আল যিলযাল

নামকরণঃ

প্রথম আয়াতে যিলযালাহা زِلۡزَالَهَا শব্দ থেকে এই নামকরণ করা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কালঃ

এর মক্কী বা মাদানী হবার ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে মাসউ’দ রা., আতা, জাবের ও মুজাহিদ বলেন, এটি মক্কী সূরা। ইবনে আব্বাসের রা. একটি উক্তিও এর সমর্থন করে। অন্যদিকে কাতাদাহ ও মুকাতিল বলেন, এটি মাদানী সূরা। এর মাদানী হবার সমর্থনে ইবনে আব্বাসেরও রা. আর একটি উক্তি পাওয়া যায়। ইবনে আবী হাতেম হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে যে রেওয়ায়াতটি উদ্ধৃত করেছেন তার থেকেও এর মাদানী হবার সমর্থনে প্রমাণ পেশ করা হয়। তাতে বলা হয়েছেঃ যখন فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ – وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَه  আয়াতটি নাযিল হয় তখন আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে বললামঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি আমার আমল দেখবো?” তিনি জবাব দিলেন, ‘হাঁ’। আমি বললাম, “এই বড় বড় গোনাহগুলোও দেখবো?” জবাব দিলেন, ‘হাঁ’। বললাম, “আর এই ছোট ছোট গোনাহগুলোও?” জবাব দিলেন, ‘হাঁ’। একথা শুনে আমি বললাম, “তাহলে তো আমি মারা পড়েছি।” তিনি বললেন, “আনন্দিত হও, হে আবু সাঈদ কারণ প্রত্যেক নেকী তার নিজের মতো দশটি নেকীর সমান হবে।” এই হাদীস থেকে এই সূরাটির মাদানী হবার ভিত্তিমূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. মদীনার অধিবাসী ছিলেন। ওহোদ যুদ্ধের পরে তিনি বালেগ হন। তাই যদি তাঁর উপস্থিতিতে নাযিল হয়ে থাকে তাহলে এর মাদানী হওয়া উচিত। কিন্তু আয়াত ও সূরার শানেনুযুল বর্ণনা সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেঈগণের যে পদ্ধতি ছিল তা ইতিপূর্বে সূরা দাহর এর ভূমিকায় আমি বর্ণনা করে এসেছি। তা থেকে জানা যায়, কোন আয়াত সম্পর্কে সাহাবীর একথা বলা যে, এ আয়াতটি অমুক ঘটনা প্রসংগে নাযিল হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট আয়াতটির ঐ সময় নাযিল হওয়ার চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। হতে পারে হযরত আবু সাঈদ জ্ঞান হবার পর যখন সর্বপ্রথম আয়াতটি রাসূলুল্লাহ সা. এর মুখ থেকে শুনেন তখন তার শেষ অংশ তাঁর মনে ভীতির সঞ্চার করে থাকবে এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে ওপরে বর্ণিত প্রশ্নগুলো করে থাকবেন। আর এই ঘটনাটিকে তিনি এমনভাবে বর্ণনা করে থাকবেন যাতে মনে হবে এই আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সা.কে এই প্রশ্নগুলো করেন। যদি এই হাদীসটি সামনে না থাকে তাহলে কুরআনকে বুঝে অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই অনুভব করবেন এটি একটি মক্কী সূরা। বরং এর বক্তব্য বিষয় ও বর্ণনাভঙ্গী থেকে অনুভূত হবে, এটি মক্কায় প্রাথমিক যুগে এমন সময় নাযিল হয় যখন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে ইসলামের বুনিয়াদি আকিদা-বিশ্বাস মানুষের সামনে পেশ করা হচ্ছিল।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ

এর বিষয়বস্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবন এবং সেখানে দুনিয়ায় করা সমস্ত কাজের হিসেব মানুষের সামনে এসে যাওয়া। সর্বপ্রথম তিনটি ছোট ছোট বাক্যে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর মানুষের দ্বিতীয় জীবনের সূত্রপাত কিভাবে হবে এবং মানুষের জন্য তা হবে কেমন বিস্ময়কর। তারপর দু’টি বাক্যে বলা হয়েছে, মানুষ এই পৃথিবীর বুকে অবস্থান করে নিশ্চিন্তে সব রকমের কাজ করে গেছে। সে কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই নিষ্প্রান জিনিস কোনদিন তার কাজকর্মের পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহর হুকুমে সেদিন সে কথা বলতে থাকবে। প্রত্যেকটি লোকের ব্যাপারে সে বলবে, কোন সময় কোথায় সে কি কাজ করেছিল। তারপর বলা হয়েছে, সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের নিজেদের কবর থেকে বের হয়ে দলে দলে আসতে থাকবে। তাদের কর্মকাণ্ড তাদেরকে দেখানো হবে। এমন পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিতভাবে এই কর্মকাণ্ড পেশ করা হবে যে, সামান্য বালুকণা পরিমাণ নেকী বা পাপও সামনে এসে যাবে।

