তাফহীম ভূমিকা
শেয়ারঃ
সূরা সমূহের তাফসীর
তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা
[তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা তাফসীরের ১ম খন্ডের শুরুতে রয়েছে। আবার ভূমিকাটি স্বতন্ত্র বই আঁকারে প্রকাশিত হয়েছে কুরআনের মর্মকথা নামে।]
শিরোনামে ‘ভূমিকা’ শব্দটি দেখে কুরআন মজীদের ভূমিকা লিখতে বসে গেছি বলে ভুল ধারণা করার কোন কারণ নেই। এটা কুরআনের নয় বরং তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা। দু’টি উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমি এ ভূমিকা লেখায় হাত দিয়েছি।
একঃ কুরআন অধ্যয়নের আগে একজন সাধারণ পাঠককে এমন কিছু কথা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে যেগুলো শুরুতেই জেনে নিলে তার পক্ষে কুরআনের বক্তব্য অনুধাবন করা সহজ হয়ে যায়। নয়তো কুরআন অধ্যয়নের মাঝখানে বারবার একথাগুলো তার মনে সন্দেহ সঞ্চার করতে পারে। অনেক সময় শুধুমাত্র এগুলো না বুঝার কারণে মানুষ কুরআনের অন্তর্নিহিত অর্থের কেবলমাত্র উপরিভাগে আসতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। ভেতরে প্রবেশ করার আর কোন পথই খুঁজে পায় না।
দুইঃ কুরআন বুঝার চেষ্টা করার সময় মানুষের মনে যে প্রশ্নগুলো উদয় হয় সর্বপ্রথম সেগুলোর জবাব দেবো যে গুলোর প্রথম প্রথম আমার মনে জেগেছিল অথবা পরে আমার সামনে আসে।
কুরআন পাঠকের সংকটঃ
সাধারণত আমরা যেসব বই পড়ে থাকি তাতে থাকে একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু। একটি বিশেষ রচনাশৈলীর আওতায় এ বিষয়বস্তুর ওপর ধারাবাহিকভাবে তথ্য সরবরাহ করা হয় এবং বিভিন্ন মতামত ও যুক্তির অবতারণা করা হয়। এ জন্য কুরআনের সাথে এখনো পরিচয় হয়নি এমন কোন ব্যক্তি যখন প্রথমবার এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করতে যান তখন তিনি একটি চিরাচরিত আশা নিয়েই এগিয়ে যান। তিনি মনে করেন, সাধারণ গ্রন্থের মতো এ গ্রন্থেও প্রথম বিষয়বস্তু নির্ধারিত থাকবে, তারপর মূল আলোচ্য বিষয়কে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে বিন্যাসের ক্রমানুসারে এক একটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হবে। এভাবে জীবনের এক একটি বিভাগকে আলাদা আলাদাভাবে নিয়ে সে সম্পর্কে পূর্বোক্ত বিন্যাসের ক্রমানুসারে বিধান ও নির্দেশাবলী লিপিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু গ্রন্থটি খুলে পড়া শুরু করার পর তিনি দেখেন সম্পুর্ণ ভিন্ন এক চিত্র। তিনি এখানে দেখেন এমন একটি বর্ণনাভংগী যার সাথে ইতিপূর্বে তার কোন পরিচয় ছিল না। এখানে তিনি দেখেন
আকীদা–বিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়াবলী, নৈতিক বিধি-নির্দেশ, শরীয়াতের বিধান, দাওয়াত, উপদেশ, সতর্কবাণী, সমালোচনা-পর্যালোচনা, নিন্দা-তিরস্কার, ভীতি প্রদর্শন, সুসংবাদ সান্ত্বনা, যুক্তি-প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং ঐতিহাসিক কাহিনী ও প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের প্রতি ইংগিত। এগুলো বার বার একের পর এক আসছে। একই বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন শব্দের মোড়কে পুনর্ব্যাক্ত করা হচ্ছে। একটি বিষয়বস্তুর পর আর একটি এবং তারপর আকাঙ্খিতভাবে তৃতীয় আর একটি বিষয়বস্তু শুরু হয়ে যাচ্ছে। বরং কখনো কখনো একটি বিষয়বস্তুর মাঝখানে একটি বিষয়বস্তু অকস্মাৎ লাফিয়ে পড়ছে। বাক্যের প্রথম পুরুষ ও দ্বিতীয় পুরুষের দিক পরিবর্তন হচ্ছে বার বার এবং বক্তব্য বার বার মোড় পরিবর্তন করছে। বিষয়বস্তুগুলোকে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে বিভক্ত করার কোনো চিহ্নও নেই। ইতিহাস লেখার পদ্ধতিতে কোথাও ইতিহাস লেখা হয়নি। দর্শন ও অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াবলীকে ন্যায়শাস্ত্র ও দর্শনের ভাষায় লেখা হয়নি। মানুষ ও বিশ্ব-জাহানের বস্তু ও পদার্থের আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু জীববিদ্যা ও পদার্থ বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে করা হয়নি। সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু তাতে সমাজ বিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। আইনগত বিধান ও আইনের মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে আইনবিদদের পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে। নৈতিকতার যে শিক্ষা বিবৃত হয়েছে তার বর্ণনাভংগী নৈতিক দর্শন সম্পর্কিত বইপত্রে আলোচিত বর্ণনাভংগী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। সাধারণভাবে বইপত্রে যেভাবে লেখা হয় এসব কিছুই তার বিপরীত। এ দৃশ্য একজন পাঠককে বিব্রত করে। তিনি মনে করতে থাকেন, এটি একটি অবিন্যস্ত, অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্ত বক্তব্যের সমষ্টি এখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য ‘খণ্ড’ একত্রে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে এগুলোকে ধারাবাহিক রচনা আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিরোধিতার দৃষ্টিতে কুরআন অধ্যয়নকারীরা এরই উপর রাখেন তাদের সকল আপত্তি, অভিযোগ ও সন্দেহ-সংশয়ের ভিত। অন্যদিকে অনুকুল দৃষ্টিভংগীর অধিকারীরা কখনো অর্থের দিক থেকে চোখ বন্ধ করে সন্দেহ সংশয় থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। কখনো কখনো তারা এই আপাত অবিন্যস্ত উপস্থাপনার ব্যাখ্যা করে নিজেদের মনকে বুঝাতে সক্ষম হন। কখনো কৃত্রিম পদ্ধতিতে যোগসূত্র অনুসন্ধান করে অদ্ভুত ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হন্ আবার কখনো ‘খণ্ড রচনার’ মতবাদটি গ্রহণ করে নেন, যার ফলে প্রত্যেকটি আয়াত তার পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে আলাদা হয়ে বক্তার উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী অর্থ প্রকাশ করতে থাকে।
আবার একটি বইকে ভালোভাবে বুঝতে হলে পাঠককে জানতে হবে তার বিষয়বস্তুর উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, মূল বক্তব্য ও দাবী এবং তার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়। সেই সাথে তার বর্ণনা পদ্ধতির সাথেও পরিচিত হতে হবে। তার পরিভাষা বিশেষ বিশ্লেষণ রীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। শব্দের উপরি কাঠামোর পেছনে তার বর্ণনাগুলো যেসব অবস্থা ও বিষয়াবলীর সাথে সম্পর্কিত সেগুলোও চোখের সামনে থাকতে হবে। সাধারণত যেসব বই আমরা পড়ে থাকি তার মধ্যে এগুলো সহজেই পাওয়া যায়। কাজেই তাদের বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করা আমাদে জন্য মোটেই কঠিন হয় না। কিন্তু অন্যান্য বইতে আমরা এগুলো যেভাবে পেতে অভ্যস্ত কুরআনে ঠিক সেভাবে পাওয়া যায় না। তাই একজন সাধারণ বই পাঠকের মানসিকতা নিয়ে যখন আমাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করতে থাকেন তখন তিনি খুঁজে পান না এই কিতাবের বিষয়বস্তু, মূল বক্তব্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়। এর বর্ণনা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিও তার কাছে নতুন ও অপরিচিত মনে হয়। অধিকাংশ জায়গায় এর বাক্য ও বক্তব্যগুলোর পটভূমিও তার চোখের আড়ালে থাকে। ফলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন আয়াতের মধ্যে জ্ঞানের যে উজ্জ্বল মুক্তোমালা জড়িয়ে রয়েছে তা থেকে কম বেশী কিছুটা লাভবান হওয়া সত্ত্বেও পাঠক আল্লাহর কালামের যথার্থ অন্তর্নিহিত প্রাণসত্তার সন্ধান পায় না। এ ক্ষেত্রে কিতাবের জ্ঞান লাভ করার পরিবর্তে তাকে নিছক কিতাবের কতিপয় বিক্ষিপ্ত তত্ত্ব ও উপদেশাবলী লাভ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বরং কুরআন অধ্যয়নের পর যেসব লোকের মনে নানা কারণে সন্দেহ জাগে তাদের অধিকাংশের বিভ্রান্তির একটি কারণ হচ্ছে এই যে, কুরআনের বক্তব্য অনুধাবন করার ব্যাপারে এই মৌখিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তাদের জানা থাকে না। এরপরও কুরআন পড়তে দিয়ে তারা দেখে তার পাতায় পাতায় বিভিন্ন বিষয়বস্তু ছড়িয়ে আছে। বহু আয়াতের গভীর অর্থ তাদের কাছে অনুদ্ঘাটিত থেকে গেছে। অনেকগুলো আয়াতের মধ্যে তারা জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য পেয়েছে কিন্তু আয়াতের পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষিতে এই বক্তব্য তাদের কাছে সম্পূর্ণ বেমানান মনে হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও বর্ণনাভংগীর সাথে অপরিচত থাকার কারণে আয়াতের আসল অর্থ থেকে তারা অন্যদিকে সরে গিয়েছে এবং অধিকাংশ স্থানে পটভূমি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে এভাবে তারা মারাত্মক ধরনের বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।
সংকট উত্তরণের উপায়ঃ
কুরআন কোন ধরনের কিতাব? এটি কিভাবে অবতীর্ণ হলো? এর সংকলন ও বিন্যাসের পদ্ধতি কি ছিল? এর বিষয়বস্ত ও আলোচ্য বিষয় কি? কোন কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুর সাথে এর অসংখ্য বিভিন্ন পর্যায়ের বিষয়ালী সন্পর্কিত? নিচের বক্তব্য উপস্থাপন পদ্ধতি ও সপ্রমাণ করার জন্য এতে কোন ধরনের বর্ণনাধারা ও যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর এবং এই ধরনের আরো কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব যদি পাঠক শুরুতেই পেয়ে যান তাহলে তিনি বহুবিধ আশংকা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। তার জন্য কুরআনের অর্থ অনুধাবন ও তার মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার পথ প্রশস্ত হয়ে যেতে পারে। যে ব্যক্তি কুরআন মজীদে প্রচলিত গ্রন্থের ন্যায় রচনা বিন্যাসের সন্ধান করেন এবং এর পাতায় তার সাক্ষাত না পেয়ে চতুর্দিকে হাতড়াতে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়েন, কুরআন সম্পর্কিত এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব জানা না থাকাই তার মানসিক অস্থিরতার মূল কারণ। “ধর্ম সম্পর্কিত” একটি বই পড়তে যাচ্ছেন–এই ধারণা নিয়ে তিনি কুরআন পড়তে শুরু করেন। “ধর্ম সম্পর্কিত” এবং ‘বই’ এ দু’টোর ব্যাপারে তার মনে সাধারণত ধর্ম ও বই সম্পর্কিত ধারণাই বিরাজ করতে থাকে। কিন্তু যখন সেখানে নিজের মানসিক ধ্যান-ধারণার সম্পুর্ণ বিপরীত একটি চিত্র তিনি দেখতে পান তখন তাঁর কাছে সেটি সম্পুর্ণ অপরিচিত মনে হতে থাকে। আলোচ্য বিষযের মূল কথার নাগাল না পাওয়ার কারণে প্রতিটি বাক্যের মধ্যে তিনি এমনভাবে বিভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করতে থাকেন যেন মনে হয় যে, আপনি যে কিতাবটি পড়তে যাচ্ছেন সেটি বইপত্রের জগতে কেটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও অভিনব বই। এটির রচনাপদ্ধতিও স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্টমন্ডিত। বিষয়বস্তু, বক্তব্য বিষয় ও আলোচনা বিন্যাসের দিক দিয়েও এখানে সম্পুর্ণ অভিনব পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। কাজেই এতদিন পর্যন্ত নানা ধরনের বইপত্র পড়ে আপনার মনে বই সম্পর্কে যে একটি কাঠামোগত ধারণা গড়ে উঠেছে, এ কিতাবটি বুঝার ব্যাপারে তা আপনার কোন কাজে লাগবে না। বরং উলটো এ ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। একে বুঝতে হলে নিজের মনের মধ্যে আগে থেকেই যে সব ধারণা ও কল্পনা বাসা বেঁধে আছে সেগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে এবং এই কিতাবের অভিনব বৈশিষ্টকে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নিতে হবে।
