তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿سُورَةٌ أَنزَلْنَاهَا وَفَرَضْنَاهَا وَأَنزَلْنَا فِيهَا آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ لَّعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ﴾
১। এটি একটি সূরা, আমি এটি নাযিল করেছি এবং একে ফরয করে দিয়েছি আর এর মধ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশসমূহ নাযিল করেছি,১ হয়তো তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে।
১. এসব বাক্যাংশের মধ্যে “আমি”র ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আর কেউ এটি নাযিল করেনি বরং “আমিই” নাযিল করেছি। তাই কোন শক্তিহীন উপদেশকের বাণীর মতো একে হালকা জিনিস মনে করে বসো না। ভালো করে জেনে রাখো, এমন এক সত্ত্বা এটি নাযিল করেছেন যার মুঠোর মধ্যে রয়েছে তোমাদের প্রাণ ও কিসমত এবং তোমরা মরেও যার পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না।
দ্বিতীয় বাক্যাংশে বলা হয়েছে, এ সূরায় যেসব কথা বলা হয়েছে সেগুলো “সুপারিশ” পর্যায়ের জিনিস নয়। তোমার ইচ্ছা হলে মেনে নিলে অন্যথায় যা ইচ্ছা তাই করতে থাকলে, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং এটি হচ্ছে অকাট্য ও চূড়ান্ত বিধান। এ বিধান মেনে চলা অপরিহার্য। যদি তুমি মু’মিন ও মুসলিম হয়ে থাকো, তাহলে এ বিধান অনুযায়ী কাজ করা তোমার জন্য ফরয।
তৃতীয় বাক্যাংশে বলা হয়েছে, এ সূরায় যেসব নির্দেশ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা নেই। পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট নির্দেশনামা। এগুলো সম্পর্কে তোমরা এ ওজর পেশ করতে পারবে না যে, অমুক কথাটি বুঝতে পারিনি কাজেই সেটিকে কেমন করে কার্যকর করতাম?
যে মহান ঘোষণার পরে আইনগত বিধান শুরু হয়ে যায় এই হচ্ছে তার ভূমিকা (Preamble)। সূরা আন নূরের বিধানগুলো মহান আল্লাহ কত গুরুত্ব সহকারে পেশ করছেন এ ভূমিকার বর্ণনাভঙ্গী নিজেই তা জানিয়ে দিচ্ছে। আইন-বিধান সম্বলিত অন্য কোন সূরার ভূমিকা এত বেশী জোরদার নয়।
﴿الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ ۖ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۖ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾
২। ব্যভিচারিনী ও ব্যভিচারী উভয়ের প্রত্যেককে এক শত বেত্রাঘাত করো।২ আর আল্লাহর দীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি কোন মমত্ববোধ ও করুণা যেন তোমাদের মধ্যে না জাগে যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনো।৩ আর তাদেরকে শাস্তি দেবার সময় মু’মিনদের একটি দল যেন উপস্থিত থাকে।৪
২. এ বিষয়টির অনেকগুলো আইনগত, নৈতিক ও ঐতিহাসিক দিক ব্যাখ্যা সাপেক্ষ রয়ে গেছে। সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা ছাড়া বর্তমান যুগে এক ব্যক্তির জন্য আল্লাহর এ শরীয়াতী বিধান অনুধাবন করা কঠিন। তাই নিচে আমি এর বিভিন্ন দিকের ওপর ধারাবাহিকভাবে আলোকপাত করবোঃ
একঃ যিনা বা ব্যভিচারের যে সাধারণ অর্থটি প্রত্যেক ব্যক্তি জানে সেটি হচ্ছে এই যে, ‘একটি পুরুষ একটি স্ত্রীলোক নিজেদের মধ্যে কোন বৈধ দাম্পত্য সম্পর্ক ছাড়াই পরস্পর যৌন মিলন করে।’ এ কাজটির নৈতিকভাবে খারাপ হওয়া অথবা ধর্মীয় দিক দিয়ে পাপ হওয়া কিংবা সামাজিক দিক দিয়ে দূষণীয় ও আপত্তিকর হওয়া এমন একটি জিনিস যে ব্যাপারে প্রাচীনতম যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সকল মানব সমাজ ঐকমত্য পোষণ করে আসছে। কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন কয়েকজন লোক যারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিকে নিজেদের প্রবৃত্তি তোষণ নীতির অধীন করে দিয়েছে অথবা যারা নিজেদের উন্মত্ত মস্তিষ্কের অভিনব খেয়ালকে দার্শনিক তত্ত্ব মনে করে নিয়েছে তারা ছাড়া আর কেউই আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে মতবিরোধ প্রকাশ করেনি। এ বিশ্বজনীন ঐকমত্যের কারণ হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রকৃতি নিজেই যিনা হারাম হওয়ার দাবী জানায়। মানবজাতির অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব এবং মানবিক সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা উভয়ই এ বিষয়টির ওপর নির্ভর করে যে, নারী ও পুরুষ শুধুমাত্র আনন্দ উপভোগের জন্য মিলিত হবার এবং তারপর আলাদা হয়ে যাবার ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারী হবে না বরং প্রত্যেকটি জোড়ার পারস্পরিক সম্পর্ক এমন একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার ও চুক্তির ভিত্তিতে গড়ে উঠবে যা সমাজের সবাই জানবে এবং সবার কাছে হবে পরিচিত এবং এ সঙ্গে সমাজ তার নিশ্চয়তাও দেবে। এ অঙ্গীকার ও চুক্তি ছাড়া মানুষের বংশধারা এক দিনের জন্যও চলতে পারে না। কারণ মানব শিশু নিজের জীবন ও নিজের বিকাশের জন্য বছরের পর বছরের সহানুভূতিশীল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা-প্রশিক্ষণের মুখাপেক্ষী হয়। যে পুরুষটি এ শিশুর দুনিয়ায় অস্তিত্ব লাভের কারণ হয়েছে যতক্ষণ না সে নারীর সাথে এ সহযোগিতা করবে ততক্ষণ কোন নারী একাকী এ বোঝা বহন করার জন্য কখনো তৈরী হতে পারে না। অনুরূপভাবে এ চুক্তি ছাড়া মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতিও টিকে থাকতে পারে না। কারণ সভ্যতা-সংস্কৃতির জন্মই তো একটি পুরুষ ও একটি নারীর সহাবস্থান করার, গৃহ ও পরিবারের অস্তিত্ব দান করার এবং তারপর পরিবারগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমেই হয়ে থাকে। যদি নারী ও পুরুষ গৃহ ও পরিবার গঠন না করে নিছক আনন্দ উপভোগের জন্য স্বাধীনভাবে সহাবস্থান করতে থাকে তাহলে সমস্ত মানুষ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। সমাজ জীবনের ভিত্তি চূর্ণ ও বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির এ ইমারত যে ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে তার অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এসব কারণে নারী ও পুরুষের যে স্বাধীন সম্পর্ক কোন সুপরিচিত ও সর্বসম্মত বিশ্বস্ততার চুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় তা মূলত মানবিক প্রকৃতির বিরোধী। এসব কারণেই প্রতি যুগে মানুষ একে মারাত্মক দোষ, বড় ধরনের অসদাচার ও ধর্মীয় পরিভাষায় একটি কঠিন গোনাহ মনে করে এসেছে এবং এসব কারণেই প্রতি যুগে মানব সমাজ বিয়ের প্রচলন ও প্রসারের সাথে সাথে যিনা ও ব্যভিচারের পথ বন্ধ করার জন্য কোন না কোনভাবে অবশ্যই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে এ প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইন-কানুন এবং নৈতিক, তামাদ্দুনিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য ছিল। জাতি ও সমাজের জন্য যিনার ক্ষতিকর হবার চেতনা কোথাও কম এবং কোথাও বেশী, কোথাও সুস্পষ্ট আবার কোথাও অন্যান্য সমস্যার সাথে জড়িয়ে অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
দুইঃ যিনার হারাম হবার ব্যাপারে একমত হবার পর যে বিষয়ে মতবিরোধ হয়েছে সেটি হচ্ছে, এর অপরাধ অর্থাৎ আইনগতভাবে শাস্তিযোগ্য হবার ব্যাপারটি। এখান থেকে ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্ম ও আইনের বিরোধ শুরু হয়। যেসব সমাজ মানব প্রকৃতির কাছাকাছি থেকেছে তারা সবসময় যিনা অর্থাৎ নারী ও পুরুষের অবৈধ সম্পর্ককে একটি অপরাধ হিসেবে দেখে এসেছে এবং এজন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ধারা যতই সমাজকে খারাপ করে চলেছে এ অপরাধ সম্পর্কে ততই মনোভাব কোমল হয়ে চলেছে।
এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম যে শৈথিল্য প্রদর্শন করা হয় এবং অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রদর্শন করা হয় সেটি ছিলঃ “নিছক যিনা” (Fornication) এবং “পর নারীর সাথে যিনা” (Adultery) এর মধ্যে পার্থক্য করে প্রথমটিকে সামান্য ভুল এবং কেবলমাত্র শেষোক্তটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা হয়।
নিছক যিনার যে সংজ্ঞা বিভিন্ন আইনে পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, “কোন অবিবাহিত বা বিবাহিত পুরুষ এমন কোন মেয়ের সাথে সঙ্গম করে যে অন্য কোন পুরুষের স্ত্রী নয়।” এ সংজ্ঞায় মূলত পুরুষের নয় বরং নারীর অবস্থার ওপর নির্ভর করা হয়েছে। নারী যদি স্বামীহীনা হয় তাহলে তার সাথে সঙ্গম নিছক যিনা হবে। এক্ষেত্রে সঙ্গমকারী পুরুষের স্ত্রী থাক বা না থাক। তাতে কিছু আসে যায় না। প্রাচীন মিসর, ব্যাবিলন, আসিরীয়া ও ভারতের আইনে এর শাস্তি ছিল খুবই হালকা পরিমাণের। গ্রীস ও রোমও এ পদ্ধতিই অবলম্বন করে। পরবর্তী পর্যায়ে ইহুদীরাও এ থেকে প্রভাবিত হয়। বাইবেলে একে শুধুমাত্র এমন একটি অন্যায় বলা হয়েছে যার ফলে পুরুষকে কেবলমাত্র অর্থদণ্ডই দিতে হয়। যাত্রা পুস্তকে এ সম্পর্কে যে হুকুম দেয়া হয়েছে তার শব্দাবলী নিম্নরূপঃ
“আর কেহ যদি অবাগদত্তা কুমারীকে ভুলাইয়া তাহার সহিত শয়ন করে, তবে সে অবশ্য কন্যাপণ দিয়া তাহাকে বিবাহ করিবে। যদি সেই ব্যক্তির সহিত আপন কন্যার বিবাহ দিতে পিতা নিতান্ত অসম্মত হয়, তবে কন্যাপণের ব্যবস্থানুসারে তাহাকে রৌপ্য দিতে হইবে।” (২২: ১৬-১৭)
“দ্বিতীয় বিবরণে” এ হুকুমটি কিছুটা অন্য শব্দাবলীর সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তারপর বলা হয়েছে, পুরুষের কাছ থেকে পঞ্চাশ শেকল (প্রায় ২০ তোলা) পরিমাণ রৌপ্য কন্যার পিতাকে জরিমানা দেবে। (২২: ২৮-২৯) তবে কোন ব্যক্তি যদি পুরোহিতের মেয়ের সাথে যিনা করে তাহলে তার জন্য ইহুদী আইনে রয়েছে ফাঁসি এবং মেয়েকে জীবিত অগ্নিদগ্ধ করার ব্যবস্থা। (Everyman’s Talmud, P 319-20)
এ চিন্তাটি হিন্দু চিন্তার সাথে কত বেশী সামঞ্জস্যশীল তা অনুমান করার জন্য মনু সংহিতার সাথে একবার মিলিয়ে দেখুন। সেখানে বলা হয়েছেঃ
“যে ব্যক্তি নিজের জাতের কুমারী মেয়ের সাথে তার সম্মতিক্রমে যিনা করে সে কোন শাস্তি লাভের যোগ্য নয়। মেয়ের বাপ রাজী থাকলে সে বিনিময় দিয়ে তাকে বিয়ে করে নেবে। তবে মেয়ে যদি উচ্চ বর্ণের হয় এবং পুরুষ হয় নিম্নবর্ণের, তাহলে মেয়েকে গৃহ থেকে বের করে দেয়া উচিত এবং পুরুষের অঙ্গচ্ছেদের শাস্তি দিতে হবে।” (৮: ৩৬৫-৩৬৬) আর মেয়ে ব্রাহ্মণ হলে এ শাস্তি জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করার শাস্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। (৩৭৭ শ্লোক)।
আসলে এ সমস্ত আইনে পরস্ত্রীর সাথে যিনা করাই ছিল বড় অপরাধ। অর্থাৎ যখন কোন (বিবাহিত বা অবিবাহিত) ব্যক্তি এমন কোন মেয়ের সাথে সঙ্গম করে যে অন্য কোন ব্যক্তির স্ত্রী। এ কর্মটির অপরাধ হবার ভিত্তি এ ছিল না যে, একটি পুরুষ একটি নারী যিনা করেছে। বরং তারা দু’জন মিলে তৃতীয় এক ব্যক্তিকে এমন একটি শিশু লালন-পালন করার বিপদে ফেলে দিয়েছে যেটি তার নয়, এটিই ছিল এর ভিত্তি। অর্থাৎ যিনা নয় বরং বংশধারা মিশ্রণের আশঙ্কা এবং একের সন্তানকে অন্যের অর্থে প্রতিপালন করা ও তার উত্তরাধিকার হওয়াই ছিল অপরাধের মূল ভিত্তি। এ কারণে পুরুষ ও নারী উভয়েই অপরাধী সাব্যস্ত হতো। মিসরীয়দের সামজে এর শাস্তি ছিল পুরুষটিকে লাঠি দিয়ে ভালোমতো পিটাতে হবে এবং মেয়েটির নাক কেটে দিতে হবে। প্রায় এ একই ধরণের শাস্তির প্রচলন ছিল ব্যাবিলন, আসিরীয়া ও প্রাচীন ইরানেও। হিন্দুদের মধ্যে নারীর শাস্তির ছিল, তার ওপর কুকুর লেলিয়ে দেয়া হতো এবং পুরুষের শাস্তি ছিল, তাকে উত্তপ্ত লোহার পালংকে শুইয়ে দিয়া চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেয়া হতো। গ্রীস ও রোমে প্রথম দিকে একজন পুরুষের অধিকার ছিল যদি সে নিজের স্ত্রীর সাথে কাউকে যিনা করতে দেখে তাহলে তাকে হত্যা করতে পারতো অথবা ইচ্ছা করলে তার কাছ থেকে অর্থদণ্ড নিতে পারতো। তারপর প্রথম খৃস্টপূর্বাব্দে সীজার আগষ্টিস এ আইন জারি করেন যে, পুরুষের সম্পত্তির অর্ধাংশ বাজেয়াপ্ত করে তাকে দেশান্তর করে দিতে হবে এবং নারীর অর্ধেক মোহরানা বাতিল এবং এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাকেও দেশের কোন দূরবর্তী এলাকায় পাঠিয়ে দিতে হবে। কনষ্টান্টিন এ আইনটি পরিবর্তিত করে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করেন। লিও (Leo) ও মারসিয়ানের (Mercian) যুগে এ শাস্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। তারপর সীজার জাষ্টিনীন এ শাস্তিটি আরো হাল্কা করে এ নিয়ম জারি করেন যে, মেয়েটিকে বেত্রাঘাত করার পর কোন সন্ন্যাসীর আশ্রমে দিয়ে আসতে হবে এবং তার স্বামীকে এ অধিকার দেয়া হয় যে, সে চাইলে দু’বছর পর তাকে সেখান থেকে বের করে আনতে পারে অন্যথায় সারা জীবন সেখানে ফেলে রাখতে পারে।
ইহুদী আইনে পরস্ত্রীর সাথে যিনা সম্পর্কে যে বিধান পাওয়া যায় তা হচ্ছে নিম্নরূপঃ
“আর মূল্য দ্বারা কিংবা অন্যরূপে মুক্ত হয় নাই, এমন যে বাগদত্তা দাসী, তাহার সহিত যদি কেহ সঙ্গম করে, তবে তাহারা দণ্ডনীয় হইবে; তাহাদের প্রাণদণ্ড হইবে না, কেননা সে মুক্ত নহে।” (লেবীয় পুস্তকঃ ১৯: ১৭)
“আর যে ব্যক্তি পরের ভার্যার সহিত ব্যভিচার করে, যে ব্যক্তি প্রতিবাসীর ভার্যার সহিত ব্যভিচার করে, সেই ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী, উভয়ের প্রাণদণ্ড অবশ্যই হইবে।” (লেবীয় পুস্তকঃ ২০: ১০)
“কোন পুরুষ যদি পরস্ত্রীর সহিত শয়নকালে ধরা পড়ে, তবে পরস্ত্রীর সহিত শয়নকারী সেই পুরুষ ও সেই স্ত্রী উভয়ে হত হইবে।” (দ্বিতীয় বিবরণঃ ২২: ২২)
“যদি কেহ পুরুষের প্রতি বাগদত্তা কোন কুমারীকে নগর মধ্যে পাইয়া তাহার সহিত শয়ন করে, তবে তোমরা সেই দুইজনকে বাহির করিয়া নগরদ্বারের নিকটে আনিয়া প্রস্তরাঘাতে বধ করিবে, সেই কন্যাকে বধ করিবে, কেননা, নগরের মধ্যে থাকিলেও সে চিৎকার করে নাই এবং সেই পুরুষকে বধ করিবে, কেননা, সে আপন প্রতিবেশীর স্ত্রীকে মানভ্রষ্টা করিয়াছেঃ এইরূপে তুমি আপনার মধ্য হইতে দুষ্টাচার লোপ করিবে। কিন্তু যদি কোন পুরুষ বাগদত্তা কন্যাকে মাঠে পাইয়া বলপূর্বক তাহার সহিত শয়ন করে, তবে তাহার সহিত শয়নকারী সেই পুরুষ মাত্র হত হইবে, কিন্তু কন্যার প্রতি তুমি কিছুই করিবে না।” (দ্বিতীয় বিবরণঃ ২২: ২৩-২৬)
কিন্তু হযরত ঈসা আ. এর যুগের বহু পূর্বে ইহুদী উলামা, ফকীহ, শাসক ও জনতা সবাই এ আইন কার্যত রহিত করে দিয়েছিল। যদিও এ আইন বাইবেলে লিখিত ছিল এবং একই আল্লাহর হুকুম মনে করা হতো কিন্তু কেউ এর কার্যত প্রচলনের পক্ষপাতি ছিল না। এমনকি এ হুকুমটি কখনো জারি করা হয়েছিল এমন কোন নজিরও ইহুদীদের ইতিহাসে পাওয়া যেতো না। হযরত ঈসা আ. যখন সত্যের দাওয়াত নিয়ে আবির্ভূত হন এবং ইহুদী আলেমগণ দেখেন এ বন্যা প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থাই কার্যকর হচ্ছে না তখন তারা একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তারা এক ব্যভিচারিণীকে তাঁর কাছে ধরে আনেন এবং বলেন, এর ফায়সালা করে দিন। (যোহনঃ ৮:১-১১) এ থেকে তাদের উদ্দেশ্য ছিল হযরত ঈসাকে কুয়া বা খাদ দু’টোর মধ্য থেকে কোন একটিতে লাফিয়ে পড়তে বাধ্য করা। যদি তিনি পাথর মেরে হত্যা (রজম) ছাড়া অন্য কোন শাস্তি নির্ধারণ করেন, তাহলে একথা বলে তাঁর দুর্নাম রটানো হবে যে, দেখো ইনি একজন অভিনব পয়গম্বর এসেছেন, দুনিয়ার ভয়ে আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে ফেলেছেন। আর যদি ‘রজম’ করার হুকুম দেন, তাহলে একদিকে রোমীয় আইনের সাথে তাঁর সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়া হবে আর অন্যদিকে জাতিকে বলা হবে, এ পয়গম্বর সাহেবকে মেনে নাও, দেখে নাও একবার তাওরাতের পুরো শরীয়াত তোমাদের পিঠে ও জীবনের ওপর নিক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু হযরত ঈসা আ. একটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে তাদের কৌশল তাদের মাথার ওপর ছুঁড়ে মারেন। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে নিজে পাক-পবিত্র-ব্যভিচারমুক্ত সে এগিয়ে এসে এর ওপর পাথর নিক্ষেপ করো। এ কথা শুনতেই ফকীহদের পুরো জমায়েত ফাঁকা হয়ে যায়। প্রত্যেকে মুখ লুকিয়ে কেটে পড়েন এবং আল্লাহর শরীয়াতের বাহকদের নৈতিক অবস্থা একেবারেই নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে। তারপর যখন মেয়েটি একাকী দাঁড়িয়ে থাকে তখন তিনি তাকে নসীহত করেন এবং তাওবা পড়িয়ে বিদায় করে দেন। কারণ তিনি বিচারক ছিলেন না। কাজেই তার মামলার ফায়সালা তিনি করতে পারতেন না। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে কোন সাক্ষীও উপস্থাপিত হয়নি। সর্বোপরি আল্লাহর আইন জারি করার জন্য কোন ইসলামী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
হযরত ঈসার এ ঘটনা এবং বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত তাঁর আরো কতিপয় বিক্ষিপ্ত বাণী থেকে ভুল যুক্তি সংগ্রহ করে ঈসায়ীরা যিনার অপরাধ সম্পর্কে অন্য একটি ধারণা তৈরী করে নিয়েছে। তাদের মতে অবিবাহিত পুরুষ যদি অবিবাহিত মেয়ের সাথে যিনা করে তাহলে এটা যিনা তো হবে ঠিকই কিন্তু শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে না। আর যদি এ কর্মের পুরুষ বা নারী যে কোন এক পক্ষ বিবাহিত হয় অথবা উভয় পক্ষই হয় বিবাহিত, তাহলে এটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু একে অপরাধে পরিণত করে “চুক্তিভঙ্গ”, নিছক যিনা নয়। তাদের মতে যে ব্যক্তিই বিবাহিত হবার পরও যিনা করে সে গীর্জায় পাদ্রির সামনে নিজের স্ত্রী বা স্বামীর সাথে যে বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার ও চুক্তি করেছিল তা ভঙ্গ করে ফেলেছে তাই সে অপরাধী। কিন্তু এ অপরাধের এছাড়া আর কোন শাস্তি নেই যে, যিনাকারী পুরুষের স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে অবিশ্বস্ততার দাবী করে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি লাভ করতে পারবে এবং যিনাকারী স্ত্রীর স্বামী একদিকে নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবিশ্বস্ততার দাবী করে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি লাভ করতে পারবে এবং অন্য দিকে যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে খারাপ করেছে তার কাছ থেকে অর্থদণ্ড লাভ করার অধিকার রাখে। খৃস্টীয় আইন বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারীনিকে এ শাস্তিই দিয়ে থাকে। আর সর্বনাশের ব্যাপার হচ্ছে, এ শাস্তি দুধারী তলোয়ারের মতো। যদি কোন স্ত্রী তার বিশ্বাসঘাতক স্বামীর বিরুদ্ধে “অবিশ্বস্ততার” দাবী করে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি হাসিল করে নেয়, তাহলে তো সে সেই বিশ্বাসঘাতক স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে কিন্তু খৃস্টীয় আইন অনুযায়ী এরপর আর সে জীবনভর দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। আর যে পুরুষটি তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবিশ্বস্ততার দাবী এনে বিবাহ বিচ্ছেদ করেছিল তার অবস্থাও তাই হবে। কারণ খৃস্টীয় আইন তাকেও দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দেয় না। এ যেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্য থেকে যে সারা জীবন যোগী হিসেবে থাকতে চাইবে নিজের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর বিরুদ্ধে খৃস্টীয় আদালতে তার অবিশ্বস্ততার মামলা ঠুকে দিলেই চলবে।
বর্তমান যুগের পাশ্চাত্য আইন-কানুন এসব বিচিত্র চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ মুসলিম দেশও আজ এসব আইনের ধারা অনুসরণ করে চলছে। এ পাশ্চাত্য আইনের দৃষ্টিতে যিনা করা একটি দোষ, নৈতিক চরিত্রহীনতা বা পাপ যাই কিছু হোক না কেন, মোটকথা এটা কোন অপরাধ নয়। একে যদি কোন জিনিস অপরাধে পরিণত করতে পারে তাহলে তা হচ্ছে এমন ধরনের বল প্রয়োগ যার সাহায্যে দ্বিতীয় পক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌন ক্রিয়া করা হয়। আর কোন বিবাহিত পুরুষের যিনা করার ব্যাপারটা হচ্ছে, তা যদি অভিযোগের কারণ হয়ে থাকে তাহলে তার স্ত্রীর জন্য। সে চাইলে তার প্রমাণ দিয়ে তালাক হাসিল করতে পারে। আর যিনার অপরাধী যদি হয় বিবাহিত নারী, তাহলে তার স্বামীর কেবল তার বিরুদ্ধে নয় বরং যিনাকারী পুরুষের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দেখা দেয় এবং উভয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে সে স্ত্রী থেকে তালাক এবং যিনাকারী পুরুষ থেকে অর্থদণ্ড নিতে পারে।
তিনঃ এসব চিন্তার বিপরীতে ইসলামী আইন স্বয়ং যিনাকেই একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করে এবং বিবাহিত হবার পরও যিনা করলে তার দৃষ্টিতে তা অপরাধের মাত্রা আরো বেশী বাড়িয়ে দেয়। এটা এজন্য নয় যে, অপরাধী কারোর সাথে “চুক্তিভঙ্গ” অথবা অন্য কারো বিছানায় হস্তক্ষেপ করেছে। বরং এজন্য যে, তার নিজের প্রবৃত্তির কামনা পূরণ করার জন্য একটি বৈধ মাধ্যম ছিল এবং এরপরও সে অবৈধ মাধ্যম অবলম্বন করেছে। ইসলামী আইন যিনাকে যে দৃষ্টিতে দেখে তা হচ্ছে এই যে, এটি এমন একটি কর্ম যাকে স্বাধীনভাবে করার সুযোগ দেয়া হলে একদিকে মানব বংশধারা এবং অন্যদিকে তার সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলোচ্ছেদ হয়ে যাবে। বংশধারার স্থায়িত্ব ও সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা উভয়ের জন্য নারী ও পুরুষের সম্পর্ক শুধুমাত্র আইন অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা অপরিহার্য। আর তার সাথে সাথে যদি অবাধ যৌন সম্পর্কেরও খোলাখুলি অবকাশ থাকে তাহলে তাকে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। কারণ গৃহ ও পরিবারের দায়িত্বের বোঝা বহন করা ছাড়া যেখানে লোকদের প্রবৃত্তির কামনা পূর্ণ করার সুযোগ থাকে সেখানে তাদের থেকে আশা করা যেতে পারে না যে, সেসব প্রবৃত্তির কামনা পূর্ণ করার জন্য তারা আবার এত বড় দায়িত্বের বোঝা বহন করতে উদ্যত হবে। এটা ঠিক বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের স্বাধীনতা থাকার পর রেল গাড়িতে বসার জন্য টিকিটের শর্ত অর্থহীন হয়ে যাওয়ার মতো। টিকিটের শর্ত যদি অপরিহার্য হয়ে থাকে তাহলে তাকে কার্যকর করার জন্য বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। তারপর যদি কোন ব্যক্তি পয়সা না থাকার কারণে বিনা টিকিটে সফর করে তাহলে সে অপেক্ষাকৃত কম পর্যায়ের অপরাধী হবে এবং ধনাঢ্য হবার পরও এ অপরাধ করলে তার অপরাধ আরো কঠিন হয়ে যায়।
