তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿طه﴾
১। ত্বা-হা।
﴿مَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَىٰ﴾
২। আমি এ কুরআন তোমার প্রতি এজন্য নাযিল করেনি যে, তুমি বিপদে পড়বে।
﴿إِلَّا تَذْكِرَةً لِّمَن يَخْشَىٰ﴾
৩। এ তো একটি স্মারক এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে ভয় করে।১
১. এ বাক্যটি নিজেই পূর্ববর্তী বাক্যের অর্থের ওপর আলোকপাত করছে। উভয় বাক্য মিলিয়ে পড়লে এ পরিস্কার অর্থটি বুঝা যায় যে, কুরআন নাযিল করে আমি তোমার দ্বারা এমন কোন কাজ করাতে চাই না যা তোমার পক্ষে করা অসম্ভব। তোমাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি যে, যারা মেনে তিতে চায় না তদেরকে মানাতেই হবে। এটা তো একটা স্মরণ করা ও স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং এজন্য পাঠানো হয়েছে যে, যার মনে আল্লাহর ভয় আছে সে এটা শুনে সজাগ হবে। এখন যদি কিছু লোকের মনে আল্লাহর ভয় একদম না থেকে থাকে এবং তাদের হক ও বাতিলের কোন পরোয়াই না থাকে তাহলে তাদের পেছনে সময় নষ্ট করার কোন প্রয়োজনই তোমার নেই।
﴿تَنزِيلًا مِّمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلَى﴾
৪। যে সত্তা পৃথিবী ও সুউচ্চ আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে এটি নাযিল করা হয়েছে।
﴿الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ﴾
৫। তিনি পরম দয়াবান। (বিশ্ব-জাহানের) শাসন কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন।২
২. অর্থাৎ সৃষ্টি করার পর তিনি কোথাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েননি। বরং সৃষ্টিজগতে সমস্ত ব্যবস্থা নিজেই পরিচালনা করছেন। এই সীমাহীন রাজ্যে তিনি নিজেই রাজত্ব করছেন। তিনি কেবল স্রষ্টাই নন, কার্যত শাসকও।
﴿لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَىٰ﴾
৬। যা কিছু পৃথিবীতে ও আকাশে আছে, যাকিছু পৃথিবী ও আকাশের মাঝখানে আছে এবং যাকিছু ভুগর্ভে আছে সবকিছুর মালিক তিনিই।
﴿وَإِن تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السِّرَّ وَأَخْفَى﴾
৭। তুমি যদি নিজের কথা উচ্চকন্ঠে বলো, তবে তিনি তো চুপিসারে বলা কথা বরং তার চাইতেও গোপনে বলা কথাও জানেন।৩
৩. অর্থাৎ তোমার ও তোমার সাথীদের ওপর যেসব জুলুম নিপীড়ন চলছে এবং যেসব দুষ্কৃতি ও শয়তানী কার্যকলাপের মাধ্যমে তোমাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলোর জন্য তোমার উচ্চ কন্ঠে ফরিয়াদ জানানোর তেমন কোন দরকার নেই। তুমি কোন ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হয়েছো তা আল্লাহ খুব ভালো করেই জানেন। তিনি তোমাদের অন্তরের ডাকও শুনছেন।
﴿اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ﴾
৮। তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তাঁর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ।৪
৪. অর্থাৎ তিনি সর্বোত্তম গুণাবলীর অধিকারী।
﴿وَهَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ مُوسَىٰ﴾
৯। আর তোমার কাছে কি মূসার খবর কিছু পৌঁছেছে?
﴿إِذْ رَأَىٰ نَارًا فَقَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي آنَسْتُ نَارًا لَّعَلِّي آتِيكُم مِّنْهَا بِقَبَسٍ أَوْ أَجِدُ عَلَى النَّارِ هُدًى﴾
১০। যখন সে একটি আগুন দেখলো৫ নিজের পরিবারের লোকদেরকে বললো, “একটু দাড়াও, আমি একটি আগুন দেখেছি, হয়তো তোমাদের জন্য এক আধটি অংগার আনতে পারবো অথবা এ আগুনের নিকট আমি পথের দিশা পাবো”।৬
৫. এটা সে সময়ের কথা যখন হযরত মূসা মাদয়ানে কয়েক বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করার পর নিজের স্ত্রীকে (যার সাথে মাদয়ানে বিয়ে হয়েছিল) নিয়ে মিসরে ফিরে যাচ্ছিলেন। এর আগর ঘটনা সূরা আল কাসাসে বর্ণিত হয়েছে। এর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছেঃ হযরত মূসার হাতে একজন মিসরীয় মারা পড়ার ফলে তিনি নিজের গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার আশংকা করছিলেন। এ সময় তিনি মিসর ত্যাগ করে মাদয়ানে গিয় আশ্রয় নিয়ছিলেন।
৬. মনে হচ্ছে তখন সময়টা ছিল শীতকালের একটি রাত। হযরত মূসা সিনাই উপদ্বীপের দক্ষিণ এলাকা অতিক্রম করছিলেন। দূর থেকে একটি আগুন দেখে তিনি মনে করেছিলেন সেখান থেকে কিছু আগুন পাওয়া যাবে যার সাহায়্যে শিশু সন্তান ও পরিবারের লোকজনদের সারারাত গরম রাখার ব্যবস্থা হবে অথবা কমপক্ষে সামনের দিকে অগ্রসর হবার পথের সন্ধান পাওয়া যাবে। তিনি দুনিয়ার পথের সন্ধান পাওযার কথা চিন্তা করেছিলেন আর পেয়ে গেলেন সেখানে আখেরাতের পথ।
﴿فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ يَا مُوسَىٰ﴾
১১। সেখানে পৌঁছলে তাকে ডেকে বলা হলো, “হে মূসা! আমিই তোমার রব, জুতো, খুলে ফেলো,৭
৭. সম্ভবত এ ঘটনার কারণে ইহুদীরা তাদের শরীযাতের এ বিধান তৈরী করে নিয়েছে যে, জুতা পায়ে দিয়ে নামায পড়া জায়েয নয়। নবী সা. এ বিভ্রান্তিটি দূর করার জন্য বলেনঃ
خالِفوا اليَهودَ فإنَّهم لا يصلُّونَ في نعالِهم ولا في خِفافِهم
“ইহুদীদের বিপরীত কাজ করো। কারণ তারা জুতা ও চামড়ার মোজা পরে নামায পড়ে না।” (আবু দাউদ)
এর অর্থ এ নয় যে, জুতা পরেই নামায পড়তে হবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, এমনটি করা জায়েয। কাজেই উভয়বিধ কাজ করা। আবু দাউদে আমর ইবনে আসের রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, তিনি নবী সা.কে উভয় অবস্থায় নামায পড়তে দেখেছেন। মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদে আবু সাঈদ খূদরীর রা. রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে নবী সা. বলেছেনঃ “যখন তোমাদের কেউ মসজিদে আসে, সে যেন তার জুতা পরীক্ষা করে দেখে নেয়। যদি কোন নাপাকী লেগে থাকে তাহলে মাটিতে ঘসে পরিস্কার করো এবং সে জুতা পরে নামায পড়ে নাও।” আবু হুরাইরার রা. রেওয়ায়াতে নবী সা. এর একথাগুলো আছেঃ “যদি তোমাদের কেউ জুতা দিয়ে নাপকী মাড়িয়ে থাকে হাহলে মাটি তাকে পাক করে দেবার জন্য যথেষ্ট।” আর হযরত উম্মে সালমাহ রা. বর্ণিত রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে يطَهرُه ما بعدَه অর্থাৎ “এক জায়াগায় নাপাকী লেগে থাকলে অন্য জায়গায় যেতে যেতে মাটি নিজে নিজেই তাকে পাক করে দেবে।” এ বিপুল সংখ্যক হাদীসের কারণে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম আওযায়ী ও ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইয়াহ প্রমুখ ফকীহগণ এমত পোষণ করেন যে, জুতা সর্বাবস্থায় যমীনের মাটির সাহায্যে পাক হয়ে যায়। ইমাম আহমদ ও ইমাম শাফেঈর একটি উক্তিও এর সমর্থনে রয়েছে। কিন্তু ইমাম শাফেঈর সর্বজন পরিচিত উক্তি এর বিরোধী। সম্ভবত তিনি জুতা পরে নামায পড়া আদবের বিরোধী মনে করে তা করতে নিষেধ করেন। যদিও একথা মনে করা হয়েছে যে, তাঁর মতে জুতা মাটিতে ঘসলে পাক হয় না। (এ প্রসংগে উল্লেখ্য, মসজিদে নববীতে চাটাইয়ের বিছানাও ছিল না বরং কাঁকর বিছানো ছিল। কাজেই এসব হাদীসের প্রমাণের ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তি আজ মসজিদের বিছানার ওপর জুতা পায়ে উঠতে চায় তাহলে তা সঠিক হবে না। তবে ঘাসের ওপর বা খোলা ময়দানে জুতা পায়ে নামায পড়তে পারে। তবে যারা মাঠে-ময়দানে জানাযার নামায পড়ার সময়ও পা থেকে জুতা খুলে ফেলার ওপর জোর দিতে থাকে তারা আসলে শরীয়াতের বিধান জানে না।)
﴿إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ ۖ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى﴾
১২। তুমি পবিত্র ‘তুওয়া’ উপত্যকায় আছো।৮
৮. সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, “তুওয়া” ছিল এই উপত্যকাটির নাম। কিন্তু কোন কোন মুফাসসির “পবিত্র তুওয়া উপত্যকা” অর্থ করেছেন, “এমন উপত্যকা যাকে একটি সময়ের জন্য পবিত্র করা হয়েছে”
﴿وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا يُوحَىٰ﴾
১৩। এবং আমি তোমাকে বাছাই করে নিয়েছি, শোনো যা কিছু অহী করা হয়।
﴿إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي﴾
১৪। আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, কাজেই তুমি আমার ইবাদত করো এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম করো।৯
৯. এখানে নামাযের মূল উদ্দেশ্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। মানুষ যেন আল্লাহ থেকে গাফেল না হয়ে যায়। দুনিয়ার চোখ ধাঁধানো দৃশ্যাবলী যেন তাকে এ সত্য বিমুখ না করে দেয় যে, সে কারো বান্দা এবং সে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন নয়। এ চিন্তাকে জীবন্ত ও তরতাজা রাখার এবং আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক জড়িত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে নামায। প্রতিদিন কয়েকবার মানুষকে দুনিয়ার কাজকারবার থেকে সরিয়ে নামায তাকে আল্লাহর দিকে নিয়ে যায়।
কেউ কেউ এর এ অর্থও নিয়েছেন যে, নামায কায়েম করো যাতে আমি তোমাকে স্মরণ করতে পারি, যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ “আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাকে স্মরণে রাখবো”।
অনুসংগিকভাবে এ আয়াত থেকে এ বিধানটিও বের হয় যে, যে ব্যক্তি ভুলে যায় তার যখনই মনে পড়বে তখনই নামায পড়ে নেয়া উচিত। হাদীসে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণনা করা হয়েছেঃ নবী সা. বলেছেনঃ
مَن نَسِيَ صلاةً فلْيُصَلِّها إذا ذَكَرَها، لا كفارةً لها إلا ذلك
“কোন ব্যক্তি কোন সময় নামায পড়তে ভুলে গিয়ে থাকলে যখন তার মনে পড়ে যায় তখনই নামায পড়ে নেয়া উচিত। এছাড়া এর আর কোন কাফ্ফারা নেই”। (বুখারী, মুসলিম, আহমদ)
এ অর্থে হযরত আবু হুরাইরার রা. একটি হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এটি তাঁদের হাদীসগ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। আবু কাতাদাহ রা. বর্ণিত একটি হদীসে বলা হয়েছেঃ নবী সা.কে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি আমরা নামাযের সময় ঘুমিয়ে থাকি তাহলে কি করবো” জবাবে তিনি বলেন, “ঘুমের মধ্যে কোন দোষ নেই। দোষের সম্পর্ক তো জেগে থাকা অবস্থার সাথে। কাজেই যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ভুলে যাবে অথবা ঘুমিয়ে পড়বে তখন জেগে উঠলে বা মনে পড়লে তৎক্ষণাত নামায পড়ে নেবে”। (তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ)
﴿إِنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَىٰ كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَىٰ﴾
১৫। কিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তার সময়টা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেকটি প্রাণসত্তা তার প্রচেষ্টা অনুযায়ী প্রতিদান লাভ করতে পারে।১০
১০. তাওহীদের পরে যে দ্বিতীয় সত্যটি প্রত্যেক যুগে সকল নবীর সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে এবং যার শিক্ষা দেবার জন্য তাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছে সেটি হচ্ছে আখেরাত। এখানে কেবলমাত্র এ সত্যটি বর্ণনা করাই হয়নি বরং এর উদ্দেশ্যের ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে। এ প্রতীক্ষিত সময়টি আসার কারণ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি দুনিয়ায় যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং যে কাজ করেছে তার প্রতিদান পাবে সে আখেরাতে। তবে পরীক্ষার উদ্দেশ্য পূর্ণ করার লক্ষে সে সময়টি গোপন রাখা হয়েছে। যার আখেরাতের সামান্য চিন্তা থাকবে সে সব সময় এ সময়টির কথা ভাববে এবং এ ভাবনা তাকে ভুল পথে চলা থেকে রক্ষা করবে। আর যে ব্যক্তি বৈষয়িক কাজ কর্মের মধ্যে হারিয়ে যেতে চাইবে সে এ চিন্তার মধ্যে ডুবে যাবে যে, কিয়ামত এখনো অনেক দূরে, বহুদূরে ও তার আসার কোন চিন্হই দেখা যায় না।
﴿فَلَا يَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَن لَّا يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَىٰ﴾
১৬। কাজেই যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনে না এবং নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে গেছে সে যেন তোমাকে সে সময়ের চিন্তা থেকে নিবৃত্ত না করে। অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।
﴿وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَىٰ﴾
১৭। -আর হে মূসা! এ তোমার হাতে এটা কি?”১১
১১. জ্ঞান লাভ করার বা জানার জন্য এ প্রশ্ন ছিল না। বরং আল্লাহ জানতেন হযরত মূসার হাতে যে লাঠি আছে অন্য কিছু নয় এ ব্যাপারে যেন তিনি নিশ্চিত হয়ে যান এবং এরপর দেখেন আল্লাহর কুদরতের খেলা কিভাবে শুরু হয়।
﴿قَالَ هِيَ عَصَايَ أَتَوَكَّأُ عَلَيْهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَىٰ غَنَمِي وَلِيَ فِيهَا مَآرِبُ أُخْرَىٰ﴾
১৮। মূসা জবাব দিল, “এ আমার লাঠি। এর ওপর ভর দিয়ে আমি চলি, নিজের ছাগলগুলোর জন্য এর সাহায্যে পাতা পাড়ি এবং এর সাহায্যে আরো অনেক কাজ করি”।১২
১২. যদিও জবাবে শুধুমাত্র এতটুকু বলে দেয়াই যথেষ্ট ছিল যে, জনাব, এটা একটা লাঠি। কিন্তু হযরত মূসা এ প্রশ্নের যে লম্বা জাবাব দিলেন তা তাঁর সে সময়কার মানসিক অবস্থার একটা চমৎকার ছবি তুলে ধরেছে। সাধারণত দেখা যায়, মানুষ যখন কোন বড় ব্যক্তির সাথে কথা বলার সুযোগ পায় তখন নিজের কথা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে, যাতে তার সাথে বেশীক্ষণ কথা বলার সৌভাগ্য লাভ করা যায়।
﴿قَالَ أَلْقِهَا يَا مُوسَىٰ﴾
১৯। বললেন, একে ছুঁড়ে দাও হে মূসা”!
﴿فَأَلْقَاهَا فَإِذَا هِيَ حَيَّةٌ تَسْعَىٰ﴾
২০। সে ছূঁড়ে দিল এবং অকস্মাত সেটা হয়ে গেলো একটা সাপ, যা দৌড়াচ্ছিল।
﴿قَالَ خُذْهَا وَلَا تَخَفْ ۖ سَنُعِيدُهَا سِيرَتَهَا الْأُولَىٰ﴾
২১। বললেন, “ধরে ফেলো ওটা এবং ভয় করো না, আমি ওকে আবার ঠিক তেমনটিই করে দেবা যেমনটি সে আগে ছিল।
﴿وَاضْمُمْ يَدَكَ إِلَىٰ جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاءَ مِنْ غَيْرِ سُوءٍ آيَةً أُخْرَىٰ﴾
২২। আর তোমার হাতটি একটু বগলের মধ্যে রাখো, তা কোনপ্রকার ক্লেশ ছাড়াই উজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে আসবে,১৩ এটা দ্বিতীয় নিদর্শন।
১৩. অর্থাৎ সূর্যের আলোর মতো আলো হবে কিন্তু এর ফলে তোমার কোন কষ্ট হবে না। বাইবেলে সাদা হাতের ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং সেখান থেকে আমাদের তাফসীরগুলোতেও এর প্রচলন হয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে এই যে, হযরহ মূসা যখন বগলে হাত রেখে বাইরে বের করলেন তখন দেখা গেলো পুরো হাতটাই কুষ্টরোগীর হাতের মতো সাদা হয়ে গেছে। তারপর আবার যখন তা বগলে রাখলেন তখন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। এ মুজিযাটির এ ব্যাখ্যাই তালমুদেও বর্ণিত হয়েছে এবং এর গূঢ় তত্ত্ব বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে যে, ফেরাউনের কুষ্ঠরোগ ছিল এবং এ রোগ সে লুকিয়ে রেখেছিল। আহ তার সামনে এ মুজিযা পেশ করে তাকে দেখানো হয়েছে যে, দেখো মুহুর্তের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ সৃষ্টি করে মুহুর্তের মধ্যেই তা নিরাময় করা যায়। কিন্তু প্রথমত ভারসাম্যপূর্ণ রুচিশীলতা কোন নবীকে কুষ্ঠরোগের মুজিযা দিয়ে এক বাদশাহর দরবারে পাঠানোর ব্যাপারটিই গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। দ্বিতীয়ত ফেরাউনের যদি অপ্রকাশ্য কুষ্ঠরোগ থেকে থাকে তাহলে কুষ্ঠরোগীর সাদা হাত শুধুমাত্র তার একার জন্য মুজিযা হতে পারে, তার সভাসদদের ওপর এ মুজিযার কী প্রভাব পড়বে” কাজেই সঠিক কথা এটাই, যা আমরা উপরে বর্ণনা করেছি। অর্থাৎ তাঁর হাত সূর্যালোকের মতে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠতো এবং চোখ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো না। প্রথম যুগের মুফাসসিরদের অনেকেই এ অর্থ গ্রহণ করেছেন।
﴿لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى﴾
২৩। এজন্য যে, আমি তোমাকে নিজের বৃহৎ নিদর্শনগুলো দেখাবো।
﴿اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ﴾
২৪। এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে”।
﴿قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي﴾
২৫। মূসা বললো, “হে আমার রব!