এ প্রসংগে পাঠককে সর্বপ্রথম মূল কুরআনের সাথে পরিচিত হতে হবে। এর প্রতি তার বিশ্বাস থাকা না থাকার প্রশ্ন এখানে নেই। তবে এ কিতাবকে বুঝতে হলে প্রারন্ভিক সূত্র হিসেবে এ কিতাব নিজে এবং এর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মাদ সা. যে মূল বিষয় বিবৃত করেছেন তা গ্রহণ করতে হবে। এ মূল বিষয় নিম্নরূপঃ
১. সমগ্র বিশ্ব-জাহানের প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও একচ্ছত্র শাসক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অংশবিশেষ এ পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে দান করেছেন জানার, বুঝার ও চিন্তা করার ক্ষমতা। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার, নির্বাচন, ইচ্ছা ও সংকল্প করার এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার স্বাধীনতা দান করেছেন। এক কথায় মানুষককে এক ধরনের স্বাধীনতা (Autonomy) দান করে তাকে দুনিয়ায় নিজের খলীফা বা প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত করেছেন।
২. মানুষকে এই পদে নিযুক্ত করার সময় বিশ্ব-জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের মনে একথা দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেনঃ আমিই তোমাদের এবং সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির একমাত্র মালিক, মাবুদ ও প্রভু। আমার এই সাম্রাজ্যে তোমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নও, কারোর অধীনও নও এবং আমার ছাড়া আর কারোর তোমাদেরকে কিছু স্বাধীন ক্ষমতা ইখতিয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি আসলে তোমাদের জন্য পরীক্ষাকাল। এই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তোমাদের কাজগুলো যাঁচাই বাছাই করে আমি সিদ্ধান্ত নেবো তোমাদের মধ্য থেকে কে সফল হলো এবং কে হলো ব্যর্থ।
তোমাদের জন্য সঠিক কর্মনীতি একটিইঃ তোমারা আমাকে মেনে নেবে তোমাদের একমাত্র মাবুদ ও শাসক হিসেবে। আমি তোমাদের জন্য যে বিধান পাঠাবো সেই অনুযায়ী তোমারা দুনিয়ায় কাজ করবে। দুনিয়াকে পরীক্ষাগৃহ মনে করে এই চেতনা সহকারে জীবন যাপন করবে যেন আমার আদালতে শেষ বিচারে সফলকাম হওয়াই তোমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য। বিপরীত পক্ষে এর থেকে ভিন্নতর প্রত্যেকটি কর্মনীতি তোমাদের জন্য ভুল ও বিভ্রান্তিকর। প্রথম কর্মনীতি গ্রহণ করলে (যেটি গ্রহণ করার স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে) তোমরা দুনিয়ায় শান্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা লাভ করবে। তারপর আমার কাছে ফিরে আসলে আমি তোমাদের দান করবো চিরন্তন আরাম ও আনন্দের আবাস জান্নাত। আর দ্বিতীয় কর্মনীতিটি গ্রহণ করলে (যেটি গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা তোমাদের দেয়া হয়েছে) তোমাদের দুনিয়ায় বিপর্যয় ও অস্হিরতার মুখোমুখি হতে হবে এবং দুনিয়ার জীবন শেষ করে আখেরাতে প্রবেশকালে সেখানে জাহান্নাম নামক চিরন্তন মর্মজ্বালা দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের গভীর গর্ভে তোমরা নিক্ষিপ্ত হবে।
৩. একথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বিশ্ব-জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানব জাতির দুই সদস্য (আদম ও হাওয়া) বিশিষ্ট প্রথম গ্রুপকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্য বিধান দান করেন। এই বিধান অনুযায়ী তাদের ও তাদের সন্তান সন্ততিদের দুনিয়ার সমস্ত কাজ-কারবার চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই প্রাথমিক বংশধররা মূর্খতা, অজ্ঞতা, ও অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্টি হননি। তারা সত্যকে জানতেন। তাদেরকে জীবন বিধান দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর অনুগাত্য (অর্থাৎ ইসলাম) ছিল তাদের জীবন পদ্ধতি। তাঁরা তাদেঁর সন্তাদেরও আল্লাহর অনুগত বান্দাহ্ (মুসলিম) হিসাবে জীবন যাপন করার কথা শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শত শত বছরের জীবনাচরণে মানুষ ধীরে ধীরে এই সঠিক জীবন পদ্ধতি (অর্থাৎ দ্বীন) থেকে দূরে সরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল কর্মনীতি অবলম্বন করেছে। গাফিলতির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে তারা এক সময় এই সঠিক জীবন পদ্ধতি হারিয়ে ফেলেছে। আবার শয়তানী প্ররোচনায় একে বিকৃতও করেছে। তারা পৃথিবী ও আকাশের মানবিক ও অমানবিক এবং কাল্পনিক ও বস্তুগত বিভিন্ন সত্তাকে আল্লাহর সাথে তাঁর কাজ–কারবারে শরীক করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত যথার্থ জ্ঞানের (আল ইলম) মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কল্পনা, ভাববাদ, মনগড়া মতবাদ ও দর্শনের মিশ্রন ঘটিয়ে তারা অসংখ্য ধর্মের সৃষ্টি করেছে। তারা আল্লাহর নির্ধারিত ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ নৈত্তিক ও সাংস্কৃতিক নীতি (শরীয়াত) পরিহার বা বিকৃত করে নিজেদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও ঝোকপ্রবণতা অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্য নিজেরাই এমন বিধান তৈর করেছে যার ফলে আল্লাহর এই যমীন জুলুম-নিপীড়নে ভরে গেছে।
৪. আল্লাহ যদি তাঁর স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপথগামী মানুষদেরকে জোরপূর্বক সঠিক কর্মনীতি ও জীবনধারার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন তাহলে সেটি হতো মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত স্বাধীনতা দান নীতির পরিপন্থী। আবার এ ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই তিনি যদি মানুষকে ধ্বংস করে দিতেন তাহলে সেটি হতো সমগ্র মানব জাতিকে পৃথিবীতে কাজ করার জন্য তিনি যে সময় ও সুযোগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল।সৃষ্ঠির প্রথমদিকে থেকে তিনি যে দায়িত্বটি গ্রহণ করেছিলেন সেটি ছিল এই যে, মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে কাজের মাঝখানে যেসব সুযোগ-সুবিধে দেয়া হবে তার মধ্য দিয়েই তিনি তাকে পথনির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই নিজের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি মানব জাতির মধ্য থেকে এমন একদল লোককে ব্যবহার করতে শুরু করেন যাঁরা তাঁর ওপর ঈমান রাখতেন এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যেতেন। এদেঁরকে তিনি করেন নিজের প্রতিনিধি। এদেঁর কাছে পাঠান নিজের অলংঘনীয় বাণী। যথার্থ সত্য জ্ঞান ও জীবন যাপনের সঠিক বিধান এদেঁরকে তান কসে তিনি বনী আদমকে ভুল পথ থেকে এই সহজ সত্য পথের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দেয়ার জন্য এদেরকে নিযুক্ত করেন।
৫. এঁরা ছিলেন আল্লাহর নবী। বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে আল্লাহ তাঁর নবী পাঠাতে থাকেন। হাজার হাজার বছর থেকে তাদের আগমনের এ সিল্সিলা বা ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তাঁদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। তাঁরা সবাই একই দ্বীনের তথা জীবন পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মানুষকে যে সঠিক কর্মনীতির সাথে পরিচিত করানো হয়েছিল তাঁরা সবাই ছিলেন তারই অনুসারী তাঁরা সবাই ছিলেন একই হেদায়াতের প্রতি অনুগত। অর্থাৎ প্রথমদিন থেকেই মানুষের জন্য নৈতিক ও সমাজ-সংস্কৃতির যে চিরন্তন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছিল তাঁরা ছিলেন তারই প্রতি অনুগত। তাঁদের সবার একই মিশন ছিল। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের বংশধর, গোত্র ও জাতিকে এই দ্বীন ও হেদায়াতের দিকে আহবান জানান। তারপর যারা এ আহবান গ্রহণ করে তাদেরকে সংগঠিত করে এমন একটি উন্মাতে পরিণত করেন যাঁরা নিজেরা হন আল্লাহর আইনের অনুগত এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের আনুগত্য কায়েম করার এবং তাঁর আইনের বিরুদ্ধাচরণ প্রবণতা প্রতিরোধ করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে থাকেন। এই নবীগণ প্রত্যেকই তাঁদের নিজেদের যুগে অত্যন্ত সূচারুরূপে এ মিশনের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সবসময় দেখা গেছে মানব গোষ্টির একটি বিরাট অংশ তাঁদের দাওয়াত গ্রহণ করতে প্রস্তুতই হয়নি। আর যারা এই দাওয়াত গ্রহণ করে উন্মাতে মুসিলমার অংগীভূত হয় তারাও ধীরে ধীরে নিজেরাই বিকৃতির সাগরে তলিয়ে যেতে থাকে। এমনকি তাদের কোন কোন উম্মাত আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতকে একেবারেই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর বাণীর সাথে নিজেদের কথার মিশ্রণ ঘটিয়ে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে তার চেহারাই বিকৃত করে দেয়।
৬. সবশেষে বিশ্ব-জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরব দেশে মুহাম্মাদ সা.কে পাঠন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন নবীকে তিনি যে দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মাদ সা. এর উপরও সেই একই দায়িত্ব অর্পণ করেন। সাধারণ মানুষের সাথে সাথে পূর্বের নবীদের প্রথভ্রষ্ট উম্মাতদেরকেও তিনি আল্লাহর দীনের দিকে আহবান জানান। সবাইকে সঠিক কর্মনীতি ও সঠিক পথ গ্রহণের দাওয়াত দেন। সবার কাছে নতুন করে আল্লাহর হেদায়াত পৌছিয়ে দেয়া এবং এই দাওয়াত ও হেদায়াত গ্রহণকারীদেরকে এমন একটি উম্মাতে পরিণত করাই ছিল তাঁর কাজ যেন একদিকে আল্লাহর হেদায়াতের উপর নিজেদের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অন্যদিকে সমগ্র দুনিয়ার সংশোধন ও সংস্কার সাধনের জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে। এই দাওয়াত ও হেদায়াতের কিতাব হচ্ছে এই কুরআন। মুহাম্মাদ সা. এর উপর আল্লাহ এই কিতাবটি অবতীর্ণ করেন।
কুরআনের মুল আলোচ্যঃ
কুরআন সম্পর্কিত এই প্রাথমিক কথাগুলো জেনে নেয়ার পর পাঠকের জন্য এই কিতাবের বিষয়বস্তু, এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় ও লক্ষ্যবিন্দু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা সহজ হয়ে যায়।
এর বিষয়বস্তু মানুষ। প্রকৃত ও জাজ্জ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ কিসে-একথাই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু।
এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, আপাত দৃষ্টি, আন্দাজ-অনুমান নির্ভরতা অথবা প্রকৃত্তির দাসত্ব করার কারণে মানুষ আল্লাহ, বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা, নিজের অস্তিত্ব ও নিজের পার্থিব জীবন সম্পর্কে যেসব মতবাদ গড়ে তুলেছে এবং ঐ মতবাদগুলোর ভিত্তিতে যে দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে যথার্থ জাজ্জ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে তা সবই ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিণতির দিক দিয়ে তা মানুষের জন্য ধ্বংসকর। আসল সত্য তাই যা মানুষকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করার সময় আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছিলেন। আর এই আসল সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের জন্য ইতপূর্বে সঠিক কর্মনীতি নামে যে দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতির আলোচনা করা হয়েছে তাই সঠিক, নির্ভুল ও শুভ পরিণতির দাবীদার।
এ চুড়ান্ত লক্ষ্য ও বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে সঠিক দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বনের প্রতি আহবান জানানো এবং আল্লাহর হেদায়াতকে দ্ব্যর্থহীনভাবে পেশ করা। মানুষ নিজের গাফলতি ও অসতর্কতার দরুন এগুলো হারিয়ে ফেলেছে এবং তার শয়তানী প্রবৃত্তির কারণে সে এগুলোকে বিভিন্ন সময় বিকৃত করার কাজই করে এসেছে।
এই তিনটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে কুরআন পাঠ করতে থাকলে দেখা যাবে এই কিতাবটি তার সমগ্র পরিসরে কোথাও তার বিষয়বস্তু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং মূল লক্ষ্য ও বক্তব্য থেকে এক চুল পরিমাণো সরে পড়েনি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার বিভিন্ন ধরনের বিষয়াবলী তার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত আছে যেমন একটি মোতির মালার বিভিন্ন রংয়ের ছোট বড় মোতি একটি সূতোর বাঁধনে এক সাথে একত্রে একটি নিবিড় সম্পর্কে গাঁথা থাকে। কুরআনে আলোচনা করা হয় পৃথিবী ও আকাশের গঠনাকৃতির, মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া পদ্ধতি এবং বিশ্ব-জগতের নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণের ও অতীতের বিভিন্ন জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর। কুরআনে বিভিন্ন জাতির আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হয়। অতি প্রাকৃতিক বিষয়াবলীর ব্যাখ্যা করা হয়। এই সাথে অন্যান্য আরো বহু জিনিসের উল্লেখও করা হয়। কিন্তু মানুষকে পদার্থ বিদ্যা, জীব বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন বা অন্য কোন বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্য কুরআনে এগুলো আলোচনা করা হয়নি। বরং প্রকৃত ও জাজ্জ্বল্যমান সত্য সম্পর্ক মানুষের ভুল ধারণা দূর করা, যথার্থ সত্যটি মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দেয়া, যথার্থ সত্য বিরোধী কর্মনীতির ভ্রান্তি ও অশুভ পরিণতি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা এবং সত্যের অনুরূপ ও শুভ পরিণতির অধিকারী কর্মনীতির দিকে মানুষকে আহবান করাই এর উদ্দেশ্য। এ কারণেই এতে প্রতিটি বিষয়ের আলোচনা কেবলমাত্র ততটুকুই এবং সেই ভংগিমায় করা হয়েছে যতটুকু এবং যে ভংগিমায় আলোচনা করা তার মূল লক্ষ্যের জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজন মতো এসব বিষয়ের আলোচনা করার পর কুরআন সবসময় অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে এসেছে। একটি সুগভীর ঐক্য একাত্মতা সহকারে তার সমস্ত আলোচানা ‘ইসলাম দাওয়াত’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে ঘুরছে।
কুরআন নাযিলের পদ্ধতিঃ
কিন্তু কুরআনের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি, বিন্যাস রীতি ও তার বহুতর আলোচ্য বিষয়কে পুরোপুরি হৃদয়ংগম করতে হলে তার অবতরণের রীতি-পদ্ধতি ও অবস্থা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানলাভ করতে হবে।
মহান আল্লাহ এই কুরআনটি একবারে লিখে মুহাম্মাদ সা. এর হাতে দিয়ে এর বহুল প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে একটি বিশেষ জীবন ধারার দিকে আহবান জানাবার নির্দেশ দেননি। এটি আদৌ তেমন কোন কিতাব নয়। অনুরূপভাবে এই কিতাবে প্রচলিত রচনা পদ্ধতিতে বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের আলোচনা করা হয়নি। এ জন্য রচনা বিন্যাসের প্রচলিত পদ্ধতি এবং সাধারণভাবে যে পদধতিতে বই লেখা হয় তা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আসলে এটি একটি অভিনব ধরনের কিতাব। মহান আল্লাহ আরব দেশের মক্কা নগরীতে তাঁর এক বান্দাকে নবী করে পাঠালেন।নিজের শহর ও গোত্র (কুরাইশ) থেকে দাওয়াতের সূচনা করার জন্য তাকেঁ নির্দেশ দিলেন। এ কাজ শুরু করার জন্য প্রথম দিকে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় বিধানগুলোই তাকেঁ দেয়া হলো। এ বিধানগুলো ছিল প্রধানত তিনটি বিষয়বস্তু সন্বলিত।
একঃ নবীকে শিক্ষা দান। এই বিরাট ও মহান দায়িত্ব পালন কররা জন্য তিনি নিজেকে কিভাবে তৈরি করবেন এবং কোন পদ্ধতিতে কাজ করবেন তা তাঁকে শিখিয়ে দেয়া হলো।
দুইঃ যথার্থ সত্য সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যাবলী সরবরাহ এবং সত্য সম্পর্কে চারপাশের লোকদের মধ্যে যে ভুল ধারণাগুলো পাওয়া যেতো সংক্ষেপে সেগুলো খন্ডন। এগুলোর কারণে তারা ভল কর্মনীতি গ্রহণ করতো।
তিনঃ সঠিক কর্মনীতি দিকে আহাবান। আল্লাহর বিধানের যেসব মৌলিক চরিত্র নীতির অনুসরণ মানুষের জন্য কল্যান ও সৌভাগ্যের বার্তাবহ সেগুলো বিবৃত করা হলো।
ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বঃ
প্রথম দিকের এ বাণীগুলো দাওঢাতের সূচনাকালের পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় ছোট ছোট সংক্ষিপ্ত কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো।এগুলোর ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল, মিষ্টি-মধুর, ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী এবং যে জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তাদের রুচি অনুযায়ী সর্বোত্তম সাহিত্যরস সমৃদ্ধ। ফলে একথাগুলো মনে গেঁথে যেতো তীরের মতো। ভাষার ঝংকার ও সুর লালিত্যের কারণে এগুলোর দিকে কান নিজে নিজেই অতি দ্রুত আকৃষ্ট হতো। সময়োপযোগী এবং মনের চাহিদার সাথে সামঞ্জ্যশীল হবার কারণে জিহ্বা স্বতস্ফূর্তভাবে এগুলোর পুনরাবৃত্তি করতো। আবার এতে স্থানীয় প্রভাব ছিল অনেক বেশী। বিশ্বজনীন সত্য বর্ণনা করা হলেও সে জন্য যুক্তি, প্রমাণ ও উদাহারণ গ্রহণ করা হতো এমন নিকটতম পরিবেশ থেকে যার সাথে শ্রোতারা ভালোভাবে পরিচিত ছিল। তাদেরই ইতিহাস, ঐতিহ্য, তাদেরই প্রতিদিনের দেখা নিদর্শনসমূহ এবং তাদেরই আতীদাগত, নৈতিক ও সামাজিক ত্রুটিগুলোর ওপর ছিল সমস্ত আলোচনার ভিত।এভাবে এর প্রভাব গ্রহণ করার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল।
ইসলামী দাওয়াতের এ সূচনা পর্বটি প্রায় চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত জারী ছিল। এ পর্যায়ে নবী সা. এর ইসলাম প্রচারের তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়।
১. কতিপয় সৎকর্মশীল ব্যক্তি ইসলামী দাওয়াত গ্রহণ করেন। তাঁরা ‘মুসলিম উন্মাহ’ নামে একটি উম্মত গড়ে তুলতে প্রস্তুত হল।
২. বিপুল সংখ্যক লোক মূর্খতা স্বার্থান্ধতা বা বাপ-দাদার রসম রেওয়াজের প্রতি অন্ধ আসক্তির কারণে এই দাওয়াতের বিরোধিতা করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
৩. মক্কা ও কুরাইশদের সীমানা পেরিয়ে এই নতুন দাওয়াতের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে অপেক্ষাকৃত বিশাল বিস্তৃত এলাকায়।
ইসলামী দাওয়াতের দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ
এখান থেকে এই দাওয়াতের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়ে যায়। এ পর্যায়ে ইসলামের এই আন্দোলন ও পুরাতন জাহেলিয়াতের মধ্যে একটি কঠিন প্রাণান্তকর সংঘাত সৃষ্টি হয়। আট নয় বছর পর্যন্ত এ সংঘাত চলতে থাকে। কেবল মক্কার ও কুরাইশ গোত্রের লোকেরাই নয় বরং বিস্তীর্ন আরব ভূ-খন্ডের অধিকাংশ এলাকার যেসব লোক পুরাতন জাহেলিয়াতকে। অপরিবর্তিত রাখতে চাইছিল তারা সবাই বল প্রয়োগ করে এই আন্দোলনটির কন্ঠরোধ করে। মিথ্যা প্রচারণা চালায়। অভিযোগ, সন্দেহ, সংশয় ও আপত্তি উত্থাপন করে অসংখ্য। সাধারণ মানুষের মনে নানান প্ররোচনার বীজ বপন করে। অপরিচিত লোকেরা যাতে নবী সা. এর কথাশুনতে না পারে সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর চালায় বর্বর পাশবিক নির্যাতন। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কট করে। তাদের ওপর এত বেশী উৎপীড়ন নির্যাতন চালায় যার ফলে তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্য থেকে অনেক লোক দু’দুবার নিজেদের দেশ ত্যাগ করে আবিসিনিয়ার দিকে হিজরত করে যেতে বাধ্য হয়, অবশেষে তাদের সবাই কে মদীনার দিকে হিজরত করতে হয়। কিন্তু এই কঠিন ও ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্তেও এ আন্দোলনটি বিস্তার লাভ করতে থাকে। মক্কায় এমন কোন বংশ ও পরিবার ছিল না যার কোন না কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেনি। অধিকাংশ ইসলাম বিরোধী ভাই-বোনপো, পুত্র-কন্যা, ভগ্নী-ভগ্নীপতি ইসলামী দাওয়াতের কেবল অনুসারীই ছিল না বরং প্রাণ উৎসর্গকারী কর্মীর ভূমিকা পালন করছিল এবং তাদের কলিজার টুকরা সন্তানরাই তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জবার প্রস্তুতি নিয়েছিল–এটিই ছিল তাদের শত্রুতার তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা ও তিক্ততার কারণ। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যারা পুরাতন জাহেলিয়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেক এই নবজাত আন্দোলনে যোগদান করছিল, তারা ইতিপূবে তাদের সমাজের সর্বোত্তম লোক হিসেবে বিবিচিত হয়ে আসছিল। অতপর এই আন্দোলনে যোগদান করে তারা এতই সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও পূত চরিত্রের অধিকারী হযে উঠেছিল যে, দুনিয়াবাসীর চোখে এই আন্দোলনের শ্রেষ্টত্ব ও মাহাত্ম্য অনুভূত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। যে দাওয়াত এ ধরনের লোকদের কে নিজের দিকে আকর্ষণ করে তাদেরকে এহেন উন্নত পর্যায়ের মানবিক গুণ সম্পন্ন করে তুলছিল তার শ্রেষ্টত্ব দুনিয়াবাসীর চোখে সমুজ্জল হয়ে ওঠাই ছিল স্বাভাভিক।
