পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
c রুকুঃ
১ d
﴿الم﴾
১। আলিফ
লাম মীম।১
১. এগুলো বিচ্ছিন্ন হরফ। কুরআন মজীদের কোন কোন সূরার শুরুতে এগুলো দেখা যায়। কুরআন মজীদ নাযিলের যুগে সমকালীন আরবী
সাহিত্যে এর ব্যবহার ছিল।
বক্তার বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাধারণত এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বক্তা ও কবি উভয় গোষ্ঠীই এ পদ্ধতি আশ্রয় নিতেন। বর্তমানে জাহেলী যুগের কবিতার যেসব নমুনা
সংরক্ষিত আছে তার মধ্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে ব্যবহারের কারণে এ বিচ্ছিন্ন হরফগুলো কোন ধাঁধা
হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।
এগুলো এমন ছিল না যে, কেবল বক্তাই এগুলোর অর্থ বুঝতো বরং শ্রোতারাও এর অর্থ বুঝতে পারতো। এ কারণে দেখা যায়, নবী সা. এর সমকালীন বিরোধীদের
একজনও এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়নি। তাদের একজনও একথা বলেনি যে, বিভিন্ন সূরার শুরুতে আপনি যে
কাটা কাটা হরফগুলো বলে যাচ্ছেন এগুলো কি? এ কারণেই সাহাবায়ে
কেরাম ও নবী সা. এর কাছে এগুলোর অর্থ জানতে চেয়েছেন এ মর্মে কোন হাদীসও উদ্ধৃতি
হতে দেখা যায়নি।
পরবর্তীকালে আরবী ভাষায় এ বর্ণনা পদ্ধতি পরিত্যক্ত হতে চলেছে। ফলে কুরআন ব্যাখ্যাকারীদের জন্য এগুলোর অর্থ নির্ণয় করা
কঠিন হয়ে পড়ে। তবে একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করা এ
শব্দগুলোর অর্থ বুঝার ওপর নির্ভরশীল নয়। অথবা এ হরফগুলোর মানে না বুঝলে কোন ব্যক্তির সরল সোজা পথ
লাভের মধ্যে গলদ থেকে যাবে, এমন কোন কথাও নেই। কাজেই একজন সাধারণ পাঠকের জন্য এর অর্থ অনুসন্ধানে ব্যাকুল কোন প্রয়োজন নেই।
﴿ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ
ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ﴾
২। এটি
আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই।২ এটি
হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের
জন্য৩
২. এর একটা সরল অর্থ এভাবে করা যায় “নিসন্দেহে এটা আল্লাহর
কিতাব।” কিন্তু এর একটা অর্থ এও হতে
পারে যে, ওটা এমন একটা কিতাব যাতে সন্দেহের কোন লেশ নেই। দুনিয়ায় যতগুলো গ্রন্থে অতিপ্রাকৃত এবং
মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান বহির্ভূত বিষয়বলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো সবই কল্পনা, ধারণা ও আন্দাজ–অনুমানের
ভিত্তিতে লিখিত হয়েছে। তাই এ গ্রন্থগুলোর লেখকরাও নিজেদের রচনাবলীর নির্ভূলতা সম্পর্কে যতই প্রত্যয়
প্রকাশ করুক না কেন তাদের নির্ভুলতা সন্দেহ মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু এ কুরআন মজীদ এমন একটি গ্রন্থ যা
আগাগোড়া নির্ভূল সত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ। এর রচয়িতা হচ্ছেন এমন এক মহান সত্তা যিনি সমস্ত তত্ব ও সত্যের জ্ঞান রাখেন। কাজেই এর মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এর মধ্যে সন্দেহ
পোষণ করলে সেটা অবশ্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা এবং সে জন্য এ কিতাব দায়ী নয়।
৩. অর্থাৎ এটি একেবারে একটি হিদায়াত ও পথনির্দেশনার গ্রন্থ। কিন্তু এর থেকে লাভবান হতে চাইলে মানুষের
মধ্যে কয়েকটি মৌলিক গুণ থাকতে হবে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটির প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, তাকে ‘মুত্তাকী’ হতে হবে। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা তার
মধ্যে থাকতে হবে। তার মধ্যে মন্দ থেকে
নিষ্কৃতি পাওয়ার ও ভালোকে গ্রহণ করার আকাংখা এবং এ আকাংখাকে বাস্তবায়িত করার ইচ্ছা
থাকতে হবে। তবে যারা দুনিয়ায় পশুর মতো
জীবন যাপন করে, নিজেদের কৃতকর্ম সঠিক কি না সে ব্যাপারে কখনো চিন্তা করে না, যেদিকে সবাই চলছে বা যেদিকে প্রবৃত্তি তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অথবা যেদিকে
মন চায় সেদিকে চলতে যারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য কুরআন মজীদে
কোর পথনির্দেশনা নেই।
﴿الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ
وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ﴾
৩। যারা
অদৃশ্যে বিশ্বাস করে৪, নামায কায়েম করে৫।
৪. কুরআন থেকে লাভবান হবার জন্য এটি হচ্ছে দ্বিতীয় শর্ত। ‘গায়েব’ বা অদৃশ্য বলতে
এমন গভীর সতের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যা মানুষের ইন্দ্রিয়াতীত এবং কখনো সরাসরি
সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে না। যেমন আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, ফেরেশতা, অহী, জান্নাত, জাহান্নাম
ইত্যাদি। এ গভীর সত্যগুলোকে না দেখে
মেনে নেয়া এবং নবী এগুলোর খবর দিয়েছেন বলে তাঁর খবরের সত্যতার প্রতি আস্থা রেখে
এগুলোকে মেনে নেয়াই হচ্ছে ‘ঈমান বিল গায়েব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আয়াতের অর্থ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি মেনে নেয়ার জন্য
দেখার, ঘ্রাণ নেয়ার ও আস্বাদন করার শর্ত আরোপ করে এবং যে
ব্যক্তি বলে, আমি এমন কোন জিনিস মেনে নিতে পারি না যা পরিমাণ
করা ও ওজন করা যায় না-সে এ কিতাব থেকে হিদায়াত ও পথনির্দেশনা লাভ করতে পারবে না।
৫. এটি হচ্ছে তৃতীয় শর্ত। এর অর্থ হচ্ছে, যারা কেবল মেনে নিয়ে নীরবে বসে থাকবে তারা
কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারবে না। বরং মেনে নেয়ার পর সংগে সংগেই তার আনুগত্য করা ও তাকে কার্যকর করাই হচ্ছে এ
থেকে উপকৃত হবার জন্য একান্ত অপরিহার্য প্রয়োজন। আর বাস্তব আনুগত্যের প্রধান ও স্থায়ী আলামত হচ্ছে নামায। ঈমান আনার পর কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হতে না হতেই
মুয়াযযিন নামাযের জন্য আহবান জানায় আর ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি বাস্তবে আনুগত্য
করতে প্রস্তুত কি না তার ফায়সালা তখনই হয়ে যায়। এ মুয়াযযিন আবার প্রতিদিন পাঁচবার আহবান জানাতে থাকে। যখনই এ ব্যক্তি তার আহবানে সাড়া না দেয় তখনই
প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি এবার আনুগত্য থেকে বের হয়ে এসেছে। কাজেই নামায ত্যাগ করা আসলে আনুগত্য ত্যাগ
করারই নামান্তর। বলা বাহুল্য কোন ব্যক্তি
যখন কারোর নির্দেশে মেনে চলতে প্রস্তুত থাকে না তখন তাকে নির্দেশ দেয়া আর না দেয়া
সমান।
ইকমাতে সালাত বা নামায কায়েম করা একটি ব্যাপক ও পূর্ণ অর্থবোধক পরিভাষা একথাটি
অবশ্যি জেনে রাখা প্রয়োজন। এর অর্থ কেবল নিয়মিত নামায পড়া নয় বরং সামষ্টিকভাবে নামাযের ব্যবস্থাপনা
প্রতিষ্ঠিত করাও এর অর্থের অন্তরভুক্ত। যদি কোন লোকালয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি নিয়মিতভাবে নামায পড়ে থাকে
কিন্তু জামায়াতের সাথ এ ফরযটি আদায় করার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সেখানে নামায কায়েম আছে,
একথা বলা যাবে না।
﴿وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ
بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ﴾
৪। এবং যে
রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে৬। আর যে
কিতাব তোমাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল
করা হয়েছিল সে সবগুলোর ওপর ঈমান আনে৭ আর
আখেরাতের ওপর একীন রাখে।৮
৬. কুরআনের হিদায়াত লাভ করার জন্য এটি হচ্ছে চতুর্থ শর্ত। সংকীর্ণমনা ও অর্থলোলুপ না হয়ে মানুষকে হতে
হবে আল্লাহ ও বান্দার অধিকার আদায়কারী। তার সম্পদে আল্লাহ ও বান্দার যে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে তাকে তা আদায় করার জন্য
প্রস্তুত থাকতে হবে। যে
বিষয়ের ওপর সে ঈমান এনেছে তার জন্য অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করা ব্যাপারে সে কোন
রকম ইতস্তত করতে পারবে না।
৭. এটি হচ্ছে পঞ্চম শর্ত। অর্থাৎ আল্লাহ অহীর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর
পূর্ববর্তী নবীগণের ওপর বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন দেশে যেসব কিতাব নাযিল করেছিলেন
সেগুলোকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। এ শর্তটির কারণে যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিধান অবতরনের
প্রয়োজনীয়তাকে আদতে স্বীকারই করে না অথবা প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করলেও এ জন্য অহী
ও নবুওয়াতের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না এবং এর পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া মতবাদকে
আল্লাহর বিধান বলে ঘোষণা করে অথবা আল্লাহর কিতাবের স্বীকৃতি দিলেও কেবলমাত্র সেই
কিতাবটি বা কিতাবগুলোর ওপর ঈমান আনে যেগুলোকে তাদের বাপ-দাদারা মেনে আসছে যারা এ
উৎস থেকে উৎসারিত অন্যান্য বিধানগুলোকে অস্বীকার করে–তাদের সবার জন্য কুরআনের
হিদায়াতের দুয়ার রুদ্ধ। এ
ধরনের সমস্ত লোককে আলাদা করে দিয়ে কুরআন তার অনুগ্রহ একমাত্র তাদের ওপর বর্ষণ করে
যারা নিজেদেরকে আল্লাহর বিধানের মুখাপেক্ষী মনে করে এবং আল্লাহর এ বিধান আলাদা
আলাদাভাবে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে না এসে বরং নবীদের ও আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমেই
মানুষের কাছে আসে বলে স্বীকার করে আর এই সংগে বংশ, গোত্র বা জাতি প্রীতিতে লিপ্ত
হয় না বরং নির্ভেজাল সত্যের পূজারী হয়, সত্য যেখানে যে
আকৃতিতে আবির্ভূত হোক না কেন তারা তার সামনে মস্তক অবনত করে দেয়।
৮. এটি ষষ্ঠ ও সর্বশেষ শর্ত। আখেরাত একটি ব্যাপক ও পরিপূর্ণ অর্থবোধক শব্দ। আকীদা-বিশ্বাসের বিভিন্ন উপাদানের সমষ্টির
ভিত্তিতে এ আখেরাতের ভাবধারা গড়ে উঠেছে। বিশ্বাসের নিম্নোক্ত উপাদানগলো এর অন্তরভুক্ত।
একঃ এ দুনিয়ায় মানুষ কোন দায়িত্বহীন জীব নয়। বরং নিজের সমস্ত কাজের জন্য তাকে আল্লাহর
সামনে জবাবদিহি করতে হবে।
দুইঃ দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা চিরন্তন নয়। এক সময় এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং সে সময়টা একমাত্র
আল্লাহই জানেন।
তিনঃ এ দুনিয়া শেষ হবার পর আল্লাহ আর একটি দুনিয়া তৈরি করবেন। সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত
পৃথিবীতে যত মানুষের জন্ম হয়েছে সবাইকে সেখানে একই সংগে পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। সবাইকে একত্র করে তাদের কর্মকান্ডের হিসেব
নেবেন। সবাইকে তার কাজের পূর্ণ
প্রতিদান দেবেন।
চারঃ আল্লাহর এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সৎলোকেরা জান্নাতে স্থান
পাবে এবং অসৎলোকদেরকে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে।
পাঁচঃ বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি সাফল্য ও
ব্যর্থতার আসল মানদন্ড নয়। বরং আল্লাহর শেষ বিচারে যে ব্যক্তি উতরে যাবে সে-ই হচ্ছে সফলকাম আর সেখানে যে
উতরোবে না সে ব্যর্থ।
এ সমগ্র আকীদা-বিশ্বাসগুলোকে যারা মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি তারা কুরআন
থেকে কোনক্রমেই উপকৃত হতে পারবে না। কারণ এ বিষয়গুলো অস্বীকার করা তো দূরের কথা এগুলো সম্পর্কে কারো মনে যদি
সামান্যতম দ্বিধা ও সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে মানুষের জীবনের জন্য কুরআন যে পথনির্দেশ
করেছে সে পথে তারা চলতে পারবে না।
﴿أُولَٰئِكَ عَلَىٰ هُدًى
مِّن رَّبِّهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾
৫। এ ধরনের
লোকেরা তাদের রবের পক্ষ থেকে সরল সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারা কল্যাণ লাভের
অধিকারী।
﴿إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا
سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَأَنذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنذِرْهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ﴾
৬। যেসব লোক
(একথাগুলো মেনে নিতে) অস্বীকার করেছে৯, তাদের জন্য সমান–তোমরা তাদের
সতর্ক করো বা না করো, তারা মেনে নেবে না।
৯. অর্থাৎ ওপরে বর্ণিত ছয়টি শর্ত যারা পূর্ণ করেনি অথবা
সেগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
﴿خَتَمَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ
وَعَلَىٰ سَمْعِهِمْ ۖ وَعَلَىٰ أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
৭। আল্লাহ
তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন।১০ এবং
তাদের চোখের ওপর আবরণ পড়ে গেছে। তারা কঠিন
শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।
১০. আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছিলেন বলেই তারা মেনে নিতে অস্বীকার
করেছিল–এটা এ বক্তব্যের অর্থ নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যখন তারা ওপরে বর্ণিত মৌলিক বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং নিজেদের
জন্য কুরআনের উপস্থাপিত পথের পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নিয়েছিল তখন আল্লাহ তাদের
হৃদয়ে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছিলেন। যে ব্যক্তি কখনো ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন
তিনি অবশ্যি এ মোহর লাগার অবস্থার ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকবেন।আপনার উপস্থাপিত পথ যাচাই করার পর কোন ব্যক্তি
একবার যখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন উল্টো পথে তার মন-মানস এমনভাবে দৌড়াতে থাকে
যার ফলে আপনার কোন কথা আর তার বোধগম্য হয় না। আপনার দাওয়াতের জন্য তার কান হয়ে যায় বধির ও কালা। আপনার কার্যপদ্ধতির গুণাবলী দেখার ব্যাপারে
তার চোখ হয়ে যায় অন্ধ।
তখন সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, সত্যিই তার হৃদয়ের দুয়ারে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
c রুকুঃ ২ d
﴿وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ
آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُم بِمُؤْمِنِينَ﴾
৮। কিছু লোক
এমনও আছে যারা বলে, আমরা
আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়।
﴿يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ
آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ﴾
৯। তারা
আল্লাহর সাথে ও যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করেছে। কিন্তু
আসলে তারা নিজেদেরকেই প্রতারণ করছে, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।১১
১১. অর্থাৎ তাদের মুনাফেকী কার্যকলাপ তাদের জন্য লাভজনক হবে–এ
ভুল ধারণায় তারা নিমজ্জিত হয়েছে। অথচ এসব তাদেরকে দুনিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং আখেরাতেও। একজন মুনাফিক কয়েকদিনের জন্য দুনিয়ায় মানুষকে ধোকা দিতে
পারে কিন্তু সবসময়ের জন্য তার এই ধোঁকাবাজি চলতে পারে না। অবশেষে একদিন তার মুনাফিকীর গুমোর ফাঁক হয়ে যাবেই। তখন সমাজে তার সামান্যতম মর্যাদাও খতম হয়ে যাবে। আর আখেরাতের ব্যাপারে বলা যায়, সেখানে তো ঈমানের মৌখিক দাবীর
কোন মূল্যই থাকবে না যদি আমল দেখা যায় তার বিপরীত।
﴿فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ
اللَّهُ مَرَضًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ﴾
১০। তাদের
হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে
রোগ আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছেন১২, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার
বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
১২. মুনাফিকীকেই এখানে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর আল্লাহ এ রোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, একথার অর্থ হচ্ছে এই যে,
তিনি কালবিলম্ব না করে ঘটনাস্থলেই মুনাফিকদেরকে তাদের মুনাফিকী
কার্যকলাপের শাস্তি দেন না বরং তাদেরকে ঢিল দিতে থাকেন। এর ফলে মুনাফিকরা নিজেদের কলা-কৌশলগুলোকে আপাত
দৃষ্টিতে সফল হতে দেখে আরো বেশী ও পূর্ণ মুনাফিকী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে থাকে।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا
تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ﴾
১১। যখনই তাদের
বলা হয়েছে, যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা একথাই বলেছে, আমরা তো সংশোধনকারী।
﴿أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ
وَلَٰكِن لَّا يَشْعُرُونَ﴾
১২। সাবধান!
এরাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا
كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ ۗ أَلَا إِنَّهُمْ
هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَٰكِن لَّا يَعْلَمُونَ﴾
১৩। আর যখন
তাদের বলা হয়েছে, অন্য লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান
আনো১৩ তখন তারা এ জবাবই দিয়েছে-আমরা
কি ঈমান আনবো নির্বোধদের মতো১৪? সাবধান! আসলে এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা জানে না।
১৩. অর্থাৎ তোমাদের এলাকার অন্যান্য লোকেরা যেমন সাচ্চা দিলে ও সরল অন্তঃকরণে
মুসলমান হয়েছে তোমরাও যদি ইসলাম গ্রহণ করতে চাও তাহলে তেমনি নিষ্ঠা সহকারে সাচ্চা
দিলে গ্রহণ করো।
১৪. যারা সাচ্চা দিলে নিষ্ঠা সহকারে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদেরকে উৎপীড়ন, নির্যাতন, কষ্ট ও বিপদের মুখে নিক্ষেপ করছিল তাদেরকে তারা নির্বোধ মনে করতো। তাদের মতে নিছক সত্য ও ন্যায়ের জন্য সারা
দেশের জনসমাজের শত্রুতার মুখোমুখি হওয়া নিরেট বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা মনে করতো, হক ও বাতিলের বিতর্কে না পড়ে
সব ব্যাপারেই কেবলমাত্র নিজের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
﴿وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ
آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَىٰ شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ
إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ﴾
১৪। যখন এরা মু’মিনদের
সাথে মিলিত হয়, বলেঃ “আমরা ঈমান এনেছি”, আবার যখন নিরিবিলিতে নিজেদের
শয়তানদের১৫ সাথে মিলিত হয় তখন বলেঃ “আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই
আছি আর ওদের সাথে তো নিছক তামাশা করছি।”
১৫. আরবী ভাষায় সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক ও স্বৈরাচারীকে শয়তান বলা হয়। মানুষ ও জিন উভয়ের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা
হয়। কুরআনের অধিকাংশ জায়গায় এ
শব্দটি জিনদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও কোন কোন জায়গায় আবার শয়তান প্রকৃতির
মানুষদের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষাপটে এসব ক্ষেত্রে কোথায় শয়তান শব্দটি জিনদের জন্য
এবং কোথায় মানুষদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে তা সহজেই জানা যায়। তবে আমাদের আলোচ্য স্থানে শয়তান শব্দটিকে বহুবচনে ‘শায়াতীন’ হিসেবে
ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখানে ‘শায়াতীন’ বলতে মুশরিকদের বড় বড়
সরদারদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ সরদাররা তখন ইসলামের বিরোধিতার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
﴿اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ
وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ﴾
১৫। আল্লাহ
এদের সাথে তামাশা করছেন, এদের রশি দীর্ঘায়িত বা ঢিল দিয়ে যাচ্ছেন এবং এরা
নিজেদের আল্লাহদ্রোহিতার মধ্যে অন্ধের মতো পথ হাতড়ে মরছে।
﴿أُولَٰئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا
الضَّلَالَةَ بِالْهُدَىٰ فَمَا رَبِحَت تِّجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ﴾
১৬। এরাই
হিদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহী কিনে নিয়েছে, কিন্তু এ সওদাটি তাদের জন্য লাভজনক নয় এবং
এরা মোটেই সঠিক পথে অবস্থান করছে না।
﴿مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِي
اسْتَوْقَدَ نَارًا فَلَمَّا أَضَاءَتْ مَا حَوْلَهُ ذَهَبَ اللَّهُ بِنُورِهِمْ وَتَرَكَهُمْ
فِي ظُلُمَاتٍ لَّا يُبْصِرُونَ﴾
১৭। এদের
দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন এক
ব্যক্তি আগুন জ্বালালো এবং যখনই সেই আগুন চারপাশ আলোকিত করলো তখন আল্লাহ তাদের
দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিলেন এবং তাদের ছেড়ে দিলেন এমন অবস্থায় যখন অন্ধকারের মধ্যে
তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না।১৬
১৬. যখন আল্লাহর এক বান্দা আলো জ্বালালেন এবং হককে বাতিল থেকে, সত্যেকে মিথ্যা থেকে ও সরল
সোজা পথকে ভুল পথ থেকে ছেটে সুস্পষ্টরূপে আলাদা করে ফেললেন তখন চক্ষুষ্মান
ব্যক্তিদের কাছে সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো সুস্পষ্ট দিবালোকের মতো। কিন্তু প্রবৃত্তি পূজার অন্ধ মুনাফিকরা এ আলোয়
কিছুই দেখতে পেলো না। “আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি
ছিনিয়ে নিলেন”– বাক্যের কারণে কেউ যেন এ ভুল ধারণা পোষণ না করেন যে, তাদের অন্ধকারে হাতড়ে মরার
জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। যে ব্যক্তি নিজে হক ও সত্যের প্রত্যাশী নয়, নিজেই হিদায়াতের পরিবর্তে
গোমরাহীকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে এবং সত্যের আলোকোজ্জ্বল চেহারা দেখার আগ্রহ যার
মোটেই নেই, আল্লাহ তারই দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেন। সত্যের আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে নিজেই যখন
বাতিলের অন্ধকারে হাতড়ে মরতে চায় তখন আল্লাহও তাকে তারই সুযোগ দেন।
﴿صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ
لَا يَرْجِعُونَ﴾
১৮। তারা কালা, বোবা, অন্ধ১৭। তারা আর ফিরে আসবে না।
১৭. হককথা শোনার ব্যাপারে বধির, হককথা বলার ক্ষেত্রে বোবা এবং হক ও সত্য দেখার প্রশ্নে অন্ধ।
﴿أَوْ كَصَيِّبٍ مِّنَ السَّمَاءِ
فِيهِ ظُلُمَاتٌ وَرَعْدٌ وَبَرْقٌ يَجْعَلُونَ أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِم مِّنَ
الصَّوَاعِقِ حَذَرَ الْمَوْتِ ۚ وَاللَّهُ مُحِيطٌ بِالْكَافِرِينَ﴾
১৯। অথবা এদের
দৃষ্টান্ত এমন যে, আকাশ থেকে
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। তার সাথে আছে অন্ধকার
মেঘমালা, বজ্রের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক। বজ্রপাতের
আওয়াজ শুনে নিজেদের প্রাণের ভয়ে এরা কানে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। আল্লাহ এ
সত্য অস্বীকারকারীদেরকে সবদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছেন।১৮
১৮. কানে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে এরা ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাবে–এ ধারণায় কিছুক্ষণের
জন্য ডুবে যেতে পারে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এভাবে তারা বাঁচতে পারবে না। কারণ আল্লাহ তাঁর সমগ্র শক্তি দিয়ে তাদেরকে ঘিরে রেখেছেন।
﴿يَكَادُ الْبَرْقُ يَخْطَفُ
أَبْصَارَهُمْ ۖ كُلَّمَا أَضَاءَ لَهُم مَّشَوْا فِيهِ وَإِذَا أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ
قَامُوا ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَذَهَبَ بِسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ
عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
২০। বিদ্যুৎ
চমকে তাদের অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যেন বিদ্যুৎ শীগগির তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেবে। যখন
সামান্য একটু আলো তারা অনুভব করে তখন তার মধ্যে তারা কিছুদূর চলে এবং যখন তাদের
ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তারা দাঁড়িয়ে পড়ে।১৯ আল্লাহ চাইলে তাদের
শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি একেবারেই কেড়ে নিতে পারতেন।২০ নিঃসন্দেহে তিনি সবকিছুর ওপর
শক্তিশালী।
১৯. প্রথম দৃষ্টান্তটি ছিল এমন সব মুনাফিকদের যারা মানসিক দিক দিয়ে ঈমান ও ইসলামকে
পুরোপুরি অস্বীকার করতো কিন্তু কোন স্বার্থ ও সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে মুসলমান হয়ে
গিয়েছিল। আর এ দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি
হচ্ছে সন্দেহ, সংশয় ও দ্বিধার শিকার এবং দুর্বল ঈমানের অধিকারীদের। এরা কিছুটা সত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু সে জন্য বিপদ-মুসিবত, কষ্ট–নির্যাতন সহ্য করতে তারা
প্রস্তুত ছিল না। এ
দৃষ্টান্তে বৃষ্টি বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য একটি রহমত রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অন্ধকার মেঘমালা, বিদ্যুৎ চমক ও বজ্রের গর্জন
বলে এখানে সেই ব্যাপক দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ ও সংকটের কথা
বুঝানো হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের মোকাবিলায় জাহেলী শক্তির প্রবল বিরোধিতার মুখে
যেগুলো একের পর এক সামনে আসছিল। দৃষ্টান্তের শেষ অংশে এক অভিনব পদ্ধতিতে এ মুনাফিকদের এ অবস্থার নক্শা আঁকা
হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাপারটি একটু সহজ
হয়ে গেলে তারা চলতে থাকে আবার সমস্যা-সংকটের জট পাকিয়ে গেলে অথবা তাদের প্রবৃত্তি
বিরোধী হয়ে পড়লে বা জাহেলী স্বার্থে আঘাত পড়লে তারা সটান দাঁড়িয়ে যায়।
২০. অর্থাৎ যেভাবে প্রথম ধরনের মুনাফিকদের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপে ছিনিয়ে
নিয়েছিলেন সেভাবে আল্লাহ তাদেরকেও হক ও সত্যের ব্যাপারে কানা ও কালায় পরিণত করতে
পারতেন। কিন্তু যে ব্যক্তি কিছুটা
দেখতে ও শুনতে চায় তাকে ততটুকুও দেখতে শুনতে না দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। যতটুকু হক দেখতে শুনতে তারা প্রস্তুত ছিল
আল্লাহ ততটুকু শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি তাদের আয়ত্বধীনে রেখেছিলেন।
c রুকুঃ ৩ d
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا
رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾
২১। হে মানব
জাতি।২১ ইবাদাত করো তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের ও তোমাদের
পূর্বে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সবার সৃষ্টিকর্তা, এভাবেই তোমরা নিষ্কৃতি লাভের
আশা করতে পারো।২২
২১. যদিও কুরআনের দাওয়াত সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতির জন্য তবুও এ দাওয়াত থেকে
লাভবান হওয়া না হওয়া মানুষের নিজের ইচ্ছা প্রবণতার ওপর এবং সেই প্রবণতা অনুযায়ী
আল্লাহ প্রদত্ত সুযোগের ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রথমে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে কোন ধরনের লোক এ কিতাবের পথনির্দেশনা
থেকে লাভবান হতে পারে এবং কোন ধরনের লোক লাভবান হতে পারে না তা সুস্পষ্ট করে দেয়া
হয়েছে। তারপর এখন সমগ্র মানবজাতির
সামনে সেই আসল কথাটিই পেশ করা হচ্ছে, যেটি পেশ করার জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল।
২২. অর্থাৎ দুনিয়ায় ভুল চিন্তা-দর্শন, ভুল কাজ-কর্ম ও আখেরাতে আল্লাহর আযাব থেকে
নিষ্কৃতিলাভের আশা করতে পারো।
﴿الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ
الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً
فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَّكُمْ ۖ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَندَادًا
وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
২২। তিনিই
তোমাদের জন্য মাটির শয্যা বিছিয়েছেন, আকাশের ছাদ তৈরি করেছেন,
ওপর থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে সব রকমের ফসলাদি
উৎপন্ন করে তোমাদের আহার যুগিয়েছেন। কাজেই
একথা জানার পর তোমরা অন্যদেরকে আল্লাহর প্রতিপক্ষে পরিণত করো না।২৩
২৩. অর্থাৎ যখন তোমরা নিজেরাই একথা স্বীকার করো এবং এ সমস্তই আল্লাহ করেছেন বলে
তোমরা জানো তখন তোমাদের সমস্ত বন্দেগী ও দাসত্ব একমাত্র তাঁর জন্য নির্ধারিত হওয়া
উচিত। আর কার বন্দেগী ও দাসত্ব
তোমরা করবে? আর কে এর অধিকারী হতে পারে? অন্যদেরকে আল্লাহর
প্রতিপক্ষ বানাবার অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দাসত্ব ও বন্দেগীর মধ্য থেকে কোনটিকে
আল্লাহ ছাড়া অন্যদের সাথে সম্পর্কিত করা। সামনের দিকে কুরআন এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে। তা থেকে জানা যাবে, কোন ধরনের ইবাদাত একমাত্র
আল্লাহর জন্য নিদিষ্ট, যাতে অন্যদেরকে শরীক ‘শিরক’–এর অন্তরভুক্ত এবং যার পথ রোধ করার জন্য কুরআন
অবতীর্ণ হয়েছে।
﴿وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ
مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا
شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
২৩। আর যে
কিতাবটি আমি আমার বান্দার ওপর নাযিল করেছি সেটি আমার কিনা-এ ব্যাপারে যদি তোমরা
সন্দেহ পোষণ করে থাকো তাহলে তার মতো একটি সূরা তৈরি করে আনো এবং নিজেদের সমস্ত
সমর্থক গোষ্টীকে ডেকে আনো–এক আল্লাহকে ছাড়া আর যার যার চাও তার সাহায্য নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে
এ কাজটি করে দেখাও।২৪
২৪. ইতিপূর্বে মক্কায় কয়েকবার এ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছিল, যদি তোমরা এ কুরআনকে মানুষের
রচনা মনে করে থাকো তাহলে এর সমমানের কোন বাণী রচনা করে আনো। এখন মদীনায় এসে আবার সেই একই চ্যালেঞ্জের
পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে।
(দেখুন সূরা ইউনূসঃ ৩৮, সূরা হুদঃ ১৩, সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮৮ এবং সূরা আত তূরঃ
৩৩-৩৪)
﴿فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَن
تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ ۖ أُعِدَّتْ
لِلْكَافِرِينَ﴾
২৪। কিন্তু
যদি তোমরা এমনটি না করো আর নিসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবে না, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর২৫, যা তৈরি রাখা হয়েছে সত্য
অস্বীকারকারীদের জন্য।
২৫. এখানে একটি সূক্ষ্ম ইংগিত রয়েছে। অর্থাৎ সেখানে দোজখের ইন্ধন তোমরা একাই হবে না বরং তোমাদের সাথে থাকবে
তোমাদের ঠাকুর ও আরাধ্য দেবতাদের সেই সব মূর্তি যাদেরকে তোমরা মাবুদ ও আরাধ্য
বানিয়ে পূজা করে আসছিলে।
তখন তোমরা নিজেরাই জানতে পারবে খোদায়ী করার ও উপাস্য হবার ব্যাপারে এদের অধিকার
কতটুকু।
﴿وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا
وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
ۖ كُلَّمَا رُزِقُوا مِنْهَا مِن ثَمَرَةٍ رِّزْقًا ۙ قَالُوا هَٰذَا الَّذِي رُزِقْنَا
مِن قَبْلُ ۖ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا ۖ وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ
ۖ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
২৫। আর হে নবী, যারা এ কিতাবের ওপর ঈমান আনবে
এবং(এর বিধান অনুযায়ী) নিজেদের কার্যধারা সংশোধন করে নেবে তাদেরকে এ মর্মে সুখবর
দাও যে, তাদের জন্য
এমন সব বাগান আছে যার নিম্নদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে ঝর্ণাধারা। সেই
বাগানের ফল দেখতে দুনিয়ার ফলের মতই হবে। যখন কোন
ফল তাদের দেয়া হবে খাবার জন্য, তারা বলে উঠবেঃ এ ধরনের ফলই ইতিপূর্বে
দুনিয়ায় আমাদের দেয়া হতো।২৬ তাদের জন্য সেখানে থাকবে পাক-পবিত্র
স্ত্রীগণ২৭ এবং তারা সেখানে থাকবে চিরকাল।
২৬. অর্থাৎ এ ফলগুলো নতুন ও অপরিচিত হবে না। দুনিয়ায় যেসব ফলের সাথে তারা পরিচিত ছিল সেগুলোর সাথে এদের
আকার আকৃতির মিল থাকবে।
তবে হাঁ এদের স্বাদ হবে অনেক গুণ বেশী ও উন্নত পর্যায়ের। যেমন ধরুন আম, কমলা ও ডালিমের মতো হবে অনেকগুলো ফল। জান্নাতবাসীরা ফলগুলো দেখে চিনতে পারবে–এগুলো
আম, এগুলো কমলা
এবং এগুলো ডালিম।
কিন্তু স্বাদের দিক দিয়ে দুনিয়ার আম, কমলা ও ডালিমকে এর সাথে তুলনাই করা যাবে না।
২৭. মূল আরবী বাক্যে ‘আযওয়াজ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে ‘যওজ’। এ অর্থ হচ্ছে ‘জোড়া’। এ শব্দটি স্বামী ও স্ত্রী উভয় অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্বামীর জন্য স্ত্রী হচ্ছে ‘যওজ’। আবার স্ত্রীর জন্য স্বামী হচ্ছে ‘যওজ’। তবে আখেরাতে ‘আযওয়াজ’ অর্থাৎ
জোড়া হবে পবিত্রতার গুণাবলী সহকারে। যদি দুনিয়ায় কোন সৎকর্মশীলা না হয় তাহলে আখেরাতে তাদের
সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সে
ক্ষেত্রে ঐ সৎকর্মশীল পুরুষটিকে অন্য কোন সৎকর্মশীলা স্ত্রী দান করা হবে। আর যদি দুনিয়ায় কোন কোন স্ত্রী হয় সৎকর্মশীলা
এবং তার স্বামী হয় অসৎ তাহলে আখেরাতে ঐ অসৎ স্বামী থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে কোন
সৎপুরুষকে তার স্বামী হিসেবে দেয়া হবে। তবে যদি দুনিয়ায় কোন স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সৎকর্মশীল হয় তাহলে আখেরাতে তাদের
এই সম্পর্কটি চিরন্তন ও চিরস্থায়ী সম্পর্কে পরিণত হবে।
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَسْتَحْيِي
أَن يَضْرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوضَةً فَمَا فَوْقَهَا ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا
فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ ۖ وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَيَقُولُونَ
مَاذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلًا ۘ يُضِلُّ بِهِ كَثِيرًا وَيَهْدِي بِهِ كَثِيرًا
ۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِ إِلَّا الْفَاسِقِينَ﴾
২৬। অবশ্য
আল্লাহ লজ্জা করেন না মশা বা তার চেয়ে তুচ্ছ কোন জিনিসের দৃষ্টান্ত দিতে।২৮ যারা সত্য গ্রহণকারী তারা এ দৃষ্টান্ত–উপমাগুলো দেখে
জানতে পারে এগুলো সত্য, এগুলো এসেছে তাদের রবেরই পক্ষ থেকে, আর যারা (সত্যকে) গ্রহণ করতে
প্রস্তুত নয় তারা এগুলো শুনে বলতে থাকে, এ ধরনের দৃষ্টান্ত–উপমার সাথে
আল্লাহর কী সম্পর্ক? এভাবে আল্লাহ একই কথার সাহায্যে অনেককে
গোমরাহীতে লিপ্ত করেন আবার অনেককে দেখান সরল সোজা পথ।২৯
২৮. এখানে একটি আপত্তি ও প্রশ্নের উল্লেখ না করেই তার জবাব দেয়া হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার
জন্য মশা, মাছি ও মাকড়শা ইত্যাদির দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। বিরোধীরা এর ওপর আপত্তি উঠিয়েছিল,এটা কোন ধরনের আল্লাহর কালাম
যেখানে এই ধরনের তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে? তারা বলতো, এটা আল্লাহর কালাম হলে এর মধ্যে এসব বাজে
কথা থাকতো না।
২৯. অর্থাৎ যারা কথা বুঝতে চায় না, সত্যের মর্ম অনুসন্ধান করে না, তাদের দৃষ্টি তো কেবল শব্দের বাইরের কাঠাতোর ওপর নিবদ্ধ থাকে এবং ঐ
জিনিসগুলো থেকে বিপরীত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সত্য থেকে আরো দূরে চলে যায়। অপর দিকে যারা নিজেরাই সত্য সন্ধানী এবং সঠিক
দৃষ্টিশক্তির অধিকারী তারা ঐ সব কথার মধ্যে সূক্ষ্ম জ্ঞানের আলোকচ্ছটা দেখতে পায়। এ ধরনের জ্ঞানগর্ভ কথা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হতে
পারে বলে তাদের সমগ্র হৃদয় মন সাক্ষ্য দিয়ে ওঠে।
﴿الَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهْدَ
اللَّهِ مِن بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَن يُوصَلَ
وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ﴾
২৭। আর তিনি
গোমরাহীর মধ্যে তাদেরকেই নিক্ষেপ করেন যারা ফাসেক৩০, যারা আল্লাহর সাথে মজবুতভাবে
অংগীকার করার পর আবার তা ভেঙ্গে ফেলে৩১, আল্লাহ যাকে জোড়ার হুকুম
দিয়েছেন তাকে কেটে ফেলে৩২ এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে চলে।৩৩ আসলে এরাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
৩০. ফাসেক তাকে বলে যে নাফরমান এবং আল্লাহর আনুগত্যের সীমা অতিক্রম করে যায়।
৩১. বাদশাহ নিজের কর্মচারী ও প্রজাদের নামে যে ফরমান বা নির্দেশনামা জারী করেন
আরবী ভাষায় প্রচলিত কথ্যরীতিতে তাকে বলা হয় ‘আহদ’ বা অংগীকার। কারণ এই অংগীকার মেনে চলা হয় প্রজাদের
অপরিহার্য কর্তব্যের অন্তরভুক্ত। এখানে অংগীকার শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহর অংগীকার অর্থ হচ্ছে, তাঁর স্থায়ী ফরমান। এই ফরমানের দৃষ্টিতে বলা যায়, সমগ্র মানবজাতি একমাত্র তাঁরই
বন্দেগী, আনুগত্য ও পূজা-উপাসনা করার জন্য আদিষ্ট ও নিযুক্ত
হয়েছে। ‘মজবুতভাবে অংগীকার করার পর’-কথাটি বলে আসলে হযরত আদম আ. এর সৃষ্টির সময় সমগ্র মানবাত্মার নিকট থেকে এ
ফরমানটির আনুগত্য করার যে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। সূরা আল আ’রাফ-এর ১৭২ আয়াতে এই অংগীকারের ওপর তুলনামূলকভাবে
অনেক বেশী বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।
৩২. অর্থাৎ যেসব সম্পর্ককে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত করার ওপর মানুষের ব্যক্তিগত ও
সামষ্টিক কল্যাণ নির্ভর করে এবং আল্লাহ যেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার হুকুম দিয়েছেন, তার ওপর এরা অস্ত্র চালায়। এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটির মধ্যে রয়েছে অর্থের
অশেষ ব্যাপকতা। ফলে দু’টি মানুষের মধ্যকার
পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের পারস্পারিক
সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে যে মানবিক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিশাল জগত
তার সমগ্র অবয়বও এই অর্থের আওতাধীন এসে যায়। সম্পর্ক কেটে ফেলার অর্থ নিছক মানবিক সম্পর্কচ্ছেদ নয় বরং
সঠিক ও বৈধ সম্পর্ক ছাড়া অন্য যত প্রকারের সম্পর্ক কায়েম করা হবে তা সবই এর
অন্তরভুক্ত হবে। কারণ অবৈধ ও ভুল সম্পর্কের
পরিণতি এবং সম্পর্কচেছদের পরিণতি একই। অর্থাৎ এর পরিণতিতে মানুষের পারস্পরিক সর্ম্পক খারাপ হয় এবং নৈতিক ও
সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হয় ধ্বংসের মুখোমুখি।
৩৩. এই তিনটি বাক্যের মধ্যে ফাসেকী ও ফাসেকের চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেয়া
হয়েছে। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার
সম্পর্ক এবং মানুষ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন বা বিকৃত করার অনিবার্য পরিণতি
হচ্ছে বিপর্যয়। আর যে ব্যক্তি এ বিপর্যয়
সৃষ্টি করে সেই হচ্ছে ফাসেক।
﴿كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ
وَكُنتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ۖ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ
تُرْجَعُونَ﴾
২৮। তোমরা
আল্লাহর সাথে কেমন করে কুফরীর আচরণ করতে পারো। অথচ তোমরা
ছিলে প্রাণহীন, তিনি
তোমাদের জীবন দান করেছেন। অতপর তিনি তোমাদের প্রাণ হরণ
করবেন এবং অতপর তিনি তোমাদের জীবন দান করবেন। তরাপর
তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।
﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم
مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَىٰ إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ
سَمَاوَاتٍ ۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
২৯। তিনিই
পৃথিবীতে তোমাদের জন্য সমস্ত জিনিস সৃষ্টি করলেন। তারপর
ওপরের দিকে লক্ষ করলেন এবং সাত আকাশ বিন্যস্ত করলেন৩৪ তিনি সব জিনিসের জ্ঞান রাখেন।৩৫
৩৪. সাত আকাশের তাৎপর্য কি? সাত আকাশ বলতে কি বুঝায়। এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া কঠিন। মানুষ প্রতি যুগে আকাশ বা অন্য কথায় পৃথিবীর বাইরের জগত
সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ ও ধারণা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিভিন্ন চিন্তা ও মতবাদের
অনুসারী হয়েছে। এ চিন্তা ও মতবাদগুলো
বিভিন্ন সময় বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই এর মধ্য থেকে কোন একটি মতবাদ নির্দেশ করে তার ভিত্তিতে কুরআনের এই
শব্দগুলোর অর্থ নির্ণয় করা ঠিক হবে না। তবে সংক্ষেপে এতটুকু বুঝে নিতে হবে যে, সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে যতগুলো জগত আছে
সবগুলোকেই আল্লাহ সাতটি সুদৃঢ় স্তরে বিভক্ত করে রেখেছেন অথবা এই বিশ্ব-জাহানের যে
স্তরে পৃথিবীর অবস্থিতি সেটি সাতটি স্তর সমন্বিত।
৩৫. এই বাক্যটিতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।
একঃ যে আল্লাহ তোমাদের সমস্ত গতিবিধি ও কর্মকান্ডের খবর রাখেন
এবং যার দৃষ্টি থেকে তোমাদের কোন গতিবিধিই গোপন থাকতে পারে না তাঁর মোকাবিলায়
তোমরা কুফরী ও বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করার সাহস কর কেমন করে?
