তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿نٓ ۚ وَٱلْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ﴾
১। নূন, শপথ কলমের এবং লেখকরা যা লিখে চলেছে তার।১
১. তাফসীরের ইমাম মুজাহিদ বলেনঃ কলম মানে যে কলম দিয়ে যিকর অর্থাৎ কুরআন মজীদ লেখা হচ্ছিলো। এ থেকে বুঝা যায়, যা লেখা হচ্ছিলো তা ছিল কুরআন মজীদ।
﴿مَآ أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍۢ﴾
২। তোমার রবের অনুগ্রহে তুমি পাগল২ নও।
২. একথাটির জন্যই কলম ও কিতাবের নামে শপথ করা হয়েছে। অর্থাৎ অহী লেখক ফেরেশতাদের হাত দিয়ে কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ হচ্ছে। কুরআন মজীদ ফেরেশতাদের হাতে লিপিবদ্ধ হওয়াই কাফেরদের এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, নাউযুবিল্লাহ, রাসূলুল্লাহ সা. পাগল। নবুওয়াত দাবী করার পূর্বে মক্কাবাসীরা নবী সা.কে কওমের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মনে করতো। তারা তাঁর দ্বীনদারী, আমানতদারী, বিবেক-বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার ওপর আস্থাশীল ছিলো। কিন্তু তিনি তাদের সামনে কুরআন মজীদ পেশ করতে শুরু করলে তারা তাঁকে পাগল বলে অভিহিত করতে লাগলো। এর সোজা অর্থ হলো, রাসূলের সা. প্রতি পাগল হওয়ার যে অপবাদ তারা আরোপ করতো তাদের দৃষ্টিতে তার মূল কারণ ছিলো কুরআন। তাই বলা হয়েছে, কুরআনই এ অপবাদের অসারতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। নাউযুবিল্লাহ! তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন একথা প্রমাণ করা তো দূরে থাক অতি উচ্চমানের বিশুদ্ধ ও অলংকারপূর্ণ ভাষায় এরূপ উন্নত বিষয়বস্তু পেশ করাই বরং একথা প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ সা. এর ওপর আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী বর্ষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো বাহ্যিকভাবে নবী সা.কে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা হলেও মূল লক্ষ্য হলো কাফেরদেরকে তাদের অপবাদের জবাব দেয়া। অতএব, কারো মনে যেন এ সন্দেহ দানা না বাঁধে যে, এ আয়াতটি নবী সা. যে পাগল নন এ মর্মে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য নাযিল হয়েছে। নবী সা. নিজের সম্পর্কে এমন কোন সন্দেহ পোষণ করতেন না যা নিরসনের জন্য তাঁকে এরূপ সান্তনা দেয়ার প্রয়োজন ছিলো। বরং এর লক্ষ্য কাফেরদেরকে এতোটুকু জানিয়ে দেয়া যে, কুরআনের কারণে তোমরা কুরআন পেশকারীকে পাগল বলে আখ্যায়িত করছো। তোমাদের এ অভিযোগ যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন খোদ কুরআনই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। (আরো বেশী জানতে হলে দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আত তূরঃ টীকা ২২)
﴿وَإِنَّ لَكَ لَأَجْرًا غَيْرَ مَمْنُونٍۢ﴾
৩। আর নিশ্চিতভাবেই তোমার জন্য এমন পুরস্কার রয়েছে যা কখনো ফুরাবে না।৩
৩. অর্থাৎ এ জন্য তাঁকে দেয়া হবে অগণিত ও চিরস্থায়ী নিয়ামত। কারণ আল্লাহর বান্দাদের হিদায়াতের জন্য তিনি চেষ্টা-সাধনা করেছেন। বিনিময়ে তাঁকে নানা রকম কষ্টদায়ক কথা শুনতে হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও তিনি তাঁর এ কর্তব্য পালন করে চলেছেন।
﴿وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍۢ﴾
৪। নিঃসন্দেহে তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন।৪
৪. এখানে এ আয়াতটির দু’টি অর্থ। একটি হলো, আপনি নৈতিক চরিত্রের সর্বোচ্চ মানের ওপর অধিষ্ঠিত। তাই আপনি আল্লাহর বান্দাদের হিদায়াতের কাজে এতো দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছেন। একজন দুর্বল নৈতিক চরিত্রের মানুষ এ কাজ করতে সক্ষম হতো না। অন্যটি হলো, কাফেররা আপনার প্রতি পাগল হওয়ার যে অপবাদ আরোপ করেছে তা মিথ্যা হওয়ার আরেকটি সুস্পষ্ট প্রমাণ আপনার উন্নত নৈতিক চরিত্র। কারণ উন্নত নৈতিক চরিত্র ও মস্তিস্ক বিকৃতি একসাথে একই ব্যক্তির মধ্যে থাকতে পারে না। যার বুদ্ধি-বিবেক ও চিন্তার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং মেজাজে সমতা নেই সেই পাগল। পক্ষান্তরে মানুষের উন্নত নৈতিক চরিত্র প্রমাণ করে যে, তার মস্তিষ্ক ও বিবেক-বুদ্ধি ঠিক আছে এবং সে সুস্থ ও স্বাভাবিক। তার মন-মানস ও মেজাজ অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ সা. এর নৈতিক চরিত্র কেমন তা মক্কার প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মানুষ চিন্তা করতে বাধ্য হবে যে, তারা কতই নির্লজ্জ। নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে এতো উন্নত একজন মানুষকে তারা পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। তাদের এ অর্থহীন কথাবার্তা রাসূলুল্লাহ সা. এর জন্য নয় বরং তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। কারণ শত্রুতার আক্রোশে উন্মত্ত হয়ে তারা তাঁর সম্পর্কে এমন কথা বলেছিলো, যা কোন বিবেকবান ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না। এ যুগের জ্ঞান-গবেষণার দাবীদারদের ব্যাপারও ঠিক তাই। তারাও রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি মৃগী রোগগ্রস্ত ও বিকৃত মস্তিষ্ক হওয়ার অপবাদ আরোপ করছে। দুনিয়ার সব জায়গায় কুরআন শরীফ পাওয়া যায় এবং নবী সা. এর জীবন বৃত্তান্তও সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে। যে কোন লোক তা অধ্যয়ন করলেই বুঝতে পারবে, যে এ অনুপম গ্রন্থ পেশকারী এবং এরূপ উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষটিকে মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত করে তারা শত্রুতার অন্ধ আবেগে আক্রান্ত হয়ে কি ধরনের অর্থহীন ও হাস্যকর প্রলাপ বকে চলেছে।
রাসূলুল্লাহ সা. এর নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম সংজ্ঞা দিয়েছেন হযরত আয়েশা রা.। তিনি বলেছেনঃ كان خلقها القران (কুরআনই ছিলো তাঁর চরিত্র। ইমাম আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী ও ইবনে জারীর সামান্য কিছু শাব্দিক তারতাম্যসহ তাঁর এ বাণীটি বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন। এর মানে, রাসূলুল্লাহ সা. দুনিয়ার সামনে শুধু কুরআনের শিক্ষাই পেশ করেননি। বরং তিনি নিজেকে তার জীবন্ত নমুনা হিসেবে পেশ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। কুরআনে যেসব নির্দেশ দেয়া হয়েছে সবার আগে তিনি নিজে সে মোতাবেক কাজ করেছেন। এতে যেসব বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে তিনি নিজে তা সবার আগে বর্জন করেছেন। কুরআন মজীদে যে নৈতিক গুণাবলীকে মর্যাদার কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেসব গুণে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে বেশী গুণান্বিত। আর কুরআন মজীদে যেসব বিষয়কে অপছন্দনীয় আখ্যায়িত করা হয়েছে তিনি নিজে ছিলেন তা থেকে সবচেয়ে বেশী মুক্ত। আরেকটি বর্ণনায় হযরত আয়েশা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. কখনো কোন খাদেমকে মারেননি, কোন নারীর গায়ে হাত তোলেননি, জিহাদের ক্ষেত্র ছাড়া নিজ হাতে কখনো কাউকে হত্যা করেননি।*১ তাঁকে কেউ কষ্ট দিয়ে থাকলে তিনি কখনো তার প্রতিশোধ নেননি। কেবল আল্লাহর হারাম করা বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তার শাস্তি দিয়েছেন। তাঁর নীতি ছিলো, কোন দু’টি বিষয়ের একটি গ্রহণ করতে হলে তা যদি গোনাহের কাজ না হতো তাহলে তিনি সহজতর বিষয়টি গ্রহণ করতেন। গোনাহের কাজ থেকে তিনি সবচেয়ে বেশী দূরে থাকতেন। (মুসনাদে আহমাদ) হযরত আনাস বর্ণনা করেছেন, আমি দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমার কোন কাজ সম্পর্কে তিনি কখনো উহ! শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। আমার কোন কাজ দেখে কখনো বলেননিঃ তুমি এ কাজ করলে কেন? কিংবা কাজ না করলে কখনো বলেননিঃ তুমি এ কাজ করলে না কেন? (বুখারীও মুসলিম)
*১.সীরাতে ইবনে হিশাম সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বাংলা অনুবাদ পৃষ্ঠা-১৯২ দেখুন। (অনুবাদক)
﴿فَسَتُبْصِرُ وَيُبْصِرُونَ﴾
৫। অচিরে তুমিও দেখতে পাবে এবং তারাও দেখতে পাবে যে,
﴿بِأَييِّكُمُ ٱلْمَفْتُونُ﴾
৬। তোমাদের উভয়ের মধ্যে কারা পাগলামীতে লিপ্ত।
﴿إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعْلَمُ بِٱلْمُهْتَدِينَ﴾
৭। তোমার রব তাদেরকেও ভাল করে জানেন যারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আর তাদেরকেও ভাল করে জানেন যারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়েছে।
﴿فَلَا تُطِعِ ٱلْمُكَذِّبِينَ﴾
৮। কাজেই তুমি মিথ্যাচরীদের অনুসরণ করো না।
﴿وَدُّوا۟ لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُونَ﴾