চারঃ ইসলাম মানব সমাজকে যিনার আশঙ্কা থেকে বাঁচাবার জন্য শুধুমাত্র দণ্ডবিধি আইনের অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না বরং তার জন্য ব্যাপক আকারে সংস্কার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে। আর এ দণ্ডবিধি আইনকে নির্ধারণ করেছে নিছক একটি শেষ উপায় হিসেবে। এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, লোকেরা এ অপরাধ করে যেতেই থাকুক এবং তাদেরকে বেত্রাঘাত করার জন্য দিনরাত তাদের ওপর নজর রাখা হোক। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা যেন এ অপরাধ না করে এবং কাউকে শাস্তি দেবার সুযোগই না পাওয়া যায়। সে সবার আগে মানুষের প্রবৃত্তির সংশোধন করে। তার মনের মধ্যে বসিয়ে দেয় অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী এবং সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহর ভয়। তার মধ্যে আখেরাতে জিজ্ঞাসাবাদের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। মরেও মানুষ এ হাত থেকে বাঁচতে পারে না। তার মধ্যে আল্লাহর আইনের আনুগত্য করার প্রেরণা সৃষ্টি করে। এটি হচ্ছে ঈমানের অপরিহার্য দাবী। আর তারপর বারবার তাকে এ মর্মে সতর্ক করে যে, যিনা ও সতীত্বহীনতা এমন বড় বড় গোনাহর অন্তর্ভুক্ত যেগুলো সম্পর্কে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সমগ্র কুরআনে বারবার এ বিষয়বস্তু সামনে আসতে থাকে। তারপর ইসলাম মানুষের জন্য বিয়ের যাবতীয় সম্ভাব্য সহজ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এক স্ত্রীতে তৃপ্ত না হলে চারটি পর্যন্ত বৈধ স্ত্রী রাখার সুযোগ করে দেয়। স্বামী-স্ত্রীর মনের মিল না হলে স্বামীর জন্য তালাক ও স্ত্রীর ‘খুলা’র সুযোগ করে দেয়। আর অমিলের সময় পারিবারিক সালিশ থেকে শুরু করে সরকারী আদালতে পর্যন্ত আপীল করার পথ খুলে দেয়, এ ফলে দু’জনের মধ্যে সমঝোতা হয়ে যেতে পারে আর নয়তো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের বন্ধন মুক্ত হয়ে নিজেদের ইচ্ছা মতো অন্য কোথাও বিয়ে করতে পারে। এসব বিষয় সূরা আল বাকারাহ, সূরা আন নিসা ও সূরা আত তালাকে দেখা যেতে পারে। আর এ সূরা আন নূরেও দেখা যাবে পুরুষ ও নারীকে বিয়ে না করে বসে থাকাকে অপছন্দ করা হয়েছে এবং এ ধরনের লোকদের বিয়ে করিয়ে দেবার এমনকি গোলাম ও বাঁদীদেরকেও অবিবাহিত করে না রাখার জন্য পরিষ্কার হুকুম দেয়া হয়েছে।
তারপর ইসলাম সমাজ থেকে এমন সব কার্যকারণ নির্মূল করে দেয় যেগুলো যিনার আগ্রহ ও তার উদ্যোগ সৃষ্টি করে এবং তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরী করতে পারে। যিনার শাস্তি বর্ণনা করার এক বছর আগে সূরা আল আহযাবে মেয়েদেরকে গৃহ থেকে বের হতে হলে চাদর মুড়ি দিয়ে এবং ঘোমটা টেনে বের হবার হুকুম দেয়া হয়েছিল। মুসলমান মেয়েদের জন্য যে নবীর গৃহ ছিল আদর্শ গৃহ সেখানে বসবাসকারী মহিলাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, নিজেদের গৃহ মধ্যে মর্যাদা ও প্রশান্তি সহকারে বসে থাকো, নিজেদের সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার প্রদর্শনী করে বেড়িও না এবং বাইরের পুরুষরা তোমাদের থেকে কোন জিনিস নিলে যেন পর্দার আড়াল থেকে নেয়। দেখতে দেখতে এ আদর্শ সমস্ত মু’মিন মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের কাছে জাহেলী যুগের নির্লজ্জ মহিলারা নয় বরং নবীর সা. স্ত্রী ও কন্যাগণই ছিলেন অনুসরণযোগ্য। অনুরূপভাবে ফৌজদারী আইনের শাস্তি নির্ধারণ করার আগে নারী ও পুরুষের অবাধ মিশ্রিত সামাজিকতা বন্ধ করা হয়, নারীদের সাজসজ্জা করে বাইরে বের হওয়া বন্ধ করা হয় এবং যে সমস্ত কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণ যিনার সুযোগ-সুবিধা তৈরী করে দেয় সেগুলোর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এসবের পরে যখন যিনার ফৌজদারী তথা অপরাধমূলক শাস্তি নির্ধারণ করা হয় তখন দেখা যায় এর সাথে সাথে এ সূরা আন নূরেই অশ্লীলতার সম্প্রসারণেও বাধা দেয়া হচ্ছে। পতিতাবৃত্তিকে (Prostitution) আইনগতভাবে বন্ধ করা হচ্ছে। নারী ও পুরুষদের বিরুদ্ধে বিনা প্রমাণে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া এবং তার আলোচনা করার জন্যও কঠোর শাস্তির বিধান দেয়া হচ্ছে। দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত করার হুকুম দিয়ে চোখকে প্রহরাধীন রাখা হচ্ছে, যাতে দৃষ্টি বিনিময় সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি এবং সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ কামচর্চায় পৌঁছতে না পারে। এ সঙ্গে নারীদেরকে নিজেদের ঘরে মাহ্রাম ও গায়ের মাহ্রাম আত্মীয়দের মধ্যে পার্থক্য করার এবং গায়ের মাহ্রামদের সামনে সেজেগুজে না আসার হুকুম দেয়া হচ্ছে। এ থেকে যে সংস্কার পরিকল্পনার একটি অংশ হিসেবে যিনার আইনগত শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে তার সমগ্র অবয়বটি অনুধাবন করা যেতে পারে। ভিতর-বাইরের যাবতীয় সংশোধন ব্যবস্থা অবলম্বন করা সত্ত্বেও যেসব দুষ্ট প্রকৃতির লোক প্রকাশ্য বৈধ সুযোগ বাদ দিয়ে অবৈধ পথ অবলম্বন করে নিজেদের প্রবৃত্তির কামনা পূর্ণ করার ওপর জোর দেয় তাদেরকে চরম শাস্তি দেবার এবং একজন ব্যভিচারীকে শাস্তি দিয়ে সমাজের এ ধরনের প্রবৃত্তির অধিকারী বহু সংখ্যক লোকের মানসিক অপারেশন করার জন্য এ শাস্তি। এ শাস্তি নিছক একজন অপরাধীর শাস্তির নয় বরং এটি একটি কার্যকর ঘোষণা যে, মুসলিম সমাজ ব্যভিচারীদের অবাধ বিচরণস্থল নয় এবং এটি স্বাদ আস্বাদনকারী পুরুষ ও নারীদের নৈতিক বাঁধনমুক্ত হয়ে যথেচ্ছা আমোদ ফুর্তি করার জায়গাও নয়। এ দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি ইসলামের এ সংস্কার পরিকল্পনা অনুধাবন করতে চাইলে সহজে অনুভব করেন যে, এ সমগ্র পরিকল্পনার একটি অংশকেও তার নিজের জায়গা থেকে সরানো যেতে পারে না এবং এর মধ্যে কোন কম-বেশীও করা যেতে পারে না। এর মধ্যে রদবদল করার চিন্তা করতে পারে এমন একজন অজ্ঞ-নাদান, যে একে অনুধাবন করার যোগ্যতা ছাড়াই এর সংশোধনকারী ও সংস্কারক হয়ে বসেছে অথবা মহাজ্ঞানী আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে এ পরিকল্পনাটি দিয়েছেন তা পরিবর্তন করাই যার আসল নিয়ত এমন একজন বিপর্যয় সৃষ্টিকারীই এ চিন্তা করতে পারে।
পাঁচঃ তৃতীয় হিজরীতেই তো যিনাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা হয়েছিল। কিন্তু তখনো পর্যন্ত এটি একটি আইনগত অপরাধ ছিল না। রাষ্ট্রীয় পুলিশ ও বিচার বিভাগ এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতো না। বরং তখন এটি ছিল একটি “সামাজিক” বা “পারিবারিক” অপরাধ। পরিবারের লোকদেরই এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ইখতিয়ার ছিল। হুকুম ছিল, যদি চার জন সাক্ষী এই মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, তারা একটি পুরুষ ও একটি মেয়েকে যিনা করতে দেখেছে তাহলে তাদের দু’জনকে মারধর করতে হবে এবং মেয়েটিকে গৃহবন্দী করতে হবে। এ সঙ্গে এ ইশারাও করে দেয়া হয়েছিল যে, “পরবর্তী হুকুম” না দেয়া পর্যন্ত হুকুমটি জারি থাকবে। আসল আইন পরে আসছে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নিসাঃ ১৫ ও ১৬ আয়াত এবং এ সঙ্গে টীকাও) এর আড়াই তিন বছর পর সূরা আন নূরের এ আয়াত নাযিল হয়। কাজেই এটি আগের হুকুম রহিত করে যিনাকে একটি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ যোগ্য (Cognizable Offence) আইনগত অপরাধ গণ্য করে।
ছয়ঃ এ আয়াতে যিনার যে শাস্তি নির্ধারণ করা হয় তা আসলে “নিছক যিনা”র শাস্তি, বিবাহিতের যিনার শাস্তি নয়। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে এ বিবাহিতের যিনা কঠিনতর অপরাধ। একথা কুরআনের একটি ইশারা থেকে জানা যায় যে, সে এখানে এমন একটি যিনার শাস্তি বর্ণনা করছে যার উভয় পক্ষ অবিবাহিত। সূরা আন নিসায় ইতিপূর্বে বলা হয়ঃ
وَاللَّاتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِنْ نِسَائِكُمْ……..أَوْ يَجْعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلًا
“তোমাদের নারীদের মধ্য থেকে যারা ব্যভিচারের অপরাধ করবে তাদের ওপর তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে চার জনের সাক্ষ্য নাও। আর যদি তারা সাক্ষ্য দিয়ে দেয় তাহলে এরপর তাদেরকে (অপরাধী নারীদেরকে) ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখে দাও, যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু এসে যায় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য বের করে দেন কোন পথ।” (আয়াতঃ ১৫)
এরপর কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বলা হয়ঃ
وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ مِنْكُمْ طَوْلًا أَنْ يَنْكِحَ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ فَمِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ فَتَيَاتِكُمُ الْمُؤْمِنَاتِ……فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ
“আর তোমাদের মধ্যে যারা মু’মিনদের মধ্য থেকে স্বাধীন নারীদেরকে বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে না, তারা তোমাদের মু’মিন বাঁদীদেরকে বিয়ে করবে।…… তারপর যদি (ঐ বাঁদীরা) বিবাহিত হয়ে যাবার পর ব্যভিচার করে, তাহলে তাদের শাস্তি (এ ধরনের অপরাধে) স্বাধীন নারীদের তুলনায় অর্ধেক দিতে হবে। (আয়াতঃ ২৫)
এর মধ্যে প্রথম আয়াতে আশা দেয়া হয়েছে যে, ব্যভিচারিণীদের জন্য, যাদেরকে আপাততঃ বন্দী করার হুকুম দেয়া হচ্ছে, আল্লাহ পরে কোন পথ বের করে দেবেন। এ থেকে জানা যায়, সূরা আন নিসার ওপরে উল্লেখিত আয়াতে যে ওয়াদা করা হয়েছিল এ দ্বিতীয় হুকুমটির মাধ্যমে সে ওয়াদা পূরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে বিবাহিতা বাঁদীর যিনার শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে একই আয়াতে এবং একই বর্ণনাধারায় দু’বার “মুহ্সানাত” তথা স্বাধীন নারী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আর উভয় জায়গায়ই এর অর্থ একই, একথা অবশ্য মানতেই হবে। এবার শুরুর দিকের বাক্যাংশ দেখুন, সেখানে বলা হচ্ছে, যারা “মুহ্সানাতদের” বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে না। অবশ্যই এখানে “মুহ্সানাত” মানে বিবাহিতা নারী হতে পারে না বরং এর মানে হতে পারে, একটি স্বাধীন পরিবারের অবিবাহিতা নারী। তারপর শেষের বাক্যাংশে বলা হচ্ছে, বাঁদী বিবাহিতা হবার পর যদি যিনা করে, তাহলে এ অপরাধে মুহ্সানাতের যে শাস্তি হওয়া উচিত তার শাস্তি হবে তার অর্ধেক। পরবর্তী আলোচনা পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে যে, প্রথম বাক্যাংশে “মুহ্সানাত” অর্থ যা ছিল এ বাক্যাংশেও তার অর্থ সে একই অর্থাৎ বিবাহিতা নয় বরং স্বাধীন পরিবারে লালিত-পালিত অবিবাহিতা নারী। এভাবে সূরা আন নিসার এ দু’টি আয়াতে একত্র হয়ে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে যে, সেখানে অবিবাহিতাদের যিনার শাস্তির কথা বর্ণনার যে ওয়াদা করা হয়েছিল সূরা আন নূরের এ হুকুমটি সে কথাই বর্ণনা করছে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নিসাঃ ৪৬ টীকা)
সাতঃ বিবাহিতের যিনার শাস্তি কি, একথা কুরআন মজীদ থেকে নয় বরং হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি। অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে প্রমাণিত, নবী সা. কেবল মুখেই এর শাস্তি রজম (প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু) বর্ণনা করেননি বরং কার্যত বহু সংখ্যক মোকদ্দমায় তিনি এ শাস্তি জারিও করেন। তাঁর পরে চার খোলাফায়ে রাশেদীনও নিজ নিজ যুগে এ শাস্তি জারি করেন এবং আইনগত শাস্তি হিসেবে বারবার এরই ঘোষণা দেন। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ ছিলেন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। কোন এক ব্যক্তিরও এমন একটি উক্তি পাওয়া যায় না যা থেকে একথা প্রমাণ হতে পারে যে, প্রথম যুগে এর প্রমাণিত শরয়ী’ হুকুম হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল। তাঁদের পরে সকল যুগের ও দেশের ইসলামী ফকীহগণ এর একটি প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত হবার ব্যাপারে একমত ছিলেন। কারণ এর নির্ভুলতার সপক্ষে এত বিপুলসংখ্যক ও শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে যার উপস্থিতিতে কোন তত্ত্বজ্ঞানী একথা অস্বীকার করতে পারেন না। উম্মতে মুসলিমার সমগ্র ইতিহাসে খারেজী ও কোন কোন মুতাজিলী ছাড়া কেউই একথা অস্বীকার করেননি। খারেজী ও মুতাজিলাদের অস্বীকৃতির কারণ এটা নয় যে, তারা নবী সা. থেকে এর প্রমাণের ক্ষেত্রে কোন প্রকার দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। বরং তারা একে কুরআন বিরোধী গণ্য করতেন। অথচ এটি ছিল তাঁদের নিজেদের কুরআন অনুধাবনের ত্রুটি। তাঁরা বলতেন, কুরআন الزَّانِي وَالزَّانِيَةُ এর একচ্ছত্র শর্তহীন শব্দ ব্যবহার করে এর শাস্তি বর্ণনা করে একশ’ বেত্রাঘাত। কাজেই কুরআনের দৃষ্টিতে সকল প্রকার ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর শাস্তি এটিই এবং এ থেকে বিবাহিত ব্যভিচারীকে পৃথক করে তার জন্য কোন ভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা করা আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তাঁরা এ কথা চিন্তা করেননি যে, কুরআনের শব্দাবলীর যে আইনগত গুরুত্ব রয়েছে সে একই গুরুত্বের অধিকারী হচ্ছে তাদের উদ্ধৃত নবী সা. এর ব্যাখ্যাও। তবে এখানে শর্ত শুধু হচ্ছে এই যে, এ ব্যাখ্যা যে তাঁরই একথা প্রমাণিত হতে হবে। কুরআন এ ধরনের ব্যাপক ও একচ্ছত্র অর্থবোধক শব্দের মাধ্যমে السَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ তথা পুরুষ চোর ও মেয়ে চোরের শাস্তি হিসেবে হাত কাটার বিধান দিয়েছেন। এ বিধানকেও যদি নবী সা. এর প্রমাণিত ব্যাখ্যাসমূহের নিয়ন্ত্রণাধীন না করা হয় তাহলে এর শব্দাবলীর ব্যাপকতার দাবী হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তি সামান্য একটু সুঁই বা কুল চুরি করলেও তাকে চোর আখ্যা দিয়ে তার হাতটি একেবারে কাঁধের কাছ থেকে কেটে দেয়া হবে। অন্যদিকে লাখ লাখ টাকা চুরি করার পরও যদি এক ব্যক্তি পাকড়াও হয়ে বলে, আমি নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছি এবং ভবিষ্যতে আমি আর চুরি করবো না, চুরি থেকে আমি তাওবা করে নিলাম তাহলে এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যি ছেড়ে দিতে হবে। কারণ কুরআন বলছেঃ
فَمَنْ تَابَ مِنْ بَعْدِ ظُلْمِهِ وَأَصْلَحَ فَإِنَّ اللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِ
“যে ব্যক্তি জুলুম করার পরে তাওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করে নেন।” (আল মায়িদাহঃ ৩৯)
এভাবে কুরআন শুধুমাত্র দুধ-মা ও বোনকে বিয়ে করা হারাম ঘোষণা করেছে, দুধ-কন্যাকে বিয়ে এ যুক্তির প্রেক্ষিতে কুরআন বিরোধী হওয়া উচিত। কুরআন কেবলমাত্র দুই বোনকে এক সঙ্গে বিয়ে করা নিষেধ করেছে। খালা-ভাগনী এবং ফুফী–ভাইঝিকে একত্রে বিয়ে করাকে যে ব্যক্তি হারাম বলে তার বিরুদ্ধে কুরআন বিরোধী হুকুম দিচ্ছে বলে অভিযোগ আনতে হবে। কুরআন সৎ-মেয়েকে বিয়ে করা শুধুমাত্র তখনই হারাম করে যখন সে তার সৎ-পিতার ঘরে প্রতিপালিত হয়। শর্তহীন ও একচ্ছত্রভাবে এর হারাম হওয়ার বিষয়টি কুরআন বিরোধী গণ্য হওয়া উচিত। কুরআন শুধুমাত্র এমন অবস্থায় ‘রেহেন’ রাখার অনুমতি দেয় যখন মানুষ বিদেশে সফররত থাকে এবং ঋণ সংক্রান্ত দলিলপত্র লেখার লোক পাওয়া না যায়। দেশে অবস্থানকালে এবং দলিলপত্র লেখার লোক পাওয়া গেলে এ অবস্থায় রেহেন রাখার বৈধতা কুরআন বিরোধী হওয়া উচিত। কুরআন সাধারণ ও ব্যাপক অর্থবোধক শব্দের মাধ্যমে হুকুম দেয়ঃ وَأَشْهِدُوا إِذَا تَبَايَعْتُمْ (অর্থাৎ পরস্পরের মধ্যে কেনাবেচা করার সময় সাক্ষী রাখো)।
এ প্রেক্ষিতে আমাদের হাটে-বাজারে-দোকানে দিনরাত বিনা সাক্ষী প্রমাণে যেসব কেনাবেচা হচ্ছে সেসবই অবৈধ হওয়া উচিত। এখানে গুটিকয় মাত্র দৃষ্টান্ত পেশ করলাম। এগুলোর ওপর চোখ বুলালে রজম তথা প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডকে যারা কুরআন বিরোধী বলেন, তাদের যুক্তির গলদ চোখের সামনে ভেসে উঠবে। শরীয়াতী ব্যবস্থায় নবীর দায়িত্ব হচ্ছে, তিনি আমাদের কাছে আল্লাহর হুকুম পৌঁছিয়ে দেবার পর আমাদের জানাবেন তার অর্থ কি, তা কার্যকর করার পদ্ধতি কি, কোন্ কোন্ বিষয়ে তা প্রযোজ্য হবে এবং কোন্ কোন্ বিষয়ে প্রযোজ্য হবে না। ইসলামী শরীয়াতে নবীর এ মর্যাদা অনস্বীকার্য। নবীর এ মর্যাদা ও পদাধিকার অস্বীকার করা শুধুমাত্র দীনের মূলনীতিরই অস্বীকার নয় বরং এর ফলে অগণিত বাস্তব ত্রুটিও দেখা দেয়।
আটঃ যিনার আইনগত সংজ্ঞা নির্দেশের ক্ষেত্রে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হানাফীগণ এর সংজ্ঞা বর্ণনা করে বলেন, কোন পুরুষের এমন কোন নারীর সাথে সম্মুখ দ্বার দিয়ে সঙ্গম করা যে তার বিয়ে করা স্ত্রী বা মালিকানাধীন বাঁদী নয় এবং যাকে বিবাহিতা স্ত্রী বা মালিকানাধীন বাঁদী মনে করে সঙ্গম করেছে বলে সন্দেহ পোষণ করার কোন যুক্তিসংগত কারণও যেখানে নেই।” এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে পশ্চাদ্বারে সঙ্গম, লূতের সম্প্রদায়ের কর্ম, পশুর সাথে সঙ্গম ইত্যাদির ওপর যিনার অর্থ প্রযোজ্য হয় না। শুধুমাত্র যখন শরীয়াতে সুস্পষ্ট অথবা অস্পষ্ট অধিকার ছাড়া নারীর সাথে সম্মুখদ্বার দিয়ে সঙ্গম করা হয় তখনই তা যিনা হিসেবে চিহ্নিত হয়। বিপরীতপক্ষে শাফেঈগণ এর সংজ্ঞা এভাবে বর্ণনা করেন, “লজ্জাস্থানকে এমন লজ্জাস্থানে প্রবেশ করানো যা শরীয়াতের দৃষ্টিতে হারাম কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে যেদিকে আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে।” আর মালেকীদের মতে এর সংজ্ঞা হচ্ছে, “শরীয়াত নির্ধারিত সুস্পষ্ট অথবা অস্পষ্ট অধিকার ছাড়া সম্মুখদ্বার বা পশ্চাদ্বার দিয়ে পুরুষ বা নারীর সাথে সঙ্গম করা” এ দু’টি সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে লূতের জাতির কর্মও যিনার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে, এ দু’টি সংজ্ঞাই যিনা শব্দের পরিচিত ব্যাখ্যার বাইরে পড়ে। কুরআন সবসময় শব্দকে তার পরিচিত ও সাধারণের জন্য সহজবোধ্য অর্থে ব্যবহার করে থাকে। তবে কখনো আবার সে কোন শব্দকে তার বিশেষ পরিভাষায় পরিণত করে এবং এ অবস্থায় সে নিজেই তার বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। এখানে যিনা শব্দটিকে কোন বিশেষ অর্থে ব্যবহার করার কোন লক্ষণ নেই। কাজেই একে পরিচিত অর্থেই গ্রহণ করা হবে। আর এ অর্থটি নারীর সাথে স্বাভাবিক কিন্তু অবৈধ সম্পর্ক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। যৌন কামনা চরিতার্থ করার অন্যান্য উপায় ও অবস্থা পর্যন্ত এটি বিস্তৃত নয়। এছাড়া একথাও সবার জানা যে, লূতের জাতির কুকর্ম তথা সমকামের শাস্তির ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। এ কর্মটিকেও যদি ইসলামী পরিভাষার দৃষ্টিতে যিনার মধ্যে শামিল করা হতো, তাহলে একথা সুস্পষ্ট যে, এক্ষেত্রে মতবিরোধের কোন অবকাশই থাকতো না।
নয়ঃ আইনগতভাবে একটি যিনা কর্মকে শাস্তিযোগ্য গণ্য করার জন্য কেবলমাত্র পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ প্রবেশ করানোটাই যথেষ্ট, সম্পূর্ণ প্রবেশ বা ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া এজন্য জরুরী নয়। পক্ষান্তরে যদি পুরুষাঙ্গ প্রবেশ না করে, তাহলে নিছক এক বিছানায় দু’জনকে পাওয়া অথবা জড়াজড়ি করতে দেখা কিংবা উলঙ্গ অবস্থায় পাওয়া কাউকে যিনাকারী গণ্য করার জন্য যথেষ্ট নয়। আবার কোন দু’জন নারী পুরুষকে এ অবস্থায় পেলে তাদের ডাক্তারী পরীক্ষা করার মাধ্যমে যিনার প্রমাণ পেশ করে তাদের বিরুদ্ধে যিনার শাস্তি প্রয়োগ করার কথাও ইসলামী শরীয়াত বলে না। যাদেরকে এ ধরনের অশ্লীল কাজে লিপ্ত পাওয়া যাবে তাদেরকে নিছক এমন ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হবে, যার ফায়সালা করবেন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের বিচারপতি নিজেই অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের মজলিসে শূরা তাদের জন্য কোন শাস্তি নির্ধারণ করবেন। এ শাস্তি বেত্রাঘাতের আকারে হলে তা দশ ঘা’র বেশী হবে না। কারণ হাদীসে পরিষ্কার বলা হয়েছেঃ
لَا يُجْلَدُ فَوْقَ عَشْرِ جَلَدَاتٍ إِلَّا فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللهِ
“আল্লাহ নির্ধারিত শাস্তি ছাড়া অন্য যে কোন অপরাধে দশ বেত্রাঘাতের বেশী শাস্তি দিয়ো না।” (বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ)
আর যদি কোন ব্যক্তি পাকড়াও হয়নি বরং নিজেই লজ্জিত হয়ে এ ধরনের কোন অপরাধের কথা স্বীকার করে, তাহলে তার জন্য শুধুমাত্র তাওবা করার নির্দেশ দেয়াই যথেষ্ট। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বললেনঃ “নগরের বাইরে আমি একটা নারীর সাথে সঙ্গম ছাড়া সবকিছু করে ফেলেছি। এখন জনাব আপনি আমাকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিন।” হযরত উমর রা. বললেনঃ “আল্লাহ যখন গোপন করে দিয়েছিলেন তখন তুমিও গোপন থাকতে দিতে।” নবী সা. সবকিছু শোনার পর নীরব থাকলেন এবং সে ব্যক্তি চলে গেলেন। তারপর তিনি তাকে ফিরিয়ে আনলেন এবং এ আয়াতটি পড়লেনঃ
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ
“নামায কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে এবং কিছু রাত অতিক্রান্ত হবার পর। অবশ্যই সৎকাজ অসৎকাজগুলোকে দূর করে দেয়।” (হূদঃ ১১৪)
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি শুধু তারই জন্য” নবী সা. বললেন, “না, সবার জন্য।” (মুসলিম, তিরমিযী, আবুদ দাউদ, নাসায়ী) শুধু এতটুকুই নয়, কোন ব্যক্তি অপরাধের বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে না দিয়ে যদি নিজের অপরাধী হবার স্বীকৃতি দেয়, তাহলে এ অবস্থায় অনুসন্ধান চালিয়ে সে কি অপরাধ করেছে তা জানতে চাওয়াটাও শরীয়াত বৈধ করেনি। নবী সা. এর খিদমতে এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি দণ্ড লাভের অধিকারী হয়ে গেছি, আমাকে শাস্তি দিন।” কিন্তু তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন না, তুমি কোন দণ্ড লাভের অধিকারী হয়েছো? তারপর নামায শেষ হবার পর ঐ ব্যক্তি আবার উঠে বললেন, “আমি অপরাধী, আমাকে শাস্তি দিন।” রাসূললুল্লাহ সা. বললেন, “তুমি কি এখনই আমাদের সাথে নামায পড়নি?” জবাব দিলেন “জি হ্যাঁ”। বললেন, “ব্যস, তাহলে আল্লাহ তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন।” (বুখারী, মুসলিম ও আহমাদ)।
দশঃ কোন ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য কেবলমাত্র সে যিনা করেছে এতটুকু যথেষ্ট নয়। বরং এজন্য অপরাধীর মধ্যে কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে। নিছক যিনার ক্ষেত্রে এ শর্তগুলো এক ধরনের এবং বিবাহিতের যিনার ক্ষেত্রে এগুলো আবার ভিন্ন ধরনের।
নিছক যিনার ক্ষেত্রে এ শর্তগুলো হচ্ছে, অপরাধী হবে জ্ঞান সম্পন্ন ও প্রাপ্ত বয়স্ক। যদি কোন বুদ্ধিভ্রষ্ট পাগল বা শিশু এ কর্ম করে তাহলে তার ওপর যিনার শাস্তি প্রযুক্ত হবে না।
বিবাহিতের যিনার জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক ও জ্ঞান সম্পন্ন হবার সাথে সাথে আরো কয়েকটি শর্তও রয়েছে। নিচে আমি এগুলো বর্ণনা করছিঃ
