আল আ’রাফ

নামকরণঃ

এ সূরার ৪৬ ও ৪৭নং আয়াতে (পঞ্চম রুকূতে) আসহাবে আ’রাফ বা আ’রাফবাসীদের উল্লেখ করা হয়েছে। সেই জন্যে এর নামকরণ করা হয়েছে আল আ’রাফ। অন্য কথায় বলা যায়, এ সূরাকে সূরা আল আ’রাফ বলার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, যে সূরার মধ্যে আ’রাফের কথা বলা হয়েছে, এটা সেই সূরা।

নাযিলের সময়-কালঃ

এ সূরার আলোচ্য বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয়ে যে, এ সূরাটি সূরা আল আনআ’মের প্রায় সমসময়ে নাযিল হয়। অবশ্য এটা আগে না আল আনআ’ম আগে নাযিল হয় তা নিশ্চয়তার সাথে চিহ্নিত করা যাবে না। তবে এ সূরায় প্রদত্ত ভাষণের বাচনভংগী থেকে এটি যে ঐ সময়ের সাথে সম্পর্কিত তা পরিষ্কার বুঝা যায়। কাজেই এর ঐতিহাসিক পটভূমি অনুধাবন করার জন্যে সূরা আল আনআ’মের শুরুতে যে ভূমিকা লেখা হয়েছে তার ওপর একবর নজর বুলিয়ে নেয়া যথেষ্ট হবে।

আলোচ্য বিষয়ঃ

এ সূরার ভাষণের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হচ্ছে রিসালাতের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত। আল্লাহ প্রেরিত রাসূলের আনুগত্য করার জন্যে শ্রোতাদের উদ্বদ্ধ করাই এর সমগ্র আলোচনার মৌল উদ্দশ্য ও লক্ষ্য। কিন্তু এ দাওয়াত সতর্ক করার ও ভয় দেখানোর ভাবধারাই ফূটে উঠেছে বেশী করে।কারণ এখানে যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে (অর্থাৎ মক্কাবাসী) তাদেরকে বুঝাতে বুঝাতে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। তাদের স্থুল শ্রবণ ও অনুধাবন শক্তি, হঠকারিতা, গোয়ার্তুমী ও একগুঁয়ে মনোভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। যার ফলে রাসূলের প্রতি তাদেরকে সম্বোধন করা বন্ধ করে দিয়ে অন্যদেরকে সম্বোধন করার হুকুম অচিরেই নাযিল হতে যাচ্ছিল। তাই বুঝাবার ভংগীতে নবুওয়াত ও রিসালাতের দাওয়াত পেশ করার সাথে সাথে তাদেরকে একথাও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, নবীর মোকাবিলায় তোমরা যে কর্মনীতি অবলম্বন করেছো তোমাদের আগের বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ও নিজেদের নবীদের সাথে অনুরূপ আচরণ অবলম্বন করে অত্যন্ত মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল। তারপর বর্তমানে যেহেতু তাদেরকে যুক্তি প্রমাণ সহকারে দাওয়াত দেবার প্রচেষ্টা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হতে চলেছে। তাই ভাষণের শেষ অংশে তাদের দিক থেকে মূখ ফিরিয়ে আহলি কিতাবদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এক জায়গায় সারা দুনিয়ার মানুষকে সাধারণভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। এ থেকে এরূপ আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, এখন হিজরত নিকটবর্তী এবং নবীর জন্যে তার নিটকতর লোকদেরকে সম্বোধন করার যুগ শেষ হয়ে আসছে।

এ ভাষণের এক পর্যায়ে ইহুদিদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাই এই সাথে রিসালাত ও নবুওয়াতের দাওয়াতের আর একটি দিকও সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। নবীর প্রতি ঈমান আনার পর তাঁর সাথে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করার, আনুগত্য ও অনুসৃতির অংগীকার করার পর তা ভংগ করার এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে যাওয়ার পর মিথ্যার প্রতি সাহায্য সহযোগিতা দানের কাজে আপাদমস্তক ডুবে থাকার পরিনাম কি, তাও এতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে

﴿المص﴾

 আলিফ,লাম,মীমছোয়াদ 

﴿كِتَابٌ أُنزِلَ إِلَيْكَ فَلَا يَكُن فِي صَدْرِكَ حَرَجٌ مِّنْهُ لِتُنذِرَ بِهِ وَذِكْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ﴾

 এটি তোমার প্রতি নাযিল করা একটি কিতাব  কাজেই তোমার মনে যেন এর সম্পর্কে কোন সংকোচ না থাকে  এটি নাযিল করার উদ্দেশ্য হচ্ছেএর মাধ্যমে তুমি (অস্বীকারকারীদেরকে)ভয় দেখাবে এবং মুমিনদের জন্যে এটি হবে একটি স্মারক

১. কিতাব বলতে এখানে এই সূরা আল আ’রাফকেই বুঝোনো হয়েছে

২. অর্থাৎ কোন প্রকার সংকোচইতস্ততভাব ও ভীতি ছাড়াই একে মানুষের কাছে পৌছিয়ে দাও বিরুদ্ধবাদীরা একে কিভাবে গ্রহণ করবে তার কোন পরোয়া করবে নাতারা ক্ষেপে যায় যাকবিদ্রূপ করে করুকনানান আজেবাজে কথা বলে বলুক এবং তাদেরকে শত্রুতা আরো বেড়ে যায় যাক তোমরা নিশ্চিন্তে ও নিসংকোচে তাদের কাছে এ পয়গাম পৌছিয়ে দাও এর প্রচারে একটুও গড়িমসি করো না

এখানে যে অর্থে আমরা সংকোচ শব্দটি ব্যবহার করেছিমূল ইবারতে তার জন্যে حرج হারজ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে হারজ‘ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছেএমন একটি ঘন ঝোপঝাড়যার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা কঠিন মনে হারজ‘ হবার মানে হচ্ছে এই যেবিরোধিতা ও বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার না দেখে মানুষের মন সামনে এগিয়ে চলতে পারে নাথেমে যায় কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়বস্তুকে ضيق صدر শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে যেমন বলা হয়েছেঃ

وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ

হে মুহাম্মাদ! আমি জানি এরা যেসব কথা বলে বেড়াচ্ছে তাতে তোমার মন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে” অর্থাৎ যারা জিদহঠকারিতাও সত্য বিরোধিতায় এ পর্যায়ে নেমে এসেছে যে তাদেরকে কিভাবে সোজা পথে আনা যাবেএ চিন্তায় তুমি পেরেশান হয়ে পড়েছো অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

فَلَعَلَّكَ تَارِكٌ بَعْضَ مَا يُوحَىٰ إِلَيْكَ وَضَائِقٌ بِهِ صَدْرُكَ أَن يَقُولُوا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ كَنزٌ أَوْ جَاءَ مَعَهُ مَلَكٌ

এমন যেন না হয় যেতোমার দাওয়াতের জবাবে তারা তোমার কাছে কোন ধনভাণ্ডার অবতীর্ণ হয়নি কেনতোমার সাথে কোন ফেরেশতা আসেনি কেনএকথা বলবে ভেবে তুমি তোমার প্রতি নাযিল করা কোন কোন অহী প্রচার করা বাদ দিয়ে দেবে এবং বিব্রত বোধ করবে (হুদঃ ১২)

৩. এর অর্থ হচ্ছেএ সূরার আসল উদ্দেশ্য তো ভয় দেখানো অর্থাৎ রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ না করার পরিণাম সম্পর্কে লোকদেরকে সতর্ক করা ও ভয় দেখানো এবং গাফেলদেরকে সজাগ করা তবে এটি যে মুমিনদের জন্যে স্মারকও, (অর্থাৎ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়) সেটি এর একটি আনুসঙ্গিক লাভভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে এটি আপনা আপনিই অর্জিত হয়ে যায়

﴿اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ ۗ قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ﴾

 হে মানব সমাজ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং নিজেদের রবকে বাদ দিয়ে অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না  কিন্তু তোমরা খুব কমই উপদেশ মেনে থাকো

৪. এটি হচ্ছে এ সূরার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এ ভাষণটিতে যে আসল দাওয়াত দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছেঃ দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের জন্যে যে হেদায়াত ও পথ-প্রদর্শনার প্রয়োজননিজের ও বিশ্বজাহানের স্বরূপ এবং নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুধাবন করার জন্যে তার যে জ্ঞানের প্রয়োজন এবং নিজের আচার-আচারণচরিত্রনৈকিকতা, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারাকে সঠিক ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সে যেসব মূলনীতির মুখাপেক্ষী সেগুলোর জন্যে তাকে একমাত্র আল্লাহ বাব্বুল আলামীনকেই নিজের পথপদর্শক হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং আল্লাহ তার রাসূলের মাধ্যমে যে হেদায়াত ও পথ-পদর্শনা দিয়েছেন একমাত্র তারই অনুসরণ করতে হবে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারোর দিকে পথ-নির্দেশনা লাভ করার জন্য মুখ ফিরানো এবং তার নেতৃত্বের আওতায় নিজেকে সমর্পণ করা মানুষের একটি মৌলিক ভ্রান্ত কর্মপদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয় এর পরিণামে মানুষকে সব সময় ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তাকে সবসময় এই একই পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে

এখানে “আউলিয়া” (অভিভাবকগণ) শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যেমানুষ সাধারণত যার নির্দেশে ও নেতৃত্বে চলে তাকে আসলে নিজের ওলি’ তথা অভিভাবকে পরিণত করে মুখে সে তার প্রশংসা করতে পারে বা তার প্রতি অভিশাপও বর্ষণ করতে পারেআবার তার অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি দিতে পারে বা কঠোরভাবে তা অস্বীকার ও করতে পারে (আরো ব্যাখার জন্যে দেখুন আশ শূরাঃ টীকা ৬)

﴿وَكَم مِّن قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا فَجَاءَهَا بَأْسُنَا بَيَاتًا أَوْ هُمْ قَائِلُونَ﴾

 কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি তাদের ওপর আমার আযাব অকস্মাত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বলা অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল

﴿فَمَا كَانَ دَعْوَاهُمْ إِذْ جَاءَهُم بَأْسُنَا إِلَّا أَن قَالُوا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِينَ﴾

 আর যখন আমার আযাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোন কথাই ছিল না যেসত্যিই আমরা জালেম ছিলাম 

৫. অর্থাৎ তোমাদের শিক্ষার জন্য এমন সব জাতির দৃষ্টান্ত রয়েছে যারা আল্লাহর হেদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মানুষ ও শয়তানের নেতৃত্বে জীবন পথে এগিয়ে চলেছেঅবশেষে তারা এমনভাবে বিপথগামী ও বিকারগ্রস্ত হয়ে গেছে যার ফলে পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব এক দুঃসহ অভিশাপে পরিণত হয়েছে এবং আল্লাহর আযাব এসে তাদের নাপাক অস্তিত্ব থেকে দুনিয়াকে মুক্ত করেছে

শেষ বাক্যটির উদ্দেশ্য দু’টি বিষয়ে সতর্ক করে দেয়াঃ

একঃ সংশোধনের সময় অতিক্রম হবার পর কারোর সচেতন হওয়া এবং নিজের ভূল স্বীকার করা অর্থহীন যে ব্যক্তি ও জাতি গাফিলতিতে লিপ্ত ও ভোগের নেশায় মত্ত হয়ে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর দেয়া অবকাশ ও সুযোগ হারিয়ে বসেসত্যের আহবায়কতের আওয়াজ যাদের অচেতন কানের পর্দায় একটুও সাড়া জাগায় না এবং আল্লাহর হাত মজবুতভাবে পাকড়াও করার পরই যারা সচেতন হয় তাদের চাইতে বড় নাদান ও মুর্খ আর কেউ নেই 

দুইঃ ব্যক্তি ও জাতিদের জীবনের দু একটি নয়অসংখ্য দৃষ্টান্ত তোমাদের সামনে এসে গেছে কারোর অসৎ কর্মের পেয়ালা যখন পরিপুর্ণ হয়ে যায় এবং তার অবকাশের সীমা শেষ হয়ে যায় তখন অকস্মাৎ এক সময় আল্লাহ তাকে পাকড়াও করেন আর আল্লাহ একবার কাউকে পাকড়াও করার পর আর তার মুক্তি লাভের কোন পথই থাকে না তাছাড়া মানব জাতির ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এক দু’বার নয়শত শত বারহাজার হাজার বার ঘটে গেছে এ ক্ষেত্রে মানুষের জন্যে বারবার সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করার যৌক্তিকতা কোথায়সচেতন হবার জন্যে সে কেনই বা সেই শেষ মুহূর্তেরই অপেক্ষা করতে থাকবে যখন কেবলমাত্র আক্ষেপ করা ও মর্মজ্বালা ভোগ করা ছাড়া সচেতন হবার আর কোন স্বার্থকতাই থাকে না

﴿فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ﴾

 কাজেই যাদের কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি তাদেরকে অবশ্যি জিজ্ঞাসাবাদ করবো  এবং রাসূলকেও জিজ্ঞাসা করবো (তারা পয়গাম পৌছিয়ে দেবার দায়িত্ব কতটুকু সম্পাদন করেছে এবং এর কি জবাব পেয়েছে) 

৬. এখানে জিজ্ঞাসাবাদ বলতে কিয়ামতের হিসেব-নিকেশ বুঝানো হয়েছে অসৎ ব্যক্তিও জাতিদের ওপর দুনিয়ায় যেসব আযাব আসে সেগুলো তাদের অসৎকর্মের চূড়ান্ত ফল নয় এবং সেগুলো তাদের অপরাধের পূর্ণ শাস্তিও নয় বরং এটাকে এ অবস্থার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে যেএকজন অপরাধী স্বাধীনভাবে অপরাধ করে বেড়াচ্ছিলতাকে অকস্মাত গ্রেফতার করে তার আরো বেশী জুলুমঅন্যায় ও ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার সুযোগ ছিনিয়ে নেয়া হলো মানব জাতির ইতিহাসে এ ধরনের গ্রেফতারীর অসংখ্য নজীর পাওয়া যায় এ নজীরগুলো এ কথারই এক একটি সুষ্পষ্ট আলামত যেমানুষকে এ দুনিয়ায় যেখানে চরে বেড়াবার এবং যাচ্ছে তাই করে বেড়াবার জন্য লাগামহীন উটের মতো স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়নি বরং সবার ওপরে কোন এক শক্তি আছে যে একই বিশেষ সীমারেখা পর্যন্ত তার রশি আলগা করে রাখে অসৎ প্রবণতা থেকে ফিরে আসার জন্যে একের পর এক সতর্ক সিগন্যাল দিয়ে যেতে থাকে আর যখন দেখা যায়,সে কোনক্রমেই সৎ পথে ফিরে আসছে না তখন হঠাৎ এক সময় তাকে পাকড়াও করে ফেলে তারপর এ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ওপর চিন্তা-ভাবনা করলে কোন ব্যক্তি সহজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে যেএ বিশ্ব জাহানের ওপর যে শাসনকর্তা শাসণ চলছে তিনি নিশ্চয়ই এমন একটি সময় নির্ধারিত করে রেখে থাকবেন যখন এসব অপরাধীদের বিচার করা হবে এবং নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্যে তাদের জবাবাদিহি করতে হবে এ কারণে ওপরের যে আয়াতটিতে পার্থিব আযাবের কথা বলা হয়েছেতাকে কাজেই শব্দটি দ্বারা পরবর্তী আয়াতের সাথে সংযক্ত করা হয়েছে অর্থাৎ পার্থিব আযাব বার বার আসা যেন আখেরাতে জবাবদিহি নিশ্চয়তার একটি প্রমাণ

৭. এ থেকে জানা গেলোআখেরাতে জিজ্ঞাসাবাদ সরাসরি রিসালাতের ভিত্তিহেই অনুষ্ঠিত হবে একদিকে নবীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবেমানব সম্প্রদায়ের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌছিয়ে দেবার জন্যে তোমরা কি কি কাজ করেছোঅন্যদিকে যাদের কাছেরাসূলের দাওয়াত পৌছে গেছে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবেএ দাওয়াতের সাথে তোমরা কি ব্যবহার করছো? যেসব ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের কাছে নবীদের বাণী পৌছেনী তাদের মামলার নিষ্পত্তি কিভাবে হবেসে সম্পর্কে কুরআন মজীদ আমাদের কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর ফায়সালা সংরক্ষিত করে রেখেছেন কিন্তু যেসব ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের কাছে নবীদের শিক্ষা পৌছে গেছে তাদের সম্পর্কে কুরআন পরিষ্কার ঘোষণা করেছে যে তারা নিজেদের কুফরীঅবাধ্যতাঅস্বীকৃতিফাসিকীও নাফরমানীর স্বপক্ষে কোন যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতে পারবে না আর লজ্জায় আক্ষেপে ও অনুতাপে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে জাহান্নামের পাথে এগিয়ে চলা ছাড়া কিয়ামতের দিন তাদের জন্যে দ্বিতীয় কোন পথ থাকবে না

﴿فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِم بِعِلْمٍ ۖ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ﴾

 তারপর আমি নিজেই পূর্ণ জ্ঞান সহকারে সমুদয় কার্যাবিবরণী তাদের সামনে পেশ করবো আমি তো আর সেখানে অনুপস্থিত ছিলাম না!

﴿وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ ۚ فَمَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾

 আর ওজন হবে সেদিন যথার্থ সত্য 

৮. অর্থাৎ আল্লাহর ন্যায় তুলাদণ্ডে সেদিন ওজন ও সত্য হবে পরস্পরের সমার্থক সত্য বা হক ছাড়া কোন জিনিসের সেখানে কোন ওজন থাকবে না আর ওজন ছাড়াও কোন জিনিস সত্য সাব্যস্ত হবে না যার সাথে যতটুকু সত্য থাকবে সে হবে ততটুকু ওজনদান ও ভারী ওজনের পরিপ্রক্ষিতেই সব কিছু ফায়সালা হবে অন্য কোন জিনিসের বিন্দুমাত্রও মর্যাদা ও মূল্য দেয়া হবে না মিথ্যা ও বাতিলের স্থিতিকাল দুনিয়ায় যতই দীর্ঘ ও বিস্তৃত থাকুক না কেন এবং আপাতদৃষ্টিতে তার পেছনে যতই জাঁকজমকশান-শওকত ও আড়ম্বর শোভা পাক না কেনএ তুলাদণ্ডে তা একেবারেই ওজনহীন প্রমাণিত হবে বাতিলপন্থীদেরকে যখন এ তুলাদণ্ডে ওজন করা হবেতারা নিজেদের চোখেই দেখে নেবে দুনিয়ায় দীর্ঘকাল ধরে তারা যা কিছু করেছিল তার ওজন একটি মাছির ডানার সমানও নয় সূরা আল কাহাফের শেষ তিনটি আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যারা দুনিয়ার জীবনে সবকিছু দুনিয়ারই জন্যে করে গেছে এবং আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করে এ ভেবে কাজ করেছে যেপরকাল বলে কিছু নেইকাজেই কারোর কাছে নিজের কাজের হিসেব দিতে হবে নাআখেরাতে আমি তাদের কার্যকলাপের কোন ওজন দেবো না

﴿وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَٰئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُم بِمَا كَانُوا بِآيَاتِنَا يَظْلِمُونَ﴾

 যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হালকা হবে তারা নিজেরাই হবে নিজেদের ক্ষতি সাধনকারী  কারণ তারা আমার আয়াতের সাথে জালেম সূলভ আচরণ চালিয়ে গিয়েছিল  

৯. এ বিষয়টিকে এভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যেমানুষের জীবনের সমগ্র কার্যাবলী দু’টি অংশে বিভক্ত হবে একটি ইতিবাচক বা সৎ কাজ এবং অন্যটি নেতিবাচক বা অসৎ কাজ ইতিবাচক অংশের অন্তর্ভুক্ত হবে সত্যকে জানা ও মেনে নেয়া এবং সত্যের অনুসরণ করে সত্যের খাতিরে কাজ করা আখেরাতে একমাত্র এটিই হবে ওজনদানভারী ও মূল্যবানঅন্যদিকে সত্য থেকে গাফিল হয়ে অথবা সত্য থেকে বিচ্যূত হয়ে মানুষ নিজের নফস-প্রবৃত্তি বা অন্য মানুসের ও শয়তানের অনুসরণ করে অসত্য অংশটি কেবল যেমূল্যহীনই হবে তাই নয় বরং এটাই মানুষের ইতিবাচক অংশের মর্যাদাও কমিয়ে দেবে

কাজেই মানুষের জীবনের সমুদয় কার্যাবলীর ভাল অংশ যদি তার মন্দ অংশের ওপর বিজয় লাভ করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনেক কিছু দেবার পরও তার হিসেবে কিছু না কিছু অবশিষ্ট থাকেতবেই আখেরাতে তার সাফল্য লাভ করা সম্ভব আর যে ব্যক্তির জীবনের মন্দ কাজ সমস্ত ভাল কাজকে মূল্যহীন করে দেবে তার অবস্থা হবে সেই দেউলিয়া ব্যবসায়ীর মত যার সমুদয় পূঁজি ক্ষতিপূরণ ও দাবী পূরণ করতে করতেই শেষ হয়ে যায় এবং এরপরও কিছু কিছু দাবী তার জিম্মায় অনাদায়ী থেকে যায়

﴿وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ ۗ قَلِيلًا مَّا تَشْكُرُونَ﴾

১০ তোমাদেরকে আমি ক্ষমতা-ইখতিয়ার সহকারে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তোমাদের জন্যে এখানে জীবন ধারণের উপকরণ সরবরাহ করেছিকিন্তু তোমরা খুব কমই শোকর গুজারী করে থাকো

﴿وَلَقَدْ خَلَقْنَاكُمْ ثُمَّ صَوَّرْنَاكُمْ ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ لَمْ يَكُن مِّنَ السَّاجِدِينَ﴾

১১ আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতি দান করলাম অতপর ফেরেশতাদের বললাম,আদমকে সিজদা করো১০  এ নির্দেশ অনুযায়ী সবাই সিজদা করলো কিন্তু ইবলীস সিজদাকারীদের অন্তরভুক্ত হলো না

১০. তূলনামূলক পাঠের জন্যে সূরা আল বাকারাহ-এর ৪ রুকূ দেখুন (আয়াতঃ ৩০থেকে ৩৯)

সূরা আল বাকারায় যেসব শব্দ সমন্বয়ে সিজদার আদেশ উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে সন্দেহ হতে পারে যেনিছক এক ব্যক্তি হিসেবেই আদম আ. এর সামনে ফেরেশতাদেরকে সিজদা করার হুকুম দেয়া হয়েছিল কিন্তু এখান থেকে সে সন্দেহ দূর হয়ে যায় এখানে যে বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা থেকে পরিষ্কার জানা যায়আদম আ.কে আদম হিসেবে নয় বরং মানব জাতির প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে সিজদা করানো হয়েছিল