এই সুদীর্ঘ ও তীব্র সংঘাতকালীন সময়ে মহান আল্লাহ পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের নবীর ওপর এমনসব আবেগময় ভাষণ অবতীর্ণ করতে থাকেন যার মধ্যে চিল স্রোতস্বিনীর গতিময়তা, বন্যার প্রচন্ড শক্তি এবং আগুনের তীক্ষ্ণতা ও তেজময়তার প্রভাব এই ভাষণগুলোর মাধ্যমে একদিকে ঈমানদারদেরকে জানানো হয়েছে তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাদের মধ্যে দলীয় চেতনা সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদেরকে তাকওয়া, উন্নত চারিত্রিক মাহাত্ম্য স্বভাব-প্রকৃতি ও আচরণবিধি শেখানো হয়েছে। আল্লাহর সত্য দ্বীন প্রচারের পদ্ধতি তাদেরকে জানানো হয়েছে। সাফল্যদানের অংগীকার ও জান্নাত লাভের সুসংবাদ দান করে তাদের হিম্মত ও মনোবল সুদূঢ় করা হয়েছে।আল্লাহর পথে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, অবিচলতা ও উন্নত মনোবল সহকারে সংগ্রাম–সাধনা চালিয়ে যাবার জন্য তাদেরকে উদ্দীপিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রাণ উৎসর্গীতার এমন বিপুল আবেগ ও উদ্দীপনা যার ফলে তারা সব রকমের বিপদের মোকাবিলা করতে এবং বিরোধিতা উত্তুংগ তুফানের সামনে অটল-অচল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে যেতে প্রস্তুত হয়েছিল। অন্যদিকে বিরোধিতাকারী, সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত এবং গাফলতির ঘুমে অচেতন জনসমাজকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে এমন সব জাতির মর্মান্তিক ও ধ্বংসকর পরিণতির চিত্র তুলে ধরে যাদের ইতিহাসের সাথে তারা পরিচিত ছিল। যেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদের ওপর দিয়ে সফর ব্যাপদেশে দিনরাত তাদের যাওয়া–আসা করতে হতো তাদেরকে শিক্ষা ও উপদেশ দেয়া হয়েছে। পৃথিবী ও আকাশের উন্মুক্ত পরিসরে দিনরাত যেসব শত শত হাজার হাজার সুস্পষ্ট নিদর্শন তাদের চোখের সামনে বিরাজ করছিল এবং নিজেদের জীবনে যেগুলোর প্রভাব তারা হরহামেশা অনুভব করছিল, সেগুলো থেকে তাদেরকে তাওহীদ ও আখেরাতের প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, শিরক ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং পরকাল অস্বীকার ও বাপ-দাদার ভ্রান্ত পথের অন্ধ অনুসৃতির ভুল ধরা হয়েছে এমন সব দ্ব্যর্থহীন যুক্তি-প্রমানের মাধ্যমে যেগুলো সহজে মন-মস্তিস্ককে প্রভাবিত করতে পারে। তারপর তাদের প্রত্যেকটি সন্দেহ-সংশয় নিরসন করা হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ জবাব দেযা হয়েছে। যেসব জটিল মানসিক সমস্যায় তারা নিজেরা ভুগছিল এবং অন্যদের মনেও যেসব সমস্যার আবর্ত সৃষ্টি করতে চাইছিল সেগুলোর কুয়াশা থেকে তাদের মনকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করেছে।এভাবে সবদিক দিয়ে ঘেরাও করে এমন সুকঠিনভাবে জাহেলিয়াতকে পাকড়াও করা হয়েছে যার ফলে বুদ্ধি–চিন্তা ও মনের জগতে তার শ্বাস ফেলার জন্য এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও থাকেনি। এই সাথে তাদের ভয় দেখানো হয়েছে আল্লাহর ক্রোধের, কিয়ামতের বিচারের ভয়াবহতার ও জাহান্নামের শাস্তির। অসৎ চরিত্র, ভুল জীবনধারা, জাহেলী রীতিনীতি, সত্যের দুশমনিও মুসলিম নিপীড়নের জন্য তাদেরকে তিরস্কার হয়েছে। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার যেসব বড় বড় মূলনীতির ভিত্তিতে দুনিয়ায় হামেশা আল্লাহর প্রিয় ও মনোনীত সৎ ও উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত রচিত হয়ে এসেছে সেগুলো তাদের সামনে পেশ করা হয়েছে।
এ পর্যায়টি বিভন্ন স্তরে বিভক্ত। প্রতিটি স্তরে দাওয়াত অধিকতর ব্যাপক হতে চলেছে। একদিকে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম এবং অন্যদিকে বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে চলেছে। বিভিন্ন আকীদা-বিশ্বাস ও বিভিন্ন কর্মধারার অধিকারী গোত্র ও দলগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেই অনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বাণীসমূহের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র বাড়তে থেকেছে। এই হচ্ছে কুরআন মজীদে অংকিত মক্কী জীবনের পটভুমি।
দাওয়াতের তৃতীয় অধ্যায়ঃ
মক্কায় এই আন্দোলন তের বছর সক্রিয় থাকার পর হঠাৎ সে মদীনায় সন্ধান পেলো একটি কেন্দ্রের। সমগ্র আরব ভূখন্ড থেকে এক এক করে নিজের সমস্ত অনুসারীদেরকে সেখানে একত্র করে নিজের সমুদয় শক্তিকে একটি কেন্দ্রে একীভুত করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে গেলো। নবী সা. এবং ইসলামের অধিকাংশ অনুসারী হিজরাত করে মদীনা পৌছে গেলেনে। এভাবে ইসলামী দাওয়াত তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করলো।
এই পর্যায়ে অবস্থার চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেলো। মুসলিম উন্মাহ একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল হলো। পুরাতন জাহেলিয়াতের ধারকদের সাথে শুরু হলো সশস্ত্র সংঘাত। আগের নবীদের উম্মাতের (ইহুদী ও নাসারা) সাথেও সংঘাত বাঁধলো। উম্মাতে মুসলিমার আভ্যন্তরীন ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করলো বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক। তাদের সাথেও লড়তে হলো। দশ বছরের কঠিন সংঘর্ষ-সংঘাতের পথ পেরিয়ে এই আন্দোলন সাফল্যের মনযিলে পৌছে গেলো সমগ্র আরব ভূখন্ডে বিস্তৃত হলো তার আধিপত্য।তার সামনে খুলে গেলো বিশ্বজনীন দাওয়াত ও সংস্কারের দুয়ার। এই পর্যায়টিও কয়েকটি স্তরে বিভক্ত। প্রত্যেক স্তরে ছিল এই আন্দোলনের বিশিষ্ট প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য বিষয়গুলো।এই প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী সা. এর ওপর এমন সব ভাষণ ও বক্তব্য অবতীর্ণ হতে থাকলো, যেগুলো কখনো হতো অনলবর্ষী বক্তৃতার মতো, কখনো হাযির হতো সেগুলো রাজকীয় ফরমান ও নির্দেশের চেহারা নিয়ে, আবার কখনো শিক্ষকের শিক্ষাদান ও অধ্যাপনা এবং সংস্কারকের উপদেশ দান ও বুঝাবার প্রচেষ্টা তার মধ্যে ফুটে উঠতো। দল ও রাষ্ট্র এবং সৎ ও সুন্দর নাগরিক জীবন কিভাবে গড়ে তুলতে হবে, জীবনের বিভিন্ন বিভাগগুলো কোন নীতি ও শৃংখল-বিধির ভিত্তিতে প্রতিষ্টিত করতে হবে, মুনাফিকদের সাতে কোন ধরনের ব্যবহার করতে হবে, যিম্মী কাফের, আহ্ লি কিতাব, যুদ্ধরত শত্রু এবং চুক্তি সূত্রে আবদ্ধ জাতিদের ব্যাপারে কোন ধরনের কর্মনীতি অবলন্বন করা হবে এবং সুসংগঠিত ঈমানদারদের এই দলটি দুনিয়ায় আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করার জন্য নিজেকে কিভাবে তৈরি করবে-এসব কথা সেখানে বিবৃত হতো। এই বক্তৃতাগুলোর মাধ্যমে মুসলমানদের শিক্ষা ও তরবিয়ত (ট্রেনিং) দান করা হতো, তাদের দুর্বলতাগুলো দূর করা হতো, আল্লাহর পথে জান-মাল দিয়ে জিহাদ করতে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হতো, জয়-পরাজয়, আরাম-মুসিবত, দুঃখ-আনন্দ, দারিদ্র-সচ্ছলতা, নিরাপত্তা-ভীতি ইত্যাদি সব ধরনের অবস্থায় সেই অবস্থার উপযোগী নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হতো। তাদেরকে নবী সা. এর পরে তাঁর স্থলভিষিক্ত হয়ে ইসলামী দাওয়াত ও সংস্কারের কাজ সম্পাদন করার যোগ্যতা সম্পন্ন করে তৈরী করা হতো। অন্যদিকে আহ্লে কিতাব, মুনাফিক, মুশরিক ও কাফের ইত্যাদি যারা ঈমানের পরিসরের বাইরে অবস্থান করছিল, তাদের সবাইকে তাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে বুঝবার, হৃদয়গ্রাহী ভাষায় দাওয়াত দেয়ার, কঠোরভাবে তিরস্কার ও উপদেশ দান করার, আল্লাহর আযাবের ভয় দেখাবার এবং শিক্ষণীয় অবস্থা ও ঘটনাবলী থেকে উপদেশ ও শিক্ষাদান করার চেষ্টা করা হতো। এভাবে সত্যকে উপস্থাপন করার ব্যাপারে তাদের সামনে কোন জড়তা বা অস্পষ্টতা থাকেনি।
এই হচ্ছে কুরআন মজীদের মাদানী সূরাগুলোর প্রেক্ষাপট।
কুরআনের বণর্নাভংগীঃ
এ বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, একটি দাওয়াতের বাণী নিয়ে কুরআন মজীদ নাজিল হওয়া শরু হয়। দাওয়াতটি শুরু হবার পর থেকে তার পূর্ণতার চূড়ান্ত মনযিলে পৌছা পর্যন্ত পূর্ব তেইশ বছরে তাকে যেসব পর্যায় ও স্তর অতিক্রম করতে হয় তাদের বিভিন্ন ও বিচিত্র প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে কুরআনের বিভিন্ন অংশ নাযিল হতে থাকে। কাজেই ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করার জন্য যেসব বইপত্র লেখা হয় সেগুলোর মতো রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তু বিন্যস্ত করার কায়দা এখানে অবলম্বিত হয়নি। আবার এই দাওয়াতের ক্রমোন্নতির সাথে সাথে কুরআনের ছোট বড় যে সমস্ত অংশ নাযিল হয় সেগুলোও কোন পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হতো না বরং বক্তৃতা ও বিবৃত্তির আকারে বর্ণনা করা হতো এবং সেভাবে প্রচারও করা হতো। তাই সেগুলোর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে লেখার নয়, বক্তৃতার বংগীমা। তারপর এই বক্তৃতাও কোন অধ্যাপকের নয় বরং একজন আহবায়কের বক্তৃতার মতো ছিল। মন, মস্তিষ্ক, বুদ্ধি ও আবেগ সবার কাছেই সে আবেদন জানাতো। তাকে সব করমের মানসিকতার মুখোমুখি হতে হতো। নিজের দাওয়াত ও প্রচার এবং কার্যকর আন্দোলনের ব্যাপারে তাকে অসংখ্য বৈচিত্রপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে হতো। সম্ভব্য সকল উপায়ে নিজের কথা মনের মধ্যে বসিয়ে দেয়া, চিন্তার জগত বদলে দেয়া, আবেগের সমুদ্রে তরংগ সৃষ্টি করা, বিরোধিতার পাহার ভেঙ্গে ফেলা, সহযোগীদের সংশোধন করা ও প্রশিক্ষণ দান এবং তাদের মধ্যে প্রেরণা, উদ্দীপনা ও দৃঢ় সংকল্প সৃষ্টি করা, শত্রুদের বন্ধু ও অস্বীকারকারীদের স্বীকারকারীতে পরিণত করা, বিরোধীদের যুক্তি-প্রমাণ খণ্ডন করা এবং তাদের নৈতিক শক্তি ছিন্নভিন্ন করা-এভাবে তাকে এমন সব কাজ করতে হতো, যা একটি দাওয়াতের ধারক বাহক এবং একটি আন্দোলনের নেতার জন্য অপরিহার্য। এ জন্য মহান আল্লাহ এই কাজ ও দায়িত্ব প্রসঙ্গে তাঁর নবীর উপর যে সমস্ত ভাষণ নাযিল করেছেন তার ধরন ও প্রকৃতি একটি দাওয়াতের উপযোগীই হয়েছে। সেখানে কলেজের অধ্যাপক সুলভ বক্তৃতাভংগী অনুসন্ধান করা উচিত নয়।
এখান থেকে আর একটি বিষয়ও সহজে বুঝতে পারা যায়। সেটি হচ্ছে, কুরআনে একই বিষয়ের আলোচনা বিভিন্ন স্থানে বারবার কেন এসেছে? একটি দাওয়াত ও একটি বাস্তব-সক্রিয় আন্দোলনের কতগুলো স্বাভাবিক চাহিদা ও দাবী রয়েছে। এই আন্দোলন যে সময় যে পর্যায়ে অবস্থান করে সে সময় সেই পর্যায়ের সাথে সামঞ্জশীল কথাই বলতে হবে। যতক্ষণ দাওয়াত এক পর্যায়ে অবস্থান করে ততক্ষণ পরবর্তী পর্যায়গুলোর প্রসংগ সেখানে উত্থাপিত হতে পারবে না। বরং সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের কথাই বারবার আলোচিত হতে হবে। এতে কয়েক মাস বা কয়েক বছর অতিক্রান্ত হলেও তার পরোয়া করা যাবে না। আবার একই বাক্যের মধ্যে একই ধরনের কথার একই ভংগীমায় পুরাবৃত্তি চলতে থাকলে তা শুনতে শুনতে কান পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং মনে বিরক্তি সঞ্চার হয়। তাই প্রতি পর্যায়ে যে কথাগুলো বারবার বলার প্রয়োজন দেখা দেবে সেগুলোকে প্রতি বার নতুন শব্দের মোড়ক, নতুন ভংগীমায় এবং রঙে সাজিয়ে, নতুন কায়দায় মার্জিত ও সুরুচিসম্পন্ন ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে যাতে সেগুলো সুখকর ভাবাবেশে মনে বদ্ধমূল হয়ে যায় এবং দাওয়াতের এক একটি মনযিল সুদৃঢ় হতে থাকে। এই সাথে দাওয়াতের ভিত্তি যেসব বিশ্বাস ও মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সেগুলোকে প্রথম পদক্ষেপ থেকে নিয়ে শেষ মনযিল পর্যন্ত কোনক্রমেই দৃষ্টির আড়াল করা যাবে না। বরং দাওয়াতের প্রতি পর্যায়ে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হতে হবে। এ কারণে দেখা যায়, ইসলামী দাওয়াতের এক পর্যায়ে কুরআন মজীদের যতগুলো সূরা নাযিল হয়েছে তার সবগুলোর মধ্যে সাধারণত একই ধরনের বিষয়বস্তু শব্দ ও বর্ণনাভংগীর খোলস পরিবর্তন করে এসেছে। তবে তাওহীদ, আল্লাহর গুণাবলী, আখেরাত, আখেরাতের জবাবদিহি, কিয়ামতে পুরস্কার ও শাস্তি, রিসালাত, কিতাবের উপর ঈমান, তাকওয়া, সরব, তাওয়াক্কুল এবং এ ধরনের অন্যান্য মৌলিক বিষয়ের আলোচনা সারা কুরআনে সর্বত্র বার বার দেখা যায়। কারণ এই আন্দোলনের কোন পর্যায়ের এই মৌলিক বিষয়গুলো থেকে চোখ বন্ধ করে রাখাকে বরদাশত করা হয়নি। এই মৌলিক চিন্তা ও ধ্যান-ধারণাগুলো সামন্য দুর্বল হয়ে পড়লে ইসলামের এই আন্দোলন কখনো তার যথার্থ প্রাণশক্তি সহকারে গতিশীল হতে পারতো না।
