তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ ٱتَّقِ ٱللَّهَ وَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَٱلْمُنَـٰفِقِينَ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًۭا﴾
১। হে নবী!১ আল্লাহকে ভয় করো এবং কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী।২
১. ওপরে ভূমিকায় বর্ণনা করে এসেছি, এ আয়াত এমন এক সময় নাযিল হয় যখন হযরত যায়েদ রা. হযরত যয়নবকে রা. তালাক দিয়েছিলেন। তখন নবী সা. নিজেও অনুভব করেছিলেন এবং আল্লাহর ইশারাও এটিই ছিল যে, দত্তক সম্পর্কের ব্যাপারে জাহেলীয়াতের রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের ওপর আঘাত হানার এটিই মোক্ষম সময়। নবীর সা. নিজেকে অগ্রসর হয়ে তাঁর দত্তক পুত্রের (যায়েদ) তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা উচিত। এভাবে এ রেওয়াজটি চূড়ান্তভাবে খতম হয়ে যাবে। কিন্তু যে কারণে নবী কারীম সা.এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ইতস্তত করেছিলেন তা ছিল এ আশঙ্কা যে, এর ফলে তাঁর একের পর এক সাফল্যের কারণে যে কাফের ও মুশরিকরা পূর্বেই ক্ষিপ্ত হয়েই ছিল এখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা করার জন্য তাঁরা একটি শক্তিশালী অস্ত্র পেয়ে যাবে। এটা তাঁর নিজের দুর্নামের আশঙ্কা জনিত ভয় ছিল না। বরং এ কারণে ছিল যে, এর ফলে ইসলামের উপর আঘাত আসবে, শত্রুদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়া বহু লোকের মনে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাবে, বহু নিরপেক্ষ লোক শত্রুপক্ষে যোগ দেবে এবং স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যে যারা দুর্বল বুদ্ধি ও মননের অধিকারী তারা সন্দেহ-সংশয়ের শিকার হবে। তাই নবী সা.মনে করতেন, জহেলীয়াতের একটি রেওয়াজ পরিবর্তন করার জন্য এমন পদক্ষেপ উঠানো কল্যাণকর নয় যার ফলে ইসলামের বৃহত্তর উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. ভাষণ শুরু করে প্রথম বাক্যেই নবী কারীমের সা.এ আশঙ্কার অবসান ঘটিয়েছেন। বক্তব্যের নিগূঢ় অর্থ হচ্ছে দ্বীনের কল্যাণ কিসে এবং কিসে নয় এ বিষয়টি আমিই ভালো জানি। কোন্ সময় কোন্ কাজটি করতে হবে এবং কোন কাজটি অকল্যাণকর তা আমি জানি। কাজেই তুমি এমন কর্মনীতি অবলম্বন করো না যা কাফের ও মুনাফিকদের ইচ্ছার অনুসারী হয় বরং এমন কাজ করো যা হয় আমার ইচ্ছার অনুসারী। কাফের ও মুনাফিকদেরকে নয় বরং অামাকেই ভয় করা উচিত।
﴿وَٱتَّبِعْ مَا يُوحَىٰٓ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًۭا﴾
২। তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যে বিষয়ের ইঙ্গিত করা হচ্ছে তার অনুসরণ করো। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা সবই জানেন।৩
৩. এ বাক্যে সম্বোধন করা হয়েছে নবী সা.কে, মুসলমানদেরকেও ইসলাম বিরোধীদেরকেও। এর অর্থ হচ্ছে নবী যদি আল্লাহর হুকুম পালন করে দুর্নামের ঝুঁকি মাথা পেতে নেন এবং নিজের ইজ্জত আবরুর ওপর শত্রুর আক্রমণ ধৈর্য সহকারে বরদাশ্ত করেন তাহলে তাঁর বিশ্বস্তামূলক কর্মকাণ্ড আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে থাকবে না। মুসলমানদের মধ্য থেকে যেসব লোক নবীর প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অবিচল থাকবে এবং যারা সন্দেহ-সংশয়ে ভুগবে তাদের উভয়ের অবস্থাই অগোচরে থাকবে না। কাফের ও মুনাফিকরা তাঁর দুর্নাম করার জন্য যে প্রচেষ্টা চালাবে সে সম্পর্কেও আল্লাহ বেখবর থাকবেন না। কাজেই ভয়ের কোন কারণ নেই। প্রত্যেকে যার যার কার্য অনুযায়ী যে পুরস্কার বা শাস্তি লাভের যোগ্য হবে তা সে অবশ্যই পাবে।
﴿وَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِ ۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَكِيلًۭا﴾
৩। আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। কর্ম সম্পাদনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।৪
৪. এ বাক্যে আবার নবী সা.কে সম্বোধন করা হয়েছে। তাঁকে এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তোমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে তা সম্পন্ন করো এবং সারা দুনিয়ার মানুষ যদি বিরোধিতায় এগিয়ে আসে তাহলেও তার পরোয়া করো না। মানুষ যখন নিশ্চিত ভাবে জানবে উমুক হুকুমটি আল্লাহ দিয়েছেন তখন সেটি পালন করার মধ্যেই সমস্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে তার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া উচিত। এরপর তার মধ্যে কল্যাণ, সুবিধা ও প্রজ্ঞা খুঁজে বেড়ানো সেই ব্যক্তির নিজের কাজ নয় বরং কাজ হওয়া উচিত শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে তাঁর হুকুম পালন করা। বান্দা তার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেবে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি পথ দেখাবার জন্যও যথেষ্ট এবং সাহায্য করার জন্যও। আর তিনিই এ বিষয়ের নিশ্চয়তাও দেন যে, তাঁর পথনির্দেশের আলোকে কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তি কখনো অশুভ ফলাফলের সম্মুখীন হবে না।
﴿مَّا جَعَلَ ٱللَّهُ لِرَجُلٍۢ مِّن قَلْبَيْنِ فِى جَوْفِهِۦ ۚ وَمَا جَعَلَ أَزْوَٰجَكُمُ ٱلَّـٰٓـِٔى تُظَـٰهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَـٰتِكُمْ ۚ وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَآءَكُمْ أَبْنَآءَكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ قَوْلُكُم بِأَفْوَٰهِكُمْ ۖ وَٱللَّهُ يَقُولُ ٱلْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِى ٱلسَّبِيلَ﴾
৪। আল্লাহ কোন ব্যক্তির দেহাভ্যন্তরে দু’টি হৃদয় রাখেননি।৫ তোমাদের যেসব স্ত্রীকে তোমরা ‘যিহার’ করো তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের জননীও করেননি৬ এবং তোমাদের পালক পুত্রদেরকেও তোমাদের প্রকৃত পুত্র করেননি।৭ এসব তো হচ্ছে এমন ধরনের কথা যা তোমরা স্বমুখে উচ্চারণ করো, কিন্তু আল্লাহ এমন কথা বলেন যা প্রকৃত সত্য এবং তিনিই সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।
৫. অর্থাৎ একজন লোক একই সঙ্গে মু’মিন ও মুনাফিক, সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী এবং সৎ ও অসৎ হতে পারে না। তার বক্ষ দেশে দু’টি হৃদয় নেই যে, একটি হৃদয়ে থাকবে আন্তরিকতা এবং অন্যটিতে থাকবে আল্লাহর প্রতি বেপরোয়া ভাব। কাজেই একজন লোক এক সময় একটি মর্যাদারই অধিকারী হতে পারে। সে মু’মিন হবে অথবা হবে মুনাফিক। সে কাফের হবে অথবা হবে মুসলিম। এখন যদি তোমরা কোন মু’মিনকে মুনাফিক বলো অথবা মুনাফিককে মু’মিন, তাহলে তাতে প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আসল মর্যাদা অবশ্যই একটিই থাকবে।
৬. ‘যিহার’ আরবের একটি বিশেষ পরিভাষা। প্রাচীনকালে আরবের লোকেরা স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করতে করতে কখনো একথা বলে বসতো, “তোমার পিঠ আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো।” একথা কারো মুখ থেকে একবার বের হয়ে গেলেই মনে করা হতো, এ মহিলা এখন তার জন্য হারাম হয়ে গেছে। কারণ সে তাকে তার মায়ের সাথে তুলনা করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, স্ত্রীকে মা বললে বা মায়ের সাথে তুলনা করলে সে মা হয়ে যায় না। মা তো গর্ভধারিনী জন্মদাত্রী। নিছক মুখে মা বলে দিলে প্রকৃত সত্য বদলে যায় না। এর ফলে যে স্ত্রী ছিল সে তোমাদের মুখের কথায় মা হয়ে যাবে না। (এখানে যিহার সম্পর্কিত শরীয়াতের বিধান বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। যিহার সম্পর্কিত আইন বর্ণনা করা হয়েছে সূরা আল মুজাদালার ২-৪ আয়াতে)
৭. এটি হচ্ছে বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য। ওপরের দু’টি বাক্যাংশ এ তৃতীয় বক্তব্যটি বুঝাবার যুক্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
﴿ٱدْعُوهُمْ لِـَٔابَآئِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ ٱللَّهِ ۚ فَإِن لَّمْ تَعْلَمُوٓا۟ ءَابَآءَهُمْ فَإِخْوَٰنُكُمْ فِى ٱلدِّينِ وَمَوَٰلِيكُمْ ۚ وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌۭ فِيمَآ أَخْطَأْتُم بِهِۦ وَلَـٰكِن مَّا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ ۚ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورًۭا رَّحِيمًا﴾
৫। পালক পুত্রদেরকে তাদের পিতার সাথে সম্পর্কিত করে ডাকো। এটি আল্লাহর কাছে বেশী ন্যায়সঙ্গত কথা।৮ আর যদি তোমরা তাদের পিতৃ পরিচয় না জানো, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই এবং বন্ধু।৯ না জেনে যে কথা তোমরা বলো সেজন্য তোমাদের পাকড়াও করা হবে না, কিন্তু তোমরা অন্তরে যে সংকল্প করো সেজন্য অবশ্যই পাকড়াও হবে।১০ আল্লাহ ক্ষমাকারী ও দয়াময়।১১
৮. এ হুকুমটি পালন করার জন্য সর্বপ্রথম যে সংশোধনমূলক কাজটি করা হয় সেটি হচ্ছে এই যে, নবী সা. এর পালক পুত্র হযরত যায়েদকে রা. যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলার পরিবর্তে তাঁর প্রকৃত পিতার সাথে সম্পর্কিত করে যায়েদ ইবনে হারেসাহ বলা শুরু করা হয়। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, যায়েদ ইবনে হারেসাকে প্রথমে সবাই যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলতো। এ আয়াত নাযিল হবার পর তাঁকে যায়েদ ইবনে হারেসাহ বলা হতে থাকে। তাছাড়া এ আয়াতটি নাযিল হবার পর কোন ব্যক্তি নিজের আসল বাপ ছাড়া অন্য কারো সাথে পিতৃ সম্পর্ক স্থাপন করাকে হারাম গণ্য করা হয়। বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী কারীম সা. বলেছেনঃ
مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ غَيْرُ أَبِيهِ فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ
“যে ব্যক্তি নিজেকে আপন পিতা ছাড়া অন্য কারো পুত্র বলে দাবী করে, অথচ সে জানে ঐ ব্যক্তি তার পিতা নয়, তার জন্য জান্নাত হারাম।”
হাদীসে একই বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্যান্য রেওয়াতও পাওয়া যায়। সেগুলো এ কাজটিকে মারাত্মক পর্যায়ের গুনাহ গণ্য করা হয়েছে।
৯. অর্থাৎ এ অবস্থাতেও খামাখা কোন ব্যক্তির সাথে তার পিতৃ-সম্পর্ক জুড়ে দেয়া ঠিক হবে না।
১০. এর অর্থ হচ্ছে, কাউকে সস্নেহে পুত্র বলে ফেললে এতে কোন গুনাহ হবে না। অনুরূপভাবে মা, মেয়ে, বোন, ভাই ইত্যাদি শব্দাবলীও যদি কারো জন্য নিছক ভদ্রতার খাতিরে ব্যবহার করা হয় তাহলে তাতে কোন গুনাহ হবে না। কিন্তু যদি এরূপ নিয়ত সহকারে একথা বলা হয় যে, যাকে পুত্র ইত্যাদি বলা হবে তাকে যথার্থই এ সম্পর্কগুলোর যে প্রকৃত সেই মর্যাদায় অভিসিক্ত করতে হবে, এ ধরনের আত্মীয়দের যে অধিকার স্বীকৃত তা দান করতে হবে এবং তার সাথে ঠিক তেমনি সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে যেমন সেই পর্যায়ের আত্মীয়দের সাথে করা হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এটি হবে আপত্তিকর এবং এজন্য পাকড়াও করা হবে।
১১. এর একটি অর্থ হচ্ছে, ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে যেসব ভুল করা হয়েছে আল্লাহ সেগুলো মাফ করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাদেরকে আর কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, না জেনে কোন কাজ করার জন্য আল্লাহ পকড়াও করবেন না। যদি বিনা ইচ্ছায় এমন কোন কাজ করা হয় যার বাইরের চেহারা কোন নিষিদ্ধ কাজের মতো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে সেই নিষিদ্ধ কাজটি করার ইচ্ছা ছিল না। তাহলে নিছক কাজটির বাইরের কাঠামোর ভিত্তিতে আল্লাহ শাস্তি দেবেন না।
﴿ٱلنَّبِىُّ أَوْلَىٰ بِٱلْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوَٰجُهُۥٓ أُمَّهَـٰتُهُمْ ۗ وَأُو۟لُوا۟ ٱلْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍۢ فِى كِتَـٰبِ ٱللَّهِ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُهَـٰجِرِينَ إِلَّآ أَن تَفْعَلُوٓا۟ إِلَىٰٓ أَوْلِيَآئِكُم مَّعْرُوفًۭا ۚ كَانَ ذَٰلِكَ فِى ٱلْكِتَـٰبِ مَسْطُورًۭا﴾
৬। নিঃসন্দেহে নবী ঈমানদারদের কাছে তাদের নিজেদের তুলনায় অগ্রাধিকারী,১২ আর নবীদের স্ত্রীগণ তাদের মা।১৩ কিন্তু আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে সাধারণ মু’মিন ও মুহাজিরদের তুলনায় আত্মীয়রা পরস্পরের বেশি হকদার। তবে নিজেদের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কোন সদ্ব্যবহার (করতে চাইলে তা) তোমরা করতে পারো।১৪ আল্লাহর কিতাবে এ বিধান লেখা আছে।
১২. অর্থাৎ নবী সা. এর সাথে মুসলমানদের এবং মুসলমানদের সাথে নবী সা. এর যে সম্পর্ক তা অন্যান্য সমস্ত মানবিক সম্পর্কের উর্ধ্বে এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। নবী ও মু’মিনদের মধ্যে যে সম্পর্ক বিরাজিত, অন্য কোন আত্মীয়তা ও সম্পর্ক তার সাথে কোন দিক দিয়ে সামান্যতমও তুলনীয় নয়। নবী সা.মুসলমানদের জন্য তাদের বাপ-মায়ের, চাইতেও বেশী স্নেহশীল ও দয়াদ্র হৃদয় এবং তাদের নিজেদের চাইতেও কল্যাণকামী। তাদের বাপ-মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তাদের ক্ষতি করতে পারে, তাদের সাথে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করতে পারে, তাদেরকে বিপথে পরিচালিত করতে পারে, তাদেরকে দিয়ে অন্যায় কাজ করাতে পারে, তাদেরকে জাহান্নামে ঠেলে দিতে পারে, কিন্তু নবী সা.তাদের পক্ষে কেবলমাত্র এমন কাজই করতে পারেন যাতে তাদের সত্যিকারের সাফল্য অর্জিত হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে পারে, বোকামি করে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করতে পারে কিন্তু নবী সা.তাদের জন্য তাই করবেন যা তাদের জন্য লাভজনক হয়। আসল ব্যাপার যখন এই তখন মুসলমানদের ওপরও নবী সা. এর এ অধিকার আছে যে, তারা তাঁকে নিজেদের বাপ-মা ও সন্তানদের এবং নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয় মনে করবে। দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে তাঁকে বেশী ভালোবাসবে। নিজেদের মতামতের ওপর তাঁর মতামতকে এবং নিজেদের ফায়সালার ওপর তাঁর ফায়সালাকে প্রাধান্য দেবে। তাঁর প্রত্যেকটি হুকুমের সামনে মাথা নত করে দেবে। বুখারী ও মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ তাদের হাদীস গ্রন্থে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তন সহকারে এ বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
“তোমাদের কোন ব্যক্তি মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষের চাইতে বেশী প্রিয় হই।”
১৩. ওপরে বর্ণিত এ একই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই নবী সা. এর এও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, মুসলমানদের নিজেদের পালক মাতা কখনো কোন অর্থেই তাদের মা নয় কিন্তু নবী সা. এর স্ত্রীগণ ঠিক তেমনিভাবে তাদের জন্য হারাম যেমন তাদের আসল মা তাদের জন্য হারাম। এ বিশেষ বিধানটি নবী সা.ছাড়া দুনিয়ার আর কোন মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে এ কথাও জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, নবী সা. এর স্ত্রীগণ শুধু মাত্র এ অর্থে মু’মিনদের মাতা যে, তাঁদেরকে সম্মান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব এবং তাঁদের সাথে কোন মুসলমানের বিয়ে হতে পারে না। বাদবাকি অন্যান্য বিষয়ে তাঁরা মায়ের মতো নন। যেমন তাদের প্রকৃত আত্মীয়গণ ছাড়া বাকি সমস্ত মুসলমান তাদের জন্য গায়ের মাহরাম ছিল এবং তাঁদের থেকে পর্দা করা ছিল ওয়াজিব। তাঁদের মেয়েরা মুসলমানদের জন্য বৈপিত্রেয় বোন ছিলেন না, যার ফলে তাদের সাথে মুসলমানদের বিয়ে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাঁদের ভাই ও বোনেরা মুসলমানদের জন্য মামা ও খালার পর্যায়ভুক্ত ছিলেন না। কোন ব্যক্তি নিজের মায়ের তরফ থেকে যে মীরাস লাভ করে তাঁদের তরফ থেকে কোন অনাত্মীয় মুসলমান সে ধরনের কোন মীরাস লাভ করে না।
এখানে আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে নবী সা. এর সকল স্ত্রীই এই মর্যাদার অধিকারী। হযরত আয়েশা রা.ও এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু একটি দল যখন হযরত আলী ও ফাতেমা রা. এবং তাঁর সন্তানদেরকে দ্বীনের কেন্দ্রে পরিণত করে সমগ্র ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে তাঁদের চারপাশে ঘোরাতে থাকে এবং এরই ভিত্তিতে অন্যান্য বহু সাহাবার সাথে হযরত আয়েশাকেও নিন্দাবাদ ও গালাগালির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তখন কুরআন মজীদের এ আয়াত তাদের পথে প্রতিরোধ দাঁড় করায়। কারণ এ আয়াতের প্রেক্ষিতে যে ব্যক্তিই ঈমানের দাবীদার হবে সে-ই তাঁকে মা বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য। শেষমেষ এ সংকট থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে এ অদ্ভুত দাবী করা হয়েছে যে, নবী কারীম সা.হযরত আলীকে এ ইখতিয়ার দিয়েছিলেন যে, তাঁর ইন্তিকালের পর তিনি তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের মধ্য থেকে যাঁকে চান তাঁর স্ত্রীর মর্যাদায় টিকিয়ে রাখতে পারেন এবং যাঁকে চান তাঁর পক্ষ থেকে তালাক দিতে পারেন। আবু মনসুর আহমাদ ইবনে আবু তালেব তাবরাসী কিতাবুল ইহ্তিজাজে যে কথা লিখেছেন এবং সুলাইমান ইবনে আবদুল্লাহ আলজিরানী যা উদ্ধৃত করেছেন তা হচ্ছে এই যে, নবী সা.হযরত আলীকে বলেনঃ
يا ابا الحسن ان هذا الشرف باق مادمنا على طاعة الله تعالى فايتهن عصت الله تعالى بعدى بالخروج عليك فطلقها من الازواج واسقطها من شرف امهات الؤمنين
“হে আবুল হাসান! এ মর্যাদা ততক্ষণ অক্ষুণ্ন থাকবে যতক্ষণ আমরা আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো। কাজেই আমার স্ত্রীদের মধ্য থেকে যে কেউ আমার পরে তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আল্লাহর নাফরমানি করবে তাকে তুমি তালাক দিয়ে দেবে এবং তাদেরকে মু’মিনদের মায়ের মর্যাদা থেকে বহিস্কার করবে।”
হাদীস বর্ণনার রীতি ও মূলনীতির দিক দিয়ে তো এ রেওয়ায়াতটি সম্পুর্ণ ভিত্তিহীন। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি এ সূরার ২৮-২৯ এবং ৫১ ও ৫২ আয়াত ৪টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে তিনি জানতে পারবেন যে, এ রেওয়ায়াতটি কুরআনেরও বিরোধী। কারণ ইখ্তিয়ার সম্পর্কিত আয়াতের পর রাসুলুল্লাহ সা. এর যে সকল স্ত্রী সর্বাবস্থায় তাঁর সাথে থাকা পছন্দ করেছিলেন তাঁদেরকে তালাক দেবার ইখ্তিয়ার আর রাসুলের সা.হাতে ছিল না। সামনের দিকে ৪২ ও ৯৩ টীকায় এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা আসছে।
এছাড়াও একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিই ব্যবহার করে এ রেওয়ায়াতটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলেও তিনি পরিষ্কার দেখতে পাবেন এটি একটি চরম ভিত্তিহীন এবং রাসূলে পাকের বিরুদ্ধে অত্যন্ত অবমাননাকর মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। রাসূল তো অতি উন্নত ও শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অধিকারী, তাঁর কথাই আলাদা, এমন কি একজন সাধারণ ভদ্রলোকের কাছেও এ আশা করা যেতে পারে না যে, তিনি মারা যাবার পর তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেবার কথা চিন্তা করবেন এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার সময় নিজের জামাতাকে এই ইখ্তিয়ার দিয়ে যাবেন যে, যদি কখনো তার সাথে তোমার ঝগড়া হয় তাহলে তুমি আমার পক্ষ থেকে তাকে তালাক দিয়ে দেবে। এ থেকে জানা যায়, যারা আহ্লে বায়তের প্রেমের দাবীদার তারা গৃহস্বামীর (সাহেবে বায়েত) ইজ্জত ও আবরুর কতোটা পরোয়া করেন। আর এরপর তারা মহান আল্লাহর বাণীর প্রতিও কতটুকু মর্যাদা প্রদর্শন করেন সেটিও দেখার বিষয়।
১৪. এ আয়াতে বলা হয়েছে, নবী সা. এর সাথে তো মুসলমানদের সম্পর্কের ধরন ছিল সবকিছু থেকে আলাদা। কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এমন নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে যার ফলে আত্মীয়দের অধিকার পরস্পরের ওপর সাধারণ লোকদের তুলনায় অগ্রগণ্য হয়। নিজের মা-বাপ, সন্তান-সন্ততি ও ভাইবোনদের প্রয়োজন পূর্ণ না করে বাইরে দান-খয়রাত করে বেড়ালে তা সঠিক গণ্য হবে না। যাকাতের মাধ্যমে প্রথমে নিজের গরীব আত্বীয় স্বজনদেরকে সাহায্য করতে হবে এবং তারপর অন্যান্য হকদারকে দিতে হবে। মীরাস অপরিহার্যভাবে তারাই লাভ করবে যারা হবে মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়। অন্যদেরকে সে চাইলে (জীবিতাবস্থায়) হেবা, ওয়াকফ বা অসিয়াতের মাধ্যমে নিজের সম্পদ দান করতে পারে। কিন্তু এও ওয়ারিসদেরকে বঞ্চিত করে সে সবকিছু অন্যদেরকে দিয়ে যেতে পারে না। হিজরাতের পর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছিল, যার প্রেক্ষিতে নিছক দ্বীনী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের ভিত্তিতে মুহাজির ও আনসারগণ পরস্পরের ওয়ারিস হতেন, এ হুকুমের মাধ্যমে তাও রহিত হয়ে যায়। আল্লাহ পরিষ্কার বলে দেন, মীরাস বণ্টন হবে আত্মীয়তার ভিত্তিতে। তবে হ্যাঁ কোন ব্যক্তি চাইলে হাদীয়া, তোহ্ফা, উপঢৌকন বা অসিয়াতের মাধ্যমে নিজের কোন দ্বীনী ভাইকে সাহায্য করতে পারেন।
﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ ٱلنَّبِيِّـۧنَ مِيثَـٰقَهُمْ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٍۢ وَإِبْرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ٱبْنِ مَرْيَمَ ۖ وَأَخَذْنَا مِنْهُم مِّيثَـٰقًا غَلِيظًۭا﴾
৭। আর হে নবী! স্মরণ করো সেই অঙ্গীকারের কথা যা আমি নিয়েছি সকল নবীর কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও মারইয়াম পুত্র ঈসার কাছ থেকেও। সবার কাছ থেকে আমি নিয়েছি পাকাপোক্ত অলংঘনীয় অঙ্গীকার১৫
১৫. এ আয়াতে আল্লাহ নবী সা.কে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, সকল নবীদের ন্যায় আপনার থেকেও আল্লাহ পাকাপোক্ত অঙ্গীকার নিয়েছেন সে অঙ্গীকার আপনার কঠোরভাবে পালন করা উচিত। এ অঙ্গীকার বলতে কোন অঙ্গীকার বুঝানো হয়েছে? ওপর থেকে যে আলোচনা চলে আসছে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এখানে যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছেঃ নবী নিজে আল্লাহর প্রত্যেকটি হুকুম মেনে চলবেন এবং অন্যদের তা মেনে চলার ব্যবস্থা করবেন। আল্লাহর প্রত্যেকটি কথা হুবহু অন্যদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবেন এবং তাকে কার্যত প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা ও সংগ্রামে কোন প্রকার গাফলতি করবেন না। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“আল্লাহ তোমাদের জন্য এমন দ্বীন নির্ধারিত করে দিয়েছেন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে এবং যা অহির মাধ্যমে দান করা হয়েছে (হে মুহাম্মাদ) তোমাকে। আর নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এ তাগিদ সহকারে যে, তোমরা প্রতিষ্ঠিত করবে এ দ্বীনকে এবং এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে না।” (আশ শূরাঃ ১৩)
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ
“আর স্মরণ করো, আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন তাদের থেকে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল এজন্য যে, তোমরা তার শিক্ষা বর্ণনা করবে এবং তা লুকাবে না।” (আলে ইমরানঃ ১৮৭)
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ
“আর স্মরণ করো, আমি বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না।” (আল বাকারাহঃ ৮৩)
أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِيثَاقُ الْكِتَابِ……………. خُذُوا مَا آتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“তাদের থেকে কি কিতাবের অঙ্গীকার নেয়া হয়নি? ——সেটিকে মজবুতভাবে ধরো যা আমি তোমাদের দিয়েছি এবং সেই নির্দেশ মনে রাখো যা তার মধ্যে রয়েছে। আশা করা যায়, তোমরা আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাকবে।” (আল আ’রাফঃ ১৬৯-১৭১)
وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمِيثَاقَهُ الَّذِي وَاثَقَكُمْ بِهِ إِذْ قُلْتُمْ سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا
“আর হে মুসলমানরা! মনে রেখো আল্লাহর অনুগ্রহকে, যা তিনি তোমাদের প্রতি করেছেন এবং সেই অঙ্গীকারকে যা তিনি তোমাদের থেকে নিয়েছেন যখন তোমরা বলেছিলে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম।” (আল মায়িদাহঃ ৭)
নবী সা.শত্রুদের সমালোচনার আশঙ্কায় পালক সন্তানের আত্মীয়তা সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের নিয়ম ভাংতে ইতস্তত করছিলেন বলেই মহান আল্লাহ এ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যেহেতু ব্যাপারটা একটি মহিলাকে বিয়ে করার, তাই তিনি বারবার লজ্জা অনুভব করছিলেন। তিনি মনে করছিলেন, আমি যতই সৎ সংকল্প নিয়ে নিছক সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যেই কাজ করি না কেন শত্রু একথাই বলবে, প্রবৃত্তির তাড়নায় এ কাজ করা হয়েছে এবং এ ব্যক্তি নিছক ধোঁকা দেবার জন্য সংস্কারকের খোলস নিয়ে আছে। এ কারণেই আল্লাহ নবী সা.কে বলছেন, তুমি আমার নিযুক্ত পয়গম্বর, সকল পয়গম্বরদের মতো তোমার সাথেও আমার এ মর্মে অলংঘনীয় চুক্তি রয়েছে যে, আমি যা কিছু হুকুম করবো তাই তুমি পালন করবে এবং অন্যদেরকেও তা পালন করার হুকুম দেবে। কাজেই কারো তিরস্কার সমালোচনার পরোয়া করো না, কাউকে লজ্জা ও ভয় করো না এবং তোমাকে দিয়ে আমি যে কাজ করাতে চাই নির্দ্বিধায় তা সম্পাদন করো।