﴿وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي﴾
২৬। আমার বুক প্রশস্ত করে দাও।১৪
১৪. অর্থাৎ আমার মনে এ মহান দায়িত্বভার বহন করার মতো হিম্মত সৃষ্টি করে দাও। আমার উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়িয়ে দাও। যেহেতু হযরত মূসাকে আ. একটি অনেক বড় কাজের দায়িত্ব সোপর্দ করা হচ্ছিল যা করার জন্য দুরন্ত সাহসের প্রয়োজন তাই তিনি দোয়া করেন, আমাকে এমন ধৈর্য, দৃঢ়তা, সংযম, সহনশীলতা, নির্ভীকতা ও দুর্জয় সংকল্প দান করো যা এ কাজের জন্য প্রয়োজন।
﴿وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي﴾
২৭। আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও
﴿يَفْقَهُوا قَوْلِي﴾
২৮। এবং আমার জিভের জড়তা দূর করে দাও, যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে।১৫
১৫. বাইবেলে এর যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসা বললেনঃ “হায় সদাপ্রভু! আমি বাকপটু নহি, ইহার পূর্বও ছিলাম না, বা এই দাসের সহিত তোমার আলাপ করিবার পরেও নহি। কারণ আমি জড়মুখ ও জড় জিহ্বা। (যাত্রা পুস্তুকঃ ৪:১০) কিন্তু তালমূদে এ সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে একথা বলা হয়েছে যে, শৈশবে হযরত মূসা যখন ফেরাউনের গৃহে লালিত পালিত হচ্ছিলেন তখন একদিন তিনি ফেরাউনের মাথার মুকুট নামিয়ে নিজের মাথায় পরে নেন। এতে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এ শিশু এ কাজটি ইচ্চাকৃতভাবে করেছে, অথবা এটা তার নিছক বালকসূলভ চপলতা। শেষে ঠিক করা হয়, শিশুর সামনে সোনা ও আগুন একসাথে রাখা হবে। সে মোতাবেক দু’টি জিনিস এনে একসাথে সামনে রাখা হলো এবং হযরত মূসা আগুন উঠিয়ে মুখে পুরে দিলেন। এতে তিনি কোন রকমে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার জিহ্বায় চিরদিনের জন্য জড়তা সৃষ্টি হয়।
এ কাহিনী ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আমাদের তাফসীর প্রন্থগুলোতেও লিখিত হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি ও কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে। কারণ শিশু যদি আগুনে হাত দিয়েও ফেলে তাহলে এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, সে অংগার উঠিয়ে নিয়ে মুখের মধ্যে পুরে দেবে। শিশু তো আগুনের জ্বালা অনুভব করার সাথে সাথেই হাত গুটিয়ে নেবে। পোড়া হাতে অংগার নিয়ে সে অংগার মুখে দেবার অবকাশ পাবে কেমন করে? কুরআনের শব্দাবলী থেকে আমরা যে কথা বুঝতে পারি তা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসা আ. নিজের মধ্যে বাগ্মীতার অভাব দেখছিলেন। ফলে তাঁর মনে আশংকা জেগেছিল যে, নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি তাঁর কখনো বক্তৃতা দেবার প্রয়োজন দেখা দেয় (এ পর্যন্ত যার কোন প্রয়োজন তাঁর দেখা দেয়নি) তাহলে তাঁর স্বভাবসূলভ সংকোচ বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই তিনি দোয়া করেন, হে আল্লাহ। আমার জিভের জড়তা দূর করে দাও যাতে আমি নিজের কথা লোকদেরকে ভালোভাবে বুঝাতে পারি। এ বিষয়েই ফেরাউন একবার তাঁকে খোঁটা দিয়ে বলেছিলঃ “এ ব্যক্তি তো নিজের কথাই সঠিকভাবে বলতে পারে না”। (لَا يَكَادُ يُبِينُ
যুখরুফঃ ৫২) এ দুর্বলতা অনুভব করেই হযরত মূসা নিজের ভাই হারুনকে সাহায্যকারী হিসেবে চান। সূরা আল কাসাসে তার এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে যে,
وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا
“আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে বাকপটু তাকে সাহায্যকারী হিসেবে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও”। (আল কাসাসঃ ৩৪) পরবর্তী আলোচনায় আরো জানা যায় যে, হযরত মূসার এ দুর্বলতা দূর হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি বেশ জোরদার ভাষণ দিতে শুরু করেছিলেন। কুরআনে ও বাইবেলে তাঁর পরবর্তীকালের যেসব ভাষণ উদ্ধৃত হয়েছে তা উন্নত পর্যায়ের শাব্দিক অলংকার ও বাকপটুতার সাক্ষ্য দেয়।
জিভে জড়াতা আছে এমন একজন তোতলা ব্যক্তিকে আল্লাহ নিজের রাসূল নিযুক্ত করবেন, একথা স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি বিরোধী। রাসূলরা সব সময় এমন ধরনের লোক হয়েছেন যারা চেহারা, সুরত ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার দিক দিয়ে হয়েছেন সর্বোত্তম, যাদের ভেতর বাইরের প্রতিটি দিক অন্তর ও দৃস্টিকে প্রভাবিত করেছে। কোন রাসূলকে এমন কোন দোষ সহকারে পাঠানো হয়নি এবং পাঠানো যেতে পারতো না যে কারণে তিনি লোকদের মধ্যে হাস্যাস্পদ হন অথবা লোকেরা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে।
﴿وَاجْعَل لِّي وَزِيرًا مِّنْ أَهْلِي﴾
২৯। আর আমার জন্য নিজের পরিবার থেকে সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করে দাও
﴿هَارُونَ أَخِي﴾
৩০। আমার ভাই হরুনকে।১৬
১৬. বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে হযরত হারুন হযরত মূসার চাইতে তিন বছরের বড় ছিলেন। (যাত্রা পুস্তকঃ ৭:৭)
﴿اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي﴾
৩১। তার মাধ্যমে আমার হাত মজবুত করো
﴿وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي﴾
৩২। এবং তাকে আমার কাজে শরীক করে দাও,
﴿كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا﴾
৩৩। যাতে আমরা খুব বেশী করে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারি,
﴿وَنَذْكُرَكَ كَثِيرًا﴾
৩৪। এবং খুব বেশী করে তোমার চর্চা করি।
﴿إِنَّكَ كُنتَ بِنَا بَصِيرًا﴾
৩৫। তুমি সব সময় আমাদের অবস্থার পর্যবেক্ষক”।
﴿قَالَ قَدْ أُوتِيتَ سُؤْلَكَ يَا مُوسَىٰ﴾
৩৬। বলেলেন, “হে মূসা! তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেওয়া হলো।
﴿وَلَقَدْ مَنَنَّا عَلَيْكَ مَرَّةً أُخْرَىٰ﴾
৩৭। আমি আর একবার তোমার প্রতি অনুগ্রহ করলাম।১৭
১৭. এরপর আল্লাহ হযরত মূসাকে তাঁর জন্ম থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত তার প্রতি যতগুলো অনুগ্রহ করা হয়েছিল, এক এক করে তার সবক’টি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন। সূরা আল কাসাসে এ ঘটনাগুলো বিস্থারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে কেবলমাত্র ইংহিত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে হযরত মূসাকে এ অনুভূতি দান করা যে, এখন যে কাজে তোমাকে নিযুক্ত করা হচ্ছে এ কাজের জন্যই তোমাকে পয়দা করা হয়েছে এবং এ কাজের জন্যই আজ পর্যন্ত বিশেষ সরকারী তত্ত্বাবধানে তুমি প্রতিপালিত হয়ে এসেছো।
﴿إِذْ أَوْحَيْنَا إِلَىٰ أُمِّكَ مَا يُوحَىٰ﴾
৩৮। সে সময়ের কথা মনে করো যখন আমি তোমার মাকে ইশারা করেছিলাম, এমন ইশারা যা অহীর মাধ্যমে করা হয়, এই মর্মে এই এ শিশুকে সিন্দুকের মধ্যে রেখে দাও এবং সিন্দুকটি দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও, দরিয়া তাকে তীরে নিক্ষেপ করবে এবং আমার শত্রু ও এ শিশুর শত্রু একে তুলে নেবে।
﴿أَنِ اقْذِفِيهِ فِي التَّابُوتِ فَاقْذِفِيهِ فِي الْيَمِّ فَلْيُلْقِهِ الْيَمُّ بِالسَّاحِلِ يَأْخُذْهُ عَدُوٌّ لِّي وَعَدُوٌّ لَّهُ ۚ وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّي وَلِتُصْنَعَ عَلَىٰ عَيْنِي﴾
৩৯। আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলাম এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও।
﴿إِذْ تَمْشِي أُخْتُكَ فَتَقُولُ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ مَن يَكْفُلُهُ ۖ فَرَجَعْنَاكَ إِلَىٰ أُمِّكَ كَيْ تَقَرَّ عَيْنُهَا وَلَا تَحْزَنَ ۚ وَقَتَلْتَ نَفْسًا فَنَجَّيْنَاكَ مِنَ الْغَمِّ وَفَتَنَّاكَ فُتُونًا ۚ فَلَبِثْتَ سِنِينَ فِي أَهْلِ مَدْيَنَ ثُمَّ جِئْتَ عَلَىٰ قَدَرٍ يَا مُوسَىٰ﴾
৪০। স্মরণ করো, যখন তোমার বোন চলছিল, তারপর গিয়ে বললো, “আমি কি তোমাদের তার সন্ধান দেবো যে এ শিশুকে ভালোভাবে লালন করবে?” এভাবে আমি তোমাকে আবার তোমার মায়ের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি, যাতে তার চোখ শীতল থাকে এবং সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ না হয়। এবং (এটাও স্মরণ করো) তুমি একজনকে হত্যা করে ফেলেছিলে, আমি তোমাকে এ ফাঁদ থেকে বের করেছি এবং তোমাকে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এসেছি, আর তুমি মাদ্য়ানবাসীদের মধ্যে কয়েক বছর অবস্থান করেছিলে। তারপর এখন তুমি এখন তুমি ঠিক সময়েই এসে গেছো। হে মূসা!
﴿وَاصْطَنَعْتُكَ لِنَفْسِي﴾
৪১। আমি তোমার নিজের জন্য তৈরী করে নিয়েছি।
﴿اذْهَبْ أَنتَ وَأَخُوكَ بِآيَاتِي وَلَا تَنِيَا فِي ذِكْرِي﴾
৪২। যাও, তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনগুলোসহ এবং দেখো আমার স্মরণে ভুল করো না।
﴿اذْهَبَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ﴾
৪৩। যাও, তোমরা দু’জন ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে।
﴿فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ﴾
৪৪। তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে”।১৮
১৮. মানুষ দু’ভাবে সঠিক পথে আসে। সে নিজে বিচার-বিশ্লেষণ করে বুঝে-শুনে ও উপদেশবাণীতে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করে অথবা অশুভ পরিণামের ভয়ে সোজা হয়ে যায়।
﴿قَالَا رَبَّنَا إِنَّنَا نَخَافُ أَن يَفْرُطَ عَلَيْنَا أَوْ أَن يَطْغَىٰ﴾
৪৫। উভয়েই ১৮(ক) বললো, “হে আমাদের রব! আমাদের ভয় হয়, সে আমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবে অথবা আমাদের ওপর চড়াও হবে”।
১৮(ক). মনে হচ্ছে এটা এমন সময়ের কথা যখন হযরত মূসা আ. মিসরে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং হযরত হারুন কার্যত তাঁর সাথে শরীক হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় ফেরাউনের কাছে যাওয়ার আগে উভয়েই আল্লাহর কাছে এ নিবেদন পেশ করে থাকবেন।
﴿قَالَ لَا تَخَافَا ۖ إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَىٰ﴾
৪৬। বললেন, “ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, সবকিছু শুনছি ও দেখছি।
﴿فَأْتِيَاهُ فَقُولَا إِنَّا رَسُولَا رَبِّكَ فَأَرْسِلْ مَعَنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَا تُعَذِّبْهُمْ ۖ قَدْ جِئْنَاكَ بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكَ ۖ وَالسَّلَامُ عَلَىٰ مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَىٰ﴾
৪৭। যাও তার কাছে এবং বলো, আমরা তোমার রবের প্ররিত, বনী ইসরাঈলকে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিয়ো না। আমরা তোমার কাছে নিয়ে এসেছি তোমার রবের নিদর্শন এবং শান্তি ও তার জন্য যে সঠিক পথ অনুসরণ করে।
﴿إِنَّا قَدْ أُوحِيَ إِلَيْنَا أَنَّ الْعَذَابَ عَلَىٰ مَن كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰ﴾
৪৮। আমাদের অহীর সাহায্যে জানানো হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্য যে মিথ্যা আরোপ করে, ও মুখ ফিরিয়ে নেয়”।১৯
১৯. এ ঘটনাটি বাইবেল ও তালমূদে যেভাবে পেশ করা হয়েছে তার ওপরও একবার নজর বুলানো দরকার। এর ফলে কুরআন মজীদ আম্বিয়া আ. এর কথা কেমন মর্যাদা সহকারে বর্ণনা করেছে এবং বনী ইসরাঈলের বর্ণনসমূহে এর কি চিত্র অংকন করা হয়েছে তা আন্দাজ করা যাবে। বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, প্রথমবার আল্লাহ যখন মূসাকে বললেন, “এখন আমি তোমাকে ফেরাউনের কাছে পাঠাচ্ছি এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি আমার জাতি বনী ইসরাঈলকে মিসর থেকে বের করে আনবে” তখন হযরত মূসা জবাব দিলেন, “ফেরাউনের কাছে যাবার এবং বনী ইসরাঈলকে মিসর থেকে বের করে আনার আমি কে”? তারপর আল্লাহ হযরত মূসাকে অনেক বুঝালেন, তাঁর মনে শক্তি সঞ্চার করলেন, মুজিযা দান করলেন কিন্তু মূসা আবার এ কথাই বললেন, “হে আমার প্রভূ বিনয় করি, অন্য যাহার হাতে পাঠাইতে চাও এ বার্তা পাঠাও”। (যাত্রাপুস্তকঃ ৩-১৩) তালমূদের বর্ণনা আবার এর চাইতে কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ এ ব্যাপারটি নিয়ে আল্লাহ ও হযরত মূসার সাথে সাতদিন পর্যন্ত বাদানুবাদ হতে থাকে। আল্লাহ বলতে থাকেন, নবী হও। কিন্তু মূসা বলতে থাকেন, আমার কণ্ঠই খুলছে না, কাজেই আমি নবী হই কেমন করে। শেষে আল্লাহ বললেন, তুমি নবী হয়ে যাও এতেই আমি খুশী। একথায় হযরত মূসা বলেন, লূতকে বাঁচাবার জন্য আপনি ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন, হাজেরা যখন সারার গৃহ থেকে বের হলেন তখন তার জন্য পাঁচজন ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন, আর এখন নিজের বিশেষ সন্তান (বনী ইসরাঈল)-দেরকে মিসর থেকে বেরকরে আনার জন্য আপনি আমাকে পাঠাচ্ছেন? একথায় আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন এবং তিনি রিসালাতের কাজে তাঁর সাথে হারুনকে শরীক করে দিলেন। আর মূসার সন্তানদের বঞ্চিত করে পৌরহিত্যের দায়িত্ব হারুনের সন্তানদের দিয়ে দিলেন-এগুলোই হচ্ছে প্রাচীন কিতাব এবং নির্লজ্জ লোকেরা এগুলো সম্পর্কে বলে থাকে যে, কুরআনের এ কাহিনীগুলো নাকি এসব কিতাব থেকে নকল করা হয়েছে।
﴿قَالَ فَمَن رَّبُّكُمَا يَا مُوسَىٰ﴾
৪৯। ফেরাউন২০ বললো, “আচ্ছা, তাহলে তোমাদের দু’জনের রব কে হে মূসা?”২১
২০. হযরত মূসা কিভাবে ফেরাউনের কাছে পৌছলেন এবং কিভাবে তার সামনে নিজের দাওয়াত পেশ করলেন এসব বিস্তারিত বিবরণ এখানে পরিহার করা হয়েছে। সূরা আল আ’রাফের ১৩ রুকূতে এক আলোচনা এসেছে। আর সামনের দিকে সূরা আশ শুআ’রার ২-৩, সূরা আল কাসাসের ১৪ এবং সূরা আন নাযিআতের ১ রুকূতে এ আলোচনা করা হয়েছে।
ফেরাউন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদির জন্য তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফের ৮৫ টীকা দেখুন।
২১. দুই ভাইয়ের মধ্যে যেহেতু মূল নবী ছিলেন হযরত মূসা আ. এবং দাওয়াতদানের তিনিই ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব তাই ফেরাউন তাঁকেই সম্বোধন করে। আর হতে পারে তাঁকে সম্বোধন করার তার আর একটি কারণও থাকতে পারে। অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য এও হতে পারে যে, সে হযরত হারুনের বাকপটুতা ও উন্নত বাগ্মীতার মুখোমুখি হতে চাচ্ছিল না এবং বাগ্মীতার ক্ষেত্রে হযরত মূসার দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করতে চাচ্ছিল। ইতিপূর্বে এ আলোচনা করা হয়েছে।
ফেরাউনের এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল, তোমরা দু’জন আবার কাকে রব বানিয়ে নিয়েছো, মিসর ও মিসরবাসীদের রব তো আমিই। সূরা আন নাযিআতে তার এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, أَنَا۠ رَبُّكُمُ ٱلْأَعْلَىٰ হে মিসর বাসীরা! আমি তোমাদের প্রধানতম রব। সূরা আয যুখরুফে সে দরবারের সমস্ত লোকদের সম্বোধন করে বলেঃ
يا قَوْمِ أَلَيْسَ لِي مُلْكُ مِصْرَ وَهَٰذِهِ الْأَنْهَارُ تَجْرِي مِن تَحْتِ
“হে আমার জাতি! মিসরের রাজত্বের মালিক কি আমি নই? আর এ নদীগুলো কি আমার নীচে প্রবাহিত হচ্ছে না?” (আয়াতঃ ৫১ ) সূরা আল কাসাসে সে নিজের সভাসদদের সামনে এভাবে হুংকার দিয়ে বলেঃ
يا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَل لِّي صَرْحًا لَّعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَىٰ إِلَٰهِ مُوسَىٰ
“হে জাতির সরদারগণ! আমি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। হে হামান! কিছু ইট পোড়াও এবং আমার জন্য এটি উঁচু ইমারত নির্মাণ করো। আমি উপরে উঠে একবার দেখি তো এই মূসা কাকে আল্লাহ বানাচ্ছে”। (আয়াতঃ ৩৮)
সূরা আশ শূআ’রায় সে হযরত মূসাকে ধমক দিয়ে বলেঃ
لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَٰهًا غَيْرِي لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ
“যদি আমাকে ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বানিয়েছো তাহলে মনে রেখো, তোমাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেবো”। (আয়াতঃ ২৯)
