পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿الر ۚ تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِينِ﴾
১। আলিফ-লাম-রা। এগুলো এমন কিতাবের আয়াত যা নিজের বক্তব্য পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে।
﴿إِنَّا أَنزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ﴾
২। আমি একে আরবী ভাষায় কুরআন বানিয়ে নাযিল করেছি,১ যাতে তোমরা (আরববাসীরা) একে ভালোভাবে বুঝতে পারো।২
১. قُرْآن হচ্ছে قُرْأة ক্রিয়াপদের শব্দমূল। এর আসল মানে হচ্ছে ‘পড়া’, শব্দমূলকে যখন কোন জিনিসের জন্য নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ হয় সংশ্লিষ্ট জিনিসটির মধ্যে তার শব্দমূলের অর্থ পুরোপুরি পাওয়া যায়। যেমন যখন কোন ব্যক্তিকে বীর বলার পরিবর্তে ‘বীরত্ব’ বলা হবে যখন তার মানে হবে, তার মধ্যে সাহসিকতা ও বীর্যবত্তা এমন পূর্ণাংগ পর্যায়ে পাওয়া যায় যেন সে এবং বীরত্ব একই জিনিস হয়ে গেছে। কাজেই এ কিতাবের নাম ‘কুরআন’ (পড়া) রাখার অর্থ হচ্ছে এই যে, এ কিতাব সাধারণ ও অসাধারণ নির্বিশেষে সকলের পড়ার জন্য এবং খুব বেশী বেশী করে পঠিত হবার জিনিস।
২. এর মানে এ নয় যে, এ কিতাবটি বিশেষভাবে আরববাসীদের জন্য নাযিল করা হয়েছে। বরং এ বাক্যাংশটির আসল বক্তব্য হচ্ছে, “হে আরববাসীরা! এসব কথা তোমাদের ইরানী ও গ্রীক ভাষায় শুনানো হচ্ছে না, তোমাদের নিজেদেরই ভাষায় শুনানো হচ্ছে। কাজেই তোমরা এ ওজর পেশ করতে পারো না যে, এসব কথা তো আমরা বুঝতে পারছি না। আর এ কিতাবে অলৌকিকতার যে দিকগুলো রয়েছে, যা এর আল্লাহর বাণী হওয়ার সাক্ষ্য দিচ্ছে, সেগুলোও যে তোমাদের দৃষ্টির আগোচরে থেকে যাবে, এটাও সম্ভব নয়।”
কেউ কেউ কুরআন মজীদে এ ধরনের বাক্য দেখে আপত্তি করে থাকেন যে, এ কিতাব তো আরববাসীদের জন্য নাযিল হয়েছে, অনারবদের জন্য নয়। এ ক্ষেত্রে একে সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়াত কেমন করে বলা যেতে পারে? কিন্তু এটি নিছক একটি হালকা ও ফাঁকা আপত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল সত্য উপলব্ধি করার চেষ্টা না করেই এ আপত্তি উত্থাপন করা হয়। মানব জাতির ব্যাপক ও সার্বজনীন হেদায়াতের জন্য যে জিনিসই পেশ করা হবে তা অবশ্যি মানব সমাজে প্রচলিত ভাষাগুলোর যে কোন একটিতেই পেশ করা হবে। এ হেদায়াত পেশকারী এটিকে যে জাতির ভাষায় পেশ করছেন প্রথমে তাকে এর শিক্ষাবলী দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন। তারপর এ জাতিই অন্যান্য জাতির কাছে এর শিক্ষা পৌঁছাবার মাধ্যমে পরিণত হবে। কোন দাওয়াত ও আন্দোলনকে আন্তরজাতিক পর্যায়ে সম্প্রসারিত করার জন্য এটিই একটি বাস্তব ও স্বাভাবিক পদ্ধতি।
﴿نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ الْقَصَصِ بِمَا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ هَٰذَا الْقُرْآنَ وَإِن كُنتَ مِن قَبْلِهِ لَمِنَ الْغَافِلِينَ﴾
৩। হে মুহাম্মাদ! আমি এ কুরআনকে তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়ে উত্তম পদ্ধতিতে ঘটনাবলী ও তত্ত্বকথা তোমার কাছে বর্ণনা করছি। নয়তো ইতিপূর্বে তুমি (এসব জিনিস থেকে) একেবারেই বেখবর ছিলে।৩
৩. সূরার ভূমিকায় আমি একথা বর্ণনা করে এসেছি যে, মক্কার কাফেরদের কোন কোন লোক নবী সা.কে পরীক্ষা করার বরং তাদের মতে তাঁর মুখোশ খুলে দেবার জন্য সম্ভবত ইহুদীদের ইংগিতে তাঁকে হঠাৎ এ প্রশ্ন করে বসেছিল যে, বনী ইসরাঈলদে মিসরে চলে যাওয়ার কারণ কি ছিল? এ কারণে তাদের প্রশ্নের জবাবে বনী ইসরাঈলদের ইতিহাসের এ অধ্যায় বর্ণনা করার আগে ভূমিকা স্বরূপ একথা বলে দেয়া হলো। হে মুহাম্মাদ! তুমি এসব ঘটনা জানতে না, আমি অহির মাধ্যমে তোমাকে তাদের কথা জানাচ্ছি। আপাতদৃষ্টে এ বাক্যে নবী সা.কে সম্বোধন করা হয়েছে কিন্তু আসলে এখানে এমন সব বিরোধীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখা হয়েছে যারা অহীর মাধ্যমে নবী সা. যে সঠিক জ্ঞান লাভ করেন একথা বিশ্বাস করতো না।
﴿إِذْ قَالَ يُوسُفُ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ إِنِّي رَأَيْتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَبًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ رَأَيْتُهُمْ لِي سَاجِدِينَ﴾
৪। এটা সেই সময়ের কথা, যখন ইউসুফ তার বাপকে বললোঃ “আব্বাজান! আমি স্বপ্ন দেখেছি, এগারটি তারকা এবং সূর্য ও চাঁদ আমাকে সিজদা করছে।”
﴿قَالَ يَا بُنَيَّ لَا تَقْصُصْ رُؤْيَاكَ عَلَىٰ إِخْوَتِكَ فَيَكِيدُوا لَكَ كَيْدًا ۖ إِنَّ الشَّيْطَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوٌّ مُّبِينٌ﴾
৫। জবাবে তার বাপ বললোঃ “হে পুত্র! তোমার এ স্বপ্ন তোমার ভাইদেরকে শুনাবে না ; শুনালে তারা তোমার ক্ষতি করার জন্য পেছনে লাগবে।৪ আসলে শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু
৪. এখানে হযরত ইউসুফের আ. দশজন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কথা বলা হয়েছে। হযরত ইয়াকূব আ. জানতেন এ বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা ইউসুফকে আ. হিংসা করে। নৈতিক দিক দিয়েও তারা এমন পর্যায়ের সচ্চরিত্র ছিল না যে, নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য কোন অবৈধ কাজ করতে কুন্ঠিত হবে। তাই তিনি নিজের সদাচারী পুত্রকে বলে দিলেন, তাদের থেকে সাবধান থেকো। স্বপ্নের পরিষ্কার অর্থ ছিল এইঃ সূর্য মানে হযরত ইয়াকূব আ., চাঁদ মানে তাঁর স্ত্রী (হযরত ইউসূফের বিমাতা) এবং এগারটি তারকা মানে এগারটি ভাই।
﴿وَكَذَٰلِكَ يَجْتَبِيكَ رَبُّكَ وَيُعَلِّمُكَ مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ وَيُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَعَلَىٰ آلِ يَعْقُوبَ كَمَا أَتَمَّهَا عَلَىٰ أَبَوَيْكَ مِن قَبْلُ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
৬। এবং ঠিক এমনটিই হবে (যেমনটি তুমি স্বপ্নে দেখেছো যে,) তোমার রব তোমাকে (তাঁর কাজের জন্য) নির্বাচিত৫ করবেন এবং তোমাকে কথার মর্মমূলে পৌঁছানো শেখাবেন৬ আর তোমার প্রতি ও ইয়াকূবের পরিবারের প্রতি তাঁর নিয়ামত ঠিক তেমনিভাবে পূর্ণ করবেন যেমন এর আগে তিনি তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম ও ইসহাকের প্রতি করেছেন। নিসন্দেহে তোমার রব সর্বজ্ঞ ও বিজ্ঞানময়।”৭
৫. অর্থাৎ নবুওয়াত দান করবেন।
৬. تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ মানে নিছক স্বপ্নের তাবীরের জ্ঞান নয়, যেমন মনে করা হয়ে থাকে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তোমাকে সমস্যা ও পরিস্থিতি অনুধাবন করার এবং সত্য পর্যন্ত পৌঁছুবার জ্ঞান দান করবেন। আর এ সংগে এমন গভীর অন্তরদৃষ্টি দান করবেন যার মাধ্যমে তুমি প্রত্যেকটি বিষয়ের গভীর নামার এবং তার তলদেশে পৌঁছে যাবার যোগ্যতা অর্জন করবে।
৭. বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা কুরআনের এ বর্ণনা থেকে ভিন্নতর। তাদের বর্ণনা হচ্ছে, হযরত ইয়াকূব স্বপ্নের বর্ণনা শুনে ছেলেকে খুব ধমক দেন এবং তাকে বলেনঃ “আচ্ছা, এখন তাহলে এ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছো যে, আমি, তোমার মা ও তোমার সব ভাইয়েরা তোমাকে সিজদা করবো।” কিন্তু একটু চিন্তা করলে সহজেই একথা উপলব্ধি করা যেতে পারে যে, বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা নয় বরং কুরআনের বর্ণনাটিই হযরত ইয়াকূবের নবীসুলভ চরিত্রের সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল। হযরত ইউসুফ নিজের স্বপ্ন বর্ণনা করেছিলেন, নিজের আকাংখা ও অভিলাষ ব্যক্ত করেননি। স্বপ্ন যদি সত্য হয়ে থাকে এবং বলা বাহুল্য যে, হযরত ইয়াকূব তার যে তাবীর করেছিলেন তা সত্য স্বপ্ন মনে করেই করেছিলেন, তাহলে এ পরিষ্কার অর্থ ছিল, এটা ইউসূফ আ. এরআকাংখা ছিল না বরং আল্লাহর তকদীরের ফায়সালা ছিল যে, এক সময় তিনি উন্নতির এহেন উচ্চ শিখরে আরোহণ করবেন। এ ক্ষেত্রে একজন নবী তো দূরের কথা একজন বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিও কি এরূপ আচরণ করতে পারেন? এ ধরনের কথায় কি তিনি অসস্তুষ্ট হতে এবং যে স্বপ্ন দেখেছে উলটো তাকে ধমক দিতে পারেন? কোন ভদ্র পিতাও কি এমন হতে পারেন যে, নিজের পুত্রের ভবিষ্যত উন্নতির সুখবর শুনে খুশী হবার পরিবর্তে তিনি উলটো বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হবেন?
﴿لَّقَدْ كَانَ فِي يُوسُفَ وَإِخْوَتِهِ آيَاتٌ لِّلسَّائِلِينَ﴾
৭। আসলে ইউসুফ ও তার ভাইদের ঘটনার মধ্যে এ প্রশ্নকারীদের জন্য বড় বড় নিদর্শন রয়েছে।
﴿إِذْ قَالُوا لَيُوسُفُ وَأَخُوهُ أَحَبُّ إِلَىٰ أَبِينَا مِنَّا وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّ أَبَانَا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
৮। এ ঘটনা এভাবে শুরু হয়ঃ তার ভাইয়েরা পরস্পর বলাবলি করলো, “এ ইউসুফ ও তার ভাই,৮ এরা দু’জন আমাদের বাপের কাছে আমাদের সবার চাইতে বেশী প্রিয়, অথচ আমরা একটি পূর্ণ সংঘবদ্ধ দল। সত্যি বলতে কি আমাদের পিতা একেবারেই বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন।৯
৮. এখানে হযরত ইউসুফের সহোদর ভাই বিন ইয়ামীনের কথা বলা হয়েছে। এ ভাইটি তার থেকে কয়েক বছরের ছোট ছিল। তার জন্মের সময় তার মায়ের ইন্তিকাল হয়। এ কারণে হযরত ইয়াকূব এ দু’টি মাতৃহীন সন্তানের প্রতি একটু বেশী নজর দিতেন। এ ছাড়াও এ স্নেহের আর একটি কারণ ছিল এই যে, তাঁর সব ছেলের মধ্যে একমাত্র হযরত ইউসুফই এমন ছিলেন যার মধ্যে তিনি সৌভাগ্য ও সত্য সঠিক পথের সন্ধান লাভের লক্ষণ দেখেছিলেন। হযরত ইউসুফের স্বপ্নের কথা শুনে তিনি যাকিছু বলেছিলেন ওপরে তার যে বর্ণনা এসেছে তা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, তিনি নিজের এ ছেলেটির অসাধারণ যোগ্যতা সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই জানতেন। অন্যদিকে সামনের দিকে যেসব ঘটনার প্রকাশ ঘটেছে তা থেকে তাঁর বাকি দশ ছেলের চারিত্রক মান সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কোন সৎব্যক্তি এ ধরনের সন্তানদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন একথা কেমন করে আশা করা যেতে পারে? কিন্তু বাইবেলের বর্ণনায় অবাক হতে হয়। সেখানে ইউসুফের প্রতি তাঁর ভাইদের হিংসার এমন একটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে যার ফলে উল্টো হযরত ইউসুফই দোষী সাব্যস্ত হন। বাইবেলের বর্ণনা মতে হযরত ইউসুফ তাঁর পিতার কাছে ভাইদের বিরুদ্ধে চুগলখোরী করতেন। এ কারণে তাঁর ভাইয়েরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।
৯. এ বাক্যটির মর্ম উপলব্ধি করার জন্য বেদুইনদের গোত্রীয় জীবনের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে। সেখানে কোন রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা থাকে না। স্বাধীন উপজাতিরা পরস্পর পাশাপাশি বসবাস করে। সেখানে কোন ব্যক্তির বিপুল সংখ্যক ছেলে, নাতি-পুতি, ভাই ভাতিজা ইত্যাদির ওপর তার ক্ষমতা নির্ভর করে। তার ধন-প্রাণ, ইজ্জত-আবরু রক্ষার প্রয়োজনে তারা তাকে সাহায্য করে। এ ধরনের অবস্থায় মেয়েদের ও শিশুদের তুলনায় স্বাভাবিকভাবে জোয়ান ছেলেরাই মানুষের কাছে বেশী প্রিয় হয়। কারণ দুশমনের সাথে মোকাবিলায় তারা সাহায্য করতে পারে। এ কারণে ইউসুফের ভাইয়েরা বললো, বুড়ো বয়সে আমাদের বাপ দিশেহারা হয়েছে। আমাদের মতো দলবদ্ধ এ যুবক ছেলেরা, যারা খারাপ সময়ে তাঁর কাজে লাগতে পারে, তাঁর কাছে ততটা প্রিয় নয় যতোটা এ ছোট ছেলে দু’টি যারা তাঁর কোন কাজে লাগতে পারে না বরং উলটো তাদেরকেই হেফাজত করতে হবে।
﴿اقْتُلُوا يُوسُفَ أَوِ اطْرَحُوهُ أَرْضًا يَخْلُ لَكُمْ وَجْهُ أَبِيكُمْ وَتَكُونُوا مِن بَعْدِهِ قَوْمًا صَالِحِينَ﴾
৯। চলো আমরা ইউসুফকে মেরে ফেলি অথবা তাকে কোথাও ফেলে দেই, যাতে আমাদের পিতার দৃষ্টি কেবল আমাদের দিকেই ফিরে আসে। এ কাজটি শেষ করে তারপর তোমরা ভালো লোক হয়ে যাবে।১০
১০. যারা নিজেদেরকে প্রবৃত্তির কামনা বাসনার হাতে সোপর্দ করে দেবার সাথে সাথে ঈমানদারী ও সততার সাথেও কিছুটা সম্পর্ক রেখে চলে এ বাক্যটির মধ্যে তাদের মানসিকতার একটি চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটেছে। এ ধরনের লোকদের রীতি হচ্ছে, যখনই প্রবত্তি তাদের কাছে কোন খারাপ কাজ করার তাগিদ দেয় তখনই ঈমানের তাগিদ মুলতবি রেখে তারা প্রথমে প্রবৃত্তির তাগিদ পূর্ণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। এ সময় বিবেক ভেতর থেকে দংশন করতে থাকলে তাকে এ বলে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে যে, একটুখানি সময় করো, এ অনিবার্য গুনাহটি না করলে আমার কাজ আটকে থাকে, কাজেই এটা করে নিতে দাও, তারপর ইনশাআল্লাহ তাওবা করে আমি তেমনি সৎ হয়ে যাবো যেমনটি তুমি আমাকে দেখতে চাও।
﴿قَالَ قَائِلٌ مِّنْهُمْ لَا تَقْتُلُوا يُوسُفَ وَأَلْقُوهُ فِي غَيَابَتِ الْجُبِّ يَلْتَقِطْهُ بَعْضُ السَّيَّارَةِ إِن كُنتُمْ فَاعِلِينَ﴾
১০। এ কথায় তাদের একজন বললো, “ইউসুফকে মেরে ফেলো না। যদি কিছু করতেই হয় তাহলে তাকে কোন অন্ধ কুপে ফেলে দাও, আসা-যাওয়ার পথেকোন কাফেলা তাকে তুলে নিয়ে যাবে।”
﴿قَالُوا يَا أَبَانَا مَا لَكَ لَا تَأْمَنَّا عَلَىٰ يُوسُفَ وَإِنَّا لَهُ لَنَاصِحُونَ﴾
১১। (এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে) তারা তাদের বাপকে গিয়ে বললো, “আব্বাজান। কি ব্যাপার, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের ওপর ভরসা করেন না? অথচ আমরা তার সত্যিকার শুভাকাংখী
﴿أَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا يَرْتَعْ وَيَلْعَبْ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
১২। আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, সে কিছু ফলমূল খাবে এবং দৌড়ঝাঁপ করে মন চাংগা করবে। আমরা তার হেফাজত করবো।১১
১১. এ বর্ণনাটিও বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা থেকে ভিন্ন ধরনের। তাদের বর্ণনা হচ্ছে, ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পশু চরাতে সিককিমের দিকে গিয়েছিল। হযরত ইয়াকূব নিজেই তাদের সন্ধানে হযরত ইউসূফকে তাদের পেছনে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু একথা কল্পনাই করা যায় না যে, হযরত ইয়া’কুব আ. হযরত ইউসূফ আ. এরসাথে তার ভাইদের হিংসার কথা জানা সত্ত্বেও তাঁকে নিজের হাতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন। তাই কুরআনের বর্ণনাই অধিকতর বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়।
﴿قَالَ إِنِّي لَيَحْزُنُنِي أَن تَذْهَبُوا بِهِ وَأَخَافُ أَن يَأْكُلَهُ الذِّئْبُ وَأَنتُمْ عَنْهُ غَافِلُونَ﴾
১৩। বাপ বললো, “তোমরা তাকে নিয়ে যাবে, এটা আমাকে কষ্ট দেবে এবং আমরা আশংকা হয়, তোমরা তার প্রতি অমনোযোগী থাকবে এবং নেকড়ে থাকে খেয়ে ফেলবে।”
﴿قَالُوا لَئِنْ أَكَلَهُ الذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّا إِذًا لَّخَاسِرُونَ﴾
১৪। তারা জবাব দিল, “যদি আমাদের সংঘবদ্ধ দল থাকতে তাকে নেকড়ে খেয়ে ফেলে তাহলে তো আমরা হবো বড়ই অকর্মন্য।”
﴿فَلَمَّا ذَهَبُوا بِهِ وَأَجْمَعُوا أَن يَجْعَلُوهُ فِي غَيَابَتِ الْجُبِّ ۚ وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُم بِأَمْرِهِمْ هَٰذَا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾
১৫। এভাবে চাপ দিয়ে যখন তারা তাকে নিয়ে গেলো এবং সিদ্ধান্ত করলো তাকে একটি অন্ধ কূপে ফেলে দেবে তখন আমি ইউসুফকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম, “এক সময় আসবে যখন তুমি তাদের এ কৃতকর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। তাদের কাজের ফলাফল সম্পর্কে তারা জানে না।”১২
১২. মূল ইবারতে وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ বাক্য এমনভাবে এসেছে যার ফলে তার তিনটি অর্থ হয় এবং তিনটি অর্থই এখানে মানানসই বলে মনে হয়। একটি অর্থ হচ্ছে, আমি ইউসুফকে এ সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এবং তার ভাইয়েরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেখবর ছিল যে, তাকে অহীর মাধ্যমে সবকিছু জানানো হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তুমি এমন অবস্তায় তাদের এ কর্ম সম্পর্কে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে যেখানে তোমার অবস্থানের ব্যাপারটি তারা কল্পনাও করতে পারবে না। তৃতীয় অর্থটি হচ্ছে, আজ এরা না জেনে বুঝে একটি কাজ করছে এবং ভবিষ্যতে এ ফলাফল কি হবে তা এরা জানে না।
এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে ইউসুফ আ.কে যে কি সান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল বাইবেল ও তালমূদে এর কোন উল্লেখ নেই। বিপরীত পক্ষে তালমূদে যে বর্ণনা এসেছে তা হচ্ছে এই যে, ইউসুফকে যখন কূপে ফেলে দেয়া হলো তখন তিনি জোরে জোরে কাঁদতে থাকলেন এবং চিৎকার করে ভাইদের কাছে ফরিয়াদ করলেন। কুরআনের বর্ণনা পড়লে মনে হবে এমন এক যুবকের কথা বলা হচ্ছে যিনি আগামীতে ইতিহাসের মহান ব্যক্তিদের অন্তরভুক্ত হবেন। অন্যদিকে তালমূদ পড়লে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে তা হচ্ছে এই যে, জনমানবশূন্য বিয়াবনে কয়েকজন বদ্দু একটি বালককে কূপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে এবং এ সময় একজন সাধারণ বালক যা করে সে-ও তাই করছে।
﴿وَجَاءُوا أَبَاهُمْ عِشَاءً يَبْكُونَ﴾
১৬। রাতে তারা কাঁদতে কাঁদতে তাদের বাপের কাছে আসলো
﴿قَالُوا يَا أَبَانَا إِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا يُوسُفَ عِندَ مَتَاعِنَا فَأَكَلَهُ الذِّئْبُ ۖ وَمَا أَنتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صَادِقِينَ﴾
১৭। বললো, “আব্বাজান! আমরা দৌঁড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের জিনিসপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম, ইতিমধ্যে নেকড়েবাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলেছে। আপনি তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী।”
﴿وَجَاءُوا عَلَىٰ قَمِيصِهِ بِدَمٍ كَذِبٍ ۚ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْرًا ۖ فَصَبْرٌ جَمِيلٌ ۖ وَاللَّهُ الْمُسْتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ﴾
১৮। তারা ইউসূফের জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল। একথা শুনে তাদের বাপ বললো, “বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি বড় কাজকে সহজ করে দিয়েছে। ঠিক আছে, আমি সবর করবো এবং খুব ভালো করেই সবর করবো।১৩ তোমরা যে কথা সাজাচ্ছো তার ওপর একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।”১৪
১৩. কুরআনের ইবারতে صَبْرٌ جَمِيلٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর শাব্দিক অনুবাদ “ভালো সবর” হতে পারে। এর অর্থ হয় এমন সবর যার মধ্যে অভিযোগ, ফরিয়াদ, ভয়-ভীতি ও কান্নাকাটি নেই। একজন উচ্চ ও প্রসস্ত হৃদয়বত্তার অধিকারী মানুষের ওপর যে বিপদ আসে তাকে ধীর স্থির চিত্তে বরদাশত করে যাওয়াই এ সবরের প্রকৃতি।