একটি দল এ অঙ্গীকারকে একটি বিশেষ অঙ্গীকার অর্থে গ্রহণ করে। নবী সা. এর পূর্বের সকল নবীর কাছ থেকে এ অঙ্গীকারটি নেয়া হয়। সেটি ছিল এই যে, তাঁরা পরবর্তীকালে আগমনকারী নবীর প্রতি ঈমান আনবেন এবং তাঁর সাথে সহযোগিতা করবেন। এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এ দলের দাবী হচ্ছে, নবী সা. এর পরেও নবুওয়াতের দরজা খোলা আছে এবং মুহাম্মাদ সা. এর কাছ থেকেও এ অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে যে, তাঁর পরেও যে নবী আসবে তাঁর উম্মাত তার প্রতি ঈমান আনবে। কিন্তু আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্য পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভুল। যে বক্তব্য পরম্পরায় এ আয়াতটি এসেছে সেখানে তাঁর পরও নবী আসবে এবং তাঁর উম্মাতের তার প্রতি ঈমান আনা উচিত, একথা বলার কোন অবকাশই নেই। এর এ অর্থ গ্রহণ করলে এ আয়াতটি এখানে একেবারেই সর্ম্পকহীন ও খাপছাড়া হয়ে যায়। তাছাড়া এ আয়াতের শব্দগুলোয় এমন কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই যা থেকে এখানে অঙ্গীকার শব্দটির সাহায্যে কোন ধরনের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা বুঝা যেতে পারে। অবশ্যই এর ধরন জানার জন্য আমাদের কুরআন মজীদের যেসব জায়গায় নবীদের থেকে গৃহীত অঙ্গীকারসমূহের কথা বলা হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি ফিরাতে হবে। এখন যদি সমগ্র কুরআন মজীদে শুধুমাত্র একটি অঙ্গীকারের কথা বলা হতো এবং তা হতো পরবর্তীকালে আগমনকারী নবীদের প্রতি ঈমান আনার সাথে সম্পর্কিত তাহলে এখানেও ঐ একই অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে একথা দাবী করা যথার্থ হতো। কিন্তু যে ব্যক্তিই সচেতনভাবে কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করে সে জানে এ কিতাবে নবীগণ এবং তাঁদের উম্মাতদের থেকে গৃহীত বহু অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। কাজেই এসব বিভিন্ন ধরনের অঙ্গীকারের মধ্যে থেকে যে অঙ্গীকারটি এখানকার পূর্বাপর বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখে একমাত্র সেটির কথা এখানে বলা হয়েছে বলে মনে করা সঠিক হবে। এখানে যে অঙ্গীকারের উল্লেখের কোন সুযোগই নেই তার কথা এখানে বলা হয়েছে বলে মনে করা কখনই সঠিক নয়। এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কিছু লোক কুরআন থেকে হিদায়াত গ্রহণ করার নয় বরং কুরআনকে হিদায়াত করার কাজে ব্যাপৃত হয়।
﴿لِّيَسْـَٔلَ ٱلصَّـٰدِقِينَ عَن صِدْقِهِمْ ۚ وَأَعَدَّ لِلْكَـٰفِرِينَ عَذَابًا أَلِيمًۭا﴾
৮। যাতে সত্যবাদীদেরকে (তাদের রব) তাদের সত্যবাদিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন১৬ এবং কাফেরদের জন্য তো তিনি যন্ত্রণাদায়ক আযাব প্রস্তুত করেই রেখেছেন।১৭
১৬. অর্থাৎ আল্লাহ কেবলমাত্র অঙ্গীকার নিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং এ অঙ্গীকার কতটুকু পালন করা হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন করবেন। তারপর যারা নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর সাথে করা অঙ্গীকার পালন করে থাকবে তারাই অঙ্গীকার পালনকারী গণ্য হবে।
১৭. এ রুকুর বিষয়বস্তু পরোপুরি অনুধাবন করার জন্য একে এ সূরার ৩৬ ও ৪১ আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়া দরকার।
﴿ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱذْكُرُوا۟ نِعْمَةَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَآءَتْكُمْ جُنُودٌۭ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًۭا وَجُنُودًۭا لَّمْ تَرَوْهَا ۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا﴾
৯। হে ঈমানদারগণ১৮ স্মরণ করো আল্লাহর অনুগ্রহ, যা (এই মাত্র) তিনি করলেন তোমাদের প্রতি, যখন সেনাদল তোমাদের ওপর চড়াও হলো আমি পাঠালাম তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ধুলিঝড় এবং এমন সেনাবাহিনী রওয়ানা করলাম যা তোমরা দেখোনি।১৯ তোমরা তখন যা কিছু করছিলে আল্লাহ তা সব দেখছিলেন।
১৮. এখান থেকে ৩ রুকুর শেষ পর্যন্তকার আয়াত গুলো নাযিল হয় নবী সা. বনী কুরাইযার যুদ্ধ শেষ করার পর। এ দু’টি রুকুতে আহযাব ও বনী কুরাইযার ঘটনাবলী সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। এগুলো পড়ার সময় আমি ভূমিকায় এ দু’টি যুদ্ধের যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছি তা যেন দৃষ্টি সম্মুখে থাকে।
১৯. শত্রুসেনারা যখন মদীনার ওপর চড়াও হয়েছিল ঠিক তখনই এ ধূলিঝড় আসেনি। বরং অবরোধের এক মাস হয়ে যাওয়ার পর এ ধূলিঝড় আসে। অদৃশ্য ‘সেনাবাহিনী’ বলতে এমন সব গোপন শক্তিকে বুঝানো হয়েছে যা মানুষের বিভিন্ন বিষয়াবলীতে আল্লাহর ইশারায় কাজ করতে থাকে এবং মানুষ তার খবরই রাখে না। ঘটনাবলী ও কার্যকলাপকে মানুষ শুধুমাত্র তাদের বাহ্যিক কার্যকারণের দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অননুভূত পদ্ধতিতে যেসব শক্তি কাজ করে যায় সেগুলো থাকে তার হিসেবের বাইরে। অথচ অধিকাংশ সময় এসব গোপন শক্তির কার্যকারিতা চূড়ান্ত প্রমাণিত হয়। এসব শক্তি যেহেতু আল্লাহর ফেরেশতাদের অধীনে কাজ করে তাই ‘সেনাবাহিনী’ অর্থে ফেরেশতাও ধরা যেতে পারে, যদিও এখানে ফেরেশতাদের সৈন্য পাঠাবার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি।
﴿إِذْ جَآءُوكُم مِّن فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ ٱلْأَبْصَـٰرُ وَبَلَغَتِ ٱلْقُلُوبُ ٱلْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِٱللَّهِ ٱلظُّنُونَا۠﴾
১০। যখন তারা ওপর ও নিচে থেকে তোমাদের ওপর চড়াও হলো,২০ যখন ভয়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল, প্রাণ হয়ে পড়েছিল ওষ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা প্রকার ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিলে
২০. এর একটি অর্থ হতে পারে, সবদিক থেকে চড়াও হয়ে এলো। দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, নজদ ও খয়বরের দিক থেকে আক্রমণকারীরা ওপরের দিক থেকে এবং মক্কা মোআ’যযমার দিক থেকে আক্রমণকারীরা নিচের দিক থেকে আক্রমণ করলো।
﴿هُنَالِكَ ٱبْتُلِىَ ٱلْمُؤْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا۟ زِلْزَالًۭا شَدِيدًۭا﴾
১১। তখন মু’মিনদেরকে নিদারুণ পরীক্ষা করা হলো এবং ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়া হলো।২১
২১. এখানে মু’মিন তাদেরকে বলা হয়েছে যারা মুহাম্মাদ সা.কে রাসূল বলে মেনে নিয়ে নিজেকে তাঁর অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এদের মধ্যে সাচ্চা ঈমানদার ও মুনাফিক উভয়ই ছিল। এ প্যারাগ্রাফে মুসলমানদের দলের উল্লেখ করেছেন সামগ্রিকভাবে, এরপরের তিনটি প্যারাগ্রাফে মুনাফিকদের নীতির ওপর মন্তব্য করা হয়েছে। তারপর শেষ দু’টি প্যারাগ্রাফে রাসূলুল্লাহ সা.ও সাচ্চা মু’মিনদের সম্পর্কে বলা হয়েছে।
﴿وَإِذْ يَقُولُ ٱلْمُنَـٰفِقُونَ وَٱلَّذِينَ فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌۭ مَّا وَعَدَنَا ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ إِلَّا غُرُورًۭا﴾
১২। স্মরণ করো যখন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ ছিল তারা পরিষ্কার বলছিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন২২ তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
২২. অর্থাৎ এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি যে, ঈমানদাররা আল্লাহর সাহায্য-সমর্থন লাভ করবে এবং তাদেরকে চূড়ান্ত বিজয় দান করা হবে।
﴿وَإِذْ قَالَت طَّآئِفَةٌۭ مِّنْهُمْ يَـٰٓأَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَٱرْجِعُوا۟ ۚ وَيَسْتَـْٔذِنُ فَرِيقٌۭ مِّنْهُمُ ٱلنَّبِىَّ يَقُولُونَ إِنَّ بُيُوتَنَا عَوْرَةٌۭ وَمَا هِىَ بِعَوْرَةٍ ۖ إِن يُرِيدُونَ إِلَّا فِرَارًۭا﴾
১৩। যখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল বললো, “হে ইয়াসরিববাসীরা! তোমাদের জন্য এখন অবস্থান করার কোন সুযোগ নেই, ফিরে চলো।”২৩ যখন তাদের একপক্ষ নবীর কাছে এই বলে ছুটি চাচ্ছিল যে, “আমাদের গৃহ বিপদাপন্ন,”২৪ অথচ তা বিপদাপন্ন ছিল না২৫ আসলে তারা (যুদ্ধক্ষেত্র থেকে) পালাতে চাচ্ছিল।
২৩. এ বাক্যটি দু’টি অর্থে বলা হয়েছে। এর বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, খন্দকের সামনে কাফেরদের মোকাবিলায় অবস্থান করার কোন অবকাশ নেই। শহরের দিকে চলো। আর এর গূঢ় অর্থ হচ্ছে, ইসলামের ওপর অবস্থান করার কোন অবকাশ নেই। এখন নিজেদের পৈতৃক ধর্মে ফিরে যাওয়া উচিত। এর ফলে সমস্ত আরব জাতির শত্রুতার মুখে আমরা যেভাবে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছি তা থেকে রক্ষা পেয়ে যাবো। মুনাফিকরা নিজ মুখে এসব কথা এজন্য বলতো যে, তাদের ফাঁদে যে পা দেবে তাকে নিজেদের গূঢ় উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেবে এবং যে তাদের কথা শুনে সতর্ক হয়ে যাবে এবং তাদেরকে পাকড়াও করবে নিজেদের শব্দের বাহ্যিক আবরণের আড়ালে গিয়ে তাদের পাকড়াও থেকে বেঁচে যাবে।
২৪. অর্থাৎ যখন বনু কুরাইযাও হানাদারদের সাথে হাত মিলালো তখন রাসূলুল্লাহ সা. এর সেনাদল থেকে কেটে পড়ার জন্য মুনাফিকরা একটি চমৎকার বাহানা পেয়ে গেলো এবং তারা এই বলে ছুটি চাইতে লাগলো যে, এখন তো আমাদের ঘরই বিপদের মুখে পড়ে গিয়েছে, কাজেই ঘরে ফিরে গিয়ে আমাদের নিজেদের পরিবার ও সন্তানদের হেফাজত করার সুযোগ দেয়া উচিত। অথচ সেসময় সমগ্র মদীনাবাসীদের হেফাজতের দায়িত্ব ছিল রাসূলুল্লাহ সা. এর ওপর। বনী কুরাইযার চুক্তি ভঙ্গের ফলে যে বিপদ দেখা দিয়েছিল তার হাত থেকে শহর ও শহরবাসীদেরকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা ছিল রাসূলের সা.কাজ, পৃথক পৃথকভাবে একেকজন সৈনিকের কাজ ছিল না।
২৫. অর্থাৎ নবী সা.ই তো এ বিপদ থেকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ব্যবস্থাপনাও তাঁর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল এবং সেনাপতি হিসেবে তিনি এ ব্যবস্থা কার্যকর করার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। কাজেই সেসময় কোন তাৎক্ষণিক বিপদ দেখা দেয়নি। এ কারণে তাদের এ ধরনের ওজর পেশ করা কোন পর্যায়েও যুক্তিসঙ্গত ছিল না।
﴿وَلَوْ دُخِلَتْ عَلَيْهِم مِّنْ أَقْطَارِهَا ثُمَّ سُئِلُوا۟ ٱلْفِتْنَةَ لَـَٔاتَوْهَا وَمَا تَلَبَّثُوا۟ بِهَآ إِلَّا يَسِيرًۭا﴾
১৪। যদি শহরের বিভিন্ন দিক থেকে শত্রুরা ঢুকে পড়তো এবং সেসময় তাদেরকে ফিতনা সৃষ্টি করার জন্য আহবান জানানো হতো,২৬ তাহলে তারা তাতেই লিপ্ত হয়ে যেতো এবং ফিতনায় শরীক হবার ব্যাপারে তারা খুব কমই ইতস্তত করতো।
২৬. অর্থাৎ যদি নগরে প্রবেশ করে কাফেররা বিজয়ীর বেশে এ মুনাফিকদেরকে এই বলে আহবান জানাতো, এসো আমাদের সাথে মিলে মুসলমানদেরকে খতম করো।
﴿وَلَقَدْ كَانُوا۟ عَـٰهَدُوا۟ ٱللَّهَ مِن قَبْلُ لَا يُوَلُّونَ ٱلْأَدْبَـٰرَ ۚ وَكَانَ عَهْدُ ٱللَّهِ مَسْـُٔولًۭا﴾
১৫। তারা ইতিপূর্বে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্টপ্রদর্শন করবে না এবং আল্লাহর সাথে করা অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা তো হবেই।২৭
২৭. অর্থাৎ ওহোদ যুদ্ধের সময় তারা যে দুর্বলতা দেখিয়েছিল তারপর লজ্জা ও অনুতাপ প্রকাশ করে তারা আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিল যে, এবার যদি পরীক্ষার কোন সুযোগ আসে তাহলে তারা নিজেদের এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে। কিন্তু আল্লাহকে নিছক কথা দিয়ে প্রতারণা করা যেতে পারে না। যে ব্যক্তিই তাঁর সাথে কোন অঙ্গীকার করে তাঁর সামনে তিনি পরীক্ষার কোন না কোন সুযোগ এনে দেন। এর মাধ্যমে তার সত্য ও মিথ্যা যাচাই হয়ে যায়। তাই ওহোদ যুদ্ধের মাত্র দু’বছর পরেই তিনি তার চাইতেও বেশী বড় বিপদ সামনে নিয়ে এলেন এবং এভাবে তারা তাঁর সাথে কেমন ও কতটুকু সাচ্চা অঙ্গীকার করেছিল তা যাচাই করে নিলেন।
﴿قُل لَّن يَنفَعَكُمُ ٱلْفِرَارُ إِن فَرَرْتُم مِّنَ ٱلْمَوْتِ أَوِ ٱلْقَتْلِ وَإِذًۭا لَّا تُمَتَّعُونَ إِلَّا قَلِيلًۭا﴾
১৬। হে নবী! তাদেরকে বলো, যদি তোমরা মৃত্যু বা হত্যা থেকে পলায়ন করো, তাহলে এ পলায়নে তোমাদের কোন লাভ হবে না। এরপর জীবন উপভোগ করার সামান্য সুযোগই তোমরা পাবে।২৮
২৮. অর্থাৎ এভাবে পলায়ন করার ফলে তোমাদের আয়ু বেড়ে যাবে না। এর ফলে কখনোই তোমরা কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে এবং সারা দুনিয়া জাহানের ধন-দৌলত হস্তগত করতে পারবে না। পালিয়ে বাঁচলে বড় জোর কয়েক বছরই বাঁচবে এবং তোমাদের জন্য যতটুকু নির্ধারিত হয়ে আছে ততটুকুই জীবনের আয়েশ-আরাম ভোগ করতে পারবে।
﴿قُلْ مَن ذَا ٱلَّذِى يَعْصِمُكُم مِّنَ ٱللَّهِ إِنْ أَرَادَ بِكُمْ سُوٓءًا أَوْ أَرَادَ بِكُمْ رَحْمَةًۭ ۚ وَلَا يَجِدُونَ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَلِيًّۭا وَلَا نَصِيرًۭا﴾
১৭। তাদেরকে বলো, কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে আল্লাহর হাত থেকে যদি তিনি তোমাদের ক্ষতি করতে চান? আর কে তাঁর রহমতকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে যদি তিনি চান তোমাদের প্রতি মেহেরবানী করতে? আল্লাহর মোকাবিলায় তো তারা কোন পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী লাভ করতে পারে না।
﴿قَدْ يَعْلَمُ ٱللَّهُ ٱلْمُعَوِّقِينَ مِنكُمْ وَٱلْقَآئِلِينَ لِإِخْوَٰنِهِمْ هَلُمَّ إِلَيْنَا ۖ وَلَا يَأْتُونَ ٱلْبَأْسَ إِلَّا قَلِيلًا﴾
১৮। আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে তাদেরকে খুব ভালো করেই জানেন যারা (যুদ্ধের কাজে) বাঁধা দেয়, যারা নিজেদের ভাইদেরকে বলে, “এসো আমাদের দিকে”২৯ যারা যুদ্ধে অংশ নিলেও নিয়ে থাকে শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তে।
২৯. অর্থাৎ এ নবীর দল ত্যাগ করো। কেন তোমরা দ্বীন, ঈমান, সত্য ও সততার চক্করে পড়ে আছো? নিজেদেরকে বিপদ-আপদ, ভীতি ও আশঙ্কার মধ্যে নিক্ষেপ করার পরিবর্তে আমাদের মতো নিরাপদে অবস্থান করার নীতি অবলম্বন করো।
﴿أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ ۖ فَإِذَا جَآءَ ٱلْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنظُرُونَ إِلَيْكَ تَدُورُ أَعْيُنُهُمْ كَٱلَّذِى يُغْشَىٰ عَلَيْهِ مِنَ ٱلْمَوْتِ ۖ فَإِذَا ذَهَبَ ٱلْخَوْفُ سَلَقُوكُم بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَى ٱلْخَيْرِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوا۟ فَأَحْبَطَ ٱللَّهُ أَعْمَـٰلَهُمْ ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرًۭا﴾
১৯। যারা তোমাদের সাথে সহযোগিতা করার ব্যাপারে বড়ই কৃপণ।৩০ বিপদের সময় এমনভাবে চোখ উলটিয়ে তোমাদের দিকে তাকাতে থাকে যেন কোন মৃত্যুপথযাত্রী মূর্ছিত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিপদ চলে গেলে এই লোকেরাই আবার স্বার্থলোভী হয়ে তীক্ষ্ণ ভাষায় তোমাদেরকে বিদ্ধ করতে থাকে।৩১ তারা কখনো ঈমান আনেনি, তাই আল্লাহ তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড ধ্বংস করে দিয়েছেন৩২ এবং এমনটি করা আল্লাহর জন্য অত্যন্ত সহজ।৩৩
৩০. অর্থাৎ সাচ্চা মু’মিনরা যে পথে তাদের সবকিছু উৎসর্গ করে দিচ্ছে সেপথে তারা নিজেদের শ্রম, সময়, চিন্তা ও সহায়-সম্পদ স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ব্যয় করতে প্রস্তুত নয়। প্রাণপাত করা ও বিপদ মাথা পেতে নেয়া তো দূরের কথা কোন কাজেও তারা নির্দ্বধায় মু’মিনদের সাথে সহযোগিতা করতে চায় না।
৩১. আভিধানিক দিক দিয়ে আয়াতটির দু’টি অর্থ হয়। একঃ যুদ্ধের ময়দান থেকে সাফল্য লাভ করে যখন তোমরা ফিরে আসো তখন তারা বড়ই হৃদ্যতা সহকারে ও সাড়ম্বরে তোমাদেরকে স্বাগত জানায় এবং বড় বড় বুলি আউড়িয়ে এই বলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে যে, আমরাও পাক্কা মু’মিন এবং এ কাজ সম্প্রসারণে আমরাও অংশ নিয়েছি কাজেই আমরাও গনীমাতের মালের হকদার। দুইঃ বিজয় অর্জিত হলে গনীমাতের মাল ভাগ করার সময় তাদের কন্ঠ বড়ই তীক্ষ্ণ ও ধারাল হয়ে যায় এবং তারা অগ্রবর্তী হয়ে দাবী করতে থাকে, আমাদের ভাগ দাও, আমরাও কাজ করেছি, সবকিছু তোমরাই লুটে নিয়ে যেয়ো না।
৩২. অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করার পর তারা যেসব নামায পড়েছে, রোযা রেখেছে, যাকাত দিয়েছে এবং বাহ্যত যেসব সৎকাজ করেছে সবকিছুকে মহান আল্লাহ নাকচ করে দেবেন এবং সেগুলোর কোন প্রতিদান তাদেরকে দেবেন না। কারণ আল্লাহর দরবারে কাজের বাহ্যিক চেহারার ভিত্তিতে ফায়সালা করা হয় না বরং এ বাহ্য চেহারার গভীরতম প্রদেশে বিশ্বাস ও আন্তরিকতা আছে কিনা তার ভিত্তিতে ফায়সালা করা হয়। যখন এ জিনিস আদতে তাদের মধ্যে নেই তখন এ লোক দেখানো কাজ একেবারেই অর্থহীন। এখানে এ বিষয়টি গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, যেসব লোক আল্লাহ ও রাসূলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, নামায পড়ছিল, রোযা রাখছিল, যাকাতও দিচ্ছিল এবং মুসলমানদের সাথে তাদের অন্যান্য সৎকাজে শামিলও হচ্ছিল, তাদের সম্পর্কে পরিষ্কার ফায়সালা শুনিয়ে দেয়া হলো যে, তারা আদতে ঈমানই আনেনি। আর এ ফায়সালা কেবলমাত্র এরই ভিত্তিতে করা হলো যে, কুফর ও ইসলামের দ্বন্দ্বে যখন কঠিন পরীক্ষার সময় এলো তখন তারা দো-মনা হবার প্রমাণ দিল, দ্বীনের স্বার্থের ওপর নিজের স্বার্থের প্রার্ধন্য প্রতিষ্ঠিত করলো এবং ইসলামের হেফাজতের জন্য নিজের প্রাণ, ধন-সম্পদ ও শ্রম নিয়োজিত করতে অস্বীকৃতি জানালো। এ থেকে জানা গেলো, ফায়সালার আসল ভিত্তি এসব বাহ্যিক কাজ-কর্ম নয়। বরং মানুষের বিশ্বস্ততা কার সাথে সম্পর্কিত তারই ভিত্তিতে এর ফায়সালা সূচিত হয়। যেখানে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের প্রতি বিশ্বস্ততা নেই সেখানে ঈমানের স্বীকৃতি এবং ইবাদাত ও অন্যান্য সৎকাজের কোন মূল্য নেই।
৩৩. অর্থাৎ তাদের কার্যাবলীর কোন গুরুত্ব ও মূল্য নেই। ফলে সেগুলো নষ্ট করে দেয়া আল্লাহর কাছে মোটেই কষ্টকর হবে না। তাছাড়া তারা এমন কোন শক্তিই রাখে না যার ফলে তাদের কার্যাবলী ধ্বংস করে দেয়া তাঁর জন্য কঠিন হতে পারে।
﴿يَحْسَبُونَ ٱلْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوا۟ ۖ وَإِن يَأْتِ ٱلْأَحْزَابُ يَوَدُّوا۟ لَوْ أَنَّهُم بَادُونَ فِى ٱلْأَعْرَابِ يَسْـَٔلُونَ عَنْ أَنۢبَآئِكُمْ ۖ وَلَوْ كَانُوا۟ فِيكُم مَّا قَـٰتَلُوٓا۟ إِلَّا قَلِيلًۭا﴾
২০। তারা মনে করছে আক্রমণকারী দল এখনো চলে যায়নি। আর যদি আক্রমণকারীরা আবার এসে যায়, তাহলে তাদের মন চায় এ সময় তারা কোথাও মরুভূমিতে বেদুইনের মধ্যে গিয়ে বসতো এবং সেখান থেকে তোমাদের খবরাখবর নিতো। তবুও যদি তারা তোমাদের মধ্যে থাকেও তাহলে যুদ্ধে খুব কমই অংশ নেবে।
﴿لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُولِ ٱللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌۭ لِّمَن كَانَ يَرْجُوا۟ ٱللَّهَ وَٱلْيَوْمَ ٱلْـَٔاخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرًۭا﴾
২১। আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে ছিল একটি উত্তম আদর্শ৩৪ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিনের আকাঙ্ক্ষী এবং বেশী করে আল্লাহকে স্মরণ করে।৩৫
৩৪. যে প্রেক্ষাপটে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে সে দৃষ্টিতে বিচার করলে বলা যায়, যারা আহ্যাব যুদ্ধে সুবিধাবাদী ও পিঠ বাঁচানোর নীতি অবলম্বন করেছিল তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই নবী কারীমের সা.কর্মধারাকে এখানে আদর্শ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে, তোমরা ছিলে ঈমান, ইসলাম ও রাসূলের আনুগত্যের দাবীদার। তোমাদের দেখা উচিত ছিল, তোমরা যে রাসূলের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছো তিনি এ অবস্থায় কোন ধরনের নীতি অবলম্বন করেছিলেন। যদি কোন দলের নেতা নিজেদের নিরাপদ থাকার নীতি অবলম্বন করেন, নিজেই আরাম প্রিয় হন, নিজেই ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেন, বিপদের সময় নিজেই পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি করতে থাকেন, তাহলে তার অনুসারীদের পক্ষ থেকে এ দুর্বলতাগুলোর প্রকাশ যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। কিন্তু এখানে তো রাসূলল্লাহ সা. এর অবস্থা এই ছিল যে, অন্যদের কাছে তিনি যে কষ্ট স্বীকার করার জন্য দাবী জানান তার প্রত্যেকটি কষ্ট স্বীকার করার ব্যাপারে তিনি সবার সাথে শরীক ছিলেন, সবার চেয়ে বেশী করে তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমন কোন কষ্ট ছিল না যা অন্যরা বরদাশ্ত করেছিল কিন্তু তিনি করেননি। খন্দক খননকারীরে দলে তিনি নিজে শামিল ছিলেন। ক্ষুধা ও অন্যান্য কষ্ট সহ্য করার ক্ষেত্রে একজন সাধারণ মুসলমানের সাথে তিনি সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবরোধকালে তিনি সর্বক্ষণ যুদ্ধের ময়দানে হাজির ছিলেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও শত্রুদের সামনে থেকে সরে যাননি। বনী কুরাইযার বিশ্বাসঘাতকতার পরে সমস্ত মুসলমানদের সন্তান ও পরিবারবর্গ যে বিপদের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তাঁর সন্তান ও পরিবারবর্গও সেই একই বিপদের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। তিনি নিজের সন্তান ও পরিবারবর্গের হেফাজতের জন্যও এমন কোন বিশেষ ব্যবস্থা করেননি যা অন্য মুসলমানের জন্য করেননি। যে মহান উদ্দেশ্যে তিনি মুসলমানদের কাছ থেকে ত্যাগ ও কুরবানীর দাবী করেছিলেন সে উদ্দেশ্যে সবার আগে এবং সবার চেয়ে বেশি করে তিনি নিজে নিজের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই যে কেউ তাঁর অনুসরণের দাবীদার ছিল তাকে এ আর্দশ দেখে তারই অনুসরণ করা উচিত ছিল।
পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী এ ছিল এ আয়াতের নির্গলিতার্থ। কিন্তু এর শব্দগুলো ব্যাপক অর্থবোধক এবং এর উদ্দেশ্যকে কেবলমাত্র এ অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার কোন কারণ নেই। আল্লাহ এ কথা বলেননি যে, কেবলমাত্র এ দৃষ্টিতেই তাঁর রাসূলের জীবন মুসলমানদের জন্য আর্দশ বরং শর্তহীন ও অবিমিশ্রভাবে তাঁকে আর্দশ গণ্য করেছেন। কাজেই এ আয়াতের দাবী হচ্ছে, মুসলমানরা সকল বিষয়েই তাঁর জীবনকে নিজেদের জন্য আর্দশ জীবন মনে করেবে এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের চরিত্র ও জীবন গড়ে তুলবে।
৩৫. অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ থেকে গাফিল তার জন্য এ জীবন আদর্শ নয়। কিন্তু তার জন্য অবশ্যই আদর্শ যে, কখনো ঘটনাক্রমে আল্লাহর নাম নেয় না বরং বেশী করে তাঁকে স্মরণ করে ও স্মরন রাখে। অনুরূপভাবে এ জীবন এমন ব্যক্তির জন্যও কোন আদর্শ নয় যে আল্লাহর কাছ থেকেও কিছু আশা করে না এবং আখেরাতের আগমনেরও প্রত্যাশা করে না। কিন্তু এমন ব্যক্তির জন্য তার অবশ্যই আদর্শ যে, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দান আশা করে এবং যে একথা চিন্তা করে যে, একদিন আখেরাতের জীবন শুরু হবে যেখানে দুনিয়ার জীবনে তার মনোভাব ও নীতি আল্লাহর রাসূলের সা.মনোভাব ও নীতির কতটুকু নিকটতর আছে তার ওপরই তার সমস্ত কল্যাণ নির্ভর করবে।
﴿وَلَمَّا رَءَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْأَحْزَابَ قَالُوا۟ هَـٰذَا مَا وَعَدَنَا ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَصَدَقَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ ۚ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّآ إِيمَـٰنًۭا وَتَسْلِيمًۭا﴾
২২। আর সাচ্চা মু’মিনদের (অবস্থা সে সময় এমন ছিল,)৩৬ যখন আক্রমণকারী সেনাদলকে দেখলো তারা চিৎকার করে উঠলো, “এতো সেই জিনিসই যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের দিয়েছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা পুরোপুরি সত্য ছিল।”৩৭ এ ঘটনা তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণ আরো বেশী বাড়িয়ে দিল।৩৮
৩৬. রাসূলুল্লাহ সা.কে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করার প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করার পর এবার আল্লাহ সাহাবায়ে কেরামের কর্মধারাকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরছেন, যাতে ঈমানের মিথ্যা দাবীদার এবং আন্তরিকতা সহকারে রাসূলের আনুগত্যকারীদের কার্যাবলীকে পরস্পরের মোকাবেলায় পুরোপুরিভাবে সুস্পষ্ট করে দেয়া যায়। যদিও বাহ্যিক ঈমানের স্বীকারোক্তির ব্যাপারে তারা এবং এরা একই পর্যায়ভুক্ত ছিল, উভয়কেই মুসলমানদের দলভুক্ত গণ্য করা হতো এবং নামাযে উভয়ই শরীক হতো কিন্তু পরীক্ষার মুহূর্ত আসার পর উভয়ই পরস্পর থেকে ছাঁটাই হয়ে আলাদা হয়ে যায় এবং পরিষ্কার জানা যায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বস্ত কে এবং কে কেবল নিছক নামের মুসলমান?
