পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
c রুকুঃ ১ d
﴿الم﴾
১। আলিফ
লাম-মীম।
﴿اللَّهُ
لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ﴾
২। আল্লাহ এক
চিরঞ্জীব ও শাশ্বত সত্তা, যিনি বিশ্ব–জাহানের সমগ্র ব্যবস্থাপনাকে ধারণ করে আছেন, আসলে তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ
নেই।১
১. এর ব্যাখা
জানার জন্য সূরা আল বাকারা। আল বাকারাহ-এর ২৭৮ টীকা
দেখুন।
﴿نَزَّلَ
عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنزَلَ التَّوْرَاةَ
وَالْإِنجِيلَ﴾
৩। তিনি
তোমার ওপর এই কিতাব নাযিল করেছেন, যা সত্যের বাণী বহন করে এনেছে এবং আগের
কিতাবগুলোর সত্যতা প্রমাণ করছে। এর আগে তিনি মানুষের
হিদায়াতের জন্য তাওরাত ও ইনজীল নাযিল করেছিলেন।২ আর তিনি মানদণ্ড নাযিল করেছেন (যা সত্য ও মিথ্যার
মধ্যে পার্থক্য করে দেয়)
২. সাধারণভাবে লোকেরা তাওরাত
বলতে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের (পুরাতন নিয়ম) প্রথম দিকের পাঁচটি পুস্তক এবং
ইনজীল বলতে নিউ টেস্টামেণ্টের (নতুন নিয়ম) চারটি প্রসিদ্ধ ইনজীল মনে করে থাকে। তাই এ
পুস্তকগুলো সত্যিই আল্লাহর কালাম কিনা, এ প্রশ্ন দেখা দেয়। আর এই
সংগে এ প্রশ্নও দেখা দেয় যে, এই পুস্তকগুলোতে যেসব কথা লেখা আছে
যথার্থই কুরআন সেগুলোকে সত্য বলে কিনা। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রকৃত
সত্য হচ্ছে এই যে, তাওরাত বাইবেলের প্রথম পাঁচটি পুস্তকের নাম
নয় বরং এগুলোর মধ্যে তাওরাত নিহিত রয়েছে এবং ইনজীল নিউ টেস্টামেন্টের চারটি
ইনজীলের নাম নয় বরং এগুলোর মধ্যে ইনজীল পাওয়া যায়।
আসলে হযরত মূসা আ. এর নবুওয়াত লাভের পর থেকে তাঁর
ইন্তিকাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তাঁর ওপর যেসব বিধান অবতীর্ণ হয়েছিল
সেগুলোই তাওরাত। এর মধ্যে পাথরের তক্তার গায়ে খোদাই করে দশটি বিধান
আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন। অবশিষ্ট বিধানগুলো হযরত মূসা
আ. লিখিয়ে তার বারোটি অনুলিপি করে বারোটি গোত্রকে দান করেছিলেন এবং একটি কপি
সংরক্ষণ করার জন্যে দান করেছিলেন বণী লাবীকে। এ কিতাবারে নাম ছিল তাওরাত। বাইতুল
মাকদিস প্রথমবার ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত এটি একটি স্বতন্ত্র কিতাব হিসেবে সংরক্ষিত ছিল। বনি
লাবীকে যে কপিটি দেয়া হয়েছিল, পাথরের তক্তা সহকারে সেটি ’অংগীকারের সিন্দুকে‘র মধ্যে রাখা হয়েছিল। বনী
ইসরাঈল সেটিকে ‘তাওরীত‘ নামেই জানতো। কিন্তু
তার ব্যাপারে তাদের গাফলতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যার ফলে ইয়াহুদীয়ার বাদশাহ
ইউসিয়ার আমলে যখন ‘হাইকেলে সুলাইমানী‘ মেরামত
করা হয়েছিল তখন ঘটনাক্রমে ‘কাহেন‘ প্রধান
(অর্থাৎ হাইকেল বা উপাসনা গৃহের গদীনশীন এবং জাতির প্রধান ধর্মীয় নেতা)। খিলকিয়াহ
একস্থানে তাওরীত সুরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে গেলেন। তিনি একটি অদ্ভুত বস্তু
হিসেবে এটি বাদশাহর প্রধান সেক্রেটারীকে দিলেন। সেক্রেটারী সেটিকে এমনভাবে
বাদশাহর-সামনে পেশ করেন যেন ঐটি একটি বিস্ময়ক আবিষ্কার (২-রাজাবলী, অধ্যায় ২২,
শ্লোক ৮-১৩ দেখুন)। এ কারণেই বখ্তে নসর যখন
জেরুসালেম জয় করে হাইকেলসহ সারা শহর ধ্বংস করে দিল তখন বনী ইসরাঈলরা তাওরাতের যে
মূল কপিটিকে বিস্মৃতির সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল এবং যার অতি অল্প সংখ্যক অনুলিপি
তাদের কাছে ছিল, সেগুলো হারিয়ে ফেললো চিরকালের জন্য। তারপর
আযরা (উযাইর) কাহেনের যুগে বনী ইসরাঈলদের অবশিষ্ট লোকেরা বেবিলনের কারাগার থেকে
জেরুসালেমে ফিরে এলো এবং ভাইতুল মাসদিস পূনর্নিমান করা হলো। এ সময় উযাইর নিজের জাতির আরো
কয়েকজন মনীষীর সহায়তায় বনী ইসরাঈলদের পূর্ণ ইতিহাস লিখে ফেললেন। বর্তমান
বাইবেলের প্রথম সতেরোটি পরিচ্ছেদ এ ইতিহাস সম্বলিত। এ ইতিহাসের চারটি অধ্যায়
অর্থাৎ যাত্রা, লেবীয়, গণনা ও
দ্বিতীয় বিবরণে হযরত মূসা আ. এর জীবনী লিপিবদ্ধ হয়েছে। আযরা ও তার সহযোগীরা
তাওরাতের যতগুলো আয়াত সংগ্রহ করতে পেরেছিল এই জীবন ইতিহাসের বিভিন্ন স্থানে
অবতীর্ণের সময়-কাল ও ধারাবাহিকতা অনুযায়ী ঠিক জায়গামতো সেগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। কাজেই এখন
মূসা আ. এর জীবন ইতিহাসের মধ্যে সেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশের নামই তারওরাত। এগুলোকে
চিহ্নিত করার জন্য আমরা কেবলমাত্র নিম্নোক্ত আলামতের ওপর নির্ভর করতে পারি। এ
ঐতিহাসিক বর্ণনার মাঝখানে যেখানে লেখক বলেন, প্রভু মূসাকে একথা বললেন
অথবা মূসা বলেন, সদাপ্রভু তোমাদের প্রভু একথা বললেন, সেখান থেকে তাওরাতের একটি অংশ শুরু হচ্ছে, তারপর
আবার যেখান থেকে জীবনী প্রসংগ শুরু হয়ে গেছে সেখান থেকে ঐ অংশ খতম হয়ে গেছে ধরে
নিতে হবে। মাঝখানে যেখানে যেখানে বাইবেলের লেখক ব্যাখ্যা বা
টীকা আকারে কিছু অংশ বৃদ্ধি করেছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ও
বাছাই করে আসল তাওরাত থেকে আলাদা কিতাবসমূহের গভীর জ্ঞান রাখেন, তারা ঐসব অংশের কোথায় কোথায় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মূলক বৃদ্ধি করা হয়েছে
কিছুটা নির্ভুলভাবে তা অনুধাবন করতে পারেন। এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
অংশগুলোকেই কুরআন তাওরাত নামে আখ্যায়িত করেছে। কুরআন এগুলোকেই সত্য বলে
ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ অংশগুলোকে একত্র করে কুরআনের পাশাপাশি
দাঁড় করালে কোন কোন স্থানে ছোট খাটো ও খুঁটিনাটি বিধানের মধ্যে কিছু বিরোধ দেখা
গেলেও মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সামান্যতম পার্থক্যও পাওয়া যাবে না। আজও একজন
সচেতন পাঠক সুস্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারেন যে, এ দু’টি স্রোতধারা এক্ই
উৎস থেকে উৎসারিত।
অনুরূপভাবে ইনজীল হচ্ছে হযরত ঈসা আ. এর ইলহামী ভাষণ ও
বানী সমষ্টি, যা তিনি নিজের জীবনের শেষ আড়াই তিন বছরে
নবী হিসেবে প্রচার করেন। এ পবিত্র বাণীসমূহ তাঁর
জীবদ্দশায় লিখিত, সংকলিত ও বিন্যস্ত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্ক
জানার কোন উপায় আমাদের কাছে নেই। হতে পারে কিছু লোক সেগুলো
নোট করে নিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে, শ্রবণকারী
ভক্তবৃন্দ সেগুলো কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিলেন। যাহোক দীর্ঘকাল পরে হযরত ঈসা
আ. এর জীবন বৃত্তান্ত সম্বলিত বিভিন্ন পুস্তিকা রচনা কালে তাতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর
সাথে সাথে ঐ পুস্তিকাগুলোর রচয়িতাদের কাছে মৌখিক বানী ও লিখিত স্মৃতিকথা আকারে
হযরত ঈসার আ. যেসব বানী ও ভাষণ পৌঁছেছিল সেগুলোও বিভিন্ন স্থানে জায়গা মতো সংযোজিত
হয়েছিল। বর্তমানে মথি, র্মাক, লুক ও যোহন লিখিত যেসব পুস্তককে ইনজীল বলা হয় সেগুলো আসলে ইনজীল নয়। বরং ইনজীল
হচ্ছে ঐ পুস্তকগুলোতে সংযোজিত হযরত ঈসা আ. এর বানীসমূহ। আমাদের কাছে সেগুলো চেনার ও
জীবনীকারদের নিজেদের কথা থেকে সেগুলো আলাদা করার এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন মাধ্যম নেই
যে, যেখানে জীবনীকার বলেন, ঈসা বলেছেন অথবা মানুষকে
শিক্ষা দিয়েছেন-কেবলমাত্র এ স্থানগুলো আসল ইনজীলের অংশ। কুরআন এ
অংশগুলোর সমষ্টিকে ইনজীল নাম অভিহিত করে এবং এরই সত্যতার ঘোষণা দেয়। এ
বিক্ষিপ্ত অংশগুলোকে একত্র করে আজ যে কেউ কুরআনের পাশাপাশি রেখে এর সত্যতা বিচার
করতে পারেন। তিনি উভয়ের মধ্যে অতি সামান্য পার্থক্যই দেখতে পাবেন। আর যে
সামান্য পার্থক্য অনুভূত হবে পক্ষপাতহীন চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা
সহজেই দূর করা যাবে।
﴿مِن قَبْلُ
هُدًى لِّلنَّاسِ وَأَنزَلَ الْفُرْقَانَ ۗ إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ
لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ ذُو انتِقَامٍ﴾
৪। এখন যারা
আল্লাহর বিধানসমূহ মেনে নিতে অস্বীকার করবে, তারা অবশ্যি কঠিন শাস্তি পাবে। আল্লাহ
অসীম ক্ষমতার অধিকারী এবং তিনি অন্যায়ের শাস্তি দিয়ে থাকেন।
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَىٰ
عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ﴾
৫। পৃথিবী ও
আকাশের কোন কিছুই আল্লাহর কাছে গোপন নেই।৩
৩. অর্থাৎ তিনি বিশ্ব-জাহানের
যাবতীয় তত্ত্ব ও বাস্তব সত্য জানেন। কাজেই যে কিতাব তিনি নাযিল
করেছেন তা পরিপূর্ণ সত্যই হওয়া উচিত। বরং নির্ভেজাল সত্য একমাত্র
সেই কিতাবের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে যেটি সেই সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী সত্তার পক্ষ
থেকে পাঠানো হয়েছে।
﴿هُوَ الَّذِي
يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ
الْحَكِيمُ﴾
৬। তিনি
মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন।৪ এই প্রবল পরাক্রান্ত মহাজ্ঞানের অধিকারী সত্তা ছাড়া
আর কোন ইলাহ নেই।
৪. এখানে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ
সত্যের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। একঃ তোমাদের প্রকৃতিকে তাঁর
মতো করে কেউ জানতে পারে না, এমনকি তোমরা নিজেরাও জানতে পারো না। কাজেই তার
পথপ্রদর্শন ও পথনির্দেশনার ওপর আস্থা স্থাপন করা ছাড়া তোমাদের গত্যন্তর নেই। দুইঃ যিনি
গর্ভাশয়ে তোমাদের উৎপত্তি থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল পর্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে
তোমাদের ছোট ছোট প্রয়োজনগুলোও পূর্ণ করার ব্যবস্থা করেছেন, তিনি দুনিয়ার
জীবনে তোমাদের হিদায়াত ও পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবেন না, এটা
কেমন করে সম্ভব হতে পারে? অথচ তোমরা সবচেয়ে বেশী এ জিনিসটিরই
মুখাপেক্ষী।
﴿هُوَ الَّذِي
أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ
مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ
مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ
إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ
عِندِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ﴾
৭। তিনিই
তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবে
দুই ধরনের আয়াত আছেঃ এক হচ্ছে, মুহ্কামাত, যেগুলো কিতাবের আসল বুনিয়াদ৫ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, মুতাশাবিহাত।৬ যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে
সবসময় মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে থাকে। অথচ
সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। বিপরীত
পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলেঃ “আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই
এসেছে”।৭ আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান
লোকেরাই কোন বিষয় থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
৫. মুহকাম পাকাপোক্ত জিনিসকে
বলা হয়। এর বহুবচন ‘মুহকামাত’। ‘মুহকামাত আয়াত’
বলতে এমন সব আয়াত বুঝায় যেগুলোর ভাষা একেবারেই সুস্পষ্ট, যেগুলোর অর্থ নির্ধারণ করার ব্যাপারে কোন প্রকার সংশয়-সন্দেহে অবকাশ থাকে
না, যে শব্দগুলো দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য উপস্থাপন করে এবং
যেগুলোর অর্থ বিকৃত করার সুযোগ লাভ করা বড়ই কঠিন। এ আয়াত গুলো ‘কিতাবের আসল
বুনিয়াদ’। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে এ আয়াত
গুলো সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করে। এ আয়াত গুলোর মাধ্যমে
দুনিয়াবাসীকে ইসলামের দিকে আহবান জানানো হয়েছে। এগুলোতেই শিক্ষা ও উপদেশের
কথা বর্ণিত হয়েছে। ভ্রষ্টতার গলদ তুলে ধরে সত্য-সঠিক পথের চেহারা
সুস্পষ্ট করা হয়েছে। দীনের মূলনীতি এবং আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত,
চরিত্রনীতি,দায়িত্ব-কর্তব্য ও আদেশ-নিষেধের
বিধান এ আয়াত গুলোতেই বর্ণিত হয়েছে। কাজেই কোন সত্যানুসন্ধানী
ব্যক্তি কোন পথে চলবে এবং কোন পথে চলবে না, এ কথা জানার জন্য যখন কুরআনের
স্মরণাপন্ন হয় তখন এ ‘মুহকাম’ আয়াতগুলেঅই তার পথপ্রদর্শন করে। স্বাভাবিকভাবে
এগুলোর প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এবং এগুলো থেকে উপকৃত হবার জন্য সে প্রচেষ্টা
চালাতে থাকে।
৬. ‘মুতাশাবিহাত’
অর্থ যেসব আয়াতের অর্থ গ্রহণে সন্দেহ-সংশয়ের ও বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে
দেবার অবকাশ রয়েছে।
বিশ্ব-জাহানের অন্তর্নিহিত সত্য ও তাৎপর্য, তার সূচনা ও
পরিণতি, সেখানে মানুষের অবস্থান, মর্যাদা
ও ভূমিকা এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত সর্বনিম্ন অপরিহার্য
তথ্যাবলী মানুষকে সরবরাহ না করা পর্যন্ত মানুষের জীবন পথে চলার জন্য কোন পথনির্দেশ
দেয়া যেতে পারে না, এটি একটি সর্বজন বিদিত সত্য। আবার
একথাও সত্য, মানবিক ইন্দ্রিয়ানভুতির বাইরের
বস্তু-বিষয়গুলো, যেগুলো মানবিক জ্ঞানের আওতায় কখনো আসেনি এবং
আসতেও পারে না, যেগুলোকে সে কখনো দেখেনি, স্পর্শ করেনি এবং যেগুলোর স্বাদও গ্রহণ করেনি, সেগুলো
বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষার ভাণ্ডারে কোন শব্দও রচিত হয়নি এবং প্রত্যেক শ্রোতার
মনে তাদের নির্ভুল ছবি অংকিত করার মতো কোন পরিচিত বর্ণনা পদ্ধতিও পাওয়া যায় না। কাজেই এ
ধরনের বিষয় বুঝাবার জন্য এমন সব শব্দ ও বর্ণনা পদ্ধথিত অবলম্বন করা অপরিহার্য হয়ে
পড়ে, যেগুলো প্রকৃত সত্যের সাথে নিকটতর সাদৃশ্যের অধিকারী অনুভবযোগ্য জিনিসগুলো
বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষায় পাওয়া যায়। এ জন্য অতি প্রাকৃতিক তথা
মানবিক জ্ঞানের ঊর্ধের ও ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়গুলো বুঝাবার জন্য কুরআন মজীদে এ ধরনের
শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব আয়াতে এ ধরনের ভাষা ও
শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোকেই ‘মুতাশাবিহাত’ বলা হয়।
কিন্তু এ ভাষা ব্যবহারের ফলে মানুষ বড়জোর সত্যের
কাছাকাছি পৌছতে পারে অথবা সত্যের অস্পষ্ট ধারণা তার মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে, এর বেশী নয়। এ ধরনের
আয়াতের অর্থ নির্ণয়ের ও নির্দিষ্ট করনের জন্য যত বেশী চেষ্টা করা হবে তত বেশী
সংশয়-সন্দেহ ও সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে। ফলে মানুষ প্রকৃত সত্যের
নিকটতর হবার চাইতে বরং তার থেকে আরো দূরে সরে যাবে। কাজেই যারা সত্যসন্ধানী এবং
আজেবাজে অর্থহীন বিষয়ের চর্চা করার মানসিকতা যাদের নেই, তারা ‘মুতাশাবিহাত’ থেকে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অস্পষ্ট
ধারণা লাভ করেই সন্তুষ্ট থাকে। এতটুকুন ধারণাই তাদের কাজ
চালাবার জন্য যথেষ্ট হয়। তারপর তারা ‘মুহ্কামাত’
এর পেছনে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু যারা ফিতনাবাজ অথবা
বাজে কাজে সময় নষ্ট করতে অব্যস্ত, তাদের কাজই হয় মুতাশাবিহাতের আলোচনায়
মশগুল থাকা এবং তার সাহায্যেই তারা পেছন দিয়ে সিঁদ কাটে।
৭. এখানে এ অমূলক সন্দেহ করার
কোন প্রশ্নই ওঠে না যে, মুতাশাবিহাতের সঠিক অর্থ যখন তারা জানে না
তখন তারা তার ওপর কেমন করে ঈমান আনে? আসলে একজন সচেতন
বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তির মনে মুতাশাবিহাত আয়াত গুলোর দূরবর্তী অসংগত
বিশ্লেষন ও অস্পষ্ট বিকৃত ব্যাখার মাধ্যমে কুরআন আল্লাহর কিতাব হবার বিশ্বাস জন্মে
না। এ বিশ্বাস জন্মে মুহকামাত আয়াত গুলো অধ্যায়নের
মাধ্যমে। মুহকামাত আয়াতগুরোর মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার পর যখন
তার মনে কুরআন আল্লাহর কিতবা হবার ব্যপারে পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ততা আসে তখন
মুতাশাবিহাত তার মনে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব ও সংশয় সৃষ্টিতে সক্ষম হয় না। তাদের
যতটুকু সরল অর্থ সে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় ততটুকুই গ্রহণ করে নেয় করার নামে উল্টা
সিধা অর্থ করার পরিবর্তে সে আল্লাহর কালামের ওপর সামগ্রিকভাবে ঈমান এনে কাজের
কথাগুলোর দিকে নিজে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়।
﴿رَبَّنَا
لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً
ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ﴾
৮। তারা
আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেঃ “হে আমাদের রব!যখন তুমি আমাদের সোজা পথে চালিয়েছো
তখন আর আমাদের অন্তরকে বক্রতায় আচ্ছন্ন করে দিয়ো না, তোমার দান ভাণ্ডার থেকে
আমাদের জন্য রহমত দান করো কেননা তুমিই আসল দাতা।
﴿رَبَّنَا
إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَّا رَيْبَ فِيهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ
الْمِيعَادَ﴾
৯। হে আমাদের
রব! অবশ্যি তুমি সমগ্র মানব জাতিকে একদিন একত্রে সমবেত করবে, যে দিনটির আগমনের ব্যাপারে
কোন সন্দেহ নেই। তুমি কখনো ওয়াদা থেকে বিচ্যুত হও না।”
c রুকুঃ ২ d
﴿إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا
لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُم مِّنَ اللَّهِ شَيْئًا ۖ وَأُولَٰئِكَ
هُمْ وَقُودُ النَّارِ﴾
১০। যারা
কুফরী নীতি অবলম্বন করেছে,৮ তাদের না ধন–সম্পদ, না সন্তান–সন্ততি আল্লাহর
মোকাবিলায় কোন কাজে লাগবে। তারা দোজখের ইন্ধনে পরিণত
হবেই।
৮. এর ব্যাখ্যার জন্য সূরা আল
বাকারাহ-এর ১৬১ টীকা দেখুন।
﴿كَدَأْبِ
آلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ
بِذُنُوبِهِمْ ۗ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ﴾
১১। তাদের
পরিণম ঠিক তেমনি হবে যেমন ফেরাউনের সাথী ও তার আগের নাফরমানদের হয়ে গেছেঃ তারা
আল্লাহর আয়াতের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে, ফলে আল্লাহ তাদের গোনাহের
জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেছেন। আর যথার্থই আল্লাহ কঠোর
শাস্তিদানকারী।
﴿قُل لِّلَّذِينَ
كَفَرُوا سَتُغْلَبُونَ وَتُحْشَرُونَ إِلَىٰ جَهَنَّمَ ۚ وَبِئْسَ الْمِهَادُ﴾
১২। কাজেই হে
মুহাম্মাদ! যারা তোমরা দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো, তাদের বলে দাও, সেই সময় নিকটবর্তী যখন হবে, তোমরা পরাজিত হবে এবং তোমাদের
জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, আর জাহান্নাম বড়ই খারাপ আবাস।
﴿قَدْ كَانَ
لَكُمْ آيَةٌ فِي فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا ۖ فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأُخْرَىٰ
كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُم مِّثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ ۚ وَاللَّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ
مَن يَشَاءُ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّأُولِي الْأَبْصَارِ﴾
১৩। তোমাদের
জন্য সেই দু’টি দলের মধ্যে একটি শিক্ষার নিদর্শন ছিল যারা (বদরে) পরস্পর যুদ্ধে
লিপ্ত হয়েছিল। একটি দল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছিল এবং
অন্য দলটি ছিল কাফের। চোখের দেখায় লোকেরা দেখছিল, কাফেররা মু’মিনদের দ্বিগুণ।৯ কিন্তু ফলাফল (প্রমাণ করলো যে) আল্লাহ তাঁর বিজয় ও
সাহায্য দিয়ে যাকে ইচ্ছা সহায়তা দান করেছেন।
অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য এর মধ্যে বড়ই শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।১০
৯. যদিও আসল পার্থক্য ছিল
তিনগুণ। কিন্তু সরাসরি এক নজরে দেখে যে কেউ মনে করতে পারতো, কাফেরদের
সৈন্য সংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুন হবে।
১০. বদরের যুদ্ধ মাত্র কিছুদিন
আগে হয়ে গেছে। তার বিভিন্ন ঘটনা তখনো মানুষের মনে তরতাজা ছিল। তাই এ
যুদ্ধের ঘটনাবলী ও ফলাফলের প্রতি ইংগিত করে লোকদের উপদেশ দেয়া হয়েছে। এ যুদ্ধের
তিনটি বিষয় ছিল অত্যন্ত শিক্ষণীয়ঃ
একঃ মুসলমান ও কাফেররা যেভাবে
পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল তাতে উভয় দলের নৈতিক ও চারিত্রিক পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে
উঠেছিল। একিদেক কাফেরদের সেনাবাহিনীতে মদপানের হিড়িক চলছিল। তাদের
গায়িকা ও নর্তকী বাঁদীরা সংগে এসেছিল। ফলে সেনা শিবিরের ভোগের
পেয়ালা উপচে পড়ছিল। অন্যদিকে মুসলমানদের সেনাদল আল্লাহভীতি ও আল্লাহর
প্রতি আনুগত্যের স্নিগ্ধ পরিবেশ বিরাজমান ছিল। তাদের মধ্যে ছিল চরম নৈতিক
সংযম। সৈন্যরা নামায-রোয়ায় মশগুল ছিল। কথায় কথায় আল্লাহর নাম
উচ্চারিত হচ্ছিল এবং আল্লাহর কাছে দোয়া ও করুণা ভিক্ষা মহড়া চলছিল। দু’টি
সৈন্য দল দেখে যে কোন ব্যক্তি অতি সহজেই জানতে পারতো, কোন দলটি
আল্লাহর পথে লড়াই করছে।
দুইঃ মুসলমানরা তাদের সংখ্যাল্পতা
ও সমরাস্ত্রের অভাব সত্ত্বেও যেভাবে কাফেরদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ও উন্নত অস্ত্রসজ্জায়
সেনাদলের ওপর বিজয় লাভ করলো তাতে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, তারা আল্লাহর
সাহায্যপুষ্ট ছিল।
তিনঃ আল্লাহর প্রবল প্রতাপান্বিত
ক্ষমতা সম্পর্কে গাফেল হয়ে যারা নিজেদের সাজ-সরঞ্জাম ও সমর্থকদের সংখ্যাধিক্যের
কারণে আত্নম্ভরিকতায় মেতে উঠেছিল, তাদের জন্য এ ঘটনাই ছিল যথার্থই একটি
চাবুকের আঘাত। আল্লাহ কিভাবে মাত্র গুটিকয় বিত্তহীন, অভাবী ও
প্রবাসী মুহাজির এবং মদীনার কৃষক সমাজের মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় কুরাইশদের
মতো অভিজাত শক্তিশালী ও সমগ্র আরবীয় সমাজের মধ্যমণি গোত্রকে পরাজিত করতে পারেন,
তা তারা স্বচক্ষেই দেখে নিল।
﴿زُيِّنَ
لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ
مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ
ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ﴾
১৪। মানুষের
জন্য নারী, সন্তান, সোনারুপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদী পশু ও কৃষি ক্ষেতের
প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু
এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র।
প্রকৃতপক্ষে উত্তম আবাস তো রয়েছে আল্লাহর কাছে।
﴿قُلْ أَؤُنَبِّئُكُم
بِخَيْرٍ مِّن ذَٰلِكُمْ ۚ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي
مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ
مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ﴾
১৫। বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো, ওগুলোর চাইতে ভালো জিনিস কি? যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন
করে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বাগান, তার নিম্নদেশে ঝরণাধারা
প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরন্তন জীবন লাভ করবে। পবিত্র
স্ত্রীরা হবে তাদের সংগিনী১১ এবং তারা লাভ করবে আল্লাহর
সন্তুষ্টি। আল্লাহ তার বান্দাদের কর্মনীতির ওপর গভীর
ও প্রখর দৃষ্টি রাখেন।১২
১১. এর ব্যাখ্যা দেখুন সূরা আল
বাকারাহ-এর ২৭ টীকায়।
১২. অর্থাৎ আল্লাহ অপাত্রে দান
করেন না। উপরি উপরি বা ভাসাভাসাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তার
নীতি নয়। তিনি তার বান্দাহদের কার্যাবলী, সংকল্প ও
ইচ্ছা পুরোপুরি ও ভালোভাবেই জানেন। কে পুরুস্কার লাভের যোগ্য আর
কে যোগ্য নয়, তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন।
﴿الَّذِينَ
يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ
النَّارِ﴾
১৬। এ লোকেরাই
বলেঃ “হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, আমাদের গোনাহখাতা মাফ করে দাও এবং
জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদের বাচাঁও। এরা
সবরকারী,১৩
১৩. অর্থাৎ সত্য পথে পূর্ণ
অবিচলতার সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। কোন ক্ষতি বা বিপদের মুখে
কখনো সাহস ও হিম্মতহারা হয় না। ব্যর্থতা এদের মনে কোন চিড়
ধরায় না। লোভ-লালসায় পা পিছলে যায় না। যখন আপাতদৃষ্টিতে সাফল্যের
কোন সম্ভাবনাই দেখা যায় না তখনো এরা মজবুতভাবে সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকে। (সূরা আল
বাকারাহ-এর ৬০ টীকাটিও দেখে নিন)।
﴿الصَّابِرِينَ
وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنفِقِينَ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ﴾
১৭। সত্যনিষ্ঠ, অনুগত ও দানশীল এবং রাতের
শেষভাগে আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফের জন্য দোয়া করে থাকে।”
﴿شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا
إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ ۚ لَا
إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
১৮। আল্লাহ
নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাই নেই।১৪ আর ফেরেশতা ও সকল জ্ঞানবান লোকই সততা ও
ন্যায়পরায়ণতার সাথে এ সাক্ষ্য দিচ্ছে১৫ যে, সেই প্রবল পরাক্রান্ত ও
জ্ঞানবান সত্তা ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।
১৪. অর্থাৎ যে আল্লাহ
বিশ্ব-জাহানের সমস্ত তত্ব, সত্য ও রহস্যের প্রত্যক্ষ জ্ঞান রাখেন,
যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে আবরণহীন অবস্থায় দেখছেন এবং যার দৃষ্টি থেকে
পৃথিবী ও আকাশের কোন একটি বস্তুও গোপন নেই-এটি তার সাক্ষ্য এবং তার চাইতে আর বেশী নির্ভরযোগ্য
চাক্ষুষ সাক্ষ্য আর কে দিতে পারে? কারণ সমগ্র সৃষ্টিজগতে
তিনি ছাড়া আর কোন সত্তা খোদায়ী গুণান্বিত নয়। আর কোন সত্তা খোদায়ী
কর্তৃত্বের অধিকারী নয় এবং আর কারোর খোদায়ী করার যোগ্যতাও নেই।
১৫. আল্লাহর পর সবচেয়ে বেশী
নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য হচ্ছে ফেরেশতাদের। কারণ তারা হচ্ছে
বিশ্বরাজ্যের ব্যবস্থাপনার কার্যনির্বাহী ও কর্মচারী। তারা সরাসরি নিজেদের
ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই বিশ্বারাজ্যে আল্লাহ
ছাড়া আর আরো হুকুম চলে না এবং পৃথিবী ও আকাশের পরিচালনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে
তিনি ছাড়া আর কোন সত্তা এমন নেই যার কাছ থেকে তারা নির্দেশ গ্রহণ করতে পারে।
ফেরেশতাদের পরে এই সৃষ্টিজগতে আর যারাই প্রকৃত সত্য সম্পর্কে কম বেশী কিছুটা জ্ঞান
রাখে, সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তকার তাদের সবার সর্বসম্মত সাক্ষ্য হচ্ছে
এই যে, আল্লাহ একাই এই সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক, পরিচাল ও প্রভু।
﴿إِنَّ
الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ ۗ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ
إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ۗ وَمَن يَكْفُرْ بِآيَاتِ
اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾
১৯। ইসলাম
আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন–জীবনবিধান।১৬ যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারা এ দীন থেকে সরে গিয়ে
যেসব বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, সেগুলো অবলম্বনের এ ছাড়া আর কোন কারণই ছিল
না যে, প্রকৃত
জ্ঞান এসে যাওয়ার পর তারা নিজেদের মধ্যে পরস্পরের ওপর বাড়াবাড়ি করার জন্য এমনটি
করেছে।১৭ আর যে কেউ আল্লাহর হেদায়াতের
আনুগত্য করতে অস্বীকার করে, তার কাছ থেকে হিসেব নিতে আল্লাহর মোটেই
দেরী হয় না।
১৬. অর্থাৎ আল্লাহর কাছে মানুষের
জন্য একটি মাত্র জীবন ব্যবস্থা ও একটি মাত্র জীবন বিধান সঠিক ও নির্ভুল বলে গৃহীত। সেটি
হচ্ছে, মানুষ আল্লাহকে নিজের মালিক ও মাবুদ বলে স্বীকার করে নেবে এবং তাঁর ইবাদাত,
বন্দেগী ও দাসত্বের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেবে। আর তাঁর
বন্দেগী করার পদ্ধতি নিজের আবিষ্কার করবে না। বরং তিনি নিজের
নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে যে হিদায়ত ও বিধান পাঠিয়েছেন কোন প্রকার কমবেশী না করে তার
অনুসরণ করবে। এই চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির নাম “ইসলাম” আর
বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার ও প্রভর নিজের সৃষ্টিকূল ও প্রজা সাধারনের জন্য ইসলাম ছাড়া
অন্য কোন কর্মপদ্ধতির বৈধতার স্বীকৃতি না দেয়াও পুরোপুরি ন্যায়সংগত। মানুষ তার
নির্বুদ্ধিতার কারণে নাস্তিক্যবাদ থেকে নিয়ে শিরক ও মূর্তিপূজা পর্যন্ত যে কোন
মতবাদ ও যে কোন পদ্ধতির অনুসরণ করা নিজের জন্য বৈধ মনে করতে পারে কিন্তু
বিশ্ব-জাহানের প্রভুর দৃষ্টির এগুলো নিছক বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৭. এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ
থেকে দুনিয়ার যে কোন অঞ্চলে যে কোন যুগে যে নবীই এসেছেন, তাঁর
দীনই ছিল ইসলাম। দুনিয়ার যে কোন জাতির ওপর যে কিতাবই
নাযিল হয়েছে, তা ইসলামেরই শিক্ষা দান করেছে। এই আসল
দীনকে বিকৃত করে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে যেসব ধর্ম মানুষের মধ্যে
প্রচলিত হয়েছে, তাদের জন্ম ও উদ্ভবের কারণ ও ছাড়া আর কিছুই
ছিল না যে, লোকেরা নিজেদের বৈধ সীমা অতিক্রম নিজেদের খেয়াল
খুশী মতো আসল দীনের আকীদা-বিশ্বাস, মূলনীতি ও বিস্তারিত বিধান
পরিবর্তন করে ফেলেছে।
﴿فَإِنْ
حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ ۗ وَقُل لِّلَّذِينَ
أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ ۚ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوا
ۖ وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ﴾
২০। এখন যদি এ
লোকেরা তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের বলে দাওঃ “আমি ও আমার অনুগতরা
আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নত করেছি।” তারপর
আহলি কিতাব ও অ-আহলি কিতাব উভয়কে জিজ্ঞেস করো, “তোমরাও কি তাঁর বন্দেগী কবুল
করেছো?”১৮ যদি করে থাকে তাহলে ন্যায় ও সত্যের পথ লাভ
করেছে আর যদি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে, তাহলে তোমার ওপর কেবলমাত্র
পয়গাম পৌছিয়ে দেবার দায়িত্বই অর্পিত হয়েছিল। পরবর্তী
পর্যায়ে আল্লাহ নিজেই তার বান্দাদের অবস্থা দেখবেন।
১৮. অন্য কথায় এ বক্তব্যটিকে
এভাবে বলা যায়, যেমনঃ “আমি ও আমার
অনুসারীরা তো সেই নির্ভেজাল ইসলামের স্বীকৃতি দিয়েছি, যেটি
আল্লাহর আসল দীন ও জীবন বিধান। এখন তোমরা বলো, তোমরা ও
তোমাদের পুর্বপুরুষরা দীনের মধ্যে যে পরিবর্তন সাধন করেছো তা বাদ দিয়ে এই আসল ও
প্রকৃত দীনের দিকে কি তোমরা ফিরে আসবে?