১৪. বাইবেল ও তালমূদ এখানে হযরত ইয়াকূবের প্রতিক্রিয়ার এমন ছবি এঁকেছে যা যে কোন সাধারণ বাপের প্রতিক্রিয়া থেকে কোন অংশেই ভিন্নতর নয়। বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, “তখন ইয়াকূব নিজের জামা ফেড়ে ফেলেন, নিজের কোমরের সাথে চট জড়িয়ে নেন এবং বহুদিন পর্যন্ত ছেলের জন্য মাতম করতে থাকেন।” তালমূদে বলা হয়েছে, “ইয়াকূব ছেলের জামা চিনতে পেরেই উপড়ে হয়ে মাটিতে পড়ে যান এবং দীর্ঘক্ষণ নিথর-নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকেন। তারপর উঠে বিকট জোরে চিৎকার দিয়ে বলেন, হাঁ এ আমার ছেলের জামা। এরপর তিনি বছরের পর বছর ধরে ইউসুফের জন্য মাতম করতে থাকেন।“
এ বর্ণনায় হযরত ইয়াকূবকে ঠিক তেমনিটি করতে দেখা যাচ্ছে যেমনটি এ অবস্থায় প্রত্যেক বাপ করে থাকে। কিন্তু কুরআন এর যে বর্ণনা দিয়েছে তা আমাদের সামনে একটি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের ছবি তুলে ধরেছে। এ ব্যক্তি আপাদমস্তক ধৈর্য ও সহিষ্ণুতর প্রতিমূর্তি। এতবড় শোকাবহ ও হৃদয়বিদারক খবর শুনেও তিনি নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন না। প্রখর বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পরিস্থিতির সঠিক চেহারা অনুমান করতে পারছেন। তিনি বুঝতে পারেন এটা একটা বানোয়াট কথা। তাঁর হিংসুটে ছেলেরা ঘটনাটা সাজিয়ে তাঁর সামনে পেশ করেছে। তারপর বিশাল হৃদয় ব্যক্তিদের মতো তিনি সবর করেন এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করেন।
﴿وَجَاءَتْ سَيَّارَةٌ فَأَرْسَلُوا وَارِدَهُمْ فَأَدْلَىٰ دَلْوَهُ ۖ قَالَ يَا بُشْرَىٰ هَٰذَا غُلَامٌ ۚ وَأَسَرُّوهُ بِضَاعَةً ۚ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَعْمَلُونَ﴾
১৯। ওদিকে একটি কাফেলা এলো। তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে পানি নেবার জন্য পাঠালো। সে কূয়ার মধ্যে পানির ডোল নামিয়ে দিল। সে (ইউসুফকে দেখে) বলে উঠলো, “কী সুখবর! এখানে তো দেখছি একটি বালক।” তারা তাকে পণ্য দ্রব্য হিসেবে লুকিয়ে ফেললো। অথচ তারা যা কিছু করছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত ছিলেন।
﴿وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُودَةٍ وَكَانُوا فِيهِ مِنَ الزَّاهِدِينَ﴾
২০। শেষে তারা তাকে সামান্য দামে কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।১৫ আর তার দামের ব্যাপারে তারা বেশী আশা করছিল না।
১৫. ঘটনাটা সহজভাবে বলতে গেলে এরূপ বলা যায় যে, ইউসুফের ভাইয়েরা হযরত ইউসুফকে কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে যায়। পরে কাফেলার লোকজন এসে তাকে সেখান থেকে বের করে আনে। তারা তাকে মিসরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, ইউসুফের ভাইয়েরা পরে ইসমাঈলীদের একটি কাফেলা দেখে ইউসুফকে কূয়া থেকে বের করে তাদের হাতে বিক্রি করে দিতে চায়। কিন্তু তার আগেই মাদয়ানের সওদাগর তাকে কূয়া থেকে বের করে ফেলে। এ সওদাগরেরা বিশ দিরহামে ইউসুফকে ইসমাঈলীদের হাতে বিক্রি করে দেয়। সামনের দিকে গিয়ে বাইবেল লেখকরা একথা ভুলে যান যে, ইতিপূর্বে তারা ইউসুফকে ইসমাঈলীদের হাতে বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন। তাই তারা ইসমাঈলীদের পরিবর্তে আবার মাদায়ানের সওদাগরদের দ্বারা তাঁকে মিসরীয়দের হাতে বিক্রি করাচ্ছেন। (দেখুন, আদি পুস্তকঃ ৩৭:২৫-২৮ এবং ৩৬) অন্যদিকে তালমূদের বর্ণনা হচ্ছে, মাদয়ানের সওদাগরেরা ইউসুফকে কূয়া থেকে বের করে এনে নিজেদের গোলামে পরিণত করে। অবশেষে তারা বিশ দিরহাম মূল্য পরিশোধ করে ইউসুফের ভাইদেরেকে রাজি করে। তারপর তারা বিশ দিরহামের বিনিময়েই ইউসুফকে ইসমাঈলীদের হাতে বিক্রি করে। আর ইসমাঈলীলা মিসরে গিয়ে তাকে বিক্রি করে। এখান থেকেই মুসলমানদের মধ্যে এ বর্ণণা প্রচলন হয়েছে যে, ইউসুফের ভাইয়েরা ইউসুফকে বিক্রি করে কিন্তু জানা উচিত, কুরআন এ সমস্ত বর্ণনা সমর্থন করেনি।
﴿وَقَالَ الَّذِي اشْتَرَاهُ مِن مِّصْرَ لِامْرَأَتِهِ أَكْرِمِي مَثْوَاهُ عَسَىٰ أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا ۚ وَكَذَٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ وَلِنُعَلِّمَهُ مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ ۚ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰ أَمْرِهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
২১। মিসরে যে ব্যক্তি তাকে কিনেছিল১৬ সে তার স্ত্রীকে১৭ বললো, “একে ভালোভাবে রাখো, বিচিত্র নয় সে আমাদের জন্য উপকারী প্রমাণিত হবে এবং আমরা তাকে পুত্র বানিয়ে নেবো।১৮ এভাবে আমি ইউসুফের জন্য সে দেশে প্রতিষ্ঠালাভের পথ বের করে দিলাম এবং তাকে সমস্যা ও বিষয়াবলী অনুধাবন করার জন্য যথোপযোগী শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করলাম।১৯ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পন্ন করেই থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।
১৬. বাইবেলে এ ব্যক্তির নাম লেখা হয়েছে “পোটীফর”। সামনের দিকে গিয়ে কুরআন মজীদ একে “আযীয” নামে উল্লেখ করেছে। তারপর আবার এক জায়গায় হযরত ইউসুফের জন্যও এ উপাধি ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন মিসরের কোন বড় অফিসার অথবা পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। কারণ “আযীয” মানে হচ্ছে এমন কর্তৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি যার ক্ষমতাকে প্রতিহত করা যেতে পারে না। বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা হচ্ছে, তিনি ছিলেন বাদশাহর রক্ষক সেনাপতি (দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান)। ইবনে জারীর হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে রেওয়ায়াত করেছেন যে, তিনি ছিলেন রাজকীয় অর্থ বিভাগের প্রধান।
১৭. তালমূদে এ মাহিলাটিকে যালীখা (Zelicha) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকেই এ নামটি মুসলমানদের বর্ণনায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু আমাদের এখানে সাধারণভাবে প্রচলিত হয়ে গেছে যে, পরবর্তীকালে হযরত ইউসুফের সাথে মহিলাটির বিয়ে হয়ে যায়। একথাটির আসলে কুরআনে বা ইসরাঈলী ইতিহাসে কোন ভিত্তি নেই। একজন নবী এমন একটি মহিলাকে বিয়ে করবেন যার অসতিপনা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতায়ই ধরা পড়েছে-এটা আসলে তাঁর নবী সুলভ মর্যাদার তুলনায় অনেক নিম্নমানের। কুরআন মজীদে এ ব্যাপারে যে সাধারণ নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যেঃ
الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ ۖ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ
“অসৎ মেয়েরা অসৎ পুরুষদের জন্য এবং অসৎ পুরুষরা অসৎ মেয়েদের জন্য আর পবিত্র মেয়েরা পবিত্র পুরুষদের জন্য এবং পবিত্র পুরুষরা পবিত্র পবিত্র মেয়েদের জন্য।“
১৮. তালমূদের বর্ণনামতে এ সময় হযরত ইউসুফের বয়স ছিল ১৮ বছর। পোটীফর তাঁর গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ যুবক গোলাম নয় বরং কোন অভিজাত পরিবারের আদরের দুলাল এবং অবস্থার আবর্তন তাকে এখানে টেনে এনেছে। তাকে কেনার সময়ই তিনি সওদাগরদের বলেনঃ এ ছেলে তো কোন গোলাম বলে মনে হচ্ছে না, আমার সন্দেহ হচ্ছে তোমরা একে কোথাও থেকে চুরি করে এনেছো এ কারণে পোটীফর তাঁর সাথে দাস সুলভ ব্যবহার করেননি। বরং তাঁর ওপর নিজের গৃহের এবং নিজের যাবতীয় সম্পদ-সম্পত্তি পরিচালনার একচ্ছত্র দায়িত্ব অর্পণ করেন। বাইবেলের বর্ণনা মতে “তিনি নিজের সবকিছু ইউসুফের হাতে ছেড়ে দেন এবং শুধুমাত্র খাবার রুটি টুকু ছাড়া নিজের আর কোন জিনিসেরই তাঁর খবর ছিল না।” (আদি পুস্তকঃ ৩৯:৬)
১৯. এ পর্যন্ত হযরত ইউসুফের জীবন গড়ে উঠেছিল বিজন মরু প্রান্তরে আধা যাযাবর ও পশুপালকদের পরিবেশে। কেনান ও উত্তর আরব এলাকায় সে সময় কোন সংগঠিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল না এবং সেখানকার সমাজ-সংস্কৃতি তেমন কোন ধরনের উন্নতি লাভ করেনি। সেখানে ছিল কিছুসংখ্যক স্বাধীন উপজাতির বাস। তারা মাঝে মাঝে এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে বসবাস করতো। আবার কোন কোন উপজাতি বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ী বসতি গড়ে তুলে নিজেদের ছোট ছোট রাষ্ট্রও গঠন করে নিয়েছিল। মিসরের পার্শ্ববতী এলাকায় বসবাসকারী এসব লোকের অবস্থা ছিল প্রায় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত স্বাধীন পাঠান উপজাতিদের মতো। এখানে হযরত ইউসুফ যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তাতে অবশ্যই অন্তরভুক্ত ছিল বেদুইন জীবনের সৎগুণাবলী এবং ইবরাহিমী পরিবারের আল্লাহমুখী জীবন চিন্তা ও ধর্মচর্চা। কিন্তু মহান আল্লাহ সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে সুসভ্য ও উন্নত দেশ অর্থাৎ মিসরে তাঁর মাধ্যমে যে কাজ নিতে চাচ্ছিলেন এবং এ জন্য যে পর্যায়ের জানাশোনা, অভিজ্ঞতা ও গভীর অন্তরদৃষ্টির প্রয়োজন ছিল তার বিকাশ সাধনের কোন সুযোগ বেদুইন জীবনে ছিল না। তাই আল্লাহ তাঁর সর্বময় ক্ষমতাবলে তাঁকে মিসরে রাজ্যের একজন বড় সরকারী কর্মচারীর কাছে পৌঁছিয়ে দিলেন। আর তিনি তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা দেখে তাঁকে নিজের গৃহ ও ভূসম্পত্তির দেখাশোনা ও পরিচালনার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব দান করলেন। এভাবে ইতিপূর্বে তাঁর যেসব যোগ্যতাকে কোন কাজে লাগনো হয়নি তা পূর্ণ বিকাশ লাভ করার সুযোগ পেয়ে গেলো। ছোট্ট একটি জমিদারী পরিচালনার মাধ্যমে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করলেন তা আগামীতে একটি বড় রাষ্ট্রের আইন শৃংখলা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল এ আয়াতে এ বিষয়টির দিকে ইংগিত করা হয়েছে।
﴿وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ﴾
২২। আর যখন সে তার পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলো, আমি তাকে ফায়সালা করার শক্তি ও জ্ঞান দান করলাম।২০ এভাবে আমি নেক লোকদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
২০. কুরআনের ভাষায় সাধারণভাবে এমন শব্দের মানে হয় “নবুওয়াত দান করা।” ফায়সালা করার শক্তিকে কুরআনের মূল ভাষ্যে বলা হয়েছে “হুকুম”। এ হুকুম অর্থ কর্তৃত্বও হয়। কাজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন বান্দাকে হুকুম দান করার মানে হলো আল্লাহ তাঁকে মানব জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে ফায়সালা দান করার যোগ্যতা দান করেছেন আবার এ জন্য ক্ষমতাও অর্পণ করেছেন। আর “জ্ঞান” বলতে এমন বিশেষ সত্যজ্ঞান বুঝানো হয়েছে যা নবীদেরকে অহীর মাধ্যমে সরাসরি দেয়া হয়।
﴿وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَن نَّفْسِهِ وَغَلَّقَتِ الْأَبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ ۚ قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ ۖ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ ۖ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ﴾
২৩। যে মহিলাটির ঘরে সে ছিল সে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকলো এবং একদিন সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, “চলে এসো”। ইউসুফ বললো, “আমি আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, আমার রব তো আমাকে ভালই মর্যাদা দিয়েছেন (আর আমি এ কাজ করবো!)। এ ধরনের জালেমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না।”২১
২১. সাধারণভাবে মুফাসসির ও অনুবাদকগণ মনে করে থাকেন, এখানে “আমার রব” তথা আমার প্রভু শব্দটি বলে হযরত ইউসুফ সে সময় যার অধীনে চাকরি করতেন তার কথা বলতে চেয়েছেন। তারা মনে করেন, তাঁর এ জবাবের অর্থ ছিল এই যে, আমার মনিব তো আমাকে খুব যত্নের সাথেই রেখেছেন, এ অবস্থায় আমি তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করার মতো নিমকহারামী কেমন করে করতে পারি? কিন্তু এ অনুবাদ ও ব্যাখ্যার আমি কঠোর বিরোধিতা করছি। যদিও আরবী ভাষার দিক দিয়ে এ অর্থ গ্রহণ করারও অবকাশ আছে, কারণ আরবীতে ‘রব’ শব্দটি প্রভু অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু একজন নবী একটি গুনাহ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে আল্লাহর পরিবর্তে কোন বান্দার প্রতি নজর দেবেন এটা তাঁর মর্যাদার তুলনায় অনেক নিম্নমানের। তাছাড়া কোন নবী আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে নিজের রব বলেছেন, কুরআনে এর কোন নজীরও নেই। সামনের দিকে ৪১, ৪২ ও ৫০ আয়াতে আমরা দেখছি হযরত ইউসুফ আ. বারবার তাঁর নিজের ও মিসরীয়দের মতবাদের মধ্যে এ পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছেন যে, তাঁর রব হচ্ছেন আল্লাহ এবং মিসরীয়রা বান্দাকে নিজেদের রব বানিয়ে রেখেছে। কাজেই এখানে আয়াতের শব্দের মধ্যে যখন এ অর্থ গ্রহণ করার অবকাশ রয়েছে যে, হযরত ইউসুফ “রব্বী” বলে আল্লাহর সত্তা বুঝাতে চেয়েছেন তখন কি কারণে আমরা এমন একটি অর্থ গ্রহণ করবো যার মধ্যে দোষের দিকটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে?
﴿وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ ۖ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَن رَّأَىٰ بُرْهَانَ رَبِّهِ ۚ كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ ۚ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ﴾
২৪। মহিলাটি তার দিকে এগিয়ে এলো এবং ইউসুফও তার দিকে এগিয়ে যেতো যদি না তার রবের জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতো।২২ এমনটিই হলো, যাতে আমি তার থেকে অসৎবৃত্তি ও অশ্লীলতা দূর করে দিতে পারি।২৩ আসলে সে ছিল আমার নির্বাচিত বান্দাদের অন্তরভুক্ত।
২২. মূল আয়াতে আছে “বুরহান।” বুরহান মানে দলীল বা প্রমাণ। রবের প্রমাণ মানে রবের দেখিয়ে দেয়া বা বুঝিয়ে দেয়া এমন প্রামণ যার ভিত্তিতে হযরত ইউসুফের আ. বিবেক তার ব্যক্তিসত্তার কাছ থেকে একথার স্বীকৃতি আদায় করেছে যে, এ নারীর ভোগের আহবানে সাড়া দেয়া তার পক্ষে শোভনীয় নয়। এ প্রমাণটি কি ছিল? ইতিপূর্বে পিছনের বাক্যেই তা বলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে বলা হয়েছেঃ “আমার রব তো আমাকে ভালই মর্যাদা দিয়েছেন আর আমি খারাপ কাজ করবো! এ ধরনের জালেমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না।” এ অকাট্য যুক্তিই হযরত ইউসুফ আ.কে সদ্যেন্মিত যৌবনকালের এ সংকট সন্ধিক্ষণে পাপ কাজ থেকে বিরত রেখেছিল। তারপর বলা হলো, “ইউসুফও তার দিকে এগিয়ে যেতো যদি তা তার রবের জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতো।” এ থেকে নবীগণের নিষ্পাপ হবার (ইসমতে আম্বিয়া) তত্বের অর্ন্তনিহিত সত্য পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবীর নিষ্পাপ হবার মানে এ নয় যে, তাঁর গুনাহ, ভুল ও ত্রুটি করার ক্ষমতা ও সমার্থ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, ফলে তাঁর দ্বারা গুনাহর কাজ সংঘটিত হতেই পারে না। বরং এর মানে হচ্ছে, নবী যদিও গুনাহ করার শক্তি রাখেন কিন্তু সমস্ত মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হওয়া এবং যাবতীয় মানবিক আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছা-প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও তিনি এমন সদাচারী ও আল্লাহভীরু হয়ে থাকেন যে, জেনে বুঝে কখনো গুনাহ করার ইচ্ছা করেন না। তার বিবেকের অভ্যন্তরে আল্লাহর এমন সব শক্তিশালী দলীল প্রমাণ তিনি রাখেন যেগুলোর মোকাবিলায় প্রবৃত্তির কামনা বাসনা কখনো সফলকাম হবার সুযোগ পায় না। আর যদি সজ্ঞানে তিনি কোন ত্রুটি করেই বসেন তাহলে মহান আল্লাহ তখনই সুস্পষ্ট অহীর মাধ্যমে তা সংশোধন করে দেন। কারণ তাঁর পদস্খলন শুধুমাত্র এক ব্যক্তির পদস্খলন নয় বরং সমগ্র উম্মতের পদস্খলনের রূপ নেয়। তিনি সঠিক পথ থেকে এক চুল পরিমাণ সরে গেলে সারা দুনিয়া গোমরাহীর পথে মাইলের পর মাইল চলে যায়।
২৩. এ উক্তির দু’টি অর্থ হতে পারে।
একঃ তার রবের প্রমাণ দেখা ও গুনাহ থেকে রক্ষা পাওয়া আমার দেয়া সুযোগ ও পথপ্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। কেননা, আমি নিজের এ নির্বাচিত বান্দাটি থেকে অসৎবৃত্তি ও অশ্লীলতা দূর করতে চাচ্ছিলেন।
এর দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে এবং এটি অত্যন্ত গভীর অর্থবোধক যে, ইউসুফের সাথে এই যে ব্যাপারটি ঘটে গেলো এটি আসলে তার প্রশিক্ষণ পর্বের একটি প্রয়োজনীয় পর্যায় ছিল। তাঁকে অসৎ প্রবণতা ও অশ্লীলতা মুক্ত করার এবং তাঁর আত্মিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতাকে পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী অপরিহার্য ছিল যে, তাঁর সামনে গুনাহের এমনি একটি সংকটময় পরিস্থিতি আসুক এবং সেই পরীক্ষার সময় তিনি নিজের সমগ্র ইচ্ছাশক্তিকে তাকওয়া ও আল্লাহভীতির পাল্লায় রেখে দিয়ে নিজের নফসের অসৎ প্রবণতাগুলোকে চিরকালের জন্য চূড়ান্তভাবে পরাজিত করুন। বিশেষ করে তদানীন্তন মিসরীয় সমাজে যে নৈতিক পরিবেশ বিরাজিত ছিল তা দৃষ্টি সমক্ষে রাখলে এ বিশেষ প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। সামনের দিকে চতুর্থ রুকূতে এ পরিবেশের একটি সামন্যতম নমুনা দেখানো হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যাবে, তৎকালীন ‘সুসভ্য মিসরে’ সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে সে দেশের উচ্চ শ্রেণীতে স্বাধীন যৌনাচারিতা প্রায় বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য দেশসমূহে এবং আমাদের দেশের ফিরিংগী প্রভাবিত সমাজের সমমানে অবস্থান করছিল। এ ধরনের বিকৃত রুচিসম্পন্ন লোকদের মধ্যে হযরত ইউসুফকে কাজ করতে হবে। এ কাজ করতে হবে একজন সাধারণ লোক হিসেবে নয় বরং দেশের শাসনকর্তা হিসেবে। এখন একথা সুস্পষ্ট যে, একজন সুন্দর ও সুশ্রী গোলামের জন্য যেসব ভদ্র মহিলা নিজেদেরকে এভাবে বিলীন করে দিচ্ছিল তারা একজন যুবক বয়সের সুদর্শন শাসনকর্তাকে পথভ্রষ্ট করার ও ফাঁদে ফেলার জন্য কত কী-ইনা করতে পারতো। আল্লাহ এরি পথ বন্ধ করার জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন যে, প্রথমেই এ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর করিয়ে হযরত ইউসুফকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছে তারপর অন্যদিকে মিসরীয় মহিলাদেরকেও তাঁর ব্যাপারে হতাশ করে দিয়ে তাদের সমস্ত ছলনা ও কারসাজির দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।
﴿وَاسْتَبَقَا الْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِيصَهُ مِن دُبُرٍ وَأَلْفَيَا سَيِّدَهَا لَدَى الْبَابِ ۚ قَالَتْ مَا جَزَاءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوءًا إِلَّا أَن يُسْجَنَ أَوْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
২৫। শেষ পর্যন্ত ইউসুফ ও সে আগেপিছে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো এবং সে পেছন থেকে ইউসুফের জামা (টেনে ধরে) ছিঁড়ে ফেললো। উভয়েই দরজার ওপর তার ওপর তার স্বামীকে উপস্থিত পেলো। তাকে দেখতেই মহিলাটি বলতে লাগলো, “তোমার পরিবারের প্রতি যে অসৎ কামনা পোষণ করে তার কি শাস্তি হতে পারে? তাকে কারগারে প্রেরণ করা অথবা কঠোর শাস্তি দেয়া ছাড়া আর কি শাস্তি দেয়া যেতে পারে?”