এহেন বিন্যাসের কারণঃ
যে ক্রমিকধারয় কুরআন নাযিল হয়েছিল একে গ্রন্থ আকারে বিন্যস্ত ও লিপিবন্ধ করার সময় নবী সা. সেই ধারা অক্ষুণ্ন রাখেননি কেন এ প্রশ্নের জবাব একটু চিন্তা করলে আমাদের এ বর্ণনায়ই পাওয়া যাবে।
ওপরের আলোচনায় আপনারা জেনেছেন, তেইশ বছর ধরে কুরআন নাযিল হয়েছে। যে ক্রমানুসারে ইসলামী দাওয়াতের সূচনা ও অগ্রগতি হয়েছে সেই ক্রমানুসারেই কুরআন নাযিল হতে থেকেছে। এখন সহজেই অনুমান করা যায়, দাওয়াত পূর্ণতা লাভ করার পর কুরআনের নাযিলকৃত অংশগুলোর এমন ধরনের বিন্যাস যা কেবল দাওয়াতের ক্রমোন্নাতির সাথে সন্পর্কিত ছিল–কোনক্রমেই সঠিক হতে পারে না। এখন তাদের জন্য দাওয়াত পূর্ণতা লাভের পর সৃষ্ট অবস্থার অধিকতর উপযোগী একটি নতুন ধরনের বিন্যাসের প্রয়োজন ছিল। কারণ শুরুতে সে এমন সব লোককে সর্বপ্রথম দাওয়াত দেয় যারা ছিল ইসলামের সাথে সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত। তাই তখন একেবারে গোড়া থেকেই শিক্ষা ও উপদেশ দানের কাজ শুরু হয়। কিন্তু দাওয়াত পরিপূর্ণতা লাভ করার পর তার প্রথম লক্ষ্য হয় এমন সব লোক যারা তার ওপর ঈমান এনে একটি উম্মাতের অন্তরভুক্ত হয়েছে এবং যাদের ওপর এই কাজ জারী রাখার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। নবী সা. এই দাওয়াতকে চিন্তা ও কর্মধারা উভয় দিক দিয়ে পূর্তা দান করার পর তাদের হাতে সোপর্দ করেছিলেন। এখন নিশ্চিতরূপে সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, নিজেদের জীবন যাপনের জন্য আইন-কানুন এবং পূর্ববর্তী নবদের উম্মাতদের মধ্যে যে সমস্ত ফিতনা সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তারপর ইসলামের সাথে অপরিচিত দুনিয়াবাসীদের কাছে আল্লাহর বিধান পেশ করার জন্য তাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া ক্রুআন মজীদ যে ধরনের কিতাব কোন ব্যক্তি গভীর মনোযোগ সহকারে তা পাঠ করার পর সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, একই ধরনের বিষয়বস্তুকে এক জায়গায় একত্র করার বিষয়টি কুরআনের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কুরআনের প্রকৃতিই দাব করে, তার পাঠকের সামনে মাদানী পর্যায়ের কথা মক্কী যুগের শিক্ষর মধ্যে, মক্কী পর্যায়ের কথা মাদানী যুগের বক্তৃতাবলীর মধ্যে এবং প্রাথমিক যুগের আলোচনা শেষ যুগের উপদেশালীর মধ্যে এবং শেষ যুগের বিধানসমূহ সূচনাকালের শিক্ষাবলীর পাশাপাশি বার বার আলোচিত হবে। এভাবে ইসলামের পূর্ণ, ব্যাপকতর ও সামগ্রিক চিত্র তার চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে। ইসলামের একটি দিক তার চোখের সামনে থাকবে এবং অন্য দিকটি থাকবে তার চোখের আড়ালে, কখনো এমনটি যেন না হয়।
তারপরও কুরআন যে ক্রমানুসারে নাযিল হয়েছিল যদি সেভাবেই তাকে বিন্যস্ত করা হতো তাহলে পরবর্তীকালে আগত লোকদের জন্য তা কেবল সেই অবস্থায় অর্থপূর্ণ হতে পারতো যখন কুরআনের সাথে সাথে তার নাযিলের ইতিহাস এবং তার এক একটি অংশের নাযিল হওয়ার অবস্থা ও পরিপ্রেক্ষিত লিখে দেয়া হতো। মহাণ আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে তাঁর বাণী একত্র করে বিন্যস্ত ও সংরক্ষণ করেছিলেন এটি ছিল তার পরিপন্থী। আল্লাহর কালামকে নির্ভেজাল অবস্থায় অন্য কোন কালাম, বাণী বা কথার মিশ্রন বা অন্তরভুক্ত ছাড়াই সংক্ষিপ্ত আকারে সংকলিত করাই ছিল আল্লাহর উদ্দেশ্য। এ কালাম পাঠ করবে যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, নারী, পুরুষ, নগরবাসী, গ্রামবাসী, শিক্ষিত সুধী, পন্ডিত, সাধারণ শিক্ষিত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ। সর্বস্তরের বুদ্ধি-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কমপক্ষে এতটুকু কথা অবিশ্যি জেনে নেবে যে তাদের মহান প্রভু তাদের কাছে কি চান এবং কি চান না। বলা বাহুল্য যদি এই সমগ্র কালামের সাথে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাসও জুড়ে দেয়া থাকতো এবং তা পাঠ করাও সবার জন্য অপরিহার্য গণ্য করা হতো তাহলে এ কালামকে সুবিন্যস্ত ও সুসংরক্ষিত করার পেছনে মহান আল্লাহর যে উদ্দেশ্য ছিল তা ব্যর্থ হয়ে যেতো।
আসলে কুরআনের বর্তমান বিন্যাসকে যারা আপত্তিকর মনে করেন তারা এই কিতাবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে কেবল অনবহিতই নন বরং তারা এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন বলে মনে হয় যে, এ কিতাবটি কেবল মাত্র ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য অবর্তীণ হয়েছে।
ক্রুআনের বর্তমান বিন্যাস সম্পর্কে পাঠকদের আর একটি কথা জেনে নেয়া উচিত। এই বিন্যাস পরবর্তীকালের লোকদের হাতে সাধিত হয়নি। বরং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নবী সা. নিজেই কুরআনের আয়াত গুলোকে এভাবে বিন্যস্ত ও সংযোজিত করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর চিরাচরিত নিয়ম ছিল, কোন সূরা নাযিল হলে তিনি তখনই নিজের কোন কাতেবকে (কুরআন লেখক) ডেকে নিতেন এবং সূরার আয়াত গুলো যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করাতেন। এরপর নির্দেশ দিতেন, এ সূরাটি অমুক সূরার পরে বা অমুক সূরার আগে বসাও। অনুরূপভাবে কখনো কুরআনের কিছু অংশ নাযিল হতো। এটাকে স্বতন্ত্র সূরার পরিণত করার উদ্দেশ্য থাকতো না। সে ক্ষেত্রে তিনি নির্দেশ দিতেন, একে অমুক সূরার অমুক সন্নিবেশ করো। অতপর এই বিন্যাস অনুযায়ী তিনি নিজে নামাযেও পড়তেন। অন্যান্য সময় কুরআন মজীদ তেলাওয়াতেও করতেন। এই বিন্যাস অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরাম কুরআন মজীদ কন্ঠস্থও করতেন। কাজেই কুরআনের বিন্যাস একটি প্রমানিত ঐতিহাসিক সত্য। যেদিন ক্রুআন মজীদের নাযিলের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যায় সেদিন তার বিন্যাসও সম্পূর্ণ হয়ে যায়। যিনি এটি নাযিল করছিলেন তিনি এটি বিন্যস্তও করেন। যাঁর হৃদয়ের পরদায় এটি নাযিল করছিলেন তাঁরই হাতে এটি বিন্যস্তও করান। এর মধ্যে অনুপ্রবেশ বা হস্তক্ষেপ করার অধিকার ও ক্ষমতাই কারোর ছিল না।
কুরআন কিভাবে সংকলিত হলোঃ
যেহেতু নামায শুরু থেকেই মুসলমানদের ওপর ফরজ ছিল [উল্লেখ্য, নবী সা. এর নবুওয়াত লাভের কয়েক বছর পর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হয়। কিন্তু সাধারণভাবে নামায ফরজ ছিল প্রথম দিন থেকেই। ইসলামের জীবনের এমন একটি মুহূর্তও অতিক্রন্ত হয়নি যখন নামায ফরয হয়নি।] এবং কুরআন পাঠকে নামাযের একটি অপরিহার্য অংশ গণ্য করা হয়েছিল, তাই কুরআন নাযিল হওয়ার সাথেসাথেই মুসলমানদের মধ্যে কুরআন কন্ঠস্থ করার প্রক্রিয়াও জারী হয়ে গিয়েছিল। কুরআন যতটুকু নাযিল হয়ে যেতো মুসলমানরা ততটুকু কন্ঠস্থও করে ফেলতো। এভাবে নবী সা. নিজের কাতেবদের সাহায্যে খেজুর পাতা, হাঁড় ও পাথর খন্ডের ওপর কুরআন লেখার যে ব্যবস্থা করেছিলেন কেবলমাত্র তার ওপর কুরআনের হেফাযত নির্ভরশীল ছিল না বরং নাযিল হবার সাথে সাথেই শত শত থেকে হাজার হাজার এবং হাজার হাজার থেকে লাখো লাখো হৃদয়ে তার নকশা আঁকা হয়ে যেতো। এর মধ্যে একটি শব্দেরও হেরফের করার ক্ষমাতা কোন শয়তানের ছিল না।
নবী সা. এর ইন্তিকালের পর আরবদেশে বেশ কিছু লোক ‘মুরদাত’ হয়ে গেলো। তাদের দমন করা এবং একদল মুসলমানের ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতে হলো। এসব যুদ্ধে এমন অনেক সাহাবা শহীদ হয়ে গেলেন যাদের সমগ্র কুরআন কন্ঠস্থ ছিল। এ ঘটনায় হযরত উমরের রা. মনে চিন্তা জাগলো, কুরআনের হেফাযতের ব্যাপারে কেবলমাত্র একটি মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল থাকা সংগত নয়। শুধু দিলের ওপর কুরআনের বাণী। অংকিত থাকলে হবে না তাকে কাগজের পাতায়ও সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তদানীন্তন খলীফা হযরত আবু বকরের রা. কাছে তিনি বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করলেন। কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করার পর তিনিও তাঁর সাথে একমত হলেন। নবী সা. এর কাতেব (সেক্রেটারী) হযরত যায়েদকে রা. এ কাজে নিযুক্ত করলেন। এ জন্য যে পদ্ধতি নির্ধারণ করা হলো তা হলো এইঃ একদিকে নবী সা. যেসব বিচ্ছিন্ন বস্তুর ওপর কুরআন লিখে গেছেন সেগুলো সংগ্রহ করা। অন্যদিকে সাহাবীদের মধ্যে যার যার কাছে কুরআনের যেসব বিচ্ছিন্ন অংশ লিখিত আছে তাদের কাছ থেকে সেগুলোও সংগ্রহ করা।
[নিভরযোগ্য সূত্র জানা যায়, রাসূলের সা. জীবদ্দশায়ই বিভিন্ন সাহাবী কুরআন বা তার বিভিন্ন অংশ লিখে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে হযরত উসমান রা., হযরত আলী রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা., হযরত সালেম মাওলা হুযাইফা রা., হযরত যায়েদ ইবনে সাবেতরা., হযরত হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা., হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. এবং হযরত আবু যায়েদ কায়েদ ইবনিস সাকান রা. এর নাম পাওয়া যায়।]
এই সাথে কুরআনের হাফেযদের থেকেও সাহায্য নেয়া। এই তিনটি মাধ্যমেকে পূর্ণরূপে ব্যবহার করে নির্ভুল হবার ব্যাপারে শতকরা একশ’ ভাগ নিশ্চয়তা ও নিশ্চন্ততা লাভ করার পর কুরআনের এক একটি হরফ, শব্দ ও বাক্য গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কুরআন মজীদের একটি নির্ভুল ও প্রামাণ্য সংকলন তৈরি করে উম্মল মু’মেনীন হযরত হাফসা রা. এর কাছে রেখে দেয়া হলো। সবাইকে তার অনুলিপি করার অথবা তার সাথে যাচাই করে নিজের পান্ডুলিপি সংশোধন করে নেয়ার সাধারণ অনুমতি দেয়া হলো।
একই ভাষা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বিভিন্ন শহর ও জেলার কথ্যভাষার মধ্যে যেমন পার্থক্য দেখা যায় আরবের বিভিন্ন এলাকার ও গোত্রের কথ্যভাষার মধ্যেও তেমনি পার্থক্য ছিল। মক্কার কুরাইশরা যে ভাষায় কথা বলতো কুরআন মজীদ সেই ভাষায় নাযিল হয়। কিন্তু প্রথম দিকে বিভন্ন এলাকা ও গোত্রের লোকদের তাদের নিজ নিজ উচ্চারণ ও বাকভংগী অনুযায়ী তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কারণ এভাবে পড়ায় অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য হতো না। কেবলমাত্র বাক্য তাদের জন্য একটু কোমল ও মোলায়েম হয়ে যেতো। কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলাম বিস্তার লাভ করলো। আরববাসীরা নিজেদের মরুভূমির এলাকা পেরিয়ে দুনিয়ার একটি বিশাল বিস্তীর্ণ অংশ জয় করলো। অন্যান্য দেশের ও জাতির লোকেরা ইসলামের চতুঃসীমার মধ্যে প্রবেশ করতে লাগলো। আরব ও অনারবের ব্যাপকতর মিশ্রণে আরবী ভাষা প্রভাবিত হতে থাকলো। এ সময় আশংকা দেখা দিল, এখনো যদি বিভিন্ন উচ্চারণ ও বাকরীতিতে কুরআন পড়ার অনুমতি অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে এর ফলে নানা ধরনের ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যেমন, এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে অপরিচিত পদ্ধতিতে কুরআন পড়তে শুনে সে সেচ্ছাকৃতভাবে কুরআনে বিকৃতি সাধন করেছে বলে তার সাথে বিরোধে ও সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। অথবা এই শাব্দিক পার্থক্য ধীরে ধীরে বাস্তব বিকৃতির দ্বার উন্মুক্ত করে দেবে। অথবা এই আরব অনারবের মিশ্রণের ফলে যেসব লোকের ভাষা বিকৃত হবে তারা নিজেদের বিকৃত ভাষা অনুযায়ী কুরআনের মধ্যে হস্তক্ষেপ করে তার বাক সৌন্দর্যের বিকৃতি সাধন করবে। এ সমস্ত কারণে হযরত উসমান রা. অন্যান্য সাহাবয়ে কেরামদের সাথে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সমগ্র ইসলামী দুনিয়ায় একমাত্র হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর নির্দেশে লিখিত কুরআন মজীদের নুসখা (অনুলিপিই) চালু করা হবে। এ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত উচ্চারণ ও বাকরীতিরে লিখিত নুসখার প্রকাশ ও পাঠ নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হবে।