এর অর্থ এ নয় যে, ফেরাউন তার জাতির একমাত্র মাবুদ ছিল এবং সেখানে তার ছাড়া আর করো পূজা হতো না। এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে, ফেরাউন নিজেকে সূর্য দেবতার (র’ বা রা’) আতার হিসেবে বাদশাহের দাবীদার বলতো। তাছাড়া মিসরের ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণিত যে, বহু দেবী ও দেবতার পূজা_উপাসনা করা ছিল এ জাতির ধর্ম। তাই “একমাত্র পূজনীয়” হবার দাবী ফেরাউনের ছিল না। বরং সে কার্যত মিসরের এবং আদর্শগতভাবে সমগ্র মানব জাতির রাজনৈতিক প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের দাবীদার ছিল। সে একথা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না যে, অন্য কোন সত্তা তার ওপর কর্তৃত্ব করবে, তার প্রতিনিধি এসে তাকে হুকুম দেবে এবং তার কাছে এ হুকুমের আনুগত্য করার দাবী জানাবে। তার আত্নগর্ব ও ঔদ্ধত্যের কারণে কোন কোন লোকের ধারণা হয়েছে, সে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো এবং নিজে ইলাহ ও উপাস্য হবার দাবীদার ছিল। কিন্তু একথা কুরআন থেকে প্রমাণিত যে, সে উর্ধ জগতে অন্য কারো শাসন কর্তৃত্ব স্বীকার করতো। সূরা আল মু’মিনঃ ২৮-৩৪ এবং সূরা আয যুখরুফঃ ৫৩ আয়াত গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ুন। এ আয়াত গুলো একতা প্রমাণ করছে যে, আল্লাহ ও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সে অস্বীকার করতো না। তবে তার রাজনৈতিক প্রভুত্বে কেউ হস্তক্ষেপ করবে এবং আল্লাহর কোন রাসূল এসে তার ওপর হুকুম চালাবে, এটা মেনে নিতে সে প্রস্তুত ছিল না। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল কাসাসঃ ৫৩ টীকা)
﴿قَالَ رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَىٰ كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَىٰ﴾
৫০। মূসা জবাব দিল, “আমাদের রব তিনি২২ যিনি প্রত্যেক জিনিসকে তার আকৃতি দান করেছেন তারপর তাকে পথ নির্দেশ দিয়েছেন।২৩
২২. অর্থাৎ আমরা সকল অর্থে একমাত্র তাঁকেই রব মানি। প্রতিপালক, প্রভূ, মালিক, শাসক ইত্যাকার সকল অর্থেই আমরা তাঁকে ছাড়া আর কাউকেও রব বলে স্বীকার করি না।
২৩. অর্থাৎ দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিস তাঁরই নির্মাণ কৌশলে নির্মিত হয়েছে। প্রত্যেকটি জিনিসকে তিনিই আকার-আকৃতি, পঠনশৈলী, শক্তি, যোগ্যতা, গোণ ও বিশষত্ব দান করেছেন। দুনিয়ায় কাজ করার জন্য হাতের যে গঠনাকৃতির প্রয়োজন ছিল তা তিনি তাকে দিয়েছেন। পায়ের জন্য যে সর্বাধিক উপযুক্ত গঠনাকৃতির দরকার তা তাকে দিয়েছেন। মানুষ, পশু, উদ্ভিদ, জড় পদার্থ, বাতাস, পানি, আলো, প্রত্যেককে তিনি এমন বিশেষ আকৃতি দান করেছেন যা এ বিশ্ব-জাহানে তার নিজের অংশের কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন ছিল।
তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিসকে কেবল তার বিশষ আকৃতি দান করেই এমনিভাবে ছেড়ে দেননি। বরং তিনিই সবাইকে পথও দেখিয়েছেন। দুনিয়ায় এমন কোন জিনিস নেই যাকে তিনি নিজের গঠনাকৃতিকে কাজে লাগাবার এবং নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ করার পদ্ধতি শেখাননি। কানকে শুনা ও চোখকে দেখা তিনিই শিখিয়েছেন। মাছকে সাঁতার কাটার ও পাখিকে উড়ার শিক্ষা তিনিই দিয়েছেন। গাছকে ফুল ও ফল দেবার ও মাটিকে উদ্ভিদ উৎপাদান করার নির্দেশ তিনিই দিয়েছেন। মোট কথা তিনি সারা বিশ্ব-জাহান এবং তার সমস্ত জিনিসের শুধুমাত্র স্রষ্টাই নন বরং তাদের শিক্ষক ও পথ প্রদর্শকও।
এ অতুলনীয় ব্যাপক অর্থবহুল ও সংক্ষিপ্ত বাক্যে হযরত সূসা আ. শুধু একথাই বলেননি যে, তাঁর রব কে? বরং একথাও বলে দিয়েছেন যে, তিনি রব কেন এবং কেন তাঁকে ছাড়া আর কাউকে রব বলে মেনে নেয়া যেতে পারে না। দাবীর সাথে সাথে তার যুক্তি-প্রমাণও এই ছোট্ট বাক্যটির মধ্যে এসে গেছে। একথা সুস্পস্ট যে, যখন ফেরাউন ও তার প্রত্যেকটি প্রজা তার নিজের বিশষ অস্তিত্বের জন্য আল্লাহর অনুগৃহীত এবং যখন তাদের এক জনেরও শ্বাসযন্ত্র, পাস্থলী ও হৃদযন্ত্র আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশ অনুসারে নিজের কাজ করে না যাওয়া পর্যন্ত সে এক মুহুর্তের জন্যও জীবিত থাকতে পারে না তখন ফেরাউনের নিজেকে লোকদের রব বলে দাবী করা এবং লোকদের কার্যত তাকে নিজেদের রব বলে মেনে নেয়া একটা নির্বুদ্ধিতা ও বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
আবার এ ছোট্ট বাক্যে হযরত মূসা আ. ইশারায় রিসালাতের যুক্তিও পেশ করে দিয়েছেন। ফেরাউন এই রিসালাত মেনে নিতে অস্বীকার করছিল। হযরত মূসার যুক্তির মধ্য এ ইংগিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহ যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের পথনির্দেশক এবং যিনি প্রত্যেকটি বস্তুকে তার অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে পথ নির্দেশনা দিচ্ছেন, তাঁর পথ নির্দেশনা দেবার বিশ্বজনীন দায়িত্বের অপরিহার্য দাবী হচ্ছে এই যে, তিনি মানুষের সচেতন জীবনের জন্যও পথনির্দেশনা দেবার ব্যবস্থা করবেন। আর মাছ ও মুরগীর জন্য যে ধরনের পথনির্দেশনা উপযোগী, মানুষের সচেতন জীবনের জন্য সে ধরনের পথনির্দেশনা উপযোগী হতে পারে না। এর সবচেয়ে মানানসই পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, একজন সচেতন মানুষ তাঁর পক্ষ থেকে মানুষদের পথ দেখাবার জন্য নিযুক্ত হবেন এবং তিনি মানুষদের বুদ্ধি ও চেতনার প্রতি আবেদন জানিয়ে তাদেরকে সঠিক-সোজা পথ দেখাবেন।
﴿قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَىٰ﴾
৫১। ফেরাউন বললো, “আর পূর্ববর্তী বংশধর যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের তাহলে কি অবস্থা ছিল?”২৪
২৪. অর্থাৎ ব্যাপার যদি এটাই হয়ে থাকে যে, যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে আকৃতি দিয়েছেন এবং তাকে দুনিয়ায় কাজ করার পথ বাতলে দিয়েছেন তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন রব নেই, তাহলে এ আমাদের সবার বাপ-দাদারা, যারা বংশ পরস্পরায় ভিন্ন প্রভূ ও ইলাহর বন্দেগী করে চলে এসেছে তোমাদের দৃষ্টিতে তাদের অবস্থান কোথায় হবে? তারা সবাই কি গোমরাহ ছিল? তারা সবাই কি আযাবের হকদার ছিল? তাদের সবার কি বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছিল? এ ছিল ফেরাউনের কাছে হযরত মূসার এ যুক্তির জবাব। হতে পারে সে মুর্খতা ও অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে এ জবাব দিয়েছে। আবার দুষ্টামির কারণও এ জবাব দিতে পারে। তাছাড়া ও উভয় কারণই এ জবাবের পিছনে সক্রিয় থাকতে পারে। অর্থাৎ সে নিজেও এ কথায় রাগান্বিত হয়েছে যে এ ধর্মের কারণে আমাদের সকল বুযর্গ যে পথভ্রষ্ট ছিল তা মেনে নিতে হবে আবার সাথে সাথে নিজের সভাসদ ও সাধারণ মিসরবাসীদের মনে হযরত মূসার দাওয়াতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করাও এ উদ্দশ্য হতে পারে। সত্যপন্থীদের সত্য প্রচারের বিরুদ্ধেএ অস্ত্রটি হামেশা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মুর্খদের কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য এটা বড়ই প্রভাবশালী প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে যে সময় কুরআনের এ আয়াত গুলো নাযিল হয় সে সময় মক্কায় নবী সা. এর দাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সবচাইতে বেশী ও অস্ত্রটিকেই কাজে লাগানো হয়েছিল। তাই হযরত মূসার মোকাবিলায় ফেরাউনের এ ছলনার উল্লেখ যথার্থই ছিল।
﴿قَالَ عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي فِي كِتَابٍ ۖ لَّا يَضِلُّ رَبِّي وَلَا يَنسَى﴾
৫২। মূসা বললো “সেজ্ঞান আমার রবের কাছে লিপিবদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। আমার রব ভুলও করেন না, বিস্মৃতও হন না”।২৫
২৫. এটি হযরত মূসার সে সময় প্রদত্ত একটি অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ জবাব। এ থেকে প্রচার কৌশল সম্পর্কে ভালো শিক্ষা লাভ করা যায়। উপরের বর্ণনা অনুসারে ফেরাউনের উদ্দেশ্য ছিল শ্রোতাদের এবং তাদের মাধ্যমে সমগ্র জাতির মনে বিদ্বেষের আগুন জ্বালানো। যদি হযরত মূসা বলতেন, হাঁ, তারা সবাই মুর্খ ও পথভ্রষ্ট ছিল এবং সবাই জাহান্নামের ইন্ধন হবে, তাহলে এটা সত্য কথনের বিরাট আদর্শ হলেও এ জবাব হযরত মূসার পরিবর্তে ফেরাউনের উদ্দেশ্য সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। তাই তিনি পূর্ণ বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষনতা সহকারে এমন জবাব দেন যা ছিল একদিকে যথার্থ সত্য এবং অন্যদিকে ফেরাউনের বিষ দাঁতও উঁপরে ফেলতে সক্ষম। তিনি বলেন, তারা যাই কিছু ছিল, নিজেদের কাজ করে আল্লাহর কাছে পৌছে গেছে। তাদের কার্যাবলী এবং কাজের পেছনে নিহিত অন্তরের ইচ্ছাসমূহ জানার কোন উপায় নেই। কাজেই তাদের ব্যাপারে আমি কোন সিদ্ধান্ত দিই কেমন করে? তাদের সমস্ত রেকর্ড আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত আছে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ও তার কারণসমূহের খবর আল্লাহই জানেন। কোন জিনিস আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে থাকেনি এবং তাঁর স্মৃতি থেকেও কোন জিনিস বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আল্লাহই জানেন তাদের সাথে কি ব্যবহার করতে হবে। তাদের ভূমিকা কি ছিল এবং তাদের পরিণাম কি হবে, তোমার ও আমার এ কথা চিন্তা করা উচিত নয়। আমাদের চিন্তা করা উচিত। আমাদের ভূমিকা কি এবং আমরা কোন ধরনের পরিণামের সম্মুখীন হবো।
﴿الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَسَلَكَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّن نَّبَاتٍ شَتَّىٰ﴾
৫৩। –তিনিই২৬ তোমাদের জন্য যমীনের বিছানা বিছিয়েছেন, তার মধ্যে তোমাদের চলার পথ তৈরী করেছেন এবং উপর থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, তারপর তার মাধ্যমে আমি বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করি।
২৬. কথার ধরন থেকে বুঝা যাচ্ছে, হযরত মূসার জবাব “বিস্মৃতও হন না” এ এসে শেষ হয়ে গেছে এবং এখান থেকে শেষ প্যারা পর্যন্ত সমস্ত ভাষ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা ও স্মারক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনে এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। অতীতে ঘটেছে বা আগামীতে ঘটবে এমন কোন ঘটনা বর্ণনা প্রসংগে যখন কোন ব্যক্তির কোন উক্তি উদ্ধৃত করা হয় তখন তার পরপরই উপদেশ, ব্যাখ্যা বা বিস্তারিত বিবরণ হিসেবে কয়েকটি অতিরিক্ত বাক্য বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কথার ধরন থেকেই জানা যায় যে, এগুলো ইতিপূর্বে যে ব্যক্তির কথার আলোচনা চলছিল তার উক্তি নয় বরং আল্লাহর নিজের উক্তি।
উল্লেখ্য, এ ভাষ্যের সম্পর্কে কেবলমাত্র নিকটবর্তী বাক্য “আমার রব ভুলও করেন না, বিস্মৃত ও হন না” এর সাথে নেই বরং হযরত মূসা আ. এর সমগ্র বক্তব্যের সাথে রয়েছে এর সম্পর্ক, যা رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَىٰ كُلَّ شَيْءٍ থেকে শুরু হয়েছে।
﴿كُلُوا وَارْعَوْا أَنْعَامَكُمْ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّأُولِي النُّهَىٰ﴾
৫৪। খাও এবং তোমাদের পশুও চরাও। অবশ্যি এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শনাবলী।২৭
২৭. অর্থাৎ যারা ভারসাম্যপূর্ণ সুস্থ বিবেক বুদ্ধি ব্যবহার করে সত্য অনুসন্ধান করতে চান তারা এ নির্দেশনাবলীর সহায়তায় প্রকৃত সত্যের মনযিলে পৌছার পথ জানতে পারেন। এ নিদর্শনাবলী তাদেরকে একথা জানিয়ে দেবে যে, এ বিশ্ব-জাহানের একজন রব আছেন এবং সমগ্র রবুবিয়াত ও ইলাহী কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁরই হাতে কেন্দ্রীভূত। অন্য কোন রবের জন্য এখানে কোন অবকাশ নেই।
﴿مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَىٰ﴾
৫৫। এ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরি মধ্যে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো এবং এ থেকেই আবার তোমাদেরকে বের করবো।২৮
২৮. অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিকে অনিবার্যভাবে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হবে। একটি পর্যায় হচ্ছে, বর্তমান জগতে জম্ম থেকে মৃত্যু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত এবং তৃতীয়টি হচ্ছে কিয়ামতের দিন পুনর্বার জীবিত হবার পরের পর্যায়। এই আয়াতের দৃষ্টিতে এ তিনটি পর্যায়ই অতিক্রান্ত হবে এ যমীনের ওপর।
﴿وَلَقَدْ أَرَيْنَاهُ آيَاتِنَا كُلَّهَا فَكَذَّبَ وَأَبَىٰ﴾
৫৬। আমি ফেরাউনকে আমার সমস্ত নিদর্শন দেখালাম২৯ কিন্তু সে মিথ্যা আরোপ করতে থাকলো এবং মেনে নিল না।
২৯. অর্থাৎ পৃথিবী ও প্রাণী জগতের যুক্তি-প্রমাণসমূহের নিদর্শনাবলী এবং হযরত মূসাকে আ. প্রদত্ত যাবতীয় মু’জিযাও। ফেরাউনকে বুঝাবার জন্য হযরত মূসা আ. যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সেগুলো বর্ণিত হয়েছে এবং তাকে একের পর এক যেসব মু’জিযা দেখানো হয়েছিল সেগুলোও কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে।
﴿قَالَ أَجِئْتَنَا لِتُخْرِجَنَا مِنْ أَرْضِنَا بِسِحْرِكَ يَا مُوسَىٰ﴾
৫৭। বলতে লাগলো, “হে মূসা! তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছো যে, নিজের যাদুর জোরে আমাদের দেশ থেকে আমাদের বের করে দেবে?৩০
৩০. যাদু বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে লাঠি ও সাদা হাতকে। সূরা আল আ’রাফ ও সূরা আশ শূআ’রায় বিস্তারিতভাবে একথা বর্ণনা করা হয়েছে যে, হযরত মূসা প্রথম সাক্ষাতের সময় প্রকাশ্য দরবারে একথা পেশ করেছিলেন। এ মু’জিযা দেখে ফেরাউন যে রকম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল তা কেবলমাত্র তার এ একটি বাক্য থেকেই আন্দাজ করা যেতে পারে যে, “তোমার যাদুর জোরে তুমি আমাদের দেশ থেকে আমাদের বের করে দিতে চাও”। কোন যাদুকর যাদুর জোরে কোন দেশ জয় করে নিয়েছে, দুনিয়ার ইতিহাসে পূর্বে কখনো এ ধরনের ঘটনা ঘটতে এবং পরবর্তী কালেও ঘটতে দেখা যায়নি। ফেরাউনের নিজের দেশে শত শত যাদুকর ছিল, যারা যাদুর খেলা দেখিয়ে পুরস্কার নেবার জন্য হাত পাততো। এ জন্য ফেরাউনের এদিকে হযরত মূসাকে যাদুকর বলা এবং অন্যদিকে তিনি তার রাজ্য ছিনিয়ে তিতে চান বলে আশংকা প্রকাশ করা তার স্পষ্ট দিশেহারা হয়ে যাবার আলামত পেশ করে। আসলে হযরত মূসার ন্যায়সংগত ও যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা এবং মু’জিযাগুলো দেখে সে বুঝতে পেরেছিল যে, শুধুমাত্র তার সভাসদরাই নয় বরং তার সাধারণ অসাধারণ নির্বিশেষে সকল প্রজাই এ থেকে প্রভাবিত না হয়ে পারবে না। তাই সে মিথ্যা, প্রতারণা ও হিংসার পথে কার্যোদ্ধারের চেষ্টা শুরু করলো। সে বললো, এসব মু’জিযা নয়, যাদু এবং আমার রাজ্যের প্রত্যেক যাদুকরই এভাবে লাঠিকে সাপ বানিয়ে দেখাতে পারে। সে বললোঃ হে জনতা! ভেবে দেখো, এ ব্যক্তি তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামী গণ্য করছে। সে আরো বললোঃ হে জনতা! সাবধান হয়ে যাও, এ ব্যাক্তি নবী-টবী কিছুই নয়, এ আসলে ক্ষমতালোভী। এ ব্যক্তি ইউসুফের যামানার মতো আবার বনী ইসরাঈলকে এখানে শাসন কর্তৃত্বে বসিয়ে দিতে এবং কিবতীদের হাত থেকে কর্তৃত্ব ক্ষমতা কেড়ে নিতে চায়। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ফেরাউন সত্যের দাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাচ্ছিল। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফঃ ৮৭, ৮৮, ৮৯ টীকা, সূরা ইউনুসঃ ৭৫ টীকা)। এ প্রসংগে একথাটিও সামনে রাখতে হবে যে, প্রতি যুগে ক্ষমতাসীন লোকেরা সত্যের আহ্বায়কদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগই এনেছে যে, তারা ক্ষমতালোভী এবং এ উদ্দেশ্যই সব কথা বলছে। এর দৃষ্টান্ত দেখুন সূরা আল আ’রাফের ১১০ ও ১৩৩, সূরা ইউনুসের ৭৮ এবং সূরা আল মু’মিনের ২৪ আয়াত সমূহে।
﴿فَلَنَأْتِيَنَّكَ بِسِحْرٍ مِّثْلِهِ فَاجْعَلْ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ مَوْعِدًا لَّا نُخْلِفُهُ نَحْنُ وَلَا أَنتَ مَكَانًا سُوًى﴾
৫৮। বেশ, আমরাও তোমার মোকাবিলায় অনুরূপ যাদু আনছি, ঠিক করো কবে এবং কোথায় মোকাবিলা করবে, আমরাও এ চুক্তির অন্যথা করবো না, তুমিও না। খোলা ময়দানে সামনে এসে যাও”।
﴿قَالَ مَوْعِدُكُمْ يَوْمُ الزِّينَةِ وَأَن يُحْشَرَ النَّاسُ ضُحًى﴾
৫৯। মূসা বললো, “উৎসবের দিন নির্ধারিত হলো এবং পূর্বাহ্নে লোকদেরকে জড়ো করা হবে।৩১