৯। তারা তো চায় তুমি নমনীয়তা দেখালে তারাও নমনীয়তা দেখাবে।৫
৫. অর্থাৎ ইসলাম প্রচারের কাজে তুমি কিছু শিথিলতা দেখালে এরাও তোমার বিরোধিতায় কিছুটা নমনীয়তা দেখাবে। কিংবা তাদের গোমরাহীকে প্রশ্রয় দিয়ে যদি দ্বীনের মধ্যে কিছুটা কাটছাঁট করতে রাজী হয়ে যাও তাহলে এরাও তোমার সাথে আপোষ রফা করে নেবে।
﴿وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍۢ مَّهِينٍ﴾
১০। তুমি অবদমিত হয়ো না তার দ্বারা যে কথায় কথায় শপথ করে, যে মর্যাদাহীন,৬
৬. মূল আয়াতে مَهِينٍ (মাহিনিন) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি নগণ্য, তুচ্ছ এবং নীচু লোকদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটা কথায় কথায় শপথকারী ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট। সে কথায় কথায় কসম খায়। কারণ সে নিজেই বুঝে যে লোকে তাকে মিথ্যাবাদী মনে করে। কসম না খাওয়া পর্যন্ত লোকে তাকে বিশ্বাস করবে না। তাই সে নিজের বিবেকের কাছে হীন এবং সমাজের কাছেও তার কোন মর্যাদা নেই।
﴿هَمَّازٍۢ مَّشَّآءٍۭ بِنَمِيمٍۢ﴾
১১। যে গীবত করে, চোগল খোরী করে বেড়ায়,
﴿مَّنَّاعٍۢ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ﴾
১২। কল্যাণের কাজে বাধা দেয়,৭ জুলুম ও বাড়াবাড়িতে সীমালংঘন করে,
৭. আয়াতে مَنَّاعٍ لِلْخَيْرِ (মান্নাইল্লিলখায়ের) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় অর্থ-সম্পদ ও যাবতীয় ভাল কাজকেও خير (খায়ের) বলা হয়। তাই শব্দটিকে যদি অর্থ-সম্পদ অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার মানে হবে সে অত্যন্ত বখীল এবং কৃপণ। কাউকে কানাকড়ি দেয়ার মত উদারতা এবং মন-মানসও তার নেই। আর যদি خير খায়ের শব্দটি নেকী ও ভাল কাজের অর্থে গ্রহণ করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে তার একটি অর্থ হতে পারে, সে প্রতিটি কল্যাণের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। আরেকটি অর্থ হতে পারে সে ইসলাম থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে অত্যন্ত তৎপর।
﴿عُتُلٍّۭ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ﴾
১৩। চরম পাপিষ্ঠ ঝগড়াটে ও হিংস্র৮ এবং সর্বোপরি বজ্জাত।৯
৮. আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হলো عُتُل (ওতুল্লিন)। আরবী ভাষায় عتل ওতুল বলা হয় এমন লোককে যে অত্যন্ত সুঠামদেহী ও অধিকমাত্রায় পানাহারকারী। অধিকন্তু চরম দুশ্চরিত্র ঝগড়াটে এবং হিংস্র ও পাষণ্ড।
৯. মূল আয়াতে زَنِيمٍ (যানীম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবদের ভাষায় এ শব্দটি এমন অবৈধ সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে পরিবারের লোক নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। সাঈদ ইবনে জুবাইর এবং শা’বী বলেনঃ এ শব্দটি এমন লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যে তার অন্যায় ও দুষ্কৃতির কারণে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
এসব আয়াতে বর্ণিত বৈশিষ্টগুলো যে ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তার সম্পর্কে মুফাসিসরগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কেউ বলেছেন যে, সে ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা। কেউ আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুসের নাম উল্লেখ করেছেন। কেউ আখনাস ইবনে শুরাইককে এই ব্যক্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার কেউ কেউ অন্য ব্যক্তির প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু কুরআন মজীদে তার নাম উল্লেখ না করে শুধু বৈশিষ্টগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে সে মক্কায় বেশ পরিচিত ছিল। তাই তার নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল না। এসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা মাত্র যে কোন লোক বুঝতে পারতো, কার প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে।
﴿أَن كَانَ ذَا مَالٍۢ وَبَنِينَ﴾
১৪। কারণ সে সম্পদশালী ও অনেক সন্তানের পিতা১০