প্রথম শর্ত হচ্ছে, অপরাধীকে স্বাধীন হতে হবে। এ শর্তটির ব্যাপারে সবাই একমত। কারণ কুরআন নিজেই ইঙ্গিত করছে, গোলামকে রজমের শাস্তি দেয়া যাবে না। একটু আগেই একথা আলোচনা হয়েছে যে, বাঁদী যদি বিয়ের পর যিনায় লিপ্ত হয় তাহলে তাকে অবিবাহিতা স্বাধীন নারীর তুলনায় অর্ধেক শাস্তি দেয়া উচিত। ফকীহগণ স্বীকার করেছেন কুরআনের এ বিধানটিই গোলামের ওপরও প্রযুক্ত হবে।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, অপরাধীকে যথারীতি বিবাহিত হতে হবে। এ শর্তটির ব্যাপারেও সবাই একমত। আর এ শর্তটির প্রেক্ষিতে যে ব্যক্তি নিজের বাঁদীর সাথে যৌন সম্পর্ক করেছে অথবা যার বিয়ে হয়েছে কোন গর্হিত পদ্ধতিতে, তাকে বিবাহিত গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ সে যদি যিনা করে তাহলে তাকে রজম নয় বরং বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হবে।
তৃতীয় শর্তটি হচ্ছে, তার নিছক বিয়েই যথেষ্ট নয় বরং বিয়ের পর সঠিক অর্থে স্বামী-স্ত্রীর নিভৃত মিলনও হতে হবে। নিছক বিবাহ অনুষ্ঠান কোন পুরুষকে বিবাহিত এবং কোন নারীকে বিবাহিতা করে না যার ফলে যিনা করার কারণে তাদেরকে রজম করা যেতে পারে। এ শর্তটির ব্যাপারেও অধিকাংশ ফকীহ একমত। তবে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (র) এর মধ্যে আরো এতটুকু সংযোজন করেন যে, একজন পুরুষ ও নারীকে কেবলমাত্র তখনই বিবাহিত গণ্য করা হবে যখন বিয়ে ও নিভৃত মিলনের সময় স্বামী স্ত্রী উভয়ই স্বাধীন, প্রাপ্ত বয়স্ক ও জ্ঞান সম্পন্ন হবে। এ অতিরিক্ত শর্তের ফলে যেটুকু পার্থক্য দেখা দেয় তা হচ্ছে এই যে, যদি একটি পুরুষের বিয়ে একটি বাঁদী, উন্মাদ বা অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ের সাথে হয় তাহলে এ অবস্থায় সে নিজের স্ত্রীর সাথে নিভৃত মিলনের স্বাদ গ্রহণ করলেও এরপর যদি সে যিনায় লিপ্ত হয় তাহলে রজমের শাস্তি লাভের অধিকারী হবে না। নারীর ব্যাপারেও এ একই কথা। সে তার গোলাম, উন্মাদ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক স্বামীর সাথে যৌন মিলনের স্বাদ গ্রহণ করলেও এর পরে যদি সে যিনায় লিপ্ত হয় তাহলে রজমের শাস্তি লাভের অধিকারী হবে না। ভেবে দেখলে বুঝা যাবে, এই দু’জন বিচক্ষণ প্রতিভাবান ইমামের এই বর্ধিত শর্তটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত।
চতুর্থ শর্তটি হচ্ছে, অপরাধীকে মুসলমান হতে হবে। এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফেঈ, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম আহমাদও শর্তটি মানেন না। তাঁদের মতে অসুমলিমও যদি বিয়ে করার পর যিনায় লিপ্ত হয় তাহলে তাকে রজম করা হবে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেক এ বিষয়ে একমত যে, একমাত্র মুসলমানকেই বিয়ে করার পর যিনায় লিপ্ত হলে রজমের শাস্তি দেয়া যেতে পারে। এর যেসব যুক্তি তাঁরা দেখিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে সঙ্গত ও গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হচ্ছে, এক ব্যক্তিকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ শাস্তি দেবার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে এই যে, সে পূর্ণ “বিবাহিতা” অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও যিনা থেকে বিরত হয় না। বিবাহিত মানে হচ্ছে “নৈতিক দূর্গ পরিবেষ্টিত।” আর তিনটি প্রাচীর এ পরিবেষ্টনকে পূর্ণতা দান করে। প্রথম প্রাচীর হচ্ছে, মানুষকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে হবে। আখেরাতের জবাবদিহির প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে এবং আল্লাহর শরীয়াতকে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয় প্রাচীর হচ্ছে, তাকে সমাজের স্বাধীন ব্যক্তি হতে হবে। সে কারোর গোলাম হবে না। কারণ মালিকের বিধি-নিষেধ মেনে নিয়ে নিজের কামনা পূর্ণ করতে গিয়ে তাকে বৈধ উপায় অবলম্বনে বাধা পেতে হয় এবং এর ফলে অক্ষমতা তাকে গোনাহে লিপ্ত করতে পারে। কোন পরিবারও তার চরিত্র ও মান-সম্মান রক্ষায় সাহায্যকারী হয় না। আর তৃতীয় প্রাচীর হচ্ছে, তার বিয়ে হয়ে গেছে এবং নিজের কামনা পূর্ণ করার বৈধ উপায় তার করায়ত্ত্ব আছে। এ তিনটি প্রাচীরের অস্তিত্ব যখন বিদ্যমান থাকে তখনই “দূর্গ পরিবেষ্টন” পূর্ণতা লাভ করে এবং তখনই যে ব্যক্তি অবৈধ যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য এ ধরনের তিন তিনটি প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে সে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু বরণের যোগ্য গণ্য হতে পারে। কিন্তু যেখানে প্রথম ও সবচেয়ে বড় প্রাচীর অর্থাৎ পরকাল ও আল্লাহর আইনের প্রতি বিশ্বাসই উপস্থিত নেই সেখানে নিশ্চিতভাবেই দূর্গ পরিবেষ্টন পূর্ণতা করেনি এবং এ কারণে চরিত্রহীনতার অপরাধ এমন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায়নি যা তাকে চরম শাস্তির অধিকারী করে। ইসহাক ইবনে রাহাওয়াহ তাঁর মুসনাদে এবং দারুকুত্নী তাঁর সুনান গ্রন্থে ইবনে উমরের রা. যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন সেটি এ যুক্তিকে সমর্থন করে। হাদীসটিতে বলা হয়েছে مَنْ أَشْرَكَ بِاللهِ فَلَيْسَ بِمُحْصَنٍ “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শির্ক করেছে সে ‘মুহসিন’ নয়।” যদিও এ হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. নবী সা. এর উক্তির পুনরাবৃত্তি করেছেন, না নিজের মত ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে কিন্তু এ দুর্বলতা সত্ত্বেও মূল অর্থের দিক দিয়ে এর বিষয়বস্তু অত্যন্ত শক্তিশালী। এর জবাবে ইহুদীদের একটি মোকদ্দমা থেকে যুক্তি পেশ করা হয় যাতে নবী সা. রজম করার বিধান প্রয়োগ করেছিলেন, তাহলে আমি বলবো, এ যুক্তি সঠিক নয়। কারণ ঐ মোকদ্দমা সম্পর্কিত সমস্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস একত্র করলে পরিষ্কার জানা যায় যে, সেখানে নবী সা. তাদের ওপর ইসলামের প্রচলিত আইন (Law of the Land) নয়, তাদের নিজেদের ধর্মীয় আইন (Personal law) প্রয়োগ করেছিলেন। বুখারী ও মুসলিম একযোগে এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, যখন এ মোকদ্দমা রাসূলের কাছে আনা হলো তখন তিনি ইহুদীদের জিজ্ঞেস করলেনঃ مَا تَجِدُونَ فِي التَّوْرَاةِ مِنْ شَأْنِ الرَّجْمِ يَا مَا تَجِدُونَ فِي كِتَابِكُمْ অর্থাৎ “তোমাদের নিজেদের কিতাব তাওরাতে এর কি বিধান প্রদত্ত হয়েছে?” তারপর যখন একথা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, তাদের সমাজে রজমের বিধান আছে তখন তিনি বললেনঃ فَإِنِّى أَحْكُمُ بِمَا فِى التَّوْرَاةِ “আমি সেই ফায়সালা দিচ্ছি যা তাওরাতে আছে।” অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, তিনি এ মোকদ্দমার ফায়সালা দিতে গিয়ে বলেনঃ اللَّهُمَّ إِنِّى أَوَّلُ مَنْ أَحْيَا أَمْرَكَ إِذْ أَمَاتُوهُ “হে আল্লাহ! আমি প্রথম ব্যক্তি যে তোমার হুকুমকে জীবিত করেছে যখন তারা তাকে মেরে ফেলেছিল।” (মুসলিম, আবু দাউদ, আহমাদ)
এগারঃ যিনাকারীকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য তার নিজের ইচ্ছায় কাজটি করাও জরুরী। জোর জবরদস্তি যদি কাউকে এ কাজ করতে বাধ্য করা হয়ে থাকে তাহলে সে অপরাধীও নয় এবং শাস্তিরও যোগ্য নয়। এ ব্যাপারে কেবল শরীয়াতের এ সাধারণ নিয়মই প্রযোজ্য হয় না যে, “বলপূর্বক কাউকে দিয়ে কোন কাজ করানো হলে তার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থেকে সে মুক্ত থাকে” বরং এ সূরায়ই সামনের দিকে গিয়ে কুরআন এমন মেয়েদের ক্ষমার কথা ঘোষণা করছে যাদেরকে যিনা করতে বাধ্য করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, বলপূর্বক যিনা করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যে বল প্রয়োগ করে যিনা করেছে তাকেই শাস্তি দেয়া হয়েছে এবং যার ওপর বল প্রয়োগ করা হয়েছিল তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তিরমিযী ও আবু দাউদের বর্ণনা হচ্ছে জনৈকা মহিলা অন্ধকারের মধ্যে নামাযের জন্য বের হন। পথে এক ব্যক্তি তাকে পাকড়াও করে বলপূর্বক তার সতীত্ব হরণ করে। তার চিৎকারে লোকেরা দৌড়ে এসে যিনাকারীকে ধরে ফেলে। নবী সা. তাকে রজম করান এবং মহিলাটিকে মুক্তি দেন। বুখারীর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, হযরত উমরের রা. খিলাফতকালে এক ব্যক্তি একটি মেয়ের সাথে জোরপূর্বক যিনা করে। তিনি লোকটিকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন এবং মেয়েটিকে ছেড়ে দেন। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে নারীদের ব্যাপারে আইনের ক্ষেত্রে ঐকমত্য রয়েছে কিন্তু মতবিরোধ দেখা দিয়েছে পুরুষের ক্ষেত্রে। এ ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম হাসান ইবনে সালেহ বলেন, পুরুষকেও যদি যিনা করতে বাধ্য করা হয় তাহলে তাকে মাফ করে দেয়া হবে। ইমাম যুফার বলেন, তাকে মাফ করা হবে না। কারণ সে অঙ্গ সঞ্চালন না করলে এ কর্মটি সংঘটিত হওয়াই সম্ভব নয় এবং তার অঙ্গ সঞ্চালনই একথা প্রমাণ করে যে, তার নিজের যৌন কামনা এ কর্মের উদ্যোক্তা হয়েছিল। ইমাম আবু হানীফা বলেন, যদি সরকার বা তার কোন প্রশাসক কোন ব্যক্তিকে যিনা করতে বাধ্য করে থাকে তাহলে যিনাকারীকে শাস্তি দেয়া হবে না। কারণ যখন সরকারই অপরাধ করতে বাধ্য করছে তখন তার শাস্তি দেবার অধিকার থাকে না। কিন্তু যদি সরকার ছাড়া অন্য কেউ বাধ্য করে থাকে তাহলে যিনাকারীকে শাস্তি দেয়া হবে। কারণ নিজের যৌন কামনা ছাড়া অবশ্যই সে যিনা করতে পারে না এবং যৌন কামনা জোরপূর্বক সৃষ্টি করা যেতে পারে না। এ তিনটি বক্তব্যের মধ্যে প্রথম বক্তব্যটিই সবচেয়ে বেশী সঠিক। এর যুক্তি হচ্ছে, অঙ্গ সঞ্চালন যৌন কামনার প্রমাণ হতে পারে কিন্তু সম্মতি ও মানসিক আকাঙ্ক্ষার অপরিহার্য প্রমাণ নয়। মনে করুন, কোন জালেম এক শরীফ ব্যক্তিকে জোর পূর্বক গ্রেফতার করে বন্দি করে এবং তার সাথে একটি সুন্দরী মেয়েকেও উলঙ্গ করে একই কামরায় আটকে রাখে। ঐ মেয়ের সাথে যিনায় লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সে তাকে মুক্তি দেয় না। এ অবস্থায় যদি তারা দু’জন যিনায় লিপ্ত হয়ে যায় এবং ঐ জালেম ঘটনার চার জন্য সাক্ষীসহ তাদেরকে আদালতে হাযির করে, তাহলে তাদের বাস্তব অবস্থায় উপেক্ষা করে তাদরেকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দান অথবা বেত্রাঘাত করার শাস্তি কি ন্যায়সঙ্গত হবে? এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়া যুক্তি ও বাস্তবতা— উভয়ের নিরিখেই সম্ভব যাতে যৌন কামনার উদ্রেক ঘটতে পারে কিন্তু মানুষের নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ তার সহযোগী হয় না। যদি কোন ব্যক্তিকে বন্দী করে কারাগারে আবদ্ধ রেখে তাকে পান করার জন্য শরাব ছাড়া আর কিছুই দেয়া না হয় এবং এ অবস্থায় সে শরাব পান করে, তাহলে নিছক এ যুক্তিতে কি তাকে শাস্তি দেয়া যেতে পারে যে, তার জন্য তো অবশ্যই বাধ্যবাধকতার অবস্থা ছিল ঠিকই কিন্তু নিজের ইচ্ছা ছাড়া তো গলার মধ্য দিয়ে শরাবের তরল পদার্থ সে নীচের দিকে নামাতে পারতো না? অপরাধ ঘটার জন্য কেবলমাত্র ইচ্ছা থাকা যথেষ্ট নয় বরং এজন্য স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োজন। যে ব্যক্তিকে জবরদস্তি এমন এক অবস্থার মুখোমুখি করানো হয় যার ফলে সে অপরাধ করার সংকল্প করতে বাধ্য হয়, সে কোন কোন অবস্থায় তো একেবারেই অপরাধী হয় না এবং কোন কোন অবস্থায় তার অপরাধ অতি সামান্যই হয়ে থাকে।
বারোঃ ইসলামী আইন সরকার ছাড়া আর কাউকেই যিনাকারী ও যিনাকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষমতা দেয় না। সে আদালত ছাড়া আর কাউকেই তাদেরকে শাস্তি দেবার অধিকার দেয় না। আলোচ্য আয়াতে “তাদেরকে বেত্রাঘাত করো” শব্দাবলীর মাধ্যমে জনগণকে নয় বরং রাষ্ট্রীয় শাসকবৃন্দ ও বিচারপতিগণকে সম্বোধন করা হয়েছে, এ ব্যাপারে উম্মতের সকল ফকীহ একমত। তবে গোলামদের ক্ষেত্রে মতবিরোধ রয়েছে। তার প্রভু এ ব্যাপারে তাকে শাস্তি দিতে পারে কিনা এ প্রশ্নে সবাই একমত নয়। হানাফী মাযহাবের সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত যে, প্রভু গোলামকে শাস্তি দিতে পারে না। শাফেঈ ইমামগণ বলেন, তাদের সে ক্ষমতা আছে। আর মালেকীগণ বলেন, চুরির অপরাধে প্রভু গোলামদের হাত কাটার অধিকার রাখে না কিন্তু যিনা, সতীসাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও শরাব পানের শাস্তি দিতে পারে।
তেরোঃ ইসলামী আইন যিনার শাস্তিকে রাষ্ট্রীয় আইনের একটি অংশ গণ্য করে। তাই মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ওপর এ আইন জারি হবে। এ ব্যাপারে একমাত্র ইমাম মালেক ছাড়া সম্ভবত ইমামদের মধ্য থেকে আর কেউ দ্বিমত প্রকাশ করেননি। রজমের শাস্তি অমুসলিমদের ওপর প্রয়োগ করার প্রশ্নে ইমাম আবু হানীফার যে মতবিরোধ তার ভিত্তি এ নয় যে, এটি রাষ্ট্রীয় আইন নয়। বরং এ মত বিরোধের ভিত্তি হচ্ছে এই যে, তাঁর মতে রজমের শর্তাবলীর মধ্যে যিনাকারীর “পূর্ণ বিবাহিত” হওয়া হচ্ছে অন্যতম শর্ত। আর পূর্ণ বিবাহিত হওয়া ইসলাম ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি অমুসলিম যিনাকারীকে রজমের শাস্তির আওতা বহির্ভূত গণ্য করেন, বিপরীতপক্ষে ইমাম মালেকের মতে এ হুকুমটি মুসলমানদের জন্য প্রদান করা হয়েছে, কাফেরদের জন্য নয়। তাই তিনি যিনার দণ্ডবিধিকে মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনের (Personal Law) একটি অংশ গণ্য করেন। আর অন্য দেশ থেকে দারুল ইসলামে অনুমতি নিয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীর ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম শাফেঈ বলেন, সে যদি দারুল ইসলামে যিনায় লিপ্ত হয়, তাহলে তার ওপর যিনার দণ্ডবিধি জারি করা হবে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ বলেন, আমরা তার ওপর যিনার দণ্ডবিধি জারি করতে পারি না।
চৌদ্দঃ কোন ব্যক্তি নিজের অপরাধ নিজ মুখে স্বীকার করবে অথবা কারোর যিনার কথা যারা জানতে পারে তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শাসকের কাছে অবশ্যই তা পৌঁছাবে, ইসলামী আইন এটা অপরিহার্য গণ্য করে না। তবে শাসকরা যখন এ অপরাধের কথা জানতে পারেন তখন আর সেখানে ক্ষমার কোন অবকাশ থাকে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে নবী সা. বলেছেনঃ
مَنْ اَتَى شَيْئًا مِنْ هَذِهِ الْقَاذُوْرَاتِ فَلْيَسْتَتِرْ بِسِتْرِ اللهِ فَاِن اَبْدَى لَنَا صَفْحَتَهُ اَقِمْنَا عَلَيْهِ كِتَابَ اللهِ (احكام القران- للجصاص)
“তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই এসব নোংরা অপরাধগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে যায়, সে যেন আল্লাহর পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সে যদি আমাদের সামনে পর্দা উঠায়, তাহলে আমরা তার ওপর আল্লাহর কিতাবের আইন প্রয়োগ করেই ছাড়বো”। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস)
আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে, মাঈয ইবনে মালেক আস্লামী অপরাধে জড়িত হয়ে পড়লে হায্যাল ইবনে নুআ’ইম তাঁকে বলেন, নবী সা. এর কাছে গিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করো। তাই তিনি গিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিজের অপরাধ বর্ণনা করেন। এর ফলে তিনি একদিকে তাকে রজমের শাস্তি দেন এবং অন্য দিকে হায্যালকে বলেন, لَوْ سَتَرْتَهُ بِثَوْبِكَ كَانَ خَيْرًا لَكَ “যদি তুমি তার ওপর পর্দা ফেলে দিতে, তাহলে তোমার জন্য বেশী ভালো হতো।”
আবু দাউদ ও নাসায়ীতে অন্য একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে নবী সা. বলেনঃ
تَعَافَوُا الْحُدُودَ فِيمَا بَيْنَكُمْ فَمَا بَلَغَنِى مِنْ حَدٍّ فَقَدْ وَجَبَ
“শাস্তিযোগ্য অপরাধকে নিজেদের মধ্যে ক্ষমা করে দাও। কিন্তু যে অপরাধের ব্যাপারটি আমার কাছে পৌঁছে যাবে তার শাস্তি বিধান করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।”
পনেরঃ ইসলামী আইনে এ অপরাধটি পারস্পরিক আপসের মাধ্যমে ফায়সালা করে নেবার ব্যাপারও নয়। হাদীসের প্রায় সবক’টি কিতাবে এ ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে যে, একটি ছেলে এক ব্যক্তির কাছে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতো। সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা করে বসে। ছেলেটির বাপ একশ ছাগল ও একটি বাঁদি দিয়ে ঐ ব্যক্তিকে রাজি করিয়ে নেয়। কিন্তু এ মামলাটি যখন নবী সা. এর কাছে আসে তখন তিনি বলেন, أَمَّا غَنَمُكَ وَجَارِيَتُكَ فَرَدٌّ عَلَيْكَ “তোমার ছাগল ও তোমার বাঁদি তুমিই ফিরিয়ে নিয়ে যাও।” তারপর তিনি যিনাকারী ও যিনাকারীনী উভয়ের ওপর শরীয়াতের দণ্ডবিধি জারি করেন। এ থেকে কেবল এতটুকুই জানা যায় না যে, এ অপরাধে আপসে রাজি করিয়ে নেবার কোন অবকাশ নেই। বরং একথাও জানা যায় যে, ইসলামী আইন অর্থদণ্ডের আকারে সতীত্বের বিনিময় দান করা যেতে পারে না। ইজ্জতের মূল্য প্রদান করার এ ধরনের জঘন্য ভাবধারা পাশ্চাত্য আইনেরই বৈশিষ্ট্য।
ষোলঃ কোন ব্যক্তির যিনার করার কোন প্রমাণ না পাওয়া গেলে ইসলামী রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবে না। অপরাধের প্রমাণ ছাড়া কারোর ব্যভিচার সংক্রান্ত খবর একাধিক উপায়ে শাসকদের কাছে এসে পৌঁছালেও তারা কোনক্রমেই তার ওপর শরীয়াতের দণ্ডবিধি জারি করতে পারেন না। মদীনায় একটি মেয়ে ছিল। তার সম্পর্কে বলা হতো, সে ছিল প্রকাশ্য চরিত্রহীনা। বুখারী একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ كَانَتْ تُظْهِرُ فِي الْإِسْلَامِ السُّوءَ “সে ইসলামে অসতীপনার প্রকাশ ঘটাচ্ছিল।” অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ كَانَتْ قَدْ أَعْلَنَتْ فِي الْإِسْلَامِ “সে ইসলামে প্রকাশ্য অসদাচার করছিল।” আবার ইবনে মাজার একটা হাদীসে বলা হয়েছেঃ فَقَدْ ظَهَرَ فِيهَا الرِّيبَةُ فِى مَنْطِقِهَا وَهَيْئَتِهَا وَمَنْ يَدْخُلُ عَلَيْهَا “মেয়েটির কথায় ও স্বভাব চরিত্রে এবং তার কাছে যারা যাওয়া আসা করতো তাদের থেকে সুস্পষ্ট সন্দেহ জেগে উঠেছিল।”
কিন্তু যেহেতু তার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের প্রমাণ ছিল না তাই তাকে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি। অথচ তার সম্পর্কে নবী সা. এর পবিত্র মুখ থেকেও এ কথা বের হয়ে গিয়েছিল যে, لَوْ كُنْتُ رَاجِمًا أَحَدًا بِغَيْرِ بَيِّنَةٍ لَرَجَمْتُهَا “যদি আমি কাউকে প্রমাণ ছাড়া রজম করতাম তাহলে ঐ মেয়েটিকে নিশ্চয়ই রজম করতাম।”
সতেরঃ যিনার অপরাধের প্রথম সম্ভাব্য প্রমাণ হচ্ছে এই যে, তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এ সংক্রান্ত আইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ হচ্ছে নিম্নরূপঃ
(ক) কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করে, যিনার জন্য কমপক্ষে চারজন চাক্ষুষ সাক্ষীর প্রয়োজন। সূরা আন নিসার ১৫ আয়াতে একথা বলা হয়েছে। সামনের দিকে এ সূরা আন নূরেই দু’জায়গায় একথা আসছে। সাক্ষী ছাড়া কাযী স্বচক্ষে এ অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলেও কেবলমাত্র নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে এ ফায়সালা দিতে পারেন না।
(খ) সাক্ষী হতে হবে এমন সব লোক, ইসলামের সাক্ষ্য আইনের দৃষ্টিতে যারা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। যেমন, ইতিপূর্বে কোন মামলায় তারা মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী প্রমাণিত হয়নি। তারা খেয়ানতকারী নয়। ইতিপূর্বে তারা কখনো শাস্তি পায়নি। অপরাধীর সাথে যাদের কোন শত্রুতা প্রমাণিত হয়নি ইত্যাদি। মোটকথা অনির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাউকে রজম করা বা কারোর পিঠে বেত্রাঘাত করা যেতে পারে না।
(গ) সাক্ষীদের একথার সাক্ষ্য দিতে হবে যে, তারা অভিযুক্ত নারী ও পুরুষকে সঙ্গমরত অবস্থায় চাক্ষুষ দেখেছে অর্থাৎ كالْمِيلُ فِي الْمُكْحُلَةِ وَالرِّشَاءُ فِى الْبِئْرِ (এমনভাবে যেমন সুর্মাদানীর মধ্যে সুর্মা তোলার শলাকা এবং কুয়ার মধ্যে রশি)।
(ঘ) সাক্ষীদের কবে, কখন, কোথায়, কাকে, কার সাথে যিনা করতে দেখেছে এ ব্যাপারে একমত হতে হবে। এ মৌলিক বিষয়গুলোতে মতবিরোধ ঘটলে তাদের সাক্ষ্য বাতিল হয়ে যাবে।
সাক্ষ্য সম্পর্কিত এ শর্তগুলো স্বতঃই একথা প্রকাশ করছে যে, গোয়েন্দাবৃত্তি করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খবর বের করা এবং প্রতিদিন লোকদের পিঠে বেত্রাঘাত করা ইসলামী আইনের উদ্দেশ্য নয়। বরং সে এমন অবস্থায় এ ধরনের কঠিন শাস্তি দেয় যখন সব ধরনের সংশোধন ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও ইসলামী সমাজে কোন নারী ও পুরুষ এমন নির্লজ্জ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে যে, চার চারজন লোক তাদের অপরাধমূলক তৎপরতা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়।
আঠারঃ স্ত্রীলোকের যখন কোন জানা ও পরিচিত স্বামী বা বাঁদীর অনুরূপ কোন মনিব থাকে না তখন নিছক তার গর্ভবতী হওয়াটাই তার বিরুদ্ধে যিনা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য কিনা এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। হযরত উমরের রা. মতে এ সাক্ষ্য যথেষ্ট। মালেকীগণ এ মতটিই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে, নিছক গর্ভধারণ এতটা মজবুত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য নয় যার ভিত্তিতে কাউকে রজম বা কারোর পিঠে একশত বেত্রাঘাত করা যেতে পারে। এত বড় শাস্তির জন্য সাক্ষীর উপস্থিতি অথবা অপরাধের স্বীকৃতি অপরিহার্য। ইসলামী আইনের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, সন্দেহ শাস্তির নয় বরং ক্ষমার উদ্দীপক হবে। নবী সা. বলেনঃ ادْفَعُوا الْحُدُودَ مَا وَجَدْتُمْ لَهُا مَدْفَعًا “শাস্তিসমূহ এড়িয়ে চলো যতদূর সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ থাকে।” (ইবনে মাজাহ) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ
ادْرَءُوا الْحُدُودَ عَنِ الْمُسْلِمِينَ مَا اسْتَطَعْتُمْ فَإِنْ كَانَ لَهُ مَخْرَجٌ فَخَلُّوا سَبِيلَهُ فَإِنَّ الإِمَامَ أَنْ يُخْطِئَ فِى الْعَفْة خَيْرٌ مِنْ أَنْ يُخْطِئَ فِى الْعُقُوبَةِ
“মুসলমানদের থেকে যতদূর সম্ভব শাস্তি দূরে রাখো। যদি কোন অপরাধীকে শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেবার কোন পথ পাওয়া যায় তাহলে তাকে ছেড়ে দাও। কারণ শাসকের ক্ষমা করে দেবার ব্যাপারে ভুল করা তার শাস্তি দেবার ব্যাপারে ভুল করার চেয়ে ভালো।” (তিরমিযী)
এ নিয়ম অনুযায়ী গর্ভবর্তী হওয়া সন্দেহের জন্য যতই শক্তিশালী ভিত্তি হোক না কেন তা কোনক্রমেই যিনার নিশ্চিত প্রমাণ নয়। কারণ কোন পুরুষের সাথে সঙ্গম ছাড়াও কোন মেয়ের গর্ভাশয়ে কোন পুরুষের শুক্রের কোন অংশ পৌঁছে যাওয়ার এক লাখ ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনাও আছে এবং এর ফলে সে গর্ভবতীও হয়ে যেতে পারে। এতটুকু হালকা সন্দেহও অপরাধিনীকে ভয়াবহ শাস্তির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য যথেষ্ট হতে হবে।