আজ যে কুরআন মজীদটি আমাদের হাতে আছি সেটি হযরত আবু বকর সিদ্দীকের রা. নুসখার অনুলিপি। এই অনুলিপিটি হযরত উসমান রা. সরকারী ব্যবস্থাপনায় সারা দুনিয়ার দেশে দেশে পাঠিয়েছিলেন। বর্তমানেও দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে কুরআনেকর সেই প্রামান্য নুসখাগুলো পাওয়া যায়। কুরআন মজীদ সঠিকভাবে সংরক্ষিত হবার ব্যাপারে যদি কারোর মনে সামান্যতমও সংশয় থাকে তাহলে মানসিক সংশয় দূর করার জন্য তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দিয়ে সেখানকার কোর বই বিক্রতার দোকান থেকে এক খন্ড কুরআন মজীদ কিনে নিতে পারেন। তারপর সেখান থেরক চলে আসতে পারেন আফ্রিকা ইন্দোনেশিয়ার জাভায়। জাভার কোন হাফেযো মুখে কুরআনের পাঠ শুনে পশ্চম আফ্রিকা থেকে কেনা তাঁর হাতের নোসখাটির সাথে তা মিলিয়ে দেখতে পারেন। তারপর দুনিয়ার বড় বড় গ্রন্থাগারগুলোয় হযরত উসমানের রা. আমল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তকার যতগুলো কুরআনের নুসখা রক্ষিত আছে সবগুলোর সাথে সেটি মিলাতে পারেন। তিনি যদি তার মধ্যে কোন একটি হরফ নোকতার পার্থক্য দেখতে পান তাহলে সারা দুনিয়াকে এই অভিনব আবিস্কারের খবরটি জানানো তাঁর অবশ্যি কর্তব্য। কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহকারী সন্দেহ করতে পারেন। কিন্তু যে কুরআনটি আমাদের হাতে আছে সেটি সামান্যতম হেরফের ও পরিবর্তন ছাড়াই মুহাম্মাদ সা. এর ওপর যে কুরআনটি নাযিল হয়েছিল এবং যেটি তিনি দুনিয়ার সামনে পেশ করেছিলেন তারই হুবহু অনুলিপি, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। এমন অকাট্য সাক্ষ্য–প্রমাণ সন্বলিত সত্য দুনিঢার ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। এরপরও যদি কেউ এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন তাহলে বলতে হয়, দুনিয়ায় কোন কালে রোমান সাম্রাজ্য বলে কোন সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল এবং মোগল রাজবংশ কোন দিন ভারত শাসন করেছেন অথবা দুনিয়ায় নেপোলিয়ান নামক কোন ব্যক্তি ছিলেন–এ ব্যাপারেও তিনি অবশ্যি সন্দেহ পোষণ করবেন। এ ধরনের ঐতিহাসিক সত্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা জ্ঞানের নয়, বরং অজ্ঞতারই প্রমাণ।
কুরআন অধ্যায়নের পদ্ধতিঃ
কুরআন একটি অসাধারণ গ্রন্থ। দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ অসংখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআনের দিকে এগিয়ে আসে। এদের সবার প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে কোন পরামর্শ দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয়। এ বিপুল সংখ্যক অনুসন্ধানীদের মধ্যে যারা একে বুঝতে চান এবং এ কিতাবটি মানুষের জীবন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভূমিকা পালন করে এবং তাকে কিভাবে পথ দেখায় একথা যারা জানতে চান আমি কেবল তাদের ব্যাপারেই আগ্রহী। এ ধরনের লোকদের কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আমি এখানে কিছু পরামর্শ দেবো। আর এই সংগে সাধারণত লোকেরা এ ব্যাপারে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তারও সমাধান করার চেষ্টা করবো।
কোন ব্যক্তি কুরআনের ওপর ঈমান রাখুন আর নাই রাখুন তিনি যদি এই কিতাবকে বুঝতে চান তাহলে সর্বপ্রথম তাঁকে নিজের মন-মস্তিস্ককে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা ও মতবাদ এবং অনুকুল–প্রতিকুল উদ্দেশ্য ও স্বার্থচিন্তা থেকে যথাসম্ভব মুক্ত করতে হবে। এ কিতাবটি বুঝার ও হৃদয়ংগম করার নির্ভেজাল ও আন্তরিক উদ্দেশ্য নিয়ে এর অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। যারা মনের মধ্যে বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা পুষে রেখে এ কিতাবটি পড়েন তারা এর বিভিন্ন ছত্রের মাঝখানে নিজেদের চিন্তাধারাই পড়ে যেতে থাকেন। আসল কুরআনের সামান্য বাতাসটুকুও তাদের গায়ে লাগে না। দুনিয়ার যে কোন বই পড়ার ব্যাপারেও এ ধরনের অধ্যয়ন রীতি ঠিক নয়। আর কুরআন তো এই ধরনের পাঠকের জন্য তার অন্তর্নিহিত সত্য ও গভীর তাৎপর্যময় অর্থের দুয়ার কখনোই উন্মুক্ত করে না।
তারপর যে ব্যক্তি কুরআন সম্পর্কে ভাসাভাসা জ্ঞান লাভ করতে চায় তার জন্য সম্ভবত একবার পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। কিন্তু যে এর অর্থের গভীরে নামতে চায় তার জন্য তো দু’বার পড়ে নেয়াও যথেষ্ট হতে পারে না। অবশ্যি তাকে বার বার পড়তে হবে।প্রতি বার একটি নতুন ভংগীমায় পড়তে হবে। একজকন ছত্রের মতো পেন্সিল ও নোটবই সাথে নিয়ে বসতে হবে। এভাবে যারা কুরআন পড়তে প্রস্তুত হবে, কুরআন যে চিন্তা ও কর্মধারা উপস্থাপন করতে চায় তার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনটা যেন তাদের সামনে ভেসে ওঠে কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তাদের অন্ততপক্ষে দু’বার এই কিতাবটি পড়তে হবে। এই প্রাথমিক অধ্যয়নের সময় তাদের কুরআনরে সমগ্র বিষয়বস্তুর ওপর ব্যাপকভিত্তিক জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করতে হবে। তাদের দেখতে হবে, এই কিতাবটি কোন কোন মৌলিক চিন্তা পেশ করে এবং সেই চিন্তাধারার ওপর কিভাবে জীবন ব্যবস্থার অট্টালিকার ভিত গড়ে তোলে, এ সময়-কালে কোন জায়গায় তার মনে যদি কোন প্রশ্ন জাগে বা কোন খট্কা লাগে, তাহলে তখনি সেখানেই সে সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সেটি নোট করে নিতে হবে এবং ধৈয্য সহকারে সামনের দিকে অধ্যয়ন জারী রাখতে হবে। সামনের দিকে কোথাও না কোথাও তিনি এর জবাব পেয়ে যাবেন, এরি সন্ভাবনা বেশী। জবাব পেয়ে গেলে নিজের প্রশ্নের পাশাপাশি সেটি নোট করে নেবেন। কিন্তু প্রথম অধ্যয়নের পর নিজের কোন প্রশ্নের জবাব না পেলে ধৈয্য সহকারে দ্বিতীয় বার অধ্যয়ন করতে হবে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারে, দ্বিতীয়বার গভীর মনোয়োগ সহকারে অধ্যয়ন করার পর কালেভদ্রে কোন প্রশ্নের জবাব অনুদঘাটিত থেকে গেছে।
এভাবে কুরআন সম্পর্কে একটি ব্যাপক দৃষ্টিভংগী লাভ করার পর এর বিস্তারিত অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। এ প্রসংগে পাঠককে অবশ্যি কুরআনের শিক্ষার এক একটি দিক পূর্ণরূপে অনুধাবন করার পর নোট করে নিতে হবে। যেমন মানবতার কোন ধরনের আদর্শ তার কাছে গৃণার্হ ও প্রত্যাখ্যাত–একথা তাকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নেয়ার জন্য তাকে নিজের নোট বইতে একদিকে লিখতে হবে ‘পছন্দনীয় মানুষ’ এবং অন্যদিকে লিখতে হবে ‘অপছন্দনীয় মানুষ’ এবং উভয়ের নীচে তাদের বৈশিষ্ট ও গুণাবলী লিখে যেতে হবে। অথবা যেমন, তাকে জানার চেষ্টা করতে হবে, কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি কোন কোন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল এবং কোন কোন জিনিসকে সে মানবতার জন্য ক্ষতিকরক ও ধ্বংসাত্মক গণ্য করে–এ বিষয়টিকেও সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতবাবে জানার জন্য আগের পদ্ধতিই অবলন্বন করতে হবে। অর্থাৎ নোট বইতে কল্যাণের জন্য অপরিহার্য বিষয়সমূহ এবং ‘ক্ষতির জন্য অনিবার্য বিষয়সমূহ’ এই শিরোনামে দু’টি পাশাপাশি লিখতে হবে। অতপর প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়ন করার সমকয় সংশ্লিষ্ট বিষয় দু’টি সম্পর্কে নোট করে যেতে হবে। এ পদ্ধতিতে আকিদা-বিশ্বাস, চরিত্র-নৈতিকতা, অদিকার, কতর্ব্য, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন, দলীয় সংগঠন-শৃংখলা, যুদ্ধ, সন্ধি এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়াবলী সম্পর্কে কুরআনের বিধান নোট করতে হবে এবং এর প্রতিটি বিভাগের সামগ্রিক চেহারা কি দাড়ায়, তারপর এসবগুলোকে এক সাথে মিলালে কোন ধরনের জীবন চিত্র ফুটে ওঠে, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে।
আবার জীবনের বিশেষ কোন সমস্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে হলে এবং সে ব্যাপারে কুরআনের দৃষ্টিভংগী জানতে হলে সেই সমস্যা সন্পর্কিত প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এই অধ্যয়নের মাধ্যমে তাকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার মৌলিক বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে। মানুষ আজ পর্যন্ত সে সম্পর্কে কি কি চিন্তা করেছে এবং তাকে কিভাবে অনুধাবন করেছে? কোন কোন বিষয় এখনো সেখানে সমাধানের অপেক্ষায় আছে? মানুষের চিন্তার গাড়ি কোথায় গিয়ে আটকে গেছে? এই সমাধানযোগ্য সমস্যা ও বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। কোন বিষয় সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভংগী জানার এটিই সবচেয়ে ভালো ও সুন্দর পথ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এভাবে কোন বিষয়ে গবেষণাও অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যয়ন করতে থাকলে এমন সব আয়াতের মধ্যে নিজের প্রশ্নের জওয়াব পাওয়া যাবে যেগুলো ইতিপূর্বে কয়েকবার পড়া হয়ে থাকলও এই তত্ত্ব সেখানে লুকিয়ে আছে একথা ঘুণাক্ষরেও মনে জাগেনি।
কুরআনের প্রাণসত্তা অনুধাবনঃ