১০. এ আয়াতটির সম্পর্কে পূর্বোক্ত আয়াত গুলোর সাথেও হতে পারে এবং পরের আয়াতের সাথেও হতে পারে। পূর্বোক্ত আয়াত গুলোর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ হবে, বিপুল অর্থ-সম্পদ এবং অনেক সন্তান আছে বলে এ ধরনের লোকের দাপট ও প্রভাব-প্রতিপত্তি মেনে নিয়ো না। পরবর্তী আয়াতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ হবে, বিপুল অর্থ-সম্পদ ও অনেক সন্তান থাকার কারণে সে অহংকারী হয়েছে। তাকে আমার আয়াত শুনালে সে বলে এসব তো প্রাচীনকালের কিস্সা কাহিনী মাত্র।
﴿إِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِ ءَايَـٰتُنَا قَالَ أَسَـٰطِيرُ ٱلْأَوَّلِينَ﴾
১৫। তাকে যখন আমার আয়াত সমূহ শোনানো হয় তখন সে বলে এ তো প্রাচীনকালের কিস্সা-কাহিনী।
﴿سَنَسِمُهُۥ عَلَى ٱلْخُرْطُومِ﴾
১৬। শিগগীরই আমি তার শুঁড় দাগিয়ে দেবো।১১
১১. সে যেহেতু নিজেকে খুব মর্যাদাবান মনে করতো তাই তার নাককে শুঁড় বলা হয়েছে। নাক দাগিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে লাঞ্ছিত করা। অর্থাৎ আমি তাকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গাতেই এমন লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবো যে, এ লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে সে কখনো নিষ্কৃতি পাবে না।
﴿إِنَّا بَلَوْنَـٰهُمْ كَمَا بَلَوْنَآ أَصْحَـٰبَ ٱلْجَنَّةِ إِذْ أَقْسَمُوا۟ لَيَصْرِمُنَّهَا مُصْبِحِينَ﴾
১৭। আমি এদের (মক্কাবাসী)-কে পরীক্ষায় ফেলেছি যেভাবে পরীক্ষায় ফেলেছিলাম১২ বাগানের মালিকদেরকে, যখন তারা শপথ করেছিল যে, তারা খুব ভোরে গিয়ে অবশ্যি নিজেদের বাগানের ফল আহরণ করবে।
১২. এখানে সূরা আল কাহাফের পঞ্চম রুকূর আয়াত গুলো সামনে রাখতে হবে। সেখানেও একইভাবে উপদেশ দেয়ার জন্য দুই বাগান মালিকের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে।
﴿وَلَا يَسْتَثْنُونَ﴾
১৮। তারা এ ব্যাপারে কোন ব্যতিক্রমের সম্ভাবনা স্বীকার করছিলো না।১৩
১৩. অর্থাৎ নিজেদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার ওপর তাদের এমন আস্থা ছিল যে, শপথ করে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে ফেললো, কালকে আমরা অবশ্যই আমাদের বাগানের ফল আহরণ করবো। আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে আমরা এ কাজ করবো এতটুকু কথা বলার প্রয়োজনও তারা বোধ করেনি।
﴿فَطَافَ عَلَيْهَا طَآئِفٌۭ مِّن رَّبِّكَ وَهُمْ نَآئِمُونَ﴾
১৯। অতঃপর তোমার রবের পক্ষ থেকে একটি বিপর্যয় এসে সে বাগানে চড়াও হলো। তখন তারা ছিলো নিদ্রিত।
﴿فَأَصْبَحَتْ كَٱلصَّرِيمِ﴾
২০। বাগানের অবস্থা হয়ে গেলো কর্তিত ফসলের ন্যায়।
﴿فَتَنَادَوْا۟ مُصْبِحِينَ﴾
২১। ভোরে তারা একে অপরকে ডেকে বললোঃ
﴿أَنِ ٱغْدُوا۟ عَلَىٰ حَرْثِكُمْ إِن كُنتُمْ صَـٰرِمِينَ﴾
২২। তোমরা যদি ফল আহরণ করতে চাও তাহলে সকাল সকাল ফসলের মাঠের দিকে বেরিয়ে পড়ো।১৪
১৪. এখানে ক্ষেত শব্দ ব্যবহার করার কারণ সম্ভবত এই যে, বাগানে বৃক্ষরাজির ফাঁকে ফাঁকে কৃষিক্ষেতও ছিলো।
﴿فَٱنطَلَقُوا۟ وَهُمْ يَتَخَـٰفَتُونَ﴾
২৩। সুতরাং তারা বেরিয়ে পড়লো। তারা নীচু গলায় একে অপরকে বলছিলো,
﴿أَن لَّا يَدْخُلَنَّهَا ٱلْيَوْمَ عَلَيْكُم مِّسْكِينٌۭ﴾
২৪। আজ যেন কোন অভাবী লোক বাগানে তোমাদের কাছে না আসতে পারে।
﴿وَغَدَوْا۟ عَلَىٰ حَرْدٍۢ قَـٰدِرِينَ﴾
২৫। তারা কিছুই না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভোরে এমনভাবে দ্রুত১৫ সেখানে গেল যেন তারা (ফল আহরণ করতে) সক্ষম হয়।
১৫. আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হলো عَلَى حَرْدٍ (আলা হারদিন)। আরবী ভাষায় حَرْدٍ হারদ শব্দটি বাধা দান করা এবং না দেয়া বুঝাতেও বলা হয়, ইচ্ছা এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত বুঝাতেও বলা হয় এবং তাড়াহুড়া অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সুতরাং অনুবাদ করতে আমরা তিনটি অর্থের প্রতিই লক্ষ রেখেছি।
﴿فَلَمَّا رَأَوْهَا قَالُوٓا۟ إِنَّا لَضَآلُّونَ﴾
২৬। কিন্তু বাগানের অবস্থা দেখার পর বলে উঠলোঃ আমরা রাস্তা ভুলে গিয়েছি।
﴿بَلْ نَحْنُ مَحْرُومُونَ﴾
২৭। তাও না- আমার বরং বঞ্চিত হয়েছি।১৬
১৬. অর্থাৎ বাগান দেখে প্রথমে তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, সেটিই তাদের বাগান। তাই তারা বলেছে, আমরা পথ ভুলে হয়তো অন্য কোথাও এসে পৌঁছেছি। পরে চিন্তা করে যখন তারা বুঝতে পারলো সেটি তাদের নিজেদেরই বাগান তখন চিৎকার করে বলে উঠলোঃ আমাদের কপাল পুড়ে গেছে!