দুইঃ যে আল্লাহ যাবতীয় সত্য জ্ঞানের অধিকারী, যিনি আসলে সমস্ত জ্ঞানের উৎস
তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে মাথা কুটে মরা ছাড়া তোমাদের আর কি
লাভ হতে পারে! তিনি ছাড়া যখন জ্ঞানের আর কোন উৎস নেই, তোমাদের
জীবনের পথ সুস্পষ্টভাবে দেখার জন্য যখন তাঁর কাছ থেকে ছাড়া আর কোথাও থেকে আলো
পাওয়ার সম্ভবনা নেই তখন তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মধ্যে তোমরা নিজেদের জন্য এমন
কি কল্যাণ দেখতে পেলে?
c রুকুঃ ৪ d
﴿وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ
فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ
إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾
৩০। আবার৩৬ সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর
যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের৩৭ বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা-প্রতিনিধি৩৮ নিযুক্ত করতে চাই।” তারা বললো, “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে
নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে?৩৯ আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে
তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি।”৪০ আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না।”৪১
৩৬. ওপরের রুকুতে আল্লাহর বন্দেগী করার আহবান জানানো হয়েছিল। এ আহবানের ভিত্তিভূমি ছিল নিম্নরূপঃআল্লাহ তোমাদের স্রষ্টা
ও প্রতিপালক। তাঁর হাতেই তোমাদের জীবন ও
মৃত্যু। যে বিশ্ব-জগতে তোমরা বাস
করছো তিনিই তার একচ্ছত্র অধিপতি ও সার্বভৌম শাসক। কাজেই তাঁর বন্দেগী ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি তোমাদের জন্য
সঠিক নয়। এখন এই রুকূতে অন্য একটি
ভিত্তিভূমির ওপর ঐ একই আহবান জানানো হয়েছে। অর্থাৎ এই দুনিয়ায় আল্লাহ তোমাদেরকে খলীফাপদে অভিষিক্ত করেছেন। খলীফা হবার কারণে কেবল তাঁর বন্দেগী করলেই
তোমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না বরং এই সংগে তাঁর পাঠানো হিদায়াত ও নির্দেশাবলী
অনুযায়ী জীবন যাপনও করতে হবে। আর যদি তোমরা এমনটি না কর তোমাদের আদি শত্রু শয়তানের ইংগিতে চলতে থাকো, তাহলে তোমরা নিকৃষ্ট পর্যায়ের
বিদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং এ জন্য তোমাদের চরম পরিণতির সম্মুখীন হতে
হবে।
এ প্রসঙ্গে মানুষের স্বরূপও বিশ্ব-জগতে তার মর্যাদা ও ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে
ধরা হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসের এমন
অধ্যায়ও উপস্থাপন করা হয়েছে যে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার দ্বিতীয় কোন মাধ্যম
মানুষের করায়ত্ত নেই। এই
অধ্যায়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত লাভ করা হয়েছে তা প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যায়ে
মাটির তলদেশ খুড়ে বিক্ষিপ্ত অস্থি ও কংকাল একত্র করে আন্দাজ–অনুমানের ভিত্তিতে
সেগুলোর মধ্যে সম্পর্কে স্থাপনের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে অনেক বেশী মূল্যবান।
৩৭. এখানে মূল আরবী শব্দ ‘মালাইকা’ হচ্ছে বহুবচন। একবচন ‘মালাক’। মালাক–এর আসল মানে ‘বাণীবাহক’। এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে “যাকে পাঠানো হয়েছে” বা ফেরেশতা। ফেরেশতা নিছক কিছু কায়াহীন, অস্তিত্বহীন শক্তির নাম নয়। বরং এরা সুস্পষ্ট কায়া ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের
অধিকারী। আল্লাহ তার এই বিশাল
সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় তাদের খেদমত নিয়ে থাকেন। তাদেরকে আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যের কর্মচারী বলা যায়। আল্লাহর বিধান ও নির্দেশাবলী তারা প্রবর্তন
করে থাকেন। মূর্খ লোকেরা ভুলক্রমে
তাদেরকে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও কাজ-কারবারে অংশীদার মনে করে। কেউ কেউ তাদেরকে মনে করে আল্লাহর আত্মীয়। এ জন্য দেবতা বানিয়ে তাদের পূজা করে।
৩৮. যে ব্যক্তি কারো অধিকারের আওতাধীনে তারই অর্পিত ক্ষমতা-ইখতিয়ার ব্যবহার করে
তাকে খলীফা নিজে মালিক নয় বরং আসল মালিকের প্রতিনিধি। সে নিজে ক্ষমতার অধিকারী নয় বরং মালিক তাকে ক্ষমতার অধিকার
দান করেছেন, তাই সে ক্ষমতা ব্যবহার করে। সে নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করার অধিকার রাখে না। বরং মালিকের ইচ্ছে পূরণ করাই হয় তার কাজ। যদি সে নিজেকে মালিক মনে করে বসে এবং তার ওপর
অর্পিত ক্ষমতাকে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে থাকে অথবা আসল মালিককে বাদ দিয়ে
অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে নিয়ে তারই ইচ্ছে পূরণ করতে এবং তার নির্দেশ পালন
করতে থাকে, তাহলে এগুলো সবই বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য হবে।
৩৯. এটা ফেরেশতাদের আপত্তি ছিল না। বরং এটা ছিল তাদের জিজ্ঞাসা। আল্লাহর কোন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করার অধিকারই ফেরেশতাদের ছিল
না। ‘খলীফা’ শব্দটি
থেকে তারা অবশ্যি এতটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, পরিকল্পনায়
উল্লেখিত সৃষ্টিজীবকে,দুনিয়ায় কিছু ক্ষমতা-ইখতিয়ার দান করা
হবে। তবে বিশ্ব-জাহানের এ বিশাল
সাম্রাজ্য আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের আওতাধীনে কোন স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন
সৃষ্টজীব কিভাবে অবস্থান করতে পারে-একথা তারা বুঝতে পারছিল না। এই সাম্রাজ্যের কোন অংশে কাউকে যদি সামান্য
কিছু স্বাধীন ক্ষমতা দান করা হয় তাহলে সেখানকার ব্যবস্থাপনা বিপর্যয়ের হাত থেকে
কিভাবে রক্ষা পাবে, একথা তারা বুঝতে চাইছিল।
৪০. এই বাক্যে ফেরেশতারা একথা বলতে চায়নি যে,খিলাফত তাদেরকে দেয়া হোক কারণ তারাই এর
হকদার। বরং তাদের বক্তব্যের অর্থ
ছিলঃ হে মহান ইচ্ছা অনুযায়ী সমস্ত বিশ্ব-জাহানকে আমরা পাক পবিত্র করে রাখছি। আর এই সাথে আপনার প্রশংসাগীত গাওয়া ও
স্তব-স্তুতি করা হচ্ছে।আমরা
আপনার খাদেমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং আপনার তাসবীহ পড়ছি তাহলে এখন আর
কিসের অভাব থেকে যায়? একজন খলীফার প্রয়োজন দেখা দিল কেন?এর কারণ আমরা
বুঝতে পারছি না।
(তাসবীহ শব্দটির দুই অর্থ হয়। এর একটি অর্থ যেমন পবিত্রতা বর্ণনা করা হয় তেমনি অন্য একটি অর্থ হয় তৎপরতার
সাথে কাজ করা এবং মনোযোগ সহকারে প্রচেষ্টা চালানো। ঠিক এভাবেই তাকদীস শব্দটিরও দুই অর্থ হয়। এক. পবিত্রতার প্রকাশ ও বর্ণনা এবং দুই.
পাক-পবিত্র করা।)
৪১. এটি হচ্ছে ফেরেশতাদের দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব। বলা হয়েছে, খলীফা নিযুক্ত করার কারণ ও প্রয়োজন আমি
জানি, তোমরা তা বুঝতে পারবে না। তোমরা নিজেদের যে সমস্ত কাজের কথা বলছো, সেগুলো যথেষ্ট নয়। বরং এর চাইতেও বেশী আরো কিছু আমি চাই। তাই পৃথিবীতে ক্ষমতা-ইখতিয়ার সম্পন্ন একটি জীব
সৃষ্টি করার সংকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
﴿وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ
كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَٰؤُلَاءِ
إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
৩১। অতপর
আল্লাহ আদমকে সমস্ত জিনিসের নাম শেখালেন৪২ তারপর সেগুলো পেশ করলেন
ফেরেশতাদের সামনে এবং বললেন, “যদি তোমাদের ধারণা সঠিক হয়
(অর্থাৎ কোন প্রতিনিধি নিযুক্ত করলে ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হবে) তাহলে একটু বলতো
দেখি এই জিনিসগুলোর নাম?”
৪২. কোন বস্তুর নামের মাধ্যমে মানুষ তার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে থাকে, এটিই হয় মানুষের জ্ঞানলাভের
পদ্ধতি। কাজেই মানুষের সমস্ত
তথ্যজ্ঞান মূলত বস্তুর নামের সাথে জড়িত। তাই আদমকে সমস্ত নাম শিখিয়ে দেয়ার মানেই ছিল তাঁকে সমস্ত
বস্তুর জ্ঞান দান করা হয়েছিল।
﴿قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا
عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا ۖ إِنَّكَ أَنتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ﴾
৩২। তারা
বললোঃ “ত্রুটিমুক্ত তো একমাত্র আপনারই সত্তা, আমরা তো মাত্র ততটুকু জ্ঞান
রাখি ততটুকু আপনি আমাদের দিয়েছেন।৪৩ প্রকৃতপক্ষে আপনি ছাড়া আর এমন
কোন সত্তা নেই যিনি সবকিছু জানেন ও সবকিছু বোঝেন।”
৪৩. মনে হচ্ছে প্রত্যেকটি ফেরেশতার ওবং ফেরেশতাদের প্রত্যেকটি শ্রেণীর জ্ঞান তার
সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেমন বাতাসের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত আছেন যেসব ফেরেশতা
তারা বাতাস সম্পর্কে সবকিছু জানেন কিন্তু পানি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। অন্যান্য বিভাগের ফেরেশতাদের অবস্থাও এমনি। এদের বিপরীত পক্ষে মানুষকে ব্যাপকতর জ্ঞান দান
করা হয়েছে। এক একটি বিভাগ সম্পর্কে
মানুষকে যে জ্ঞান দান করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ফেরেশতাদের চাইতে তা কোন অংশে
কম হলেও সামগ্রিকভাবে সমস্ত বিভাগের জ্ঞান মানুষকে যেভাবে দান করা হয়েছে তা
ফেরেশতারা লাভ করতে পারেননি।
﴿قَالَ يَا آدَمُ أَنبِئْهُم
بِأَسْمَائِهِمْ ۖ فَلَمَّا أَنبَأَهُم بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ
إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا
كُنتُمْ تَكْتُمُونَ﴾
৩৩। তখন
আল্লাহ আদমকে বললেন, “তুমি
ওদেরকে এই জিনিসগুলোর নাম বলে দাও।” যখন সে তাদেরকে সেসবের নাম
জানিয়ে দিল৪৪ তখন আল্লাহ বললেনঃ “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আকাশ ও পৃথিবীর এমন সমস্ত
নিগূঢ় তত্ত্ব জানি যা তোমাদের অগোচরে রয়ে গেছে? যা কিছু তোমরা প্রকাশ করে
থাকো তা আমি জানি এবং যা কিছু তোমরা গোপন করো তাও আমি জানি।”
৪৪. এই মহড়াটি ছিল ফেরেশতাদের প্রথম সন্দেহের জবাব। এভাবে আল্লাহ যেন জানিয়ে দিলেন, আদমকে আমি কেবল স্বাধীন
ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিচ্ছি না বরং তাকে জ্ঞানও দিচ্ছি। তার নিয়োগে তোমরা যে বিপর্যয়ের আশংকা করছো, তা এ ব্যাপারটির একটি দিক
মাত্র। এর মধ্যে কল্যাণের আর একটি
দিকও আছে। বিপর্যয়ের দিকটির তুলনায় এই
কল্যাণের গুরুত্ব ও মূল্য অনেক বেশী। ছোটখাট ক্ষতি ও অকল্যাণের জন্য বড় রকমের লাভ ও কল্যাণকে উপেক্ষা করা
বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
﴿وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ
اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ
الْكَافِرِينَ﴾
৩৪। তারপর যখন
ফেরেশতাদের হুকুম দিলাম, আদমের সামনে নত হও, তখন সবাই৪৫ অবনত হলো, কিন্তু ইবলিস৪৬ অস্বীকার করলো। সে নিজের
শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মেতে উঠলো এবং নাফরমানদের অন্তরভুক্ত হলো।৪৭
৪৫. এর অর্থ হচ্ছে, পৃথিবী ও তার সাথে সম্পর্কিত মহাবিশ্বের বিভিন্ন
স্তরে যে পরিমাণ ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছেন তাদের সবাইকে মানুষের জন্য অনুগত ও বিজিত
হয়ে যাবার হুকুম দেয়া হয়েছে। যেহেতু এই এলাকায় আল্লাহর হুকুমে মানুষকে তাঁর খলীফার পদে নিযুক্ত করা হচ্ছিল
তাই ফরমান জারী হলোঃআমি মানুষকে যে ক্ষমতা-ইখতিয়ার দান করছি ভালো–মন্দ যে কোন কাজে
মানুষ তা ব্যবহার করতে চাইলে এবং আমার বিশেষ ইচ্ছার অধীন তাকে সেটি করা সুযোগ দেয়া
হলে তোমাদের যার যার কর্মক্ষেত্রের সাথে ঐ কাজের সম্পর্ক থাকবে। তাদের নিজেদের ক্ষেত্রের পরিধি পর্যন্ত ঐ কাজে
তার সাথে সহযোগিতা করা হবে তোমাদের ওপর ফরয। সে চুরি করতে বা নামায পড়তে চাইলে, ভালো কাজ বা মন্দ কাজ করার
এরাদা করলে উভয় অবস্থায় যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করার
অনুমতি দিতে থাকবো ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের দায়িত্ব হবে তার কাজের পরিবেশ সৃষ্টি
করা। উদাহরণ স্বরূপ মনে করুন, কোন বাদশাহ যখন কোন ব্যক্তিকে
নিজের রাজ্যের কোন প্রদেশের বা জেলার শাসক নিযুক্ত করেন তখন তার আনুগত্য করা সেই
এলাকার সমস্ত সরকারী কর্মচারীদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। তিনি কোন সঠিক বা বেঠিক কাজে তার ক্ষমতা ব্যবহার করুন না
কেন যতদিন বাদশাহ চান ততদিন তাকে তার ক্ষমতা ব্যবহার করার সুযোগ দিতে হবে। তবে বাদশাহর পক্ষ থেকে যখন যে কাজটি না করতে
দেয়ার ইংগিত পাওয়া যাবে তখনই সেখানেই ঐ শাসকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব খতম হয়ে যাবে। এ সময় তিনি অনুভব করতে থাকেন যেন চারদিকের
সমস্ত কর্মচারী ও কর্মকর্তারা ধর্মঘট করেছে। এমন কি বাদশাহর পক্ষ থেকে যখন ঐ শাসককে বরখাস্ত ও গ্রেফতার
করার ফরমান জারী হয় তখন কাল পর্যন্ত তার অধীনে যারা কাজ করছিল এবং তার আঙুলের
ইশারায় যারা ওঠা-বসা করতো তারাই আজ তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে তাকে ফাসেক তথা
বিদ্রোহীদের আবাসস্থলের দিকে নিয়ে যেতে একটুও দ্বিধা করে না। ফেরেশতাদেরকে আদমের সামনে সিজদানত হবার হুকুম দেয়া হয়েছিল। এর ধরনটা কিছুটা এই রকমেরই ছিল। হতে পারে কেবল বিজিত হয়ে যাওয়াকেই হয়তো বা
সিজদা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। আবার অনুগত হয়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবে তার বাহ্যিক প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে, এটাও সম্ভবপর। তবে এটাই বেশী সঠিক বলে মনে হয়।
৪৬. ‘ইবলিস’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, “চরম
হতাশ”। আর পারিভাষিক অর্থে এমন একটি জিনকে ইবলিস বলা
হয় যে আল্লাহর হুকুমের নাফরমানি করে আদম ও আদম সন্তানদের অনুগত ও তাদের জন্য বিজিত
হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার ও কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে ভুল পথে চলার প্রেরণা দান করার
জন্য সে আল্লাহর কাছে সময় ও সুযোগ প্রার্থনা করেছিল। আসলে শয়তান ও ইবলিস নিছক কোন জড় শক্তি পিন্ডের নাম নয়। বরং সেও মানুষের মতো একটি কায়া সম্পন্ন
প্রাণীসত্তা। তা ছাড়া সে ফেরেশতাদের
অন্তরভুক্ত ছিল, এ ভুল ধারণাও কারো না থাকা উচিত। কারণ পরবর্তী আলোচনাগুলোয় কুরআন নিজেই তার জিনদের
অন্তরভুক্ত থাকার এবং ফেরেশতাদের থেকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীর সৃষ্টি হওয়ার
ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য পরিবেশন করেছে।
৪৭. এই শব্দগুলো থেকে মনে হয় সম্ভবত শয়তান একা সিজদা করতে অস্বীকার করেনি। বরং তার সাথে জিনদের একটি দলই আল্লাহর
নাফরমানি করতে প্রস্তুত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে একমাত্র শয়তানের নাম নেয়া হয়েছে তাদের নেতা হবার এবং বিদ্রোহের
ক্ষেত্রে সবার চেয়ে বেশী অগ্রসর থাকার কারণে। কিন্তু এই আয়াতটির আর একটি অনুবাদও হতে পারে সেটি হচ্ছেঃ ‘সে ছিল কাফেরদের অন্তরভুক্ত।’ এ অবস্থায় এর অর্থ হবেঃ পূর্ব
থেকেই জিনদের মধ্যে একটি বিদ্রোহী ও নাফরমান দল ছিল এবং ইবলিস এই দলের অন্তরভুক্ত
ছিল। কুরআনে সাধারণভাবে ‘শায়াতীন’ (শয়তানরা) শব্দটি এসব জিনও তাদের বংশধরদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আর কুরআনের যেখানে ‘শায়াতীন’ শব্দের
অর্থ ‘মানুষ’ বুঝার জন্য কোন স্পষ্ট
নিদর্শন ও প্রমাণ নেই সেখানে এর অর্থ হবে জিন শয়তান।
﴿وَقُلْنَا يَا آدَمُ اسْكُنْ
أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا
هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ﴾
৩৫। তখন আমরা
আদমকে বললাম, “তুমি ও তোমার স্ত্রী উভয়েই জান্নাতে থাকো এবং এখানে
স্বাচ্ছন্দের সাথে ইচ্ছে মতো খেতে থাকো, তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না।৪৮ অন্যথায়
তোমরা দু’জন যালেমদের৪৯ অন্তরভুক্ত হয়ে যাবে।”
৪৮. এ থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে অর্থাৎ নিজের কর্মস্থলে খলীফা নিযুক্ত করে পাঠাবার আগে মানসিক
প্রবণতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে তাদের দু’জনকে পরীক্ষা করার জন্য জান্নাতে রাখা হয়। তাদেরকে এভাবে পরীক্ষা করার জন্য একটি গাছ
বাছাই করা হয়। হুকুম দেয়া হয়,ঐ গাছটির কাছে যেয়ো না। গাছটির কাছে গেলে তার পরিণাম কি হবে তাও বলে
দেয়া হয়।বলে দেয়া হয় এমনটি করলে আমার
দৃষ্টিতে তোমরা যালেম হিসেবে গণ্য হবে। সে গাছটি কি ছিল এবং তার মধ্যে এমন কি বিষয় ছিল যেজন্য তার কাছে যেতে নিষেধ
করা হয়-এ বিতর্ক এখানে অবান্তর। নিষেধ করার কারণ এ ছিল না যে, গাছটি প্রকৃতিগতভাবে এমন কোন দোষদুষ্ট ছিল
যার ফলে তার কাছে গেলে আদম ও হাওয়ার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিল। আসল উদ্দেশ্য ছিল আদম ও হাওয়ার পরীক্ষা। শয়তানের প্রলোভনের মোকাবিলায় তারা আল্লাহর এই
হুকুমটি কতটুকু মেনে চলে তা দেখা। এই উদ্দেশ্যে কোন একটি জিনিস নির্বাচন করাই যথেষ্ট ছিল। তাই আল্লাহ কেবল একটি গাছের নাম নিয়েছেন,তার প্রকৃতি সম্পর্কে কোন কথাই
বলেননি।
এই পরীক্ষার জন্য জান্নাতই ছিল সবচেয়ে উপযোগী স্থান। আসলে জান্নাতকে পরীক্ষাগৃহ করার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে একথা
বুঝিয়ে দেয়া যে,মানবিক মর্যাদার প্রেক্ষিতে তোমাদের জন্য জান্নাতই উপযোগী স্থান। কিন্তু শয়তানের প্রলোভনে পড়ে যদি তোমরা
আল্লাহর নাফরমানির পথে এগিয়ে যেতে থাকো তাহরে যেভাবে শুরুতে তোমরা এ থেকে বঞ্চিত
হয়েছিলে তেমনি শেষেও বঞ্চিত হবে। তোমাদের উপযোগী এই আবাসস্থলটি এবং এই হারানো ফিরদৌসটি লাভ করতে হলে তোমাদের
অবশ্যি নিজেদের সেই দুশমনের সফল মোকাবিলা করতে হবে, যে তোমাদেরকে হুকুম মেনে চলার
পথ দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
৪৯. যালেম শব্দটি গভীর অর্থবোধক। ‘যুলুম’
বলা হয় অধিকার হরণকে। যে ব্যক্তি কারো অধিকার হরণ করে সে যালেম। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম পালন করে না, তাঁর নাফরমানি করে সে আসলে
তিনটি বড় বড় মৌলিক অধিকার হরণ করে। প্রথমত সে আল্লাহর অধিকার হরণ করে। কারণ আল্লাহর হুকুম পালন করতে হবে, এটা আল্লাহর অধিকার। দ্বিতীয়ত এই নাফরমানি করতে গিয়ে সে যে সমস্ত
জিনিস ব্যবহার করে তাদের সবার অধিকার সে হরণ করে তার দেহের অংগ-প্রত্যংগ, স্নায়ু মন্ডলী, তার সাথে বসবাসকারী সমাজের অন্যান্য লোক, তার ইচ্ছা
ও সংকল্প পূর্ণ করার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ফেরেশতাগণ এবং যে জিনিসগুলো সে তার কাজে
ব্যবহার করে–এদের সবার তার উপর অধিকার ছিল, এদেরকে কেবলমাত্র
এদের মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু যখন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে তাদের ওপর নিজের
কর্তৃত্ব ব্যবহার করে তখন সে আসলে তাদের ওপর যুলুম করে। তৃতীয়ত তার নিজের অধিকার হরণ করে। কারণ তার ওপর তার আপন সত্তাকে ধ্বংস থেকে বাঁচবার অধিকার
আছে। কিন্তু নাফরমানি করে যখন সে
নিজেকে আল্লাহর শাস্তিলাভের অধিকারী করে তখন সে আসলে নিজের ব্যক্তি সত্তার ওপর
যুলুম করে। এসব কারণে কুরআনের বিভিন্ন
স্থানে ‘গোনাহ’ শব্দটি জন্য যুলুম এবং ‘গোনাহগার’ শব্দটি জন্য যালেম পরিভাষা ব্যবহার করা
হয়েছে।
﴿فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ
عَنْهَا فَأَخْرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِ ۖ وَقُلْنَا اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ
عَدُوٌّ ۖ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَىٰ حِينٍ﴾
৩৬। শেষ
পর্যন্ত শয়তান তাদেরকে সেই গাছটির লোভ দেখিয়ে আমার হুকুমের আনুগত্য থেকে সরিয়ে দিল
এবং যে অবস্থার মধ্যে তারা ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে ছাড়লো। আমি আদেশ
করলাম, “এখন তোমরা
সবাই এখান থেকে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু।৫০ তোমাদের একটি নিদিষ্ট সময়
পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করতে ও জীবন অতিবাহিত করতে হবে।”
৫০. অর্থাৎ মানুষের শক্র শয়তান এবং শয়তানের শক্র মানুষ। শয়তান মানুষের শত্রু, একথা তো সুস্পষ্ট। কারণ সে মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালনের পথ থেকে
সরিয়ে রাখার এবং ধ্বংসের পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু শয়তানের শত্রু মানুষ, একথার অর্থ কি? আসলে শয়তানের প্রতি শত্রুতার মনোভাব পোষণ করাই তো মানবতার দাবী। কিন্তু প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার সামনে সে যে
সমস্ত প্রলোভন এনে হাযির করে মানুষ সেগুলোর দ্বারা প্রতারিত হয়ে তাকে নিজের বন্ধু
ভেবে বসে। এই ধরনের বন্ধুত্বের অর্থ এ
নয় যে, প্রকৃতপক্ষে
শত্রুতা বন্ধুত্বে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, এক শত্রু আর এক শত্রুর হাতে পরাজিত হয়েছে
এবং তার জালে ফেঁসে গেছে।
﴿فَتَلَقَّىٰ آدَمُ مِن رَّبِّهِ
كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾
৩৭। তখন আদম
তার রবের কাছ থেকে কয়েকটি বাক্য শিখে নিয়ে তাওবা করলো।৫১ তার রব তার এই তাওবা কবুল করে
নিলেন। কারণ তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী।৫২
৫১. অর্থাৎ আদম আ. যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, তিনি আল্লাহর নাফরমানির পথ পরিহার করে তাঁর
হুকুম মেনে চলার পথ অবলম্বন করতে চাইলেন এবং তাঁর মনে যখন নিজের রবের কাছে নিজের
গোনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার আকাংখা জাগলো তখন ক্ষমা প্রার্থনা করার ভাষা
তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাঁর অবস্থা দেখে আল্লাহ তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনার ভাষা
তাঁকে শিখিয়ে দিলেন।
তাওবার আসল অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা। বান্দার পক্ষ থেকে তাওবার অর্থ হচ্ছে এই যে, সে সীমালংঘন ও বিদ্রোহের পথ
পরিহার করে বন্দেগীর পথে পা বাড়িয়েছে। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওবা করার অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি নিজের লজ্জিত ও অনুতপ্ত
দাসের প্রতি অনুগ্রহ সহকারে দৃষ্টি দিয়েছেন এবং বান্দার প্রতি তাঁর দান পুনর্বার
বর্ষিত হতে শুরু করেছে।
৫২. গোনাহর ফল অনিবার্য এবং মানুষকে অবশ্যি তা ভোগ করতে হবে, কুরআন এ মতবাদের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ জানায়।
এটা মানুষের মনগড়া ভুল মতবাদগুলোর মধ্যে একটি বড়ই বিভ্রান্তিকর মতবাদ। কারণ যে ব্যক্তি একবার গোনাহে লিপ্ত হয়েছে এই
মতবাদ তাকে চিরকালের জন্য হতাশার সাগরে নিক্ষেপ করে। একবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঐ ব্যক্তি যদি তার অতীতের
ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় এবং ভবিষ্যতে সৎ-সুন্দর জীবন যাপন করতে আগ্রহ হয়, তাহলে এই মতবাদ তাকে বলে তোমার