তরজমা ও তাফসীর

পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে

﴿إِذَا زُلْزِلَتِ ٱلْأَرْضُ زِلْزَالَهَا﴾

যখন পৃথিবীকে প্রবলবেগে ঝাঁকুনি দেয়া হবে

১. মূল শব্দগুলো হচ্ছেزُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا  যালযালাহু’ মানে হচ্ছে, একাদিক্রমে পরপর জোরে জোরে ঝাড়া দেয়া কাজেই زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ  বলতে ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে এবং ভূমিকম্পের পর ভূমিকম্পের মাধ্যমে পৃথিবীকে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে দেয়া হবে আর যেহেতু পৃথিবীকে নাড়া দেবার কথা বলা হয়েছে তাই এ থেকে আপনা-আপনিই এই অর্থ বের হয়ে আসে যে, পৃথিবীর কোন একটি অংশ কোন একটি স্থান বা অঞ্চল নয় বরং সমগ্র পৃথিবীকে কম্পিত করে দেয়া হবে তারপর এই নাড়া দেবার এই ভূকম্পনের ভয়াবহতা আরো বেশী করে প্রকাশ করার জন্য তার সাথে বাড়তি زِلْزَالَهَا  শব্দটিও বসিয়ে দেয়া হয়েছে এ শব্দটির শাব্দিক মানে হচ্ছে, “কম্পিত হওয়া” অর্থাৎ তার মতো বিশাল ভূগোলককে যে ভাবে ঝাঁকানি দিলে কাঁপে অথবা যেভাবে ঝাঁকানি দিলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে ভীষণভাবে কাঁপে ঠিক সেভাবে তাকে ঝাঁকানি দেয়া হবে কোন কোন মুফাসসির এই কম্পনকে প্রথম কম্পন ধরে নিয়েছেন তাদের মতে কিয়ামতের প্রথম পর্বের সূচনা হবে যে কম্পন থেকে এটি হচ্ছে সেই কম্পন অর্থাৎ যে কম্পনের পর দুনিয়ার সব সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার সমগ্র ব্যবস্থাপনা ওলট-পালট হয়ে যাবে কিন্তু মুফাসসিরগণের একটি বড় দলের মতে যে কম্পনের মাধ্যমে কিয়ামতের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে অর্থাৎ যখন আগের পিছের সমস্ত মানুষ পুনর্বার জীবিত হয়ে উঠবে, এটি সেই কম্পন এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি বেশী নির্ভুল কারণ পরবর্তী সমস্ত আলোচনায় এই বিষয়টির প্রকাশ ঘটেছে

﴿وَأَخْرَجَتِ ٱلْأَرْضُ أَثْقَالَهَا﴾

পৃথিবী তার ভেতরের সমস্ত ভার বাইরে বের করে দেবে

২. এই বিষয়টি সূরা ইনশিকাকের ৪ আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে وَأَلْقَتْ مَا فِيهَا وَتَخَلَّتْ  আর যা কিছু তার মধ্যে রয়েছে তা বাইরে নিক্ষেপ করে দিয়ে খালি হয়ে যাবে” এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে একঃ মরা মানুষ মাটির বুকে যেখানে যে অবস্থায় যে আকৃতিতে আছে তাদের সবাইকে বের করে এনে সে বাইরে ফেলে দেবে আর পরবর্তী বাক্য থেকে একথা প্রকাশ হচ্ছে যে, সে সময় তাদের সমস্ত শরীরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশগুলো এক জায়গায় জমা হয়ে নতুন করে আবার সেই একই আকৃতি সহকারে জীবিত হয়ে উঠবে যেমন সে তার প্রথম জীবনের অবস্থায় ছিল দুইঃ এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, কেবলমাত্র মরা মানুষদেরকে সে বাইরে নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হবে না বরং তাদের প্রথম জীবনের সমস্ত কথা ও কাজ এবং যাবতীয় আচার-আচরণের রেকর্ড ও সাক্ষ্য-প্রমাণের যে বিশাল স্তূপ তার গর্ভে চাপা পড়ে আছে সেগুলোকেও বের করে বাইরে ফেলে দেবে পরবর্তী বাক্যটিতে একথারই প্রকাশ ঘটেছে তাতে বলা হয়েছে, যমীন তার ওপর যা কিছু ঘটেছে তা বর্ণনা করবে তিনঃ কোন কোন মুফাসসির এর তৃতীয় একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন সেটি হচ্ছে, সোনা, রূপা, মণিমাণিক্য এবং অন্যান্য যেসব মূল্যবান সম্পদ ভূ-গর্ভে সঞ্চিত রয়েছে সেগুলোর বিশাল বিশাল স্তূপ ও সেদিন যমীন উগড়ে দেবে মানুষ দেখবে, এগুলোর জন্য তারা দুনিয়ায় প্রাণ দিতো এগুলো কবজা করার জন্য তারা পরস্পর হানাহানি ও কাটাকাটি করতো হকদারদের হক মেরে নিতো চুরি ডাকাতি করতো, জলে-স্থলে দস্যুতা করতো যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো এবং এক একটি সম্প্রদায় ও জাতিকে ধ্বংস করে দিতো আজ এসব কিছু তাদের সামনে উপস্থিত অথচ এগুলো এখন আর তাদের কোনো কাজে লাগবে না বরং উল্টো তাদের জন্য আযাবের সরঞ্জাম হয়ে রয়েছে

﴿وَقَالَ ٱلْإِنسَـٰنُ مَا لَهَا﴾

আর মানুষ বলবে, এর কি হয়েছে?

৩. মানুষ অর্থ প্রত্যেকটি মানুষ হতে পারে কারণ পুনরায় জীবন লাভ করে চেতনা ফিরে পাবার সাথে সাথেই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া এটিই হবে যে, এসব কি হচ্ছে? এটা যে হাশরের দিন একথা সে পরে বুঝতে পারবে আবার মানুষ অর্থ আখেরাত অস্বীকারকারী মানুষ ও হতে পারো কারণ যে বিষয়কে অসম্ভব মনে করতো তা তার সামনে ঘটে যেতে থাকবে এবং সে এসব দেখে অবাক ও পেরেশান হবে তবে ঈমানদারদের মনে এ ধরনের বিস্ময় ও পেরেশানি থাকবে না কারণ তখন তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও প্রত্যয় অনুযায়ীই সবকিছু হতে থাকবে সূরা ইয়াসিনের ৫২ আয়াতটি এই দ্বিতীয় অর্থটি কতকটা সমর্থন করে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে সময় আখেরাত অস্বীকারকারীরা বলবেঃ مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا  কে আমাদের শয়নাগার থেকে আমাদের উঠালো?” এর জবাব আসবেঃ هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ  এটি সেই জিনিস যার ওয়াদা করুণাময় করেছিলেন এবং আল্লাহর পাঠানো রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন” ঈমানদাররাই যে কাফেরদেরকে এই জবাব দেবে, এ ব্যাপারে এই আয়াতটি সুস্পষ্ট নয় কারণ আয়াতে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি তবে ঈমানদারদের পক্ষ থেকে তারা এই জবাব পাবে, এ সম্ভাবনা অবশ্যি এখানে আছে