কিন্তু কুরআন বুঝার এই সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে কাজ করার বিধান ও নির্দেশ নিয়ে কুরআন এসেছে কার্যত ও বাস্তবে তা না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কুরআনের প্রাণসত্তার সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারে না। এটা নিছক কোন মতবাদ ও চিন্তাধারার বই নয়। কাজেই আরাম কেদারায় বসে বসে এ বইটি পড়লে এর সব কথা বুঝতে পারা যাবার কথা নয়। দুনিয়ায় প্রচলিত ধর্ম চিন্তা অনুযায়ী এটি নিছক একটি ধর্মগ্রন্থও নয়। মাদরাসায় ও খানকাহে বসে এর সমস্ত রহস্য ও গভীর তত্ত্ব উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। শুরুতে ভূমিকায় বলা হয়েছে, এটি একটি দাওয়াত ও আন্দোলনের কিতাব। সে এসেই এই নীরব প্রকৃতির সৎ ও সত্যনিষ্ট ব্যক্তি নির্জন ও নিঃসংগ জীবন ক্ষেত্র থেকে বের করে এনে আল্লাহ বিরোধী দুনিয়ার মোকাবিলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার কন্ঠে যুগিয়েছে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ধ্বনি। যুগের কুফরী, ফাসেকী ও ভ্রষ্টতার পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে তাকে প্রচন্ড সংঘাতে লিপ্ত করেছে। সচ্চরিত্র সম্পন্ন সত্যনিষ্ঠ লোকদেরকে প্রতিটি গৃহাভ্যন্তর থেকে খুঁজে বের করে এনে সত্যের আহবায়কের পতাকাতলে সমবেত করেছে। দেশের প্রতিটি এলাকার ফিতনাবাজ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে বিক্ষুদ্ধ ও উত্তেজিত করে সত্যানুসারীদের সাথে তাদের যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। এক ব্যক্তির আহবানের মাধ্যমে নিজের কাজ শুরু করে খিলাফতে ইলাহীয়ার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত পূর্ণ তেইশ বছর ধরে এই কিতাবটি এই বিরাট ও মহান ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেছে। হক ও বাতিলের এই সদীর্ঘ ও প্রাণান্তকর সংঘর্ষকালে প্রতিটি মনযিল ও প্রতিটি পর্যায়েই সে একদিকে ভাঙ্গার পদ্ধতি শিখিয়েছে এবং অন্যদিকে পেশ করেছে গড়ার নকশা। এখন বলুন, যদি আপনি ইসলাম ও জাহেলিয়াত এবং দীন ও কুফররি সংগ্রামে অংশগ্রহণই না করেন, যদি এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মনযিল অতিক্রম করার সুযোগই আপনার ভাগ্যে না ঘটে, তাহলে নিছক কুরআনের শব্দগুলো পাঠ করলে তার সমুদয় তত্ত্ব আপনার কেমন করে উদঘাটিত হয়ে যাবে? কুরআনকে পুরোপুরি অনুধাবন করা তখনই সম্ভব হবে যখন আপনি নিজেই কুরআনের দাওয়াত নিয়ে উঠবেন, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার কাজ শুরু করবেন এবং এই কিতাব যেভাবে পথ দেখায় সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে থাকবেন। একমাত্র তখনই কুরআন নাযিলের সময়কালীন অভিজ্ঞতাগুলো আপনি লাভ করতে সক্ষম হবেন। মক্কা, হাবশা (বর্তমান ইথিয়োপিয়া) ও তায়েফের মনযিলও আপনি দেখবেন। বদর ও ওহোদ থেকে শুরু করে হুনাইন ও তাবুকের মনযিলও আপনার সামনে এসে যাবে। আপনি আবু জেহেল ও আবু লাহাবের মুখোমুখি হবেন। মুনাফিক ও ইহুদিদের সাক্ষাতও পাবেন। ইসলামের প্রথম যুগের উৎসর্গীয় প্রাণ মু’মিন থেকে নিয়ে দুর্বল হৃদয়ের মু’মিন পর্যন্ত সবার সাথেই আপনার দেখা হবে। এক ধরনের ‘সাধনা’। একে আমি বলি “কুরআনী সাধনা।” এই সাধন পথে ফুটে ওঠে এক অভিনব দৃশ্য। এর যতগুলো মনযিল অতিক্রম করতে থাকবেন তার প্রতিটি মনযিলে কুরআনের কিছু আয়াত ও সূরা আপনা আপনি আপনার সামনে এসে যাবে। তারা আপনাকে বলতে থাকবে –এই মনযিলে তারা অবতীর্ণ হয়েছিল এবং সেখানে এই বিধানগুলো এনেছিল। সে সময় অভিধান, ব্যাকরণ অলংকার শাস্ত্রীয় কিছু তত্ত্ব সাধকের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে কিন্তু কুরআন নিজের প্রাণসত্তাকে তার সামনে উম্মুক্ত করতে কার্পণ্য করবে, এমনটি কখনো হতে পারে না।
আবার এই সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কুরআনের বিধানসমূহ, তার নৈতিক শিক্ষাবলী, তার অর্থনৈতিকও সাংস্কৃতিক বিধি বিধান এবং জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে তার প্রণীত নীতি-নিয়ম ও আইনসমূহ বুঝতে পারবে না যতক্ষণ না সে বাস্তবে নিজের জীবনে এগুলো কার্যকর করে দেখবে। যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে কুরআনের অনুসৃতি নেই সে তাকে বুঝতে পারবে না। আর যে জাতির সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান কুরআন বিবৃত পথ ও কর্মনীতির বিপরীত দিকে চলে তার পক্ষেও এর সাথে পরিচিত হওয়া সম্ভব নয়।
কুরআনী দাওয়াতের বিশ্বজনীনতাঃ
কুরআন সমগ্র বিশ্ব মানবতাকেব পথ দেখাবার দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছে, একথা সবাই জানে। কিন্তু কুরআন পড়তে বসেই কোন ব্যক্তি দেখতে পায়, সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার নাযিল হবার সমকালীন আরববাসীদেরকে লক্ষ্য করেই তার বক্তব্য পেশ করেছে। তবে কখনো কখনো মানব জাতি ও সাধারণ মানুষকেও সন্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এমন সব কথা বলে যা আরববাসীদের রুচি-অভিরুচি, আরবের পারিপার্শিক পরিবেশ, ইতিহাস ও রীতিনীতির সাথেই সন্পর্কিত। এসব দেখে এক ব্যক্তি চিন্তা করতে থাকে, সমগ্র মানব জাতিকে পথ দেখাবার জন্য কিতাবটি অবতীর্ন হয়েছিল তার মধ্যে সাময়িক, স্থানীয় ও জাতীয় বিষয়বস্তু ও উপাদান এত বেশী কেন? এ বিষয়টির তাৎপর্য অনুধাবন না করার কারণে অনেকের মনে সন্দেহে জাগে। তারা মনে করেন, সম্ভবত এ কিতাবটি সমকালীন আরববাসীদের সংশোধন ও সংস্কারের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীকালে জোরপূর্বক টানা হেঁচড়া করে তাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য জীবন বিধান গণ্য করা হয়েছে।
যে ব্যক্তি নিছক অভিযোগ হিসেবে নয় বরং বাস্তবে কুরআন বুঝার জন্য এ ধরনের অভিযোগ আনেন তাকে আমি একটি পরামর্শ দেবো। প্রথমে কুরআন পড়ার সময় সেই সমস্ত স্থানগুলো একটু দাগিয়ে রাখুন যেখানে কুরআন কেবল মাত্র আরবদের জন্য এবং প্রকৃতপক্ষে স্থান–কাল ও সময় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এমন আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা বা ভাবধারা অথবা নৈতিক বিধান বা কার্যকর নিয়ম-কানুন উপস্থাপন করেছে। কুরআন একটি বিশেষ স্থানে একটি বিশেষ যুগের লোকদেরকে সন্বোধন করে তাদের মুশরিকী বিশ্বাস ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং তাদেরই আশেপাশের জিনিসগুলোকে ভিত্তি করে তাওহীদের পক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ দাঁড় করায়–নিছক এতটুকু কথার ভিত্তিতে কুরআনের দাওয়াত ও তার আবেদন স্থানীয় ও সাময়িক, একথা বলা যথেষ্ট হবে না। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, শিরকের প্রতিবাদে সে যা কিছু বলে তা কি দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিটি শিরকের ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে খাপ খেয়ে যায় না যেমন আরবের মুশরিকদের শিরকের সাথে খাপ খেয়ে গিয়েছিল? সেই একই যুক্তি প্রমাণগুলোকে কি আমরা প্রতিটি যুগের ও প্রতিটি দেশের মুশরিকদের চিন্তার পরিশুদ্ধি করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি না? আর তাওহীদের প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনী প্রমাণ পদ্ধতিকে কি সামান্য রদবদল করে সবসময় ওসব জায়গায় কাজে লাগানো যেতে পারে না? জবাব যদি ইতিবাচক হয়ে থাকে, তাহলে একটি বিশ্বজনীন শিক্ষা কেবল মাত্র একটি বিশেষ কালে একটি বিশেষ জাতিকে সন্বোধন করে দান করা হয়েছিল বলেই তাকে স্থানীয় ও সাময়িক বলার কোন কারণই থাকতে পারে না। দুনিয়ায় এমন কোন দর্শন, জীবন, জীবন ব্যবস্থা ও চিন্তা দর্শন নেই যার প্রথম থেকে নিয়ে শেষ অবধি সমস্ত কথাই বস্তুনিরপেক্ষ (অনংঃৎধপঃ) বর্ণনাভংগীতে পেশ করা হয়েছে। বরং কোন একটি বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে তার ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এ ধরনের পূর্ণ বস্তু নিরপেক্ষতা সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও তা নিছক কাজীর গরুর মতো খাতাপত্রেই থাকবে, গোয়ালে তার নামনিশানাও দেখা যাবে না। কাজেই মানুষের জীবনের সাথে সংযুক্ত হয়ে তার পক্ষে কোন বাস্তব বিধানের রূপ নেয়া কোন দিনই সম্ভব হবে না।
তাছাড়া কোন চিন্তামূলক, নৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে সন্প্রসারিত করতে চাইলে তার আদৌ এর কোন প্রয়োজন নেই। বরং যথার্থই বলতে হয়, শুরু থেকেই তাকে আর্ন্তজাতিক বানাবার চেষ্টা করা তার জন্য কল্যানকরও নয়। আসলে তার জন্য সঠিক ও বাস্তবসম্মত পন্থা একটিই। এই আন্দোলনটে যেসব চিন্তাধারা, মতবাদ ও মূলনীতির ভিত্তিতে মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাকে পূর্ণ শক্তিতে সেই দেশেই পেশ করতে হবে যেখান থেকে তার দাওয়াতের সূচনা হয়েছে। সেই দেশের লোকদের মনে এই দাওয়াতের তাৎপর্য অংকিত করে দিতেহবে, যাদের ভাষা, স্বভাব, প্রকৃতি, অভ্যাস ও আচরণের সাথে আন্দোলনের আহবায়ক নিজে সুপরিচিত। তারপর তাঁকে নিজের দেশেই ঐ মূলনীতিগুলো বাস্তবায়িত করে তার ভিত্তিতে একটি সফল জীবন ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ স্থাপন করতে হবে। তবেই তো দুনিয়ার অন্যান্য জাতিরা তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে তাকে অনুধাবন করতে ও নিজের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবে। কাজেই কোন চিন্তা ও কর্মব্যবস্থাকে প্রথমে শুধুমাত্র একটি জাতির সামনে পেশ করা হয়েছিল এবং কেবলমাত্র তাদেরকেই বুঝাবার ও নিশ্চিন্ত করার জন্য যুক্তি প্রদর্শনের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল বলেই তা নিছক একটি জাতীয় দাওয়াত ও আন্দোলন–একথা বলার পেছনে কোন যুক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে একটি জাতীয় ও একটি আর্ন্তজাতিক এবং একটি সাময়িক ও একটি চিরন্তর ব্যবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তার বিশেষত্বগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারেঃ জাতীয় ব্যবস্থা হয় একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপাত্য বা তার বিশেষ অধিকারসমূহের দাবিদার। অথবা তার নিজের মধ্যে এমন কিছু নীতি ও মতাদর্শ থাকে যা অন্যান্য জাতির মধ্যে ঠাঁই পেতে পারে না। বিপরীত পক্ষে আর্ন্তজাতিক ব্যবস্থা আর্ন্তজাতিক ব্যবস্থা সকল মানুষের মর্যাদা হয় সমান, তাদের সমান অধিকার দিতেও সে প্রস্তুত হয় এবং তার নীতিগুলোর মধ্যেও বিশ্বজনীনতার সন্ধান পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে একাটি সাময়িক ব্যবস্থা অবশ্যি এমন কিছু নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যেগুলো কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার সমস্ত কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। আর এর বিপরতি পক্ষে একটি চিরন্তন ব্যবস্থার নীতিগুলো সব রকমের পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে চলে। এই বৈশিষ্ঠ্যগুলো দৃষ্টির সামনে রেখে যদি কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করেন এবং যে বিষয়গুলোর কারণে সত্যি সত্যিই কুরআন উপস্থাপিত ব্যবস্থাকে সাময়িক বা জাতীয় হবার ধারণা পোষণ করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হবেন, এতে সন্দেহ নেই।
পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধানঃ
কুরআন সম্পর্কে সাধারণ পাঠকও শুনেছেন যেমন এটি একটি বিস্তারিত পথনির্দেশনা, জীবন বিধান ও আইন গ্রন্থ। কিন্তু কুরআন পড়ার পর সেখানে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তরিত নির্দেশনা ও বিধি-বিধানের সন্ধান সে পায় না। বরং সে দেখে, নামায ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরযও–যার ওপর কুরআন বার বার জোর দিয়েছে, তার জন্যও এখানে যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিধান বিস্তারিতভাবে দান করা হয়নি। কাজেই এ কিতাবটি কোন অর্থে একটি পথনির্দেশনা ও জীবন বিধান তা বুঝতে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। পাঠকের মনে এ সম্পর্কে সন্দেহ জাগে।