বাঁচার কোন আশা নেই, যা কিছু তুমি করে এসেছো তার ফল অবশ্যি
তোমাকে ভোগ করতে হবে। এর বিপরীত পক্ষে কুরআন বলে, সৎকাজের পুরস্কার ও অসৎকাজের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা
সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। তোমরা যে সৎকাজের পুরস্কার পাও সেটা তোমাদের সৎকাজের স্বাভাবিক ফল নয়। সেটা আল্লাহর দান। তিনি চাইলে দান করতে পারেন, চাইলে নাও করতে পারেন। অনুরূপভাবে তোমরা যে সৎকাজের পুরস্কার ও
অসৎকাজের শাস্তি লাভ করো সেটা তোমাদের অসৎকাজের অনিবার্য ফল নয়। বরং এ ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতা ও ইখতিয়ার
রয়েছে, তিনি চাইলে
ক্ষমা করতে এবং চাইলে শাস্তি দিতে পারেন। তবে আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত তাঁর জ্ঞানের সাথে গভীর সূত্রে
আবদ্ধ। তিনি জ্ঞানী হবার কারণে
তাঁর ক্ষমতা কর্তৃত্ব অন্ধের মতো ব্যবহার করেন না। কোন সৎকাজের পুরস্কার দেয়ার সময় বান্দা আন্তরিকতার সহকারে, সাচ্চা নিয়তে তাঁর সন্তুষ্টি
অর্জনের উদ্দেশ্যে এই সৎকাজটি করেছে, এ দিকটি বিবেচনা করেই
তিনি তাকে পুরস্কৃত করেন। আর কোন সৎকাজকে প্রত্যাখ্যান করলে এই উদ্দেশ্যে করেন যে, তার বাইরে রূপটি ছিল ঠিক
সৎকাজের মতোই কিন্তু তার ভেতরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নির্ভেজাল প্রেরণা ও
ভাবধারা কার্যকর ছিল না। অনুরূপভাবে বিদ্রোহাত্মক ধৃষ্টতা সহকারে কোন অসৎকাজ করা হলে তার পেছনে যদি
লজ্জার মনোভাবের পরিবর্তে আরো বেশী অপরাধ করার প্রবণতা সক্রিয় থাকে তাহলে এ ধরনের
অপরাধের তিনি শাস্তি দিয়ে থাকেন। আর যে অসৎকাজ করার পর বান্দা লজ্জিত হয় এবং ভবিষ্যতে নিজের সংশোধন প্রয়াসী হয়
এই ধরনের অসৎকাজে ত্রুটি তিনি নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করে দেন। মারাত্মক ধরনের অপরাধী কট্টর কাফেরের জন্যও আল্লাহর দরবার
থেকে নিরাশ হবার কোন কারণ নেই। তবে শর্ত হচ্ছে, সে যদি তার অপরাধ স্বীকার করে, নিজের নাফরমানির জন্য
লজ্জিত হয় এবং বিদ্রোহের মনোভাব ত্যাগ করে আনুগত্যের পথে এগিয়ে চলতে প্রস্তুত হয়,
তাহলে আল্লাহ তার গোনাহ ও ত্রুটি মাফ করে দেবেন।
﴿قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا
جَمِيعًا ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ
عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾
৩৮। আমরা
বললাম, “তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও।৫৩ এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন
হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য
থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা।
৫৩. এই বাক্যটির পুনরাবৃত্তি তাৎপর্যপূর্ণ। আগের বাক্যে বলা হয়েছে আদম তাওবা করলেন এবং আল্লাহ তা কবুল
করে নিলেন। এর অর্থ এই দাঁড়ালো, আদম তাঁর নাফরমানির জন্য
আযাবের হকদার হলেন না। গোনাহগারীর যে দাগ তাঁর গায়ে লেগেছিল তা ধয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। না এ দাগের কোন চিহ্ন তাঁর বা তাঁর বংশধরদের
গায়ে রইলো, ফলে আর না এ প্রয়োজন হলো যে, আল্লাহর–একমাত্র
পুত্রকে (মায়াযাল্লাহ)(নাউযুবিল্লাহ) বনী আদমের গোনাহর কাফফারাহ আদায় করার জন্য
দুনিয়াতে পাঠিয়ে শূলে চড়াতে হলো। বিপরীত পক্ষে মহান আল্লাহ আদম আ. এর কেবল তাওবাই কবুল করে
ক্ষান্ত হননি এবং এরপর আবার তাঁকে নবুওয়াতও দান করলেন। এভাবে তিনি নিজের বংশধরদেরকে সত্য–সহজ পথ দেখিয়ে গেলেন।
এখানে আবার জান্নাত থেকে বের করে দেয়ার হুকুমের পুনরাবৃত্তি করে একথা বুঝানো
হয়েছে যে, আদমকে পৃথিবীতে না নামিযে জান্নাতে রেখে দেয়া তাওবা কবুলিয়াতের অপরিহার্য
দাবী ছিল না।
পৃথিবী তাঁর জন্য দারুল আযাব বা শাস্তির আবাস ছিল না। শাস্তি দেয়ার জন্য তাঁকে এখানে পাঠানো হয়নি। বরং তাঁকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করার জন্য
সৃষ্টি করা হয়েছিল। জান্নাত তাঁর আসল কর্মস্থল
ছিল না। সেখান থেকে বের করে দেয়ার
হুকুম তাঁকে শাস্তি দেয়ার পর্যায়ভুক্ত ছিল না। তাঁকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়াটাই ছিল মূল পরিকল্পনার
অন্তরভুক্ত। তবে এর আগে ৪৮ নং টীকার যে
পরীক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেই পরীক্ষার জন্যই তাকে জান্নাতে রাখা হয়েছিল।
﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا
بِآيَاتِنَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
৩৯। আর যারা
একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে৫৪ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা
হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।”৫৫
৫৪. আরবীতে আয়াতের আসল মানে হচ্ছে নিশানী বা আলামত। এই নিশানী কোন জিনিসের পক্ষ থেকে পথনির্দেশ দেয়। কুরআনে এই শব্দটি চারটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে
ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও এর অর্থ হয়েছে নিছক
আলামত বা নিশানী। কোথাও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও
প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনসমূহকে বলা হয়েছে আল্লাহর আয়াত। কারণ এই বিশ্ব-জাহানের অসীম ক্ষমতাধর আল্লাহর সৃষ্টি
প্রতিটি বস্তুই তার বাহ্যিক কাঠামোর অভ্যন্তরে নিহিত সত্যের প্রতি ইংগিত করছে। কোথাও নবী-রাসূলগণ যেসব ‘মু’জিযা’ (অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম)দেখিয়েছেন সেগুলোকে বলা হয়েছে আল্লাহর আয়াত। কারণ নবী-রাসূলগণ যে এ বিশ্ব-জাহানের সার্বভৌম
ক্ষমতাসম্পন্ন প্রভুর প্রতিনিধি এই মু’জিযাগুলো ছিল আসলে তারই প্রমাণ ও আলামত। কোথাও কুরআনের বাক্যগুলোকে আয়াত বলা হয়েছে। কারণ এ বাক্যগুলো কেবল সত্যের দিকে পরিচালিত
করেই ক্ষান্ত নয় বরং প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কোন কিতাবই এসেছে, তার কেবল বিষয়বস্তুই নয়,
শব্দ, বর্ণনাভংগী ও বাক্য গঠনরীতির মধ্যেও এই
গ্রন্থের মহান মহিমান্বিত রচয়িতার অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যের নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্টভাবে
অনুভূত হয়েছে।
কোথায় ‘আয়াত’ শব্দটি কোন অর্থ গ্রহণ করতে হবে তা বাক্যের
পূর্বাপর আলোচনা থেকে সর্বত্র সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।
৫৫. এটা হচ্ছে সৃষ্টির প্রথম থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানব জাতির জন্য আল্লাহম
স্থায়ী ফরমান। তৃতয়ি রুকূতে এটিকেই
আল্লাহর ‘অংগীকার’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।নিজেই নিজের পথ তৈরি করে নেয়া মানুষের কাজ নয়। বরং একদিকে বান্দা এবং অন্যদিকে খলীফার
দ্বিবিধ ভূমিকা পালনের লক্ষে তার রব-নির্ধারিত পথের অনুসরণ করার জন্যই সে নিযুক্ত
হয়েছে। দু’টো উপায়ে এ পথের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। একঃ কোন মানুষের কাছে সরাসরি আল্লাহ পক্ষ থেকে অহী আসতে
পারে। দুইঃ অথবা যে মানুষটির কাছে অহী এসেছে,তার অনুসরণ করা যেতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের তৃতীয় কোন পথ নেই। এ দু’টি পথ ছাড়া বাদবাকি সমস্ত পথই মিথ্যা ও
ভুল। শুধু ভুলই নয়, প্রত্যক্ষ বিদ্রোহের পথও। আর এর শাস্তি জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়।
কুরআন মজীদের সাতটি জায়গায় আদমের জন্ম ও মানব জাতির সূচনা কালের ইতিহাস বিবৃত
হয়েছে। এ সাতটি জায়গার মধ্যে এটিই
হচ্ছে প্রথম এবং আর ছয়টি জায়গায় হচ্ছেঃ সূরা আল আ’রাফ ২য় রুকু, আল হিজরঃ ৩য় রুকু, বনী ইসরাঈলঃ ৭ম রুকূ, আল কাহাফ ৭ম রুকু, ত্বা-হাঃ ৭ম রুকু, এবং ছোয়াদঃ ৫ম রুকু। বাইবেলের জন্ম অধ্যায়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অনুচ্ছেদেও এ কাহিনী
বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু বাইবেল ও কুরআন উভয়ের বর্ণনার তুলনা করার পর একজন বিবেকবান ও সুস্থ
জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি নিজেই উভয় কিতাবের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারবেন।
আদম আ. এর সৃষ্টিকালীন আল্লাহ ও ফেরেশতাদের মধ্যকার কথাবার্তার বর্ণনা
তালমূদেও উদ্ধৃত হয়েছে।
কিন্তু কুরআন বর্ণিত কাহিনীতে যে গভীর অন্তরনিহিত প্রাণসত্তার সন্ধান পাওয়া যায়, সেখানে তা অনুপস্থিত। বরং সেখানে কিছু রসাত্মক আলাপও পাওয়া যায়। যেমন, ফেরেশতারা আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হচ্ছে?’ জবাবে আল্লাহ বললেন,
‘এ জন্য যে, তাদের মধ্যে সৎলোক জন্ম নেবে।’ অসৎলোকদের কথা আল্লাহ বললেন না। অন্যথায় ফেরেশতারা মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে
আল্লাহর পরিকল্পনার পক্ষে অনুমোদন দিতেন না। [Talmudic
Miscellany, paul Issac Herson, London 1880. p. 294-95]
c রুকুঃ ৫ d
﴿يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا
نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَوْفُوا بِعَهْدِي أُوفِ بِعَهْدِكُمْ
وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ﴾
৪০। হে বনী
ইসরাঈল।৫৬ আমার সেই নিয়ামতের কথা মনে
করো, যা আমি
তোমাদের দান করেছিলাম, আমার সাথে তোমাদের যে অংগীকার ছিল, তা পূর্ণ করো, তা হলে তোমাদের সাথে আমার যে
অংগীকার ছিল,তা আমি পূর্ণ করবো এবং তোমরা একমাত্র আমাকেই
ভয় করো।
৫৬. ‘ইসরাঈল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আবদুল্লাহ বা আল্লাহর
বান্দা। এটি হযরত ইয়া’কুব আ. এর
উপাধি। আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি এ
উপাধিটি লাভ করেছিলেন।
তিনি ছিলেন হযরত ইসহাক আ. এর পুত্র ও ইব্রাহীম আ. এর প্রপুত্র। তাঁরই বংশধরকে বলা হয় বনী ইসরাঈল। আগের চারটি রুকূতে যে ভাষণ পেশ করা হয়েছে তা
একটি ভূমিকামূলক ভাষণ। এই
ভাষনে সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এখন এই পঞ্চম রুকূ থেকে চৌদ্দ রুকু পর্যন্ত যে ভাষণ
চলছে, এটি একটি
ধারাবাহিক ভাষণ। এই
ভাষণে মূলত বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে কোথাও কোথাও খৃস্টান ও আরবের মুশ্রিকদের
দিকে লক্ষ করেও কথা বলা হয়েছে। আবার সুবিধামতো কোথাও হযরত মুহাম্মাদ সা. এর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে যারা ইসলামের
ওপর ঈমান এনেছিল তাদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছে। এ ভাষণটি পড়ার সময় নিম্নোক্ত কথাগুলো বিশেষভাবে সামনে
রাখতে হবেঃ
একঃ পূর্ববর্তী নবীদের উম্মাতের মধ্যে এখনো কিছু সংখ্যক
সত্যনিষ্ঠ এবং সৎবৃত্তি ও সদিচ্ছাসম্পন্ন লোক রয়ে গেছে। মুহাম্মাদ সা.কে যে সত্যের আহবায়ক এবং যে আন্দোলনের
মহানায়ক করে পাঠানো হয়েছে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনার এবং তাঁর আন্দোলনে শরীক
হবার জন্য আহবান জানানোই এ ভাষণের উদ্দেশ্য। তাই তাদের বলা হচ্ছে, ইতিপূর্বে তোমাদের নবীগণ এবং তোমাদের কাছে
আগত সহীফাগুলো যে দাওয়াত ও আন্দোলন নিয়ে বার বার এসেছিল এই কুরআন ও এই নবী সেই একই
দাওয়াত ও আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। প্রথমে এটি তোমাদেরকেই দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তোমরা নিজেরা এ পথে চলবে এবং অন্যদেরকেও
এদিকে আহবান জানাবে এবং এ পথে চালাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু অন্যদেরকে পথ দেখানো তো দূরের কথা তোমরা নিজেরাই সে
পথে চলছো না। তোমরা বিকৃতির পথেই এগিয়ে
চলছো। তোমাদের ইতিহাস এবং তোমাদের
জাতির বর্তমান নৈতিক ও দীনি অবস্থাই তোমাদের বিকৃতির সাক্ষ্য দিয়ে চলছে। এখন আল্লাহ সেই একই জিনিস দিয়ে তাঁর এক
বান্দাকে পাঠিয়েছেন এটি কোন নতুন ও অজানা জিনিস নয়। তোমাদের নিজেদের জিনিস। কাজেই জেনে-বুঝে সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করো না। বরং তাকে মেনে নাও। যে কাজ তোমাদের করার ছিল কিন্তু তোমরা করোনি। সেই কাজ অন্যেরা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। তোমরা তাদের সাথে সহযোগিতা করো।
দুইঃ সাধারণ ইহুদিদের কাছে চূড়ান্ত কথা বলে দেয়া এবং তাদের দীনি
ও নৈতিক অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্যে। তোমাদের নবীগণ যে দীনের পতাকাবাহী ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ
সা. সে দীনেরই দাওয়াত দিচ্ছেন–একথাটিই তাদের সামনে প্রমাণ করা হয়েছে। দীনের মূলনীতির মধ্যে এমন একটি বিষয়ও নেই
যেখানে কুরআনের শিক্ষা তাওরাতের শিক্ষা থেকে আলাদা-একথাই তাদের সামনে তুলে ধরা
হয়েছিল তার আনুগত্য করার এবং নেতৃত্বের যে দায়িত্ব তোমাদেরকে ওপর অর্পণ করা হয়েছিল
তার হক আদায় করার ব্যাপারে তোমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছো। এমন সব ঘটনাবলী থেকে এর সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যার
প্রতিবাদ করা তাদের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। আবার সত্যকে জানার পরও যেভাবে তারা তার বিরোধিতায় চক্রান্ত, বিভ্রান্তি সৃষ্টি, হঠধর্মিতা, কূটতর্ক ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছিল এবং
মুহাম্মাদ সা. এর মিশনকে সফলকাম হতে না দেয়ার জন্য যেমন পদ্ধতি অবলম্বন করছিল তা
সবই ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। এ থেকে একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, তাদের বাহ্যিক ধার্মিকতা নিছক একটি ভন্ডামি
ছাড়া আর কিছুই নয়। এর
পেছনে সক্রিয় রয়েছে বিশ্বস্ততা ও সত্যনিষ্ঠার পরিবর্তে হঠধর্মিতা, অজ্ঞতা মূর্খতাপ্রসূত বিদ্বেষ
ও স্বার্থান্ধতা।
আসলে সৎকর্মশীলতার কোন কাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি তারা চায় না। এভাবে চূড়ান্ত কথা বলে দেয়ায় যে সুফল হয়েছে তা হচ্ছে এই যে
একদিকে ঐ জাতির মধ্যে যেসব সৎলোক ছিল তাদের চোখ খুলে গেছে এবং অন্যদিকে মদীনার
জনগণের বিশেষ করে আরবদেশের মুশরিকদের ওপর তাদের যে ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাব ছিল, তা খতম হয়ে গেছে। তৃতীয়ত নিজেদের আবরণহীন চেহারা দেখে তারা
নিজেরাই হিম্মতহারা হয়ে গেছে। ফলে নিজের সত্যপন্থী হবার ব্যাপারে যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ রূপে নিশ্চিত সে যেমন
সৎসাহস ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলায় এগিয়ে আসে তেমনটি করা তাদের পক্ষে কোনদিন সম্ভব নয়।
তিনঃ আগের চারটি রুকূতে সমগ্র মানবজাতিকে সাধারণভাবে দাওয়াত দিয়ে
যেসব কথা বলা হয়েছিল সে একই প্রসংগে যে জাতি আল্লাহ প্রেরিত মুখ ফিরিয়ে নেয় তেমনি
একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত দিয়ে তার পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য বনী ইসরাঈলকে বাছাই করার
একটি বিশেষ কারণ রয়েছে।
পৃথিবীর অসংখ্য জাতিদের মধ্যে বর্তমান বিশ্বে একমাত্র বনী ইসরাঈলই ক্রমাগত চার
হাজার বছর থেকে সমগ্র মানবজাতির সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে আছে। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার পথে কোন
জাতির জীবনে যত চড়াই উতরাই আসতে পারে তার সবগুলোরই সন্ধান পাই আমরা এ জাতিটির
মর্মান্তিক ইতিকথায়।
চারঃ মুহাম্মাদ সা. এর অনুসারীদের শিক্ষা দেয়াই এর উদ্দেশ্য। পূর্ববর্তী নবীদের উম্মাতরা অধপতনের যে গভীর
গর্তে পড়ে গিয়েছিল তা থেকে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে রক্ষা করাই এর লক্ষ। ইহুদিদের নৈতিক দুর্বলতা, ধর্মীয় বিভ্রান্তি এবং বিশ্বাস
ও কর্মের গলদগুলোর মধ্যে থেকে প্রতিটির দিকে অংগুলি নির্দেশ করে তার মোকাবিলায়
আল্লাহর সত্য দীনের দাবীসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে মুসলমানরা পরিষ্কারভাবে নিজেদের পথ দেখে নিতে পারবে
এবং ভুল পথ থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হবে। এ প্রসংগে ইহুদি ও খৃস্টানদের সমালোচনা করে কুরআন যা কিছু বলেছে সেগুলো পড়ার
সময় মুসলমানদের অবশ্যি নবী সা. এর একটি বিখ্যাত হাদীস মনে রাখা উচিত। হাদীসটিতে তিনি বলেছেনঃ তোমরাও অবশেষে
পূর্ববর্তী উম্মাতদের কর্মনীতির অনুসরণ করবেই। এমন কি তারা যদি কোন গো-সাপের গর্তে ঢুকে থাকে, তাহলে তোমরাও তার মধ্যে ঢুকবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি
ইহুদি ও খৃস্টানদের কথা বলছেন? জবাব দিলেন, তাছাড়া আর কি? নবী সা. এর এ উক্তিটি কেবলমাত্র একটি
ভীতি প্রদর্শনই ছিল না বরং আলাহ প্রদত্ত গভীর অন্তরদৃষ্টির মাধ্যমে তিনি জানতে
পেরেছিলেন, বিভিন্ন নবীর উম্মাতের মধ্যে বিকৃতি এসেছিল কোন কোন
পথে এবং কো্ন আকৃতিতে তার প্রকাশ ঘটেছিল।
﴿وَآمِنُوا بِمَا أَنزَلْتُ
مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍ بِهِ ۖ وَلَا تَشْتَرُوا
بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَإِيَّايَ فَاتَّقُونِ﴾
৪১। আর আমি যে
কিতাব পাঠিয়েছি তার ওপর ঈমান আন। তোমাদের
কাছে আগে থেকেই যে কিতাব ছিল এটি তার সত্যতা সমর্থনকারী। কাজেই
সবার আগে তোমরাই এর অস্বীকারকারী হয়ো না। সামান্য
দামে আমার আয়াত বিক্রি করো না।৫৭ আমার গযব থেকে আত্মরক্ষা করো।
৫৭. ‘সামান্য দাম’ বলে দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের কথা
বুঝানো হয়েছে। এর
বিনিময়ে মানুষ আল্লাহর বিধান প্রত্যাখ্যান করছিল। সত্যকে বিক্রি করে তার বিনিময়ে সারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ
হাসিল করলেও তা আসলে সামান্য দামই গণ্য হবে। কারণ সত্য নিসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান।
﴿وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ
بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
৪২। মিথ্যার
রঙে রাঙিয়ে সত্যকে সন্দেহযুক্ত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করার চেষ্টা করো
না।৫৮
৫৮. এ আয়াতটির অর্থ বুঝার জন্য সমকালীন আরবের শিক্ষাগত অবস্থাটা সামনে থাকা দরকার। আরববাসীরা সাধারণভাবে ছিল অশিক্ষিত। তাদের তুলনায় ইহুদিদের মধ্যে এমনিতেই শিক্ষার
চর্চা ছিল অনেক বেশী।
তাছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইহুদিদের মধ্যে এমন অনেক বড় বড় আলেম ছিলেন যাদের খ্যাতি
আরবের গন্ডী ছাড়িয়ে বিশ্ব পর্যায়ে ও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই আরবদের ওপর ইহুদিদের ‘জ্ঞানগত’ প্রতিপত্তি
ছিল অনেক বেশী। এর
ওপর ছিল আবার তাদের উলামা ও মাশায়েখের ধর্মীয় দরবারের বাহ্যিক শান–শওকত। এসব জাঁকালো দরবারে বসে তারা ঝাঁড়-ফুঁক, দোয়া-তাবিজ ইত্যাদির কারবার
চালিয়েও জনগণের ওপর নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি গভীরতর ও ব্যাপকতর করেছিলেন। বিশেষ করে মদীনাবাসীদের ওপর তাদের প্রভাব ছিল
প্রচন্ড। কারণ তাদের আশেপাশে ছিল বড়
বড় ইহুদি গোত্রের আবাস।
ইহুদিদের সাথে তাদের রাতদিন ওঠাবসা ও মেলামেশা চলতো। একটি অশিক্ষিত জনবসতি যেমন তার চাইতে বেশ শিক্ষিত, বেশী সংস্কৃতিবান ও বেশী
সুস্পষ্ট ধর্মীয় গুণাবলীর অধিকারী প্রতিবেশীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, এই মেলামেশায় মদীনাবাসীরাও ঠিক তেমনী ইহুদিদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত
হয়ে থাকে, এই মেলামেশায় মদীনাবাসীরাও ঠিক তেমনি ইহুদিদের
দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এ অবস্থায় নবী সা. যখন নিজেকে নবী হিসেবে পেশ করলেন এবং লোকদেরকে ইসলামের
দিকে দাওয়াত দিতে থাকলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই অশিক্ষিত আরবরা আহলে কিতাব ইহুদিদের
কাছে দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, “আপনারাও তো একজন নবীর অনুসারী এবং একটি আসমানী কিতাব মেনে চলেন, আপনারাই বলুন, আমাদের মধ্যে এই যে ব্যক্তি নবুওয়াতের
দাবী করছেন তাঁর এবং তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কি?” মক্কার লোকেরাও ইতিপূর্বে ইহুদিদের কাছে এ প্রশ্নটি বার বার করেছিল। রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় আসার পর এখানেও বহু লোক ইহুদি
আলেমদের কাছে গিয়ে একথা জিজ্ঞেস করতো। কিন্তু ইহুদি আলেমরা কখনো এর জবাবে সত্য কথা বলেনি। ডাহা মিথ্যা কথা তাদের জন্য কঠিন ছিল। যেমন, মুহাম্মাদ সা. যে তাওহীদ পেশ করছেন তা মিথ্যা। অথবা আম্বিয়া, আসমানী গ্রন্থসমূহ, ফেরেশতা ও আখেরাত সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য সঠিক নয়। অথবা তিনি যে নৈতিক মূলনীতি শিক্ষা দিচ্ছেন
তার মধ্যে কোন গলদ রয়ে গেছে। হবে যা কিছু তিনি পেশ করছেন তা সঠিক ও নির্ভুল-এ ধরনের স্পষ্ট ভাষায় সত্যের স্বীকৃতি
দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল না তারা প্রকাশ্য সত্যের প্রতিবাদ করতে পারছিল না আবার
সোজাসুজি তাকে সত্য বলে মেনে নিতেও প্রস্তুত ছিল না। এ দু’টি পথের মাঝখানে তারা তৃতীয় একটি পথ অবলম্বন করলো। প্রত্যেক প্রশ্নকারীর মনে তারা নবী সা., তাঁর জামায়াত ও তাঁর মিশনের
বিরুদ্ধে কোন না কোন অসঅসা-প্ররোচনা দিয়ে দিত। তাঁর বিরুদ্ধে কোন না কোন অভিযোগ আনতো, এমন কোন ইংগিতপূর্ণ কথা বলতো
যার ফলে লোকেরা সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে পড়ে যেতো। এভাবে তারা মানুষের এবং তাদের মাধ্যমে নবী সা. ও তাঁর
অনুসারীদেরকেও আটকাতে চাইতো। তাদের এ দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতির কারণে তাদেরকে বলা হচ্ছেঃ সত্যের গায়ে
মিথ্যার আবরণ চড়িয়ে দিয়ো না। নিজেদের মিথ্যা প্রচারণা এবং শয়তানী সন্দেহ-সংশয় আপত্তির সাহায্য সত্যকে
দাবিয়ে ও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করো না। সত্য ও মিথ্যা মিশ্রণ ঘটিয়ে দুনিয়াবাসীকে প্রতারিত করো না।
﴿وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا
الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ﴾
৪৩। নামায
কায়েম করো, যাকাত দাও৫৯ এবং যারা
আমার সামনে অবনত হচ্ছে তাদের সাথে তোমরাও অবনত হও।
৫৯. নামায ও যাকাত প্রতি যুগে দীন ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত
হয়ে এসেছে। অন্যান্য সব নবীদের মতো বনী
ইসরাঈলদের নবীরাও এর প্রতি কঠোর দাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইহুদিরা এ ব্যাপানে গাফেল হয়ে পড়েছিল। তাদের সমাজে জামায়াতের সাথে নামায পড়ার
ব্যবস্থাপনা প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বেশীর ভাগ লোক ব্যক্তিগত পর্যায়েও নামায ছেড়ে দিয়েছিল। আর যাকাত দেয়ার পরিবর্তে তারা সুদ খেতো।
﴿أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ
وَتَنسَوْنَ أَنفُسَكُمْ وَأَنتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ﴾
৪৪। তোমরা
অন্যদের সৎকর্মশীলতার পথ অবলম্বন করতে বলো কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে যাও। অথচ তোমরা
কিতাব পাঠ করে থাকো। তোমরা কি জ্ঞান বুদ্ধি একটুও
কাজে লাগাও না?