﴿إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ
بِآيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَيَقْتُلُونَ الَّذِينَ
يَأْمُرُونَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ﴾
২১। যারা
আল্লাহর বিধান ও হিদায়াত মানতে অস্বীকার করে এবং তাঁর নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা
করে আর এমন লোকদের প্রাণ সংহার করে, যারা মানুষের মধ্যে ন্যায়, ইনসাফ ও সততার নির্দেশ দেবার
জন্য এগিয়ে আসে, তাদের কঠিন
শাস্তির সুসংবাদ দাও।১৯
১৯. এটি একিট ব্যাংগাত্মক
বর্ণনাভংগী। এই বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, নিজেদের যে
সমস্ত কীর্তিকলাপের দরুন তারা আজ আনন্দে ফুলে উঠেছে এবং মনে করছে যে তারা খুব ভালো
কাজ করে বেড়াচ্ছে, তাদের জানিয়ে দাও, তোমাদের
এ সমস্ত কাজের এই হচ্ছে প্রতিফল।
﴿أُولَٰئِكَ
الَّذِينَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ﴾
২২। এরা এমন
সব লোক যাদের কর্মকাণ্ড (আমল) দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই নষ্ট হয়ে গেছে২০ এবং এদের কোন সাহায্যকারী নেই।২১
২০. অর্থাৎ তারা নিজেদের শক্তি ও
প্রচেষ্টাসমূহ এমন সব কাজে নিয়োজিত করেছে যার ফল দুনিয়াতে যেমন খারাপ তেমনি
আখেরাতেও খারাপ।
২১. অর্থাৎ এমন কোন শক্তি নেই, যে তাদের এসব
ভুল প্রচেষ্টা ও অসৎকার্যাবলীকে সুফলদায়ক করতে অথবা কমপক্ষে খারাপ পরিণতি থেকে
বাঁচাতে পারে। দুনিয়ায় বা আখেরাতে অথবা উভয় স্থানে
তাদের কাজে লাগবে বলে যেসব শক্তির ওপর তারা ভরসা করে, তাদের মধ্য
থেকে আসলে কেউই তাদের সাহায্যকারী প্রমাণিত হবে না।
﴿أَلَمْ
تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِّنَ الْكِتَابِ يُدْعَوْنَ إِلَىٰ كِتَابِ
اللَّهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ يَتَوَلَّىٰ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ وَهُم مُّعْرِضُونَ﴾
২৩। তুমি কি
দেখনি কিতাবের জ্ঞান থেকে যারা কিছু অংশ পেয়েছে, তাদের কি অবস্থা হয়েছে? তাদের যখন আল্লাহর কিতাবের দিকে
সে অনুযায়ী তাদের পরস্পরের মধ্যে ফায়সালা করার জন্য আহবান জানানো হয়২২ তখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল পাশ কাটিয়ে
যায় এবং এই ফায়সালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
২২. অর্থাৎ তাদের বলা হয়, আল্লাহর
কিতাবকে চূড়ান্ত সনদ হিসেবে মেনে নাও এবং তাঁর ফায়সালার সামনে মাথা নত করে দাও। এই
কিতাবের দৃষ্টিতে যা হক প্রমাণিত হয় তাকে হক বলে এবং যা বাতিল প্রমাণিত হয় তাকে
বাতিল বলে মেনে নাও। এখানে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর
কিতাব বলতে এখানে তাওরাত ও ইনজীলকে বুঝানো হয়েছে। আর কিতাবের জ্ঞানের কিছু অংশ
লাভকারী বলতে ইহুদী ও খৃষ্টান আলেমদের কথা বুঝানো হয়েছে।
﴿ذَٰلِكَ
بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَن تَمَسَّنَا النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ ۖ وَغَرَّهُمْ
فِي دِينِهِم مَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ﴾
২৪। তাদের এ
কর্মপদ্ধতির কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলেঃ “জাহান্নামের আগুন তো আমাদের
স্পর্শও করবে না। আর যদি জাহান্নামের শাস্তি আমরা পাই
তাহলে তা হবে মাত্র কয়েক দিনের।”২৩ তাদের মনগড়া বিশ্বাস নিজেদের দীনের
ব্যাপারে তাদেরকে বড়ই ভুল ধারণার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।
২৩. তারা নিজেদেরকে আল্লাহর
প্রিয়পাত্র মনে করে বসেছে। তাদের মনে এই ভুল ধারণা
বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, তারা যাই কিছু করুক না কেন জান্নাত তাদের
নামে লিখে দেয়া হয়ে গেছে, তারা ঈমানদার গোষ্ঠী, তারা উমুকের সন্তান, উমুকের উম্মাত, উমুকের মুরীদ এবং উমুকের হাতে হাত রেখেছে,কাজেই জাহান্নামের
আগুনের কোন ক্ষমতাই নেই তাদেরকে স্পর্শ করার। আর যদিওবা তাদেরকে কখনো
জাহান্নামে দেয়া হয়,তাহলেও তা হবে মাত্র কয়েক দিনের জন্য। গোনাহের
যে দাগগুলো গায়ে লেগে গেছে সেগুলো মুছে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে তাদেরকে সোজা
জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ ধরনের চিন্তাধারা তাদের
এমনি নির্ভিক বানিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে তারা নিশ্চিন্তে কঠিন থেকে
কঠিনতর অপরাধ করে যেতো, নিকৃষ্টতম গোনাহের কাজ করতো, প্রকাশ্যে সত্যর বিরোধিতা করতো এবং এ অবস্থায় তাদের মনে সামান্যতম আল্লাহ
ভয়ও জাগতো না।
﴿فَكَيْفَ
إِذَا جَمَعْنَاهُمْ لِيَوْمٍ لَّا رَيْبَ فِيهِ وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ
وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ﴾
২৫। কিন্তু
সেদিন কি অবস্থা হবে, যেদিন আমি তাদের একত্র করবো, যেদিনটির আসা একেবারেই
অবধারিত? সেদিন
প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার উপার্জনের পুরোপুরি প্রতিদান দেয়া হবে এবং কারো ওপর জুলুম
করা হবে না।
﴿قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ
الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ وَتُعِزُّ
مَن تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَاءُ ۖ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ
قَدِيرٌ﴾
২৬। বলোঃ হে
আল্লাহ! বিশ্ব–জাহানের মালিক! তুমি যাকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা দান করো এবং যার থেকে
চাও রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নাও। যাকে চাও মর্যাদা ও ইজ্জত
দান করো এবং যাকে চাও লাঞ্জিত ও হেয় করো। কল্যাণ
তোমরা হাতেই নিহিত। নিসন্দেহে তুমি সবকিছুর ওপর
শক্তিশালী।
﴿تُولِجُ
اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ ۖ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ
مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ ۖ وَتَرْزُقُ مَن تَشَاءُ بِغَيْرِ
حِسَابٍ﴾
২৭। তুমি
রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করাও এবং দিনকে রাতের মধ্যে। জীবনহীন
থেকে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও এবং জীবন্ত থেকে জীবনহীনের। আর যাকে
চাও তাকে তুমি বেহিসেব রিযিক দান করো।২৪
২৪. মানুষ যখন একদিকে কাফের ও
নাফরমানদের কার্যলাপ দেখে এবং তারপর দেখে কিতাবে দিনের পর দিন তাদের বিত্ত ও প্রাচুর্য
বেড়ে যাচ্ছে, আবার অন্যদিকে দেকে ঈমানদারদের আনুগত্যের
পসরা এবং তারপর তাদের দারিদ্র্য, অভাব অনাহারে জর্জরিত জীবন,
আর দেখে তাদের একের পর এক বিপদ মুসিবত ও দূঃখ দুর্দশার শিকার হতে,
নবী সা. ও তার সাহাবীগণ তৃতীয় হিজরী ও তার কাছাকাছি সময়ে যার শিকার হয়েছিলেন,
তখন স্বাভাবিকভাবেই তার মনের মধ্যে একটি অদ্ভুত আক্ষেপ মিশ্রিত
জিজ্ঞাসা জেগে উঠে। আল্লাহ এখানে এই জিজ্ঞাসার
জবাব দিয়েছেন। এমন সূক্ষ্মভাব দিয়েছেন, যার চেয়ে
বেশী সুক্ষ্মতার কথা কল্পনাই করা যায় না।
﴿لَّا يَتَّخِذِ
الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ
ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً ۗ
وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ ۗ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ﴾
২৮। মু’মিনরা
যেন ঈমানদারদের বাদ দিয়ে কখনো কাফেরদেরকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক, বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে গ্রহণ
না করে। যে এমনটি করবে, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক
নেই। তবে হ্যাঁ, তাদের জুলুম থেকে আত্মরক্ষার
জন্য তোমরা যদি বাহ্যত এ নীতি অবলম্বন করো তাহলে তা মাফ করে দেয়া হবে।২৫ কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের
সত্তার ভয় দেখাচ্ছেন আর তোমাদের তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।২৬
২৫. অর্থাৎ যদি কোন মু’মিন কোন
ইসলাম দুশমন দলের ফাঁদে আটকা পড়ে যায় এবং সে তাদের জুলুম-নির্যাতন চালাবার আশংকা
করে, তাহলে এ অবস্থায় তাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে, সে নিজের
ঈমান লুকিয়ে রেখে কাফেরদের সাথে বাহ্যত এমনভাবে অবস্থান করতে পারে যেন সে তাদেরই
একজন। অথবা যদি তার মুসলমান হবার কথা প্রকাশ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে নিজের
প্রাণ বাঁচাবার জন্য সে কাফেরদের প্রতি বন্ধুত্বের মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। এমনি কি
কঠিন ভয়ভীতি ও আশংকাপূর্ণ অবস্থায় যে ব্যক্তি সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে,তাকে কুফরী
বাক্য পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করার অনুমতিটুকু দেয়া হয়েছে।
২৬. অর্থাৎ মানুষের ভয় যেন
তোমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন না করে ফেলে যার ফলে আল্লাহর ভয় মন থেকে উবে যায়। মানুষ
বড়জোর তোমার পার্থিব ও বৈষিক স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে, যার পরিসর
দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আল্লাহ তোমাকে
চিরন্তন আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারেন।কাজেই নিজের প্রাণ বাঁচাবার
জন্য যদি কখনো বাধ্য হয়ে কাফেরদের সাথে আত্মরক্ষামূলক বন্ধুত্বনীতি অবলম্বন করতে
হয়,তাহলে তার পরিসর কেবলমাত্র ইসলামের মিশন, ইসলামী
জামায়াতের স্বার্থ ও কোন মুসলমানের ধন-প্রাণের ক্ষতি না করেই নিজের জানমালের
হেফাজত করে নেয়া পর্যন্তই সীমিত হতে পারে। কিন্তু সাবধান, তোমার
মাধ্যমে যেন কুফর ও কাফেরদের এমন কোন খেদমত না হয় যার ফলে ইসলামের মোকাবিলায় কুফরী
বিস্তার লাভ করে এবং মুসলমানদের ওপর কাফেরদের বিজয় লাভ ও আধিপত্য ও বিস্তারের পথ
প্রশস্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। অবশ্যি একথা ভালোভাবে জেনে
রাখতে হবে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে যদি তোমরা আল্লাহর দীনকে অথবা মু’মিনদের জামায়াতকে
বা কোন মুসলিম ব্যক্তিকে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে থাকো অথবা আল্লাহদ্রোহীদের কোন
যথার্থ খেদমত করে থাকো, তাহলে আল্লাহর পাকড়াও থেকে তোমরা কোনক্রমেই
রক্ষা পেতে পারবে না। তোমাদের তো অবশেষে তার কাছে
যেতেই হবে।
﴿قُلْ إِن
تُخْفُوا مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللَّهُ ۗ وَيَعْلَمُ مَا
فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
২৯। হে নবী!
লোকদের জানিয়ে দাও, তোমাদের
মনের মধ্যে যা কিছু আছে তাকে তোমরা লুকিয়ে রাখো বা প্রকাশ করো, আল্লাহ তা জানেন। পৃথিবী ও
আকাশের কোন কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে অবস্থান করছে না এবং তার কর্তৃত্ব সবকিছুর
ওপর পরিব্যাপ্ত।
﴿يَوْمَ
تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَيْرٍ مُّحْضَرًا وَمَا عَمِلَتْ مِن سُوءٍ
تَوَدُّ لَوْ أَنَّ بَيْنَهَا وَبَيْنَهُ أَمَدًا بَعِيدًا ۗ وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ
نَفْسَهُ ۗ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ﴾
৩০। সেদিন
আসবে, যেদিন
প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের ফল সামনে উপস্থিত পাবে, তা ভালো কাজই হোক আর মন্দ কাজ। সেদিন
মানুষ কামনা করবে, হায়! যদি
এখনো এই দিন এর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতো! আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের সত্তার
ভয় দেখাচ্ছেন। আর তিনি নিজের বান্দাদের গভীর শুভাকাংখী।২৭
২৭. অর্থাৎ তিনি পূর্বাহ্নেই
তোমাদের এমনসব কাজ থেকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যা পরিণামে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর হতে
পারতো, এটা তার চরম কল্যাণাকাংখারই প্রকাশ।
﴿قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ
اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ
غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৩১। হে নবী!
লোকদের বলে দাওঃ “যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন
এবং তোমাদের গোহাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই
ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” তাদেরকে বলোঃ আল্লাহ ও
রাসূলের আনুগত্য করো।
﴿قُلْ أَطِيعُوا
اللَّهَ وَالرَّسُولَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ﴾
৩২। তারপর যদি
তারা তোমাদের এ দাওয়াত গ্রহণ না করে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ এমন লোকদের
ভালোবাসবেন না, যারা তাঁর
ও তাঁর রাসূলদের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে।২৮
২৮. প্রথম ভাষণটি এখানেই শেষ
হয়েছে। এর বিষয়বস্তু, বিশেষ করে এর মধ্যে
বদরযুদ্ধের দিকে যে ইংগিত করা হয়েছে, তার বর্ণনাভংগী
সম্পর্কে চিন্তা করলে এই ভাষণটি বদর যুদ্ধের পরে এবং ওহোদ যুদ্ধের আগে অর্থাৎ ৩ হিজরীতে
নাযিল হয়েছিল বলে প্রবল ধারণা জন্মাবে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের
বর্ণনা থেকে সাধারণ লোকদের এই ভুল ধারণা হয়েছে যে, এই সূরার
প্রথম ৮টি আয়াত নাজরানের প্রতিনিধি দলের আগমেনর সময় হিজরী ৯ সনে নাযিল হয়েছিল। কিন্তু
প্রথমত এই ভূমিকা হিসেবে প্রদত্ত ভাষনটির বিষয়বস্তু পরিষ্কারভাবে একথা তুলে ধরেছে
যে, এটি তার অনেক আগেই নাযিল হয়ে থাকবে। দ্বিতীয়, মুকাতিল ইবনে
সুলাইমানের রেওয়ায়াতে একথা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে, নাজরানের
প্রতিনিধিদলের আগমেনর সময় কেবলমাত্র হযরত ইয়াহ্ইয়া আ. ও হযরত ঈসা আ. এর বর্ণনা
সম্বলিত ৩০ টি বা তার চেয়ে কিছু বেশী আয়াত নাযিল হয়েছিল।
﴿إِنَّ
اللَّهَ اصْطَفَىٰ آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ﴾
৩৩। আল্লাহ২৯ আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর ও ‘ইমরানের
বংশধরদেরকে৩০ সমগ্র বিশ্ববাসীর ওপর
প্রাধান্য দিয়ে (তাঁর রিসালতের জন্য) মনোনীত করেছিলেন।
২৯. এখান থেকে দ্বিতীয় ভাষণটি
শুরু হচ্ছে। নবম হিজরী সনে নাজরানের খৃষ্টীয় প্রজাতন্ত্রের
প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ সা. এর দরবারে হাযির হবার পর এ অংশটি নাযিল হয়েছিল। হিজায ও
ইয়ামনের মাঝখানে নাজরান এলাকা অবস্থিত। সে সময় এ এলাকায় ৭২টি জনপদ
ছিল। বলা হয়ে থাকে, এই জনপদগুলো থেকে সে সময়
এক লাখ বিশ হাজার যুদ্ধ করার যোগ্যতা সম্পন্ন জওয়ান বের হয়ে আসতে পারতো। এলাকার
সমগ্র অধিবাসীই ছিল খৃস্টান। তিনজন দলনেতার অধীনে তারা
শাসিত হতো। একজনকে বলা হতোঃ আকেব। তিনি ছিলেন জাতীয় প্রধান।
দ্বিতীয়জনকে বলা হতো সাইয়েদ। তিনি জাতির তামাদ্দুনিক ও
রাজনৈতিক বিষয়গুলো দেখাশুনো করতেন। তৃতীয়জনকে বলা হতোঃ উসকুফ্
(বিশপ)। তিনি ছিলেন ধর্মীয় বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত। নবী সা.
এর মক্কা বিজয়ের পর যখন সমগ্র আরববাসীর মনে এ বিশ্বাস জন্মালো যে, দেশের
ভবিষ্যৎ এখন মুহাম্মাদ সা. এর হাতে তখন আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে তার কাছে
প্রতিনিধি দলের আগমন হতে লাগলো। এই সময় নাজরানের তিনজন
দলনেতাও ৬০ জনের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তারা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত
ছিল ন। তখন প্রশ্ন ছিল, তারা ইসলামগ গ্রহণ করবে,
না যিম্মী হয়ে থাকবে। এ সময় মহান আল্লাহ নবী সা.
এর ওপর এ ভাষণটি নাযিল করেন। এর মাধ্যমে নাজরানের
প্রতিনিধি দলেনর সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করার ব্যবস্থা করা হয়।
৩০. ইমরান ছিল হযরত মূসা ও
হারুনের পিতার নাম। বাইবেলে তাঁকে “আমরাম” বলা হয়েছে।
﴿ذُرِّيَّةً
بَعْضُهَا مِن بَعْضٍ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
৩৪। এরা সবাই
একই ধারায় অন্তরগত ছিল, একজনের উদ্ভব ঘটেছিল অন্যজনের বংশ থেকে। আল্লাহ
সবকিছু শোনেন ও জানেন।৩১
৩১. খৃষ্টানদের ভ্রষ্টতার
প্রধানতম কারণ এই যে,তারা হযরত ঈসাকে আ. আল্লাহার বান্দা ও নবী
হবার পরিবর্তে তাঁকে আল্লাহর পুত্র ও আল্লাহর কর্তৃত্বে অংশীদার গণ্য করে। তাদের
বিশ্বাসের এই মৌলিক গলদটি দূর করতে পারলে সঠিক ও নির্ভুল ইসলামের দিকে তাদের
ফিরিয়ে আনা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাই এই ভাষনের ভূমিকা এভাবে
ফাঁদা হয়েছেঃ আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশের
ও ইমরানের বংশের সকল নবীই ছিলেন মানুষ। একজনের বংশে আর একজনের জন্ম
হয়েছে। তাদের কেউ খোদা ছিলেন না। তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, আল্লাহর তার
দীনের প্রচার ও দুনিয়াবাসীর সংশোধনের জন্য তাদেরকে মনোনীত করেছিলেন।
﴿إِذْ قَالَتِ
امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ
مِنِّي ۖ إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾
৩৫। (তিনি তখন
শুনছিলেন) যখন ইমরানের মহিলা৩২ বলছিলঃ “হে আমার রব! আমার
পেটে এই যে সন্তানটি আছে এটি আমি তোমাদের জন্য নজরনা দিলাম, সে তোমার জন্য উৎসর্গ হবে। আমার এই
নজরানা কবুল করে নাও। তুমি সবকিছু শোনো ও জানো।”৩৩
৩২. ‘ইমরানের মহিলা‘
শব্দের অর্থ এখানে যদি ইমরানের স্ত্রী ধরা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এখানে সেই ইমরানের কথা বলা হয়নি যার প্রসংগে ইতিপূর্বে
উল্লেখিত হয়েছে। বরং ইনি ছিলেন হযরত মারইয়ামের আ. পিতা। সম্ভবত এ
নাম ছিল ইমরান। আর ‘ইমরানের মহিলা‘ শব্দের অর্থ যদি ধরা হয় ইমরান বংশের মহিলা, তাহলে
হযরত মারইয়ামের আ. মা ইমরান বংশের মেয়ে ছিলেন একথাই বুঝতে হবে। কিন্তু এই
দু’টি অর্থের মধ্য থেকে কোন একটিকে চূড়ান্তভাবে অগ্রাধিকার দেবার জন্য কোন তথ্য
মাধ্যম আমাদের হাতে নেই। কারণ হযরত মারইয়ামের পিতা কে ছিলেন এবং
তাঁর মাতা ছিলেন কোন বংশের মেয়ে-এ বিষয়ে ইতিহাসে কোন উল্লেখ নেই। তবে হযরত
ইয়াহ্ইয়ার মাতা ও হযরত মারইয়ামের মাতা পরস্পর আত্মীয় ছিলেন, এই বর্ণনাটি
যদি সঠিক বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলে ইমরান বংশের মেয়ে-ই হবে “ইমরানের মহিলা” শব্দের সঠিক অর্থ। কারণ লুক লিখিত ইনজীলে আমরা
সুস্পষ্টভাবে পাই যে, হযরত ইয়াহ্ইয়ার মাতা হযরত হারুনের বংশধর
ছিলেন। (লুকঃ ৫)
৩৩. অর্থাৎ তুমি নিজের বান্দাদের
প্রার্থনা শুনে থাকো এবং তাদের মনের অবস্থা জানো।
﴿فَلَمَّا
وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنثَىٰ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ
وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنثَىٰ ۖ وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا
بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ﴾
৩৬। তারপর যখন
সেই শিশু কন্যাটি তার ওখানে জন্ম নিল, সে বললোঃ “হে আমার প্রভু! আমার এখানে তো
মেয়ে জন্ম নিয়েছে। অথচ সে যা প্রসব করেছিল তা আল্লাহর জানাই
ছিল। –আর পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মতো হয়
না।৩৪ যা হোক আমি তার নাম রেখে
দিলাম মারইয়াম। আর আমি তাকে ও তার ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে
অভিশপ্ত শয়তানের ফিতনা থেকে রক্ষার জন্য তোমরা আশ্রয়ে সোপর্দ করছি।’’
৩৪. অর্থাৎ মেয়েরা এমন অনেক
প্রাকৃতিক দুর্বলতা ও তামাদ্দুনিক বিধি-নিষেধের আওতাধীন থাকে, যেগুলো থেকে
ছেলেরা থাকে মুক্ত। কাজেই ছেলে জন্ম নিলে আমি যে
উদ্দেশ্যে নিজের সন্তান তোমার পথে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলাম, তা ভালোভাবে
পূর্ণ হতো।
﴿فَتَقَبَّلَهَا
رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا
ۖ كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزْقًا ۖ قَالَ
يَا مَرْيَمُ أَنَّىٰ لَكِ هَٰذَا ۖ قَالَتْ هُوَ مِنْ عِندِ اللَّهِ ۖ إِنَّ اللَّهَ
يَرْزُقُ مَن يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾
৩৭। অবশেষে
তার রব কন্যা সন্তানটিকে সন্তুষ্টি সহকারে কবুল করে নিলেন, তাকে খুব ভালো মেয়ে হিসেবে
গড়ে তুললেন এবং যাকারিয়াকে বানিয়ে দিলেন তার অভিভাবক। যাকারিয়া৩৫ যখনই তার কাছে মিহরাবে৩৬ যেতো, তার কাছে কিছু না কিছু
পানাহার সামগ্রী পেতো। জিজ্ঞেস করতোঃ ‘‘মারইয়াম
এগুলো তোমরা কাছে কোথা থেকে এলো?’’ সে জবাব দিতোঃ আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। আল্লাহ
যাকে চান, বেহিসেব
দান করেন।
৩৫. এখান থেকে সেই সময়ের আলোচনা
শুরু হয়েছে যখন হযরত মারায়াম প্রাপ্ত বয়স্কা হলেন, তাঁকে বাইতুল
মাকদিসের ইবাদাতগাহে (হাইকেল) পৌঁছিয়ে দেয়া হলো এবং সেখানে তিন দিন-রাত আল্লাহর
যিকিরে মশগুল হয়ে গেলেন। শিক্ষা ও অনুশীলন দানের জন্য
তাকে হযরত যাকারিয়ার অভিভাবকত্বে সোপর্দ করা হয়েছিল। আত্মীয়তার সম্পর্কের দিক
দিয়ে সম্ভবত হযরত যাকারিয়া ছিলেন তার খালু। তিনি হাইকেলের অন্যতম
পুরোহিত ছিলন। এখানে সেই যাকারিয়া নবীর কথা বলা হয়নি। যাকে
হত্যা করার ঘটনা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখিত হয়েছে।
৩৬. মেহরাব শব্দটি বলার সাথে
সাথে লোকদের দৃষ্টি সাধারণত আমাদের দেশে মসজিদে ইমামের দাঁড়াবার জন্য যে জায়গাটি
তৈরী করা হয় সেদিকে চলে যায়। কিন্তু এখানে মেহরাব বলতে সে
জায়গাটি বুঝানো হয় নি। খৃষ্টান ও ইহুদীদের গীর্জা ও
উপাসনালয়গুলোতে মূল উপাসনা গৃহের সাথে লাগোয়া ভূমি সমতল থেকে যথেষ্ট উঁচুতে যে
কক্ষটি তৈরী করা হয়, যার মধ্যে উপাসনালয়ের খাদেম, পুরোহিত এতেকাফকারীরা অবস্থান করে, তাকে মেহরাব বলা
হয়। এই ধরনের একটি কামরায় হযরত মারইয়াম এতেকাফ করছিলেন।
﴿هُنَالِكَ
دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّهُ ۖ قَالَ رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً
ۖ إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ﴾
৩৮। এ অবস্থা
দেখে যাকারিয় তার রবের কাছে প্রার্থনা করলোঃ ‘‘হে আমার রব! তোমরা বিশেষ ক্ষমতা বলে
আমাকে সৎ সন্তান দান করো। তুমিই প্রার্থনা শ্রবণকারী’’।৩৭ যখন তিনি মেহরাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিলেন।
৩৭. হযরত যাকারিয়া আ. সে সময়
পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলন। এই যুবতী পুন্যবতী মেয়েটিকে দেখে
স্বভাবতই তার মনে এ আকাংখা জন্ম নিলঃ আহা, যদি আল্লাহ আমাকেও এমনি
একটি সৎসন্তান দান করতেন। আর আল্লাহর তার অসীম
কুদরাতের মাধ্যমে যেভাবে এই সংসার ত্যাগী, নিসংগ, কক্ষবাসিনী মেয়েটিকে আহার যোগাচ্ছেন। তা দেখে তার মনে আশা জাগে যে, আল্লাহ চাইলে
এই বৃদ্ধ বয়সেও তাকে সন্তান দিতে পারেন।
﴿فَنَادَتْهُ
الْمَلَائِكَةُ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي فِي الْمِحْرَابِ أَنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكَ
بِيَحْيَىٰ مُصَدِّقًا بِكَلِمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَسَيِّدًا وَحَصُورًا وَنَبِيًّا
مِّنَ الصَّالِحِينَ﴾
৩৯। তখন এর
জবাবে তাকে ফেরেশতাগণ বললোঃ ‘‘আল্লাহ তোমাকে ইয়াহইয়ার৩৮ সুসংবাদ দান করেছেন। সে
আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ফরমানের৩৯ সত্যতা প্রমাণকারী হিসেবে
আসবে। তার মধ্যে নেতৃত্ব ও সততার গুণাবলী থাকবে। সে
পরিপূর্ণ সংযমী হবে, নবুওয়াতের
অধিকারী হবে এবং সৎকর্মশীলদের মধ্যে গণ্য হবে।’’
৩৮. বাইবেলে এর নাম লিখিত হয়েছে, খৃষ্ট ধর্মে
দীক্ষাদাতা-জোন (John The Baptist)। তাঁর অবস্থা জানার জন্য
দেখুন, মথিঃ ৩,১১,১৪ অধ্যায়; মার্কঃ ১,৬ অধ্যায় এবং লুকঃ ১,৩
অধ্যায়।
৩৯. আল্লাহর ‘ফরমান’
বলতে এখানে হযরত ঈসা আ. কে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু
তাঁর জন্ম হয়েছিল মহান আল্লাহর একটি অস্বাভাবিক ফরমানের মাধ্যমে অলৌকিক বিষয়
হিসেবে, তাই কুরআন মজীদে তাঁকে “কালেমাতুম মিনাল্লাহু” বা আল্লাহর ফরমান বলা হয়েছে।
﴿قَالَ
رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَقَدْ بَلَغَنِيَ الْكِبَرُ وَامْرَأَتِي عَاقِرٌ
ۖ قَالَ كَذَٰلِكَ اللَّهُ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ﴾
৪০। যাকারিয়া
বললোঃ ‘‘হে আমার রব! আমার সন্তান হবে কেমন করে? আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি এবং
আমার স্ত্রী তো বন্ধা।’’ জবাব এলোঃ ‘‘এমনটিই হবে।৪০ আল্লাহ যা চান তাই করেন।
৪০. অর্থাৎ তোমরা বার্ধক্য ও
তোমরা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব সত্ত্বেও আল্লাহ তোমাকে পুত্র সন্তান দান করবেন।
﴿قَالَ
رَبِّ اجْعَل لِّي آيَةً ۖ قَالَ آيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ
إِلَّا رَمْزًا ۗ وَاذْكُر رَّبَّكَ كَثِيرًا وَسَبِّحْ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ﴾
৪১। আরজ করলোঃ
‘‘হে প্রভু! তাহলে আমার জন্য কোন নিশানী ঠিক করে দাও।’’৪১ জবাব দিলেনঃ ‘‘নিশানী হচ্ছে এই যে, তুমি তিন দিন পর্যন্ত মানুষের
সাথে ইশারা-ইংগিত ছাড়া কোন কথা বলবে না। এই সময়ে
নিজের রবকে খুব বেশী করে ডাকো এবং সকাল সাঁঝে তার ‘তাস্বীহ করতে থাকো।’’৪২
৪১. অর্থাৎ এমন নিশানী বলে দাও, যার ফলে একজন
জরাজীর্ণ বৃদ্ধ ও বন্ধা বৃদ্ধার ঘরে পুত্র সন্তান জন্ম নেবার মতো বিস্ময়কর ও
অস্বাভাবিক ঘটনাটি ঘটার খবরটি আগাম জানতে পারি।
৪২. খৃষ্টানরা হযরত ঈসা আ. কে ‘আল্লাহর পুত্র’
ও ‘খোদা’ বলে বিশ্বাস
করে যে ভুল করে চলেছে, সেই বিশ্বাস ও আকীদাগত ভুলটি সুষ্পষ্ট
করে তুলে ধরাই এই ভাষনটির মূল্য উদ্দেশ্য। সূচনায় হযরত ইয়াহইয়া আ. এর
কথা বলার কারণ হচ্ছে এই যে, হযরত ঈসা আ. এর জন্ম যেমন অলৌকিক পদ্ধতিতে
হয়েছিল, ঠিক তেমনি তার থেকে মাত্র ছয় মাস আগে একই পরিবারে আর
একটি অলৌকিক পদ্ধতিতে হযরত ইয়াহ্ইয়ার জন্ম হয়েছিল। এর মাধ্যমে মহান ও
সর্বশক্তিমান আল্লাহ খৃস্টনাদের একথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, ইয়াহ্ইয়ার
অলৌকিক জন্ম যদি তাকে খোদা ও উপাস্য পরিণত না করে থাকে তাহলে ঈসার নিছক অস্বাভাবিক
জন্মপদ্ধতি কিভাবে তাকে ‘ইলাহ‘ ‘খোদা‘র আসনে বসিয়ে দিতে পারে?