৩৭. এ প্রসঙ্গে ১২ আয়াতটি দৃষ্টিসমক্ষে রাখা উচিত। সেখানে বলা হয়েছিল, যারা ছিল মুনাফিক ও হৃদয়ের রোগে আক্রান্ত, তারা দশ বারো হাজার সৈন্যকে সামনে থেকে এবং বনী কুরাইযাকে পিছন থেকে আক্রমণ করতে দেখে চিৎকার করে বলতে থাকে, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.আমাদের সাথে যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন সেগুলো ডাহা মিথ্যা ও প্রতারণা প্রমাণিত হলো। আমাদের বলা তো হয়েছিল, আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ঈমান আনলে আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থন পেছনে থাকবে, আরবে ও আজমে তোমাদের ডংকা বাজবে এবং রোম ও ইরানের সম্পদ তোমাদের করায়ত্ত হবে কিন্তু এখন দেখছি সমগ্র আরব আমাদের খতম করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে এবং আমাদেরকে এ বিপদ সাগর থেকে উদ্ধার করার জন্য কোথাও ফেরেশতাদের সৈন্যদলের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না।” এখন বলা হচ্ছে ঐ সব মিথ্যা ঈমানের দাবীদার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকারের যে অর্থ বুঝেছিল এর একটি তাই ছিল। সাচ্চা ঈমানদাররা এর যে অর্থ বুঝেছে সেটি এর দ্বিতীয় অর্থ। বিপদের ঘনঘটা দেখে আল্লাহর অঙ্গীকারের কথা তাদেরও মনে পড়েছে কিন্তু এ অঙ্গীকার নয় যে, ঈমান আনার সাথে সাথেই কুটোটিও নাড়ার দরকার হবে না সোজা তোমরা দুনিয়ার শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে যাবে এবং ফেরেশতারা এসে তোমাদের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেবে। বরং এ অঙ্গীকার যে, কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে, বিপদের পাহাড় তোমাদের মাথায় ভেঙ্গে পড়বে, তোমাদের চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, তবেই কোন পর্যায়ে আল্লাহর অনুগ্রহ তোমাদের প্রতি বর্ষিত হবে এবং তোমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের এমন সব সাফল্য দান করা হবে যেগুলো দেবার অঙ্গীকার আল্লাহ মু’মিন বান্দাদের সাথে করেছিলেনঃ
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
“তোমরা কি একথা মনে করে নিয়েছো যে, তোমরা জান্নাতে এমনিই প্রবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের পূর্বে যারা ঈমান এনেছিল তারা যে অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল এখনো তোমরা সে অবস্থার সম্মুখীন হওনি। তারা কাঠিন্য ও বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল এবং তাদেরকে নাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, এমনকি রাসূল ও তার সঙ্গী-সাথীরা চিৎকার করে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে!-শোনো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই আছে।” (আল বাকারাহঃ ২১৪)
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ – وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
“লোকেরা কি একথা মনে করে নিয়েছে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ একথা বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে আর পরীক্ষা করা হবে না? অথচ এদের আগে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সবাইকে আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে অবশ্যই দেখতে হবে কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যাবাদী” (আল আনকাবূতঃ ২-৩)
৩৮. অর্থাৎ বিপদ আপদের এ পাহাড় দেখে তাদের ঈমান নড়ে যাবার পরিবর্তে আরো বেশি বেড়ে গেলো এবং আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে দূরে পালিয়ে যাবার পরিবর্তে তারা আরো বেশী প্রত্যয় ও নিশ্চিন্ততা সহকারে সবকিছু তাঁর হাতে সোপর্দ করতে উদ্যোগী হয়ে উঠলো।
এ প্রসঙ্গে একথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, ঈমান ও আত্মসমর্পণ আসলে মনের এমন একটি অবস্থা যা দ্বীনের প্রত্যেকটি হুকুম ও দাবীর মুখে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। দুনিয়ার জীবনে প্রতি পদে পদে মানুষ এমন অবস্থার মুখোমুখি হয় যখন দ্বীন কোন কাজের আদেশ দেয় অথবা তা করতে নিষেধ করে অথবা প্রাণ, ধন-সম্পদ, সময়, শ্রম ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ত্যাগ করার দাবী করে। এ ধরনের প্রত্যেক সময়ে যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে সরে আসবে তার ঈমান ও আত্মসমর্পণ কমতি দেখা দেবে এবং যে ব্যক্তিই আদেশের সামনে মাথা নত করে দেবে তার ঈমান ও আত্মসমর্পণ বেড়ে যাবে যদিও শুরুতে মানুষ কেবলমাত্র ইসলাম গ্রহণ করতেই মু’মিন ও মুসলিম রূপে গণ্য হয়ে যায় কিন্তু এটা কোন স্থির ও স্থবির অবস্থা নয়। এ অবস্থা কেবল এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে না। বরং এর মধ্যে উন্নতি ও অবনতি উভয়েরই সম্ভাবনা থাকে। আনুগত্য ও আন্তরিকতার অভাব ও স্বল্পতা এর অবনতির কারণ হয়। এমনকি এক ব্যক্তি পেছনে হটতে হটতে ঈমানের শেষ সীমানায় পৌঁছে যায়, যেখান থেকে চুল পরিমাণ পেছনে হটলেই সে মু’মিনের পরিবর্তে মুনাফিক হয়ে যায়। পক্ষান্তরে আন্তরিকতা যত বেশী হতে থাকে, আনুগত্য যত পূর্ণতা লাভ করে এবং আল্লাহর সত্য দ্বীনের ঝাণ্ডা বুলন্দ করার ফিকির, আকাঙ্ক্ষা ও আত্মনিমগ্নতা যত বেড়ে যেতে থাকে সেই অনুপাতে ঈমানও বেড়ে যেতে থাকে। এভাবে এক সময় মানুষ ‘সিদ্দীক’ তথা পূর্ণ সত্যবাদীর মর্যাদায় উন্নীত হয়। কিন্তু এই তারতম্য ও হ্রাসবৃদ্ধি কেবল নৈতিক মর্যাদার মধ্যেই সীমিত থাকে। আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে এর হিসেব করা সম্ভব নয়। বান্দাদের জন্য একটি স্বীকারোক্তি ও সত্যতার ঘোষণাই ঈমান। এর মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান ইসলামে প্রবেশ করে এবং যতদিন সে এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে ততদিন তাকে মুসলমান বলে মেনে নেয়া হয়। তার সম্পর্কে আমরা এ কথা বলতে পারি না যে, সে আধা মুসলমান বা সিকি মুসলমান কিংবা দ্বিগুন মুসলমান বা ত্রিগুন মুসলমান। এ ধরনের আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রে সকল মুসলমান সমান। কাউকে আমরা বেশী মু’মিন বলতে পারি না এবং তার অধিকারও বেশী হতে পারে না। আবার কাউকে কম মু’মিন গণ্য করে তার অধিকার কম করতে পারি না। এসব দিক দিয়ে ঈমান কম-বেশী হওয়ার কোন প্রশ্ন দেখা দেয় না। আসলে এ অর্থেই ইমাম আবু হানীফা রাহি. বলেছেনঃ
الايمان لايزيد ولاينقص
অর্থাৎ “ঈমান কম-বেশী হয় না” (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আনফালঃ ২ এবং আল ফাতহঃ ৭ টীকা)
﴿مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌۭ صَدَقُوا۟ مَا عَـٰهَدُوا۟ ٱللَّهَ عَلَيْهِ ۖ فَمِنْهُم مَّن قَضَىٰ نَحْبَهُۥ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا۟ تَبْدِيلًۭا﴾
২৩। ঈমানদারদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেখালো। তাদের কেউ নিজের নজরানা পূর্ণ করেছে এবং কেউ সময় আসার প্রতীক্ষায় আছে।৩৯ তারা তাদের নীতি পরিবর্তন করেনি।
৩৯. অর্থাৎ কেউ আল্লাহর পথে প্রাণ উৎসর্গ করে দিয়েছে এবং কেউ তাঁর দ্বীনের খাতিরে নিজের খুনের নজরানা পেশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।
﴿لِّيَجْزِىَ ٱللَّهُ ٱلصَّـٰدِقِينَ بِصِدْقِهِمْ وَيُعَذِّبَ ٱلْمُنَـٰفِقِينَ إِن شَآءَ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ غَفُورًۭا رَّحِيمًۭا﴾
২৪। (এসব কিছু হলো এজন্য) যাতে আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যতার পুরস্কার দেন এবং মুনাফিকদেরকে চাইলে শাস্তি দেন এবং চাইলে তাদের তাওবা কবুল করে নেন। অবশ্যই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
﴿وَرَدَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ بِغَيْظِهِمْ لَمْ يَنَالُوا۟ خَيْرًۭا ۚ وَكَفَى ٱللَّهُ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱلْقِتَالَ ۚ وَكَانَ ٱللَّهُ قَوِيًّا عَزِيزًۭا﴾
২৫। আল্লাহ কাফেরদের মুখ ফিরিয়ে দিয়েছেন, তারা বিফল হয়ে নিজেদের অন্তর্জ্বালা সহকারে এমনিই ফিরে গেছে এবং মু’মিনদের পক্ষ থেকে লড়াই করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে গেছেন। আল্লাহ বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত।
﴿وَأَنزَلَ ٱلَّذِينَ ظَـٰهَرُوهُم مِّنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ مِن صَيَاصِيهِمْ وَقَذَفَ فِى قُلُوبِهِمُ ٱلرُّعْبَ فَرِيقًۭا تَقْتُلُونَ وَتَأْسِرُونَ فَرِيقًۭا﴾
২৬। তারপর আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারাই এর আক্রমণকারীদের সাথে সহযোগিতা করেছিল৪০ তাদের দুর্গ থেকে আল্লাহ তাদেরকে নামিয়ে এনেছেন এবং তাদের অন্তরে তিনি এমন ভীতি সঞ্চার করেছেন যার ফলে আজ তাদের একটি দলকে তোমরা হত্যা করছো এবং অন্য একটি দলকে করছো বন্দী।
৪০. অর্থাৎ ইহুদি বনী কুরাইযা।
﴿وَأَوْرَثَكُمْ أَرْضَهُمْ وَدِيَـٰرَهُمْ وَأَمْوَٰلَهُمْ وَأَرْضًۭا لَّمْ تَطَـُٔوهَا ۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرًۭا﴾
২৭। তিনি তোমাদেরকে তাদের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদের ওয়ারিস করে দিয়েছেন এবং এমন এলাকা তোমাদের দিয়েছেন যাকে তোমরা কখনো পদানত করোনি। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন।
﴿يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ قُل لِّأَزْوَٰجِكَ إِن كُنتُنَّ تُرِدْنَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًۭا جَمِيلًۭا﴾
২৮। হে নবী!৪১ তোমার স্ত্রীদেরকে বলো, যদি তোমরা দুনিয়া এবং তার ভূষণ চাও, তাহলে এসো আমি তোমাদের কিছু দিয়ে ভালোভাবে বিদায় করে দিই।
৪১. এখানে থেকে ৩৫ আয়াত পর্যন্ত আহযাব ও বনী কুরাইযার যুদ্ধের সন্নিহিত সময়ে নাযিল হয়েছিল। ভূমিকায় আমি এগুলোর পটভূমি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি। সহীহ মুসলিমে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. সে যুগের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, একদিন হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উমর রা. নবী কারীমের সা.খেদমতে হাজির হয়ে দেখেন তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর চারদিকে বসে আছেন এবং তিনি কোন কথা বলছেন না। নবী কারীম সা.হযরত উমরকে সম্বোধন করে বললেন, هُنَّ كَمَا تَرَى يَسأْلننِى النَّفَقة “তুমি দেখতে পাচ্ছো, এরা আমার চারদিকে বসে আছে এবং আমার কাছে খরচপত্রের জন্য টাকা চাচ্ছে।” একথা শুনে তাঁরা উভয়ে নিজ নিজ মেয়েকে ধমক দিলেন এবং তাদেরকে বললেন, তোমরা রাসূললুল্লাহ সা.কে কষ্ট দিচ্ছো এবং এমন জিনিস চাচ্ছো যা তাঁর কাছে নেই। এ ঘটনা থেকে বুঝা যায়, নবী সা. এর আর্থিক সংকট সে সময় কেমন ঘনীভূত ছিল এবং কুফর ও ইসলামের চরম দ্বন্দ্বের দিনগুলোতে খরচপাতির জন্য পবিত্র স্ত্রীগণের তাগাদা তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বকে কিভাবে বিচলিত করে তুলছিল।
﴿وَإِن كُنتُنَّ تُرِدْنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَٱلدَّارَ ٱلْـَٔاخِرَةَ فَإِنَّ ٱللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَـٰتِ مِنكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًۭا﴾
২৯। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের প্রত্যাশী হও, তাহলে জেনে রাখো তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তাদের জন্য আল্লাহ মহা প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।৪২
৪২. এ আয়াতটি নাযিল হবার সময় নবী সা. এর স্ত্রী ছিল চারজন। তাঁরা ছিলেন হযরত সওদা রা., হযরত আয়েশা রা., হযরত হাফসা রা. এবং হযরত উম্মে সালামাহ রা.। তখনো হযরত যয়নবের রা. সাথে নবী কারীমের সা.বিয়ে হয়নি। (আহকামুল কুরআনঃ ইবনুল আরাবীঃ ১৯৫৮ সালে মিসর থেকে মুদ্রিত, ৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১২-৫১৩) এ আয়াত নাযিল হবার পর নবী কারীম সা.সর্বপ্রথম হযরত আয়েশার সাথে আলোচনা করেন এবং বলেন, “আমি তোমাকে একটি কথা বলছি, জবাব দেবার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না। তোমার বাপ-মায়ের মতামত নাও এবং তারপর ফায়সালা করো।” তারপর তিনি তাঁকে বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এ হুকুম এসেছে এবং তাঁকে এ আয়াত শুনিয়ে দেন। হযরত আয়েশা বলেন, “এ ব্যাপারটি কি আমি আমার বাপ-মাকে জিজ্ঞেস করবো? আমি তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতকে চাই।” এরপর নবী সা.এক এক করে তাঁর অন্যান্য পবিত্র স্ত্রীদের প্রত্যেকের কাছে যান এবং তাঁদেরকে একই কথা বলেন। তারা প্রত্যেকে হযরত আয়েশার রা. মতো একই জবাব দেন। (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম ও নাসাঈ)
ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয় ‘তাখঈর’। অর্থাৎ স্ত্রীকে তার স্বামীর থাকার বা আলাদা হয়ে যাবার মধ্য থেকে যে কোন একটিকে বাছাই করে নেবার ফায়সালা করার ইখতিয়ার দান করা। এই তাখঈর নবী সা. এর ওপর ওয়াজিব ছিল। কারণ আল্লাহ তাঁকে এর হুকুম দিয়েছিলেন। যদি তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের কেউ আলাদা হয়ে যাবার পথ অবলম্বন করতেন তাহলে তিনি আপনা আপনিই আলাদা হয়ে যেতেন না বরং নবী কারীমের সা.আলাদা করে দেবার কারণে আলাদা হয়ে যেতেন যেমন আয়াতের শব্দাবলী থেকে সুস্পষ্ট হচ্ছেঃ “এসো আমি কিছু দিয়ে তোমাদের ভালোভাবে বিদায় করে দেই।” কিন্তু এ অবস্থায় তাঁকে আলাদা করে দেয়া নবী সা. এর ওপর ওয়াজিব ছিল। কারণ নিজের প্রতিশ্রুতি পালন না করা নবী হিসেবে তাঁর জন্য সমীচীন ছিল না। আলাদা হয়ে যাবার পর বাহ্যত এটাই মনে হয়, মু’মিনের মাতার তালিকা থেকে তাঁর নাম কাটা যেতো এবং অন্য মুসলমানের সাথে তাঁর বিবাহ আর হারাম থাকতো না। কারণ তিনি দুনিয়া এবং তার সাজসজ্জার জন্যই তো রাসূলে কারীমের সা.থেকে আলাদা হতেন এবং এর অধিকার তাঁকে দেয়া হয়েছিল। আর একথা সুস্পষ্ট যে, অন্য কারো সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ থাকলে তাঁর এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হতো না। অন্যদিকে আয়াতের এটিও একটি উদ্দেশ্য মনে হয়, নবী কারীমের সা.যে সকল স্ত্রী আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতকে পছন্দ করে নিয়েছেন তাঁদেরকে তালাক দেবার ইখতিয়ার নবীর আর থাকেনি। কারণ তাখঈরের দু’টি দিক ছিল। একঃ দুনিয়াকে গ্রহণ করলে তোমাদেরকে আলাদা করে দেয়া হবে। দুইঃ আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতকে গ্রহণ করলে তোমাদের আলাদা করে দেয়া হবে না। এখন একথা সুস্পষ্ট, এ দু’টি দিকের মধ্য থেকে যে কোন একটি দিকই কোন মহিমান্বিতা মহিলা গ্রহণ করলে দ্বিতীয় দিকটি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যেতো।
ইসলামী ফিকহে ‘তাখঈর’ আসলে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করার পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ স্বামী এর মাধ্যমে স্ত্রীকে এ ক্ষমতা দেয় যে, সে চাইলে তার স্ত্রী হিসেবে থাকতে পারে এবং চাইলে আলাদা হয়ে যেতে পারে। এ বিষয়টির ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে ইজতিহাদের মাধ্যমে ফকীহগণ যে বিধান বর্ণনা করেছেন তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নরূপঃ
একঃ এ ক্ষমতা একবার স্ত্রীকে দিয়ে দেবার পর স্বামী আর তা ফেরত নিতে পারে না এবং স্ত্রীকে তা ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতেও পারে না। তবে স্ত্রীর জন্য তা ব্যবহার করা অপরিহার্য হয়ে যায় না। সে চাইলে স্বামীর সাথে থাকতে সম্মত হতে পারে, চাইলে আলাদা হয়ে যাবার কথা ঘোষণা করতে পারে এবং চাইলে কোন কিছুর ঘোষণা না দিয়ে এ ক্ষমতাকে এমনিই নষ্ট হয়ে যাবার সুযোগ দিতে পারে।
দুইঃ এ ক্ষমতাটি স্ত্রীর দিকে স্থানান্তরিত হবার জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে। প্রথমত স্বামী কর্তৃক তাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তালাকের ইখতিয়ার দান করা চাই, অথবা তালাকের কথা সুস্পষ্ট ভাষায় না বললেও এ ইখতিয়ার দেবার নিয়ত তার থাকা চাই। যেমন, সে যদি বলে, “তোমার ইখতিয়ার আছে” বা “তোমার ব্যাপার তোমার হাতে আছে,” তাহলে এ ধরনের ইঙ্গিতধর্মী কথার ক্ষেত্রে স্বামীর নিয়ত ছাড়া তালাকের ইখতিয়ার স্ত্রীর কাছে স্থানান্তরিত হবে না। যদি স্ত্রী এর দাবী করে এবং স্বামী হলফ সহকারে বিবৃতি দেয় যে, এর মাধ্যমে তালাকের ইখতিয়ার সোপর্দ করার উদ্দেশ্য তার ছিল না, তাহলে স্বামীর কথা গ্রহণ করা হবে। তবে স্ত্রী যদি এ মর্মে সাক্ষ্য হাজির করে যে, অবনিবনা ঝগড়া বিবাদের পরিবেশে বা তালাকের কথাবার্তা চলার সময় একথা বলা হয়েছিল, তাহলে তখন তার দাবী বিবেচিত হবে। কারণ এ প্রেক্ষাপটে ইখতিয়ার দেবার অর্থ এটাই বুঝা যাবে যে, স্বামীর তালাকের ইখতিয়ার দেবার নিয়ত ছিল। দ্বিতীয়ত স্ত্রীর জানতে হবে যে, তাকে এ ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। যদি সে অনুপস্থিত থাকে, তাহলে তার কাছে এ খবর পৌঁছতে হবে এবং যদি সে উপস্থিত থাকে, তাহলে এ শব্দগুলো তার শুনতে হবে। যতক্ষণ সে নিজ কানে শুনবে না অথবা তার কাছে খবর পৌঁছবে না ততক্ষণ ইখতিয়ার তার কাছে স্থানান্তরিত হবে না।
তিনঃ যদি স্বামী কোন সময় নির্ধারণ করা ছাড়াই শর্তহীনভাবে স্ত্রীকে ইখতিয়ার দান করে, তাহলে স্ত্রী কতক্ষণ পর্যন্ত এ ইখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে? এ ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতবিরোধ পাওয়া যায়। একটি দল বলেন, যে বৈঠকে স্বামী একথা বলে সে বৈঠকেই স্ত্রী তার ইখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে। যদি সে কোন জবাব না দিয়ে সেখান থেকে উঠে যায় অথবা এমন কাজে লিপ্ত হয় যা একথাই প্রমাণ করে যে, সে জবাব দিতে চায় না, তাহলে তার ইখতিয়ার বাতিল হয়ে যাবে। এ মত পোষণ করেন হযরত উমর রা., হযরত উসমান রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা., হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা., হযরত জাবের ইবনে যায়েদ, আতা রাহি., মুজাহিদ রাহি., শা’বী রাহি., ইব্রাহীম নাখঈ রাহি., ইমাম মালেক রাহি., ইমাম আবু হানীফা রাহি., ইমাম শাফেঈ রাহি., ইমাম আওযায়ী রাহি., সুফিয়ান সওরী রাহি. ও আবু সওর রাহি.। দ্বিতীয় দলের মতে, তার ইখতিয়ার ঐ বৈঠক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং তারপরও সে এ ইখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারবে। এ মত পোষণ করেন হযরত হাসান বসরী রাহি., কাতাদাহ ও যুহরী।
চারঃ স্বামী যদি সময় নির্ধারণ করে দেয়। যেমন, সে যদি বলে, এক মাস বা এক বছর পর্যন্ত তোমাকে ইখতিয়ার দিলাম অথবা এ সময় পর্যন্ত তোমার বিষয় তোমার হাতে রইলো, তাহলে ঐ সময় পর্যন্ত সে এ ইখতিয়ার ভোগ করবে। তবে যদি সে বলে, তুমি যখন চাও এ ইখতিয়ার ব্যবহার করতে পারো, তাহলে এ অবস্থায় তার ইখতিয়ার হবে সীমাহীন।
পাঁচঃ স্ত্রী যদি আলাদা হতে চায়, তাহলে তাকে সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত অর্থবোধক শব্দাবলীর মাধ্যমে তা প্রয়োগ করতে হবে। অস্পষ্ট শব্দাবলী, যার মাধ্যমে বক্তব্য সুস্পষ্ট হয় না, তা দ্বারা ইখতিয়ার প্রয়োগ কার্যকর হতে পারে না।
ছয়ঃ আইনত স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে ইখতিয়ার দেবার জন্য তিনটি বাক্য ব্যবহার করা যেতে পারে। একঃ সে বলবে, “তোমার ব্যাপারটি তোমার হাতে রয়েছে।” দুইঃ সে বলবে, “তোমাকে ইখতিয়ার দেয়া হচ্ছে।” তিনঃ সে বলবে, “যদি তুমি চাও তাহলে তোমাকে তালাক দিলাম।” এর মধ্যে প্রত্যেকটির আইনগত ফলাফল হবে ভিন্ন রকমেরঃ
(ক) “তোমার বিষয়টি তোমার হাতে রয়েছে” –এ শব্দগুলো যদি স্বামী বলে থাকে এবং স্ত্রী এর জবাবে এমন কোন স্পষ্ট কথা বলে যা থেকে বুঝা যায় যে, সে আলাদা হয়ে গেছে, তাহলে হানাফী মতে এক তালাক বায়েন হয়ে যাবে। অর্থাৎ এরপর স্বামী আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু ইদ্দত অতিবাহিত হবার পর উভয়ে আবার চাইলে পরস্পরকে বিয়ে করতে পারে। আর যদি স্বামী বলে থাকে, “এক তালাক পর্যন্ত তোমার বিষয়টি তোমার হাতে রয়েছে,” তাহলে এ অবস্থায় একটি ‘রজঈ’ তালাক অনুষ্ঠিত হবে। (অর্থাৎ ইদ্দতের মধ্যে স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে।) কিন্তু স্বামী যদি বিষয়টি স্ত্রীর হাতে সোপর্দ করতে গিয়ে তিন তালাকের নিয়ত করে থাকে অথবা একথা সুস্পষ্ট করে বলে থাকে, তাহলে সে সুস্পষ্ট ভাষায় নিজের ওপর তিন তালাক আরোপ করুক অথবা কেবলমাত্র একবার বলুক আমি আলাদা হয়ে গেলাম বা নিজেকে তালাক দিলাম, এ অবস্থায় স্ত্রীর ইখতিয়ার তালাকের সমার্থক হবে।
(খ) “তোমাকে ইখতিয়ার দিলাম” শব্দগুলোর সাথে যদি স্বামী স্ত্রীকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ইখতিয়ার দিয়ে থাকে এবং স্ত্রী আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে থাকে, তাহলে হানাফীর মতে স্বামীর তিন তালাকের ইখতিয়ার দেবার নিয়ত থাকলেও একটি বায়েন তালাকই অনুষ্ঠিত হবে। তবে যদি স্বামীর পক্ষ থেকে তিন তালাকের ইখতিয়ার দেবার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রীর তালাকের ইখতিয়ারের মাধ্যমে তিন তালাক অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। ইমাম শাফেঈর রাহি. মতে, যদি স্বামী ইখতিয়ার দেবার সময় তালাকের নিয়ত করে থাকে এবং স্ত্রী আলাদা হয়ে যায়, তাহলে একটি রজঈ তালাক অনুষ্ঠিত হবে। ইমাম মালেকের রাহি. মতে, স্বামী যদি স্ত্রীর সাথে সহবাস করে থাকে তাহলে তিন তালাক অনুষ্ঠিত হবে আর যদি সহবাস না করে থাকে, তাহলে এ অবস্থায় স্বামী এক তালাকের নিয়তের দাবী করলে তা মেনে নেয়া হবে।
(গ) “যদি তুমি চাও, তাহলে তোমাকে তালাক দিলাম” –একথা বলার পর যদি স্ত্রী তালাকের ইখতিয়ার ব্যবহার করে, তাহলে বায়েন নয় বরং একটি রজঈ তালাক অনুষ্ঠিত হবে।
সাতঃ যদি স্বামীর পক্ষ থেকে আলাদা হবার ইখতিয়ার দেবার পর স্ত্রী তার স্ত্রী হয়ে থাকার জন্য নিজের সম্মতি প্রকাশ করে, তাহলে কোন তালাক সংঘটিত হবে না। এ মত পোষণ করেন হযরত উমর রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা., হযরত আয়েশা রা., হযরত আবু দারদা রা., হযরত ইবনে আব্বাস রা. ও হযরত ইবনে উমর রা.। সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহগণ এ মতই অবলম্বন করেছেন। মাসরূক হযরত আয়েশাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি জবাব দেনঃ
خَيَّرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم نِسَاءَهُ فَاخْتَرْنَهُ ، أَفَكَانَ ذَلِكَ طَلاَقًا؟
“রাসূলুল্লাহ সা.তাঁর স্ত্রীদেরকে ইখতিয়ার দিয়েছিলেন এবং তাঁরা রাসূলূল্লাহরই সাথে থাকা পছন্দ করেছিলেন। একে কি তালাক বলে গণ্য করা হয়?”