আর আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতিদান করলাম অতপর ফেরশতাদের বললামআদম কে সিজদা করোএকথার অর্থ হচ্ছে আমি প্রথমে তোমাদের সৃষ্টির পরিকল্পনা প্রণয়ন করলাম,তোমাদের সৃষ্টির মৌলিক উপাদান তৈরী করলাম তারপর সেই উপাদানকে মানবিক আকৃতি দান করলাম অতপর আদম যখন একজন জীবিত মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো তখন তাকে সিজদা করার জন্যে ফেরেশতাদেরকে হুকুম দিলাম কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানেও এ আয়াতটির এরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেমন সূরা ছোয়াদ এর পঞ্চম রুকূতে বলা হয়েছেঃ

إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَراً مِّن طِينٍ . فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي فَقَعُواْ لَهُ سَاجِدِينَ

সেই সময়ের কথা চিন্তা করো যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেনআমি মাটি থেকে একটা মানুষ তৈরী করবো তারপর যখন আমি সেটি পুরোপুরি তৈরী করে ফেলবো এবং তার মধ্যে নিজের রূহ থেকে কিছু ফূঁকে দেবো তখন তোমরা সবাই তার সমানে সিজদানত হবে” (আয়াতঃ ৭১)

এ আয়াতটিতে ঐ তিনটি পর্যায় বর্ণিত হয়ছে অন্য এক ভংগীমার এখানে বলা হয়েছেঃ প্রথমে মাটি থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করা হবেতারপর তার “তাসবীয়া” করা হবে অর্থাৎ তাকে আকার-আকৃতি দান করা হবে এবং তার দেহ-সৌষ্ঠব ও শক্তিসমর্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হবে এবং সবশেষে নিজের রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দিয়ে আদমকে অস্তিত্ব দান করা হবে এ বিষয়বস্তুটিকেই সূরা আল হিজর-এর তৃতীয় রুকূতে নিম্নলিখিত শব্দাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছেঃ

إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِّن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُون، فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ 

আর সেই সময়টির কথা ভাবো যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেনআমি ছাঁচে ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করবোতারপর যখন তাকে পুরোপুরি তৈরী করে ফেলবো তার মধ্যে নিজের রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দেবো তখন তোমরা সবাই তার সামনে সিজদানত হবে (আয়াতঃ ২৮২৯)

মানব সৃষ্টির এ সূচনা পূর্বের বিস্তারিত অবস্থা অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন মাটির পিণ্ড থেকে কিভাবে মানুষ বানানো হলো তারপর কিভাবে তাকে আকার আকৃতি দান ও তার মধ্যে ভারসাম্য কায়েম করা হলো এবং তার মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেবার ধরনটিই বা কি ছিল এসেবের পূর্ণ তাৎপর্য বিশ্লেষণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় তবুও একথা সুষ্পষ্ট যে,বর্তমান যুগে ডারউইনের অনুসারীরা বিজ্ঞানের নামে যেসব মতবাদ পেশ করছে মানব সৃষ্টির সূচনা পূর্বের অবস্থা সম্পর্কে কুরআন মজীদ তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অবস্থার বর্ণনা দিয়েছে এসব মতবাদের দৃষ্টিতে মানুষ একটি সম্পূর্ণ অমানবিক বা অর্ধমানবিক অবস্থার বিভিন্ন স্তর থেকে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে মানবিক স্তরে উপনীত হয়েছে আর এ ক্রমবিবর্তন ধারার সুদীর্ঘ পথে এমন কোন বিশেষ বিন্দু নেই যেখান থেকে অমানবিক অবস্থার ইতি ঘোষণা করে মানব জাতীর সূচনা হয়েছে বলে দাবী করা যেতে পারে বিপরীত পক্ষে কুরআন আমাদের জানাচ্ছেমানব বংশধারার সূচনা হয়েছে নির্ভেজাল মানবিক অস্তিত্ব থেকেই কোন অমানবিক ধারার সাথে তার ইতিহাসের কোন কালেও কোন সম্পর্ক ছিল না প্রথম দিন থেকে তাকে মানুষ হিসেবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল আল্লাহ পরিপূর্ণ মানবিক চেতনা সহকারে পূর্ণ আলোকে তার পার্থিব জীবনের সূচনা করেছিলেন

মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে এ দু’টি ভিন্ন ধর্মী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ সম্পর্কে দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী চিন্তাধরার উদ্ভব হয় একটি চিন্তাধারা মানুষকে জীবজন্তু ও পশু জগতের একটি শাখা হিসেবে পেশ করে তার জীবনের সমস্ত আইন কানুন এমন কি নৈতিক ও চারিত্রিক আইনের জন্যেও মূলনিতির সন্ধান করা হয় ইতর প্রাণীসমূহের জীবন রীতিতে ও পশুদের জীবন ধারায় তার জন্যে পশুদের ন্যায় কর্মপদ্ধতি একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতি মনে হয় সেখানে মানবিক কর্মপদ্ধতি ও পাশবিক কর্মপদ্ধতির মধ্যে বড় জোড় এতটুকু পার্থক্য দেখার প্রত্যাশা করা হয় যেমানুষ যন্ত্রপাতিকল-কারখানা,শিল্পসভ্যতাসংস্কৃতির সূক্ষ্ম ও নিপুন কারুকার্য অবলম্বনে কাজ করে পক্ষান্তরেপশুরা কাজ করে ঐসবের সহায়তা ছাড়াই বিপরীত পক্ষে অন্য চিন্তাধারাটি মানুষকে পশুর পরিবর্তে মানুষ হিসেবেই উপস্থাপন করে সেখানে মানুষ বাকশক্তিসম্পন্ন পশু বা সামাজিক ও সংস্কৃতিবান জন্তু (Social animal)নয় বরং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি সেখানে বাকশক্তি বা সামাজিকতাবোধ তাকে অন্যন্যা জীব ও প্রানী থেকে আলাদা করে না বরং তাকে আলাদা করে তার নৈতিক দায়িত্ব এবং ক্ষমতা ও ইখতিয়ার যা আল্লাহ তাকে দান করেছেন এবং যার ভিত্তিতে তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে এভাবে এখানে মানুষ ও তার সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কিত দৃষ্টিকোণ পূববর্তী দৃষ্টিকোণটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায় এখানে মানুষের জন্যে একটি জীবন দর্শন এবং অন্য একটি নৈতিকসাংস্কৃতিক ব্যবস্থার মূলনীতি অনুসন্ধান করার জন্যে মানুষের দৃষ্টি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিম্ন জগতের পরিবর্তে উর্ধ জগতের দিকে উঠতে থাকবে

প্রশ্ন করা যেতে পারেমানুষ সম্পর্কিত এ দ্বিতীয় ধারণাটি নৈতিক ও মস্ততাত্বিক দিক দিয়ে যতই উন্নত পর্যায়ের হোক না কেননিছক কল্পনার ওপর নির্ভর করে যুক্তিতথ্য দ্বারা প্রমাণিত একটি মতবাদকে কেমন করে রদ করা যেতে পারেকিন্তু যারা এ ধরনের প্রশ্ন করেনতাদের কাছে আমার পাল্টা প্রশ্নসত্যিই কি ডারউইনের বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক যুক্তিতথ্যের মাধ্যমে প্রমাণিতবিজ্ঞান সম্পর্কে নিছক ভাসা ভাসা ও স্থুল জ্ঞান রাখে এমন ধরনের লোকেরা অবশ্যি এ মতবাদকে একটি প্রমাণিত তাত্বিক সত্য মনে করার ভ্রান্তিতে লিপ্ত কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও অনুসন্ধান বিশারদরা জানেনগুটিকয় শব্দ ও হাড়গোড়ের লম্বা চওড়া ফিরিস্তি সত্ত্বেও এখনো একটি মতবাদের পর্যায়েই রয়ে গেছে এবং এর যেসব যুক্তিতথ্যকে ভুলক্রমে প্রমাণ্য বলা হচ্ছে সেগুলো নিছক সম্ভাব্যতার যুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয় অর্থাৎ সেগুলোর ভিত্তিতে বড় জোর এতটুকু বলা যেতে পারে যেডারউইনের বিবর্তনবাদের সম্ভাবনা ঠিক ততটুকুই যতটুকু সম্ভাবনা আছে সরাসরি সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে এক একটি শ্রেনীর পৃথক অস্তিত্ব লাভের

﴿قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ ۖ قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ﴾

১২ আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যখন তোকে হুকুম দিয়েছিলাম তখন সিজদা করতে তোকে বাধা দিয়েছিল কিসে”?সে জবাব দিলঃ “আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো এবং ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে”

﴿قَالَ فَاهْبِطْ مِنْهَا فَمَا يَكُونُ لَكَ أَن تَتَكَبَّرَ فِيهَا فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِينَ﴾

১৩ তিনি বললেনঃ “ঠিক আছেতুই এখান থেকে নীচে নেমে যা এখানে অহংকার করার অধিকার তোর নেই বের হয়ে যা আসলে তুই এমন লোকদের অন্তরভুক্তযারা নিজেরাই নিজেদেরকে লাঞ্ছিত করতে চায়”১১

১১. মূলে  صَّاغِرِينَশব্দ ব্যবহৃত হয়েছেصَّاغِرِ  মানে লাঞ্ছনা ও অবমাননার মধ্যে সন্তুষ্ট থাকা অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেই লাঞ্ছনাঅবমাননা ও নিকৃষ্টতর অবস্থা অবলম্বন করে কাজেই আল্লাহর বানীর অর্থ হচ্ছেআল্লাহর বান্দা ও সৃষ্টি হয়েও তোমার অহংকারের মত্ত হওয়া এবং তুমি নিজের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের যে ধারণা নিজেই তৈরী করে নিয়েছো তার দৃষ্টিতে তোমার রবের হুকুম তোমার জন্যে অবমাননাকর মনে হওয়া ও সে জন্যে তা অমান্য করার অর্থ দাঁড়ায় এই যেতুমি নিজেই নিজেকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতে দাওশ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যাঅহমিকা,মর্যাদার ভিত্তিহীনদাবী এবং কোন জন্মগত ও স্বতসিদ্ধ অধিকার ছাড়াই নিজেকে অযথা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন মনে করা তোমাকে বড়শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাশালী করতে পারে না বরং এর ফলে তুমি মিথ্যুক লাঞ্ছিত ও অপমানিতই হবে এবং তোমার এ লাঞ্ছনা ও অবমাননার কারণ হবে তুমি নিজেই

﴿قَالَ أَنظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ﴾

১৪ সে বললঃ “আমাকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দাও যখন এদের সবাইকে পুনর্বার ওঠানো হবে”

﴿قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ﴾

১৫ তিনি বললেনঃ “তোকে অবকাশ দেয়া হলো”

﴿قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ﴾

১৬ সে বললোঃ “তুমি যেমন আমাকে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করছো তেমনি আমি ও এখন তোমার সরল-সত্য পথে এ লোকদের জন্যে ওঁত পেতে বসে থাকবো,১২ 

১২. এটি ছিল ইবলীসের চ্যালেঞ্জ সে আল্লাহকে এ চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল তার এ বক্তব্যের অর্থ ছিল এই যেতুমি আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত এই যে অবকাশ দিয়েছো তাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে আমি একথা প্রমাণ করার জন্যে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করবো যেতুমি মানুষকে আমার মোকাবিলায় যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করছো সে তার যোগ্য নয় মানুষ যে কতবড় নাফরমাননিমক হারাম ও অকৃতজ্ঞ তা আমি দেখিয়ে দেবো

শয়তান যে অবকাশ চেয়েছিল এবং আল্লাহ তাকে যে অবকাশ দিয়েছিলেন সেটি নিছক সময়ের অবকাশ ছিল না বরং সে যে কাজ করতে চাচ্ছিল সে কাজটি করার সুযোগ ও এর অন্তরভূক্ত ছিল অর্থাৎ তার দাবী ছিলমানুষকে বিভ্রান্ত করে তার দুর্বলতাসমূহকে কাজে লাগিয়ে তাকে অযোগ্য প্রমাণ করার সুযোগ দিতে হবে এ সুযোগ আল্লাহ তাকে দিয়েছেন সূরা বনী ইসরাঈলের সপ্তম রুকূতে (আয়াতঃ ৬১-৬৫) এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে সেখানে আল্লাহ শয়তানকে এ ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দেবার কথা বলেছেন যে আদম ও তার সন্তানসন্তুতিদেরকে সত্যসঠিক পথ থেকে বিচ্যূত করার জন্যে সে নিজের ইচ্ছা মত যে কোন কৌশল অবলম্বন করতে পারেএসব কৌশল অবলম্বন করার ক্ষেত্রে তাকে কোন প্রকার বাধা দেয়া হবে না বরং যেসব পথে সে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে সেই সমস্ত পথই খোলা থাকবে কিন্তু এই সংগে এ শর্তটিও জুড়ে দেয়া হয়েছে-

إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ

অর্থাৎ “আমার বান্দাদের ওপর তোমার কোন কর্তৃত্ব থাকবে না তুমি কেবল এতটুকু করতে পারবেতাদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারবে মিথ্যা আশার ছলনে ভুলাতে পারবেঅসৎ কাজ ও গোমরাহীকে সুশোভন করে তাদের সামনে পেশ করতে পারবেভোগের আনন্দ ও স্বার্থের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে ভুল পথের দিকে আহবান জানাতে পারবে কিন্তু তাদের হাত ধরে জবরদস্তি তাদেরকে তোমার পথের দিকে টেনে আনবে এবং তারা যদি সত্যসঠিক পথে চলতে চায় তাহলেও তুমি তা থেকে তাদেরকে বিরত রাখবেসে ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হবে না সূরা ইবরাহীমের চতুর্থ রুকূতেও একই কথা বলা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছেকিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালত থেকে ফায়সালা শুনিয়ে দেবার পর শয়তান তার অনুসারী মানুষদেরকে বলবেঃ

وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُم مِّن سُلْطَانٍ إِلَّا أَن دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي ۖ فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنفُسَكُم

তোমাদের ওপর আমার তো কোন জবরদস্তি ছিল নাআমার অনুসরণ করার জন্যে আমি তোমাদের বাধ্য করিনি আমি তোমাদেরকে আমার পথের দিকে আহবান জানিয়েছিলামএর বেশী আমি কিছুই করিনি আর তোমরা আমার আহবান গ্রহণ করেছিলে কাজেই এখন আমাকে তিরষ্কার করো না বরং তোমাদের নিজেদেরকেই তিরস্কার করো”

আর শয়তান যে এখানে আল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যেতুমিই আমাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছোএর অর্থ হচ্ছে এই যেশয়তান নিজের গোনাহের দায়-দায়িত্ব আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিতে চায় তার অভিযোগ হচ্ছেআদমের সামনে সিজদা করার হুকুম দিয়ে তুমি আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছো এবং আমার আত্মাভিমান ও আত্মম্ভরিতায় আঘাত দিয়ে আমাকে এমন অবস্থার সম্মুখীন করেছো যার ফলে আমি তোমার নাফরমানী করেছি অন্য কথায় বলা যায়নির্বোধ শয়তান চাচ্ছিলতার মনের গোপণ ইচ্ছা যেন ধরা না পড়েবরং যে মিথ্যা অহমিকা ও বিদ্রোহ সে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলতাকে সে পর্দার অন্তরালে সংগোপন করে রাখতে চাচ্ছিল এটা ছিল একটি হীন ও নির্বোধসূলভ আচরণ এহেন আচরণের জবাব দেবার কোন প্রয়োজন ছিল না তাই মহান আল্লাহ তার এ অভিযোগের আদৌ কোন গুরুত্বই দেননি

﴿ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ﴾

১৭ সামনে-পেছনেডাইনে-বাঁয়েসবদিক থেকে এদেরকে ঘিরে ধরবো এবং এদের অধিকাংশকে তুমি শোকর গুজার পাবে না”

﴿قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَّدْحُورًا ۖ لَّمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنكُمْ أَجْمَعِينَ﴾

১৮ আল্লাহ বললেনঃ “বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও ধিকৃত অবস্থায় নিশ্চিতভাবে জেনে রাখিস, এদের মধ্য থেকে যারাই তোর অনুসরণ করবে তাদেরকে এবং তোকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভরে দেবো

﴿وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ﴾

১৯ আর হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী তোমরা দুজনাই এ জান্নাতে থাকো যেখানে যা তোমাদের ইচ্ছা হয় খাও,কিন্তু এ গাছটির কাছে যেয়ো নাঅন্যথায় তোমরা জালেমদের অন্তরভূক্ত হয়ে যাবে”

﴿فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِن سَوْآتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَٰذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَن تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ﴾

২০ তারপর তাদের লজ্জাস্থান,যা তাদের পরষ্পর থেকে গোপন রাখা হয়েছিলতাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেবার জন্যে শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল সে তাদেরকে বললোঃ “তোমাদের রব যেতোমাদের এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করেছেন তার পেছনে এ ছাড়া আর কোন কারণই নেই যেপাছে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাও অথবা তোমরা চিরন্তন জীবনের অধিকারী হয়ে পড়ো”

﴿وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ﴾

২১ আর সে কসম খেয়ে তাদেরকে বললোআমি তোমাদের যথার্থ কল্যাণকামী

﴿فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ ۚ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِن وَرَقِ الْجَنَّةِ ۖ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَن تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُل لَّكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِينٌ﴾

২২ এভাবে প্রতারণা করে সে তাদের দুজনকে ধীরে ধীরে নিজের পথে নিয়ে এলো অবশেষে যখন তারা সেই গাছের ফল আস্বাদন করলোতাদের লজ্জা স্থান পরস্পরের সামনে খুলে গেলো এবং তারা নিজেদের শরীর ঢাকতে লাগলো জান্নাতের পাতা দিয়েতখন তাদের রব তাদেরকে ডেকে বললোঃ “আমি কি তোমাদের এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদের বলিনি যে,শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”?

﴿قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

২৩ তারা দুজন বলে উঠলোঃ “হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করোএবং আমাদের প্রতি রহম না করোতাহলে নিসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো১৩

১৩. এ কাহিনীটি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়ঃ

একঃ লজ্জা মানুষের একটি প্রকৃতিগত ও স্বাভাবিক অনুভূতি মানুষ নিজের শরীরের বিশেষ স্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে প্রকৃতিগতভাবে যে লজ্জা অনুভব করে সেটি ঐ স্বাভাবিক অনুভূতির প্রাথমিক প্রকাশ কুরআন আমাদের জানায়সভ্যতার ক্রমোন্নতির ফলে মানুষের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এ লজ্জার সৃষ্টি হয়নি বা এটি বাইরের থেকে অর্জিত কোন জিনিসও নয়যেমন শয়তানের কোন কোন সুচতুর শিষ্য ও অনুসারী অনুমান করে থাকে বরং জন্মের প্রথম দিন থেকেই এ প্রকৃতিগত গুণটি মানুষের মধ্যে রয়েছে

দুইঃ মানুষকে তার স্বভাবসূলভ সোজা-সরল পথ থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে শয়তানের প্রথম কৌশলটি ছিল তার এ লজ্জার অনুভূতিতে আঘাত করাউলংগতার পথ দিয়ে তার জন্যে নির্লজ্জতা ও অশ্লিলতার দরজা খুলে দেয়া এবং যৌন বিষয়ে তাকে খারাপ পথে পরিচালিত করা অন্য কথায় বলা যায়প্রতিপেক্ষের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্যে তার যেদুর্বলতম স্থানটিকে সে বেছে নিয়েছিল সেই ছিল তার জীবনের যৌন বিষয়ক দিক যে লজ্জাকে মানবীয় প্রকৃতির দুর্গরক্ষক হিসেবে মহান আল্লাহ নিযুক্ত করেছিলেন তারই ওপর এনেছে সে প্রথম আঘাতটি শয়তান ও তার শিষ্যবর্গের এ কর্মনীতি আজো অপরিবর্তিত রয়েছে মেয়েদেরকে উলংগ করে প্রকাশ্য বাজারে না দাঁড় করানো পর্যন্ত তাদের প্রগতির কোন কার্যক্রম শুরুই হতে পারে না

তিনঃ অসৎকাজ করার প্রকাশ্য আহবানকে মানুষ খুব কমই গ্রহণ করেএটিও মানুষের স্বভাবসূলভ প্রবণতা সাধারণত তাকে নিজের জালে আবব্ধ করার জন্যে তাই প্রত্যেক অসৎকর্মের আহকায়ককে কল্যাণকামীর ছদ্মবেশে আসতে হয়

চারঃ মানুষের মধ্যে উচ্চতর বিষয়াবলী যেমন মানবিক পর্যায় থেকে উন্নতি করে উচ্চতর মার্গে পৌছার বা চিরন্তন জীবনলাভের স্বাভাবিক আকাংকা থাকে আর শয়তান তাকে ধোঁকা দেবার ক্ষেত্রে প্রথম সাফল্য অর্জন করে এ পথেই সে মানুষের এ আকাংখাটির কাছে আবেদন জানায় শয়তানের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হচ্ছেসে মানুষের সামনে তাকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়ার এবং বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নতর অবস্থায় পৌছিয়ে দেবার টোপ ফেলেতারপর তাকে এমন পথের সন্ধান দেয়যা তাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে যায়

পাঁচঃ সাধারণভাবে একথাটির প্রচলিত হয়ে গেছে যেশয়তান প্রথমে হযরত হাওয়াকে তার প্রতারণা জালে আবদ্ধ করেতারপর হযরত আদমকে জালে আটকাবার জন্যে তাকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করে কিন্তু কুরআন এ ধারণা খণ্ডন করে কুরআনের বক্তব্য হচ্ছেশয়তান তাদের উভয়কেই ধোঁকা দেয় এবং তারা উভয়েই শয়তানের ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয় আপাতদৃষ্টিতে এটা একটি মামুলী কথা বলে মনে হয় কিন্তু যারা জানেনহযরত হওয়া সম্পর্কিত এ সাধারন্যে প্রচলিত বক্তব্যটি সারা দুনিয়ায় নারীর নৈতিক সামাজিক ও আইনগত মর্যাদা হ্রাস করার ক্ষেত্রে কত বড় ভূমিকা পালন করেছে একমাত্র তারাই কুরআনের এ বর্ণনার যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন

ছয়ঃ এরূপ ধারণা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই যেনিষিদ্ধ গাছের এমন কোন বিশেষ গুণ ছিলযে কারণে তার ফল মুখ দেবার সাথে সাথেই হযরত আদম ও হাওয়ার লজ্জাস্থান অনাবৃত হয়ে গিয়েছিল আসলে এটি কেবল আল্লাহর নাফরমানিরই ফলশ্রুতি ছিল আল্লাহ ইতিপূর্বে নিজের ব্যবস্থাপনায় তাদের লজ্জাস্থান আবৃত করেছিলেন তারা তাঁর নির্দেশ অমান্য করার সাথে সাথেই তিনি তাদের ওপর থেকে নিজের হেফাজত ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে নিয়েছিলেনতাদের আবরণ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তারা যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করার ব্যবস্থা করুক এ কাজের দায়িত্ব তাদের নিজেদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন আর যদি তারা প্রয়োজন মনে না করে অথবা এ জন্যে প্রচেষ্টা না চালায় তাহলে তারা যেভাবেই বিচরণ করুক না কেনতাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না এভাবে যেন চিরকালের জন্যে এ সত্যটি প্রকাশ করে দেয়া হলো যেমানুষ আল্লাহর নাফরমানী করলে একদিন না একদিন তার আবরণ উন্মুক্ত হয়ে যাবেই এবং মানুষের প্রতি আল্লাহর সাহায্যসহযোগিতা ততদিন থাকবে যতদিন সে থাকবে আল্লাহর হুকুমের অনুগত আনুগত্যের সীমানার বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই সে আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারবে না বরং তখন তাকে তার নিজের হাতেই সঁপে দেয়া হবে বিভিন্ন হাদীসে নবী সা. এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবংএ সম্পর্কে তিনি দোয়া করেছেন

اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْ

হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমতের আশা করি কাজেই এক মুহুর্তের জন্যেও আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করে দিয়ো না”

সাতঃ শয়তান একথা প্রমাণ করতে চাচ্ছিল যেতার মোকাবিলায় মানুষকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে সে তার যোগ্য নয় কিন্তু প্রথম মোকাবিলায় সে পরিজিত হলো সন্দেহ নেইএ মোকাবিলায় মানুষ তার রবের নির্দেশ মেনে চলার ব্যাপারে পূর্ণ সফলকাম হতে পারেনি এবং তার এ দুর্বলতাটিও প্রকাশ হয়ে পড়লো যেতার পক্ষে নিজের প্রতিপক্ষের প্রতারণা জালে আবদ্ধ হয়ে তার আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া সম্ভব কিন্তু এ প্রথম মোকাবিলায় একথাও চূড়ান্ত ভাবে প্রমানিত হয়ে গেছে যেমানুষ তার নৈতিক মর্যাদার দিক দিয়ে একটি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি প্রথমত শয়তান নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার ছিল আর মানুষ নিজে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করেনি রবং শ্রেষ্ঠত্ব তাকে দান করা হয়েছে দ্বিতীয়ত শয়তান নির্জলা অহংকার ও আত্মাম্ভরিতার ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে অন্যদিকে মানুষ স্বেচ্ছায় ও স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেনি বরং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে এতে প্রবৃত্ত হয় অসৎকাজের প্রকাশ্য আহবানে সে সাড়া দেয়নি বরং অসৎকাজের আহবায়ককে সৎকাজের আহবায়ক সেজে তার সামনে আসতে হয়েছিল সে নীচের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে নীচের দিকে যায়নি বরং এ পথটি তাকে উপরের দিকে নিয়ে যাবে এ ধোকায় পড়ে সে নীচের দিকে যায় তৃতীয়ত শয়তানকে সতর্ক করার পর সে নিজের ভুল স্বীকার করে বন্দেগীর দিকে ফিরে আসার পরিবর্তে নাফরমানীর ওপর আরো বেশী অবিচল হয়ে যায় অন্যদিকে মানুষকে তার ভূলের ব্যাপারে সতর্ক করে দেবার পর সে শয়তানের মত বিদ্রোহ করেনি বরং নিজের ভূল বুঝতে পারার সাথে সাথেই লজ্জিত হয়ে পড়ে নিজের ত্রুটি স্বীকার করেবিদ্রোহ থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের রবের রহমতের ছত্রছায়ায় আশ্রয় খুঁজতে থাকে

আটঃ এভাবে শয়তানের পথ ও মানুষের উপযোগী পথ দু’টি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর মোকাবিলায় বিদ্রোহের ঝাণ্ডা বুলন্দ করাসতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও সগর্বে নিজের বিদ্রোহাত্মক কর্মপদ্ধতির ওপর অটল হয়ে থাকা এবং যারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে চলে তাদেরকেও বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করে গোনাহ ও নাফরমানীর পথে টেনে আনার চেষ্টা করাই হচ্ছে নির্ভেজাল শয়তানের পথ বিপরীত পক্ষে মানুষের উপযোগী পথটি হচ্ছেঃ প্রথমত শয়তানের প্ররোচান ও অপহরণ প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হবে তার এ প্রচেষ্টায় বাধা দিতে হবে নিজের শত্রুর চাল ও কৌশল বুঝাতে হবে এবং তার হাতে থেকে বাচার জন্যে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে কিন্তু এরপর যদি কখনো তার পা বন্দেগী ও আনুগত্যের পথ থেকে সরেও যায় তাহলে নিজের ভূল উপলব্ধি করার সাথে সাথেই লজ্জায় অধোবদন হয়ে তাকে নিজের রবের দিকে ফিরে আসতে হবে এবং নিজের অপরাধ ও ভুলের প্রতিকার ও সংশোধন করতে হবে এ কাহিনী থেকে মহান আল্লাহ এ মৌল শিক্ষাটিই দিতে চান এখানে মানুষের মনে তিনি একথাগুলো বদ্ধমূল করে দিতে চান যেতোমরা যে পথে চলছো সেটি শয়তানের পথ এভাবে আল্লাহর হেদায়াতের পরোয়া না করে জিন ও মানুষের মধ্যকার শয়তানদেরকে নিজেদের বন্ধু ও অভিভাবকে পরিণত করা এবং ক্রমাগত সতর্ক বাণী উচ্চারণ করার পরও তোমাদের এভাবে নিজেদের ভুলের ওপর অবিচল থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মূলত নির্ভেজাল শয়তানী কর্মনীতি ছাড়া আর কিছুই নয় তোমরা নিজেদের আদি ও চিরন্তন দুশমনের ফাঁদে আটকা পড়ছো এবং তার কাছে পূর্ণ পরাজয় বরণ করছো শয়তান যে পরিণতির মুখোমুখি হতে চলেছেতোমাদের এ বিভ্রান্তির পরিণামও তাই হবে যদি তোমরা সত্যিই নিজেরা নিজেদের শত্রু না হয়ে গিয়ে থাকো এবং তোমাদের মধ্যে সামান্যতম চেতনাও থেকে থাকেতাহলে তোমরা নিজেদের ভুল শুধরিয়ে নাওসতর্ক হয়ে যাও এবং তোমাদের বাপ আদম ও মা হাওয়া পরিশেষে যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তোমরাও সেই একই পথ অবলম্বন করো

﴿قَالَ اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَىٰ حِينٍ﴾

২৪ তিনি বললেনঃ “নেমে যাও,১৪  তোমরা পরষ্পরের শত্রু এবং তোমাদের জন্য একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত পৃথিবীতেই রয়েছে বসবাসের জায়গা ও জীবন যাপনের উপকরণ

১৪. হযরত আদম ও হযরত হাওয়া আ.কে জান্নাত থেকে বের হয়ে যাওয়ার এ হুকুম দেয়া হয়েছিল শাস্তি হিসেবেএরূপ ধারণা পোষণ করার কোন কারণ নেই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে একথা সুষ্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দেয়া হয়েছে যেআল্লাহ তাঁদের তাওবা কবুল করেন এবং তাদেরকে মাফ করে দেন কাজেই এ নির্দেশের মধ্যে শাস্তির কোন ব্যাপার থাকতে পারে না বরং যে উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এর মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্যটিই পূর্ণ হয়েছে (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা আল বাকারাহ-এর ৪৮-৫৩ নম্বর টীকা)

﴿قَالَ فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيهَا تَمُوتُونَ وَمِنْهَا تُخْرَجُونَ﴾

২৫ আর বললেনঃ “সেখানেই তোমাদের জীবন যাপন করতে এবং সেখানেই মরতে হবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের সবশেষে আবার বের করে আনা হবে

﴿يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا ۖ وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ ۚ ذَٰلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ﴾

২৬ হে বনী আদম!১৫ তোমাদের শরীরের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকার এবং তোমাদের দেহের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বিধানের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম এই আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতমসম্ভবত লোকেরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে

১৫. এবার আদম ও হাওয়ার ঘটনার একটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরববাসীদের সামনে তাদের নিজেদের জীবনে শয়তানী ভ্রষ্টতাপ্রতারণার একই অত্যন্ত সুষ্পষ্ট প্রভাবের প্রতি অংগলী নির্দেশ করা হয়েছে তারা কেবলমাত্র সৌন্দর্য সামগ্রী হিসেবে ও বিভিন্ন ঋতুর প্রভাব থেকে শারীরিকভাবে আত্মরক্ষা করার জন্যে পোশাক ব্যবহার করতো কিন্তু এর যে প্রাথমিক ও মৌলিক উদ্দেশ্য শরীরের লজ্জাস্থানগুলোকে আবৃত করাসেটি তাদের কাছে কোন গুরুত্ব লাভ করেনি নিজেদের লজ্জাস্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে তারা মোটেই ইতস্তত করতো না প্রকাশ্য স্থানে উলংগ হয়ে গোসল করাপথে ঘাটে যেখানে সেখানে প্রকাশ্য জায়গায় প্রকৃতির ডাকে উদোম হয়ে বসে পড়াপরণের কাপড় খুলে পড়ে যেতে এবং লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যেতে থাকলেও তার পরোয়া না করা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রতিদিনের অভ্যাস সবচেয়ে মারাত্মক ছিল হজ্জের সময় তাদের অসংখ্য লোকের কাবার চারদিকে উলংগ হয়ে তাওয়াফ করা এ ব্যাপারে তাদের পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই ছিল কিছু বেশী নির্লজ্জ তাদের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি ধর্মীয় কাজ এবং সৎকাজ মনে করেই তারা এটি করতো আর যেহেতু এটি কেবল আরবদের বৈশিষ্ট্য ছিল না রবং দুনিয়ার অধিকাংশ জাতি ও নির্লজ্জ বেহায়াপনায় লিপ্ত ছিল এবং আজো আছে তাই এখানে কেবলমাত্র আরববাসীদেরকে সম্বোধন করা হয়নি বরং ব্যাপকভাবে সারা দুনিয়ার মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে এখানে সমগ্র মানব জাতিকে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যেদেখো শয়তানী প্রতারণার একটি সুষ্পষ্ট আলামত তোমাদের নিজেদের জীবনেই রয়েছে তোমরা নিজেদের রবের পথনির্দশনার তোয়াক্কা না করে এবং নিজেদের নবীরাসূলের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছো আর সে তোমাদেরকে মানবিক প্রকৃতির পথ থেকে বিচ্যুত করে সেই একই নির্লজ্জতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে যার মধ্যে ইতিপূর্বে সে তোমাদের প্রথম পিতা-মাতাকে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল এ ব্যাপারে চিন্তা করলে প্রকৃত সত্য তোমাদের সামনে সুষ্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে অর্থাৎ রাসূলদের নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনা ছাড়া তোমরা নিজেদের প্রকৃতির প্রাথমিক দাবীগুলো পর্যন্ত ও বুঝতে এবং তা পূর্ণ করতে অক্ষম

﴿يَا بَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ الْجَنَّةِ يَنزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ﴾

২৭ হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনিভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার জন্যে তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না এ শয়তানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি১৬

১৬. এ আয়াত গুলোতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সুষ্পষ্ট হয়ে সামনে ভেসে উঠেছেঃ

একঃ পোশাক মানুষের জন্যে কোন কৃত্রিম জিনিস নয় বরং এটি মানব প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী আল্লাহ মানুষের দেহের বহির্ভাগে পশুদের মত কোন লোমশ আচ্ছাদন জন্মগতভাবে তৈরী করে দেননি বরং লজ্জার অনুভূতি তার প্রকৃতির মধ্যে গচ্ছিত রেখে দিয়েছেন তিনি মানুষের যৌন অংগগুলোকে কেবলমাত্র যৌনাংগ হিসেবেই তৈরী করেন না বরং এগুলোকে “সাওআত” ও বানিয়েছেন আরবী ভাষায় “সাওআত” এমন জিনিসকে বলা হয় যার প্রকাশকে মানুষ খারাপ মনে করে আবার এ প্রকৃতিগত লজ্জার দাবী পূরণ করার জন্যে তিনি মানুষকে কোন তৈরি করা পোষাক দেননি বরং তার প্রকৃতিকে পোশাক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছেন,  أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا যাতে নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করে সে প্রকৃতির এ দাবীটি উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহর সৃষ্ট উপাদান ও উপকারণ সমূহ কাজে লাগিয়ে নিজের জন্যে পোশাক তৈরী করতে সক্ষম হয়

দুইঃ এ প্রাকৃতিক ও জন্মগত উপলব্ধির প্রেক্ষিতে মানুষের জন্যে পোশাকের নৈতিক প্রয়োজন অগ্রগণ্য অর্থাৎ প্রথমে সে “সাওআত” তথা নিজের লজ্জাস্থান আবৃত করবে আর তার স্বভাবগত চাহিদা ও প্রয়োজন দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত অর্থাৎ তারপর তার পোশাক তার জন্যে “রীশ”অর্থাৎ দৈহিক সৌন্দর্য বিধান করবে এবং আবহাওয়ার প্রভাব থেকে তার দেহ সৌষ্ঠবকে রক্ষা করবেএ পর্যায়েও মানুষ ও পশুর ব্যাপার স্বভাবতই সম্পূর্ণ ভিন্নপশুর শরীরের লোমশ আচ্ছাদন মূলত তার জন্যে “রীশ” অর্থাৎ তার শরীরের শোভা বর্ধন ও ঋতুর প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা করে তার লোমশ আচ্ছাদন তার লজ্জাস্থান ঢাকার কাজ করে না কারণ তার যৌনাংগ আদতে তার সাওআত বা লজ্জাস্থান নয় কাজেই তাকে আবৃত করার জন্যে পশুর স্বভাবও প্রকৃতিতে কোন অনুভূতি ও চাহিদা থাকে না এবং তার চাহিদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে তার জন্যে কোন পোশাকও সৃষ্টি করা হয় না কিন্তু মানুষ যখন শয়তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করলো তখন ব্যাপারটি আর উল্টে গেলো শয়তান তার এ শিষ্যদেরকে এভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলো যেতোমাদের জন্যে পোশাকের প্রয়োজন পশুদের জন্য পোশাকের প্রয়োজনের সমপর্যায়ভুক্তআর পোশাক দিয়ে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার ব্যাপারটি মোটেই কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়বরং পশুদের অংগপ্রত্যংগ যেমন তাদের লজ্জাস্থান হিসেবে বিবেচিত হয় নাঠিক তেমনি তোমাদের এ অংগপত্যংগ গুলোও লজ্জাস্থান নয় বরং এগুলো নিছক যৌনাংগ

তিনঃ মানুষের পোশাক কেবলমাত্র তার লজ্জাস্থান আবৃত করার এবং তার শারীরিক শোভাবর্ধন ও দেহ সংরক্ষণের উপায় হবেএতটুকুই যথেষ্ঠ নয় বরং আসলে এ ব্যাপারে তাকে অন্তত এতটুকু মহত্তর মানে পৌছতে হবেযার ফলে তার পোশাক তাকওয়ার পোশাকে পরিণত হয় অর্থাৎ তার পোশাক দিয়ে সে পুরোপুরি ‘সতর’ তথা লজ্জাস্থান ঢেকে ফেলবে সৌন্দর্য চর্চা ও সাজসজ্জার মাধ্যমে শরীরের শোভা বর্ধন করার ক্ষেত্রে তা সীমা অতিক্রম করে যাবে না বা ব্যক্তির মর্যাদার চেয়ে নিম্ন মানেরও হবে না তার মধ্যে গর্বঅহংকার ও আত্মম্ভরিতার কোন প্রদর্শনী থাকবে না আবার এমন কোন মানসিক রোগের প্রতিফলনও তাতে থাকবে না যার আক্রমণের ফলে পুরুষ নারীসূলভ আচরণ করতে থাকে,নারী করতে থাকে পুরুষসূলভ আচরণ এবং এ জাতি নিজেকে অন্য এক জাতির সদৃশ বানাবার প্রচেষ্টায় নিজের নিজের হীনতা ও লাঞ্ছনার জীবন্ত প্রতীকে পরিণত হয় যেসব লোক নবীদের প্রতি ঈমান এনে নিজেদেরকে পুরোপুরি আল্লাহর পথনির্দেশনার আওতাধীন করে দেয়নি তাদের পক্ষে পোশাকের ব্যাপারে এ কাংখিত মহত্তর মানে উপনীত হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয় যখন তারা আল্লাহর পথনির্দশনা গ্রহণে অসম্মতি জানায় তখন শয়তানদেরকে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক বানিয়ে দেয়া হয় এবং এ শয়তান তাদেরকে কোন না কোনভাবে ভূলভ্রান্তি ও অসৎকাজে লিপ্ত করেই ছাড়ে

চারঃ দুনিয়ার চারদিকে আল্লাহর যেসব অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এবং যেগুলো মহাসত্যের সন্ধানলাভের ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করেপোশাকের ব্যাপারটিও তার অন্যতম তবে এখানে শর্ত হচ্ছেমানুষের নিজের তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে ওপরে আমি যেসব সত্যের দিকে ইংগিত করেছে সেগুলোকে একটু গভীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে পোশাক কোন দৃষ্টিতে আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন তা সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে

﴿وَإِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً قَالُوا وَجَدْنَا عَلَيْهَا آبَاءَنَا وَاللَّهُ أَمَرَنَا بِهَا ۗ قُلْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ ۖ أَتَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾

২৮ তারা যখন কোন অশ্লিল কাজ করে তখন বলেআমাদের বাপ-দাদারদেকে আমরা এভাবেই করতে দেখেছি এবং আল্লাহই আমাদের এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন১৭  তাদেরকে বলে দাও আল্লাহ কখনো নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার হুকুম দেন না১৮  তোমরা কি আল্লাহর নাম নিয়ে এমন কথা বলো যাকে তোমরা আল্লাহর কথা বলে জানো না?

১৭. এখানে আরবাসীদের উলংগ অবস্থায় কাবা শরীফ তাওয়াফ করার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে ইতিপূর্বে আমি এ সম্পর্কে আলোচনা করেছিএকটি ধর্মীয় কাজ মনে করেই তারা এটা করতো তারা মনে করতোআল্লাহ তাদেরকে এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন

১৮. আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি অতি সংক্ষিপ্ত বাক্য কিন্তু আসলে এর মধ্যে কুরআন মজীদ উলংগ তাওয়াফকারীদের জাহেলী আকীদার বিরুদ্ধে একটি মস্তবড় যুক্তি পেশ করেছে এ যুক্তি উপস্থাপন পদ্ধতিটি অনুধাবন করতে হলে ভূমিকা স্বরূপ দু’টি কথা অবশ্যি বুঝে নিতে হবেঃ

একঃ আরববাসীরা যদিও নিজেদের কোন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের সময় উলংগ হতো এবং একে একটি পবিত্র ধর্মীয় কাজ মনে করতো কিন্তু উলংগ হওয়াটাকে তারা এমনিতে একটি লজ্জাজনক কাজ বলে মনে করতো এবং এটি তাদের নিকট স্বীকৃতি ছিল তাই কোন সম্ভ্রান্ত ভদ্র ও অভিজাত আরব কোন সংস্কৃতিবান মজলিসে বা কোন বাজরে অথবা নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উলংগ হওয়াটাকে কোনক্রমেই পছন্দ করতো না

দুইঃ উলংগপনাকে লজ্জাজনক জানা সত্ত্বেও তারা একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নিজেদের ইবাদতের সময় উলংগ হতো আর যেহেতু নিজেদের ধর্মকে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ধর্ম বলে মনে করতো তাই তারা মনে করতো এ আনুষ্ঠানিকতাটিও আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এরই ভিত্তিতে কুরআন মজীদ এখানে এ যুক্তি উপস্থাপন করেছে যেযে কাজটি অশ্লীল এবং যাকে তোমরা নিজেরাও অশ্লীল বলে জানো ও স্বীকার করো সে সম্পর্কে তোমরা কেমন কর একথা বিশ্বাস করো যেআল্লাহর এর হুকুম দিয়ে থাকবেনআল্লাহর পক্ষ থেকে কখনো কোন অশ্লীল কাজের হুকুম আসতে পারে না আর যদি তোমাদের ধর্মে এমন কোন হুকুম পাওয়া যায় তাহলে তোমাদের ধর্ম যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নয়এটিই তার অকাট্য প্রমাণ

﴿قُلْ أَمَرَ رَبِّي بِالْقِسْطِ ۖ وَأَقِيمُوا وُجُوهَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ ۚ كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ﴾

২৯ হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও আমার রব তো সততা ও ইনসাফের হুকুম দিয়েছেনতাঁর হুকুম হচ্ছেপ্রত্যেক ইবাদত নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখো এবং নিজের দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্য করে নিয়ে তাঁকেই ডাকো যেভাবে তিনি এখান তোমাদের সৃষ্টি করেছেন ঠিক তেমনিভাবে তোমাদের আবার সৃষ্টি করা হবেও১৯

১৯. এর অর্থ হচ্ছেতোমাদের এসব অর্থহীন রীতি-আনুষ্ঠানিকতার সাথে আল্লাহর দীনের কি সম্পর্কতিনি যে দীনের শিক্ষা দিয়েছেন তার মূলনীতিগুলো নিম্নরূপঃ

একঃ মানুষের নিজের জীবনকে সত্যসততান্যায়নিষ্ঠাও ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে

দুইঃ ইবাদতের ক্ষেত্র সঠিক লক্ষ্যের ওপর অবিচল থাকতে হবে অর্থাৎ তার ইবাদতের আল্লাহ ছাড়া আর কারোর বন্দেগীর সামান্যতম স্পর্শও থাকবে না আসল মাবুদ আল্লাহর দিকে ফিরে ছাড়া আর কোন দিকে ফিরে তার আনুগত্যদাসত্বহীনতাও দীনতার সামান্যতম প্রকাশও ঘটতে পারবে না