﴿وَإِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ
يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاكِ وَطَهَّرَكِ وَاصْطَفَاكِ عَلَىٰ نِسَاءِ الْعَالَمِينَ﴾
৪২। তারপর এক
সময় এলো, ফেরেশতারা
মারইয়ামের কাছে এসে বললোঃ হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন, তোমাকে পবিত্রতা দান করেছেন
এবং সারা বিশ্বের নারী সমাজের মধ্যে তোমাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজের সেবার জন্য
বাছাই করে নিয়েছেন।
﴿يَا مَرْيَمُ
اقْنُتِي لِرَبِّكِ وَاسْجُدِي وَارْكَعِي مَعَ الرَّاكِعِينَ﴾
৪৩। হে
মারইয়াম! তোমার রবের ফরমানের অনুগত হয়ে থাকো। তাঁর
সামনে সিজদানত হও এবং যেসব বান্দা তাঁর সামনে অবনত হয় তুমিও তাদের সাথে অবনত হও।
﴿ذَٰلِكَ
مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۚ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ
أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ﴾
৪৪। হে
মুহাম্মাদ! এসব অদৃশ্য বিষয়ের খবর, অহীর মাধ্যমে আমি এগুলো তোমাকে জানাচ্ছি। অথচ তুমি
সেখানে ছিলে না, যখন
হাইকেলের সেবায়েতরা মারইয়ামের তত্ত্বাবধায়ক কে হবে একথার ফায়সালা করার জন্য
নিজেদের কলম নিক্ষেপ করছিল।৪৩ আর তুমি তখনো সেখানে ছিলো না
যখন তাদের মধ্যে ঝগড়া চলছিল।
৪৩. অর্থাৎ লটারী করছিল। এই লটারী
করার প্রয়োজন দেখা দেবার কারণ এই ছিল যে, হযরত মারইয়ামের মাতা
হাইকেলে আল্লাহর কাজ করার জন্য মারইয়ামকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর তিনি
মেয়ে হবার কারণে হাইকেলের খাদেম ও সেবায়েতদের মধ্য থেকে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ও
অভিভাবক নিযুক্ত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
﴿إِذْ قَالَتِ
الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِّنْهُ اسْمُهُ
الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ﴾
৪৫। যখন
ফেরেশতারা বললঃ ‘‘হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে তাঁর একটি ফরমানের সুসংবাদ দান করেছেন। তার নাম
হবে মসীহ ঈসা ইবনে মারইয়াম। সে দুনিয়ায় ও আখেরাতে
সম্মানিত হবে। আল্লাহর নৈকট্যলাভকারী বান্দাদের
অন্তরভুক্ত হবে।
﴿وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي
الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَمِنَ الصَّالِحِينَ﴾
৪৬। দোলনায়
থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সেও মানুষের সাথে কথা বলবে এবং সে হবে সৎব্যক্তিদের অন্যতম।’’
﴿قَالَتْ رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ
لِي وَلَدٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ ۖ قَالَ كَذَٰلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ
ۚ إِذَا قَضَىٰ أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ﴾
৪৭। একথা শুনে
মারইয়াম বললোঃ ‘‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সন্তান কেমন করে হবে? আমাকে তো কোন পুরুষ স্পর্শও
করেনি।’’ জবাব এলোঃ ‘‘এমনটিই হবে।৪৪ আল্লাহ যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যখন
কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন তখন কেবল এতটুকুই বলেন, হয়ে যাও, তাহলেই তা হয়ে যায়।’’
৪৪. অর্থাৎ কোন পুরুষ তোমাকে
স্পর্শ না করলেও তোমার সন্তান হবে। এখানে যে ‘এমনটি হবে’ (كَذَٰلِكِ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, হযরত যাকারিয়া আ. এর জবাবেও এই একই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখানে এর
যে অর্থ ছিল এখানেও সেই একই অর্থ হওয়াই উচিত। তা ছাড়া পরবর্তী বাক্য বরং
পূর্বাপর সমস্ত বর্ণনাই এই অর্থ সমর্থন করে যে, কোন প্রকার যৌন সংযোগ
ছাড়াই হযরত মারইয়ামকে সন্তান জন্মের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। আর আসলে
এভাবেই হযরত ঈসার আ. জন্ম হয়েছিল। নয়তো দুনিয়ার আর দশটি
স্ত্রীলোক যেভাবে সন্তান জন্ম দেয় সেভাবে পরিচিত স্বাভাবিক পদ্ধতিতে যদি হযরত
মারইয়ামের গর্ভে সন্তান জন্ম নেবার ব্যাপারটি ঘটে থাকতো এবং যদি প্রকৃতপক্ষে হযরত
ঈসা আ. ঐভাবেই জন্মগ্রহণ করে থাকতেন, তাহলে ৪ রুকূ থেকে ৬ রুকূ
পর্যন্ত যে বর্ণনা চলে আসছে তা পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে যায় এবং ঈসা আ. এর জন্ম
সংক্রান্ত আর যে সমস্ত বর্ণনা আমরা কুরআনের আরো বিভিন্ন স্থানে পাই তাও নিরর্থক
হয়ে পড়ে। পিতার ঔরস ছাড়াই অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে হযরত ঈসার আ.
জন্ম হয়েছিল বলেই না খৃষ্টানরা তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র‘ ও ইলাহ মনে করেছিল। আর একজন কুমারী মেয়ে সন্তান
প্রসব করেছে, এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেই তো ইহুদীরা তাঁর
প্রতি দোষারোপ করেছিল। যদি এটা আদতে কোন সত্য ঘটন্ই
না হয়ে থাকে, তাহলে ঐ দু’টি দলের চিন্তার প্রতিবাদ
প্রসংগে কেবল এতটুকু বলে দেয়াই যথেষ্ট হতো যে, তোমরা ভুল
বলছো, সে মেয়েটি ছিল বিবাহিতা, ওমুক
ব্যক্তি ছিল তার স্বামী এবং তারই ঔরসে ঈসার জন্ম হয়েছিল। এই
সংক্ষিপ্ত চুম্বক কথা ক’টি বলার পরিবর্তে এতো দীর্ঘ ভূমিকা ফাঁদার, পেঁচিয়ে কথা
বলার এবং সোজাসুজি উমুক ব্যক্তির পুত্র ঈসা বলার পরিবর্তে মারইয়ামের পুত্র ঈসা
বলার কি প্রয়োজন ছিল? এর ফলে তো বিষয়টি সহজে মীমাংসা হওয়ার
পরিবর্তে আরো জটিল হয়ে পড়েছে। কাজেই যারা কুরআনকে আল্লাহর
কালাম বলে মানে এবং এরপর ঈসা আ. সম্পর্কে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, স্বাভাবিকভাবে
মাতা পিতার মিলনের ফলে তাঁর জন্ম হয়েছিল, তারা আসলে একথা
প্রমাণ করেন যে, মনের কথা প্রকাশ করা ও নিজের বক্তব্য
সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার যতটুকু ক্ষমতা তাদের আছে, আল্লাহর
ততটুকু নেই (মা‘আযাল্লাহ)
﴿وَيُعَلِّمُهُ
الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ﴾
৪৮।
(ফেরেশতারা আবার তাদের আগের কথার জের টেনে বললোঃ) ‘‘আর আল্লাহ তাকে কিতাব ও হিকমত
শিক্ষা দেবেন, তাওরাত ও ইনজীলের জ্ঞান দান করবেন
﴿وَرَسُولًا
إِلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنِّي قَدْ جِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ ۖ أَنِّي
أَخْلُقُ لَكُم مِّنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا
بِإِذْنِ اللَّهِ ۖ وَأُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ وَأُحْيِي الْمَوْتَىٰ بِإِذْنِ
اللَّهِ ۖ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ ۚ
إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
৪৯। এবং নিজের
রাসূল বানিয়ে ইসরাঈলদের কাছে পাঠাবেন।’’ (আর বনী
ইসরাঈলদের কাছে রাসূল হিসেবে এসে সে বললোঃ) ‘‘আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের
কাছে নিশানী নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের সামনে মাটি থেকে
পাখির আকৃতি বিশিষ্ট একটি মূর্তি তৈরী করছি এবং তাতে ফুৎকার দিচ্ছি, আল্লাহর হুকুমে সেটি পাখি হয়ে
যাবে। আল্লাহর হুকুমে আমি জন্মান্ধ ও
কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় করি এবং মৃতকে জীবিত করি। আমি
তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি, তোমরা নিজেদের গৃহে কি খাও ও কি মওজুদ করো। এর মধ্যে
তোমাদের জন্য যথেষ্ঠ নিশানী রয়েছে, যদি তোমরা ঈমানদার হও।৪৫
৪৫. অর্থাৎ যদি তোমরা হককে মেনে
নিতে প্রস্তুত হয়ে যাও এবং হঠধর্মী না হও, তাহলে সমগ্র
বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ যে আমাকে পাঠিয়েছেন,
এ বিষয়টি মেনে নেবার এবং এ ব্যাপারে তোমাদের নিশ্চিন্ত করার জন্য এই
নিশানীগুলোই যথেষ্ট।
﴿وَمُصَدِّقًا
لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ
عَلَيْكُمْ ۚ وَجِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ﴾
৫০। আমি সেই
শিক্ষা ও হিদায়াতের সত্যতা ঘোষণা করার জন্য এসেছি, যা বর্তমানে আমার যুগে
তাওরাতে আছে।৪৬ আর তোমাদের জন্য যেসব জিনিস
হারাম ছিল তার কতকগুলো হালাল করার জন্য আমি এসেছি।৪৭ দেখো, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে
তোমাদের কাছে আমি নিশানী নিয়ে এসেছি। কাজেই
আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।
৪৬. অর্থাৎ আমি যে আল্লাহর পক্ষ
থেকে প্রেরিত হয়েছি এটি তার আর একটি প্রমাণ। যদি আমি তাঁর পক্ষ থেকে
প্রেরিত না হতাম বরং একজন মিথ্যা দাবীদার হতাম, তাহলে আমি নিজেই একটি
ধর্ম তৈরী করে ফেলতাম এবং দক্ষতা সহকারে তোমাদের আগের পুরাতন ধর্ম থেকে বিচুত করে
নিজের নতুন উদ্ভাবিত ধর্মের দিকে টেনে আনার প্রচেষ্টা চালাতাম। কিন্তু
আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবীরা আমার পূর্বে যেসব দীন এনেছিলেন আমি তো সেই আসল দীনকে
মানি এবং তার শিক্ষাকে সঠিক গণ্য করি।
বর্তমানে প্রচলিত ইনজীল থেকেও একথা সুস্পষ্টভাবে
প্রমাণিত হয় যে, মূসা আ. ও অন্যান্য নবীগণ যে দীনের প্রচার
করেছিলেন হযরত ঈসা আ.ও সেই একই দীনের প্রচারক ছিলেন। যেমন মথির বর্ণনা মতে পাহাড়
থেকে প্রদত্ত ভাষণে ঈসা আ. পরিষ্কার বলেনঃ
“একথা মনে করো না যে, আমি
তাওরাত বা নবীদের কিতাব রহিত করতে এসেছি। রহিত করতে নয় বরং সম্পূর্ণ
করতে এসেছি।” (৫:১৭)
একজন ইহুদী আলেম হযরত ঈসা আ. কে জিজ্ঞেস করলেন, দীনের
বিধানের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য হুকুম কোনটি? জবাবে তিনি বললেনঃ
“তোমরার সমস্ত অন্তঃকরণ তোমার সমস্ত প্রাণ ও
তোমার সমস্ত মন দিয়ে তোমার ইশ্বর প্রভুকে প্রেম করবে। এটি মহৎ ও প্রথম হুকুম। আর
দ্বিতীয়টি এর তুল্য; তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসবে। এই দু’টি
হুকুমের ওপরই সমস্ত তাওরাত ও নবী রাসূলদের সহীফা ও গ্রন্থসমূহ নির্ভরশীল।” (মথিঃ ২২:৩৭-৪০)
আবার হযরত ঈসা আ. তাঁর শিষ্যদের বলেনঃ
“ধর্মগুরু ও ফরীসীরা মূসার আসনে বসেছে। তারা
তোমাদের যা কিছু বলে তা পালন করো ও মানো। কিন্তু তাদের মতো কাজ করো না। কারণ তারা
বলে কিন্তু করে না।” (মথিঃ ২৩:২-৩)
৪৭. অর্থাৎ তোমাদের মূর্খদের
কাল্পনিক বিশ্বাস, ফকীহদের আইনের চুলচেরা বিশ্লেষন, বৈরাগ্যবাদীদের কৃচ্ছ্রসাধনা এবং অমুসলিম জাতিদের তোমাদের ওপর প্রাধান্য ও
শাসন প্রতিষ্ঠার কারণে তোমাদের আল্লাহ প্রদত্ত আসল শরীয়াতের ওপর যেসব বিধি বন্ধনের
বাড়তি বোঝা আরোপিত হয়েছে, আমি সেগুলো রহিত করবো এবং আল্লাহ
যেগুলো হালাল বা হারাম গণ্য করেছেন সেগুলোই আমি তোমাদের জন্য হালাল ও হারাম গণ্য
করবো।
﴿إِنَّ
اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ ۗ هَٰذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيمٌ﴾
৫১। আল্লাহ
আমার রব এবং তোমাদেরও রব। কাজেই তোমরা তার বন্দেগী করো। এটিই
সোজাপথ।৪৮
৪৮. এ থেকে জানা গেল অন্যান্য
সকল নবীদের মতো হযরত ঈসা আ. এর দাওয়াতের তিনটি মৌলিক বিষয়বস্তু ছিলঃ
একঃ সার্বভৌম কর্তৃত্ব, যার
দাসত্ব ও বন্দেগী করতে হবে এবং যার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক
ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত বলে স্বীকার
করতে হবে।
দুইঃ ঐ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীর
প্রতিনিধি হিসেবে নবীর নির্দেশের আনুগত্য করতে হবে।
তিনঃ মানুষের জীবনকে হালাল ও হারাম
এবং বৈধতা ও অবৈধতার বিধিনিষেধে আবদ্ধকারী আইন ও বিধিবিধান একমাত্র আল্লাহ দান
করবেন। অন্যদের চাপানো সমস্ত আইন ও বিধিবিধান বাতিল করতে
হবে।
কাজেই হযরত ঈসা আ., হযরত মূসা আ., হযরত মুহাম্মাদ সা.
ও অন্যান্য নবীদের মিশনের মধ্যে আসলে সামান্যতম পার্থক্যও নেই। যারা
বিভিন্ন নবীর মিশন বিভিন্ন বলে গণ্য করেছেন এবং তাদের মিশনের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতির
মধ্য পার্থক্য দেখিয়েছেন, তারা মারাত্মক ভূল করেছেন। বিশ্ব-জাহানের সার্বভৌম
কর্তৃত্বের অধিকারীর পক্ষ থেকে তাঁর প্রজাদের দিকে যে ব্যক্তিই নিযুক্ত হয়ে আসবেন
তাঁর আসার উদ্দেশ্য এছাড়া আর দ্বিতীয় কিছুই হতে পারে না যে, তিনি প্রজাদেরকে
নাফরমানী, স্বেচ্ছাচারিতা ও শিরক (অর্থাৎ সার্বভৌম প্রভূত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী
হিসেবে বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র মালিক ও প্রভূ আল্লাহর সাথে আর কাউকে অংশীদার করা
এবং নিজের বিশ্বস্ততা ও ইবাদাত বন্দেগীকে তাদের মধ্যে বিভক্ত করে দেয়া) থেকে বিরত
রাখবেন এবং আসল ও প্রকৃত মালিকের নির্ভেজাল আনুগত্য, দাসত্ব,
পূজা, আরাধনা ও বন্দেগী করার আহবান জানাবেন।
দূঃখের বিষয়, ঈসা আ. এর মিশনকে ওপরে কুরআনে যেমন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে বর্তমান ইনজীলে
তেমনটি করা হযনি। তবুও উপরে যে তিনটি মৌলিক বিষয়বস্তু
বর্ণিত হয়েছে তা বিক্ষিপ্তভাবে ইশারা ইংগিতের আকারে হলেও বর্তমানে ইনজীলে দেখতে
পাওয়া যায়। যেমন, হযরত ঈসা আ. একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর দাওয়াত দিয়েছিলেন, একথা
ইনজীলের নিম্নোক্ত ইংগিত থেকে সুস্পষ্ট হয়ঃ
“তোমার ঈশ্বর প্রভূকে প্রণিপাত (সিজদা) করো এবং একমাত্র তাঁরই আরাধনা করো।” (মথিঃ ৪:১০)
তিনি যে কেবল এরি দাওয়াত দিয়েছিলেন তা নয় বরং তাঁর
সমস্ত প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যই ছিল, আকাশ রাজ্যে যেমন সার্বভৌম ক্ষমতা
সম্পন্ন আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনুরূপ ভাবে পৃথিবীতেও একমাত্র
তাঁরই শরিয়াতী বিধানের আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
“তোমার রাজ্য আসুক। তোমার
ইচ্ছা যেমন আকাশে পূর্ণ হয় তেমনি পৃথিবীতের পূর্ণ হোক।” (মথিঃ ৬:১০)
আবার ঈসা আ. নিজেকে নবী ও আসামানী
রাজত্বের প্রতিনিধি হিসেবে পেশ করতেন এবং এ হিসেবেই লোকদেরকে নিজের আনুগত্য করার
দাওয়াত দিতেন। তাঁর ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তব্যগুলো থেকে
জানা যায়, তিনি নিজের জন্মভূমি ‘নাসেরা’ (নাজরারাথ)-তে নিজের
দাওয়াতের সূচনা করলে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শহরবাসীরাই তাঁর বিরোধীতায় নেমে পড়ে। এ
সম্পর্কে মথি, মার্ক ও লুক একযোগে বর্ণনা করেছেন যে,
“নবী তাঁর স্বদেশে জনপ্রিয় হন না।” এরপর
জেরুসালেমে যখন তাঁ হত্যার চক্রান্ত চলতে লাগলো এবং লোকেরা তাঁকে অন্য কোথাও চলে
যাবার পরামর্শ দিল তথন তিনি জবাব দিলেনঃ “নবী জেরুসালেমের
বাইরে মৃত্যুবরণ করবে, এটা সম্ভব নয়।” (লুকঃ ১৩:৩৩) শেষবার যখন তিনি জেরুসালেম প্রবেশ করছিলৈন,
তখন তাঁর শিষ্যবর্গ উচ্চস্বরে বলতে লাগলোঃ “ধন্য
সেই রাজা যিডিন প্রভূর নামে আসছেন।” একথায় ইহুদী
আলেমরা অসন্তুষ্ট হলেন এবং তারা হযরত ঈসাকে বললেন, “আপনার
শিষ্যদের মুখ বন্ধ করুন।” হযরত ঈসা বললেনঃ “ওরা যদি মুখ বন্ধ করে তাহলে পাথরগুলো চিৎকার করে উঠবে।” (লোক ১৯:৩৮–৪০) আর একবার তিনি বললেনঃ
“হে শ্রমজীবীরা! হে
ভারবহনে পিষ্টলোকেরা! সবাই আমার কাছে এসো। আমি
তোমাদের বিশ্রাম দান করবো। আমার জোয়াল তোমাদের কাঁধে
উঠিয়ে নাও। …আমার জোয়াল সহজে বহনীয় এবং আমার বোঝা
হালকা।” (মথি ১১:২৮–৩০)
এছাড়া ঈসা আ. মানব রচিত আইনের পরিবর্তে
আল্লাহ প্রদত্ত আইনের আনুগত্য করতে চাইতেন একথাও মথি ও মার্কের বর্ণনা থেকে
সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়। তাদের বর্ণনার সারনির্যাস
হচ্ছেঃ ইহুদী আলেমগন অভিযোগ করলেন, আপনার শিষ্যরা পূর্ববর্তী
সম্মানীয় বুযর্গদের ঐতিহ্যের বিপরীত হাত না ধূয়েই আহার করে কেন? হযরত ঈসা আ. এর জবাবে বললেনঃ তোমাদের মতো রিয়াকারদের
অবস্থা হচ্ছে ঠিক তেমনি যেমন হযরত ইয়াসইয়া নবীল কন্ঠে এ তিরস্কার করা হয়েছেঃ “এই উম্মত মুখে আমার প্রতি মর্যাদার বাণী উচ্চারণ করে কিন্তু তাদের হৃদয়
আমার থেকে দূরে। কারণ এরা মানবিক বিধানের শিক্ষা দেয়।” তোমরা
আল্লাহর হুকুমকে বাতিল করে থাক এবং নিজেদের বানয়াট আইনকে প্রতিষ্ঠিত রাখো। আল্লাহ
তাওরাতের মাধ্যমে তোমাদের হুকুম দিয়েছিলেন, মা–বাপদের
প্রতি সম্মাণ প্রদর্শণ করো এবং যে ব্যক্তি মা–বাপকে একথা বলে
দেয়, আমরা যে খেদমত তোমার কাজে লাগতে পারে তাকে আমি আল্লাহর
জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি, তার জন্য মা–বাপের
খেদমত না করা সম্পূর্ণ বৈধ। (মথিঃ ১৫:৩–৯, মার্ক ৭:৫–১৩)
﴿فَلَمَّا
أَحَسَّ عِيسَىٰ مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ ۖ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ
نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ﴾
৫২। যখন ঈসা
অনুভব করলো, ইসরাঈল
কুফরী ও অস্বীকার করতে উদ্যেগী হয়েছে, সে বললোঃ ‘‘কে হবে আল্লাহর পথে আমার
সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ৪৯ বললোঃ আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী।৫০ আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। সাক্ষী
থাকো, আমরা
মুসলিম (আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নতকারী)।
৪৯. ‘হাওয়ারী’
শব্দটি আমাদের এখানে ‘আনসার’ শব্দের কাছাকাছি অর্থ বহন করে। বাইবেলে সাধারণভাবে হাওয়ারীর
পরিবর্তে ‘শিষ্যবৃন্দ’ শব্দ
ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন স্থানে তাদের ‘রাসূল’ও বলা হয়েছে। কিন্তু রাসূল এই অর্থে যে, ঈসা আ.
তাদেরকে দীন প্রচারের জন্য পাঠাতেন। আল্লাহ তাদেরকে রাসূল হিসেবে
নিযুক্ত করেছেন, এই অর্থে রাসূল বলা হয়নি।
৫০. ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে অংশ
গ্রহণকে কুরাআন মজীদের অধিকাংশ স্থানে “আল্লাহকে সাহায্য করা”
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি অবশ্যি একটি ব্যাখ্যা
সাপেক্ষ বিষয়। জীবনের যে পরিসরে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও সংকল্পের
স্বাধীনতা দান করেছেন সেখানেই তিনি নিজের খোদায়ী শক্তি ব্যবহার করে কুফর বা ঈমান, বিদ্রোহ বা
আনুগত্যের মধ্য থেকে কোন একটির পথ অবলম্বন করার জন্য মানুষকে বাধ্য করেননি। এর
পরিবর্তে তিনি যুক্তি ও উপদেশের সাহায্য নিয়েছেন। এভাবে তিনি মানুষের কাছ থেকে
এই স্বতষ্ফুর্ত স্বীকৃতি আদায় রতে চেয়েছেন যে, অস্বীকৃতি, নাফরমানী ও বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার জন্য নিজের স্রষ্টার
দাসত্ব, আনুগত্য ও বন্দেগীর পথ অবলম্বন করাই প্রকৃত সত্য এবং
এটিই তার সাফল্য ও নাজাতের পথ। এভাবে প্রচার, উপদেশ ও
নসীহতের সাহায্যে মানুষকে সত্য সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করাই আল্লাহর কাজ। আর যেসব
লোক এই কাজে আল্লাহকে সাহায্য করে তাদেরকেই আল্লাহর সাহায্যকারী গণ্য করা হয়। আল্লাহর
কাছে মানুষের এটিই সবোর্চ্চ মর্যাদা। নামায, রোযা এবং
অন্যান্য যাবতীয় ইবাদাত বন্দেগীতে মানুষ নিছক বান্দা ও গোলামদের মর্যাদায়
প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার
সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে সে আল্লাহর সাহায্যকারী ও সহযোগীর মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত
হয়। এই দুনিয়ার রূহানী ও আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে
অভিষিক্ত হবার এটিই উচ্চতম মর্যাদা ও মকাম।
﴿رَبَّنَا
آمَنَّا بِمَا أَنزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ﴾
৫৩। হে আমাদের
মালিক! তুমি যে ফরমান নাযিল করেছ, আমরা তা মেনে নিয়েছি এবং রাসূলের আনুগত্য
কবুল করে নিয়েছি। সাক্ষ্যদানকারীদের মধ্যে আমাদের নাম লিখে
নিয়ো।’’
﴿وَمَكَرُوا
وَمَكَرَ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ﴾
৫৪। তারপর বনী
ইসরাঈল (ঈসার বিরুদ্ধে) গোপন চক্রান্ত করতে লাগলো। জবাবে
আল্লাহও তাঁর গোপন কৌশল খাটালেন। আর আল্লাহ
শ্রেষ্ঠতম কুশলী।
﴿إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَىٰ
إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَجَاعِلُ
الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ۖ ثُمَّ
إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ﴾
৫৫। (এটি
আল্লাহরই একটি গোপন কৌশল ছিল) যখন তিনি বললেনঃ ‘‘হে ঈসা! এখন আমি তোমাকে ফিরিয়ে
নেবো৫১ এবং তোমাকে আমার নিজের দিকে উঠিয়ে নেবো। আর যারা
তোমাকে অস্বীকার করেছে তাদের থেকে (অর্থাৎ তাদের সংগ এবং তাদের পূতিগন্ধময় পরিবেশে
তাদের সংগে থাকা থেকে) তোমাকে পবিত্র করে দেবো এবং তোমাকে যারা অস্বীকার করেছে৫২ তাদের ওপর তোমার অনুসারীদের কিয়ামত
পর্যন্ত প্রাধান্য দান করবো। তারপর তোমাদের মধ্যে যেসব
বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোর মীমাংসা করে দেবো।
৫১. এখানে কুরআনের মূল শব্দ
হচ্ছে, মুতাওয়াফ্ফীকা (مُتَوَفِّيكَ) মূল তাওয়াফ্ফা
(تَوَفَّي)
শব্দের আসল মানে হচ্ছেঃ নেয়া ও আদায় করা। “প্রাণবায়ু বরে করে নেয়া”
হচ্ছে এর গৌণ ও পরোক্ষ অর্থ, মূল আভিধানিক অর্থ নয়। এখানে এ
শব্দটি ইংরেজী To Recall এর অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ
হয়, কোন পদাধিকারীকে তার পদ থেকে ফিরিয়ে ডেকে নেয়া। যেহেতু
বনী ইসরাঈল শত শত বছর ধরে অনবরত নাফরমানী করে আসছিল, বার বার
উপদশে দান ও সতর্ক করে দেয়ার পরও তাদের জাতীয় মনোভাব ও আচরণ বিকৃত হয়ে চলছিল,
একের পর এক কয়েকজন নবীকে তারা হত্যা করেছিল এবং যেকোন সদাচারী
ব্যক্তি তাদেরকে নেকী, সততা ও সৎবৃত্তির দাওয়াত দিতো তাকেই
তারা হত্যা করতো। তাই আল্লাহ তাদের মুখ বন্ধ করার ও
তাদেরকে শেষবারের মতো সুযোগ দেবার জন্যে হযরত ঈসা ও হযরত ইয়াহ্ইয়া আ. এর মতো দু’জন
মহান মর্যাদা সম্পন্ন পয়গম্বর পাঠালেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের
নিযুক্তির প্রমাণ স্বরূপ তাদের সাথে এমন সব সুস্পষ্ট নিশানী ছিল যেগুলো একমাত্র
তারাই অস্বীকার করতে পারতো, যারা ন্যায়, সত্য ও
সততার সাথে চরম শত্রুতা পোষন করতো এবং যাদের সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করার দূঃসাহস ও
নির্লজ্জতা চরতম পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল। কিন্তু বনী ঈসরাইলরা এই শেষ
সুযোগও হাত ছাড়া করেছিল। তারা কেবল এই দুজন পয়গম্বরের দাওয়াত
প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং এই সংগে তাদের একজন প্রধান ব্যক্তি নিজের
নর্তকীর ফরমায়েশ অনুযায়ী প্রকাশ্যে হযরত ইয়াহ্ইয়া আ. এর শিরচ্ছেদ করেছিল এবং তাদের
আলমে ও ফকীহগণ ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করে রোমান শাসকের সাহায্যে হযরত ঈসা আ. কে
মৃত্যুদন্ড দেবার চেষ্টা চালিয়েছিল। এরপর আর বনী ইসলাঈলদের উপদশে
দেবার জন্য বেশী সময় ও শক্তি ব্যয় করা ছিল অর্থহীন। তাই মহান আল্লাহ তার নবীকে
ফিরিয়ে নিজের কাছে ডেকে নিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত বনী ইসলাঈলদের জন্য লিখে দিলেন
লাঞ্ছনার জীবন। এখানে অবশি একথা অনুধাবন করতে হবে যে, কুরআনের এ
সমগ্র ভাষণ আসলে খৃষ্টানদের ঈসার খোদা হওয়ার আকীদার প্রতিবাদ ও সংশোধনের
উদ্দেশ্যেই ব্যক্ত হয়েছে। খৃষ্টানদের মধ্যে এই আকীদার
জন্মের মূলে ছিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কারণঃ
একঃ হযরত ঈসার অলৌকিক জন্ম।
দুইঃ তাঁর সুস্পষ্ট অনুভূত
মুজিযাসমূহ।
তিনঃ তাঁর আকাশের দিকে উঠিয়ে নেয়া। তাদের বই
পত্রে পরিস্কার ভাষায় এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
কুরআন প্রথম কথাটিকে সত্য বলে ঘোষণা করেছে। কুরআনের
বক্তব্য হচ্ছে, হযরত ঈসার আ. পিতা ছাড়াই জন্মগ্রহণ নিছক
আল্লাহর কুদরাতের প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ যাকে যেভাবে ইচ্ছা
সৃষ্টি করে থাকেন। এই অস্বাভাবিক জন্মের কারণে একথা প্রমাণ হয় না যে, হযরত ঈসা আ.