﴿قَالَ هِيَ رَاوَدَتْنِي عَن نَّفْسِي ۚ وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِّنْ أَهْلِهَا إِن كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِن قُبُلٍ فَصَدَقَتْ وَهُوَ مِنَ الْكَاذِبِينَ﴾
২৬। ইউসুফ বললো, “সে-ই আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছিল।” “মহিলাটির নিজের পরিবারের একজন (পদ্ধতিগত) সাক্ষ্য দিল,২৪ “যদি ইউসুফের জামা সামনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে মহিলাটি সত্য কথা বলেছে এবং সে মিথ্যুক
২৪. এ ব্যাপারটি মনে হয় এভাবে ঘটে থাকবে যে, গৃহকর্তার সাথে সংশ্লিষ্ট মহিলার আত্মীয়দের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তিও আসছিল। সে এ ঝগড়া শুনে হয়তো বলেছেঃ এরা দু’জনেই যখন পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করছে এবং উপস্থিত ঘটনার কোন সাক্ষীও নেই তখন পরিবেশগত সাক্ষের সূত্র ধরে বিষয়টি সম্পর্কে এভাবে অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু এ সাক্ষ্য পেশ করেছিল। শিশুটি ঐ ঘরে দোলনায় শায়িত ছিল। আল্লাহ তাকে বাকশক্তি দান করে তার মুখ দিয়ে এ সাক্ষের কথা উচ্চারণ করিয়েছিলেন। কিন্তু এ বর্ণনাটি কোন নির্ভুল সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। আর তাছাড়া এ ব্যাপারে অযথা মু’জিযার সাহায্য নেয়ার কোন প্রয়োজন অনুভূত হয় না। সাক্ষ্যদাতা যে পরিবেশগত সাক্ষের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা ছিল যথার্থই যুক্তিসংগত ব্যাপার এ সাক্ষের প্রতি দৃষ্টি দিলে এক মুহূর্তেই বুঝা যায় যে, এ ব্যক্তি অতীব বিচক্ষণ, সূক্ষ্মদর্শী ও ব্যাপকতর অভিজ্ঞতার অধিকারী ছিল। ঘটনার চিত্র তার সামনে এসে যেতেই সে তার গভীরে পৌঁছে গেছে। বিচিত্র নয় যে, উল্লেখিত ব্যক্তি কোন বিচারপতি বা ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারে। (উল্লেখ থাকে, মুফাসসিরগণ দুগ্ধপোষ্য শিশুর সাক্ষ্যদানের যে বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন তা ইহুদী বর্ণনা থেকে গৃহীত হয়েছে। দেখুন, তালমূদের নির্বাচিত অংশ, পল ইসহাক হিরশূন, লণ্ডন ১৮৮০, ২৫৬ পৃষ্ঠা)
﴿وَإِن كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِن دُبُرٍ فَكَذَبَتْ وَهُوَ مِنَ الصَّادِقِينَ﴾
২৭। আর যদি তার জামা পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে মহিলাটি মিথ্যা কথা বলেছে এবং সে সত্যবাদী।”২৫
২৫. এর মানে হচ্ছে, ইউসুফের কাপড় যদি সামেনর দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে ইউসুফের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এবং মহিলাটি নিজেকে বাঁচাবার জন্য ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত হয়েছিল, এটা হবে তার স্পষ্ট আলামত। কিন্তু যদি ইউসুফের কাপড় পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে স্পষ্ট বুঝতে হবে, মহিলাটি তার পেচনে লেগেছিল এবং ইউসুফ তার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। এ ছাড়াও আর একটি বাস্তব সাক্ষ্যও এ সাক্ষের মধ্যে লুকিয়েছিল। সেটি হচ্ছে, এ সাক্ষী শুধুমাত্র ইউসুফ আ. এরকাপড়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে। এ থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মহিলাটির শরীরে বা পোশাকে আদতে বল প্রয়োগের কোন আলামতই ছিল না। অথচ যদি এটা বলাৎকারজনিত মামলা হতো তাহলে মহিলাটির শরীরে ও পোশাকে এর পরিষ্কার আলামত দেখা যেতো।
﴿فَلَمَّا رَأَىٰ قَمِيصَهُ قُدَّ مِن دُبُرٍ قَالَ إِنَّهُ مِن كَيْدِكُنَّ ۖ إِنَّ كَيْدَكُنَّ عَظِيمٌ﴾
২৮। স্বামী যখন দেখলো ইউসুফের জামা পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া তখন বললো, “এসব তোমাদের মেয়েলোকদের ছলনা। সত্যিই বড়ই ভয়ানক তোমাদের ছলনা!
﴿يُوسُفُ أَعْرِضْ عَنْ هَٰذَا ۚ وَاسْتَغْفِرِي لِذَنبِكِ ۖ إِنَّكِ كُنتِ مِنَ الْخَاطِئِينَ﴾
২৯। হে ইউসুফ! এ ব্যাপারটি উপেক্ষা করো। আর হে নারী! তুমি নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, তুমিই আসল অপরাধী”২৫(ক)
২৫(ক). বাইবেলে এ কাহিনীকে যে কদাকাররূপে চিত্রিত করা হয়েছে নিচের বর্ণনায় তা দেখা যেতে পারেঃ
“তখন সে যোসেফের বস্ত্র ধরিয়া বলিল, আমার সহিত শয়ন কর, কিন্তু যোসেফ তাহার হস্তে আপন বস্ত্র ফেলিয়া রাখিয়া বাহিরে পালাইয়া গেলেন। তখন যোসেফ তাহার হস্তে বস্ত্র ফেলিয়া রাখিয়া বাহিরে পলাইলেন দেখিয়া, সে নিজ ঘরের লোকদিগকে ডাকিয়া কহিল, দেখ তিনি আমাদের সাথে ঠাট্টা করিতে একজন ইব্রীয় পুরুষকে আনিয়াছেন, সে আমার সংগে শয়ন করিবার জন্য আমার নিকটে আসিয়াছিল, তাহতে আমি চীৎকার করিয়া উঠিলাম, আমার চীৎকার শুনিয়া সে আমার নিকটে নিজ বস্ত্রখানি ফেলিয়া বাহিরে পলাইয়া গেল। আর যে পর্যন্ত তাহার কর্তা ঘরে না আসিলেন, সে পর্যন্ত সেই স্ত্রীলোক তাঁহার বস্ত্র আপনার কাছে রাখিয়া দিল।……..তাঁহার প্রভু যখন আপন স্ত্রীর একথা শুনিলেন যে, “তোমার দাস আমার প্রতি এরূপ ব্যবহার করিয়াছে”, তখন ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন। অতএব যোসেফের প্রভু তাঁহাকে লইয়া কারাগারে রাখিলেন, যে স্থানে রাজার বন্দিগণ বদ্ধ থাকিত।” (আদি পুস্তকঃ ৩৯:১২-২০)
এ অদ্ভুত বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে এই যে, হযরত ইউসুফ এমন ধরনের পোশাক পরেছিলেন যে, যুলাইখা তাতে হাত লাগাতেই সমস্ত পোশাকটাই খুলে তার হাতে এসে পড়লো! তারপর আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, হযরত ইউসুফ নিজে পোশাক তার কাছে রেখে দিয়ে একেবারে দিগম্বর হয়ে ভাগলেন এবং তাঁর পোশাক (অর্থাৎ তাঁর অপরাধের অনস্বীকার্য প্রামণ) ঐ মহিলার কাছে রয়ে গেলো। এরপরে হযরত ইউসুফের অপরাধী হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে কি?
এতো গেলো বাইবেলের বর্ননা। অন্যদিকে তালমূদের বর্ণনা হচ্ছে, পোটিফর যখন তার স্ত্রীর মুখ থেকে এ অভিযোগ শুনলেন তখন তিনি ইউসুফকে খুব মারধার করালেন। তারপর তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করলেন। আদলতে কর্মকর্তারা হযরত ইউসুফের পোশাক পরীক্ষা করে রায় দিল, “দোষ মহিলাটির, কারণ কাপড় সামনের দিক থেকে নয় বরং পেচনের দিক থেকে ছেঁড়া।” কিন্তু যে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সামান্য চিন্তা করলেই একথাটি বুঝতে পারে যে, কুরআনের বর্ণনা তালমূদের বর্ণনা থেকে অনেক বেশী যুক্তিসংগত। একথা কেমন করে মেনে নেয়া যায় যে, এত বড় একজন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর ওপর নিজের দাসের তথাকথিত চড়াও হবার মামলাটি নিজেই আদলতে নিয়ে গেছেন? এটি কুরআন ও ইসরাঈলী বর্ণনার মধ্যে পার্থক্যের একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত। এ থেকে মুহাম্মাদ সা. এ কাহিনীটি বনী ইসরাঈলদের থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন বলে পশ্চিমী প্রাচ্যবিদরা যে অভিযোগ আনেন তার অন্তসারশূন্যতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সত্যি কথা হচ্ছে, কুরআন তাদের বর্ণনা সংশোধন করেছে এবং সঠিক সত্য ঘটনাটিই দুনিয়াবাসীর সামনে তুলে ধরেছে।
﴿وَقَالَ نِسْوَةٌ فِي الْمَدِينَةِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ تُرَاوِدُ فَتَاهَا عَن نَّفْسِهِ ۖ قَدْ شَغَفَهَا حُبًّا ۖ إِنَّا لَنَرَاهَا فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
৩০। শহরের মেয়েরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো।, “আযীযের স্ত্রী তার যুবক গেলামের পেছনে পড়ে আছে, প্রেম তাকে উন্মদ করে দিয়েছে। আমাদের মতে সে পরিষ্কার ভুল করে যাচ্ছে।”
﴿فَلَمَّا سَمِعَتْ بِمَكْرِهِنَّ أَرْسَلَتْ إِلَيْهِنَّ وَأَعْتَدَتْ لَهُنَّ مُتَّكَأً وَآتَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِّنْهُنَّ سِكِّينًا وَقَالَتِ اخْرُجْ عَلَيْهِنَّ ۖ فَلَمَّا رَأَيْنَهُ أَكْبَرْنَهُ وَقَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ وَقُلْنَ حَاشَ لِلَّهِ مَا هَٰذَا بَشَرًا إِنْ هَٰذَا إِلَّا مَلَكٌ كَرِيمٌ﴾
৩১। সে যখন তাদের এ শঠতাপূর্ণ কথা শুনলো তখন তাদেরকে ডেকে পাঠালো। তাদের জন্য হেলান দিয়ে বসার মজলিসের আয়োজন করলো।২৬ খাওয়ার বৈঠকে তাদের সবার সামনে একটি করে ছুরি রাখলো। (তারপর ঠিক সেই মুহূর্তে যখন তারা ফল কেটে কেটে খাচ্ছিল) সে ইউসুফকে তাদের সামনে বের হয়ে আসার ইশারা করলো। যখন ঐ মেয়েদের দৃষ্টি তার ওপর পড়লো, তার বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলো এবং নিজের হাত কেটে ফেললো। তারা বললো, “আল্লাহর কী অপার মহিমা! এতো মানুষ নয়, এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশ্তা।”
২৬. অর্থাৎ এমন মজলিস যে মজলিসে মেহমানদের হেলান দিয়ে বসার জন্য বালিশ সাজানো ছিল। মিসরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকেও এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে তাদের মজলিসে মহফিলে বালিশের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।
বাইবেলে এ ভোজসভার কোন উল্লেখ নেই। তবে তালমূদে এ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার বর্ণনাধারা কুরআন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কুরআনের বর্ণনার যে জীবন জোয়ার, যে প্রাণশক্তি, স্বাভাবিকতা ও উন্নত নৈতিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় তালমূদে তার সামান্যতম স্পর্শ ও নেই।
﴿قَالَتْ فَذَٰلِكُنَّ الَّذِي لُمْتُنَّنِي فِيهِ ۖ وَلَقَدْ رَاوَدتُّهُ عَن نَّفْسِهِ فَاسْتَعْصَمَ ۖ وَلَئِن لَّمْ يَفْعَلْ مَا آمُرُهُ لَيُسْجَنَنَّ وَلَيَكُونًا مِّنَ الصَّاغِرِينَ﴾
৩২। আযীযের স্ত্রী বললো, “দেখলে তো! এ হলো সেই ব্যক্তি যার ব্যাপারে তোমরা আমার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ করতে। অবশ্যই আমি তাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে নিজেকে রক্ষা করেছে। যদি সে আমার কথা না মেনে নেয় তাহলে কারারুদ্ধ হবে এবং নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে।”২৭
২৭. এ থেকে তদানীন্তন মিসরের উচ্চ ও অভিজাত সমাজে নৈতকতার অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল তা অনুমান করা যায়। একথা সুস্পষ্ট, আযীযের স্ত্রী যেসব মহিলাকে দাওয়াত দিয়েছিল তারা নিশ্চয়ই নগরের আমীর-উমরাহ ও বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদের বেগমরাই ছিল। এসব উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ভদ্র মহিলার সামনে সে নিজের প্রিয় যুবককে পেশ করলো। তার সুদর্শন যৌবনোদ্ভিন্ন দেহ সুষমা দেখিয়ে সে তাদের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করতে চাইলো যে, এমন সুন্দর যুবকের জন্য যদি আমি পাগল না হয়ে যাই তাহলে আর কী হবো! তারপর এসব পদস্থ ব্যক্তিবর্গের স্ত্রী-কন্যারা নিজেদের কাজের মাধ্যমে যেন একথার সত্যতা প্রমাণ করলো যে, সত্যিই এ ধরনের অবস্থায় তাদের প্রত্যেকেই ঠিক তাই করতো যা আযীযের স্ত্রী করেছে। আবর অভিজাত মহিলাদের এ ভরা মজলিসে মেজবান সাহেবা প্রকাশ্যে এ সংকল্প ঘোষণা করতে একটুও লজ্জা অনুভব করলো না যে, যদি এ সুন্দর যুবক তার কামনার ক্রীড়নক হতে রাযি না হয় তাহলে সে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। এ সবকিছুই একথা প্রমাণ করে যে ইউরোপ ও আমেরিকা এবং তাদের প্রাচ্যদেশীয় অন্ধ অনুসারীরা আজ যে নারী স্বাধীনতা এবং নারীদের অবাধ বিচরণ ও মেলামেশাকে বিংশ শতাব্দীর প্রগতিশীলতার অবদান মনে করে থাকে তা আসলে কোন নতুন জিনিস নয়, অনেক পুরাতন, প্রাচীন জিনিস। অতি প্রাচীনকালে দাকিয়ানুসের শাসনেরও বহুশত বছর আগে মিসরে ঠিক একই রকম শানশওকতের সাথে এর প্রচলন ছিল যেমন আজকের এ “প্রগতিশীলতার” যুগে আছে।
﴿قَالَ رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ﴾
৩৩। ইউসুফ বললো, “হে আমার রব ! এরা আমাকে দিয়ে যে কাজ করাতে চাচ্ছে তার চাইতে কারাগারই আমার কাছে প্রিয়! আর যদি তুমি এদের চক্রান্ত থেকে আমাকে না বাঁচাও তাহলে আমি এদের ফাঁদে আটকে যাবো এবং অজ্ঞদের অন্তরভুক্ত হবে।”২৮
২৮. সে সময় হযরত ইউসুফ যেসব অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন এ আয়াত গুলো আমাদের সামনে তার একটি অদ্ভুত চিত্র তুলে ধরেছে। উনিশ বিশ বছরের একটি সুন্দর যুবক। বেদুইন জীবনের উদ্দামতায় লালিত বলিষ্ঠ ও সুঠাম দেহী। আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন প্রবাস জীবন, দেশান্তর ও বলপূর্বক দাসত্বের পর্যায় অতিক্রম করার পর ভাগ্য তাকে দুনিয়ার বৃহত্তম সুসভ্য রাষ্ট্রের রাজধানীতে একজন উচ্চ রাষ্ট্রীয় পদমর্যদাসম্পন্ন ব্যক্তির বাড়িতে টেনে এনেছে। এখানে এ বাড়ির যে বেগম সাহেবার সাথে সকাল বিকাল তাকে ওঠাবসা করতে হয় সে-ই প্রথমে তার পেছনে লাগে। তারপর তার সৌন্দর্যের আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র রাষ্ট্রে। সারা শহরের অভিজাত পরিবারের মেয়েরা তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। এখন তার চতুর্দিকে সবসময় শত শত সুন্দর জাল বিছানা থাকে তাকে আটকাবার জন্য। তার ভাবাবেগকে উসকিয়ে দেবার এবং তার ধার্মিকতাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করার জন্য সব ধরনের কৌশল ও ফন্দি আঁটা হতে থাকে। তিনি যেদিকে যান সেদিকেই দেখতে পান পাপ তার সমস্ত চাকচিক্য ও মোহনীয়তা নিয়ে দরজা উন্মুক্ত করে তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে অসৎ ও অশালীন করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। কিন্তু এখানে সুযোগই তাকে খুঁজে ফিরছে এবং সবসময় ওঁৎ পেতে আছে যখনই তার মনে অসৎকাজের প্রতি সামান্যতম ঝোঁকপ্রবণতা দেখা দেবে তখনই সে তার সামনে নিজেকে পেশ করে দেবে। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা তিনি এক মহা আতংকের মধ্যে জীবন যাপন করছেন। কখনো মাত্র এক লহমার জন্য যদি তাঁর ইচ্ছা ও সংকল্পের বাঁধন সামান্যতম ঢিলে হয়ে যায় তাহলে পাপের যে অসংখ্য দরজা তার অপেক্ষায় হরহামেশা খোলা আছে তার যে কোন একটির মধ্য দিয়ে তিনি ভেতরে প্রবেশ করে যেতে পারেন। এ অবস্থায় এ আল্লাহ বিশ্বাসী যুবক যে সাফল্যের সাথে এসব শয়তানী প্ররোচণার মোকাবিলা করেছেন তা এমনিতেই কম প্রশংসনীয় নয়। কিন্তু এ সর্বোচ্চ মানের আত্মসংযমের পরিচয় দেবার পর আত্মোপলব্ধি ও চিন্তার বিশুদ্ধতারও তিনি চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। এমন নজীরবিহীন পরহেজগারীর দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরও তাঁর মনে কখনো এ মর্মে অহমিকা জাগেনি যে, “বাহ, কত মজবুত আমার চরিত্র! এতো সুন্দরী ও যুবতী মেয়েরা আমার প্রেমে পাগলপারা কিন্তু এরপরও আমার পদস্থলন হয়নি।” বরং এর পরিবর্তে তিনি নিজের মানবিক দুর্বলতার কথা চিন্তা করে ভয়ে কেঁপে উঠেছেন এবং অত্যন্ত দীনতার সাথে আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়ে বলেছেন, হে আমার রব! আমি একজন দুর্বল মানুষ। এ অসংখ্য অগণিত প্ররোচণার মোকাবিলা করার শক্তি আমার কোথায়! তুমি আমাকে সহায়তা দান করো এবং আমাকে বাঁচাও। আমি ভয় করছি আমার পা পিচলে না যায় আসলে এটি হযরত ইউসুফ আ. এরনৈতিক প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটময় অধ্যায় ছিল। বিশ্বস্ততা, আমানতদারী, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা, সত্যনিষ্ঠা, অকপটতা, সংযম ও চিন্তার ভারসাম্যের অসাধারণ গুণাবলী এ পর্যন্ত তাঁর মধ্যে সুপ্ত ছিল এবং এ সম্পর্কে তিনি নিজেও বেখবর ছিলেন। এ কঠোর পরীক্ষার যুগে এ গুণগুলো সবই তাঁর মধ্যে বিকশিত হয়ে উঠলো। এগুলো পূর্ণ শক্তিতে কাজ করতে থাকেলো। তিনি নিজেও জানতে পারলেন তাঁর মধ্যে কোন কোন শক্তি আছে এবং তাদেরকে তিনি কোন কোন কাজে লাগাতে পারেন।
﴿فَاسْتَجَابَ لَهُ رَبُّهُ فَصَرَفَ عَنْهُ كَيْدَهُنَّ ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾
৩৪। তার রব তার দোয়া কবুল করলেন এবং তাদের অপকৌশল থেকে তাকে রক্ষা করলেন।২৯ অবশ্যি তিনি সবার কথা শোনেন এবং সবকিছু জানেন।
২৯. রক্ষা করা এ অর্থে যে, ইউসুফ আ. এরসৎচরিত্রকে এমন শক্তিমত্তা ও দৃঢ়তা দান করা হয় যার ফলে তার মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট নারী সামজের সমস্ত অপকৌশলই ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাছাড়া এ অর্থেও রক্ষা করা যে, আল্লাহর ইচ্ছায় কারাগারের দরজা তাঁর জন্য খুলে দেয়া হয়।
﴿ثُمَّ بَدَا لَهُم مِّن بَعْدِ مَا رَأَوُا الْآيَاتِ لَيَسْجُنُنَّهُ حَتَّىٰ حِينٍ﴾
৩৫। তারপর তারা মনে করলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে কারারুদ্ধ করতে হবে, অথচ তারা (তার নিষ্কুলুষতা এবং নিজেদের স্ত্রীদের অসতিপনার) সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দেখে নিয়েছিল।৩০