উনিশঃ যিনার সাক্ষীদের মধ্যে যদি পার্থক্য দেখা দেয় অথবা অন্য কোন কারণে তাদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণিত না হয় তাহলে মিথ্যা অপবাদ দেবার কারণে সাক্ষীরা কি শাস্তি পাবে এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। ফকীহদের একটি দল বলেন, এ অবস্থায় তারা মিথ্যা অপবাদদানকারী গণ্য হবে এবং তাদেরকে ৮০টি বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হবে। অন্য দলটি বলেন, তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না। কারণ তারা সাক্ষী হিসেবে এসেছে, বাদী হিসেবে আসেনি। যদি এভাবে সাক্ষীদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে যিনার সাক্ষ্য দেবার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। চারজন সাক্ষীর মধ্য থেকে কেউ বিগড়ে যাবে কিনা এ ব্যাপারে যখন কেউই নিশ্চিত নয় তখন শাস্তির ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সাক্ষ্য দেবার জন্য এগিয়ে আসবে, কে এমন দায়ে ঠেকেছে? আমার মতে এ দ্বিতীয় মতটিই যুক্তিসঙ্গত। কারণ সন্দেহের ফলে অপরাধীর মতো সাক্ষীদেরও লাভবান হওয়া উচিত। যদি তাদের সাক্ষ্যের দুর্বলতা বিবাদীকে যিনার ভয়াবহ শাস্তি দেবার জন্য যথেষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে তার সাক্ষীদেরকে মিথ্যা অপবাদের ভয়াবহ শাস্তি দেবার জন্যও যথেষ্ট না হওয়া উচিত। তবে যদি তাদের মিথ্যুক হওয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই তারা এ শাস্তি পাবে। প্রথম মতের সমর্থনে দু’টি বড় বড় যুক্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে, কুরআন যিনার মিথ্যা অপবাদকে শাস্তিযোগ্য গণ্য করে। কিন্তু এ যুক্তিটি সঠিক নয়। কারণ কুরআন নিজেই মিথ্যা অপবাদদানকারী(قاذف) ও সাক্ষীরشاهد) ) মধ্যে পার্থক্য করে। আর আদালত সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট মনে করেনি, শুধুমাত্র এ কারণেই সাক্ষী মিথ্যা অপবাদদাতা গণ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে, মুগীরাহ ইবনে শু’বার রা. মোকদ্দমায় হযরত উমর রা. আবু বাক্রাহ ও তাঁর দু’সহযোগী সাক্ষীদেরকে মিথ্যা অপবাদদানের শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু এ মোকদ্দমার বিস্তারিত বিবরণ দেখলে বুঝা যায়, যেসব মোকদ্দমায় অপরাধ প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্য অকিঞ্চিৎ প্রমাণিত হয় সে ধরনের প্রত্যেকটি মোকদ্দমার ওপর এ নজিরটি প্রযোজ্য নয়। মোকদ্দমাটির বিবরণ হচ্ছেঃ বসরার গভর্নর মুগীরাহ ইবনে শু’বার সাথে আবু বাক্রাহর সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ ছিল। উভয়ের গৃহের অবস্থান ছিল একই পথের পাশে মুখোমুখি। একদিন হঠাৎ দম্কা বাতাসের ঝটকায় উভয়ের গৃহের জানালা খুলে যায়। আবু বাক্রাহ নিজের জানালা বন্ধ করতে ওঠেন। তাঁর দৃষ্টি পড়ে সামনের কামরায়। তিনি হযরত মুগীরাহকে সঙ্গমরত দেখেন। আবু বাক্রাহর কাছে বসেছিলেন তার তিন বন্ধু (নাফে’ ইবনে কলাদাহ, যিয়াদ ও শিব্ল ইবনে মা’বাদ)। তিনি বলেন, এসো, দেখো এবং মুগীরাহ কি করছে তার সাক্ষী থাকো। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেন, এ মেয়েটি কে? আবু বাক্রাহ বলেন, উম্মে জামীল। পরদিন এ সম্পর্কে হযরত উমরের রা. কাছে অভিযোগনামা পাঠানো হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই হযরত মুগীরাহকে সাসপেণ্ড করে হযরত আবু মুসা আশ্আরীকে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দেন এবং অভিযুক্তকে সাক্ষীসহ মদীনায় ডেকে আনেন। খলীফার সামনে পেশ হবার পর আবু বাক্রাহ ও দু’জন সাক্ষী বলেন, আমরা মুগীরাহকে উম্মে জামীলের সাথে সঙ্গমরত অবস্থায় দেখেছি। কিন্তু যিয়াদ বলেন, মেয়েটিকে পরিষ্কার দেখা যায়নি এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না সে উম্মে জামীল ছিল। মুগীরাহ ইবনে শু’বা জেরার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন, যেদিক থেকে তারা তাঁদেরকে দেখেছিল সেদিক থেকে তাদের পক্ষে মেয়েটিকে ভালো করে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি এটাও প্রমাণ করে দেন যে, তাঁর স্ত্রীর ও উম্মে জামীলের মধ্যে চেহারাগত সাদৃশ্য রয়েছে। ঘটনার পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায় যে, হযরত উমরের রা. শাসনামলে একটি প্রদেশের গভর্নরের পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না যে, তিনি যে সরকারী গৃহে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন, সেখানে অন্য একটি মেয়েকে ডেকে এনে যিনা করবেন। এ কারণে মুগীরাহ তার নিজের ঘরে নিজের স্ত্রীর পরিবর্তে উম্মে জামীলের সাথে সহবাস করছে, আবু বাকরাহ ও তার সাথীদের এ কথা মনে করা একটি নিতান্ত অবাস্তব কু-ধারণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ কারণেই হযরত উমর রা. কেবলমাত্র অভিযুক্তকেই অভিযোগ মুক্ত করে ক্ষান্ত হননি বরং আবু বাক্রাহ, নাফে ও শিবলকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তিও প্রদান করেন। এ মামলাটির বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে এ ফায়সালা করা হয়েছিল। এ থেকে এরূপ বিধি প্রণয়ন করা যায় না যে, যখনই সাক্ষ্যের মাধ্যমে যিনার অপরাধ প্রমাণিত হবে না তখনই সাক্ষীদেরকে অবশ্যই মারধর করতে হবে। (মোকদ্দমার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন আহকামুল কুরআন ইবনুল আরাবীঃ ২য় খণ্ড, ৮৮-৮৯ পৃষ্ঠা)।
বিশঃ সাক্ষ্য ছাড়া আর যে জিনিসটির মাধ্যমে যিনার অপরাধ প্রমাণিত হতে পারে সেটি হচ্ছে অপরাধীর নিজের স্বীকারোক্তি। যিনার কাজ করা হয়েছে বলে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ স্বীকারোক্তির শব্দাবলী উচ্চারিত হতে হবে। অর্থাৎ তাকে স্বীকার করতে হবে যে, তার জন্য হারাম ছিল এমন একটি নারীর সাথে সে كالْمِيلُ فِي الْمُكْحُلَةِ (সুর্মাদানীর মধ্যে সুর্মা শলাকার মতো) যিনার কাজ করেছে। আদালতেরও এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে যে, অপরাধী কোন প্রকার বাইরের চাপ ছাড়াই সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সজ্ঞানে ও সচেতন অবস্থায় এ স্বীকৃতি দিচ্ছে। কোন কোন ফকীহ বলেন, একটি স্বীকারোক্তি যথেষ্ট নয় বরং অপরাধীর চার বার আলাদা আলাদাভাবে স্বীকারোক্তি দেয়া উচিত। ( এটি ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমাদ, ইবনে আবী লাইলা, ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ ও হাসান ইবনে সালেহর অভিমত) আবার কেউ কেউ বলেন একটি স্বীকারোক্তি যথেষ্ট। (এটি ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, উসমানুল বাত্তা ও হাসান বাসরী প্রমূখ ফকীহগণের অভিমত) তারপর এমন অবস্থায়ও যখন অন্য কোন প্রমাণ ছাড়াই কেবলমাত্র অপরাধীর নিজেরই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ফায়সালা করা হয়েছে তখন যদি ঠিক শাস্তির মাঝামাঝি সময়েও অপরাধী নিজের স্বীকারোক্তি থেকে সরে আসে তাহলে ও তার শাস্তি মুলতবী করে দেয়া উচিত, এমনকি যদি বুঝা যায় যে, মারের কষ্ট সইতে না পেরে সে নিজের স্বীকারোক্তি থেকে ফিরে আসছে, তাহলেও তার শাস্তি মুলতবি হওয়া উচিত। হাদীসে যিনার মামলা সংক্রান্ত যেসব নজির পাওয়া যায় সেগুলো এ সমস্ত আইনের উৎস। সবচেয়ে বড় মামলাটি হচ্ছে মাঈ’য ইবনে মালিক আসলামীর। বিভিন্ন সাহাবী থেকে অসংখ্য বর্ণনাকারী এটি উদ্ধৃত করেছেন। প্রায় সবক’টি হাদীসের কিতাবে এ বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। মাঈ’য ছিল আসলাম গোত্রের একটি এতিম সন্তান। সে হযরত হায্যাল ইবনে নুআ’ইমের গৃহে লালিত-পালিত হয়। সেখানে এক মুক্তিপ্রাপ্তা বাঁদীর সাথে যিনা করে বসে। হযরত হায্যাল তাকে বলেন, নবী সা. এর কাছে গিয়ে নিজের এ গোনাহের কথা বলো। হয়তো তিনি তোমরা মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে দেবেন। মাঈ’য মসজিদে নববীতে গিয়ে নবী সা. কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে পবিত্র করে দিন, আমি যিনা করেছি। তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন এবং তারপর বলেন, وَيْحَكَ ارْجِعْ فَاسْتَغْفِرِ اللهَ، وَتُبْ إِلَيْهِ “আরে, চলে যাও, আর আল্লাহর কাছে তাওবা ও ইসতিগফার করো।” কিন্তু ছেলেটি আবার সামনে এসে একই কথা বলে এবং এবারও তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। ছেলেটি আবার সে কথাই বলে এবং তিনি আবার মুখ ফিরিয়ে নেন। এ অবস্থায় হযরত আবু বকর রা. তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, দেখো, যদি তুমি চতুর্থবার স্বীকারোক্তি করো তাহলে রাসূলুল্লাহ সা. তোমাকে রজম করে দেবেন। কিন্তু সে মানেনি এবং আবার তার কথার পুনরাবৃত্তি করে। এবার নবী সা. তার দিকে ফেরেন এবং তাকে বলেন, لَعَلَّكَ قَبَّلْتَ أَوْ غَمَزْتَ أَوْ نَظَرْتَ “সম্ভবত তুমি চুমো খেয়েছো বা জড়াজড়ি করেছো অথবা কু-নজর দিয়েছো।” (এবং তুমি মনে করেছো এতেই বুঝি যিনা করা হয়ে গেছে) সে বলে, না। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি তার সাথে এক বিছানায় শুয়েছো?” জবাব দেয়, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি তার সাথে সহবাস করেছো?” জবাব দেয়, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি তার সাথে সংগম করেছো?” জবাব দেয়, হ্যাঁ। তারপর তিনি এমন শব্দ উচ্চারণ করেন যা আরবী ভাষায় সঙ্গম করার সুস্পষ্ট প্রতিশব্দ হিসেবে বলা হয়ে থাকে এবং তাকে অশ্লীল মনে করা হয়ে থাকে। এ ধরনের শব্দ নবী সা. এর মুখে এর আগে কেউ শোনেনি এবং পরেও আর কখনো শোনা যায়নি। যদি এক ব্যক্তির প্রাণনাশের প্রশ্ন না হতো তাহলে তাঁর মুবারক কন্ঠে কখনো এ ধরনের শব্দ উচ্চারিত হতে পারতো না। কিন্তু এর জবাবেও সে হ্যাঁ বলে দেয়। তিনি জিজ্ঞেস করেন,
حَتَّى غَابَ ذَلِكَ مِنْكَ فِى ذَلِكَ مِنْهَا
(এমন কি তোমার সেই অঙ্গ তার সেই অঙ্গের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল?) সে বলে, হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞেস করেন,
كَمَا يَغِيبُ الْمِرْوَدُ فِى الْمُكْحُلَةِ وَالرِّشَاءُ فِى الْبِئْرِ
(সেটা কি এমনভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল যেমন সুর্মাদানীতে সুর্মা শলাকা এবং কুয়ার মধ্যে রশি?) সে বলে, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেন, “যিনা কাকে বলে তুমি কি জানো?” সে বলে, “জি হ্যাঁ।” আমি তার সাথে হারাম পদ্ধতিতে এমন কাজ করেছি যা স্বামী হালাল পদ্ধতিতে নিজের স্ত্রীর সাথে করে থাকে।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তোমার কি বিয়ে হয়েছিল?” জবাব দেয়, “জি হ্যাঁ।” জিজ্ঞেস করেন, “তুমি তো মদ পান করনি?” জবাব দেয়, না। এক ব্যক্তি উঠে তার মুখ শুঁকে দেখেন এবং তার কথা সত্যতার সাক্ষ্য দেন। তারপর তিনি তার মহল্লার লোকদেরকে জিজ্ঞেস করেন, এ ছেলেটি পাগল নয় তো? মহল্লার লোকেরা বলে, আমরা তার বুদ্ধির মধ্যে কোন বিকৃতি দেখিনি। তিনি হায্যালকে বলেন,
لَوْ سَتَرْتَهُ بِثَوْبِكَ كَانَ خَيْرًا لَكَ
“যদি তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে তাহলে তোমার জন্য ভালো হতো।” তারপর তিনি মাঈ’যকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তাকে নগরীর বাইরে নিয়ে গিয়ে পাথরের আঘাতে মেরে ফেলা হয়। যখন পাথর পড়তে শুরু হয় তখন মাঈ’য দৌড়ে পালাতে থাকে এবং বলতে থাকে “লোকেরা! আমাকে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। আমার গোত্রের লোকেরা আমাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছে। তারা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে তারা বলেছিল, রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে হত্যা করবেন না।” কিন্তু যারা পাথর মারছিল তারা তাকে মেরেই ফেলে। পরে যখন নবীকে সা. এ খবর জানানো হয় তখন তিনি লোকেদের বলেন, তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে না কেন? তাকে আমার কাছে আনতে। হয়তো সে তাওবা করতো এবং আল্লাহ তার তাওবা কবুল করে নিতেন।”
দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে গামেদীয়ার। গামেদীয়া ছিল গামেদ গোত্রের (জুহাইনীয়া গোত্রের একটি শাখা) একটি মেয়ে। সে এসেও চারবার স্বীকারোক্তি করে যে, সে যিনা করেছে এবং অবৈধ গর্ভধারণ করেছে। নবী সা. তাকেও প্রথম স্বীকারোক্তির সময় বলেনঃ وَيْحَكَ ارْجِعْى فَاسْتَغْفِرِى اللهَ، وَتُوبْى إِلَيْهِ (আরে চলে যাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তাওবা করো।) কিন্তু সে বলে, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে মাঈ’যের মতো এড়িয়ে যেতে চান? আমি যিনার মাধ্যমে গর্ভবতী হয়েছি।” এখানে যেহেতু স্বীকারোক্তির সাথে গর্ভধারণের ব্যাপারটিও ছিল, তাই তিনি তাকে মাঈ’যের মতো বিস্তারিত জেরার সম্মুখীন করেননি। তিনি বলেন, “ঠিক আছে, যদি একান্তই না শুনতে চাও, তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে এসো।” সন্তান জন্মের পর সে শিশুটিকে কোলে নিয়ে এসে বলে, এবার আমাকে পবিত্র করে দিন। তিনি বলেন, “যাও, একে দুধ পান করাও এবং শিশু দুধ ছাড়ার পরে এসো।” তারপর সে শিশুর দুধ ছাড়ার পরে আসে এবং সাথে এক টুকরা রুটিও নিয়ে আসে। শিশুকে রুটির টুকরা খাইয়ে রাসূলুল্লাহকে সা. দেখান এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এখন তো এ দুধ ছেড়ে দিয়েছে এবং দেখুন রুটিও খেতে শুরু করেছে। তখন তিনি শিশুটিকে লালন-পালন করার জন্য এক ব্যক্তির হাতে সোপর্দ করেন এবং তাকে রজম করার হুকুম দেন।
এ দু’টি ঘটনায় সুস্পষ্টভাবে চারটি স্বীকারোক্তির কথা বলা হয়েছে। আর আবু দাউদে হযরত বুরাইদার বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরামগণ সাধারণভাবে মনে করতেন যদি মাঈ’য ও গামেদীয়া চারবার করে স্বীকারোক্তি না করতো তাহলে তাদেরকে রজম করা হতো না। তবে তৃতীয় ঘটনাটিতে (যার উল্লেখ আমি ওপরে পনের নম্বরে করেছি) শুধুমাত্র এ শব্দগুলো পাওয়া যায় যে, “যাও তার স্ত্রীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। যদি সে স্বীকার করে তাহলে একে রজম করো।” এখানে চারবার স্বীকারোক্তির কথা বলা হয়নি। এ থেকেই ফকীহগণের একটি দল একটি স্বীকারোক্তি যথেষ্ট বলে মত প্রকাশ করেছেন।
একুশঃ ওপরে আমি যে তিনটি মামলার নজির পেশ করেছি তা থেকে প্রমাণ হয় যে, স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারী অপরাধীকে সে কার সাথে যিনা করেছে সে কথা জিজ্ঞেস করা হবে না। কারণ এভাবে এক জনের পরিবর্তে দু’জনকে শাস্তি দিতে হবে। আর শরীয়াত লোকদেরকে শাস্তি দেবার জন্য উদগ্রীব নয়। তবে অপরাধী নিজেই যদি বলে যে, এ কর্মের অপর পক্ষ অমুক জন, তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। যদি সেও স্বীকারোক্তি করে তাহলে তাকেও শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু যদি সে অস্বীকার করে তাহলে কেবলমাত্র স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিকারী অপরাধীই শরীয়াতের শাস্তির যোগ্য হবে। এ দ্বিতীয় অবস্থায় (অর্থাৎ যখন দ্বিতীয় পক্ষ তার সাথে যিনা করার কথা স্বীকার করে না) তাকে যিনার না মিথ্যা অপবাদের (قذف) শাস্তি দেয়া হবে, এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈর মতে তার জন্য যিনার শাস্তি ওয়াজিব হয়ে যাবে। কারণ সে এ অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আওযা’ঈর মতে তাকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দেয়া হবে। কারণ দ্বিতীয় পক্ষের অস্বীকৃতি তার যিনার অপরাধকে সন্দেহযুক্ত করে দিয়েছে। তবে তার মিথ্যা অপবাদের অপরাধ অবশ্যই প্রমাণিত হয়ে গেছে। অন্য দিকে ইমাম মুহাম্মাদের ফতওয়া (ইমাম শাফেঈ’র একটি উক্তিও এ সমর্থনে পাওয়া যায়) হচ্ছে এই যে, তাকে যিনার শাস্তিও দিতে হবে এবং মিথ্যা অপবাদের শাস্তিও। কারণ নিজের যিনার অপরাধের স্বীকারোক্তি সে নিজেই করেছে এবং দ্বিতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে নিজের অভিযোগ সে প্রমাণ করতে পারেনি। নবী সা. এর আদালতে এ ধরনের একটি মামলা এসেছিল। তার একটি বর্ণনা মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদে সাহল ইবনে সা’দ থেকে নিম্নোক্ত শব্দাবলী সহকারে উদ্ধৃত হয়েছেঃ “এক ব্যক্তি এসে নবী সা. এর সামনে স্বীকারোক্তি করে, সে অমুক মেয়ের সাথে যিনা করেছে। তিনি মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন। সে অস্বীকার করে। তিনি লোকটিকে শাস্তি দেন এবং মেয়েটিকে মুক্তি দিয়ে দেন।” এ হাদীসে তিনি কোন্ শাস্তিটি দেন তার সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। দ্বিতীয় রেওয়ায়েতটি আবু দাউদ ও নাসাই ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, প্রথমে তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তিনি তাকে যিনার শাস্তি দেন। তারপর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলে সে অস্বীকার করে এবং এর ফলে লোকটিকে আবার মিথ্যা অপবাদের জন্য বেত্রাঘাত করেন। কিন্তু এ হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে দুর্বল। কারণ এর একজন বর্ণনাকারী কাসেম ইবনে ফাইয়াযকে বহু মুহাদ্দিস অনির্ভরযোগ্য ঘোষণা করেছেন। আবার এ হাদীসটি যুক্তিরও বিরোধী। কারণ নবী সা. থেকে আশা করা যেতে পারে না যে, তিনি যিনার জন্য বেত্রাঘাত করার পর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করবেন। বুদ্ধিবৃত্তি ও ইনসাফের যে সুস্পষ্ট দাবী নবী সা. উপেক্ষা করতে পারেন না তা ছিল এই যে, লোকটি যখন মেয়েটির নাম নিয়েছিল তখন তিনি মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞেস না করে মামলার ফায়সালা করতে পারতেন না। সাহল ইবনে সা’দ বর্ণিত রেওয়ায়াতটি কিন্তু একথাই সমর্থন করেছে। কাজেই দ্বিতীয় বর্ণনাটি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বাইশঃ অপরাধ প্রমাণ হবার পর যিনাকারী ও যিনাকারীনীকে কি শাস্তি দেয়া হবে, এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন ফকীহর মতামত নিচে পেশ করছিঃ
বিবাহিত পুরুষ ও নারীর যিনার শাস্তিঃ ইমাম আহমাদ, দাউদ যাহেরী, ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহের মতে এর শাস্তি হচ্ছে একশ বেত্রাঘাত এবং তারপর প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু।
অন্য সকল ফকীহ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, কেবলমাত্র প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুই তাদের শাস্তি। বেত্রাঘাত ও প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুকে একত্র করা যাবে না।
অবিবাহিতদের শাস্তিঃ ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ, ইসহাক, দাউদ যাহেরী, সুফিয়ান সওরী, ইবনে আবী লাইলা ও হাসান ইবনে সালেহের মতে, নারী ও পুরুষ উভয়ের শাস্তি একশত বেত্রাঘাত ও এক বছরের দেশান্তর।
ইমাম মালেক ও ইমাম আওযা’ঈর মতে, পুরুষের জন্য একশ বেত্রাঘাত ও এক বছর দেশান্তর এবং নারীর জন্য শুধুমাত্র একশ বেত্রাঘাত। (তাঁদের সবার মতে দেশান্তর অর্থ হচ্ছে, একটি লোকালয় থেকে বের করে কমপক্ষে এমন এক দূরত্বে পৌঁছে দেয়া যেখানে নামাযে কসর করা ওয়াজিব হয়। কিন্তু যায়েদ ইবনে আলী ও ইমাম জা’ফর সাদেকের মতে কারাগারে বন্দী করলেও দেশান্তরের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়)।
ইমাম আবু হানীফা এবং তাঁর শাগরিদ ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম যুফার ও ইমাম মুহাম্মাদ বলেন, এ অবস্থায় পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য যিনার শাস্তি হচ্ছে শুধুমাত্র একশ বেত্রাঘাত। এর ওপর কারাদণ্ড বা দেশান্তরের বাড়তি শাস্তি বা অন্য কোন শাস্তি আসলে ‘হদ’ বা শরীয়াতী দণ্ড নয় বরং ‘তাযীর’ বা শাসনমূলক দণ্ড। কাযী যদি দেখেন অপরাধীর চালচলন খারাপ অথবা অপরাধী ও অপরাধিনীর সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর তাহলে প্রয়োজন মাফিক তিনি তাদেরকে দেশত্যাগী করতে অথবা কারাদণ্ড দিতে পারেন।
(হদ ও তা’যীরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, হদ একটি নির্ধারিত শাস্তি। অপরাধ প্রমাণের শর্তাবলী পূর্ণ হবার পর অনিবার্যভাবে এ শাস্তি দেয়া হবে। আর তা’যীর এমন শাস্তিকে বলা হয় যা পরিমাণ ও ধরনের দিক দিয়ে আইনের মধ্যে মোটেই নির্ধারিত করে দেয়া হয়নি। বরং আদালত মামলার অবস্থার প্রেক্ষিতে তার মধ্যে কম-বেশী করতে পারে।)
এসব মতাবলম্বীরা তাঁদের মতামত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীসের সহায়তা নিয়েছেন। নিচে আমি সেগুলো উদ্ধৃত করছিঃ
হযরত উবাদাহ ইবনে সামেতের রেওয়ায়াত। মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযী ও ইমাম আহমাদ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এতে নবী সা. বলেছেনঃ
خُذُوا عَنِّى خُذُوا عَنِّى قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لَهُنَّ سَبِيلاً وَالْبِكْرُ بِالْبِكْرِ جَلْدُ مَاةٍ وَ تَغْرِيْبُ عَامِ وَالثَّيِّبُ بِالثَّيِّبِ جَلْدُ ماةٍ وَالرَجْمُ(اورمى بالحجارة اورجم باالحجارة)
“আমার কাছ থেকে নাও, আমার কাছ থেকে নাও, আল্লাহ যিনাকারীনীদের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অবিবাহিত পুরুষের অবিবাহিত মেয়ের সাথে ব্যভিচারের জন্য একশ বেত্রাঘাত ও এক বছর দেশান্তর। আর বিবাহিতা পুরুষের বিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচারের জন্য একশ বেত্রাঘাত ও প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু।”
(এ হাদিসটি যদিও বর্ণনা পরম্পরার দিক দিয়ে সহীহ কিন্তু বিপুল সংখ্যক সহীহ হাদিস আমাদের একথা জানাচ্ছে যে, একে নবী ও খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে কখনো কার্যকর করা হয়নি ফকিহদের একজনও হুবহু এর বক্তব্য অনুযায়ী ফত্ওয়াও দেননি। ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের এ সংক্রান্ত যে বিষয়ে সবাই একমত সেটি হচ্ছে এই যে, যিনাকারী ও যিনাকারীনীর বিবাহিত ও অবিবাহিত হবার ব্যাপারটির ওপর আলাদা আলাদাভাবে দৃষ্টি দেওয়া হবে। অবিবাহিত পুরুষ বিবাহিত বা অবিবাহিতা যে কোন নারীর সাথে যিনা করুক না কেন উভয় অবস্থায়ই তার শাস্তি একই হবে। আর বিবাহিত পুরুষ অবিবাহিতা বা বিবাহিতা যে কোন নারীর সাথে যিনা করুক না কেন উভয় অবস্থায়ই একই শাস্তি হবে। নারীর ব্যাপারেও এই একই কথা। সে বিবাহিত হলে তার সাথে অবিবাহিত বা বিবাহিত পুরুষ যেই যিনা করুক না কেন উভয় অবস্থায়ই একই শাস্তি হবে। আর অবিবাহিত হলে তার সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত যে কোন পুরুষ যিনা করলেও উভয় অবস্থায়ই তার একই শাস্তি হবে।)