﴿يَوْمَئِذٍۢ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا﴾

সেদিন সে তার নিজের (ওপর যা কিছু ঘটেছে সেই) সব অবস্থা বর্ণনা করবে

৪. হযরত আবু হুরাইরা রা. রেওয়ায়াত করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. এ আয়াতটি পড়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “জানো তার সেই অবস্থা কি?” লোকেরা জবাব দেয়, আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন রাসূল সা. বলেনঃ “সেই অবস্থা হচ্ছে, যমীনের পিঠে প্রত্যেক মানব মানবী যে কাজ করবে সে তার সাক্ষ্য দেবে সে বলবে, এই ব্যক্তি অমুক দিন অমুক কাজ করেছিল এই হচ্ছে সেই অবস্থা, যা যমীন বর্ণনা করবে” (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে জারীর, আবদ ইবনে হুমাইদ, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া এবং বায়হাকী ফিশশুআ’ব) হযরত রাবআহ আল খারাশী রেওয়ায়াত করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “যমীন থেকে তোমরা নিজেদেরকে রক্ষা করে চলবে কারণ এ হচ্ছে তোমাদের মূল ভিত্তি আর এমনকোন ব্যক্তি নেই যে এর ওপর ভালো মন্দ কোনো কাজ করে এবং সে তার খবর দেয় না” (মু’জামুত তাবরানী) হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন যমীন এমন প্রতিটি কাজ নিয়ে আসবে যা তার পিঠের ওপর করা হয়েছে” তারপর তিনি এই আয়াতটি তেলাওয়াত করেন (ইবনে মারদুইয়া, বায়হাকী) হযরত আলী রা. সংক্রান্ত জীবনীগ্রন্থে লিখিত হয়েছেঃ বায়তুলমালের সমুদয় সম্পদ যখন তিনি হকদারদের মধ্যে বণ্টন করে সব খালি করে দিতেন তখন সেখানে দু’রাকাত নফল নামায পড়তেন তারপর বলতেনঃ “তোকে সাক্ষ্য দিতে হবে, আমি তোকে সত্য সহকারে ভরেছি এবং সত্য সহকারে খালি করেছি

যমীনের ওপর যা কিছু ঘটে গেছে তার সবকিছু সে কিয়ামতের দিন বলে দেবে, যমীন সম্পর্কে একথাটি প্রাচীন যুগে মানুষকে অবাক করে দিয়ে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই কারণ তারা মনে করে থাকবে, যমীন আবার কেমন করে কথা বলবে? কিন্তু আজ পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত নতুন নতুন জ্ঞান-গবেষণা, আবিষ্কার–উদ্ভাবন এবং সিনেমা, লাউড স্পীকার, রেডিও, টেলিভিশন, টেপ রেকর্ডার ও ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদির আবিষ্কারের এ যুগে যমীন তার নিজের অবস্থা ও নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী কিভাবে বর্ণনা করবে একথা অনুধাবন করা মোটেই কঠিন নয় মানুষ তার মুখ থেকে যা কিছু উচ্চারণ করে তার পূর্ণ অবয়ব বাতাসে, রেডিও তরঙ্গে, ঘরের দেয়ালে, মেঝে ও ছাদের প্রতি অণু-পরমাণুতে এবং কোন পথে, ময়দানে বা ক্ষেতে কোন কথা বলে থাকলে সেখানকার প্রতিটি অণু কণিকায় তা গেঁথে আছে আল্লাহ‌ যখনি চাইবেন একথাগুলোকে এসব জিনিসের মাধ্যমে তখনই হুবহু ঠিক তেমনিভাবে শুনিয়ে দিতে পারবেন যেভাবে সেগুলো একদিন মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সে সময় মানুষ নিজের কানেই নিজের এই আওয়াজ শুনে নেবে তার পরিচিতিজনেরাও তার এই আওয়াজ চিনে নেবে এবং তারা একে তারই কন্ঠধ্বনি ও বাকভঙ্গীমা বলে সনাক্ত করবে তারপর মানুষ যমীনের যেখানেই যে অবস্থায় যেকোনো কাজ করেছে তার প্রতিটি নড়াচড়া ও অঙ্গভঙ্গীর প্রতিচ্ছবি তার চারপাশের সমস্ত বস্তুতে পড়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে সেসব চিত্রায়িত হয়ে রয়েছে একেবারে নিকষ কালো আঁধারের বুকে সে কোনো কাজ করে থাকলেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীন এমনসব রশ্মি রয়েছে যেগুলোর কাছে আলো-আঁধার সমান, তারা সকল অবস্থায় তার ছবি তুলতে পারে এসব ছবি কিয়ামতের দিন একটি সচল ফিল্মের মতো মানুষের সামনে এসে যাবে এবং সারাজীবন সে কোথায় কি করেছে তা তাকে দেখিয়ে দেবে