﴿وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ
وَالصَّلَاةِ ۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ﴾
৪৫। সবর ও
নামায সহকারে সাহায্য নাও।৬০ নিসন্দেহে নামায বড়ই কঠিন কাজ,
৬০. অর্থাৎ যদি সৎকর্মশীলতার পথে চলা তোমরা কঠিন মনে করে থাকো তাহলে সবর ও নামায
এই কাঠিন্য দূর করতে পারে। এদের সাহায্যে শক্তি সঞ্চয় করলে এ কঠিন পথ পাড়ি দেয়া তোমাদের জন্য সহজ হয়ে
যাবে।
সবর শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, বাধা দেয়া, বিরত রাখা
ও বেঁধেঁ রাখা। এ
ক্ষেত্রে মজবুত ইচ্ছা, অবিচল সংকল্প ও প্রবৃত্তির আশা–আকাংখাকে এমনভাবে শৃংখলাবদ্ধ করা বুঝায়,
যার ফলে এক ব্যক্তি প্রবৃত্তির তাড়না ও বাইরের সমস্যাবলীর মোকাবিলায়
নিজের হৃদয় ও বিবেকের পছন্দনীয় পথে অনবরত এগিয়ে যেতে থাকে। এখানে আল্লাহর এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই নৈতিক গুণটিকে নিজের মধ্যে
লালন করা এবং বাইর থেকে একে শক্তিশালী করার জন্য নিয়মিত নামায পড়া।
﴿الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم
مُّلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ﴾
৪৬। কিন্তু
সেসব অনুগত বান্দাদের জন্য কঠিন নয় যারা মনে করে, সবশেষে তাদের মিলতে হবে তাদের
রবের সাথে এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।৬১
৬১. অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগত নয় এবং আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তার জন্য নিয়মিত নামায পড়া
একটি আপদের শামিল। এ
ধরনের আপদে সে কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে আল্লাহর আনুগত্যে
নিজেকে সোপর্দ করেছে এবং যে ব্যক্তি মৃত্যুর পর তার মহান প্রভুর সামনে হাযির হবার
কথা চিন্তা করে, তার জন্য নামায পড়া নয়, নামায ত্যাগ করাই কঠিন।
c রুকুঃ ৬ d
﴿يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا
نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ﴾
৪৭। হে বনী
ইসরাঈল! আমার সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ করো, যা আমি তোমাদের দান করেছিলাম
এবং একথাটিও যে, আমি
দুনিয়ার সমস্ত জাতিদের ওপর তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম।৬২
৬২. এখানে সেই যুগের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যখন দুনিয়ার সকল জাতির মধ্যে একমাত্র
বনী ইসরাঈলের কাছে আল্লাহ প্রদত্ত সত্যজ্ঞান ছিল এবং তাদেরকে বিশ্বের জাতিসমূহের
নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। অন্যান্য জাতিদেরকে আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বের পথে আহবান করাই ছিল তার
দায়িত্ব।
﴿وَاتَّقُوا يَوْمًا لَّا
تَجْزِي نَفْسٌ عَن نَّفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ
مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنصَرُونَ﴾
৪৮। আর ভয় করো
সেই দিনকে যেদিন কেউ কারো সামান্যতমও কাজে লাগবে না, কারো পক্ষ থেকে সুপারিশ গৃহীত
হবে না, বিনিময় নিয়ে
কাউকে ছেড়ে দেয়া হবে না এবং অপরাধীরা কোথাও থেকে সাহায্য লাভ করতে পারবে না।৬৩
৬৩. বনী ইসরাঈলদের আখেরাত সম্পর্কিত আকীদার মধ্যে গলদের অনুপ্রবেশ ছিল তাদের
বিকৃতির অন্যতম বড় কারণ। এ
ব্যাপারে তারা এক ধরনের উদ্ভট চিন্তা পোষণ করতো। তারা মনে করতো, তারা মহান মর্যাদা সম্পন্ন নবীদের সন্তান। বড় বড় আউলিয়া, সৎকর্মশীল ব্যক্তি, আবেদ ও যাহেদদের সাথে তারা সম্পর্কিত। ঐ সব মহান মনীষীদের বদৌলতে তাদের পাপ মোচন হয়ে যাবে। তাদের সাথে সম্পর্কিত হয়ে এবং তাদের আস্তিন
জড়িয়ে ধরে থাকার পরও কোন ব্যক্তি কেমন করে শাস্তি লাভ করতে পারে। এসব মিথ্যা নির্ভরতা ও সান্ত্বনা তাদেরকে দীন
থেকে গাফেল করে গোনাহের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়ামত ও আল্লাহর অসীম অনুগ্রহের কথা স্মরণ করাবার
সাথে সাথেই তাদের এই ভুল ধারণাগুলো দূর করা হয়েছে।
﴿وَإِذْ نَجَّيْنَاكُم مِّنْ
آلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبْنَاءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ
نِسَاءَكُمْ ۚ وَفِي ذَٰلِكُم بَلَاءٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَظِيمٌ﴾
৪৯। স্মরণ করো
সেই সময়ের কথা৬৪ যখন আমরা ফেরাউনী দলের৬৫ দাসত্ব থেকে তোমাদের মুক্তি
দিয়েছিলাম। তারা তোমাদের কঠিন যন্ত্রণায় নিমজ্জিত
করে রেখেছিল, তোমাদের পুত্র সন্তানদের যবেহ করতো এবং তোমাদের
কন্যা সন্তানদের জীবিত রেখে দিতো। মূলত এ
অবস্থায় তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য বড় কঠিন পরীক্ষা ছিল।৬৬
৬৪. এখান থেকে নিয়ে পরবর্তী কয়েক রুকূ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে যেসব ঘটনার প্রতি
ইংগিত করা হয়েছে সেগুলো সবই বনী ইসরাঈলদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ঘটনা। ইসরাঈল জাতির যুব-বৃদ্ধ-শিশু নির্বেশেষে সবাই
সেগুলো জানতো। তাই ঘটনাগুলোর বিস্তারিত
আলোচনা না করে এক একটি ঘটনার প্রতি সংক্ষেপে ইংগিত করা হয়েছে মাত্র। এই ঐতিহাসিক বর্ণনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ আসলে
যে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চান সেটি হচ্ছে এই যে, একদিকে আল্লাহ তোমাদের প্রতি
এসব অনুগ্রহ করেছিলেন আর অন্যদিকে তার জবাবে এসব হচ্ছে তোমাদের কীর্তিকলাপ।
৬৫. ‘আলে ফেরাউন’ শব্দের অনুবাদ করেছি আমি “ফেরাউনী দল”।এতে ফেরাউনের বংশ ও মিসরের শাসকশ্রেণী উভয়ই
অন্তরভুক্ত হয়েছে।
৬৬. যে চুল্লীর মধ্যে তোমাদের নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা থেকে তোমরা খাঁটি সোনা হয়ে
বের হও, না ভেজাল হয়ে–এরি ছিল পরীক্ষা। এত বড় বিপদের মুখ থেকে অলৌকিকভাবে মুক্তি লাভ করার পরও
তোমরা আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হও কি না, এ মর্মেও ছিল পরীক্ষা।
﴿وَإِذْ فَرَقْنَا بِكُمُ
الْبَحْرَ فَأَنجَيْنَاكُمْ وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ وَأَنتُمْ تَنظُرُونَ﴾
৫০। স্মরণ করো
সেই সময়ের কথা যখন আমরা সাগর চিরে তোমাদের জন্য পথ করে দিয়েছিলাম, তারপর তার মধ্য দিয়ে তোমাদের
নির্বিঘ্নে পার করে দিয়েছিলাম, আবার সেখানে তোমাদের চোখের
সামনেই ফেরাউনী দলকে সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম।
﴿وَإِذْ وَاعَدْنَا مُوسَىٰ
أَرْبَعِينَ لَيْلَةً ثُمَّ اتَّخَذْتُمُ الْعِجْلَ مِن بَعْدِهِ وَأَنتُمْ ظَالِمُونَ﴾
৫১। স্মরণ করো
সেই সময়ের কথা যখন আমরা মূসাকে চল্লিশ দিন-রাত্রির জন্য ডেকে নিয়েছিলাম৬৭, তখন তার অনুপস্থিতিতে তোমরা
বাছুরকে নিজেদের উপাস্যে৬৮ পরিণত করেছিল। সে সময়
তোমরা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছিলে।
৬৭. মিসর থেকে মুক্তি লাভ করার পর বনী ইসরাঈল যখন সাইনা (সিনাই )উপদ্বীপে পৌছে
গেলো তখন মহান আল্লাহ হযরত মূসা আ.কে চল্লিশ দিন-রাতের জন্য তূর পাহাড়ে ডেকে নিলেন। ফেরাউনের দাসত্ব মুক্ত হয়ে যে জাতিটি এখন
মুক্ত পরিবেশে স্বাধীন জীবন যাপন করছে তার জন্য শরীয়াতের আইন এবং জীবন যাপনের
বিধান দান করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। (বাইবেল, নির্গমন পুস্তকঃ ২৪-৩১ পরিচ্ছেদ দেখুন )
৬৮. বনী ইসরাঈলদের প্রতিবেশী জাতিদের মধ্যে গাভী ও ষাঁড় পূজার রোগ সর্বত্র ছড়িয়ে
ছিল। মিসর ও কেনানে এর প্রচলন
ছিল অত্যন্ত ব্যাপক।
হযরত ইউসুফ আ. এর পর বনী ইসরাঈল যখন অধপতনের শিকার হলো এবং ধীরে ধীরে কিবতীদের
দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে পড়লো তখন অন্যান্য আরো বহু রোগের মধ্যে এ রোগটিও তারা
নিজেদের শাসকদের থেকে গ্রহণ করেছিলো। (বাছুর পূজার এ ঘটনাটি বাইবেলের নির্গমন পুস্তকের ৩২ অনুচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে
আলোচিত হয়েছে।)
﴿ثُمَّ عَفَوْنَا عَنكُم مِّن
بَعْدِ ذَٰلِكَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
৫২। কিন্তু
এরপরও আমরা তোমাদের মাফ করে দিয়েছিলাম এ জন্য যে, হয়তো এবার তোমরা কৃতজ্ঞ হবে।
﴿وَإِذْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ
وَالْفُرْقَانَ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾
৫৩। স্মরণ করো
(ঠিক যখন তোমরা এই যুলুম করছিলে সে সময়) আমরা মূসাকে কিতাব ও ফুরকান৬৯ দিয়েছিলাম, যাতে তার মাধ্যমে তোমরা সোজা
পথ পেতে পারো।
৬৯. ফুরকান হচ্ছে এমন একটি জিনিস যার মাধ্যমে হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য
সুস্পষ্ট করে তোলা হয়।
আমাদের ভাষায় এই অর্থটিকে সুস্পষ্ট করার জন্য সবচাইতে কাছাকাছি শব্দ হচ্ছে ‘মানদন্ড’। এখানে ফুরকানের মানে হচ্ছে দীনের এমন জ্ঞান, বোধ ও উপলব্ধি যার মাধ্যমে
মানুষ হক ও বাতিল এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে।
﴿وَإِذْ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ
يَا قَوْمِ إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنفُسَكُم بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَىٰ
بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ عِندَ بَارِئِكُمْ فَتَابَ
عَلَيْكُمْ ۚ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾
৫৪। স্মরণ করো
যখন মূসা(এই নিয়ামত নিয়ে ফিরে এসে) নিজের জাতিকে বললো, “হে লোকেরা! তোমরা বাছুরকে
উপাস্য বানিয়ে নিজেদের ওপর বড়ই যুলুম করেছো, কাজেই তোমরা নিজেদের স্রষ্টার
কাছে তাওবা করো এবং নিজেদেরকে হত্যা করো৭০, এরি মধ্যে তোমাদের স্রষ্টার
কাছে তোমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। সে সময়
তোমাদের স্রষ্টা তোমাদের তাওবা কবুল করে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও
অনুগ্রহকারী।”
৭০. অর্থাৎ তোমাদের যেসব লোক গো-শাবককে উপাস্য বানিয়ে তার পূজা করেছে তাদেরকে
হত্যা করো।
﴿وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَىٰ
لَن نُّؤْمِنَ لَكَ حَتَّىٰ نَرَى اللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنتُمْ
تَنظُرُونَ﴾
৫৫। স্মরণ করো, যখন তোমরা মূসাকে বলেছিলে, “আমরা কখনো তোমার কথায় বিশ্বাস
করবো না, যতক্ষণ না আমরা স্বচক্ষে আল্লাহকে তোমার সাথে
প্রকাশ্যে (কথা বলতে) দেখবো।” সে সময় তোমাদের চোখের সামনে
তোমাদের ওপর একটি ভয়াবহ বজ্রপাত হলো, তোমরা নিস্প্রাণ হয়ে পড়ে গেলে।
﴿ثُمَّ بَعَثْنَاكُم مِّن
بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
৫৬। কিন্তু
আবার আমরা তোমাদের বাঁচিয়ে জীবিত করলাম, হয়তো এ অনুগ্রহের পর তোমরা কৃতজ্ঞ হবে।৭১
৭১. এখানে যে ঘটনাটির দিকে ইংগিত করা হয়েছে সেটি হচ্ছেঃ চল্লিশ-রাতের নির্দিষ্ট
সময়ের জন্য হযরত মূসা আ. যখন তূর পাহাড়ে চলে গেলেন, আল্লাহ তাঁকে হুকুম দিলেন বনী
ইসরাঈলের সত্তরজন তাঁর সাথে নিয়ে আসার। তারপর মহান আল্লাহ মূসা আ.কে কিতাব ও ফুরকান দান করলেন। তিনি তা ঐ প্রতিনিধিদের সামনে পেশ করলেন। কুরআন বলছে, ঠিক তখনই তাদের মধ্য থেকে
কয়েকজন দুষ্ট প্রকৃতির লোক বলতে থাকলো, মহান আল্লাহ আপনার
সাথে কথা বলেছেন একথাটি আমরা শুধুমাত্র আপনার কথায় কেমন করে মেনে নিতে পারি?