তিনঃ পথনির্দেশনাসাহায্যসমর্থনপৃষ্ঠপোষকতা,হেফাজত ও সংরক্ষণের জন্যে একমাত্র আল্লাহরই কাছে দোয়া চাইতে হবে কিন্তু এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছেএসব বিষয়ের জন্যে দোয়া প্রার্থীকে পূর্বাহ্নেই নিজের দীনকে একান্তভাবে আল্লাহ জন্য নিদির্ষ্ট করতে হবে জীবনের সমগ্র ব্যবস্থাকুফরীশিরকগোনাহ ও অন্যের বন্দগীর ভিত্তিতে পরিচালিত হবেকিন্তু সাহায্য চাওয়া হবে আল্লাহর কাছে এ বলেহে আল্লাহ! তোমার বিরুদ্ধে আমার এ বিদ্রোহে আমাকে সাহায্য করোএমনটি যেন না হয়

চারঃ এ মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যেএ দুনিয়ায় সে যেভাবে জন্ম নিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে অন্য একটি জগতেও তার জনম হবে এবং সেখানে আল্লাহর কাছে তার সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে

﴿فَرِيقًا هَدَىٰ وَفَرِيقًا حَقَّ عَلَيْهِمُ الضَّلَالَةُ ۗ إِنَّهُمُ اتَّخَذُوا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ اللَّهِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُم مُّهْتَدُونَ﴾

৩০ একটি দলকে তিনি সোজা পথ দেখিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অন্য দলটির ওপর গোমরাহী সত্য হয়ে চেপেই বসেছে কারণ তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তানদেরকে নিজেদের অভিভাবকে পরিণত করেছে এবং তারা মনে করছেআমরা সঠিক পথেই আছি

﴿يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ﴾

৩১ হে বনী আদম! প্রত্যেক ইবাদাতের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও২০  আর খাও ও পান করো কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যেয়ো নাআল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না২১

২০. এখানে সুন্দর সাজ বলতে পূর্ণ পোশাক-পরিচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে দাঁড়াবার সময় কেবল মাত্র লজ্জাস্থান ঢাকাই যথেষ্ট হবে না বরং একই সংগে সামর্থ অনুযায়ী নিজের পূর্ণ পোশাক পরে নিতে হবেযার মাধ্যমে লজ্জাস্থান আবৃত হবার সাথে সাথে সৌন্দর্যের প্রকাশও ঘটবে মূর্খ ও অজ্ঞ লোকেরা নিজেদের ভ্রান্তিনীতির ভিত্তিতে ইবাদতের ক্ষেত্রে যেসব কাজ করতো এবং এখনো করে চলছে এ নির্দেশে তার প্রতিবাদ করা হয়েছে তারা মনে করতো উলংগ বা অর্ধউলংগ হয়ে এবং নিজেদের আকারআকৃতি ও বেশভুষা বিকৃত করে আল্লাহর ইবাদত করা উচিত আল্লাহ বলেননিজেকে সুন্দর সাজে সজ্জিত করে এমন আকার আকৃতি ধারণ করে ইবাদত করতে হবে যার মধ্যে উলংগপনা তো দূরের কথা অশ্লীলতার লেশমাত্রও যেন না পাওয়া যায়

২১. অর্থাৎ তোমাদের দৈন্যদশাঅনাহারক্লিষ্ট জীবন এবং হালাল জীবিকা থেকে বঞ্চিত থাকা আল্লাহর কাছে প্রিয় নয় তাঁর বন্দেগী করার জন্যে তোমাদের কোন পর্যায়ে এসবের শিকার হতে হোক-এটা তিনি চান না বরং তোমরা তার দেয়া উত্তম পোশাক পরলে এবং পবিত্র ও হালাল খাবার খেলে তিনি খুশী মানুষ যখন হালালকে হারাম করার বা হারামকে হালাল করার জন্যে তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে তখনি সেটা তাঁর শরীয়াতে আসল গোনাহ হিসেবে চিহ্নিত হয়

﴿قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ ۚ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ﴾

৩২ হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাওআল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যে যেসব সৌন্দর্য সামগ্রী সৃষ্টি করেছেনসেগুলো কে হারাম করেছেআর আল্লাহর দেয়া পবিত্র জিনিসগুলো কে নিষিদ্ধ করেছে?২২  বলোদুনিয়ার জীবনেও এ সমস্ত জিনিস ঈমানদাদের জন্যেআর কিয়ামতের দিনে এগুলো তো একান্তাভাবে তাদেরই জন্যে হবে২৩  এভাবে যারা জ্ঞানের অধিকারী তাদের জন্যে আমার কথাগুলো আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণনা করে থাকি

২২. এর অর্থ হচ্ছেআল্লাহ তো তাঁর দুনিয়ার সমস্ত শোভাসৌন্দর্য এবং সমস্ত পাক-পবিত্র জিনিস তাঁর বান্দাদের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন কাজেই এগুলো বান্দাদের জন্যে হারাম করে দেয়া কখনো তার উদ্দেশ্য হতে পারে না এখন যদি কোন ধর্ম বা নৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা এগুলোকে হারামঘৃণ্য অথবা আত্মিক উন্নতির প্রতিবন্ধক গণ্য করে তাহলে তার এ কাজটিই সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যেসেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি বাতিল ধর্মমতগুলোর বিরুদ্ধে কুরআন যেসব যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছে এটি তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি বস্তুত কুরআনের যুক্তি উপস্থাপন পদ্ধতি অনুধাবন করার জন্যে এ যুক্তিটি অনুধাবন করা একান্ত অপরিহার্য

২৩. অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সৃষ্ট সমস্ত জিনিস দুনিয়ার জীবনেও ঈমানদারদের জন্যেই কারণ তারাই আল্লাহর বিশ্বস্ত প্রজা আর একমাত্র নিমকহালালবিশ্বস্ত ও অনুগত লোকেরাই অনুগ্রহলাভের অধিকারী হতে পারে কিন্তু দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থাপনা যেহেতু পরীক্ষা ও অবকাশদানের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত তাই এখানে অধিকাংশ সময় আল্লাহর অনুগ্রহগুলো নিমকহারাম ও অকৃতজ্ঞদের মধ্যে ও বন্টিত হতে থাকে আর অনেক সময় বিশ্বস্ত ও নিমক হালালের তুলনায় তাদের ওপরই বেশী অনুগ্রহ বর্ষণ করা হয়ে থাকে তবে আখেরাত (যেখানকার সমস্ত ব্যবস্থাপনা হকসত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে)জীবনের আরাম আয়েশের সমস্ত উপকরণ এবং সমস্ত পবিত্র খাদ্য ও পানীয় একমাত্র অনুগতকৃতজ্ঞ ও নিমকহালাল বান্দাদের জন্যেই নির্ধারিত থাকবে যেসব নিমকহারাম বান্দা তাদের রবের দেয়া খাদ্যপানীয়ে জীবন ধারণ করার পরও তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড়িয়েছে তারা এর থেকে কোন অংশই পাবে না

﴿قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾

৩৩ হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাওআল্লাহ যেসব জিনিস হারাম করেছেন সেগুলো হচ্ছেঃ প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা,২৪  গোনাহ,২৫  সত্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি২৬  আল্লাহর সাথে তোমাদের কাউকে শরীক করা যার স্বপক্ষে তিনি কোন সনদ পাঠাননি এবং আল্লাহর নামে তোমাদের এমন কোন কথা বলাযা মূলত তিনি বলেছেন বলে তোমাদের জানা নেই  

২৪. ব্যাখ্যার জন্যে সূরা আল আনআ’মের ১২৮ও ১৩১টীকা দেখুন

২৫. এখানে মূল শব্দ হচ্ছে, إِثْمَ  (ইসম) এর আসল অর্থ হচ্ছে,ত্রুটিবিচ্যুতি।  إِثْمَة (ইসমাহ) এমন এক ধরনের উটনীকে বলা হয়যে দ্রুত চলতে পারে কিন্তু জেনে বুঝে অলসভাবে চলে এ থেকেই এ শব্দের মধ্যে গোনাহের ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ মানুষ যখন নিজের রবের আনুগত্য করার ও তাঁর হুকুম মেনে চলার ক্ষমতা ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও গড়িমসি ও গাফলতি করে এবং জেনে বুঝে ভুল-ত্রুটি করে তার সন্তুষ্টি লাভে অসমর্থ হয়তখন সেই আচরণটিকেই গোনাহ বলা হয়

২৬. অর্থাৎ নিজের সীমানা অতিক্রম করে এমন একটি সীমানায় পদার্পণ করা যেখানে প্রবেশ করার অধিকার মানুষের নেই এ সংজ্ঞার আলোকে বিচার করলে যারা বন্দেগীর সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর রাজ্যে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব ও আচরণ গ্রহণ করেযারা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে থেকেও নিজেদের অহংকার ও শ্রেষ্টত্বের ডংকা বাজায় এবং যারা মানুসের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেতারা সবাই বিদ্রোহী গণ্য হয়

﴿وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ ۖ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ﴾

৩৪ প্রত্যেক জাতির জন্য অবকাশের একটি সময় নির্দিষ্ট রয়েছে তারপর যখন কোন জাতির সময় পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মুহূর্তকালের জন্যেও তাকে বিলম্বিত বা ত্বরান্বিত করা হবে না২৭ 

২৭. অবকাশের সময় নির্দিষ্ট করার মানে এ নয় যেপ্রত্যেক জাতির জন্যে বছর,মাসদিন ধরে একটি আয়ুস্কাল নির্দিষ্ট করা হয় এবং এ সময়টি শেষ হয়ে যেতেই তাকে অবশ্যিই খতম করে দেয়া হয়বরং এর অর্থ হচ্ছেপ্রত্যেক জাতিকে দুনিয়ায় কাজ করার যে সুযোগ দেয়া হয়তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে ভাল ও মন্দের আনুপাতিক হার কমপক্ষে কতটুকু বরদাশত করা যেতে পারেএ অর্থে তার কাজ করার একটি নৈতিক সীমানা চিহ্নিত করা হয় যতদিন একটি জাতির মন্দ গুণগুলো তার ভাল গুণাবলীর তুলনায় ঐ আনুপাতিক হারের সর্বশেষ সীমার মধ্যে অবস্থান করতে থাকে ততদিন তাকে তার সমস্ত অসৎকর্ম সত্ত্বেও অবকাশ দেয়া হয়আর যখন তা ঐ সর্বশেষ সীমানা পার হয়ে যায় তখন এ ধরনের অসৎ বৃত্তিসম্পন্ন ও অসৎকর্মশীল জাতিকে আর কোন বাড়তি অবকাশ দেয়া হয়না (সূরা নূহের ৪-১০-১২ আয়াত দ্রষ্টব্য)

﴿يَا بَنِي آدَمَ إِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي ۙ فَمَنِ اتَّقَىٰ وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾

৩৫ (আর সৃষ্টির সূচনাপূর্বেই আল্লাহ একথা পরিষ্কার বলে দিয়েছেনঃ) হে বনী আদম! মনে রেখোযদি তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে কোন রাসূল এসে তোমাদেরকে আমার আয়াত শুনাতে থাকেতাহলে যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজের কর্মনীতির সংশোধন করে নেবেতার কোন ভয় এবং দুঃখের কারণ নেই

﴿وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾

৩৬ আর যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা বলবে এবং তার সাথে বিদ্রোহত্মাক আচরণ করবেতারাই হবে জাহান্নামের অধিবাসীসেখানে থাকবে তারা চিরকাল২৮

২৮. কুরআন মজীদের যেখানেই আদম ও হাওয়া আ. এর জান্নাত থেকে নামিয়ে দেবার ঘট্না উল্লেখিত হয়েছে (যেমন দেখুন সূরা আল বাকারাহ-এর ৪ রুকূ ও সূরা ত্বা-হা এর ৬ রুকূ) সেখানেই একথা বলা হয়েছে কাজেই এখানেও এটিকে এই একই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত মনে করা হবে অর্থাৎ যখন মানব জাতির জীবনের সূচনা হচ্ছিল ঠিক তখনই একথাটির পরিষ্কাভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল(দেখুন সূরা আলে ইমরানঃ ৬৯ টীকা)

﴿فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ ۚ أُولَٰئِكَ يَنَالُهُمْ نَصِيبُهُم مِّنَ الْكِتَابِ ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا يَتَوَفَّوْنَهُمْ قَالُوا أَيْنَ مَا كُنتُمْ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ ۖ قَالُوا ضَلُّوا عَنَّا وَشَهِدُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا كَافِرِينَ﴾

৩৭ একথা সুস্পষ্টযে ব্যক্তি ডাহা মিথ্যা কথা বানিয়ে আল্লাহর কথা হিসেবে প্রচার করে অথবা আল্লাহর সত্য আয়াত সমূহকে মিথ্যা বলে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হবেএ ধরনের লোকেরা নিজেদের তকদীরের লিখন অনুযায়ী তাদের অংশ পেতে থাকবে২৯  অবশেষে সেই সময় উপস্থিত হবে যখন আমার পাঠানো ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করার জন্যে তাদের কাছে এসে যাবে সে সময় তারা (ফেরেশতারা) তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেবলো এখন তোমাদের সেই মাবুদরা কোথায়যাদেরকে তোমরা ডাকতেআল্লাহকে বাদ দিয়েতারা বলবেসবাই আমাদের কাছ থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছে এবং তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যেবাস্তবিক পক্ষেই তারা সত্য অস্বীকারকারী ছিল

২৯. অর্থাৎ দুনিয়ায় যতদিন তাদের অবকাশের মেয়াদ নির্ধারিত থাকবে ততদিন তারা এখানে থাকবে এবং যে ধরনের ভাল বা মন্দ জীবন যাপন করার কথা তাদের নসীবে লেখা থাকবেসেই ধরনের জীবন তারা যাপন করবে

﴿قَالَ ادْخُلُوا فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُم مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ فِي النَّارِ ۖ كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَّعَنَتْ أُخْتَهَا ۖ حَتَّىٰ إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَٰؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِّنَ النَّارِ ۖ قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَٰكِن لَّا تَعْلَمُونَ﴾

৩৮ আল্লাহ বলবেনঃ যাওতোমরাও সেই জাহান্নামে চলে যাওযেখানে চলে গেছে তোমাদের পূর্বের অতিক্রান্ত জিন ও মানবগোষ্ঠী প্রত্যেকটি দলই নিজের পূর্ববর্তী দলের প্রতি অভিসম্পাত করতে করতে জাহান্নামে প্রবেশ করবে অবশেষে যখন সবাই সেখানে একত্র হয়ে যাবে তখন পরবর্তী প্রত্যেকটি দল পূর্ববর্তী দলের ব্যাপারে বলবেহে আমাদের রব! এরাই আমাদের গোমরাহ করেছেকাজেই এদেরকে আগুনের দ্বিগুণ শাস্তি দাও জওয়াবে বলা হবেপ্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ শাস্তিই রয়েছে কিন্তু তোমরা জানো না৩০

৩০. অর্থাৎ সর্বাবস্থায় তোমাদের প্রত্যেকটি দল কোন না কোন দলের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী দল ছিল কোন দলের পূর্ববর্তী দল উত্তরাধিকার হিসেবে যদি তার জন্যে ভুল ও বিপথগামী চিন্তা ও কর্ম রেখে গিয়ে থাকেতাহলে সে নিজেও তো তার পরবর্তীদের জন্যে একই ধরনের উত্তরাধীকার রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে যদি একটি দলের পথভ্রষ্ট হবার কিছুটা দায়-দায়িত্ব তার পূর্ববর্তীদের ওপর বর্তায় তাহলে তার পরবর্তীদের পথভ্রষ্ট হবার বেশ কিছু দায় দায়িত্ব তার নিজের ওপর বর্তায় তাই বলা হয়েছে প্রত্যেকের জন্যে দ্বিগুণ শাস্তিই রয়েছে একটি শাস্তি হচ্ছেনিজের ভুল পথ অবলম্বনের এবং অন্য শাস্তিটি অন্যদেরকে ভুল পথ দেখাবার একটি শাস্তি নিজের অপরাধের এবং অন্য শাস্তিটি অন্যদের জন্যে পূর্বাহ্নের অপরাধের উত্তরাধিকার রেখে আসার

এ বিষয়বস্তুটিকে হাদীসে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছেঃ

مَنِ ابْتدَعَ بِدعةً ضَلالَةً لا يَرْضَاها اللهُ ورسولُهُ كان عليه من الاثم مِثلُ آثامِ مَن عَمِلَ بِها لا يُنقِصُ ذلِك من أوزارِ هم شيئًا

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অপছন্দ করেন এমন কোন নতুন বিভ্রান্তিকর কাজের সূচনা করেতার ঘাড়ে সেই সমস্ত লোকের পথভ্রষ্টতার গোনাহও চেপে বসবে যারা তার উদ্ভাবিত পথে চলেছে তবে এ জন্যে ঐ লোকেদের নিজেদের দায়-দায়িত্ব মোটেই লাঘব হবে না”

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ

لا تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا، إلَّا كانَ علَى ابْنِ آدَمَ الأوَّلِ كِفْلٌ مِن دَمِها، لأنَّهُ أوَّلَ مَن سَنَّ القَتْلَ.

এই দুনিয়ায় যে ব্যক্তিকেই অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়সেই অন্যায় হত্যাকাণ্ডের পাপের একটি অংশ হযরত আদমের সেই প্রথম সন্তানটির আমলনামায় লিখিত হয়যে তার ভাইকে হত্যা করেছিল কারণ মানুষ হত্যার পথ সে-ই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করেছিল”

এ থেকে জানা যায় যে ব্যক্তি দল কোন ভুল চিন্তা বা কর্মনীতির ভিত রচনা করে সে কেবল নিজের ভূলের ও গোনাহের জন্যে দায়ী হয় না বরং দুনিয়ায় যতগুলো লোক তার দ্বারা প্রভাবিত হয় তাদের সবার গোনাহের দায়িত্বের একটি অংশও তার আমলনামায় লিখিত হতে থাকেযতদিন তার এ গোনাহের প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকেততদিন তার আমলনামায় গোনাহ লিখিত হতে থাকে তাছাড়া এ থেকে একথাও জানা যায় যেপ্রত্যেক ব্যক্তির নেকী বা গোনাহের দায়-দায়িত্ব কেবল তার নিজের ওপরই বর্তায় না বরং অন্যান্য লোকদের জীবনে তার নেকী ও গোনাহের কি প্রভাব পড়ে সে জন্যে ও তাকে জবাবদিহি করতে হবে

উদাহরণ স্বরূপ একজন ব্যভিচারী কথাই ধরা যাক যাদের শিক্ষা ও অনুশীলনের দোষেযাদের সাহচর্যের প্রভাবেযাদের খারাপ দৃষ্টান্ত দেখে এবং যাদের উৎসাহ দানের ফলে ঐ ব্যক্তির মধ্যে যিনা করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়তারা সবাই তার যিনাকারি হয়ে গড়ে উঠার ব্যাপারে অংশীদারআবার ঐ লোকগুলোও পূর্ববর্তী যেসব লোকদের কাছে থেকেই কুদৃষ্টেকুচিন্তাকুসংকল্প ও কুকর্মের প্ররোচানা উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করে তাদের কাঁধে পর্যন্ত ও তার দায়দায়িত্ব গিয়ে পৌছায় এমন কি এ ধারা অগ্রসর হতে হতে সেই প্রথম ব্যক্তিতে গিয়ে ঠেকে যে সর্বপ্রথম ভ্রান্ত পথে যৌন লালসা চরিতার্থ করে মানব জাতিকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল এ যিনাকারীর আমলনামায় এ অংশটি তার সমকালীনদের ও পূর্ববর্তী লোকদের সাথে সম্পর্কিত এছাড়া সে নিজেও নিজের যিনা ও ব্যভিচারের জন্যে দায়ীতাকে ভালমন্দের মধ্যে পার্থক্য করার যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলতাকে যে বিবেকবোধ দান করা হয়েছিল আত্মসংযমের যে শক্তি তার মধ্যে গচ্ছিত রাখা হয়েছিলসৎ লোকদের কাছ থেকে সে ভালমন্দ ও ন্যায়অন্যায়ের যে জ্ঞান লাভ করেছিলতার সামনে সৎলোকদের যেসব দৃষ্টান্ত সমুজ্জ্বল ছিলযৌন অসদাচারের অশুভ পরিণামের ব্যাপারে তার যেসব তথ্য জানা ছিলসে সবের কোনটিকেও সে কাজে লাগায়নি উপরন্তু সে নিজেকে কামনা বাসনার এমন একটি অন্ধ আবেগের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছিল যে কোন প্রকারে নিজের আকাংখা চরিতার্থ করাই ছিল যার অভিপ্রায় তার আমলমানার এ অংশটি তার নিজের সাথে সম্পর্কিততারপর এ ব্যক্তি যে গোনাহ নিজে করেছেএবং যাকে স্বকীয় প্রচেষ্টায় লালন করে চলেছে,তাকে অন্য লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে কোথাও থেকে কোন যৌন রোগের জীবানু নিজের মধ্যে বহন করে আনেতারপর তাকে নিজের বংশধরদের মধ্যে এবং না জানি আরো যে কত শত বংশদরদের মধ্যে ছড়িয়ে কত শত লোকদের জীবন ধ্বংস করে তা একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন কোথাও নিজের শুত্রুবীজ রেখে আসেযে শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব তারই বহন করা উচিত ছিলতাকে অন্য একজনের উপার্জনের অবৈধ অংশীদারতার সন্তানদের অধিকার থেকে জোরপূর্বক হিস্সা গ্রহণকারী এবং তার উত্তরাধিকারে অবৈধ শরীক বানিয়ে দেয় এ অধিকার হরণের ধারা চলতে থাকে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে বহুদূর পর্যন্তকোন কুমারী মেয়েকে ফুসলিয়ে ব্যভিচারের পথে টেনে আনে এবং তার মধ্যে এমন অসৎ গুণাবলী সৃষ্টি করে যা তার থেকে অন্যদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে নাজানি আরো কত দূর কত পরিবার ও কত বংশধরদের মধ্যে পৌছে যায় এবং কত পরিবারে বিকৃতি আনেনিজের সন্তানসন্তুতি আত্মীয়স্বজনবন্ধু-বান্ধব ও সমাজের অন্যান্য লোকদের সামনে সে নিজের চরিত্রের একটি কুদৃষ্টান্ত পেশ করে এবং অসংখ্য লোকের চরিত্র নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে এর প্রভাব চলতে থাকে দীর্ঘকালব্যাপী ইনসাফের দাবী হচ্ছেএ ব্যক্তি সমাজ দেহে যেসব বিকৃতি সৃষ্টি করলো সেগুলো তারই আমলনামায় লিখিত হওয়া উচিত এবং ততদিন পর্যন্ত লিখিত হওয়া উচিত যতদিন তার সরবরাহ করা অসৎ বৃত্তি ও অসৎকাজের ধারা দুনিয়ায় চলতে থাকে