আসলে প্রত্যেক মানুষের কর্মকাণ্ড আল্লাহ‌ সরাসরি জানলেও আখেরাতে যখন তিনি আদালত কায়েম করবেন তখন সেখানে যাকেই শাস্তি দেবেন ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দাবী পুরোপুরি পালন করেই শাস্তি দেবেন তাঁর আদালতে প্রত্যেকটি অপরাধী মানুষের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হবে তার সপক্ষে এমনসব অকুটিল সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করা হবে যার ফলে তার অপরাধী হবার ব্যাপারে কারো কোন কথা বলার অবকাশ থাকবে না সর্বপ্রথম পেশ করা হবে তার আমলনামা সবসময় তার সাথে লেগে থাকা কেরামান কাতেবীন ফেরেশতাদ্বয় তার প্রত্যেকটি কথা ও কাজ রের্কড করছেন (কাফ-১৭ আয়াত, সূরা আল ইনফিতারঃ ১০-১২) এ আমলনামা তার হাতে দিয়ে দেয়া হবে তাকে বলা হবে, তোমার জীবনের এই কার্যবিবরণী পড়ো নিজের হিসেবে নেবার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট (বনি ইসরাঈলঃ ১৪) মানুষ তা পড়ে অবাক হয়ে যাবে কারণ ছোট বড় এমন কোন বিষয় নেই যা তাতে যথাযথভাবে সংযোজিত হয়নি (আল কাহাফঃ ৪৯) এরপর হচ্ছে মানুষের নিজের শরীর দুনিয়ায় এই শরীরের সাহায্যে সে সমস্ত কাজ করেছে আল্লাহর আদালতে তার জিহবা সাক্ষ্য দেবে, সে দুনিয়ায় কি কি কথা বলে‌ছে, তার নিজের হাত পা সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে দিয়ে সে কোন কোন কাজ করিয়েছে (আন নূরঃ ২৪) তার চোখজোড়া সাক্ষ্য দেবে তার কান সাক্ষ্য দেবে, তার সাহায্যে সে কি কি কথা শুনেছে তার শরীরের গায়ে লেপ্টে থাকা চামড়া তার যাবতীয় কাজের সাক্ষ্য দেবে সে পেরেশান হয়ে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলবে, তোমরাও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছো? তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জবাব দেবে, আজ যে আল্লাহর হুকুমে সমস্ত জিনিস চলছে তাঁরই হুকুমে আমরাও চলছি (হা-মীম সাজদাহঃ ২০ থেকে ২২) এরপরে আছে আরো অতিরিক্ত সাক্ষ্য এই সাক্ষ্যগুলো পেশ করা হবে যমীন ও তার চারপাশের সমগ্র পরিবেশ থেকে সেখানে নিজের আওয়াজ মানুষ নিজের কানে শুনবে নিজের প্রতিটি কাজকর্মের প্রতিচ্ছবি নিজের চোখেই দেখবে এর চাইতেও অগ্রসর হয়ে দেখা যাবে, মানুষের মনে যেসব চিন্তা, ইচ্ছা, সংকল্প ও উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল এবং যেসব নিয়তের মাধ্যমে সে নিজের সমস্ত কাজ করেছিল তাও সব সামনে এনে রেখে দেয়া হবে যেমন সামনে সূরা আদিয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে এ কারণে এবং এ ধরনের চূড়ান্ত ও জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সামনে এসে যাবার পর মানুষ অবাক ও নির্বাক হয়ে যাবে নিজের পক্ষ থেকে ওজর পেশ করার কোন সুযোগই তার থাকবে না (আল মুরসালাতঃ ৩৫-৩৬)

﴿بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَىٰ لَهَا﴾

কারণ তোমার রব তাকে (এমনটি করার) হুকুম দিয়ে থাকবেন

﴿يَوْمَئِذٍۢ يَصْدُرُ ٱلنَّاسُ أَشْتَاتًۭا لِّيُرَوْا۟ أَعْمَـٰلَهُمْ﴾

সেদিন লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ফিরে আসবে, যাতে তাদের কৃতকর্ম তাদেরকে দেখানো যায় 

৫. এর দু’টো অর্থ হতে পারে একঃ প্রত্যেক ব্যক্তি একাকী তার ব্যক্তিগত অবস্থায় অবস্থান করবে পরিবার, গোষ্ঠী, জোট, দল, সম্প্রদায় ও জাতি সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানেও একথা বলা হয়েছে যেমন সূরা আল আনআ’মে রয়েছে, সেদিন মহান আল্লাহ‌ লোকদের বলবেনঃ “নাও, এখন তুমি এমনিতেই একাকী আমার সামনে হাজির হয়ে গেছো, যেমন আমি প্রথমবার তোমাকে সৃষ্টি করেছিলাম” (আয়াতঃ ৯৪) আর সূরা মারইয়ামে বলা হয়েছেঃ “একাকী আমার কাছে আসবে” (আয়াতঃ ৮০) আরো বলা হয়েছেঃ “তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে একাকী হাযির হবে” (আয়াতঃ ৯৫) দুইঃ এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, বিগত হাজার হাজার বছরে সমস্ত মানুষ যে যেখানে মরেছিল সেখান থেকে অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে চলে আসতে থাকবে যেমন সূরা নাবায় বলা হয়েছেঃ “যে দিন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তোমার দলে দলে এসে যাবে” (আয়াতঃ ১৮) এছাড়া বিভিন্ন তাফসীরকার এর যে অর্থ বর্ণনা করেছেন তার অবকাশ এখানে উল্লেখিত ‘আশতাতান’ (أَشْتَاتًا শব্দের মধ্যে নেই তাই আমার মতে সেগুলো এই শব্দটির অর্থগত সীমাচৌহদ্দীর বাইরে অবস্থান করছে যদিও বক্তব্য হিসেবে সেগুলো সঠিক এবং কুরআন ও হাদীস বর্ণিত কিয়ামতের অবস্থা ও ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্য রাখে