খোদা ছিলেন বা খোদায়ী কর্তৃত্বে তাঁর কোন অংশীদারীত্ব ছিল।
দ্বিতীয় কথাটিকেও কুরআন সত্য বলে ঘোষণা করেছে। কুরআন
হযরত ঈসার মুজিযাগুলো একটি একটি করে গণনা করে বর্ণনা করেছে। কিন্তু এখানে সুস্পষ্ট করে
বলে দেয়া হয়েছে যে, এই সমস্ত কাজই তিনি আল্লাহর হুকুমে সম্পদান
করেছিলেন। তিনি নিজে অর্থবা নিজের শক্তিতে কিছুই করেননি। কাজেই
এগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি ভিত্তিতেই এই ফল লাভ করা যেতে পারে না যে, খোদায়ী
কর্তৃত্ব ও কার্যকলাপে হযরত ঈসার কোন অংশ ছিল।
এখন তৃতীয় কথাটি সম্পর্কে খৃষ্টানদের বর্ণনাগুলো যদি
একবারেই ভুল বা মিথ্যা হতো, তাহলে তাদের ঈসার খোদা হবার আকীদাটির
প্রতিবাদ করার জন্য পরিষ্কারভাবে একথা বলে দেয়া অপিরহার্য ছিল যে, যাকে তোমরা খোদার পুত্র বা খোদা বলছো সে তো কবে মরে মাটির সাথে মিশে গেছে। আর যদি
এজন্য অধিকতর নিশ্চিন্ত হতে চাও, তাহলে উমুক স্থানে গিয়ে তার কবরটি
দেখো। কিন্তু একথা না বলে কুরআন কেবল তাঁর মৃত্যুর
ব্যাপারটি অস্পষ্ট রেখেই থেমে যায়নি এবং তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সম্পর্কে কেবল এমন
শব্দ ব্যবহার করেনি যার ফলে কমপক্ষে তাঁকে জীবিত উঠিয়ে নেয়ার অর্থের সম্ভাবনা থেকে
যায় বরং খৃস্টানদের সুস্পষ্টভাবে একথা বলে দেয় যে, ঈসাকে আদতে
শূলে চড়ানোই হয়নি। অর্থাৎ যে ব্যক্তি শেষ সময়ে “এইলী এইলী
লিমা শাবাকতানী” (অর্থাৎ ঈশ্বর আমার! কেন আমাকে পরিত্যাগ
করেছো?) বলেছিল এবং যার শুলে চড়াবার দৃশ্যের ছবি নিয়ে তোমরা
ঘুরে বেড়াও, সে ঈসা ছিল না। ঈসাকে আল্লাহ তার আগেই উঠিয়ে
নিয়েছিলেন।
এ ধরনের বক্তব্য পেশ করার পর যে ব্যক্তি কুরআনের আয়াত
থেকে হযরত ঈসার আ. মৃত্যুর অর্থ বের করার চেষ্টা করে সে আসলে একথা প্রমাণ করার
চেষ্টা করে যে আল্লাহ পরিস্কার ভাষায় নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন না, নাউযুবিল্লাহ
মিন যালিক।
৫২. অস্বীকারকারী বলতে এখানে
ইহুদীদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ঈসা আ. তাদেরকে ঈমান আনার দাওয়াত
দিয়েছিলেন এবং তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। বিপরীত পক্ষে তাঁর অনুসারী
বলতে যদি সঠিক, যথাথ নির্ভুল অনুসারী ধরা হয় তাহলে কেবল
মুসলমানরাই তার অন্তরভূক্ত হতে পারে। আর যদি এর অর্থ হয় মোটামুটি
যারা তাঁকে মেনে নিয়েছিল, তাহলে এর মধ্যে খৃষ্টান ও মুসলমান উভয়ই
শামিল হবে।
﴿فَأَمَّا
الَّذِينَ كَفَرُوا فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
وَمَا لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ﴾
৫৬। যারা
কুফরী ও অস্বীকার করার নীতি অবলম্বন করেছে তাদেরকে দুনিয়ায় ও আখেরাতে উভয় স্থানে
কঠোর শাস্তি দেবো এবং তারা কোন সাহায্যকারী পাবে না।
﴿وَأَمَّا
الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ ۗ وَاللَّهُ
لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ﴾
৫৭। আর যারা
ঈমান ও সৎকাজ করার নীতি অবলম্বন করেছে, তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। ভালো করেই
জেনে রাখো আল্লাহ জালেমদের কখনোই ভালোবাসেন না।’’
﴿ذَٰلِكَ
نَتْلُوهُ عَلَيْكَ مِنَ الْآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ﴾
৫৮। এই আয়াত ও
জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আমি তোমাকে শুনাচ্ছি।
﴿إِنَّ
مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ ۖ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ
كُن فَيَكُونُ﴾
৫৯। আল্লাহর
কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মতো। কেননা আল্লাহ তাকে মাটি থেকে
সৃষ্টি করেন এবং হুকুম দেন, হয়ে যাও, আর তা হয়ে যায়।৫৩
৫৩. অর্থাৎ যদি নিছক অলৌকিক
জন্মলাভ কারো খোদা বা খোদার পুত্র হবার যথেষ্ট প্রমাণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, তাহলে
সর্বপ্রথম তোমাদের আদম সম্পর্কেই এহেন আকীদা পোষণ করা উচিত ছিল। কারণ ঈসা
কেবল বিনা পিতায় জন্মলাভ করেছিলেন কিন্তু আদম জন্মলাভ করেছিলেন পিতা ও মাতা উভয়ের
সাহায্য ছাড়াই।
﴿الْحَقُّ
مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُن مِّنَ الْمُمْتَرِينَ﴾
৬০। এ প্রকৃত
সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। কাজেই
তুমি সন্দেহকারীদের অন্তরভুক্ত হয়ো না।৫৪
৫৪. এ পর্যন্তকার ভাষনে যেসব
মৌলিক বিষয় খৃষ্টানদের সামনে পেশ করা হয়েছে সেগুলোর সংক্ষিপ্তসার ক্রমানুসারে নীচে
দেয়া হলোঃ
প্রথম যে বিষয়টি তাদের বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে সেটি
হচ্ছে, যেসব কারণ ঈসাকে আল্লাহ বলে তোমাদের মনে বিশ্বাস জন্মেছে, সেগুলোর মধ্যে একটি কারণও এই ধরনের বিশ্বাসের ভিত্তি হতে পারে না। ঈসা একজন
মানুষ ছিলেন। বিশেষ কারণে ও উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁকে অস্বাভাবিক
পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা সংগত মনে করেন। তাঁকে এমন সব মু‘জিয়া তথা
অলৌকিক ক্ষমতা ও নিদর্শন দান করেন, যা ছিল তাঁর নবুওয়াতের
দ্ব্যর্থহীন আলামত। সত্য অস্বীকারকারী ও
সত্যদ্রোহীদের দ্বারা শূলবিদ্ধ হওয়া থেকে তাকে রক্ষা করেন। বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে
উঠিয়ে নেন। প্রভু তার দাসকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করার ক্ষমতা ও
ইখতিয়ার রাখেন। নিছক তাঁর সাথে এই অস্বাভাবিক ব্যবহার দেখে এই
সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া যে, তিনি নিজেই প্রভু ছিলেন অথবা প্রভুপুত্র
ছিলেন অথবা প্রভুত্বে ও মালিকানা স্বত্বে অংশীদার ছিলেন, এটা
কেমন করে সঠিক হতে পারে?
দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তাদের বুঝানো হয়েছে
সেটি হচ্ছে এই যে, ঈসা যে দাওয়াত নিয়ে এসিছিলেন সেই একই
দাওয়াত নিয়ে এসেছেন মুহাম্মাদ সা.। উভয়ের মিশনের মধ্যে সামান্য
চুল পরিমাণ পার্থক্যও নেই।
এই ভাষনের তৃতীয় মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে, কুরআন যে
ইসলামের দাওয়াত পেশ করছে এই ইসলামই ছিল হযরত ঈসার পর তাঁর হাওয়ারীদের ধর্মী।
পরবর্তীকালের ইসায়ী ধর্ম হযরত ঈসা আ. এর শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকেনি এবং তাঁর
অনুসারীবৃন্দ হওয়ারীদের অনুসৃত ধর্মের ওপরও প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেনি।
﴿فَمَنْ
حَاجَّكَ فِيهِ مِن بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا
وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنفُسَنَا وَأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ
فَنَجْعَل لَّعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ﴾
৬১। এই জ্ঞান
এসে যাওয়ার পর এখন যে কেউ এ ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়া করে, হে মুহাম্মাদ! তাকে বলে দাওঃ
‘‘এসো আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রগণকে এবং তোমাদের পুত্রগণকে। আর আমাদের
নারীদেরকে এবং তোমাদের নারীদেরকে আর আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের নিজেদেরকে, তারপর আল্লাহর কাছে এই মর্মে
দোয়া করি যে, যে
মিথ্যাবাদী হবে তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক।’’৫৫
৫৫. মীমাংসার এই পদ্ধিত উপস্থাপন
করার উদ্দেশ্য ছিল আসলে একথা প্রমাণ করা যে, নাজরানের প্রতিনিধিদল
জেনে বুঝে হঠধর্মিতার পথ অবলম্বন করছে। ওপরের ভাষণে যেসব কথা বলা
হয়েছে তার একটিরও জবাব তাদের কাছে ছিল না। খৃষ্টানদের আকীদাগুলোর মধ্য
থেকে কোন একটির পক্ষেও তারা নিজেদের পবিত্র গ্রন্থ ইনজীল থেকে এমন কোন সনদ আনতে
পারছিল না যার ভিত্তিতে পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে তারা এ দাবী করতে পারতো যে, তাদের
বিশ্বাস প্রকৃত সত্যের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল এবং সত্য কোনক্রমেই তার বিরোধী নয়। তা ছাড়া
নবী সা. এর চরিত্র মাধুর্য এবং তাঁর শিক্ষা ও কার্যাবলী দেখে প্রতিনিধি দলের
অধিকাংশ সদস্যের মনে তাঁর নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাসও জন্মে গিয়েছিল। অথবা
কমপক্ষে তাঁর নবুওয়াত অস্বীকার করার ভিত নড়ে উঠেছিল। তাই যখন তাদের বলা হলো আচ্ছা, যদি তোমাদের
বিশ্বাসের সত্যতার ওপর পূর্ণ ঈমান থাকে, তাহলে এসো আমাদের
মোকাবিলায় এই দোয়া করো যে, যে মিথ্যেবাদী হবে তার ওপর
আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক, তখন তাদের একজনও মোকাবিলায় এগিয়ে
এলো না। এভাবে সমগ্র আরববাসীর সামনে একথা পরিস্কার হয়ে গেলো
যে, নাজরানের খৃষ্টবাদের যেসব পুণ্যাত্মা পাদরী ও যাজকের পবিত্রতার প্রভাব
বহুদূর বিস্তৃত, তারা আসলে এমনসব আকীদা-বিশ্বাস পালন করে
আসছে যেগুলোর সত্যতার প্রতি তাদের নিজেদেরও পূর্ণ আস্থা নেই।
﴿إِنَّ
هَٰذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ ۚ وَمَا مِنْ إِلَٰهٍ إِلَّا اللَّهُ ۚ وَإِنَّ اللَّهَ
لَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
৬২। নিসন্দেহ
এটা নির্ভুল সত্য বৃত্তান্ত। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া আর
কোন ইলাহ নেই। আর আল্লাহর সত্তা প্রবল পরাক্রান্ত এবং
তার জ্ঞান ও কর্মকৌশল সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থায় সক্রিয়।
﴿فَإِن
تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِالْمُفْسِدِينَ﴾
৬৩। কাজেই এরা
যদি (এই শর্তে মোকাবিলায় আসার ব্যাপারে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে (তারা যে ফাসাদকারী
একথা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং) আল্লাহ অবশ্যি ফাসাদকারীদের অবস্থা ভালো করেই জানেন।
c রুকুঃ ৭ d
﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ
تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا
اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا
مِّن دُونِ اللَّهِ ۚ فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ﴾
৬৪। বলঃ৫৬ হে আহলি কিতাব! এসো এমন একটি
কথার দিকে, যা আমাদের
ও তোমাদের মধ্যে একই ধরনের।৫৭ তা হচ্ছেঃ আমরা আল্লাহ ছাড়া
কারোর বন্দেগী ও দাসত্ব করবো না। তাঁর সাথে
কাউকে শরীক করবো না। আর আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া
আর কাউকেও নিজের রব হিসেবে গ্রহণ করবে না। যদি তারা
এ দাওয়াত গ্রহণ করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে পরিষ্কার বলে দাওঃ ‘‘তোমরা সাক্ষী
থাকো, আমরা
অবশ্যি মুসলিম (একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী ও আনুগত্যকারী)।’’
৫৬. এখান থেকে তৃতীয় ভাষন শুরু
হচ্ছে। এর বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে মনে হয় এটা বদর ও
ওহোদের যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে নাযিল হয়েছিল। কিন্তু এ তিনটি ভাষণের মধ্যে
অর্থের দিক দিয়ে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক পাওয়া যায়। যার ফলে শূরার শুরু থেকে
নিএয় এখান পর্যন্ত কোথাও বক্তব্যের মধ্যে কোন সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেনি। এ জন্য
কোন কোন তাফসীরকার সন্দেহ করেছেন যে, এই পরবর্তী আয়াত গুলোও
নাজরানের প্রতিনিধিদলের সাথে সম্পর্কিত ভাষণেরই অংশবিশেষ। কিন্তু
এখান থেকে যে ভাষন শুরু হচ্ছে তার ধরন দেখে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে
ইহুদীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে।
৫৭. অর্থাৎ এমন একটি বিশ্বাসের প্রশ্নে
একমত হয়ে যাও, যার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি এবং তোমরাও যার
নির্ভুলতা অস্বীকার করতে পারো না। তোমাদের নবীদের এ বিশ্বাসের
কথাই প্রচারিত হয়েছে। তোমাদের পবিত্র কিতাবগুলোতে এরি শিক্ষা
দেয়া হয়েছে।
﴿يَا أَهْلَ
الْكِتَابِ لِمَ تُحَاجُّونَ فِي إِبْرَاهِيمَ وَمَا أُنزِلَتِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنجِيلُ
إِلَّا مِن بَعْدِهِ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ﴾
৬৫। হে আহলি
কিতবা! তোমরা ইবরাহীমের ব্যাপারে আমার সাথে ঝগড়া করছো কেন? তাওরাত ও ইনজীল তো ইবরাহীমের
পরে নাযিল হয়েছে। তাহলে তোমরা কি এতকুটু কথাও বুঝো না?৫৮
৫৮. অর্থাৎ তোমাদের ইহুদীবাদ ও
খৃষ্টাবাদ তাওরাত ও ইনজীল নাযিলের পরে সৃষ্টি হয়েছে। আর ইব্রাহীম আ. যে ধর্মের
ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন সেটি ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ ছিল না। এরপর যদি হযরত ইব্রাহীম আ.
সত্য-সঠিক পথে থেকে থাকেন এবং নাজাত লাভ করে থাকেন, তাহলে
নিসন্দেহে একথা প্রমাণ হয় যে, মানুষের সত্য-সঠিক পথে থাকা
ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের অনুসৃতির ওপর নির্ভরশীল নয়। (সূরা আল বাকারাহ-এর ১৩৫ ও
১৪১ টীকা দেখুন)
﴿هَا أَنتُمْ
هَٰؤُلَاءِ حَاجَجْتُمْ فِيمَا لَكُم بِهِ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَاجُّونَ فِيمَا لَيْسَ
لَكُم بِهِ عِلْمٌ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾
৬৬। তোমরা
যেসব বিষয়ের জ্ঞান রাখো সেগুলোর ব্যাপারে বেশ বিতর্ক করলে, এখন আবার সেগুলোর ব্যাপারে
বিতর্ক করতে চললে কেন যেগুলোর কোন জ্ঞান তোমাদের নেই? আল্লাহ জানেন কিন্তু তোমরা
জানো না।
﴿مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا
وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِن كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
৬৭। ইব্রাহীম
ইহুদী ছিল না, খৃস্টানও
ছিল না বরং সে তো ছিল একজন একনিষ্ঠ মুসলিম৫৯ এবং সে কখনো মুশরিকদের
অন্তরভুক্ত ছিল না। ইবরাহীমের যারা অনুসরণ করেছে
তারাই তার সাথে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক রাখার অধিকারী।
৫৯. আসলে এখানে ‘হানীফ’
শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ অর্থ হয় এমন ব্যক্তি যেসব
দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটি বিশেষ পথে চলে। এই অর্থটিকেই আমরা “একনিষ্ঠ
মুসলিম” শব্দের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি।
﴿إِنَّ
أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَٰذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ
آمَنُوا ۗ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ﴾
৬৮। আর এখন এই
নবী এবং এর ওপর যারা ঈমান এনেছে তারাই এই সম্পর্ক রাখার বেশী অধিকারী। আল্লাহ
কেবল তাদেরই সমর্থক ও সাহায্যকারী যারা ঈমান এনেছে।
﴿وَدَّت
طَّائِفَةٌ مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يُضِلُّونَكُمْ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنفُسَهُمْ
وَمَا يَشْعُرُونَ﴾
৬৯। (হে
ঈমানদারগণ!) আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে একটি দল যে কোন রকমের তোমাদের সত্য ও ন্যায়ের
পথ থেকে বিচ্যুত করতে চায়। অথচ তারা নিজেদের ছাড়া আর
কাউকেই বিপথগামী করছে না। কিন্তু তারা এটা উপলব্ধি করে
না।
﴿يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ
تَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأَنتُمْ تَشْهَدُونَ﴾
৭০। হে আহ্লি
কিতাব! কেন আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করছো, অথচ তোমরা নিজেরাই তা প্রত্যক্ষ করছো?৬০
৬০. এ বাক্যটির আর একটি অনুবাদও
হতে পারে। সেটি হচ্ছে, “তোমরা নিজেরা সাক্ষ্য
দিচ্ছো” উভয় অবস্থাতেই মূল অর্থের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। আসলে নবী
সা. এর পবিত্র জীবন,সাহাবায়ে কেরামের জীবনের ওপর তাঁর শিক্ষা ও
অনুশীলনের বিস্ময়কর প্রভাব এবং কুরআনের উন্নতমানের বিষয়বস্তু এসবগুলোই মহান
আল্লাহর এমনি উজ্জ্বল নিদর্শন ছিল। যা দেখার পর নবী-রাসূলদের
অবস্থা ও আসমানী কিতাবসমূহের ধারাবিবরণীর সাথে পরিচিত ব্যক্তি মাত্রেরই নবী সা. এর
নবুওয়াত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার ছিল। কাজেই অনেক আহলি কিতাব
(বিশেষ করে তাদের আলেম সমাজ) একথা জেনে নিয়েছিল যে, পূর্ববর্তী
নবীগণ যে নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন মুহাম্মাদ সা. সেই নবী। এমন কি
কখনো কখনো সত্যের প্রবল শক্তির চাপে বাধ্য হয়ে তারা নবী সা. এর সত্যতা ও তাঁর
উপস্থাপিত শিক্ষাকে সত্য বলে স্বীকার করে নিতো। এ জন্যই কুরআন বার বার তাদের
বিরুদ্ধে ও অভিযোগ এনেছে যে, তোমরা নিজেরাই আল্লাহর যেসব নিদর্শনের
সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছো, সেগুলোকে তোমরা নিজেদের মানসিক
দুস্কৃতিপরায়তার কারণে ইচ্ছা করেই মিথ্যা বলছো কেন?
﴿يَا أَهْلَ
الْكِتَابِ لِمَ تَلْبِسُونَ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَأَنتُمْ
تَعْلَمُونَ﴾
৭১। হে আহলি
কিতাব! কেন সত্যের গায়ে মিথ্যার প্রলেপ লাগিয়ে তাকে সন্দেহযুক্ত করে তুলছো? কেন জেনে বুঝে সত্যকে গোপন
করছো?
﴿وَقَالَت طَّائِفَةٌ مِّنْ
أَهْلِ الْكِتَابِ آمِنُوا بِالَّذِي أُنزِلَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَجْهَ النَّهَارِ
وَاكْفُرُوا آخِرَهُ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ﴾
৭২। আহলি
কিতাবদের একটি দল বলে, এই নবীকে যারা মেনে নিয়েছে তাদের ওপর যা কিছু নাযিল হয়েছে, তার প্রতি তোমরা সকাল বেলায়
ঈমান আনো এবং সাঁঝের বেলায় তা অস্বীকার করো। সম্ভবত এই
উপায়ে এই লোকেরা নিজেদের ঈমান থেকে ফিরে যাবে।৬১
৬১. মদীনার উপকন্ঠে বসবাসকারী
ইহুদীদের সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ইসলামের দাওয়াতকে দুর্বল করার জন্য যেসব চাল
চালতো এটি তার অন্যতম। ইসলামের প্রতি মুসলমানদেরকে বিরূপ করে
তোলার এবং নবী সা. সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ ও খারাপ ধারণা সৃষ্টি করার
উদ্দেশ্যে তারা গোপনে লোক তৈরী করে পাঠাতো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমে এই
লোকগুলো প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করবে, তারপর মুরতাদ হয়ে যাবে
এবং ইসলাম, মুসলমান ও তাদের নবীর মধ্যে নানা প্রকার গলদ
নির্দেশ করে বিভিন্ন স্থানে এই মর্মে প্রচার করে বেড়াবে যে, এই
সমস্ত দোষ-ত্রুটি দেখেই তারা ইসলাম থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
﴿وَلَا
تُؤْمِنُوا إِلَّا لِمَن تَبِعَ دِينَكُمْ قُلْ إِنَّ الْهُدَىٰ هُدَى اللَّهِ أَن
يُؤْتَىٰ أَحَدٌ مِّثْلَ مَا أُوتِيتُمْ أَوْ يُحَاجُّوكُمْ عِندَ رَبِّكُمْ ۗ قُلْ
إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ﴾
৭৩। তাছাড়া এই
লোকেরা পরস্পর বলাবলি করে, নিজের ধর্মের লোক ছাড়া আর কারো কথা মেনে নিয়ো না। হে নবী!
এদের বলে দাও, ‘‘আল্লাহর
হিদায়াতই তো আসল হিদায়াত এবং এটা তো তাঁরই নীতি যে, এক সময় যা তোমাদের দেয়া
হয়েছিল তাই অন্য একজনকে দেয়া হবে অথবা অন্যেরা তোমাদের রবের কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে
পেশ করার জন্য শক্তিশালী প্রমাণ পেয়ে যাবে।’’ হে নবী!
তাদের বলে দাও, ‘‘গ্রহণ ও
মর্যাদা আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। তিনি
ব্যাপক দৃষ্টির অধিকারী৬২
৬২. মূলে ‘ওয়াসে’ শব্দটি ব্যবহার
করা হয়েছে। কুরআনে সাধারণত তিনটি জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহার করা
হয়। একঃ যেখানে কোন একটি মানব গোষ্ঠীর সংকীর্ণমনতা ও
সংকীর্ণ চিন্তার উল্লেখ করা হয় এবং আল্লাহ তাদের মতো সংকীর্ণ দৃষ্টির অধিকারী নন, একথা তাদের
জানিয়ে দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দুইঃ যেখানে কারো কৃপণতা, সংকীর্ণমনতা
এবং স্বল্প সাহস ও হিম্মতের কারণে তাকে তিরস্কার করে মহান আল্লাহ যে উদার হস্ত এবং
তার মতো কৃপণ নন, একথা বুঝাবার প্রয়োজন হয়। তিনঃ
যেখানে লোকেরা নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে আল্লাহর ওপরও এক ধরনের
সীমাবদ্ধতা আরোপ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে একথা জানাবার
প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে, আল্লাহ সকল প্রকার সীমাবদ্ধতার উর্ধে,
তিনি অসীম। (এ প্রসংগে সূরা আল
বাকারাহ-এর ১১৬ টীকাটি ও দেখুন)।
﴿يَخْتَصُّ
بِرَحْمَتِهِ مَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ﴾
৭৪। এবং
সবকিছু জানেন।৬৩ নিজের রহমতের জন্য তিনি যাকে
চান নির্ধারিত করে নেন এবং তাঁর অনুগ্রহ বিশাল ব্যপ্তির অধিকারী।’’
৬৩. অর্থাৎ কে অনুগ্রহ ও
মর্যাদালাভের যোগ্য আল্লাহই তা জানেন।
﴿وَمِنْ
أَهْلِ الْكِتَابِ مَنْ إِن تَأْمَنْهُ بِقِنطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُم مَّنْ
إِن تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لَّا يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلَّا مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَائِمًا
ۗ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ
عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾
৭৫। আহলি
কিতাবদের মধ্যে কেউ এমন আছে, তার ওপর আস্থাস্থাপন করে যদি তাকে সম্পদের
স্তূপ দান করো, তাহলেও সে
তোমার সম্পদ তোমাকে ফিরিয়ে দেবে। আবার
তাদের কারো আবস্থা এমন যে, যদি তুমি তার ওপর একটি মাত্র দীনারের ব্যাপারেও আস্থাস্থাপন
করো, তাহলে সে
তা তোমাকে ফিরিয়ে দেবে না, তবে যদি তোমরা তার ওপর চড়াও হয়ে যাও। তাদের এই
নৈতিক অবস্থার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলেঃ নিরক্ষরদের (অ–ইহুদী) ব্যাপারে
আমাদের কোন দায়দায়িত্ব নেই।৬৪ আর এটা একটা সর্ম্পূণ মিথ্যা
বানোয়াট কথা তারা আল্লাহর প্রতি আরোপ করেছে। অথচ তারা
জানে, (আল্লাহ এমন
কোন কথা বলেননি।)
৬৪. এটা কেবল সাধারণ ইহুদীদের
মূর্খতাপ্রসূত ধারণাই ছিল না। বরং এটাই ছিল তাদের ধর্মীয়
শিক্ষা। তাদের বড় বড় ধর্মীয় নেতারা এই ধর্মীয় বিধানও দিতো। বাইবেলে
ঋণ ও সূদের বিধানের ক্ষেত্রে ইসরাঈলী ও অ-ইসলাঈলীদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য করা
হয়েছে। (দ্বিতীয় বিবরণঃ ১৫:৩-২৩:২০)
তালমূদে বলা হয়েছে, যদি কোন
ইসরাঈলীর বলদ কোন অ-ইসরাঈলীর বলদকে আহত করে তাহলে এ জন্য কোন জরিমানা দিতে হবে না। কোন
ব্যক্তি যদি কোন জিনিস কুড়িয়ে পায় তাহলে তাকে চারপাশের জনবসতির দিকে নজর দিতে হবে। চারপাশে
যদি ইসরাঈলীদের বসতি থাকে, তাহলে বিনা ঘোষণায় সে জিনিসটি নিয়ে নিতে
পারে। রাব্বী ইসমাঈল বলেনঃ যদি ইসরাঈলী ও অইসরাঈলীর মামলা
বিচারপতির আদালতে আসে, তাহলে বিচারপতি ধর্মীয় আইনের আওতায় নিজের
ভাইকে জয়ী করতে পারলে তাই করবেন এবং বলবেন,এটা তো আমাদের আইন। আর
অ-ইসরাঈলীদের আইনের আওতায় জয়ী করতে পারলে তাই করবেন এবং বলবেন, এটা তো
তোমাদের আইন। যদি দু’টি আইনের কোনটার সাহায্যেই
ইসরাইলীকে জয়ী করানো সম্ভব না হয়,তাহলে যে কোন বাহানাবাজী ও কৌশল
অবলম্বন করে ইসরাঈলীকে জয়ী করা যায়,তা তাকে করতে হবে। রাব্বী
শামওয়াঈল বলনেঃ অ-ইসরাঈলীর প্রতিটি ভুলের সুযোগ গ্রহণ করা উচতি। (Talmudic miscellany paul
isaac hershon, London 1880. Page-37, 220, 221)
﴿بَلَىٰ
مَنْ أَوْفَىٰ بِعَهْدِهِ وَاتَّقَىٰ فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾
৭৬। আচ্ছা, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে
না কেন? যে ব্যক্তিই তার অংগীকার পূর্ণ করবে এবং অসৎকাজ থেকে দূরে
থাকবে, সে আল্লাহর
প্রিয়ভাজন হবে। কারণ আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন।
﴿إِنَّ
الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَٰئِكَ
لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنظُرُ إِلَيْهِمْ
يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
৭৭। আর যারা
আল্লাহর সাথে করা অংগীকার ও নিজেদের শপথ সামান্য দামে বিকিয়ে দেয়, তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ
নেই। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা
বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পাক–পবিত্র ও করবেন না।৬৫ বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠোর
যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
৬৫. এর কারণ হচ্ছে, এরা এত বড় বড়
এবং কঠিনতম অপরাধ করার পরও মনে করতো, কিয়ামতের দিন তারাই
আল্লাহর সবচেয়ে বেশী নৈকট্যলাভের অধিকারী হবে। তাদের প্রতি বর্ষিত হবে
আল্লাহর অনুগ্রহ। আর দুনিয়ার জীবনে যে সামান্য গোনাহের দাগ তাদের গায়ে
লেগে গেছে, বুযর্গদের বদৌলতে তাও ধুয়ে মুছে সাফ করে
দেয়া হবে। অথচ আসলে সেখানে তাদের সাথে এর সম্পূর্ণ উল্টা
ব্যবহার করা হবে।
﴿وَإِنَّ
مِنْهُمْ لَفَرِيقًا يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُم بِالْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ الْكِتَابِ
وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِندِ اللَّهِ وَمَا هُوَ مِنْ
عِندِ اللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾
৭৮। তাদের
মধ্যে কিছু লোক আছে, তারা কিতাব
পড়ার সময় এমনভাবে জিভ ওলট পালট করে যে, তোমরা মনে করতে থাকো, তারা কিতাবেরই ইবারত পড়ছে, অথচ তা কিতাবের ইবারত নয়।৬৬ তারা বলে, যা কিছু আমরা পড়ছি, তা আল্লাহর কাছ থেকেই পাওয়া
অথচ তা আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া নয়, তারা জেনে বুঝে আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ
করে।
৬৬. এর অর্থ যদিও এটাও হতে পারে
যে, তারা আল্লাহর কিতাবের অর্থ বিকৃত করে অথবা শব্দ ওলট পালট করে তার অর্থ
সম্পূর্ণ উল্টে দেয় তবুও এর আসল অর্থ হচ্ছে তারা আল্লাহর কিতাব পড়ার সময় তাদের
স্বার্থ বা মনগড়া আকীদা-বিশ্বাস ও মতবাদ বিরোধী কোন বিশেষ শব্দকে জিভের নাড়াচাড়ার
মাধ্যমে এমনভাবে উচ্চারণ করে যার ফলে তারা চেহারা বদল হয়ে যায়। কুরআনের
স্বীকৃতি দানকারী আহ্লী কিতাবদের মধ্যেও এর নজীরের অভাব নেই। যেমন নবীর মানব
সম্প্রদায়ভূক্ত হবার বিষটি যারা অস্বীকার করে তারা কুরআনের (إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٌ
مِّثْلُكُمْ) (অবশ্যি আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ) আয়াতটি পড়ার সময় ‘ইন্নামা’
শব্দটিকে ভেঙে ‘ইনা’ ‘মা’ দুই শব্দ করে পড়ে। এর অর্থ
হয়ঃ “হে নবী! তুমি বলে দাও, অবশ্যি আমি মানুষ নই তোমাদের
মতো”।
﴿مَا كَانَ
لِبَشَرٍ أَن يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ
لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِّي مِن دُونِ اللَّهِ وَلَٰكِن كُونُوا رَبَّانِيِّينَ
بِمَا كُنتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنتُمْ تَدْرُسُونَ﴾
৭৯। কোন
ব্যক্তিকে আল্লাহর কিতাব, হিকমত ও নবুওয়াত দান করবেন আর সে লোকদের বলে বেড়াবে, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার
দাস হয়ে যাও, এটা তার
জন্য শোভনীয় নয়। সে তো একথাই বলবে, তোমরা খাঁটি রব্বানী৬৭ হয়ে যাও, যেমন এই কিতাবের দাবী, যা তোমরা পড়ো এবং অন্যদের
পড়াও।
৬৭. ইহুদীদের সমাজে যারা আলেম
পদবাচ্য হতেন, যারা ধর্মীয় পদ ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকতেন,
ধর্মীয় ব্যাপারে লোকদের নেতৃত্বদান এবং ইবাদাত প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয়
বিধান প্রবর্তন করাই ছিল যাদের কাজ তাদের জন্য রব্বানী শব্দটি ব্যবহার করা হতো। যেমন
কুরআনের একস্থান বলা হয়েছেঃ
لَوْلَا يَنْهَىٰهُمُ ٱلرَّبَّٰنِيُّونَ
وَٱلْأَحْبَارُ عَن قَوْلِهِمُ ٱلْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ ٱلسُّحْتَ
(অর্থাৎ তাদের রব্বানী ও আলেমরা তাদেরকে
গোনাহের কথা বলতে ও হারাম সম্পদ খেতে বাধা দিতো না কেন?) অনুরূপভাবে
খৃস্টানদের মধ্যে ‘রব্বানী’ এর সমার্থক (Divine) প্রচলন দেখা যায়।
﴿وَلَا
يَأْمُرَكُمْ أَن تَتَّخِذُوا الْمَلَائِكَةَ وَالنَّبِيِّينَ أَرْبَابًا ۗ أَيَأْمُرُكُم
بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنتُم مُّسْلِمُونَ﴾
৮০। তারা
তোমাদের কখনো বলবে না, ফেরেশতা বা নবীদেরকে তোমাদের রব হিসেবে গ্রহণ করো। তোমরা যখন
মুসলিম তখন তোমাদেরকে কুফরীর হুকুম দেয়া একজন নবীর পক্ষে কি সম্ভব?৬৮
৬৮. দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি
আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবীদের ওপর যেসব মিথ্যা কথা আরোপ করে নিজেদের ধর্মীয়
গ্রন্থগুলোর অন্তরভূক্ত করে নিয়েছে এবং যেগুলোর প্রেক্ষিতে নবী বা ফেরেশতারা কোন
না কোন দিক দিয়ে ইলাহ ও মাবুদ হিসেবে গণ্য হয়, এখানে তাদের সেই সমস্ত
মিথ্যা কথার বলিষ্ঠ ও পূর্ণাংগ প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এই আয়াতে একটি মূলনীতি
বর্ণনা করা হয়েছে, বলা হয়েছেঃ যে শিক্ষা মানুষকে আল্লাহ ছাড়া
অন্য কোন সত্তার বন্দেগী ও পূজা-অর্চনায় লিপ্ত করে এবং তাকে আল্লাহর দাসত্বের
পর্যায় থেকে খোদায়ীর পর্যায়ে উন্নীত করে, তা কখনো নবীর
শিক্ষা হতে পারে না। কোন ধর্মী গ্রন্থে ধরনের
বক্তব্য দেখা গেলে সেখানে বিভ্রান্ত লোকেরা এই বিকৃতি ঘটিয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
﴿وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ
النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُم مِّن كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ
لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ ۚ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ
عَلَىٰ ذَٰلِكُمْ إِصْرِي ۖ قَالُوا أَقْرَرْنَا ۚ قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُم
مِّنَ الشَّاهِدِينَ﴾
৮১। স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নবীদের থেকে এই
মর্মে অংগীকার নিয়েছিলেন, আজ আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দান করেছি, কাল যদি অন্য একজন রাসূল এই
শিক্ষার সত্যতা ঘোষণা করে তোমাদের কাছে আসে, যা আগে থেকেই তোমাদের কাছে
আছে, তাহলে
তোমাদের তার প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং তাকে সাহায্য করতে হবে।৬৯ এই বক্তব্য উপস্থাপন করার পর
আল্লাহ জিজ্ঞেস করেনঃ তোমরা কি একথার স্বীকৃতি দিচ্ছো এবং আমার পক্ষ থেকে
অংগীকারের গুরুদায়িত্ব বহন করতে প্রস্তুত আছো? তারা বললো, হ্যাঁ, আমরা স্বীকার করলাম।
৬৯. এর অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক
নবীর কাছ থেকে এই মর্মে অংগীকার নেয়া হয়েছে। আর যে অংগীকার নবীর কাছ থেকে
নেয়া হয়েছে তা নিসন্দেহে ও অনিবার্যভাবে তাঁর অনুসারীদের ওপরও আরোপিত হয়ে যায়। অংগীকারটি
হচ্ছে, যে দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে তোমাদের নিযুক্ত করা হয়েছে সেই একই
দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়ে আমার পক্ষ থেকে যে নবীকে পাঠানো হবে তার
সাথে তোমাদের সহযোগিতা করতে হবে। তার প্রতি কোন হিংসা ও
বিদ্বেষ পোষণ করবে না। নিজেদেরকে দীনের ইজারাদার মনে করো না। সত্যের
বিরোধিতা করবে না। বরং যেখানে যে ব্যক্তিকেই আমার পক্ষ থেকে সত্যের
পতাকা উত্তোলন করার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হবে সেখানেই তার পতাকাতলে সমবেত হয়ে যাবে।
এখানে আরো এতটুকু কথা জেনে নিতে হবে যে, হযরত
মুহাম্মাদ সা. এর পূর্বে যে নবীই এসেছিলেন তাঁর কাছ থেকে এই অংগীকারই নেয়া হয়েছে। আর এরই
ভিত্তিতে প্রত্যেক নবী নিজের উম্মাতকে তাঁর পরে যে নবী আসবেন তার খবর দিয়েছেন এবং
তাঁর সাথে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ সা.