﴿قَالَ أَوْسَطُهُمْ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ لَوْلَا تُسَبِّحُونَ﴾
২৮। তাদের মধ্যকার সবচেয়ে ভাল লোকটি বললোঃ “আমি কি তোমাদের বলিনি তোমরা ‘তাসবীহ’ করছো না কেন?১৭
১৭. এর মানে যখন তারা শপথ করে বলেছিলো যে, আগামী দিন আমরা অবশ্যই বাগানের ফল আহরণ করবো তখন এ ব্যক্তি তাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিলো। সে বলেছিলো, তোমরা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছো। তোমরা ইনশাআল্লাহ বলছো না কেন? কিন্তু তারা সে কথায় কর্ণপাতও করলো না। পুনরায় যখন তারা দুস্থ ও অসহায়দের কিছু না দেয়ার জন্য সলাপরামর্শ করেছিলো তখনো সে তাদেরকে উপদেশ দিয়ে বললোঃ আল্লাহর কথা স্মরণ করো এবং এ খারাপ মনোভাব পরিত্যাগ করো। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইলো।
﴿قَالُوا۟ سُبْحَـٰنَ رَبِّنَآ إِنَّا كُنَّا ظَـٰلِمِينَ﴾
২৯। তখন তারা বলে উঠলোঃ আমাদের রব অতি পবিত্র। বাস্তবিকই আমরা গোনাহগার ছিলাম।
فَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍۢ يَتَلَـٰوَمُونَ﴾
৩০। এরপর তারা সবাই একে অপরকে তিরষ্কার করতে লাগলো।১৮
১৮. অর্থাৎ তারা একে অপরকে এই বলে দোষারোপ করতে শুরু করলো, আমরা অমুকের প্ররোচনায় আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিলাম এবং এ কুমতলব এঁটেছিলাম।
﴿قَالُوا۟ يَـٰوَيْلَنَآ إِنَّا كُنَّا طَـٰغِينَ﴾
৩১। অবশেষে তারা বললোঃ “আমাদের এ অবস্থার জন্য আফসোস! আমরা তো বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিলাম।
﴿عَسَىٰ رَبُّنَآ أَن يُبْدِلَنَا خَيْرًۭا مِّنْهَآ إِنَّآ إِلَىٰ رَبِّنَا رَٰغِبُونَ﴾
৩২। বিনিময়ে আমাদের রব হয়তো এর চেয়েও ভাল বাগান আমাদের দান করবেন। আমরা আমাদের রবের দিকে রুজু করছি
﴿كَذَٰلِكَ ٱلْعَذَابُ ۖ وَلَعَذَابُ ٱلْـَٔاخِرَةِ أَكْبَرُ ۚ لَوْ كَانُوا۟ يَعْلَمُونَ﴾
৩৩। আযাব এরূপই হয়ে থাকে। আখেরাতের আযাব এর চেয়েও বড়। হায়! যদি তারা জানতো।
﴿إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّـٰتِ ٱلنَّعِيمِ﴾
৩৪। নিশ্চিতভাবে১৯ মুত্তাকীদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে নিয়ামত ভরা জান্নাত।
১৯. মক্কার বড় বড় নেতারা মুসলমানদের বলতো, আমরা দুনিয়াতে যেসব নিয়ামত লাভ করছি তা প্রমাণ করে যে, আমরা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। আর তোমরা যে দুর্দশার মধ্যে ডুবে আছো তা প্রমাণ করে যে, তোমরা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত। তোমাদের বক্তব্য অনুসারে আখেরাত যদি হয়ও তাহলে সেখানেও মজা লুটবো আমরা। আযাব ভোগ করলে তোমরা করবে, আমরা নই। এ আয়াত গুলোতে একথারই জবাব দেয়া হয়েছে।
﴿أَفَنَجْعَلُ ٱلْمُسْلِمِينَ كَٱلْمُجْرِمِينَ﴾
৩৫। আমি কি অনুগতদের অবস্থা অপরাধীদের মতো করবো?