সৎকাজ ও পূর্ণকর্মের ব্যাপারটিও অনুরূপ আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আমরা নেকীর ও সৎকাজের যে উত্তরাধিকার লাভ করেছি তার প্রতিদান তাদের সবার পাওয়া উচিতযারা সৃষ্টির শুরু থেকে নিয়ে আমাদের যুগ পর্যন্ত ওগুলো আমাদের কাছে হস্তান্তর করার ব্যাপারে অংশ নিয়েছেনএ উত্তরাধিকার নিয়ে তাকে সযত্নে হেফাজত করার ও তার উন্নতি বিধানের জন্যে আমরা যেসব প্রচেষ্টা চালাবো ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবো তার প্রতিদান আমাদেরও পাওয়া উচিত তারপর নিজেদের সৎপ্রচেষ্টার যেসব চিহ্ন ও প্রভাব আমরা দুনিয়ায় রেখে যাবো সেগুলোও আমাদের সৎকাজের হিসেবের খাতায় ততদিন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে লিখিত হওয়া উচিত যতদিন ও চিহ্ন ও প্রভাবগুলো দুনিয়ার বুকে অক্ষত থাকবেমানব জাতীর বংশধরদের মধ্যে এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকূল এর দ্বারা লাভবান হতে থাকবে

প্রতিটি বিবেকবান ব্যক্তিই একথা স্বীকার করবেন যেকুর্আন মজীদ প্রতিদানের এই যে পদ্ধতি উপস্থাপন করেছে একমাত্র এ পদ্ধতিতেই সঠিক ও পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এ সত্যটি ভালভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হলে যারা প্রতিদানের জন্যে এ দুনিয়ায় বর্তমান জীবনকেই যথেষ্ট মনে করেছে এবং যারা মনে করেছে যেজন্মান্তরের মাধ্যমে মানুষকে তার কাজের পুরোপুরি প্রতিদান দেয়া যেতে পারে তাদের সবার বিভ্রান্তিও সহজে দূর হয়ে যেতে পারে আসলে এ উভয় দলই মানুষের কার্যকলাপতার প্রভাবফলাফলও পরিণতির ব্যাপ্তি এবং ন্যায়সংগত প্রতিদান ও তার দাবীসমূহ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি একজন লোকের বয়স এখন ষাট বছরসে তার এ ষাট বছরের জীবনে ভালমন্দ যা কিছু করেছে না জানি উপরের দিকে কত দূর পর্যন্ত তার পূর্ব-পুরুষরা এ কাজের সাথে জড়িত এবং তাদের ওপর এর দায়িত্ব বর্তায় আর তাদেরকে এর পুরষ্কার বা শাস্তি দান করা কোনক্রমেই সম্ভব নয় তারপর এ ব্যক্তি আজ যে ভাল বা মন্দ কাজ করেছে তার মুত্যু সাথে সাথেই তা বন্ধ হয়ে যাবে না বরং তার প্রভাব চলতে থাকবে আগামী শত শত বছর পর্যন্ত হাজার হাজারলাখোলাখোবরং কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়বে এর প্রভাব চলা ও বিস্তৃত হওয়া পর্যন্ত তার আমলনামার পাতা খোলা থাকবে এ অবস্থায় আজই এ দুনিয়ার জীবনে এ ব্যক্তিকে তার উপার্জনের সম্পূর্ণ ফসল প্রদান করা কেমন করে সম্ভবকারণ তার উপার্জনের এক লাখ ভাগের এক ভাগও এখনো অর্জিত হয়নি তাছাড়াও এ দুনিয়ার সীমিত জীবন ও এর সীমিত সম্ভাবনা আদতে এমন কোন অবকাশই রাখেনি যার ফলে এখানে কোন ব্যক্তি তার উপার্জনের পূর্ণ ফসল লাভ করতে পারে মনে করুনকোন ব্যক্তি দুনিয়ায় এক মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং তার এ মারাত্মক অপকর্মের বিপুল বিষময় কুফল হাজার বছর পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এ ব্যক্তির এ ধরনের অপরাধের কথা একবার কল্পনা করুন এ দুনিয়ার যত বড় ধরনের দৈহিকনৈতিকমানসিক অথবা বস্তুগত শাস্তি দেয়া সম্ভবতার কোনটিও কি তার এ অপরাধের ন্যায়সংগত পরিপূর্ণ শাস্তি হতে পারেঅনুরূপভাবে দুনিয়ার সবচাইতে বড় যে পুরস্কারের কথা কল্পনা করা যেতে পারেতার কোনটিও কি এমন এক ব্যক্তির জন্যে যথেষ্ট হতে পারেযে সারা জীবন মানবজাতির কল্যাণার্থে কাজ করে গেছে এবং হাজার হাজার বছর পর্যন্ত অসংখ্য মানব সন্তান যার প্রচেষ্টার ফসল থেকে লাভবান হয়ে চলেছেযে ব্যক্তি কর্ম ও প্রতিদানের বিষয়টিকে এ দৃষ্টিতে বিচার করবে সে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করবে যেকর্মফলের জন্যে আসলে আর একটি জগতের প্রয়োজনযেখানে পূর্বের ও পরের সমগ্র মানব গোষ্ঠি একত্র হবে সকল মানুষের আমলনামা বন্ধ হয়ে যাবেহিসেব গ্রহণ করার জন্যে একজন সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানময় আল্লাহ বিচারের আসনে বসবেনএবং কর্মের পুরোপুরি প্রতিদান লাভ করার জন্যে মানুষের কাছে সীমহীন জীবন ও তার চারদিকে পুরষ্কার ও শাস্তির অঢেল সম্ভাবনা বিরাজিত থাকবে

আবার এই একই দিক সম্পর্কে চিন্তা করলে জন্মান্তরবাদীদের আর একটি মৌলিক ভ্রান্তির অপনোদনও হতে পারে এ ভ্রান্তিটিই তাদের পুনর্জন্মের ধারণা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে তারা এ সত্যই উপলব্ধি করতে পারেনি যে,মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত পঞ্চাশ বছরের জীবনের কর্মফল ভোগের জন্যে তার চাইতে হাজার গুণ বেশী দীর্ঘ জীবনের প্রয়োজন হয়অথচ পুনর্জন্মেবাদের ধারণা মতে তার পরিবর্তে পঞ্চাশ বছরের জীবন শেষ হতেই দ্বিতীয় আর একটি দায়িত্বপূর্ণ জীবনতারপর তৃতীয় জীবন এ দুনিয়াতেই শুরু হয়ে যায় আবার এসব জীবনে পুনরায় শাস্তিযোগ্য বা পুরষ্কাযোগ্য বহু কাজ করা হতে থাকে এভাবে তো হিসেব চুকে যাওয়ার পরিবর্তে আরো বাড়তেই থাকবে এবং কোন দিন তা খতম হওয়া সম্ভব হবে না

﴿وَقَالَتْ أُولَاهُمْ لِأُخْرَاهُمْ فَمَا كَانَ لَكُمْ عَلَيْنَا مِن فَضْلٍ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْسِبُونَ﴾

৩৯ প্রথম দলাটি দ্বিতীয় দলকে বলবেঃ (যদি আমরা দোষী হয়ে থাকি) তাহলে তোমরা কোন দিক দিয়ে আমাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ ছিলে? এখন নিজেদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো৩১ 

৩১. জাহান্নামবাসীদের এ পারস্পরিক সংলাপ ও তর্কবিতর্ক কুরআন মজীদের আরো কয়েকটি স্থানে বর্ণিত হয়েছে যেমন সূরা সাবার ৪ রুকূতে বলা হয়েছেঃ হায়!তোমরা যদি সেই সময়টি দেখতে পেতে যখন এ জালেমরা নিজেদের রবের সামনে দাঁড়াবে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে থাকবে যাদেরকে দুনিয়ায় দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তারা বড়ও শক্তিশালীর আসনে বসেছিল তাদেরকে বলবেঃ তোমরা না থাকলে আমরা মুমিন হতাম বড় ও শক্তিশালীর আসনে যারা বসেছিল তারা দুর্বল করে রাখা লোকদেরকে জবাব দেবেঃ তোমাদের কাছে যখন হেদায়াত এসেছিল তখন আমরা কি তা গ্রহণ করতে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছিলামনা,তা নয়বরং তোমরা নিজেরাই অপরাধী ছিলে এর অর্থ হচ্ছেতোমরা আবার কবে হেদায়াতের প্রত্যাশী ছিলেআমরা যদি তোমাদেরকে দুনিয়ার লোভ দেখিয়ে নিজেদের দাসে পরিণত করে থাকিতাহলে তোমরা লোভী ছিলে বলেই তো আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছিলে যদি আমরা তোমাদেরকে কিনে নিয়ে থাকিতাহলে তোমরা নিজেরাই তো বিকোবার জন্যে তৈরী ছিলেতবেই না আমরা কিনতে পেরেছিলাম যদি আমরা তোমাদেরকে বস্তুবাদবৈষয়িক লালসাজাতিপূজা এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন প্রকার গোমরাহী ও অসৎকাজে লিপ্ত করে থাকিতাহলে তোমরা নিজেরাই তো আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দুনিয়ার পূজারী সেজেছিলেতাবেই না তোমরা আল্লাহর আনুগত্য ও আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবানকারীদেরকে ত্যাগ করে আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলে যদি আমরা তোমাদের ধর্মের আবরণে প্রতারিত করে থাকিতাহলে যে জিনিসগুলো আমরা পেশ করছিলাম এবং তোমরা লুফে নিচ্ছিলেসেগুলোর চাহিদা তো তোমাদের নিজেদের মধ্যেই ছিল তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব প্রয়োজন পূরণকারী খুঁজে বেড়াচ্ছিলেযারা তোমাদের কাছে কোন নৈতিক বিধানের আনুগত্যের দাবী না করেই কেবলমাত্র তোমাদের ইস্পিত কাজই করে যেতে থাকতো আমরা সেই সব প্রয়োজন পুরণকারী তৈরী করে তোমাদেরকে দিয়েছিলাম তোমরা আল্লাহর আদেশ নিষেধ থেকে বেপরোয়া হয়ে দুনিয়ার কুকুর হয়ে গিয়েছিলে এবং তোমাদের পাপ মোচনের জন্য এমন এক ধরনের সুপারিশকারী খুঁজে বেড়াচ্ছিলে যারা তোমাদের গোনাহ মাফ করিয়ে দেয়ার সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেবে আমরা সেই সব সুপারিশকারী তৈরী করে তোমাদের কাছে সরবরাহ করেছিলাম তোমরা নিরস ও স্বাদগন্ধহীন দীনদাবীপরহেজগারীকুরবানীএবং প্রচেষ্টা ও সাধনার পরিবর্তে নাজাতলাভের জন্যে অন্য কোন পথের সন্ধান চাচ্ছিলে তোমরা চাচ্ছিলে এ পথে তোমাদের প্রবৃত্তি ও লালসা চরিতার্থ করতে নানা প্রকার স্বাদ আহরণ করতে কোন বাধা না থাকে এবং প্রবৃত্তি লালসা যেন সব রকমের বিধিনিষেধের আওতামুক্ত থাকে আমরা এ ধরনের সুদৃশ্য ধর্ম উদ্ভাবন করে তোমাদের সামনে রেখেছিলাম মোটকথা দায়দায়িত্ব কেবল আমাদের একার নয় তোমরাও এতে সমান অংশীদার আমরা যদি গোমরাহী সরবরাহ করে থাকিতাহলে তোমরা ছিলে তার খরিদ্দার

﴿إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ﴾

৪০ নিশ্চিতভাবে জেনে রাখোযারা আমার আয়াত সমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে এবং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেতাদের জন্য কখনো আকাশের দরজা খুলবে না তাদের জান্নাতে প্রবেশ এমনই অসম্ভব ব্যাপার যেমন সূঁচের ছিদ্রে উট প্রবেশ করানো অপরাধীরা আমার কাছে এভাবেই বদলা পেয়ে থাকে

﴿لَهُم مِّن جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَمِن فَوْقِهِمْ غَوَاشٍ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ﴾

৪১ তাদের জন্য বিছানাও হবে জাহান্নামের এবং ওপরের আচ্ছাদনও হবে জাহান্নামের এ প্রতিফল আমি জালেমদেরকে দিয়ে থাকি

﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾

৪২ অন্যদিকে যারা আমার আয়াত মেনে নিয়েছে এবং সৎকাজ করেছেআর এ পর্যায়ে আমি কাউকে তার সামর্থের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করি না-তারা হচ্ছে জান্নাতবাসী সেখানে তারা থাকবে চিরকাল

﴿وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ ۖ وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي هَدَانَا لِهَٰذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلَا أَنْ هَدَانَا اللَّهُ ۖ لَقَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ ۖ وَنُودُوا أَن تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾

৪৩ তাদের মনে পরষ্পরের বিরুদ্ধে যা কিছু গ্লানি থাকবে তা আমি বের করে দেবো৩২  তাদের নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত হবে এবং তারা বলবেঃ “প্রশংসা সব আল্লাহরই জন্যযিনি আমাদের এ পথ দেখিয়েছেন আমরা নিজেরা পথের সন্ধান পেতাম না যদি না আল্লাহ আমাদের পথ দেখাতেন্ আমাদের রবের পাঠানো রাসূলগণ যথার্থ সত্য নিয়েই এসেছিলেন সে সময় আওয়াজ ধ্বনিত হবেঃ “তোমাদেরকে এই যে জান্নাতের উত্তরাধিকারী বানানো হয়েছেএটা তোমরা লাভ করেছো সেই সমস্ত কাজের প্রতিদানে যেগুলো তোমরা অব্যাহতভাবে করতে৩৩

৩২. অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে এ সৎলোকেদের মধ্যে কিছু পারষ্পরিক তিক্ততামনোমালিন্য ও ভুল বুঝাবুঝি থেকে থাকলেও আখেরাতের জীবনে তা সব দূর করে দেয়া হবে তাদের মন পরস্পরের ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে যাবে তারা পরস্পর আন্তরিকতা সম্পন্ন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে দুনিয়ায় যে ব্যক্তি তাদের বিরোধী ছিলযে তাদের সাথে লড়াই করেছিল এবং তাদের বিরূপ সমালোচনা করেছিলতাকে তাদের সাথে জান্নাতের আপ্যায়নে শামিল থাকতে দেখে তাদের কারোর মনে কোন প্রকার কষ্টের উদ্রেক হবে না এ আয়াতটি পড়ে হযরত আলী রা. বলেছিলেনঃ আমি আশা করিআল্লাহ আমারউসমানেরতালহার ও যোবাইরের মধ্যে সাফাই করে দেবেন

এ আয়াতটিকে ব্যাপকভাবে দৃষ্টিতে দেখলে আমরা এ সিন্ধান্তে উপনীত হতে পারিযেএ দুনিয়ায় সৎলোকদের গায়ে ঘটনাক্রমে যেসব দাগ বা কলংক লেগে যায়সেই দাগগুলো সহকারে আল্লাহর তাদের কে জান্নাতে নিয়ে যাবেন না বরং সেখানে প্রবেশ করার আগে নিজের বিশেষ অনুগ্রহে তাদেরকে একেবারে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে নেবেন এবং একটি নিরেট নিষ্কলংক জীবন নিয়ে তারা সেখানে উপস্থিত হবেন

৩৩. বেহেশত এ ধরনের একটি মজার ব্যাপার ঘটবে জান্নাতবাসীরা নিজেদের কাজের জন্যে অহংকারে মেতে উঠবে না তারা একথা মনে করবে না যেতারা এমন কাজ করেছিল যার বিনিময়ে তাদের জন্যে জান্নাত অবধারিত হয়ে গিয়েছিল বরং তারা আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে তারা বলবেএসব আমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ নয়তো আমরা এর যোগ্য ছিলাম না অন্যদিকে আল্লাহ তাদের ওপর নিজের অনুগ্রহের বড়াই করবেন না বরং জবাবে বলবেনতোমরা নিজেদের কাজের বিনিময়ের এ মর্যাদার অধিকারী হয়েছো তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হচ্ছে সবই তোমাদের মেহনতের ফসলএগুলো ভিক্ষে করে পাওয়া নয় বরং তোমাদের প্রচেষ্টার ফল এবং তোমাদের কাজের মজুরী নিজেদের মেহনতের বিনিময়ে তোমরা এসব সম্মানজনক জীবিকা অর্জনের অধিকার লাভ করছো অপর দিকে আল্লাহ তাঁর জবাবের কথা এ ভাবে উল্লেখ করেছেন না যেআমি একথা বলবোরবং তিনি বলছেনআওয়াজ ধ্বনিত হবে,-এভাবে বর্ণনা করার কারণে বিষয়টি আরো বেশী আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে

আসলে এই একই ধরনের সম্পর্ক দুনিয়ায় আল্লাহ ও তাঁর নেক বান্দাদের মধ্যেও রয়েছে দুরাচারী লোকেরা দুনিয়ায় যে অনুগ্রহে লাভ করে থাকে তারা সে জন্যে গর্ব করে বেড়ায় তারা বলে থাবে,এসব আমাদের যোগ্যতাপ্রচেষ্টা,-সাধনা ও কর্মের ফল আর এ জন্যেই তারা প্রত্যেকটি অনুগ্রহলাভের কারণে আরো বেশী অহংকারী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীতে পরিণত হতে থাকে বিপরীত পক্ষে সৎলোকেরা যে কোন অনুগ্রহ লাভ করুক না কেন তাকে অবশ্যি আল্লাহ দান মনে করে সে জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আল্লাহর দান যতই বাড়তে থাকে ততই তারা বিনয় প্রকাশ করতে থাকেএবং ততই তাদের দয়াস্নেহ ও বদান্যতা বেড়ে যেতে থাকে তারপর আখেরাতের ব্যাপারেও তারা নিজেদের সৎকর্মের জন্যে অহংকারে মত্ত হয় নাতারা একথা বলে না যেতাদের গুনাহখাতা নিশ্চিতভাবেই মাফ করে দেয়া হবে বরং নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্যে তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে নিজেদের কর্মফলের পরিবর্তে আল্লাহর করুনা ও মেহেরবানীর ওপর পূর্ণ আস্থাশীল হয় তারা সবসময় ভয় করতে থাকেতাদের আমলনামায় প্রাপ্যের পরিবর্তে কোন দেনার খাত বের হয়ে না আসে বুখারী ও মুসলিম উভয় হাদীস গ্রন্থে উল্লিখত হয়েছে নবী সা. বলেছেনঃ

اعلموا أن أحدَكم لن يُدخِلَه عملُه الجنَّةَ

খুব ভালভাবেই জেনে রাখোতোমরা নিছক নিজেদের কর্মকাণ্ডের জোরে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না” লোকেরা জিজ্ঞাস করলোহে আল্লাহর রাসূল! আপনিওজবাব দিলেনহাঁ আমিও-

إلَّا أنْ يَتَغَمَّدَنِيَ اللَّهُ برَحْمَةٍ عنه وفضل

হাঁতবে যদি আল্লাহ আমাকে তাঁর রহমত ও অনুগ্রহের আবরণে ঢেকে নেন”

﴿وَنَادَىٰ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابَ النَّارِ أَن قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلْ وَجَدتُّم مَّا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا ۖ قَالُوا نَعَمْ ۚ فَأَذَّنَ مُؤَذِّنٌ بَيْنَهُمْ أَن لَّعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ﴾

৪৪ তারপর জান্নাতের অধিবাসীরা জাহান্নামের অধিবাসীদেরকে ডেকে বলবেঃ “আমাদের রব আমাদের সাথে যে সমস্ত ওয়াদা করেছিলেন তার সবগুলোকেই আমরা সঠিক পেয়েছিতোমাদের রব যেসব ওয়াদা করেছিলেনতোমরাও কি সেগুলোকে সঠিক পেয়েছো?৩৪

৩৪. অর্থাৎ এ আরাফাবাসীরা হবে এমন একদল লোকযাদের জীবনের ও কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক বা ভাল দিক এত বেশী শক্তিশালী হবে নাযার ফলে তারা জান্নাতলাভ করতে সক্ষম হয়আবার এর নেতিবাচক বা খারাপ দিকও এত বেশী খারপ হবে নাযার ফলে তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা যেতে পারে তাই তারা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে একটি সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করবে

﴿الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُم بِالْآخِرَةِ كَافِرُونَ﴾

৪৫তারা জবাবে বলবেঃ “হাঁ”তখন একজন ঘোষণাকারী তাদের মধ্য ঘোষণা করবেঃ “আল্লাহর লানত সেই জালেমদের ওপরযারা মানুষকে আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিতো এবং তাকে বাঁকা করে দিতে চাইতো আর তারা ছিল আখেরাত অস্বীকারকারী

﴿وَبَيْنَهُمَا حِجَابٌ ۚ وَعَلَى الْأَعْرَافِ رِجَالٌ يَعْرِفُونَ كُلًّا بِسِيمَاهُمْ ۚ وَنَادَوْا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَن سَلَامٌ عَلَيْكُمْ ۚ لَمْ يَدْخُلُوهَا وَهُمْ يَطْمَعُونَ﴾

৪৬ এ উভয় দলের মাঝখানে থাকবে একটি অন্তরাল এর উচু স্থানে (আ’রাফ) অপর কিছু লোক থাকবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করেনি ঠিকই কিন্তু তারা হবে তার প্রার্থী

﴿وَإِذَا صُرِفَتْ أَبْصَارُهُمْ تِلْقَاءَ أَصْحَابِ النَّارِ قَالُوا رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾

৪৭ তারা প্রত্যেককে তার লক্ষণের সাহায্যে চিনে নেবে জান্নাতবাসীদেরকে ডেকে তারা বলবেঃ “তোমাদের প্রতি শান্তি হোক!” আর যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামবাসীদের দিকে ফিরবেতারা বলবেঃ “হে আমাদের রব! এ জালেমের সাথে আমাদের শামিল করো না

﴿وَنَادَىٰ أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُم بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَىٰ عَنكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ﴾

৪৮ আবার এ আরাফের লোকেরা জাহান্নামের কয়েকজন বড় বড় ব্যক্তিকে তাদের আলামত দেখে চিনে নিয়ে ডেকে বলবেঃ “দেখলে তো তোমরাআজ তোমাদের দলবলও তোমাদের কোন কাজে লাগলো না আর তোমাদের যেই সাজ-সরঞ্জামকে তোমরা অনেক বড় মনে করতে তাও কোন উপকারে আসলো না

﴿أَهَٰؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ ۚ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنتُمْ تَحْزَنُونَ﴾

৪৯ আর এ জান্নাতের অধিবাসীরা কি তারাই নয়যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম খেয়ে বলতেএদেরকে তো আল্লাহ তাঁর রহমত থেকে কিছুই দেবেন নাআজ তাদেরকেই বলা হয়েছেপ্রবেশ করো জান্নাতে-তোমাদের কোন ভয়ও নেইদুঃখও নেই