তাদের একথায় আল্লাহর ক্রোধ উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো এবং তিনি তাদেরকে
শাস্তি দিলেন।
কিন্তু এ ব্যাপারে বাইবেল বলছেঃ
“তারা ইসরাঈলের খোদাকে দেখেছে। তাঁর চরণ তলের স্থানটি ছিল নীলকান্তমণি খচিত পাথরের
চত্বরের ন্যায়। আকাশের মতো ছিল তার
স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্য।
তিনি বনী ইসরাঈলের সম্মানিত ব্যক্তিদের ওপর নিজের হাত প্রসারিত করেননি। কাজেই তারা খোদাকে দেখেছে, খেয়েছে এবং পান করেছে।” (নির্গমন পুস্তকঃ ২৪ অনুচ্ছেদ, ১০-১১ শ্লোক)
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে,এই বাইবেলের আরো সামনের দিকে গিয়ে বলা বলা হয়েছেঃ “যখন হযরত
মূসা আ.খোদার কাছে আরজ করলেন, আমাকে তোমার প্রতাপ ও জ্যোতি
দেখাও। জবাবে তিনি বললেন, তুমি আমাকে দেখতে পারো না।” (নির্গমন পুস্তুকঃ ৩৩ অনুচ্ছেদ, ১৮-২৩ শ্লোক)।
﴿وَظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ
الْغَمَامَ وَأَنزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَىٰ ۖ كُلُوا مِن طَيِّبَاتِ
مَا رَزَقْنَاكُمْ ۖ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ﴾
৫৭। আমরা তোমাদের
ওপর মেঘমালার ছায়া দান করলাম৭২, তোমাদের জন্য সরবরাহ করলাম
মান্না ও সালওয়ার খাদ্য৭৩ এবং তোমাদের বললাম, যে পবিত্র দ্রব্য-সামগ্রী
আমরা তোমাদের দিয়েছি তা থেকে খাও। কিন্তু
তোমাদের পূর্বপুরুষরা যা কিছু করেছে তা আমাদের ওপর যুলুম ছিল না বরং তারা নিজেরাই
নিজেদের ওপর যুলুম করেছে।
৭২. অর্থাৎ প্রখর রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য যেখানে সিনাই উপদ্বীপে তোমাদের জন্য কোন
আশ্রয়স্থল ছিল না সেখানে আমরা মেঘামালার ছায়া দান করে তোমাদের বাঁচার উপায় করে
দিয়েছি। এ প্রসংগে মনে রাখতে হবে, লক্ষ লক্ষ বনী ইসরাঈর মিসর
থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর সিনাই উপত্যকায় গৃহ তো দূরের কথা সামান্য একটু মাথা গোঁজার মতো তাবুও
তাদের কাছে ছিল না। সে সময় যদি আল্লাহর পক্ষ
থেকে একটি বিশেষ সময়ের জন্য আকাশকে মেঘাবৃত করে রাখা না হতো, তাহলে খর-রৌদ্র–তাপে বনী
ইসরাঈলী জাতি সেখানেই ধ্বংস হয়ে যেতো।
৭৩. মান্না ও সালওয়া ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক প্রকার প্রাকৃতিক খাদ্য। বনী ইসরাঈররা তাদের বাস্তুহারা জীবনের সুদীর্ঘ
চল্লিশ বছর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে এই খাদ্য লাভ করতে থেকেছে। মান্না ছিল ধনিয়ার ধানার মতো ক্ষুদ্রাকৃতির এক ধরনের খাদ্য। সেগুলোর বর্ষণ হতো কুয়াসার মতো। জমিতে পড়ার পর জমে যেতো। আর সালওয়া ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির কবুতরের মতো একপ্রকার পাখি। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে এই খাদ্যের ওপর জীবন
নির্বাহ করেছে। তাদের কাউকে কোনদিন অনাহারে
থাকতে হয়নি। অথচ আজকের উন্নত বিশ্বের
কোন দেশে যদি হঠাৎ কয়েক লাখ শরণার্থী প্রবেশ করে তাহলে তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করা
একটি প্রাণান্তকর সমস্যায় পরিণত হয়। (মান্না ও সালওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে বাইবেলের নির্গমন পুস্তুকঃ ১৬
অনুচ্ছেদ, গণনাঃ১১ অনুচ্ছেদ,৭-৯ ও ৩১-৩৬ শ্লোক এবং ঈশুঃ৫
অনুচ্ছেদ, ১২ শ্লোক)
﴿وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوا
هَٰذِهِ الْقَرْيَةَ فَكُلُوا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَدًا وَادْخُلُوا الْبَابَ
سُجَّدًا وَقُولُوا حِطَّةٌ نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ ۚ وَسَنَزِيدُ الْمُحْسِنِينَ﴾
৫৮। আরো স্মরণ
করো যখন আমরা বলেছিলাম, “তোমাদের সামনের এই জনপদে৭৪ প্রবেশ করো এবং সেখানকার
উৎপন্ন দ্রব্যাদি যেমন ইচ্ছা খাও মজা করে। কিন্তু
জনপদের দুয়ারে সিজদানত হয়ে প্রবেশ করবে ‘হিত্তাতুন’ ‘হিত্তাতুন’ বলতে বলতে।৭৫ আমরা তোমাদের ত্রুটিগুলো মাফ
করে দেবো এবং সৎকর্মশীলদের প্রতি অত্যধিক অনুগ্রহ করবো।”
৭৪. এখনো পর্যন্ত যথার্থ অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ জনপদটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা
সম্ভব হয়নি। তবে যে ঘটনা পরস্পরায় এর
উল্লেখ হয়েছে তা এমন এক যুগের সাথে সম্পর্কিত যখন বনী ইসরাঈল সাইন উপদ্বীপেই
অবস্থান করছিল। তাতেই মনে হয়, উল্লেখিত জনপদটির অবস্থান এ
উপদ্বীপের কোথাও হবে। কিন্তু এ জনপদটি ‘সিত্তীম’ ও হতে পারে। সিত্তীম শহরটি ‘ইয়ারীহো’–এর ঠিক
বিপরীত দিকে জর্দান নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত ছিল। বাইবেলে উল্লেখিত হয়েছে, বনী ইসরাঈলরা মূসার আ. জীবনের
শেষ অধ্যায়ে এ শহরটি জয় করেছিল। সেখানে তারা ব্যাপক ব্যভিচার করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ভয়াবহ মহামারীর শিকারে পরিণত করেন এবং এতে চব্বিশ হাজার
লোকের মৃত্যু হয়। (গণনা, ২৫ অনুচ্ছেদ, ১-৮ শ্লোক)
৭৫. অর্থাৎ তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল। স্বেচ্ছাচারী যালেম বিজয়ীদের মতো অহংকার মদমত্ত হয়ে প্রবেশ করো না। বরং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও তাঁর ভয়ে ভীত
বান্দাদের মতো বিনম্রভাবে প্রবেশ করো। যেমন হযরত মুহাম্মাদ সা. মক্কা বিজয়ের সময় বিনয়াবনত হয়ে মক্কায় প্রবেশ
করেছিলেন। ‘হিত্তাতুন’ শব্দটির দুই অর্থ হতে পারে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কাছে নিজের গোনাহর জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা করতে করতে প্রবেশ করো। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, ব্যাপক গণহত্যা ও লুটতরাজ
তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে করতে শহরে প্রবেশ করো।
﴿فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا
قَوْلًا غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ فَأَنزَلْنَا عَلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا رِجْزًا
مِّنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ﴾
৫৯। কিন্তু যে
কথা বলা হয়েছিল যালেমরা তাকে বদলে অন্য কিছু করে ফেললো। শেষ
পর্যন্ত যুলুমকারীদের ওপর আমরা আকাশ থেকে আযাব নাযিল করলাম। এ ছিল
তারা যে নাফরমানি করছিল তার শাস্তি।
c রুকুঃ ৭ d
﴿وَإِذِ اسْتَسْقَىٰ مُوسَىٰ
لِقَوْمِهِ فَقُلْنَا اضْرِب بِّعَصَاكَ الْحَجَرَ ۖ فَانفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا
عَشْرَةَ عَيْنًا ۖ قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَّشْرَبَهُمْ ۖ كُلُوا وَاشْرَبُوا
مِن رِّزْقِ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ﴾
৬০। স্মরণ করো, যখন মূসা তার জাতির জন্য
পানির দোয়া করলো, তখন আমরা বললাম, অমুক পাথরের
ওপর তোমার লাঠিটি মারো। এর ফলে সেখান থেকে বারোটি
ঝর্ণাধারা উৎসারিত হলো।৭৬ প্রত্যেক গোত্র তার পানি
গ্রহণের স্থান জেনে নিল। (সে সময় এ নির্দেশ দেয়া
হয়েছিল যে,) আল্লাহ
প্রদত্ত রিযিক খাও, পান করো এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।
৭৬. সে পাথরটি এখনো সিনাই উপদ্বীপে রয়েছে। পর্যটকরা এখনো গিয়ে সেটি দেখেন। পাথরের গায়ে এখনো ঝর্ণার উৎস মুখের গর্তগুলো দেখা যায়। ১২টি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করার কারণ ছিল এই যে, বনী ইসরাঈলদেরও ১২টি গোত্র ছিল। প্রত্যেক গোত্রের জন্য আল্লাহ একটি করে ঝর্ণা
প্রবাহিত করেন। তাদের মধ্যে পানি নিয়ে কলহ
সৃষ্টি না হয়, এ জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছিল।
﴿وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَىٰ
لَن نَّصْبِرَ عَلَىٰ طَعَامٍ وَاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُخْرِجْ لَنَا مِمَّا
تُنبِتُ الْأَرْضُ مِن بَقْلِهَا وَقِثَّائِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَا
ۖ قَالَ أَتَسْتَبْدِلُونَ الَّذِي هُوَ أَدْنَىٰ بِالَّذِي هُوَ خَيْرٌ ۚ اهْبِطُوا
مِصْرًا فَإِنَّ لَكُم مَّا سَأَلْتُمْ ۗ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ
وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِّنَ اللَّهِ ۗ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوا يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ
اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ۗ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا
يَعْتَدُونَ﴾
৬১। স্মরণ করো, যখন তোমরা বলেছিলে, “হে মূসা!আমরা একই ধরনের
খাবারের ওপর সবর করতে পারি না, তোমার রবের কাছে দোয়া করো যেন তিনি আমাদের
জন্য শাক-সব্জি, গম, রসুন, পেঁয়াজ, ডাল ইত্যাদি কৃষিজাত
দ্রব্যাদি উৎপন্ন করেন।” তখন মূসা বলেছিল, “তোমরা কি একটি উৎকৃষ্ট
জিনিসের পরিবর্তে নিকৃষ্ট জিনিস নিতে চাও৭৭? তাহলে তোমরা কোন নগরে
গিয়ে বসবাস করো, তোমরা যা কিছু চাও সেখানে পেয়ে যাবে।” অবশেষে
অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছলো যার ফলে লাঞ্ছনা, অধপতন, দুরবস্থা ও অনটন তাদের ওপর
চেপে বসলো এবং আল্লাহর গযব তাদেরকে ঘিরে ফেললো। এ ছিল
তাদের ওপর আল্লাহর আয়াতের সাথে কুফরী করার৭৮ এবং পয়গম্বরদেরকে অন্যায়ভাবে
হত্যা করার ফল।৭৯ এটি ছিল তাদের নাফরমানির এবং
শরীয়াতের সীমালংঘনের ফল।
৭৭. এর অর্থ এ নয় যে, বিনা শ্রমে লদ্ধ মান্না ও সালওয়া বাদ দিয়ে তোমরা এমন জিনিস চাচ্ছো যে জন্য
শারীরিক মেহনত করে কৃষি করতে হবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যে মহান উদ্দেশ্যে তোমাদের মরুচারিতায়
লিপ্ত করা হয়েছে তার মোকাবিলায় খাদ্যের স্বাদ তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে তোমরা ঐ মহান উদ্দেশ্য ত্যাগ করতে
প্রস্তুত হয়েছো কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য ঐ খাদ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে চাও
না। (তুলনামুলক পর্যালোচনার
জন্য দেখুন গণনা পুস্তুক ১১ অনুচ্ছেদ, ৪-৯ শ্লোক)
৭৮. আয়াতের সাথে কুফরী করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। যেমন,
একঃ আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষাবলীর মধ্য থেকে যে কতাটিকে নিজেদের
চিন্তা–ভাবনা, ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাংখার বিরোধী পেয়েছে তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি
জানিয়েছে।
দুইঃ কোন বক্তব্যকে আল্লাহর বক্তব্য জানার পরও পূর্ণ দাম্ভিকতা, নির্লজ্জতা ও বিদ্রোহাত্মক
মনোভাব সহকারে তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং আল্লাহর নির্দেশের কোন পরোয়া করেনি।
তিনঃ আল্লাহর বাণীর অর্থ ও উদ্দেশ্য ভালোভাবে জানার ও বুঝার পরও
নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মধ্যে পরিবর্তন সাধন করেছে।
৭৯. বনী ইসরাঈল নিজেদের এই অপরাধকে নিজেদের ইতিহাস গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা
করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বাইবেলের
কয়েকটি ঘটনা এখানে উদ্ধৃত করছি।
একঃ হযরত সুলাইমানের পর ইসরাঈলী সাম্রাজ্য দু’টি রাষ্ট্রে(
জেরুযালেমের ইহুদিয়া রাষ্ট্র এবং সামারিয়ার ইসরাঈর রাষ্ট্র) বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ চলতে থাকে। অবশেষে ইহুদিয়া রাষ্ট্র নিজের ভাইদের বিরুদ্ধে
লড়াই করার জন্য দামেস্কের আরামী রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করে। এতে আল্লাহর হুকুমে হানানী নবী ইহুদিয়া
রাষ্ট্রের শাসক ‘আসা’-কে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন। কিন্তু ‘আসা’ এই সতর্কবাণী গ্রহণ
করার পরিবর্তে আল্লাহর নবীকে করারুদ্ধ করে। (২ বংশাবলী, ১৭অধ্যায়, ৭-১০
শ্লোক)
দুইঃ হযরত ইলিয়াস (ইলিয়াহ-ELLIAH) আ. যখন বা’ল
দেবতার পূজার জন্য ইহুদিদের তিরস্কার করেন এবং নতুন করে আবার তাওহীদের দাওয়াত দিতে
থাকেন তখন সামারিয়ার ইসরাঈলী রাজা ‘আখিআব’ নিজের মুশরিক স্ত্রীর প্ররোচনায় তাঁর প্রাণনাশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায়
মেতে ওঠেন। ফলে তাঁকে সিনাই উপদ্বীপের
পর্বতাঞ্চলে আশ্রয় নিতে হয়। এ সময় ইলিয়াস যে দোয়া করেন তার শব্দবলী ছিল নিম্নরূপঃ
“বনী আসরাঈল তোমার সাথে কৃত অংগীকার ভংগ করেছে …… তোমার নবীদের হত্যা করেছে
তলোয়ারের সাহায্যে এবং একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই তারা আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করছে।” ( ১ রাজাবলী, ১৭ অধ্যায়, ১-১০
শ্লোক)
তিনঃ সত্য ভাষণের অপরাধে হযরত ‘মিকাইয়াহ’ নামে আর একজন নবীকেও এই ইসরাঈলী শাসক আখিআব কারারুদ্ধ করে। সে হুকুম দেয়,এই ব্যক্তিকে বিপদের খাদ্য
খাওয়াও এবং বিপদের পানি পান করাও। (১ রাজাবলী,২২ অধ্যায়, ২৬-২৭
শ্লোক )।
চারঃ আবার যখন ইহুদিয়া রাষ্ট্রে প্রকাশ্যে মূর্তি পূজা ও
ব্যভিচার চলতে থাকে এবং হযরত যাকারিয়া আ. এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন তখন
ইহুদি রাজা ইউআস-এর নির্দেশে তাকে মূল হাইকেলে সুলাইমানীতে ‘মাকদিস’( পবিত্র
স্থান) ও ‘যবেহ ক্ষেত্র’-এর মাঝখানে
প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়। (২ বংশাবলী, ২৪ অধ্যায়, ২১ শ্লোক )।
পাঁচঃ অতপর আশুরিয়াদের হাতে যখন সামারিয়াদের ইসরাঈলী রাষ্ট্রের
পতন হয় এবং জেরুসালেমের ইহুদি রাষ্ট্র মহাধ্বংসের সম্মুখীন হয় তখন ‘ইয়ারমিয়াহ’ নবী নিজের জাতির পতনে আর্তনাদ করে ওঠেন। তিনি পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে নিজের জাতিকে সম্বোধন করে বলতে
থাকেন, “সতর্ক হও, নিজেদেরকে সংশোধন
করো, অন্যথায় তোমাদের পরিণাম সামারিয়া জাতির চাইতেও ভয়াবহ
হবে।” কিন্তু জাতির পক্ষ থেকে এই
সাবধান বাণীর বিরূপ জওয়াব আসে। চারদিক থেকে তাঁর ওপর প্রবল বৃষ্টিধারার মতো অভিশাপ ও গালি-গালাজ বর্ষিত হতে
থাকে। তাঁকে মারধর করা হয়। কারারুদ্ধ করা হয়। ক্ষুধা ও পিপাসায় শুকিয়ে মেরে ফেলার জন্য রশি দিয়ে বেঁধে
তাকে কর্দমাক্ত কূয়ার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার এবং বিদেশী
শত্রুর সাথে আতাত করার অভিযোগ আনা হয়। (যিরমিয়, ১৫ অধ্যায়, ১০ শ্লোক; ১৮
অধ্যায়, ২০-২৩ শ্লোক; ২০ অধ্যায়,
১-১৮ শ্লোক; ৩৬-৪০ অধ্যায় )।
ছয়ঃ ‘আমুস’ নামক আর এজন নবী সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ যখন তিনি
সামারিয়ার ইসরাঈলী রাষ্ট্রের ভ্রষ্টতা ও ব্যভিচারের সমালোচনা করেন এবং এই অসৎকাজের
পরিণাম সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দেন তখন তাঁকে চরমপত্র দিয়ে দেয়া হয়, এদেশ থেকে বের হয়ে যাও এবং বাইরে গিয়ে নিজের নবুওয়াত প্রচার করো। (আমুস, ৭ অধ্যায়, ১০-১৩
শ্লোক )।
সাতঃ হযরত ইয়াহইয়া (JOHN THE BAPTIST) আ. যখন ইহুদি শাসক
হিরোডিয়াসের দরবারে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত ব্যভিচার ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান তখন প্রথমে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। তারপর বাদশাহ নিজের প্রেমিকার নির্দেশানুসারে
জাতির এই সবচেয়ে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিটির শিরচ্ছেদ করে। কর্তিত মস্তক থালায় নিয়ে বাদশাহ তার প্রেমিকাকে উপহার দেয়। (মার্কঃ ৬ অধ্যায়, ১৭-২৯ শ্লোক)।
আটঃ সবশেশে হযরত ঈসা আ. এর বিরুদ্ধে বনী ইসরাঈলের আলেম সমাজ ও
জাতীয় নেতৃবৃন্দের ক্রোধ উদ্দীপিত হয়। কারণ তিনি তাদের পাপ কাজ ও লোক দেখানো সৎকাজের সমালোচনা করতেন। তাদেরকে ঈমান ও সৎকাজের দিকে আহবান জানাতেন। এসব অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা তৈরি
করা হয়। রোমান আদালত তাঁকে
প্রাণদন্ড দানের সিদ্ধান্ত করে। রোমান শাসক পীলাতীস যখন ইহুদিদের বললো, আজ ঈদের দিন, আমি
তোমাদের স্বার্থে ঈসা ও বারাব্বা(Barabbas) ডাকাতের মধ্য
থেকে একজনকে মুক্তি দিতে চাই। আমি কাকে মুক্তি দেবো? ইহুদিরা সমস্বরে বললো, আপনি বারাব্বকে মুক্তি দিন
এবং ঈসাকে ফাঁসি দিন। (মথিঃ ২৭ অধ্যায়, ২০-২৬)
এই হচ্ছে ইহুদি জাতির অপরাধমূলক কর্মকান্ডের একটি কলংকজনক অধ্যায়। কুরআনের উল্লেখিত আয়াত গুলোতে সংক্ষেপে এদিকেই
ইংগিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে জাতি নিজের
ফাসেক ও দুশ্চরিত্র সম্পন্ন লোকদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে এবং সৎ ও উন্নত
চরিত্রের অধিকারী লোকদেরকে কারাগারে স্থান দিতে চায় আল্লাহ তাদের ওপর অভশাপ বর্ষণ
না করলে আর কাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করবেন?