৩১. ফেরাউনের উদ্দেশ্য ছিল, একবার যাদুকরদের লাঠি ও দড়িদড়ার সাহয্যে সাপ বানিয়ে দেখিয়ে দেই তাহলে মূসার মু’জিযার যে প্রভাব লোকদের ওপর পড়েছে তা তিরোহিত হয়ে যাবে। হযরত মূসাও মনেপ্রাণে এটাই চাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, এ জন্য কোন পৃথক দিন ও স্থান নির্ধারণ করার দরকার নেই। উৎসবের দিন কাছেই এসে গেছে। সারা দেশের লোক এদিন রাজধানীতে চলে আসবে। সেদিন যেখানে জাতীয় মেলা অনুষ্ঠিত হবে সেই ময়দানেই এই প্রতিযোগিতা হবে। সমগ্র জাতিই এ প্রতিযোগিতা দেখবে। আর সময়টাও এমন হতে হবে যখন দিনের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, যাতে কারো সন্দেহ ও সংশয় করার কোন অবকাশই না থাকে।
﴿فَتَوَلَّىٰ فِرْعَوْنُ فَجَمَعَ كَيْدَهُ ثُمَّ أَتَىٰ﴾
৬০। ফেরাউন পেছনে ফিরে নিজের সমস্ত কলাকৌশল একত্র করলো এবং তারপর মোকাবিলায় এসে গেলো।৩২
৩২. ফেরাউন ও তার সভাসদদের দৃষ্টিতে এই প্রতিযোগিতার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশী। তারা এর ফায়সালার সাথে নিজেদের ভাগ্যের ফায়সালা জড়িত মনে করছিল। সারা দেশে লোক পাঠানো হয়। যেখানে যে অভিজ্ঞ–পারদর্শী যাদুকর পাওয়া যায় তাকেই সংগে করে নিয়ে আসার হুকুম দেয়া হয়। এভাবে জনগণকে হাযির করার জন্যও বিশেষভাবে প্রেরণা দান করা হয়। এভাবে বেশী বেশী লোক একত্র হয়ে যাবে এবং তারা স্বচক্ষে যাদুর তেলেসমতি দেখে মূসার লাঠির ভয় ও প্রভাব থেকে নিজেদেরকে সংরক্ষিত রাখতে পারবে। প্রকাশ্য বলা হতে লাগলো, আমাদের ধর্ম এখন যাদুকরদের তেলেসমতির ওপর নির্ভর করছে। তারা জিতলে আমাদের ধর্ম বেঁচে যাবে, নয়তো মূসার ধর্ম চারদিকে ছেয়ে যাবেই। (দেখুন সূরা আশ শূআ’রাঃ ৩ রুকু)
এ ক্ষেত্রে এ সত্যটিও সামনে থাকা দরকার যে, মিসরের রাজ পরিবার ও অভিজাত শ্রেণীর ধর্ম জনগণের ধর্ম থেকে যথেস্ট ভিন্ন ছিল। উভয়ের দেবতা ও মন্দির আলাদা ছিল। ধর্মীয় অনুষ্ঠানও এক ধরনের ছিল না। আর মৃত্যুপরের জীবনের ব্যাপারেও মিসরে যার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশী, উভয়ের কার্যকর পদ্ধতি ও আদর্শিক পরিণাম অনেক বড় ফারাক পাওয়া যেতো। (দেখুন টয়েনবির লেখা (A Study Of History) বইয়ের ৩১-৩২ পৃষ্টা) তাছাড়া মিসরে ইতিপূর্বে যে ধর্মীয় বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার ফলে সেখানকার জনগণের মধ্যে এমন একাধিক গ্রুপ তৈরী হয়ে গিয়েছিল যারা মুশরিকী ধর্মের তুলানায় একটি তাওহীদী ধর্মকে প্রাদান্য দিচ্ছিল অথবা দিতে পারতো। যেমন বনী ইসরাঈল এবং তাদের স্বধর্মীয় লোকেরা। এরা জনসংখ্যার প্রায় এক দশামাংশ ছিল। এছাড়াও রাষ্ট্রশক্তির সহযোগিতায় ফেরাউন আমিনোফিস বা আখনাতুন (খৃঃপূঃ ১৩৭৭-১৩৬০) যে ধর্ম বিপ্লব অনুষ্ঠান করেছিলেন তারপর তখনো পুরো দেড়শ’ বছরও অতিক্রান্ত হয়নি। এ বিপ্লবের মাধ্যমে সমস্ত উপাস্যদেরকে খতম করে একমাত্র একক উপাস্য “অতুন”কে প্রতিষ্ঠিত রাখা হয়েছিল। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রশক্তির জোরেই এ বিপ্লবের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল তবুও সে তার কিছু না কিছু প্রভাব রেখে গিয়েছিল। এসব অবস্থা সামনে রাখলে সে সময় ফেরাউনের মনে যে ভীতি ও আশংকা জাগছিল তা পুরোপুরি অনুধাবন করা যাবে।
﴿قَالَ لَهُم مُّوسَىٰ وَيْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَيُسْحِتَكُم بِعَذَابٍ ۖ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَىٰ﴾
৬১। মূসা (যথা সময় পতিপক্ষ দলকে সম্বোধন করে) বললো,৩৩ “দুর্ভাগ্য পীড়িতরা! আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়ো না,৩৪ অন্যথায় তিনি কঠিন আযাব দিয়ে তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন। যে-ই মিথ্যা রটনা করেছে সে-ই ব্যর্থ হয়েছে”।
৩৩. হযরত মূসার এ সম্বোধন জনগণের প্রতি ছিল না। কারণ হযরত মূসা মু’জিযা দেখাচ্ছেন, না যাদু দেখাচ্ছেন-তখনো পর্যন্ত জনগণ এ ব্যাপারে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। কাজেই এ সম্বোধন ছিল ফেরাউন ও তার সভাসদদের প্রতি। কারণ তারাই তাঁকে যাদুকর গণ্য করছিল।
৩৪. অর্থাৎ এ মু’জিযাকে যাদু এবং এর নবীকে যাদুকর গণ্য করো না।
﴿فَتَنَازَعُوا أَمْرَهُم بَيْنَهُمْ وَأَسَرُّوا النَّجْوَىٰ﴾
৬২। একথা শুনে তাদের মধে মতবিরোধ হয়ে গেলো এবং তারা চুপিচুপি পরামর্শ করতে লাগলো।৩৫
৩৫. এ থেকে জানা যায়, এরা মনে মনে নিজেরাই নিজেদের দুর্বলতা অনুভব করছিল। এরা জানতো, হযরত মূসা যা কিছু দেখিয়েছেন তা যাদু নয়। এরা প্রথম থেকেই দোটানা মনোভাব ও ভীতি সহকারে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। তারপর যখন নির্ধারিত সময়ে হযরত মূসা তাদেরকে উচ্চস্বরে আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিলেন তখন অকস্মাত তাদের দৃঢ় সংকল্প কেঁপে উঠলো। সম্ভবত তারা এ বিষয়ে মতবিরোধ করে থাকবে যে, এত বড় উৎসব, যেখানে সারা দেশের লোক জমা হয়ে গছে সেখানে খোলা ময়দানে দিনের উজ্জ্বল আলোকে এ প্রতিযোগিতায় নামা ঠিক হবে কি না। যদি এখানে আমরা পরাজিত হয়ে যাই এবং সবার সামনে যাদু ও মু’জিযার ফারাক প্রকাশ হয়ে যায় তাহলে তখন আর করার কিছুই থাকবে না।
﴿قَالُوا إِنْ هَٰذَانِ لَسَاحِرَانِ يُرِيدَانِ أَن يُخْرِجَاكُم مِّنْ أَرْضِكُم بِسِحْرِهِمَا وَيَذْهَبَا بِطَرِيقَتِكُمُ الْمُثْلَىٰ﴾
৬৩। শেষ কিছু লোক বললো,৩৬ “এরা দু’জন তো নিছক যাদুকর, নিজেদের যাদুর জোরে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে উৎখাত করা এবং তোমাদের আদর্শ জীবন যাপন পদ্ধতি ধ্বংস করে দেয়াই এদের উদ্দেশ্য।৩৭
৩৬. এ উক্তিকারীরা নিশ্চয়ই হবে ফেরাউনী পার্টির চরমপন্থী গ্রুপ, যারা যে কোন উপায়ে হযরত মূসার বিরোধিতা করতে প্রস্তুত ছিল। মনে হয়, দুরদর্শী, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ লোকেরা সামনের দিকে এক পা এগিয়ে যেতেও ইতস্তত করছিল। কিন্তু এ চরমপন্থী আবেগমুখর লোকেরা হয়তো বলেছিলঃ অনর্থক দূরের চিন্তা ত্যাগকরে এবং মন স্থির করে প্রতিযোগিতায় নেমে যাও।
৩৭. অর্থাৎ দু’টি বিষয় ছিল তাদের মূল প্রতিপাদ্য।
একঃ যদি যাদুকররাও মূসার মতো লাঠিকে সাপ বানিয়ে দেখিয়ে দেয় তাহলে সাধারণ জনসমাবেশে মূসার যাদুকর হওয়া প্রমাণ হয়ে যাবে।
দুইঃ তারা হিংসার আগুন জ্বালিয়ে শাসক শ্রেণীর মনে অন্ধ আবেগ সৃষ্টি করতে চাচ্ছিল। তাদেরকে এই মর্মে ভয় দেখাচ্ছিল যে, মূসার বিজয় দেশের কর্তৃত্ব ক্ষমতা তোমাদের হস্তচ্যুত হওয়া এবং তোমাদের আদর্শ (Ideal) জীবন যাপন পদ্ধতির অপমৃত্যুর নামান্তর। তারা দেশের প্রভাবশালী শ্রেণীকে ভয় দেখাচ্ছিল এই বলে যে, মূসা যদি মেশের কর্তৃত্ব লাভ করতে পারে তাহলে তোমাদের এ শিল্প, চারুকলা, সুন্দর ও মোহময় সংস্কৃতি এবং তোমাদের নারী স্বাধীনতা (যার চমৎকার নমুনা হযরত ইউসুফের জামানায় মিসরীয় ললনারা পেশ করেছিল) তথা এমন সবকিছু যেগুলো ছাড়া জীবনের সুখ ও আনন্দ উপভোগই করা যায় না, একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর তো শুরু হবে নিছক”কাঠমোল্লাদের” রাজত্ব, যা সহ্য করার চাইতে মরে যাওয়াই ভলো।
﴿فَأَجْمِعُوا كَيْدَكُمْ ثُمَّ ائْتُوا صَفًّا ۚ وَقَدْ أَفْلَحَ الْيَوْمَ مَنِ اسْتَعْلَىٰ﴾
৬৪। আজ নিজেদের সমস্ত কলাকৌশল একত্র করে নাও এবং একজোট হয়ে ময়দানে এসো।৩৮ ব্যস, জেনে রাখো, আজকে যে প্রাধান্য লাভ করবে সেই জিতে গেছে”।
৩৮. অর্থাৎ এদের মোকাবিলায় সংযুক্ত মোর্চা গঠন করো। এ সময় যদি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ দেখা দেয় এবং প্রতিযোগিতার সংগীন মুহূর্তে সাধারণ জনতার সামনে তোমাদের মধ্যে যদি এ ধরনের কানাকানি ও ইতস্তত ভাব চলতে থাকে তাহলে এখনই পায়ের তলা থকে মাটি সরে যাবে এবং লোকেরা মনে করতে থাকবে তোমাদের সত্যপন্থী হবার ব্যাপারে তোমরা নিজেরাই নিশ্চিত নও বরং সংশয় দোলায়িত চিত্তে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছো।
﴿قَالُوا يَا مُوسَىٰ إِمَّا أَن تُلْقِيَ وَإِمَّا أَن نَّكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَلْقَىٰ﴾
৬৫। যাদুকররা বললো,৩৯ “হে মূসা! তুমি নিক্ষেপ করবে, না কি আমরাই আগে নিক্ষেপ করবো?”মূসা বললো, “না তোমরাই নিক্ষেপ করো”।
৩৯. মাঝখানে বিস্তারিত বিবরণ এখানে বর্ণিত হয়নি, যা থেকে জানা যায় যে, উপরোক্ত বক্তব্যের ফলে ফেরাউনের দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে এবং প্রতিযোগিতা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাদুকরদেরকে প্রকাশ্য ময়দানে চলে আসার হুকুম দেয়া হয়।
﴿قَالَ بَلْ أَلْقُوا ۖ فَإِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِن سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَىٰ﴾
৬৬। অকস্মাত তাদের যাদুর প্রভাবে তাদের দড়িদড়া ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে বলে মূসার মনে হতে লাগলো৪০
৪০. সূরা আল আ’রাফে বলা হয়েছেঃ
فَلَمَّا أَلْقَوْا سَحَرُوا أَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ
“যখন তারা নিজেদের তন্ত্রমন্ত্র ছাড়লো তখন তা দ্বারা লোকদের দৃষ্টিকে যাদু করলো এবং তাদরকে আতংকিত করে তুললো”। (আয়াতঃ ১১৬)
এখানে একথা বলা হচ্ছে যে, এ প্রভাব শুধুমাত্র সাধারণ লোকদের ওপর পড়েনি, হযরত মূসাও যাদু প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর চোখই কেবল এটা অনুভব করেনি বরং তাঁর মস্তিষ্কও অনুভব করছিল যে, লাঠি ও দড়িদড়া সাপ হয়ে দৌড়াচ্ছে।
﴿فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُّوسَىٰ﴾
৬৭। এবং মূসার মনে ভীতির সঞ্চার হলো৪১
৪১. মনে হচ্ছে, যখনই হযরত মূসার মুখ থেকে “নিক্ষেপ করো” শব্দ বের হয়েছে তখনই যাদুকররা অকস্মাত নিজেদের লাঠিসোটা ও দড়িদড়াগুলো তাঁর দিকে ফিঁকে দিয়েছে এবং হঠাৎই তাঁর চোখ ভেসে উঠেছে যেন শত শত সাপ কিল বিল করতে করতে তাঁর দিকে দৌড়ে চলে আসছে। এ দৃশ্য দেখে হযরত মূসা তাৎক্ষণিকভাবে নিজের মধ্যে যদি একটি আশংকার ভাব অনুভব করে থাকেন তাহলে এটা কোন অবাক হবার কথা নয়। মানুষ তো সর্বাবস্থায় একজন মানুষই। একজন নবী নবী হলেও মানবিক আবেগ-অনুভীতি এবং অন্যান্য মানবিক চাহিদা থেকে তিনি কখনোই মুক্ত নন। তাছাড়া এ সময় হযরত মূসা স্বাভাবিকভাবে এ আশংকাও করে থাকতে পারেন যে, মু’জিযার সাথে এতটা সাদৃশ্যপূর্ণ দৃশ্য দেখে জনসাধারণ নিশ্চয়ই বিভ্রাটে পড়ে যাবে এবং তদের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এখানে একটি কথা অবশ্যি উল্লেখযোগ্য। কুরআন এখানে এ কথার সত্যতা প্রমাণ করছে যে নবীও যাদু প্রভাবিত হতে পারেন। যদিও যাদুকর তাঁর নবুওয়াত কেড়ে নেবার অথবা তাঁর প্রতি নাযিলকৃত অহীর মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার কিংবা যাদুর প্রভাবে তাঁকে পথভ্রষ্ট করার ক্ষমতা রাখে না, তবুও মোটামুটিভাবে কিছুক্ষণের জন্য তাঁর স্নায়ুর ওপর এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এ থেকে যারা হাদীসগ্রন্থগুলোতে নবী সা. এর ওপর যাদুর প্রভাব পড়ার ঘটনাবলী পাঠ করে শুধুমাত্র এ রেওয়ায়াতগুলোকে মিথ্যা বলেই ক্ষান্ত হন না বরং আরো সামনে অগ্রসর হয়ে সমগ্র হাদীস শাস্ত্রকেই অনির্ভরযোগ্য গণ্য করতে থাকেন, তাদের চিন্তাধারার গলদও সামনে এসে যাবে।
﴿قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنتَ الْأَعْلَىٰ﴾
৬৮। আমি বললাম, “ভয় পেয়ো না, তুমিই প্রাধান্য লাভ করবে।
﴿وَأَلْقِ مَا فِي يَمِينِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا ۖ إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ ۖ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَىٰ﴾
৬৯। ছুঁড়ে দাও তোমার হাতে যাকিছু আছে, এখনি এদের সব বানোয়াট জিনিসগুলোকে গ্রাস করে ফেলবে,৪২ এরা যাকিছু বানিয়ে এনেছে এতো যাদুকরের প্রতারণা এবং যাদুকর যেভাবেই আসুক না কেন কখনো সফল হতে পারে না”।
৪২. হতে পারে, মু’জিযার মাধ্যমে যে অজগর সৃষ্টি হয়েছিল তা সামনের যেসব লাঠি ও দড়িদড়া সাপের মতো দেখাচ্ছিল সেগুলোকে গিলে ফেলেছিল। কিন্তু এখানে এবং কুরআনের অন্যান্য স্থানে যেসব শব্দের সাহায্যে ও ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে বাহ্যত অনুমিত হয় যে, এ অজগরটি লাঠি ও দড়িগুলো গিলে ফেলেনি বরং যে যাদুর প্রভাব সেগুলো সাপ বলে মনে হচ্ছিল সে প্রভাবটিই নষ্ট করে দিয়েছিল। সূরা আল আ’রাফ ও সূরা আশ শূআ’রার শব্দাবলী হচ্ছেঃ
تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُونَ
“যে মিথ্যা তারা তৈরী করছিল তাকে সে গিলে ফেলছিল”। আর এখানে এ শব্দাবলী হচ্ছেঃ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوٓاْ “সে গিলে ফেলবে তা, যা তারা তৈরী করে রেখেছে”। একথা স্পষ্ট যে, তাদের মিথ্যা ও কৃত্রিমতা তাদের লাঠি ও দড়িদড়া ছিল না বরং তা ছিল তাদের যাদু, যার বদৌলতে সেগুলোকে সাপের মতো দেখা যাচ্ছিল। তাই আমাদের মতে এ অজগরটি যেদিকেই গেছে যার ফলে দিয়ে গেছে যার ফলে প্রত্যেকটি লাঠি ও দড়ি স্ব স্ব স্থানে পড়ে রয়েছে।
﴿فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سُجَّدًا قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ هَارُونَ وَمُوسَىٰ﴾
৭০। শেষ পর্যন্ত এই হলো যে, সমস্ত যাদুকরকে সিজদাবনত করে দেয়া হলো৪৩ এবং তারা বলে উঠলোঃ “আমরা মেনে নিলাম হারুন ও মূসার রবকে”।৪৪
৪৩. অর্থাৎ মূসার লাঠির কৃতিত্ব দেখার সাথে সাথেই তাদের বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, এটি নিশ্চিতভাবেই মু’জিযা, যাদু কোনক্রমেই নয়। তাই তারা হঠাৎ স্বতষ্ফর্তভাবে সিজদাবনত হয়, যেন কেউ তাদরকে উঠিয়ে নিয়ে ফেলে দিয়েছে।
৪৪. এর মানে হচ্ছে, সেখানে সবাই জানতো কিসের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সমগ্র জনসমাবেশে একজন ও এ ভুল ধারণা পোষণ করতো না যে, মূসার ও যাদুকরদের কলাকৌশলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে এবং কার কৌশল শক্তিশালী সেটিই এখন দেখার বিষয়। সবাই জানতো, একদিকে মূসা নিজেকে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা আল্লাহর নবী হিসেবে পেশ করছেন এবং নিজের নবুওয়াতের প্রমাণ স্বরূপ দাবী করছেন যে, তাঁর লাঠি অলৌকিকভাবে অজগরে পরিণত হয়। অন্যদিকে যাদুকরদেরকে জনসমক্ষে আহ্বান করে ফেরাউন একথা প্রমাণ করতে চায় যে, লাঠির অজগরে হওয়া অলৌকিক কর্ম নয় বরং নিছক যাদুর তেলেসমাতি। অন্যকথায়, সেখানে ফেরাউন ও যাদুকর এবং সাধারণ অসাধারণ নির্বিশেষে সমগ্র দর্শকমণ্ডলী মু’জিযা ও যাদুর পার্থক্য অবগত ছিল। কাজেই সেখানে এ মর্মে পরীক্ষা চলছিল যে, মূসা যা কিছু দেখাচ্ছেন তা যাদুর পর্যায়ভুক্ত, না রাব্বুল আলামীনের অসীম ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোন ক্ষমতার সাহয্যে যে মু’জিযা দেখানো যেতে পারে না তার পর্যায়ভুক্ত? এ কারণে যাদুকররা নিজেদের যাদুকে পরাভূত হতে দেখে একথা বলেনি, আমরা মেনে নিলাম, মূসা আমাদের চাইতে বড় যাদুকর। বরং সংগে সংগেই তাদের বিশ্বাস জন্মে গেছে যে, মুসা যথার্থই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাচ্চা পয়গম্বর। তারা চিৎকার করে বলে উঠেছে, আমরা সে আল্লাহকে মেনে নিয়েছি, যার পয়গম্বর হিসেবে মূসা ও হারুন এসেছেন।
এ থেকে সাধারণ জন সমাবেশে এ পরাজয়ের কি প্রভাব পড়ে থাকবে এবং সারা দেশবাসী এর দ্বারা কি সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকবে তা অনুমান করা যেতে পারে। ফেরাউন দেশের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় মেলায় এ প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান করেছিল এ আশায় যে, মিশরের সব এলাকা থেকে আগত লোকেরা স্বচক্ষে দেখে নেবে লাঠি দিয়ে সাপ তৈরী করা মূসার একার কোন অভিনব কৃতিত্ব নয়, প্রত্যেক যাদুকরই এটা করতে পারে। ফলে মূসার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে। কিন্তু তার এ কৌশলের ফাঁদে সে নিজেই আটকে গেছে এবং গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আগত লোকদের সামনে যাদুকররাই একযোগে একথার সত্যতা প্রকাশ করেছে যে, মূসা যা কিছু দেখাচ্ছেন তা যাদু নয়, তা হচ্ছে মূলত মু’জিযা। কেবলমাত্র আল্লাহর নবীগণই এ মু’জিযা দেখাতে পারেন।
﴿قَالَ آمَنتُمْ لَهُ قَبْلَ أَنْ آذَنَ لَكُمْ ۖ إِنَّهُ لَكَبِيرُكُمُ الَّذِي عَلَّمَكُمُ السِّحْرَ ۖ فَلَأُقَطِّعَنَّ أَيْدِيَكُمْ وَأَرْجُلَكُم مِّنْ خِلَافٍ وَلَأُصَلِّبَنَّكُمْ فِي جُذُوعِ النَّخْلِ وَلَتَعْلَمُنَّ أَيُّنَا أَشَدُّ عَذَابًا وَأَبْقَىٰ﴾
৭১। ফেরাউন বললো, “তোমারা ঈমান আনলে, আমি তোমাদের অনুমতি দেবার আগেই” দেখছি, এ তোমাদের গুরু, এ-ই তোমাদের যাদুবিদ্যা শিখিয়েছিল।৪৫ এখন আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কাটাচ্ছি৪৬ এবং খেজুর গাছের কাণ্ডে তোমাদের শুলিবিদ্ধ করছি৪৭ এরপর তোমরা জানতে পারবে আমাদের দু’জনের মধ্যে কার শাস্তি কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী”।৪৮ (অর্থাৎ আমি না মূসা, কে তোমাদের বেশী কঠিন শাস্তি দিতে পারে)।