﴿مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ﴾
৩৬। কি হয়েছে তোমাদের? এ কেমন বিচার তোমরা করছো?২০
২০. অর্থাৎ আল্লাহ তাআ’লা অনুগত ও অপরাধীর মধ্যে কোন পার্থক্য করবেন না, এটা বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী। বিশাল বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা এমন বিচার-বুদ্ধিহীন হবেন, এটা তোমরা ধারণা করলে কিভাবে? তোমরা মনে করে নিয়েছো, এ পৃথিবীতে কারা তাঁর হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধান মেনে চললো এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকলো আর কারা তার তোয়াক্কা না করে সব রকমের গোনাহ, অপরাধ এবং জুলুম-অত্যাচার চালালো তা তিনি দেখবেন না! তোমরা ঈমানদারদের দুর্দশা ও দূরবস্থা এবং নিজেদের স্বাচ্ছন্দ ও সচ্ছলতা দেখতে পেয়েছো ঠিকই কিন্তু নিজেদের এবং তাদের নৈতিক চরিত্র ও কাজ-কর্মের পার্থক্য তোমাদের নজরে পড়েনি। তাই আগাম বলে দিয়েছো যে, আল্লাহর দরবারেও এসব অনুগতদের সাথে অপরাধীদের ন্যায় আচরণ করা হবে। কিন্তু তোমাদের মত পাপীদের দেয়া হবে জান্নাত।
﴿أَمْ لَكُمْ كِتَـٰبٌۭ فِيهِ تَدْرُسُونَ﴾
৩৭। তোমাদের কাছে কি কোন কিতাব ২১ আছে যাতে তোমরা পাঠ করে থাকো যে,
২১. অর্থাৎ আল্লাহর পাঠানো কিতাব।
﴿إِنَّ لَكُمْ فِيهِ لَمَا تَخَيَّرُونَ﴾
৩৮। তোমাদের জন্য সেখানে তাই আছে যা তোমরা পছন্দ করো।
﴿أَمْ لَكُمْ أَيْمَـٰنٌ عَلَيْنَا بَـٰلِغَةٌ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَـٰمَةِ ۙ إِنَّ لَكُمْ لَمَا تَحْكُمُونَ﴾
৩৯। তোমাদের সাথে কি আমার কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ এমন কোন চুক্তি আছে যে, তোমরা নিজের জন্য যা চাইবে সেখানে তাই পাবে?
﴿سَلْهُمْ أَيُّهُم بِذَٰلِكَ زَعِيمٌ﴾
৪০। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখো এ ব্যাপারে কে দায়িত্বশীল?২২
২২. মূল আয়াতে زَعِيمٌ (যাইম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় زعيم যাইম বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যে কোন বিষয়ের দায়িত্বশীল কিংবা কোন গোষ্ঠী বা দলের মুখপাত্র। কথাটার মানে হলো, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কি এমন দাবী করে যে, সে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে?
﴿أَمْ لَهُمْ شُرَكَآءُ فَلْيَأْتُوا۟ بِشُرَكَآئِهِمْ إِن كَانُوا۟ صَـٰدِقِينَ﴾
৪১। কিংবা তাদের স্বনিয়োজিত কিছু অংশীদার আছে কি (যারা এ বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে)? তারা তাদের সেসব অংশীদারদের নিয়ে আসুক। যদি তারা সত্যবাদী২৩ হয়ে থাকে।
২৩. অর্থাৎ নিজেদের সম্পর্কে তোমরা যা বলছো তার কোন ভিত্তি নেই। এটা বিবেক-বুদ্ধিরও পরিপন্থী। আল্লাহর কোন কিতাবে এরূপ লেখা আছে বলেও তোমরা দেখাতে পারবে না। তোমাদের মধ্য থেকে কেউ এরূপ দাবীও করতে পারে না। এ মর্মে আল্লাহর নিকট থেকে কোন রকম প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে বলেও তোমাদের মধ্য থেকে কেউ দাবী করতে পারে না। কিংবা তোমরা যাদেরকে উপাস্য বানিয়ে রেখেছো তাদের কাউকে দিয়ে একথাও তোমরা বলতে পারবে না যে, সে আল্লাহর নিকট থেকে তোমাদের জান্নাত দেয়ার দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেছে। এসব সত্ত্বেও তোমরা কি করে এ ভ্রান্ত ধারণার শিকার হলে?
﴿يَوْمَ يُكْشَفُ عَن سَاقٍۢ وَيُدْعَوْنَ إِلَى ٱلسُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ﴾
৪২। যেদিন কঠিন সময় এসে পড়বে২৪ এবং সিজদা করার জন্য লোকদেরকে ডাকা হবে। কিন্তু তারা সিজদা করতে সক্ষম হবে না।
২৪. মূল আয়াতে আছে يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ “যেদিন পায়ের গোছা অনাবৃত করা হবে” সাহাবা ও তাবেয়ীনগণের এক দলের মতে একথাটি প্রচলিত প্রবাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী প্রবাদে দুর্দিনের আগমনকে “পায়ের গোছা অনাবৃত করা” বলে বুঝানো হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসও কথাটির একই অর্থ বর্ণনা করেছেন। আরবী ভাষা থেকে তিনি এর স্বপক্ষে প্রমাণও পেশ করেছেন। হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং রাবী ইবনে আনাছ থেকে বর্ণিত অপর একটি ব্যাখ্যায় পায়ের গোছা অনাবৃত করার অর্থ করা হয়েছে সত্যকে আবরণ মুক্ত করা। এ ব্যাখ্যা অনুসারে অর্থ হবে, যেদিন সব সত্য উন্মুক্ত হবে এবং মানুষের সব কাজ কর্ম স্পষ্ট হয়ে সামনে আসবে।