হযরত আবু হুরাইরা রা. ও হযরত খালেদ জুহানীর রা. হাদীস। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাই, ইবনে মাজাহ ও ইমাম আহমাদ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এ হাদীসে বলা হয়েছেঃ দু’জন গ্রামীন আরব নবী সা. এর কাছে একটি মামলা নিয়ে আসে। একজন বলে, আমার ছেলে এ ব্যক্তির বাড়িতে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতো। সে এর স্ত্রীর সাথে জড়িয়ে পড়ে। আমি একে একশ ছাগল ও একটি বাঁদি দিয়ে রাজি করিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আলেমগণ বলছেন, এ মীমাংসা আল্লাহর কিতাব বিরোধী। আপনি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করে দিন। অন্যজনও বলে, আপনি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করে দিন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ীই ফায়সালা করবো। ছাগল ও বাঁদী তুমি ফেরত নিয়ে যাও। তোমার ছেলের শাস্তি হচ্ছে, একশ বেত্রাঘাত ও এক বছর দেশান্তর। তারপর তিনি আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে বলেন, হে উনাইস! তুমি গিয়ে এর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করো। যদি সে স্বীকারোক্তি করে তাহলে তাকে রজম করে দাও। দেখা গেলো তার স্ত্রী স্বীকারোক্তি করেছে। ফলে তাকে রজম করা হলো। (এখানে রজম করার আগে বেত্রাঘাতের কোন কথা নেই। আর অবিবাহিত পুরুষকে বিবাহিতা নারীর সাথে ব্যভিচার করার ফলে বেত্রাঘাত ও দেশান্তরের শাস্তি দেয়া হয়।)
মাঈ’য ও গামেদীয়ার মামলার যতগুলো বিবরণী হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে তার কোনটিতেও একথা পাওয়া যায় না যে, রাসূলুল্লাহ সা. রজম করার আগে তাদেরকে একশ বেত্রাঘাত করার ব্যবস্থাও করেছিলেন।
কোন হাদীসে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না যা থেকে জানা যায় যে, নবী সা. কোন মামলায় রজমের সাথে বেত্রাঘাতের শাস্তিও দেন। বিবাহিতের যিনার শাস্তিতে তিনি শুধুমাত্র রজমের শাস্তিই দেন।
হযরত উমর রা. তাঁর বহুল প্রচারিত ভাষণে বিবাহিতের যিনার শাস্তি রজম বর্ণনা করেছেন। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাই বিভিন্ন বর্ণনা পরম্পরায় এটি উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমাদও এ থেকে বিভিন্ন বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এর কোন একটি বর্ণনায়ও রজমের সাথে বেত্রাঘাতের উল্লেখ নেই।
খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে একমাত্র হযরত আলী রা. বেত্রাঘাত ও রজমকে একই শাস্তির আওতায় একত্র করেছেন। ইমাম আহমাদ ও বুখারী আমের শা’বী থেকে এ ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, শুরাহাহ নামক এক মহিলা অবৈধ গর্ভের স্বীকারোক্তি করে। হযরত আলী রা. বৃহস্পতিবার দিন তাকে বেত্রাঘাত করান এবং শুক্রবার রজমের শাস্তি দেন আর তারপর বলেন, আমি আল্লাহর কিতাবের বিধান অনুযায়ী তাকে বেত্রাঘাতের এবং রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী রজমের শাস্তি দিয়েছি। এ একটি ঘটনা ছাড়া খেলাফতে রাশেদার সমগ্র আমলে রজমের সাথে বেত্রাঘাতের শাস্তির পক্ষে দ্বিতীয় কোন ঘটনা পাওয়া যায় না।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রা. একটি রেওয়ায়াত। আবু দাউদ ও নাসাঈ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এতে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি যিনা করে এবং নবী সা. তাকে কেবল বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন। তারপর জানা যায় সে বিবাহিত ছিল। তখন তিনি তাকে রজমের শাস্তিই দেন। এছাড়াও ইতিপূর্বে আমি বিভিন্ন হাদীস উদ্ধৃত করেছি। সেগুলো থেকে জানা যায়, অবিবাহিত যিনাকারীদেরকে তিনি কেবল বেত্রাঘাতের শাস্তিই দেন। যেন যে ব্যক্তি মসজিদে গমনকারী এক মহিলার সাথে বলপূর্বক যিনা করেছিল এবং যে ব্যক্তি যিনার স্বীকারোক্তি করেছিল এবং মেয়েটি করেছিল অস্বীকার।
হযরত উমর রা. বারীআ’হ ইবনে উমাইয়াহ ইবনে খাল্ফকে মদ পানের অপরাধে দেশান্তর করেন এবং সে পালিয়ে গিয়ে রোমানদের সাথে যোগ দেয়। এর ফলে হযরত উমর রা. বলেন, ভবিষ্যতে আমি আর কাউকে দেশান্তরের শাস্তি দেবো না। অনুরূপভাবে হযরত আলী রা. অবিবাহিত পুরুষ ও নারীকে যিনার অপরাধে দেশান্তর করতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, এর ফলে ফিতনার আশঙ্কা আছে। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাসঃ ৩য় খণ্ড, ৩১৫ পৃষ্ঠা)।
এ সমস্ত হাদীসের প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টি দিলে পরিষ্কার অনুভূত হয়, ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর সহযোগীদের অভিমতই সঠিক। অর্থাৎ বিবাহিতের যিনার শাস্তি শুধুমাত্র রজম এবং অবিবাহিতের যিনার শাস্তি শুধুমাত্র একশ বেত্রাঘাত। বেত্রাঘাত ও রজমকে একসাথে নবীর সা. আমল থেকে হযরত উসমানের রা. আমল পর্যন্ত কখনো কার্যকর করা হয়নি। আর বেত্রাঘাত ও দেশান্তরের শাস্তিকে কখনো একত্র করা হয়েছে আবার কখনো একত্র করা হয়নি। এ থেকে হানাফী অভিমতের নির্ভুলতা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়।
তেইশঃ বেত্রাঘাতের ধরন সম্পর্কে প্রথম ইঙ্গিত কুরআনের শব্দ فاجلدوا এর মধ্যে পাওয়া যায়। جلد جلد (জাল্দ) শব্দটি جلد (জিল্দ অর্থাৎ চামড়া) থেকে গৃহীত। এ থেকে সকল অভিধান বিশারদ ও কুরআন ব্যাখ্যাদাতা এ অর্থই নিয়েছেন যে, আঘাত এমন হতে হবে যার প্রভাব চামড়ার ওপর থাকে, গোশতের মধ্যে না পৌঁছে। এমন ধরনের বেত্রাঘাত যার ফলে গোশতের টুকরা উড়ে যেতে থাকে অথবা চামড়া ফেটে আঘাত ভেতরে পৌঁছে যায়, তা কুরআন বিরোধী।
আঘাত করার জন্য কোড়া বা বেত যাই ব্যবহার করা হোক না কেন উভয় ক্ষেত্রেই তা মাঝারি পর্যায়ের হতে হবে। বেশী মোটা ও বেশী তীক্ষ্ম অথবা বেশী পাতলা ও বেশী নরম হতে পারবে না। মুআত্তা গ্রন্থে ইমাম মালেক রেওয়ায়াত করেছেন যে, নবী সা. বেত্রাঘাতের জন্য কোড়া আনতে বলেন। সেটি বেশী ব্যবহার করার কারণে অনেক বেশী হাল্কা পাতলা হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, فوق هذا (এর চাইতে বেশী তীক্ষ্ম দেখে আনো)। তখন একটি নতুন কোড়া আনা হয়। সেটি তখনো কোন প্রকার ব্যবহারের ফলে নরম হয়ে যায় নি। তিনি বলেন, এ দু’য়ের মাঝামাঝি। তারপর এমন কোড়া আনা হয় যা সওয়ারীর পিঠে ব্যবহার করা হয়েছিল। তা দিয়ে তিনি আঘাত করান। প্রায় একই বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি বর্ণনা আবু উসমান আন্নাহদী হযরত উমর রা. সম্পর্কে বর্ণনা করে বলেন যে, তিনি প্রায় মাঝারি ধরনের কোড়া ব্যবহার করতেন। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাসঃ ৩য় খণ্ড, ৩২২ পৃষ্ঠা) গাঁট বাঁধানো কোড়া অথবা দু’চামড়া-তিন চামড়া বা দু’রশি-তিন রশি বাঁধানো কোড়া ব্যবহার করা নিষেধ।
আঘাতও হতে হবে মাঝারি পর্যায়ের। হযরত উমর রা. আঘাতকারীকে নির্দেশ দিতে لاترفع (يالاتخرج) ابطك অর্থাৎ “এমনভাবে মারো যেন তোমার বগল খুলে না যায়।” অর্থাৎ পূর্ণ শক্তিতে হাত উঁচিয়ে মেরো না। (আহকামুল কুরআন-ইবেন আরাবী, ২য় খণ্ড, ৮৪ পৃষ্ঠা, আহকামুল কুরআন-জাস্সাসঃ ৩য় খণ্ড, ৩২২ পৃষ্ঠা)। সকল ফকীহ এ ব্যাপারে একমত যে, এ ধরনের আঘাত হবে না যার ফলে ঘা হয়ে যায়। একই জায়গায় মারা যাবে না বরং সারা শরীরে মার ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র চেহারা ও লজ্জাস্থান এবং (হানাফীদের মতে মাথাও) অক্ষত রাখতে হবে। বাদবাকি সমস্ত অঙ্গে কিছু না কিছু মার পড়তে হবে। এক ব্যক্তিকে যখন কোড়া মারা হচ্ছিল তখন হযরত আলী রা. বলেন, “শরীরের প্রত্যেক অঙ্গকে তার প্রাপ্য দাও এবং শুধুমাত্র মুখ ও লজ্জাস্থানকে নিষ্কৃতি দাও।” (আহকামুল কুরআন-জাস্সাসঃ ৩য় খণ্ড, ৩২১ পৃষ্ঠা) নবী সা. বলেনঃ إِذَا ضَرَبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَتَّقِ الْوَجْهَ “তোমাদের কেউ যখন আঘাত করবে তখন মুখে আঘাত করবে না।” (আবু দাউদ)
পুরুষকে দাঁড় করিয়ে ও স্ত্রী লোককে বসিয়ে মারা উচিত। ইমাম আবু হানীফার সময় কুফার কাযী ইবনে আবী লাইলা একটি মেয়েকে দাঁড় করিয়ে মারার ব্যবস্থা করেন। ইমাম আবু হানীফা এর কঠোর সমালোচনা করেন এবং প্রকাশ্যে তার এ কার্যক্রমকে ভুল বলে চিহ্নিত করেন। (এ থেকে আদালতের অমর্যাদা সংক্রান্ত ইমাম আবু হানীফার মতবাদের ওপরও আলোকপাত হয়)। কোড়া মারার সময় স্ত্রীলোক তার পূর্ণ পোশাক পরে থাকবে। বরং তার শরীরের কোন অংশ যাতে বের হয়ে না যায় এজন্য কাপড় তার সারা শরীরে ভালোভাবে বেঁধে দেয়া হবে। শুধু মোটা কাপড় খুলে নিতে হবে। পুরুষের ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। কোন কোন ফকীহ বলেন, পুরুষ কেবল পাজামা পরে থাকবে। আবার অন্যেরা বলেন, জামাও খোলা যাবে না। হযরত আবু উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ রা. এক যিনাকারীকে কোড়া মারার হুকুম দেন। সে বলে, “এই শরীরটার ভালোভাবে মার খাওয়া উচিত।” একথা বলে সে জামা খুলতে শুরু করে। হযরত আবু উবাইদাহ বলেন, “তাকে জামা খুলতে দিয়ো না।” (আহকামুল কুরআন-জাস্সাসঃ ৩য় খণ্ড, ৩২২ পৃষ্ঠা)। হযরত আলীর আমলে এক ব্যক্তি নিজের গায়ে চাদর জড়িয়ে ছিল এ অবস্থায় তাকে কোড়া মারা হয়।
প্রচণ্ড শীত ও প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মারা নিষিদ্ধ। শীতকালে গরম সময়ে এবং গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডার মধ্যে মারতে হবে।
বেঁধে মারারও অনুমতি নেই। তবে অপরাধী যদি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তাহলে বেঁধে মারা যেতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউ’দ রা. বলেন, لايحل فى هذه الامة تجريد ولامد “এই উম্মতের মধ্যে উলঙ্গ করে এবং খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারা জায়েজ নয়।”
ফকীহগণ প্রতিদিন অন্ততঃপক্ষে বিশ ঘা কোড়া মারা বৈধ বলেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে সম্পূর্ণ শাস্তি দিয়ে দেয়া উত্তম।
মূর্খ ও হিংস্র ধরনের জল্লাদের সাহায্যে মারার কাজ সম্পন্ন করা উচিত নয়। বরং শিক্ষিত ও মার্জিত জ্ঞানবান লোকদের সাহায্যে এ কাজ সম্পন্ন করা উচিত। যারা জানে শরীয়াতের দাবী পূর্ণ করার জন্য কিভাবে মারা উচিত তারাই এ কাজ করবে। ইবনে কাইয়েম যাদুল মাআ’দ গ্রন্থে লিখেছেন, নবী সা. এর জামানায় হযরত আলী রা., হযরত যুবাইর রা., হযরত মিকদাদ ইবনে আমর রা., হযরত মুহাম্মাদ ইবনে মাস্লামাহ রা., হযরত আসেম ইবনে সামেত দ্বাহ্হাক ইবনে সুফিয়ানের ন্যায় সজ্জন ও মর্যাদাশালী লোকেরা জল্লাদের দায়িত্ব পালন করতেন। (১ম খণ্ড, ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠা)।
যদি অপরাধী রুগ্ন হয় অথবা তার আরোগ্য লাভ করার কোন আশা না থাকে কিংবা একেবারে বৃদ্ধ হয় তাহলে একশ শাখাওয়ালা একটা ডাল বা শতকাঠিওয়ালা একটি ঝাড়ু দিয়ে তাকে কেবলমাত্র একবার মেরে দেয়াই উচিত, যাতে আইনের দাবী পূর্ণ হয়। নবী সা. এর সময় এক বৃদ্ধ রোগী যিনার অপরাধে পাকড়াও হয়। তিনি তার জন্য এ শাস্তিই নির্ধারণ করেন। (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ) গর্ভবতী নারীকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিতে হলে শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর নিফাসের সময় পার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর তাকে রজম করতে হলে যতক্ষণ তার সন্তান দুধ পান করা পরিত্যাগ না করে ততক্ষণ তাকে শাস্তি দেয়া যেতে পারবে না।
যদি সাক্ষ্যের মাধ্যমে যিনা প্রমাণ হয় তাহলে সাক্ষী মারের সূচনা করবে আর যদি স্বীকারোক্তির মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে কাযী নিজেই সূচনা করবেন, যাতে সাক্ষী নিজের সাক্ষ্যকে এবং বিচারক নিজের বিচারকে খেল-তামাশা মনে না করেন। শুরাহাহর মামলায় যখন হযরত আলী রাহি. রজমের ফায়সালা দেন তখন বলেন, “যদি তার অপরাধের কোন সাক্ষী থাকতো তাহলে তাকেই মার শুরু করতে হতো। কিন্তু তাকে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কাজেই আমি নিজেই শুরু করবো।” হানাফীয়াদের মতে এমনটি করা ওয়াজিব। শাফেঈরা একে ওয়াজিব মনে করেন না। কিন্তু সবাই একে উত্তম মনে করেন।
বেত্রাঘাতের শাস্তির এ বিস্তারিত বিবরণ পড়ুন তারপর যারা এ শাস্তিকে বর্বরোচিত বলে থাকে তাদের ধৃষ্টতার কথা ভাবুন। আজকাল কারাগারে কয়েদীদেরকে যে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হচ্ছে তা তাদের কাছে বড়ই ভদ্রোচিত! বর্তমান আইনের দৃষ্টিতে কেবলমাত্র আদালতই নয়, জেলখানার একজন মামুলি সুপারিন্টেনডেন্টও একজন কয়েদীকে হুকুম অমান্য বা গোস্তাখী করার অপরাধে ৩০ ঘা পর্যন্ত বেত্রাঘাতের শাস্তি দেবার অধিকার রাখে। এ বেত্রাঘাত করার জন্য একজন লোককে বিশেষভাবে তৈরী করা হয় এবং সে সবসময় এটা মশ্ক করতে থাকে। এ উদ্দেশ্যে বেতও বিশেষভাবে ভিজিয়ে ভিজিয়ে তৈরী করা হয়, যাতে করে শরীরের ওপর তা ছুরির মতো কেটে বসে যেতে পারে। অপরাধীকে নাঙ্গা করে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া হয়, যাতে সে একটু নড়াচড়াও করতে না পারে। কেবলমাত্র তার লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য এক টুকরা পাতলা কাপড় তার পাছার সাথে জড়িয়ে দেয়া হয় এবং সেটিকেও টিংচার আইওডিন দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয়। জল্লাদ দূর থেকে দৌড়ে আসে এবং পূর্ণ শক্তিতে তার ওপর আঘাত করে। শরীরের একটি বিশেষ অংশ (অর্থাৎ পাছায়) বরাবর আঘাত করা হতে থাকে। ফলে সেখান থেকে গোশ্ত কিমা হয়ে উড়ে যেতে থাকে এবং অনেক সময় ভেতর থেকে হাড় দেখা যেতে থাকে। অধিকাংশ সময় এমন হয়, অত্যন্ত বলশালী ও শক্তিধর ব্যক্তিও ৩০ ঘা বেত সম্পূর্ণ হবার আগেই বেহুশ হয়ে পড়ে যায়। এ অবস্থায় তার শরীর ভরাট হতে দীর্ঘ সময় লাগে। তথাকথিত এ ভদ্রজনোচিত শাস্তিকে যারা আজ কারাগারে নিজেরাই প্রবর্তিত করে চলেছে তারা কোন মুখে ইসলাম প্রবর্তিত বেত্রাঘাতের শাস্তিকে “বর্বরোচিত” বলার ধৃষ্টতা দেখাতে পরে! তারপর তাদের পুলিশ বাহিনী যেসব অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে তাদেরকে নয় বরং নিছক সন্দেহভাজন লোকদেরকে ধরে এনে অনুসন্ধান চালাবার উদ্দেশ্যে (বিশেষ করে রাজনৈতিক অপরাধ সন্দেহে) যেভাবে শাস্তি দিয়ে থাকে তা আজ আর কারো দৃষ্টির অগোচরে নেই।
চব্বিশঃ রজমের শাস্তির ফলে অপরাধী মারা যাবার পর তার সাথে পুরোপুরি মুসলমানের মতো ব্যবহার করা হবে। তার লাশকে গোসল দিয়ে কাফন পরানো হবে। তার জানাযার নামায পড়া হবে। তাকে মর্যাদা সহকারে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা হবে। তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা হবে। দুর্নাম সহকারে তার কথা আলোচনা করা কারোর জন্য বৈধ হবে না। বুখারীতে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারীর রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, “রজমের ফলে মাঈ’য ইবনে মালেকের মৃত্যু হলে নবী সা. সুনামের সাথে তাকে স্মরণ করতে থাকেন এবং নিজে তার জানাযার নামায পড়ান।” মুসলিমে হযরত বুরাইদার রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে নবী কারীম সা. বলেছেনঃ
اسْتَغْفِرُوا لِمَاعِزِ بْنِ مَالِكٍ لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أُمَّةٍ لَوَسِعَتْهُمْ
“মাঈ’য ইবনে মালেকের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো। সে এমন তাওবা করেছে যে, যদি তা সমগ্র উম্মতের ওপর বন্টন করে দেয়া হয়, তাহলে সবার জন্য যথেষ্ট হবে।”
এ হাদীসে একথাও বলা হয়েছে, গামেদীয়া যখন রজম করার ফলে মারা যান তখন নবী কারীম সা. নিজেই তার জানাযার নামায পড়ান। আর হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ রা. যখন দুর্নাম সহকারে তার কথা বলতে থাকেন তখন তিনি বলেনঃ
مَهْلاً يَا خَالِدُ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا صَاحِبُ مَكْسٍ لَغُفِرَ لَهُ
“হে খালেদ! চুপ করো। সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, সে এমন তাওবা করেছিল যে, যদি নিপীড়নমূলক কর আদায়কারীও তেমন তাওবা করতো তাহলে তাকেও মাফ করে দেয়া হতো।”
আবু দাউদে হযরত আবু হুরাইরার রা. রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মাঈ’যের ঘটনার পর একদিন রাসূলুল্লাহ সা. পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দু’জন লোককে মাঈ’যের দুর্নাম করতে শুনলেন। কয়েক পা এগিয়ে গেলে একটি গাধার লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেলো। রাসূলুল্লাহ সা. থেমে গেলেন এবং ঐ দু’জন লোকের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা দু’জন এটা থেকে কিছু খাও।” তারা বললেন, “হে আল্লাহর নবী! ওটা কে খেতে পারে।” তিনি বললেন, “এখনই তো তোমরা তোমাদের ভাইয়ের ইজ্জত-আব্রু খাচ্ছিলে। ওটা এর চেয়ে অনেক খারাপ জিনিস ছিল।” মুসলিমে ঈমরান ইবনে হুসাইন বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত উমর রা. গামেদীয়ার জানাযার নামাযের সময় বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! এখন কি এই যিনাকারীনীর জানাযার নামায পড়া হবে? তিনি জবাব দেনঃ
لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أَهْلِ الْمَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ
“সে এমন তাওবা করেছে, যা সমগ্র মদীনাবাসীর মধ্যে ভাগ করে দেয়া হলেও তা সবার জন্য যথেষ্ট হবে।”
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরাহ রা. বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তিকে মদপানের অপরাধে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। তা দেখে একজনের মুখ থেকে বের হয়ে পড়ে, “আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন।” একথায় নবী সা. বলেন, “এভাবে বলো না। এর বিরুদ্ধে শয়তানকে সাহায্য করো না।” আবু দাউদে এর ওপর আর এতটুকু সংযোজন আছে যে, নবী সা. বলেন, বরং এভাবে বলোঃ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ “হে আল্লাহ তাকে মাফ করো, হে আল্লাহ! তার প্রতি রহম করো।” এ হচ্ছে ইসলামে শাস্তির তাৎপর্য। ইসলাম কোন বৃহত্তম অপরাধীকেও শত্রুতার মনোভাব হবার পর তার প্রতি স্নেহ ও মমতার দৃষ্টিতে দেখে। আধুনিক সভ্যতাই বর্তমানে এমন এক সংকীর্ণমনতার জন্ম দিয়েছে যার ফলে সরকারী সৈন্য বা পুলিশ যাকে হত্যা করে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের ফলে যাকে হত্যা করা বৈধ গণ্য করা হয় তার লাশ বহন করে নিয়ে যাওয়া বা কারও মুখে তার প্রশংসা কীর্তিত হওয়াকে কোনক্রমেই পছন্দ করা হয় না। এরপর দুনিয়াবাসীকে সহিষ্ণুতা ও উদারতার নসিহত করে নিজের নৈতিক সাহসের (এটা আধুনিক সভ্যতায় ধৃষ্টতা ও নির্লজ্জতার মার্জিত নাম) পরাকাষ্ঠা দেখানো হয়।
পঁচিশঃ মুহাররম নারীদের সাথে যিনার শাস্তি সম্পর্কিত শরীয়াতের আইন তাফহীমুল কুরআনের সূরা আন নিসার ৩৪ টীকায় এবং লূতের জাতির কর্ম (সমকাম) সংক্রান্ত শরীয়াতী ফায়সালা তাফহীমুল কুরআনের সূরা আল আ’রাফের ৬৪ থেকে ৬৮ টীকার বর্ণনা করা হয়েছে। আর পশুর সাথে ব্যভিচার করাকেও কোন কোন ফকীহ যিনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং সে যিনার শাস্তি লাভের যোগ্য বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা রাহি., ইমাম আবু ইউসুফ রাহি., ইমাম মুহাম্মাদ রাহি., ইমাম যুফার রাহি., ইমাম মালেক রাহি. ও ইমাম শাফেঈ রাহি. একে যিনা বলেন না এবং তাঁরা এ ধরনের কর্মে লিপ্ত ব্যক্তির ওপর “হূদ” বা “তা’যীর” কোনটি জারি করার পক্ষপাতী নন। তা’যীর সম্পর্কে আমি আগেই বলে এসেছি যে, এর ফায়সালা করবেন কাযী নিজেই অথবা রাষ্ট্রের মজলিসে শূরা প্রয়োজন বোধ করলে এজন্য কোন উপযোগী ব্যবস্থা নিজেই প্রবর্তন করতে পারবে।
৩. এ আয়াতের প্রথম উল্লেখযোগ্য জিনিসটি হচ্ছে, এখানে ফৌজদারী আইনকে “আল্লাহর দ্বীন” বলা হচ্ছে। এ থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতই দ্বীন নয় বরং দেশের আইনও দ্বীন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ শুধু নামায প্রতিষ্ঠা নয় বরং আল্লাহর আইন ও শরীয়াত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাও। যেখানে এসব প্রতিষ্ঠিত হয় না সেখানে নামায প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও যেন অসম্পূর্ণ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলে মনে করা হবে। যেখানে একে বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন অবলম্বন করা হয় সেখানে অন্য কিছু নয় বরং আল্লাহর দ্বীনকেই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এখানে দ্বিতীয় যে জিনিসটি উল্লেখযোগ্য সেটি হচ্ছে, আল্লাহর এ সতর্কবাণীঃ যিনাকারী ও যিনাকারীনীর ওপর আমার নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগকালে অপরাধীর জন্য দয়া ও মমতার প্রেরণা যেন তোমাদের হাত টেনে না ধরে। নবী সা. একথাটি আরো স্পষ্টভাবে নিম্নোক্ত হাদীসটিতে বলেনঃ
يُؤتَى بِوَالٍ نَقَصَ مِنَ الحَدِّ سَوْطاً فَيُقَالُ لَهُ لِمَ فَعَلْتَ ذَاكَ؟ فَيَقُوْلُ رَحْمَةٌ لِعِبَادِكَ فَيُقَالُ لَهُ أَنْتَ أَرْحَمُ بهم مِنِّي؟ فَيَؤْمَرُ بِهِ إِلَى النَّارِ- وَيُؤْتَى بِمَنْ زَادَ سَوْطاً فَيُقَالُ لَهُ لِمَ فَعَلْتَ ذَاكَ فيقولُ لِيَنْتَهَوا عَنْ مَعَاصِيكَ فيقول أَنتَ أَحْكَمُ بِهِم مِنِّي؟ فَيُؤْمَرُ به إلى النَّار
“কিয়ামতের দিন একজন শাসককে আনা হবে। সে হদের মধ্যে বেত্রাঘাতের সংখ্যা এক ঘা কমিয়ে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করা হবে, এ কাজ তুমি কেন করেছিলে? জবাব দেবে, আপনার বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহশীল হয়ে। আল্লাহ বলবেনঃ আচ্ছা, তাহলে তাদের ব্যাপারে তুমি আমার চেয়ে বেশী অনুগ্রহশীল ছিলে? তারপর হুকুম হবে, নিয়ে যাও একে দোযখে। আর একজন শাসককে আনা হবে। সে বেত্রাঘাতের সংখ্যা ১টি বাড়িয়ে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি এ কাজ করেছিলে কেন? সে জবাব দেবে, যাতে লোকেরা আপনার নাফরমানি করা থেকে বিরত থাকে। আল্লাহ বলবেনঃ আচ্ছা, তাদের ব্যাপারে তুমি তাহলে আমার চেয়ে বেশী বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিলে? তারপর হুকুম হবে, নিয়ে যাও একে দোযখে। (তাফসীরে কবীরঃ ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২২৫ পৃষ্ঠা)
দয়া বা প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে হদের মধ্যে কম-বেশী করার কাজ চললে এ অবস্থা হবে। কিন্তু কোথাও যদি অপরাধীদের মর্যাদার ভিত্তিতে বিধানের মধ্যে বৈষম্য করা হতে থাকে তাহলে সেটা হবে জঘন্য ধরনের অপরাধ। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আয়েশার রা. একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নবী সা. এক ভাষণে বলেনঃ “হে লোকেরা! তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মত অতিক্রান্ত হয়েছে তারা এজন্য ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের কোন মর্যাদাশালী ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিতো এবং কোন দুর্বল ব্যক্তি চুরি করলে তাকে শাস্তি দিতো।” অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ “একটি হদ্ জারি করা দুনিয়াবাসীর জন্য চল্লিশ দিন বৃষ্টি হবার চাইতেও বেশী কল্যাণকর।” (নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)
কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াতের এ অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, অপরাধ প্রমাণ হবার পর অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া যাবে না এবং তার শাস্তিও কম করা যাবে না বরং তাকে পুরো একশ কোড়া মারতে হবে। আবার কেউ কেউ এ অর্থ নিয়েছেন যে, অপরাধী যে মারের কোন কষ্ট অনুভব করতে না পারে এমন ধরনের কোন হাল্কা মার মারা যাবে না। আয়াতের শব্দাবলী উভয় ধরনের অর্থ সম্বলিত। বরং উভয় অর্থই প্রযোজ্য মনে হয়। বরঞ্চ সে সাথে এ অর্থও হয় যে, যিনাকারীকে সে শাস্তি দিতে হবে যা আল্লাহ নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তাকে অন্য কোন শাস্তিতে পরিবর্তিত করা যাবে না। কোড়া মারার পরিবর্তে যদি অন্য কোন শাস্তি দয়া ও মমতার ভিত্তিতে দেয়া হয়, তাহলে তা হবে গোনাহ। আর যদি কোড়া মারাকে একটি বর্বরোচিত শাস্তি মনে করে অন্য শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে তা হবে নির্জলা কুফরী, যা এক মুহূর্তকালের জন্যও ঈমানের সাথে একই বক্ষে একত্র হতে পারে না। আল্লাহকে আল্লাহ বলে মেনে নেয়া আবার (নাউযুবিল্লাহ্) তাকে বর্বরও বলা কেবলমাত্র এমন ধরনের লোকের পক্ষে সম্ভব যে জঘন্য পর্যায়ের মুনাফিক।
৪. অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ লোকের সামনে শাস্তি দিতে হবে। এর ফলে একদিকে অপরাধী অপদস্ত হবে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষ শিক্ষা লাভ করবে। এ থেকে ইসলামের শাস্তি তত্ত্বের ওপর সুস্পষ্ট আলোকপাত হয়। সূরা আল মায়িদায় চুরির শাস্তি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ جَزَآءًۢ بِمَا كَسَبَا نَكَالاً مِّنَ اللّٰهِ “তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অপরাধ প্রতিরোধক শাস্তি।” (আয়াতঃ ৩৮) আর এখানে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, যিনাকারীকে প্রকাশ্য লোকদের সামনে শাস্তি দিতে হবে। এ থেকে জানা যায়, ইসলামী আইনে শাস্তির তিনটি উদ্দেশ্য। একঃ অপরাধী থেকে তার জুলুম ও বাড়াবাড়ির প্রতিশোধ নিতে হবে এবং সে অন্য ব্যক্তি বা সমাজের প্রতি যে অন্যায় করেছিল তার কিছুটা স্বাদ তাকে আস্বাদন করিয়ে দিতে হবে। দুইঃ তাকে পুনর্বার অপরাধ করা থেকে বিরত রাখতে হবে। তিনঃ তার শাস্তিকে শিক্ষণীয় করতে হবে, যাতে সমাজের খারাপ প্রবণতার অধিকারী অন্য লোকদের মগজ ধোলাই হয়ে যায় এবং তারা যেন এ ধরনের কোন অপরাধ করার সাহসই না করতে পারে। এছাড়াও প্রকাশ্যে শাস্তি দেবার আর একটি লাভ হচ্ছে এই যে, এ অবস্থায় শাসকরা শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে অহেতুক সুবিধা দান বা অহেতুক কঠোরতা প্রদর্শন করার সাহস না দেখাতে পারে।
﴿الزَّانِي لَا يَنكِحُ إِلَّا زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً وَالزَّانِيَةُ لَا يَنكِحُهَا إِلَّا زَانٍ أَوْ مُشْرِكٌ ۚ وَحُرِّمَ ذَٰلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ﴾
৩। ব্যভিচারী যেন ব্যভিচারিনী বা মুশরিক নারী ছাড়া কাউকে বিয়ে না করে এবং ব্যভিচারিনীকে যেন ব্যভিচারী বা মুশরিক ছাড়া আর কেউ বিয়ে না করে। আর এটা হারাম করে দেয়া হয়েছে মু’মিনদের জন্য।৫
৫. অর্থাৎ অ-তাওবাকারী ব্যভিচারীর জন্য ব্যভিচারিণীই উপযোগী অথবা মুশরিক নারী। কোন সৎ মু’মিন নারীর জন্য সে মোটেই উপযোগী পুরুষ নয়। আর মু’মিনদের জন্য জেনে বুঝে নিজেদের মেয়েদেরকে এ ধরনের অসচ্চরিত্র লোকদের হাতে সোপর্দ করা হারাম। এভাবে যিনাকারীনী (অ-তাওবাকারী) মেয়েদের জন্য তাদেরই মতো যিনাকারীরা অথবা মুশরিকরাই উপযোগী। সৎ মু’মিনদের জন্য তারা মোটেই উপযোগী নয়। যেসব নারীর চরিত্রহীনতার কথা মু’মিনরা জানে তাদেরকে বিয়ে করা তাদের জন্য হারাম। যে সমস্ত পুরুষ ও নারী তাদের চরিত্রহীনতার পথে গা ভাসিয়ে দিয়েছে একমাত্র তাদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য। তবে যারা তাওবা করে নিজেদের সংশোধন করে নিয়েছে তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। কারণ তাওবা ও সংশোধনের পর “যিনাকারী” হবার দোষ আর তাদের জন্য প্রযুক্ত হয় না।
যিনাকারীর সাথে বিয়ে হারাম হবার অর্থ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এ নিয়েছেন যে, আদতে তার সাথে বিয়ে অনুষ্ঠিতই হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে সঠিক কথা হচ্ছে, এর অর্থ নিছক নিষেধাজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ করে যদি কেউ বিয়ে করে তাহলে আইনগতভাবে তা বিয়েই হবে না এবং এ বিয়ে সত্ত্বেও উভয় পক্ষকে যিনাকারী গণ্য করতে হবে একথা ঠিক নয়। নবী সা. একটি সার্বজনীন নিয়ম হিসেবে বলেনঃ الحرام لايحرم الحلال “হারাম হালালকে হারাম করে দেয় না।” (তাবারানী ও দারুকুতনী) অর্থাৎ একটি বেআইনী কাজ অন্য একটি আইনসঙ্গত কাজকে বেআইনী করে দেয় না। কাজেই কোন ব্যক্তির যিনা করার কারণে সে যদি বিয়েও করে তাহলে তা তাকে যিনায় পরিণত করে দিতে পারে না এবং বিবাহ চুক্তির দ্বিতীয় পক্ষ যে ব্যভিচারী নয় সেও ব্যভিচারী গণ্য হবে না। নীতিগতভাবে বিদ্রোহ ছাড়া কোন অপরাধ এমন নেই, যা অপরাধ সম্পাদনকারীকে নিষিদ্ধ ব্যক্তিতে (Outlaw) পরিণত করে। যার পরে তার কোন কাজই আইনসঙ্গত হতে পারে না। এ বিষয়টি সামনে রেখে যদি আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যায়, তাহলে আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে এই মনে হয় যে, যাদের ব্যভিচারী চরিত্র জনসমক্ষে পরিচিত তাদেরকে বিয়ে করার জন্য নির্বাচিত করা একটি গোনাহর কাজ। মু’মিনদের এ গোনাহ থেকে দূরে থাকা উচিত। কারণ এর মাধ্যমে ব্যভিচারীদের হিম্মত বাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ শরীয়াত তাদেরকে সমাজের অবাঞ্ছিত ও ঘৃণ্য জীব গণ্য করতে চায়।
অনুরূপভাবে এ আয়াত থেকে এ সিদ্ধান্তও টানা যায় না যে, যিনাকারী মুসলিম পুরুষের বিয়ে মুশরিক নারীর সাথে এবং যিনাকারীনী মুসলিম নারীর বিয়ে মুশরিক পুরুষের সাথে সঠিক হবে। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বলা যে, যিনা একটি চরম নিকৃষ্ট কুকর্ম। যে ব্যক্তি মুসলমান হয়েও এ কাজ করে সে মুসলিম সমাজের সৎ ও পাক-পবিত্র লোকদের সাথে আত্মীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তার নিজের মতো যিনাকারীদের সাথেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত অথবা মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত, যারা আদৌ আল্লাহর বিধানের প্রতি বিশ্বাসই রাখে না।
এ প্রসঙ্গে নবী সা. থেকে যেসব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলোই আসলে আয়াতের সঠিক অর্থ প্রকাশ করে। মুসনাদে আহমাদ ও নাসাঈতে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আসের রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, উম্মে মাহ্যাওল নামে একটি মেয়ে পতিতাবৃত্তি অবলম্বন করেছিল। এক মুসলমান তাকে বিয়ে করতে চায় এবং এজন্য নবী সা. এর কাছে অনুমতি চায়। তিনি নিষেধ করে এ আয়াতটি পড়েন। তিরমিযী ও আবু দাউদে বলা হয়েছে, মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ একজন সাহাবী ছিলেন। জাহেলী যুগে মক্কার ঈনাক নামক এক ব্যভিচারিণীর সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। পরে তিনি তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা করেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. কাছে অনুমতি চান। দু’বার জিজ্ঞেস করার পরও তিনি নীরব থাকেন। আবার তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করেন, এবার তিনি জবাব দেনঃ
يا مرثد الزَّانِى لاَ يَنْكِحُ إِلاَّ زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً فلاَ يَنْكِحُهَا
“হে মারসাদ! ব্যভিচারী এক ব্যভিচারিণী বা মুশরিক নারী ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না, কাজেই তাকে বিয়ে করো না।”
এছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. থেকেও বিভিন্ন হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলোতে বলা হয়েছে, নবী সা. বলেছেনঃ “কোন দাইয়ুস (অর্থাৎ যে ব্যক্তি জানে তার স্ত্রী ব্যভীচারিনী এবং এরপরও সে তার স্বামী থাকে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।” (আহমাদ, নাসাঈ, আবু দাউদ) প্রথম দুই খলীফা হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উমর রা. উভয়ই এ ব্যাপারে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা ছিল এই যে, তাঁদের আমলে যে অবিবাহিত পুরুষ ও নারী যিনার অভিযোগে গ্রেফতার হতো তাদেরকে তাঁরা প্রথমে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিতেন তারপর তাদেরকেই পরস্পরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতেন। ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, একদিন এক ব্যক্তি বড়ই পেরেশান অবস্থায় হযরত আবু বকরের রা. কাছে আসে। সে এমনভাবে কথা বলতে থাকে যেন তার মুখে কথা ভালভাবে ফুটছিল না। হযরত আবু বকর রা., হযরত উমরকে রা. বলেন ওকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে একান্তে জিজ্ঞেস করুন ব্যাপারখানা কি? হযরত উমর রা. জিজ্ঞেস করতে সে বলে, তাদের বাড়িতে মেহমান হিসেবে এক ব্যক্তি এসেছিল। সে তার মেয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে বসেছে। হযরত উমর রা. বলেনঃ قَبَّحَكِ اللَّهُ الا سترت على ابْنَتَكَ “তোমার মন্দ হোক, তুমি নিজের মেয়ের আবরণ ঢেকে দিলে না?” শেষ পর্যন্ত পুরুষটি ও মেয়েটির বিরুদ্ধে মামলা চলে। উভয়কে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হয়। তারপর উভয়কে পরস্পরের সাথে বিয়ে দিয়ে হযরত আবু বকর রা. এক বছরের জন্য তাদেরকে দেশান্তর করেন। এ ধরনেরই আরো কয়েকটি ঘটনা কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী তাঁর আহকামুল কুরআন গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন (পৃষ্ঠা ৮৬, ২য় খণ্ড)।
﴿وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
৪। আর যারা সতী-সাধ্বী নারীর ওপর অপবাদ লাগায়, তারপর চারজন সাক্ষী আনে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করো এবং তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করো না। তারা নিজেরাই ফাসেক।
﴿إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৫। তবে যারা এরপর তাওবা করে এবং শুধরে যায়, অবশ্যই আল্লাহ (তাদের পক্ষে) ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।৬
৬. এ হুকুমটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজে লোকদের গোপন প্রণয় ও অবৈধ সম্পর্কের আলোচনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া। কারণ এর মাধ্যমে অসংখ্য অসৎকাজ, অসৎবৃত্তি ও অসৎ প্রবণতার প্রসার ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অসৎবৃত্তিটি হলো, এভাবে সবার অলক্ষ্যে একটি ব্যভিচারমূলক পরিবেশ তৈরী হয়ে যেতে থাকে। একজন নিছক কৌতুকের বশে কারোর সত্য বা মিথ্যা কুৎসিত ঘটনাবলী অন্যের সামনে বর্ণনা করে বেড়ায়। অন্যেরা তাতে লবণ মরিচ মাখিয়ে লোকদের সামনে পরিবেশন করতে থাকে এবং এ সঙ্গে আরো কিছু লোকের ব্যাপারেও নিজেদের বক্তব্য বা কু-ধারণা বর্ণনা করে। এভাবে কেবলমাত্র যৌন কামনা-বাসনার একটি ব্যাপক ধারাই প্রবাহিত হয় না বরং খারাপ প্রবণতার অধিকারী নারী-পুরুষরা জানতে পারে যে, সমাজের কোথায় কোথায় অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারবে। শরীয়াত প্রথম পদক্ষেপেই এ জিনিসটির পথ রোধ করতে চায়। একদিকে সে হুকুম দেয়, যদি কেউ যিনা করে এবং সাক্ষী-সাবুদের মাধ্যমে তার যিনা প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে এমন চরম শাস্তি দাও যা কোন অপরাধে দেয়া হয় না। আবার অন্যদিকে সে ফায়সালা করে, যে ব্যক্তি অন্যের বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ আনে সে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিজের অভিযোগ প্রমাণ করবে আর যদি প্রমাণ করতে না পারে তাহলে তাকে আশি ঘা বেত্রাঘাত করো, যাতে ভবিষ্যতে আর সে কখনো এ ধরনের কোন কথা বিনা প্রমাণে নিজের মুখ থেকে বের করার সাহস না করে। ধরে নেয়া যাক যদি অভিযোগকারী কাউকে নিজের চোখে ব্যভিচার করতে দেখে তাহলেও তার নীরব থাকা উচিত এবং অন্যদের কাছে একথা না বলা উচিত ফলে ময়লা যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাকবে এবং আশেপাশে ছড়িয়ে যেতে পারবে না। তবে তার কাছে যদি সাক্ষী থাকে তাহলে সমাজে আজেবাজে কথা ছড়াবার পরিবর্তে বিষয়টি শাসকদের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং আদালতে অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করে তাকে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ আইনটি পুরোপুরি অনুধাবন করার জন্য এর বিস্তারিত বিষয়াবলী দৃষ্টি সমক্ষে থাকা উচিত। তাই আমি নীচে এর বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছিঃ
একঃ আয়াতে وَالَّذِينَ يَرْمُونَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হয় “যেসব লোক অপবাদ দেয়।” কিন্তু পূর্বাপর আলোচনা বলে, এখানে অপবাদ মানে সব ধরনের অপবাদ নয় বরং বিশেষভাবে যিনার অপবাদ। প্রথমে যিনার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে এবং সামনের দিকে আসছে “লিআ’ন”-এর বিধান। এ দু’য়ের মাঝখানে এ বিধানটির আসা পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে এখানে অপবাদ বলতে কোন্ ধরনের অপবাদ বুঝানো হয়েছে। তারপর يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ (অপবাদ দেয় সতী মেয়েদেরকে) থেকেও এ মর্মে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এখানে এমন অপবাদের কথা বলা হয়েছে যা সতীত্ব বিরোধী। তাছাড়া অপবাদদাতাদের কাছে তাদের অপবাদের প্রমাণস্বরূপ চারজন সাক্ষী আনার দাবী করা হয়েছে। সমগ্র ইসলামী আইন ব্যবস্থায় একমাত্র যিনার সাক্ষ্যদাতাদের জন্য চারজনের সংখ্যা রাখা হয়েছে। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে সমগ্র উম্মতের আলেম সমাজের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এ আয়াতে শুধুমাত্র যিনার অপবাদের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্য উলামায়ে কেরাম স্বতন্ত্র পারিভাষিক শব্দ “কাযাফ” নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যাতে অন্যান্য অপবাদসমূহ (যেমন কাউকে চোর, শরাবী, সূদখোর বা কাফের বলা) এ বিধানের আওতায় এসে না পড়ে। “কাযাফ” ছাড়া অন্য অপবাদসমূহের শাস্তি কাজী নিজেই নির্ধারণ করতে পারেন অথবা দেশের মজলিসে শূরা প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের জন্য অপমান বা মানহানির কোন সাধারণ আইন তৈরী করতে পারেন।
দুইঃ আয়াতে يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ (সতী নারীদেরকে অপবাদ দেয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ফকীহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, শুধুমাত্র নারীদেরকে অপবাদ দেয়া পর্যন্ত এ বিধানটি সীমাবদ্ধ নয় বরং নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষদেরকে অপবাদ দিলেও এ একই বিধান কার্যকর হবে। এভাবে যদিও অপবাদদাতাদের জন্য الَّذِينَ يَرْمُونَ (যারা অপবাদ দেয়) পুরুষ নির্দেশক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তবুও এর মাধ্যমে শুধুমাত্র পুরুষদেরকেই নির্দেশ করা হয়নি বরং মেয়েরাও যদি “কাযাফ”-এর অপরাধ করে তাহলে তারাও এ একই বিধানের আওতায় শাস্তি পাবে। কারণ অপরাধের ব্যাপারে অপবাদদাতা ও যাকে অপবাদ দেয়া হয় তাদের পুরুষ বা নারী হলে কোন পার্থক্য দেখা দেয় না। কাজেই আইনের আকৃতি হবে এ রকম— যে কোন পুরুষ ও নারী কোন নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষ ও নারীর ওপর যিনার অপবাদ চাপিয়ে দেবে তার জন্য হবে এ আইন (উল্লেখ্য, এখানে “মুহসিন” ও “মুহসিনা” মানে বিবাহিত পুরুষ ও নারী নয় বরং নিষ্কলুষ চরিত্র সম্পন্ন পুরুষ ও নারী)।
তিনঃ অপবাদদাতা যখন কোন নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী পুরুষ ও নারীর বিরুদ্ধে এ অপবাদ দেবে একমাত্র তখনই এ আইন প্রযোজ্য হবে। কোন কলঙ্কযুক্ত ও দাগী চরিত্র সম্পন্ন পুরুষ ও নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দিলে এটি প্রযুক্ত হতে পারে না। দুশ্চরিত্র বলে পরিচিত ব্যক্তি যদি ব্যভিচারী হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে “অপবাদ” দেবার প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু যদি সে এমন না হয়, তাহলে তার ওপর প্রমাণ ছাড়াই অপবাদদাতার জন্য কাজী নিজেই শাস্তি নির্ধারণ করতে পারেন অথবা এ ধরনের অবস্থার জন্য মজলিসে শূরা প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে পারে।
চারঃ কোন মিথ্যা অপবাদ (কাযাফ) দেয়ার কাজটি শাস্তিযোগ্য হবার জন্য শুধুমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে, একজন অন্য জনের ওপর কোন প্রমাণ ছাড়াই ব্যভিচার করার অপবাদ দিয়েছে। বরং এজন্য কিছু শর্ত অপবাদদাতার মধ্যে, কিছু শর্ত যাকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে এবং কিছু শর্ত স্বয়ং অপবাদ কর্মের মধ্যে থাকা অপরিহার্য।
অপবাদদাতার মধ্যে যে শর্তগুলো থাকতে হবে সেগুলো হচ্ছেঃ প্রথমত তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। শিশু যদি অপবাদ দেবার অপরাধ করে তাহলে তাকে আইন–শৃঙ্খলা বিধানমূলক (তা’যীর) শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তার ওপর শরিয়াতী শাস্তি (হদ) জারি হতে পারে না। দ্বিতীয়ত তাকে মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। পাগলের ওপর “কাযাফের” শাস্তি জারি হতে পারে না। অনুরূপভাবে হারাম নেশা ছাড়া অন্য কোন ধরনের নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যেমন ক্লোরোফরমের প্রভাবাধীন অপবাদদাতাকেও অপরাধী গণ্য করা যেতে পারে না। তৃতীয়ত সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় (ফকীহগণের পরিভাষায় ‘তায়েআন’) এ কাজ করবে। কারোর বল প্রয়োগে অপবাদদানকারীকে অপরাধী গণ্য করা যেতে পারে না। চতুর্থত সে, যাকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার নিজের বাপ বা দাদা নয়। কারণ তাদের ওপর অপবাদের হদ জারি হতে পারে না। এগুলো ছাড়া হানাফীদের মতে পঞ্চম আর একটি শর্তও আছে। সেটি হচ্ছে, সে বাকশক্তি সম্পন্ন হবে, বোবা হবে না। বোবা যদি ইশারা ইঙ্গিতে অপবাদ দেয় তাহলে তার ফলে অপবাদের শাস্তি ওয়াজিব হয়ে যাবে না। ইমাম শাফেঈ এ থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন যদি বোবার ইশারা একেবারেই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হয় এবং তা দেখে সে কি বলতে চায় তা লোকেরা বুঝতে পারে, তাহলে তো সে অপবাদদাতা। কারণ তার ইশারা এক ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত ও বদনাম করে দেবার ক্ষেত্রে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করার তুলনায় কোন অংশে কম নয়। পক্ষান্তরে হানাফীদের মতে নিছক ইশারার মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশ এত বেশী শক্তিশালী নয়, যার ভিত্তিতে এক ব্যক্তিকে ৮০ ঘা বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া যেতে পারে। তারা তাকে শুধুমাত্র দমনমূলক (তা’যীর) শাস্তি দেবার পক্ষপাতী।
যাকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় তার মধ্যেও নিম্নোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যেতে হবে। প্রথমত তাকে বুদ্ধি সচেতন হতে হবে। অর্থাৎ তার ওপর এমন অবস্থায় যিনা করার অপবাদ দেয়া হয় যখন সে বুদ্ধি সচেতন ছিল। পাগলের প্রতি (পরে সে বুদ্ধি সচেতন হয়ে গিয়ে থাক বা না থাক) যিনা করার অপবাদদানকারী ‘কাযাফ’-এর শাস্তি লাভের উপযুক্ত নয়। কারণ পাগল তার নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে পারে না। আর তার বিরুদ্ধে যিনা করার সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও সে যিনার শাস্তির উপযুক্ত হয় না এবং তার মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয় না। কাজেই তার প্রতি অপবাদদানকারীরও কাযাফের শাস্তি লাভের যোগ্য হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ইমাম মালেক ও ইমাম লাইস ইবনে সা’দ বলেন, পাগলের প্রতি ব্যভিচারের অপবাদদানকারী কাযাফের শাস্তি লাভের যোগ্য। কারণ সে একটি প্রমাণ বিহীন অপবাদ দিচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় তার ওপর যিনা করার অপবাদ দেয়া হয়। শিশুর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া অথবা যুবকের বিরুদ্ধে এ মর্মে অপবাদ দেয়া যে, সে শৈশবে এ কাজ করেছিল, এ ধরনের অপবাদের ফলে ‘কাযাফ’-এর শাস্তি ওয়াজিব হয় না। কারণ পাগলের মত শিশুও নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে না। ফলে কাযাফ-এর শাস্তি তার ওপর ওয়াজিব হয় না এবং তার মান-সম্মানও নষ্ট হয় না। কিন্ত ইমাম মালেক বলেন, যে ছেলে প্রাপ্ত বয়স্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তার বিরুদ্ধে যদি যিনা করার অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তো অপবাদ দানকারীর ওপর কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব হবে না কিন্তু যদি একই বয়সের মেয়ের ওপর যিনা করার অভিযোগ আনা হয় যার সাথে সহবাস করা সম্ভব, তাহলে তার প্রতি অপবাদদানকারী কাযাফ-এর শাস্তি লাভের যোগ্য। কারণ এর ফলে কেবলমাত্র মেয়েরই নয় বরং তার পরিরবারেরও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় এবং মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যায়। তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে মুসলমান হতে হবে। অর্থাৎ মুসলিম থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে যিনা করার অপবাদ দেয়া হয়। কাফেরের বিরুদ্ধে এ অপবাদ অথবা মুসলিমের বিরুদ্ধে এ অপবাদ যে, সে কাফের থাকা অবস্থায় এ কাজ করেছিল, তার জন্য কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব করে দেয় না। চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, তাকে স্বাধীন হতে হবে। বাঁদি বা গোলামের বিরুদ্ধে এ অপবাদ অথবা স্বাধীনের বিরুদ্ধে এ অপবাদ যে, সে গোলাম থাকা অবস্থায় এ কাজ করেছিল, তার জন্য কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব করে দেয় না। কারণ গোলামীর অসহায়তা ও দুর্বলতার দরুন তার পক্ষে নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতার ব্যবস্থা করা সম্ভব নাও হতে পারে। স্বয়ং কুরআনই গোলামীর অবস্থাকে ‘ইহ্সান’ তথা পূর্ণ বিবাহিত অবস্থা গণ্য করেনি। তাই সূরা আন নিসায় শব্দটি বাঁদীর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু দাউদ যাহেরী এ যুক্তি মানেন না। তিনি বলেন, বাঁদি ও গোলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদদানকারীও কাযাফ-এর শাস্তি লাভের যোগ্য। পঞ্চম শর্ত হচ্ছে, তাকে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। অর্থাৎ তার জীবন যিনা ও যিনাসদৃশ চালচলন থেকে মুক্ত হবে। যিনা মুক্ত হবার অর্থ হচ্ছে, সে বাতিল বিবাহ, গোপন বিবাহ, সন্দেহযুক্ত মালিকানা বা বিবাহ সদৃশ যৌন সঙ্গম করেনি। তার জীবন যাপন এমন ধরনের নয় যেখানে তার বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতা ও নির্লজ্জ বেহায়াপনার অভিযোগ আনা যেতে পারে এবং যিনার চেয়ে কম পর্যায়ের চরিত্রহীনতার অভিযোগ তার প্রতি ইতিপূর্বে কখনো প্রমাণিত হয়নি। কারণ এসব ক্ষেত্রেই তার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ক্ষুণ্ণ হয়ে যায় এবং এ ধরনের অনিশ্চিত নিষ্কলুষতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী ৮০ ঘা বেত্রাঘাতের শাস্তি লাভের যোগ্য হতে পারে না। এমন কি যদি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদের (কাযাফ) শাস্তি জারি হবার আগে যার প্রতি অপবাদ দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে কখনো কোন যিনার অপরাধের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলেও মিথ্যা অপবাদদানকারীকে ছেড়ে দেয়া হবে। কারণ যার প্রতি সে অপবাদ আরোপ করেছিল সে নিষ্কলুষ থাকেনি।