এ ব্যাপারে একমাত্র হযরত আলীর রা. ও হযরত যায়েদ ইবনে সাবেতের রা. এ অভিমত উদ্ধৃত হয়েছে যে, এক্ষেত্রে একটি রজঈ তালাক অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এ উভয় মনীষীর অন্য একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তাঁরাও এক্ষেত্রে কোন তালাক সংঘটিত হবে না বলে মত প্রকাশ করেছেন।
﴿يَـٰنِسَآءَ ٱلنَّبِىِّ مَن يَأْتِ مِنكُنَّ بِفَـٰحِشَةٍۢ مُّبَيِّنَةٍۢ يُضَـٰعَفْ لَهَا ٱلْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرًۭا﴾
৩০। হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ কোন সুস্পষ্ট অশ্লীল কাজ করবে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে।৪৩ আল্লাহর জন্য এটা খুবই সহজ কাজ।৪৪
৪৩. এর অর্থ এ নয় যে, নাউযুবিল্লাহ নবী সা. এর পবিত্র স্ত্রীদের থেকে কোন অশ্লীল কাজের আশঙ্কা ছিল। বরং এর মাধ্যমে নবীর স্ত্রীগণকে এ অনুভূতি দান করাই উদ্দেশ্য ছিল যে, ইসলামী সমাজে তাঁরা যেমন উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত আছেন সেই অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্বও অনেক কঠিন। তাই তাঁদের নৈতিক চালচলন হতে হবে অত্যন্ত পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। এটা ঠিক তেমনি যেমন নবী সা.কে সম্বোধন করে মহান আল্লাহ বলেনঃ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ “যদি তুমি শিরক করো তাহলে তোমার সমস্ত কৃতকর্ম বরবাদ হয়ে যাবে।” (আয যুমারঃ ৬৫) এর অর্থ এ নয় যে, নাউযুবিল্লাহ নবী কারীম সা.থেকে কোন শিরকের আশঙ্কা ছিল বরং নবী কারীমকে এবং তাঁর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শিরক কত ভয়াবহ অপরাধ এবং তাকে কঠোরভাবে এড়িয়ে চলা অপরিহার্য, সে কথা বুঝানোই ছিল উদ্দেশ্য।
৪৪. অর্থাৎ তোমরা এ ভুলের মধ্যে অবস্থান করো না যে, নবীর স্ত্রী হওয়ার কারণে তোমরা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বেঁচে যাবে অথবা তোমাদের মর্যাদা এত বেশী উন্নত যে, সে কারণে তোমাদেরকে পাকড়াও করা আল্লাহর জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে।
﴿وَمَن يَقْنُتْ مِنكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَتَعْمَلْ صَـٰلِحًۭا نُّؤْتِهَآ أَجْرَهَا مَرَّتَيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهَا رِزْقًۭا كَرِيمًۭا﴾
৩১। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং সৎকাজ করবে তাকে আমি দু’বার প্রতিদান দেবো৪৫ এবং আমি তার জন্য সম্মানজনক রিযিকের ব্যবস্থা করে রেখেছি।
৪৫. গোনাহর জন্য দু’বার শাস্তি ও নেকীর জন্য দু’বার পুরস্কার দেবার কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ যাদেরকে মানুষের সমাজে কোন উন্নত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন তারা সাধারণত জনগণের নেতা হয়ে যায় এবং জনগণের বিরাট অংশ ভালো ও মন্দ কাজে তাঁদেরকেই অনুসরণ করে চলে। তাঁদের খারাপ কাজ শুধুমাত্র তাঁদের একার খারাপ কাজ হয় না বরং একটি জাতির চরিত্র বিকৃতির কারণও হয় এবং তাঁদের ভালো কাজ শুধুমাত্র তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ভালো কাজ হয় না বরং বহু লোকের কল্যাণ সাধনেরও কারণ হয়। তাই তারা যখন খারাপ কাজ করে তখন নিজেদের খারাপের সাথে সাথে অন্যদের খারাপেরও শাস্তি পায় এবং যখনি তারা সৎকাজ করে তখন নিজেদের সৎকাজের সাথে সাথে অন্যদেরকে তারা যে সৎপথ দেখিয়েছে তারও প্রতিদান লাভ করে।
আলোচ্য আয়াত থেকে এ মূলনীতিও স্থিরীকৃত হয় যে, যেখানে মর্যাদা যত বেশী হবে এবং যত বেশী বিশ্বস্ততার আশা করা হবে যেখানে মর্যাদাহানি ও অবিশ্বস্ততার অপরাধ ততবেশী কঠোর হবে এবং এ সঙ্গে তার শাস্তিও হবে তত বেশী কঠিন। যেমন মসজিদে শরাব পান করা নিজ গৃহে শরাব পান করার চেয়ে বেশী ভয়াবহ অপরাধ এবং এর শাস্তিও বেশী কঠোর। মাহরাম নারীদের সাথে যিনা করা অন্য নারীদের সাথে যিনা করার তুলনায় বেশী গোনাহের কাজ এবং এজন্য শাস্তিও হবে বেশী কঠিন।
﴿يَـٰنِسَآءَ ٱلنَّبِىِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍۢ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ ۚ إِنِ ٱتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِٱلْقَوْلِ فَيَطْمَعَ ٱلَّذِى فِى قَلْبِهِۦ مَرَضٌۭ وَقُلْنَ قَوْلًۭا مَّعْرُوفًۭا﴾
৩২। হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও।৪৬ যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করে থাকো, তাহলে মিহি স্বরে কথা বলো না, যাতে মনের গলদে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে, বরং পরিষ্কার সোজা ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলো।৪৭
৪৬. এখান থেকে শেষ প্যারা পর্যন্ত আয়াত গুলোর মাধ্যমে ইসলামে পরদা সংক্রান্ত বিধানের সূচনা করা হয়েছে। এ আয়াত গুলোতে নবী সা. এর স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত মুসলিম পরিবারে এ সংশোধনীগুলো প্রবর্তন করা। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণকে সম্বোধন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, যখন নবী সা. এর গৃহ থেকে এ পবিত্র জীবন ধারার সূচনা হবে তখন অন্যান্য সকল মুসলিম গৃহের মহিলারা আপনা আপনিই এর অনুসরণ করতে থাকবে। কারণ এ গৃহটিই তাদের জন্য আদর্শ ছিল। এ আয়াত গুলোতে নবী সা. এর স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে কেবলমাত্র এরই ভিত্তিতে কেউ কেউ দাবী করে বসেছেন যে, এ বিধানগুলো কেবলমাত্র তাঁদের সাথেই সংশ্লিষ্ট। কিন্তু সামনের দিকে এ আয়াত গুলোতে যা কিছু বলা হয়েছে তা পাঠ করে দেখুন। এর মধ্যে কোন টি এমন যা শুধুমাত্র নবীর সা.পবিত্র স্ত্রীদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং বাকি মুসলমান নারীদের জন্য কাংখিত নয়? কেবলমাত্র নবীর স্ত্রীগণই আবর্জনামুক্ত নিষ্কলুষ জীবন যাপন করবেন, তাঁরাই আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবেন, নামায তাঁরাই পড়বেন এবং যাকাত তাঁরাই দেবেন, আল্লাহর উদ্দেশ্য কি এটাই হতে পারতো? যদি এ উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব না হতো, তাহলে গৃহকোণে নিশ্চিন্তে বসে থাকা, জাহেলী সাজসজ্জা থেকে দূরে থাকা এবং ভিন্ন পুরুষদের সাথে মৃদুস্বরে কথা বলার হুকুম একমাত্র তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং অন্যান্য সমস্ত মুসলিম নারীরা তা থেকে আলাদা হতে পারে কেমন করে? একই কথার ধারাবাহিকতায় বিধৃত সামগ্রিক বিধানের মধ্য থেকে কিছু বিধিকে বিশেষ শ্রেণীর মানুষের জন্য নির্দিষ্ট ও কিছু বিধিকে সর্বসাধারণের পালনীয় গণ্য করার পেছনে কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তি আছে কি? আর “তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও” এ বাক্যটি থেকেও এ অর্থ বুঝায় না যে, সাধারণ নারীদের সাজসজ্জা করে বাইরে বের হওয়া এবং ভিন্ন পুরুষদের সাথে খুব ঢলাঢলি করে কথাবার্তা বলা উচিত। বরং এ কথাটা কিছুটা এমনি ধরনের যেমন এক ভদ্রলোক নিজের সন্তানদেরকে বলে, “তোমরা বাজারের ছেলেমেয়েদের মত নও। তোমাদের গালাগালি না করা উচিত।” এ থেকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ও বক্তা এ উদ্দেশ্য আবিষ্কার করবে না যে, সে কেবলমাত্র নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য গালি দেয়াকে খারাপ মনে করে, অন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে এ দোষ থাকলে তাতে তার কোন আপত্তি নেই।
৪৭. অর্থাৎ প্রয়োজন হলে কোন পুরুষের সাথে কথা বলতে বাধা নেই কিন্তু এ সময় নারীর কথা বলার ভংগী ও ধরন এমন হতে হবে যাতে আলাপকারী পুরুষের মনে কখনো এ ধরনের কোন চিন্তার উদয় না হয় যে, এ নারীটির ব্যাপারে অন্য কিছু আশা করা যেতে পারে। তার বলার ভংগীতে কোন নমনীয়তা থাকবে না। তার কথায় কোন মনমাতানো ভাব থাকবে না। সে সজ্ঞানে তার স্বরে মাধুর্য সৃষ্টি করবে না, যা শ্রবণকারী পুরুষের আবেগকে উদ্বেলিত করে তাকে সামনে পা বাড়াবার প্ররোচনা দেবে ও সাহস যোগাবে। এ ধরনের কথাবার্তা সম্পর্কে আল্লাহ পরিষ্কার বলেন, এমন কোন নারীর পক্ষে এটা শোভনীয় নয়, যার মনে আল্লাহ ভীতি ও অসৎকাজ থেকে দূরে থাকার প্রবণতা রয়েছে। অন্যকথায় বলা যায়, এটা দুশ্চরিত্রা ও বেহায়া নারীদের কথা বলার ধরন, মু’মিন ও মুত্তাকী নারীদের নয়। এই সাথে সূরা আন নূরের নিম্নোক্ত আয়াতটিও সামনে রাখা দরকার وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ (আর তারা যেন যমীনের ওপর এমনভাবে পদাঘাত করে না চলে যার ফলে যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের গোচরীভূত হয়।) এ থেকে মনে হয় বিশ্ব-জাহানের রবের পরিষ্কার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, নারীরা যেন অযথা নিজেদের স্বর ও অলংকারের ধ্বনি অন্য পুরুষদেরকে না শোনায় এবং যদি প্রয়োজনে অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে হয়, তাহলে পূর্ণ সতর্কতা সহকারে বলতে হবে। এজন্য নারীদের আযান দেয়া নিষেধ। তাছাড়া জামায়াতের নামাযে যদি কোন নারী হাজির থাকে এবং ইমাম কোন ভুল করেন তাহলে পুরুষের মতো তার সুবহানাল্লাহ বলার অনুমতি নেই, তার কেবলমাত্র হাতের ওপর হাত মেরে আওয়াজ সৃষ্টি করতে হবে যাতে ইমাম সতর্ক হয়ে যান।
এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে যে, দ্বীন নারীকে ভিন্ পুরুষের সাথে কোমল স্বরে কথা বলার অনুমতি দেয় না এবং পুরুষদের সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলতেও তাদেরকে নিষেধ করে, সে কি কখনো নারীর মঞ্চে এসে নাচগান করা, বাজনা বাজানো ও রঙ্গরস করা পছন্দ করতে পারে? সে কি রেডিও-টেলিভিশনে নারীদের প্রেমের গান গেয়ে এবং সুমিষ্ট স্বরে অশ্লিল রচনা শুনিয়ে লোকদের আবেগকে উত্তেজিত করার অনুমতি দিতে পারে? নারীরা নাটকে কখনো কারো স্ত্রীর এবং কখনো কারো প্রেমিকার অভিনয় করবে, এটাকে কি সে বৈধ করতে পারে? অথবা তাদেরকে বিমানবালা (Air-hostess) করা হবে এবং বিশষভাবে যাত্রীদের মন ভোলাবার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, কিংবা ক্লাবে, সামাজিক উৎসবে ও নারী-পুরুষের মিশ্র অনুষ্ঠানে তারা চমকপ্রদ সাজ-সজ্জা করে আসবে এবং পুরুষদের সাথে অবাধে মিলেমিশে কথাবার্তা ও ঠাট্টা-তামাসা করবে, এসবকে কি সে বৈধ বলবে? এ সংস্কৃতি উদ্ভাবন করা হয়েছে কোন কুরআন থেকে? আল্লাহর নাযিল করা কুরআন তো সবার সামনে আছে। সেখানে কোথাও যদি এ সংস্কৃতির অবকাশ দেখা যায় তাহলে সেখানটা চিহ্নিত করা হোক।
﴿وَقَرْنَ فِى بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ ٱلْجَـٰهِلِيَّةِ ٱلْأُولَىٰ ۖ وَأَقِمْنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعْنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجْسَ أَهْلَ ٱلْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًۭا﴾
৩৩। নিজেদের গৃহ মধ্যে অবস্থান করো।৪৮ এবং পূর্বের জাহেলী যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না।৪৯ নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। আল্লাহ তো চান, তোমাদের নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে।৫০
৪৮. মূলে বলা হয়েছে قَرْنَ কোন কোন অভিধানবিদ একে قرار শব্দ থেকে গৃহীত বলে মত প্রকাশ করেন আবার কেউ কেউ বলেন وقار থেকে গৃহীত। যদি এটি قرار থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে এর অর্থ হবে “স্থিতিবান হও” “টিকে থাকো।” আর যদি وقار থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে অর্থ হবে “শান্তিতে থাকো।”, “নিশ্চিন্তে ও স্থির হয়ে বসে উভয় অবস্থায় আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, নারীর আসল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তার গৃহ। এ বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করে তাকে নিশ্চিন্তে নিজের দায়িত্ব সম্পাদন করে যেতে হবে। কেবলমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সে গৃহের বাইরে বের হতে পারে। আয়াতের শব্দাবলী থেকেও এ অর্থ প্রকাশ হচ্ছে এবং নবী সা. এর হাদীস একে আরো বেশী সুস্পষ্ট করে দেয়। হাফেয আবু বকর বায্যার হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেনঃ নারীরা নবী কারীমের সা.কাছে নিবেদন করলো যে, পুরুষরা তো সকল শ্রেষ্ঠ মর্যাদা লুটে নিয়ে গেলো। তারা জিহাদ করে এবং আল্লাহর পথে বড় বড় কাজ করে। মুজাহিদদের সমান প্রতিদান পাবার জন্য আমরা কি কাজ করবো? জবাবে বললেনঃ
مَنْ قَعَدَةْ مِنْكُنَّ فِى بَيْتِهَا فَاِنَّهَا تَدْرِكَ عَمَلَ الْمُجَاهِدِيْن
“তোমাদের মধ্য থেকে যে গৃহমধ্যে বসে যাবে সে মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করবে।” অর্থাৎ মুজাহিদ তো তখনই স্থিরচিত্তে আল্লাহ পথে লড়াই করতে পারবে যখন নিজের ঘরের দিক থেকে সে পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে, তার স্ত্রী তার গৃহস্থালী ও সন্তানদেরকে আগলে রাখবে এবং তার অবর্তমানে তার স্ত্রী কোন অঘটন ঘটাবে না, এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত থাকবে। যে স্ত্রী তার স্বামীকে এ নিশ্চিন্ততা দান করবে সে ঘরে বসেও তার জিহাদে পুরোপুরি অংশীদার হবে। অন্য একটি হাদীস বায্যার ও তিরমিযী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি নবী সা. এর এ উক্তি বর্ণনা করেছেনঃ
ان الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ وَاَقْرَبَ مَا تَكُوْنُ بِرَوْحَةٍ رَبِّهَا وَهِى فِى قَعْرِ بَيْتِهَا
“নারী পর্দাবৃত থাকার জিনিস। যখন সে বের হয় শয়তান তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এবং তখনই সে আল্লাহর রহমতের নিকটতর হয় যখন সে নিজের গৃহে অবস্থান করে।” (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফসীর সূরা আন নূর ৪৯ টীকা)
কুরআন মজীদের এ পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হুকুমের উপস্থিতিতে মুসলমান নারীদের জন্য অবকাশ কোথায় কাউন্সিল ও পার্লামেন্টে সদস্য হবার, ঘরের বাইরে সামাজিক কাজকর্মে দৌঁড়াদৌঁড়ি করার, সরকারী অফিসে পুরুষদের সাথে কাজ করা, কলেজে ছেলেদের সাথে শিক্ষালাভ করার, পুরুষদের হাসপাতলে নার্সিংয়ের দায়িত্ব সম্পাদন করার, বিমানে ও রেলগাড়িতে যাত্রীদের সেবা করার দায়িত্বে নিয়োজিত হবার এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তাদেরকে আমেরিকায় ও ইংল্যাণ্ড পাঠাবার? নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার বৈধতার সপক্ষে সবচেয়ে যে যুক্তি পেশ করা হয় সেটি হচ্ছে এই যে, হযরত আয়েশা রা. উষ্ট্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এ যুক্তি যারা পেশ করেন তারা সম্ভবত এ ব্যাপারে স্বয়ং হযরত আয়েশার কি চিন্তা ছিল তা জানেন না। আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল যাওয়ায়েদুয যাহদ এবং ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী শাইবাহ ও ইবনে সা’দ তাঁদের কিতাবে মাসরূক থেকে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা রা. যখন কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে এ আয়াতে পৌঁছতেন (وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ) তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেঁদে ফেলতেন, এমনকি তাঁর উড়না ভিজে যেতো। করণ এ প্রসঙ্গে উষ্ট্র যুদ্ধে গিয়ে তিনি যে ভুল করেছিলেন সে কথা তাঁর মনে পড়ে যেতো।
৪৯. এ আয়াতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার জন্য এ দু’টি বুঝে নেয়া জরুরী। এর একটি হচ্ছে ‘তাবাররুজ’ এবং দ্বিতীয়টি ‘জাহেলিয়াত’।
আরবী ভাষায় ‘তাবাররুজ’ মানে হচ্ছে উন্মুক্ত হওয়া, প্রকাশ হওয়া এবং সুস্পষ্ট হয়ে সামনে এসে যাওয়া। দূর থেকে দেখা যায় এমন প্রত্যেক উঁচু ভবনকে আরবরা ‘বুরুজ’ বলে থাকে। দুর্গ বা প্রাসাদের বাইরের অংশের উচ্চ কক্ষকে এ জন্যই বুরুজ বলা হয়ে থাকে। পালতোলা নৌকার পাল দূর থেকে দেখা যায় বলে তাকে ‘বারজা’ বলা হয়, নারীর জন্য তাবাররুজ শব্দ ব্যবহার করা হলে তার তিনটি অর্থ হবে। একঃ সে তার চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য লোকদের দেখায়। দুইঃ সে তার পোশাক ও অলংকারের বহর লোকদের সামনে উন্মুক্ত করে। তিনঃ সে তার চাল-চলন ও চমক-ঠমকের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে। অভিধান ও তাফসীর বিশারদগণ এ শব্দটির এ ব্যাখ্যাই করেছেন। মুজাহিদ, কাতাদাহ ও ইবনে আবি নুজাইহ বলেন, التبرج المشى بتبخر وتكسر وتغنج “তাবাররুজের অর্থ হচ্ছে, গর্ব ও মনোরম অংগভংগী সহকারে হেলেদুলে ও সাড়ম্বরে চলা।” মুকাতিল বলেন, ابداء قلائدها وقرطها وعنقها “নিজের হার, ঘাড় ও গলা সুস্পষ্ট করা।” আল মুবাররাদের উক্তি হচ্ছেঃ ان تبدى من مناسنها مايجب عليها ستره “নারীর এমন গুণাবলী প্রকাশ করা যেগুলো তার গোপন রাখা উচিত।” আবু উবাইদাহর ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ
ان تخرج من محاسنها ماتستدهى به شهوة الرجال
“নারীর শরীর ও পোশাকের সৌন্দর্য এমনভাবে উন্মুক্ত করা যার ফলে পুরুষেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।”
জাহেলিয়াত শব্দটি কুরআন মজিদের এ জায়গা ছাড়াও আরো তিন জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। একঃ আলে ইমরানের ১৫৪ আয়াত। সেখানে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে যারা গা বাঁচিয়ে চলে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা “আল্লাহ সম্পর্কে সত্যের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের মতো ধারণা পোষণ করে।” দুইঃ সূরা আল মায়িদাহর ৫০ আয়াতে। সেখানে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে অন্য কারোর আইন অনুযায়ী ফায়সালাকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তারা কি জাহেলিয়াতের ফায়সালা চায়?” তিনঃ সূরা আল ফাতহের ২৬ আয়াতে সেখানে মক্কার কাফেররা নিছক বিদ্বেষ বশত মুসলমানদের উমরাহ করতে দেয়নি বলে তাদের এ কাজকেও “জাহেলী স্বার্থান্ধতা ও জিদ” বলা হয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে, একবার হযরত আবু দারদা করো সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে তার মাকে গালি দেন। রাসূলুল্লাহ সা.তা শুনে বলেন, “তোমার মধ্যে এখনো জাহেলিয়াত রয়ে গেছে।” অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “তিনটি কাজ জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অন্যের বংশের খোটা দেয়া, নক্ষত্রের আবর্তন থেকে ভাগ্য নির্ণয় করা এবং মৃতদের জন্য সুর করে কান্নাকাটি করা।” শব্দটির এ সমস্ত প্রয়োগ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জাহেলিয়াত বলতে ইসলামী পরিভাষায় এমন প্রত্যেকটি কার্যধারা বুঝায় যা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ইসলামী শিষ্টাচার ও নৈতিকতা এবং ইসলামী মানসিকতার বিরোধী। আর প্রথম যুগের জাহেলিয়াত বলতে এমন অসৎকর্ম বুঝায় যার মধ্যে প্রাগৈসলামিক আরবরা এবং দুনিয়ার অন্যান্য সমস্ত লোকেরা লিপ্ত ছিল।
এ ব্যাখ্যা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ নারীদেরকে যে কার্যধারা থেকে বিরত রাখতে চান তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে গৃহ থেকে বের হওয়া। তিনি তাদের আদেশ দেন, নিজেদের গৃহে অবস্থান করো। কারণ, তোমাদের আসল কাজ রয়েছে গৃহে, বাইরে নয়। কিন্তু যদি বাইরে বের হবার প্রয়োজন হয়, তাহলে এমনভাবে বের হয়ো না যেমন জাহেলী যুগে নারীরা বের হতো। প্রসাধন ও সাজ-সজ্জা করে, সুশোভন অলংকার ও আঁটসাঁট বা হালকা মিহিন পোষাকে সজ্জিত হয়ে চেহারা ও দেহের সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করে এবং গর্ব ও আড়ম্বরের সাথে চলা কোন মুসলিম সমাজের নারীদের কাজ নয়। এগুলো জাহেলিয়াতের রীতিনীতি। ইসলামে এসব চলতে পারে না। এখন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই দেখতে পারেন আমাদের দেশে যে সংস্কৃতির প্রচলন করা হচ্ছে তা কুরআনের দৃষ্টিতে ইসলামের সংস্কৃতি না জাহেলিয়াতের সংস্কৃতি? তবে হ্যাঁ, আমদের কর্মকর্তাদের কাছে যদি অন্য কোন কুরআন এসে গিয়ে থাকে, যা থেকে ইসলামের এ নতুন তত্ত্ব ও ধ্যান-ধারণা বের করে তারা মুসলমানদের মধ্যে ছড়াচ্ছেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
৫০. যে প্রেক্ষাপটে এ আয়াত নাযিল হয়েছে তা থেকে সুস্পষ্টভাবে জনা যায় যে, এখানে আহলে বায়েত বা নবী পরিবার বলতে নবী সা. এর স্ত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ সম্বোধনের সূচনা করা হয়েছে “হে নবীর স্ত্রীগণ!” বলে এবং সামনের ও পিছনের পুরো ভাষণ তাদেরকে সম্বোধন করেই ব্যক্ত হয়েছে। এছাড়াও যে অর্থে আমরা “পরিবারবর্গ” শব্দটি বলি এ অর্থে একজন লোকের স্ত্রী ও সন্তানরা সবাই এর অন্তর্ভুক্ত হয় ঠিক সেই একই অর্থে আরবী ভাষায় “আহলুল বায়েত” শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্ত্রীকে বাদ দিয়ে ‘পরিবারবর্গ’ শব্দটি কেউ ব্যবহার করে না। খোদ কুরআন মজীদেও এ জায়গা ছাড়াও আরো দু’জায়গায় এ শব্দটি এসেছে এবং সে দু’জায়গায়ও তার অর্থের মধ্যে স্ত্রী অন্তর্ভুক্তই শুধু নয়, অগ্রবর্তীও রয়েছে। সূরা হূদে যখন ফেরেশতারা হযরত ইব্রাহীমকে আ. পুত্র সন্তান লাভের সুসংবাদ দেন তখন তাঁর স্ত্রী তা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন এই বলে যে, এ বুড়ো বয়সে আমাদের আবার ছেলে হবে কেমন করে! একথায় ফেরেশতারা বলেনঃ
أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ
“তোমরা কি আল্লাহর কাজে অবাক হচ্ছো? হে এ পরিবারের লোকেরা! তোমাদের প্রতি তো আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত রয়েছে।”
সূরা আল কাসাসে যখন হযরত মূসা আ. একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু হিসেবে ফেরাউনের গৃহে পৌঁছে যান এবং ফেরাউনের স্ত্রী এমন কোন ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন যার দুধ এ শিশু পান করবে তখন হযরত মূসার বোন গিয়ে বলেনঃ
هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى أَهْلِ بَيْتٍ يَكْفُلُونَهُ لَكُم
“আমি কি তোমাদের এমন পরিবারের খবর দেবো যারা তোমাদের জন্য এ শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন?”