﴿خَـٰشِعَةً أَبْصَـٰرُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌۭ ۖ وَقَدْ كَانُوا۟ يُدْعَوْنَ إِلَى ٱلسُّجُودِ وَهُمْ سَـٰلِمُونَ﴾
৪৩। তাদের দৃষ্টি হবে অবনত। হীনতা ও অপমানবোধ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এর আগে যখন তারা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলো তখন সিজদার জন্য তাদেরকে ডাকা হতো (কিন্তু তারা অস্বীকৃতি জানাতো)।২৫
২৫. এর মানে হলো দুনিয়াতে কে আল্লাহ তাআ’লার ইবাদাত করতো আর কে তার বিরোধী ছিলো কিয়ামতের দিন প্রকাশ্যে তা দেখানো হবে। এ উদ্দেশ্যে লোকদেরকে আল্লাহ তাআ’লার সামনে সিজদাবনত হওয়ার আহবান জানানো হবে। যারা দুনিয়াতে আল্লাহর ইবাদাত করতো তারা সাথে সাথে সিজদায় পড়ে যাবে। কিন্তু দুনিয়াতে যারা আল্লাহকে সিজদা করেনি তাদের কোমর শক্ত ও অনমনীয় হয়ে যাবে। তাদের পক্ষে ইবাদতগুজার বান্দা হওয়ার মিথ্যা প্রদর্শনী করা সম্ভব হবে না। তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
﴿فَذَرْنِى وَمَن يُكَذِّبُ بِهَـٰذَا ٱلْحَدِيثِ ۖ سَنَسْتَدْرِجُهُم مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৪৪। তাই হে নবী! এ বাণী অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে আমার ওপর ছেড়ে দাও।২৬ আমি ধীরে ধীরে এমনভাবে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না।২৭
২৬. অর্থাৎ তাদের সাথে বুঝাপড়া করার চিন্তা করো না। তাদের সাথে বুঝাপড়া করা আমার কাজ।
২৭. অজ্ঞাতসারে কাউকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার পন্থা হলো ন্যায় ও সত্যের দুশমন এবং জালেমকে এ পৃথিবীতে অধিক পরিমাণে বিলাস সামগ্রী, স্বাস্থ্য, অর্থ-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি ও পার্থিব সাফল্য দান করা যাতে সে ধোঁকায় পড়ে যায় এবং মনে করে বসে সে যা করেছে ঠিকই করেছে। তার কাজে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। এভাবে সে ন্যায় ও সত্যের সাথে শত্রুতা এবং জুলুম-অত্যাচার ও সীমালংঘনের কাজে অধিক মাত্রায় মেতে উঠে এবং বুঝেই উঠতে পারে না যে, যেসব নিয়ামত সে লাভ করেছে তা পুরস্কার নয়, বরং ধ্বংসের উপকরণ মাত্র।
﴿وَأُمْلِى لَهُمْ ۚ إِنَّ كَيْدِى مَتِينٌ﴾
৪৫। আমি এদের রশি ঢিলে করে দিচ্ছি। আমার কৌশল২৮ অত্যন্ত মজবুত।
২৮. আয়াতে كَيْدِ (কাইদি) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হলো কারো বিরুদ্ধে গোপনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কাউকে অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে এরূপ করা হলে তা খুব খারাপ কাজ। অন্যথায় এরূপ কাজে কোন দোষ নেই। বিশেষ করে কোন ব্যক্তি যদি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে এরূপ করার বৈধতা সৃষ্টি করে নিজেকে এর উপযুক্ত বানিয়ে নেয়।
﴿أَمْ تَسْـَٔلُهُمْ أَجْرًۭا فَهُم مِّن مَّغْرَمٍۢ مُّثْقَلُونَ﴾
৪৬। তুমি কি এদের কাছে কোন পারিশ্রমিক দাবী করছো যে, সে জরিমানার বোঝা তাদের কাছে দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে?২৯
২৯. এখানে দৃশ্যত রাসূলুল্লাহ সা.কে প্রশ্ন করা হচ্ছে। তবে মূল লক্ষ্য সেসব লোক যারা তাঁর বিরোধিতার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করেছিলো। তাদেরকে বলা হয়েছেঃ আমার রাসূল কি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক দাবী করেছেন যে কারণে তোমরা এতটা বিগড়ে গিয়েছো? তোমরা জানো, তিনি একজন নিঃস্বার্থ ব্যক্তি। তিনি তোমাদের কাছে যা পেশ করেছেন তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ আছে বলে তিনি মনে করেন। আর এ জন্য তিনি তা পেশ করেছেন। তোমরা না চাইলে তা মানবে না। কিন্তু এর প্রচার ও তাবলীগের ব্যাপারে এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছো কেন? (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন, সূরা আত তূরঃ টীকা ৩১)
﴿أَمْ عِندَهُمُ ٱلْغَيْبُ فَهُمْ يَكْتُبُونَ﴾
৪৭। তাদের কি গায়েবের বিষয় জানা আছে, যা তারা লিখে রাখছে?৩০
৩০. এ প্রশ্নটিও বাহ্যত রাসূলুল্লাহ সা.কে করা হয়েছে। কিন্তু আসলে প্রশ্নটি তাঁর বিরোধীদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, তোমরা কি গায়েবের পর্দার অন্তরালে উঁকি দিয়ে দেখে নিয়েছো যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল নন। আর যেসব সত্য তিনি তোমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন তাও ঠিক নয়। তাই তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য তোমরা এমন কোমর বেঁধে লেগেছো? (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, সূরা আত তূরের তাফসীরঃ টীকা৩২)