এর কাছ থেকে এ ধরনের কোন অংগীকার নেয়া হয়েছে এমন কোন কথা কুরআনে ও হাদীসে কোথাও
উল্লেখিত হয়নি। অথবা তিনি নিজের উম্মাতকে পরবর্তীকালে আগমনকারী কোন
নবীর খবর দিয়ে তার প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দিয়ে গেছেন বলে কোন কথাও জানা যায়নি।
﴿فَمَن
تَوَلَّىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
৮২। আল্লাহ
বললেনঃ আচ্ছা, তাহলে
তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম, এরপর যারাই এ অংগীকার ভংগ
করবে তারাই হবে ফাসেক।৭০
৭০. এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে
আহ্লি কিতাবদের এই মর্মে সতর্ক করা যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কৃত
অংগীকার ভংগ করছো এবং মুহাম্মাদ সা.কে অস্বীকার ও তাঁর বিরোধিতা করে তোমাদের
নবীদের থেকে যে অংগীকার নেয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধাচরন করছো। কাজেই এখন
তোমরা ফাসেক হয়ে গেছো। অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের শিকল কেটে বের
হয়ে গেছো।
﴿أَفَغَيْرَ
دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا
وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ﴾
৮৩। এখন কি
এরা আল্লাহর আনুগত্যের পথ (আল্লাহর দীন) ত্যাগ করে অন্য কোন পথের সন্ধান করছে? অথচ আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই
স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর হুকুমের অনুগত (মুসলিম)৭১ এবং তাঁরই দিকে সবাইকে ফিরে
যেতে হবে।
৭১. অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব-জাহান ও
বিশ্ব-জাহানের মধ্যে যা কিছু আছে সবার দীন ও জীবন বিধানই হচ্ছে এ ইসলাম। অর্থাৎ
আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর দাসত্ব।এখন এই বিশ্ব-জাহানের মধ্যে
অবস্থান করে তোমরা ইসলাম ছাড়া আর কোন জীবন বিধানের অনুসন্ধান করছো?
﴿قُلْ آمَنَّا
بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ عَلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ
وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَالنَّبِيُّونَ
مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ﴾
৮৪। হে নবী!
বলোঃ আমরা আল্লাহকে মানি, আমাদের ওপর অবতীর্ণ শিক্ষাকে মানি, ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও ইয়াকূব সন্তানদের
ওপর অবতীর্ণ শিক্ষাকেও মানি এবং মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীদেকে তাদের রবের পক্ষ
থেকে যে হিদায়াত দান করা হয় তার ওপরও ঈমান রাখি। আমরা
তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না৭২ এবং আল্লাহর হুকুমের অনুগত
(মুসলিম)।
৭২. অর্থাৎ কোন নবীকে মানবো ও
কোন নবীকে মানবো না এবং কোন নবীকে মিথ্যা ও কোন নবীকে সত্য বলবো, এটা আমাদের
পদ্ধতি নয়। আমরা হিংসা-বিদ্বেষ ও জাহেলী আত্মম্ভরিতা মুক্ত। দুনিয়ার
যেখানেই আল্লাহর যে বান্দাই আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যের পয়গাম এনেছেন আমরা তার
সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছি।
﴿وَمَن
يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ
مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾
৮৫। এ আনুগত্য
(ইসলাম) ছাড়া যে ব্যক্তি অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায় তার সে পদ্ধতি কখনোই
গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ব্যর্থ, আশাহত ও বঞ্চিত।
﴿كَيْفَ
يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ
حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾
৮৬। ঈমানে
নিয়ামত একবার লাভ করার পর পুনরায় যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দান
করবেন, এটা কেমন
করে সম্ভব হতে পারে? অথচ তারা
নিজেরা সাক্ষ্য দিয়েছে যে, রাসূল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তার কাছে উজ্জ্বল
নিদর্শনসমূহও এসেছে।৭৩ আল্লাহ জালেমদের হিদায়াত দান
করেন না।
৭৩. এখানে আবার সে একই কথার
পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে,যা ইতিপূর্বে বারবার বিবৃত করা হয়েছে অর্থাৎ
নবী সা. এর যুগে ইহুদী আলেমরা একথা জানতে পেরেছিল এবং তারা এর সাক্ষ্য দিয়েছিল যে,
মুহাম্মাদ সা. সত্য নবী এবং তিনি সেই একই শিক্ষা এনেছেন, যা ইতিপূর্বে অন্যান্য নবীগণও এনেছিলেন। এসব জানার পরও তারা যা কিছু
করেছে তা ছিল নিছক বিদ্বেষ, হঠধর্মিতা ও সত্যের সাথে দুশমনির পুরাতন
অভ্যাসের ফল। শত শত বছর থেকে তারা এ অপরাধ করে আসছিল।
﴿أُولَٰئِكَ
جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ﴾
৮৭। তাদের ওপর
আল্লাহ, ফেরেশতা ও
সমস্ত মানুষের লানত, এটিই হচ্ছে
তাদের জুলুমের সঠিক প্রতিদান।
﴿خَالِدِينَ
فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنظَرُونَ﴾
৮৮। এই
অবস্থায় তারা চিরদিন থাকবে। তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না
এবং তাদের বিরামও দেয়া হবে না।
﴿إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا
مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৮৯। তবে যারা
তাওবা করে নিজেদের কর্মনীতির সংশোধন করে নেয় তারা এর হাত থেকে রেহাই পাবে। আল্লাহ
ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
﴿إِنَّ
الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَّن تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ
وَأُولَٰئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ﴾
৯০। কিন্তু
যারা ঈমান আনার পর আবার কুফরী অবলম্বন করে তারপর নিজেদের কুফরীর মধ্যে এগিয়ে যেতে
থাকে,৭৪ তাদের তাওবা কবুল হবে না। এ ধরনের
লোকেরা তো চরম পথভ্রষ্ট।
৭৪. অর্থাৎ কেবল অস্বীকার করেই
ক্ষান্ত হয়নি বরং কার্যত তার বিরোধিতা ও তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। লোকদের
আল্লাহর পথে চলা থেকে বিরত রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সন্দেহ ও
সংশয় সৃষ্টি করেছে এবং বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বেড়িয়েছে। মনের মধ্যে দ্বিধার সৃষ্টি
করেছে ও কুমন্ত্রণা দিয়েছে এবং নবীর মিশন যাতে কোনক্রমে সফলতার সীমান্তে পৌছাতে না
পারে সেজন্য সবরকমের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে।
﴿إِنَّ
الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَن يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِم مِّلْءُ
الْأَرْضِ ذَهَبًا وَلَوِ افْتَدَىٰ بِهِ ۗ أُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ وَمَا
لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ﴾
৯১।
নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, যারা কুফরী অবলম্বন করেছে এবং কুফরীর
অবস্থায় জীবন দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকে কেউ যদি নিজেকে শাস্তি
থেকে বাঁচাবার জন্য সারা পৃথিবীটাকে স্বর্ণে পরিপূর্ণ করে বিনিময় স্বরুপ পেশ করে
তাহলেও তা গ্রহণ করা হবে না। এ ধরনের
লোকদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এবং তারা নিজেদের জন্য কোন সাহায্যকারীও
পাবে না।
c রুকুঃ ১০ d
﴿لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُوا مِمَّا
تُحِبُّونَ ۚ وَمَا تُنفِقُوا مِن شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ﴾
৯২। তোমরা নকী
অর্জন করতে পারো না যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলো (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো।৭৫ আর তোমরা যা ব্যয় করবে আল্লাহ
তা থেকে বেখবর থাকবেন না।
৭৫. নেকী, সওয়ার ও
পুন্যের ব্যাপারে তারা যে ভুল ধারা পোষণ করতো, তা দূর করাই এ
বক্তব্যের উদ্দেশ্য। নেকী ও পূর্ণ সম্পর্কে তাদের
মনে যে ধারণা ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ধারণাটির চেহারা ছিল নিম্নরূপঃ শত শত
বছরের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারেরর পথ বেয়ে শরীয়াতের যে একটি বিশেষ আনুষ্ঠানিক চেহারা
তাদের সমাজে তৈরি হয়ে গিয়েছিল মানুষ নিজের জীবনে পুরোপুরি তার নকলনবিশী করবে। আর তাদের
আলেম সমাজ আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে একটি বড় রকমের আইন ব্যবস্থা গড়ে
তুলেছিল জীবনের ছোটখাটো ও খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোকে দিনরাত বসে বসে তার মানদণ্ডে
বিচার করতে থাকবে। ধার্মীকতার এই আবরণের নীচে সাধারণত ইহুদীদের বড় বড় ‘ধার্মীকেরা’
সংকীর্নতা, লোভ,লালসা,
কার্পণ্য, সত্য গোপন করা ও সত্যকে বিক্রি করার
দোষগুলো সংগোপনে লুকিয়ে রেখেছিল। ফলে সাধারণ মানুষ তাদেরকে সৎ
ও পুন্যবান মনে করতো। এ বিভ্রান্তির দূর করার জন্য তাদেরকে বলা
হচ্ছেঃ তোমরা যে জিনিসকে কল্যাণ, সততা ও সৎকর্মশীলতা মনে করছো ‘সৎলোক’ হওয়া তার চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার। আল্লাহর
প্রতি ভালোবাসাই হচ্ছে নেকীর মূল প্রাণসত্তা। এই ভালোবাসা এমন পর্যায়ে
পৌছতে হবে, যার ফলে আল্লাহর সন্তুষ্ঠির মোকাবিলায়
মানুষ দুনিয়ার কোন জিনিসকেই প্রিয়তর মনে করবে না। যে জিনিসের প্রতি ভালোবাসা
মানুষের মনে এমনভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে যে, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার
জন্য সে তাকে ত্যাগ করতে পারে না, সেটিই হচ্ছে একটি দেবতা। এই
দেবতাকে বিসর্জন দিতে ও বিনষ্ট করতে না পারলে নেকীর দুয়ার তার জন্য বন্ধ থাকবে। এই
প্রাণসত্তা শূণ্য হবার পরে নেকী নিছক বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান ভিত্তিক ধার্মিকতায়
পরিণত হয় এবং তাকে তখন এমন একটি চকচকে তেলের সাথে তুলনা করা যায়, যা একটি ঘূণে
ধরা কাঠের গায়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের তেল চকচকে কাঠ দেখে
মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে, আল্লাহ নয়।
﴿كُلُّ
الطَّعَامِ كَانَ حِلًّا لِّبَنِي إِسْرَائِيلَ إِلَّا مَا حَرَّمَ إِسْرَائِيلُ عَلَىٰ
نَفْسِهِ مِن قَبْلِ أَن تُنَزَّلَ التَّوْرَاةُ ۗ قُلْ فَأْتُوا بِالتَّوْرَاةِ فَاتْلُوهَا
إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
৯৩। এসব
খাদ্যবস্তু (শরীয়াতে মুহাম্মাদীতে যেগুলো হালাল) বনী ইসলাঈলদের জন্যও হালাল ছিল।৭৬ তবে এমন কিছু বস্তু ছিল
যেগুলোকে তাওরাত নাযিল হবার পূর্বে বনী ইসরাঈল৭৭ নিজেই নিজের জন্য হারাম করে
নিয়েছিল। তাদেরকে বলে দাও, যদি তোমরা (নিজেদের আপত্তির
ব্যাপারে) সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে তাওরাত নিয়ে এসো এবং তার কোন বাক্য
পেশ করো।
৭৬. ইহুদী আলেমরা কুরআন ও
মুহাম্মাদ সা. এর শিক্ষার বিরুদ্ধে যখন কোন নীতিগত আপত্তি জানাতে পারলো না (কারণ
যেসব বিষয়ের ওপর দীনের ভিত্তি স্থাপিত ছিল, তার ব্যাপারে পূর্ববর্তী
নবীদের শিক্ষা ও মুহাম্মাদ সা. এর শিক্ষার মধ্যে সামান্য চুল পরিমাণ পার্থক্যও ছিল
না) তখন তারা ফিকাহ্ ভিত্তিক আপত্তি উত্থাপন করতে লাগলো। এ প্রসংগে
তারা এই বলে আপত্তি জানালো-আপনি পানাহার সামগ্রীর মধ্যে এমন কিছুকে হালাল গণ্য
করেছেন, যা পূর্ববর্তী নবীদের সময় থেকে হারাম
হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এখানে এই আপত্তিটির জবাব
দেয়া হয়েছে।
৭৭. ইসরাঈল বলতে যদি এখানে বনী
ইসরাঈল বুঝানো হয়ে থাকে, তাহলে এর অর্থ হবে, তাওরাত
নাযিল হবার পূর্বে বনী ইসরাঈলরা কিছু জিনিস নিছক প্রথাগতভাবে নিজেদের জন্য হারাম
করে নিয়েছিল। আর একথায় যদি হযরত ইয়া’কুব আ. কে বুঝানো
হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ হবে, নিজের প্রকৃতিগত অপছন্দ অথবা কোন
রোগের কারণে তিনি কোন কোন জিনিস পরিহার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর সন্তানরা
সেগুলো নিষিদ্ধ মনে করে নিয়েছিল। এ শেষোক্ত বক্তব্যটি বেশী
প্রচলিত পরবর্তী আয়াত থেকে পরিস্কার বুঝা যায়, বাইবেলে উট ও খরগোশ হারাম
হবার যে বিধান লিখিত হয়েছে তা মূল তাওরাতের বিধান নয়। বরং ইহুদী আলেমরাই
পরবর্তীকালে এ বিধান কিতাবের অন্তরভুক্ত করেছিল। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য
দেখুন সূরা আল আনআ’ম-এর ১২২ টীকা)।
﴿فَمَنِ
افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾
৯৪। এরপরও
যারা নিজেদের মিথ্যা মনগড়া কথা আল্লাহর প্রতি আরোপ করতে থাকবে তারাই আসলে জালেম।
﴿قُلْ صَدَقَ اللَّهُ ۗ فَاتَّبِعُوا
مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
৯৫। বলে দাও, আল্লাহ যা কিছু বলেছেন, সত্য বলেছেন। কাজেই
তোমাদের একাগ্রচিত্তে ও একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের পদ্ধতির অনুসরণ করা উচিত। আর
ইব্রাহীম শিরককারীদের অন্তরভুক্ত ছিল না।৭৮
৭৮. এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা ফিকাহর
এ সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ের বিতর্ক আলোচনায় জড়িয়ে পড়েছো, অথচ
এক আল্লাহর বন্দেগী করাই হচ্ছে দীনের ভিত্তি। আর এ ভিত্তিকে বাদ দিয়ে
তোমরা শিরকের পুতিগন্ধময় আবর্জনা গায়ে মেখে চলছো। আবার এখন ফিকার বিষয় নিয়ে
বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছো। অথচ এগুলো আইনের অহেতুক চুলচেরা
বিশ্লেষণের মাধ্যমে তোমাদের উল্লামা সম্প্রদায়ের নিজেদের তৈরী। অধপতনের
বিগত শতাব্দীগুলোতে আসল ইবরাহিমী মিল্লাত থেকে সরে গিয়ে তারা এগুলো তৈরী করেছিল।
﴿إِنَّ
أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ﴾
৯৬। নিসন্দেহে
মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদাত গৃহটি নির্মিত হয় সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে
কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত
করা হয়েছিল।৭৯
৭৯. ইহুদীদের দ্বিতীয় আপত্তি ছিল
এই-তোমরা বাইতুল মাকদিসকে বাদ দিয়ে কাবাকে কিবলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছো কেন? অথচ এ বাইতুল
মাকদিসই ছিল পূর্ববর্তী নবীদের কিবলাহ। সূরা আল বাকারায় এ আপত্তির
জবাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইহুদীরা এরপর ও নিজেদের আপত্তির ওপর জোর দিয়ে
আসছিল। তাই এখানে আবার এর জবাব দেয়া হয়েছে। বাইতুল
মাকিদস সম্পর্কে বাইবেল নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, হযরত মূসা আ.
এর সাড়ে চারশো বছর পর হযরত সুলাইমান আ. এটি নির্মান করেছিলেন।
(১-রাজাবলী, ৬:১) আর হযরত সুলাইমানের আ. আমলেই এটি
তাওহীদবাদীদের কিবলাহ গণ্য হয়। (১-রাজাবলী, ৮:২৯-৩০)
বিপরীত পক্ষে সমগ্র আরববাসীর একযোগে সুদীর্ঘকালীন ধারাবাহিক বর্ণনায় একথা প্রমাণিত
যে, কাবা নির্মাণ করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম আ.। তিনি হযরত
মূসার আ. আট নয়শো বছর আগে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। কাজেই কাবার অগ্রবর্তী
অবস্থান ও নির্মান সন্দেহাতীতভাবে সত্য।
﴿فِيهِ
آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَّقَامُ إِبْرَاهِيمَ ۖ وَمَن دَخَلَهُ كَانَ آمِنًا ۗ وَلِلَّهِ
عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ۚ وَمَن كَفَرَ
فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ﴾
৯৭। তার মধ্যে
রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ৮০ এবং ইবরাহীমের ইবাদাতের স্থান। আর তার
অবস্থা হচ্ছে এই যে, যে তার
মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে
নিরাপত্তা লাভ করেছে।৮১ মানুষের মধ্য থেকে যারা
সেখানে পৌঁছার সামর্থ রাখে, তারা যেন এই গৃহের হজ্জ সম্পন্ন করে, এটি তাদের ওপর আল্লাহর অধিকার। আর যে
ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী
নন।
৮০. অর্থাৎ এর মধ্যে কিছু
সুস্পষ্ট আলামত পাওয়া যায়, যা থেকে একথা প্রমাণ হয় যে, এ ঘরটি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছে এবং আল্লাহ একে নিজের ঘর হিসেবে পছন্দ
করে নিয়েছেন। ধূ ধূ মরুর বুকে এ ঘরটি তৈরী করা হয়। তারপর
মহান আল্লাহ এর আশপাশের অধিবাসীদের আহার্য সরবরাহের চমৎকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
জাহেলিয়াতের কারণে আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত সমগ্র আরব ভূখণ্ডে চরম অশান্তি ও নিরাপত্তা
হীনতা বিরাজ করছিল। কিন্তু এই বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ দেশটিতে একমাত্র কাবাঘর
ও তার আশাপাশের এলাকাটি এমন ছিল যেখানে শান্তি ও নিরাপত্ত পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত
ছিল। বরং এই কাবার বদৌলতেই সমগ্র দেশটি বছরে চার মাস
শান্তি ও নিরাপত্তা ও ভোগ করতো। তারপর এই মাত্র অর্ধ শতাব্দী
আগে সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল কাবা আক্রমণকারী আবরাহার সেনাবাহিনী কিভাবে আল্লাহর
রোষানলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সে সময়ের আরবের
শিশু-বৃদ্ধ-যুবক সবাই এ ঘটনা জানতো। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী
সাক্ষীরাও কুরআন নাযিলের সময় জীবিত ছিল।
৮১. এ ঘরটির মর্যাদা এমনভাবে
প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, মারাত্মক প্রাণঘাতী শত্রুকে এখানে ঘোরাফেরা
করতে দেখেও শত্রুর রক্তে হাত রঞ্জিত করার আকাংখা পোষণকারী ব্যক্তিরা পরস্পরের ওপর
হাত ওঠাবার সাহস করতো না।
﴿قُلْ يَا
أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ شَهِيدٌ عَلَىٰ مَا
تَعْمَلُونَ﴾
৯৮। বলো, হে আহলি কিতাব! তোমরা কেন
আল্লাহর কথা মানতে অস্বীকার করছো? তোমরা যেসব কাজ কারবার করছো, আল্লাহ তা সবই দেখছেন।
﴿قُلْ يَا
أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ مَنْ آمَنَ تَبْغُونَهَا عِوَجًا
وَأَنتُمْ شُهَدَاءُ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾
৯৯। বলো, হে আহলি কিতাব! তোমরা এ কেমন
কর্মনীতি অবলম্বন করেছো, যে ব্যক্তি আল্লাহর কথা মানে তাকে তোমরা আল্লাহর পথ থেকে
বিরত রাখো এবং সে যেন বাকা পথে চলে এই কামনা করে থাকো? অথচ তোমরা নিজেরাই তার (সত্য
পথাশ্রয়ী হবার) সাক্ষী। তোমরা যা কিছু করছো সে
সম্পর্কে আল্লাহ গাফিল নন।
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا إِن تُطِيعُوا فَرِيقًا مِّنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُم
بَعْدَ إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ﴾
১০০। হে
ঈমানদারগণ! যদি তোমরা এই আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে একটি দলের কথা মানো, তাহলে তারা তোমাদের ঈমান থেকে
কুফরীর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
﴿وَكَيْفَ
تَكْفُرُونَ وَأَنتُمْ تُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ آيَاتُ اللَّهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُ ۗ وَمَن
يَعْتَصِم بِاللَّهِ فَقَدْ هُدِيَ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ﴾
১০১। তোমাদের
জন্যে কুফরীর দিকে ফিরে যাবার এখন আর কোন সুযোগটি আছে, যখন তোমাদের শুনানো হচ্ছে
আল্লাহর আয়াত এবং তোমাদের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর রাসূল? যে ব্যক্তি আল্লাহকে
মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরবে, সে অবশ্যি সত্য সঠিক পথ লাভ করবে।
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ﴾
১০২। হে
ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো। মুসলিম
থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়।৮২
৮২. অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব
মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ ও বিশ্বস্ত থাকো।
﴿وَاعْتَصِمُوا
بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ
إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا
وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ
يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾
১০৩। তোমরা
সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু৮৩ মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং
দলাদলি করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন
সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরের শক্র। তিনি
তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও
মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো। তোমরা
একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে। আল্লাহ
সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে নিয়েছেন।৮৪ এভাবেই আল্লাহ তাঁর
নির্দশনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন। হয়তো এই
নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা সরল পথ দেখতে পাবে।৮৫
৮৩. আল্লাহর রজ্জু বলতে তাঁর
দীনকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর দীনকে রজ্জুর সাথে তুলনা করার
কারণ হচ্ছে এই যে, এটিই এমন একটি সম্পর্ক, যা একদিকে আল্লাহর সাথে ঈমানদারদের সম্পর্ক জুড়ে দেয় এবং অন্যদিকে সমস্ত
ঈমানদারদেরকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে এক জামায়াত বদ্ধ করে। এই
রজ্জুকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার মানে হচ্ছে, মুসলমানরা ‘দীন’ কেই আসল গুরুত্বের অধিকারী মনে করবে,তার
ব্যাপারেই আগ্রহ পোষণ করবে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য
প্রচেষ্টা চালাবে এবং তারই খেদমত করার জন্য পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করবে। যেখানেই
মুসলমানরা দীনের মৌলিক শিক্ষা ও দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে এবং
তাদের সমগ্র দৃষ্টি ও আগ্রহ ছোটখাট ও খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে সেখানেই
অনিবার্যভাবে তাদের মধ্যে সে এই প্রকারের দলাদলি ও মতবিরোধ দেখা দেবে, যা ইতিপূর্বে
বিভিন্ন নবীর উম্মাতদেরকে তাদের আসল জীবন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে দুনিয়া ও
আখেরাতের লাঞ্ছনার আবর্তে নিক্ষেপ করেছিল।
৮৪. ইসলামের আগমেনর পূর্বে
আরববাসীরা যেসব ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল, এখানে সেদিকেই ইংগিত করা
হয়েছে। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা, কথায় কথায়
ঝগড়া বিবাদ এবং রাতদিন মারামারি, কাটাকাটি,হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সমগ্র আবর জাতিই ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত
হয়েছিল। এই আগুনে পুড়ে ভস্মীভুত হওয়া থেকে ইসলামই তাদেরকে
রক্ষা করেছিল। এই আয়াত নাযিল হওয়ার তিন চার বছর আগেই মদীনার লোকেরা
ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইসলামের এ জীবন্ত অবদান তারা স্বচক্ষে
প্রত্যক্ষ করেছিল। তারা দেখছিলঃ আওস ও খাযরাজ দু’টি গোত্রে বছরের পর
বছর থেকে শত্রুতা চলে আসছিল। তারা ছিল পরস্পরের রক্ত
পিপাসু। ইসলামের বদৌলতে তারা পরস্পরের মিলে মিশে একাকার হয়ে
গিয়েছিল। এই গোত্র দু’টি মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের সাথে এমন
নজীর বিহীন ত্যাগ ও প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করছিল, যা সাধারণত একই পরিবারের
লোকদের নিজেদের মধ্যে করতে দেখা যায় না।
৮৫. অর্থাৎ যদি তোমাদের সত্যিকার
চোখ থেকে থাকে, তাহলে এই আলামতগুলো দেখে তোমরা নিজেরাই
আন্দাজ করতে পারবে, কিসে তোমাদের কল্যাণ-এই দীনকে মজবুতভাবে
আঁকড়ে ধরার মধ্যে, না একে পরিত্যাগ করে আবার তোমাদের সেই
পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার মধ্যে? তোমাদের আসল কল্যাণকামী
কে-আল্লাহ ও তাঁর রাসূল না সেই ইহুদী, মুশরিক ও মুনাফিক,
যারা তোমাদের আগের অবস্থার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে?