৩০. এভাবে হযরত ইউসুফকে কারাগারে নিক্ষেপ করা আসলে তাঁর নৈতিক বিজয় এবং মিসরের সমগ্র অভিজাত ও শাসক সমাজের চূড়ান্ত নৈতিক পরাজয়ের ঘোষণা ছিল। হযরত ইউসুফ তখন কোন অজ্ঞাতনামা ও অপরিচিত লোক ছিলেন না। সারাদেশে এবং কমপক্ষে তো রাজধানী নগরীতে বিশেষ ও সাধারণ সব মহলেই তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। যে ব্যক্তির আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের প্র্রতি দু‘-একটি নয়, অধিকাংশ অভিজাত পরিবারের মহিলারা প্রণয়াসক্ত এবং যার মনমাতানো ও চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের তীব্র আকর্ষণে নিজেদের দাম্পত্য জীবন ধ্বংস হতে দেখে মিসরের শাসকরা তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেই নিজেদের ঘর-দোর সামলাবার ব্যবস্থা করেছিল। এহেন ব্যক্তিত্ব কখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে থাকতে পারে না, একথা সহজেই অনুমান করা যায়। নিশ্চয়ই প্রতি ঘরে তাঁর কথা আলোচিত হতো। সাধারণভাবেও লোকেরা নিশ্চয়ই তাঁর অসাধারণ উন্নত, শক্তিশালী ও পবিত্র চরিত্রের কথা জেনে গিয়েছিল। তারা জেনেছিল, এ ব্যক্তিকে তার কোন অপরাধের কারণে কারাগারে পাঠানো হয়নি বরং মিসরের অভিজাত লোকেদের জন্য নিজেদের স্ত্রী-কন্যাদেরকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার পরিবর্তে এ নিরপধাধকে কারাগারে পাঠানো সহজ ছিল বলেই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এ থেকে একথাও জানা গেলো, কোন ব্যক্তিকে ইনসাফের শর্ত অনুযায়ী আদালতে অপরাধী প্রমাণ না করেই খেয়াল খুশীমত গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া বেঈমান শাসকদের পুরাতন রীতি। এ ব্যাপারেও আজকের শয়তানরা চার হাজার বছর আগের শয়তানদেরকে থেকে খুব বেশী ভিন্নতর নয়। ফারাক কেবল এতটুকুই, তারা “গণতন্ত্রের” নাম নিত না আর এরা নিজেদের কার্যকলাপের সাথে গণতন্ত্রের নাম নেয়। তারা কোন আইন ছাড়াই বেআইনী কার্যকলাপ করতো। আর এরা প্রত্যেকটি অবৈধ অন্যায় কাজের জন্য প্রথমে একটি “আইন” তৈরী করে নেয়। তারা পরিষ্কারভাবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার করতো আর এরা যার ওপর জুলুম নির্যাতন চালায় তার সম্পর্কে দুনিয়াবাসীকে বুঝাবার চেষ্টা করে যে, তার কারণে তার নিজের নয় বরং দেশ ও জাতির জন্য আশংকা দেখা দিয়েছিল। মোটকথা, তারা শুধু জালেম ছিল কিন্তু এরা সেই সাথে মিথ্যুক এবং নির্লজ্জও।
﴿وَدَخَلَ مَعَهُ السِّجْنَ فَتَيَانِ ۖ قَالَ أَحَدُهُمَا إِنِّي أَرَانِي أَعْصِرُ خَمْرًا ۖ وَقَالَ الْآخَرُ إِنِّي أَرَانِي أَحْمِلُ فَوْقَ رَأْسِي خُبْزًا تَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْهُ ۖ نَبِّئْنَا بِتَأْوِيلِهِ ۖ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ﴾
৩৬। কারাগারে৩১ তার সাথে আরো দু’টি ভৃত্যও প্রবেশ করলো।৩২ একদিন তাদের একজন তাকে বললো, “আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি মদ তৈরী করছি।” অন্যজন বললো, “আমি দেখলাম আমার মাথায় রুটি রাখা আছে এবং পাখিরা তা খাচ্ছে।” তারা উভয়ে বললো, “আমাদের এর তা’বীর বলে দিন। আমরা আপনাকে সৎকর্মশীল হিসেবে পেয়েছি।”৩৩
৩১. হযরত ইউসুফকে যখন কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তখন সম্ভবত তাঁর বয়স বিশ একুশ বছরের বেশী ছিল না। তালমূদে বলা হয়েছে, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যখন তিনি মিসরের শাসনকর্তা হন তখন তাঁর বয়স ছিল তিরিশ বছর। এদিকে কুরআন বলছে, কারাগারে তিনি بضع سنين অর্থাৎ কয়েক বছর কাটান। بضع শব্দটি আরবী ভাষায় ১০ পর্যন্ত সংখ্যার জন্য বলা হয়ে থাকে।
৩২. হযরত ইউসুফের সাথে এই যে দু’জন গোলাম কারাগারে প্রবেশ করেছিল তাদের সম্পর্কে বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, তাদের একজন ছিল মিসরের বাদশাহর মদ পরিবেশকদের সরদার এবং দ্বিতীয়জন রাজকীয় রুটি প্রস্তুকারকদের অফিসার। তালমূদের বর্ণনা মতে, মিসরের বাদশাহ তাদের এ অপরাধে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন যে, একবার এক দাওয়াতের মজলিসে পরিবেশিত রুটি একটু বিস্বাদ লেগেছিল। এবং একটি মদের পাত্রে পাওয়া গিয়েছিল মাছি।
৩৩. কারাগারে হযরত ইউসুফকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হতো এ থেকে তা আন্দাজ করা যেতে পারে। ওপরে যেসব ঘটনার কথা আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো সামনে রাখলে ব্যাপারটা আর মোটেই বিস্ময়কর মনে হয় না যে, এ কয়েদী দু’জন হযরত ইউসুফের কাছেই-বা এসে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলো কেন এবং তাঁকে “আমরা আপনাকে সদাচারী হিসেবে পেয়েছি” বলে শ্রদ্ধার্ঘ পেশ করলো কেন। জেলখানার ভেতরে বাইরে সবাই জানতো, এ ব্যক্তি কোন অপরাধী নয়, বরং একজন হুকুম মেনে চলার প্রমাণ পেশ করেছেন। আজ সারাদেশে তাঁর চেয়ে বেশী সৎব্যক্তি আর কেউ নেই। এমনকি দেশের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যেও তাঁর মতো লোক একজনও নেই। এ কারণে শুধু কয়েদীরাই তাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতো না রবং কয়েদখানার পরিচালকবৃন্দ এবং কর্মচারীরাও তাঁর ভক্তদলে শামিল হয়ে গিয়েছিল। বাইবেলে বলা হয়েছেঃ “কারা রক্ষক কারাস্থিত সমস্ত বন্দির ভার যোসেফের হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং তথাকার লোকদের সমস্ত কর্ম যোসেফের আজ্ঞা অনুসারে চলিত লাগিল। কারারক্ষক তাঁহার হস্তগত কোন বিষয়ে দৃষ্টিপাত করিতেন না।” (আদি পুস্তকঃ ৩৯:২২, ২৩)
﴿قَالَ لَا يَأْتِيكُمَا طَعَامٌ تُرْزَقَانِهِ إِلَّا نَبَّأْتُكُمَا بِتَأْوِيلِهِ قَبْلَ أَن يَأْتِيَكُمَا ۚ ذَٰلِكُمَا مِمَّا عَلَّمَنِي رَبِّي ۚ إِنِّي تَرَكْتُ مِلَّةَ قَوْمٍ لَّا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَهُم بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ﴾
৩৭। ইউসুফ বললোঃ “এখানে তোমরা যে খাবার পাও তা আসার আগেই আমি তোমাদের এ স্বপ্নগুলোর অর্থ বলে দেবো। আমার রব আমাকে যা দান করেছেন এ জ্ঞান তারই অন্তরভূক্ত। আসল ব্যাপার হচ্ছে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং আখেরাত অস্বীকার করে তাদের পথ পরিহার করে।
﴿وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ۚ مَا كَانَ لَنَا أَن نُّشْرِكَ بِاللَّهِ مِن شَيْءٍ ۚ ذَٰلِكَ مِن فَضْلِ اللَّهِ عَلَيْنَا وَعَلَى النَّاسِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ﴾
৩৮। আমি আমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের পথ অবলম্বন করেছি। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়। আসলে এটা আমাদের এবং সমগ্র মানব জাতির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ (যে, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারোর বান্দা হিসেবে তৈরী করেননি) কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
﴿يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ﴾
৩৯। হে জেলখানার সাথীরা! তোমারা নিজেরাই ভেবে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু সংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ, যিনি সবার ওপর বিজয়ী।”
﴿مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৪০। তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের বন্দেগী করছো তারা শুধুমাত্র কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ-পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোন প্রমাণ পাঠাননি। শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর হুকুম- তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।
﴿يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَمَّا أَحَدُكُمَا فَيَسْقِي رَبَّهُ خَمْرًا ۖ وَأَمَّا الْآخَرُ فَيُصْلَبُ فَتَأْكُلُ الطَّيْرُ مِن رَّأْسِهِ ۚ قُضِيَ الْأَمْرُ الَّذِي فِيهِ تَسْتَفْتِيَانِ﴾
৪১। হে জেলখানার সাথীরা! তোমাদের স্বপ্নের তা’বীর হচ্ছে, তোমাদের একজন তার নিজের প্রভুকে (মিসর রাজ) মদ পান করাবে আর দ্বিতীয় জনকে শূলবিদ্ধ করা হবে এবং পাখি তার মাথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। তোমরা যে কথা জিজ্ঞেস করছিলে তার ফায়সালা হয়ে গেছে।৩৪
৩৪. এখানে যে কাহিনীটি বর্ণনা করা হয়েছে এ ভাষণটি হচ্ছে তার প্রাণ। এটি কুরআনেরও তাওহীদ সম্পর্কিত সর্বোত্তম ভাষণগুলোর অন্যতম। কিন্তু বাইবেল ও তালমূদে কোথাও এ সম্পর্কে সামান্য ইংগিত ও নেই। সেখানে হযরত ইউসুফকে নিছক একজন জ্ঞানী ও আল্লাহভীরু লোক হিসেবেই পেশ করা হয়েছে। কিন্তু কুরাআন কেবল তাঁর চরিত্রের এ দিকগুলোকে বাইবেল ও তালমূদের চাইতে বেশী উজ্জ্বল করে পেশ করেছে তাই নয় বরং এ ছাড়াও আমাদেরও একথা জানায় যে, হযরত ইউসুফের নিজের একটি নবুওয়াত মিশন ছিল এবং তাঁর দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ তিনি কারাগারেই শুরু করে দিয়েছিলেন।
এ ভাষণটির ওপর শুধুমাত্র সাদামাটাভাবে চোক বুলিয়ে চলে যাওয়া যাবে, এমন পর্যায়ের ভাষণ এটি নয়। এর এমন অনেকগুলো দিক আছে যেগুলো প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং যেগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন আছেঃ
একঃ এ প্রথম আমরা দেখছি হযরত ইউসুফ আ. আল্লাহর সত্য দীনের প্রচার করছেন। এর আগে তাঁর জীবন কাহিনীর যে অংশ কুরআন পেশ করেছে তাতে কেবলমাত্র তার উন্নত নৈতকি চরিত্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু তাবলীগ বা প্রচারের কোন আবাস সেখানে পাওয়া যায় না। এ থেকে প্রমাণ হয়, প্রথম পর্যায়গুলো ছিল নিছক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণমূলক। নবুওয়াতের কাজ কার্যত এ কারাগার পর্যায়ে তাঁকে সোপর্দ করা হয় এবং নবী হিসেবে এটি তাঁর প্রথম দাওয়াতী ভাষণ।
দুইঃ এ প্রথম লোকদের সামনে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করেন। এর আগে আমরা দেখেছি তিনি যেসব অবস্থা সম্মুখীন হয়েছেন অত্যন্ত ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার সাথে সেগুলো গ্রহণ করতে থেকেছেন। যখন কাফেলার লোকেরা তাঁকে ধরে গোলাম বানালো, যখন তিনি মিসরে আনীত হলেন, যখন তাঁকে মিসরের আযীযের হাতে বিক্রি করা হলো, যখন তাঁকে কারাগারে পাঠানো হলো, এর মধ্যে কোন এক সময়েও তিনি একথা বলেননি যে, তিনি ইব্রাহীম ও ইসহাক আ. এরপৌত্র এবং ইয়াকূব আ. এরছেলে। তাঁর বাপ ও দাদা কেউ অপরিচিত ছিলেন না। কাফেলার লোকেরা, ময়দানবাসী হোক বা ইসমাঈলী উভয়েরই তাদের পরিবারের সাথে নিকট সম্পর্ক ছিল। মিসরবাসীরাও তো কমপক্ষে হযরত ইব্রাহীম সম্পর্কে বেখবর ছিল না। (বরং হযরত ইউসুফ যেভাবে তাঁদের এবং হযরত ইয়াকূব ও ইসহাকের কথা বলেছেন তাতে অনুমান করা যায় এ তিনজন মনীষীর খ্যাতি মিসরে পৌঁছে গিয়েছিল।) কিন্তু হযরত ইউসুফ আ. বিগত চার পাঁচ বছর ধরে যেমন অবস্থার সম্মুখীন হতে থেকেছেন তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কখনো নিজের বাপ-দাদাদের নাম নেননি। সম্ভবত তিনি নিজেও জানতেন, আল্লাহ তাঁকে যা কিছু বানাতে চান সে জন্য তাঁকে এসব অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখন শুধুমাত্র নিজের দাওয়াত ও তাবলীগের খাতিরে তিনি এ সত্যটি সামনে তুলে ধরলেন যে, তিনি কোন নতুন অভিনব দীন পেশ করছেন না বরং তাওহীদ প্রচারের এমন একটি বিশ্বজনীন আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে যার নেতা হচ্ছে ইব্রাহীম ইসহাক ও ইয়াকূব আ.। তাঁর এমনটি করা এ জন্য জরুরী ছিল যে, সত্য দীনের আহবায়ক কখনো “আমি একটি নতুন কথা বলছি যা এর আগে কেউ বলেনি” এ ধরনের দাবীর মাধ্যমে তাঁর দাওয়াতের কাজ শুরু করেন না। বরং প্রথম পদক্ষেপেই তিনি একথা পরিষ্কার করে বলে দেন যে, তিনি একটি চিরন্তন ও চিরস্তায়ী সত্যের দিকে আহবান জানাচ্ছেন, যা ইতিপূর্বে সবসময়ই সকল সত্যপন্থী পেশ করে এসেছেন।
তিনঃ তারপর ইউসুফ আ. নিজের বক্তব্য পেশ করার জন্য যেভাবে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তা থেকে আমরা প্রচার কৌশলের ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করি। দু’জন লোক তাদের স্বপ্ন বর্ণনা করছে। তারা নিজেদের ভক্তি ও শ্রদ্ধার কথা প্রকাশ করে তার তা’বীর জিজ্ঞেস করছে। জবাবে তিনি বলছেন, তা’বীর তো আমি অবশ্যি বলবো কিন্তু তার আগে শুনে রাখো, যে জ্ঞানের মাধ্যমে আমি তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেবো তার উৎস কি? এভাবে তাদের কথার মধ্য থেকে নিজের কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করে তিনি তাদের সামনে নিজের দীন পেশ করতে থাকেন। এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কোন ব্যক্তি যদি সত্য প্রচারের ফিকিরে লেগে যায় এবং সে সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তিরও অধিকারী হয় তাহলে কেমন চমৎকারভাবে আলোচনার মোড় নিজের দিকে ফিরিয়ে নিতে পারে। যে ব্যক্তি দাওয়াত দেবার ধান্দায় থাকে না তার সামনে সুযোগের পর সুযোগ আসতে থাকে কিন্তু কোন সুযোগেই সে নিজের কথা পেশ করার প্রয়োজন অনুভব করে না। কিন্তু যার এ ধান্দা থাকে, সে সুযোগের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকে এবং সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই নিজের কাজ শুরু করে দেয়। তবে বিচক্ষণ ও জ্ঞানী প্রচারকের সুযোগ সন্ধান এবং নির্বোধ ও অবিবেচক প্রচারকের সুযোগ সদ্ধানের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নির্বোধ প্রচারক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি না রেখে লোকদের কানে জোরপূর্বক নিজের দাওয়াত ঠেসে দেবার চেষ্টা করে তারপর অনর্থক তর্কবিতর্ক ও বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে তাদের মনে নিজের দাওয়াতের প্রতি উলটো বিরুক্তির সৃষ্টি করে।
চারঃ লোকদের সামনে দীনের দাওয়াত পেশ করার সঠিক পদ্ধতি কি, একথাও এখান থেকে জানা যেতে পারে। হযরত ইউসুফ আ. সুযোগ পেতেই ইসলামের বিস্তারিত বিধান ও নীতিগুলো পেশ করতে শুরু করেননি। বরং শ্রোতাদের সামনে দীনের এমন একটি সূচনা বিন্দু তুলে ধরেন যেখান থেকে সত্যপন্থী ও মিথ্যাপন্থীদের পথ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ তাওহীদ ও শিরকের পার্থক্যকে তুলে ধরেছেন। আবার এ পার্থক্যকে এমন যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে সুস্পষ্ট করেছেন যার ফলে সাধারণ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন যে কোন ব্যক্তিই তা অনুভব না করে পারেন না। বিশেষ করে সে সময় যাদেরকে সম্বোধন করে তিনি একথা বলছিলেন তাদের মন মস্তিষ্কে তীরের মতো একথা গেঁথে গিয়ে থাকবে। কারণ তারা ছিল কর্মজীবী গোলাম। নিজেদের মনের গভীরে তারা একথা ভালোভাবে অনুভব করতো যে, একজন প্রভুর গোলাম হওয়া ভালো, না একাধিক প্রভুর গোলাম হওয়া আর সারা দুনিয়ার একক প্রভু যিনি, তার বন্দেগী করা ভালো, না তার বান্দাদের বন্দেগী করা? তারপর তিনি একথাও বলেন না যে, তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করো এবং আমার দীন গ্রহণ করো। বরং এক বিচিত্র ভংগীতে বলছেন, আল্লাহর কতবড় মেহেরবানী, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারো বান্দা হিসেবে পয়দা করেননি, অথচ অধিকাংশ লোক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না বরং অনর্থক নিজেরাই মনগড়া রব তৈরী করে তাদের পূজা ও বন্দেগী করছে। তারপর তিনি শ্রোতাদের অনুসৃত ধর্মের সমালোচনাও করছেন কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে এবং কোন প্রকার মনোকষ্ট না দিয়ে। তিনি এতটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন যে, এই যেসব মাবুদ-যাদের কাউকে তোমরা অন্নদাতা, কাউকে অনুগ্রহদাতা ও করুণানিধান, কাউকে ভূমির অধিপতি এবং কাউকে ধন-সম্পদের মালিক অথবা স্বাস্থ্য ও রোগের একচ্ছত্র অধিপতি ও পরিচালক ইত্যাদি বলে থাকো এরা নিছক অন্তসারশূন্য নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নামগুলোর পিছনে কোন সত্যিকার অন্নদাতা, অনুগ্রহকারী, মালিক ও প্রভুর অস্তিত্ব নেই। আসল মালিক ও প্রভু হচ্ছেন মহান আল্লাহ, যাকে তোমরাও বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক বলে স্বীকার করে থাকো। তিনি এসব মালিক ও প্রভুদের কাউকে মালিকনা, প্রভুত্ব ও উপাস্য হবার ছাড়পত্র দেননি। তিনি সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্বের যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা নিজের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন এবং তাঁরই আদেশ হচ্ছে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না।
পাঁচঃ হযরত ইউসুফ আ. কারাগারের এ আট দশ বছরের জীবন কিভাবে অতিবাহিত করেছেন এ থেকে একথাও অনুমান করা যেতে পারে। লোকেরা মনে করে, কুরআন যেহেতু তাঁর শুধু একটি মাত্র ভাষণের উল্লেখ আছে কাজেই তিনি কেবল একবারই দীনের দাওয়াত দেবার জন্য মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু প্রথমত নবী তাঁর আসল কাজ থেকে গাফেল ছিলেন, একজন নবী সম্পর্কে এ ধারণা করা মারাত্মক ধরনের কুধারণার পর্যায়ভুক্ত। তারপর যে ব্যক্তির সত্যদীন প্রচারের আগ্রহ ও ফিকির এত বেশী প্রবল ছিল যে, দু’জন লোক স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করতেই তিনি সেই সুযোগেই সদ্ব্যবহার করে তাদের কাছে দীনের তাবলীগ করতে শুরু করে দেন, তাঁর সম্পর্কে কেমন করে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, তিনি কারাবাসের এ কয়েক বছর নীরবে কাটিয়ে দিয়েছিলেন?