c রুকুঃ ৮ d
﴿إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا
وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَىٰ وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ
الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ
وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾
৬২।
নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো, যারা শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনে কিংবা ইহুদি, খৃষ্টান বা সাবি তাদের মধ্য
থেকে যে ব্যক্তিই আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তার প্রতিদান
রয়েছে তাদের রবের কাছে এবং তাদের জন্য কোন ভয় ও মর্মবেদনার অবকাশ নেই।৮০
৮০. বক্তব্য ও বিষয়বস্তু বর্ণনার ধারাবাহিকতাকে সামনে রাখলে একথা আপনা আপনি
সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এখানে ঈমান ও সৎকাজের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া মূল লক্ষ নয়। কোন বিষয়গুলো মানতে হবে এবং কোন কাজগুলো করলে
মানুষ আল্লাহর কাছে প্রতিদান লাভের অধিকারী হবে, এ আয়াতে সে প্রসংগ আলোচিত হয়নি। বরং যথাস্থানে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা আসবে। ইহুদিরা যে একমাত্র ইহুদি গোষ্ঠীকেই নাজাত ও
পরকালীন মুক্তির ইজারদার মনে করতো সেই ভ্রান্ত ধারণাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোই
এখানে এই আয়াতটির উদ্দেশ্য। তারা এই ভুল ধারণার পোষণ করতো যে, তাদের দলের সাথে আল্লাহর কোন বিশেষ সম্পর্ক
রয়েছে–যা অন্য মানুষের সাথে নেই, কাজেই তাদের দলের সাথে যে-ই
সম্পর্ক রাখবে, তার আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক
যাই হোক না কেন, সে নির্ঘাত নাজাত লাভ করবে। আর তাদের দলের বাইরে বাদবাকি সমগ্র মানবজাতি
কেবল জাহান্নামের ইন্ধন হবার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। এই ভুল ধারণা দূর করার জন্য বলা হচ্ছে, আল্লাহর কাছে তোমাদের এই দল ও
গোত্র বিভক্তিই আসল কথা নয় বরং সেখানে একমাত্র নির্ভরযোগ্য হাযির হবে সে তার রবের
কাছ থেকে তার প্রতিদান লাভ করবে। আল্লাহর ওখানে ফায়সালা হবে মানুষের গুণাবলীর ওপর, জনসংখ্যার হিসাবের খাতাপত্রের
ওপর নয়।
﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ
وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّورَ خُذُوا مَا آتَيْنَاكُم بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا
فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾
৬৩। স্মরণ করো
সেই সময়ের কথা যখন আমরা ‘তূর’কে তোমাদের ওপর উঠিয়ে তোমাদের
থেকে পাকাপোক্ত অংগীকার নিয়েছিলাম এবং বলেছিলামঃ৮১ “যে মধ্যে যে সমস্ত নির্দেশ ও
বিধান রয়েছে সেগুলো স্মরণ রেখো। এভাবেই আশা করা যেতে পারে যে, তোমরা তাকওয়ার পথে চলতে পারবে।”
৮১. এ ঘটনাটিকে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে সহজেই
বুঝা যায় যে, এটি বনী ইসরাঈলদের মধ্যে একটি সুবিখ্যাত ও সর্বজনবিদিত ঘটনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর বিস্তারিত অবস্থা জানা
কঠিন। তবে সংক্ষেপে এতটুকু বুঝে
নেয়া উচিত যে, পাহাড়ের পাদদেশে অংগীকার নেয়ার সময় এমন ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে দেয়া
হয়েছিল যার ফলে তারা মনে করছিল পাহাড় তাদের ওপর আপতিত হবে। সূরা আল আ’রাফের ১৭১ আয়াতে কিছুটা এ ধরনেরই
একটি ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। (সূরা আল আ’রাফের ১৩২ নম্বর টীকাটি দেখুন)
﴿ثُمَّ تَوَلَّيْتُم مِّن
بَعْدِ ذَٰلِكَ ۖ فَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَكُنتُم مِّنَ
الْخَاسِرِينَ﴾
৬৪। কিন্তু
এরপর তোমরা নিজেদের অংগীকার ভংগ করলে। তবুও
আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত তোমাদের সংগ ছাড়েনি নয়তো তোমরা কবেই ধ্বংস হয়ে যেতে।
﴿وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ الَّذِينَ
اعْتَدَوْا مِنكُمْ فِي السَّبْتِ فَقُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ﴾
৬৫। নিজেদের
জাতির সেইসব লোকের ঘটনা তো তোমাদের জানাই আছে যারা শনিবারের৮২ বিধান ভেঙেছিল। আমরা
তাদের বলে দিলামঃ বানর হয়ে যাও এবং এমনভাবে অবস্থান করো যাতে তোমাদের সবদিক থেকে
লাঞ্ছনা গঞ্জনা সইতে হয়।৮৩
৮২. বনী ইসরাঈলদের জন্য শনিবারের বিধান তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ আইনের মাধ্যমে শনিবার দিনটি তাদের বিশ্রাম ও ইবাদাত
করার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এদিনে তারা পার্থিব কোন কাজ এমন কি রান্না-বান্নার কাজ নিজেরা করতে পারবে না
এবং চাকর-বাকরদের দ্বারাও এ কাজ করাতে পারবে না। এ প্রসংগে কড়া নির্দেশ জারী করে বলা হয়েছিল,যে ব্যক্তি এই পবিত্র দিনের
নির্দেশ অমান্য করবে তাকে হত্যা করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়বে। (যাত্রা পুস্তুকঃ ৩১ অধ্যায়, ১২-১৭ শ্লোক )।
কিন্তু বনী ইসরাঈলরা নৈতিক ও ধর্মীয় পতনের শিকার হবার পর প্রকাশ্যে শনিবার
ব্যবসা-বানিজ্য, কাজ-কারবার চলতে থাকে।
৮৩. সূরা আল আ’রাফের ২১ রুকুতে এ ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। তাদেরকে বানরে পরিণত করার ধরন সম্পর্কে
মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তাদের দৈহিক কাঠামো পরিবর্তন
কর বানরে রূপান্তরিত করে দেয়া হয়েছিল। আবার অনেকে এর অর্থ এই গ্রহণ করে থাকে যে, তাদের মধ্যে বানরের স্বভাব ও
বানরের গুণাবলী সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কুরআনের শব্দাবলী ও বর্ণনাভংগী থেকে মনে হয়, তাদের মধ্যে নৈতিক নয়, দৈহিক বিকৃতি ঘটেছিল। আমার মতে, তাদের মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তিকে পূর্ববৎ অবিকৃত রেখে শারীরিক বিকৃতি ঘটিয়ে
বানরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল এটিই যুক্তিসংগত বলে মনে হয়।
﴿فَجَعَلْنَاهَا نَكَالًا
لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهَا وَمَا خَلْفَهَا وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ﴾
৬৬। এভাবে
আমরা তাদের পরিণতিকে সমকালীন লোকদের এবং পরবর্তী বংশধরদের জন্য শিক্ষণীয় এবং যারা
আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য মহান উপদেশে পরিণত করেছি।
﴿وَإِذْ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تَذْبَحُوا بَقَرَةً ۖ قَالُوا أَتَتَّخِذُنَا هُزُوًا
ۖ قَالَ أَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ﴾
৬৭। এরপর
স্মরণ করো সেই ঘটনার কথা যখন মূসা তার জাতিকে বললো, আল্লাহ তোমাদের একটি গাভী
যবেহ করা হুকুম দিচ্ছেন। তারা বললো, তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা
করছো? মূসা বললো,নিরেট মূর্খদের মতো কথা
বলা থেকে আমি আল্লাহ কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।
﴿قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ
يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَ ۚ قَالَ إِنَّهُ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ لَّا فَارِضٌ
وَلَا بِكْرٌ عَوَانٌ بَيْنَ ذَٰلِكَ ۖ فَافْعَلُوا مَا تُؤْمَرُونَ﴾
৬৮। তারা বললো, আচ্ছা তাহলে তোমার রবের কাছে
আবেদন করো তিনি যেন সেই গাভীর কিছু বিস্তারিত বিবরণ আমাদের জানিয়ে দেন। মূসা জবাব
দিল আল্লাহ বলছেন, সেটি অবশ্যি এমন একটি গাভী হতে হবে যে বৃদ্ধা নয়, একেবারে ছোট্ট বাছুরটিও নয়
বরং হবে মাঝারি বয়সের। কাজেই যেমনটি হুকুম দেয়া হয়
ঠিক তেমনটিই করো।
﴿قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ
يُبَيِّن لَّنَا مَا لَوْنُهَا ۚ قَالَ إِنَّهُ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ صَفْرَاءُ
فَاقِعٌ لَّوْنُهَا تَسُرُّ النَّاظِرِينَ﴾
৬৯। আবার তারা
বলতে লাগলো, তোমার রবের
কাছে আরো জিজ্ঞেস করো, তার রংটি কেমন?মূসা জবাব দিল, তিনি বলছেন, গাভীটি অবশ্যি হলুদ রংয়ের হতে
হবে, তার রং এতই উজ্জল হবে যাতে তা দেখে মানুষের মন ভরে
যাবে।
﴿قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ
يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَ إِنَّ الْبَقَرَ تَشَابَهَ عَلَيْنَا وَإِنَّا إِن شَاءَ
اللَّهُ لَمُهْتَدُونَ﴾
৭০। আবার তারা
বললো, তোমার রবের
কাছ থেকে এবার পরিষ্কার ভাবে জেনে নাও, তিনি কেমন ধরনের গাভী চান? গাভীটি নির্ধারণ করার
ব্যাপারে আমরা সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েছি। আল্লাহ
চাইলে আমরা অবশ্যি এটি বের করে ফেলবো।
﴿قَالَ إِنَّهُ يَقُولُ إِنَّهَا
بَقَرَةٌ لَّا ذَلُولٌ تُثِيرُ الْأَرْضَ وَلَا تَسْقِي الْحَرْثَ مُسَلَّمَةٌ لَّا
شِيَةَ فِيهَا ۚ قَالُوا الْآنَ جِئْتَ بِالْحَقِّ ۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُوا يَفْعَلُونَ﴾
৭১। মূসা জবাব
দিল আল্লাহ বলছেন,সেটি এমন
একটি গাভী যাকে কোন কাজে নিযুক্ত করা হয়না, জমি চাষ বা ক্ষেতে পানি সেচ
কোনটিই করে না, সুস্থ-সবল
ও নিখুঁত। একথায় তারা বলে উঠলো, হাঁ, এবার তুমি ঠিক সন্ধান দিয়েছো। অতপর তারা
তাকে যবেহ করলো, অন্যথায়
তারা এমনটি করতো বলে মনে হচ্ছিল না।৮৪
৮৪. তাদের প্রতিবেশী জাতিরা গরুকে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র মনে করতো এবং গরু পূজা করতো আর
প্রতিবেশীদের থেকে এ রোগ তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়, তাই তাদেরকে গরু যবেহ করার
হুকুম দেয়া হয়।
তাদের ঈমানের পরীক্ষা এভাবেই হওয়া সম্ভবপর ছিল। এখন যদি তারা যথার্থই আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে মাবুদ বলে
স্বীকার না করে তাহলে এ আকীদা গ্রহণ করার পূর্বে যেসব ঠাকুর-দেবতার মুর্তিকে তারা
মাবুদ মনে করে আসছিল তাদেকে নিজের হাতে ভেঙে ফেলতে হবে। এটা অনেক বড় পরীক্ষা ছিল। তাদের দিলের মধ্যে ঈমান পুরোপুরি বাসা বাঁধতে পারেনি, তাই তারা টালবাহানা করতে থাকে
এবং বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাক। কিন্তু যতই বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে ততই তারা
নিজেরা ঘেরাও হয়ে যেতে থাকে। অবশেষে সেকালে যে বিশেষ ধরনের সোনালী গাভীর পূজা করা হতো তার প্রতি প্রায়
অংগুলি নির্দেশ করে তাকেই যবেহ করতে বলা হলো। বাইবেলে ও এই ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। তবে বনী ইসরাঈলরা এ নির্দেশটি উপেক্ষা করার
জন্য কোন ধরনের টালবাহানা করেছিল,তা সেখানে বলা হয়নি। (গণনা পুস্তুকঃ ১৯ অধ্যায়, ১-১০ শ্লোক)
c রুকুঃ ৯ d
﴿وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْسًا
فَادَّارَأْتُمْ فِيهَا ۖ وَاللَّهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ﴾
৭২। আর স্মরণ
করো সেই ঘটনার কথা যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে এবং একজন আর একজনের
বিরুদ্ধে হত্যার অভিয়োগ আনছিলে। আর আল্লাহ সিদ্ধান্ত
করেছিলেন তোমরা যা কিছু গোপন করছো তা তিনি প্রকাশ করে দেবেন।
﴿فَقُلْنَا اضْرِبُوهُ بِبَعْضِهَا
ۚ كَذَٰلِكَ يُحْيِي اللَّهُ الْمَوْتَىٰ وَيُرِيكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ﴾
৭৩। সে সময়
আমরা হুকুম দিলাম, নিহতের লাশকে তার একটি অংশ দিয়ে আঘাত করো। দেখো
এভাবে আল্লাহ মৃতদের জীবন দান করেন এবং তোমাদেরকে নিজের নিশানী দেখান, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পারো।৮৫
৮৫. এখানে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, হত্যাকারীর সন্ধান বলে দেয়ার জন্য নিহত
ব্যক্তির লাশের মধ্যে পুনরায় কিছুক্ষণের জন্য প্রাণস্পন্দন ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ জন্য যে কৌশর অবলম্বন করা হয়েছিল।অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির লাশকে তার একটি অংশ দিয়ে
আঘাত করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়ে গেছে বলে মনে
হচ্ছে। তবুও এর ব্যাখ্যায়
প্রাচীনতম তাফসীরকারগণ যা বলেছেন তাকেই এ নিকটতম অর্থ ধরা যায়। অর্থাৎ আগে যে গাভী যবেহ করা নির্দেশ দেয়া
হয়েছিল তারই গোশ্ত দিয়ে নিহত ব্যক্তির লাশের গায়ে আঘাত করতে বলা হয়েছিল। এভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেলো। প্রথমত আল্লাহর কুদরাত ও অসীম ক্ষমতার একটি
প্রমাণ তাদের সামনে তুলে ধরা হলো। দ্বিতীয়ত গরুর পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও তাকে উপাস্য হবার যোগ্যতার ওপরও একটি শক্তিশালী
আঘাত হানা হলো। এই
তথাকথিত উপাস্যটি যদি সামান্যতম ক্ষমতারও অধিকারী হতো তাহলে তাকে যবেহ করার কারণে
একটি মহাবিপদ ও সুর্যোগ ঘনিয়ে আসতো। কিন্তু বিপরীত পক্ষে আমরা দেখছি তা মানুষের কল্যাণে লেগেছে।
﴿ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم
مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ۚ وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ
لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ
مِنْهُ الْمَاءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۗ وَمَا اللَّهُ
بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾
৭৪। কিন্তু এ
ধরনের নিশানী দেখার পরও তোমাদের দিল কঠিন হয়ে গেছে, পাথরের মত কঠিন বরং তার চেয়েও
কঠিন। কারণ এমন অনেক পাথর আছে যার মধ্য দিয়ে
ঝরণাধারা প্রবাহিত হয় আবার অনেক পাথর ফেটে গেলে তার মধ্য থেকে পানি বের হয়ে আসে, আবার কোন কোন পাথর আল্লাহর
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পড়েও যায়। আল্লাহ তোমাদের কর্মকান্ড
সম্পর্কে বেখবর নন।
﴿أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُوا
لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ
مِن بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾
৭৫। হে
মুসলমানরা! তোমরা কি তাদের থেকে আশা করো তারা তোমাদের দাওয়াতের ওপর ঈমান আনবে?৮৬ অথচ
তাদের একটি দলের চিরাচরিত রীতি এই চলে আসছে যে, আল্লাহর কালাম শুনার পর খুব
ভালো করে জেনে বুঝে সজ্ঞানে তার মধ্যে ‘তাহরীফ’ বা বিকৃতি সাধন করেছে।৮৭
৮৬. এখানে মদীনার নওমুসলিমদের সম্বোধন করা হয়েছে। তারা নিকটবর্তী কালে শেষ নবীর ওপর ঈমান এনেছিল। ইতিপূর্বে নবুওয়াত, শরীয়াত,কিতাব,
ফেরেশতা, আখেরাত ইত্যাদি শব্দগুলো তাদের কানে
পৌছেছিল। এসব তারা শুনেছিল তাদের
প্রতিবেশ ইহুদিদের কাছ থেকে। তারা ইহুদিদের মুখ থেকে আরো শুনেছিল যে, দুনিয়ায় আরো একজন নবী আসবেন। যারা তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে সারা দুনিয়ায়
তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠত হবে। এই জানার ভিত্তিতে মদীনাবাসীরা নবী সা.এর নবুওয়াতের চর্চা শুনে তাঁর প্রতি
আকৃষ্ট হয়েছিল এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এখন তারা আশা করছিল, যারা আগে থেকে নবী ও আসমানী কিতাবের
অনুসারী এবং যাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত খবরের বদৌলতে তারা ঈমানের মহামূল্যবান সম্পদের
অধিকারী হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই তাদের সহযোগী হবে। বরং এ পথে তারা অগ্রগামী হবে। এই বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে মদীনার উদ্যোগী
নওমুসলিমরা তাদের ইহুদি বন্ধু ও প্রতিবেশীদের কাছে যেতো এবং তাদেরকে ইসলামের
দাওয়াত দিতো। তারা এ দাওয়াত গ্রহণে
অস্বীকৃতি জানালে মুনাফিক ও ইসলাম বিরোধীরা এ সুযোগ গ্রহণ করতো। তারা এ থেকে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করতো যে, ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক ও
সংশয়পূর্ণ মনে হচ্ছে, নইলে মুহাম্মাদ সা. যদি সত্যিই নবী
হতেন তাহলে ‘আহলি কিতাব’দের উপামা,
মাশায়েখ ও পবিত্র বুযর্গগণ কি জেনে বুজে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানাতো
এবং তারা কি অনর্থক এভাবে নিজেদের পরকাল নষ্ট করতো? তাই বনী
ইসরাইলদের অতীত ইতিহাস বর্ণনা করার পর এবার সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বলা
হচ্ছে, অতীতে যারা এ ধরনের কীর্তিকলাপ করেছে তাদের ব্যাপাবে
তোমরা বেশী কিছু আশা করো না। অন্যথায় তোমাদের দাওয়াত তাদের পাষাণ অন্তরে ধাক্কা খেয়ে যখন ফিরে আসবে তখন
তোমাদের মন ভেঙে পড়বে। এই
ইহুদিরা শত শত বছর থেকে বিকৃত হয়ে আছে। আল্লাহর যে সমস্ত আয়াত শুনে তোমাদের দিল কেঁপে ওঠে সেগুলোকে নিয়ে
ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে করতে তাদের কয়েক পুরুষ কেটে গেছে। আল্লাহর সত্য দীনকে তারা নিজেদের ইচ্ছা ও চাহিদা মোতাবিক
বিকৃত করেছে। এই বিকৃত দীনের মাধ্যমেই
তারা পরকালীন নাজাত লাভের প্রত্যাশী। সত্যের আওয়াজ বুলন্দ হবার সাথে সাথেই তারা সেদিকে দৌড়ে যাবে, তাদের সম্পর্কে এ ধারণা রাখা
বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৮৭. “একটি দল” বলতে তাদের উলামা ও শরীয়াতধারীদেরকে বুঝানো হয়েছে। এখানে তাওরাত, যাবুর ও অন্যান্য কিতাব,
যেগুলো তারা নিজেদের নবীদের মাধ্যমে লাভ করেছিল, সেগুলোকেই বলা হয়েছে “আল্লাহর কালাম”। ‘তাহরীফ’ অর্থ হচ্ছে কোন কথাকে তার আসল অর্থ ও
তাৎপর্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের ইচ্ছে মতো এমন কোন অর্থে ব্যবহার করা যা বক্তার
উদ্দেশ্য ও লক্ষের পরিপন্থী। তাছাড়া শব্দের মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করাকেও তাহরীফ বলে। বনী ইসরাঈলী আলেমগণ আল্লাহর কালামের মধ্যে এই দু’ধরনের
তাহরীফ বা বিকৃতি সাধন করেছিল।
﴿وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ
آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ قَالُوا أَتُحَدِّثُونَهُم
بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ لِيُحَاجُّوكُم بِهِ عِندَ رَبِّكُمْ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ﴾
৭৬।
(মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর ওপর) যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে সাক্ষাত হলে বলে, আমরাও তাঁকে মানি। আবার যখন
পরস্পরের সাথে নিরিবিলিতে কথা হয় তখন বলে, তোমরা কি বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে
গেলে? এদেরকে তোমরা এমন সব কথা বলে দিচ্ছো যা আল্লাহ
তোমাদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন, ফলে এরা তোমাদের রবের কাছে তোমাদের
মোকাবিলায় তোমাদের একথাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করবে?৮৮
৮৮. অর্থাৎ তারা পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় বলতো, এই নবী সম্পর্কে তাওরাত ও অন্যান্য আসমানী
গ্রন্থসমূহে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী উল্লিখিত হয়েছে অথবা আমাদের পবিত্র কিতাবসমূহে
আমাদের বর্তমান মনোভাব ও কর্মনীতিকে অভিযুক্ত করার মতো যে সমস্ত আয়াত ও শিক্ষা
রয়েছে, সেগুলো মুসলমানদের সামনে বিবৃত করো না। অন্যথায় তারা আল্লাহর সামনে এগুলোকে তোমাদের
বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে পেশ করবে। আল্লাহ সম্পর্কে নাদান ইহুদিদের বিশ্বাস এভাবেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ তারা যেন মনে করতো, দুনিয়ায় যদি তারা আল্লাহর
কিতাবকে বিকৃত করে ও সত্য গোপন করে তাহলে এ জন্য আখেরাতে তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা
চলবে না। তাই পরবর্তী প্রাসংগিক
বাক্যে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, তোমরা কি আল্লাহকে বেখবর মনে করো?
﴿أَوَلَا يَعْلَمُونَ أَنَّ
اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ﴾
৭৭। এরা কি
জানে না, যা কিছু
এরা গোপন করছে এবং যা কিছু প্রকাশ করছে সমস্তই আল্লাহ জানেন?
﴿وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لَا
يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ﴾
৭৮। এদের
মধ্যে দ্বিতীয় একটি দল হচ্ছে নিরক্ষরদের। তাদের
কিতাবের জ্ঞান নেই, নিজেদের
ভিত্তিহীন আশা-আকাংখাগুলো নিয়ে বসে আছে এবং নিছক অনুমান ও ধারণার ওপর নির্ভর করে
চলছে।৮৯
৮৯. এ ছিল তাদের জনগণের অবস্থা। আল্লাহর কিতাবের কোন জ্ঞানই তাদের ছিল না। আল্লাহ তাঁর কিতাবে দীনের কি কি মূলনীতি বর্ণনা করেছেন, শরীয়াত ও নৈতিকতার কি বিধান
দিয়েছেন এবং কোন কোন জিনিসের ওপর মানুষের কল্যাণ ও ক্ষতির ভিত রেখেছেন, তার কিছুই তারা জানতো না। এই জ্ঞান না থাকার কারণে তারা নিজেদের ইচ্ছা, আশা-আকাংখা ও কল্পনার অনুসারী
বিভিন্ন মনগড়া কথাকে দীন মনে করতো এবং এরি ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মিথ্যা আশা বুকে নিয়ে
জীবন ধারণ করতো।
﴿فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ
الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنْ عِندِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا
بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۖ فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُم
مِّمَّا يَكْسِبُونَ﴾
৭৯। কাজেই
তাদের জন্য ধ্বংস অবধারিত যারা স্বহস্তে শরীয়াতের লিখন লেখে তারপর লোকদের বলে এটা
আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। এভাবে তারা এর বিনিময়ে
সামান্য স্বার্থ লাভ করে।৯০ তাদের হাতের এই লিখন তাদের
ধ্বংসের কারণ এবং তাদের এই উপার্জনও তাদের ধ্বংসের উপকরণ।
৯০. তাদের আলেমদের সম্পর্কে একথাগুলো বলা হচ্ছে। তারা কেবলমাত্র আল্লাহর কালামের অর্থ নিজেদের ইচ্ছা ও
পার্থিব স্বার্থ অনুযায়ী পরিবর্তন করেনি বরং এই সংগে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা, জাতীয় ইতিহাস, কল্পনা, আন্দাজ–অনুমান, লৌকিক
চিন্তাদর্শন এবং নিজেদের তৈরি করা আইন-কানুনগুলোর বাইবেলের মূল কালামের মধ্যে
অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। সাধারণ মানুষের সামনে সেগুলোকে তারা এমনভাবে পেশ করেছে যেন সগুলো সবই আল্লাহর
পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে।
বাইবেলে স্থান লাভ করেছে এমন প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক কাহিনী,ভাষ্যকারের মনগড়া ব্যাখ্যা,
ধর্মতাত্বিক ন্যায়শাস্ত্রবিদের আল্লাহ সম্পর্কিত আকীদা-বিশ্বাস এবং
প্রত্যেক আইন শাস্ত্রবিদের উদ্ভাবিত আইন আল্লাহর বাণীর(Word of God) মর্যাদা লাভ করেছে। তার প্রতি ঈমান আনা ও বিশ্বাস স্থাপন করা একান্ত কর্তব্যে পরিণত হয়ে গেছে। তাকে প্রত্যাহার করা ধর্মকে প্রত্যাহার করার
নামান্তর বিবেচিত হয়েছে।
﴿وَقَالُوا لَن تَمَسَّنَا
النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَّعْدُودَةً ۚ قُلْ أَتَّخَذْتُمْ عِندَ اللَّهِ عَهْدًا
فَلَن يُخْلِفَ اللَّهُ عَهْدَهُ ۖ أَمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾
৮০। তারা বলে, জাহান্নামের আগুন আমাদের কখনো
স্পর্শ করবে না, তবে কয়েক দিনের শাস্তি হলেও হয়ে যেতে পারে।৯১ এদেরকে জিজ্ঞেস করো, তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে
কোন অংগীকার নিয়েছো, যার
বিরুদ্ধাচারণ তিনি করতে পারেন না? অথবা তোমরা আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিয়ে এমন
কথা বলছো যে কথা তিনি নিজের ওপর চাপিয়ে নিয়েছেন বলে তোমাদের জানা নেই? আচ্ছা জাহান্নামের আগুন
তোমাদেরকে স্পর্শ করবে না কেন?