কিন্তু এ পাঁচটি ক্ষেত্রে শরীয়াত নির্ধারিত শাস্তি (হদ্) জারি না হবার অর্থ এ নয় যে, পাগল, শিশু, কাফের, গোলাম বা অনিষ্কলুষ ব্যক্তির প্রতি প্রমাণ ছাড়াই যিনার অপবাদ আরোপকারী দমনমূলক (তা’যীর) শাস্তি লাভের যোগ্য হবে না।
এবার স্বয়ং মিথ্যা অপবাদ কর্মের মধ্যে যেসব শর্ত পাওয়া যেতে হবে সেগুলোর আলোচনায় আসা যাক। একটি অভিযোগকে দু’টি জিনিসের মধ্য থেকে কোন একটি জিনিস মিথ্যা অপবাদে পরিণত করতে পারে। একঃ অভিযোগকারী অভিযুক্তের ওপর এমন ধরনের নারী সঙ্গমের অপবাদ দিয়েছে যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর যিনার শাস্তি ওয়াজিব হবে যাবে। দুইঃ অথবা সে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জারজ সন্তান গণ্য করেছে। কিন্তু উভয় অবস্থায়ই এ অপবাদটি পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হতে হবে। ইশারা-ইঙ্গিত গ্রহণযোগ্য নয়। এর সাহায্যে যিনা বা বংশের নিন্দার অর্থ গ্রহণ করা মিথ্যা অপবাদদাতার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল হয়। যেমন কাউকে ফাসেক, পাপী, ব্যভিচারী বা দুশ্চরিত্র ইত্যাদি বলে দেয়া অথবা কোন মেয়েকে বেশ্যা, কস্বী বা ছিনাল বলা কিংবা কোন সৈয়দকে পাঠান বলে দেয়া— এসব ইশারা হয়। এগুলোর মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীন মিথ্যা অপবাদ প্রমাণ হয় না। অন্যরূপভাবে যেসব শব্দ নিছক গালাগালি হিসেবে ব্যবহার হয়, যেমন হারামি বা হারামজাদা ইত্যাদিকেও সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ গণ্য করা যেতে পারে না। তবে ‘তা’রীয’ (নিজের প্রতি আপত্তিকর বক্তব্য অস্বীকৃতির মাধ্যমে অন্যকে খোঁটা দেয়া) এর ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে এটাও অপবাদ কিনা এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। যেমন কেউ অন্যকে সম্বোধন করে বলে, “হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো আর যিনাকারী নই” অথবা “আমার মা তো আর যিনা করে আমাকে জন্ম দেয়নি।” ইমাম মালেক বলেন, এমন কোন “তা’রীয” “কাযাফ” বা যিনার মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে যা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, প্রতিপক্ষকে যিনাকারী বা জারজ সন্তান গণ্য করাই বক্তার উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় “হদ” বা কাযাফ-এর শাস্তি ওয়াজিব হয়ে যায়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা, তাঁর সাথীগণ এবং ইমাম শাফেঈ, সুফিয়ান সওরী, ইবনে শুব্রুমাহ ও হাসান ইবনে সালেহ বলেন, “তা’রীযে”র ক্ষেত্রে অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ থাকে এবং সন্দেহ সহকারে কাযাফের শাস্তি জারি হতে পারে না। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ্ বলেন, যদি ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে “তা’রীয” করা হয়, তাহলে তা হবে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আর হাসি-ঠাট্টার মধ্যে করা হলে তা ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ হবে না। খলীফাগণের মধ্যে হযরত উমর রা., হযরত আলী রা. তা’রীযের জন্য কাযাফ-এর শাস্তি দেন। হযরত উমরের আমলে দু’জন লোকের মধ্যে গালিগালাজ হয়। একজন অন্য জনকে বলে, “আমার বাবাও যিনাকারী ছিল না, আমার মাও যিনাকারীনী ছিল না।” মামলাটি হযরত উমরের দরবারে পেশ হয়। তিনি উপস্থিত লোকদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা এ থেকে কি মনে করেন? কয়েকজন বলে, “সে নিজের বাবা-মার প্রশংসা করেছে। দ্বিতীয় ব্যক্তির বাবা-মা’র উপর আক্রমণ করেনি।” আবার অন্য কয়েকজন বলে, “তার নিজের বাবা-মা’র প্রশংসা করার জন্য কি শুধু এ শব্দগুলোই রয়ে গিয়েছিল? এ বিশেষ শব্দগুলোকে এ সময় ব্যবহার করার পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, দ্বিতীয় ব্যক্তির বাবা-মা ব্যভিচারী ছিল।” হযরত উমর রা. দ্বিতীয় দলটির সাথে একমত হন এবং ‘হদ’ জারি করেন। (জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা) কারোর প্রতি সমকামিতার অপবাদ দেয়া ব্যভিচারের অপবাদ কিনা এ ব্যাপারেও মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈ একে ব্যভিচারের অপবাদ গণ্য করেন এবং ‘হদ’ জারি করার হুকুম দেন।
পাঁচঃ ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ সরাসরি সরকারী হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ (Cognizable Offence) কিনা এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে আবী লাইলা বলেন, এটি হচ্ছে আল্লাহর হক। কাজেই যার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে সে দাবী করুক বা নাই করুক মিথ্যা অপবাদদাতার বিরুদ্ধে কাযাফ-এর শাস্তি জারি করা ওয়াজিব। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলা চালানো, যার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে, তার দাবীর ওপর নির্ভর করে এবং এদিক দিয়ে এটি ব্যক্তির হক। ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আওযাঈও এ একই মত পোষণ করেছেন। ইমাম মালেকের মতে যদি শাসকের সামনে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তা হবে সরকারী হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ অন্যথায় এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়েছে তার দাবীর ওপর নির্ভরশীল।
ছয়ঃ ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেবার অপরাধ, আপোসে মিটিয়ে ফেলার মতো অপরাধ (Compoundable Offence) নয়। অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির আদালতে মামলা দায়ের না করাটা ভিন্ন ব্যাপার কিন্তু আদালতে বিষয়টি উত্থাপিত হবার পর অপবাদ দানকারীকে তার অপবাদ প্রমাণ করতে বাধ্য করা হবে। আর প্রমাণ করতে না পারলে তার ওপর ‘হদ’ জারি করা হবে। আদালত তাকে মাফ করতে পারে না, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তিও পারে না এবং কোন প্রকার অর্থদণ্ড দিয়েও ব্যাপারটির নিষ্পত্তি করা যেতে পারে না। তাওবা করে মাফ চেয়েও সে শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারে না। নবী সা. এর এ উক্তি আগেই আলোচিত হয়েছেঃ
تَعَافَوُا الْحُدُودَ فِيمَا بَيْنَكُمْ فَمَا بَلَغَنِى مِنْ حَدٍّ فَقَدْ وَجَبَ
“অপরাধকে আপোসে মিটিয়ে দাও কিন্তু যে অপরাধের নালিশ আমার কাছে চলে এসেছে, সেটা ওয়াজিব হয়ে গেছে।”
সাতঃ হানাফীদের মতে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দাবী করতে পারে অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি নিজেই অথবা যখন দাবী করার জন্য অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি নিজে উপস্থিত নেই এমন অবস্থায় যার বংশের মর্যাদাহানি হয় সেও দাবী করতে পারে। যেমন বাবা, মা, ছেলেমেয়ে এবং ছেলেমেয়ের ছেলেমেয়েরা এ দাবী করতে পারে। কিন্তু ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈর মতে এ অধিকার উত্তরাধিকার সূত্রে লাভযোগ্য। অপবাদ আরোপিত ব্যক্তি মারা গেলে তার প্রত্যেক শরয়ী উত্তরাধিকার হদ্ জারি করার দাবী জানাতে পারে। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, ইমাম শাফেঈ স্ত্রী ও স্বামীকে এর বাইরে গণ্য করছেন। এ ব্যাপারে তাঁর যুক্তি হচ্ছে, মৃত্যুর সাথে সাথেই দাম্পত্য সম্পর্ক খতম হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় স্বামী বা স্ত্রী কোন এক জনের বিরুদ্ধে অপবাদ দিলে অন্যের বংশের কোন মর্যাদাহানি হয় না। অথচ এ দু’টি যুক্তিই দুর্বল। কারণ শাস্তি দাবী করাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অধিকার বলে মেনে নেবার পর মৃত্যু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক খতম করে দিয়েছে বলে স্বামী ও স্ত্রী এ অধিকারটি লাভ করবে না একথা বলা স্বয়ং কুরআনের বক্তব্য বিরোধী। কারণ কুরআন এক জনের মরে যাওযার পর অন্যজনকে উত্তরাধিকারী গণ্য করেছে। আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্য থেকে কোন একজনের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হলে অন্য জনের বংশের কোন মর্যাদাহানি হয় না একথাটি স্বামীর ব্যাপারে সঠিক হলেও হতে পারে কিন্তু স্ত্রীর ব্যাপারে একদম সঠিক নয়। কারণ যার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় তার তো সমস্ত সন্তান-সন্ততির বংশধারাও সন্দেহযুক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া শুধুমাত্র বংশের মর্যাদাহানির কারণে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদের শাস্তি ওয়াজিব গণ্য করা হয়েছে, এ চিন্তাও সঠিক নয়। বংশের সাথে সাথে মান-সম্মান-ইজ্জত-আব্রুর বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন পুরুষ ও নারীর জন্য তার স্বামী বা স্ত্রীকে ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিণী গণ্য করা কম মর্যাদাহানিকর নয়। কাজেই ব্যভিচারের মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার দাবী যদি উত্তরাধিকারিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে তাহলে স্বামী-স্ত্রীকে তা থেকে আলাদা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
আটঃ কোন ব্যক্তি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে একথা প্রমাণ হয়ে যাবার পর কেবলমাত্র নিম্নলিখিত জিনিসটিই তাকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারে। তাকে এমন চারজন সাক্ষী আনতে হবে যারা আদালতে এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, তারা অপবাদ আরোপিত জনকে অমুক পুরুষ বা মেয়ের সাথে কার্যত যিনা করতে দেখেছে। হানাফীয়াদের মতে এ চারজন সাক্ষীকে একই সঙ্গে আদালতে আসতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের সাক্ষ্য দিতে হবে। কারণ যদি তারা একের পর এক আসে তাহলে তাদের প্রত্যেক মিথ্যা অপবাদদাতা হয়ে যেতে থাকবে এবং তার জন্য আবার চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয়ে পড়বে। কিন্তু এটি একটি দুর্বল কথা। ইমাম শাফেঈ ও উসমানুল বাত্তি এ ব্যাপারে যে কথা বলেছেন সেটিই সঠিক। তারা বলেছেন, সাক্ষীদের একসঙ্গে বা একের পর এক আসার মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায় না। বরং বেশী ভাল হয় যদি অন্যান্য মামালার মতো এ মামলায় সাক্ষীরা একের পর এক আসে এবং সাক্ষ্য দেয়। হানাফীয়াদের মতে এ সাক্ষীদের “আদেল” তথ্য ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া জরুরী নয়। যদি অপবাদদাতা চারজন ফাসেক সাক্ষীও আনে তাহলে সে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি থেকে রেহাই পাবে এবং অপবাদ আরোপিত ব্যক্তিও যিনার শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। কারণ সাক্ষী “আদেল” নয়। তবে কাফের, অন্ধ, গোলাম বা মিথ্যা অপবাদের অপরাধে পূর্বাহ্নে শাস্তিপ্রাপ্ত সাক্ষী পেশ করে অপবাদদাতা শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। কিন্তু ইমাম শাফেঈ বলেন, অপবাদদাতা যদি ফাসেক সাক্ষী পেশ করে, তাহলে সে এবং তার সাক্ষী সবাই শরীয়াতের শাস্তির যোগ্য হবে। ইমাম মালেকও একই রায় পেশ করেন। এ ব্যাপারে হানাফীয়াদের অভিমতই নির্ভুলতার বেশী নিকটবর্তী বলে মনে হয়। সাক্ষী যদি “আদেল” (ন্যায়নিষ্ঠ) হয় অপবাদদাতা অপবাদের অপরাধ মুক্ত হয়ে যাবে এবং অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যিনার অপরাধ প্রমাণিত হবে। কিন্তু সাক্ষী যদি “আদেল” না হয়, তাহলে অপবাদদাতার অপবাদ, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির যিনা ও সাক্ষীদের সত্যবাদিতা ও মিথ্যাচার সবাই সন্দেহযুক্ত হয়ে যাবে এবং সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকেও শরীয়াতের শাস্তির উপযুক্ত গণ্য করা যেতে পারবে না।
নয়ঃ যে ব্যক্তি এমন সাক্ষ্য পেশ করতে সক্ষম হবে না, যা তাকে অপবাদের অপরাধ থেকে মুক্ত করতে পারে তার ব্যাপারে কুরআন তিনটি নির্দেশ দেয়ঃ একঃ তাকে ৮০ ঘা বেত্রাঘাত করতে হবে। দুইঃ তার সাক্ষ্য কখনও গৃহীত হবে না। তিনঃ সে ফাসেক হিসেবে চিহ্নিত হবে। অতঃপর কুরআন বলছেঃ
إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“তারা ছাড়া যারা এরপর তাওবা করে ও সংশোধন করে নেয়, কেননা, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” (আন নূরঃ ৫)
এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, এখানে তাওবা ও সংশোধনের মাধ্যমে যে ক্ষমার কথা বলা হয়েছে তার সম্পর্ক ঐ তিনটি নির্দেশের মধ্য থেকে কোনটির সাথে আছে? প্রথম হুকুমটির সাথে এর সম্পর্ক নেই, এ ব্যাপারে ফকীহগণ একমত। অর্থাৎ তাওবার মাধ্যমে “হদ” তথা শরীয়াতের শাস্তি বাতিল হয়ে যাবে না এবং যে কোন অবস্থায়ই অপরাধীকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হবে। শেষ হুকুমটির সাথে ক্ষমার সম্পর্ক আছে, এ ব্যাপারেও সকল ফকীহ একমত। অর্থাৎ তাওবা করার ও সংশোধিত হবার পর অপরাধী ফাসেক থাকবে না। আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। (এ ব্যাপারে অপরাধী শুধুমাত্র মিথ্যা অপবাদ দেবার কারণেই ফাসেক হয়, না আদালতের ফায়সালা ঘোষিত হবার পর ফাসেক হিসেবে গণ্য হয়, সে ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফেঈ ও লাইস ইবনে সাদের মতে, মিথ্যা অপবাদ দেবার কারণেই ফাসেক হয়। এ কারণে তাঁরা সে সময় থেকেই তাকে প্রত্যাখ্যাত সাক্ষী গণ্য করেন। বিপরীতপক্ষে ইমাম আবু হানীফা, তাঁর সহযোগীগণ ও ইমাম মালেক বলেন, আদালতের ফায়সালা জারি হবার পর সে ফাসেক হয়। তাই তাঁরা হুকুম জারি হবার পূব পর্যন্ত তাকে গ্রহণযোগ্য সাক্ষী মনে করেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, অপরাধীর আল্লাহর কাছে ফাসেক হওয়ার ব্যাপারটি মিথ্যা অপবাদ দেবার ফল এবং তার মানুষের কাছে ফাসেক হওয়ার বিষয়টি আদালতে তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া এবং তার শাস্তি পাওয়ার ওপর নির্ভর করে।) এখন থেকে যায় মাঝখানের হুকুমটি অর্থাৎ “মিথ্যা অপবাদদাতার সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করা হবে না।” إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا বাক্যাংশটির সম্পর্ক এ হুকুমটির সাথে আছে কিনা এ ব্যাপারে ফকীহগণের অভিমত ব্যাপকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল বলেন, কেবলমাত্র শেষ হুকুমটির সাথে এ বাক্যাংশটির সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাওবা ও সংশোধন করে নেবে সে আল্লাহর সমীপে এবং মানুষের কাছেও ফাসেক থাকবে না। কিন্তু এ সত্ত্বে প্রথম দু’টি হকুম অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ অপরাধীর বিরুদ্ধে শরীয়াতের শাস্তি জারি করা হবে এবং তার সাক্ষ্যও চিরকাল প্রত্যাখ্যাত থাকবে। এ দলের রয়েছেন কাযী শুরাইহ, সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব, সাঈদ ইবনে জুবাইর, হাসান বসরী, ইব্রাহীম নাখঈ’, ইবনে সিরীন, মাকহুল, আবদুর রাহমান ইবনে যায়েদ, আবু হানীফা, আবু ইউসুফ, যুফার, মুহাম্মাদ, সুফ্ইয়ান সওরী ও হাসান ইবনে সালেহর মতো শীর্ষ স্থানীয় ফকীহগণ। দ্বিতীয় দলটি বলেন, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا এর সম্পর্ক প্রথম হুকুমটির সাথে তো নেই-ই তবে শেষের দু’টো হুকুমের সাথে আছে অর্থাৎ তাওবার পর মিথ্যা অপবাদে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে এবং সে ফাসেক হিসেবেও গণ্য হবে না। এ দলে রয়েছেন আতা, তাউস, মুজাহিদ, শা’বী, কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ, সালেম, যুহরী, ইকরামাহ, উমর ইবনুল আযীয, ইবনে আবী নুজাইহ, সুলাইমান ইবনে ইয়াসার, মাসরূক, দ্বাহ্হাক, মালেক ইবনে আনাস, উসমান আলবাত্তী, লাইস ইবনে সা’দ, শাফেঈ, আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইবনে জারীর তাবারীর মতো শ্রেষ্ঠ ফকীহবৃন্দ। এরা নিজেদের মতের সমর্থনে অন্যান্য যুক্তি-প্রমাণের সাথে সাথে হযরত উমর রা., মুগীরাহ ইবনে শু’বার মামলায় যে ফায়সালা দিয়েছিলেন সেটিও পেশ করে থাকেন। কারণ তার কোন কোন বর্ণনায় একথা বলা হয়েছে যে, ‘হদ’ জারি করার পর হযরত উমর রা., আবু বাক্রাহ ও তার দুই সাথীকে বলেন, যদি তোমরা তওবা করে নাও (অথবা “নিজেদের মিথ্যাচারিতা স্বীকার করে নাও”) তাহলে আমি আগামীতে তোমাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে নেবো অন্যথায় তা গ্রহণ করা হবে না। সাথী দু’জন স্বীকার করে নেয় কিন্তু আবু বাক্রাহ নিজের কথায় অনড় থাকেন। বাহ্যত এটি একটি বড় শক্তিশালী সমর্থন মনে হয়। কিন্তু মুগীরাহ ইবনে শু’বার মামলার যে বিস্তারিত বিবরণী আমি পূবেই পেশ করেছি সে সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার প্রকাশ হয়ে যাবে যে, এ নজিরের ভিত্তিতে এ বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শন করা সঠিক নয়। সেখানে মূল কাজটি ছিল সর্ববাদী সম্মত এবং স্বয়ং মুগীরাহ ইবনে শু’বাও এটি অস্বীকার করেননি। মেয়েটি কে ছিল, এ নিয়ে ছিল বিরোধ। মুগীরাহ রা. বলছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁর স্ত্রী, যাকে এরা উম্মে জামীল মনে করেছিলেন। এ সঙ্গে একথাও প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে, হযরত মুগীরার স্ত্রী ও উম্মে জামীলের চেহারায় এতটা সাদৃশ্য ছিল যে, ঘটনাটি যে পরিমাণ আলোয় যতটা দূর থেকে দেখা গেছে তাতে মেয়েটিকে উম্মে জামীল মনে করার মতো ভুল ধারণা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আন্দাজ-অনুমান সবকিছু ছিল মুগীরার পক্ষে এবং বাদীপক্ষের একজন সাক্ষীও একথা স্বীকার করেছিলেন যে, মেয়েটিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। এ কারণে হযরত উমর রা., মুগীরাহ ইবনে শু’বার পক্ষে রায় দেন এবং ওপরে উল্লেখিত হাদীসে যে কথাগুলো উদ্ধৃত হয়েছে আবু বাক্রাহকে শাস্তি দেবার পর সেগুলো বলেন। এসব অবস্থা পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, হযরত উমরের উদ্দেশ্য ছিল আসলে একথা বুঝানো যে, তোমরা অযথা একটি কুধারণা পোষণ করেছিলে, একথা মেনে নাও এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এ ধরনের কুধারণার ভিত্তিতে লোকদের বিরুদ্ধে অপবাদ না দেবার ওয়াদা করো। অন্যথায় ভবিষ্যতে তোমাদের সাক্ষ্য কখনো গৃহীত হবে না। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে না যে, সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী প্রমাণিত ব্যক্তিও যদি তাওবা করে তাহলে এরপর হযরত উমরের মতে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। আসলে এ বিষয়ে প্রথম দলটির মতই বেশী শক্তিশালী মনে হয়। মানুষের তাওবার অবস্থা আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আমাদের সামনে যে ব্যক্তি তাওবা করবে আমরা তাকে বড় জোর ফাসেক বলবো না। এতটুকু সুবিধা তাকে আমরা দিতে পারি। কিন্তু যার মুখের কথার উপর আস্থা একবার খতম হয়ে গেছে সে কেবলমাত্র আমাদের সামনে তাওবা করছে বলে তার মুখের কথাকে আবার দাম দিতে থাকবো, এত বেশী সুবিধা তাকে দেয়া যেতে পারে না। এছাড়া কুরআনের আয়াতের বর্ণনাভঙ্গীও একথাই বলছে— إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا “তবে যারা তাওবা করেছে” এর সম্পর্ক শুধুমাত্র أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ “তারাই ফাসেক” এর সাথেই রয়েছে। তাই এ বাক্যের মধ্যে প্রথম দু’টি কথা বলা হয়েছে কেবলমাত্র নির্দেশমূলক শব্দের মাধ্যমে। অর্থাৎ “তাদেরকে আশি ঘা বেত্রাঘাত করো।” “এবং তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করো না।” আর তৃতীয় কথাটি বলা হয়েছে খবর পরিবেশন করার ভঙ্গীতে। অর্থাৎ “তারা নিজেরাই ফাসেক”। এ তৃতীয় কথাটির পরে সাথে সাথেই, “তারা ছাড়া যারা তাওবা করে নিয়েছে” একথা বলা প্রকাশ করে দেয় যে, এ ব্যতিক্রমের ব্যাপারটি শেষের খবর পরিবেশন সংক্রান্ত বাক্যাংশটির সাথে সম্পর্কিত। পূর্বের দু’টি নির্দেশমূলক বাক্যাংশের সাথে এর সম্পর্ক নেই। তবুও যদি এ কথা মেনে নেয়া হয় যে, এ ব্যতিক্রমের ব্যাপারটি শেষ বাক্যাংশ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, তাহলে এরপর বুঝে আসে না তা “সাক্ষ্য গ্রহণ করো না” বাক্যাংশ পর্যন্ত এসে থেমে গেল কেন, “আশি ঘা বেত্রাঘাত করো” বাক্যাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল না কেন?
দশঃ প্রশ্ন করা যেতে পারে, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا এর মাধ্যমে ব্যতিক্রম করাটাকে প্রথম হুকুমটির সাথে সম্পর্কিত বলে মেনে নেয়া যায় না কেন? মিথ্যা অপবাদ তো আসলে এক ধরনের মানহানিই। এরপর এক ব্যক্তি নিজের দোষ মেনে নিয়েছে, অপবাদ আরোপিত ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজ করবে না বলে তাওবা করেছে। তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে না কেন? অথচ আল্লাহ নিজেই হুকুম বর্ণনা করার পর বলছেন, إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا….. فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ আল্লাহ মাফ করে দেবেন কিন্তু বান্দা মাফ করবে না, এটাতো সত্যই বড় অদ্ভূত ব্যাপার হবে। এর জবাব হচ্ছেঃ তাওবা আসলে ت-و-ب-ه সমন্বিত চার অক্ষরের একটি শব্দ মাত্র নয়। বরং হৃদয়ের লজ্জানুভূতি, সংশোধনের দৃঢ়-সংকল্প ও সততার দিকে ফিরে যাওয়ার নাম। এর এ জিনিসটির অবস্থা আর কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই তাওবার কারণে পার্থিব শাস্তি মাফ হয় না। বরং শুধুমাত্র পরকালীন শাস্তি মাফ হয়। এ কারণে আল্লাহ বলেননি, যদি তারা তাওবা করে নেয় তাহলে তোমরা তাদেরকে ছেড়ে দাও বরং বলেছেন, যারা তাওবা করে নেবে আমি তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও করুণাময়। যদি তাওবার সাহায্যে পার্থিব শাস্তি মাফ হয়ে যেতে থাকে, তাহলে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তাওবা করবে না এমন অপরাধী কে আছে?