﴿فَٱصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تَكُن كَصَاحِبِ ٱلْحُوتِ إِذْ نَادَىٰ وَهُوَ مَكْظُومٌۭ﴾
৪৮। অতএব তোমার রবের চূড়ান্ত ফায়সালা পর্যন্ত ধের্য্যসহ অপেক্ষা করো।৩১ এবং মাছওয়ালার (ইউনুস আ.) মতো৩২ হয়ো না, যখন সে বিষাদ ভারাক্রান্ত৩৩ হয়ে ডেকেছিলো।
৩১. অর্থাৎ আল্লাহ তাআ’লা কর্তৃক তোমাদের বিজয় ও সাহায্য দেয়া এবং তোমাদের এসব বিরোধীদের পরাজিত করার চূড়ান্ত ফায়সালার সময় এখনও বহু দূরে। চূড়ান্ত ফয়সালার সে সময়টি আমার পূর্ব পর্যন্ত এ দ্বীনের তাবলীগ ও প্রচারের পথে যত দুঃখ-কষ্ট ও মুসিবত আসবে তা ধৈর্যের সাথে বরদাশত করতে থাকো।
৩২. অর্থাৎ ইউনূস আ. এর মত অধৈর্য হয়ে পড়ো না। অধৈর্য হয়ে পড়ার কারণে তাকে মাছের পেটে যেতে হয়েছিলো। আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালা না আসা পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা.কে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়ার পরক্ষণেই “ইউনুস আ. এর মত হয়ো না” বলা থেকে স্বতঃই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালা আসার আগেই তিনি অধৈর্য হয়ে কোন কাজ করে ফেলেছিলেন এবং এভাবে আল্লাহর অসন্তুষ্টি লাভ করেছিলেন। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনূসঃ আয়াত ৯৮, টীকা ৯৯; সূরা আল আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৭-৮৮, টীকা ৮২ থেকে ৮৫; সূরা আস সাফফাতঃ আয়াত ১৩৯ থেকে ১৪৮, টীকা ৭৮ থেকে ৮৫।
৩৩. সূরা আল আম্বিয়াতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মাছের পেটের এবং সাগরের পানির অন্ধকারে হযরত ইউনুস আ. উচ্চস্বরে এ বলে প্রার্থনা করলেনঃ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ তোমার পবিত্র সত্তা ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আসলে আমিই অপরাধী।” আল্লাহ তাআ’লা তাঁর ফরিয়াদ গ্রহণ করলেন এবং তাকে এ দুঃখ ও মুসিবত থেকে মুক্তি দান করলেন। (আয়াতঃ ৮৭-৮৮)
﴿لَّوْلَآ أَن تَدَٰرَكَهُۥ نِعْمَةٌۭ مِّن رَّبِّهِۦ لَنُبِذَ بِٱلْعَرَآءِ وَهُوَ مَذْمُومٌۭ﴾
৪৯। তার রবের অনুগ্রহ যদি তার সহায়ক না হতো তাহলে সে অপমানিত হয়ে খোলা প্রান্তরে নিক্ষিপ্ত হতো।৩৪
৩৪. এ আয়াতটিকে সূরা আস সাফ্ফাতের ১৪২ থেকে ১৪৬ পর্যন্ত আয়াত গুলোর পাশাপাশি রেখে পড়লে দেখা যাবে যে, যে সময় হযরত ইউনুস মাছের পেটে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তখন তিনি তিরষ্কারের পাত্র ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি আল্লাহর তাসবীহ করলেন এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করলেন তখন তাঁকে মাছের পেট থেকে বের করে অসুস্থ অবস্থায় এবং উন্মুক্ত ভূখণ্ডের ওপর নিক্ষেপ করা হলো। কিন্তু সে মুহূর্তে তিনি আর তিরষ্কারের পাত্র নন। মহান আল্লাহ তাঁর রহমতের সে জায়গায় একটি লতানো গাছ উৎপন্ন করে দিলেন, যাতে এ গাছের পাতা তাকে ছায়াদান করতে পারে এবং এর ফল খেয়ে তিনি ক্ষুধা ও পিপাসা নিবৃত করতে পারেন।
﴿فَٱجْتَبَـٰهُ رَبُّهُۥ فَجَعَلَهُۥ مِنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ﴾
৫০। অবশেষে তার রব তাকে বেছে নিলেন এবং নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করলেন।
﴿وَإِن يَكَادُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ لَيُزْلِقُونَكَ بِأَبْصَـٰرِهِمْ لَمَّا سَمِعُوا۟ ٱلذِّكْرَ وَيَقُولُونَ إِنَّهُۥ لَمَجْنُونٌۭ﴾
৫১। এ কাফেররা যখন উপদেশবাণী (কুরআন) শোনে তখন এমনভাবে তোমার দিকে তাকায় যেন তোমার পদযুগল উৎপাটিত করে ফেলবে৩৫ আর বলে যে, এ তো অবশ্যি পাগল।
৩৫. আমরা বলে থাকি, অমুক ব্যক্তি তার প্রতি এমনভাবে তাকালো যেন তাকে খেয়ে ফেলবে। একথাটিও ঠিক সেরকম। মক্কার কাফেরদের ক্রোধ ও আক্রোশের এ অবস্থা সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৩ থেকে ৭৭ পর্যন্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
﴿وَمَا هُوَ إِلَّا ذِكْرٌۭ لِّلْعَـٰلَمِينَ﴾
৫২। অথচ তা সারা বিশ্ব-জাহানের জন্য উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।
— সমাপ্ত —