﴿وَلْتَكُن
مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ
عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾
১০৪। তোমাদের
মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যি থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান
জানাবে, ভালো কাজের
নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ
দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে।
﴿وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ
تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَأُولَٰئِكَ
لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
১০৫। তোমরা যেন
তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য
হিদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে।৮৬ যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে
তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে।
৮৬. এখানে পুর্ববর্তী নবীদের এমন
সব উম্মাতের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে, যারা সত্য দীনের সরল ও
সুস্পষ্ট শিক্ষা লাভ করেছিল। কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত
হবার পর দীনের মূল বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে দীনের সাথে সম্পর্কবিহীন গৌণ ও
অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়াবলীর ভিত্তিতে নিজেদেরকে একটি আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায়
হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে দিয়েছিল। তারপর অবান্তর ও আজেবাজে কথা
নিয়ে এমনভাবে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, আল্লাহ তাদের ওপর যে
দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার কথাই তারা ভুলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাস ও
নৈতিকতার যেসব মূলনীতির ওপর আসলে মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে,
তার প্রতি কোন আগ্রহই তাদের ছিল না।
﴿يَوْمَ
تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ
أَكَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ﴾
১০৬। যেদিন
কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদেরকে
বলা হবে, ঈমানের
নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরী নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই নিয়ামত
অস্বীকৃতির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো।
﴿وَأَمَّا
الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
১০৭। আর যাদের
চেহারা উজ্জ্বল হবে, তারা
আল্লাহর রহমতের আশ্রয় লাভ করবে এবং তারা চিরদিন এই অবস্থায় থাকবে।
﴿تِلْكَ آيَاتُ اللَّهِ نَتْلُوهَا
عَلَيْكَ بِالْحَقِّ ۗ وَمَا اللَّهُ يُرِيدُ ظُلْمًا لِّلْعَالَمِينَ﴾
১০৮। এগুলো
আল্লাহর বাণী, তোমাকে
যথাযথভাবে শুনিয়ে যাচ্ছি। কারণ দুনিয়াবাসীদের প্রতি
জুলুম করার কোন এরাদা আল্লাহর নেই।৮৭
৮৭. অর্থাৎ যেহেতু আল্লাহ
দুনিয়াবাসীদের প্রতি কোন জুলুম করতে চান না তাই তিনি তাদেরকে সোজা পথ দেখিয়ে
দিচ্ছেন। আবার শেষ পর্যন্ত কোন কোন বিষয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ
করা হবে সে কথাও পূর্বাহ্নেই জানিয়ে দিচ্ছেন। এরপরও যারা বাঁকা পথ ধরবে
এবং নিজেদের ভ্রান্ত কর্মপদ্ধতি পরিহার করবে না, তারা আসলে
নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করবে।
﴿وَلِلَّهِ
مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۚ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ﴾
১০৯। আল্লাহ
পৃথিবী ও আকাশের সমস্ত জিনিসের মালিক এবং সমস্ত বিষয় আল্লাহর দরবারে পেশ হয়।
﴿كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ
لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ
بِاللَّهِ ۗ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُم ۚ مِّنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ
وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
১১০। এখন
তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা
হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য।৮৮ তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। এই আহলি কিতাবরা৮৯ ঈমান আনলে তাদের জন্যই ভালো
হতো। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ঈমানদার
পাওয়া যায়, কিন্তু
তাদের অধিকাংশই নাফরমান।
৮৮. ইতিপূর্বে সূরা আল
বাকারাহ-এর ১৭ রুকূতে যে কথা বলা হয়েছিল এখানেও সেই একই বিষয়বস্তুর অবতারণা করা
হয়েছে। নবী সা. এর অনুসারীদের বলা হচ্ছে, নিজেদের
অযোগ্যতার কারণে বনী ইসরাঈলদেরকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের যে আসন থেকে
বিচ্যুত করা হয়েছে সেখানে এখন তোমাদেরকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ
নৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপের দিক দিয়ে এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী। সৎ ও
ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন সেগুলো তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে
গেছে। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে ন্যায় ও সৎবৃত্তির প্রতিষ্ঠা
এবং অন্যায় ও অসৎবৃত্তির মূলোৎপাটন করার মনোভাব ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এই
সংগে তোমরা এক ও লা-শরীক আল্লাহকেও বিশ্বাসগত দিক দিয়ে এবং কার্যতও নিজেদের ইলাইহ, রব ও সর্বময়
প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছো। কাজেই এ কাজের দায়িত্ব এখন
তোমাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা নিজেদের দায়িত্ব
অনুধাবন করো এবং তোমাদের পূর্ববর্তীরা যেসব ভুল করে গেছে তা থেকে নিজেদেরকে দূরে
রাখো। (সূরা আল বাকারাহ-এর ১২৩ ও ১৪৪ টীকা ও দেখুন)
৮৯. এখানে আহলি কিতাব বলতে বনী
ইসরাঈলকে বুঝানো হয়েছে।
﴿لَن يَضُرُّوكُمْ
إِلَّا أَذًى ۖ وَإِن يُقَاتِلُوكُمْ يُوَلُّوكُمُ الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يُنصَرُونَ﴾
১১১। এরা
তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। বড় জোড়
কিছু কষ্ট দিতে পারে। এরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করলে
পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে তারপর এমনি অসহায় হয়ে পড়বে যে কোথাও থেকে কোন সাহায্য পাবে না।
﴿ضُرِبَتْ
عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ أَيْنَ مَا ثُقِفُوا إِلَّا بِحَبْلٍ مِّنَ اللَّهِ وَحَبْلٍ
مِّنَ النَّاسِ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِّنَ اللَّهِ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الْمَسْكَنَةُ
ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوا يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ الْأَنبِيَاءَ
بِغَيْرِ حَقٍّ ۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ﴾
১১২। এদের
যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই এদের ওপর লাঞ্জনার মার পড়েছে। তবে কোথাও
আল্লাহর দায়িত্বে বা মানুষের দায়িত্বে কিছু আশ্রয় মিলে গেলে তা অবশ্যি ভিন্ন কথা,৯০ আল্লাহর গযব এদেরকে ঘিরে
ফেলেছে। এদের ওপর মুখাপেক্ষীতা ও পরাজয় চাপিয়ে
দেয়া হয়েছে। আর এসব কিছুর কারণ হচ্ছে এই যে, এরা আল্লাহর আয়াত অস্বীকার
করতে থেকেছে এবং নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। এসব হচ্ছে
এদের নাফরমানি ও বাড়াবাড়ির পরিণাম।
৯০. অর্থাৎ দুনিয়ার কোথাও যদি
তারা কিছুটা শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে থাকে। তাহলে তা তাদের নিজেদের
ক্ষমতা বলে অর্জিত হয়নি বরং অন্যের সহায়তা ও অনুগ্রহের ফল। কোথাও কোন মুসলিম সরকার
আল্লাহর নামে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করেছে এবং কোথাও কোন অমুসলিম সরকার নিজস্বভাবে
তাদেরকে সহায়তা দান করেছে। এভাবে কোন কোন সময় দুনিয়ার
কোথাও তারা শক্তিশালী হবার সুযোগও লাভ করেছে। কিন্তু তাও নিজের বাহু বলে
নয়, বরং নিছক অপরের অনুগ্রহে তথা পরের ধনে পোদ্দারী করার মতো।
﴿لَيْسُوا
سَوَاءً ۗ مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ يَتْلُونَ آيَاتِ اللَّهِ آنَاءَ
اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ﴾
১১৩। কিন্তু
সমস্ত আহলি কিতাব এক ধরনের নয়। এদের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে
সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তারা রাতে আল্লাহর আয়াত পাঠ
করে এবং তাঁর সামনে সিজদানত হয়।
﴿يُؤْمِنُونَ
بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ
وَيُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَأُولَٰئِكَ مِنَ الصَّالِحِينَ﴾
১১৪। আল্লাহ ও
আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে। সৎকাজের
নির্দেশ দেয়, অসৎকাজ
থেকে বিরত রাখে এবং কল্যাণ ও নেকীর কাজে তৎপর থাকে। এরা সৎলোক।
﴿وَمَا يَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ
فَلَن يُكْفَرُوهُ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ﴾
১১৫। এরা যে
সৎকাজই করবে তার অমর্যাদা করা হবে না। আল্লাহ
মুত্তাকীদেরকে খুব ভালোভাবেই জানেন।
﴿إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا
لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُم مِّنَ اللَّهِ شَيْئًا ۖ وَأُولَٰئِكَ
أَصْحَابُ النَّارِ ۚ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
১১৬। আর যারা
কুফরীনীতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর মোকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ কোন কাজে লাগবে না এবং
তাদের সন্তান–সন্ততিও। তারা তো আগুনের মধ্যে প্রবেশ
করবে এবং সেখানেই তারা থাকবে চিরকাল।
﴿مَثَلُ مَا يُنفِقُونَ فِي
هَٰذِهِ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَثَلِ رِيحٍ فِيهَا صِرٌّ أَصَابَتْ حَرْثَ قَوْمٍ
ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ فَأَهْلَكَتْهُ ۚ وَمَا ظَلَمَهُمُ اللَّهُ وَلَٰكِنْ أَنفُسَهُمْ
يَظْلِمُونَ﴾
১১৭। তারা
তাদের এই দুনিয়ার জীবনে যা কিছু ব্যয় করছে তার উপমা হচ্ছে এমন বাতাস যার মধ্যে আছে
তূষার কণা। যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে তাদের
শস্যক্ষেতের ওপর দিয়ে এই বাতাস প্রবাহিত হয় এবং তাকে ধ্বংস করে দেয়।৯১ আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম
করেননি। বরং প্রকৃতপক্ষে এরা নিজেরাই নিজেদের ওপর
জুলুম করেছে।
৯১. এই উপমাটিতে শস্যক্ষেত মানে
হচ্ছে জীবন ক্ষেত্র। আখেরাতে মানুষকে তার এই জীবনক্ষেতের ফসল
কাটতে হবে। বাতাস বলতে মানুষের বাহ্যিক কল্যাণাকাংখাকে বুঝানো
হয়েছে। যার ভিত্তিতে কাফেরেরা জনকল্যাণমূলক কাজ এবং দান
খয়রাত ইত্যাদিতে অর্থ ব্যয়্ করে থাকে। আর তূষারকণা হচ্ছে, সঠিক ঈমান ও
আল্লাহর বিধান অনুসৃতির অভাব, যার ফলে তাদের সমগ্র জীবন
মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। এ উপমাটির সাহায্যে আল্লাহ
একথা বলতে চাচ্ছেন যে, শস্যক্ষেতের পরিচর্যার ক্ষেত্রে বাতাস যেমন
উপকারী তেমনি আবার এই বাতাসের মধ্যে যদি তূষারকণা থাকে তাহলে তা শস্যক্ষেতকে সবুজ
শ্যামল করার পরিবর্তে ধ্বংস করে দেয়। ঠিক তেমনি দান-খয়রাত যদিও
মানুষের আখেরাতের ক্ষেতের পরিচর্যা করে কিন্তু তার মধ্যে কুফরীর বিষ মিশ্রিত থাকলে
তা লাভজনক হবার পরিবর্তে মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। একথা সুস্পষ্ট যে,মানুষের মালিক
হচ্ছেন আল্লাহ এবং মানুষ যে ধন-সম্পদ ব্যয় করছে তার মালিকও আল্লাহ। এখন যদি
আল্লাহর এই দাস তার মালিকের সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার না করে অথবা তাঁর বন্দেগীর
সাথে আর কারো অবৈধ বন্দেগী শরীক করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ ব্যয় করে ও তাঁর
রাজ্যের মধ্যে চলাফেরা ও বিভিন্ন কাজ কারবার করে তাঁর আইন ও বিধানের আনুগত্য না
করে, তাহলে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার এ সমস্ত কাজ অপরাধে পরিণত হয়।
প্রতিদান-পাওয়া তো দূরের কথা বরং এই সমস্ত অপরাধ তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের
করার ভিত্তি সরবরাহ করে। তার দান খয়রাতের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ কোন
চাকর যেন তার মনিবের অনুমতি ছাড়াই তার অর্থ ভাণ্ডারের দরজা খুলে নিজের ইচ্ছামত
যেখানে সংগত মনে করলো সেখানে ব্যয় করে ফেললো।
﴿يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِّن دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا
وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي
صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ ۚ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ ۖ إِن كُنتُمْ تَعْقِلُونَ﴾
১১৮। হে
ঈমানদারগণ! তোমাদের নিজেদের জামায়াতের লোকদের ছাড়া অন্য কাউকে তোমাদের গোপন কথার
সাক্ষী করো না। তারা তোমাদের দুঃসময়ের সুযোগ গ্রহণ করতে
কুণ্ঠিত হয় না।৯২ যা তোমাদের ক্ষতি করে তাই
তাদের কাছে প্রিয়। তাদের মনের হিংসা ও বিদ্বেষ তাদের মুখ
থেকে ঝরে পড়ে এবং যা কিছু তারা নিজেদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তা এর চাইতেও
মারাত্মক। আমি তোমাদের পরিষ্কার হিদায়াত দান করেছি। তবে যদি
তোমরা বুদ্ধিমান ও (তাহলে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার সতর্কতা অবলম্বন করবে)।
৯২. মদীনার আশেপাশে যেসব ইহুদী
বাস করতো আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের সাথে প্রাচীন কাল থেকে তাদের বন্ধুত্ব চলে
আসছিল। এ দুই গোত্রের লোকেরা ব্যক্তিগতভাবেও বিভিন্ন
ইহুদীরা সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতো এবং গোত্রীয়ভাবেও তারা ছিল পরস্পরের
প্রতিবেশী ও সহযোগী। আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা মুসলমান হয়ে
যাবার পরও ইহুদীদের সাথে তাদের সেই পুরাতন সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।
ব্যক্তিগতভাবেও তারা তাদের পুরাতন ইহুদী বন্ধুদের সাথে আগের মতই প্রীতি ও
আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করতো। কিন্তু নবী সা. ও তাঁর
মিশনের বিরুদ্ধে ইহুদীদের মধ্যে যে শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তার
ফলে তারা এই নতুন আন্দোলনে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক
রাখতে প্রস্তুত ছিল না। আনসারদের সাথে তারা বাহ্যত আগের সম্পর্ক
বজায় রেখেছিল। কিন্তু মনে মনে তারা হয়ে গিয়েছিল তাদের চরম শত্রু। ইহুদীরা
তাদের এই বাহ্যিক বন্ধুত্বকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে মুসলমানদের জামায়াতে অভ্যন্তরীণ
ফিতনা ও ফাসাদ সৃষ্টি করার এবং তাদের জামায়াতের গোপন বিষয়গুলোর খবর সংগ্রহ করে
শত্রুদের হাতে পৌছিয়ে দেবার জন্য সর্বক্ষন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মহান
আল্লাহ এখানে তাদের এই মুনাফেকী কর্মনীতি থেকে মুসলমানদের সাবধান থাকার নির্দেশ
দিয়েছেন।
﴿هَا أَنتُمْ
أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ
وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ
مِنَ الْغَيْظِ ۚ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ﴾
১১৯। তোমরা
তাদেরকে ভালোবাসো কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসে না অথচ তোমরা সমস্ত আসমানী
কিতাবকে মানো।৯৩ তারা তোমাদের সাথে মিলিত হলে
বলে, আমরাও (তোমাদের
রাসূল ও কিতাবকে) মেনে নিয়েছে। কিন্তু তোমাদের থেকে আলাদা
হয়ে যাবার পর তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ ও আক্রোশ এতবেশী বেড়ে যায় যে, তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে
থাকে। তাদেরকে বলে দাও, নিজেদের ক্রোধ ও আক্রোশে
তোমরা নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরো। আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন।
৯৩. অর্থাৎ এটা একটা অদ্ভুত
ব্যাপারই বলতে হবে, কোথায় তোমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে,তা নয় বরং তারা তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। তোমরা তো কুরআনের সাথে
তাওরাতকেও মানো, তাই তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ করার
কোন যুক্তিসংগত কারণ থাকেত পারে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের
অভিযোগ থাকতে পারতো।কারণ তারা কুরআনকে মানে না।
﴿إِن تَمْسَسْكُمْ
حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِن تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا ۖ وَإِن تَصْبِرُوا
وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا ۗ إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ
مُحِيطٌ﴾
১২০। তোমাদের
ভালো হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের ওপর কোন বিপদ এলে তারা খুশী হয়। তোমরা যদি
সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের
কোন কৌশল কার্যকর হতে পারে না। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ তা
চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে আছেন।
c রুকুঃ ১৩ d
﴿وَإِذْ غَدَوْتَ مِنْ أَهْلِكَ
تُبَوِّئُ الْمُؤْمِنِينَ مَقَاعِدَ لِلْقِتَالِ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
১২১। (হে নবী!৯৪ মুসলমানদের সামনে সে সময়ের
কথা বর্ণনা কারো) যখন তুমি অতি প্রত্যুষে নিজের ঘর থেকে বের হয়েছিল এবং (ওহোদের
ময়দানে) মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন স্থানে নিযুক্ত করেছিলে। আল্লাহ
সমস্ত কথা শুনেন এবং তিনি সবকিছু ভালো করে জানেন।
৯৪. এখান থেকে চতুর্থ ভাষণ শুরু
হচ্ছে। ওহোদ যুদ্ধের পর এটি নাযিল হয়। এখানে ওহোদ যুদ্ধের ওপর
মন্তব্য করা হয়েছে। আগের ভাষণটি শেষ করার সময় বলা হয়েছিল, “যদি তোমরা
সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের
বিরুদ্ধে তাদের কোন কৌশল কার্যকর হতে পারবেনা”। এখন যেহেতু ওহোদ যুদ্ধে
মুসলমানদের পরাজয়ের কারণেই দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে সবরের অভাব ছিল এবং কোন কোন
মুসলমানের এমন কিছু ভূলচুক হয়ে গিয়েছিল যা ছিল আল্লাহভীতি বিরোধী, তাই তাদের এই
দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্কবাণী সম্বলিত এ ভাষণটি উপরোক্ত ভাষনের শেষ বাক্যটির পরপরই
তার সাথে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ ভাষণটির বর্ণনাভংগী বড়ই বৈশিষ্টময়। ওহোদ
যুদ্ধের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তার প্রত্যেকটির ওপর
পৃথক পৃথকভাবে কয়েকটি মাপাজোখা শব্দ সমন্বিত ভারসাম্যপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে
শিক্ষনীয় মন্তব্য করা হয়েছে। এগুলো বুঝতে হলে সংশ্লিষ্ট
ঘটণাগুলোর পটভূমি জানা একান্ত অপরিহার্য।
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের শুরুতে মক্কার কুরাইশরা
প্রায় তিন হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণ করে। সংখ্যায় বেশী হবার পরও
অস্ত্রশস্ত্রও তাদের কাছে ছিল মুসলমানদের চাইতে অনেক বেশী। এর ওপর ছিল তাদের বদর
যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার তীব্র আকাংখা। নবী সা. ও অভিজ্ঞ সাহাবীগণ
মদীনায় অবরুদ্ধ হয়ে প্রতিরক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু
বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি এমন কতিপয় শাহাদাতের আকাংখায় অধীরভাবে
প্রতীক্ষারত তরুণ সাহাবী শহরের বাইরে বের হয়ে যুদ্ধ করার ওপর জোর দিতে থাকেন। অবশেষে
তাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে নবী সা. বাইরে বের হবার ফায়সালা করেন। এক হাজার
লোক তাঁর সাথে বের হন। কিন্তু ‘শওত‘ নামক স্থানে পৌছে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার তিনশো সংগী নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। যুদ্ধের
অব্যবহিত পূর্বে তার এহেন আচরণে মুসলিম সেনাদল বেশ বড় আকারের অস্থিরতা ও হতাশার
সঞ্চার হয়। এমন কি বনু সাল্মা ও বনু হারেসার লোকরা এত বেশী
হতাশ হয়ে পড়ে যে, তারাও ফিরে যাবার সংকল্প করে ফেলেছিল।
কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ী সাহাবীগণের প্রচেষ্টায় তাদের
মানসিক অস্থিরতা ও হতাশা দূর হয়ে যায়। এই অবশিষ্ট সাতশো সৈন্য নিয়ে
নবী সা. সামনের দিকে এগিয়ে যান এবং ওহোদ পর্বতের পাদদেশে (মদীনা থেকে প্রায় চার
মাইল দূরে) নিজের সেনাবাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যার ফলে পাহাড় থাকে তাদের
পেছন দিকে এবং সামনের দিকে থাকে কুরাইশ সেনাদল। একপাশে এমন একটি গিরিপথ ছিল, যেখান থেকে
আকস্মিক হামলা হবার আশংকা ছিল। সেখানে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে
জুবাইরের নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী মোতায়েন করেন। তাদেরকে
জোর তাকীদ দিয়ে জানিয়ে দেনঃ “কাউকে আমাদের ধারে কাছে ঘেষঁতে দেবে না। কোন
অবস্থায় এখান থেকে সরে যাবে না। যদি তোমরা দেখো, পাখিরা
আমাদের গোশত ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে, তাহলেও তোমরা নিজেদের জায়গা
থেকে সরে যাবে না”। অতপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রথম
দিকে মুসলমানদের পাল্লা ভারী থাকে। এমনকি মুশরিকদের
সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা দেখা দেয়। তারা বিচ্ছিন্ন–বিক্ষিপ্ত
হয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু এই প্রাথমিক সাফল্যকে পূর্ণ বিজয়ের
দ্বারপ্রান্তে পৌছিয়ে দেবার পরিবর্তে গনীমাতের মাল আহরণ করার লোভ মুসলমানদের
বশীভূত করে ফেলে।তারা শত্রু সেনাদের ধন-সম্পদ লুট করতে শুরু করে।
ওহুদ যুদ্ধক্ষেত্রের নকশা
ওদিকে যে তীরন্দাজদেরকে পেছনে দিকের হেফাজতে নিযুক্ত
করা হয়েছিল,তারা যখন দেখতে পেলো শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে
এবং গনীমাতের মাল লুট করা হচ্ছে তখন তারাও নিজেদের জায়গা ছেড়ে গনীমাতের মালের ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়ে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাদেরকে নবী
সা. এর কড়া নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বার বার বাঁধা দিতে থাকেন। কিন্তু
মাত্র কয়েকজন ছাড়া কাউকে থামানো যায় নি। কাফের সেনাদলের একটি বাহিনীর
কমাণ্ডার খালেদ ইবনে অলীদ যথা সময়ে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। তিনি
নিজের বাহিনী নিয়ে পাহাড়ের পেছন দিক থেকে এক পাক ঘুরে এসে গিরিপথে প্রবেশ করে
আক্রমণকরে বসেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাঁর মাত্র কয়েকজন সংগীকে
নিয়ে এই আক্রমণ সামাল দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। গিরিপথের ব্যুহ ভেদ করে
খালেদ তার সেনাদল দিয়ে অকস্মাৎ মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। খালেদের বাহিনীর এই আক্রমণ
পলায়নের কাফের বাহিনীর মনে নতুন আশার সঞ্চার করে। তারাও পেছন ফিরে মুসলমানদের
ওপর একযোগে আক্রমণ করে বসে। এভাবে মুহূর্তের মধ্যে
যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা বদলে যায়। হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত অবস্থার
মুখোমুখি হয়ে মুসলমানরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তাদের একটি বড় অংশ বিক্ষিপ্ত
হয়ে পলায়নমুখী হয়। তবুও কয়েক জন সাহসী সৈন্য তখনো যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীর
বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। এমন সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, নবী সা. শহীদ
হয়ে গেছেন। এ গুজবটি সাহাবায়ে কেরামের অবশিষ্ট বাহ্যিক
জ্ঞানটুকুও বিলুপ্ত করে দেয়। এতক্ষণ যারা ময়দানে লড়ে
যাচ্ছিলেন এবার তারাও হিম্মতহারা হয়ে বসে পড়েন। এ সময় নবী সা. এর চারপাশে
ছিলেন মাত্র দশ বারো জন উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ। তিনি নিজেও আহত ছিলেন। পরিপূর্ণ
পরাজয়ে আর কিছুই বাকি ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে সাহাবীগণ
জানতে পারলেন, নবী সা. জীবিত আছেন। কাজেই
তারা সবদিক থেকে একে একে তাঁর চারদিকে সমবেত হতে থাকে। তারা তাঁকে নিরাপদে পর্বতের
ওপরে নিয়ে যান। এ সময়ের এ বিষয়টি আজো দুর্ব্যেধ্য রয়ে গেছে এবং এ
প্রশ্নটির জবাব আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি যে,কাফেররা তখন অগ্রবর্তী হয়ে
ব্যাপকভাবে আক্রমণ না চালিয়ে কিসের তাড়নায় নিজেরাই মক্কায় ফিরে গিয়েছিল? মুসলমানরা এত বেশী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁদের
পক্ষে পূনর্বার এক জায়গায় একত্র হয়ে যথারীতি যুদ্ধ শুরু করা কঠিন ছিল কাফেররা
তাদের বিজয়কে পূর্ণতার প্রান্তসীমায় পৌছাতে উদ্যোগী হলে তাদের সাফল্য লাভ অসম্ভব
ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তারা নিজেরাই বা কেন ময়দানে ছেড়ে
চলে গিয়েছিল তা আজো অজানা রয়ে গেছে।
﴿إِذْ هَمَّت
طَّائِفَتَانِ مِنكُمْ أَن تَفْشَلَا وَاللَّهُ وَلِيُّهُمَا ۗ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ
الْمُؤْمِنُونَ﴾
১২২। স্মরণ করো, যখন তোমাদের দু’টি দল
কাপুরুষতার প্রদর্শনী করতে উদ্যেগী হয়েছিল,৯৫ অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যের
জন্য বর্তমান ছিলেন এবং মুমিনদের আল্লাহরই ওপর ভরসা করা উচিত।
৯৫. এখানে বনু সাল্মা ও বনু
হারেসার দিকে ইংগিত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার
সাথীদের ময়দান থেকে সরে পড়ার কারণে তারা সাহস হারিয়ে ফেলেছিল।
﴿وَلَقَدْ
نَصَرَكُمُ اللَّهُ بِبَدْرٍ وَأَنتُمْ أَذِلَّةٌ ۖ فَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ
تَشْكُرُونَ﴾
১২৩। এর আগে
তোমরা অনেক দুর্বল ছিলে। কাজেই আল্লাহর না–শোকরী করা
থেকে তোমাদের দূরে থাকা উচিত, আশা করা যায় এবার তোমরা শোকর গুজার হবে।
﴿إِذْ تَقُولُ لِلْمُؤْمِنِينَ
أَلَن يَكْفِيَكُمْ أَن يُمِدَّكُمْ رَبُّكُم بِثَلَاثَةِ آلَافٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ
مُنزَلِينَ﴾
১২৪। স্মরণ করো
যখন তুমি মুমিনদের বলছিলেঃ আল্লাহ তাঁর তিন হাজার ফেরেশতা নামিয়ে দিয়ে তোমাদের
সাহায্য করবেন, এটা কি
তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয়?৯৬
৯৬. মুসলমানরা যখন দেখলেন, একদিকে
শত্রুদের সংখ্যা তিন হাজার আর অন্যদিকে তাঁদের মাত্র এক হাজার থেকেও আবার তিনশো
চলে যাচ্ছে, তখন তাদের মনোবল ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। সে সময়
নবী সা. তাঁদেরকে একথা বলেছিলেন।
﴿بَلَىٰ
ۚ إِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا وَيَأْتُوكُم مِّن فَوْرِهِمْ هَٰذَا يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُم
بِخَمْسَةِ آلَافٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُسَوِّمِينَ﴾
১২৫। অবশ্যি, যদি তোমরা সবর করো এবং
আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে যে মুহূর্তে দুশমন তোমাদের ওপর চড়াও
হবে ঠিক তখনি তোমাদের রব (তিন হাজার নয়) পাচঁ হাজার চিহ্নযুক্ত ফেরেশতা দিয়ে
তোমাদের সাহায্য করবেন।
﴿وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا
بُشْرَىٰ لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُم بِهِ ۗ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِندِ
اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ﴾
১২৬। একথা
আল্লাহ তোমাদের এ জন্য জানিয়ে দিলেন যে, তোমরা এতে খুশী হবে এবং তোমাদের মন
আশ্বস্ত হবে। বিজয় ও সাহায্য সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ
থেকে আসে। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত ও মহাজ্ঞানী।
﴿لِيَقْطَعَ طَرَفًا مِّنَ
الَّذِينَ كَفَرُوا أَوْ يَكْبِتَهُمْ فَيَنقَلِبُوا خَائِبِينَ﴾
১২৭। (আর এ
সাহায্য তিনি তোমাদের এ জন্য দেবেন) যাতে কুফরীর পথ অবলম্বনকারীদের একটি বাহু কেটে
দেবার অথবা তাদের এমন লাঞ্জনাপূর্ণ পরাজয় দান করার ফলে তারা নিরাশ হয়ে পশ্চাদপসরণ
করবে।
﴿لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ
شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ﴾
১২৮। (হে নবী!)
চূড়ান্ত ফায়সালা করার ক্ষমতায় তোমার কোন অংশ নেই। এটা
আল্লাহর ক্ষমতা-ইখতিয়ারভুক্ত, তিনি চাইলে তাদের মাফ করে দেবেন। আবার
চাইলে তাদের শাস্তি দেবেন। কারণ তারা জালেম।
﴿وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ
وَمَا فِي الْأَرْضِ ۚ يَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ
غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
১২৯। পৃথিবী ও
আকাশে যা কিছু আছে সমস্তই আল্লাহর মালিকানাধীন। যাকে চান
মাফ করে দেন এবং যাকে চান শাস্তি দেন। তিনি
ক্ষমাশীল ও করুণাময়।৯৭
৯৭. আহত হবার পর নবী সা. এর মুখ
থেকে কাফেরদের জন্য বদ্দোয়া নিঃসৃত হয় এবং তিনি বলেনঃ “যে জাতি তার নবীকে আহত করে
সে কেমন করে কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করেত পারে?” এরি জবাবে এই আয়াত নাযিল
হয়।
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ
تُفْلِحُونَ﴾
১৩০। হে
ঈমানদারগণ! এ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া বন্ধ করো৯৮ এবং আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।
৯৮. ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের
পরাজয়ের একটা বড় কারণ এই ছিল যে, ঠিক বিজয়ের মুহূর্তেই ধন-সম্পদের লোভ
তাঁদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে বসে এবং নিজেদের কাজে পূর্ণরূপে শেষ করার
পরিবর্তে তারা গনীমাতের মাল লুট করতে শুরু করে দেন। তাই মহাজ্ঞানী আল্লাহ এই
অবস্থার সংশোধনের জন্য অর্থশিপ্সার উৎস মুখে বাঁধ বাঁধা অপরিহার্য গণ্য করেছেন এবং
সুদ খাওয়া পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই সুদের ব্যবসায়ে মানুষ
দিন-রাত কেবল নিজের লাভ ও লাভ বৃদ্ধির হিসেবেই ব্যস্ত থাকে এবং এই কারণে মানুষের
মধ্যে অর্থ লালসা ব্যাপক ও সীমাহীন হারে বেড়ে যেতে থাকে।
﴿وَاتَّقُوا
النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ﴾
১৩১। সেই আগুন
থেকে দূরে থাকো, যা
কাফেরদের জন্য তৈরী করা হয়েছে
﴿وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ
لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾
১৩২। এবং
আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মেনে নাও, আশা করা যায় তোমাদের ওপর রহম করা হবে।
﴿وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ
مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ﴾
১৩৩। দৌড়ে চলো
তোমাদের রবের ক্ষমার পথে এবং সেই পথে যা পৃথিবী ও আকাশের সমান প্রশস্ত জান্নাতের
দিকে চলে গেছে, যা এমন সব
আল্লাহভীরু লোকদের জন্য তৈরী করা হয়েছে,
﴿الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي
السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ
ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾
১৩৪। যারা
সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের
দোষ–ক্রটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ
অত্যন্ত ভালোবাসেন।৯৯
৯৯. যে সমাজে সুদের প্রচলন থাকে
সেখানে সুদখোরীর কারণে দুই ধরনের নৈতিক রোগ দেখা দেয়। সুদ গ্রহণকারীদের মধ্যে
লোভ-লালসা, কৃপণতা ও স্বার্থন্ধতা এবং সুদ
প্রদানকারীদের মধ্যে, ঘৃণা, ক্রোধ,
হিংসা ও বিদ্ধেস জন্ম নেয়। ওহোদের পরাজয়ে এ দুই ধরনের
রোগের কিছু না কিছু অংশ ছিল। মহান আল্লাহ মুসলমানদের
জানিয়ে দিয়েছেন যে, সুদখোরীর কারণে সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট
পক্ষদ্বয়ের মধ্যে যে নৈতিক গুণাবলীর সৃষ্টি হয় তার বিপরীত পক্ষে আল্লাহর পথে অর্থ
ব্যয়ের কোণে এসব ভিন্নধর্মী নৈতিক গুণাবলীর মাধ্যমে, প্রথম
ধরনের গুণাবলীর মাধ্যমে নয়। (আরো বেশী জানার জন্য সূরা
আল বাকারাহ-এর ৩২০ টীকা দেখুন)।
﴿وَالَّذِينَ
إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا
لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ مَا
فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾
১৩৫। আর যারা
কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোন গোনাহের কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে
বসলে আবার সংগে সংগে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য
মাফ চায়– কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কে গোনাহ মাফ করতে পারেন– এবং জেনে বুঝে নিজেদের
কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না,
﴿أُولَٰئِكَ جَزَاؤُهُم مَّغْفِرَةٌ
مِّن رَّبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا
ۚ وَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ﴾
১৩৬। এ ধরনের
লোকদের যে প্রতিদান তাদের রবের কাছে আছে তা হচ্ছে এই যে, তিনি তাদের মাফ করে দেবেন এবং
এমন বাগীচায় তাদের প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। সৎকাজ
যারা করে তাদের জন্য কেমন চমৎকার প্রতিদান!
﴿قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُمْ
سُنَنٌ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ﴾
১৩৭। তোমাদের
আগে অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করে দেখে
নাও যারা (আল্লাহর বিধান ও হিদায়াতকে) মিথ্যা বলেছে তাদের পরিণাম কি হয়েছে।
﴿هَٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ
وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ﴾
১৩৮। এটি মানব
জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সর্তকবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য
পথনির্দেশ ও উপদেশ।
﴿وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا
وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
১৩৯। মনমরা হয়ো
না, দুঃখ করো
না, তোমরাই
বিজয়ী হবে, যদি তোমরা
মুমিন হয়ে থাকো।
﴿إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ
فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ ۚ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ
النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاءَ ۗ
وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ﴾
১৪০। এখন যদি
তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের
গায়েও।১০০ এ–তো কালের উত্থান পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন
করে থাকি। এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা
হয়েছে যে, আল্লাহ
দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে? আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে
নিতে চান, যারা
যথার্থ (সত্য ও ন্যায়ের) সাক্ষী হবে১০১ —কেননা জালেমদেরকে আল্লাহ
পছন্দ করেন না
১০০. এখানে বদর যুদ্ধের প্রতি
ইংগিত করা হয়েছে। একথা বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, বদর যুদ্ধের
আঘাতে যখন কাফেররা হিম্মতহারা হয়নি তখন ওহোদ যুদ্ধের এই আঘাতে তোমরা সাহস হারিয়ে
ফেলছো কেন?
১০১. কুরআনের মূল বাক্যটি হচ্ছে, وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ
شُهَدَاءَ এর একটি অর্থ হচ্ছে, তোমাদের থেকে কিছু সংখ্যা
শহীদ নিতে চাইছিলেন। অর্থাৎ কিছু লোককে শাহাদাতের
মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে চাইছিলেন। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, বর্তমানে
তোমাদের মধ্যে ঈমানদার ও মুনাফিক যে মিশ্রিত দলটি গড়ে উঠেছে তার মধ্য থেকে এমন সব
লোকদের ছেঁটে আলাদা করে নিতে চাইছিলেন যারা আসলে شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ
(সমগ্র মানব জাতির ওপর সাক্ষী) অর্থাৎ এই মহান পদের যোগ্য হিসেবে বিবেচিত। কারণ এই
মহান ও মর্যাদাপূর্ণ পদেই মুসলিম উম্মাহকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে।
﴿وَلِيُمَحِّصَ
اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ﴾
১৪১।– এবং তিনি
এই পরীক্ষার মাধ্যমে সাচ্চা মুমিনদের বাছাই করে নিয়ে কাফেরদের চিহ্নিত করতে
চাইছিলেন।
﴿أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا
الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ﴾
১৪২। তোমরা কি
মনে করে রেখেছ তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে
প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং কে তাঁর জন্য সবরকারী।
﴿وَلَقَدْ كُنتُمْ تَمَنَّوْنَ
الْمَوْتَ مِن قَبْلِ أَن تَلْقَوْهُ فَقَدْ رَأَيْتُمُوهُ وَأَنتُمْ تَنظُرُونَ﴾
১৪৩। তোমরা তো
মৃত্যুর আকাংখা করছিলে! কিন্তু এটা ছিল তখনকার কথা যখন মৃত্যু সামনে আসেনি। তবে এখন
তা তোমাদের সামনে এসে গেছে এবং তোমরা স্বচক্ষে তা দেখছো।১০২
১০২. লোকদের শাহাদাত লাভের যে
আকাংখার অত্যধিক চাপে নবী সা. মদীনার বাইরে এসে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন
এখানে সেই আকাংখার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।
﴿وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ
قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ ۚ أَفَإِن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انقَلَبْتُمْ عَلَىٰ
أَعْقَابِكُمْ ۚ وَمَن يَنقَلِبْ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ فَلَن يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا
ۗ وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ﴾
১৪৪। মুহাম্মাদ
একজন রাসূল বৈ তো আর কিছুই নয়। তার আগে আরো অনেক রাসূলও চলে
গেছে। যদি সে মারা যায় বা নিহত হয়, তাহলে কি পেছনের দিকে ফিরে
যাবে?১০৩ মনে রেখো, যে পেছনের দিকে ফিরে যাবে সে
আল্লাহর কোন ক্ষতি করবে না, তবে যারা আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকবে
তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।
১০৩. নবী সা. এর শাহাদাতের খবর
ছড়িয়ে পড়ার পর অধিকাংশ সাহাবী সাহস হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায় মুনাফিকরা (যারা
মুসলমানদের সাথে সাথেই ছিল) বলতে থাকেঃ চলো আমরা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে যাই। সে আমাদের
জন্য আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তা এনে দেবে। আবার কেউকেউ এমন কথাও বলে
ফেলেঃ যদি মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূলই হতেন,তাহলে নিহত হলেন কেমন করে?