এগারঃ এ প্রশ্নও করা যেতে পারে, এক ব্যক্তির নিজের অভিযোগের স্বপক্ষে সাক্ষী পেশ করতে না পারার মানে তো এ নয় যে, সে মিথ্যুক। এটা কি সম্ভব নয় যে, তার অভিযোগ যথার্থই সঠিক কিন্তু সে এর স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি? তাহলে শুধুমাত্র প্রমাণ পেশ করতে না পারার কারণে তাকে কেবল মানুষের সামনেই নয়, আল্লাহর সামনেও ফাসেক গণ্য করা হবে, এর কারণ কি? এর জবাব হচ্ছে, এক ব্যক্তি নিজের চোখেও যদি কাউকে ব্যভিচার করতে দেখে তাহলেও সে তা নিয়ে আলোচনা করলে এবং সাক্ষী ছাড়া তার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করতে থাকলে গোনাহগার হবে। এক ব্যক্তি যদি কোন ময়লা আবর্জনা নিয়ে এক কোণে বসে থাকে তাহলে অন্য ব্যক্তি উঠে সমগ্র সমাজ দেহে তা ছড়িয়ে বেড়াক আল্লাহর শরীয়াত এটা চায় না। সে যদি এ ময়লা-আবর্জনার খবর জেনে থাকে তাহলে তার জন্য দু’টি পথ থাকে। যেখানে তা পড়ে আছে সেখানে তাকে পড়ে থাকতে দেবে অথবা তার উপস্থিতির প্রমাণ পেশ করবে, যাতে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকগণ তা পরিষ্কার করে ফেলতে পারেন। এ দু’টি পথ ছাড়া তৃতীয় কোন পথ তার জন্য নেই। যদি সে জনগণের মধ্যে এর আলোচনা শুরু করে দেয় তাহলে এক জায়গায় আটকে থাকা আবর্জনাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবার অপরাধে অভিযুক্ত হবে। আর যদি সে যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষ্য ছাড়াই বিষয়টি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে নিয়ে যায় তাহলে শাসকগণ তা পরিষ্কার করতে পারবেন না। ফলে এ মামলায় ব্যর্থতা আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ার কারণও হবে এবং ব্যভিচারীদের মনে তা সাহসের সঞ্চারও করবে। এজন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া মিথ্যা অভিযোগকারী বাস্তবে যতই সত্যবাদী হোক না কেন সে একজন ফাসেকই।
বারঃ মিথ্যা অপবাদের ‘হদে’র ব্যাপারে হানাফী ফকীহগণের অভিমত হচ্ছে অপবাদদাতাকে যিনাকারীর তুলনায় হাল্কা মার মারতে হবে। অর্থাৎ ৮০ ঘা বেতই মারা হবে কিন্তু যিনাকারীকে যেমন কঠোরভাবে প্রহার করা হয় তাকে ঠিক ততটা কঠোরভাবে প্রহার করা হবে না। কারণ যে অভিযোগের দরুন তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে তার মিথ্যাবাদী হওয়াটা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
তেরঃ মিথ্যা অপবাদের পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে হানাফী ও অধিকাংশ ফকীহের অভিমত হচ্ছে এই যে, অপবাদদাতা শাস্তি পাবার আগে বা মাঝখানে যতবারই এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করুক না কেন ‘হদ’ তার ওপর একবারই জারি হবে। আর যদি হদ জারি করার পর সে নিজের পূর্ববর্তী অপরাধেরই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে তাহলে যে ‘হদ’ তার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে তা-ই যথেষ্ট হবে। তবে যদি হদ জারি করার পর সে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নতুন কোন যিনার অপবাদ দেয় তাহলে আবার নতুন করে মামলা দায়ের করা হবে। মুগীরাহ ইবনে শু’বার রা. মামলায় শাস্তির পাবার পর আবু বাক্রাহ প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুগীরাহ যিনা করেছিল।’’ হযরত উমর রা. আবার তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সংকল্প করেন। কিন্তু যেহেতু তিনি আগের অপবাদেরই পুনরাবৃত্তি করছিলেন, তাই হযরত আলী রা. তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলা চালানো যেতে পারে না বলে রায় দেন। হযরত উমর তাঁর রায় গ্রহণ করেন। এরপর ফকীহগণ ঐকমত্যে পৌঁছেন যে, শাস্তিপ্রাপ্ত মিথ্যা অপবাদদাতাকে কেবলমাত্র নতুন অপবাদেই পাকড়াও করা যেতে পারে, আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তিতে নয়।
চৌদ্দঃ কোন দল বা গোষ্ঠীর ওপর মিথ্যা অপবাদের ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হানাফীরা বলেন, যদি এক ব্যক্তি বহু লোকের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়, যদিও তা একটি শব্দে বা আলাদা আলাদা শব্দে হয়, তাহলেও তার ওপর একটি ‘হদ’ জারি করা হবে। তবে যদি ‘হদ’ জারির পর সে আবার কোন নতুন মিথ্যা অপবাদের অবতারণা করে তাহলে সে জন্য পৃথক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কারণ আয়াতের শব্দের মধ্যে বলা হয়েছেঃ ‘‘যারা সতী সাধ্বী মেয়েদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়।” এ কথা থেকে জানা যায়, এক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই নয়, একটি দলের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপকারীও শুধুমাত্র একটি ‘হদের’ হকদার হয়। এ ব্যাপারে আরো একটি যুক্তি এই যে, যিনার এমন কোন অপবাদই হতে পারে না যা কমপক্ষে দু’ব্যক্তির ওপর আরোপিত হয় না। কিন্তু এ সত্ত্বেও শরীয়াত প্রবর্তক একটি ‘হদেরই হুকুম দিয়েছেন। নারীর বিরুদ্ধে অপবাদের জন্য আলাদা এবং পুরুষের বিরুদ্ধে অপবাদের জন্য আলাদা ‘হদ’ জারি করার হকুম দেননি। এর বিপরীতে ইমাম শাফেঈ বলেন, একটি দলের বিরুদ্ধে অপবাদ দানকারী এক শব্দে বা আলাদা আলাদা শব্দে অপবাদ দান করুক না কেন, সে জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির বাবদ এক একটি পূর্ণ ‘হদ’ জারি করা হবে। উসমান আলবাত্তীও এ অভিমত প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে ইবনে আবীলাইলার উক্তি, শা’বী ও আওযাঈও যার সাথে অভিন্ন মত পোষণ করেন তা হচ্ছে এই যে, একটি বিবৃতির মাধ্যমে পুরো দলের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ আরোপকারী একটি হদের হকদার হবে এবং আলাদা আলাদা বিবৃতির মাধ্যমে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ আরোপকারী প্রত্যেকটি অপবাদের জন্য আলাদা আলাদা হদের অধিকারী হবে।
﴿وَالَّذِينَ يَرْمُونَ أَزْوَاجَهُمْ وَلَمْ يَكُن لَّهُمْ شُهَدَاءُ إِلَّا أَنفُسُهُمْ فَشَهَادَةُ أَحَدِهِمْ أَرْبَعُ شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ ۙ إِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ﴾
৬। আর যারা নিজেদের স্ত্রীদেরকে অভিযোগ দেয় এবং তাদের কাছে তারা নিজেরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন সাক্ষী থাকে না, তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির সাক্ষ্য হচ্ছে (এই যে, সে) চার বার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে সাক্ষ্য দেবে যে, সে (নিজের অভিযোগে) সত্যবাদী
﴿وَالْخَامِسَةُ أَنَّ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَيْهِ إِن كَانَ مِنَ الْكَاذِبِينَ﴾
৭। এবং পঞ্চম বার বলবে, তার প্রতি আল্লাহর লা’নত হোক যদি সে (নিজের অভিযোগে) মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে।
﴿وَيَدْرَأُ عَنْهَا الْعَذَابَ أَن تَشْهَدَ أَرْبَعَ شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ ۙ إِنَّهُ لَمِنَ الْكَاذِبِينَ﴾
৮। আর স্ত্রীর শাস্তি এভাবে রহিত হতে পারে যদি সে চার বার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে সাক্ষ্য দেয় যে, এ ব্যক্তি(তার অভিযোগে) মিথ্যাবাদী
﴿وَالْخَامِسَةَ أَنَّ غَضَبَ اللَّهِ عَلَيْهَا إِن كَانَ مِنَ الصَّادِقِينَ﴾
৯। এবং পঞ্চমবার বলে, তার নিজের ওপর আল্লাহর গযব নেমে আসুক যদি এ ব্যক্তি (তার অভিযোগে) সত্যবাদী হয়।৭
৭. এ আয়াত পেছনের আয়াতের কিছুকাল পরে নাযিল হয়। মিথ্যা অপবাদের বিধান যখন নাযিল হয় তখন লোকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়, ভিন পুরুষ ও নারীর চরিত্রহীনতা দেখে তো মানুষ সবর করতে পারে, সাক্ষী না থাকলে ঠোঁটে তালা লাগাতে পারে এবং ঘটনাটি উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু নিজের স্ত্রীর চরিত্রহীনতা দেখলে কি করবে? হত্যা করলে তো উল্টো শাস্তি লাভের যোগ্য হয়ে যাবে। সাক্ষী খুঁজতে গেলে তাদের আসা পর্যন্ত অপরাধী সেখানে অপেক্ষা করতে যাবে কেন? আর সবর করলে তা করবেই বা কেমন করে। তালাক দিয়ে স্ত্রীকে বিদায় করে দিতে পারে। কিন্তু এর ফলে না মেয়েটির কোন বস্তুগত বা নৈতিক শাস্তি হলো, না তার প্রেমিকের। আর যদি তার অবৈধ গর্ভসঞ্চার হয়, তাহলে অন্যের সন্তান নিজের গলায় ঝুললো। এ প্রশ্নটি প্রথমে হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ একটি কাল্পনিক প্রশ্নের আকারে পেশ করেন। তিনি এতদূর বলে দেন, আমি যদি আল্লাহ না করুন নিজের ঘরে এ অবস্থা দেখি, তাহলে সাক্ষীর সন্ধানে যাবো না বরং তলোয়ারের মাধ্যমে তখনই এর হেস্তনেস্ত করে ফেলবো। (বুখারী ও মুসলিম) কিন্তু মাত্র কিছুদিন পরেই এমন কিছু মামলা দায়ের হলো যেখানে স্বামীরা স্বচক্ষেই এ ব্যাপার দেখলো এবং নবী সা. এর কাছে এর অভিযোগ নিয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ ও ইবনে উমরের রেওয়ায়াত অনুযায়ী আনসারদের এক ব্যক্তি (সম্ভবত উওয়াইমির আজ্লানী) রাসূলের সামনে হাযির হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর সাথে পরপুরুষকে পায় এবং সে মুখ থেকে সে কথা বের করে ফেলে, তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের “হদ” জারি করবেন, হত্যা করলে আপনি তাকে হত্যা করবেন, নীরব থাকলে সে চাপা ক্রোধে ফুঁসতে থাকবে। শেষমেশ সে করবে কি? এ কথায় রাসূলুল্লাহ সা. দোয়া করেনঃ হে আল্লাহ! এ বিষয়টির ফায়সালা করে দাও। (মুসলিম, বুখারী, আবু দাউদ, আহমাদ ও নাসাঈ) ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, হেলাল ইবনে উমাইয়াহ এসে নিজের স্ত্রীর ব্যাপারটি পেশ করেন। তিনি তাকে নিজের চোখে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকতে দেখেছিলেন। নবী সা. বলেন, “প্রমাণ আনো, অন্যথায় তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি জারি হবে।” এতে সাহাবীদের মধ্যে সাধারণভাবে পেরেশানী সৃষ্টি হয়ে যায় এবং হেলাল বলেন, সেই আল্লাহর কসম যিনি আপনাকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন, আমি একদম সঠিক ঘটনাই তুলে ধরছি, আমার চোখ এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এবং কান শুনেছে। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমার ব্যাপারে এমন হুকুম নাযিল করবেন যা আমার পিঠ বাঁচাবে। এ ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয়। (বুখারী, আহমাদ ও আবুদ দাউদ) এখানে মীমাংসার যে পদ্ধতি দেয়া হয়েছে তাকে ইসলাম আইনের পরিভাষায় “লিআ’ন” বলা হয়।
এ হুকুম এসে যাবার পর নবী সা. যেসব মামলার ফায়সালা দেন সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের কিতাবগুলোতে লিখিত আকারে সংরক্ষিত রয়েছে এবং সেগুলোই লিআ’ন সংক্রান্ত বিস্তারিত আইনগত কার্যধারার উৎস।
হেলাল ইবনে উমাইয়ার মামলার যে বিস্তারিত বিবরণ সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদ এবং তাফসীরে ইবনে জারিরে ইবনে আব্বাস রা. ও আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছেঃ এ আয়াত নাযিল হবার পর হেলাল ও তার স্ত্রী দু’জনকে নবীর আদালতে হাযির করা হয়। রাসূলুল্লাহ সা. প্রথমে আল্লাহর হুকুম শুনান। তারপর বলেন, “খুব ভালভাবে বুঝে নাও, আখেরাতের শাস্তি দুনিয়ার শাস্তির চাইতে কঠিন।” হেলাল বলেন, “আমি এর বিরুদ্ধে একদম সত্য অভিযোগ দিয়েছি।” স্ত্রী বলে, “এ সম্পূর্ণ মিথ্যা।” রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “বেশ, তাহলে এদের দু’জনের মধ্যে লিআ’ন করানো হোক।” তদনুসারে প্রথমে হেলাল উঠে দাঁড়ায়। তিনি কুরআনী নির্দেশ অনুযায়ী কসম খাওয়া শুরু করেন। এ সময় নবী সা. বারবার বলতে থাকেন, “আল্লাহ্ জানেন তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একজন মিথ্যেবাদী। তারপর কি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাওবা করবে?” পঞ্চম কসমের পূর্বে উপস্থিত লোকেরা হেলালকে বললো, “আল্লাহকে ভয় করো। দুনিয়ার শাস্তি পরকালের শাস্তির চেয়ে হালকা। এ পঞ্চম কসম তোমার ওপর শাস্তি ওয়াজিব করে দেবে।” কিন্তু হেলাল বলেন, যে আল্লাহ এখানে আমার পিঠ বাঁচিয়েছেন তিনি পরকালেও আমাকে শাস্তি দেবেন না। একথা বলে তিনি পঞ্চম কসমও খান। তারপর তার স্ত্রী ওঠে। সেও কসম খেতে শুরু করে। পঞ্চম কসমের পূর্বে তাকেও থামিয়ে বলা হয়, “আল্লাহকে ভয় করো, আখেরাতের আযাবের তুলনায় দুনিয়ার আযাব বরদাশত করে নেয়া সহজ। এ শেষ কসমটি তোমার ওপর আল্লাহর আযাব ওয়াজিব করে দেবে।” একথা শুনে সে কিছুক্ষণ থেমে যায় এবং ইতস্তত করতে থাকে। লোকেরা মনে করে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে চাচ্ছে। কিন্তু তারপর সে বলতে থাকে। “আমি চিরকালের জন্য নিজের গোত্রকে লাঞ্ছিত করবো না।” তারপর সে পঞ্চম কসমটিও খায়। অতঃপর নবী সা. তাদের উভয়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা দেন, এর সন্তান (যে তখন মাতৃগর্ভে ছিল) মায়ের সাথে সম্পর্কিত হবে। বাপের সাথে সম্পর্কিত করে তার নাম ডাকা হবে না। তার বা তার সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবার অধিকার কারোর থাকবে না। যে ব্যক্তি তার বা তার সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবে সে মিথ্যা অপবাদের (কাযাফ) শাস্তির অধিকারী হবে। ইদ্দতকালে তার খোরপোশ ও বাসস্থান লাভের কোন অধিকার হেলালের ওপর বর্তায় না। কারণ তাকে তালাক বা মৃত্যু ছাড়াই স্বামী থেকে আলাদা করা হচ্ছে। তারপর তিনি লোকদের বলেন, তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখো সে কার মতো হয়েছে। যদি এ আকৃতির হয় তাহলে হেলালের হবে। আর যদি ঐ আকৃতির হয়, তাহলে যে ব্যক্তির সাথে মিলিয়ে একে অপবাদ দেয়া হয়েছে এ তার হবে। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখা গেলো সে শেষোক্ত ব্যক্তির আকৃতি পেয়েছে। এ অবস্থায় নবী সা. বলেন, لو لا الايمان অর্থাৎ যদি কসমসমূহ না হতো (অথবা বর্ণনান্তরে لَكَانَ لِى وَلَهَا شَأْنٌ (لَوْلاَ مَا مَضَى مِنْ كِتَابِ اللَّهِ) আল্লাহর কিতাব প্রথমেই ফায়সালা না করে দিতো) তাহলে আমি এ মেয়েটির সাথে কঠোর ব্যবহার করতাম।
‘উওয়াইমির আজলানীর মামলার বিবরণ পাওয়া যায় বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ। সাহল ইবনে সা’দ সা’ঈদী ও ইবনে উমর রা. থেকে এগুলো বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছেঃ উওয়াইমির ও তার স্ত্রী উভয়কে মসজিদে নববীতে ডাকা হয়। তারা নিজেদের ওপর ‘লিআ’ন’ করার আগে রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকেও সতর্ক করে দিয়ে তিনবার বলেন, “আল্লাহ্ খুব ভালভাবেই জানেন তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তাহলে কি তোমাদের কেউ তাওবা করবে?” দু’জনের কেউ যখন তাওবা করলো না তখন তাদের ‘লিআ’ন’ করানো হয়। এরপর ‘উওয়াইমির বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি এ স্ত্রীকে রেখে দেই তাহলে মিথ্যুক হবো।” একথা বলেই রাসূলুল্লাহ সা. তাকে হুকুম দেয়া ছাড়াই তিনি তিন তালাক দিয়ে দেন। সাহল ইবনে সা’দ বলেন, “রাসূলুল্লাহ সা. এ তালাক জারি করেন, তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং বলেন, “যে দম্পতি লিআ’ন করবে তাদের জন্য এ ছাড়াছাড়ি।” লিআ’নকারী স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করে দেবার এ সুন্নত কায়েম হয়ে যায়। এরপর তারা আর কখনো একত্র হতে পারবে না। সাহল ইবনে সা’দ একথাও বর্ণনা করেন যে, স্ত্রী গর্ভবতী ছিল এবং ‘উওয়াইমির বলেন, এ গর্ভ আমার ঔরসজাত নয়। এজন্য শিশুকে মায়ের সাথে সম্পর্কিত করা হয় এবং এ সুন্নত জারি হয় যে, এ ধরনের সন্তান মায়ের উত্তরাধিকারী হবে এবং মা তার উত্তরাধিকারী হবে।
এ দু’টি মামলা ছাড়া হাদীসের কিতাবগুলোতে আমরা এমন বহু রেওয়ায়াত পাই যেগুলো থেকে এ মামলাগুলো কাদের সাথে জড়িত ছিল তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। হতে পারে সেগুলোর কোন কোনটি এ দু’টি মামলার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু কয়েকটিতে অন্য কিছু মামলার কথা বলা হয়েছে এবং সেগুলো থেকে লিআ’ন আইনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত হয়।
ইবনে উমর একটি মামলার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রী লিআ’ন শেষ করার পর নবী সা. তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন। (বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আহমাদ ও ইবনে জারীর) ইবনে উমরের অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর মধ্যে লিআ’ন করানো হয়। তারপর স্বামীটি গর্ভের সন্তান অস্বীকার করে। নবী সা. তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা শুনিয়ে দেন, সন্তান হবে শুধুমাত্র মায়ের। (সিহাহে সিত্তা ও আহমাদ) ইবনে উমরেরই আর একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, উভয়ের লিআ’ন করার পরে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “তোমাদের হিসাব এখন আল্লাহর জিম্মায়। তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যুক।” তারপর তিনি পুরুষটিকে বলেন, لَا سَبِيلَ لَكَ عَلَيْهَا (অর্থ এখন এ আর তোমার নয়। তুমি এর ওপর নিজের কোন অধিকার দেখাতে পারো না। এর ওপর কোনরকম হস্তক্ষেপও করতে পারো না। অথবা এর বিরুদ্ধে অন্য কোন প্রকার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকারও আর তোমার নেই)। পুরুষটি বলে হে আল্লাহর রাসূল! আর আমার সম্পদ? (অর্থাৎ যে মোহরানা আমি তাকে দিয়েছিলাম তা আমাকে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করুন)। রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ
لاَ مَالَ لَكَ ، إِنْ كُنْتَ صَدَقْتَ عَلَيْهَا ، فَهْوَ بِمَا اسْتَحْلَلْتَ مِنْ فَرْجِهَا ، وَإِنْ كُنْتَ كَذَبْتَ عَلَيْهَا ، فَذَاكَ أَبْعَدُ وأَبْعَدُ لَكَ منها
“সম্পদ ফেরত নেবার কোন অধিকার তোমার নেই। যদি তুমি তার ওপর সত্য অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে ঐ সম্পদ সে আনন্দ উপভোগের প্রতিদান যা তুমি হালাল করে তার থেকে লাভ করেছো। আর যদি তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকো। তাহলে সম্পদ তোমার কাছ থেকে আরো অনেক দূরে চলে গেছে। তার তুলনায় তোমার কাছ থেকে তা বেশী দূরে রয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ)।
দারুকুত্নী আলী ইবনে আবু তালেব ও ইবনে মাসউ’দ রা. এর উক্তি উদ্ধৃত করেছে। তাতে বলা হয়েছেঃ “সুন্নাত এটিই নির্ধারিত হয়েছে যে, লিআ’নকারী স্বামী-স্ত্রী পরবর্তী পর্যায়ে আর কখনো একত্র হতে পারে না।” (অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আর কোনদিন তাদের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না)। আবার এ দারুকত্নী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, নবী সা. বলেন, এরা দু’জন আর কখনো একত্র হতে পারে না।
কাবীসাহ ইবনে যুওয়াইব বর্ণনা করেছেন, হযরত উমরের আমলে এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর গর্ভের সন্তানকে অবৈধ গণ্য করে তারপর আবার তা নিজের বলে স্বীকার করে নেয়। তারপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর বলতে থাকে, এ শিশু আমার নয়। ব্যাপারটি হযরত উমরের আদালতে পেশ হয়। তিনি তার ওপর কাযাফের শাস্তি জারি করেন এবং ফায়সালা দেন, শিশু তার সাথেই সম্পর্কিত হবে। (দারুকুত্নী বাইহাকী)।
ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বলে, আমার একটি স্ত্রী আছে, আমি তাকে ভীষণ ভালবাসি। কিন্তু তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, সে কোন স্পর্শকারীর হাত ঠেলে দেয় না। (উল্লেখ্য, এটি একটি রূপক ছিল। এর অর্থ যিনাও হতে পারে আবার যিনার কম পর্যায়ের নৈতিক দুর্বলতাও হতে পারে।) নবী সা. বলেন, তালাক দিয়ে দাও। সে বলে, আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারি না। জবাব দেন, তুমি তাকে রেখে দাও। (অর্থাৎ তিনি তার কাছ থেকে তার ইঙ্গিতের ব্যাখ্যা নেননি এবং তার উক্তিকে যিনার অপবাদ হিসেবে গণ্য করে লিআ’ন করার হুকুম দেননি।) —নাসাঈ।
আবু হুরাইরা রা. বলেছেন, এক ব্যক্তি হাজির হয়ে বলে, আমার স্ত্রী কালো ছেলে জন্ম দিয়েছে। আমি তাকে আমার সন্তান বলে মনে করি না। (অর্থাৎ নিছক শিশু সন্তানের গায়ের রং তাকে সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। নয়তো তার দৃষ্টিতে স্ত্রীর ওপর যিনার অপবাদ লাগাবার অন্য কোন কারণ ছিল না।) রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করেন, তোমার তো কিছু উট আছে? সে বলে, হ্যাঁ, আছে। জিজ্ঞেস করেন, সেগুলোর রং কি? জবাব দেয় লাল। জিজ্ঞেস করেন, তাদের মধ্যে কোনটা কি খাকি রংয়ের আছে? জবাব দেয়, জি হ্যাঁ, কোন কোনটা এমনও আছে। জিজ্ঞেস করেন, এ রংটি কোথায় থেকে এলো? জবাব দেয়, হয়তো কোন শিরা টেনে নিয়ে গেছে। (অর্থাৎ তাদের বাপ-দাদাদের কেউ এ রংয়ের থেকে থাকবে এবং তার প্রভাব এর মধ্যে এসে গেছে।) তিনি বলেন, “সম্ভবত এ শিশুটিকেও কোন শিরা টেনে নিয়ে গেছে।” তারপর তিনি তাকে সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার অনুমতি দেননি। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ ও আবুদ দাউদ।)
আবু হুরাইরার রা. অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, নবী সা. লিআ’ন সম্পর্কিত আয়াত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, “যে স্ত্রী কোন বংশে এমন সন্তান প্রবেশ করায় যে ঐ বংশের নয় (অর্থাৎ হারামের শিশু গর্ভে ধারণ করে স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়) তার আল্লাহর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তাকে কখ্খনো জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। আর যে পুরুষ নিজের সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে অথচ সন্তান তাকে দেখছে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে পর্দা করবেন এবং পূর্বের ও পরের সমস্ত সৃষ্টির সামনে তাকে লাঞ্ছিত করবেন। (আবু দাউদ, নাসাঈ ও দারেমী।)
লি’আনের আয়াত এবং এ হাদীসগুলো, নজিরসমূহ ও শরীয়াতের সাধারণ মূলনীতিগুলোই হচ্ছে ইসলামের লি’আনের আইনের উৎস। এগুলোর আলোকে ফকীহগণ লি’আনের বিস্তারিত আইন-কানুন তৈরী করেছেন। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো হচ্ছেঃ
একঃ যে ব্যক্তি স্ত্রীর ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখে লি’আনের পথ অবলম্বন না করে হত্যা করে বসে তার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে। কারণ নিজের উদ্যোগে ‘হদ’ জারি করার তথা আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার তার ছিল না। দ্বিতীয় দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে না এবং তার কর্মের জন্য তাকে জবাবদিহিও করতে হবে না, তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হতে হবে (অর্থাৎ যথার্থই সে তার যিনার কারণে এ কাজ করেছে)। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ্ বলেন, এটিই হত্যার কারণ এ মর্মে তাকে দু’জন সাক্ষী আনতে হবে। মালেকীদের মধ্যে ইবনুল কাসেম ও ইবনে হাবীব এ মর্মে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন যে, যাকে হত্যা করা হয়েছে সেই যিনাকারীর বিবাহিত হতে হবে। অন্যথায় কুমার যিনাকারীকে হত্যা করলে তার কাছ থেকে কিসাস নেয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে তাকে কিসাস থেকে শুধুমাত্র তখনই মাফ করা হবে যখন সে যিনার চারজন সাক্ষী পেশ করবে অথবা নিহত ব্যক্তি মরার আগে নিজ মুখে একথা স্বীকার করে যাবে যে, সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা করছিল এবং এ সঙ্গে নিহত ব্যক্তিকে বিবাহিতও হতে হবে। (নাইলুল আওতারঃ ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২২৮ পৃষ্ঠা)।
দুইঃ ঘরে বসে লিআ’ন হতে পারে না। এজন্য আদালতে যাওয়া জরুরী।
তিনঃ লিআ’ন দাবী করার অধিকার শুধু স্বামীর নয়, স্ত্রীরও। স্বামী যখন তার ওপর যিনার অপবাদ দেয় অথবা তার শিশুর বংশধারা মেনে নিতে অস্বীকার করে তখন স্ত্রী আদালতে গিয়ে লিআ’ন দাবী করতে পারে।
চারঃ সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি লিআ’ন হতে পারে অথবা এজন্য তাদের দু’জনের মধ্যে কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে? এ বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম শাফেঈ বলেন, যার কসম আইনের দিক দিয়ে নির্ভরযোগ্য এবং যার তালাক দেবার ক্ষমতা আছে সে লি’আনের যোগ্যতা সম্পন্ন হবার জন্য যথেষ্ট। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী মুসলিম বা কাফের, গোলাম বা স্বাধীন, গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যের অধিকারী হোক বা না হোক এবং মুসলিম স্বামীর স্ত্রী মুসলমান বা জিম্মি যেই হোক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। প্রায় একই ধরণের অভিমত ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদেরও। কিন্তু হানাফীগণ বলেন, লিআ’ন শুধুমাত্র এমন স্বাধীন মুসলমান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হতে পারে যারা কাযাফের অপরাধে শাস্তি পায়নি। যদি স্বামী ও স্ত্রী দু’জনই কাফের, গোলাম বা কাযাফের অপরাধে পূর্বেই শাস্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে লিআ’ন হতে পারে না। এছাড়াও যদি স্ত্রী এর আগেও কখনো হারাম বা সন্দেহযুক্ত পদ্ধতিতে কোন পুরুষের সাথে মাখামাখি করে থাকে, তাহলে এক্ষেত্রেও লিআ’ন ঠিক হবে না। হানাফীগনের এর শর্তগুলো আরোপ করার কারণ হচ্ছে এই যে, তাদের মতে লিআ’ন ও কাযাফের আইনের মধ্যে এছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই যে, অন্য ব্যক্তি যদি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয় তাহলে তার জন্য রয়েছে ‘হদ’ আর স্বামী এ অপবাদ দিলে সে লিআ’ন করে অব্যাহতি লাভ করতে পারে। বাকি অন্যান্য সবদিক দিয়ে লিআ’ন ও কাযাফ একই জিনিস। এ দেবার যোগ্যতা নেই এমন কোন ব্যক্তিকে তারা এর অনুমতি দেয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে হানাফীদের অভিমত দুর্বল এবং ইমাম শাফেঈ যে কথাটি বলেছেন সেটিই সঠিক। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, কুরআন স্ত্রীর বিরুদ্ধে কাযাফের ব্যাপারটিকে কাযাফের আয়াতের একটি অংশে পরিণত করেনি বরং সেজন্য একটি স্বতন্ত্র আইন বর্ণনা করেছেন তাই তাকে কাযাফের আয়াতের শব্দাবলী থেকে আলাদা এবং উভয় হুকুমও ভিন্ন। তাই লি’আনের আয়াত থেকেই লি’আনের বিধান গ্রহণ করা উচিত। কাযাফের আয়াত থেকে নয়। যেমন কাযাফের আয়াতের শাস্তি লাভের যোগ্য হচ্ছে এমন লোক যে সতী সাধ্বী স্ত্রীর শর্ত আরোপ করা হয়নি। একটি মেয়ে কোন সময় হয়তো পাপ কাজ করেছিল, যদি পরবর্তীকালে সে তাওবা করে কোন পুরুষকে বিয়ে করে এবং তারপর তার স্বামী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাহলে লি’আনের আয়াত একথা বলে না যে, এ মেয়ের স্বামীকে এর বিরুদ্ধে অপবাদ দেবার বা এর সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার ব্যাপক অনুমতি দিয়ে দাও, কারণ এর জীবন এক সময় কলুষিত ছিল। দ্বিতীয় এবং ঠিক একই পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এই যে