﴿وَقَالَ لِلَّذِي ظَنَّ أَنَّهُ نَاجٍ مِّنْهُمَا اذْكُرْنِي عِندَ رَبِّكَ فَأَنسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ فَلَبِثَ فِي السِّجْنِ بِضْعَ سِنِينَ﴾
৪২। আবার তাদের মধ্য থেকে যার সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে ইউসুফ তাকে বললোঃ “তোমার প্রভুকে (মিসরের বাদশাহ) আমার কথা বলো।” কিন্তু শয়তান তাকে এমন গাফেল করে দিল যে, সে তার প্রভুকে (মিসরের বাদাশাহ) তার কথা বলতে ভুলে গেলো। ফলে ইউসুফ কয়েক বছর কারাগারে পড়ে রইলো।৩৫
৩৫. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, “শয়তান হযরত ইউসুফকে তাঁর রবের (অর্থাৎ আল্লাহ) স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয় এবং তিনি এক বান্দার কাছে চান যে, সে তার রবের (মিসরের বাদশাহর) কাছে তার কথা আলোচনা করে তার কারামুক্তির চেষ্টা করুক, তাই আল্লাহ তাঁকে কয়েক বছর জেলখানা পড়ে থাকার শাস্তি দেন।” মূলত এটি পুরোপুরি একটি ভুল ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেমন আল্লামা ইবনে কাসীর এবং প্রথম যুগের তাফসীরকারদের মধ্যে মুজাহিদ, মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইত্যাদি তাফসীরকারগণ বলেন, فَأَنسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ (শয়তান তাকে ভুলিয়ে দেয় তার রবের বা প্রভুর স্মরণ) এর মধ্যে “তার” বলতে সেই ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যার সম্পর্কে হযরত ইউসুফের ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে এবং এ আয়াতের মানে হচ্ছে, “শয়তান তার প্রভুর কাছে হযরত ইউসুফের বিষয়টা উত্থাপন করার কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল।” এ প্রসংগে একটি হাদীসও পেশ করা হয়। হাদীসটিতে বলা হয়েছেঃ নবী সা. বলেছেন, “ইউসুফ আ. যে কথা বলেছিলেন সে কথা যদি তিনি না বলতেন তাহলে তিনি কয়েক বছর কারাগারে আটক থাকতেন না।” কিন্তু আল্লামা ইবনে কাসীর বলেছেনঃ “এ হাদীস যে ক’টি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে সব কটিই দুর্বল। কোন কোন সুত্রে এটি “মরফূ” হাদীস। সেখানে বর্ণনাকারী হচ্ছে সুফিয়ান ইবন ওয়াকী ও ইব্রাহীম ইবনে ইয়াযীদ। এরা উভয়ই অনির্ভরযোগ্য। আবার কোন কোন সূত্রে এটি “মুরসাল” হাদীস। কিন্তু এ ধরনের বিষয়ে মুরসাল হাদীসের ওপর ভরসা করা যেতে পারে না।” এ ছাড়া একজন মজলুম ব্যক্তি নিজের মুক্তির জন্য পার্থিব পন্থা অবলম্বন করাকে আল্লাহ থেকে গাফলতির ও তাঁর প্রতি অনির্ভরশীলতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হবে -একথা যুক্তির দিক দিয়েও গ্রহণযোগ্য নয়।
﴿وَقَالَ الْمَلِكُ إِنِّي أَرَىٰ سَبْعَ بَقَرَاتٍ سِمَانٍ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌ وَسَبْعَ سُنبُلَاتٍ خُضْرٍ وَأُخَرَ يَابِسَاتٍ ۖ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ أَفْتُونِي فِي رُؤْيَايَ إِن كُنتُمْ لِلرُّؤْيَا تَعْبُرُونَ﴾
৪৩। একদিন৩৬ বাদশাহ বললো, “আমি স্বপ্ন দেখেছি, সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও সাতটি শুকনো শীষ। হে সভাসদবৃন্দ! আমাকে এ স্বপ্নের তা’বীর বলে দাও, যদি তোমরা স্বপ্নের মানে বুঝে থাকো।”৩৭
৩৬. মাঝখানে কারাগার জীবনের কয়েক বছরের অবস্থা বাদ দিয়ে এখন হযরত ইউসুফের পার্থিব উন্নতির সূচনা লগ্নের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়া হয়েছে।
৩৭. বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা মতে এ স্বপ্ন দেখার পর বাদশাহ বড়ই পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে নিজের রাজ্যের বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল গোষ্ঠী, জ্যোতিষী, গণক, দর্মীয় নেতা ও যাদুকরদের একত্র করে তাদের সবার সামনে এ স্বপ্ন পেশ করেছিলেন।
﴿قَالُوا أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ ۖ وَمَا نَحْنُ بِتَأْوِيلِ الْأَحْلَامِ بِعَالِمِينَ﴾
৪৪। লোকেরা বললা, “এসব তো অর্থহীন স্বপ্ন, আর আমরা এ ধরনের স্বপ্নের মানে জানি না।”
﴿وَقَالَ الَّذِي نَجَا مِنْهُمَا وَادَّكَرَ بَعْدَ أُمَّةٍ أَنَا أُنَبِّئُكُم بِتَأْوِيلِهِ فَأَرْسِلُونِ﴾
৪৫। সেই দু’জন কয়েদীর মধ্য থেকে যে বেঁচে গিয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে এখন যার মনে পড়েছিল, সে বললো, “আমি আপনাদের এর তা’বীর বলে দিচ্ছি, আমাকে একটু (কারাগারে ইউসুফের কাছে) পাঠিয়ে দিন।”৩৮
৩৮. কুরআন এখানে ঘটনার আলোচনা সংক্ষেপে সেরে দিয়েছে। বাইবেল ও তালমূদে এর যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে (বস্তুত যুক্তির আলোকে এ বিবরণই সঠিক মনে হয়।) তা হচ্ছে এইঃ মদ পরিবেশকদের সরদার ইউসুফ আ. এরঅবস্থা বাদশাহর কাছে বর্ণনা করে এবং এ সংগে জেলখানার তাদের স্বপ্ন এবং হযরত ইউসুফ আ. তার যে তা’বীর করেছিলেন আর এ তা’বীর যেভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে তা সবই তার সামনে তুলে ধরে। শেষে সে বাদাশাহর কাছে আবেদন করে, আমি জেলখানায় গিয়ে তাঁর কাছ থেকে এর তা’বীর জিজ্ঞেস করে আসবো, আমাকে সেখানে যাবার অনুমতি দেয়া হোক।
﴿يُوسُفُ أَيُّهَا الصِّدِّيقُ أَفْتِنَا فِي سَبْعِ بَقَرَاتٍ سِمَانٍ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌ وَسَبْعِ سُنبُلَاتٍ خُضْرٍ وَأُخَرَ يَابِسَاتٍ لَّعَلِّي أَرْجِعُ إِلَى النَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَعْلَمُونَ﴾
৪৬। সে গিয়ে বললো, “হে সত্যবাদিতার প্রতীক ইউসুফ!৩৯ আমাকে এ স্বপ্নের অর্থ বলে দাওঃ সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি শীষ সবুজ ও সাতটি শীর্ষ শুকনো সম্ভবত আমি লোকদের কাছে ফিরে যেতে পারবো এবং তারা জানতে পারবে।৪০
৩৯. মূল ভাষ্যে صِّدِّيقُ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি আরবী ভাষায় সর্বোচ্চ মানের সততা ও সত্যবাদিতার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, কারাগারে অবস্থানকালে এ ব্যক্তি হযরত ইউসুফ আ. এরপবিত্র জীবন ও চরিত্র দ্বারা কী বিপুলভাবে প্রবাবিত হয়েছিল! দীর্ঘকাল অতিবাহিত হবার পরও এ প্রভাব কেমন অটুট ছিল! “সিদ্দীক” শব্দটির আরো বেশী ব্যাখ্যা জানার জন্য দেখুন সূরা আন নিসার ৯৯ টীকা।
৪০. অর্থাৎ তারা আপনার মর্যাদা ও মূল্য বুঝতে পারবে। তারা অনুভব করতে পারবে কত উঁচুদরের বক্তিত্বকে তারা কোথায় আটকে রেখেছে। এভাবে আপনার সাথে কারাবাসের সময় আমি যে ওয়াদা করেছিলাম তা পূর্ণ করার সুযোগ আমি পেয়ে যাবো।
﴿قَالَ تَزْرَعُونَ سَبْعَ سِنِينَ دَأَبًا فَمَا حَصَدتُّمْ فَذَرُوهُ فِي سُنبُلِهِ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّا تَأْكُلُونَ﴾
৪৭। ইউসুফ বললো, “তোমরা সাত বছর পর্যন্ত লাগাতার চাষাবাদ করতে থাকবে। এ সময় তোমরা যে ফসল কাটবে তা থেকে সামান্য পরিমাণ তোমাদের আহারের প্রয়োজনে বের করে নেবে এবং বাদবাকি সব শীষ সমেত রেখে দেবে।
﴿ثُمَّ يَأْتِي مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ سَبْعٌ شِدَادٌ يَأْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّا تُحْصِنُونَ﴾
৪৮। তারপর সাতটি বছর আসছে বড়ই কঠিন। এ সময়ের জন্য তোমরা যে শস্য জমা করবে তা সমস্ত এ সময়ে খেয়ে ফেলা হবে। যদি কিছু বেঁচে যায় তাহলে তা হবে কেবলমাত্র সেটুকুই যা তোমরা সংরক্ষণ করবে।
﴿ثُمَّ يَأْتِي مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ عَامٌ فِيهِ يُغَاثُ النَّاسُ وَفِيهِ يَعْصِرُونَ﴾
৪৯। এরপর আবার এক বছর এমন আসবে যখন রহমতের বৃষ্টি ধারার মাধ্যমে মানুষের আবেদন পূর্ণ করা হবে এবং তারা রস নিংড়াবে।”৪১
৪১. মূল ভাষ্যে يَعْصِرُونَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর শাব্দিক মানে হচ্ছে ‘নিংড়ানো’। এখানে এর মাধ্যমে পরবর্তীকালের চতুরদিকের এমন শষ্য শ্যামল তরতাজা পরিবেশ বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য যা দুর্ভিক্ষের পর রহমতের বৃষ্টিধারা ও নীলনদের জোয়ারের পানি সিঞ্চনের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে। জমি ভালোভাবে পানিসিক্ত হলে তেল উৎপাদনকারী বীজ, রসাল ফল ও অন্যান্য ফলফলাদি বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং ভালো ঘাস খাওয়ার কারণে গৃহপালিত পশুরাও প্রচুর পরিমাণে দুধ দেয়।
হযরত ইউসুফ আ. এ তা‘বীরে শুধুমাত্র বাদশাহর স্বপ্নের অর্থ বর্ণনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি বরং তিনি এ সংগে প্রাচুর্যের প্রথম সাত বছরে আসন্ন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা ও শস্য সংরক্ষণ করার জন্য কি ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে তাও বলে দিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি দুর্ভিক্ষে পরে সুদিন আসার সুখবরও দিয়েছেন অথচ বাদশাহর স্বপ্নে এর কোন উল্লেখ ছিল না।
﴿وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ ۖ فَلَمَّا جَاءَهُ الرَّسُولُ قَالَ ارْجِعْ إِلَىٰ رَبِّكَ فَاسْأَلْهُ مَا بَالُ النِّسْوَةِ اللَّاتِي قَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ ۚ إِنَّ رَبِّي بِكَيْدِهِنَّ عَلِيمٌ﴾
৫০। বাদশাহ বললো, “তাকে আমার কাছে আনো।” কিন্তু বাদশাহর দূত যখন ইউসুফের কাছে পৌঁছুলে তখন সে বললো,৪২ তোমার প্রভুর কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যে মহিলারা হাত কেটে ফেলেছিল তাদের ব্যাপারটা কি? আমার রব তো তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে অবগত।”৪৩
৪২. এখান থেকে শুরু করে বাদশাহর সাথে সাক্ষাত পর্যন্ত আলোচনাটি এ কাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সম্পর্কে যা কিছু কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তার কোন উল্লেখ বাইবেল ও তালমূদে নেই। বাইবেলে বলা হয়েছে, বাদশাহর ডাকে হযরত ইউসুফ আ. সংগে সংগেই চলে আসার জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি ক্ষৌরকর্ম শেষ করলেন, পোশাক বদলালেন এবং রাজ দরবারে হাযির হয়ে গেলেন। তালমূদ এর চাইতেও নিকৃষ্ট ভংগীতে এঘটনাকে পেশ করেছে। তার বর্ণনামতে, “বাদশাহ তার কর্মচারীদেরকে হুকুম দিলেন ইউসুফকে আমার সামনে হাজির করো এবং এ সংগে এও নির্দেশ দিলেন যে, দেখো এমন কোন কাজ করো না যাতে ছেলেটি ভয় পেয়ে যায় এবং সঠিক তা’বীর দিতে না পারে। কাজেই রাজ কর্মচারীরা হযরত ইউসুফকে কারাগার থেকে বের করলো। তাঁর ক্ষৌরকর্ম সম্পন্ন করলো, পোশাক বদলালো এবং দরবারে নিয়ে এলো। বাদশাহ নিজের সিংহাসনে বসেছিলেন। সেখানে হীরা, মুক্তা, মনি-মাণিক্যের চোখ ধাঁধানো দৃশ্য ও দরবারের শান-শওকত দেখে ইউসুফ হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং তাঁর দৃষ্টি বিষ্ফারিত হয়ে গেলো। বাদশাহর সিংহাসনের সাতটি সিঁড়ি ছিল। নিয়ম ছিল, যখন কোন সম্মানিত ও মর্যাদাশালী ব্যক্তি কিছু বলতে চাইতেন তখন ছয়টি সিঁড়ি চড়ে ওপরে যেতেন এবং বাদশাহর সাথে কথা বলতেন। আর ঘখন নিম্ন শ্রেণীর কোন ব্যক্তিকে বাদশাহর সাথে কথা বলার জন্য ডাকা হতো তখন সে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো এবং বাদশাহ তৃতীয় সিঁড়িতে নেমে এসে তার সাথে কথা বলতেন। এ নিয়ম মোতাবেক ইউসুফ নীচে দাঁড়িয়ে ভূমি চুম্বন করে বাদশাহকে সালামী দিলেন এবং বাদশাহ তৃতীয় সিঁড়িতে নেমে এসে তাঁর সাথে কথা বললেন।” এ চিত্রে বনী ইসরাঈল তার মহান মর্যাদাশালী পয়গম্বরকে যেভাবে হেয় করে পেশ করেছে তা চোখের সামনে রেখে কুরআন তাঁর কারাগার থেকে বের হওয়া এবং বাদশাহর সাথে সাক্ষাত করার ঘটনাকে যে মর্যাদাপূর্ণ ও গৌরবময় ভংগীতে পেশ করেছে তা একবার পর্যালোচনা করে দেখুন। এখন একজন বিবেকবান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি এ ফায়সালা করতে পারেন যে, এ দু’টি চিত্রের মধ্যে কোন চিত্রটি নবুওয়াতের মর্যাদার সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল। তাছাড়া সাধারণ বিচার বুদ্ধির দৃষ্টিতেও একথাটি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয় যে, বাদশাহর সাথে সাক্ষাত করা পর্যন্ত যদি হযরত ইউসুফ এতই নিকৃষ্ট মর্যাদার অধিকারী থেকে থাকেন যেমন তালমূদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাহলে স্বপ্নের তা’বীর শুনার পর অকস্মাত তাঁকে একেবারে সমগ্র রাজ্যের সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী করে দেয়া হলো কেমন করে? একটি উন্নত ও সুসভ্য দেশে এতবড় মর্যাদা মানুষ তখনই লাভ করে যখন সে লোকদের কাছে নিজের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দেয়। কাজেই বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়েও বাইবেল ও তালমূদের তুলনায় কুরআনের বর্ণনাই বাস্তবতার সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল মনে হয়।
৪৩. অর্থাৎ আমার রব আল্লাহ তো আগে থেকেই জানেন যে, আমি নিরপরাধ। কিন্তু তোমাদের রব অর্থাৎ বাদশাহের ও আমার মুক্তির পূর্বে যে কারণে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে সে ব্যাপারটির পুরোপুরি অনুসন্ধান করে নেয়া উচিত। কারণ আমি কোন সন্দেহ ও অপবাদের কলংক মাথায় নিয়ে মানুষের সামনে যেতে চাই না। আমাকে মুক্তি দিতে চাইলে আগে আমি যে নিরপরাধ ছিলাম একথাটি সর্বসমক্ষে প্রমাণিত হওয়া উচিত। আসল অপরাধী ছিল তোমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ। তারা নিজেরদের স্ত্রীদের অসচ্চরিত্রতার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমার নিরপরাধ সত্তা ও নিষ্কলংক চরিত্রের ওপর।
হযরত ইউসুফ আ. তাঁর এ দাবীকে যে ভাষায় পেশ করেছেন তা থেকে সুস্পষ্টভাবে একথা প্রকাশিত হয় যে, আযীযের স্ত্রীর ভোজের মজলিসে যে ঘটনা ঘটেছিল সে সম্পর্কে মিসরের বাদশাহ পুরাপুরি অবগত ছিলেন। বরং সেটি এমনি একটি বহুল প্রচারিত ঘটনা ছিল যে, সেদিকে কেবলমাত্র একটি ইংগিতই যথেষ্টে ছিল।
তারপর এ দাবীতে হযরত ইউসুফ আ. আযীযের, স্ত্রীকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র যে মহিলাগুলো আংগুল কেটে ফেলেছিল তাদের ব্যাপারটি উত্থাপন করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। এটি তাঁর চরম ভদ্রতা ও উন্নত হৃদয়বৃত্তির আর একটি প্রমাণ। আযীযের স্ত্রী তাঁর সাথে যে পর্যায়ের অসদ্ব্যবহার করে থাকুক না কেন তবুও তার স্বামী উপকার করেছিলেন। তাই তার ইজ্জত-আবরুর ওপর হামলা করে কোন কথা তিনি বলতে চাননি।
﴿قَالَ مَا خَطْبُكُنَّ إِذْ رَاوَدتُّنَّ يُوسُفَ عَن نَّفْسِهِ ۚ قُلْنَ حَاشَ لِلَّهِ مَا عَلِمْنَا عَلَيْهِ مِن سُوءٍ ۚ قَالَتِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَا رَاوَدتُّهُ عَن نَّفْسِهِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ﴾
৫১। একথায় বাদশাহ সেই মহিলাদেরকে জিজ্ঞেস করলো,৪৪ “তোমরা যখন ইউসুফকে অসৎকাজে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলে তোমাদের তখনকার অভিজ্ঞতা কি?” সবাই একবাক্যে বললো, “আল্লাহর কী অপার মহিমা! আমরা তার মধ্যে অসৎ প্রবণতার গন্ধই পাইনি।” আযীযের স্ত্রী বলে উঠলো, “এখন সত্য প্রকাশ হয়ে গেছে। আমিই তাকে ফুসলাবার চেষ্টা করেছিলাম, নিসন্দেহে সে একদম সত্যবাদী।”৪৫
৪৪. সম্ভবত শাহীমহলে এ মহিলাদের কে ডেকে এনে এ জবানবন্দী নেয়া হয়েছিল। আবার এও হতে পারে যে, বাদশাহ নিজের কোন বিশেষ বিশ্বস্ত ব্যাক্তিকে পাঠিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এ স্বীকারোক্তি আদায় করেছিলেন।
৪৫. অনুমান করা যেতে পারে, এ স্বীকারোক্তিগুলো কিভাবে আট নয় বছর আগের ঘটনাবলীকে আবার নতুন করে তরতাজা করে দিয়ে ছিল, কিভাবে হযরত ইউসুফের ব্যক্তিত্ব কারাজীবনের দীর্ঘকালীন বিস্মৃতির পর আবার অকস্মাত বিপুলভাবে উদভাসিত হয়ে উঠেছিল, কিভাবে মিসরের সমস্ত অভিজাত, মর্যাদাশালী ও মধ্যবিত্ত সমাজে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাঁর নৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল ওপরে বাইবেল ও তালমূদের বরাত দিয়ে একথা বলা হয়েছে যে, বাদশাহ সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে সারা দেশের জ্ঞানীগুণী, আলেম ও পীরদের একত্র করেছিলেন এবং তারা সবাই তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হয়েছিল। এরপর হযরত ইউসুফ আ. এর ব্যাখ্যা করেছিলেন। এ ঘটনার ফলে সারা দেশের জনতার দৃষ্টি আগে থেকেই তাঁর প্রতি নিবদ্ধ হয়েছিল। তারপর বাদশাহর তলবনামা পেয়ে যখন তিনি জেলখানা থেকে বাইরে আসতে অস্বীকার করলেন তখন সমগ্র দেশবাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, এ আবার কেমন অদ্ভুত প্রকৃতির উচ্চ মনোবল সম্পন্ন মানুষ, যাকে আট নয় বছরের কারাবাসের পর বাদশাহ নিজেই মেহেরবানী করে ডাকছেন এবং তারপরও তিনি ব্যাকুল চিত্তে দৌঁড়ে আসছেন না! তারপর যখন তারা ইউসুফের নিজের কারামুক্তির এবং বাদশাহর সাথে দেখা করতে আসার জন্য পেশকৃত শর্তাবলী শুনালো তখন সবার দৃষ্টি এ অনুসন্ধান ও তদন্তের ফলাফলের প্রতি কেন্দ্রীভূত হয়ে রইল। এরপর যখন লোকেরা এর ফলাফল শুনলো তখন দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এই বলে বাহবা দিল যে, আহা, এ ব্যক্তি কেমন পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবন ও চরিত্রের অধিকারী! কাল যারা নিজেদের সমবেত প্রচেষ্টায় তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছিল আজ তাঁর চারিত্রিক নিষ্কলুষতার পক্ষে তারাই সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে একথা ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, সে সময় হযরত ইউসুফের উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠার জন্য কেমন অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। এরপর বাদশাহর সাথে সাক্ষাতের সময় হযরত ইউসুফ হঠাৎ কেমন করে তাকে দেশের অর্থ-সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব দান করার দাবী জানিয়েছিলেন এবং বাদশাহ কেন নির্দ্ধিধায় তা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন একথা আর মোটেই বিস্ময়কর ঠেকে না। ব্যাপার যদি শুধু এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো যে কারাগারের একজন বন্দী বাদশাহর একটি স্বপ্নের তা’বীর বলে দিয়েছিলেন তাহলে এ জন্য তিনি বড়জোর কোন পুরুষ্কারের এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের অধিকারী হতে পারতেন। কিন্তু শুধুমাত্র এতটুকুন কথায় তিনি বাদশাহকে বলবেন, “আমাকে দেশের যাবতীয় অর্থ-সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব দান করো” এবং বাদশাহ বলে দেবেন “নাও, সবকিছু তোমার জন্য হাযির”-এটা যথেষ্ট হতে পারতো না।
﴿ذَٰلِكَ لِيَعْلَمَ أَنِّي لَمْ أَخُنْهُ بِالْغَيْبِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي كَيْدَ الْخَائِنِينَ﴾
৫২। (ইউসুফ বললোঃ)৪৬ “এ থেকে আমার উদ্দেশ্যে এই ছিল যে, আযীয জানতে পারুক, আমি তার অবর্তমানে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি এবং আল্লাহ বিশ্বাস ঘাতকতারকারীদের চক্রান্ত সফল করেন না।
৪৬. একথা সম্ভবত হযরত ইউসুফ তখনই বলে থাকবেন যখন কারাগারে তাঁকে তদন্তের ফলাফল জানিয়ে দেয়া হয়ে থাকবে। ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাসীরের মতো বড় বড় মুফাসসির সহ আরো কোন কোন তাফসীরকার এ বাক্যটিতে হযরত ইউসুফের নয় বরং আযীযের স্ত্রীর বক্তব্যের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এ বাক্যটি আযীযের স্ত্রীর উক্তির সাথে সংযুক্ত এবং মাঝখানে এমন কোন শব্দ নেই যা থেকে একথা মনে করা যেতে পারে যে, انه لمن الصادقين এ এসে আযীযের স্ত্রীর কথা শেষ হয়ে গেছে এবং পরবর্তী কথা হযরত ইউসুফ বলেছেন। তাঁরা বলেন, দু’টি লোকের কথা যদি পরস্পরের সাথে সংলগ্ন থাকে এবং এটা অমুকের কথা ও ওটা অমুকের কথা -এ বিষয়টি যদি সুস্পষ্ট না থাকে তাহলে এ অবস্থায় অবশ্যি এমন কোন চিহ্ন থাকা উচিত যা উভয় কথার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। কিন্তু এখানে এ ধরনের কোন পার্থক্য চিহ্ন নেই। কাজেই একথা মেনে নিতে হবে যে الئن حصحص الحق থেকে শুরু করে ان ربي غفور رحيم পর্যন্ত সম্পূর্ণ বক্তব্যটি আযীযের স্ত্রীর। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, এ বিষয়টি কেমন করে ইবনে তাইমিয়ার মতো সূক্ষদর্শী ব্যক্তিরও দৃষ্টির আগোচরে থেকে গেলো যে, কথা বলার ধরণ ভংগী নিজেই একটি বড় পার্থব্য চিহ্ন এবং এর উপস্থিতিতে আর কোন পার্থক্য চিহ্নের প্রয়োজনই হয় না। প্রথম বাক্যটি অবশ্যি আযীযের স্ত্রীর মুখে সাজে কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যটিও কি তার মুখে খাপ খায়? দ্বিতীয় বাক্যের প্রকাশভংগী তো পরিষ্কার জানাচ্ছে যে, আযীযের স্ত্রী নয় হযরত ইউসুফই তার প্রবক্তা। এ বাক্যে যে সৎহৃদয়বৃত্তি, উচ্চ মনোভাব, বিনয় ও আল্লাহভীতি সোচ্চার তা নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তা এমন এক নারীর কন্ঠে উচ্চারিত হতে পারে না যে কন্ঠে ইতিপূর্বে هيت لك (এসে যাও) উচ্চারিত হয়েছিল, যে কন্ঠ থেকে ইতিপূর্বে বের হয়েছিল ما جازاء من اراد باهلك سوء যে ব্যক্তি তোমার স্ত্রীকে কুকর্মে লিপ্ত করতে চায় তার শাস্তি কি?