চলো, আমাদের বাপ-দাদাদের ধর্মের দিকে ফিরে যাই। এ সমস্ত
কথার জবাবে বলা হচ্ছে, তোমাদের ‘সত্যপ্রীতি’ যদি কেবল মুহাম্মাদের
সা. ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে এবং তোমাদের ইসলাম যদি এতই দুর্বল
ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে যে, মুহাম্মাদের সা. দুনিয়া
থেকে বিদায় নেবার সাথে সাথে তোমরা আবার সেই কুফরীর দিকে ফিরে যাবে, যা থেকে তোমরা বের হয়ে এসেছিলে, তাহলে আল্লাহর দীন
তোমাদের কোন প্রয়োজন অনুভব করে না।
﴿وَمَا
كَانَ لِنَفْسٍ أَن تَمُوتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُّؤَجَّلًا ۗ وَمَن
يُرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَن يُرِدْ ثَوَابَ الْآخِرَةِ نُؤْتِهِ
مِنْهَا ۚ وَسَنَجْزِي الشَّاكِرِينَ﴾
১৪৫। কোন
প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরতে পারে না। মৃত্যুর
সময় তো লেখা আছে।১০৪ যে ব্যক্তি দুনিয়াবী পুরস্কার
লাভের আশায় কাজ করবে আমি তাকে দুনিয়া থেকেই দেবো। আর যে
ব্যক্তি পরকালীন পুরস্কার১০৫ লাভের আশায় কাজ করবে সে
পরকালের পুরস্কার পাবে এবং শোকরকারীদেরকে১০৬ আমি অবশ্যি প্রতিদান দেবো।
১০৪. এ থেকে মুসলমানদের একথা
বুঝানো হয়েছে যে, মৃত্যুর ভয়ে তোমাদের পালিয়ে যাওয়ার কোন
অর্থ নেই। মৃত্যুর জন্য আল্লাহ যে সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন
তার আগে কেউ মরতে পারে না এবং তার পরেও কেউ জীবিত থাকেত পারে না। কাজেই
তোমরা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার চিন্তা না করে বরং জীবিত থাকার জন্য যে সময়টুকু
পাচ্ছো সেই সময়ে তোমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যে দুনিয়া না আখেরাত কোনটি হবে, এ ব্যাপারে
চিন্তা করো।
১০৫. পুরস্কার মানে কাজের ফল। দুনিয়ার
পুরস্কার মানে, মানুষ তার প্রচেষ্টা ও কাজের ফল স্বরূপ এ
দুনিয়ার জীবনে যে লাভ, ফায়দা ও মুনাফা হাসিল করে। আর
আখেরাতের পুরস্কার মানে হচ্ছে, ঐ প্রচেষ্টা ও কাজের বিনিময়ে মানুষ
তার আখেরাতের চিরন্তন জীবনের জন্য যে ফায়দা, লাভ ও মুনাফা
অর্জন করবে। জীবন যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ যে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম
চালিয়ে যাচ্ছে সে ক্ষেত্রে তার দৃষ্টি ইহকালীন না পরকালীন ফল প্রাপ্তির দিকে
নিবদ্ধ থাকবে, ইসলামের দৃষ্টিতে মানবিক নৈতিকতার ক্ষেত্রে
এটিই হচ্ছে চূড়ান্ত এ সিদ্ধান্তকারী প্রশ্ন।
১০৬. শোকরকারী বলতে এমন সব লোকের
কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের কদর করে। আল্লাহর এই বিশেষ নিয়ামতটি
হচ্ছেঃ তিনি মানুষকে দীনের সঠিক ও নির্ভুল শিক্ষা দিয়েছেন। এ শিক্ষার মাধ্যমে তিনি
মানুষকে এ দুনিয়া ও এর সীমিত জীবনকাল থেকে অনেক বেশী ব্যাপক একটি অনন্ত ও সীমাহীন
জগতের সন্ধান দিয়েছেন এবং তাকে এ অমোঘ সত্যটিও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানষের
প্রচেষ্টা, সংগ্রাম-সাধনা ও কাজের ফল কেবলমাত্র এ দুনিয়ার
কয়েক বছরের জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এ জীবনের পর আর একটি অনন্ত অসীম জগতে এর
বিস্তার ঘটবে। এ দৃষ্টির বাপকতা, দূরদর্শন
ক্ষমতা ও পরিণামদর্শিতা অর্জিত হবার পর যে ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমকে এ
দুনিয়ার জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ফলপ্রসু হতে দেখে না অথবা তার বিপরীত ফল লাভ করতে
দেখে এবং এ সত্ত্বে এ আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ করতে থাকে, কেননা
আল্লাহ তাকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, আখেরাতে সে
অবিশ্য এর ভালো ফল পাবে-এহেন ব্যক্তিই হচ্ছে আল্লাহর শোকর গুজার বান্দা। এর
বিপরীতে যারা এরপরও সংকীর্ণ বৈষয়িক স্বার্থ পূজায় নিমগ্ন থাকে এবং দুনিয়ায় সঠিক
প্রেচষ্টাগুলোর ফলবতী হবার আশা থাকে না অথবা সেগুলো ক্ষতি হবার আশংকা থাকে, সেখানে
আখেরাতে সেগুলোর ভালো ফলের আশায় তাদের জন্য নিজেদের সময়, অর্থ-সম্পদ
ও শক্তি-সামর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত হয় না, তারাই সত্যিকার
অর্থে না-শোকরগুজার ও অকৃতজ্ঞ বান্দা। আল্লাহ তাদেরকে যে জ্ঞান দান
করেছেন তাদের কাছে সেই জ্ঞানের কোন মূল্য নেই।
﴿وَكَأَيِّن
مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ
فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ﴾
১৪৬। এর আগে
এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহ ওয়ালা লড়াই করেছে। আল্লাহর
পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং
তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি।১০৭ এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ
ভালবাসেন।
১০৭. অর্থাৎ নিজেদের সৈন্য সংখ্যা
ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামের স্বল্পতা ও অভাব এবং অন্যদিকে কাফেরদের বিপুল সংখ্যক
সৈন্য ও সাজ-সরঞ্জামের প্রাচুর্য দেখেও তারা বাতিলের কাছে অস্ত্র সম্বরণ করেনি।
﴿وَمَا
كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَن قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا
فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ﴾
১৪৭। তাদের
দোয়া কেবল এতটুকুই ছিলঃ হে আমাদের রব! আমাদের ভুল–ক্রুটিগুলো ক্ষমা করে দাও। আমাদের
কাজের ব্যাপারে যেখানে তোমরা সীমালংঘিত হয়েছে, তা তুমি মাফ করে দাও। আমাদের পা
মজবুত করে দাও এবং কাফেরদের মোকাবিলায় আমাদের সাহায্য করো।
﴿فَآتَاهُمُ اللَّهُ ثَوَابَ
الدُّنْيَا وَحُسْنَ ثَوَابِ الْآخِرَةِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾
১৪৮। শেষ
পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার পুরস্কারও দিয়েছেন এবং তার চেয়ে ভালো আখেরাতের
পুরস্কারও দান করেছেন। এ ধরনের সৎকর্মশীলদেরকে
আল্লাহ পছন্দ করেন।
c রুকুঃ ১৬ d
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
إِن تُطِيعُوا الَّذِينَ كَفَرُوا يَرُدُّوكُمْ عَلَىٰ أَعْقَابِكُمْ فَتَنقَلِبُوا
خَاسِرِينَ﴾
১৪৯। হে
ঈমানদারগণ! যদি তোমরা তাদের ইশারায় চলো, যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তাহলে তারা তোমাদের উল্টোদিকে
ফিরিয়ে নিয়ে যাবে১০৮ এবং তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
১০৮. অর্থাৎ যে কুফরীর অবস্থা
থেকে তোমরা বের হয়ে এসেছো, তারা আবার তোমাদের সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে
যেতে চায়। ওহোদের পরাজয়ের পর মুনাফিক ও ইহুদীরা মুসলমানদের
মধ্যে একথা প্রচার করার চেষ্টা করছিল যে, মুহাম্মাদ সা. যদি সত্যি
সত্যিই আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন, তাহলে যুদ্ধে পরাজিত হলেন কেন?
তিনি তো একজন সাধারণ লোক। তাঁর অবস্থাও সাধারণ লোকদের
থেকে আলাদা নয়। আজকে জিতে গেলেন আবার কালকে হেরে গেলেন। এই তাঁর
অবস্থা। তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর যে সাহায্য ও সহযোগিতার
নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছেন, তা নিছক একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
(নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক)
﴿بَلِ اللَّهُ
مَوْلَاكُمْ ۖ وَهُوَ خَيْرُ النَّاصِرِينَ﴾
১৫০। (তাদের
কথা ভুল) প্রকৃত সত্য এই যে, আল্লাহ তোমাদের সাহায্যকারী
এবং তিনি সবচেয়ে ভালো সাহায্যকারী।
﴿سَنُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ
كَفَرُوا الرُّعْبَ بِمَا أَشْرَكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا
ۖ وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ ۚ وَبِئْسَ مَثْوَى الظَّالِمِينَ﴾
১৫১। শীঘ্রই
সেই সময় এসে যাবে যখন আমি সত্য অস্বীকারকারীদের মনের মধ্যে বিভীষিকা সৃষ্টি করে
দেবো। কারণ তারা আল্লাহর সাথে তাঁর খেদায়ী
কর্তৃত্বে অংশীদার করে, যার স্বপক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণপত্র অবর্তীণ করেননি। তাদের শেষ
আবাস জাহান্নাম এবং ঐ জালেমদের ভাগ্যে জুটবে অত্যন্ত খারাপ আবাসস্থল।
﴿وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللَّهُ
وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّونَهُم بِإِذْنِهِ ۖ حَتَّىٰ إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ
فِي الْأَمْرِ وَعَصَيْتُم مِّن بَعْدِ مَا أَرَاكُم مَّا تُحِبُّونَ ۚ مِنكُم مَّن
يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنكُم مَّن يُرِيدُ الْآخِرَةَ ۚ ثُمَّ صَرَفَكُمْ عَنْهُمْ
لِيَبْتَلِيَكُمْ ۖ وَلَقَدْ عَفَا عَنكُمْ ۗ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ﴾
১৫২। আল্লাহ
তোমাদের কাছে (সাহায্য ও সমর্থনদানের) যে ওয়াদা করেছিলেন, তা পূর্ণ করেছেন। শুরুতে
তাঁর হুকুমে তোমরাই তাদেরকে হত্যা করেছিলে। কিন্তু
যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে এবং নিজেদের কাজে পারস্পারিক মতবিরোধে লিপ্ত হলে আর
যখনই আল্লাহ তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন যার ভালোবাসায় তোমরা বাঁধা ছিলে (অর্থাৎ
গনীমাতের মাল), তোমরা
নিজেদের নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে, কারণ তোমাদের কিছু লোক ছিল দুনিয়ার
প্রত্যাশী আর কিছু লোকের কাম্য ছিল আখেরাত, তখনই আল্লাহ কাফরদের
মোকাবিলায় তোমাদেরকে পিছিয়ে দিলেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। তবে যথার্থই
আল্লাহ এরপরও তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন।১০৯ কারণ মুমিনদের প্রতি আল্লাহ
বড়ই অনুগ্রহের দৃষ্টি রাখেন।
১০৯. অর্থাৎ তোমরা যে মারাত্মক
ভূল করেছিলে আল্লাহ যদি তা মাফ করে না দিতেন, তাহলে এখন আর তোমাদের
অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেতো না। মহান আল্লাহ অনুগ্রহ ও
মেহেরবানীর ফলে এবং তাঁর সাহায্য ও সহায়তার বদৌলতেই তোমাদের শত্রুরা তোমাদের ওপর
নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করার পরও নিজেদের চেতনা ও সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিল এবং বিনা
কারণে নিজেরাই পিছে হটে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল।
﴿إِذْ تُصْعِدُونَ
وَلَا تَلْوُونَ عَلَىٰ أَحَدٍ وَالرَّسُولُ يَدْعُوكُمْ فِي أُخْرَاكُمْ فَأَثَابَكُمْ
غَمًّا بِغَمٍّ لِّكَيْلَا تَحْزَنُوا عَلَىٰ مَا فَاتَكُمْ وَلَا مَا أَصَابَكُمْ
ۗ وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ﴾
১৫৩। স্মরণ করো, যখন তোমরা পালাবার কাজে এমনই
ব্যস্ত ছিলে যে, কারোর দিকে
ফিরে তাকাবার হুঁশও কারো ছিল না এবং রাসূল তোমাদের পেছনে তোমাদের ডাকছিল।১১০ সে সময় তোমাদের এহেন আচরণের
প্রতিফল স্বরুপ আল্লাহ তোমাদের দিলেন দুঃখের পর দুঃখ।১১১ এভাবে তোমরা ভবিষ্যতে এই
শিক্ষা পাবে যে, যা কিছু
তোমাদের হাত থেকে বের হয়ে যায় অথবা যে বিপদই তোমাদের ওপর নাযিল হয়, সে ব্যাপারে দুঃখিত হবে না। আল্লাহ
তোমাদের সমস্ত কার্যকলাপ সম্পর্কে জানেন।
১১০. যখন মুসলমানদের ওপর হঠাৎ একই
সময় দু’দিক থেকে আক্রমণ হলো এবং তাদের সারিগুলো ভেঙে চারদিকে বিশৃংখলা অবস্থায়
ছড়িয়ে পড়লো তখন কিছু লোক মদীনার দিকে পালাতে লাগলেন এবং কিছু ওহোদ পাহাড়ের ওপর উঠে
গেলেন। কিন্তু নবী সা. তাঁর জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও সরে গেলেন
না। চারদিক থেকে শত্রুদের আক্রমণ হচ্ছিল। তার
চারদিকে ছিলমাত্র দশ বারোজন লোকের একটি ছোট্ট দল। এহেন সংগীণ অবস্থায়ও আল্লাহর
নবী পাহাড়ের মতো নিজে অটলভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি পালায়নপর লোকদের ডেকে
ডেকে বলছিলেনঃ إِلَىَّ عِبَادَ ٱللَّهِ إِلَىَّ عِبَادَ ٱللَّهِ “আল্লার বান্দারা, আমার দিকে
এসো! আল্লাহর বান্দারা, আমার দিকে এসো”।
১১১. দুঃখ পরাজয়ের, দুঃখ নবী সা.
এর মৃত্যু সংবাদের। দুঃখ নিজেদের বিপুল সংখ্যক
নিহত ও আহতদের। দুঃখ এই চিন্তায় যে, এখন নিজেদের
বাড়ি-ঘরেরও নিরাপত্তা নেই এবং এখনই মদীনার সমগ্র জনসংখ্যার চাইতেও বেশী তিন হাজার
শত্রু সৈন্য পরাজিত সেনাদলকে মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে শহরের গলি কুচায় ঢুকে পড়েব এবং নগরীর
সবকিছু ধ্বংস ও বরবাদ করে দেব।
﴿ثُمَّ
أَنزَلَ عَلَيْكُم مِّن بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً نُّعَاسًا يَغْشَىٰ طَائِفَةً مِّنكُمْ
ۖ وَطَائِفَةٌ قَدْ أَهَمَّتْهُمْ أَنفُسُهُمْ يَظُنُّونَ بِاللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ
ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ ۖ يَقُولُونَ هَل لَّنَا مِنَ الْأَمْرِ مِن شَيْءٍ ۗ قُلْ إِنَّ
الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ ۗ يُخْفُونَ فِي أَنفُسِهِم مَّا لَا يُبْدُونَ لَكَ ۖ يَقُولُونَ
لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَّا قُتِلْنَا هَاهُنَا ۗ قُل لَّوْ كُنتُمْ
فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَىٰ مَضَاجِعِهِمْ
ۖ وَلِيَبْتَلِيَ اللَّهُ مَا فِي صُدُورِكُمْ وَلِيُمَحِّصَ مَا فِي قُلُوبِكُمْ ۗ
وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ﴾
১৫৪। এ দুঃখের
পর আল্লাহ তোমাদের কিছু লোককে আবার এমন প্রশান্তি দান করলেন যে, তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।১১২ কিন্তু আর একটি দল, নিজের স্বার্থই ছিল যার কাছে
বেশী গুরুত্বপূর্ণ, আল্লাহ
সম্পর্কে নানান ধরনের জাহেলী ধারণা পোষণ করতে থাকলো, যা ছিল একেবারেই সত্য বিরোধী। তারা এখন
বলেছে, এই কাজ
পরিচালনার ব্যাপারে আমাদেরও কি কোন অংশ আছে? তাদেরকে বলে দাও, “(কারো কোন অংশ নেই,) এ কাজেই সমস্ত ইখতিয়ার রয়েছে
এক মাত্র আল্লাহর হাতে”। আসলে এরা নিজেদের মনের মধ্যে
যে কথা লুকিয়ে রেখেছে তা তোমাদের সামনে প্রকাশ করে না। এদের আসল
বক্তব্য হচ্ছে, যদি
(নেতৃত্ব) ক্ষমতায় আমাদের কোন অংশ থাকতো, তাহলে আমরা মারা পড়তাম না। ওদেরকে
বলে দাও, যদি তোমরা নিজেদের গৃহে অবস্থান করতে তাহলেও যাদের মৃত্যু
লেখা হয়ে গিয়েছিল, তারা
নিজেরাই নিজেদের বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে আসতো। আর এই যে
বিষয়টি সংঘটিত হলো, এটি এ জন্য
ছিল যে, তোমাদের
বুকের মধ্যে যা কিছু গোপন রয়েছে আল্লাহ তা পরীক্ষা করে নেবেন এবং তোমাদের মনের
মধ্যে যে গলদ রয়েছে তা দূর করে দেবেন। আল্লাহ
মনের অবস্থা খুব ভালো করেই জানেন।
১১২. ইসলামী সেনদালের কিছু কিছু
লোক এসময় এই একটি নতুন ও অদ্ভুত ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। হযরত আবু তালহা এই যুদ্ধে
অংশ গ্রহণকারীদের একজন ছিলেন। তিনি নিজে বর্ণনা করছেন, এ অবস্থায়
আমাদে ওপর তন্দ্রাভাব এমনভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল যে, আমাদের
হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ছিল।
﴿إِنَّ
الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ
الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا ۖ وَلَقَدْ عَفَا اللَّهُ عَنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ
غَفُورٌ حَلِيمٌ﴾
১৫৫। তোমাদের
মধ্য থেকে যারা মোকাবিলার দিন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল তাদের এ পদস্খলনের কারণ এই
ছিল যে, তাদের কোন
কোন দুর্বলতার কারণ শয়তান তাদের পা টলিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহ
তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও
সহনশীল।
c রুকুঃ ১৭ d
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ كَفَرُوا وَقَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ إِذَا ضَرَبُوا فِي
الْأَرْضِ أَوْ كَانُوا غُزًّى لَّوْ كَانُوا عِندَنَا مَا مَاتُوا وَمَا قُتِلُوا
لِيَجْعَلَ اللَّهُ ذَٰلِكَ حَسْرَةً فِي قُلُوبِهِمْ ۗ وَاللَّهُ يُحْيِي وَيُمِيتُ
ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾
১৫৬। হে
ঈমানদারগণ! কাফেরদের মতো কথা বলো না। তাদের
আত্মীয়স্বজনরা কখনো সফরে গেলে অথবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে (এবং সেখানে কোন
দুর্ঘটনায় পতিত হলে) তারা বলে, যদি তারা আমাদের কাছে থাকতো তাহলে মারা
যেতো না এবং নিহত হতো না। এ ধরনের কথাকে আল্লাহ তাদের
মানসিক খেদ ও আক্ষেপের কারণে পরিণত করেন।১১৩ নয়তো জীবন–মৃত্যু তো একমাত্র
আল্লাহই দান করে থাকেন এবং তোমাদের সমস্ত কার্যকলাপের ওপর তিনি দৃষ্টি রাখেন।
১১৩. অর্থাৎ একথাগুলো সত্য নয়। এর পেছনে
কোন ভিত্তি নেই। আল্লাহর ফায়সালাকে কেউ নড়াতে পারে না। এটিই সত্য। কিন্তু
যারা আল্লাহার প্রতি ঈমান রাখে না এবং সবকিছুকে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের ওপর
নির্ভরশীল বলে মনে করে,তাদের জন্য এ ধরনের আন্দাজ অনুমান কেবল
তাদের আক্ষেপ ও হতাশাই বাড়িয়ে দেয়। তারা কেবল এই বলে আফসোস করতে
থাকে, হায়! যদি এমনটি করতাম তাহলে এমনটি হতো।
﴿وَلَئِن
قُتِلْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ مُتُّمْ لَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَحْمَةٌ
خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ﴾
১৫৭। যদি তোমরা
আল্লাহর পথে নিহত হও বা মারা যাও তা হলে তোমরা আল্লাহর যে রহমত ও ক্ষমা লাভ করবে, তা এরা যা কিছু জমা করে তার
চাইতে ভালো।
﴿وَلَئِن مُّتُّمْ أَوْ قُتِلْتُمْ
لَإِلَى اللَّهِ تُحْشَرُونَ﴾
১৫৮। আর তোমরা
মারা যাও বা নিহত হও, সব অবস্থায় তোমাদের অবশ্যি আল্লাহর দিকেই যেতে হবে।
﴿فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ
لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ
فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ
فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ﴾
১৫৯। (হে নবী!)
এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল। নয়তো যদি
তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে
যেতো। তাদের ক্রটি ক্ষমা করে দাও। তাদের
জন্য মাগফিরাতে দোয়া করো এবং দীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে অন্তরভুক্ত
করো। তারপর যখন কোন মতের ভিত্তিতে তোমরা স্থির
সংকল্প হবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো। আল্লাহ
তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর ভরসা করে কাজ করে।
﴿إِن يَنصُرْكُمُ اللَّهُ
فَلَا غَالِبَ لَكُمْ ۖ وَإِن يَخْذُلْكُمْ فَمَن ذَا الَّذِي يَنصُرُكُم مِّن بَعْدِهِ
ۗ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ﴾
১৬০। আল্লাহ
যদি তোমাদের সাহায্য করেন তাহলে কোন শক্তি তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে
পারবে না। আর যদি তিনি তোমাদের পরিত্যাগ করেন, তাহলে এরপর কে আছেন তোমাদের
সাহায্য করার মতো? কাজেই সাচ্চা মুমিনদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত।
﴿وَمَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن
يَغُلَّ ۚ وَمَن يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ ثُمَّ تُوَفَّىٰ
كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ﴾
১৬১। খেয়ানত
করা কোন নবীর কাজ হতে পারে না।১১৪ যে ব্যক্তি খেয়ানত করবে
কিয়ামতের দিন সে নিজের খেয়ানত করা জিনিস সহকারে হাজির হয়ে যাবে। তারপর
প্রত্যেকেই তার উপার্জনের পুরোপুরি প্রতিদান পেয়ে যাবে এবং কারো প্রতি কোন জুলুম
করা হবে না।
১১৪. পেছনের অংশের প্রতিক্ষার
জন্য নবী সা. যে তীরন্দাজ বাহিনী মোতায়েন করেছিলেন তারা যখন দেখলো শত্রুসৈন্যদের
মালমাত্তা লুটে নেয়া হচ্ছে তখন তারা আশংকা করলো, হয়তো সমগ্র
ধন-সম্পদ তারাই পাবে যারা সেগুলো হস্তগত করছে এবং গনীমাত বন্টনের সময় আমরা বঞ্চিত
হবো। তাই তারা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে শত্রু সেনাদের
সম্পদ ছিনিয়ে নেবার কাজে লেগে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফিরে এসে
নবী সা. ঐ তীরন্দাজ বাহিনীর লোকেদের ডেকে তাদের এ নাফরমানীর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে
তারা এমন কিছু ওজর পেশ করলো যা ছিল আসলে অত্যন্ত দুর্বল। তাদের জবাবে নবী সা. বললেনঃ بل ظننتم انا نغل ولا
نقسم لكم “আসল কথা হচ্ছে, আমাদের ওপর
তোমাদের আস্তা ছিল না। তোমরা মনে করছিলে আমরা
তোমাদের সাথে খেয়ানত করবো এবং তোমাদের অংশ দেবো না”। এ আয়াতটিতে আসলে এ বিষয়টির
প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আল্লাহর বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নবী
নিজেই যখন ছিলেন তোমাদের সেনাপতি এবং সমস্ত বিষয়ই ছিল তাঁর হাতে তখন তোমাদের মনে এ
আশংকা কেমন করে দেখা দিল যে, নবীর হাতে তোমাদের স্বার্থ
সংরক্ষিত হবে না? আল্লাহর নবীর ব্যাপারে তোমরা কি এ আশংকা
করতে পারো যে, তাঁর তত্বাবধানের যে সম্পদ থাকবে তা
বিশ্বাস্ততা, আমানতদারী ও ইনসাফের সাথে বন্টন না করে অন্য
কোনভাবে বন্টন করা হবে?
﴿أَفَمَنِ
اتَّبَعَ رِضْوَانَ اللَّهِ كَمَن بَاءَ بِسَخَطٍ مِّنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ
ۚ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ﴾
১৬২। যে
ব্যক্তি সবসময় আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী চলে সে কেমন করে এমন ব্যক্তির মতো কাজ
করতে পারে, যাকে আল্লাহর গযব ঘিরে ফেলেছে এবং যার শেষ আবাস জাহান্নাম, যা সবচেয়ে খারাপ আবাস?
﴿هُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ اللَّهِ
ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ﴾
১৬৩। আল্লাহর
কাছে এ উভয় ধরনের লোকদে মধ্যে বহু পর্যায়ের পার্থক্য রয়েছে। আল্লাহ
সবার কার্যকলাপের ওপর নজর রাখেন।
﴿لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى
الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ
آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن
قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
১৬৪। আসলে
ঈমানদারদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন নবী পাঠিয়ে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ
করেছেন। সে তাঁর আয়াত তাদেরকে শোনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও
সুবিন্যস্ত করে এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেয়। অথচ এর
আগে এই লোকেরাই সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল।
﴿أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم
مُّصِيبَةٌ قَدْ أَصَبْتُم مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّىٰ هَٰذَا ۖ قُلْ هُوَ مِنْ
عِندِ أَنفُسِكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
১৬৫। তোমাদের
ওপর যখন বিপদ এসে পড়লো তোমরা বলতে লাগলে, এ আবার কোথায় থেকে এলো?১১৫ তোমাদের এ অবস্থা কেন? অথচ (বদরের যুদ্ধে) এর
দ্বিগুণ বিপদ তোমাদের মাধ্যমে তোমাদের বিরোধী পক্ষের ওপর পড়েছিল।১১৬ হে নবী! ওদের বলে দাও, তোমরা নিজেরাই এ বিপদ এনেছো।১১৭ আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের ওপর
শক্তিমান।১১৮
১১৫. নেতৃস্থানীয় সাহাবীগণ অবশ্যি
যথার্থ সত্য অবগত ছিলেন এবং তাঁদের কোন প্রকার বিভ্রান্তির শিকার হবার সম্ভাবনা
ছিল না। তবে সাধারণ মুসলমানরা মনে করছিলেন, আল্লাহর রসূর
যখন আমাদের সংগে আছেন এবং আল্লাহ আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা দান করছেন তখন কোন
অবস্থাতেই কাফেররা আমাদের ওপর বিজয় লাভ করতে পারে না। তাই ওহোদ পরাজিত হবার পর
তারা ভীষণভাবে আশাহত হয়েছেন। তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছেন, এ কি হলো?
আমরা আল্লাহর দীনের জন্য লড়তে গিয়েছিলাম। তাঁর
প্রতিশ্রুতি ও সাহায্য আমাদের সংগে ছিল। তাঁর রাসূল সশরীরে যুদ্ধের
ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। এরপরও আমরা হেরে গেলাম? এমন লোকদের
হাতে হেরে গেলাম, যারা আল্লাহর দীনকে দুনিয়ার বুক থেকে
নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য এসেছিল? মুসলমানদের এই বিস্ময়
পেরেশানী ও হতাশা দূর করার জন্য এ আয়াত নাযিল হয়।
১১৬. ওহোদের যুদ্ধে মুসলমানদের
সত্তর জন লোক শহীদ হয়। অন্যদিকে ইতপূর্বে বদরের যুদ্ধে
মুসলমানদের হাতে সত্তর জন্য কাফের নিহত এবং সত্তর জন বন্দী হয়েছিল।
১১৭. অর্থাৎ এটা তোমাদের নিজেদের
দুর্বলতা ও ভুলের ফসল। তোমরা সবর করোনি। তোমাদের কোন কোন কাজ হয়েছে
তাকওয়া বিরোধী। তোমরা নির্দেশ অমান্য করেছো। অর্থ-সম্পদের লোভো আত্মহারা
হয়েছো। পরস্পরের মধ্যে বিবাধ ও মতিবরোধ করেছো। এতোসব
করার পর আবার জিজ্ঞেস করছো, বিপদ এলো কোথা থেকে?
১১৮. অর্থাৎ আল্লাহ যদি তোমাদের
বিজয় দান করার শক্তি রাখেন তাহলে পরাজয় দানকরার শক্তিও রাখেন।
﴿وَمَا
أَصَابَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ﴾
১৬৬। যুদ্ধের
দিন তোমাদের যে ক্ষতি হয় তা ছিল আল্লাহর হুকুমে এবং তা এ জন্য ছিল যাতে আল্লাহ
দেখে নেন তোমাদের মধ্যে কে মুমিন
﴿وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ نَافَقُوا
ۚ وَقِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوِ ادْفَعُوا ۖ قَالُوا
لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَّاتَّبَعْنَاكُمْ ۗ هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ
مِنْهُمْ لِلْإِيمَانِ ۚ يَقُولُونَ بِأَفْوَاهِهِم مَّا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ ۗ
وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُونَ﴾
১৬৭। এবং কে
মুনাফিক। এ মুনাফিকদের যখন বলা হলো, এসো আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো
অথবা (কমপক্ষে) নিজের শহরের প্রতিক্ষা করো, তারা বলতে লাগলোঃ যদি আমরা
জানতাম আজ যুদ্ধ হবে, তাহলে আমরা অবশ্যি তোমাদের সাথে চলতাম।১১৯ যখন তারা একথা বলছির তখন তারা
ঈমানের তুলনায় কুফরীর অনেক বেশী কাছে অবস্থান করছিল। তারা
নিজেদের মুখে এমন সব কথা বলে, যা তাদের মনের মধ্যে নেই এবং যা কিছু তারা
মনের মধ্যে গোপন করে আল্লাহ তা খুব ভালো করেই জানেন।
১১৯. আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখন
তিনশো মুনাফিক নিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে যেতে লাগলো তখন কোন কোন মুসলমান গিয়ে তাকে
বুজাবার চেষ্টা করলো এবং মুসলিম সেনাদলে ফিরে আসার জন্য রাজী করতে চাইলো। কিন্তু সে
জবাব দিল, “আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আজ যুদ্ধ হবে না,
তাই আমরা চলে যাচ্ছি। নয়তো আজো যুদ্ধ হবার আশা
থাকলো আমরা অবশ্যি তোমাদের সাথে চলে যেতাম”।
﴿الَّذِينَ
قَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُوا لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا ۗ قُلْ فَادْرَءُوا
عَنْ أَنفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
১৬৮। এরা
নিজেরা বসে থাকলো এবং এদের ভাই–বন্ধু যারা লড়াই করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে বলেছিলঃ যদি
তারা আমাদের কথা মেনে নিতো, তাহলে মারা যেতো না। ওদের বলে
দাও, তোমরা
নিজেদের একথায় যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে তোমাদের নিজেদের মৃত্যু যখন আসবে
তখন তা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে দেখাও।
﴿وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ
قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ﴾
১৬৯। যারা
আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত মনে করো না। তারা আসলে
জীবিত।১২০ নিজেদের রবের কাছ থেকে তারা
জীবিকা লাভ করছে।
১২০. এর ব্যাখ্যার জন্য সূরা আল
বাকারাহ-এর ১৫৫ টীকা দেখুন।
﴿فَرِحِينَ
بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا
بِهِم مِّنْ خَلْفِهِمْ أَلَّا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾
১৭০। আল্লাহ
নিজের অনুগ্রহ থেকে তাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তাতেই তারা আনন্দিত ও পরিতৃপ্ত ১২১ এবং যেসব ঈমানদার লোক তাদের
পরে এ দুনিয়ায় রয়ে গেছে এবং এখনো সেখানে পৌঁছেনি, তাদের জন্যও কোন ভয় ও দুঃখের
কারণ নেই, একথা জেনে
তারা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে।
১২১. মুসনাদে আহমাদে নবী সা. এর
একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার বিষয়বস্তু হচ্ছে, যে ব্যক্তি
ভালো কাজ করে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়, সে আল্লাহর কাছে এমন
আরাম আয়েসের জীবন লাভ করে যে,তারপর এ দুনিয়ায় ফিরে আসার কোন
আকাংখাই সে করে না। কিন্তু শহীদরা এর ব্যতিক্রম। তারা
আকাংখা করে, আবার যেন তাদেরকে দুনিয়ায় পাঠানো হয় এবং
আল্লাহর পথে জীবন দিতে গিয়ে যে ধরনের আনন্দ, উৎফুল্লতা ও
উন্মাদনায় তারা পাগল হয়ে গিয়েছিল আবার যেন সেই অভিনব আস্বাদনের সাগরে তারা ডুব
দিতে পারে।
﴿يَسْتَبْشِرُونَ
بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ﴾
১৭১। তারা
আল্লাহর পুরস্কার ও অনুগ্রহ লাভে আনন্দিত ও উল্লসিত এবং তারা জানতে পেরেছে যে, আল্লাহ মুমিনদের প্রতিদান
নষ্ট করেন না।
c রুকুঃ ১৮ d
﴿الَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ
وَالرَّسُولِ مِن بَعْدِ مَا أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ ۚ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ
وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ﴾
১৭২। আহত হবার
পরও যারা আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দিয়েছে, তাদের মধ্যে১২২ যারা সৎ-নেককার ও মুত্তাকী
তাদের জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিদান। আর
যাদেরকে১২৩
১২২. ওহোদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে
ফেরার পথে বেশ কয়েক মনযিল দূরে চলে যাবার পর মুশরিকদের টনক নড়লো। তারা
পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, এ আমরা কি করলাম! মুহাম্মাদের সা. শক্তি
ধ্বংস করার যে সুবর্ণ সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম, তা হেলায় হারিয়ে
ফেললাম? কাজেই তারা এক জায়গায় থেমে গিয়ে পরামর্শ করতে বসলো। সিদ্ধান্ত
হলো, এখনি মদীনার ওপর দ্বিতীয় আক্রমণ চালাতে হবে। সিদ্ধান্ত তো তারা করে ফেললো
তড়িঘড়ি। কিন্তু আক্রমণ করার আর সাহস হলো না। কাজেই
মক্কায় ফিরে এলো। ওদিকে নবী সা. এরও আশংকা ছিল, কাফেররা আবার
ফিরে এসে মদীনার ওপর আক্রমণ না করে বসে। তাই ওহোদ যুদ্ধের পরদিনই
তিনি মুসলমানদের একত্র করে বললেন, কাফেরদের পেছনে ধাওয়া করা উচিত। যদিও
সময়টা ছিল অত্যন্ত নাজুক তবুও যারা সাচ্চা মু’মিন ছিলেন তাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করতে
প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং নবী সা. এর সাথে হামরাউল আসাদ পর্যন্ত ধাওয়া করলেন। এ জায়গাটি
মদীনা থেকে আট মাইল দূরে অবস্থিত। এ আয়াতে এ প্রাণ উৎসর্গকারী
মু’মিন দলের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।
১২৩. এ আয়াত ক’টি ওহোদ যুদ্ধের এক
বছর পর নাযিল হয়েছিল। কিন্তু ওহোদের ঘটনাবলীর সাথে সম্পর্কিত
হবার কারণে এগুলোকে এ ভাষনের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে।
﴿الَّذِينَ
قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ
إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ﴾
১৭৩। লোকেরা
বললোঃ তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনা সমাবেশ ঘটেছে। তাদেরকে
ভয় করো, তা শুনে
তাদের ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা জবাবে বলেছেঃ আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট এবং
তিনি সবচেয়ে ভালো কার্য উদ্ধারকারী।
﴿فَانقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ
مِّنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَّمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ ۗ
وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ﴾
১৭৪। অবশেষে
তারা ফিরে এলো আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ সহকারে। তাদের কোন
রকম ক্ষতি হয়নি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর চলার সৌভাগ্যও তারা লাভ করলো। আল্লাহ
বড়ই অনুগ্রহকারী।
﴿إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ الشَّيْطَانُ
يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
১৭৫। এখন তোমরা
জেনে ফেলেছো, সে আসলে শয়তান
ছিল, তার
বন্ধুদের অনর্থক ভয় দেখাচ্ছিলে। কাজেই আগামীতে তোমরা মানুষকে
ভয় করো না, আমাকে ভয়
করো, যদি তোমরা
যথার্থ ঈমানদার হয়ে থাকো।১২৪
১২৪. ওহোদ থেকে ফেরার পথে আবু
সুফিয়ান মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে গিয়েছিল, আগামী বছর বদর প্রান্তরে
আমাদের সাথে তোমাদের আবার মোকাবিলা হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময় এগিয়ে
এলে আর তার সাহসে কুলালো না। কারণ সে বছর মক্কায়
দুর্ভিক্ষ চলছিল। তাই সে মান বাঁচাবার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করলো। গোপনে এক
ব্যক্তিকে মদীনায় পাঠিয়ে দিল। সে মদীনায় পৌঁছে মুসলমানদের
মধ্যে এ খবর ছড়াতে লাগলো যে, এ বছর কুরাইশরা বিরাট প্রস্তুতি
নিয়েছে। তারা এত বড় সেনাবাহিনী তৈরী করছে যার মোকাবিলা করার
সাধ্য আরবের কারো নেই। তার উদ্দেশ্য ছিল, এ প্রচারণায়
ভীত হয়ে মুসলমানরা নিজেদের জায়গায় বসে থাকবে। মোকাবিলা করার জন্য বাইরে
আসার সাহস তাদের হবে না। ফলে যুদ্ধক্ষেত্র না আসার দায় থেকে
কাফেররা মুক্ত হয়ে যাবে। আবু সুফিয়ানের এ চালবাজি মুসলমানদের
এমনভাবে প্রভাবিত করলো যে, নবী সা. যখন তাদের বদরের দিকে চলার আহবান
জানালেন তখন তাতে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেলো না। অবশেষে আল্লাহর রাসূল ভরা
মজলিসে ঘোষণা করে দিলেন, কেউ না গেলে আমি একাই যাবো। এ ঘোষনার
পর পনেরোশো প্রাণ উৎসর্গকারী মুজাহিদ তাঁর সাথে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। তাদের
সাথে করে নিয়ে তিনি বদরে হাযির হলেন। ওদিকে আবু সুফিয়ান দু’হাজার
সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকলো। কিন্তু দু’দিনের পথ অতিক্রম
করার পর সে তার সাথীদের বললো, এ বছর যুদ্ধ করার সংগত হবে না। আগামী বছর
আমরা আসবো। কাজেই নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে সে ফিরে গেলো। নবী সা.