৪৫. সূরা আল আ’রাফে বলা হয়েছেঃ
إِنَّ هَٰذَا لَمَكْرٌ مَّكَرْتُمُوهُ فِي الْمَدِينَةِ لِتُخْرِجُوا مِنْهَا أَهْلَهَا
“এটা একটি ষড়যন্ত্র, তোমরা রাজধানীতে বসে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে তার মালিকদেরকে হটিয়ে দেবার জন্য এ ষড়যন্ত্র করেছো”।
এখানে এ উক্তিটির বিস্তারিত বর্ণনা আবার এভাবে দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে যে শুধু পারস্পরিক যোগসাজশ আছে তাই নয় বরং মনে হচ্ছে এ মূসা তোমাদের দলের চাঁই ও গুরু। তোমরা মু’জিযার কাছে পরাজিত হওনি বরং নিজেদের গুরুর যাদুর পাতানো খেলার কাছে পরাজিত হয়েছো। বুঝা যাচ্ছে, তোমরা নিজেদের মধ্যে এ মর্মে পরামর্শ করে এসেছো যে, নিজেদের গুরুর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এবং একে তার নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করে এখানে রাজনৈতিক বিপ্লবের সূচনা করবে।
৪৬. অর্থাৎ একদিকের হাত ও অন্যদিকের পা।
৪৭. শূলিবিদ্ধ করার প্রাচীন পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপঃ একটি লম্বা কড়িকাঠ মাটিতে গেড়ে দেয়া হতো। অথবা পুরাতন গাছের গুড়ি একাজে ব্যবহৃত হতো। এর মাথার ওপর একটি তখতার আড়াআড়িভাবে বেঁধে দেয়া হতো। অপরাধীকে উপরে উঠিয়ে তার দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে তখতার গায়ে পেরেক মেরে আটকে দেয়া হতো। এভাবে অপরাধী তখতার সাথে ঝুলতে থাকতো। এবং ঘন্টার পর ঘন্টা কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুবরণ করতো। লোকদের শিক্ষালাভের জন্য শূলিদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে এভাবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হতো।
৪৮. এটা ছিল হেরে যাওয়া খেলার জয়লাভ করার জন্য ফেরাউনের সর্বশেষ চাল। সে যাদুকরদেরকে ভয়াবহতম শাস্তির ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ থেকে এ স্বীকারোক্তি আদায় করতে চাচ্ছিল যে, সত্যি তাদের এ মূসা আ.এর মধ্যে গোপন যোগসাজশ ছিল এবং তারা তাঁর সাথে মিলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিল। কিন্তু যাদুকরদের দৃঢ় সংকল্প ও অবিচল নিষ্ঠা তার এ চাল উলটে দিল। তারা এ ভয়ংকর শাস্তি বরদাশত করতে প্রস্তুত হয়ে সারা দুনিয়ার মানুষকে এ কথা নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, নিছক হেরে খেলায় জয়লাভ করার জন্য একটি নির্লজ্জ রাজনৈতিক চাল হিসেবে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য এই যে, তারা সাচ্চা দিলে মূসা আ. এর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান এনেছে।
﴿قَالُوا لَن نُّؤْثِرَكَ عَلَىٰ مَا جَاءَنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا ۖ فَاقْضِ مَا أَنتَ قَاضٍ ۖ إِنَّمَا تَقْضِي هَٰذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا﴾
৭২। যাদুকররা জবাব দিল, “সেই সত্তার কসম! যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, উজ্জ্বল সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সামনে এসে যাওয়ার পরও আমরা (সত্যের ওপর) তোমাকে প্রাধান্য দেবো, এটা কখনো হতে পারে না।৪৯ তুমি যা কিছু করতে চাও করো। তুমি বড় জোর এ দুনিয়ার জীবনের ফায়সালা করতে পারো
৪৯. এ আয়াতের দ্বিতীয় অনুবাদ এও হতে পারেঃ “আমাদের সামনে যে সব উজ্জ্বল নিদর্শন এসে গেছে এবং যে সত্তা আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার মোকাবিলায় আমরা কোনক্রমেই তোমাকে প্রাধান্য দিতে পারি না”।
﴿إِنَّا آمَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا وَمَا أَكْرَهْتَنَا عَلَيْهِ مِنَ السِّحْرِ ۗ وَاللَّهُ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ﴾
৭৩। আমরা তো তোমাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের ভুল ক্রুটিগুলো মাফ করে দেন। এবং এ যাদু বৃত্তিকেও ক্ষমা করে দেন, যা করতে তুমি আমাদের বাধ্য করেছিলে। আল্লাহই শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই স্থায়িত্ব লাভকারী”।
﴿إِنَّهُ مَن يَأْتِ رَبَّهُ مُجْرِمًا فَإِنَّ لَهُ جَهَنَّمَ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَىٰ﴾
৭৪। –প্রকৃতপক্ষে৫০ যে ব্যক্তি অপরাধী হয়ে নিজের রবের সামনে হাযির হবে তার জন্য আছে জাহান্নাম, যার মধ্যে সে না জীবিত থাকবে, না মরবে।৫১
৫০. যাদুকরদের উক্তির সাথে এটা আল্লাহর বাড়তি উক্তি। বক্তব্যের ধরন থেকেই এ কথা বুঝা যাচ্ছে যে, এ বাক্য যাদুকরদের উক্তির অংশ নয়।
৫১. অর্থাৎ জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে। পুরোপুরি মৃত্যু হবে না। যার ফলে তার কষ্ট ও বিপদের সমাপ্তি সূচিত হবে না। আবার জীবনকে মৃত্যুর ওপর প্রাধান্য দেবার মতো জীবনের কোন আনন্দও লাভ করবে না। জীবনের প্রতি বিরূপ হবে কিন্তু মৃত্যু লাভ করবে না। মরতে চাইবে কিন্তু মরতে পারবে না। কুরআন মজীদে জাহান্নামের আযাবের যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এ অবস্থাটি হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভয়াবহ। এর কল্পনায়ও হৃদয়-মন কেঁপে ওঠে।
﴿وَمَن يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَٰئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَىٰ﴾
৭৫। আর যারা তার সামনে মু’মিন হিসেবে সৎকাজ করে হাযির হবে তাদের জন্য রয়েছে সুমহান মর্যাদা,
﴿جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ جَزَاءُ مَن تَزَكَّىٰ﴾
৭৬। চির হরিৎ উদ্যান, যার পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এ হচ্ছে পুরস্কার সেই ব্যক্তির যে পবিত্রতা অবলম্বন করে।
﴿وَلَقَدْ أَوْحَيْنَا إِلَىٰ مُوسَىٰ أَنْ أَسْرِ بِعِبَادِي فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقًا فِي الْبَحْرِ يَبَسًا لَّا تَخَافُ دَرَكًا وَلَا تَخْشَىٰ﴾
৭৭। আমি৫২ মূসার কাছে অহী পাঠালাম যে, এবার রাতারাতি আমার বান্দাদের নিয়ে বের হয়ে পড়ো এবং তাদের জন্য সাগরের বুকে শুকনা সড়ক বানিয়ে নাও।৫৩ কেউ তোমাদের পিছু নেয় কিনা সে ব্যাপারে একটুও ভয় করো না। এবং (সাগরের সাঝখান দিয়ে পার হতে গিয়ে) শংকিত হয়ো না।
৫২. এরপর দীর্ঘদিন মিসরে অবস্থানকালে যা কিছু ঘটেছিল সেসব আলোচনা মাঝখানে বাদ দেয়া হয়েছে। এ ঘটনাবলী বিস্তারিত জানার জন্য সূরা আল আ’রাফঃ ১৫-১৬, সূরা ইউনুসঃ ৯, সূরা মু’মিন ৩-৫ এবং সূরা আয যুখরুফ ৫ রুকু দেখুন।
৫৩. এ সংক্ষিপ্ত কথাটির বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে এই যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ একটি রাত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এ রাতে সমস্ত ইসরাঈলী ও অইসরাঈলী মুসলমানদের (যাদের জন্য ব্যাপক অর্থবোধক আমার বান্দাদের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে) মিসরের সকল এলাকা থেকে হিজরত করে বের হয়ে পড়ার কথা ছিল। তারা সবাই একটি পূর্ব নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হয়ে একটি কাফেলার আকারে রওয়ানা হলো। এ সময় সুয়েজ খালের অস্তিত্ব ছিল না। লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত সমস্ত এলাকাটাই উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু সে এলাকার সকল পথেই ছিল সেনানিবাস। ফলে সেখান দিয়ে নিরাপদে অতিক্রম করা সম্ভবপর ছিল না। তাই হযরত মূসা লোহিত সাগরের পথ ধরলেন। সম্ভবত তাঁর পরিকল্পনা ছিল, সাগরের তীরে ধরে এগিয়ে গিয়ে সিনাই উপদ্বিপের দিকে চলে যাবেন। কিন্তু সেদিক থেকে ফেরাউন একটি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে ঠিক এমন সময় পৌছে গেলো যখন এ কাফেলা সবেমাত্র সাগরের তীরেই উপস্থিত হয়েছিল। সূরা আশ শূআ’রায় বলা হয়েছে, মুহাজিরদের কাফেলা ফেরাউনের সেনা দল ও সমুদ্র দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ঘেরাও হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এমনি সময় মহান আল্লাহ হযরত মূসাকে হুকুম দিলেন ٱضْرِب بِّعَصَاكَ ٱلْبَحْرَ “সমুদ্রের ওপর তোমার লাঠি মারো”।
فَٱنفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍۢ كَٱلطَّوْدِ ٱلْعَظِيمِ
“তখনই সাগর ফেটে গেলো এবং তার প্রত্যেকটি টুকরা একটি বড় পর্বত শৃংগের মতো দাঁড়িয়ে গেলো”।
আর মাঝখান দিয়ে শুধু কাফেলার পার হয়ে যাবার পথ তৈরী হয়ে গেলো না বরং উপরের আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী মাঝখানের এ অংশ শুকিয়ে খটখটে সড়কের আকার ধারণ করলো। এটি সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য মু’জিযার বর্ণনা। এ থেকে যারা একথা বলে থাকেন যে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বা জোয়ার ভাটার ফলে সমুদ্রের পানি সরে গিয়েছিল তাদের কথার গলদ সহজেই ধরে পড়ে। কারণ, এভাবে যে পানি সরে যায় তা দু’দিকে পর্বত শৃংগের মতো খাড়া হয়ে থাকে না। এবং মাঝখানের পানি বিহীন অংশ শুকিয়ে রাস্তা তৈরী হয়ে যায় না। (আরো বেশী জানার জন্য তাফহীমুল কুরআন, সূরা আশ শূআ’রাঃ ৪৭ টীকা দেখুন)।
﴿فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ بِجُنُودِهِ فَغَشِيَهُم مِّنَ الْيَمِّ مَا غَشِيَهُمْ﴾
৭৮। পিছন থেকে ফেরাউন তার সেনাবাহীনি নিয়ে পৌছলো এবং তৎক্ষণাত সমুদ্র তাদের উপর ছেয়ে গেলো যেমন ছেয়ে যাওয়া সমীচীন ছিল।৫৪
৫৪. সূরা আশ শূআ’রায় বলা হয়েছে, মুহাজিরদের সাগর অতিক্রম করার পর পরই ফেরাউন তার সৈন্য সামান্তসহ সমুদ্রের বুকে তৈরী হওয়া এ পথে নেমে পড়লো। (আয়াতঃ ৬৩-৬৪) এখানে বলা হয়েছে, সমুদ্র তাকে ও তার সেনাদেরকে ডুবিয়ে মারলো। সূরা আল বাকারায় বলা হয়েছে, বনী ইসরাঈল সমুদ্রের অন্য তীর থেকে ফেরাউন ও তার সেনাদলকে ডুবে যেতে দেখেছিল। (আয়াতঃ ৫০) অন্যদিকে সূরা ইউনুসে বলা হয়েছে, ডুবে যাবার সময় ফেরাউন চিৎকার করে উঠলোঃ
آمَنتُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“আমি মেনে নিয়েছি যে আর কোন ইলাহ নেই সেই ইলাহ ছাড়া যাঁর প্রতি বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে এবং আমিও মুসলমানদের অন্তরভুক্ত”।
কিন্তু এ শেষ মুহূর্তের ঈমান গৃহীত হয়নি এবং জবাব দেয়া হলোঃ
آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ، فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً
“এখন ঈমান আনছো? আর ইতিপূর্বে এমন অবস্থা ছিল যে, নাফরমানীতেই ডুবে ছিলে এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করেই চলেছিলে। বেশ, আজ আমি তোমার লাশটাকে রক্ষা করেছি, যাতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষনীয় হয়ে থাকে”। (আয়াতঃ ৯০-৯২)
﴿وَأَضَلَّ فِرْعَوْنُ قَوْمَهُ وَمَا هَدَىٰ﴾
৭৯। ফেরাউন তার জাতিকে পথভ্রষ্ট করেছিল, কোন সঠিক পথ দেখায়নি।৫৫
৫৫. অতি সুক্ষ্মভাবে মক্কার কাফেরদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে এই মর্মে যে, তোমাদের সরদার ও নেতারাও তোমাদের সেই একই পথে নিয়ে যাচ্ছে যে পথে ফেরাউন তার জাতিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এখন তোমরা নিজেরাই দেখে নাও যে, এটা কোন সঠিক পথ নির্দেশন ছিল না।
এ কাহিনী শেষ করতে গিয়ে মনে হয় বাইবেলের বর্ণনাবলীও পর্যালোচনা করা দরকার। এভাবে যারা বলে থাকে কুরআনের এ কাহিনী বনী ইসরাঈলের থেকে নকল করা হয়েছে তাদের মিথ্যার হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে। বাইবেলের যাত্রা পুস্তক (Exodus) এ কাহিনীর যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তার নিন্মোক্ত অংশগুলো প্রণিধানযোগ্যঃ
একঃ ৪ অধ্যায়ের ২-৫ শ্লোকে বলা হয়েছেঃ লাঠির মু’জিযা হযরত মূসাকে দেয়া হয়েছিল। আবার ১৭ শ্লোকে তাঁকেই এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আর তুমি এ ষষ্টি হস্তে করিবে, ইহা দ্বারাই তোমাকে সেই সকল চিহ্ন-কার্য করিতে ইইবে”। কিন্তু সামনের দিকে গিয়ে জানা গেলো না কেমন করে এ লাঠি হযরত হারুনের হাতে চলে গেলো এবং তিনিই এর সাহায্যে মু’জিযা দেখাতে থাকলেন। ৭ অধ্যায় থেকে নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা অনবরত হযরত হারুনকেই লাঠির মু’জিযা দেখাতে দেখি।
দুইঃ ৫ অধ্যায়ে ফেরাউনের সাথে হযরত মূসার প্রথম সাক্ষাতেরই অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে আল্লাহর একত্ব ও রবুবিয়াত সম্পর্কে হযরত মূসা ও ফেরাউনের মধ্যে যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল আদতে তার কোন উল্লেখই নেই। ফেরাউন বললো, সদা প্রভু কে যে, আমি তাহার কথা শুনিয়া ইসরাঈলকে ছাড়িয়া দিব? আমি সদা প্রভুকে জানি না”। কিন্তু মূসা ও হারুন এর এছাড়া আর কোন জবাব দিলেন না, “ইব্রীয়দের ঈশ্বর আমাদিগকে দর্শন দিয়াছেন”। (৫:২-৩)
তিনঃ যাদুকরদের সাথে প্রতিযোগিতার সমগ্র কাহিনী নিচের মাত্র এই ক’টি বাক্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়েছেঃ
“পরে সদাপ্রভু মোশি ও হারোনকে কহিলেন, ফরৌন যখন তোমাদিগকে বলে, তোমরা আপনাদের পক্ষে অদ্ভুত লক্ষণ, দেখাও, তখন তুমি হারোনকে বলিও, তোমার যষ্টি লইয়া ফরৌনের সামনে নিক্ষেপ কর, তাহাতে তাহা সর্প হইবে। তখন মোশি ও হারোন ফেরাউনের নিকট গিয়ে সদা প্রভুর আজ্ঞানুসারে কর্ম করিলেন, হারোন ফরৌনের ও তাঁহার দাসগণের সম্মুখে আপন যষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, তাহাতে তাহা সর্প হইল। তখন ফরৌনও বিদ্বানদিগকে ও গুণীদিগকে ডাকিলেন, তাহাতে তাহারা অর্থাৎ মিস্রীয় মন্ত্রবেত্তারাও আপনাদের মায়াবলে সেই রূপ করিল। ফলত তাহারা আপন আপন যষ্টি নিক্ষেপ করিলে সে সকল সর্প হইল, কিন্তু হারোনের যষ্টি তাহাদের সকল যষ্টিকে গ্রাস করিল”। (৭:৮-১২)
কুরআনের বর্ণনার সাথে এ বর্ণনা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। মূল কাহিনীর সমগ্র প্রাণশক্তি কি মারাত্মকভাবে এখানে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, উৎসবের দিন খোলা ময়দানে যথারীতি চ্যালেঞ্জের পর প্রতিযোগিতা হওয়া এবং তারপর পরাজয়ের পর যাদুগরদের ঈমান আনা ছিল মূলত এ কাহিনীর প্রাণ। কিন্তু এখানে তার কোন উল্লেখই করা হয়নি।
চারঃ কুরআন বলছে, বনী ইসরাঈলদের মুক্তি ও স্বাধীনতাই ছিল হযরত মূসার দাবী। বাইবেল বলছে, তাঁর দাবী কেবল এতটুকুই ছিলঃ “আমরা বিনয় করি, আমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করণার্থে আমাদিগকে তিন দিনের পথ প্রান্তরে যাইতে দিউন, (যাত্রা পুস্তকঃ ৫:৩)
পাঁচঃ মিসর থেকে বের হওয়া এবং ফেরাউনের ডুবে যাওয়ার ঘটনা ১১ থেকে ১৪ অধ্যায়ের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বহু প্রয়োজনীয় তথ্য ও কুরআনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনার বিস্তারিত রূপও আমরা দেখতে পাই। আবার এই সংগে অনেকগুলো অদ্ভুত কথাও জানা যায়। যেমন ১৪ অধ্যায়ের ১৫-১৬ শ্লোকে হযরত মূসাকে হুকুম দেয়া হচ্ছেঃ তুমি আপন যষ্টি (জি, হাঁ এখন যষ্টি হযরত হারুনের হাত থেকে নিয়ে হযরত মূসার হাতে দেয়া হয়েছে) তুলিয়া সমুদ্রের উপরে হস্ত বিস্তার কর, সমুদ্রকে দুই ভাগ কর; তাহাতে ইস্রায়েল সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্র মধ্যে প্রবেশ করিবে”। কিন্তু সামনের দিকে গিয়ে ২১-২২ শ্লোকে বলা হচ্ছেঃ “মোশি (মূসা)-সমুদ্রের উপর আপন হস্ত বিস্তার করিলেন, তাহাতে সদা প্রভু সেই সমস্ত রাত্রি ব্যাপী প্রবল পূর্বীয় বায়ূ দ্বারা সমুদ্রকে সরাইয়া দিলেন ও তাহা শুষ্ক ভূমি করিলে, তাহাতে জল দুই ভাগ হইল। আর ইস্রায়েল সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্র মধ্যে প্রবেশ করিল, এবং তাহাদের দক্ষিণে ও বামে জল প্রাচীর স্বরূপ হইল। বুঝতে পারা গেল না যে, এটা মুজিযা ছিল, না ছিল প্রাকৃতিক ঘটনা? যদি মুজিযা থেকে থাকে তাহলে তা লাঠির আঘাতেই সৃষ্ট হয়ে থাকবে, যেমন কুরআনে বলা হয়েছে। আর যদি সত্যি প্রাকৃতিক ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে পূর্বীয় বায়ূ সমুদ্রকে মাঝখান থেকে ফেড়ে পানিকে দু’দিকে দেয়ালের মতো দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এবং মাঝখানে শুকনো পথ বানিয়ে দিয়েছে, এটা তো দস্তুরমতো বিস্ময়ের ব্যাপার। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বাতাস কি কখনো এমনি ধরনের কোন আযব কাণ্ড ঘটিয়েছে?