৬. এর দু’টি অর্থ হতে পারে একঃ তাদের আমল তাদেরকে দেখানো হবে অর্থাৎ প্রত্যেকে দুনিয়ায় কি কাজ করে এসেছে তা তাকে বলা হবে দুইঃ তাদেরকে তাদের কাজের প্রতিফল দেখানো হবে যদিও لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ  বাক্যটির জন্য এই দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করা যেতে পারে তবুও যেহেতু আল্লাহ‌ এখানে لِيُرَوْا جزاء أَعْمَالَهُمْ  (তাদের কাজের প্রতিফল দেখাবার জন্য) না বলে বলেছেন لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ  (তাদের কাজগুলো দেখানো হবে) তাই সঙ্গতভাবেই প্রথম অর্থটি এখানে অগ্রাধিকার পাবে বিশেষ করে যখন কুরআন মজীদের বিভিন্নস্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কাফের ও মু’মিন, সৎকর্মশীল ও ফাসেক, আল্লাহর হুকুমের অনুগত ও নাফরমান সবাইকে অবশ্যি তাদের আমলনামা দেয়া হবে (উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা আল হাক্কার ১৯ ও ২৫ এবং সূরা আল ইনশিকাকের ৭-১০) একথা সুস্পষ্ট, কাউকে তার কার্যাবলী দেখিয়ে দেয়া এবং তার আমলনামা তার নিজের হাতে সোপর্দ করার মধ্যে কোন তফাত নেই তাছাড়া যমীন যখন তার ওপর অনুষ্ঠিত ঘটনাবলী পেশ করবে তখন হক ও বাতিলের যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ শুরু থেকে চলে আসছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে, তার সম্পূর্ণ চিত্রও সবার সামনে এসে যাবে সেখানে সবাই দেখবে, সত্যের জন্য যারা কাজ করেছিল তারা কি কি কাজ করেছে এবং মিথ্যার সমর্থকরা তাদের মোকাবেলায় কি কি কাজ করেছে হিদায়াতের পথে আহ্বানকারী ও গোমরাহী বিস্তারকারীদের সমস্ত শুনবে, এটা কোন অসম্ভব কথা নয় উভয় পক্ষের সমগ্র রচনা ও সাহিত্যের রেকর্ড অবিকল সবার সামনে এনে রেখে দেয়া হবে হকপন্থীদের ওপর বাতিল পন্থীদের জুলুম এবং উভয় পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সমূহের দৃশ্যাবলী হাশরের ময়দানে উপস্থিত লোকেরা নিজেদের চোখেই দেখে নেবে

﴿فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًۭا يَرَهُۥ﴾

তারপর যে অতি অল্প পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখে নেবে

﴿وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍۢ شَرًّۭا يَرَهُۥ﴾

এবং যে অতি অল্প পরিমাণ খারাপ কাজ করবে সে তা দেখে নেবে

৭. এটি হচ্ছে এর একটি সহজ-সরল অর্থ আবার একথা সম্পূর্ণ সত্য যে, মানুষের অনু পরিমাণ নেকী বা পাপ এমন হবে না যা তার আমলনামায় লিখিত হবে না তাকে সে অবশ্য দেখে নেবে কিন্তু দেখে নেবার মানে যদি এই হয় যে, তার পুরস্কার ও শাস্তি দেখে নেবে, তাহলে এর এ অর্থ নেয়া ভুল হবে যে আখেরাতে প্রত্যেকটি সামান্যতম নেকীর পুরস্কার এবং প্রত্যেকটি সামান্যতম পাপের শাস্তি প্রত্যেক ব্যক্তিকে দেয়া হবে আর কোন ব্যক্তিও সেখানে নিজের কোন নেকীর পুরস্কার থেকে বঞ্চিত এবং পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না কারণ তাই যদি হয় তাহলে প্রথমত এর মানে হবে, প্রত্যেকটি খারাপ কাজের শাস্তি এবং প্রত্যেকটি ভালো কাজের পুরস্কার আলাদা আলাদা দেয়া হবে দ্বিতীয়ত এর মানে এও হবে, কোন উচ্চ পর্যায়ের সৎ ও মু’মিন কোন ক্ষুদ্রতম গোনাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না আর কোন জঘন্যতম কাফের, জালেম এবং পাপীও কোন ক্ষুদ্রতম সৎকাজের পুরস্কার না পেয়ে যাবে না এ দু’টি অর্থ কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিরোধী এবং বুদ্ধিও একে ইনসাফের দাবী বলে মেনে নিতে পারে না বুদ্ধির দৃষ্টিতে বিচার করলে একথা কেমন করে বোধগম্য হতে পারে যে, আপনার একজন কর্মচারী আপনার একান্ত অনুগত, বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণ কিন্তু তার কোন সামান্যতম ত্রুটির আপনি মাফ করেন না? তার প্রতিটি সেবা-কর্মের পুরস্কার দেবার সাথে সাথে তার প্রতিটি ত্রুটির জন্যও আপনে গুণে গুণে তাকে শাস্তিও দেবেন? ঠিক তেমনি বুদ্ধির দৃষ্টিতে একথাও দুর্বোধ্য যে, আপনার অর্থ ও সাহায্য-সহযোগীতায় লালিত পালিত কোন ব্যক্তি যার প্রতি রয়েছে আপনার অসংখ্য অনুগ্রহ, সে আপনার সাথে বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং অনুগ্রহের জবাবে হামেশা নিমকহারামী করতে থাকে কিন্তু আপনি তার সামগ্রিক কার্যক্রম ও দৃষ্টিভঙ্গী উপেক্ষা করে তার প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য তাকে পৃথক শাস্তি এবং তার ছোট-খাটো কোন সেবামূলক কাজের জন্য হয়তো সে কখনো আপনাকে খাবার জন্য এক গ্লাস পানি এনে দিয়েছিল বা কখনো আপনাকে পাখা দিয়ে বাতাস করে ছিল—আপনি তাকে আলাদাভাবে পুরস্কৃত করবেন আর কুরআন ও হাদীসের ব্যাপারে বলা যেতে পারে, সেখানে সুস্পষ্টভাবে মু’মিন, মোনাফেক, কাফের, সৎ মু’মিন, গোনাহগার মু’মিন, জালেম ও ফাসেক মু’মিন, নিছক কাফের এবং জালেম ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফের ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের লোকদের পুরস্কার ও শাস্তির জন্য একটি বিস্তারিত আইন বর্ণনা করা হয়েছে আর এই পুরস্কার ও শাস্তি মানুষের সমগ্র জীবনের ওপর পরিব্যাপ্ত

এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদ নীতিগতভাবে কয়েকটি কথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বর্ণনা করেঃ

একঃ কাফের, মুশরিক ও মোনাফেকের কর্মকাণ্ড (অর্থাৎ এমনসব কর্মকাণ্ড যেগুলোকে নেকী মনে করা হয়) নষ্ট করে দেয়া হয়েছে আখেরাতে তারা এর কোন প্রতিদান পাবে না এগুলোর যা প্রতিদান, তা তারা দুনিয়াতেই পেয়ে যাবে এ জন্য উদাহরণস্বরূপ দেখুন আল আ’রাফঃ ১৪৭, আত তাওবা ১৭, ৬৭-৬৯, হূদঃ ১৫-১৬, ইব্রাহীমঃ ১৮, আল কাহফঃ ১০৪-১০৫, আন নূরঃ ৩৯, আল ফুরকানঃ ২৩, আল আহযাবঃ ১৯, আয যুমারঃ ৬৫ এবং আল আহকাফঃ ২০)

দুইঃ পাপের শাস্তি ততটুকু দেয়া হবে যতটুকু পাপ করা হয় কিন্তু নেকীর পুরস্কার মূল কাজের তুলনায় বেশী দেয়া হবে বরং কোথাও বলা হয়েছে, আল্লাহ‌ নিজের ইচ্ছেমতো নেকীর প্রতিদান বাড়িয়ে দেবেন দেখুন আল বাকারাহঃ ২৬১, আল আনআ’মঃ ১৬০, ইউনুসঃ ২৬-২৭, আন নূরঃ ৩৮, আল কাসাসঃ ৮৪, সাবাঃ ৩৭ এবং আল মু’মিনঃ ৪০ আয়াত

তিনঃ মু’মিন যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকে তাহলে তার ছোট গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে দেখুন আন নিসাঃ ৩১, আশ শূরা ৩৭ এবং আন নাজমঃ ৩২

চারঃ সৎ মু’মিনের কাছ থেকে হালকা হিসেব নেয়া হবে তার গোনাহগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হবে তার ভালো ও উত্তম আমলগুলোর দৃষ্টিতে বিচার করে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে দেখুন আল আনকাবুতঃ ৭, আয যুমারঃ ৩৫, আল আহকাফঃ ১৬ এবং আল ইনশিকাক ৮ আয়াত

হাদীসের বক্তব্য এ বিষয়টিকে একেবারে পরিষ্কার করে দেয় ইতিপূর্বে সূরা ইনশিকাকের ব্যাখ্যার কিছু হাদীস উল্লেখ করেছি কিয়ামতের দিন হালকা ও কড়া হিসেবের বিষয়টিকে বুঝাবার জন্য রাসূলুল্লাহ সা. এর ব্যাখ্যা করেছেন (এ জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ইনশিকাক ৬ টীকা) হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, একবার হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে আহার করেছিলেন এমন সময় এই আয়াতটি নাযিল হয় হযরত আবু বকর রা. খাবার থেকে হাত গুঁটিয়ে নেন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! যে অণু পরিমাণ খারাপ কাজ আমি করেছি তার ফলও কি আমি দেখে নেবো?” জবাব দেনঃ “হে আবু বকর! দুনিয়ায় যেসব বিষয়েরই তুমি সম্মুখীন হও তার মধ্যে যেগুলো তোমার অপছন্দনীয় ও অপ্রীতিকর ঠেকে সেগুলোই তুমি যেসব অণু পরিমাণ অসৎকাজ করেছো তার বদলা এবং সেসব অণু পরিমাণ নেকীর কাজই তুমি করো সেগুলো আল্লাহ‌ আখেরাতে তোমার জন্য সংরক্ষণ করে রাখছেন” (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হতেম, তাবারনী ফিল আওসাত, বাইহাকী ফিশ শুআ’ব, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া ও আবদ ইবনে হুমাইদ) এই আয়াতটি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আবু আইউব আনসারীকেও বলেছিলেনঃ “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই নেকী করবে তার পুরস্কার সে পাবে আখেরাতে আর যে ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ করবে বিপদ-আপদ ও রোগের আকারে এই দুনিয়ায় তার শাস্তি পেয়ে যাবে” (ইবনে মারদুইয়া) কাতাদাহ হযরত আনাসের রা. বরাত দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর নিম্নোক্ত বাণীটি উদ্ধৃত করেছেনঃ “আল্লাহ মু’মিনের প্রতি জুলুম করেন না দুনিয়ায় তার নেকীর প্রতিদানে তাকে রিযিক দান করেন এবং আখেরাতে আবার এর পুরস্কার দেবেন আর কাফেরের ব্যাপারে দুনিয়ায় তার সৎকাজের প্রতিদান দিয়ে দেন, তারপর যখন কিয়ামত হবে তখন তার খাতায় কোন নেকী লেখা থাকবে না” (ইবনে জারীর) মাসরূক হযরত আয়েশা রা. থেকে রেওয়ায়াত করেছেনঃ তিনি রাসূলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করেন, “আবদুল্লাহ ইবনে জুদআ’ন জাহেলীযুগে আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করতো, মিসকিনকে আহার করাতো, মেহমানদের আপ্যায়ন করাতো, বন্দিদের মুক্তি দান করতো আখেরাতে এগুলো কি তার জন্য উপকারী হবে?”রাসূলুল্লাহ সা. জবাব দেন “না, সে মরার সময় পর্যন্ত একবারও বলেনিرَبِّ اغْفِرْلِى خَطِيْئَتِىْ يَوْمَ الدِّيْنِ  (হে আমার রব! শেষ বিচারের দিন আমার ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করে দিয়ো)”(ইবনে জারীর) অন্যান্য আরো কিছু লোকের ব্যাপারেও রাসূলুল্লাহ সা. এই একই জবাব দেন তারা জাহেলী যুগে সৎকাজ করতো কিন্তু কাফের ও মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে কিন্তু নবী সা. এর কোন কোন বাণী থেকে জানা যায়, কাফেরের সৎকাজ তাকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না ঠিকই তবে জালেম ফাসেক ব্যভিচারী কাফেরকে জাহান্নামে যে ধরনের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে তার শাস্তি তেমনি পর্যায়ের হবে না যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ হাতেম তাঈ এর দানশীলতার কারণে তাকে হালকা আযাব দেয়া হবে (রূহুল মাআ’নী)