এর মতো মিথ্যা ভাষণ এবং যে কন্ঠে প্রকাশ্য মাহফিলে لئن لم يفعل ما أمره ليسجنن (যদি সে আমার কথা মতো কাজ না করে তাহলে তাকে কারাগারে পাঠানো হবে) –এর মতো হুমকি উচ্চারিত হয়েছিল। এমন ধরনের পবিত্র বাক্য কেবলমাত্র এমনি এক কন্ঠে উচ্চারিত হতে পারতো যে কন্ঠে ইতিপূর্বে معاذ الله أنه ربي احسن مثواى (আল্লাহর পানাহ চাই, তিনি আমার রব, তিনি আমাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন) এ ধরনের সকৃতজ্ঞ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, যে কন্ঠে ইতিপূর্বে قَالَ رَبِّ ٱلسِّجْنُ أَحَبُّ إِلَىَّ مِمَّا يَدْعُونَنِىٓ إِلَيْهِ (হে আমার রব! এরা আমাকে যে পথে চলার জন্য ডাকছে তার চেয়ে কারাগার আমার কাছে ভালো।) -এর মতো সৎপথে অটল থাকার দৃঢ় মনোবৃত্তির ঘোষণা দিয়েছিল এবং যে কণ্ঠ ইতিপূর্বে إِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ (হে আল্লাহ! যদি তুমি আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ধার না করো তাহলে আমি তাদের জালে আটকে যাবো) এর মতো সমর্পিত প্রাণ বান্দার আকুতি ধ্বনিত হয়েছিল। এ ধরনের পবিত্র বাণীকে সত্যনিষ্ঠ-সত্যবাদী ইউসুফের পরিবর্তে আযীযের স্ত্রীর উক্তি বলে মেনে নেয়া ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত এমন কোন আলামত বা চিহ্ন না পাওয়া যায় যা থেকে প্রমাণ হয় এ পর্যায়ে পৌঁছে আযীযের স্ত্রী তাওবা করে ঈমান এনেছিল এবং নিজের প্রবৃত্তি ও আচরণ সংশোধন করার সৌভাগ্য লাভ করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন কোন আলামত ও নিদর্শন পাওয়া যায় না।
﴿وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي ۚ إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي ۚ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৫৩। আমি নিজের নফ্সকে দোষমুক্ত করছি না। নফ্স তো খারাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে, তবে যদি কারোর প্রতি আমার রবের অনুগ্রহ হয় সে ছাড়া। অবশ্যি আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।”
﴿وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِي ۖ فَلَمَّا كَلَّمَهُ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ﴾
৫৪। বাদশাহ বললো, “তাকে আমার কাছে আনো, আমি তাকে একান্তভাবে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেব। “ইউসুফ যখন তার সাথে আলাপ করলো, সে বললো, “এখন আপনি আমাদের এখানে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী এবং আপনার আমানতদারীর ওপর পূর্ণ ভরসা আছে।”৪৭
৪৭. এটা যেন বাদশাহর পক্ষ থেকে এ মর্মে একটি সুস্পষ্ট ইংগিত ছিল যে, আপনার হাতে যে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজ সোপর্দ করা যেতে পারে।
﴿قَالَ اجْعَلْنِي عَلَىٰ خَزَائِنِ الْأَرْضِ ۖ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ﴾
৫৫। ইউসুফ বললো, “দেশের অর্থ-সম্পদ আমার হাতে সোপর্দ করুন। আমি সংরক্ষণকারী এবং জ্ঞানও রাখি।”৪৭(ক)
৪৭(ক). এর আগে যেসব আলোচনা হয়েছে তার আলোকে পর্যালোচনা করলে একথা পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, কোন পদলোভী ব্যক্তি বাদশাহর ইশারা পাওয়ার সাথে সাথেই যেমন কোন পদলাভের জন্য আবেদন করে বসে এটি তেমনি ধরনের কোন চাকরির আবেদন ছিল না। আসলে এটি ছিল একটি বিপ্লবের দরজা খোলার জন্য সর্বশেষ আঘাত। হযরত ইউসুফের নৈতিক শক্তির বলে বিগত দশ-বারো বছরের মধ্যে এ বিপ্লব ক্রমবিকাশ লাভ করে আত্মপ্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল এবং এখন এর দরজা খোলার জন্য শুধুমাত্র একটি হালকা আঘাতের প্রয়োজন ছিল। হযরত ইউসুফ আ. একটি সুদীর্ঘ ধারাবাহিক পরীক্ষার অংগন অতিক্রম করে আসছিলেন। কোন অজ্ঞাত স্থানে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং বাদশাহ থেকে শুরু করে মিসরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই এ সম্পর্কে অবগত ছিল। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি একথা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, আমানতদারী, সততা, ধৈর্য, সংযম, উদারতা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার ক্ষেত্রে অন্তুত সমকালীন লোকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর ব্যক্তিত্বের এ গুণগুলো এমনভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিল যে, এগুলো অস্বীকার করার সাধ্য কারোর ছিল না। দেশবাসী মুখে এগুলোর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল। তাদের হৃদয় এগুলোর দ্বারা বিজিত হয়ে ছিল। বাদশাহ নিজেই এগুলোর সামনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এখন তাঁর “সংরক্ষণকারী” ও “জ্ঞানী হওয়া শুধুমাত্র একটি দাবীর পর্যায়ভুক্ত ছিল না বরং এটি ছিল একটি প্রমাণিত ঘটনা। সবাই এটা বিশ্বাস করতো। এখন শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কর্তৃত্ব পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হযরত ইউসুফের সম্মতিটুকুই বাকি ছিল। বাদশাহ, তাঁর মন্ত্রী পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ একথা ভালোভাবেই জেনেছিলেন যে, তিনি ছাড়া এ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করার মতো আর দ্বিতীয় কোন যোগ্য ব্যক্তিত্বই নেই। কাজেই নিজের এ উক্তির সাহায্যে তিনি এ সম্মতিটুকুরই প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন মাত্র। তাঁর কন্ঠে এ দাবীটুকু উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই বাদশাহ ও তাঁর রাজ পরিষদ যেভাবে দু’হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করে নিয়েছেন তা একথাই প্রমাণ করে যে, ফল পুরোপুরি পেকে গিয়েছিল এবং তা ছিঁড়ে পড়ার জন্য শুধুমাত্র একটা ইশারার অপেক্ষায় ছিল। (তালমূদের বর্ণনা মতে হযরত ইউসুফকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দান করার ফায়সালাটি কেবল বাদশাহ একাই করেননি। বরং সমগ্র রাজপরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছিল।
হযরত ইউসুফ আ. এই যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব চান এবং যা তাকে দেয়া হয়, এটা কোন ধরনের ছিল? অজ্ঞ লোকেরা এখানে خزائن أرض (দেশের ধন-সম্পদ) শব্দ এবং পরবর্তী পর্যায়ে অগ্রসর হয়ে খাদ্য বন্টনের ঘটনাবলীর উল্লেখ দেখে মনে করেন সম্ভবত তিনি ধনভান্ডারের কর্তা, অর্থ বিভাগীয় কর্মকর্তা, দুর্ভিক্ষ কমিশনার, অর্থমন্ত্রী অথবা খাদ্য মন্ত্রী ধরনের একটা কিছু ছিলেন। কিন্তু কুরআন, বাইবেল ও তালমূদের সম্মিলিত সাক্ষ্য হচ্ছে এই যে, আসলে ইউসুফকে মিসর রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে (রোমীয় পরিভাষায় ডিকটেটর) অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁকে দান করা হয়েছিল। কুরআন বলছে, হযরত ইয়াকূব আ. যখন মিসরে পৌঁছলেন তখন ইউসুফ আ. সিংহাসনে বসেছিলেন ورفع ابويه على العرش এবং তিনি নিজের পিতামাতাকে তাঁর পাশে সিংহাসনে বসালেন) হযরত ইউসুফের মুখ নিঃসৃত এ বাণী কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছেঃ “হে আমার রব! তুমি আমাকে বাদশাহী দান করেছো।”رب قد اتيتني من الملك আবার আল্লাহ মিসরে তাঁর কর্তৃত্বের অবস্থা এভাবে বর্ণনা করছেন যেন সমগ্র মিসর তাঁর অধীনে ছিল يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَآءُ অন্যদিকে বাইবেল সাক্ষ্য দিচ্ছেঃ
“তুমিই আমার বাটির অধ্যক্ষ হও, আমার সমস্ত প্রজা তোমার বাক্য শিরোধার্য করিবে, কেবল সিংহাসনে আমি তোমা হইতে বড় থাকিব”…….দেখো, আমি তোমাকে সমস্ত মিসর দেশের উপরে নিযুক্ত করিলাম। ………তোমার আজ্ঞা ব্যতিরেকে সমস্ত মিসর দেশে কোন লোক হাত কি পা তুলিতে পারিবে না। আর ফেরউন যোসেফের নাম সাফনৎ পানেহ (দুনিয়ার মুক্তিদাতা) রাখিলেন” (আদি পুস্তকঃ ৪১:৪০-৪৫)
আবার তালমূদ বলছে, ইউসুফের ভাইয়েরা মিসর থেকে ফিরে গিয়ে মিসরের শাসন-কর্তার ( ইউসুফ) প্রশংসা করে বলেঃ
“দেশের অধিবাসীদের ওপর তিনি সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালী। তাঁর হুকুমে তারা বের হয় এবং তাঁর হুকুমে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠ সারা দেশ শাসন করে। কোন ব্যাপারেই তাঁর ফেরাউনের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।”
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত ইউসুফ কি উদ্দেশ্যে এ কর্তৃত্ব চেয়ে ছিলেন? তিনি কি একটি কাফের সরকারের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত কুফরী নীতি ও আইনের ভিত্তিতেই পরিচালনা করার জন্য কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা চেয়েছিলেন? অথবা তাঁর সামনে এ লক্ষ্য ছিল যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব লাভ করার পর দেশের তামাদ্দুনিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামী নীতির ভিত্তিতে ঢেলে সাজাবেন? এর সবচেয়ে চমৎকার জবাব আল্লামা যামাখ্শারী তাঁর তাফসীর “কাশশাফ” গ্রন্থে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেনঃ
“হযরত ইউসুফ اجْعَلْنِي عَلَىٰ خَزَائِنِ الْأَرْضِ বলেছেন। একথা বলার পেছনে তাঁর কেবল এতটুকুই উদ্দেশ্য ছিল যে, তাঁকে আল্লাহর বিধান জারি ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং ন্যায় ও ইনসাফের সুফল চতুরদিকে ছড়িয়ে দেবার সুযোগ দেয়া হোক। আর যেসব কাজের জন্য নবীদেরকে পাঠানো হয়ে থাকে সেগুলো সম্পন্ন করার জন্য তিনি শক্তি অর্জন করবেন। তিনি রাজত্বের লোভে বা কোন বৈষয়িক লালসার বসবর্তী হয়ে এ দাবী করেননি। বরং তিনি ছাড়া আর কেউ এ কাজ করতে পারবে না একথা জেনেই এ দাবী করেছিলেন।”
আর সত্যি বলতে কি, এ প্রশ্নটি আসলে অন্য একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। সেটি অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্ন। সেটি হচ্ছে হযরত ইউসুফ আ. নবীই ছিলেন কি না? যদি নবী থেকে থাকেন তাহলে কুরআন থেকে কি আমরা পয়গম্বরীর এ ধারণা লাভ করি যে, ইসলামের আহবায়ক নিজেই কুফরী ব্যবস্থাকে কাফেরী পদ্ধতিতে পরিচালনা করার জন্য নিজের শক্তি ও যোগ্যতা পেশ করছেন? বরং এ প্রশ্ন শুধু এখানেই শেষ হয়ে যায় না, এর চেয়েও আরো অনেক বেশী কঠিন ও নাজুক অন্য একটি প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। অর্থাৎ হযরত ইউসুফ একজন সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন কি না? যদি সত্যবদী ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি হয়ে থাকেন যে, কারাগারে অবস্থানকালে এ প্রশ্নের মাধ্যমে তাঁর নবুওয়াতের দাওয়াতের সূচনা করেনঃ “অনেক প্রভু ভালো অথবা একজন আল্লাহ তিনি সবার ওপর বিজয়ী” এবং বারংবার মিসরবাসীদের কাছে একথা সুস্পষ্ট করে দেন যে, মিসরের বাদশাহও তোমাদের এসব বিভিন্ন মনগড়া প্রভুদের একজন আর এ সংগে পরিষ্কারভাবে নিজের মিশনের এ মৌলিক বিশ্বাসটিও বর্ণনা করে দেন যে, শাসন আসে তখন এ ব্যক্তিই আবার হয়ে যান মিসরের বাদশাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বাধীনে পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার খাদেম বরং ব্যবস্থাপক, সংরক্ষক ও পৃষ্ঠপোশক, যার মৌলিক আদর্শই ছিল, শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহর জন্য নয়, বাদশাহর জন্য নির্ধারিত?
আসলে এ অংশের ব্যাখ্যায় পতন যুগের মুসলমানরা অনেকটা তেমনি ধরনের মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন যা এক সময় ইহুদিদের বৈশিষ্ট ছিল। ইহুদীদের অবস্থা ছিল এই যে, অতীত ইতিহাসের যেসব মনীষীর জীবন ও চরিত্র তাদেরকে উন্নতির শিখরে আরোহণে ইদ্বুদ্ধ করতো, নিজেদের নৈতিক ও মানসিক পতনের যুগে তারা তাদের সবাইকে নিচে নামিয়ে নিজেদের জন্য আরো বেশি নিচে নেমে যাবার বাহানা সৃষ্টি করে নিয়েছিল। দুঃখের বিষয় যে, মুসলমানরাও একই ধরনের আচরণ করেছে। তাদের কাফের সরকারের চাকরি করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এভাবে নিচে নামতে গিয়ে ইসলাম ও তার পতাকাবাহীদের নৈতিক শ্রেষ্টত্ব দেখে তারা লজ্জা পেলো। তাই এ লজ্জা দূর করার এবং নিজেদের বিবেককে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা নিজেদের সাথে এমন মহান মর্যাদাশীল পয়গম্বরকেও কুফরের সেবা করার পংকে নামিয়ে আনলো, যাঁর জীবন তাদেরকে এ শিক্ষা দিচ্ছিল যে, কোন দেশে যদি শুধুমাত্র একজন মর্দে মুমিনও নির্ভেজাল ইসলামী চরিত্র এবং ঈমানী বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার অধিকারী থেকে থাকে, তাহলে সে একাকীই কেবলমাত্র নিজের চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তার জোরে সে দেশে ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। আর মর্দে মুমিনের চারিত্রিক শক্তি (শর্ত হচ্ছে, সে যেন তা ব্যবহার করতে জানে এবং ব্যবহার করার ইচ্ছাও রাখে সেনাবাহিনী ও অস্ত্র শস্ত্র ছাড়াই দেশ জয় করতে পারে এবং রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর বিজয় লাভ করে।
﴿وَكَذَٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَاءُ ۚ نُصِيبُ بِرَحْمَتِنَا مَن نَّشَاءُ ۖ وَلَا نُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ﴾
৫৬। এভাবে আমি পৃথিবীতে ইউসুফের জন্য কতৃত্বের পথ পরিষ্কার করেছি। সেখানে সে যেখানে ইচ্ছা অবস্থান করতে পারতো।৪৮ আমি যাকে ইচ্ছা নিজের রহমতে অভিষিক্ত করি। সৎকর্মশীল লোকদের প্রতিদান আমি নষ্ট করি না।
৪৮. অর্থাৎ এখন সমগ্র মিসর দেশ ছিল তার অধিকারবুক্ত। এ দেশের যে কোন জায়গায় তিনি নিজের আবাস গড়ে তুলতে পারতেন। এ দেশের কোন জায়গায় বসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁকে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো ছিল না। এ দেশের ওপর হযরত ইউসুফের যে পূর্ণাংগ কর্তৃত্ব অধিকার ছিল এ যেন ছিল তার বর্ণনা। প্রথম যুগের মুফাসসিরগণ এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন। ইবনে যায়েদের বরাত দিয়ে আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী তাঁর নিজের তাফসীর গ্রন্থে এর এই অর্থ বর্ণনা করেছেন যে, আমি ইউসুফকে মিসরে যা কিছু ছিল সব জিনিসের মালিক বানিয়ে দিলাম। দুনিয়ার সেই এলাকার যেখানেই সে যা কিছু চাইতো করতে পারতো। সেই দেশটির সমগ্র এলাকা তার হাতে সোপর্দ করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি সে যদি ফেরাউনকে নিজের অধীনস্থ করে তার ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইতো তাহলে তাও করতে পারতো।” আল্লামা তাবারী দ্বিতীয় একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, সেটি মুজাহিদের উক্তি। মুজাহিদ হচ্ছেন তাফসীর শাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম। তাঁর মতে মিসরের বাদশাহ হযরত ইউসুফের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
﴿وَلَأَجْرُ الْآخِرَةِ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ﴾
৫৭। আর যারা ঈমান এনেছে এবং তাওয়া সহকারে কাজ করতে থেকেছে আখেরাতের প্রতিদান তাদের জন্য আরো ভালো।”৪৯
৪৯. এখানে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যেন পার্থিব রাষ্ট্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করাকে সততা ও সংকর্মশীলতার প্রকৃত পুরষ্কার ও যথার্থ কাংখিত প্রতিদান মনে না করে বসে। বরং তাকে জেনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ আখেরাতে যে পুরষ্কার দেবেন সেটিই সর্বোত্তম প্রতিদান এবং সেই প্রতিদানটিই মুমিনের কাংখিত হওয়া উচিত।
﴿وَجَاءَ إِخْوَةُ يُوسُفَ فَدَخَلُوا عَلَيْهِ فَعَرَفَهُمْ وَهُمْ لَهُ مُنكِرُونَ﴾
৫৮। ইউসুফের ভাইরো মিসরে এলো এবং তার কাছে হাযির হলো।৫০ সে তাদেরকে চিনে ফেললো। কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারলো না।৫১
৫০. এখানে আবার সাত আট বছরের ঘটনা মাঝখানে বাদ দিয়ে বর্ণনার ধারাবাহিকতা এমন এক জায়গা থেকে শুরু করে দেয়া হয়েছে যেখান থেকে বনী ইসরাঈলের মিসরে স্থানান্তরিত হবার এবং হযরত ইয়াকূবের আ. হারানো ছেলের সন্ধান পাওয়ার সূত্রপাত হয়। মাঝখানে যেসব ঘটনা বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, হযযত ইউসুফের আ. যেসব ঘটনা বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলোর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, হযরত ইউসুফের আ. রাজত্বের প্রথম সাত বছর মিসরে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয়। এ সময় তিনি আসন্ন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করার জন্য পূর্বাহ্নে এমন সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন যার পরামর্শ তিনি স্বপ্নের তা’বীর বলার সময় বাদশাহকে দিয়েছিলেন। এরপর শুরু হয় দুর্ভিক্ষের যামানা। এ দুর্ভিক্ষ শুধু মিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আশেপাশের দেশগুলোতেও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সিরিয়া, ফিলিস্তিন, পূর্ব জর্দান, দক্ষিণ আরব সব জায়গায় চলে দুর্ভিক্ষের অবাধ বিচরণ। এ অবস্থায় হযরত ইউসুফের বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনার কারণে একমাত্র মিসরে দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য থাকে। কাজেই প্রতিবেশী দেশগুলোর লোকেরা খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য মিসরে আসতে বাধ্য হয়। এ সময় ফিলিস্তিন থেকে হযরত ইউসুফের আ. ভাইয়েরা খাদ্যশস্য কেনার জন্য মিসরে পৌঁছে। সম্ভবত হযরত ইউসুফ আ. খাদ্য ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলেন যার ফলে বাইরের দেশগুলোয় বিশেষ অনুমতিপত্র ছাড়া এবং বিশেষ পরিমাণের বেশী খাদ্য সরবরাহ করা যেতে পারতো না। এ কারণে ইউসুফের ভাইয়েরা যখন বহির্দেশ থেকে এসে খাদ্য সংগ্রহ করতে চেয়েছিল তখন সম্ভবত তাদের বিশেষ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয়েছিল এবং এভাবেই তাদের হযরত ইউসুফের সামনে হাযির হতে হয়েছিল।
৫১. ইউসুফের ভাইয়েরা যে ইউসুফকে চিনতে পারেনি এটা কোন অযৌক্তিক বা অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। যে সময় তারা তাঁকে কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল তখন তিনি ছিলেন সতের বছর বয়সের একটি কিশোর মাত্র। আর এখন তাঁর বয়স আটতিরিশ বছরের কাছাকাছি। এর দীর্ঘ সময়ে মানুষের চেহারার কাঠামোয় অনেক পরিবর্তন আসে। তাছাড়া যে ভাইকে তারা কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল সে আজ মিসরের অধিপতি হবে, একথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।
﴿وَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمْ قَالَ ائْتُونِي بِأَخٍ لَّكُم مِّنْ أَبِيكُمْ ۚ أَلَا تَرَوْنَ أَنِّي أُوفِي الْكَيْلَ وَأَنَا خَيْرُ الْمُنزِلِينَ﴾
৫৯। তারপর সে যখন তাদের জিনিসপত্র তৈরী করালো তখন চলার সময় তাদেরকে বললো, “তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ে আমাদের কাছে আনবে, দেখছো না আমি কেমন পরিমাপ পাত্র ভরে দেই এবং আমি কেমন ভালো অতিথিপরায়ণ?