কাজেই ভাষার প্রচলিত কথ্যরীতি, কুরআনের বর্ণনাভংগী এবং খোদ এ আয়াতটির পূর্বাপর আলোচ্য বিষয় সবকিছুই চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, নবী সা. এর আহলি বায়েতের মধ্যে তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণও আছেন এবং তাঁর সন্তানরাও আছেন। বরং বেশী নির্ভুল কথা হচ্ছে এই যে, আয়াতে মূলত সম্বোধন করা হয়েছে তাঁর স্ত্রীগণকেই এবং সন্তানরা এর অন্তর্ভুক্ত গণ্য হয়েছেন শব্দের অর্থের প্রেক্ষিতে। এ কারণে ইবনে আব্বাস রা., উরওয়া ইবনে যুবাইর রা. এবং ইকরামাহ বলেন, এ আয়াতে আহলে বায়েত বলতে নবী সা. এর স্ত্রীদেরকেই বুঝানো হয়েছে।
কিন্তু কেউ যদি বলেন, ‘আহলুল বায়েত’ শব্দ শুধুমাত্র স্ত্রীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য কেউ এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না, তাহলে একথাও ভুল হবে। ‘পরিবারবর্গ’ শব্দের মধ্যে মানুষের সকল সন্তান-সন্ততি কেবল শামিল হয় তাই নয় বরং নবী সা. নিজে সুস্পষ্টভাবে তাদের শামিল হবার কথা বলেছেন। ইবনে আবি হাতেম বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়েশাকে রা. একবার হযরত আলী রা. সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে তিনি বলেনঃ
تَسْأَلُنِىْ عَنْ رَجُلٍ كَانَ مِنْ اَحَبَّ النَّاسِ اِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانَتْ تَحْتَهُ ابْنَتَهُ وَاَحَبُّ النَّاسِ اِلَيْهِ
“তুমি আমাকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রিয়তম লোকদের অন্তর্ভুক্ত এবং যার স্ত্রী ছিলেন রাসূলের এমন মেয়ে যাকে তিনি মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন।” তারপর হযরত আয়েশা রা. এ ঘটনা শুনানঃ নবী কারীম সা.হযরত আলী ও ফাতেমা এবং হাসান ও হোসাইন রা.কে ডাকলেন এবং তাঁদের উপর একটা কাপড় ছড়িয়ে দিলেন এবং দোয়া করলেনঃ
اللَّهُمَّ هَؤُلاَءِ أَهْلُ بَيْتِى فَأَذْهِبْ عَنْهُمُ الرِّجْسَ وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا
“হে আল্লাহ এরা আমার আহলে বায়েত (পরিবারবর্গ), এদের থেকে নাপাকি দূর করে দাও এবং এদেরকে পাক-পবিত্র করে দাও।”
হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি নিবেদন করলাম, আমিও তো আপনার আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত (অর্থাৎ আমাকেও এ কাপড়ের নীচে নিয়ে আমার জন্যও দোয়া করুন) নবী কারীম সা. বলেন, “তুমি আলাদা থাকো, তুমি তো অন্তর্ভুক্ত আছোই।” প্রায় একই ধরনের বক্তব্য সম্বলিত বহু সংখ্যক হাদীস মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ, ইবনে জারীর, হাকেম, বায়হাকি প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ আবু সাঈদ খুদরী রা., হযরত আয়েশা রা., হযরত আনাস রা., হযরত উম্মে সালামাহ রা., হযরত ওয়াসিলাহ ইবন আসকা’ এবং অন্যান্য কতিপয় সাহাবা থেকে বর্ণনা করেছেন। সেগুলো থেকে জানা যায়, নবী সা.হযরত আলী রা., ফাতেমা রা. এবং তাদের দু’টি সন্তানকে নিজের আহলে বায়েত গণ্য করেন। কাজেই যাঁরা তাঁদেরকে আহলে বায়েতের বাইরে মনে করেন তাদের চিন্তা ভুল।
অনুরূপভাবে যার উপরোক্ত হাদীসগুলোর ভিত্তিতে রাসূলের পবিত্র স্ত্রীগণকে আহলে বায়েতের বাইরে গণ্য করেন তাদের মতও সঠিক নয়। প্রথমত যে বিষয়টি সরাসরি কুরআন থেকে প্রমাণিত, তাকে কোন হাদীসের ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলোর অর্থও তা নয় যা সেগুলো থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এগুলোর কোন কোনটিতে এই যে কথা এসেছে যে, হযরত আয়েশা রা. ও হযরত উম্মে সালামাকে রা. নবী সা.সেই চাদরের নীচে নেননি যার মধ্যে হযরত আলী, ফতেমা, হাসান ও হোসাইনকে নিয়েছিলেন, এর অর্থ এ নয় যে, তিনি তাঁদেরকে নিজের ‘পরিবারের’ বাইরে গণ্য করেছিলেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, স্ত্রীগণ তো পরিবারের অন্তর্গত ছিলেনই। কারণ কুরআন তাঁদেরকেই সম্বোধন করেছিল। কিন্তু নবী কারীমের সা. আশঙ্কা হলো, এ চারজন সম্পর্কে কুরআনের বাহ্যিক অর্থের দিক দিয়ে কারো যেন ভুল ধারণা না হয়ে যায় যে, তাঁরা আহলে বায়েতের বাইরে আছেন, তাই তিনি পবিত্র স্ত্রীগণের পক্ষে নয়, তাঁদের পক্ষে ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করেন।
একটি দল এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শুধুমাত্র এতটুকু বাড়াবাড়ি করেই ক্ষান্ত থাকেননি যে, পবিত্র স্ত্রীগণকে আহলে বায়েত থেকে বের করে দিয়ে কেবলমাত্র হযরত আলী রা., ফাতেমা রা. ও তাঁদের দু’টি সন্তানকে এর মধ্যে শামিল করেছেন বরং এর ওপর এভাবে আরো বাড়াবাড়ি করেছেন যে, “আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে ময়লা দূর করে তোমাদের কে পুরোপুরি পবিত্র করে দিতে” কুরআনের এ শব্দগুলো থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, হযরত আলী, ফাতেমা এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততি আম্বিয়া আ. গণের মতোই মাসূম তথা গোনাহমুক্ত নিষ্পাপ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘ময়লা’ অর্থ ভ্রান্তি ও গোনাহ এবং আল্লাহর উক্তি অনুযায়ী আহলে বায়েতকে এগুলো থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। অথচ আয়াতে একথা বলা হয়নি যে, তোমাদের থেকে ময়লা দূর করে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করা হয়েছে। বরং বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক পবিত্র করতে চান। পূর্বাপর আলোচনাও এখানে আহলে বায়েতের মর্যাদা বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য একথা বলে না। বরং এখানে তো আহলে বায়েতকে এ মর্মে নসিহত করা হয়েছে, তোমরা অমুক কাজ করো এবং অমুক কাজ করো না কারণ আল্লাহ তোমাদের পাক পবিত্র করতে চান। অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা অমুক নীতি অবলম্বন করলে পবিত্রতার নিয়ামতে সমৃদ্ধ হবে অন্যথায় তা লাভ করতে পারবে না। তবুও যদি يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ…… وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا এর অর্থ এ নেয়া হয় যে, আল্লাহ তাঁদেরকে নিষ্পাপ করে দিয়েছেন, তাহলে অযু, গোসল ও তায়াম্মুমকারী প্রত্যেক মুসলমানকে নিষ্পাপ বলে মেনে না নেয়ার কোন কারণ নেই। কারণ তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَكِنْ يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ
“কিন্তু আল্লাহ চান তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করে দিতে এবং তাঁর নিয়ামত তোমাদের উপর পূর্ণ করে দিতে।” (আল মায়িদাহঃ ৬)
﴿وَٱذْكُرْنَ مَا يُتْلَىٰ فِى بُيُوتِكُنَّ مِنْ ءَايَـٰتِ ٱللَّهِ وَٱلْحِكْمَةِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا﴾
৩৪। আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের যেসব কথা তোমাদের গৃহে শুনানো হয়।৫১ তা মনে রেখো। অবশ্যই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী৫২ ও সর্ব অবহিত।
৫১. মূলে وَاذْكُرْنَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দু’টি অর্থঃ “মনে রেখো” এবং বর্ণনা করো। প্রথম অর্থের দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য এই দাঁড়ায়ঃ হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কখনো ভুলে যেয়ো না যে, যেখান থেকে সারা দুনিয়াকে আল্লাহর আয়াত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দেয়া হয় সেটিই তোমাদের আসল গৃহ। তাই তোমাদের দায়িত্ব বড়ই কঠিন। লোকেরা এ গৃহে জাহিলিয়াতের আদর্শ দেখতে থাকে, এমন যেন না হয়। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হয়ঃ হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা যা কিছু শোনো এবং দেখো তা লোকদের সামনে বর্ণনা করতে থাকো। কারণ রাসূলের সাথে সার্বক্ষণিক অবস্থানের কারণে এমন অনেক বিধান তোমাদের গোচরীভূত হবে যা তোমাদের ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে লোকদের জানা সম্ভব হবে না।
এ আয়াতে দু’টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। একঃ আল্লাহর আয়াত, দুইঃ হিকমাত বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আল্লাহর আয়াত অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কিতাবের আয়াত। কিন্তু হিকমাত শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। সকল প্রকার জ্ঞানের কথা এর অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো নবী সা.লোকদেরকে শেখাতেন। আল্লাহর কিতাবের শিক্ষার ওপরও এ শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র তার মধ্যেই একে সীমিত করে দেবার সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। কুরআনের আয়াত শুনানো ছাড়াও নবী সা. নিজের পবিত্র জীবন ও নৈতিক চরিত্র এবং নিজের কথার মাধ্যমে যে হিকমাতের শিক্ষা দিতেন তাও অপরিহার্যভাবে এর অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ কেবলমাত্র এরই ভিত্তিতে যে আয়াতে مَا يُتْلَى (যা তেলাওয়াত করা হয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এ দাবী করেন যে আল্লাহর আয়াত ও হিকমাত মানে হচ্ছে কেবলমাত্র কুরআন। কারণ ‘তেলাওয়াত’ শব্দটি একমাত্র কুরআন তেলাওয়াতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এ যুক্তি একবারেই ভ্রান্ত। তেলওয়াত শব্দটি পারিভাষিকভাবে একমাত্র কুরআন বা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেয়া পরবর্তীকালের লোকদের কাজ। কুরআনে এ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। সূরা আল বাকারাহ-এর ১০২ আয়াতে এ শব্দটিকেই যাদুমন্ত্রের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। শয়তানরা হযরত সুলাইমানের নামের সাথে জড়িত করে এ মন্ত্রগুলো লোকদেরকে তেলাওয়াত করে শুনাতোঃ
وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ
“তারা অনুসরণ করে এমন এক জিনিসের যা তেলাওয়াত করতো অর্থাৎ যা শুনাতো শয়তানরা সুলাইমানের বাদশাহীর সাথে জড়িত করে”–থেকে স্পষ্টত প্রমাণিত হয়, কুরআন এ শব্দটিকে এর শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করে। আল্লাহর কিতাবের আয়াত শুনাবার জন্য পারিভাষিকভাবে এক নির্দিষ্ট করে না।
৫২. আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী অর্থাৎ গোপনে এবং অতিসঙ্গোপনে রাখা কথাও তিনি জানতে পারেন। কোন জিনিসই তাঁর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যেতে পারে না।
﴿إِنَّ ٱلْمُسْلِمِينَ وَٱلْمُسْلِمَـٰتِ وَٱلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتِ وَٱلْقَـٰنِتِينَ وَٱلْقَـٰنِتَـٰتِ وَٱلصَّـٰدِقِينَ وَٱلصَّـٰدِقَـٰتِ وَٱلصَّـٰبِرِينَ وَٱلصَّـٰبِرَٰتِ وَٱلْخَـٰشِعِينَ وَٱلْخَـٰشِعَـٰتِ وَٱلْمُتَصَدِّقِينَ وَٱلْمُتَصَدِّقَـٰتِ وَٱلصَّـٰٓئِمِينَ وَٱلصَّـٰٓئِمَـٰتِ وَٱلْحَـٰفِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَٱلْحَـٰفِظَـٰتِ وَٱلذَّٰكِرِينَ ٱللَّهَ كَثِيرًۭا وَٱلذَّٰكِرَٰتِ أَعَدَّ ٱللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةًۭ وَأَجْرًا عَظِيمًۭا﴾
৩৫। একথা সুনিশ্চিত যে,৫৩ যে পুরুষ ও নারী মুসলিম,৫৪ মু’মিন,৫৫ হুকুমের অনুগত,৫৬ সত্যবাদী,৫৭ সবরকারী,৫৮ আল্লাহর সামনে বিনত,৫৯ সাদকাদানকারী,৬০ রোযা পালনকারী,৬১ নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী৬২ এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণকারী৬৩ আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত এবং প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।৬৪
৫৩. পিছনের প্যারাগ্রাফের পরপরই এ বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে এই মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ওপরে রাসূলের সা.পবিত্র স্ত্রীগণকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা কেবলমাত্র তাঁদের জন্যই নির্দিষ্ট নয় বরং মুসলিম সমাজের সামগ্রিক সংশোধন কাজ সাধারণভাবে এসব নির্দেশ অনুযায়ীই করতে হবে।
৫৪. অর্থাৎ যারা নিজেদের জন্য ইসলামকে জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং এখন জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এ বিধানের অনুসারী হবার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত করে নিয়েছে। অন্য কথায়, যাদের মধ্যে ইসলাম প্রদত্ত চিন্তাপদ্ধতি ও জীবনধারার বিরুদ্ধে কোন রকমের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতার লেশমাত্র নেই। বরং তারা তার পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের পথ অবলম্বন করেছে।
৫৫. অর্থাৎ যাদের এ আনুগত্য নিছক বাহ্যিক নয়, গত্যন্তর নেই, মন চায় না তবুও করছি, এমন নয়। বরং মন থেকেই তারা ইসলামের নেতৃত্বকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। চিন্তা ও কর্মের যে পথ কুরআন ও মুহাম্মাদ সা.দেখিয়েছেন সেটিই সোজা ও সঠিক পথ এবং তারই অনুসরণের মধ্যে আমাদের সাফল্য নিহিত, এটিই তাদের ঈমান। যে জিনিসকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভুল বলে দিয়েছেন তাদের নিজেদের মতেও সেটি নিশ্চিতই ভুল। আর তাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.সত্য বলে বলে দিয়েছেন তাদের নিজেদের মন-মস্তিষ্কও তাকেই সত্য বলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে। তাদের চিন্তা ও মানসিক অবস্থা এমন নয়। কুরআন ও সুন্নাত থেকে যে হুকুম প্রমাণিত হয় তাকে তারা অসঙ্গত মনে করতে পারে এবং এ চিন্তার বেড়াজালে এমনভাবে আটকে যেতে পারে যে, কোন প্রকারে তাকে পরিবর্তিত করে নিজেদের মন মাফিক করে নেবে অথবা দুনিয়ার প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে তাকে ঢালাইও করে নেবে আবার এ অভিযোগও নিজেদের মাথায় নেবে না যে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম কাটছাঁট করে নিয়েছি। হাদীসে নবী সা.ঈমানের সঠিক অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
ذَاقَ طَعْمَ الإِيمَانِ مَنْ رَضِىَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً
“ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে তার রব, ইসলামকে তার দ্বীন এবং মুহাম্মাদকে তার রাসূল বলে মেনে নিতে রাজি হয়ে গেছে।” (মুসলিম)
অন্য একটি হাদীসে তিনি এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেনঃ
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا جِئْتَ بِهِ
“তোমাদের কোন ব্যক্তি মু’মিন হয় না যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমি যা এনেছি তার অনুগত হয়ে যায়।” (শারহুস সুন্নাহ)
৫৬. অর্থাৎ তারা নিছক মেনে নিয়ে বসে থাকার লোক নয়। বরং কার্যত আনুগত্যকারী। তাদের অবস্থা এমন নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে কাজের হুকুম দিয়েছেন তাকে সত্য বলে মেনে নেবে, ঠিকই কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন নিজেরা আন্তরিকভাবে সেগুলোকে খারাপ মনে করবে কিন্তু নিজেদের বাস্তব জীবনে সেগুলোই করে যেতে থাকবে।
৫৭. অর্থাৎ নিজেদের কথায় যেমন সত্য তেমনি ব্যবহারিক কার্যকলাপেও সত্য। মিথ্যা, প্রতারণা, অসৎ উদ্দেশ্য, ঠগবৃত্তি ও ছলনা তাদের জীবনে পাওয়া যায় না। তাদের বিবেক যা সত্য বলে জানে মুখে তারা তাই উচ্চারণ করে। তাদের মতে যে কাজ ঈমানদারীর সাথে সত্য ও সততা অনুযায়ী হয় সে কাজই তারা করে। যার সাথেই তারা কোন কাজ করে বিশ্বস্ততা ও ঈমানদারীর সাথে করে।
৫৮. অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত সোজা সত্য পথে চলার এবং আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠত করার পথে যে বাঁধাই আসে, যে বিপদই দেখা দেয়, যে কষ্টই সহ্য করতে হয় এবং যে সমস্ত ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়, দৃঢ়ভাবে তারা তার মোকাবিলা করে। কোন প্রকার ভীতি, লোক ও প্রবৃত্তির কামনার কোন দাবী তাদেরকে সোজা পথ থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয় না।
৫৯. অর্থাৎ তারা দম্ভ, অহংকার ও আত্মম্ভরীতামুক্ত। তারা এ সত্যের পূর্ণ সচেতন অনুভূতি রাখে যে, তারা বান্দা এবং বন্দেগীর বাইরে তাদের কোন মর্যাদা নেই। তাই তাদের দেহ ও অন্তরাত্মা উভয়ই আল্লাহর সামনে নত থাকে। আল্লাহ ভীতি তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। আত্ম অহমিকায় মত্ত আল্লাহভীতি শূন্য লোকদের থেকে যে ধরনের মনোভাব প্রকাশিত হয় এমন কোন মনোভাব কখনো তাদের থেকে প্রকাশিত হয় না। আয়াতের বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে জানা যায়, এখানে এ সাধারণ আল্লাহভীতি মূলক মনোভাবের সাথে বিশেষ ভাবে ‘খুশু’ বা বিনত হওয়া শব্দ ব্যবহার করায় এর অর্থ হয় নামায। কারণ এরপরই সাদকাহ ও রোযার কথা বলা হয়েছে।
৬০. এর অর্থ কেবল ফরয যাকাত আদায় করাই নয় বরং সাধারণ দান-খয়রাতও এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা আল্লাহর পথে উন্মুক্ত হৃদয়ে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে। আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য করার ব্যাপারে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাতে তারা কসুর করে না। কোন এতিম, রুগ্ন, বিপদাপন্ন, দুর্বল, অক্ষম, গরীব ও অভাবী ব্যক্তি তাদের লোকালয়ে তাদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত থাকে না। আর আল্লাহর দ্বীনকে সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন হলে তার জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে তারা কখনো কার্পণ্য করে না।
৬১. ফরয ও নফল উভয় ধরনের রোযা এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
৬২. এর দু’টি অর্থ হয়। একটি হচ্ছে, তারা যিনা থেকে দূরে থাকে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তারা উলংগতাকে এড়িয়ে চলে। এই সাথে এটাও বুঝে নিতে হবে যে, কেবলমাত্র মানুষের পোশাক না পরে উলংগ হয়ে থাকাকে উলংগতা বলে না বরং এমন ধরনের পোশাক পরাও উলংগতার অন্তর্ভুক্ত, যা এতটা সূক্ষ্ম হয় যে, তার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় অথবা এমন চোস্ত ও আঁটসাঁট হয় যার ফলে তার সাহায্যে দৈহিক কাঠামো ও দেহের উঁচু-নীচু অংগ সবই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
৬৩. আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে, জীবনের সকল কাজেকর্মে সমস্ত ব্যাপারেই সবসময় যেন মানুষের মুখে আল্লাহর নাম এসে যায়। মানুষের মনে আল্লাহর চিন্তা পুরোপুরি ও সর্বব্যাপী আসন গেঁড়ে না বসা পর্যন্ত এ ধরনের অবস্থা তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। মানুষের চেতনার জগত অতিক্রম করে যখন অচেতন মনের গভীরদেশেও এ চিন্তা বিস্তৃত হয়ে যায় তখনই তার অবস্থা এমন হয় যে, সে কোন কথা বললে বা কোন কাজ করলে তার মধ্যে আল্লাহর নাম অবশ্যই এসে যাবে। আহার করলে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করবে। আহার শেষ করবে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে। আল্লাহকে স্মরণ করে ঘুমাবে এবং ঘুম ভাঙবে আল্লাহর নাম নিতে নিতে। কথাবার্তায় তার মুখে বারবার বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ এবং এ ধরনের অন্য শব্দ ও বাক্য বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে। প্রত্যেক ব্যাপারে বারবার সে আল্লাহর সাহায্য চাইবে। প্রত্যেকটি নিয়ামত লাভ করার পর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। প্রত্যেকটি বিপদ আসার পর তাঁর রহমতের প্রত্যাশী হবে। প্রত্যেক সংকটে তাঁর দিকে মুখ ফিরাবে। কোন খারাপ কাজের সুযোগ এলে তাঁকে ভয় করবে। কোন ভুল বা অপরাধ করলে তাঁর কাছে মাফ চাইবে। প্রত্যেকটি প্রয়োজন ও অভাবের মুহূর্তে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে। মোটকথা উঠতে বসতে এবং দুনিয়ার সমস্ত কাজকর্মে আল্লাহর স্মরণ হয়ে থাকবে তার কণ্ঠলগ্ন। এ জিনিসটি আসলে ইসলামী জীবনের প্রাণ। অন্য যে কোন ইবাদাতের জন্য কোন না কোন সময় নির্ধাতির থাকে এবং তখনই তা পালন করা হয়ে থাকে এবং তা পালন করার পর মানুষ তা থেকে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু এ ইবাদাতটি সর্বক্ষণ জারী থাকে এবং এটিই আল্লাহ ও তাঁর বন্দেগীর সাথে মানুষের জীবনের স্থায়ী সম্পর্ক জুড়ে রাখে। মানুষের মন কেবলমাত্র এসব বিশেষ কাজের সময়েই নয় বরং সর্বক্ষণ আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট এবং তার কণ্ঠ সর্বক্ষণ তাঁর স্মরণে সিক্ত থাকলেই এরই মাধ্যমেই ইবাদাত ও অন্যান্য দ্বীনী কাজে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। মানুষের মধ্যে যদি এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার জীবনে ইবাদাতও দ্বীনী কাজ ঠিক তেমনিভাবে বুদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে যেমন একটি চারাগাছকে তার প্রকৃতির অনুকূল আবহাওয়ায় রোপণ করা হলে তা বেড়ে উঠে। পক্ষান্তরে যে জীবন আল্লাহর এ সার্বক্ষণিক স্মরণ শূন্য থাকে সেখানে নিছক বিশেষ সময়ে অথবা বিশেষ সুযোগে অনুষ্ঠিত ইবাদাত ও দ্বীনী কাজের দৃষ্টান্ত এমন একটি চারাগাছের মতো যাকে তার প্রকৃতির প্রতিকূল আবহাওয়ায় রোপণ করা হয় এবং নিছক বাগানের মালির বিশেষ তত্ত্বাবধানের কারণে বেঁচে থাকে। একথাটিই নবী সা.একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
عَنْ مُعَاذبن انس الجهنى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّ رَجُلاً سَأَلَهُ اىُّ الْمجاهدِين أَعْظَمُ أَجْراً يَا رسول الله؟ قَالَ أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ تَعَالَى ذِكْراً- قَالَ َأَىُّ الصَّائِمِينَ اكثر أَجْراً؟ قَالَ أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ عز وجل ذِكْراً – ثُمَّ ذَكَرَ الصَّلاَةَ وَالزَّكَاةَ وَالْحَجَّ وَالصَّدَقَةَ كُلُّ ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَكْثَرُهُمْ لِلَّهِ ذِكْراً
“মুআ’য ইবনে আনাস জুহানী বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! জিহাদকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিদান লাভ করবে কে? জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে স্মরণ করবে। তিনি নিবেদন করেন, রোযা পালনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রতিদান পাবে কে? জবাব দিলেন, যে তাদের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করবে। আবার তিনি একই ভাবে নামায, যাকাত, হ্জ্জ ও সাদকা আদায়কারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। জবাবে নবী কারীম সা. বলেন, “যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করে।” (মুসনাদে আহমাদ)
৬৪. আল্লাহর দরবারে কোন গুণাবলীকে আসল মূল্য ও মর্যাদা দেয়া হয় এ আয়াতে তা বলে দেয়া হয়েছে। এগুলো ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ। একটি বাক্যে এগুলোকে একত্র সংযোজিত করে দেয়া হয়েছে। এ মূল্যবোধগুলোর প্রেক্ষিতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন ফারাক নেই। কাজের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে উভয় দলের কর্মক্ষেত্র আলাদা। পুরুষদের জীবনের কিছু বিভাগে কাজ করতে হয়। নারীদের কাজ করতে হয় ভিন্ন কিছু বিভাগে। কিন্তু এ গুণাবলী যদি উভয়ের মধ্যে সমান থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে উভয়ের মর্যাদা সমান এবং উভয়ের প্রতিদানও সমান হবে। একজন রান্নঘর ও গৃহস্থালী সামলালো এবং অন্যজন খেলাফতের মসনদে বসে শরীয়তের বিধান জারী করলো আবার একজন গৃহে সন্তান লালন-পালন করলো এবং অন্যজন যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করলে–এ জন্যে উভয়ের মর্যাদা ও প্রতিদানে কোন পার্থক্য দেখা দেবে না।
﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍۢ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَـٰلًۭا مُّبِينًۭا﴾
৩৬। যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীর৬৫ সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোন অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।৬৬
৬৫. হযরত যয়নবের রা. সাথে নবী সা.এর বিবাহ প্রসঙ্গে যে আয়াত নাযিল হয়েছিল এখান থেকেই তা শুরু হচ্ছে।
৬৬. ইবনে আব্বাস রা., মুজাহিদ, কাতাদাহ, ইকরামাহ ও মুকাতিল ইবনে হাইয়ান বলেন, এ আয়াত তখন নাযিল হয়েছিল যখন নবী সা.হযরত যায়েদের রা. জন্য হযরত যয়নবের রা. সাথে বিয়ের পয়গাম দিয়েছিলেন এবং হযরত যয়নব ও তাঁর আত্মীয়রা তা নামঞ্জুর করেছিলেন। ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন, নবী সা.যখন এ পয়গাম দেন তখন হযরত যয়নব রা. বলেনঃ انا خير منه نسبا “আমি তার চেয়ে উচ্চ বংশীয়া” ইবনে সা’দ বর্ণনা করেছেন, তিনি জবাবে একথাও বলেছিলেনঃ لارضاه لنفسى وانا ايم قريش “আমি অভিজাত কুরাইশ পরিবারের মেয়ে, তাই আমি তাকে নিজের জন্য পছন্দ করি না।” তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশও রা. এ ধরনের অসম্মতি প্রকাশ করেছিলেন। এর কারণ ছিল এই যে, হযরত যায়েদ নবী সা.এর আযাদ করা গোলাম ছিলেন এবং হযরত যয়নব ছিলেন তাঁর ফুফু (উমাইমাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব)-এর কন্যা। এত উঁচু ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, তাও আবার যা তা পরিবার নয়, নবীর নিজের ফুফাত বোন এবং তার বিয়ের পয়গাম তিনি দিচ্ছিলেন নিজের আযাদ করা গোলামের সাথে একথা তাদের কাছে অত্যন্ত খারাপ লাগছিল। এজন্য এ আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াত শুনতেই হযরত যয়নব ও তাঁর পরিবারের সবাই নির্দ্বিধায় আনুগত্যের শির নত করেন। এরপর নবী সা.তাদের বিয়ে পড়ান। তিনি নিজে হযরত যায়েদের রা. পক্ষ থেকে ১০ দ্বীনার ও ৬০ দিরহাম মোহরানা আদায় করেন, কনের কাপড় চোপড় দেন এবং কিছু খাবার দাবারের জিনিসপত্র পাঠান।