আট দিন পর্যন্ত বদর প্রান্তরে তার অপেক্ষা করলেন। এসময়ের মধ্যে তাঁর সাথীরা
একটি ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে কাজ-কারবার করে প্রচুর অর্থলাভ করলেন। তারপর যখন
খবর পাওয়া গেলো, কাফেররা ফিরে গেছে তখন তিনি সংগী-সাথীদের
নিয়ে মদীনায় ফিরে এলেন।
﴿وَلَا
يَحْزُنكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْكُفْرِ ۚ إِنَّهُمْ لَن يَضُرُّوا اللَّهَ
شَيْئًا ۗ يُرِيدُ اللَّهُ أَلَّا يَجْعَلَ لَهُمْ حَظًّا فِي الْآخِرَةِ ۖ وَلَهُمْ
عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
১৭৬। (হে নবী!)
যারা আজ কুফরীর পথে খুব বেশী দৌড়াদৌড়ি করছে তাদের তৎপরতা যেন তোমাকে মলিন বদন না
করে। এরা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ
আখেরাতে এদের কোন অংশ দিতে চান না। আর সবশেষে
তারা কঠোর শাস্তি পাবে।
﴿إِنَّ الَّذِينَ اشْتَرَوُا
الْكُفْرَ بِالْإِيمَانِ لَن يَضُرُّوا اللَّهَ شَيْئًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
১৭৭। যারা
ঈমানকে ছেড়ে দিয়ে কুফরী কিনে নিয়েছে তারা নিসন্দেহে আল্লাহর কোন ক্ষতি করছে না। তাদের
জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রয়েছে।
﴿وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ
كَفَرُوا أَنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ خَيْرٌ لِّأَنفُسِهِمْ ۚ إِنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ
لِيَزْدَادُوا إِثْمًا ۚ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ﴾
১৭৮। কাফেরদের
আমি যে ঢিল দিয়ে চলছি এটাকে যেন তারা নিজেদের জন্য ভালো মনে না করে। আমি
তাদেরকে এ জন্য ঢিল দিচ্ছি, যাতে তারা গোনাহের বোঝা ভারী করে নেয়, তারপর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন
অপমানকর শাস্তি।
﴿مَّا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ
الْمُؤْمِنِينَ عَلَىٰ مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىٰ يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ
ۗ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي
مِن رُّسُلِهِ مَن يَشَاءُ ۖ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ وَإِن تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا
فَلَكُمْ أَجْرٌ عَظِيمٌ﴾
১৭৯। তোমরা
বর্তমানে যে অবস্থায় আছো আল্লাহ মুমিনদের কখনো সেই অবস্থায় থাকতে দেবেন না।১২৫ পাক–পবিত্র লোকেদেরকে তিনি
নাপাক ও অপবিত্র লোকদের থেকে আলাদা করেই ছাড়বেন। কিন্তু
তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়।১২৬ গায়েবের খবর জানাবার জন্য
তিনি নিজের রাসূলদের মধ্য থেকে যাকে চান বাছাই করে নেন। কাজেই
(গায়েবের ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান রাখো। যদি তোমরা
ঈমান ও আল্লাহকে ভয় করার নীতি অবলম্বন করো তাহলে বিরাট প্রতিদান পাবে।
১২৫. অর্থাৎ মুসলমানেদের দলে
সাচ্চা ঈমানদার ও মুনাফিকরা এক সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে, মুসলমানদের
দলকে আল্লাহ এভাবে দেখতে চান না।
১২৬. অর্থাৎ আল্লাহ কখনো মু’মিন ও
মুনাফিকের পার্থক্য সুস্পষ্ট করার জন্য গায়েব থেকে মুসলমানদের মনের অবস্থা বর্ণনা
করে কে মু’মিন ও কে মুনাফিক একথা বলার রীতি অবলম্বন করেন না। বরং তাঁর নির্দেশে এমন সব
পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হবে যার মাধ্যমে মু’মিন ও মুনাফিকের অবস্থা সুস্পষ্টভাবে
ফুটে উঠবে।
﴿وَلَا
يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا
لَّهُم ۖ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
ۗ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ﴾
১৮০। আল্লাহ
যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তারপরও তারা কার্পণ্য করে, তারা যেন এই কৃপণতাকে নিজেদের
জন্য ভালো মনে না করে। না, এটা তাদের জন্য অত্যন্ত খারাপ। কৃপণতা
করে তারা যাকিছু জমাচ্ছে তাই কিয়ামতের দিন তাদের গলার বেড়ি হবে। পৃথিবী ও
আকাশের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই।১২৭ আর তোমরা যা কিছু করছো, আল্লাহ তা সবই জানেন।
১২৭. অর্থাৎ পৃথিবী ও আকাশের যে
কোন জিনিসই যে কেউ ব্যবহার করছে তা আসলে আল্লাহর মালিকানাধীন। তার ওপর সৃষ্টির আধিপত্য ও
তাকে ব্যবহার করার অধিকার সাময়িক। প্রত্যেককেই অবশ্যি তার দখল
ছাড়তে হবে। অবশেষে সবকিছুই আল্লাহর কাছে চলে যাবে। কাজেই এ
সাময়িক আধিপত্য ও দখলী স্বত্ব লাভ করে যে ব্যক্তি আল্লাহর সম্পদ আল্লাহর পথে প্রাণ
খুলে ব্যয় করে সে-ই বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি তা আল্লাহর
পথে ব্যয় না করে স্তূপীকৃত করে সে আসলে নিরেট বোকা বৈ আর কিছুই নয়।
﴿لَّقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ
الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ ۘ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا
وَقَتْلَهُمُ الْأَنبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ﴾
১৮১। আল্লাহ
তাদের কথা শুনেছেন যারা বলে, আল্লাহ গরীব এবং আমরা ধনী।১২৮ এদের কথাও আমি লিখে নেবো এবং
এর আগে যে পয়গাম্বরদেরকে এরা অন্যায়ভাবে হত্যা করে এসেছে তাও এদের আমলনামায় বসিয়ে
দেয়া হয়েছে। (যখন ফায়সালার সময় আসবে তখন) আমি তাদেরকে
বলবোঃ এই নাও, এবার জাহান্নামের আযাবের মজা চাখো!
১২৮. এটা ইহুদীদের কথা। কুরআনে
যখন আল্লাহর এ বক্তব্য উচ্চারিত হলোঃ مَّن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا
حَسَنًا (কে আল্লাহকে ভালো ঋণ দেবে?) তখন ইহুদীরা
এক বিদ্রুপ করে বলতে লাগলোঃ হ্যাঁ, আল্লাহ গরীব হয়ে গেছেন,
এখন তিনি বান্দার কাছে ঋণ চাচ্ছেন।
﴿ذَٰلِكَ
بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾
১৮২। এটা
তোমাদের হাতের উপার্জন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য
জালেম নন।
﴿الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ
اللَّهَ عَهِدَ إِلَيْنَا أَلَّا نُؤْمِنَ لِرَسُولٍ حَتَّىٰ يَأْتِيَنَا بِقُرْبَانٍ
تَأْكُلُهُ النَّارُ ۗ قُلْ قَدْ جَاءَكُمْ رُسُلٌ مِّن قَبْلِي بِالْبَيِّنَاتِ وَبِالَّذِي
قُلْتُمْ فَلِمَ قَتَلْتُمُوهُمْ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
১৮৩। যারা বলেঃ
আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা কাউকে রাসূল বলে স্বীকার করবো না
যতক্ষণ না তিনি আমাদের সামনে এমন কুরবানী করবেন যাকে আগুন (অদৃশ্য থেকে এসে) খেয়ে
ফেলবে। তাদেরকে বলোঃ আমার আগে তোমাদের কাছে অনেক
রাসূল এসেছেন, তারা অনেক
উজ্জ্বল নিদর্শন এনেছিলেন এবং তোমরা যে নিদর্শনটির কথা বলছো সেটিও তারা এনেছিলেন। এ
ক্ষেত্রে (ঈমান আনার জন্য এ শর্ত পেশ করার ব্যাপারে) যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তাহলে ঐ রাসূলদেরকে তোমরা
হত্যা করেছিলে কেন?১২৯
১২৯. বাইবেলর বিভিন্ন স্থানে একথা
বলা হয়েছে, আল্লাহর কাছে কোন কুরবানী গৃহীত হবার আলামত
এই ছিল যে, গায়েব থেকে একটি আগুন এসে তাকে পুড়িয়ে ছাই করে
দিতো। (বিচারকর্তৃগণঃ ৬:২০-২১, ১৩:১৯-২০) এ
ছাড়াও বাইবেলে এ আলোচনাও এসেছে যে, কোন কোন সময় কোন নবী পোড়া
জিনিস কুরবানী করতেন এবং অদৃশ্য থেকে একটি আগুণ এসে তা খেয়ে ফেলতো। (লেবীয়
পুস্তকঃ ৯:২৪ এবং ২-বংশাবলী ৯:১-২) কিন্তু বাইবেলের কোথাও এ ধরনের কুবরানীকে
নবুওয়াতের অপরিহার্য আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি বা একথাও বলা হয়নি যে, যে ব্যক্তিকে
এ মুজিযাটি দেয়া হয়নি সে নবী হতে পারে না। এটা ছিল নিছক ইহুদীদের একটি
মনগড়া বাহানাবাজী। মুহাম্মাদ সা. এর নবুওয়াত অস্বীকার করার জন্য তারা এ
বাহানাবাজীর আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এদের সত্য বিরোধিতার
এর চাইতেও বড় প্রমাণ রয়েছে। বনী ইসরাঈলদের মধ্যেও এমন
কোন কোন নবী ছিলেন যারা এ অগ্নিদগ্ধ কুরবানীর মুজিযা দেখিয়েছিলেন; কিন্তু এরপরও
এ পেশাগত অপরাধী লোকেরা তাদেরকে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। দৃষ্টান্ত
স্বরূপ হযরত ইলিয়াসের কথা বলা যায়। বাইবেলে তাঁর সম্পর্কে বলা
হয়েছেঃ তিনি বা’ল পূজারীদেরকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, সাধারণ লোকদের সমাবেশে তোমরা একটি গরু কুরবানী করবে এবং আমিও একটি গরু
কুরবানী করবো, অদৃশ্য আগুণ যার কুরবানী খেয়ে ফেলবে সে-ই
সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রমাণিত হবে। কাজেই একটি বিপুল জনসমাবেশে
এ মোকাবিলাটি হয়। অদৃশ্য আগুণ হযরত ইলিয়াসের কুরবানী খেয়ে ফেলে।কিন্তু
এরপরও ইসরাঈলী বাদশাহর বা’ল পূজারী বেগম হযতর ইলিয়াসের শত্রু হয়ে যায়। স্ত্রৈণ
বাদশাহ নিজের বেগমের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ফলে বাধ্য
হয়ে তাঁকে দেশ ত্যাগ করে সাইনা উপদ্বীপের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে হয়।
(১-রাজাবলী ১৮ ও ১৯) এ জন্য বলা হয়েছেঃ ওহে সত্যের দুশমনরা! তোমরা কোন মুখে
অগ্নিদগ্ধ কুরবানীর মুজিযা দেখতে চাচ্ছো? যেসব পয়গম্বর ও মুজিযা
দেখিয়েছিলেন, তোমরা কি তাদেরকে হত্যা করতে বিরত হয়েছিলে?
﴿فَإِن
كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ جَاءُوا بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ
وَالْكِتَابِ الْمُنِيرِ﴾
১৮৪। এখন, হে মুহাম্মাদ! যদি এরা
তোমাদের মিথ্যা বলে থাকে, তাহলে তোমরা পূর্বে বহু রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে। তারা
স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, সহীফা ও
আলোদানকারী কিতাব এনেছিলে।
﴿كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ
ۗ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۖ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ
وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ۗ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ
الْغُرُورِ﴾
১৮৫। অবশেষে
প্রত্যেক ব্যক্তিকে মরতে হবে এবং তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন নিজেদের পূর্ণ প্রতিদান
লাভ করবে। একমাত্র সেই ব্যক্তিই সফলকাম হবে, যে সেখানে জাহান্নামের আগুন
থেকে রক্ষা পাবে এবং যাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর এ
দুনিয়াটা তো নিছক একটা বাহ্যিক প্রতারণার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়।১৩০
১৩০. অর্থাৎ এ দুনিয়ার জীবনে
বিভিন্ন কাজের যে ফলাফল দেখা যায় তাকেই যদি কোন ব্যক্তি আসল ও চূড়ান্ত ফলাফল বলে
মনে করে এবং তারই ভিত্তিতে সত্য-মিথ্যা ও কল্যাণ-অকল্যাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, তাহলে সে
আসলে মারাত্মক প্রতারণার শিকার হবে। এখানে কারো ওপর অনুগ্রহ ও
নিয়ামত বর্ষিত হতে থাকলে তা থেকে একথা প্রমাণ হয় না যে, সে সত্যের
ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে এবং আল্লাহর দরবারে তার কার্যকলাপ গৃহীত হয়েছে।
অনুরূপভাবে এখানে কোন ব্যক্তির ওপর বিপদ নেমে এলে এবং সে মহাসংকটের মধ্যে
নিক্ষিপ্ত হলে তা থেকে অনিবার্যভাবে ধারণা করা যাবে না যে, সে মিথ্যার
ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং আল্লাহর দরবারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অধিকাংশ
ক্ষেত্রে এ প্রাথমিক পর্যায়ের ফলাফলগুলো চিরন্তন জীবনের পর্যায়ের চূড়ান্ত ফলাফল
থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়। আর আসলে এ শেষ ফলাফলই
নির্ভরযোগ্য।
﴿لَتُبْلَوُنَّ
فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ
مِن قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا ۚ وَإِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا
فَإِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ﴾
১৮৬। (হে
মুসলমানগণ!) তোমাদের অবশ্যি ধন ও প্রাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা
আহলি কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি এমন
অবস্থায় তোমরা সবর ও তাকওয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো১৩১ তাহলে তা হবে বিরাট সাহসিকতার
পরিচায়ক।
১৩১. অর্থাৎ তাদের গালিগালাজ, মিথ্যা
দোষারোপ, বেহুদা কথাবার্তা ও অপপ্রচারের মোকাবিলায় অধৈর্য
হয়ে তোমরা এমন কোন কথা বলতে শুরু করো না, যা সত্য, সততা, ন্যায় ইনসাফ, শিষ্টাচার
শালীনতা ও নৈতিকতা বিরোধী।
﴿وَإِذْ
أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ
وَلَا تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا
ۖ فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ﴾
১৮৭। এ আহলি
কিতাবদের সেই অংগীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দাও, যা আল্লাহ তাদের থেকে নিয়েছিলেন। তাতে বলা
হয়েছিলঃ তোমরা কিতাবের শিক্ষা মানুষের মধ্যে প্রচার করবে, তা গোপন করতো পারবে না।১৩২ কিন্তু তারা কিতাবকে পিছনে
ফেলে রেখেছে এবং সামান্য দামে তা বিক্রি করে দিয়েছে। কতই না
নিকৃষ্ট কারবার তারা করে যাচ্ছে!
১৩২. অর্থাৎ কোন কোন নবীকে অদৃশ্য
আগুনে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়া কুরবানীর নিশানী হিসেবে দেয়া হয়েছিল, একথা তারা
মনে রেখেছে। কিন্তু আল্লাহ নিজের কিতাব তাদের হাতে সোপর্দ করার
সময় তাদের থেকে কি অংগীকার নিয়েছিলেন এবং কোন মহাদায়িত্বের বোঝা তাদের মাথায়
চাপিয়ে দিয়েছিলেন, সেকথা তারা ভুলে গেছে।
এখানে যে অংগীকারের কথা বলা হয়েছে, বাইবেলের
বিভিন্ন স্থানে তার উল্লেখ দেখা যায়। বিশেষ করে বাইবেলরে দ্বিতীয়
বিবরণ পুস্তকে হযরত মূসার আ. যে শেষ ভাষনটি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তাঁকে বার বার বনী
ইসরাঈলদের থেকে নিম্নোক্ত অংগীকারটি নিতে দেখা যায়ঃ
যে বিধান আমি তোমাদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি তা নিজেদের
মনের পাতায় খোদাই করে নাও। তোমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে
সেগুলো শিখিয়ে দিয়ো। ঘরে বসে থাকা ও পথে চলা অবস্থায় এবং ওঠা, বসা ও শয়ন
করার সময় সেগুলোর চর্চা করো। নিজেদের ঘরের চোকাঠে ও
বাইরের দরজার গায়ে সেগুলো লিখে রাখো। (৬:৪-৯) তারপর নিজের সর্বশেষ
উপদেশ তিনি তাকিদ দিয়ে বলেনঃ ফিলিস্তীন সীমান্তে প্রবেশকরার পর সর্বপ্রথম যে কাজটি
করবে সেটি হচ্ছে এই যে, ইবাল পর্বতের্ ওপর বড় বড় শিলা খণ্ড স্থাপন
করে তার গায়ে তাওরাতের বিধানগুলি খোদাই করে দেবে। (২৭:২-৪) এ ছাড়াও তিনি বনী
লেভীকে এক খণ্ড তাওরাত গ্রন্থ দিয়ে এ নির্দেশ জারী করেন যে, প্রতি সপ্তম
বছরের ‘ঈদে খিয়াম’ এর সময় জাতির
নারী-পুরুষ শিশু সবাইকে বিভিন্ন স্থানে সমবেত করে সমস্ত তাওরাত গ্রন্থটির প্রতিটি
শব্দ তাদেরকে শোনাতে থাকবে। কিন্তু এরপরও আল্লাহর কিতাব
থেকে বনি ইসরাঈলরা দিনের পর দিন গাফিল হয়ে যেতে থাকে। এমনকি হযরত মূসার আ.
ইন্তিকালের সাতশো বছর পর হাইকেলে সুলাইমানীর গদীনশীন এবং জেরুসালেমের ইহুদী
শাসনকর্তা পর্যন্তও জানতেন না যে, তাদের তাওরাত নামের একটি কিতাব আছে।
(২-রাজাবলীঃ ২২:৮-১৩)
﴿لَا تَحْسَبَنَّ
الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوا وَّيُحِبُّونَ أَن يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا
فَلَا تَحْسَبَنَّهُم بِمَفَازَةٍ مِّنَ الْعَذَابِ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
১৮৮। যারা
নিজেদের কার্যকলাপে আনন্দিত এবং যে কাজ যথার্থই তারা নিজেরা করেনি সে জন্য প্রশংশা
পেতে চায়, তাদেরকে
তোমরা আযাব থেকে সংরক্ষিত মনে করো না।১৩৩ আসলে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক
শাস্তি তৈরী রয়েছে।
১৩৩. যেমন নিজেদের প্রশংসায় তারা
একথা শুনতে চায়ঃ তারা বড়ই মুত্তাকী-পরহেজগার, দ্বীনদার, সাধু-সজ্জন,দীনের খাদেম, শরীয়াতের
সাহায্যকারী,সংস্কারক, সুখী চরিত্রের
লোক। অথচ তারা কিছুই নয়। অথবা নিজেদের পক্ষে এভাবে
ঢোল পিটাতে চায়ঃ উমুক মহাত্মা অতি বড় ত্যাগী পুরুষ, জাতির
বিশ্বস্ত নেতা। তিনি নিজের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় জাতির
বিরাট খেদমত করেছেন। অথচ আসল ব্যাপার তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
﴿وَلِلَّهِ
مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
১৮৯। আল্লাহ
পৃথিবী ও আকাশের মালিক এবং তাঁর শক্তি সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে।
c রুকুঃ ২০ d
﴿إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ
وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ﴾
১৯০। পৃথিবী১৩৪ ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও
দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে
১৩৪. সুদীর্ঘ ভাষণটি এখানে শেষ
করা হয়েছে। তাই এ শেষাংশটির সম্পর্ক কেবল ওপরের আয়াতের সাথে নয়
বরং সমগ্র সূরার মধ্যে তালাশ করতে হবে। এ বক্তব্যটি বুঝতে হলে বিশেষ
করে সূরার ভূমিকাটি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।
﴿الَّذِينَ
يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي
خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ
فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ﴾
১৯১। যে সমস্ত
বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে ও
শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা
করে, তাদের জন্য
রয়েছে বহুতর নিদর্শন।১৩৫ (তারা আপনা আপনি ওঠেঃ) হে
আমাদের প্রভু! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সৃষ্টি করোনি। বাজে ও
নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত।
১৩৫. অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিই
যদি সে আল্লাহর প্রতি গাফিল না হয় এবং বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনসমূহ বিবেক-বুদ্ধিহীন
জন্তু-জানোয়ারের দৃষ্টিতে না দেখে গভীর নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখে ও
সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে প্রতিটি নিদর্শনের সাহায্যে অতি সহজে যথার্থ ও
চূড়ান্ত সত্যের দ্বারে পৌঁছুতে পারে।
﴿رَبَّنَا
إِنَّكَ مَن تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ﴾
১৯২। কাজেই হে
প্রভু! জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদের রক্ষা করো।১৩৬ তুমি যাকে জাহান্নামে ফেলে
দিয়েছো, তাকে আসলে
বড়ই লাঞ্ছনা ও অপমানের মধ্যে ঠেলে দিয়েছো এবং এহেন জালেমদের কোন সাহায্যকারী হবে
না।
১৩৬. বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনাকে
গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার পর এ সত্য তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এটি পুরোপুরি
একটি জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থাপনা। মহান আল্লাহ তাঁর যে সৃষ্টির
মধ্যে নৈতিক অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন, যাকে বিশ্ব-জগতে কাজ করার
স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দিয়েছেন এবং জ্ঞান-বুদ্ধ ও সত্য-মিথ্যা এবং ভালো-মন্দের
পার্থক্য করার ক্ষমতা দিয়েছেন, তাকে তার এ দুনিয়াবী জীবনের
কার্যাবলীর জন্য কোন জবাবদিহি করতে হবে না এবং সে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও
খারাপ কাজের জন্য শাস্তি পাবে না-এটা সম্পূর্ণ একটি বুদ্ধি বিবেক বিরোধী কথা।
﴿رَّبَّنَا
إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا
ۚ رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا
مَعَ الْأَبْرَارِ﴾
১৯৩। হে আমাদের
মালিক! আমরা একজন আহবানকারীর আহবান শুনেছিলাম। তিনি
ঈমানের দিকে আহবান করছিলেন। তিনি বলছিলেন, তোমরা নিজেদের রবকে মেনে নাও। আমরা তার
আহবান গ্রহণ করেছি।১৩৭ কাজেই, হে আমাদের প্রভু! আমরা যেসব
গোনাহ করছি তা মাফ করে দাও। আমাদের মধ্যে যেসব অসৎবৃত্তি
আছে সেগুলো আমাদের থেকে দূর করে দাও এবং নেক লোকদের সাথে আমাদের শেষ পরিণতি দান
করো।
১৩৭. এভাবে এ পর্যবেক্ষণ তাদেরকে
এ ব্যাপারেও নিশ্চিন্তকরে দেয় যে, এ বিশ্ব এবং এর শুরু ও শেষ সম্পর্কে
নবী যে দৃষ্টিভংগী ও বিশ্লেষণ পেশ করেন এবং জীবন ক্ষেত্রে তিনি যে পথ দেখান তা
একাবারেই সত্য।
﴿رَبَّنَا
وَآتِنَا مَا وَعَدتَّنَا عَلَىٰ رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ إِنَّكَ
لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ﴾
১৯৪। হে আমাদের
রব! তোমরা রাসূলদের মাধ্যেমে তুমি যেসব ওয়াদা করেছো আমাদের সাথে, সেগুলো পূর্ণ করো এবং
কিয়ামতের দিন আমাদের লাঞ্ছনার গর্তে ফেলে দিয়ো না। নিসন্দেহে
তুমি ওয়াদা খেলাপকারী নও।১৩৮
১৩৮. অর্থাৎ আল্লাহ নিজের
প্রতিশ্রুতিসমূহ পূর্ণ করবেন কিনা এ ব্যাপারে তাদের কোন সন্দেহ নেই। তবে সেই
প্রতিশ্রুতি তাদের ওপরও কার্যকর হবে কিনা, এ ব্যাপারে তাদের সন্দেহ
রয়েছে। তাই তারা আল্লাহর কাছে দোয়া করে যে, এ প্রতিশ্রুতিগুলো
তাদের ব্যাপারেও কার্যকর করা হোক এবং তাদের ক্ষেত্রে এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা হোক। এ দুনিয়ায়
নবীর ওপর ঈমান আনার কারণে তারা কাফেরদের ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকার হয়েছে আবার
কিয়ামতের দিনও যেন কাফেরদের সামনে তাদের অপমান ও লাঞ্ছনা পোহাতে না হয়। কাফেরেরা
যেন সেদিন তাদের প্রতি এ ধরনের বিদ্রুপবাণ নিক্ষেপ না করে যে, ঈমান এনেও
এদের কোন ভালো হলো না। এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার
যেন তাদের না হতে হয়, এ আশাই তারা পোষণ করে।
﴿فَاسْتَجَابَ
لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنكُم مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ
ۖ بَعْضُكُم مِّن بَعْضٍ ۖ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا
فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ
جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِّنْ عِندِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ
عِندَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ﴾
১৯৫। জবাবে
তাদের রব বললেনঃ আমি তোমাদের কারো কর্মকাণ্ড নষ্ট করবো না। পুরুষ হও
বা নারী, তোমরা সবাই
একই জাতির অন্তরভুক্ত।১৩৯ কাজেই যারা আমার জন্য নিজেদের
স্বদেশ ভূমি ত্যাগ করেছে এবং আমার পথে যাদেরকে নিজেদের ঘর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া
ও কষ্ট দেয়া হয়েছে এবং যারা আমার জন্য লড়েছে ও মারা গেছে, তাদের সমস্ত গোনাহ আমি মাফ
করে দেবো এবং তাদেরকে এমন সব বাগানে প্রবেশ করাবো যার নীচে দিয়ে ঝরণাধারা বয়ে চলবে। এসব হচ্ছে
আল্লাহর কাছে তাদের প্রতিদান এবং সবচেয়ে ভালো প্রতিদান আল্লাহর কাছেই আছে।১৪০
১৩৯. অর্থাৎ তোমরা সবাই মানুষ। আমরা
দৃষ্টিতে তোমরা সবাই সমান। আমার এখানে নারী-পুরুষ, চাকর-মনিব,সাদা-কালো ও বড়-ছোটর মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন ভিন্ন ভিন্ন
নীতি এবং তাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মীমাংসা করার সময় আলাদা আলাদা মানদণ্ড কায়েম করা
হয় না।
১৪০. এক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে, কোন কোন
অমুসলিম নবী সা. এর কাছে এসে বলেঃ মূসা নবী ‘আসা’ (অলৌকিক লাঠি) ও উজ্জ্বল হাত এনেছিলেন। ঈসা নবী অন্ধদের দৃষ্টিশক্তি
ফিরিয়ে দিতেন এবং কুষ্ঠরোগীকে নিরামত করতেন। অন্যান্য নবীরাও কিছু না
কিছু মু’জিযা এনেছিলেন। আপনি কি এনেছেন? একথার জবাবে
নবী সা. এ রুকূর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আয়াত গুলো তেলাওয়াত করেন এবং তাদেরকে বলেন,
আমি এগুলো এনেছি।
﴿لَا يَغُرَّنَّكَ
تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي الْبِلَادِ﴾
১৯৬। হে নবী!
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আল্লাহর নাফরমান লোকদের চলাফেরা যেন তোমাকে ধোঁকায় ফেলে না
দেয়।
﴿مَتَاعٌ قَلِيلٌ ثُمَّ مَأْوَاهُمْ
جَهَنَّمُ ۚ وَبِئْسَ الْمِهَادُ﴾
১৯৭। এটা নিছক
কয়েক দিনের জীবনের সামান্য আনন্দ ফূর্তি মাত্র। তারপর এরা
সবাই জাহান্নামে চলে যাবে, যা সবচেয়ে খারাপ স্থান।
﴿لَٰكِنِ الَّذِينَ اتَّقَوْا
رَبَّهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا نُزُلًا
مِّنْ عِندِ اللَّهِ ۗ وَمَا عِندَ اللَّهِ خَيْرٌ لِّلْأَبْرَارِ﴾
১৯৮। বিপরীত
পক্ষে যারা নিজেদের রবকে ভয় করে জীবন যাপন করে তাদের জন্য এমন সব বাগান রয়েছে, যার নীচে দিয়ে ঝরণাধারা বয়ে
চলছে। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। এ হচ্ছে
আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য মেহমানদারীর সরঞ্জাম। আর যা
কিছু আল্লাহর কাছে আছে, নেক লোকদের জন্য তাই ভালো।
﴿وَإِنَّ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ
لَمَن يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُمْ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِمْ خَاشِعِينَ
لِلَّهِ لَا يَشْتَرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۗ أُولَٰئِكَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ
عِندَ رَبِّهِمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾
১৯৯। আহলি
কিতাবদের মধ্যেও এমন কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহকে মানে
তোমাদের কাছে যে কিতাব পাঠানো হয়েছে তার ওপর ঈমান আনে এবং এর আগে তাদের নিজেদের
কাছে যে কিতাব পাঠানে হয়েছিল তার ওপরও ঈমান রাখে, যারা আল্লাহর সামনে বিনত
মস্তক এবং আল্লাহর আয়াতকে সামান্য দামে বিক্রি করে না। তাদের
প্রতিদান রয়েছে তাদের রবের কাছে। আর তিনি
হিসেব চুকিয়ে দেবার ব্যাপারে দেরী করেন না।
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾
২০০। হে
ঈমানদানগণ! সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবলায় দৃঢ়তা দেখাও,১৪১ হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে
লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা
যায়, তোমরা
সফলকাম হবে।
১৪১. কুরআনের মূল শব্দ হচ্ছে صَابِرُواএর দু’টি অর্থ হয়। একঃ কাফেরেরা
তাকে কুফরীর ব্যাপারে যে দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখাচ্ছে এবং কুফরীর ঝাণ্ডা সমুন্নত
রাখার জন্য যে ধরনের কষ্ট স্বীকার করছে তোমরা তাদের মোকাবিলায় তাদের চাইতেও বেশী
দৃঢ়তা অবিচলতা ও মজবুতী দেখাও। দুইঃ তাদের মোকাবেলায় তোমরা
দৃঢ়তা অবিচলতা ও মজুবতী দেখাবার ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করো।
— সমাপ্ত —