﴿وَنَادَىٰ أَصْحَابُ النَّارِ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ أَفِيضُوا عَلَيْنَا مِنَ الْمَاءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ ۚ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى الْكَافِرِينَ﴾

৫০ আর জাহান্নামবাসীরা জান্নাতবাসীদেরকে ডেকে বলবেঃ “সামান্য একটু পানি আমাদের উপর ঢেলে দাও না অথবা আল্লাহ তোমাদের যে রিযিক দান করেছেন তা থেকেই কিছু ফেলে দাও না তারা জবাবে বলবেঃ “আল্লাহ এ দু’টি জিনিসই সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য হারাম করেছেন,  

﴿الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَهُمْ لَهْوًا وَلَعِبًا وَغَرَّتْهُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا ۚ فَالْيَوْمَ نَنسَاهُمْ كَمَا نَسُوا لِقَاءَ يَوْمِهِمْ هَٰذَا وَمَا كَانُوا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُونَ﴾

৫১ যারা নিজেদের দীনকে খেলা ও কৌতুকের ব্যাপারে বানিয়ে নিয়েছিল এবং দুনিয়ার জীবন যাদেরকে প্রতারণায় নিমজ্জিত করেছিল আল্লাহ বলেন, “আজ আমিও তাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে ভুলে যাবো যেভাবে তারা এ দিনটির মুখোমুখী হওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল এবং আমার আয়াত সমূহ অস্বীকার করেছিল৩৫

৩৫. জান্নাতবাসী,জাহান্নামবাসী ও আ’রাফবাসীদের এ পারস্পরিক সংলাপ থেকে পরকালীন জীবনে মানুষের শক্তির সীমানা কতদূর বিস্তৃত হবে তা কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে সেখানে দৃষ্টিশক্তি এতটি প্রসারিত হবে যার ফলে জান্নাতজাহান্নাম বা আরাফের লোকেরা যখন ইচ্ছা পরষ্পরকে দেখতে পারবে সেখানে আওয়াজ ও শ্রবণশক্তিও হবে বহু দূরপাল্লার ফলে এ পৃথক পৃথক জগতের লোকেরা পরষ্পরের সাথে অতি সহজেই কথাবার্তা বলতে পারবে পরকালীন জগত সম্পর্কে এ বর্ণনা এবং এ ধরনের আরো যেসব বর্ণনা করআনে উদ্বৃত হয়েছে তা এ ধারণা সৃষ্টি করার জন্যে যথেষ্ট যেসেখানকার জীবন যাপনের বিধান আমাদের এ দুনিয়ার প্রকৃতিক বিধান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হবে অবশ্যি এখানে আমাদের যে ব্যক্তি-সত্তা রয়েছে সেখানেও তাই থাকবে তবে যেসব লোকের মস্তিস্ক ও প্রাকৃতিক জগতের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে এবং বর্তমান জীবন ও এর সংক্ষিপ্ত পরিমাপগুলো ছাড়া ব্যাপকতর কোন জিনিসের ধারণা যাদের মস্তিস্কে সংকুলান হয় নাতারা কুরআন ও হাদীসের এ ধরনের বর্ণনাগুলোকে অবাক দৃষ্টিতে দেখে থাকে এবং কখনো কখনো এগুলোকে বিদ্রুপও করে থাকে এভাবে তারা তাদের বুদ্ধির স্বল্পতারই প্রমাণ দিয়ে থাকে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদের বুদ্ধির পরিসর যতটা সংকীংণ জগত ও জীবনের সম্ভাবনাগুলো ততটা সংকীর্ণ নয়

﴿وَلَقَدْ جِئْنَاهُم بِكِتَابٍ فَصَّلْنَاهُ عَلَىٰ عِلْمٍ هُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾

৫২ আমি এদের কাছে এমন একটি কিতাব নিয়ে এসেছি যাকে পূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশদ ব্যাখ্যামূলক করেছি৩৬  এবং যা ঈমানদরদের জন্য পথনির্দেশন ও রহমতস্বরূপ৩৭

৩৬. অর্থাৎ এতে পরিপূর্ণ বিশাদ বিবরণ সহাকরে যথার্থ সত্যমানুষের জন্যে দুনিয়ার জীবনে সঠিক কর্মনীতি এবং সঠিক জীবন পদ্ধতির মূল নীতিগুলো কি কিতা বর্ণনা করা হয়েছে তারপর নিছক আন্দাজ অনুমান বা ধারণাকল্পনার ভিত্তিতে এ বিস্তারিত বিবরণগুলো দেয়া হয়নিবরং নির্ভেজাল ও নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে

৩৭. অর্থ হচ্ছেপ্রথমত এ কিতাবের বিষয়বস্তু ও এর শিক্ষাবলী এত বেশী সুষ্পষ্ট যেএ নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে যেকোন মানুষের সত্য পথ পরিষ্কারভাবে ভেসে উঠতে পারে তাছাড়া যারা এ কিতাবকে মানেএ কিতাবটি তাদের জীবনে কেমন সঠিক পথনির্দশনা দেয় এবং এটি যে কতবড় অনুগ্রহ তা তাদের জীবনে ঘটনাবলী থেকে কার্যত প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে এর প্রভাব গ্রহণ করার সাথে সাথেই মানুষের মন-মানসনৈতিক বৃত্তি ও চরিত্রে সর্বোত্তম বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়ে যায় এ কিতাববের প্রতি ঈমান আনার পর সাহাবায়ে কেরামের জীবনে যে বিস্ময়কর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তার দিকে এখানে ইশারা করা হয়েছে

﴿هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا تَأْوِيلَهُ ۚ يَوْمَ يَأْتِي تَأْوِيلُهُ يَقُولُ الَّذِينَ نَسُوهُ مِن قَبْلُ قَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ فَهَل لَّنَا مِن شُفَعَاءَ فَيَشْفَعُوا لَنَا أَوْ نُرَدُّ فَنَعْمَلَ غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ ۚ قَدْ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ وَضَلَّ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ﴾

৫৩ এখন এরা কি এর পরিবর্তে এ কিতাব যে পরিমাণের খবর দিচ্ছে তার প্রতীক্ষায় আছে?৩৮  যেদিন সেই পরিনাম সামনে এসে যাবে সেদিন যারা তাকে উপেক্ষা করেছিল তারাই বলবেঃ “যথার্থই আমাদের রবের রাসূলগণ সত্য নিয়ে এসেছিলেন এখন কি আমরা এমন কিছু সুপারিশকারী পাবো যারা আমাদের পক্ষে সুপারিশ করবেঅথবা আমাদের পুনরায় ফিরে যেতে দেয়া হবেযাতে পূর্বে আমরা যা কিছু করতাম তা পরিবর্তে এখন অন্য পদ্ধতিতে কাজ করে দেখাতে পারি?”৩৯  তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে এবং যে মিথ্যা তারা রচনা করেছিল তাদের সবটুকুই আজ তাদের কাছ থেকে উদাও হয়ে গেছে

৩৮. এ বিষয়বস্তুটিকে অন্য কথায় এভাবে বলা যেতে পারেএক ব্যক্তিকে অত্যন্ত যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয় কিন্তু এরপরও সে তা মানতে প্রস্তুত হয় না তারপর তার সামনে কিছু লোক সঠিক পথে চলে দেখিয়েও দেয় যেভূল পথ চলার সময় তারা কেমন ছিল এবং এখন সঠিক পথ অবলম্বন করার পর তাদের জীবনে কত ভাল পরিবর্তন এসেছে কিন্তু এ থেকেও ঐ ব্যক্তি কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না তাহলে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে এখন ঐ ব্যক্তি নিজের ভুল পথে চলার শাস্তি লাভ করার পরই কেবল একথা মেনে নেবে যেসে ভুল পথে ছিল যে ব্যক্তি ডাক্তারের জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ গ্রহণ করে না এবং নিজের মত অসংখ্য রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শ মত চলে রোগমুক্ত হতে দেখেও তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে নাসে এখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়েই কেবল একথা স্বীকার করবে যেযেভাবে ও যে পদ্ধতিতে সে জীবন যাপন করে আসছিল তা সত্যিই তার জন্যে ধ্বংসকর ছিল

৩৯. অর্থাৎ তারা পুনর্বার এ দুনিয়ায় ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করবে তারা বলবেআমাদের যে সত্যের খরব দেয়া হয়েছিল এবং তখন আমরা যে সত্যটি মেনে নেইনি,এখন চাক্ষুষ দেখার পর আমরা সে ব্যাপারে জেনে গেছি কাজেই এখন যদি আমাদের আবার দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয় তাহলে এখন আমাদের কর্মপদ্ধতি আর আগের মত হবে না(এ মিনতি এবং এর কি জবাব দেয়া হবে তা জানার জন্যে দেখুন সূরা আল আনআ’মঃ ২৭-২৮, ইব্রাহীমঃ ৪৪-৪৫, সাজদাঃ ১২-১৩ফাতিরঃ ৩৭আয যুমারঃ ৫৬-৫৯, মুমিনঃ ১১-১২)

﴿إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ ۗ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾

৫৪ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রবযিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন৪০  তারপর তিনি নিজের কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হন৪১  তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন তারপর রাতের পেছনে দিন দৌড়িয়ে চলে আসে তিনি সূর্যচন্দ্র ও তারকারাজী সৃষ্টি করেন সবাই তাঁর নির্দেশের আনুগতজেনে রাখোসৃষ্টি তারই এবং নির্দেশও তাঁরই৪২  আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী৪৩  তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের মালিক ও প্রতিপালক

৪০. এখানে দিন শব্দটি প্রচলিত ২৪ ঘন্টার দিন অর্থে অথবা যুগ বা কাল (PERIOD)অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে শেষোক্ত অর্থে কুরআনে একাধিক ব্যবহার লক্ষনীয় যেমন সূরা হজ্জের ৬ রুকূতে (আয়াতঃ ৪৭) বলা হয়েছেঃ

وَإِنَّ يَوْمًا عِندَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ

(আর প্রকৃতপক্ষে তোমরা যে হিসাব কষে থাকো সেই দৃষ্টিতে তোমার রবের এখানে একটি দিন এক হাজার বছরের সমান)

আবার সূরা আল মাআরিজ-এর ৪নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ

(ফেরেশতারা এ জিব্রাঈল তাঁর দিকে আরোহণ করে একদিনেযার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর) তবে এখানে দিন‘ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য কিতা আল্লাহই ভাল জানেন (আরো ব্যাখ্যার জন্যে দেখুনসূরা হা-মীম সাজদাঃ টীকা ১১-১৫)

৪১. আল্লাহর “ইস্তিওয়া আলাল আরশ” (কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়া) এর বিস্তারিত স্বরূপ অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন খুব সম্ভবত সমগ্র বিশ্বজাহান সৃষ্টির পর মহান আল্লাহ কোন একটি স্থানকে তাঁর এ অসীম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র নির্ধারণ করেন এবং সেখানে নিজের আলোকে রশ্মির বিচরণকে কেন্দ্রীভূত করে দেন আর তারই নাম দেন “আরশ” (কর্তৃত্বের আসন) সেখান থেকে সমগ্র বিশ্ব জাহানের নব নব সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে ও ক্রমাগত শক্তির বিচরণ ঘটেছেসেই সাথে সৃষ্টি জগতের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাও অব্যাহত রয়েছেআবার এও সম্ভব হতে পারে যেআরশ অর্থ শাসন কর্তৃত্ব এবং আরশের ওপর সমাসীন হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছেআল্লাহ এ বিশ্বজাহান সৃষ্টি করার পর এর শাসন দণ্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন মোটকথা আরশের ওপর সমাসীন হওয়ার বিস্তারিত অর্থ যাই হোক না কেনমহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ যেএ বিশ্ব-জগতের নিছক স্রষ্টাই নন বরং এর পরিচালক ও ব্যবস্থাপকও একথা ভালভাবে হৃদয়ংগম করানোই কুরআনে এর উল্লেখের আসল উদ্দেশ্য তিনি এ দুনিয়াকে অস্তিত্বশীল করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি বরং কার্যত তিনিই সারা বিশ্ব-জাহানের ছোট বড় প্রত্যেকটি বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব করেছেন পরিচালনা ও শাসন কৃর্তৃত্বের যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ প্রতিটি বস্তু তাঁর নির্দেশের অনুগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণাও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে প্রতিটি বন্তু ও প্রানীর ভাগ্যই চিরন্তরভাবে তাঁর নির্দেশের সাথে যুক্ত যে মৌলিক বিভ্রান্তিটির কারণে মানুষ কখনো শিরকের গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছেআবার কখনো নিজেকে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন ঘোষণা করার মতো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কুরআন এভাবে তার মূলোৎপাটন করতে চায়বিশ্ব-জাহানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা থেকে আল্লাহকে কার্যত সম্পর্কহীন মনে করার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় দু’টি মানুষ নিজের ভাগ্য কে অন্যের হাতে বন্দি মনে করবে এবং তার সামনে মাথা নত করে দেবে অথবা নিজেকেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করবে এবং নিজেকে সর্বময় কর্তৃত্বশীল স্বাধীন সত্তা মনে করে কাজ করে যেতে থাকবে

এখানে আরো একটি কথা প্রণিধানযোগ্য স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক সুষ্পষ্ট করার জন্যে কুরআন মজীদে মানুষের ভাষা থেকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এমন সব শব্দ পরিভাষাউপমা ও বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছেযা রাজত্ব ও বাদশাহীর সাথে সম্পর্ক রাখেএ বর্ণনাভংগী কুরআনে এত বেশী স্পষ্ট যেঅর্থ বুঝে কুরআন পাঠকারী যে কোন ব্যক্তিই এ বিষয়টি অনুভব না করে থাকতে পারবেন না কোন কোন অর্বাচীন সমালোচক স্বীয় বিকৃত চিন্তা ও মানসিকতার কারণে এ বাচনভংগী থেকে বুঝেছেন যেএ কিতাবটি যে যুগের রচনা সে যুগে মানুষের মন-মস্তিষ্কে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল তাই এ কিতাবের রচয়িতা (এ বিবেকহীন নিন্দুকদের মত এর রচয়িতা নাকি হযরত মুহাম্মাদ সা.) আল্লাহকে একজন রাজা ও বাদশাহ হিসেবেই পেশ করেছেন অথচ কুরআন যে শাশ্বত ও অনাদিঅনন্ত সত্য উপস্থাপন করছে তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত সে সত্যটি হচ্ছেভুমণ্ডলে ও নভোমণ্ডলে একমাত্র আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌমত্ব(Sovereignty)বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র তারই সত্তার একচেটিয়া অধিকার ও বৈশিষ্ট্য আর বিশ্বজাহানের এ ব্যবস্থাপনা একটি পূর্নাঙ্গ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা বিশেষযেখানে ঐ একক সত্তাসমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পূর্ণ অধিকারী কাজেই এ ব্যবস্থার মধ্যে যে ব্যক্তি বা দল নিজের বা অন্য কারুর আংশিক বা পূর্ণ কর্তৃত্বের দাবীদার হয়সে নিজেকে নিছক প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে তাছাড়া এ ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করে মানুষ পক্ষে ঐ একক সত্তাকে একই সাথে ধর্মীয় অর্থেও একমাত্র মাবুদ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকসাংস্কৃতিক অর্থেও একমাত্র শাসক (Sovereign)হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন সঠিক দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি হতে পারে না

৪২. “আরশের উপর সমাসীন হলেন” ব্যাকটির মাধ্যমে সংক্ষেপে যে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছিল এখানে তারই অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে অর্থাৎ নিছক স্রষ্টাই ননতিনি হুকুমকর্তা এবং শাসকও তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বে সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামত চলার জন্যে স্বাধীবভাবে ছেড়ে দেননি বরং কার্যত সমগ্র বিশ্ব জগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে দিন রাত্রির আবর্তন আপনা আপনিই হচ্ছে না বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন আর যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন সূর্যচন্দ্রতারকা এরা কেউ নিজস্ব কোন শক্তির অধিকারী নয় বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন এরা একান্ত অনুগত দাসের মত সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন

৪৩. বরকতের আসল অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধিউন্নতিবিকাশ এই সংগে এ শব্দটির মধ্যে একদিকে উচ্চতা ও মহত্বের ভাবধারা নিহিত রয়েছে এবং অন্যদিকে রয়েছে স্থীতিশীলতা ও অবিচলতার ভাবধারাও আবার মংগল ও কল্যাণের ভাবধারাও নিশ্চিতভাবে এসব অর্থের অন্তরভুক্ত রয়েছে কাজেই আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী হবার অর্থ এ দাঁড়ায় যেতাঁর মংগল ও কল্যাণের কোন সীমা নেই তাঁর সত্তা থেকে সীমাহীন কল্যাণ চতুর্দিকে বিস্তৃত হচ্ছে এবং তিনি অতি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ এক সত্তা তাঁর মহত্বের কোন শেষ নেই আর তাঁর এ কল্যাণ,মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব চিরস্থায়ীও অনন্তকালীনসাময়িক নয় এর ক্ষয়ও নেই পতনও নেই (আলআল ফুরকানঃ টীকা ১-১৯দ্রষ্টব্য)

﴿ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ﴾

৫৫ তোমাদের রবকে ডাকো কান্নাজড়িত কণ্ঠে ও চুপে চুপে অবশ্যি তিনি সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না

﴿وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا وَادْعُوهُ خَوْفًا وَطَمَعًا ۚ إِنَّ رَحْمَتَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِينَ﴾

৫৬ দুনিয়ায় সুস্থ পরিবেশ বহাল করার পর আর সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না৪৪  আল্লাহকেই ডাকো ভীতি ও আশা সহকারে৪৫  নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীল লোকদের নিকবর্তী  

৪৪. “পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না”-অর্থাৎ পৃথিবীর পরিচালনা ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত ও বিনষ্ট করো না মানুষ যখন আল্লাহর বন্দেগী না করে নিজের বা অন্য কারোর তাবেদারী করে এবং আল্লাহর পথনির্দেশনা গ্রহণ না করে নিজের সমাজসংস্কৃতি ও নেতিকতাকে এমনসব মূলনীতি ও আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে যা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারোর পথনির্দেশনা থেকে গৃহীততখন এমন একটি মৌলিক ও সার্বিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়যা পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থাকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এই বিপর্যয়ের পথরোধ করাই কুরআনের উদ্দেশ্য এইসংগে কুরআন এ সত্যটি সম্পর্কেও সজাগ করতে চায় যেবিপর্যয়পৃথিবীর ব্যবস্থাপনায় মৌল বিষয় নয় এবং সুস্থতাতার সাথে সাময়িকভাবে সংযুক্ত হয়নি বরং সুস্থতাহচ্ছে এ ব্যবস্থাপনার মৌল বিষয় এবং নিছক মানুষের মূর্খতা অজ্ঞতাও বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপের ফলে বিপর্যয় তার ওপর সামায়িকভাবে আপতিত হয় অন্য কথায় বলা যায়এখানে মূর্খতাঅজ্ঞাতাঅসভ্যতাশিরক বিদ্রোহ ও নৈতিক বিশৃংখলার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের সুচনা হয়নিএবং এগুলো দুর করার জন্যে পরবর্তীকালে ক্রমাগত সংশোধন সংস্কার ও সুস্থতাবিধানের কাজ চলেনি বরং প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের সুচনা হয়েছে সুস্থ ও সুসভ্য ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তীকালে দুস্কর্মশীল লোকেরা নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও দুষ্ট মনোবৃত্তির সাহায্যে এ সুস্থ ব্যবস্থাপনাটিকে ক্রমান্বয়ে বিনষ্ট ও বিপর্যস্ত করেছেবিপর্যয় নির্মূল করে জীবন ব্যবস্থাকে আবার নতুন করে সংশোধিত ও সুস্থ করে তোলার জন্যেই মহান আল্লাহ যুগে যুগে ধারাবাহিকভাবে নবী পাঠিয়েছেনতাঁরা প্রত্যেক যুগে মানুষকে এ একই দাওয়াত দিয়ে এসেছেন যেযে সুস্থ ও সভ্য বিধানের ভিত্তিতে দুনিয়ার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল তার মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকো

সভ্যতার বিবর্তন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে একটি মহল যে উদ্ভট মতাদর্শ পেশ করেছেনকুরআনের দৃষ্টিভংগী তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তাঁরা বলছেনমানুষ অন্ধকার থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে আলোর মধ্যে এসেছে বিকৃতিঅসভ্যতার ও বর্বরতা থেকে তার জীবনের সুচনা হয়েছে তারপর পর্যায়ক্রমে তা সুস্থতা ও সভ্যতার দিকে এসেছে বিপরীতপক্ষে কুরআন বলছে আল্লাহ মানুষকে পূর্ণ আলোকের মধ্যে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন পূর্ণ আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে একটি সুস্থ জীবন ব্যবস্থার আওতাধীনে তার জীবন পথে চলা শুরু হয়েছিল তারপর মানুষ নিজেই শয়তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করে বারবার অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং এ সুস্থ জীবন ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে এনেছে অন্যদিকে আল্লাহ বারবার নিজের নবী ও রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন তাঁরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আসার এবং বিপর্যয় সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার জন্যে আহবান জানিয়েছেন (দেখুন সূরা আল বাকারাহঃ ২৩০ টীকা)

৪৫. এ বাক্যটি থেকে একথা সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে যেওপরের বাক্যে যাকে বিপর্যয় বলা হয়েছিল তা হচ্ছে আসলে মানুষের আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কাউকে নিজের অভিভাবক বন্ধু ও কার্য সম্পাদনকারী গণ্য করে সাহায্যের জন্যে তাকে ডাকা অন্যদিকে মানুষের এ ডাক একমাত্র আল্লাহর সত্তাকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত হওয়ার নামই সুস্থতাও বিশুদ্ধতা

ভীতি ও আশা সহকারে ডাকার অর্থ হচ্ছেতোমাদের ভয় করতে হলে একমাত্র আল্লাহকেই করতে হবে এবং কোন আশা পোষন করতে হলে তাও করতে হবে একমাত্র আল্লাহরই কাছ থেকে এ অনুভূতি সহাকারে আল্লাহকে ডাকতে হবে যেতোমাদের ভাগ্য পুরোপুরি তাঁরই করুনা নির্ভর সৌভাগ্য,সাফল্য ও মুক্তিলাভ একমাত্র তাঁরই সাহায্য ও পথনির্দেশনায় সম্ভবঅন্যথায় তাঁর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হলে তোমাদের জন্য ব্যর্থতা ও ধ্বংস অনিবার্য