এ আয়াত যদিও একটি বিশেষ সময়ে নাযিল হয় কিন্তু এর মধ্যে যে হুকুম বর্ণনা করা হয় তা ইসলামী আইনের একটি বড় মূলনীতি এবং সমগ্র ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ওপর এটি প্রযুক্ত হয়। এর দৃষ্টিতে যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে কোন হুকুম প্রমাণিত হয় সে বিষয়ে কোন মুসলিম ব্যক্তি, জাতি, প্রতিষ্ঠান, আদালত, পার্লামেন্ট বা রাষ্ট্রের নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার করার কোন অধিকার নেই। মুসলমান হবার অর্থই হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে নিজের স্বাধীন ইখতিয়ার বিসর্জন দেয়া। কোন ব্যক্তি বা জাতি মুসলমানও হবে আবার নিজের জন্য এ ইখতিয়ারটিও সংরক্ষিত রাখবে। এ দু’টি বিষয় পরস্পর বিরোধী-এ দু’টি কাজ এক সাথে হতে পারে না। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ দু’টি দৃষ্টিভংগীকে একত্র করার ধারণা করতে পারে না। যে ব্যক্তি মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকতে চায় তাকে অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে আনুগত্যের শির নত করতে হবে। আর যে মুসলমান নয়। যদি সে না মানে তাহলে নিজেকে মুসলমান বলে যত জোরে গলা ফটিয়ে চিৎকার করুক না কেন আল্লাহ ও বান্দা উভয়ের দৃষ্টিতে সে মুনাফিকই গণ্য হবে।
﴿وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِىٓ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَٱتَّقِ ٱللَّهَ وَتُخْفِى فِى نَفْسِكَ مَا ٱللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى ٱلنَّاسَ وَٱللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَىٰهُ ۖ فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌۭ مِّنْهَا وَطَرًۭا زَوَّجْنَـٰكَهَا لِكَىْ لَا يَكُونَ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌۭ فِىٓ أَزْوَٰجِ أَدْعِيَآئِهِمْ إِذَا قَضَوْا۟ مِنْهُنَّ وَطَرًۭا ۚ وَكَانَ أَمْرُ ٱللَّهِ مَفْعُولًۭا﴾
৩৭। হে নবী!৬৭ স্মরণ করো, যখন আল্লাহ এবং তুমি যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলে৬৮ তাকে তুমি বলছিলে, “তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করো।”৬৯ সে সময় তুমি তোমার মনের মধ্যে যে কথা গোপন করছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন, তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহ এর বেশী হকদার যে, তুমি তাঁকে ভয় করবে।৭০ তারপর তখন তার ওপর থেকে যায়েদের সকল প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল৭১ তখন আমি সেই (তালাকপ্রাপ্তা মহিলার) বিয়ে তোমার সাথে দিয়ে দিলাম,৭২ যাতে মু’মিনদের জন্য তাদের পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে কোন প্রকার সংকীর্ণতা না থাকে যখন তাদের ওপর থেকে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।৭৩ আর আল্লাহর হুকুম তো কার্যকর হয়েই থাকে।
৬৭. এখান থেকে ৪৮ আয়াত পর্যন্তকার বিষয়বস্তু এমন সময় নাযিল হয় যখন নবী সা.হযরত যয়নবকে রা. বিয়ে করে ফেলেছিলেন এবং একে ভিত্তি করে মুনাফিক, ইহুদী ও মুশরিকরা রাসূলের বিরুদ্ধে তুমূল অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছিল। এ আয়াত গুলো অধ্যয়ন করার সময় একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। যে শত্রুরা নবী সা. বিরুদ্ধে ইচ্ছা করেই দুর্নাম রটাবার এবং নিজেদের অন্তর্জ্বালা মিটাবার জন্য মিথ্যা, অপবাদ, গালমন্দ ও নিন্দাবাদের অভিযান চালাচ্ছিল তাদেরকে বুঝাবার উদ্দেশ্যে এগুলো বলা হয়নি। বরং এর আসল উদ্দেশ্য ছিল তাদের এ অভিযানের প্রভাব থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষ করা এবং ছাড়ানো সন্দেহ-সংশয় থেকে তাদেরকে সংরক্ষিত রাখা। একথা স্পষ্ট, আল্লাহর কালাম অস্বীকারকারীদেরকে নিশ্চিন্ত করতে পারতো না। এ কালাম যদি কাউকে নিশ্চিন্ত করতে পারতো, তাহলে তারা হচ্ছে এমন সব লোক যারা একে আল্লাহর কালাম বলে জানতো এবং সে হিসেবে একে মেনে চলতো। শত্রুদের এসব আপত্তি কোনভাবে তাদের মনেও সন্দেহ-সংশয় এবং তাদের মস্তিষ্কেও জটিলতা ও সংকট সৃষ্টিতে সক্ষম না হয়ে পড়ে, সম্ভাব্য সকল সন্দেহ নিরসন করেছেন অন্যদিকে মুসলমানদেরকেও এবং স্বয়ং নবীকেও সা.এ ধরনের অবস্থায় তাদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত তা জানিয়ে দিয়েছেন।
৬৮. এখানে যায়েদের রা. কথা বলা হয়েছে। সামনের দিকে কথাটি সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ কি ছিল এবং নবী সা.এর অনুগ্রহ কি ছিল? এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য এখানে সংক্ষেপে তাঁর কাহিনীটি বর্ণনা করে দেয়া জরুরী মনে করছি। তিনি ছিলেন আসলে কালব গোত্রের হারেসা ইবনে শারাহীল নামক এক ব্যক্তির পুত্র। তাঁর মাতা সু’দা বিনতে সা’লাব ছিলেন তাঈ গোত্রের বনী মা’ন শাখার মেয়ে। তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর মা তাঁকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান। সেখানে নবী কাইন ইবনে জাসরের লোকেরা তাদের লোকালয় আক্রমণ করে এবং লুটপাট করে যেসব লোককে নিজেদের সাথে পাকড়াও করে নিয়ে যায় তাদের মধ্যে হযরত যায়েদও ছিলেন। তারা তায়েফের নিকটবর্তী উকাযের মেলায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে বিক্রি করে দেয়। হযরত খাদীজার রা. ভাতিজা হাকিম ইবনে হিযাম তাঁকে কিনে নিয়ে যান। তিনি তাঁকে মক্কায় নিয়ে এসে নিজের ফুফুর খেদমতে উপঢৌকন হিসেবে পেশ করেন। নবী সা. এর সাথে হযরত খাদীজার রা. যখন বিয়ে হয় তখন নবী কারীম সা.তাঁর কাছে যায়েদকে দেখেন এবং তাঁর চালচলন ও আদব কায়দা তাঁর এত বেশী পছন্দ হয়ে যায় যে, তিনি হযরত খাদীজার রা. কাছ থেকে তাঁকে চেয়ে নেন। এভাবে এই সৌভাগ্যবান ছেলেটি সৃষ্টির সেরা এমন এক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে যান যাঁকে কয়েক বছর পরেই মহান আল্লাহ নবীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত যায়েদের রা. বয়স ছিল ১৫ বছর। কিছুকাল পরে তাঁর বাপ চাচা জানতে পারেন তাদের ছেলে মক্কায় আছে। তারা তাঁর খোঁজ করতে করতে নবী সা. এর কাছে পৌঁছে যার। তারা বলেন, আপনি মুক্তিপণ হিসেবে যা নিতে চান বলুন আমরা তা আপনাকে দিতে প্রস্তুত আছি, আপনি আমাদের সন্তান আমাদের হাতে ফিরিয়ে দিন। নবী কারীম সা. বলেন, আমি ছেলেকে ডেকে আনছি এবং তাঁর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি, সে চাইলে আপনাদের সাথে চলে যেতে পারে এবং চাইলে আমার কাছে থাকতে পারে। যদি সে আপনাদের সাথে চলে যেতে চায় তাহলে আমি এর বিনিময়ে মুক্তি পণ হিসেবে কোন অর্থ নেবো না এবং তাঁকে এমনিই ছেড়ে দেবো। আর যদি সে আমার কাছে থাকতে চায় তাহলে আমি এমন লোক নই যে, কেউ আমার কাছে থাকতে চাইলে আমি তাকে খামখা তাড়িয়ে দেবো। জবাবে তারা বলেন, আপনি যে কথা বলেছেন তাতো ইনসাফেরও অতিরিক্ত। আপনি ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নিন। নবী কারীম সা.যায়েদকে ডেকে আনেন এবং তাঁকে বলেন, এই দু’জন ভদ্রলোককে চেনো? যায়েদ জবাব দেন, জি হ্যাঁ, ইনি আমার পিতা এবং ইনি আমার চাচা। তিনি বলেন, আচ্ছা, তুমি এদেরকেও জানো এবং আমাকেও জানো। এখন তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, তুমি চাইলে এদের সাথে চলে যেতে পারো এবং চাইলে আমার সাথে থেকে যাও। তিনি জবাব দেন, আমি আপনাকে ছেড়ে কারো কাছে যেতে চাই না। তার বাপ ও চাচা বলেন, যায়েদ, তুমি কি স্বাধীনতার ওপর দাসত্বকে প্রাধান্য দিচ্ছো এবং নিজের মা-বাপ ও পরিবার পরিজনকে ছেড়ে অন্যদের কাছে থাকতে চাও? তিনি জবাব দেন, আমি এ ব্যক্তির যে গুণাবলী দেখেছি তার অভিজ্ঞতা লাভ করার পর এখন আর দুনিয়ার কাউকেও তাঁর ওপর প্রাধান্য দিতে পারি না। যায়েদের এ জবাব শুনে তার বাপ ও চাচা সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁকে রেখে যেতে রাজি হয়ে যান। নবী সা.তখনই যায়েদকে আযাদ করে দেন এবং হারাম শরীফে গিয়ে কুরাইশদের সাধারণ সমাবেশে ঘোষণা করেন, আপনারা সবাই সাক্ষী থাকেন আজ থেকে যায়েদ আমার ছেলে, সে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং আমি তাঁর উত্তরাধিকারী হবো। এ কারণে লোকেরা তাঁকে যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলতে থাকে। এসব নবুওয়াতের পূর্বের ঘটনা। তারপর যখন নবী সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন তখন চারজন এমন ছিলেন যারা এক মুহূর্তের জন্যও কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই তাঁর মুখে নবুওয়াতের দাবী শুনতেই তাকে নবী বলে মেনে নেন। তাদের একজন হযরত খাদীজা রা., দ্বিতীয়জন হযরত যায়েদ রা., তৃতীয় জন হযরত আলী রা. এবং চতুর্থজন হযরত আবু বকর রা.। এ সময় হযরত যায়েদের রা. বয়স ছিল ৩০ বছর এবং নবী কারীমের সা.সাথে তাঁর ১৫ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। হিজরাতের পরে ৪ হিজরীতে নবী সা. নিজের ফুফাত বোনের সাথে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। নিজের পক্ষ থেকে তার মোহরানা আদায় করেন এবং ঘর-সংসার গুছিয়ে নেবার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও দেন।
এ অবস্থার প্রতিই মহান আল্লাহ তাঁর “যার প্রতি আল্লাহ ও তুমি অনুগ্রহ করেছিল” বাক্যাংশের মধ্যে ইশারা করেছেন।
৬৯. এটা সে সময়ের কথা যখন হযরত যায়েদ রা. ও হযরত যয়নবের রা. সম্পর্ক তিক্ততার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তিনি বারবার অভিযোগ করার পর শেষ পর্যন্ত নবী সা. এর কাছে নিবেদন করেন, আমি তাকে তালাক দিতে চাই। হযরত যয়নব রা. যদিও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম মেনে নিয়ে তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যান কিন্তু নিজের মন থেকে এ অনুভূতিটি তিনি কখনো মুছে ফেলতে পারেননি যে, যায়েদ একজন মুক্তিপ্রাপ্ত দাস, তাদের নিজোদের পরিবারের অনুগ্রহে লালিত এবং তিনি নিজে আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের একজন নিম্নমানের লোকের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়েছে। এ অনুভূতির কারণে দাম্পত্য জীবনে তিনি কখনো হযরত যায়েদকে নিজের সমকক্ষ ভাবেননি। এ কারণে উভয়ের মধ্যে তিক্ততা বেড়ে যেতে থাকে। এক বছরের কিছু বেশী দিন অতিবাহিত হতে না হতেই অবস্থা তালাক দেয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
৭০. কেউ কেউ এ বাক্যটির উল্টা অর্থ গ্রহণ করেছেন এভাবে, নবী সা. নিজেই হযরত যয়নবকে রা. বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং তাঁর মন চচ্ছিল হযরত যায়েদ তাকে তালাক দিয়ে দিক। কিন্তু যখন যায়েদ রা. এসে বললেন, আমি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাই তখন তিনি নাউযুবিল্লাহ আসল কথা মনের মধ্যে চেপে রেখে কেবলমাত্র মুখেই তাঁকে নিষেধ করলেন। একথায় আল্লাহ বলছেন, “তুমি মনের মধ্যে যে কথা লুকিয়ে রাখছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন।” অথচ আসল ব্যাপারটা এর সম্পূর্ণ উল্টো। যদি এ সূরার ১, ২, ৩ ও ৭ আয়াতের সাথে এ বাক্যটি মিলিয়ে পড়া হয়, তাহলে পরিষ্কার অনুভূত হবে যে, হযরত যায়েদ ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যে যে সময় তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছিল সে সময়ই আল্লাহ নবী সা.কে এ মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, যায়েদ যখন তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেবে তখন তোমাকে তার তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু যেহেতু আরবের সে সমাজে পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করার অর্থ কি তা নবী সা.জানতেন এবং তাও এমন এক অবস্থায় যখন মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক মুসলমান ছাড়া বাকি সমগ্র আরব দেশ তাঁর বিরুদ্ধে ধনুকভাঙাপণ করে বসেছিল-এ অবস্থায় তিনি এ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে ইতস্তত করছিলেন। এ কারণে হযরত যায়েদ রা. যখন স্ত্রীকে তালাক দেবার সংকল্প প্রকাশ করেন তখন নবী কারীম সা.তাঁকে বলেন আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ো না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যায়েদ যদি তালাক না দেন, তাহলে তিনি এ বিপদের মুখোমুখী হওয়া থেকে বেঁচে যাবেন। নয়তো যায়েদ তালাক দিলেই তাঁকে হুকুম পালন করতে হবে এবং তারপর তাঁর বিরুদ্ধে খিস্তি-খেউড় ও অপপ্রচারের ভয়াবহ তুফান সৃষ্টি করা হবে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে উচ্চ মনোবল, দৃঢ় সংকল্প ও আল্লাহর ফায়সালায় রাজি থাকার যে উচ্চ মর্যাদার আসনে দেখতে চাচ্ছিলেন সে দৃষ্টিতে নবী কারীমের সা.ইচ্ছা করে যায়েদকে তালাক থেকে বিরত রাখা নিম্নমানের কাজ বিবেচিত হয়। তিনি আসলে ভাবছিলেন যে, এর ফলে তিনি এমন কাজ করা থেকে বেঁচে যাবেন যাতে তাঁর দুর্নামের আশঙ্কা ছিল। অথচ আল্লাহ একটি বড় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁকে দিয়ে সে কাজটি করাতে চাচ্ছিলেন। “তুমি লোকভয় করছ অথচ আল্লাহকে ভয় করাই অধিকতর সঙ্গত”-এ কথাগুলো পরিষ্কারভাবে এ বিষয়বস্তুর দিকে ইঙ্গিত করছে।
ইমাম যয়নুল আবেদীন হযরত আলী ইবনে হোসাইন রা. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একথাই বলেছেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ নবী সা.কে এই মর্মে খবর দিয়েছিলেন যে, যয়নব রা. আপনার স্ত্রীদের মধ্যে শামিল হতে যাচ্ছেন। কিন্তু যায়েদ রা. যখন এসে তাঁর কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের স্ত্রী ত্যাগ করো না। এ কথায় আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি তোমাকে যয়নবের সাথে যয়নবের সাথে বিয়া দিচ্ছি অথচ তুমি যায়েদের সাথে কথা বলার সময় আল্লাহ যেকথা প্রকাশ করতে চান তা গোপন করছিলে। (ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর ইবনে আবী হাতেমের বরাত দিয়ে)
আল্লামা আলূসীও তাফসীর রুহল মাআ’নীতে এর একই অর্থ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “এটি হচ্ছে শ্রেয়তর কাজ পরিত্যাগ করার জন্য ক্রোধ প্রকাশ। নবী সা. নিশ্চুপ থাকতেন অথবা যায়েদকে রা. বলতেন, তুমি যা চাও করতে পারো, এ অবস্থায় এটিই ছিল শ্রেয়তর। অভিব্যক্ত ক্রোধের সারৎসার হচ্ছেঃ তুমি কেন যায়েদকে বললে তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না? অথচ আমি তোমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছি যে, যয়নব তোমার স্ত্রীদের মধ্যে শামিল হবে।”
৭১. অর্থাৎ যায়েদ রা. যখন নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং তাঁর ইদ্দত পুরা হয়ে গেলো। “প্রয়োজন পূর্ণ করলো” শব্দ গুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে একথাই প্রকাশ করে যে, তাঁর কাছে যায়েদের আর কোন প্রয়োজন থাকলো না। কেবলমাত্র তালাক দিলেই এ অবস্থাটির সৃষ্টি হয় না। কারণ স্বামীর আর কোন আকর্ষণ থেকে গেলে ইদ্দতের মাঝখানে তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। আর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়া বা না হওয়ার কথা জানতে পারার মধ্যেও স্বামীর প্রয়োজন থেকে যায়। তাই যখন ইদ্দত খতম হয়ে যায় একমাত্র তখনই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
৭২. নবী সা. নিজেই নিজের ইচ্ছায় এ বিয়ে করেননি বরং আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে করেন, এ ব্যাপারে এ শব্দগুলো একবারেই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।
৭৩. এ শব্দগুলো একথা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে যে, আল্লাহ এ কাজ নবী সা.এর মাধ্যমে এমন একটি প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য করিয়েছিলেন যা এ পদ্ধতিতে ছাড়া অন্য কোনভাবে সম্পাদিত হতে পারতো না। আরবে পালক পুত্রদের সম্পর্কিত আত্মীয়তার ব্যাপারে যে সমস্ত ভ্রান্ত রসম-রেওয়াজের প্রচলন হয়ে গিয়েছিল আল্লাহর রাসূল নিজে অগ্রসর হয়ে না ভাঙলে সেগুলো ভেঙে ফেলার ও উচ্ছেদ করার আর কোন পথ ছিল না। কাজেই আল্লাহ নিছক নবীর গৃহে আর একজন স্ত্রী বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে নয় বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য এ বিয়ে করিয়েছিলেন।
﴿مَّا كَانَ عَلَى ٱلنَّبِىِّ مِنْ حَرَجٍۢ فِيمَا فَرَضَ ٱللَّهُ لَهُۥ ۖ سُنَّةَ ٱللَّهِ فِى ٱلَّذِينَ خَلَوْا۟ مِن قَبْلُ ۚ وَكَانَ أَمْرُ ٱللَّهِ قَدَرًۭا مَّقْدُورًا﴾
৩৮। নবীর জন্য এমন কোন কাজে কোন বাঁধা নেই যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করেছেন৭৪ ইতিপূর্বে যেসব নবী অতীত হয়ে গেছেন তাদের ব্যাপারে এটিই ছিল আল্লাহর নিয়ম, আর আল্লাহর হুকুম হয় একটি চূড়ান্ত স্থিরীকৃত সিদ্ধান্ত।৭৫
৭৪. এ শব্দগুলো থেকে একথা পরিষ্কারভবে প্রকাশিত হয় যে, অন্য মুসলমানদের জন্য তো এ ধরনের বিয়ে নিছক মুবাহ তথা অনুমোদিত কাজ কিন্তু নবীর সা.জন্য এটি ছিল একটি ফরয এবং এ ফরয আল্লাহ তাঁর প্রতি আরোপ করেছিলেন।
৭৫. অর্থাৎ নবীদের জন্য চিরকাল এ বিধান নির্ধারিত রয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হুকুমই আসে তা কার্যকর করা তাঁদের জন্য স্থিরীকৃত কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনে বিরত থাকার কোন অবকাশ তাঁদের জন্য নেই। যখন আল্লাহ নিজের নবীর ওপর কোন কাজ ফরয করে দেন তখন সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগলেও তাঁকে সে কাজ করতেই হয়।
﴿ٱلَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَـٰلَـٰتِ ٱللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُۥ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا ٱللَّهَ ۗ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ حَسِيبًۭا﴾
৩৯। (এ হচ্ছে আল্লাহর নিয়ম তাদের জন্য) যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে থাকে, তাঁকেই ভয় করে এবং এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না আর হিসেব গ্রহণের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট।৭৬
৭৬. মূল শব্দগুলো হচ্ছে, وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا এর দু’টি অর্থ।
একঃ প্রত্যেকটি ভয় ও বিপদের মোকাবিলায় আল্লাহই যথেষ্ট।
দুইঃ হিসেব নেবার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তাঁর ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহির ভয় করার কোন প্রয়োজন নেই।
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٍۢ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَـٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّـۧنَ ۗ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمًۭا﴾
৪০। (হে লোকেরা!) মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে কারোর পিতা নয় কিন্তু সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী আর আল্লাহ সব জিনিসের জ্ঞান রাখেন।৭৭
৭৭. বিরোধীরা নবী সা.এর এ বিয়ের ব্যাপারে যেসব আপত্তি উঠাচ্ছিল এ একটি বাক্যের মাধ্যমে সেসবের মূলোচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছে।
তাদের প্রথম অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের পুত্রবধূকে বিয়ে করেন, অথচ তাঁর নিজের শরীয়াতেও পুত্রের স্ত্রী পিতার জন্য হারাম। এর জবাবে বলা হয়েছে, “মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন।” অর্থাৎ যে ব্যক্তির তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা হয়েছে তিনি মুহাম্মাদ সা. এর পুত্রই ছিলেন না, কাজেই তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা হারাম হবে কেন? তোমরা নিজেরাই জানো মুহাম্মাদ সা.এর আদতে কোন পুত্র সন্তানই নেই।
তাদের দ্বিতীয় আপত্তি ছিল, ঠিক আছে, পালক পুত্র যদি আসল পুত্র না হয়ে থাকে তাহলেও তার তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা বড় জোর বৈধই হতে পারতো কিন্তু তাকে বিয়ে করার এমন কি প্রয়োজন ছিল? এর জবাবে বলা হয়েছে, “কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল।” অর্থাৎ রাসূল হবার কারণে তাঁর ওপর এ দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হয়েছিল যে তোমাদের রসম-রেওআজ যে হালাল জিনিসটিকে অযথা হারাম গণ্য করে রেখেছে সে ব্যাপারে সকল রকমের স্বার্থপ্রীতির তিনি অবসান ঘটিয়ে দেবেন এবং তার হালাল হবার ব্যাপারে কোনো প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশই রাখবে না।
আবার অতিরিক্ত তাকিদ সহকারে বলা হয়েছে, “এবং তিনি শেষ নবী।” অর্থাৎ যদি কোন আইন ও সামাজিক সংস্কার তাঁর আমলে প্রবর্তিত না হয়ে থাকে তাহলে তাঁর পরে আগমনকারী নবী তার প্রবর্তন করতে পারতেন, কিন্তু তাঁর পরে আর কোন রাসূল তো দূরের কথা কোন নবীই আসবেন না। কাজেই তিনি নিজেই জাহেলিয়াতের এ রসমটির মুলোচ্ছেদ করে যাবেন, এটা আরো অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
এরপর আরো বেশী জোর দিয়ে বলা হয়েছে, “আল্লাহ প্রত্যেটি বিষয়ের জ্ঞান রাখেন।” অর্থাৎ আল্লাহ জানেন, এ সময় মুহাম্মাদ সা.এর মাধ্যমে জাহেলিয়াতের এ রসমটির মুলোচ্ছেদ করা কেন জরুরী ছিল এবং এমনটি না করলে কি মহা অনর্থ হতো। তিনি জানেন, এখন আর তাঁর পক্ষ থেকে কোন নবী আসবেন না, কাজেই নিজের শেষ নবীর মাধ্যমে এখন যদি তিনি এ রসমটিকে উৎখাত না করেন তাহলে এমন দ্বিতীয় আর কোন সত্তাই নেই যিনি এটি ভঙ্গ করলে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্য থেকে চিরকালেন জন্য এটি মূলোৎপাটিত হয়ে যাবে। পরবর্তী সংস্কারকগণ যদি এটি ভাঙেন, তাহলে তাদের মধ্য থেকে আরো কর্মও তাঁর ইন্তিকালের পরে এমন কোন বিশ্বজনীন ও চিরন্তন কর্তৃত্বের অধিকারী হবে না যার ফলে প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক যুগের লোকেরা তার অনুসরণ করতে থাকবে এবং তাদের মধ্য থেকে কারো ব্যক্তিত্ব ও তাঁর নিজের মধ্যে এমন কোন পবিত্রতার বাহন হবে না যার ফলে তাঁর কোনো কাজ নিছক তাঁর সুন্নাত হবার কারণে মানুষের মন থেকে অপছন্দনীয়তার সকল প্রকার ধারণার মূলোচ্ছেদ করতে সক্ষম হবে।
দুঃখের বিষয়, বর্তমান যুগের একটি দল এ আয়াতটি ভুল ব্যাখ্যা করে একটি বড় ফিতনার দরোজা খুলে দিয়েছে, তাই খতমে নবুওয়াত বিষটির পূর্ণ ব্যাখ্যা এবং এ দলটির ছড়ানো বিভ্রান্তিগুলো নিরসনের জন্য আমি এ সূরার তাফসীরের শেষে একটি বিস্তারিত পরিশিষ্ট সংযোজন করে দিয়েছি।
{পরিশিষ্টঃ ৭৭ টীকার সাথে সংশ্লিষ্ট}
বর্তমান যুগে একটি দল নতুন নবুওয়াতের ফিতনা সৃষ্টি করেছে। এর “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দের অর্থ করে ‘নবীদের’ মোহর। এরা বুঝাতে চায় রাসূলুল্লাহর সা.পর তার মোহরাংকিত হয়ে আরো অনেক নবী দুনিয়ায় আগমন করবেন। অথবা অন্য কথায় বলা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত কারো নবুওয়াত রাসূলুল্লাহর মোহরাংকিত না হয় ততক্ষণ তিনি নবী হতে পারবেন না।
কিন্তু “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দ সম্বলিত আয়াতটি যে ঘটনা পরস্পরায় বিবৃত হয়েছে, তাকে সেই বিশেষ পরিবেশে রেখে বিচার করলে, তা থেকে এ অর্থ গ্রহণের কোন সুযোগই দেখা যায় না। অধিকন্তু এ অর্থ গ্রহণ করার পর এ পরিবেশে শব্দটির ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্যের ও পরিপন্হী হয়ে দাঁড়ায়।** এটা কি নিতান্ত অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক কথা নয় যে, যয়নবের নিকাহর বিরুদ্ধে উত্থিত প্রতিবাদ এবং তা থেকে সৃষ্ট নানা প্রকার সংশয়-সন্দেহের জবাব দিতে দিতে হঠাৎ মাঝখানে বলে দেয়া হলোঃ মুহাম্মাদ সা.নবীদের মোহর। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যত নবী আসবেন তারা সবাই তারই মোহরাংকিত হবেন। আগে পিছের এ ঘটনা মাঝখানে একথাটির আকস্মিক আগমন শুধু অবান্তরই নয়, এ থেকে প্রতিবাদকারীদের জবাবে যে যুক্তি পেশ করা হচ্ছিল, তাও দূর্বল হয়ে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদকারীদের হাতে একটা চমৎকার সুযোগ আসতো এবং তারা সহজেই বলতে পারতো যে, আপনার জীবনে যদি এ কাজটা সম্পন্ন না করতেন, তাহলে ভালই হতো, কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকতো না, এই বদ রসমটা বিলুপ্ত করার যদি এতেই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে আপনার পরে আপনার মোহরাংকিত হয়ে যেসব নবী আসবেন, এ কাজটা তাদের হাতেই সম্পন্ন হবে।