৯১. এখানে ইহুদি সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি ভুল ধারণার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের আলেম, অ-আলেম, শিক্ষিত
অশিক্ষিত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এই ভুল ধারণায় লিপ্ত। তারা মনে করতো, আমরা যাই কিছু করি না কেন,
আমাদের সাতখুন মাফ, জাহান্নামের আগুন আমাদের
হারাম। কারণ আমরা ইহুদি। আর ধরে নেয়া যাক যদি আমাদের কখনো শাস্তি দেয়াও
হয় তাহলেও তা হবে মাত্র কয়েকদিনের। কয়েকদিন জাহান্নামে রেখে তারপর আমাদের জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
﴿بَلَىٰ مَن كَسَبَ سَيِّئَةً
وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
৮১। যে
ব্যক্তিই পাপ করবে এবং পাপের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে সে-ই জাহান্নামী হবে এবং
জাহান্নামের আগুনে পুড়তে থাকবে চিরকাল।
﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا
الصَّالِحَاتِ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
৮২। আর যারা
ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে থাকবে তারা চিরকাল।
c রুকুঃ ১০ d
﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ
بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
وَذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا
الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِّنكُمْ وَأَنتُم
مُّعْرِضُونَ﴾
৮৩। স্মরণ করো
যখন ইসরাঈল সন্তানদের থেকে আমরা এই মর্মে পাকাপোক্ত অংগীকার নিয়েছিলাম যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত
করবে না, মা-বাপ, আত্মীয়-পরিজন, ইয়াতিম ও মিসকিনদের সাথে ভালো
ব্যবহার করবে, লোকদেরকে
ভালো কথা বলবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। কিন্তু
সামান্য কয়েকজন ছাড়া তোমরা সবাই অংগীকার ভংগ করেছিলে এবং এখনো ভেঙে চলছো।
﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ
لَا تَسْفِكُونَ دِمَاءَكُمْ وَلَا تُخْرِجُونَ أَنفُسَكُم مِّن دِيَارِكُمْ ثُمَّ
أَقْرَرْتُمْ وَأَنتُمْ تَشْهَدُونَ﴾
৮৪। আবার
স্মরণ করো, যখন আমরা
তোমাদের থেকে মজুবত অংগীকার নিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা পরস্পরের রক্ত প্রবাহিত
করবে না এবং একে অন্যকে গৃহ থেকে উচ্ছেদ করবে না। তোমরা এর
অংগীকার করেছিলে, তোমরা
নিজেরাই এর সাক্ষী।
﴿ثُمَّ أَنتُمْ هَٰؤُلَاءِ
تَقْتُلُونَ أَنفُسَكُمْ وَتُخْرِجُونَ فَرِيقًا مِّنكُم مِّن دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُونَ
عَلَيْهِم بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِن يَأْتُوكُمْ أُسَارَىٰ تُفَادُوهُمْ وَهُوَ
مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ ۚ أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ
بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ
الدُّنْيَا ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ ۗ وَمَا
اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾
৮৫। কিন্তু আজ
সেই তোমরাই নিজেদের ভাই-বেরাদারদেরকে হত্যা করছো, নিজেদের গোত্রীয় সম্পর্কযুক্ত
কিছু লোককে বাস্তভিটা ছাড়া করছো, যুলুম ও অত্যধিক বাড়াবাড়ি সহকারে তাদের
বিরুদ্ধে দল গঠন করছো এবং তারা যুদ্ধবন্দী হয়ে
তোমাদের কাছে এলে তাদের মুক্তির জন্য তোমরা মুক্তিপণ আদায় করছো। অথচ
তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে উচ্ছেদ করাই তোমাদের জন্য হারাম ছিল। তাহলে কি
তোমরা কিতাবের একটি অংশের ওপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশের সাথে কুফরী করছো?৯২ তারপর তোমাদের মধ্য থেকে
যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও
পর্যুদস্ত হবে এবং আখেরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে? তোমাদের কর্মকান্ড থেকে
আল্লাহ বেখবর নন।
৯২. নবী সা.এর মদীনায় আগমনের পূর্বে মদীনার আশপাশের ইহুদি গোত্ররা তাদের প্রতিবেশী
আরব গোত্রগুলোর (আওস ও খাযরাজ) সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেছিল। একটি আরব গোত্র অন্য একটি আরব গোত্রের সাথে
যুদ্ধে লিপ্ত হলে উভয়ের বন্ধু ইহুদি গোত্র ও নিজেদের বন্ধুদের সাহায্য করতো এবং
এভাবে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হতো। ইহুদিদের এ কাজটি তাদের কাছে রক্ষিত আল্লাহর কিতাবের
বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থি ছিল। ইহুদিরা এটা জানতো।
তারা জেনে বুঝেই এভাবে আল্লাহর কিতাবের বিরুদ্ধাচরণ করতো। কিন্তু যুদ্ধের পর একটি ইহুদি গোত্রের লোকেরা অন্য ইহুদি
গোত্রের কাছে যুদ্ধবন্দী হয়ে এলে বিজয়ী গোত্রটি মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তি
দিতো। বিজিত গোত্রের লোকেরা এই
মুক্তিপণের অর্থ সরবরাহ করতো। তাদের মুক্তিপণের লেনদেনকে বৈধ গণ্য করার জন্য তারা আল্লাহর কিতাব থেকে
দলীল-প্রমাণ পেশ করতো।
অর্থাৎ আল্লাহর কিতাবে উল্লেখিত মুক্তিপণের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়ার
বিধানটি তারা সাগ্রহে মেনে চলতো কিন্তু পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ না করার বিধানটি মেনে
চলতো না।
﴿أُولَٰئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا
الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ ۖ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ
يُنصَرُونَ﴾
৮৬। এই
লোকেরাই আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন কিনে নিয়েছে। কাজেই
তাদের শাস্তি কমানো হবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে না।
c রুকুঃ ১১ d
﴿وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى
الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِن بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ ۖ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ
الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ ۗ أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ
بِمَا لَا تَهْوَىٰ أَنفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا
تَقْتُلُونَ﴾
৮৭। আমরা
মূসাকে কিতাব দিয়েছি। তারপর ক্রমাগতভাবে রাসূল
পাঠিয়েছি। অবশেষে ঈসা ইবনে মারইয়ামকে পাঠিয়েছি
উজ্জ্বল নিশানী দিয়ে এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করেছি।৯৩ এরপর তোমরা এ কেমনতর আচরণ করে
চলছো,যখনই কোন রাসূল
তোমাদের প্রবৃত্তির কামনা বিরোধী কোন জিনিস নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে তখনই তোমরা
তার বিরুদ্ধাচরণ করেছো, কাউকে মিথ্যা বলেছো এবং কাউকে হত্যা করেছো।
৯৩. ‘পবিত্র রূহ’ বলতে অহী-জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। অহী নিয়ে দুনিয়ায় আগমনকারী জিব্রাঈলকেও বুঝানো
হয়েছে। আবার হযরত ঈসা আ. এর পাক
রূহকেও বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহ নিজেই তাঁকে পবিত্র গুণাবলীতে ভূষিত করেছিলেন। ‘উজ্জ্বল নিশানী’ অর্থ সুস্পষ্ট আলামত ও চিহ্ন,
যা দেখে প্রত্যেকটি সত্যপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তি হযরত ঈসা
আ.কে আল্লাহর নবী বলে চিনতে পারে।
﴿وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ
ۚ بَل لَّعَنَهُمُ اللَّهُ بِكُفْرِهِمْ فَقَلِيلًا مَّا يُؤْمِنُونَ﴾
৮৮। তারা বলে, আমাদের হৃদয় সুরক্ষিত।৯৪ না, আসলে তাদের কুফরীর কারণে
তাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে, তাই তারা খুব কমই ঈমান এনে
থাকে।
৯৪. অর্থাৎ আমাদের আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা এতই পাকাপোক্ত যে, তোমরা যাই কিছু বল না কেন
আমাদের মনে তোমাদের কথা কোন রকম প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। যেসব হঠধর্মী লোকের মন-মস্তিষ্ক অজ্ঞতা ও
মূর্খতার বিদ্বেষে আচ্ছন্ন থাকে তারাই এ ধরনের কথা বলে। তারা একে মজবুত বিশ্বাস নাম দিয়ে নিজেদের একটি গুণ বলে
গণ্য করে। অথচ এটা মানুষের গুণ নয়
দোষ্। নিজের উত্তরাধিকার সূত্রে
পাওয়া আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তার গলদ ও মিথ্যা বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হবার
পরও তার ওপর অবিচল থাকার চাইতে বড় দোষ মানুষের আর কি হতে পারে?
﴿وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ
مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِن قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ
عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُم مَّا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ ۚ فَلَعْنَةُ
اللَّهِ عَلَى الْكَافِرِينَ﴾
৮৯। আর এখন
আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের কাছে যে একটি কিতাব এসেছে তার সাথে তারা কেমন ব্যবহার
করছে? তাদের কাছে
আগে থেকেই কিতাবটি ছিল যদিও এটি তার সত্যতা স্বীকার করতো এবং যদিও এর আগমনের
পূর্বে তারা নিজেরাই কাফেরদের মোকাবিলায় বিজয় ও সাহায্যের দোয়া চাইতো, তবুও যখন সেই জিনিসটি এসে
গেছে এবং তাকে তারা চিনতেও পেরেছে তখন তাকে মেনে নিতে তারা অস্বীকার করেছে।৯৫ আল্লাহর লানত এই
অস্বীকারকারীদের ওপর।
৯৫. নবী সা. এর আগমনের পূর্বে ইহুদিরা তাদের পূর্ববর্তী নবীগণ যে নবীর আগমন বার্তা
শুনিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জন্য প্রতীক্ষারত ছিল। তারা দোয়া করতো, তিনি যেন অবিলম্বে এসে কাফেরদের প্রাধান্য
খতম করে ইহুদি জাতির উন্নতি ও পুনরুত্থানের সূচনা করেন। মুহাম্মাদ সা. এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে
মদীনাবাসীদের প্রতিবেশী ইহুদি সম্প্রদায় নবীর আগমনের আশায় জীবন ধারণ করতো, মদীনাবাসীরা নিজেরাই একথার
সাক্ষ্য দেবে।
যত্রতত্র যখন তখন তারা বলে বেড়াতোঃ “ঠিক আছে, এখন প্রাণ ভরে আমাদের ওপর যুলুম করে নাও। কিন্তু যখন সেই নবী আসবেন, আমরা তখন এই যালেমদের সবাইকে
দেখে নেবো।” মদীনাবাসীরা এসব কথা আগে
থেকেই শুনে আসছিল। তাই নবী সা. এর কথা এবং
তাঁর অবস্থা শুনে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলোঃ দেখো, ইহুদিরা যেন তোমাদের পিছিয়ে
দিয়ে এই নবীর ধর্ম গ্রহণ করে বাজী জিতে না নেয়। চলো, তাদের আগে আমরাই এ নবীর ওপর ঈমান আনবো। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখলো,যে ইহুদিরা নবীর আগমন
প্রতীক্ষায় দিন গুণছিল, নবীর আগমনের পর তারাই তাঁর সবচেয়ে বড়
বিরোধী পক্ষে পরিণত হলো।
‘এবং তারা তাকে চিনতেও পেরেছে’ বলে যে কথা মূল আয়াতে বলা হয়েছে, তার স্বপক্ষে তথ্য-প্রমাণ সেই যুগেই পাওয়া গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী সাক্ষ্য পেশ
করেছেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাফিয়া রা.। তিনি নিজে ছিলেন একজন বড় ইহুদি আলেমের মেয়ে এবং আর একজন বড়
আলেমের ভাইঝি। তিনি বলেন, নবী সা. এর মদীনায় আগমনের পর
আমার বাপ ও চাচা দু’জনই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষন তাঁর সাথে কথাবার্তা বলার তারা ঘরে
ফিরে আসেন। এ সময় নিজের কানে তাদেরকে
এভাবে আলাপ করতে শুনিঃ
চাচাঃ আমাদের কিতাবে যে নবীর খবর দেয়া হয়েছে ইনি কি সত্যিই সেই
নবী?
পিতাঃ আল্লাহর কসম, ইনিই সেই নবী।
চাচাঃ এ ব্যাপারে তুমি কি একেবারে নিশ্চিত?
পিতাঃ হাঁ
চাচাঃ তাহলে এখন কি করতে চাও?
পিতাঃ যতক্ষন দেহে প্রাণ আছে এর বিরোধিতা করে যাবো। একে সফলকাম হতে দেবো না। (ইবনে হিশামঃ ২য় খন্ড, ১৬৫ পৃঃ আধুনিক সংস্করণ )
﴿بِئْسَمَا اشْتَرَوْا بِهِ
أَنفُسَهُمْ أَن يَكْفُرُوا بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ بَغْيًا أَن يُنَزِّلَ اللَّهُ مِن
فَضْلِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ ۖ فَبَاءُوا بِغَضَبٍ عَلَىٰ غَضَبٍ ۚ
وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ مُّهِينٌ﴾
৯০। যে
জিনিসের সাহায্যে তারা মনের সান্ত্বনা লাভ করে, তা কতই না নিকৃষ্ট!৯৬ সেটি হচ্ছে, আল্লাহ যে হিদায়াত নাযিল
করেছেন তারা কেবল এই জিদের বশবর্তী হয়ে তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করছে যে, আল্লাহ তাঁর যে বান্দাকে
চেয়েছেন নিজের অনুগ্রহ (অহী ও রিসালাত) দান করেছেন।৯৭ কাজেই এখন তারা উপর্যুপরি
গযবের অধিকারী হয়েছে। আর এই ধরনের কাফেরদের জন্য
চরম লাঞ্ছনার শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।
৯৬. এই আয়াতটির দ্বিতীয় একটি অনুবাদও হতে পারে। সেটি হচ্ছেঃ “যতই নিকৃষ্ট সেটি, যার জন্য তারা জীবন বিক্রি করে
দিয়েছে। অর্থাৎ নিজেদের কল্যাণ, শুভ পরিণতি ও পরকালীন নাজাতকে
কুরবানী করে দিয়েছে।”
৯৭. তারা চাচ্ছিল, ঐ নবী তাদের ইসরাঈল বংশের মধ্যে জন্ম নেবে। কিন্তু যখন তিনি বনী ইসরাঈলের বাইরে এমন এক বংশে জন্মগ্রহণ
করলেন, যাদেরকে
তারা নিজেদের মোকাবিলায় তুচ্ছ-জ্ঞান করতো, তখন তারা তাঁকে
অস্বীকার করতে উদ্যত হলো। অর্থাৎ তারা যেন বলতে চাচ্ছিল,আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে নবী পাঠালেন না
কেন?যখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস না করে যাকে ইচ্ছা তাকে নবী
বানিয়ে পাঠালেন তখন তারা বেঁকে বসলো।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا
بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا نُؤْمِنُ بِمَا أُنزِلَ عَلَيْنَا وَيَكْفُرُونَ بِمَا
وَرَاءَهُ وَهُوَ الْحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَهُمْ ۗ قُلْ فَلِمَ تَقْتُلُونَ أَنبِيَاءَ
اللَّهِ مِن قَبْلُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
৯১। যখন
তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন তার ওপর ঈমান আনো, তারা বলে, “আমরা কেবল আমাদের এখানে
(অর্থাৎ বনী ইসরাঈলদের মধ্যে) যা কিছু নাযিল হয়েছে তার ওপর ঈমান আনি।” এর বাইরে যা
কিছু এসেছে তার প্রতি ঈমান আনতে তারা অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অথচ তা
সত্য এবং তাদের কাছে পূর্ব থেকে যে শিক্ষা ছিল তার সত্যতার স্বীকৃতিও দিচ্ছে। তাদেরকে
বলে দাওঃ যদি তোমরা তোমাদের ওখানে যে শিক্ষা নাযিল হয়েছিল তার ওপর ঈমান এনে থাকো, তাহলে ইতিপূর্বে আল্লাহর
নবীদেরকে (যারা বনী ইসরাঈলদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন) হত্যা করেছিলে কেন?
﴿وَلَقَدْ جَاءَكُم مُّوسَىٰ
بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ اتَّخَذْتُمُ الْعِجْلَ مِن بَعْدِهِ وَأَنتُمْ ظَالِمُونَ﴾
৯২। তোমাদের
কাছে মূসা এসেছিল কেমন সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো নিয়ে। তারপরও
তোমরা এমনি যালেম হয়ে গিয়েছিলে যে, সে একটু আড়াল হতেই তোমরা বাছুরকে উপাস্য
বানিয়ে বসেছিলে।
﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ
وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّورَ خُذُوا مَا آتَيْنَاكُم بِقُوَّةٍ وَاسْمَعُوا ۖ قَالُوا
سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا وَأُشْرِبُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْعِجْلَ بِكُفْرِهِمْ ۚ قُلْ
بِئْسَمَا يَأْمُرُكُم بِهِ إِيمَانُكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
৯৩। তারপর সেই
অংগীকারের কথাটাও একবার স্মরণ করো, যা আমি তোমাদের থেকে
নিয়েছিলাম তূর পাহাড়কে তোমাদের ওপর উঠিয়ে রেখে। আমি জোর
দিয়েছিলাম, যে পথনির্দেশ আমি তোমাদেরকে দিচ্ছি, দৃঢ়ভাবে তা মেনে চলো এবং মন দিয়ে শুনো। তোমাদের
পূর্বসূরীরা বলেছিল, আমরা শুনেছি কিন্তু মানবো না। তাদের
বাতিলপ্রিয়তা ও অন্যায় প্রবণতার কারণে তাদের হৃদয় প্রদেশে বাছুরই অবস্থান গেড়ে
বসেছি। যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো, তাহলে এ
কেমন ঈমান, যা তোমাদেরকে এহেন খারাপ কাজের নির্দেশ দেয়?
﴿قُلْ إِن كَانَتْ لَكُمُ
الدَّارُ الْآخِرَةُ عِندَ اللَّهِ خَالِصَةً مِّن دُونِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الْمَوْتَ
إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
৯৪। তাদেরকে
বলো, যদি
সত্যিসত্যিই আল্লাহ সমগ্র মানবতাকে বাদ দিয়ে একমাত্র তোমাদের জন্য আখেরাতের ঘর
নিদিষ্ট করে থাকেন, তাহলে তো
তোমাদের মৃত্যু কামনা করা উচিত৯৮–যদি তোমাদের এই ধারণায় তোমরা
সত্যবাদী হয়ে থাকো।
৯৮. ইহুদিদের দুনিয়া প্রীতির প্রতি এটি সূক্ষ্ম বিদ্রূপ বিশেষ। আখেরাতের জীবন সম্পর্কে যারা সচেতন এবং
আখেরাতের জীবনের সাথে যাদের সত্যিই কোন মানসিক সংযোগ থাকে তারা কখনো পার্থিব
স্বার্থ লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু ইহুদিদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল এবং এখনো
আছে।
﴿وَلَن يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا
بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ﴾
৯৫।
নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, তারা কখনো এটা কামনা করবে না। কারণ তারা
স্বহস্তে যা কিছু উপার্জন করে সেখানে পাঠিয়েছে তার স্বাভাবিক দাবী এটিই (অর্থাৎ
তারা সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে না)। আল্লাহ ঐ
সব যালেমদের অবস্থা ভালোভাবেই জানেন।
﴿وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ
النَّاسِ عَلَىٰ حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا ۚ يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ
أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَن يُعَمَّرَ ۗ وَاللَّهُ
بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ﴾
৯৬। বেঁচে
থাকার ব্যাপারে তোমরা তাদেরকে পাবে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে৯৯ এমনকি এ
ব্যাপারে তারা মুশরিকদের চাইতেও এগিয়ে রয়েছে। এদের
প্রত্যেকে চায় কোনক্রমে সে যেন হাজার বছর বাঁচতে পারে। অথচ দীর্ঘ
জীবন কোন অবস্থায়ই তাকে আযাব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। যে ধরনের
কাজ এরা করছে আল্লাহ তার সবই দেখছেন।
৯৯. কুরআনের মূল শব্দে এখানে ‘আলা হায়াতিন’ বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, কোন না কোনভাবে বেঁচে থাকা,
তা যে ধরনের বেঁচে থাকা হোক না কেন, সম্মানের
ও মর্যাদার বা হীনতার, দীনতার, লাঞ্ছনা-অবমাননার
জীবনই হোক না কেন তার প্রতিই তাদের লোভ।
c রুকুঃ ১২ d
﴿قُلْ مَن كَانَ عَدُوًّا
لِّجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَىٰ قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللَّهِ مُصَدِّقًا لِّمَا
بَيْنَ يَدَيْهِ وَهُدًى وَبُشْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ﴾
৯৭। ওদেরকে
বলে দাও, যে ব্যক্তি জিব্রীলের সাথে শত্রুতা
করে১০০ তার জেনে রাখা উচিত, জিব্রাঈল আল্লাহরই
হুকুমে এই কুরআন তোমার দিলে অবতীর্ণ করেছে১০১ এটি পূর্বে আগত কিতাবগুলোর
সত্যতা স্বীকার করে ও তাদের প্রতি সমর্থন যোগায়১০২ এবং ঈমানদারদের জন্য পথনির্দেশনা
ও সাফল্যের বার্তাবাহী।১০৩
১০০. ইহুদিরা কেবল নবী সা. এবং তাঁর ওপর যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকেই গালাগালি দিতো
না বরং তারা আল্লাহর প্রিয় মহান ফেরেশতা জিব্রাঈলকেও গালাগালি দিতো এবং বলতোঃসে
আমাদের শত্রু। সে রহমতের নয়, আযাবের ফেরেশতা।
১০১. অর্থাৎ এ জন্যই তোমাদের গালমন্দ জিব্রীলের ওপর নয়, আল্লাহর মহান সত্তার ওপর
আরোপিত হয়।
১০২. এর অর্থ হচ্ছে, জিব্রাঈল এ কুরআন মজীদ বহন করে এনেছেন বলেই তোমরা এ গালাগালি করছো। অথচ কুরআন সরাসরি তাওরাতকে সমর্থন যোগাচ্ছে। কাজেই তোমাদের গালিগালাজ তাওরাতের বিরুদ্ধেও
উচ্চারিত হয়েছে।
১০৩. এখানে একটি বিশেষ বিষয়বস্তুর প্রতি সূক্ষ্ম ইংগিত করা হয়েছে।সেটি হচ্ছেঃ ওহে নির্বোধের দল!তোমাদের সমস্ত
অসন্তুষ্টি হচ্ছে হিদায়াত ও সত্য-সহজ পথের বিরুদ্ধে।তোমরা লড়ছো সঠিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।অথচ এই সঠিক ও নির্ভুল নেতৃত্বকে সহজভাবে মেনে নিলে তা তোমাদের
জন্য সাফল্যের সুসংবাদ বহন করে আনতো।
﴿مَن كَانَ عَدُوًّا لِّلَّهِ
وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِّلْكَافِرِينَ﴾
৯৮। (যদি এই
কারণে তারা জিব্রীলের প্রতি শত্রুতার মনোভাব পোষণ করে থাকে তাহলে তাদেরকে বলে দাও)যে
ব্যক্তি আল্লাহ তাঁর ফেরেশতা, তাঁর রাসূলগণ, জিব্রাঈল ও মীকাইলের শত্রু
আল্লাহ সেই কাফেরদের শত্রু।
﴿وَلَقَدْ أَنزَلْنَا إِلَيْكَ
آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ ۖ وَمَا يَكْفُرُ بِهَا إِلَّا الْفَاسِقُونَ﴾
৯৯। আমি তোমার
প্রতি এমন সব আয়াত নাযিল করেছি যেগুলো দ্ব্যর্থহীন সত্যের প্রকাশে সমুজ্জ্বল। একমাত্র
ফাসেক গোষ্ঠী ছাড়া আর কেউ তার অনুগামিতায় অস্বীকৃতি জানায়নি।
﴿أَوَكُلَّمَا عَاهَدُوا عَهْدًا
نَّبَذَهُ فَرِيقٌ مِّنْهُم ۚ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ﴾
১০০। যখনই তারা
কোন অংগীকার করেছে তখনই কি তাদের কোন না কোন উপদল নিশ্চিতরূপেই তার বুড়ো আঙুল
দেখায়নি। বরং তাদের অধিকাংশই সাচ্চা ঈমান আনে না।
﴿وَلَمَّا جَاءَهُمْ رَسُولٌ
مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ نَبَذَ فَرِيقٌ مِّنَ الَّذِينَ أُوتُوا
الْكِتَابَ كِتَابَ اللَّهِ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ كَأَنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾
১০১। আর যখনই
তাদের কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত কিতাবের সত্যতা প্রমাণ করে ও তার প্রতি সমর্থন দিয়ে
কোন রাসূল এসেছে তখনই এই আহলি কিতাবদের একটি উপদল আল্লাহর কিতাবকে এমনভাবে পেছনে
ঠেলে দিয়েছে যেন তারা কিছু জানেই না।
﴿وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو
الشَّيَاطِينُ عَلَىٰ مُلْكِ سُلَيْمَانَ ۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَٰكِنَّ الشَّيَاطِينَ
كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ
هَارُوتَ وَمَارُوتَ ۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ
فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ ۖ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ
الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ ۚ وَمَا هُم بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ
ۚ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ ۚ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ
اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ ۚ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنفُسَهُمْ
ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ﴾
১০২। আর এই সংগে তারা এমন সব জিনিসের অনুসরণ করাতে মেতে ওঠে, যেগুলো শয়তানরা পেশ করতো সুলাইমানী রাজত্বের নামে।১০৪ অথচ সুলাইমান কোন দিন কুফরী করেনি। কুফরী করেছে সেই শয়তানরা, যারা লোকদেরকে যাদু শেখাতো। তারা ব্যবিলনে দুই ফেশেতা হারূত ও মারূতের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছির তা আয়ত্ব করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। অথচ তারা(ফেরেশতারা) যখনই কাউকে এর শিক্ষা দিতো, তাকে পরিষ্কার ভাষায় এই বলে সতর্ক করে দিতোঃ দেখো, আমরা নিছক একটি পরীক্ষা মাত্র, তুমি কুফরীতে লিপ্ত হয়ো না।১০৫ এরপরও তারা তাদের থেকে এমন জিনিস শিখতো