﴿وَهُوَ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِهِ ۖ حَتَّىٰ إِذَا أَقَلَّتْ سَحَابًا ثِقَالًا سُقْنَاهُ لِبَلَدٍ مَّيِّتٍ فَأَنزَلْنَا بِهِ الْمَاءَ فَأَخْرَجْنَا بِهِ مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۚ كَذَٰلِكَ نُخْرِجُ الْمَوْتَىٰ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ﴾

৫৭ আর আল্লাহই বায়ুকে নিজের অনুগ্রহের পূর্বাহ্নে সুসংবদবাহীরূপে পাঠান তারপর যখন সে পানি ভরা মেঘ বহন করে তখন কোন মৃত ভুখণ্ডের দিকে তাকে চালিয়ে দেন এবং সেখানে বারি বর্ষণ করে(সেই মৃত ভুখণ্ড থেকে) নানা প্রকার ফল উৎপাদন করেন দেখোএভাবে আমি মৃতদেরকে মৃত্যুর অবস্থা থেকে বের করে আনি হয়তো এ চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ থেকে তোমরা শিক্ষা লাভ করবে  

﴿وَالْبَلَدُ الطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُهُ بِإِذْنِ رَبِّهِ ۖ وَالَّذِي خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًا ۚ كَذَٰلِكَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَشْكُرُونَ﴾

৫৮ উৎকৃষ্ট ভুমি নিজের রবের নির্দেশ প্রচুর ফসল উৎপন্ন করে এবং নিকৃষ্ট ভুমি থেকে নিকৃষ্ট ধরনের ফসল ছাড়া আর কিছুই ফলে না৪৬  এভাবেই আমি কৃতজ্ঞ জনগোষ্ঠির জন্য বারবার নিদর্শনসমূহ পেশ করে থাকি

৪৬. এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে মূল বক্তব্য বিষয়টি অনুধাবন করার জন্যে এ সম্পর্কে অবহিত হওয়া অপরিহার্য এখানে বৃষ্টি ও তার বরকতের উল্লেখ করার উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহর অসীম ক্ষমতা বর্ণনা ও মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের প্রমাণ তুলে ধরাই নয়বরং সেই সাথে একটি উপমার সাহায্যে রিসালাত ও তার বরকতসমূহ এবং তার মাধ্যমে ভাল ও মন্দের মধ্যে এবং উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্টের মধ্য পার্থক্যের চিত্র অংকন করাও এর লক্ষ্য রাসূলের আগমন এবং আল্লাহর শিক্ষা ও পথনির্দেশনা নাযিল হওয়াকে জলকনা বহনকারী বায়ূ প্রবাহ ও রহমতের মেঘকমালায় আছন্ন হয়ে যাওয়া এবংঅমৃতধারাপূর্ণ বারিবিন্দু বর্ষনের সাথে তুলনা করা হয়েছে আবার বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে মৃত পতিত ভূমির অকস্মাত সঞ্জীবিত হওয়া এবং তার উদর থেকে জীবনের অঢেল সম্পদরাজি উৎসারিত হবার ঘটনাকে নবীর শিক্ষাঅনুশীলন ও নেতৃত্বের মৃত ভূপতিত মানবতার অকস্মাত জেগে ওঠার এবং তার বক্ষদেশে থেকে কল্যাণের স্রোতস্বিনী উৎসারিত হবার পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে তারপর বলা হয়েছেবৃষ্টি বর্ষনের ফলে এসব বরকত কেবলমাত্র এমনসব ভূমি লাভ করেযা মূলত উর্বর কিন্তু নিছক পানির অভাবে যার শষ্য ও উৎপাদনের যোগ্যতা চাপা পড়েছিল ঠিক তেমনি রিসালাতের এ কল্যাণধারা থেকেও কেবলমাত্র সেই সব লোক লাভবান হতে পারে যারা মূলত মৃৎবৃত্তির অধিকারী এবং কেবলমাত্র নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনা না পাওয়ার কারণে যাদের যোগ্যতা ও সুস্থ মনোবৃত্তির সুস্পষ্ট রূপলাভ করার ও কর্মতৎপরতা হবার সুযোগ পায় নাঅন্যদিকে দুষ্ট মনোবৃত্তির অধিকারী ও দুষ্কর্মশীল মানুষেরা হচ্ছে এমন ধরনের অনুর্বর জমির মতযা রহমতের বারি বর্ষণে কোনক্রমেই লাভবান হয় না বরং বৃষ্টির পানি পড়ার সাথে সাথেই যার পেটের সমস্ত বিষ কাঁটা গাছ ও ঝোপ ঝাড়ের আকারে বের হয়ে আসে অনুরূভাবে রিসালাতের আবির্ভাবে তাদের কোন ফায়দা হয় নাবরং উলটো তাদের অভ্যন্তরের সমস্ত দুষ্কৃতি ও শয়তানী মনোবৃত্তি পূর্ণোদ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে

পরবর্তী কয়েকটি রুকূতে ধারাবাহিকভাবে ঐতিহাসিক প্রমাণ সহকারে এ উপমাটিকে সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে প্রত্যেক যুগে নবীর আগমনের পর মানব জাতি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় একটি ভাগ হচ্ছে সুস্থ ও সৎ চেতনা সম্পন্ন লোকদের রিসালাতের অমিয় ধারায় অবগাহন করে তারা পুরিপুষ্ট হয় এবং উন্নতি ও উত্তম ফলে ফুলে শুশোভিত হয় আর দ্বিতীয় ভাগটি হচ্ছে দুষ্ট চেতনা সম্পন্ন জনগোষ্ঠির কষ্টিপাথরের সামনে আসার সাথে সাথেই তারা নিজের সমস্ত অসৎ প্রবণতা ডালি উন্মুক্ত করে দেয় তাদের সমস্ত দৃষ্কৃতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে অবশেষে তাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে ছেটে দূরে নিক্ষেপ করা হয় যেভাবে স্বর্ণকার রূপা ও সোনা ভেজাল অংশটুকু ছেটে দুরে নিক্ষেপ করে

﴿لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ﴾

৫৯ নুহকে আমি তার সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই৪৭  সে বলেঃ হে আমার স্বগোত্রীয় ভাইয়েরা! আল্লাহর ইবাদত করোতিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই৪৮  আমি তোমাদের জন্য একটি ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা করছি

৪৭. হযরত নূহ আ. ও তার সম্প্রদায় থেকে এ ঐতিহাসিক বিবরণের সূচনা করা হযেছে কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে হযরত আদম আ. তাঁর সন্তানদের যে সৎ ও সুস্থ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে যানতাতে প্রথম বিকৃতি দেখা দেয় হযরত নূহের যুগে এবং এরি সংশোধন ও এ জীবনে ব্যবস্থাকে আবার সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে মহান আল্লাহ হযরত নূহকে পাঠান

কুরআনের ইংগিত ও বাইবেলের সুষ্পষ্ট বর্ণনার পর একথা আজ নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে যেবর্তমান ইরাকেই হযরত নূহের সম্প্রাদায়ের বসবাস ছিল বেবিলনের প্রাচীন ধ্বংসাবশেসে অভ্যন্তরে বাইবেলের চাইতেও যে প্রাচীন লিপি পাওয়া গেছেতা থেকেও এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় কুরআনে ও তাওরাতে যে ঘটনা বর্নিত হয়েছে ঐ প্রাচীন লিপিতেও তদ্রুপ এক কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায় ঘটনাটি মুসেল এর আশেপাশে ঘটেছিল বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে আবার কুর্দিস্তান ও আরমেনিয়া এলাকায় প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় যেসব কিংবদন্তী চলে আসছে তা থেকেও জানা যায় যেপ্লাবনের পর হযরত নূহের নৌকা এ এলাকার কোন এক স্থানে থেমেছিল আজো মুসেলের উত্তরে ইবনে উমর দ্বীপের আশেপাশে এবং আরমেনিয়া সীমান্তে “আরারাত” পাহাড়ের আশেপাশে নূহ আ. এর বিভিন্ন নিদর্শন চিহ্নিত করা হয়ে থাকে নখচীওয়ান’ শহরের অধিবাসীদের মধ্যে আজো এ প্রবাদ প্রচলিত যেহযরত নুহ এ শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন

নূহের প্লাবনের মত প্রায় একই ধরনের ঘটনার কথা গ্রীকমিসরভারত ও চীনের প্রাচীন সাহিত্যেও পাওয়া যায়এছাড়াও বার্মামালয়েশিয়াপূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জঅষ্ট্রেলিয়ানিউগিনি এবং আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় ও এ একই ধরনের কিংবদন্তী প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যেএ ঘটনাটি এমন এক সময়ের সাথে সম্পর্কিত যখন সমগ্র মানব জাতির দুনিয়ার একই এলাকায় অবস্থান করতোতারপর সেখান থেকে তাদের বংশধরেরা দুনিয়ার চতুরদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাই সকল জাতি তাদের উন্মেষকালীন ইতিহাসে একটি সর্বব্যাপী প্লাবনের ঘটনা নির্দেশ করেছে অবশ্য কালের আবর্তনের এর যথার্থ বিস্তারিত তথ্যাদি তারা বিস্মৃত হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকে নিজের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী আসল ঘটনার গায়ে প্রলেপ লাগিয়ে এক একটা বিরাট কল্পকাহিনী তৈরী করে নিয়েছে

৪৮. কুরআন মজীদের এ স্থানে ও অন্যান্য স্থানে হযরত নূহ ও তাঁর সম্প্রদায়ের যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে একথা সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যেএ সম্প্রদায়টি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না,তাঁর সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞও ছিল এবং তাঁর ইবাদত করতেও তারা অস্বীকার করতো না বরং তারা প্রকৃতপক্ষে যে গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল সেই ছিল শিরক অর্থাৎ তারা আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বে অন্যান্য সত্তাকেও শরীক করতো এবং ইবাদাতের লাভের অধিকারে তাদেরকে তাঁর সাথে হিস্সাদার মনে করতো তারপর এ মৌলিক গোমরাহী থেকে এ জাতির মধ্যে অসংখ্য ত্রুটি ও দুষ্কৃতির জন্ম নেয় যেসব মনগড়া মাবুদকে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অংশীদার গণ্য করা হয়েছিল,তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে জাতির মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেনীর জন্ম হয় এ শ্রেনীটি সমস্ত ধর্মীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসে জাতিকে তারা উচ্চ শ্রেনী ও নিম্ন শ্রনীতে বিভক্ত করে সমাজ জীবন জুলুম ও বিপর্যয়ে ভরপুর করে তোলে নৈতিক উচ্ছৃংখলতাচারিত্রিক নৈরাজ্য ও পাপাচারের মাধ্যমে মানবতার মূলে কুঠারাঘাত করে এ অব্স্থার পরিবর্তন করার জন্যে হযরত নূহ আ. অত্যন্ত সবরসহিষ্ণুতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে দীর্ঘকাল প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালান কিন্তু সাধারণ মানুষকে তারা নিজেদের প্রতারনা জালে এমনভাবে আবদ্ধ করে নেয় যার ফলে সংশোধনের কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়নি অবশেষে হযরত নূহ আ. আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করেন! হে আল্লাহ! এ কাফেরদের একজনকেও পৃথিবীর বুকে জীবিত ছেড়ে দিয়ো না কারণ এদের কাউকে জীবিত ছেড়ে দিলে এরা তোমার বান্দাদেরকে গোমরাহ করতে থাকবে এবং এদের বংশে যাদেরই জন্ম হবে তারাই হবে অসৎকর্মশীলদুশ্চরিত্র ও বিশ্বাসঘাতক (বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন সূরা হুদঃ ৩রুকূসূরা আশ শূআ’রাঃ ৬রুকূ ও সমগ্র সূরা নূহ)

﴿قَالَ الْمَلَأُ مِن قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾

৬০ তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা জবাব দেয়ঃ আমরা তো দেখতে পাচ্ছি তুমি সুষ্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছো

﴿قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي ضَلَالَةٌ وَلَٰكِنِّي رَسُولٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ﴾

৬১ নূহ বলেঃ হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা!আমি কোন গোমরাহীতে লিপ্ত হইনি বরং আমি রাব্বুল আলামীনের রাসূল

﴿أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾

৬২ তোমাদের কাছে আমার রবের বানী পৌঁছে দিচ্ছি আমি তোমাদের কল্যাণকামী আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি এমন সব কিছু জানি যা তোমার জান না

﴿أَوَعَجِبْتُمْ أَن جَاءَكُمْ ذِكْرٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنكُمْ لِيُنذِرَكُمْ وَلِتَتَّقُوا وَلَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾

৬৩ তোমরা কি এ জন্য অবাক হচ্ছো যেতোমাদের কাছে তোমাদের স্বীয় সম্প্রদায়েরই এক ব্যক্তির মাধ্যমে তোমাদের রবের স্মারক এসেছেতোমাদেরকে সতর্ক করার জন্যে যাতে তোমরা ভূল পথে চলা থেকে রক্ষা পাও এবং তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়?৪৯ 

৪৯. এ ব্যাপারটি ঘটেছিল হযরত নূহ আ. ও তাঁর জাতির মধ্যে ঠিক এ একই ধরনের ঘট্না ঘটছিল হযরত মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যেহযরত মুহাম্মাদ সা. এর নবুওয়াতের বিরুদ্ধে যেসব সন্দেহ প্রকাশ করছিল সেই একই ধরনের সন্দেহ হাজার হাজার বছর আগে হযরত নূহের সম্প্রদায়ের প্রধানরাও পেশ করেছিল আবার এসবের জবাবে হযরত নূহ আ. যেসব কথা বলতেনহযরত মুহাম্মাদ সা. ও সেই একই কথা বলতেন পরবর্তীতে অন্যান্য নবীদের ও তাদের জাতির যেসব ঘট্না ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে সেখানেও এটাই দেখানো হয়েছে যেপ্রত্যেক নবীর জাতির ভূমিকা মক্কাবাসীদের ভূমিকার সাথে এবং প্রত্যেক নবীর ভাষণ মুহাম্মাদ সা. এর ভাষনের সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্য রাখে এর সাহায্যে কুরআন তার পাঠক ও শ্রোতাদেরকে একথা বুঝাতে চায় যেপ্রতি যুগে মানুষের গোমরাহী মূলগতভাবে একই ধরনের ছিল এবং আল্লাহর পাঠানো মানবতার শিক্ষকদের দাওয়াতও প্রতি যুগে প্রত্যকেটি দেশে একই রকম ছিল অনুরূপভাবে যারা নবীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং নিজেদের গোমরাহীর নীতিতে অবিচল থেকেছে তাদের পরিণামও একই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে

﴿فَكَذَّبُوهُ فَأَنجَيْنَاهُ وَالَّذِينَ مَعَهُ فِي الْفُلْكِ وَأَغْرَقْنَا الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا ۚ إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمًا عَمِينَ﴾

৬৪ কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো অবশেষে আমি তাকে ও তার সাথীদেরকে একটি নৌকায় (আরোহণ করিয়ে) রক্ষা করি এবং আমার আয়াতকে যারা মিথ্যা বলেছিল তাদেরকে ডুবিয়ে দেই৫০  নিসন্দেহে তারা ছিল দৃষ্টিশক্তিহীন জনগোষ্ঠি

৫০. কুরআনের বর্ণনাভংগীর সাথে যাদের ভাল পরিচয় নেই তারা অনেক সময় এ সন্দেহ পড়ে যান যেসম্ভবত এই সমগ্র ব্যাপারটি একটি বা দু’টি বৈঠকেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল গোটা কার্যধারা এরূপ ছিল বলে মনে হয় যেনবী এলেন এবং তিনি নিজের দাওয়াত পেশ করলেন লোকেরা আপত্তি ও প্রশ্ন উত্থাপন করলো এবং তিনি তার জবাব দিলেন তারপর লোকেরা তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখান করলো আর অমনি আল্লাহ আযাব পাঠিয়ে দিলেনঅথচ ব্যাপারটি ঠিক এমন নয় যেসব ঘটনাকে যুথবদ্ধ করে এখানে মাত্র কয়েকটি বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো সংঘটিত হতে সুদীর্ঘকাল ও বছরের পর বছর সময় লেগেছিল কুরআনের একটি বিশেষ বর্ণনা পদ্ধতি হচ্ছেকুরআন ও শুধুমাত্র গল্প বলার জন্যে ঘট্না বা কাহিনী বর্ণনা করে যায় না বরং শিক্ষা দেবার জন্যে বর্ণনা করে যায়তাই সর্বত্র ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করার সময় কাহিনীর কেলমাত্র সেই অংশটুকুই কুরআন উপস্থাপন করেযার সাথে উদ্দেশ্য ও মূল বিষয়বস্তুর কোন সম্পর্ক থাকে এ ছাড়া কাহিনীর অন্যান্য বিস্তারিত বিবরণকে সম্পূর্ণ বাদ দেয় আবার যদি কোন কাহিনীকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে থাকে তাহলে সর্বত্র উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন বিস্তারিত বিবরণও পেশ করে থাকে যেমন এই নূহ আ. এর কাহিনীটির কথাই ধরা যাক নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার ও তাকে মিথ্যুক বলার পরিণাম বর্ণনা করাই এখানে এর উদ্দেশ্য কাজেই নবী যত দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিজের জাতিকে দাওয়াত দিতে থাকেছেনসে কথা বলার এখানে কোন প্রয়োজন ছিল না কিন্তু যেখানে মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথীদেরকে সবর করার উপদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে এ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে বিশেষভাবে নূহ আ. এর দাওয়াতের দীর্ঘ সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে যাতে নবী সা. ও তাঁর সাথী গণ নিজেদের মাত্র কয়েক বছরের প্রচেষ্টা ও সাধনা ফলপ্রসূ হতে না দেখে হতোদ্যম না হয়ে পড়েন এবং অন্যদিকে তারা যেন নূন আ. এর সবরের প্রতি দৃষ্টিপাত করেনযিনি সুদীর্ঘকাল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক পরিবেশে সত্যের দাওয়াত দেয়া অব্যাহত রেখেছেনএবং কোন সময় একটুও হতাশ হননি (আল আনকবুতঃ ১৪)

এখানে আর একটি সন্দেহ ও দেখা দেয় এটি দূর করাও প্রয়োজন কোন ব্যক্তি যখন বারবার কুরআনে পড়তে থাকেঅমুক জাতি নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিলনবী তাদেরকে আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হবার খরব দিয়েছিলেন এবং অকস্মাত একদিন আল্লাহর আযাব এসে সেই জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এ সময় তার মনে প্রশ্ন জাগেএ ধরনের ঘটনা এখন ঘটে না কেনযদিও এখনো বিভিন্ন জাতির উত্থান পতন হয় কিন্তু এ উত্থান পতনের ধরনই আলাদা এখন তো এমন হয় না যেএকটি সতর্কবানী উচ্চারণ করার পর ভুমিকম্পপ্লাবন বা ঝড় এলো এবং পুরো এক একটি জাতি ধ্বংস হয়ে গেলো এর জবাবে বলা যায়প্রকৃতপক্ষে একজন নবী সরাসরি যে জাতিকে দাওয়াত দেন তার ব্যাপারটি অন্য জাতিদের ব্যাপার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের যে জাতির মধ্যে কোন নবীর জন্ম হয়তিনি সরাসরি তার ভাষায় তার কাছে আল্লাহর বাণী পৌছিয়ে দেন এবং নিজের নিখুঁত ব্যক্তি চরিত্রের মাধ্যমে নিজের বিশ্বস্ততা ও সত্যতার জীবন্ত আদর্শ তার সামনে তূলে ধরেন এতে করে তার সমানে আল্লাহর যুক্তি প্রমাণ তথা তার দাওয়াত পূর্ণরূপে উপস্থাপিত হয়েছে বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় তার জন্যে ওযরআপত্তি পেশ করার আর কোন অবকাশই থাকেনা আল্লাহর পাঠানো রাসূলকে সামনাসামনি অস্বীকার করার পর তার অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌছেযার ফলে ঘটনাস্থলেই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে যাওয়া জরুরী হয়ে পড়ে পক্ষান্তরে যেসব জাতির কাছে আল্লাহর বাণী সরাসরি নয় বরং বিভিন্ন মাধ্যমে এসে পৌছেছে তাদের ব্যাপারটির ধরন এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কাজেই নবীদের সময় যেসব ঘটনার অবতারণা হতে দেখা যেতো এখন যদি আর সে ধরনের কোন ঘটনা না ঘটে থাকে তাহলে তাতে অবাক হবার কিছুই নেই কারণমুহাম্মাদ সা. এর পর নবূওয়াতের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে তবে হাঁ. কোন নবীকে সামনা সামনি প্রত্যাখ্যান করার পর কোন জাতির ওপর যে আযাব আসবে তেমনি ধরনের কোন আযাব যদি বর্তমানে কোন জাতির ওপর আসে তাহলে তাতেই বরং অবাক হতে হবে

কিন্তু এর অর্থ এ নয় যেবর্তমানে যেসব জাতি আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করছে এবং নৈতিক ও চিন্তাগত দিক দিয়ে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে তাদের ওপর আল্লাহর আযাব আসা বন্ধ হয়ে গেছেপ্রকৃতপক্ষে এখনো এসব জাতির ওপর আযাব আসছে কখনো সতর্ককারী ছোট ছোট আযাবআবার কখনো চূড়ান্ত ফায়সালাকারী বড় বড় আযাব কিন্তু আম্বিয়া আ. ও আসমানী কিতাবগুলোর মত এ আযাবগুলোর নৈতিক তাৎপর্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করছে না বরং এর বিপরীত পক্ষে স্থুল দৃষ্টির অধিকারী বিজ্ঞানীসত্য সম্পর্কে অজ্ঞঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের একটি বিরাট গোষ্ঠী মানব জাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে তারা এ ধরনের যাবতীয় ঘট্নার ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক আইন বা ঐতিহাসিক কার্যকারণের মানদণ্ডেএভাবে তারা মানুষকে অচেননতা ও বিস্মৃতির মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে তারা মানুষকে কখনো একথা বুঝার সুযোগ দেয় না যেউপরে একজন আল্লাহ আছেনতিনি অসৎকর্মশীল জাতিদেরকে প্রথমে তাদের অসৎকর্মের জন্যে সতর্ক করে দেনতারপর যখন তারা তাঁর পাঠানো সতর্ক সংকেতসমূহ থেকে চোখ বন্ধ করে নিয়ে নিজেদের অসৎকর্মে চালিয়ে যেতে থাকে অবিশ্রান্ত ভাবেতখন তিনি তাদেরকে ধ্বংসের আবতে নিক্ষেপ করেন

﴿وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ﴾

৬৫ আর আদ (জাতি)র৫১  কাছে আমি পাঠাই তাদের ভাই হূদকে সে বলেঃ “হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা!তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই এরপরও কি তোমরা ভুল পথে চলার ব্যাপারে সাবধান হবে না?”