তবুও এ আয়াতটি মানুষকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ব্যাপারে সজাগ করে দেয় সেটি হচ্ছে, প্রত্যেকটি সামান্যতম ও নগণ্যতম সৎকাজেরও একটি ওজন ও মূল্য রয়েছে এবং অনুরূপ অবস্থা অসৎকাজেরও অর্থাৎ অসৎকাজ যত ছোটই হোক না কেন অবশ্যি তার হিসেব হবে এবং তা কোন ক্রমেই উপেক্ষা করার মতো নয় তাই কোন ছোট সৎকাজকে ছোট মনে না করা উচিত কারণ এই ধরনের অনেকগুলো ছোট গোনাহ একত্র হয়ে একটি বিরাট গোনাহের স্তূপ জমে উঠতে পারে একথাটিই রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর হাদীসে ব্যক্ত করেছেন বুখারী ও মুসলিমে হযরত আদী ইবনে হাতেম রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ “জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো-তা এক টুকরা খেজুর দান করার বা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন” হযরত আদী ইবনে হাতেম থেকে সহীহ রেওয়ায়াতের মাধ্যমে আরো বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ “কোন সৎকাজকেও সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, যদিও তা কোন পানি পানেচ্ছু ব্যক্তির পাত্রে এক মগ পানি ঢেলে দেয়াই হয় অথবা তোমার কোন ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাত করাই হয়” বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে একটি রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে তাতে রাসূলুল্লাহ সা. মেয়েদেরকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ “হে মুসলিম মেয়েরা! কোন প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীনীর বাড়িতে কোন জিনিস পাঠানোকে সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, তা ছাগলের পায়ের একটি খুর হলেও” মুসনাদে আহমাদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ-এ হযরত আয়েশার রা. একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ “হে আয়েশা! যেসব গোনাহকে ছোট মনে করা হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকো কারণ আল্লাহর দরবারে সেগুলো সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাঃদ করা হবে” মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের রা. বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে তাতে রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ “সাবধান, ছোট গোনাহসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষা কর কারণ সেগুলো সব মানুষের ওপর একত্র হয়ে তাকে ধ্বংস করে দেবে” (গোনাহ কবীরা ও গোনাহ সগীরার পার্থক্য বুঝার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নিসাঃ ৫৩ টীকা ও আন নাজমঃ ৩২ টীকা)