﴿فَإِن لَّمْ تَأْتُونِي بِهِ فَلَا كَيْلَ لَكُمْ عِندِي وَلَا تَقْرَبُونِ﴾
৬০। যদি তোমরা তাকে না আনো তাহলে আমার কাছে তোমাদের জন্য কোন শস্য নেই বরং তোমরা আমার ধারেকাছেও এসো না।”৫২
৫২. বর্ণনা সংক্ষেপের কারণে হয়তো কারো পক্ষে একথা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ছে যে, হযরত ইউসুফ যখন নিজের ব্যক্তিত্বকে তাদের সামনে প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন না তখন আবার তাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কথা এলো কেমন করে? এবং তাকে আনার ব্যাপারে তাঁর এত বেশী পীড়াপীড়ি করারই বা অর্থ কি? কেননা, এভাবে তো রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলে একথা পরিষ্কার বুঝা যায়। সেখানে খাদ্যশস্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ছিল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য গ্রহণ করতে পারতো। শস্য নেবার জন্য তারা দশ ভাই এসেছিল। কিন্তু তারা তাদের পিতার ও একাদশতম ভাইয়ের অংশও হয়তো চেয়েছিল। একথায় হযরত ইউসুফ আ. বলে থাকবেন, বুঝলাম তোমাদের পিতার না আসার জন্য যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং তার ওপর চোখে দেখতে পান না, ফলে তাঁর পক্ষে সশরীরে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ভাইয়ের না আসার কি ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে পারে? এমন তো নয় যে, একজন বানোয়াট ভাইয়ের নাম করে অতিরিক্ত শস্য সংগ্রহ করে তোমরা অবৈধ্য ব্যবসায়ে নামার চেষ্টা করছো? জওয়াবে তারা হয়তো নিজেদের গৃহের অবস্থা বর্ণনা করেছে। তারা বলে থাকবে, সে আমাদের বৈমাত্রেয় ভাই। কিছু অসুবিধার কারণে পিতা তাকে আমাদের সাথে পাঠাতে ইতস্তত করেন। তাদের এসব কথায় হযরত ইউসুফ সম্ভবত বলেছেন, যাক এবারের জন্য তো আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে পূর্ণ শস্য দিয়ে দিলাম কিন্তু আগামীতে তোমরা যদি তাকে সংগে করে না আনো তাহলে তোমাদের ওপর থেকে আস্থা উঠে যাবে এবং এখান থেকে তোমরা আর কোন শস্য পাবে না। এ শাসক সুলভ হুমকি দেবার সাথে সাথে তিনি নিজের দাক্ষিণ ও মেহমানদারীর মাধ্যমে তাদেরকে বশীভূত করার চেষ্টা করেন। কারণ নিজের ছোট ভাইকে দেখার এবং ঘরের অবস্থা জানার জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে পড়েছিল। এটি ছিল ঘটনার একটি সাদামাটা চেহারা। সামান্য একটু চিন্তা-ভাবনা করলে ব্যাপারটি আপনাআপনিই বুঝতে পারা যায়। এ অবস্থায় বাইবেলের আদি পুস্তকের ৪২-৪৩ অধ্যায়ে নানা প্রকার রং চড়িয়ে যে অতিরঞ্জিত কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তার ওপর আস্থা স্থাপন করার কোন প্রয়োজন নেই।
﴿قَالُوا سَنُرَاوِدُ عَنْهُ أَبَاهُ وَإِنَّا لَفَاعِلُونَ﴾
৬১। তারা বললো, “আমরা চেষ্টা করবো যাতে আব্বাজান তাকে পাঠাতে রাযী হয়ে যান এবং আমরা নিশ্চয়ই এমনটি করবো।”
﴿وَقَالَ لِفِتْيَانِهِ اجْعَلُوا بِضَاعَتَهُمْ فِي رِحَالِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَعْرِفُونَهَا إِذَا انقَلَبُوا إِلَىٰ أَهْلِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ﴾
৬২। ইউসুফ নিজের গোলামদেরকে ইশারা করে বললো, “ওরা শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে তা চুপিসারে ওদের জিনিসপত্রের মধ্যেই রেখে দাও।” ইউসুফ এটা করলো এ আশায় যে, বাড়িতে পৌঁছে তারা নিজেদের ফেরত পাওয়া অর্থ চিনতে পারবে (অথবা এ দানশীলতার ফলে তারা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে) এবং বিচিত্র নয় যে, তারা আবার ফিরে আসবে।
﴿فَلَمَّا رَجَعُوا إِلَىٰ أَبِيهِمْ قَالُوا يَا أَبَانَا مُنِعَ مِنَّا الْكَيْلُ فَأَرْسِلْ مَعَنَا أَخَانَا نَكْتَلْ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
৬৩। যখন তারা তাদের বাপের কাছে ফিরে গেলো তখন বললো, “আব্বাজান! আগামীতে আমাদের শস্য দিতে অস্বীকার করা হয়েছে, কাজেই আমাদের ভাইকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা শস্য নিয়ে আসতে পারি এবং অবশ্যি আমরা হেফাজতের জন্য দায়ী থাকবো।”
﴿قَالَ هَلْ آمَنُكُمْ عَلَيْهِ إِلَّا كَمَا أَمِنتُكُمْ عَلَىٰ أَخِيهِ مِن قَبْلُ ۖ فَاللَّهُ خَيْرٌ حَافِظًا ۖ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ﴾
৬৪। বাপ জবাব দিল, “আমি কি ওর ব্যাপারে তোমাদের ওপর ঠিক তেমনি ভরসা করবো যে, ইতিপূর্বে তার ভাইয়ের ব্যাপারে করেছিলাম? অবশ্য আল্লাহ সবচেয়ে ভালো হেফাজতকারী এবং তিনি সবচেয়ে বেশী করুণাশীল।”
﴿وَلَمَّا فَتَحُوا مَتَاعَهُمْ وَجَدُوا بِضَاعَتَهُمْ رُدَّتْ إِلَيْهِمْ ۖ قَالُوا يَا أَبَانَا مَا نَبْغِي ۖ هَٰذِهِ بِضَاعَتُنَا رُدَّتْ إِلَيْنَا ۖ وَنَمِيرُ أَهْلَنَا وَنَحْفَظُ أَخَانَا وَنَزْدَادُ كَيْلَ بَعِيرٍ ۖ ذَٰلِكَ كَيْلٌ يَسِيرٌ﴾
৬৫। তারপর যখন তারা নিজেদের জিনিসপত্র খুললো, তারা দেখলো তাদের অর্থও তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে তারা চিৎকার করে উঠলো, “আব্বাজান, আমাদের আর কী চাই ! দেখুন এই আমাদের অর্থও আমাদের ফেরত দেয়া হয়েছে। ব্যস্ এবার আমরা যাবো আর নিজেদের পরিজনদের জন্য রসদ নিয়ে আসবো, নিজেদের ভাইয়ের হেফাজতও করবো এবং অতিরিক্ত একটি উট বোঝাই করে শস্যও আনবো, এ পরিমাণ শস্য বৃদ্ধি অতি সহজেই হয়ে যাবে।”
﴿قَالَ لَنْ أُرْسِلَهُ مَعَكُمْ حَتَّىٰ تُؤْتُونِ مَوْثِقًا مِّنَ اللَّهِ لَتَأْتُنَّنِي بِهِ إِلَّا أَن يُحَاطَ بِكُمْ ۖ فَلَمَّا آتَوْهُ مَوْثِقَهُمْ قَالَ اللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِيلٌ﴾
৬৬। তাদের বাপ বললো, “আমি কখনোই তাকে তোমাদের সাথে পাঠাবো না যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে আমার কাছে অংগীকার করবে। এ মর্মে যে তাকে নিশ্চয়ই আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে তবে হাঁ যদি কোথাও তোমরা ঘেরাও হয়ে যাও তাহলে ভিন্ন কথা।” যখন তারা তার কাছে অংগীকার করলো তখন সে বললো, “দেখো আল্লাহ আমাদের একথার রক্ষক।”
﴿وَقَالَ يَا بَنِيَّ لَا تَدْخُلُوا مِن بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوا مِنْ أَبْوَابٍ مُّتَفَرِّقَةٍ ۖ وَمَا أُغْنِي عَنكُم مِّنَ اللَّهِ مِن شَيْءٍ ۖ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ﴾
৬৭। তারপর সে বললো, “হে আমার সন্তানরা! মিসরের রাজধানীতে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো।৫৩ কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারি না। তাঁর ছাড়া আর কারোর হুকুম চলে না, তাঁর ওপরই আমি ভরসা করি এবং যার ভরসা করতে হয় তাঁর ওপরই করতে হবে।”
৫৩. এ থেকে অনুমান করা যায়, ইউসুফের পরে তার ভাইকে পাঠাবার সময় হযরত ইয়াকূবের মন কত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। যদিও আল্লাহর প্রতি আস্থা ছিল এবং সবর ও আত্মসমর্পণের দিক দিয়েও তাঁর স্থান ছিল অনেক উঁচুতে তবুও তো তিনি মানুষই ছিলেন। নানা সন্দেহ ও আশংকা তাঁর মনে জেগে ওঠে বিচিত্র নয় এবং স্বতই এ চিন্তায় তিনি পেরেশান হয়ে গিয়ে থাকবেন যে, আল্লাহই ভালো জানেন এখন এ ছেলের চেহারাও আর দেখতে পাবো কি না! তাই তিনি হয়তো নিজের সাধ্যমত সতর্কতা অবলম্বন করার ক্ষেত্রে কোনপ্রকার ক্রটি না রাখতে চেয়েছিলেন।
সে সময় যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজিত ছিল তার কথা চিন্তা করলেই এক দরজা দিয়ে সকল ভাইয়ের মিসরের রাজধানীতে প্রবেশ না করার এ সতর্কতামূলক পরামর্শটির তাৎপর্য পরিষ্কার বুঝা যেতে পারে। তারা ছিল মিসর সীমান্তের স্বাধীন উপজাতীয় এলাকার বাসিন্দা। বিচিত্র নয় যে, মিসরবাসীরা এ এলাকার লোকদেরকে ঠিক তেমনি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো যেমন বৃটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকরা সীমান্ত এলাকার স্বাধীন অধিবাসীদেরকে দেখে এসেছে। হযরত ইয়াকূবের মনে আশংকা জেগে থাকবে, এ দুর্ভিক্ষে দিনে যদি তারা দলবদ্ধ হয়ে সেখানে প্রবেশ করে তাহলে হয়তো তাদেরকে সন্দেহভাজন মনে করা হবে এবং ধারণা করা হবে, তারা এখানে লুটপাট করতে এসেছে। আগের আয়াতে হযরত ইয়াকূবের “তবে যদি তোমাদের ঘেরাও করা হয়” এ উক্তিটি নিজেই এ বিষয়বস্তুর দিকে ইংগিত করছে যে, রাজনৈতিক কারণে এ পরামর্শটি দেয়া হয়েছিল।
﴿وَلَمَّا دَخَلُوا مِنْ حَيْثُ أَمَرَهُمْ أَبُوهُم مَّا كَانَ يُغْنِي عَنْهُم مِّنَ اللَّهِ مِن شَيْءٍ إِلَّا حَاجَةً فِي نَفْسِ يَعْقُوبَ قَضَاهَا ۚ وَإِنَّهُ لَذُو عِلْمٍ لِّمَا عَلَّمْنَاهُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৬৮। আর ঘটনাক্ষেত্রে তা-ই হলো, যখন তারা নিজেদের বাপের নির্দেশ মতো শহরে (বিভিন্ন দরজা দিয়ে) প্রবেশ করল তখন তার এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবিলায় কোন কাজে লাগলো না। তবে হাঁ, ইয়াকূবের মনে যে একটি খটকা ছিল তা দূর করার জন্য সে নিজের মনমতো চেষ্টা করে নিল। অবশ্যি সে আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান ছিল কিন্তু অধিকাংশ লোক প্রকৃত সত্য জানে না।৫৪
৫৪. এর অর্থ হচ্ছে, কৌশল ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য স্থাপন, যা তোমরা ইয়াকূব আ. এরউপরোল্লিখিত উক্তির মধ্যে পাও। আসলে আল্লাহর অনুগ্রহে তার সত্য জ্ঞানের যে ধারা বর্ষিত হয়েছিল এ ছিল তারই ফলশ্রুতি। একদিকে উপায় উপকরণের স্বাভাবিক বাধ্যবাধকতার বিধান অনুযায়ী তিনি এমন সব ব্যবস্থা অবলম্বন করেন, যা বুদ্ধি, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অবলম্বন করা সম্ভব ছিল। ছেলেদেরকে তাদের প্রথম অপরাধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভয় দেখান ও সাবধান করে দেন, যাতে তারা পুনর্বার ঐ ধরনের অপরাধ করার সাহস না করে। তাদের কাছ থেকে বৈমাত্রয় ভাইয়ের হেফাজত করার জন্য আল্লাহর নামে শপথ নেন এবং তদানীন্তন রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে যে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করার প্রয়োজন অনুভূত হয় তা অবলম্বন করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেন, যাতে নিজেদের সাধ্যমত ব্যবস্থাপনার মধ্যে এমন কোন ত্রুটি থাকতে না দেয়া হয় যার ফলে তারা ঘেরাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে প্রতি মুহূর্তে একথা তার সামনে আছে এবং তিনি বারবার একথা প্রকাশও করেন যে, আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর ভরসা করা উচিত। যে ব্যক্তি প্রকৃত সত্যের জ্ঞান রাখে, যে ব্যক্তি একথাও জানে যে, দুনিয়ার জীবনের বাইরের দিকে আল্লাহর তৈরী প্রাকৃতিক ব্যবস্থা কোন ধরনের প্রচেষ্টা ও কাজ দাবী করে এবং একথাও জানে যে, এ বাহ্যিক দিকের পেছনে যে প্রকৃত সত্য লুকিয়ে আছে তার ভিত্তিতে আসল কার্যকর শক্তি কি এবং তার উপস্থিতিতে নিজের প্রচেষ্টা ও কাজের ওপরে মানুষের ভরসা কত বেশী ভিত্তিহীন-একমাত্র সে-ই নিজের কথা ও কাজের মধ্যে এ সঠিক ভারসাম্য কায়েম করতে পারে। একথাটিই অধিকাংশ লোক জানে না। তাদের মধ্য থেকে যাদের বাহ্যিক দিকের প্রভাব বেশী পড়ে তারা আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা থেকে গাফেল হয়ে কৌশল ও ব্যবস্থা অবলম্বনকে সবকিছু মনে করে বসে এবং অন্তরনিহিত সত্য যার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে সে জাগতিক কৌশল ও ব্যবস্থা অবলম্বন না করে শুধু মাত্র আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার ভিত্তিতে জীবনের গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
﴿وَلَمَّا دَخَلُوا عَلَىٰ يُوسُفَ آوَىٰ إِلَيْهِ أَخَاهُ ۖ قَالَ إِنِّي أَنَا أَخُوكَ فَلَا تَبْتَئِسْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
৬৯। তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছলে সে সহোদর ভাইকে নিজের কাছে আলাদা করে ডেকে নিল এবং তাকে বললো, “আমি তোমার সেই (হারানো) ভাই, এখন আর সেসব আচরণের জন্য দুঃখ করো না যা এরা করে এসেছে”৫৫
৫৫. একুশ বাইশ বছরের ব্যবধান দু’ভাইয়ের পূনরমিলনের পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকবে এ বাক্যে তার সম্পূর্ণ চেহারাটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হযরত ইউসূফ আ.নিজের অবস্থা বর্ণনা করে কোন কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি আজকের এ মর্যাদায় পৌঁছেছেন তা বলে থাকবেন। বিন ইয়ামীন বর্ণনা করে থাকবেন তাঁর অন্তরধানের পর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা তার সাথে কেমনতর দুর্ব্যবহার করেছে। হযরত ইউসুফ আ. ভাইকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে থাকবেন, এখন থেকে তুমি আমার কাছেই থাকবে, এ জালেমদের খপ্পরে তোমাকে আর দ্বিতীয়বার পড়তে দেবো না। সম্ভবত এ সময়ই বিন ইয়ামীনকে মিসরে আটকে রাখার জন্য কি ব্যাবস্থা অবলম্বন করা হবে এবং প্রয়োজনের খাতিরে এখন তা গোপন রাখতে হবে এ ব্যাপারে আলোচনার পর দু’ভাই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান।
﴿فَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمْ جَعَلَ السِّقَايَةَ فِي رَحْلِ أَخِيهِ ثُمَّ أَذَّنَ مُؤَذِّنٌ أَيَّتُهَا الْعِيرُ إِنَّكُمْ لَسَارِقُونَ﴾
৭০। যখন ইউসুফ তাদের মালপত্র বোঝাই করাতে লাগলো তখন নিজের ভাইয়ের মালপত্রের মধ্যে নিজের পেয়ালা রেখে দিল।৫৬ তারপর একজন নকীব চীৎকার করে বললো, “হে যাত্রীদল! তোমরা চোর।”৫৭
৫৬. সম্ভবত পেয়ালা রেখে দেবার কাজটা হযরত ইউসুফ আ. নিজের ভাইয়ের সম্মতি নিয়ে তার জ্ঞাতসারেই করেছিলেন। আগের আয়াতে এ দিকে ইংগিত করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ আ. দীর্ঘকালীন বিচ্ছেদের পর জালেম বৈমাত্রের ভাইয়ের হাত থেকে নিজের সহোদর ভাইকে রক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। ভাই নিজেও এ জালেমদের সাথে ফিরে না যেতে চেয়ে থাকবেন। কিন্তু হযরত ইউসুফের নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে তাকে প্রকাশ্যে আটকে রাখা এবং তার মিসরে থেকে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর এ অবস্থায় এ পরিচয় প্রকাশ করাটা কল্যাণকর ছিল না। তাই বিন ইয়ামীনকে আটকে রাখার জন্য দু’ভাইয়ের মধ্যে এ পরামর্শ হয়ে থাকবে। যদিও এর মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ভাইয়ের অপমান অনিবার্য ছিল, কারণ তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনা হচ্ছিল, কিন্তু পরে উভয় ভাই মিলে আসল ব্যাপারটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিলেই এ কলংকের দাগ অতি সহজেই মুছে ফেলা যেতে পারবে।
৫৭. এ আয়াতে এবং পরবর্তী আয়াত গুলোতে কোথাও এ ধরনের কোন ইশারা পাওয়া যায় না, যা থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, হযরত ইউসুফ আ. নিজের কর্মচারীদেরকে এ গাপন ব্যাপারটি পূর্বাহ্নে অবহিত করেছিলেন এবং তাদেরকে যাত্রীদলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার ব্যাপারটি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনার যে সরল আকৃতিটি সহজেই চোখে ধরা পড়ে তা হচ্ছে এই যে, পেয়ালাটি হয়তো নীরবে রেখে দেয়া হয়েছিল, পরে সরকারী কর্মচারীরা সেটি খুঁজে না পেলে অনুমান করা হয়েছিল, এটা নিশ্চয় সেই কাফেলার অন্তরভুক্ত কোন লোকের কাজ যারা এখানে অবস্থান করেছিল।
﴿قَالُوا وَأَقْبَلُوا عَلَيْهِم مَّاذَا تَفْقِدُونَ﴾
৭১। তারা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের কি হারিয়ে গেছে?”
﴿قَالُوا نَفْقِدُ صُوَاعَ الْمَلِكِ وَلِمَن جَاءَ بِهِ حِمْلُ بَعِيرٍ وَأَنَا بِهِ زَعِيمٌ﴾
৭২। সরকারী কর্মচারী বললো, “আমরা বাদশাহার পানপাত্র পাচ্ছি না,” (এবং তাদের জমাদার বললোঃ) “যে ব্যক্তি তা এনে দেবে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার এক উট বোঝাই মাল। আমি এর দায়িত্ব নিচ্ছি।”
﴿قَالُوا تَاللَّهِ لَقَدْ عَلِمْتُم مَّا جِئْنَا لِنُفْسِدَ فِي الْأَرْضِ وَمَا كُنَّا سَارِقِينَ﴾
৭৩। এ ভাইয়েরা বললো, “আল্লাহর কসম! তোমরা খুব ভালোভাবেই জানো, আমরা এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে আসিনি এবং চুরি করার মতো লোক আমরা নই”
﴿قَالُوا فَمَا جَزَاؤُهُ إِن كُنتُمْ كَاذِبِينَ﴾
৭৪। তারা বললো, “আচ্ছা, যদি তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে চোরের কি শাস্তি হবে?”
﴿قَالُوا جَزَاؤُهُ مَن وُجِدَ فِي رَحْلِهِ فَهُوَ جَزَاؤُهُ ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ﴾
৭৫। তারা জবাব দিল, “তার শাস্তি” যার মালপত্রের মধ্যে ঐ জিনিস পাওয়া যাবে তার শাস্তি হিসেবে তাকেই রেখে দেয়া হবে। আমাদের এখানে তো এটাই এ ধরনের জালেমদের শাস্তির পদ্ধতি।”৫৮
৫৮. উল্লেখ্য, এ ভাইয়েরা ছিল ইবরাহিমী পরিবারের সন্তান। কাজেই চুরির ব্যাপারে তারা যে আইনের কথা বলে তা ছিল ইবরাহিমী শরীয়াতের আইন। এ আইন অনুযায়ী চোরের শাস্তি ছিল, যে ব্যক্তির সম্পদ সে চুরি করেছে তাকে তার দাসত্ব করতে হবে।
﴿فَبَدَأَ بِأَوْعِيَتِهِمْ قَبْلَ وِعَاءِ أَخِيهِ ثُمَّ اسْتَخْرَجَهَا مِن وِعَاءِ أَخِيهِ ۚ كَذَٰلِكَ كِدْنَا لِيُوسُفَ ۖ مَا كَانَ لِيَأْخُذَ أَخَاهُ فِي دِينِ الْمَلِكِ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ ۚ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَّن نَّشَاءُ ۗ وَفَوْقَ كُلِّ ذِي عِلْمٍ عَلِيمٌ﴾
৭৬। তখন ইউসুফ নিজের ভাইয়ের আগে তাদের থলের তল্লাশী শুরু করে দিল। তারপর নিজের ভাইয়ের থলের মধ্য থেকে হারানো জিনিস বের করে ফেললো। – এভাবে আমি নিজের কৌশলের মাধ্যমে ইউসুফকে সহায়তা করলাম।৫৯ বাদশাহর দীন (অর্থাৎ মিসরের বাদশাহর আইন) অনুযায়ী নিজের ভাইক পাকড়াও করা তার পক্ষে সংগত ছিল না, তবে যদি আল্লাহই এমনটি চান।৬০ যাকে চাই তার মর্তবা আমি বুলন্দ করে দেই আর একজন জ্ঞানবান এমন আছে যে প্রত্যেক জ্ঞানবানের চেয়ে জ্ঞানী।
৫৯. এ সমগ্র ধারাবাহিক ঘটনাবলীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত ইউসুফের সমর্থনে সরাসরি কোন কৌশলটি অবলম্বন করা হয়েছিল তা অবশ্যি এখানে ভেবে দেখার মতো বিষয়। একথা সুস্পষ্ট যে, পেয়ালা রাখার কৌশলটি হযরত ইউসুফ নিজেই করেছিলেন। এটাও সুস্পষ্ট, সরকারী কর্মচারীদের চুরির সন্দেহে কাফেলাকে আটকানোও একটি নিয়ম মাফিক কাজ ছিল, যা এ ধরনের অবস্থায় সব সরকারী কর্মচারীই করে থাকে। তাহলে আল্লাহর সেই কৌশল কোনটি? ওপরের আয়াতের মধ্যে অনুসন্ধান চালালে এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন জিনিসই এর ক্ষেত্র হিসেবে পাওয়া যেতে পারে না যে, সরকারী কর্মচারীরা নিয়ম বিরোধীভাবে নিজেরাই সন্দেহপূর্ণ অপরাধীদের কাছে চুরির শাস্তি জিজ্ঞেস করলো এবং জবাবে তারাও এমন শাস্তির কথা বললো যা ইবরাহিমী শরীয়াতের দৃষ্টিতে চোরকে দেয়া হতো। এর ফলে দু’টি লাভ হলো। প্রথমত হযরত ইউসুফ ইবরাহিমী শরীয়াতকে কার্যকর করার সুযোগ পেলেন এবং দ্বিতীয়ত নিজের ভাইকে হাজতে পাঠাবার পরিবর্তে তিনি নিজের কাছে রাখতে পারলেন।
৬০. অর্থাৎ হযরত ইউসুফ আ. নিজের একটি ব্যক্তিগত ব্যাপারে মিসরের বাদশাহর আইন কার্যকর করবেন, এটা তার নবুওয়াতের মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল না। ভাইকে আটকে রাখার জন্য তিনি নিজে যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তার মধ্যে তার জন্য একটি বাধা থেকে গিয়েছিল। অর্থাৎ তিনি ভাইকে আটক করতে পারতেন ঠিকই কিন্তু এ জন্য তাকে মিসরের বাদশাহর অপরাধ দণ্ডবিধির আশ্রয় নিতে হতো। আর এটি ছিল তার পয়গম্বরীর মর্যাদা বিরোধী। করণ তিনি ইসলাম বিরোধী আইনের জায়গায় ইসলামী শরীয়াতের আইন প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যেই দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন। আল্লাহ চাইলে তার নবীকে এ ধরনের একটি বেমানান ভুলের অবতারণা করতে দিতে পারতেন। কিন্তু এ কলংক কালিমা তাঁর গায়ে লেগে থাকুক এটা তিনি চাননি। তাই তিনি সরাসরি নিজ ব্যবস্থাপনায় একটি পথ বের করে দিলেন। ঘটনাক্রমে ইউসুফের ভাইদের কাছে চোরের শাস্তি কি হতে পারে তা জিজ্ঞেস করা হলো এবং তারা এ জন্য ইবরাহিমী শরীয়াতের আইন বর্ণনা করলো। ইউসুফের ভাইয়েরা মিসরের নাগরিক না হওয়ার কারণে এ জিনিসটি এদিক দিয়ে একেবারেই যথাযথ ছিল। তারা এসেছিল একটি স্বাধীন এলাকা থেকে। কাজেই তারা যদি তাদের এলাকায় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের লোককে এমন এক ব্যক্তির দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ করতে রাযী থাকে যার সম্পদ সে চুরি করেছে তাহলে এ ক্ষেত্রে আর মিসরীয় দণ্ডবিধির সাহায্য নেবার প্রয়োজনই থাকে না। পরবর্তী দু’টি আয়াতে আল্লাহ এ জিনিসটিকেই নিজের অনুগ্রহ ও তাত্বিক শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এক ব্যাক্তি যখন তার মানবিক দুর্বলতার কারণে নিজে কোন পদঙ্খলনের শিকার হয় তখন আল্লাহ অদৃশ্য থেকে তাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন, তার জন্য এর চেয়ে বড় মর্যাদা আর কি হতে পারে! এ ধরনের উন্নত মর্যাদা একমাত্র তারাই লাভ করতে পারেন যারা নিজেদের প্রচেষ্টা ও কর্মের মাধ্যমে বড় বড় পরীক্ষায় নিজেদের ‘মুহসিন’ তথা সৎকর্মশীল হওয়া প্রমাণ করে দিয়েছেন। যদিও হযরত ইউসুফ আ. তাত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, নিজে প্রখর প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা সহকারে কাজ করতেন, তবুও এ সময় তাঁর জ্ঞানের মধ্যে একটি ফাঁক থেকে গিয়েছিল এবং এমন এক সত্তা এ ফাঁক পূরণ করেছিলেন যিনি সবার চেয়ে বড় জ্ঞানী।
এখানে আরো কয়েকটি বিয়ষ ব্যাখ্যা সাপেক্ষ থেকে যায়। সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
একঃ সাধারণভাবে এ আয়াতটির অনুবাদ এভাবে করা হয়ে থাকেঃ “বাদশাহর আইন মোতাবেক ইউসুফ নিজের ভাইকে পাকড়াও করতে পারতো না।” অর্থাৎ ما كان ليأخذ কে অনুবাদক ও ব্যাখ্যাতাগণ অক্ষমতা অর্থে নিয়েছেন, অন্যায় বা অসংগত অর্থে নেননি। কিন্তু প্রথমত এ অনুবাদ ও ব্যাখ্যা আরবী বাকধারা ও কুরআনিক ব্যবহার উভয় দিক দিয়েই ঠিক নয়। কেননা আরবীতে সাধারণত ما كان له শব্দ ব্যবহৃত হয় ما ينبغى له ما صح له، ما استقام له ইত্যাদি অর্থে। আর কুরআনেও এটি বেশীর ভাগ এ অর্থেই এসেছে। যেমনঃ
مَا كَانَ لِلَّهِ أَن يَتَّخِذَ مِن وَلَدٍ – مَا كَانَ لَنَا أَن نُّشْرِكَ بِاللَّهِ مِن شَيْءٍ – مَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ – مَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ – فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ – مَّا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَىٰ مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ – مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَن يَقْتُلَ مُؤْمِنًا
দ্বিতীয়ত অনুবাদক ও ব্যাখ্যাতাগণ সাধারণভাবে যে অর্থ বর্ণনা করেন যদি এর সে অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে ব্যাপারটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। বাদশাহর আইনে চোরকে পাকড়াও করতে না পারার কি কারণ হতে পারে? দুনিয়ায় কি কখনো এমন পর্যায়েরও কোন রাষ্ট্র ছিল য়ার আইন চোরকে গ্রেফতার করার অনুমতি দিত না?