৫১. আদছিল আরবের প্রাচীনতম জাতি আরবের সাধারণ মানুষের মখে মুখে এদের কাহিনী প্রচলিত ছিল ছোট ছোট শিশুরাও তাদের নাম জানতো তাদের অতীত কালের প্রতাপ-প্রতিপত্তিও গৌরব গাঁথা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল তারপর দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নামনিশানা মুছে যাওয়াটাও প্রবাদের রূপ নিয়েছিল আদ জাতির এ বিপুল পরিচিতির কারণেই আরবী ভাষায় প্রত্যেকটি প্রাচীন ও পুরাতন জিনিসের জন্যে আদি‘ শব্দ ব্যবহার করা হয় প্রাচীন ধ্বংসাবশেষকে আদিয়াতবলা হয় যে জমির মালিক বেঁচে নেই এবং চাষাবাদকারী না থাকার কারণে যে জমি অনাবাদ পড়ে থাকে তাকে আদি-উল-আরদ‘ বলা হয় প্রাচীন আরবী কবিতায় আমরা এ জাতির নামের ব্যবহার দেখি প্রচুর পরিমাণে আরবের বংশধারা বিশেষজ্ঞগণও নিজেদের দেশের বিলুপ্ত জাতিদের মধ্যে সর্বপ্রথম এ জাতিটির নামোচ্চারণ করে থাকেন হাদীসে বলা হয়েছেএকবার নবী সা. এর কাছে বনু যহল ইবনে শাইবান গোত্রের এক ব্যক্তি আসেন তিনি আদ জাতির এলাকার অধিবাসী ছিলেন তিনি প্রাচীনকাল থেকে তাদের এলাকার লোকদের মধ্যে আদ জাতি সম্পর্কে যেসব কিংবদন্তী চলে আসছে তা নবী সা.কে শুনান

কুরআনের বর্ণনা মতে এ জাতিটির আবাসস্থল ছিল আহকাফ‘ এলাকা এ এলাকাটি হিজাযইয়ামন ও ইয়ামামার মধ্যবর্তী রাবয়ুল খালীর দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত এখন থেকে অগ্রসর হয়ে তারা ইয়ামনের পশ্চিম সমুদ্রোপকূল এবং ওমান ও হাজরা মাউত থেকে ইরাক পর্যন্ত নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিস্তৃত করেছিল ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ জাতিটির নিদর্শনাবলী দুনিয়ার বুক থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কিন্তু দক্ষিণ আরবের কোথাও কোথাও এখনো কিছু পুরাতন ধ্বংস স্তুপ দেখা যায় সেগুলোকে আদ জাতির নিদর্শন মনে করা হয়ে থাকে হাজরা মাউতে এক জায়গায় হযরত হূদ আলাহিস সালামের নামে একটি কবরও পরিচিত লাভ করেছে ১৮৩৭খৃস্টাব্দে James R.wellested নামক একজন ইংরেজ নৌ-সেনাপতি হিসনে গুরাবে‘ একটি পুরাতন ফলকের সন্ধান লাভ করেন এতে হযরত হূদ আ. এর উল্লেখ রয়েছেএ ফলকে উৎকীর্ণ লিপি থেকে পরিষ্কার জানা যায়এটি হযরত হূদের শরীয়াতের অনুসারীদের লেখা ফলক(আল আহকাফ দেখুন)

﴿قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِي سَفَاهَةٍ وَإِنَّا لَنَظُنُّكَ مِنَ الْكَاذِبِينَ﴾

৬৬ তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা যারা তার কথা মানতে অস্বীকার করছিলতারা বললোঃ “আমরা তো তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত মনে করি এবং আমাদের ধারণা তুমি মিথ্যুক

﴿قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي سَفَاهَةٌ وَلَٰكِنِّي رَسُولٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ﴾

৬৭ সে বললোঃ “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা!আমি নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত নই বরং আমি রাব্বুল আলামীনের রাসূল,

﴿أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ﴾

৬৮ আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌছাই এবং আমি তোমাদের এমন হিতাকাংখী যার ওপর ভরসা করা যেতে পারে

﴿أَوَعَجِبْتُمْ أَن جَاءَكُمْ ذِكْرٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنكُمْ لِيُنذِرَكُمْ ۚ وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِن بَعْدِ قَوْمِ نُوحٍ وَزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً ۖ فَاذْكُرُوا آلَاءَ اللَّهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾

৬৯ তোমরা কি এ জন্য অবাক হচ্ছো যেতোমাদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে তোমাদেরই স্বগোত্রীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে তোমাদের রবের স্মারক তোমাদের কাছে এসেছেভুলে যেয়ো নাতোমাদের রব নূহের সম্প্রদায়ের পর তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং অত্যন্ত স্বাস্থ্যবানও সুঠাম দেহের অধিকারী করেন কাজেই আল্লাহর অপরিসীম শক্তির কথা স্মরণ রাখো,৫২  আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে

৫২. মূল শব্দটি হচ্ছে আলা‘- এর আভিধানিক অর্থ নিয়ামতসমূহক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতীকসমূহএবং প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলী আয়াতের সার্বিক মর্ম এই যেআল্লাহর অপার অনুগ্রহের কথাও মনে রেখোআবার এটাও ভুলে যেও না যেতিনি তোমাদের কাছ থেকে অনুগ্রহ ছিনিয়ে নেয়ারও ক্ষমতা রাখেন

﴿قَالُوا أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا ۖ فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِن كُنتَ مِنَ الصَّادِقِينَ﴾

৭০ তারা জবাব দিলোঃ “তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছো যেআমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবো এবং আমাদের বাপ-দাদারা যাদের ইবাদত করে এসেছে তাদেরকে পরিহার করবো?৫৩  বেশযদি তুমি সত্যবাদী হওতাহলে আমাদের যে আযাবের হুমকি দিচ্ছোতা নিয়ে এসো

৫৩. এখানে আবার একথাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যেএ জাতিটিও আল্লাহকে অস্বীকার করতো নাআল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল না অথবা তাঁর ইবাদত করতে অস্বীকার করছিল না আসলে তারা হযরত হূদের একমাত্র আল্লাহ বন্দেগী করতে হবে এবং তাঁর বন্দেগীর সাথে আর কারোর বন্দেগী যুক্ত করা যাবে না-এ বক্তব্যটিই মেনে নিতে অস্বীকার করছিল

﴿قَالَ قَدْ وَقَعَ عَلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ رِجْسٌ وَغَضَبٌ ۖ أَتُجَادِلُونَنِي فِي أَسْمَاءٍ سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا نَزَّلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ فَانتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُم مِّنَ الْمُنتَظِرِينَ﴾

৭১ সে বললোঃ “তোমাদের রবের অভিসম্পাত পড়েছে তোমাদের ওপর এবং তাঁর গযবও তোমরা কি আমার সাথে এমন কিছু নাম নিয়ে বিতর্ক করছোযেগুলো তৈরী করেছো তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা৫৪  এবং যেগুলোর স্বপক্ষে আল্লাহ কোন সনদ নাযিল করেননি?৫৫  ঠিক আছেতোমরা অপেক্ষা করো এবং আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি

৫৪. অর্থাৎ তোমারা কাউকে বৃষ্টির দেবতাকাউকে বায়ুর দেবতাকাউকে ধন-সম্পদের দেবতাআবার কাউকে রোগের দেবতাবলে থাকো অথচ তাদের কেউ মূলত কোন জিনিসের স্রষ্টা ও প্রতিপালক নয় বর্তমান যুগেও আমরা এর দৃষ্টান্ত দেখি এ যুগেও লোকেরা দেখি কাউকে বিপদ মোচনকারী বলে থাকে অথচ বিপদ থেকে উদ্ধার করার কোন ক্ষমতাই তার নেই লোকেরা কাউকে গনজ বখশ‘, (গুপ্ত ধন ভাণ্ডার দানকারী) বলে অভিহিত করে থাকে অথচ তার কাছে কাউকে দান করার মত কোন ধনভাণ্ডার নেই কাউকে দাতা বলা হয়ে থাকেঅথচ সে কোন জিনিসের মালিকই নয়যে কাউকে দান করতে পারবে কাউকে গরীব নওয়াজ‘ আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে অথচ তিনি নিজেই গরীব যে ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ফলে কোন গরীবকে প্রতিপালন ও তার প্রতি অনুগ্রহ করা যেতে পারে সেই ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে তার কোন অংশ নেই কাউকে গউস‘ (ফরিয়াদ শ্রবণকারী)বলা হয় অথচ কারোর ফরিয়াদ শুনার এবং তার প্রতিকার করার কোন ক্ষমাতাই তার নেই কাজেই এ ধরনের যাবতীয় নাম বা উপাধি নিছক নাম বা উপাধি ছাড়া আর কিছুই নয় এ নামগুলোর পিছনে কোন সত্তা বা ব্যক্তিত্ব নেই যারা এগুলো নিয়ে ঝগড়া ও বিতর্ক করে তারা আসলে কোন বাস্তব জিনিসের জন্যে নয়বরং কেবল কতিপয় নামের জন্যেই ঝগড়া ও বিতর্ক করে

৫৫. অর্থাৎ তোমরা নিজেরাই যেআল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ রব বলে থাকো তিনি তোমাদের এ বানোয়াট ইলাহদের সার্বভৌম ক্ষমতাকর্তৃত্ব ও প্রভুত্বের স্বপক্ষে কোন সনদ দান করেননি তিনি কোথাও বলেননি যেআমি অমুকের ও অমুকের কাছে আমার ইলাহী কর্তৃত্বের এ পরিমাণ অংশ স্থানান্তরিত করে দিয়েছি কাউকে বিপদ ত্রাতাঅথবা গনজ বখশ‘ হবার কোন পরোয়ানা তিনি দেননি তোমরা নিজেরাই ধারণা ও কল্পনা অনুযায়ী তাঁর ইলাহী ক্ষমতার যতটুকু অংশ যাকে ইচ্ছা তাকে দান করে দিয়েছো

﴿فَأَنجَيْنَاهُ وَالَّذِينَ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا ۖ وَمَا كَانُوا مُؤْمِنِينَ﴾

৭২ অবশেষে নিজ অনুগ্রহে আমি হূদ ও তার সাথীদেরকে উদ্ধার করি এবং আমার আয়াতকে যারা মিথ্যা বলেছিল এবং যারা ঈমান আনেনি তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেই৫৬

৫৬. নিশ্চিহ্ন করে দেই’ অর্থাৎ তাদেরকে বিধ্বস্ত ও ধ্বংস করে দিয়েছি দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নামনিশানা মুছে দিয়েছি প্রাথমিক পর্বের আদ জাতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাদের যাবতীয় নিদর্শনও বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেএকথা আরববাসীদের ঐতিহাসিক কথামালা ও কিংবদন্তী সমীহ থেকেও প্রমাণিত হয় এবং আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহও এর সত্যতা প্রমাণ করেতাই আরব ঐতিহাসিকগণ তাদেরকে বিলুপ্ত জাতি হিসেবেই গণ্য করে থাকেন তারপর আদ জাতির কেবলমাত্র সেই অংশটুকুই দুনিয়ার বুকে রয়ে গেছে যারা ছিল হযরত হূদ আ. এর অনুসারীএটাও আরব ইতিহাসের একটি স্বীকৃত সত্য ইতিহাসে আদ জাতির এ অবশিষ্টাংশ দ্বিতীয় আদ নামে খ্যাত উপরে আমরা হিসনে গুরাবের যে পুরাত ফলকটির কথা উল্লেখ করেছি সেটি আসলে তাদেরই স্মৃতিফলক প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞগণ এ স্মৃতি ফলকে (এটিকে হযরত ঈসার জন্মের প্রায় ১৮শত বছর পূর্বের লিখন বলে মনে করা হচ্ছে) যে উৎকীর্ণ লিখন পাঠ করেছেনতার কতিপয় বাক্য নীচে উদ্ধৃত করা হলোঃ

আমরা সুদীর্ঘকাল এই দুর্গে এমন অবস্থর অতিবাহিত করেছিলাম যখন অভাব অনটন থেকে আমাদের জীবন ছিল অনেক দূরে আমাদের খালগুলো নদীর পানিতে ভরে থাকতো……… এবং আমাদের শাসকগণ এমন ধরনের বাদশাহ ছিলেন যারা ছিলেন অসৎ চিন্তা মুক্ত এবং দুস্কৃতকারী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের প্রতি কঠোর মনোভাবাপন্ন তারা হূদের শরীয়াত অনুযায়ী আমাদের ওপর শাসন কার্য পরিচালনা করতেন এবং উত্তম ফায়সালাসমূহ একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ করে নিতেন আমরা মুজিযা ও মৃত্যুর পর পুররুত্থানের প্রতি ঈমান রাখতাম

কুরআনে যে কথা বিধৃত হয়েছে যেআদ জাতির প্রাচীন মহিমাগৌরবও সমৃদ্ধির উত্তরাধিকারী তারাই হয়েছিল যারা হূদ আ. এর প্রতি ঈমান এনেছিলএ লিপিটি আজো এরই সত্যতা প্রমাণ করে যাচ্ছে

﴿وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۖ قَدْ جَاءَتْكُم بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ ۖ هَٰذِهِ نَاقَةُ اللَّهِ لَكُمْ آيَةً ۖ فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِي أَرْضِ اللَّهِ ۖ وَلَا تَمَسُّوهَا بِسُوءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

৭৩ আর সামূদের৫৭  কাছে পাঠাই তাদের ভাই সালেহকে সে বলেঃ হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই তোমাদের কাছে তোমাদের রবের সুষ্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে আল্লাহর এ উটনীটি তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন৫৮  কাজেই তাকে আল্লাহর জমিতে চরে খাবার জন্যে ছেড়ে দাও কোন অসদুদ্দেশ্যে এর গায়ে হাত দিয়ো না অন্যথায় একটি যন্ত্রনাদায়ক আযাব তোমাদের ওপর আপতিত হবে

৫৭. এটি আরবের প্রাচীন জাতিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় জাতি আদের পরে এরাই সবচেয়ে বেশী খ্যাতি ও পরিচিত অর্জন করে কুরআন নাযিলের পূর্বে এদের কাহিনী সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল জাহেলী যুগের কবিতাও খুতবা সাহিত্যে এর ব্যাপক উল্লেখ পাওয়া যায় আসিরিয়ার শিলালিপিগ্রীসইসকানদারীয়া ও রোমের প্রাচীন ঐতিহাসিক ও ভুগোলবিগণও এর উল্লেখ করেছেন ঈসা আ. এর জন্মের কিছুকাল পুর্বে ও এ জাতির কিছু কিছু লোক বেঁচেছিল রোমীয় ঐতিহাসিকগণের মতেএরা রোমীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে এদের শত্রু নিবতীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে

উত্তর পশ্চিম আরবের যে এলাকটি আজো আল হিজর‘ নামে খ্যাত সেখানেই ছিল এদের আবাস আজকের সউদী আরবের অন্তর্গত মদীনা ও তাবুকের মাঝখানে হিজায রেলওয়ের একটি ষ্টেশন রয়েছেতার নাম মাদায়েনে সালেহএটিই ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান প্রাচীনকালে এর নাম ছিল হিজরসামূদ জাতির লোকেরা পাহাড় কেটে যেসব বিপুলায়তন ইমারত নির্মাণ করেছিল এখনো হাজার হাজার একর এলাকা জুড়ে সেগুলো অবস্থান করছে এ নিঝুম পুরীটি দেখে আন্দাজ করা যায় যে এক সময়ে এ নগরীর জনসংখ্যা চার পাঁচ লাখের কম ছিল না কুরআন নাযিল হওয়ার সময়কালে হেজাযের ব্যবসায়ী কাফেলা এ প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতো তাবুক যুদ্ধের সময় নবী সা. যখন এ এলাকা অতিক্রম করছিলেন তখন তিনি মুসলমানদেরকে এ শিক্ষানীয় নিদর্শনগুলো দেখান এবং এমন শিক্ষা দান করেন যা এ ধরনের ধ্বংসাবশেষে থেকে একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির শিক্ষা গ্রহণ করা উচিতএ জায়গায় তিনি একটি কুয়ার দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলেনএ কুয়াটি থেকে হযরত সালেহের উটনী পানি পান করতো তিনি মুসলমানদেরকে একমাত্র এ কুয়াটি থেকে পানি পান করতে বলেন এবং অন্য সমস্ত কুয়া থেকে পানি পান করতে নিষেধ করেন একটি গিরিপথ দেখিয়ে তিনি বলেনএ গিরিপথ দিয়ে হযরত সালেহের উটনীটি পানি পান করতে আসতোতাই সেই স্থানটি আজো ফাজ্জুন নাকাহ বা উটনীর পথ নামে খ্যাত হয়ে আছে তাদের ধ্বংসস্তুপগুলোর মধ্যে যেসব মুসলমান ঘোরাফেরা করছিল তাদেরকে একত্র করে তিনি একটি ভাষণ দেন এ ভাষণে সামুদ জাতির ভয়াবহ পরিণাম তাদেরকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দিয়ে তিনি বলেনএটি এমন একটি জাতির এলাকা যাদের ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হয়েছিল কাজেই এ স্থানটি দ্রুত অতিক্রম করে চলে যাও এটা ভ্রমনের জায়গা নয় বরং কান্নার জায়গা

৫৮. আয়াতটির আপাত বক্তব্য দৃষ্টে পরিস্কার অনুভূত হয় যেপূর্বের বাক্যটিতে আল্লাহর যে সুষ্পষ্ট প্রমাণের কথা বলা হয়েছেতা দ্বারা এ পরবর্তী বাক্যটিতে নিদর্শনহিসেবে উল্লেখিত উটনীটিই বুঝানো হয়েছে সূরা আশ শুআ’রার ৮ রুকূতে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যেসামুদ জাতির লোকেরা নিজেরাই হযরত সালেহের কাছে এমন একটি নিদর্শনের দাবী করেছিল যা তাঁর আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্তির দ্ব্যর্থহীন ও অকাট্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এরি জবাবে হযরত সালেহ উটনীটি হাজির করেন এ থেকে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমানিত হয় যেউটনীর আবির্ভাব হয়েছিল মুজিযা হিসেবে এবং কোন কোন নবী তাঁদের নবুওয়াতের প্রমাণ স্বরূপ নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের দাবীর জবাবে যেসব মুজিযা পেশ করেছিলেন এটি ছিল সেই ধরনেরই একটি মুজিযাতাছাড়া হযরত সালেহ এই উটনীটি হাজির করার পর যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাও এর অলৌকিক জন্মের প্রমাণ তিনি নবুওয়াত অস্বীকারকারীদেরকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেনএখন এ উটনীটির প্রাণের সাথে তোমাদের জীবন জড়িত হয়ে গেছে উটনীটি স্বাধীনভাবে তোমাদের ক্ষেতে চরে বেড়াবেএকদিন সে একাই পানি পান করবে এবং অন্যদিন সমগ্রজাতির যত পশু আছে সবাই পানি পান করবে আর যদি তোমরা তার গায়ে কোনভাবে হাত উঠাও তাহলে অকস্মাত তোমাদের ওপর আল্লাহর আযাব নেমে আসবে বলা বাহুল্য যে জিনিসটির অস্বাভাবিকতা লোকেরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিল একমাত্র সেই জিনিসটি সম্পর্কেই এভাবে কথা বলা সম্ভবউপরন্তু এ কথাও প্রনিধানযোগ্য যেদীর্ঘদিন ধরে সামুদ জাতির লোকেরা তার স্বাধীনভাবে চরে বেড়ানো এবং একদিন তার একাকী পানি পান করা অন্যদিন সমগ্র জাতির সমস্ত পশুদের পানি পান করার বিষয়টি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বরদাশত করে এসেছে অবশেষে অনেক শলা-পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের পর তারা তাকে হত্যা করে অথচ তাদের হযরত সালেহকে ভয় করার কিছুই ছিল না কারণ তাঁর কোন ক্ষমতা বা প্রতাপ ছিল না এ অকাট্য ও জ্বলন্ত সত্য দ্বারা আরো প্রমাণিত হচ্ছে যেতারা এ উটনীর ভয়ে ভীতসস্ত্রস্ত ছিল তারা জানতোএর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তি আছেতারই জোরে সে তাদের মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়ায় উটনীটি কেমন ছিল এবং কিভাবে জন্ম লাভ করলো,তার কোন বর্ণনা কুরআন দেয়নি কোন নির্ভরযোগ্য সহীহহাদীসেও এর বিস্তারিত কোন বিবরণ নেই তাই এ উটনীটির জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে যেসব বর্ণনা মুফাসসিরগণ উদ্ধৃত করেছেন তা মেনে নেয়া অপরিহার্য নয় কিন্তু এর জন্ম যেকোন না কোনভাবে মুজিযা ও অলৌকিক ঘটনার পর্যায়ভুক্ত তা অবশ্যি কুরআন থেকে প্রমাণিত

﴿وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِن بَعْدِ عَادٍ وَبَوَّأَكُمْ فِي الْأَرْضِ تَتَّخِذُونَ مِن سُهُولِهَا قُصُورًا وَتَنْحِتُونَ الْجِبَالَ بُيُوتًا ۖ فَاذْكُرُوا آلَاءَ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ﴾

৭৪ স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ আদ জাতির পর তোমাদেরকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন এবং পৃথিবীতে তোমাদেরকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যার ফলে আজ তোমরা তাদের সমতলভূমিতে বিপুলায়তন প্রাসাদ ও তার পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছো৫৯  কাজেই তাঁর সর্বময় ক্ষমতার স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যেয়ো না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না৬০

৫৯. সামূদদের এ গৃহ নির্মাণ শিল্পটি ছিল ভারতের ইলোরাঅজন্তা গূহাও অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত পর্বত গাত্রের গৃহের ন্যায় অর্থাৎ তারা পাহাড় কেটে তার মধ্য বিরাট বিরাট ইমারত তৈরী করতো মাদায়েনে সালেহ এলাকায় এখনো তাদের এসব ইমারত সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে সেগুলো দেখে এ জাতি স্থাপত্য বিদ্যায় কেমন বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছিলতা অনুমান করা যায়

৬০. অর্থাৎ আদ জাতির পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো তোমরা যদি আদদের মতো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে থাকোতাহলে যে মহান আল্লাহর অসাধারণ ক্ষমতা এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী জাতিকে ধ্বংস করে দিয়ে তার জায়গায় তোমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেনসেই মহা শক্তিধর আল্লাহই আবার তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে অন্যদেরকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন (টীকা ৫২ দ্রষ্টব্য)

﴿قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِن قَوْمِهِ لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِمَنْ آمَنَ مِنْهُم