** বর্ণনার ধারাবাহিকতা অনুধাবন করার জন্য এ সূরার ৬৭ থেকে ৭৯ টীকার আলোচনাও সামনে রাখা দরকার।
উল্লেখিত দলটি শব্দটির আর একটি বিকৃত অর্থ নিয়েছেঃ “খাতামুন নাবিয়্যীন” অর্থ হলঃ “আফজালুন নাবিয়্যীন।” অর্থাৎ নবুওয়াতের দরজা উন্মুক্তই রয়েছে, তবে কিনা নবুওয়াত পূর্ণতা লাভ করেছে রাসূলুল্লাহর ওপর। কিন্তু এ অর্থ গ্রহণ করতে গিয়েও পূর্বোল্লিখিত বিভ্রান্তির পুনরাবির্ভাবের হাত থেকে নিস্তার নেই। অগ্রপশ্চাতের সাথে এরও কোন সম্পর্ক নেই। বরং এটি পূর্বাপরের ঘটনা পরস্পরার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থবহ। কাফের ও মুনাফিকরা বলতে পারতোঃ “জনাব, আপনার চাইতে কম মর্যাদার হলেও আপনার পরে যখন আরো নবী আসছেন, তখন এ কাজটা না হয় তাদের ওপরই ছেড়ে দিতেন। এ বদ রসমটাও যে আপনাকেই মিটাতে হবে, এরই বা কি এমন আবশ্যকতা আছে”!
আভিধানিক অর্থঃ
তাহলে পূর্বাপর ঘটনাবলীর সাথে সম্পর্কের দিক দিয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, এখানে “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দের অর্থ নবুওয়য়াতের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘোষণা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহর সা.পর আর কোন নবী আসবেন না। কিন্তু শুধু পূর্বাপর সম্বন্ধের দিক দিয়েই নয়, আভিধানিক অর্থের দিক দিয়েও এটিই একমাত্র সত্য। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খতম’; শব্দের অর্থ হলঃ মোহর লাগানো, বন্ধ করা, শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এবং কোন কাজ শেষ করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করা।
খাতামাল আমাল (خَتَمَ ألعَمَلَ) অর্থ হলোঃ ফারাগা মিনাল আমাল (فَرَغَ مِنَ ألعَمَلَ) অর্থাৎ কাজ শেষ করে ফেলেছে।
খাতামাল এনায়া (خَتَمَ ألاِنَاءَ) অর্থ হলোঃ পাত্রের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে করে তার ভেতর থেকে কোন জিনিস বাইরে আসতে এবং বাইরে থেকে কিছু ভেতরে যেতে না পারে।
খাতামাল কিতাব (خَتَمَ الكِتَابَ) অর্থ হলোঃ পত্রের মুখ বন্ধ করে তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, ফলে পত্রটি সংরক্ষিত হবে।
খাতামা আলাল কালব (خَتَمَ عَلَى القَلبِ) অর্থ হলোঃ দিলের ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে। এরপর কোন কথা আর সে বুঝতে পারবে না এবং তার ভেতরের জমে থাকা কোন কথা বাইরে বেরুতে পারবে না।
খিতামু কুল্লি মাশরুব (خَتَامَ كُلِّ مَشرُوبٍ) অর্থ হলোঃ কোন পানীয় পান করার পর শেষে যে স্বাদ অনুভূত হয়।
খাতিমাতু কুল্লি শাইয়িন আকিবাতুহু ওয়া আখিরাতুহু অর্থাৎ প্রত্যেক জিনিসের খাতিমা অর্থ হলো তার পরিণাম এবং শেষ।
খাতামাশ শাইয়্যি বালাগা আখিরাহ (خَتَمَ الشئِ , بَلَغَ اخِرَهُ) অর্থাৎ কোন জিনিসকে খতম করার অর্থ হলো তার শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। খতমে কুরআন বলতে এ অর্থ গ্রহণকরা হয় এবং এ অর্থের ভিত্তিতে প্রত্যেক সূরার শেষ আয়াতকে বলা হয় ‘খাওয়াতিম’।
খাতামুল কওমে আখেরুহুম (خَاتَمُ القَومٍ اخرهم) অর্থাৎ খাতামুল কওম অর্থজাতির শেষ ব্যক্তি (দ্রষ্টব্যঃ লিসানুল আরব, কামুস এবং আকারাবুল মাওয়ারিদ।)**
** এখানে আমি মাত্র তিনটি আভিধানের উল্লেখ করলাম। কিন্তু শুধু এই তিনটি অভিধানই কেন, আরবি ভাষায় যে কোন নির্ভরযোগ্য অভিধান খুলে দেখুন, সেখানে ‘খতম’ শব্দের উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যাই পাবেন। কিন্তু ‘খতমে নবুওয়াত’ অস্বীকারকারীরা আল্লাহর দ্বীনের সুরক্ষিত গৃহে সিঁদ কাটার জন্য এর আভিধানিক অর্থকে পূর্ণরূপে এড়িয়ে গেছেন। তারা বলতে চান, কোন ব্যক্তিকে খাতামুশ শোয়ারা খাতামুল ফোকাহা অথবা ‘খাতামুল মুফাসসিরীন’ বললে এ অর্থ গ্রহণ করা হয় নাযে, যাকে ঐ পদবী দেয়া হয়, তার পরে আর কোন শায়ের তথা কবি, ফকিহ অথবা মুফাসসির পয়দা হননি। বরং এর অর্থ এই যে, ঐ ব্যক্তির ওপরে উল্লিখিত বিদ্যা অথবা শিল্পের পূর্ণতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অথবা কোন বস্তুকে অত্যধিক ফুটিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে এই ধরনের পদবী ব্যবহারের ফলে কখনো খতম-এর অভিধানিক অর্থ ‘পূর্ণ’ অথবা ‘শ্রেষ্ঠ’ হয় না এবং শেষ অর্থে এর ব্যবহার ত্রুটিপূর্ণ বলেও গণ্য হয় না। একমাত্র ব্যাকরণ-রীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিই এ ধরনের কথা বলতে পারেন। কোন ভাষারই নিয়ম এ নয় যে, কোন একটি শব্দ তার আসল অর্থের পরিবর্তে কখনো কখনো দূর সম্পর্কের অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃত হলে সেটাই তার আসল অর্থে পরিণত হবে এবং আসল আভিধানিক অর্থে তার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আপনি যখন কোন আরবের সম্মুখে বলবেনঃ جَاءَ خَاتَمَ القَوْمَ (জাআ খাতামুল কওম)–তখন কখনো সে মনে করবে না যে, গোত্রের শ্রেষ্ঠ অথবা কামেল ব্যক্তি এসেছে। বরং সে মনে করবে যে, গোত্রের সবাই এসে গেছে, এমনকি অবশিষ্ট শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্তও।
এই সঙ্গে একথাটিও সামনে রাখতে হবে যে, কোন কোন লোককে যে “খাতামুশ শোয়া’রা” “খাতামুল ফুকাহা” ও “খাতামুল মুহাদ্দিসীন” উপাধিগুলো দোয়া হয়েছে সেগুলো মানুষরাই তাদেরকে দিয়েছে। আর মানুষ যে ব্যক্তিকে কোন গুণের ক্ষেত্রে শেষ বলে দিচ্ছে তার পরে ঐ গুণ সম্পন্ন আর কেউ জন্মাবে কিনা তা সে কখনোই জানতে পারে না। তাই মানুষের কথায় এ ধরনের উপাধির অর্থ নিছক বাড়িয়ে বলা এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণতার স্বীকৃতি ছাড়া আর বেশী কিছু হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ যখন কারো ব্যাপারে বলে দেন যে, অমুক গুণটি অমুক ব্যক্তি পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে তখন তাকে মানুষের কথার মতো উপমা বা রূপক মনে করে নেবার কোন কারণ নেই। আল্লাহ যদি কাউকে শেষ কবি বলে দিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিন্তভাবে তারপর আর কোন কবি হতে পারে না। আর তিনি যাকে শেষ নবী বলে দিয়েছেন তার পরে আর কোন নবী হওয়াই অসম্ভব। কারণ, আল্লাহ হচ্ছেন ‘আলিমুল গাইব’ এবং মানুষ আলিমুল গাইব নয়। আল্লাহর কাউকে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ বলে দেয়া এবং মানুষের কাউকে ‘খাতামুশ শোয়ারা বা খাতামুল ফুকারা’, বলে দেয়া কেমন করে একই পর্যায়ভুক্ত হতে পারে?
এ জন্যই সমস্ত অভিধান বিশারদ এবং তাফসীরকারগণ একযোগে “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দের অর্থ নিয়েছেন, আখেরুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ নবীদের শেষ। আরবী অভিধান এবং প্রবাদ অনুযায়ী ‘খাতাম’-এর অর্থ ডাকঘরের মোহর নয়, যা চিঠির ওপর লাগিয়ে চিঠি পোষ্ট করা হয় বরং সেই মোহর যা খামের মুখে এ উদ্দেশ্যে লাগানো হয় যে, তার ভেতর থেকে কোন জিনিস বাইরে বেরুতে পারবে না এবং বাইরের কোন জিনিস ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।
খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. এর উক্তিঃ
পূর্বাপর সম্বন্ধ এবং আভিধানিক অর্থের দিক দিয়ে শব্দটির যে অর্থ হয়, রাসূলুল্লাহর সা.বিভিন্ন ব্যাখ্যাও তা সমর্থন করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কতিপয় অত্যন্ত নির্ভুল হাদীসের উল্লেখ করছিঃ
(1) قَالَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِىٌّ خَلَفَهُ نَبِىٌّ، وَإِنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى، وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ (بخارى , كتاب المناقب , باب ماذكر عن بنى اسرائيل)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব করতেন আল্লাহর রাসূলগণ। যখন কোন নবী ইন্তেকাল করতেন, তখন অন্য কোন নবী তার স্থলাভিষিক্তি হতেন। কিন্তু আমার পরে কোন নবী হবে না, শুধু খলীফা।
(2) قَالَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ مَثَلِى وَمَثَلَ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِى كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى بَيْتًا فَأَحْسَنَهُ وَأَجْمَلَهُ، إِلاَّ مَوْضِعَ لَبِنَةٍ مِنْ زَاوِيَةٍ، فَجَعَلَ النَّاسُ يَطُوفُونَ بِهِ وَيَعْجَبُونَ لَهُ، وَيَقُولُونَ هَلاَّ وُضِعَتْ هَذِهِ اللَّبِنَةُ قَالَ فَأَنَا اللَّبِنَةُ، وَأَنَا خَاتِمُ النَّبِيِّينَ (بخارى كتاب المناقب , باب خاتم النبين)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্ত হলো এই যে, এক ব্যক্তি একটি দালান তৈরি করলো এবং খুব সুন্দর ও শোভনীয় করে সেটি সজ্জিত করলো। কিন্তু তার এক কোণে একটি ইটের স্থান শূন্য ছিল। দালানটির চতুর্দিকে মানুষ ঘুরে ঘুরে তার সৌন্দর্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছিল এবং বলছিল, “এ স্থানে একটা ইট রাখা হয়নি কেন? বস্তুত আমি সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী।” (অর্থাৎ আমার আসার পর নবুওয়াতের দালান পূর্ণতা লাভ করেছে, এখন এর মধ্যে এমন কোন শূন্যস্থান নেই যাকে পূর্ণ করার জন্য আবার কোন নবীর প্রয়োজন হবে।)
এই বক্তব্য সম্বলিত চারটি হাদীস মুসলিম শরীফে কিতাবুল ফাযায়েলের বাবু খাতামুন নাবিয়্যানে উল্লেখিত হয়েছে এবং শেষ হাদীসটিতে এতোটুকু অংশ বর্ধিত হয়েছেঃ فَجِئْتُ فَخَتَمْتُ الْاَنْبِيَاءَ “অতঃপর আমি এলাম এবং আমি নবীদের সিলসিলা ‘খতম’ করে দিলাম।”
হাদীসটি তিরমিযী শরীফে এই শব্দ সম্বলিত হয়ে ‘কিতাবুল মানাকিবের বাবু ফাদলিন নবী’ এবং কিতাবুল আদাবের ‘বাবুল আমসালে’ বর্ণিত হয়েছে।
মুসনাদে আবু দাউদ তিয়ালাসীতে হাদীসটি জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীসের সিলসিলায় উল্লেখিত হয়েছে এবং এর শেষ অংশটুকু হলো خُتِمَ بِى الْاَنْبِيَاء “আমার মাধ্যমে নবীদের সিলসিলা ‘খতম’ করা হলো।”
মুসনাদে আহমাদে সামান্য শাব্দিক হেরফেরের সাথে এই বক্তব্য সম্বলিত হাদীস হযরত উবাই ইবনে কা’ব, হযরত আবু সাঈদ খুদরী এবং হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে।
(3) أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فُضِّلْتُ عَلَى الأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَأُحِلَّتْ لِىَ الْغَنَائِمُ وَجُعِلَتْ لِىَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وطَهُورًا وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّونَ (مسلم- ترمذى- ابن ماجه)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ ছ’টা ব্যাপারে অন্যান্য নবীদের ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছেঃ
(১) আমাকে পূর্ণ অর্থব্যঞ্জক সংক্ষিপ্ত কথা বলার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে।
(২) আমাকে শক্তিমত্তা ও প্রতিপত্তি দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে।
(৩) যুদ্ধলব্ধ অর্থ-সম্পদ আমার জন্য হালাল করা হয়েছে।
(৪) পৃথিবীর যমীনকে আমার জন্য মসজিদে (অর্থাৎ আমার শরীয়াতে নামায কেবল বিশেষ ইবাদাতগাহে নয়, দুনিয়ার প্রত্যেক স্থানে পড়া যেতে পারে) এবং মাটিকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে (শুধু পানিই নয়, মাটির সাহায্যে তায়াম্মুম করেও পবিত্রতা হাসিল অর্থাৎ অজু এবং গোসলের কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে) পরিণত করা হয়েছে।
(৫) সমগ্র দুনিয়ার জন্য আমাকে রাসূল হিসেবে পাঠানো হয়েছে এবং
(৬) আমার ওপর নবীদের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে।
(4) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ الرِّسَالَةَ وَالنُّبُوَّةَ قَدِ انْقَطَعَتْ فَلاَ رَسُولَ بَعْدِى وَلاَ نَبِىَّ (ترمذى- كتاب الرؤيا , باب ذهاب النبوة- مسند احمد , مرويات أنس بن مالك رض)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ “রিসালাত এবং নবুওয়াতের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে। আমার পর আর কোন রাসূল এবং নবী আসবে না।”
(5) قَالَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْمَاحِى الَّذِى يُمْحَى بِىَ الْكُفْرُ وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِى يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى عَقِبِى وَأَنَا الْعَاقِبُ وَالْعَاقِبُ الَّذِى لَيْسَ بَعْدَهُ نَبِىُّ ( بخارى ومسلم , كتاب الفضائل- باب اسماء النبى- ترمذى , كتاب الادب , باب اسماء النبى- مؤطاء- كتاب اسماء النبى- المستدرك للحاكم , كتاب التاريخ , باب اسماء النبى)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ “আমি মুহাম্মাদ। আমি আহমাদ। আমি বিলুপ্তকারী, আমার সাহায্যে কুফরকে বিলুপ্ত করা হবে। আমি সমবেতকারী আমার পরে লোকদেরকে হাশরের ময়দানে সমবেত করা হবে। (অর্থাৎ আমার পরে শুধু কিয়ামতই বাকি আছে) আমি সবার শেষে আগমনকারী হলো সেই) যার পরে আর নবী আসবে না।”
(6) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ لَمْ يَبْعَثْ نَبِيًّا إِلاَّ حَذَّرَ أُمَّتَهُ الدَّجَّالَ وَأَنَا آخِرُ الأَنْبِيَاءِ وَأَنْتُمْ آخِرُ الأُمَمِ وَهُوَ خَارِجٌ فِيكُمْ لاَ مَحَالَةَ- (ابن ماجه , كتاب الفتن , باب الدجال)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ “আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি তার উম্মাতকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেননি। (কিন্তু এখন আমিই শেষ নবী এবং তোমরা শেষ উম্মাত। দাজ্জাল নিঃসন্দেহে এখন তোমাদের মধ্যে বহির্গত হবে।”
(7) عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ جُبَيْرٍ قَالَ سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِى يَقُولُ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْماً كَالْمُوَدِّعِ فَقَالَ أَنَا مُحَمَّدٌ النَّبِىُّ الأُمِّىُّ ثَلاَثاً وَلاَ نَبِىَّ بَعْدِى- (مسند احمد – مرويات – عبد الله بن عمرو بن العاص)
আবদুর রাহমান ইবনে জোবায়ের বলেনঃ আমিআবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আ’সকে বলতে শুনেছি, একদিন রাসূলুল্লাহ সা. নিজের গৃহ থেকে বরে হয়ে আমাদের মধ্যে তাশরীফ আনলেন। তিনি এভাবে আসলেন যেন আমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তিনবার বললেন, আমি উম্মী নবী মুহাম্মাদ। অতঃপর বললেন, আমার পর আর কোন নবী নেই।
(8) قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لاَ نُبُوّةَ بعدى الا المبشرات قِيلِ وَمَا المُبَشّرات يَا رسول الله ؟ قَالَ الرُّؤيَا الحسنة- او قَالَ الرّؤيَا الصالِحَة- ( مسند احمد , مرويات ابو الطفيل – نسائى ابو داؤد)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমার পরে আর কোন নবুওয়াত নেই। আছে সুবংবাদ দানকারী ঘটনাবলী। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, সুসংবাদ দানকারী ঘটনাগুলো কি? জবাবে তিনি বললেনঃ ভালো স্বপ্ন। অথবা বললেন, কল্যাণময় স্বপ্ন। (অর্থাৎ আল্লাহর অহী নাযিল হবার এখন আর সম্ভাবনা নেই। বড়জোর এতোটুকু বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে যদি কাউকে কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়, তাহলে শুধু ভালো স্বপ্নের মাধ্যমেই তা দেয়া হবে)।
(9) قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَوْ كَانَ بَعْدِى نَبِىٌّ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ- ( ترمذى – كتاب المناقب)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমার পরে যদি কোন নবী হতো, তাহলে উমর ইবনে খাত্তাব সে সৌভাগ্য লাভ করতো।
(10) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَلِىٍّ أَنْتَ مِنِّى بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى إِلاَّ أَنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى- (بخارى ومسلم – كتاب فضائل الصحابه)
রাসূলুল্লাহ সা.হযরত আলীকে রা. বলেনঃ আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মূসারসাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। কিন্তু আমার পরে আর কোন নবী নেই।
বুখারী এবং মুসলিম তাবুক যুদ্ধের বর্ণনা প্রসঙ্গেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমাদে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত দু’টি হাদীস হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি বর্ণনার শেষাংশ হলোঃ الا انه لانبوة بعدى “কিন্তু আমার পরে আর কোন নবুওয়াত নেই।” আবু দাউদ তিয়ালাসি, ইমাম আহমাদ এবং মুহাম্মাদ ইসহাক এ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, তাবুক যুদ্ধে রওয়ানা হবার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সা.হযরত আলীকে রা. মদীনা তাইয়্যেবার তত্ত্বাবধান এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেখে যাবার ফয়সালা করেন। এ ব্যাপারটি নিয়ে মুনাফিকরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে থাকে। হযরত আলী রা. রাসূলুল্লাহকে সা. বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আমাকে শিশু এবং নারীদের মধ্যে ছেড়ে যাচ্ছেন? রাসূলুল্লাহ সা.তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন-আমার সাথে তোমার সম্পর্কতো মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মতো। অর্থাৎ তুর পর্বতে যাবার সময় হযরত মূসা আ. যেমন বনী ইসরাঈলদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হযরত হারুনকে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন অনুরুপভাবে মদীনার হেফাজতের জন্য আমি তোমাকে পেছনে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা.মনে এই সন্দেহও জাগে যে, হযরত হারুনের সঙ্গে এভাবে তুলনা করার ফলে হয়তো পরে এ থেকে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই পরমুহুর্তেই তিনি কথাটা স্পষ্ট করে দেন এই বলে যে, “আমার পর আর কোন ব্যক্তি নবী হবে না।”
(11) عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ….. وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِى أُمَّتِى ثَلاَثُونَ كَذَّابُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِىٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى (ابو داود – كتاب الفتن)
হযরত সাওবান বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আর কথা হচ্ছে এই যে, আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদী হবে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমার পর আর কোন নবী নেই।
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত আর একটি হাদীস আবু দাউদ ‘কিতাবুল মালাহেমে’ হযরত আবু হুরাইরা সা.থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযীও হযরত সাওবান এবং হযরত আবু হুরাইরা সা.থেকে এ হাদীস দু’টি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বর্ণনাটির শব্দ হলো এইঃ
حَتَّى يُبْعَثَ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ قَرِيب مِنْ ثَلاَثِينَ ، كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ
অর্থাৎ এমন কি ত্রিরিশ জনের মতো প্রতারক আসবে। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকেই দাবী করবে যে, সে আল্লাহর রাসূল।
(12) قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَدْ كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ مِنْ بَنِى إِسْرَائِيلَ رِجَالٌ يُكَلَّمُونَ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَكُونُوا أَنْبِيَاءَ ، فَإِنْ يَكُنْ مِنْ أُمَّتِى مِنْهُمْ أَحَدٌ فَعُمَرُ- (بخارى , كتاب المناقب)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ তোমাদের পূর্বে অতিবাহিত বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে অনেক লোক এমন ছিলেন, যাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, অথচ তারা নবী ছিলেন না। আমার উম্মাতের মধ্যে যদি এমন কেউ হয়, তাহলে সে হবে উমর।
মুসলিমে এই বিষয়বস্তু সম্বলিত যে হাদীস উল্লেখিত হয়েছে, তাতে يكلمون এর পরিবর্তে محدثون শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মুকাল্লাম এবং মুহাদ্দাস শব্দ দু’টি সমার্থক। অর্থাৎ এমন ব্যক্তি যার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন অথবা যার সাথে পর্দার পেছন থেকে কথা বলা হয়। এ থেকে জানা যায় যে, নবুওয়াত ছাড়াও যদি এই উম্মাতের মধ্যে কেউ আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করতো তাহলে তিনি একমাত্র হযরত উমরই হতেন।
(13) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى وَلاَ أَمَةً بَعْدَ اُمَّتِى (بيهقى , كتاب الرؤيا – طبرانى)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমার পরে আর কোন নবী নেই এবং আমার উম্মাতের পর আর কোন উম্মাত (অর্থাৎ কোন ভবিষ্যত নবীর উম্মাত) নেই।
(14) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِنِّى آخِرُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ مَسْجِدِى آخِرُ الْمَسَاجِدِ- (مسلم , كتاب الحج. باب فضل الصلواة بمسجد مكة والمدينة)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমি শেষ নবী এবং আমার মসজিদ (অর্থাৎ মসজিদে নববী) শেষ মসজিদ।১
১. খতমে নবুওয়াত অস্বীকারীরা এ হাদীস থেকে প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সা.যেমন তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ বলেছেন, অথচ এটি শেষ মসজিদ নয়; এরপরও দুনিয়ার বেশুমার মসজিদ নির্মিত হয়েছে অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন যে, তিনি শেষ নবী। এর অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরেও নবী আসবেন। অবশ্য শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে তিনি হলেন শেষ নবী এবং তাঁর মসজিদ শেষ মসজিদ। কিন্তু আসলে এ ধরনের বিকৃত অর্থই একথা প্রমাণ করে যে, এ লোকগুলো আল্লাহ এবং রাসূলের কালামের অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মুসলিম শরীফের যে স্থানে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সেখানে এ বিষয়ের সমস্ত হাদীস সম্মুখে রাখলেই একথা পরিষ্ফুট হবে যে, রাসূল্লাহ সা.তাঁর মসজিদকে শেষ মসজিদ কোন অর্থে বলেছেন। এখানে হযরত আবু হুরাইরা রা., হযরত আবদুল্লাহইবনে উমর রা. এবং হযরত মায়মুনার রা. যে বর্ণনা ইমাম মুসলিম উদ্ধৃত করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, দুনিয়ার মাত্র তিনটি মসজিদ এমন রয়েছে যেগুলো সাধারণ মসজিদগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। সেখানে নামায পড়লে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে হাজার গুণ বেশী সওয়াব হাসিল হয় এবং এ জন্য একমাত্র এ তিনটি মসজিদে নামায পড়ার জন্য সফর করা জায়েয। দুনিয়ার অবশিষ্ঠ মসজিদগুলোর মধ্যে সমস্ত মসজিদকে বাদ দিয়ে বিশেষ করে একটি সমজিদে নামায পড়বার জন্য সেদিকে সফর করা জায়েয নয়। এর মধ্যে মসজিদুল হারাম হলো প্রথম মসজিদ। হযরত ইব্রাহীম আ. এটি বানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি মদীনা তাইয়েবার মসজিদে নববী। এটি নির্মাণ করেন রাসূলুল্লাহ সা.। রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদের অর্থ হলো এই যে, এখন যেহেতু আমার পর আর কোন নবী আসবে না, সেহেতু আমার মসজিদের পর দুনিয়ার আর চতুর্থ এমন কোন মসজিদ নির্মিত হবে না, যেখানে নামায পড়ার সওয়াব অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশী হবে এবং সেখানে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে সেদিকে সফর করা জায়েয হবে।
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে বহু সাহাবী হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন এবং বহু মুহাদ্দিস অত্যন্ত শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য সনদসহ এগুলো উদ্ধৃত করেছেন। এগুলো অধ্যয়ন করার পর স্পষ্ট জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সা.বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার করে একথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী। তার পর কোন নবী আসবে না। নবুওয়াতের সিলসিলা তার ওপর খতম হয়ে গেছে এবং তার পরে যে ব্যক্তি রাসূল অথবা নবী হবার দাবী করবে, সে হবে দাজ্জাল (প্রতারক) এবং কাজ্জাব ও মিথ্যুক।২ কুরআনের “খাতামুন নাবিয়্যীন” শব্দের এর চাইতে বেশী শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্যএবং প্রামান্য ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে! রাসূলুল্লাহর বাণীই এখানে চরম সনদ এবং প্রমাণ। উপরন্তু যখন তা কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা করে তখন আরো অধিক শক্তিশালী প্রমাণে পরিণত হয়। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, মুহাম্মাদের সা.চেয়ে বেশী কে কুরআনকে বুঝেছে এবং তার চাইতে বেশী এর ব্যাখ্যার অধিকার কার আছে? এমন কে আছে যে খতমে নবুওয়াতের অন্য কোন অর্থ বর্ণনা করবে এবং তা মেনে নেয়া তো দূরের কথা, সে দিকে ভ্রূক্ষেপ করতেও আমরা প্রস্তুত হবো?