তালমূদের বর্ণনা বাইবেল থেকে তুলনামূলকভাবে বিভিন্ন এবং কুরআনোর অনেকটা কাছাকাছি। কিন্তু উভয়ের মোকাবিলা করলে পরিষ্কার অনুভূত হয়, এক জায়গায় সরাসরি অহী জ্ঞানের ভিত্তিতে ঘটনা বর্ণনা করা হচ্ছে এবং অন্য জায়গায় শত শত বছরের জনশ্রুতির মাধ্যমে প্রচলিত বর্ণনাই ঘটনার রূপ নিয়েছে। যার ফলে তা যথেষ্ট বিকৃত হয়েছে। দেখুনঃ The Talmud Selection, H. Polano, Pp, 150-54
﴿يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ قَدْ أَنجَيْنَاكُم مِّنْ عَدُوِّكُمْ وَوَاعَدْنَاكُمْ جَانِبَ الطُّورِ الْأَيْمَنَ وَنَزَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَىٰ﴾
৮০। হে বনী ইসরাঈল!৫৬ আমি তোমাদের শত্রুদের হাত থেকে তোমাদের মুক্তি দিয়েছি, এবং তূরের ডান পাশে৫৭ তোমাদের উপস্থিতির জন্য সময় নির্ধারণ করেছি৫৮ আর তোমাদের প্রতি মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করেছি৫৯
৫৬. মাঝখানে সমুদ্র পার হওয়া থেকে নিয়ে সিনাই পাহাড়ের পাদদেশে পৌছে যাওয়ার ঘটনা বলা হয়নি। সূরা আল আ’রাফের ১৬-১৭ রুকূতে এর বিস্তারিত বিবরণ এসে গেছে। সেখানে একথাও বলা হয়েছে যে, মিসর থেকে বের হয়েই সিনাই উপদ্বীপে একটি মন্দির দেখে বনী ইসরাঈল নিজেদের জন্য একজন কৃত্রিম খোদার দাবী করে বসেছিল। (তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফঃ ৯৮ টীকা)।
৫৭. অর্থাৎ তূর পাহাড়ের পূর্ব পাদদেশে।
৫৮. সূরা আল বাকারাহ-এর ৬ রুকূ ও সূরা আল আ’রাফের ১৭ রুকূতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে শরীয়াতের নির্দেশনা দেবার জন্য চল্লিশ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলেন। এর পর মূসা আ.কে পাথরের ফলকে লিখিত বিধান দেয়া হয়েছিল।
৫৯. মান্না ও সালওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আল বাকারাহঃ ৭৩ ও সূরা আল আ’রাফঃ ১১৯ টীকা। বাইবেলের বর্ণনা মতে মিসর থেকে বের হবার পর যখন বনী ইসরাঈল সীন মরুভূমিতে ইলীম ও সীনাইর মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল এবং মজুদ খাদ্য খতম হয়ে গিয়ে অনাহার অর্ধাহারের পালা শুরু হয়ে গিয়েছিল তখনই মান্না ও সালওয়ার অবতরণ শুরু হয় এবং ফিলিস্তীনের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পৌছে যাওয়া পর্যন্ত পুরো চল্লিশ বছর ধরে এ ধারাবাহিক কার্যক্রম চলতে থাকে। (যাত্রা পুস্তকঃ অধ্যায়-১৬, গণনা পুস্তকঃ ১১:৭-৯, যিহেশূয়ঃ ৫:১২) যাত্রা পুস্তকে মান্না ও সালওয়ার নিম্নোক্ত অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছেঃ
“পরে সন্ধ্যাকালে ভারুই পক্ষী উড়িয় আসিয়া শিবির স্থান আচ্ছাদান করিল, এবং প্রাতঃকালে শিবিরের চারিদিকে শিশির পড়িল। পরে পতিত শিশির উর্দ্ধগত হইলে দেখ ভূমিস্থিত নীহারের ন্যায় সরু বীজাকার সূক্ষ্ম বস্তু বিশেষ প্রান্তরের উপর পড়িয়া রহিল। আর তাহা দেখিয়া ইস্রায়েল সন্তানগণ পরস্পর কহিল উহা কি? কেননা তাহা কি, তাহারা জানিল না”। (১৬:১৩-১৫)
“আর ইস্রায়েল কুল ঐ খাদ্যের মান্না রাখিল, তাহা ধনিয়া বীজের মত, শুক্ল বর্ণ, এবং তাহার আস্বাদ মধুমিশ্রিত পিষ্টকের ন্যায় ছিল”। (১৬:৩১)
গণনা পুস্তকে আরো বেশী বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছেঃ
“লোকেরা ভ্রমণ করিয়া তাহা কুড়াইত, এবং যাঁতায় পিষিয়া কিংবা উখলিতে চূর্ণ করিয়া বহুগুণাতে সিদ্ধ করিত, ও তদ্বারা পিষ্টক পুস্তক করিত; তৈলপক্ক পিষ্টকের ন্যায় তাহার আস্বাদ ছিল। রাত্রিতে শিবিরের উপরে শিশির পড়িলে ঐ মান্না তাহার উপরে পড়িয়া থাকিত”। (১১:৮-৯)
এটাও ছিল একটি মু’জিযা। কারণ চল্লিশ বছর পরে বনী ইসরাঈল যখন খাদ্যের প্রাকৃতিক উপায়-উপকরণ লাভ করলো তখন খাদ্য সরবরাহের এ ধারাটি বন্ধ করে দেয়া হলো। এখন ঐ এলাকায় বাবুই পাখির প্রাচুর্য নেই এবং মান্নাও কোথাও পাওয়া যায় না। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী বনী ইসরাঈল যে এলাকায় চল্লিশ বছর মরুচারী জীবন যাপন করেছিল গবেষক ও অনুসন্ধানকারীরা সেই সমগ্র এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন। কোথাও তারা মান্নার সাক্ষাত পাননি। তবে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদেরকে বোকা বানাবার জন্য অবশ্যি মান্নার হালুয়া বিক্রি করে থাকে।
﴿كُلُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَلَا تَطْغَوْا فِيهِ فَيَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبِي ۖ وَمَن يَحْلِلْ عَلَيْهِ غَضَبِي فَقَدْ هَوَىٰ﴾
৮১। –খাও আমার দেওয়া পবিত্র রিযিক এবং তা খেয়ে সীমালংঘন করো না, অন্যথায় তোমাদের ওপর আমার গযব আপতিত হবে। আর যার ওপর আমার গযব আপতিত হয়েছে তার পতন অবধারিত।
﴿وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِّمَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَىٰ﴾
৮২। তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারপর সোজা-সঠিক পথে চলতে থাকে তার জন্য আমি অনেক বেশী ক্ষমাশীল।৬০
৬০. অর্থাৎ মাগফিরাতের জন্য রয়েছে চারটি শর্ত।
একঃ তওবা। অর্থাৎ বিদ্রাহ, নাফরমানী অথবা শিরক ও কুফরী থেকে বিরত থাকা।
দুইঃ ঈমান। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূল এবং কিতাব ও আখেরাতকে সাচ্চা দিলে মেনে নেয়া।
তিনঃ সৎকাজ। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের বিধান অনুযায়ী ভালো কাজ করা।
চারঃ সত্যপথাশ্রয়ী হওয়া। অর্থাৎ সত্য-সঠিক পথে অবিচল থাকা এবং তারপর ভুল পথে না যাওয়া।
﴿وَمَا أَعْجَلَكَ عَن قَوْمِكَ يَا مُوسَىٰ﴾
৮৩। আর৬১ কোন জিনিসটি তোমাকে তোমার সম্প্রদায়ের আগে নিয়ে এলো হে মূসা”৬২
৬১. এই মাত্র উপরে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে এখান থেকে তার সাথে আলোচনা সম্পৃক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা তূর পাহাড়ের ডান দিকে অবস্থান করো এবং চল্লিশ দিনের মেয়াদ শেষ হলে তোমাদের নির্দেশনামা দেয়া হবে।
৬২. এ বাক্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, নিজ সম্প্রদায়কে পেছনে রেখে হযরত মূসা আল্লাহর সাথে মোলাকাতের আগ্রহের আতিশয্যে আগে চলে গিয়েছিলেন। তূরের ডান পাশের যেখানকার ওয়াদা বনী ইসরাঈলদের সাথে করা হয়েছিল সেখানে তখনো কাফেলা পৌছুতে পারেনি। ততক্ষণ হযরত মূসা একাই রওয়ানা হয়ে গিয়ে আল্লাহর সামনে হাজিরা দিলেন। এ সময় আল্লাহ ও বান্দার সাথে যা ঘটে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে সূরা আল আ’রাফের ১৭ রুকূতে। হযরত মূসার আল্লাহর সাক্ষাতের আবেদন জানানো এবং আল্লাহর একথা বলা যে, তুমি আমাকে দেখতে পারবে না তারপর আল্লাহর একটি পাহাড়ের ওপর সামান্য তাজাল্লি নিক্ষেপ করে তাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেয়া এবং হযরত মূসার বেহুশ হয়ে পড়ে যাওয়া, আর তারপর পাথরের তখতিতে লেখা বিধান লাভ করা-এসব সেই সময়েরই ঘটনা। এখানে এ ঘটনার শুধুমাত্র বনী ইসরাঈলের গো-বৎস পূজার সাথে সম্পর্কিত অংশটুকুই বর্ণনা করা হচ্ছে। একটি জাতির মধ্যে মূর্তি পূজার সূচনা কিভাবে হয়এবং আল্লাহর নবী এ ফিতনাটি দেখে কেমন অস্থির হয়ে পড়েন, মক্কার কাফেরদেরকে এ কথা জানানোই এ বর্ণনার উদ্দেশ্য।
﴿قَالَ هُمْ أُولَاءِ عَلَىٰ أَثَرِي وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَىٰ﴾
৮৪। সে বললো, “তারা তো ব্যস আমার পেছনে এসেই যাচ্ছে। আমি দ্রুত তোমার সামনে এসে গেছি, হে আমার রব! যাতে তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যায়”।
﴿قَالَ فَإِنَّا قَدْ فَتَنَّا قَوْمَكَ مِن بَعْدِكَ وَأَضَلَّهُمُ السَّامِرِيُّ﴾
৮৫। তিনি বললেন, “ভালো কথা, তাহলে শোনো, আমি তোমার পেছনে তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছি এবং সামেরী৬৩ তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে”।
৬৩. এটা ঐ ব্যক্তির নাম নয়। বরং শব্দের শেষে সম্বন্ধসূচক ইয়া (ى) ব্যবহারের সুস্পষ্ট আলামত থেকে একথা জানা যায় যে, এটা গোত্র, বংশ বা স্থানের সাথে সম্পর্কিত কোন শব্দ। তারপর আবার কুরআন যেভাবে আসসামেরী বলে তার উল্লেখ করছে তা থেকে একথাও অনুমান করা যায় যে, সে সময় সামেরী গোত্র, বংশ বা স্থানের বহুলোক ছিল এবং তাদের এক বিশেষ ব্যক্তি ছিল বনী ইসরাঈলের মধ্যে স্বর্ণ নির্মিত গো-বৎস পূজার প্রচলনকারী এ সামেরী। কুরআনের এ জায়গার ব্যাখ্যার জন্য প্রকৃতপক্ষে এর চাইতে বেশী কিছু বর্ণনার দরকার নেই। কিন্তু এ জায়গায় যা বলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে খৃস্টান মিশনারীরা বিশেষ করে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদরা কুরআনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তারা বলেন, (নাউযুবিল্লাহ) এটা কুরআন রচয়িতার মারাত্মক অজ্ঞতার প্রমাণ। কারণ এ ঘটনার কয়েকশ’ বছর পর খৃস্টপূর্ব ৯২৫ অব্দের কাছাকাছি সময় ইসরাঈলী সাম্রাজ্যের রাজধানী “সামেরীয়া” নির্মিত হয়। তারপর এরও কয়েকশ’ বছর পর ইসরাঈলী ও অইসরাঈলীদের সমন্বয়ে শংকর প্রজন্মের উদ্ভব হয়, যারা “সামেরী” নামে পরিচিত হয়। তাদের মতে এই সামেরীদের মধ্যে অন্যান্য মুশরিকী বিদআতের সাথে সাথে সোনালী বাছুর পূজার রেওয়াজও ছিল এবং ইহুদীদের মাধ্যমে মুহাম্মাদ সা.এর একথা শুনে নিয়ে থাকবেন, তাই তিনি একে নিয়ে হযরত মূসার যুগের সাথে জুড়ে দিয়েছেন এবং এ কাহিনী তৈরী করেছেন যে, সেখানে সোনার বাছুর পূজার প্রচলনকারী সামেরী নামে এক ব্যক্তি ছিল। এ ধরনের কথা এরা হামানের ব্যাপারেও বলেছে। কুরআন এই হামানকে ফেরাউনের মন্ত্রী হিসেবে পেশ করেছে। অন্যদিকে খৃস্টান মিশনারী ও প্রাচ্যবিদরা তাকে ইরানের বাদশাহ আখসোয়ার্সের সভাসদ ও উমরাহ “হামান” এর সাথে মিলিয়ে দিয়ে বলেন, এটা কুরআন রচয়িতার অজ্ঞতার আর একটা প্রমাণ। সম্ভবত এ জ্ঞান ও গবেষণার দাবীদারদের ধারণা প্রাচীন যুগে এক নামের একজন লোক, একটি গোত্র অথবা একটি স্থানই হতো এবং এক নামের দুজন লোক, গোত্র বা দু’টি স্থান হবার আদৌ কোন সম্ভাবনাই ছিল না। অথচ প্রাচীনকালের একটি অতি পরিচিত জাতি ছিল সুমেরী। হযরত ইব্রাহীম আ. এর যুগে ইরাক ও তার আশপাশের এলাকায় এ জাতিটি বসবাস করতো। আর এ জাতির বা এর কোন শাখার লোকদেরকে মিসরে সামেরী বলা হতে পারে এর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তারপর এই সামেরীয়ার মূলের দিকেও নজর দিন। এরি সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতেই তো পরবর্তীকালে উত্তর ফিলিস্তীনের লোকদেরকে সামেরী বলা হতে থাকে। বাইবেলের বর্ণনা মতে ইসরাঈল রাজ্যের শাসক উমরী “সামেরী” (বা শেমর) নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি পাহাড় কিনেছিলেন যার ওপর পরে তিনি নিজের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। যেহেতু পাহাড়ের সাবেক মালিকের নাম সামর ছিল তাই এ শহরের নাম রাখা হয় সামেরিয়া(বা শামরিয়া) (১-রাজাবলী ১৬-২৪) এ থেকে পরিস্কার জানা যায়, সামেরিয়ার অস্তিত্বলাভের পূর্বে “সামর” নামক লোকের অস্তিত্ব ছিল এবং তার সাথে সম্পর্কিত হয়ে তার বংশ বা গোত্রের নাম সামেরী এবং স্থানের নাম সামেরীয়া হওয়া অবশ্যই সম্ভবপর ছিল।
﴿فَرَجَعَ مُوسَىٰ إِلَىٰ قَوْمِهِ غَضْبَانَ أَسِفًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ أَلَمْ يَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا ۚ أَفَطَالَ عَلَيْكُمُ الْعَهْدُ أَمْ أَرَدتُّمْ أَن يَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبٌ مِّن رَّبِّكُمْ فَأَخْلَفْتُم مَّوْعِدِي﴾
৮৬। ভীষণ ক্রোধ ও মর্মজ্বালা নিয়ে মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এলো। সে বললো, “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমাদের রব কি তোমাদের সাথে ভালো ভালো ওয়াদা করেননি?৬৪ তোমাদের কি দিনগুলো দীর্ঘতর মনে হয়েছে?৬৫ অথবা তোমরা নিজেদের রবের গযবই নিজেদের ওপর আনতে চাচ্ছিলে, যে কারণে তোমরা আমার সাথে ওয়াদা ভংগ করলে?৬৬
৬৪. এর অনুবাদ “ভালো ওয়াদা করেননি” ও হতে পারে। মূল ইবারতের যে অনুবাদ আমি করেছি তার অর্থ হচ্ছে, আজ পর্যন্ত তোমাদের রব তোমাদের সাথে যেসব কল্যাণের ওয়াদা করেছেন তার সবই তোমরা লাভ করতে থেকেছো। তোমাদের নিরাপদে মিসর থেকে বের করেছেন। দাসত্ব মুক্ত করেছেন। তোমাদের শত্রুকে তছনছ করে দিয়েছেন। তোমাদের জন্য তাই মরুময় ও পাবর্ত্য অঞ্চলে ছায়া ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ সমস্ত ভালো ওয়াদা কি পূর্ণ হয়নি? দ্বিতীয় অনুবাদের অর্থ হবে, তোমাদেরকে শরীয়াত ও আনুগত্যনামা দেবার যে ওয়াদা করা হয়েছিল তোমাদের মতে তা কি কোন কল্যাণ ও হিতসাধনের ওয়াদা ছিল না?
৬৫. দ্বিতীয় অনুবাদ এও হতে পারে, “ওয়াদা পূর্ণ হতে কি অনেক বেশী সময় লাগে যে, তোমরা অধৈর্য হয়ে পড়েছো”? প্রথম অনুবাদের অর্থ হবে, তোমাদের প্রতি আল্লাহ তাআ’লা এই মাত্র যে বিরাট অনুগ্রহ করেছেন, এর পর কি অনেক বেশী সময় অতীত হয়ে গেছে যে, তোমরা তাঁকে ভুলে গেলে? তোমাদের বিপদের দিনগুলো কি সুদীর্ঘকাল আগে শেষ হয়ে গেছে যে, তোমারা পাগলের মতো বিপথে ছুটে চলেছো? দ্বিতীয় অনুবাদের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, পথনির্দেশনা দেবার যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা পূর্ণ হতে তো কোন প্রকার বিলম্ব হয়নি, যাকে তোমরা নিজেদের জন্য ওজর বা বাহানা হিসেবে দাঁড় করাতে পারো।
৬৬. প্রত্যেক জাতি তার নবীর সাথে যে ওয়াদা করে তার কথাই এখানে বলা হয়েছে। এ ওয়াদা হচ্ছেঃ তাঁর আনুগত্য করা, তাঁর দেওয়া নির্দেশের ওপর অবিচল থাকা এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী না করা।
﴿قَالُوا مَا أَخْلَفْنَا مَوْعِدَكَ بِمَلْكِنَا وَلَٰكِنَّا حُمِّلْنَا أَوْزَارًا مِّن زِينَةِ الْقَوْمِ فَقَذَفْنَاهَا فَكَذَٰلِكَ أَلْقَى السَّامِرِيُّ﴾
৮৭। তারা জবাব দিল, “আমারা স্বেচ্ছায় আপনার সাথে ওয়াদা ভংগ করিনি। ব্যাপার হলো, লোকদের অলংকারের বোঝায় আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম
﴿فَأَخْرَجَ لَهُمْ عِجْلًا جَسَدًا لَّهُ خُوَارٌ فَقَالُوا هَٰذَا إِلَٰهُكُمْ وَإِلَٰهُ مُوسَىٰ فَنَسِيَ﴾
৮৮। এবং আমরা স্রেফ সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।৬৭ –তারপর৬৮ এভাবে সামেরীও কিছু ছুঁড়ে ফেললো এবং তাদের একটি বাছুরের মূর্তি বানিয়ে নিয়ে এলো, যার মধ্যে থেকে গরুর মতো আওয়াজ বের হতো। লোকেরা বলে উঠলো, “এ-ই তোমাদের ইলাহ এবং মূসারও ইলাহ, মূসা একে ভুলে গিয়েছে”।
৬৭. যারা সামেরীর ফিতনায় জড়িয়ে পড়েছিল এটি ছিল তাদের ওজর। তাদের বক্তব্য ছিল, আমরা অলংকার ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। বাছুর তৈরী করার নিয়ত আমাদের ছিল না বা তা দিয়ে কি করা হবে তাও আমাদের জানা ছিল না। এরপর যা কিছু ঘটেছে তা আসলে এমন ব্যাপারই ছিল যে, সেগুলো দেখে আমরা স্বতস্ফূর্তভাবে শিরকে লিপ্ত হয়ে গেছি।
“লোকদের অলংকারের বোঝায় আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম”-এ বাক্যের সোজা অর্থ হচ্ছে এই যে, আমাদের পুরুষ ও মেয়েরা মিসরের রীতি অনুযায়ী যেসব ভারী গহনা পরেছিল তা এ মরুচারী জীবনে আমাদের জন্য বোঝার পরিণত হয়েছিল। এ বোঝা আর কতদিন বয়ে বেড়াবো এ চিন্তায় আমরা পেরেশান হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী এ গহনাগুলো মিসর ত্যাগ করার সময় প্রত্যেক ইসরাঈলী নারী ও পুরুষ তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে নিয়েছিল। এভাবে তারা প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিবেশীদেরকে লুট করে রাতারাতি হিজরত করার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল। প্রত্যেক ইসরাঈলী নিজেই এ কাজে ব্রতী হয়েছিল, এ নৈতিক কর্মকাণ্ডটি শুধুমাত্র এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এ মহত কর্মটি আল্লাহর নবী হযরত মূসা আ. তাদেরকে শিখিয়েছিলেন এবং নবীকেও এ নির্দেশ দিয়েছিলেন আল্লাহ নিজেই। দেখুন বাইবেলের যাত্রাপুস্তক এ ব্যাপারে কি বলেঃ
“ঈশ্বর মোশিকে কহিলেন……তুমি যাও ইস্রায়েলের প্রাচীনগণকে একত্র কর, তাহাদিগকে এই কথা বল, ……তোমরা যাত্রাকালে রিক্তহস্তে যাইবে না, কিন্তু প্রত্যেক স্ত্রী আপন আপন প্রতিবাসিনী কিম্বা গৃহে প্রবাসানী স্ত্রীর কাছে রৌপ্যালংকার, স্বর্ণালংকার ও বস্ত্র চাহিবে; এবং তোমরা তাহা আপন আপন পুত্রদের ও কন্যাদের গাত্রে পরাইবে, এই রূপে তোমরা মিস্রীয়দের দ্রব্য হরণ করিবে”। (৩:১৪-২২)
“আর সদাপ্রভু মোশিকে বলিলেন, ……তুমি লোকদের কর্ণগোচরে বল, আর প্রত্যেক পুরুষ আপন আপন প্রতিবাসী হইতে, ও প্রত্যেক স্ত্রী আপন আপন প্রতিবাসিনী হইতে রৌপ্যালংকার ও স্বার্ণালংকার চাহিয়া লউক। আর সদাপ্রভু মিস্রীয়দের দৃষ্টিতে লোকদিগকে অনুগ্রহের পাত্র করিলেন”। (১১:১-৩)
“আর ইস্রায়েল সন্তানেরা মোশির বাক্যানুসারে কার্য করিল; ফলে তাহারা মিস্রীয়দের কাছে রৌপ্যলংকার, স্বর্ণালংকার ও বস্ত্র চাহিল; আর সদাপ্রভু মিস্রীয়দের দৃষ্টিতে তাহাদিগকে অনুগ্রহ পাত্র করিলেন, তাই তাহারা যাহা চাহিল, মিস্রীয়রা তাহাদিগকে তাহাই দিল। এইরূপে তাহারা মিস্রীয়দের ধন হরণ করিল”। (১২:৩৫-৩৬)
দুঃখের বিষয় আমাদের মুফাসসিরগণও কুরআনের এ আয়াতের ব্যাখ্যায় এ বর্ণনা চোখবন্ধ করে উদ্ধৃত করেছেন এবং তাদের এ ভুলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে এ চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে যে, অলংকারের এ বোঝা আসলে ছিল লুটের বোঝা।
আয়াতের দ্বিতীয় অংশ “আমরা স্রেফ সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম” এর অর্থ আমি যা বুঝেছি তা হচ্ছে এই যে, যখন নিজেদের গহনাপাতির বোঝা বইতে বইতে লোকেরা ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে গেছে তখন পরস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত হয়ে থাকবে যে, সবার গহনাপাতি এক জায়গায় জমা করা হোক এবং কার সোনা ও রূপা কি পরিমাণ আছে তা লিখে নেয়া হোক, তারপর এগুলো গলিয়ে ইট ও শলাকায় পরিণত করা হোক। এভাবে জাতির সামগ্রিক মালপত্রের সাথে গাধা ও গরুর পিঠে এগুলো উঠিয়ে দেয়া যাবে। কাজেই এ সিদ্ধান্ত আনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের যাবতীয় অলংকার এনে অলংকারের স্তুপের ওপর নিক্ষেপ করে গিয়ে থাকবে।
৬৮. এখান থেকে এ প্যারার শেষ ইবারত পর্যন্ত চিন্তা করলে পরিস্কার অনুভব করা যায় যে, জাতির জবাব “ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম” পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী এ বিস্তারিত বিবরণ আল্লাহ নিজেই দিচ্ছেন। এ থেকে যে আসল ঘটনা জানা যায় তা হচ্ছে এই যে, আসন্ন ফিতনা সম্পর্কে বেখবর হয়ে লোকেরা যার যার গহনাপাতি এনে স্তূপীকৃত করে চলেছে এবং সামেরী সাহেবও তাদের মধ্যে শামিল ছিলো। পরবর্তী পর্যায়ে অলংকার গালাবার দায়িত্ব সামেরী সাহেব নিজের কাঁধে নিয়ে নেন এবং এমন কিছু জালিয়াতি করেন যার ফলে ইট বা শলাকা তৈরী করার পরিবর্তে একটি বাছুরের মূর্তি তৈরী হয়ে আসে। তার মুখ থেকে গরুর মতো হাম্বা রব বের হতো। এভাবে সামেরী জাতিকে প্রতারিত করে। তার কথা হচ্ছে, আমি তা শুধু সোনা গালাবার দায়িত্ব নিয়েছিলাম কিন্তু তার মধ্য থেকে তোমাদের এ দেবতা নিজেই স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে।
﴿أَفَلَا يَرَوْنَ أَلَّا يَرْجِعُ إِلَيْهِمْ قَوْلًا وَلَا يَمْلِكُ لَهُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا﴾
৮৯। তারা কি দেখছিল না যে, সে তাদের কথারও জবাব দেয় না। এবং তাদের উপকার ও ক্ষতি করার কোন ক্ষমতাও রাখে না?