দুইঃ রাজকীয় আইনের জন্য আল্লাহ دين الملك (বাদশাহর আইন) শব্দ ব্যাবহার করে নিজেই ما كان ليأخذ থেকে যে অর্থ গ্রহণ করা উচিত সেদিকে ইংগিত করেছেন। একথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর নবীকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছিল دين الله (আল্লাহর আইন) জারী করার জন্য, دين الملك (বাদশাহর আইন) জারী করার জন্য নয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতির অনিবার্যতার কারণে যদি সেই রাষ্ট্রে সেই সময় পর্যন্ত বাদশাহর আইনের পরিবর্তে আল্লাহর আইন পুরোপুরি জারি করা সম্ভব না হয়ে থাকে তাহলে অন্ততপক্ষে নিজের একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে বাদশাহর আইন কার্যকর করাতো নবীর পক্ষে সমিচীন ছিল না। কাজেই হযরত ইউসুফ আ. বাদশাহর আইন অনুযায়ী নিজের ভাইকে গ্রেফতার না করার কারণ এটা ছিল না যে, বাদশাহর আইনে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ ছিল না বরং এর কারণ শুধু এটিই ছিল যে, নবী হিসেবে অন্ততপক্ষে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আল্লাহর আইন কার্যকর করা তাঁর জন্য ফরয ছিল। এ ক্ষেত্রে বাদশাহর আইন অনুযায়ী কাজ করা তাঁর জন্য কোনক্রমেই সংগত ছিল না।
তিনঃ দেশীয় আইনের (Law of the land) জন্য “দীন” শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহর দীনের অর্থের ব্যাপকতা পুরোপুরি প্রকাশ করে দিয়েছেন। এ থেকে দীন সম্পর্কে এক ধরনের লোকদের ধারণার মূল উৎপাটিত হয়ে গেছে। তারা ধারণা করেন, নবীগণের দাওয়াত শুধুমাত্র সাধারণ ধর্মীয় অর্থে এক আল্লাহর পূজা উপাসনা-আরাধনা করা এবং নিচক কতিপয় ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস ও রসম-রেওয়াজ মেনে চলাম মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা এও মনে করেন, মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি আইন-আদালত এবং এ ধরনের অন্যান্য পার্থিব বিষয়াদির সাথে দীনের কোন সম্পর্ক নেই। অথবা যদি সম্পর্ক থাকে তাহলে উল্লেখিত বিষয়াদি সম্পর্কে দীনের নির্দেশাবলী নিছক ঐচ্ছিক সুপারিশের পর্যায়ভুক্ত। এগুলো কার্যকর করতে পারলে ভালো, অন্যথায় মানুষের নিজের হাতে গড়া বিধান মেনে চলায় কোন ক্ষতি নেই। এটি পুরোপুরি দীন সম্পর্কে একটি বিভ্রান্ত চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। দীর্ঘদিন থেকে মুসলমানদের মধ্যে এর অনুশীলন চলছে। মুসলমানদেরকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম থেকে গাফেল করে দেবার ক্ষেত্রে এটিই বেশীরভাগ দায়ী। এরি বদৌলতে মুসলমানরা কুফরী ও জাহেলী জীবন ব্যবস্থায় কেবল সন্তুষ্টই হয়নি বরং একজন নবীর সুন্নাত মনে করে এ ব্যাবস্থার কল-কব্জায় পরিণত হতে এবং নিজেরাই তাকে পরিচালিত করতেও উদ্যোগী হয়েছে। এ আয়াতের দৃষ্টিতে এ চিন্তা ও কর্মনীতি পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। এখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পরিষ্কার ভাষায় বলছেনঃ যেভাবে নামায, রোযা ও হ্জ্জ দীনের অন্তরভুক্ত ঠিক তেমনি যে আইনের ভিত্তিতে দেশ ও সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয় তাও দীনের অন্তরভুক্ত। কাজেই إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ এবং وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ ইত্যাদি আয়াত গুলোতে যে দীনের প্রতি আনুগত্যের দাবী জানানো হয়েছে তার অর্থ শুধু নামায-রোযাই নয় বরং ইসলামের সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাও তার আওতায় এসে যায়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর মনোনীত এ ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য পরিহার করে অন্য কোন ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য করা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
চারঃ প্রশ্ন করা যেতে পারে, অন্ততপক্ষে এতটুকুন তো প্রমাণিত যে, এ সময পর্যন্ত মিসের রাষ্ট্রীয় পুর্যায়ে “বাদশাহর দীন” ই জারী ছিল। যদি এ সরকারের প্রধান শাসনকর্তা হযরত ইউসুফই হয়ে থাকেন যেমন এর আগে আপনি প্রমাণ করেছেন, তাহলে তো দেখা যায় আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফ নিজেই নিজের হাতে বাদশাহর দীন জারী করছিলেন। এরপর হযরত ইউসুফ যদি নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে বাদশাহরদীন এর পরিবর্তে ইবরাহীমের শরীয়াতকে কার্যকর করেন তাহলে তাতেই বা কি পার্থক্য হয়? এর জবাব হচ্ছে, হযরত ইউসুফ তো আল্লাহর দীন জারী করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। এটিই ছিল তাঁর নবুওয়াতী মিশন এবং তার শাসনের উদ্দেশ্য। কিন্তু একটি দেশের ব্যবস্থা কার্যত এক দিনেই বদলে দেয়া যায় না। আজ যদি কোন দেশ সম্পূর্ণভাবে আমাদের কর্তৃত্বাধীনে থাকে এবং আমরা সেখানে ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক সংকল্প সহকারে তার সামগ্রিক ব্যাবস্থাপনা নিজের হাতে নেই, তাহলেও তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক এবং আইন ও আদালত ব্যবস্থা বাস্তবে পরিবর্তিত করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এ অবস্থায় কিছুকাল পর্যন্ত আমাদের ব্যবস্থাপনায়ও পূর্বের আইন বহাল রাখতে হবে। ইতিহাস কি একথার সাক্ষ্য দেয় না যে, আরবের জীবন ব্যবস্থায় পূর্ণ ইসলামী বিপ্লব সাধনের জন্য নবী সা. এর নয়-দশ বছর সময় লেগেছিল? এ সময় শেষ নবীর নিজের রাষ্ট্রেই কয়েক বছর মদ পান চলতে থাকে। সূদের লেন দেন জারী থাকে। জাহেলী যুগের মীরাসী আইন জারী থাকে। পুরাতন বিয়ে তালাকের আইন চালু থাকে। অনেক ধরনের অবৈধ ব্যবসায় কার্যকর হতে থাকে। প্রথম দিনেই ইসলামের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন পুরোপুরি ও সর্বতোভাবে প্রবর্তিত হয়নি। কাজই হযরত ইউসুফের রাষ্ট্রে যদি প্রথম আট-নয় বছর পর্যন্ত সাবেক মিসরীয় রাজতন্ত্রের কিছু আইন চালু থাকে তাহলে তাতে অবাক হবোর কি আছে? আর এ থেকে আল্লাহর নবীকে মিসরে আল্লাহর দীন প্রবর্তনের জন্য নয় বরং বাদশাহর দীন প্রবর্তনের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল, এ যুক্তির উদ্ভব হয় কেমন করে? তবে দেশে যখন বাদশাহর দীন জারী ছিলই তখন হযরত ইউসুফের নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাকে কার্যকর করা তাঁর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল না কেন, এ প্রশ্নের জবাবও নবী সা. এর পদ্ধতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে সহজেই পাওয়া যায়। নবী সা. এর শাসন কালের প্রথম যুগে যতদিন ইসলামী আইন জারি হয়নি ততদিন লোকেরা পুরাতন পদ্ধতি অনুযায়ী শরাব পান করতে থাকে। কিন্তু নবী সা. নিজেও কি শরাব পান করেন? লোকেরা সুদী লেনদেন করতো। কিন্তু তিনি নিজেও কি সুদী লেনদেন করেন? লোকেরা মুতা বিয়ে করতে থাকে এবং দুই সহোদরা বোনকে একসাথে বিয়ে করতে থাকে। কিন্তু নবী সা. ও কি এমনটি করেন? এ থেকে জানা যায়, বাস্তব অক্ষমতার কারণে ইসলামের আহবায়কের ইসলামী বিধান জারি করার জন্য পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হওয়া একটি ভিন্ন ব্যাপার এবং এ পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হওয়ার যুগে তাঁর নিজের জাহেলী পদ্ধতিকে কার্যকর করা এর থেকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্নতর ব্যাপার। পর্যায়ক্রমের কারণে যে ছুট দেয়া হয় তা অন্যদের জন্য। আহবায়ক নিজে এমন সব পদ্ধতির মধ্যে থেকে কোন একটিকে বাস্তবায়িত করবেন যেগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তাঁর নিযুক্ত করা হয়েছে, এটা আসলে তাঁর নিজের কাজ নয়।
﴿قَالُوا إِن يَسْرِقْ فَقَدْ سَرَقَ أَخٌ لَّهُ مِن قَبْلُ ۚ فَأَسَرَّهَا يُوسُفُ فِي نَفْسِهِ وَلَمْ يُبْدِهَا لَهُمْ ۚ قَالَ أَنتُمْ شَرٌّ مَّكَانًا ۖ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا تَصِفُونَ﴾
৭৭। এ ভাইয়েরা বললো, “এ যদি চুরি করে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই, কারণ এর আগে এর ভাইও (ইউসুফ) চুরি করেছিল।”৬১ ইউসুফ তাদের একথা শুনে আতস্থ করে ফেললো, সত্য তাদের কাছে প্রকাশ করলো না শুধুমাত্র (মনে মনে) এতটুকু বলে থেমে গেলো, “বড়ই বদ তোমরা (আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ওপর এই যে দোষারোপ তোমরা করছো সে সম্পর্কে আল্লাহ প্রকৃত সত্য ভালোভাবে অবগত।”
৬১. আসলে নিজেদের অপমান স্খলন করার জন্য তারা একথা বলে। প্রথমে তারা বলে এসেছে, আমরা চোর নই। আর এখন দেখছে, তাদের ভাইয়ের থলের মধ্যে থেকে হারানো জিনিসটি বের হচ্ছে। কাজেই এখন সংগে সংগেই একটি মিথ্যা কথা বলে সেই ভাই থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে নিয়েছে এবং তার সাথে তার আগের ভাইকেও জড়িয়ে ফেলেছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, হযরত ইউসুফের অবর্তমানে বিন ইয়ামিনের সাথে এ ভাইয়েরা কোন ধরনের ব্যবহার করে আসছে এবং কি কারণে তার ও হযরত ইউসুফের মনে এ আকাংখা জেগেছে যে, সে তাদের সাথে ফিরে না গিয়ে ওখানে থেকে যাক।
﴿قَالُوا يَا أَيُّهَا الْعَزِيزُ إِنَّ لَهُ أَبًا شَيْخًا كَبِيرًا فَخُذْ أَحَدَنَا مَكَانَهُ ۖ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ﴾
৭৮। তারা বললো, “হে ক্ষমাতাসীন সরদার (আযীয)!৬২ এর বাপ অত্যন্ত বৃদ্ধ, এর জায়গায় আপনি আমাদের কাউকে রেখে দিন। আমরা আপনাকে বড়ই সদাচারী ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি।”
৬২. এখানে “আযীয” শব্দটি হযরত ইউসুফের জন্য ব্যবহার করার কারণে তাফসীরকারগণ ধারণা করে নিয়েছেন যে, যুলায়খার স্বামী ইতিপূর্বে যে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন হযরত ইউসুফ সেই পদেই অধিষ্ঠিত হন। এরপর আরো ধারণা করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী আযীয মারা গিয়েছিল এবং হযরত ইউসুফ তার স্থলাভিষিক্ত হন। যুলায়খাকে নতুন করে অলৌকিকভাবে যুবতী বানিয়ে দেয়া হয় এবং মিসরের বাদশাহ হযরত ইউসুফের সাথে তার বিয়ে দেন। ইউসুফের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। এমন কি বাসর রাতে হযরত ইউসুফের সাথে যুলায়খার যে কথাবার্তা হয় তাও পর্যন্ত আমাদের একশ্রেণীর তাফসীরকারগণের কাছে পৌঁছে যায়। অথচ একথাগুলো সবই কাল্পনিক। “আযীয” শব্দটি সম্পর্কে আমি আগেই একথা বলে এসেছি যে, মিসরে এটি কোন বিশেষ পদবী হিসেবে চিহ্নিত ছিল না বরং ছিক “কর্তৃত্বশালী” অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সম্ভবত মিসরে বড় বড় লোকদের জন্য এ ধরনের কিছু শব্দ পারিভাষিক অর্থে প্রচলিত ছিল, যেমন আমাদের দেশে “সরকার” শব্দটির প্রচলন দেখা যায়। এরি অনুবাদ কুরআনে “আযীয” শব্দের মাধ্যমে করা হয়েছে। আর যুলায়খার সাথে হযরত ইউসুফের বিয়ের যে গলপ ফাঁদা হয়েছে এর ভিত্তি শুধু এতটুকুই যে, বাইবেল ও তালমূদে পোটিফেরের মেয়ে আসনাত এর সাথে তার বিয়ের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ওদিকে যুলায়খার স্বামীর নামও ছিল পোটিফর। এ ঘটনাগুলো ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্ধৃত হতে হতে মুফাসসিরগণের কাছে পৌঁছে যায়। তারপর গুজব ও জনশ্রুতির বিস্তার লাভের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী। পোটিফের সহজেই পোটিফর হয়ে গেছে। মেয়ে হয়ে গেছে স্ত্রী। আর এ স্ত্রী নিশ্চিত ভাবেই হয়ে গেছে যুলায়খা। কাজেই তার সাথে হযরত ইউসুফের বিয়ে দেবার জন্য পোটিফরকে হত্যা করা হয়েছে। এভাবেই “ইউসুফ যুলায়খার” উপাখ্যান পূর্ণতা লাভ করেছে।
﴿قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ أَن نَّأْخُذَ إِلَّا مَن وَجَدْنَا مَتَاعَنَا عِندَهُ إِنَّا إِذًا لَّظَالِمُونَ﴾
৭৯। ইউসুফ বললেন, “আল্লাহর পানাহ! অন্য কাউকে আমরা কেমন করে রাখতে পারি? যার কাছে আমরা নিজেদের জিনিস পেয়েছি৬৩ তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে রাখলে আমরা জালেম হয়ে যাবো।”
৬৩. এখানে কতদূর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে একবার তলিয়ে দেখুন। এখানে “চোর” বলা হচ্ছে না বরং কেবল এতটুকু বলা হচ্ছে, “যার কাছে আমরা আমাদের জিনিস পেয়েছি।” শরীয়াতী পরিভায়ায় একেই বলা হয় “তাওরীয়া” অর্থাৎ “সত্যকে সুকৌশলে গোপন করা”। যখন কোন মজলুমকে জালেমের হাত থেকে বাঁচাবার অথবা কোন বড় আকারের জুলুমের প্রতিরোধ করার জন্য প্রকৃত ঘটনার বিপরীত কথা বলা বা সত্য বিরোধী বাহানাবাজী করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তখন এ অবস্থায় একজন আল্লাহভীরু ব্যক্তি সুস্পষ্ট মিথ্যা এড়িয়ে এমন কথা বলবে বা এমন কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করবে যার ফলে প্রকৃত সত্যকে গোপন করে দুষ্কৃতিকে রোধ করা যেতে পারে। এমনটি করা শরীয়াত ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে বৈধ, তবে এখানে শর্ত থাকবে যে, নিছক কার্যোদ্ধার করার জন্য এমনটি করা যাবে না বরং কোন বড় আকারের দুষ্কৃতি দূর করাই হবে উদ্দেশ্য। এখন এ সমগ্র ব্যাপারটিতে হযরত ইউসুফ আ. কেমন ধরনের বৈধ তাওরীয়ার শর্ত পূরণ করেছেন দেখুনঃ ভাইয়ের সম্মতিক্রমে তার মালপত্রের মধ্যে নিজের পেয়ালাটি রেখে দিয়েছেন। কিন্তু কর্মচারীদেরকে একথা বলেননি যে, এর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ দায়ের করো। তারপর সরকারী কর্মচারীরা যখন চুরির অভিযোগে তাদেরকে ধরে এনেছে তখন কোন প্রকার হৈ চৈ না করে নীরবে তাদের মালপত্র তল্লাশী করতে শুরু করেছেন এরপর যখন এ ভাইয়েরা বললো, বিন ইয়ামীনের জায়গায় আমাদের কাউকে রাখুন তখন এর জবাবে তাদেরই কথা তাদের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, তোমরাইতো ফতোয়া দিয়েছিলে, যার মালপত্রের মধ্য থেকে পেয়ালা বের হবে তাকেই রেখে দেয়া হবে। কাজেই এখন তোমাদের সামনে বিন ইয়ামীনের মালপত্রের মধ্য থেকে আমাদের জিনিস বের হয়েছে এবং তাকেই আমরা রেখে দিচ্ছি। অন্যকে তার জায়গায় আমরা কেমন করে রাখতে পারি? এ ধরনের তাওরীয়ার দৃষ্টান্ত নবী সা.এর যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসেও পাওয়া যাবে। কোন যুক্তি দিয়ে নৈতিক দৃষ্টিতে একে দোষণীয়ও বলা যেতে পারে না।
﴿فَلَمَّا اسْتَيْأَسُوا مِنْهُ خَلَصُوا نَجِيًّا ۖ قَالَ كَبِيرُهُمْ أَلَمْ تَعْلَمُوا أَنَّ أَبَاكُمْ قَدْ أَخَذَ عَلَيْكُم مَّوْثِقًا مِّنَ اللَّهِ وَمِن قَبْلُ مَا فَرَّطتُمْ فِي يُوسُفَ ۖ فَلَنْ أَبْرَحَ الْأَرْضَ حَتَّىٰ يَأْذَنَ لِي أَبِي أَوْ يَحْكُمَ اللَّهُ لِي ۖ وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ﴾
৮০। যখন তারা ইউসুফের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেলো তখন একান্তে পরামর্শ করতে লাগলো। তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বয়সে বড় ছিল সে বললোঃ “তোমরা কি জান না, তোমাদের বাপ তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে কি অংগীকার নিয়েছেন এবং ইতিপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারে তোমরা যেসব বাড়াবাড়ি করেছো তাও তোমরা জানো। এখন আমি তো এখান থেকে কখনোই যাবো না যে পর্যন্ত না আমার বাপ আমাকে অনুমতি দেন অথবা আল্লাহ আমার ব্যাপারে কোন ফায়সালা করে দেন, কেননা তিনি সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী।
﴿ارْجِعُوا إِلَىٰ أَبِيكُمْ فَقُولُوا يَا أَبَانَا إِنَّ ابْنَكَ سَرَقَ وَمَا شَهِدْنَا إِلَّا بِمَا عَلِمْنَا وَمَا كُنَّا لِلْغَيْبِ حَافِظِينَ﴾
৮১। তোমরা তোমাদের বাপের কাছে ফিরে গিয়ে বলো, “আব্বাজান, আপনার ছেলে চুরি করেছে, আমরা তাকে চুরি করতে দেখিনি, যতটুকু আমরা জেনেছি শুধু ততটুকুই বর্ণনা করছি এবং অদৃশ্যেরই রক্ষণাবেক্ষণ করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।
﴿وَاسْأَلِ الْقَرْيَةَ الَّتِي كُنَّا فِيهَا وَالْعِيرَ الَّتِي أَقْبَلْنَا فِيهَا ۖ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ﴾
৮২। আমরা যে পল্লীতে ছিলাম সেখানকার লোকজনদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন এবং যে কাফেলার সাথে আমরা ছিলাম তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমরা যা বলছি।”
﴿قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْرًا ۖ فَصَبْرٌ جَمِيلٌ ۖ عَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَنِي بِهِمْ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ﴾
৮৩। ইয়াকূব এ কাহিনী শুনে বললো, “আসলে তোমাদের মন তোমাদের জন্য আরো একটি বড় ঘটনাকে সহজ করে দিয়েছে।৬৪ ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও আমি সবর করবো এবং ভালো করেই করবো। হয়তো আল্লাহ এদের সবাইকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দেবেন। তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনি জ্ঞানের ভিত্তিতে সমস্ত কাজ করেন।”
৬৪. অর্থাৎ আমার ছেলের চারিত্রিক সততা সম্পর্কে আমি ভালোভাবেই জানি। তার একটি পেয়ালা চুরির দোষে অভিযুক্ত হবার কথা মেনে নেয়া তোমাদের জন্য সহজ হতে পারে। ইতিপূর্বে তোমাদের জন্য তোমাদের এক ভাইকে জেনেবুঝে নিখোঁজ করে দেয়া এবং তার পোশাকে কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনা খুব সহজ কাজ হয়ে গিয়েছিল। আর এখন অন্য এক ভাইকে সত্যি সত্যি চোর বলে মেনে নেয়া এবং আমাকে এসে তার খবর দেয়াও তেমনি সহজ কাজ হয়ে গেছে।
﴿وَتَوَلَّىٰ عَنْهُمْ وَقَالَ يَا أَسَفَىٰ عَلَىٰ يُوسُفَ وَابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ مِنَ الْحُزْنِ فَهُوَ كَظِيمٌ﴾
৮৪। তারপর সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে গেলো এবং বলতে লাগলো, “হায় ইউসুফ”- সে মনে মনে দুঃখে ও শোকে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিল এবং তার চোখগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল,
﴿قَالُوا تَاللَّهِ تَفْتَأُ تَذْكُرُ يُوسُفَ حَتَّىٰ تَكُونَ حَرَضًا أَوْ تَكُونَ مِنَ الْهَالِكِينَ﴾
৮৫। ছেলেরা বললো, “আল্লাহর দোহাই! আপনি তো শুধু ইউসুফের কথাই স্মরণ করে যাচ্ছেন। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তার শোকে আপনি নিজেকে দিশেহারা করে ফেলবেন অথবা নিজের প্রাণ সংহার করবেন।”
﴿قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾
৮৬। সে বললো, “আমি আমার পেরেশানি এবং আমার দুঃখের ফরিয়াদ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে করছি না। আর আল্লাহর ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি তোমরা ততটুকু জানো না।
﴿يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللَّهِ ۖ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ﴾
৮৭। হে আমার ছেলেরা! তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু অনুসন্ধান চালাও। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। তাঁর রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়।”
﴿فَلَمَّا دَخَلُوا عَلَيْهِ قَالُوا يَا أَيُّهَا الْعَزِيزُ مَسَّنَا وَأَهْلَنَا الضُّرُّ وَجِئْنَا بِبِضَاعَةٍ مُّزْجَاةٍ فَأَوْفِ لَنَا الْكَيْلَ وَتَصَدَّقْ عَلَيْنَا ۖ إِنَّ اللَّهَ يَجْزِي الْمُتَصَدِّقِينَ﴾