সত্যের একটি দিক মানুষের দৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে যাওয়ার কারণেই এ ব্যাপারে যাবতীয় সমস্যা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেবল এই কিতাবটিই নাযিল করেননি, তিনি এই সাথে একজন পয়গান্বরও পাঠিয়েছেন। আসল পরিকল্পনাটাই যদি হতো লোকদের হাতে এবং কেবলমাত্র একটি গৃহনির্মাণের নক্শা দিয়ে দেয়া এবং তারপর তারা সেই অনুযায়ী নিজেদের ইমারতটি নিজেরাই বানিয়ে নেবে, তাহলে এ অবস্থায় নিসন্দেহে গৃহনির্মাণ সংক্রান্ত ছোট বড় প্রতিটি খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ আমাদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু গৃহনির্মাণের নির্দেশের সাথে সাথে যখন একজন ইঞ্জিনিয়ারও সরকারীভাবে নিযুক্ত হয় এবং তিনি ঐ নির্দেশ অনুযায়ী একটি ইমারতও তৈরি করে ফেলেন তখন ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর নির্মিত ইমারতটিকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নক্শার মধ্যে সমগ্র ছোট বড় খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত চিত্র সন্ধান করা এবং সেখানে তা না পেয়ে নক্শাটার বিরুদ্ধে অসন্পুর্ণতার অভিযোগ আনা কোনক্রমেই সঠিক হতে পারে না। কুরআন খুঁটিনাটি বিষয়রে বিস্তারিত বিবরণ সন্বলিত কোন কিতাব নয়। বরং এই কিতার মূলনীতি ও মৌলিক বিষয়গুলোই উপস্থাপিত হয়েছে। এর আসল কাজ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার চিন্তাগত ও নৈতিক ভিত্তিগুলোর কেবল পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ সহকারে উপস্থাপনাই নয় বরং এই সংগে বৈজ্ঞানিক যুক্তি–প্রমাণ ও আবেগময় আবেদনের মাধ্যমে এগুলোকে প্রচন্ড শক্তিশালী ও দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ করা। অন্যদিকে ইসলামী জীবনধারার বাস্তব কাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে কুরআন মানুষকে জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত নীতি–নিয়ম ও আইন বিধান দান করে না করং জীবনের প্রতিটি বিভাগের চৌহদ্দি বাতলে দেয় এবং সুস্পষ্টভাবে এর কয়েকটি কোণে নিশান ফলক গেঁড়ে দেয়। এ থেকে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর গঠন ও নির্মাণ কোন পথে হওয়া উচিত, তা জানা যায়। এই নির্দেশনা ও বিধান অনুযায়ী বাস্তবে ইসলামী জীবনধারার কাঠামো তৈরি করা নবী সা. এর কাজ ছিল দুনিয়াবাসীদের সামনে কুরআন প্রদত্ত মূলনীতি ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তি চরিত্র এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব আদর্শ উপস্থাপন করার জন্যই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
বৈধ মতপার্থক্যঃ
আর একটি প্রশ্ন এই প্রসংগে সাধারণভাবে লোকদের মনে জাগে। প্রশ্নটি হচ্ছে, একদিকে কুরআন এমন সব লোকের কঠোর নিন্দা করে যারা আল্লাহর কিতাব অবতীর্ণ হবার পরও মতবিরোধ, দলাদলি ও ফেরকাবন্দির পথে পাড়ি জমায় এবং এভাবে নিজেদের দীনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ও খন্ডিত করে। অথচ অন্যদিকে কুরআনের বিধানের অর্থ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পরবর্তীকালের আলেমগণই নন, প্রথম যুগের ইমামগণ, তাবেঈন ও সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যেও বিপুল মতবিরোধ পাওয়া যায়। সম্ভবত বিধান সন্বলিত এমন একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না যার ব্যাখ্যায় সবাই একমত হয়েছেন। তাহলে কুরআনে উল্লেখিত নিন্দা কি এদের ওপর প্রযোজ্য হবে? যদি এরা ঐ নিন্দার পাত্র না হয়ে থাকেন, তাহলে কুরআন কোন ধরনের মতবিরোধ ও দলাদলির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে?
এটি একটি বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। এখানে এ ধরনের আলোচনার সুযোগ নেই। কুরআনের একজন সাধারণ পাঠক ও একজন প্রাথমিক জ্ঞানার্জনকারীর সংশয় দূর করার জন্য এখানে কেবল সামান্য একটু ইংগিত দেয়াই যথেষ্ট মনে করি। দীন ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একমত এবং ইসলামী দলীয় সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ থেকেও নিছক ইসলামী জীবন বিধান ও আইনের ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে আন্তরিক মতবিরোধের প্রকাশ ঘটে কুরআন তার বিরোধী নয়। বিপরীত পক্ষে কুরআন এমন ধরনের মতবিরোধের নিন্দা করে, যার সূচনা হয় স্বার্থন্ধতা ও বক্র দৃষ্টির মাধ্যমে এবং অবশেষে তা দলাদলি ও পারস্পরিক বিরোধে পরিণত হয়। এই দুই ধরনের মতবিরোধ মূলত একই পর্যায়ের নয় এবং ফলাফলের দিক দিয়েও উভয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। কাজেই একই লাঠি দিয়ে উভয়কে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং উভয়ের বিরুদ্ধে একই হুকুম জারী করা উচিত নয়। প্রথম ধরনের মতবিরোধ উন্নতির প্রাণকেন্দ্র ও মানুষের জীবনে প্রাণস্পন্দন স্বরূপ। বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল লোকদের সমাজে এর অস্তিত্ব পাওয়া যাবেই। এর অস্তিত্বই জীবনের আলামত। যে সমাজে বুদ্ধির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে বরং সেখানে রক্তমাংসের মানুষের পরিবর্তে কাঠের মানুষেরা বিচরণ করছে একমাত্র সেখানেই এর অস্তিত্ব থাকতে পারে না আর দ্বিতীয় ধরনের মতবিরোধটির ব্যাপারে সারা দুনিয়ার মানুষই জানে, যে দেশে ও যে সমাজে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তার অস্তিত্ব স্বাস্থ্যের নয়, রোগের আলামত। কোন উম্মাতকে সে শুভ পরিণতির দিকে এগিয়ে দিতে পারেনি। এই উভয় ধরনের মতবিরোধের পার্থক্যের চেহারাটি নিম্নোক্তভাবে অনুধাবন করুনঃ
এক ধরনের মতপার্থক্যে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যর ক্ষেত্রে সমগ্র ইসলামী সমাজে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বসম্মতিক্রমে জীবন বিধানের উৎস হিসাবে মেনে নেয়া হবে। এরপর দু’জন আলেম কোন অমৌলিক তথা খুঁটিনাটি বিষয়ের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অথবা দু’জন বিচারক কোন মামলার সিদ্ধান্ত দানে পরন্পরের সাথে বিরোধ করবেন, কিন্তু তাদের কেউই এই বিষয়টিকে এবং এর মধ্যে প্রকাশিত নিজের মতামতকে দীনের ভিত্তিতে পরিণত করবেন না। আর এই সাথে তার সংগে মতবিরোধকারীকে দীন থেকে বিচ্যুত ও দীন বহির্ভূত গণ্য করবেন না। বরং উভয়েই নিজেদের যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ পেশ করে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী অনুসন্ধানের হক আদায় করে দেবেন। সাধারণ জনমত, অথবা বিচার বিভাগীয় বিষয় হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অথবা সামাজিক বিসয় হলে ইসলামী সমাজ সংগঠনই উভয় মতের মধ্য থেকে যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করে নেবে অথবা চাইলে উভয়মতই গ্রহণ করে নেবে–এটা তাদের নির্বাচনের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
দ্বিতীয় ধরনের মতপার্থক্য করা হবে দীনের মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে। অথবা যে বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দীনের মৌলিক বিষয় বলে গণ্য করেননি এমন কোন বিষয়ে কোন আলেম, সুফী, মুফতী, নীতি শাস্ত্রবিদ বা নেতা নিজে একটি মত অবলন্বন করবেন এবং অযথা টেনে হেঁচড়ে তাকে দীনের মৌলিক বিষয়ে পরিণত করে দেবেন, তারপর তার অবলন্বিত মতের বিরোধী মত পোষনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকেই দীন ও মিল্লাত বহির্ভূত গণ্য করবেন। এই সংগে নিজের একটি সমর্থক দল বানিয়ে এই মর্মে প্রচারণা চালাতে থাকবেন যে, আসল উম্মাতে মুসলিমা তো এই একটি দলই মাত্র, বাদবাকি সবাই হবে জাহান্নামের ভাগীদার। উচ্চকন্ঠে তারা বলে যেতে থাকবে মুসলিম হও যদি এই দলে এসে যাও, অন্যথায় তুমি মুসলিমই নও।
কুরআনের আলোচনায় এই দ্বিতীয় ধরনের মতবিরোধ, দলাদলি ও ফেরকাবন্দির বিরোধিতা করা হয়েছে। আর প্রথম ধরনের মতবিরোধের কতিপয় ঘটনা তো নবী সা. এর নিজের সামনেই উপস্থাপিত হয়েছিল। তিনি এটিকে কেবল বৈধই বলেননি বরং এর প্রশংসাও করেছেন। কারণ এ মতবিরোধ প্রমাণ করছিল যে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে চিন্তা-ভাবনা করার, অনুসন্ধান–গবেষণা চালাবার এবং সঠিকভাবে বুদ্ধি প্রয়োগ করার যোগ্যতা সম্পন্ন লোকের অস্তিত্ব রয়েছে। সমাজের বুদ্ধিমান ও মেধা সম্পন্ন লোকেরা নিজেদের দীন ও তার বিধানের ব্যাপারে আগ্রহী। তাদের বুদ্ধিবৃত্তি দীনের বাইরে নয়, তার চৌহদ্দির মধ্যেই জীবন সমস্যার সমাধান খুঁজতে তৎপর। ইসলামী সমাজ সামগ্রিকভাবে মূলনীতিতে ঐক্যবদ্ধ থেকে নিজের ঐক্য অটুট রেখে এবং নিজের জ্ঞানবান ও চিন্তাশীল লোকদেরকে সঠিক সীমারেখার মধ্যে অনুসন্ধান চালাবার ও ইজতিহাদ করার স্বাধীনতা দান করে উন্নতি ও অগ্রগতির পথ খোলা রাখার স্বর্ণোজ্জল ঐতিহ্যের পতাকাবাহী
هذا من عندي، والعلم عند الله، عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ
[আমি যা সত্য মনে করলাম তা এখানে প্রকাশ করলাম। আর আমল সত্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে আছে। আমার সমস্ত নির্ভরতা একমাত্র তাঁরই ওপর এবং তাঁরই কাছে আমাকে ফিরে যেতে হবে।]
কুরআন অধ্যয়নকালে একজন পাঠকের মনে যতো রকমের প্রশ্নের উদয় হয় তার সবগুলোর জবাব দেয়ার জন্য আমি এ ভূমিকা ফাঁদিনি। কারণ এ প্রশ্নগুলোর মধ্যে এমন বহু প্রশ্ন রয়েছে যেগুলো কোন না কোন আয়াত বা সূরা পাঠকালে মনে জাগে। সেগুলোর জবাব তাফহীমুল কুরআনের সংশ্লিষ্ট অংশে যথাস্থানেই দেয়া হয়েছে। কাজেই এ ধরনের প্রশ্নগুলো বাদ দিয়ে আমি এখানে কেবলমাত্র এমন সব প্রম্নের জবাব দিয়েছি সামগ্রিকভাবে যা সমগ্র কুরআনের সাথে সন্পর্কিত। কাজেই পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ, শুধুমাত্র এই ভূমিকাটুকু পড়েই একে অস্পূর্ণ হবার ধারণা নিয়ে বসে থাকবেন না। বরং সমগ্র গ্রন্থখানি পাঠ করুন। তারপর দেখুন আপনার মনে এমন কোন প্রশ্ন রয়েছে কি–না যার জবাব পাওয়া যায়নি অথবা জবাব যথেষ্ট বলে আপনার মনে হয়নি। এ ধরনের কোন প্রশ্ন থাকলে গ্রন্থকারকে জানাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।*
*গ্রন্থাকার অবশ্যি ১৯৭১ সালে ইন্তেকাল করেছেন। কাজেই তাঁর কাছে প্রশ্ন করার আর কোন সুযোগই নেই। তবে আমার মনে হয় এ গ্রন্থ পাঠ করার পর পাঠকদের যদি কোথাও কোন অতৃপ্তি থেকে যায়, তাহলে গ্রন্থকারের বিশাল সাহিত্য ভান্ডারের মধ্যে খুঁজলে তার জবাব পাওয়া যাবে। কারণ ইসলামী আন্দোলনের জন্য গ্রন্থকার যে সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করে গেছেন তার উৎস এই কুরআন এবং তাফহীমুল কুরআন। জীবনের সূচনা লগ্ন থেকে নিয়ে যেদিন থেকে তিনি কলম হাতে নিয়েছেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই কুরআনী দাওয়াতের সন্প্রসারণের কাজই করে গেছেন। কাজই এ ক্ষেত্রে তাঁর সাহিত্য ভান্ডার তাঁর মূর্তমান প্রতিনিধি।
— সমাপ্ত —
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.