﴿وَلَقَدْ قَالَ لَهُمْ هَارُونُ مِن قَبْلُ يَا قَوْمِ إِنَّمَا فُتِنتُم بِهِ ۖ وَإِنَّ رَبَّكُمُ الرَّحْمَٰنُ فَاتَّبِعُونِي وَأَطِيعُوا أَمْرِي﴾
৯০। (মূসার আসার) আগেই হারুন তাদের বলেছিল, “হে লোকেরা! এর কারণে তোমরা পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়েছো। তোমাদের রব তো করুণাময়, কাজেই তোমরা আমার অনুসরণ করো এবং আমার কথা মেনে নাও।
﴿قَالُوا لَن نَّبْرَحَ عَلَيْهِ عَاكِفِينَ حَتَّىٰ يَرْجِعَ إِلَيْنَا مُوسَىٰ﴾
৯১। কিন্তু তারা তাকে বলে দিল, “মূসার না আসা পর্যন্ত আমরা তো এরি পূজা করতে থাকবো”।৬৯
৬৯. বাইবেল এর বিপরীত হযরত হারুনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনছে যে, বাছুর বানানো এবং তাকে উপাস্য বানানোর মহা পাপ তিনিই করেছিলেনঃ
“পর্বত হইতে নামিতে মোশির বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া লোকেরা হারোণের নিকটে একত্র হইয়া তাহাকে কহিল, উঠুন আমাদের অগ্রগামী হইবার জন্য আমাদের নিমিত্ত দেবতা নির্মাণ করুন, কেননা যে মোশি মিসর দেশ হইতে আমাদিগকে বাহির করিয়া আনিয়াছেন, সেই ব্যক্তির কি হইল, আমরা জানি না। তখন হারোণ তাহাদিগকে কহিলেন, তোমরা আপন আপন স্ত্রী ও পুত্রকন্যাগণের কর্ণের সুবর্ণ কুণ্ডল খুলিয়া আমার কাছে আন। তাহাতে সমস্ত লোক তাহাদের কর্ণ হইতে সুবর্ণ কুণ্ডল খুলিয়া হারোণের নিকটে আনিল। তখন তিনি তাহাদের হস্ত হইতে তাহা গ্রহণ করিয়া শিল্পাস্ত্রে গঠন করিলেন; এবং একটি ঢালা গো-বৎস নির্মাণ করিলেন, তখন লোকেরা বলিতে লাগিল, হে ইস্রায়েল, এ তোমার দেবতা, যিনি মিসর দেশ হইতে তোমাকে বাহির করিয়া আনিয়াছেন। আর হারোণ তাহা দেখিয়া তাহার সম্মুখে এক বেদি নির্মাণ করিলেন এবং হারোণ ঘোষণা করিয়া দিলেন, বলিলে, কল্য সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে উৎসব হইবে”। (যাত্রা পুস্তকঃ ৩২:১-৬)
বনী ইসরাঈলের সামাজে এ ভুল বর্ণনার খ্যাতিলাভের সম্ভাব্য কারণ এও হতে পারে যে, হয়তো সামেরীর নাম হারুণই ছিল এবং পরবর্তী লোকেরা এই হারুণকে হারুণ নবীর সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আজ খৃস্টান মিশনারী ও পশ্চিমের প্রাচ্যবিদরা জোর দিয়ে একথাই বলতে চায় যে, এখানেও কুরআন নিশ্চয়ই ভুল করেছে। তাদের পাক-পবিত্র নবী-ই বাছুরকে ইলাহ বানিয়েছিলেন এবং তাঁর গাত্রাবরণ থেকে এ দাগটি তুলে দিয়ে কুরআন একটি উপকার করেনি বরং উলটো অপরাধ করেছে। এ হচ্ছে তাদের হঠকারিতার অবস্থা। তবে তারা এটা দেখছেন না যে, এ একই অধ্যায়েই মাত্র কয়েক লাইন পরেই বাইবেল কিভাবে নিজেই নিজের ভুল বর্ণনার রহস্য ভেদ করছে। এ অধ্যায়ের শেষ দশটি শ্লোকে বাইবেল বর্ণনা করছে যে, হযরত মূসা আ. এরপর লেবীর সন্তানদেরকে একত্র করলেন এবং তাদেরকে আল্লাহর এ হুকুম শুনালেন যে, যারা এ শিরকের মহাপাপে লিপ্ত হয়েছে তাদেরকে হত্যা করতে হবে এবং প্রত্যেক মু’মিন নিজ হাতে নিজের যেসব ভাই, সাথী ও প্রতিবেশী গো-বৎস পূজায় লিপ্ত হয়েছিল তাদেরকে হত্যা করবে। এভাবে সেদিন তিন হাজার লোক নিহত হলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত হারুণকে কেন ছেড়ে দেয়া হলো? যদি তিনিই এ অপরাধের মূল উদগাতা ও স্রষ্টা হয়ে থাকেন তাহলে তাকে এ গণহত্যা থেকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা হলো? লেবীর সন্তানরা কি তাহলে একথা বলতো না যে, হে মূসা! আমাদের তো হুকুম দিচ্ছো নিজেদের গুনাহগার ভাই, সাথী ও প্রতিবেশীদেরকে নিজেদের হাতে হত্যা করার কিন্তু নিজের ভাইয়ের গায়ে হাত উঠাচ্ছো না কেন, অথচ আসল গোনাহগার তো সে-ই ছিল? সামনের দিকে গিয়ে আরো বলা হয়েছে, মূসা সদাপ্রভুর কাছে গিয়ে আবেদন জানান, এবার বনী ইসরাঈলের গোনাহ মাফ করে দেন, নয়তো তোমার কিতাব থেকে আমার নাম কেটে দাও। এ কথায় আল্লাহ জবাব দেন, “যে ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে গোনাহ করেছে আমি তার নাম আমার কিতাব থেকে মুছে ফেলবো”। কিন্তু আমরা দেখছি, হযরত হারুণের নাম মুছে ফেলা হয়নি। বরং তার পরিবর্তে তাঁকে ও তাঁর সন্তান সন্ততিদেরকে বনী ইসরাঈলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পদ অর্থাৎ নবী লেবীর নেতৃত্ব ও বায়তুল মাকদিসের সেবায়েতের দায়িত্ব দান করা হয়। (গণনা পুস্তকঃ ১৮:১-৭) বাইবেলের এ আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য কি তার নিজের পূর্ববর্তী বর্ণনার প্রতিবাদ ও কুরআনের বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করছে না?
﴿قَالَ يَا هَارُونُ مَا مَنَعَكَ إِذْ رَأَيْتَهُمْ ضَلُّوا﴾
৯২। মূসা (তার সম্প্রদায়কে ধমকাবার পর হরুনের দিকে ফিরে) বললো, “হে হারুন! তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন আমার পথে চলা থেকে কিসে তোমাকে বিরত রেখেছিল?
﴿أَلَّا تَتَّبِعَنِ ۖ أَفَعَصَيْتَ أَمْرِي﴾
৯৩। তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করেছো?৭০
৭০. হুকুম বলতে এখানে পাহাড়ে যাবার সময় এবং নিজের জায়গায় হযরত হারুনকে বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব অধিষ্ঠিত করার পূব মুহূর্তে হযরত মূসা তাঁকে যে হুকুম দিয়েছিলে সে কথাই বুঝানো হয়েছে। সূরা আল আ’রাফের একে এভাবে বলা হয়েছেঃ
وَقَالَ مُوسَىٰ لِأَخِيهِ هَارُونَ اخْلُفْنِي فِي قَوْمِي وَأَصْلِحْ وَلَا تَتَّبِعْ سَبِيلَ الْمُفْسِدِينَ
“আর মূসা (যাওয়ার সময়) নিজের ভাই হারুনকে বললো, তুমি আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করো এবং দেখো, সংশোধন করবে, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পথ অনুসরণ করো না। (আয়াতঃ ১৪২)
﴿قَالَ يَا ابْنَ أُمَّ لَا تَأْخُذْ بِلِحْيَتِي وَلَا بِرَأْسِي ۖ إِنِّي خَشِيتُ أَن تَقُولَ فَرَّقْتَ بَيْنَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَمْ تَرْقُبْ قَوْلِي﴾
৯৪। হারুন জবাব দিল, “হে আমার সহোদর ভাই! আমার দাড়ি ও মাথার চুল ধরে টেনো না।৭১ আমার আশংকা ছিল, তুমি এসে বলবে যে, তুমি বনী ইসরাঈলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছো এবং আমার কথা রক্ষা করোনি।”৭২
৭১. এ আয়াত গুলোর অনুবাদের সময় আমি এ বিষয়টি সামনে রেখেছি যে, হযরত মূসা ছোট ভাই ছিলেন কিন্তু মর্যাদার দিক দিয়ে ছিলেন বড়। অন্যদিকে হযরত হারুন বড় ভাই ছিলেন কিন্তু মর্যাদার দিক দিয়ে ছিলেন ছোট।
৭২. হযরত হারুনের জবাবের অর্থ কখনোই এই নয় যে, জাতির ঐক্যবদ্ধ থাকা তার সঠিক পথে থাকার চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং শিরকের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা তার এমন অনৈক্যের চেয়ে ভালো যার ভিত্তি গড়ে ওঠে হক ও বাতিলের বিরোধের ওপর। কোন ব্যক্তি যদি এ আয়াতের এ অর্থ করে তাহলে সে কুরআন থেকে গোমরাহী গ্রহণ করবে। হযরত হারুনের পুরো কথাটা বুঝতে হলে এ আয়াতটিকে সূরা আল আ’রাফের ১৫০ আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়তে হবে। সেখানে বলা হয়েছেঃ
ابْنَ أُمَّ إِنَّ الْقَوْمَ اسْتَضْعَفُونِي وَكَادُوا يَقْتُلُونَنِي فَلَا تُشْمِتْ بِيَ الْأَعْدَاءَ وَلَا تَجْعَلْنِي مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
“হে আমার সহোদর ভাই! এ লোকেরা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং আমাকে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। কাজেই তুমি দুশমনদেরকে আমার প্রতি হাসবার সুযোগ দিয়ো না এবং ঐ জালেম দলের মধ্যে আমাকে গণ্য করো না”।
এখন এ উভয় আয়াত একত্র করে দেখলে যথার্থ ঘটনার এ ছবি সামনে আসে যে, হযরত হারুন লোকদেরকে এ গোমরাহী থেকে রুখবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন কিন্তু তারা তাঁর বিরোদ্ধে মহা বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং তাঁকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। বাধ্য হয়ে তিনি এই আশংকায় নীরব হয়ে যান যে, হযরত মূসার ফিরে আমার আগেই গৃহযুদ্ধ শুরু না হয়ে যায় এবং তিনি পরে এসে এ অভিযোগ না করে বসেন যে, তোমার যখন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার ক্ষমতা ছিল না তখন তুমি পরিস্থিতিকে এতদূর গড়াতে দিলে কেন? আমার আসার অপেক্ষা করলে না কেন? সূরা আল আ’রাফের আয়াতের শেষ বাক্য থেকেও একথাই প্রতিভাত হয় যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে উভয় ভাইয়ের একদল শত্রু ছিল।
﴿قَالَ فَمَا خَطْبُكَ يَا سَامِرِيُّ﴾
৯৫। মূসা বললো, “আর হে সামেরী তোমার কি ব্যাপার?
﴿قَالَ بَصُرْتُ بِمَا لَمْ يَبْصُرُوا بِهِ فَقَبَضْتُ قَبْضَةً مِّنْ أَثَرِ الرَّسُولِ فَنَبَذْتُهَا وَكَذَٰلِكَ سَوَّلَتْ لِي نَفْسِي﴾
৯৬। সে জবাব দিল, “আমি এমন জিনিস দেখেছি যা এরা দেখেনি, কাজেই আমি রাসূলের পদাংক থেকে এক মুঠো তুলে নিয়েছি এবং তা নিক্ষেপ করেছি, আমার মন আমাকে এমনি ধারাই কিছু বুঝিয়েছে।৭৩
৭৩. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় দু’টি দলের পক্ষ থেকে অদ্ভুত ধরনের টানা হেঁচড়া করা হয়েছে।
একটি দলে আছেন প্রাচীন তাফসীরকারগণ এবং প্রাচীন পদ্ধতিতে তাফসীরকারীদের বৃহত্তম অংশ। তারা এর অর্থ বর্ণনা করেন, “সামেরী রাসূল অর্থাৎ জিব্রাঈলকে যেতে দেখে নিয়েছিল এবং তাঁর পদাংক থেকে এক মুঠো মাটি উঠিয়ে নিয়েছিল। আর এই মাটি যখন বাছুরের মূর্তির মধ্যে রাখা হয়েছিল তখন তার অলৌকিক মহিমায় তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল প্রাণ স্পন্দন এবং একটি জীবন্ত বাছুরের মত হাম্বা রব তার মুখ থেকে বের হতে শুরু হয়েছিল”। অথচ সত্যিই যে এমনটি হয়েছিল তা অবশ্যি কুরআন বলছে না। কুরআন স্রেফ এতটুকু বলছে যে, হযরত মূসার প্রশ্নের জবাবে সামেরী একথা বানিয়ে বলেছিল। এ অবস্থায় আমরা বুঝতে পারছি না, মুফাসিরগণ কেমন করে একে একটি সত্য ঘটনা এবং কুরআন বর্ণিত যথার্থ সত্য মনে করে বসলেন।
দ্বিতীয় দলটি সামেরীর কথার অন্য একটি অর্থ করেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সামেরী আসলে বলেছিল, “আমি রাসূল অর্থাৎ মূসার দীনের মধ্যে এমন দুর্বলতা দেখেছিলাম যা অন্যেরা দেখতে পায়নি। তাই আমি একদিক থেকে তাঁর পদাংক অনুসরণ করেছিলাম কিন্তু পরে তা ত্যাগ করেছিলাম”। এ ব্যাখ্যাটি সম্ভবত সর্বপ্রথম করেন আবু মুসলিম ইসফাহানী। তারপর ইমাম রাযী একে নিজের তাফসীরে উদ্ধৃত করে এর প্রতি নিজের সমর্থন প্রকাশ করেন। বর্তমানে আধুনিক তাফসীরকারদের অধিকাংশই এ অর্থটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিন্তু তারা এ কথা ভুলে গেছেন যে, কুরআন ধাঁ ধাঁ ও হেঁয়ালির ভাষায় নাযিল হয়নি। বরং পরিস্কার ও সাধারণের বোধগম্য সহজ সরল আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। একজন সাধারণ আরববাসী নিজের ভাষায় প্রচলিত স্বাভাবিক বাগধারা অনুযায়ী এর বক্তব্য বুঝতে সক্ষম। আরবী ভাষায় সাধারণ প্রচলিত বাকরীতি ও দৈনন্দিন কথোপকথনের শব্দাবলী সম্পর্কে অবগত কোন ব্যক্তি কখনো একথা মেনে নিতে পারে না যে, সামেরীর এ সামেরীর এ মনোভাব প্রকাশ করার জন্য সহজ সরল আরবী ভাষায় এমন সব শব্দ ব্যবহার করা হবে যা এ আয়াতের তাফসীরকারগণ বলেছেন। অথবা একজন সাধারণ আরবীয় একথাগুলো শুনে কখনো এমন অর্থ গহণ করতে পারে না যা এ তাফসীরকারগণ বর্ণনা করেছেন। অভিধান গ্রন্থ থেকে কোন একটি শব্দের এমন একাধিক অর্থ গ্রহণ করা যা বিভিন্ন প্রবাদে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং তার মধ্য থেকে কোন একটি অর্থ নিয়ে এমন একটি বাক্যের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া যেখানে একজন সাধারণ আরব কখনোই এ শব্দটিকে এ অর্থে ব্যবহার করে না-এটাতো ভাষাজ্ঞান হতে পারে না, তবে বাগাড়ম্বর হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি নেই। ‘ফরহংগে আসেফীয়া’ নামক উর্দু অভিধান খানি অথবা ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারী’ হাতে নিয়ে যদি কোন ব্যক্তি যথাক্রমে তাদের উর্দু ও ইংরেজী রচনাগুলো মধ্যে এ ধরনের কৃতিত্ব ফলাতে থাকেন, তাহলে সম্ভবত নিজেদের কথার দু-চারটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনেই তাদের লেখকরা চিৎকার করে উঠবেন। সাধারণত কুরআনের এ ধরনের ব্যাখ্যা এমন সময় করা হয় যখন এক ব্যক্তি কোন আয়াতের সহজ সরল অর্থ দেখে নিজে নিজেই একথা মনে করে থাকে যে, এখানে তো আল্লাহ তাআ’লা বড়ই অসাবধান হয়ে গেছেন, এসো আমি তাঁর কথা এমনভাবে পেশ করে দিই যার ফলে তাঁর ভুলের পরদা ঢেকে যাবে এবং তাঁর বক্তব্য নিয়ে লোকদের হাসাহাসি করার সুযোগ থাকবে না।
এ বিবৃত চিন্তা পরিহার করে যে ব্যক্তিই এ বক্তব্য পরম্পরায় এ আয়াতটি পড়বে সে সহজে বুঝতে পারবে যে, সামেরী ছিল একজন ফিতনাবাজ ব্যক্তি। সে ভালোভাবে ভেবেচিন্তে ধোকা ও প্রতারণার একটি বিরাট পরিকল্পনা তৈরী করেছিল। সে কেবল একটি সোনার বাছুর তৈরী করে যে কোন কৌশলে তার মধ্যে গো-বৎসের হামবা রব সৃষ্টি করে দেয়নি এবং সমগ্র জাতি অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকদের প্রতারিত করেনি বরং সে আরো দুঃসাহসী হয়ে খোদ হযরত মূসা আ.কেও এমটি প্রতারণাপূর্ণ গল্প শুনিয়ে দিল। সে দাবী করলো, আমি এমন কিছু দেখেছি যা অন্যেরা দেখেনি। সাথে সাথে এ গল্পও শুনিয়ে দিল যে, রাসুলের পদাংকের এক মুঠো মাটিই এ কেরামতি দেখিয়েছে। রাসূল বলে সে জিব্রাঈলকেও নির্দেশ করতে পরে, যেমন প্রাচীন তাফসীরকারগণ মনে করেছেন। কিন্তু যদি একথা মনে করা হয় যে, রাসূল শব্দটি বলে সে হযরত মূসাকে নির্দেশ করেছে, তাহলে এটা তার আর একটা প্রতারণা। সে এভাবে হযরত মূসাকে মানসিক উৎকোচ দিতে চাচ্ছিল, যাতে তিনি এটাকে তাঁর নিজের পদাংকের অলৌকিকতা মনে করে গর্বিত হন এবং নিজের অন্যান্য কেরামতির প্রচারণার জন্য সামেরীর প্রতারণা হিসেবেই পেশ করছে, নিজের পক্ষ থেকে প্রকৃত ঘটনা হিসেবে পেশ করছে না। তাই এতে এমন দুষনীয় কিছু ঘটেনি যে, তা প্রক্ষালনের জন্য অভিধান গ্রন্থগুলোর সাহায্যে অযথা বাগাড়ম্বর করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। বরং পরবর্তী বাক্যগুলোতে হযরত মূসা যেভাবে তাকে ধিক্কার ও অভিশাপ দিয়েছেন এবং তার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেছেন তা থেকে পরিস্কার প্রতীয়মান হয় যে, তার বানানো এ প্রতারণাপূর্ণ গল্প শোনার সাথে সাথেই তিনি তা তার মুখের উপর ছুঁড়ে মেরেছিলেন।
﴿قَالَ فَاذْهَبْ فَإِنَّ لَكَ فِي الْحَيَاةِ أَن تَقُولَ لَا مِسَاسَ ۖ وَإِنَّ لَكَ مَوْعِدًا لَّن تُخْلَفَهُ ۖ وَانظُرْ إِلَىٰ إِلَٰهِكَ الَّذِي ظَلْتَ عَلَيْهِ عَاكِفًا ۖ لَّنُحَرِّقَنَّهُ ثُمَّ لَنَنسِفَنَّهُ فِي الْيَمِّ نَسْفًا﴾
৯৭। মূসা বললো, “বেশ, তুই দুর হয়ে যা, এখন জীবনভর তুই শুধু একথাই বলতে থাকবি, আমাকে ছুঁয়ো না।৭৪ আর তোর জন্য জবাবদিহির একটি সময় নির্ধারিত রয়েছে যা কখনোই তোর থেকে দূরে সরে যাবে না। আর দেখ, তোর এই ইলাহর প্রতি, যার পূজায় তুই মত্ত ছিলি, এখন আমরা তাকে জ্বালিয়ে দেবো এবং তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেবো।