২. শেষ নবুওয়াতে অবিশ্বাসীরা নবী করিমের সা. হাদীসের বিপরীতে হযরত আয়েশার রা. বলে কথিত নিম্নোক্ত বর্ণনার উদ্ধৃতি দেয়ঃ “বল নিশ্চয়ই তিনি খাতামুন নাবিয়্যীন, একথা বলো না যে তার পর নবী নেই।” প্রথমত নবী করিমের সা. সুস্পষ্ট আদেশকে অস্বীকার করার জন্য হযরত আয়েশার রা. উদ্ধৃতি দেয়া একটা ধৃস্টতা। অধিকন্তু হযরত আয়েশার রা. বলে কথিত উপরোক্ত উদ্ধৃতি মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। হাদীস শাস্ত্রের কোন প্রমাণিক গ্রন্থেই হযরত আয়েশার রা. উপরোক্ত উক্তির উল্লেখ নেই। কোন বিখ্যাত হাদীস লিপিবদ্ধকারী এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ বা উল্লেখ করেনি। উপরোক্ত হাদীসটি ‘দুররি মানসূর’ নামক তাফসীর এবং ‘তাকমিলাহ মাজমা-উল-বিহার’ নামক অপরিচিত হাদীস সংকলন থেকে নেয়া হয়েছে; কিন্তু এর উৎপত্তি বা বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। রাসূল সা.-এর সুস্পষ্ট হাদীস বর্ণনাকারীরা খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্র ধেকে বর্ণনা করেছেন, তাকে অস্বীকার করার জন্য হযরত আয়েশার রা. উক্তির, যা দুর্বলতম সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ চূড়ান্ত ধৃষ্টতা মাত্র।
সাহাবীদের ইজমাঃ
কুরআন এবং সুন্নাহর পর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বা মতৈক্য হলো তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহর সা.ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই যেসব লোক নবুওয়াতের দাবী করে এবং যারা তাদের নবুওয়াত স্বীকার করে নেয়, তাদের সবার বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছিলেন। এ সম্পর্কে মুসাইলামা কাজ্জাবের ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে রাসূলুল্লাহর সা.নবুওয়াত অস্বীকার করছিল না; বরং সে দাবী করেছিলযে, রাসূলুল্লাহর নবুওয়াতে তাকেও অংশীদার করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পূর্বে সে তার নিকট যে চিঠি পাঠিয়েছিল তার আসল শব্দ হলো এইঃ
مِن مُسَيلَمَةِ رَسُوْلُ اللهِ اِلى مُحمَّدِرَّسُولُ الله سَلَامٌ عَلَيْكَ فَاِنِّى اُشْرِكْتُ فِى الْاَمْرِ مَعَكَ (طبرى ,جلد 2,صفحة 399,طبع مصر)
“আল্লাহর রাসূল মুসাইলামার তরফ হতে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নিকট। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপনি জেনে রাখুন, আমাকে আপনার সাথে নবুওয়াতের কাজে শরীক করা হয়েছে।”
এছাড়াও ঐতিহাসিক তাবারী একথাও বর্ণনা করেছেন যে, মুসাইলামার ওখানে যে আযান দেয়া হতো তাতে اشهد ان محمدا رسول الله শব্দাবলীও বলা হতো। এভাবে স্পষ্ট করে রিসালাতে মুহাম্মাদীকে স্বীকার করে নেবার পরও তাকে কাফের ও ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, বনু হোনায়ফা সরল অন্তকরণে তার ওপর ঈমান এনেছিল। অবশ্য তারা এই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল যে, মুহাম্মাদ সা. নিজেই তাকে তার নবুওয়াতের কাজে শরীক করেছেন। এছাড়াও আর একটা কথা হলো এই যে, মদীনা তাইয়্যেবা থেকে এক ব্যক্তি কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেছিল এবং বনু হোনায়ফারনিকটে গিয়ে সে কুরআনের আয়াতকে মুসাইলামার নিকট অবতীর্ণ আয়াতরূপে পেশ করেছিল। (البداية والنهاية لابن كثير – جلدة صفحة 1) কিন্তু এ সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম তাকে মুসলমান বলে স্বীকার করেননি এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। অতঃপর একথা বলার যুযোগ নেই যে, ইসলাম বহির্ভূত হবার কারণে সাহাবীগণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি বরং বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলেও তাদের যুদ্ধ বন্দীদেরকে গোলামে পরিণত করা যেতে পারে না। বরং শুধু মুসলমানই নয় জিম্মীও (অসুমলিম) বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, গ্রেফতার করার পর তাকে গোলামে পরিণত করা জায়েয নয়। কিন্তু মুসাইলামা এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. ঘোষণা করেন যে, তাদের মেয়েদের এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কা ছেলেদেরকে গোলাম বানানো হবে এবং গ্রেফতার করার পর দেখা গেলো, সত্যি সত্যিই তাদেরকে গোলাম বানানো হয়েছে। হযরত আলী রা. তাদের মধ্য থেকেই জনৈক যুদ্ধ বন্দিনীর মালিক হন। এই যুদ্ধ বন্দিনীর গর্ভজাত পূত্র মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়াই হলেন ১পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে সবর্জন পরিচিত ব্যক্তি। (البداية والنهاية جلد 2- صفحه 316-320) এ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম যে অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তা কোন বিদ্রোহের অপরাধ ছিল না বরং সে অপরাধ ছিল এই যে, এক ব্যক্তি মুহাম্মাদ সা. এর পরে নবুওয়াতের দাবী করে এবং অন্য লোকেরা তার নবুওয়াতের ওপর ঈমান আনে। রাসূলুল্লাহর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই এই পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এর নেতৃত্ব দেন হযরত আবু বকুর সিদ্দীক রা. এবং সাহাবীদের সমগ্র দলটি একযোগে তার নেতৃত্বাধীনে এ কাজে অগ্রসর হন। সাহাবীদের ইজমার এর চাইতে সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে।
উম্মাতের সমগ্র আলেম সমাজের ইজমাঃ
শরীয়তে সাহাবীদের ইজমার পর চতুর্থ পর্যায়ের সবচাইতে শক্তিশালী দলিল হলো সাহাবীগণের পরবর্তী কালের আলেম সমাজের ইজমা। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক যুগের এবং সমগ্র মুসলিমজাহানের প্রত্যেক এলাকার আলেম সমাজ হামেশাই এ ব্যাপারে একমত রয়েছেন যে, “মুহাম্মাদ সা. এরপরে কোন ব্যক্তি নবী হতে পারে না এবং তার পর যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করবে এবং যে ব্যক্তি এই মিথ্যা দাবীকে মেনে নেবে, সে কাফের এবং মিল্লাতে ইসলামের মধ্যে তার স্থান নেই।”
এ ব্যাপারে আমি কতিপয় প্রমাণ পেশ করছিঃ
১) ইমাম আবু হানীফার যুগে (৮০-১৫০ হি) এক ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে এবং বলেঃ “আমাকে সুযোগ দাও, আমি নবুওয়াতের সংকেত চিহ্ন পেশ করব।”
একথা শুনে ইমাম সাহেব বলেনঃ যে ব্যক্তি এর কাছ থেকে নবুওয়াতের কোন সংকেত চিহ্ন তলব করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ لَانَبِىُّ بَعْدِىْ “আমার পর আর কোন নবী নেই।”
১.হানাফিয়া নামে বনু হানাফিয়্যা গোত্রের মহিলা।
২) আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হি) তাঁর বিখ্যাত কুরআনের তাফসীরে (ولكن رسول الله وخاتم النبين) আয়াতটির বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
اَلَّذِىْ خَتَمَ اللنُّبُوَّةَ فَطُبِعَ عَلَيْهَا فَلَا تُفْتَحْ لَاحَدِ بَعْدَهُ اِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ
“যে নবুওয়াতকে খতম করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত এর দরজা আর কারো জন্য খুলবে না।” (তাফসীরে ইবনে জারীরঃ ২২ খন্ড ১২ পৃষ্ঠা।
৩) ইমাম তাহাবী (হি ২৩৯-৩২১) তার আকীদাতুস সালাফীয়া গ্রন্থে সালাফেসালেহীন (প্রথম যুগের শ্রেষ্ঠ সৎকর্মশীলগণ) এবং বিশেষ করে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহেমাহুমুল্লাহর আকিদা বিশ্বাস বর্ণনা প্রসঙ্গে নবুওয়াত সম্পর্কিত এ বিশ্বাস লিপিবদ্ধ করেছেন যে, “আর মুহাম্মাদ সা.হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা, নির্বাচিত নবী ও পছন্দনীয় রাসূল এবং শেষ নবী, মুত্তাকীদের উম্মাত, রাসূলদের সরদার ও রাব্বুল আলামীনের বন্ধু। আর তার পর নবুওয়াতের প্রত্যেকটি দাবী পথভ্রষ্টতা এবং প্রবৃত্তির লালসার বন্দেগী ছাড়া আর কিছুই নয়।”(শারহুত তাহাবীয়া ফিল আকীদাতিস সালাফিয়া, দারুল মাআরিফ মিসর, ১৫, ৮৭, ৯৬, ৯৭, ১০০ ও ১০২ পৃষ্ঠা।
৪) আল্লামা ইবনে হাজাম আন্দালুস (৩৮৪-৪৫৬) হি) লিখেছেনঃ নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ ইন্তেকালের পর অহীর সিলসিলা খতম হয়ে গেছে। এর সপক্ষে যুক্তি এই যে, অহী আসে একমাত্র নবীর কাছে এবং মহান আল্লাহ বলেছেন, মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নয়। কিন্তু সে আল্লাহ রাসূল এবং সর্বশেষ নবী (আল মুহাল্লা, প্রথম খন্ড ২৬ পৃষ্ঠা)
৫) ইমাম গাযযালী বলেন-(৪৫০-৫০৫ হি)১
لو فتح هذا الباب (اى باب انكار كون الاجماع حجة) ابجو الى امور شنيعة وهو ان قائلا لو قال يجوز ان بيعث رسول بعد نبينا محمد صلى الله عليه وسلم فيبعد التوقف فى تكفيره , ومستبعد استحالة ذالك عند البحث تستمد من الاجماع لامحالة , فان العقل لايحيله , وما نقل فيه من قوله لانبى بعدى , ومن قوله تعالى خاتم النبيين , فلا يعجز هذا القائل عن تاويله , فيقول خاتم النبيين اراد به اولوا العزم من الرسل , فان قالوا النبيين عام , فلا يبعد تخصيص العام , وقوله لا نبى بعدى لم يردبه الرسول وفوق بين النبى والرسول والنبى اعلى مرتبة من الرسول الى غير ذالك من انواع الهذيان , فهذا وامثاله لايمكن ان ندعى استحالته , من حيث مجرد اللفظ , فانا فى تاويل ظواهر التشبيه فضينا باحتمالات ابعد من هذه , ولم يكن ذالك مبطلا للنصوص , ولكن الرد على هذا القائل ان الامة فهمت بالاجماع من هذا اللفظ ومن قرائن احواله انه افهم عدم نبى بعده , ابدا وعدم رسول الله ابدا وانه ليس فيه تاويل ولاتخصيص فمنكر هذا لايكون الامنكر الاجماع (الاقتصاد فى الاعتقاد المطبعة الادبيه , مصر , ص 114)
“যদি এ দরোজাটি (অর্থাৎ ইজমাকে প্রমাণ হিসেবে মানতে অস্বীকার করার দরোজা) খুলে দেয়া হয় তাহলে বড়ই ন্যক্কারজনক ব্যাপার হয়েদাঁড়াবে। যেমন যদি কেউ বলে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সা. এর পরে অন্য কোন নবীর আগমন অসম্ভব নয়, তাহলে তাকে কাফের বলার ব্যাপারে ইতস্তত করা যেতে পারে না। কিন্তু বিতর্কের সময় যে ব্যক্তি তাকে কাফের আখ্যায়িত করতে ইতস্তত করাকে অবৈধ প্রমাণ করতে চাইবে তাকে অবশ্যইইজমার সাহায্য নিতে হবে। কারণ নিরেট যুক্তি দ্বারা তার অবৈধ হবার ফয়সালা করা যায় না। আর কুরআন ও হাদীসের বাণীর ব্যাপারে বলা যায়, এ মতে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি “আমার পরে আর কোন নবী নেই।” এবং “নবীদের মোহর” এ উক্তি দু’টির নানা রকম চুলচেরা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হবে না। সে বলবে, “খাতামুন নাবীয়্যীন”মানে হচ্ছে অতীব মর্যাদাবান নবীদের আগমন শেষ হয়ে যাওয়া। আর যদি বলা হয়, “নবীগণ” শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে সকল নবীকে বুঝানো হয়েছে, তাহলে এই সাধারণ থেকে অসাধাণ ও ব্যতিক্রমী বের করা তার জন্য মোটেই কঠিন হবে না। “আমার পর আর নবী নেই” এ ব্যাপারে সে বলে দেবে, “আমার পর আর রাসূল নেই” একথা তো বলা হয়নি। রাসূল ও নবীর মধ্যে পার্থক্য আছে। নবীর মর্যাদা রাসূলের চেয়ে বেশী। মোটকথা এ ধরনের আজেবাজে উদ্ভট কথা অনেক বলা যেতে পারে। আর নিছক শাব্দিক দিক দিয়ে এ ধরনের চুলচেরা ব্যাখ্যাকে আমরা একেবারে অসম্ভব ও বলি না। বরং বাহ্যিক উপমার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আমরা এর চেয়েও দূরবর্তী সম্ভাবনার অবকাশ স্বীকার করি। আর এ ধরনের ব্যাখ্যাকারীদের সম্পর্কে আমরা একথাও বলতে পারি না যে, কুরআন হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য সে অস্বীকার করছে। কিন্তু এ অভিমতের প্রবক্তার বক্তব্য খণ্ডন করে আমি বলবো, মুসলিম উম্মাহ ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ শব্দ অর্থাৎ আমার পরে আর কোন নবী নেই) থেকে এবং নবী সা. এর ঘটনাবলীর প্রমাণাদি থেকে একথাই বুঝেছে যে, নবী কারীমের সা. উদ্দেশ্য ছিল একথা বুঝানো যে, তাঁর পরে আর কখনো কোন নবী আসবে না এবং রাসূলও আসবে না। এ ছাড়া মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারেও একমত যে, এর মধ্যে কোন তাবীল, ব্যাখ্যা ও বিশেষিত করারও কোন অবকাশ নেই। কাজেই এহেন ব্যক্তিকে ইজমা অস্বীকারকারী ছাড়া আর কিছুই বলা যেতে পারে না।
৬) মুহিউস সুন্নাহ বাগাবী (মৃত্যুঃ ৫১০ হিঃ) তাঁর তাফসীরে মাআ’লিমুত তানজীল–এ লিখেছেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. মাধ্যমে আল্লাহ তাআ’লা নবুওয়াতের সিলসিলা খতম করেছেন। কাজেই তিনি সর্বশেষ নবী এবং ইবনে আব্বাস বলেন, আল্লাহ তাআ’লা এই আয়াতে ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, মুহাম্মাদের সা. পর কোন নবী নেই। (তৃতীয় খণ্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা)
৭) আল্লামা যামাখশারী (৪৬৭—-৫৩৮ হিঃ) তাফসীরে কাশশাফে লিখেছেনঃ যদি তোমরা বল, রাসূলুল্লাহ সা. শেষ ম্বী কেমন করে হলেন, কেননা হযরত ঈসা আ. শেষ যুগে অবতীর্ণ হবেন, তাহলে আমি বলবো, রাসূলুল্লাহর শেষ নবী হবার অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরে আর কাউকে নবীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হবে না। হযরত ঈসাকে আ. রাসূলুল্লাহর সা. পূর্বে নবী বানানো হয়েছে। অবতীর্ণ হবার পর তিনি রাসূলুল্লাহর অনুসারী হবেন এবং তাঁর কেবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেন। অর্থাৎ তিনি হবেন রাসূলুল্লাহ সা. এর উম্মাতের মধ্যে শামিল। (দ্বিতীয় খণ্ড, ১১৫ পৃষ্ঠা।
৮) কাজী ইয়ায (মৃত্যুঃ ৫৪৪ হিঃ) লিখেছেনঃ যে ব্যক্তি নিজে নবুওয়াতের দাবী করে অথবা একথাকে বৈধ মনে করে যে, যে কোন ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টায় নবুওয়াত হাসিল করতে পারে এবং অন্তত পরিশুদ্ধির মাধ্যমে নবীর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে (যেমন কোন কোন দার্শনিক এবং বিকৃতমনা সূফী মনে করেন) এবং এভাবে যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে না অথচ একথার দাবী জানায় যে, তার ওপর অহী নাযিল হয়,—এ ধরনের সমস্ত লোক কাফের এবং তারা রাসূলুল্লাহর নবুওয়াতকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করছে। কেননা তিনি খবর দিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী এবং তাঁর পর কোন নবী আসবে না এবং তিনি আল্লাহ তাআ’লার তরফ থেকে এ খবর পৌঁছিয়েছেন যে, তিনি নবুওয়াতকে খতম করে দিয়েছেন এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। সমগ্র মুসলিম সমাজ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটিই গ্রহণীয় এবং এর দ্বিতীয় কোন অর্থ গ্রহণ করার সুযোগই এখানে নেই। কাজেই উল্লেখিত দলগুলোর কাফের হওয়া সম্পর্কে কুরআন, হাদীস এবং ইজমার দৃষ্টিতে কোন সন্দেহ নেই। (শিফা দ্বিতীয় খণ্ড, ২৭০ – ২৭১ পৃষ্ঠা)
৯) আল্লামা শাহারিস্তানী (মৃত্যুঃ ৫৪৮ হিঃ) তাঁর মশহুর কিতাব আল মিলাল ওয়ান নিহালে লিখেছেনঃ এবং যে এভাবেই বলে, মুহাম্মাদ সা. এর পরও কোন নবী আসবে (হযরত ঈসা আ. ছাড়া] তার কাফের হওয়া সম্পর্কে যে কোন দু’জন ব্যক্তির মধ্যেই কোন মতবিরোধ থাকতে পারে না। (তৃতীয় খণ্ড, ২৪৯ পৃষ্ঠা)
১০) ইমাম রাযী (৫৪৩-৬০৬ হিঃ) তাঁর তাফসীরে কবীরে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ শব্দের ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেনঃ এ বর্ণনায় খাতামুন নাবিয়্যীন শব্দ এ জন্য বলা হয়েছে যে, যে নবীর পর অন্য কোন নবী আসবেন তিনি যদি উপদেশ এবং নির্দেশাবলীর ব্যাখ্যার ব্যাপারে কিছু অতৃপ্তি রেখে যান, তাহলে তাঁর পর আগমনকারী নবী তা পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু যার পর আর কোন নবী আসবে না, তিনি নিজের উম্মাতের ওপর খুব বেশী স্নেহশীল হন এবং তাদেরকে সুস্পষ্ট নেতৃত্ব দান করেন। কেননা তাঁর দৃষ্টান্ত এমন এক পিতার ন্যায় যিনি জানেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রের দ্বিতীয় কোন অভিভাবক এবং পৃষ্ঠপোষক থাকবে না। (ষষ্ঠ খণ্ড, ৫৮১ পৃষ্ঠা)
১১) আল্লামা বারযাবী (মৃত্যুঃ ৬৮৫ হিঃ) তাঁর তাফসীরে আনওয়ারুত্ তানজীল–এ লিখেছেনঃ অর্থাৎ তিন