— সমাপ্ত —

শেয়ারঃ

সম্পাদকের ব্লগ

অনলাইন পাঠাগার

অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থ

সকল সূরা

০০১

আল ফাতিহা

মাক্কী

৭ আয়াত

০০২

আল বাকারাহ

মাদানী

২৮৬ আয়াত

০০৩

আলে ইমরান

মাদানী

২০০ আয়াত

০০৪

আন নিসা

মাদানী

১৭৬ আয়াত

০০৫

আল মায়িদাহ

মাদানী

১২০ আয়াত

০০৬

আল আনআ’ম

মাক্কী

১৬৫ আয়াত

০০৭

আল আ’রাফ

মাক্কী

২০৬ আয়াত

০০৮

আল আনফাল

মাদানী

৭৫ আয়াত

০০৯

আত তাওবা

মাদানী

১২৯ আয়াত

০১০

ইউনুস

মাক্কী

১০৯ আয়াত

০১১

হূদ

মাক্কী

১২৩ আয়াত

০১২

ইউসুফ

মাক্কী

১১১ আয়াত

০১৩

আর রা’দ

মাক্কী

৪৩ আয়াত

০১৪

ইব্রাহীম

মাক্কী

৫২ আয়াত

০১৫

আল হিজর

মাক্কী

৯৯ আয়াত

০১৬

আন নাহল

মাক্কী

১২৮ আয়াত

০১৭

বনী ইসরাঈল

মাক্কী

১১১ আয়াত

০১৮

আল কাহফ

মাক্কী

১১০ আয়াত

মারইয়াম

০২০

ত্বা-হা

মাক্কী

১৩৫ আয়াত

০২১

আল আম্বিয়া

মাক্কী

১১২ আয়াত

০২২

আল হাজ্জ

মাদানী

৭৮ আয়াত

০২৩

আল মু’মিনূন

মাক্কী

১১৮ আয়াত

০২৪

আন নূর

মাক্কী

১১৮ আয়াত

০২৫

আল ফুরকান

মাক্কী

৭৭ আয়াত

০২৬

আশ শুআ’রা

মাক্কী

২২৭ আয়াত

০২৭

আন নামল

মাক্কী

৯৩ আয়াত

০২৮

আল কাসাস

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০২৯

আল আনকাবূত

মাক্কী

৬৯ আয়াত

০৩০

আর রূম

মাক্কী

৬০ আয়াত

০৩১

লুকমান

মাক্কী

৩৪ আয়াত

০৩২

আস সাজদাহ

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৩৩

আল আহযাব

মাদানী

৭৩ আয়াত

০৩৪

আস সাবা

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৩৫

ফাতির

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৩৬

ইয়াসিন

মাক্কী

৮৩ আয়াত

০৩৭

আস সাফফাত

মাক্কী

১৮২ আয়াত

০৩৮

ছোয়াদ

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০৩৯

আয যুমার

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০৪০

আল মু’মিন

মাক্কী

৮৫ আয়াত

০৪১

হা-মীম আস সাজদাহ

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৪২

আশ শূরা

মাক্কী

৫৩ আয়াত

০৪৩

আয যুখরুফ

মাক্কী

৮৯ আয়াত

০৪৪

আদ দুখান

মাক্কী

৫৯ আয়াত

০৪৫

আল জাসিয়াহ

মাক্কী

৩৭ আয়াত

০৪৬

আল আহক্বাফ

মাক্কী

৫৯ আয়াত

০৪৭

মুহাম্মাদ

মাদানী

৩৮ আয়াত

০৪৮

আল ফাতহ

মাদানী

২৯ আয়াত

০৪৯

আল হুজুরাত

মাদানী

১৮ আয়াত

০৫০

ক্বাফ

মাদানী

৪৫ আয়াত

০৫১

আয যারিয়াত

মাক্কী

৬০ আয়াত

০৫২

আত তূর

মাক্কী

৪৯ আয়াত

০৫৩

আন নাজম

মাক্কী

৬২ আয়াত

০৫৪

আল ক্বামার

মাক্কী

৫৫ আয়াত

০৫৫

আর রাহমান

মাদানী

৭৮ আয়াত

০৫৬

আল ওয়াকিআ’

মাক্কী

৯৬ আয়াত

০৫৭

আল হাদীদ

মাদানী

২৯ আয়াত

০৫৮

আল মুজাদালাহ

মাদানী

২২ আয়াত

০৫৯

আল হাশর

মাদানী

২২ আয়াত

০৬০

আল মুমতাহিনাহ

মাদানী

১৩৫ আয়াত

০৬১

আস সাফ

মাদানী

১৪ আয়াত

০৬২

আল জুমুআ’

মাদানী

১১ আয়াত

০৬৩

আল মুনাফিকুন

মাদানী

১১ আয়াত

০৬৪

আত তাগাবুন

মাদানী

১৮ আয়াত

০৬৫

আত তালাক্ব

মাদানী

১২ আয়াত

০৬৬

আত তাহরীম

মাদানী

১২ আয়াত

০৬৭

আল মুলক

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৬৮

আল কালাম

মাক্কী

৫২ আয়াত

০৬৯

আল হাককাহ

মাক্কী

৫২ আয়াত

০৭০

আল মাআ’রিজ

মাক্কী

৪৪ আয়াত

০৭১

নূহ

মাক্কী

২৮ আয়াত

০৭২

আল জিন

মাক্কী

২৮ আয়াত

০৭৩

আল মুযযাম্মিল

মাক্কী

২০ আয়াত

০৭৪

আল মুদ্দাসসির

মাক্কী

২০ আয়াত

০৭৫

আল কিয়ামাহ

মাক্কী

৪০ আয়াত

০৭৬

আদ দাহর

মাদানী

৩১ আয়াত

০৭৭

আল মুরসালাত

মাক্কী

৫০ আয়াত

০৭৮

আন নাবা

মাক্কী

৫০ আয়াত

০৭৯

আন নাযিআ’ত

মাক্কী

৪৬ আয়াত

০৮০

আবাসা

মাক্কী

৪২ আয়াত

০৮১

আত তাকবীর

মাক্কী

২৯ আয়াত

০৮২

আল ইনফিতার

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৮৩

আল মুতাফফিফীন

মাক্কী

৩৬ আয়াত

০৮৪

আল ইনশিকাক

মাক্কী

২৫ আয়াত

০৮৫

আল বুরূজ

মাক্কী

২২ আয়াত

০৮৬

আত তারিক

মাক্কী

১৭ আয়াত

০৮৭

আল আ’লা

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৮৮

আল গাশিয়াহ

মাক্কী

২৬ আয়াত

০৮৯

আল ফাজর

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৯০

আল বালাদ

মাক্কী

২০ আয়াত

০৯১

আশ শামস

মাক্কী

১৫ আয়াত

০৯২

আল লাইল

মাক্কী

২১ আয়াত

০৯৩

আদ দুহা

মাক্কী

১১ আয়াত

০৯৪

আলাম নাশরাহ

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৫

আত তীন

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৬

আল আলাক

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৯৭

আল কাদর

মাক্কী

৫ আয়াত

০৯৮

আল বাইয়্যিনাহ

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৯

আল যিলযাল

মাদানী

৮ আয়াত

১০০

আল আ’দিয়াত

মাক্কী

১১ আয়াত

১০১

আল কারিআ’হ

মাক্কী

১১ আয়াত

১০২

আত তাকাসুর

মাক্কী

৮ আয়াত

১০৩

আল আসর

মাদানী

৮ আয়াত

১০৪

আল হুমাযাহ

মাক্কী

৯ আয়াত

১০৫

আল ফীল

মাক্কী

৫ আয়াত

১০৬

কুরাইশ

মাক্কী

৪ আয়াত

১০৭

আল মাউন

মাক্কী

৭ আয়াত

১০৮

আল কাউসার

মাক্কী

৩ আয়াত

১০৯

আল কাফিরূন

মাক্কী

৬ আয়াত

১১০

আন নাসর

মাদানী

৩ আয়াত

১১১

আল লাহাব

মাক্কী

৫ আয়াত

১১২

আল ইখলাস

মাক্কী

৪ আয়াত

১১৩

আল ফালাক

মাক্কী

৫ আয়াত

১১৪

আন নাস

মাক্কী

৬ আয়াত