৭৪. অর্থাৎ শুধু এতটুকুই নয় যে, সারাজীবনের জন্য মানব সমাজের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে এবং তাকে অচ্ছুৎ বানিয়ে রাখা হয়েছে বরং তার ওপর এ দায়িত্বও অর্পিত হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই সে নিজের অচ্ছুৎ হওয়া সম্পর্কে জানিয়ে দেবে এবং দূর থেকেই লোকদেরকে এ মর্মে বলতে থাকবে, “আমি অচ্ছুৎ আমাকে ছুঁয়ো না”। বাইবেলের লেবীয় পুস্তকে কুষ্ঠরোগীর স্পর্শ থেকে লোকদেরকে বাঁচাবার জন্য যে নিয়ম বাতলানো হয়েছে তার মধ্য থেকে একটি নিয়ম হচ্ছে এইঃ
“আর যে কুষ্ঠীর ঘা হইয়াছে। তাহার বন্ত্র চেরা যাইবে, ও তার মস্তক মুক্ত কেশ থাকিবে, ও সে আপনার ওষ্ঠ বস্ত্র দ্বারা ঢাকিয়া ‘অশুচি, অশুচি’ এ শব্দ করিবে। যতদিন তাহার গাত্রে ঘা থাকিবে, ততদিন সে অশুচি থাকিবে; সে অশুচি; সে একাকী বাস করিবে, শিবিরের বাহিরে তাহার বাসস্থান হইবে”। (১৩:৪৫-৪৬)
এ থেকে অনুমতি হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে তাকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করা হয়ে থাকবে অথবা তার জন্য এ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়ে থাকবে যে, শারীরিকভাবে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যেভাবে সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা করে দেয়া হয়ে থাকি ঠিক তেমনিভাবে নৈতিক কুষ্ঠে আক্রান্ত রোগীকেও মানুষদের থেকে আলাদা করে দিতে হবে এবং এ ব্যক্তিও কুষ্ঠরোগীর মতো চিৎকার করে করে তার কাছে আগত প্রত্যেক ব্যক্তিকে বলতে থাকবেঃ আমি অপবিত্র, আমাকে ছুঁয়ো না।
﴿إِنَّمَا إِلَٰهُكُمُ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ وَسِعَ كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا﴾
৯৮। হে লোকেরা! এক আল্লাহই তোমাদের ইলাহ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, প্রত্যেক জিনিসের ওপর তাঁর জ্ঞান পরিব্যাপ্ত।
﴿كَذَٰلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ ۚ وَقَدْ آتَيْنَاكَ مِن لَّدُنَّا ذِكْرًا﴾
৯৯। হে মুহাম্মাদ!৭৫ এভাবে আমি অতীতে যা ঘটে গেছে তার অবস্থা তোমাকে শুনাই এবং আমি বিশেষ করে নিজের কাছ থেকে তোমাকে একটি ‘যিকির’ (উপদেশমালা) দান করেছি।৭৬
৭৫. মূসা আ. এর কাহিনী খতম করে আবার ভাষণের মোড় সেদিকে ফিরে যাচ্ছে যা দিয়ে সূরার সূচনা হয়েছিল। সামনে এগিয়ে যাবার আগে আর একবার সূরার সেই প্রারম্ভিক আয়াত গুলো পড়ে নিন—-যেগুলোর পর হঠাৎ হযরত মূসার কাহিনী শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ থেকে ভালোভাবে বুঝা যাবে, সূরার আসল আলোচ্য বিষয় কি, মাঝাখানে মূসার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে কেন এবং কাহিনী খতম করে কিভাবে ভাষণটি তার মূল বিষয়বস্তুর দিকে ফিরে আসছে।
৭৬. অর্থাৎ এ সূরার প্রথমে যে কুরআনের কথা বলা হয়েছিল সেটা এমন কোন বিষয় ছিল না যার মাধ্যমে তোমাদের কোন অসম্ভব কাজে লিপ্ত করা বা তোমাদের ওপর অনর্থক একটা কষ্টকর কাজ চাপিয়ে দেবার জন্য তা নাযিল করা হয়েছিল। সেটা তো ছিল একটা স্মারক ও উপদেশ (তাযকিরাহ), এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে অন্তরে আল্লাহকে ভয় করে।
﴿مَّنْ أَعْرَضَ عَنْهُ فَإِنَّهُ يَحْمِلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وِزْرًا﴾
১০০। যে ব্যক্তি এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে কিয়ামতের দিন কঠিন গোনাহের বোঝা উঠাবে।
﴿خَالِدِينَ فِيهِ ۖ وَسَاءَ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِمْلًا﴾
১০১। আর এ ধরনের লোকেরা চিরকাল এ দুর্ভাগ্য পীড়িত থাকবে এবং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য (এই অপরাধের দায়ভার) বড়ই কষ্টকর বোঝা হবে।৭৭
৭৭. এখানে প্রথমত বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ উপদেশবাণী অর্থাৎ কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং তার বিধান ও পথ নির্দেশনা গ্রহণে অস্বীকার করবে সে নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে। এর ফলে মুহাম্মাদ সা. এবং তাঁকে প্রেরণকারী আল্লাহর কোন ক্ষতি হবে না। তার এ নির্বুদ্ধিতা হবে তার নিজেরই সাথে শত্রুতারই নামান্তর। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, যে ব্যক্তির কাছে কুরআনের এ নসীহত পৌছে গেছে এবং সে এটা গ্রহণ করতে ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে ও ইতস্তত করছে সে আখেরাতে শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। আয়াতের শব্দাবলী ব্যাপক অর্থ প্রকাশক। কোন দেশ, জাতিও সময়ের সাথে সেগুলো বিশেষভাবে সম্পর্কিত নয়। যতদিন এ কুরআন দুনিয়ায় থাকবে, যেখানে, যে দেশে এবং জাতি ও ব্যক্তির কাছে এটা পৌছে যাবে সেখানে তার জন্য দুটোই পথ খোলা থাকবে। তৃতীয় কোন পথ সেখানে থাকবে না। হয় একে মেনে নিয়ে এর আনুগত্য করতে হবে আর নয়তো একে অস্বীকার করে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। প্রথম পথ অবলম্বনকারী পরিণতি সামনের দিকে বর্ণনা করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় পথ অবলম্বকারীদের পরিণতি এ আয়াতে বাতলে দেয়া হয়েছে।
﴿يَوْمَ يُنفَخُ فِي الصُّورِ ۚ وَنَحْشُرُ الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ زُرْقًا﴾
১০২। সেদিন যখন সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে৭৮ এবং আমি অপরাধীদেরকে এমনভাবে ঘেরাও করে আনবো যে, তাদের চোখ (আতংকে) দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে।৭৯
৭৮. সিংগা মানে রণভেরী, রণতুর্য। আজকাল এর বিকল্প হিসেবে বিউগল বলা যেতে পারে। সেনাদলকে একত্র ও বিক্ষিপ্ত করার এবং নির্দেশ দেবার জন্য বিউগল বাজানো হয়। আল্লাহ তাঁর বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা বুঝাবার জন্য এমন সব শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন যা মানুষের জীবন ব্যবস্থা পরিচালনায় ব্যবহৃত শব্দের সাথে সাদৃশ্য রাখে। এ শব্দ ও পরিভাষাগুলো ব্যবহার করার মূল লক্ষ হচ্ছে আমাদের ধারণা, কল্পনা ও চিন্তাশক্তিকে আসল জিনিসের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। আমরা সত্যিই আল্লাহর রাজ্যের বিভিন্ন জিনিসকে হুবহু এ সীমিত অর্থে গ্রহণ করবো এবং সেগুলোকে এসব সীমিত আকারের জিনিস মনে করে নেবো যেমন আমাদের জীবনে পাওয়া যায়, এটা কখনোই এর উদ্দেশ্য নয়। প্রাচীন যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত লোকদের জমা করার এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা ঘোষণা করার জন্য এমন কোন না কোন জিনিস বাজানো বা কোন কিছুতে ফুঁক দিয়ে বিকট আওয়াজ সৃষ্টি করা হয় যা রনভেরী, রনতুর্য বা বিউগলের সাথে সাদৃশ্য রাখে। আল্লাহ বলেন, কিয়ামতের দিন এমনি একটি জিনিস ফুঁক দেয়া হবে (যা আমাদের বিউগলের মতো। একবার তাতে ফুঁক দেয়া হবে) তখন সবাই মারা পড়বে। দ্বিতীয়বার ফুঁক দেয়া হবে, তখন সবাই জেগে উঠবে এবং পৃথিবীর সব দিক থেকে বের হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে ছুটে আসতে থাকবে। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নামলঃ ১০৬ টীকা)।
৭৯. মুল শব্দ “যুরকান”। এটা হচ্ছে “আযরাক”-এর বহুবচন। কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন যারা ‘আযরাক’ বা সাদাটে নীলচে ভাব ধারণ করবে। কারণ ভয়ে ও আতংকে তাদের রক্ত শুকিয়ে যাবে এবং তাদের অবস্থা এমন হয়ে যাবে যেন তাদের শরীরে এক বিন্দুও রক্ত নেই। আবার অন্য কিছু লোক এ শব্দকে “আযরাকুল আয়েন” বা নীল চক্ষুওয়ালার অর্থে গ্রহণ করেছেন। তারা এর অর্থ করেন অত্যাধিক ভয়ে তাদের চোখের মনি থির হয়ে যাবে। যখন কারোর চোখ আলোহীন হয়ে পড়ে তখন তার চোখের মনি সাদা হয়ে যায়।
﴿يَتَخَافَتُونَ بَيْنَهُمْ إِن لَّبِثْتُمْ إِلَّا عَشْرًا﴾
১০৩। তারা পরস্পর চুপিচুপি বলাবলি করবে, দুনিয়ায় বড়জোর তোমরা দশটা দিন অতিবাহিত করেছো”৮০
৮০. এর আরেকটি মানে এ হতে পারে মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত তোমাদের বড় জোর দশ দিন অতিবাহিত হয়ে থাকবে।” কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থান থেকে জানা যায়, কিয়ামতের দিন লোকেরা নিজেদের দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কেও আন্দাজ করে নেবে যে, তা ছিল অতি সামান্য দিনের এবং মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে সময়কাল অতিবাহিত হয়ে থাকবে সে সম্পর্কেও তাদের এ প্রায় একই ধরনের অনুমান হবে। কুরআনের এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ
قالَ كَمْ لَبِثْتُمْ في الأرْضِ عَدَدَ سِنِينَ، قالُوا لَبِثْنا يَوْمًا أوْ بَعْضَ يَوْمٍ فاسْألِ العادِّينَ
“আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা পৃথিবীতে কত বছর ছিলে? জবাব দেবে, একদিন বা দিনের এক অংশ থেকেছি, গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করে নিন”। (আল মু’মিনূনঃ ১১২-১১৩)
অন্য জায়গায় বলা হচ্ছেঃ
وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُونَ مَا لَبِثُوا غَيْرَ سَاعَةٍ ۚ كَذَٰلِكَ كَانُوا يُؤْفَكُونَ، وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَالْإِيمَانَ لَقَدْ لَبِثْتُمْ فِي كِتَابِ اللَّهِ إِلَىٰ يَوْمِ الْبَعْثِ ۖ فَهَٰذَا يَوْمُ الْبَعْثِ وَلَٰكِنَّكُمْ كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
“আর যেদিন কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে তখন অপরাধীরা কসম খেয়ে খেয়ে বলবে, আমরা (মৃত অবস্থায়) এক ঘন্টার বেশী সময় পড়ে থাকিনি। এভাবে তারা দুনিয়ায়ও ধোকা খেতে থেকেছে। আর যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান দেয়া হয়েছিল তারা বলবে, আল্লাহর কিতাবের বক্তব্য অনুযায়ী তোমরা তো পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত পড়ে থেকেছো। এবং আজ সে পুনরুত্থান দিবস, কিন্তু তোমরা জানতে না”। (আর রূমঃ ৫৫-৫৬)
এসব সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে প্রমাণ হয় দুনিয়ার জীবন ও আলমে বরযখের (মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত) জীবন উভয়কে তারা সামান্য মনে করবে। দুনিয়ার জীবন সম্বন্ধে তারা এ কথা এজন্য বলবে যে, নিজেদের আশা-আকাংখার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় একটি চিরন্তন জীবনে যখন তাদের চোখ মেলতে হবে এবং যখন তারা দেখবে এখানকার জন্য তারা কিছুই তৈরী করে আনেনি, তখন চরম আক্ষেপ ও হতাশার সাথে তারা নিজেদের পৃথিবীর জীবনের দিকে ফিরে দেখবে এবং দুঃখ করে বলতে থাকবে, হায়! মাত্র দু’দিনের আনন্দ ও ভোগ বিলাসের লোভে আমরা চিরকালের জন্য নিজেদের পায়ে কুড়াল মারলাম। মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জীবনকাল তাদের কাছে সামান্য মনে হবে, কারণ মৃত্যুপরের জীবনকে তারা দুনিয়ায় অসম্ভব মনে করতো এবং কুরআন বর্ণিত পরকলীন জগতের ভুগোল কখনোই গুরুত্ব সহকারে তাদের কাছে গৃহীত হয়নি। এ ধারণা-কল্পনা নিয়েই তারা দুনিয়ার জীবনের সচেতন মুহূর্তগুলো নিশেষ করেছিল। আর এখন হঠাৎ চোখ মেলতেই সামনে দেখবে দ্বিতীয় জীবনের সূচনা। এ জীবনের শুরুতেই বিউগলের বিকট আওয়াজে নিজেদের দেখবে মার্চ করতে করতে এগিয়ে যেতে। ভীষণ আতংকের মধ্যে এখন তারা মনে করতে থাকবে ওমুক হাসপাতালে বেহুশ হবার পর থেকে এ পর্যন্ত কতটুকু সময়ই বা কেটে গেছে। তাদের মগজে একথা আসবেই না যে, দুনিয়ায় তারা মারা পড়েছিল এবং এখন সে দ্বিতীয় জীবনটিই শুরু হয়েছে, যাকে তারা একেবারে অর্থহীন ও অযৌক্তিক বলে ঠাট্রা করে হেসে উড়িয়ে দিতো। তাই তাদের প্রত্যেকেই একথা মনে করতে থাকবে, সম্ভবত আমি কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম এবং এখন এমন এক সময় আমার চেতনা ফিরে এসেছে অথবা ঘটনাক্রমে এমন এক জায়গায় আমি পৌছে গেছি যেখানে কোন রকমের দুর্ঘটার কারণে লোকেরা একদিকে দৌড়ে চলছে। এটাও অসম্ভব মনে হয় না যে, আজকাল যারা মরছে তারা কিয়ামতের শিংগার আওয়াজকে কিছুক্ষণ পর্যন্ত বিমান আক্রমণের পূর্বের সতর্কতামূলক সাইরেন ধ্বনি বলে মনে করতে থাকবে।
﴿نَّحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُولُونَ إِذْ يَقُولُ أَمْثَلُهُمْ طَرِيقَةً إِن لَّبِثْتُمْ إِلَّا يَوْمًا﴾
১০৪। –আমি৮১ ভালোভাবেই জানি তারা কিসব কথা বলবে, (আমি এও জানি) সে সময় তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী সতর্ক অনুমানকারী হবে সে বলবে, না তোমাদের দুনিয়ার জীবনতো মাত্র একদিনের জীবন ছিল।
৮১. এটি একটি প্রাসংগিক বাক্য। ভাষণের মাঝখানে এর সাহায্যে শ্রোতাদের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে। শ্রোতাদের মনে এ সন্দেহ জাগার সম্ভাবনা রয়েছে যে, সে সময় হাশরের ময়দানে ছুটে চলা লোকেরা চুপিসারে যে আলাপ করবে তা আজ এখানে কেমন করে বর্ণনা করা হচ্ছে?
﴿وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْجِبَالِ فَقُلْ يَنسِفُهَا رَبِّي نَسْفًا﴾
১০৫। -এ লোকেরা৮২ তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, সেদিন এ পাহাড়গুলো কোথায় চলে যাবে? বলো, আমার রব তাদেরকে ধূলি বানিয়ে উড়িয়ে দেবেন
৮২. এটিও একটি প্রাসংগিক বাক্য। ভাষণের মাঝখানে কোন শ্রোতার প্রশ্নের জবাবে এ বাক্যটি বলা হয়েছে। মনে হয় যখন এ সূরাটি একটি ঐশী ভাষণ হিসেবে শুনানো হচ্ছিল তখন কেই বিদ্রুপ করার জন্য এ প্রশ্নটি উঠিয়েছিল যে, কিয়ামাতের যে চিত্র আপনি আঁকছেন তাতে তো মনে হচ্ছে সারা দুনিয়ার লোকেরা কোন সমতল প্রান্তরের ওপর দিয়ে ছুটে চলতে থাকবে। তাহলে এ বিশালাকৃতির পাহাড়গুলো তখন কোথায় চলে যাবে? এ প্রশ্নের সুযোগটি বুঝার জন্য যে পরিবেশে এ ভাষণ দেয়া হচ্ছিল সেটি সামনে রাখতে হবে। মক্কা যে স্থানে অবস্থিত তার অবস্থা একটি জলাধারের মতো, যার চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি। প্রশ্নকারী এ পাহাড়গুলোর প্রতি ইংগিত করে একথা বলে থাকবে। অহীর ইশারায় উপস্থিত ক্ষেত্রে তখনই এর এ জবাব দেয়া হয়েছে যে, এ পাহাড়গুলো ভেঙ্গে বালুকারাশির মতো গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়া হবে এবং সেগুলো ধূলোমাটির মতো সারা দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে সমগ্র দুনিয়াকে এমন একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেয়া হবে যেখানে কোন উঁচু নীচু, ঢালু বা অসমতল জায়গা থাকবে না। তার অবস্থা এমন একটি পরিস্কার বিছানার মতো হবে যাতে সামান্যতমও খাঁজ বা ভাঁজ থাকবে না।
﴿فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا﴾
১০৬। এবং যমীনকে এমন সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন যে,
﴿لَّا تَرَىٰ فِيهَا عِوَجًا وَلَا أَمْتًا﴾
১০৭। তার মধ্যে তোমরা কোন উঁচু নিচু ও ভাঁজ দেখতে পাবে না।৮৩
৮৩. পরকালীন জগতে পৃথিবী যে নতুন রূপ নেবে কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় তা বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা ইনশিকাকে বলা হয়েছে وَإِذَا الْأَرْضُ مُدَّتْ “যখন পৃথিবী বিস্তৃত করে দেয়া হবে”। সূরা আল ইনফিতারের বলা হয়েছে وَإِذَا ٱلْبِحَارُ فُجِّرَتْ “যখন সাগর চিরে ফেলা হবে”। এর অর্থ সম্ভবত এই যে,