পরম
করুণাময়
মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿الر ۚ تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ
وَقُرْآنٍ مُّبِينٍ﴾
১।
আলিফ-লাম-রা। এগুলো আল্লাহর কিতাব
ও সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াত।১
১. এটি এ সূরার সংক্ষিপ্ত পরিচিতিমূলক ভূমিকা। এরপর সাথে সাথেই আসল
বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভাষণ শুরু হয়ে গেছে। “সুস্পষ্ট” শব্দটি কুরআনের
বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, এগুলো এমন এক কুরআনের আয়াত যে নিজের বক্তব্য পরিস্কারভাবে বলে দেয়।
﴿رُّبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ
كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ﴾
২। এমন এক
সময় আসা বিচিত্র নয় যখন আজ যারা (ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করতে) অস্বীকার করছে, তারা অনুশোচনা করে বলবে, হায়, যদি আমরা আনুগত্যের শির নত
করে দিতাম!
﴿ذَرْهُمْ يَأْكُلُوا وَيَتَمَتَّعُوا
وَيُلْهِهِمُ الْأَمَلُ ۖ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ﴾
৩। ছেড়ে দাও
এদেরকে, খানাপিনা
করুক, আমোদ
ফূর্তি করুক এবং মিথ্যা প্রত্যাশা এদেরকে ভুলিয়ে রাখুক। শিগ্গির
এরা জানতে পারবে।
﴿وَمَا أَهْلَكْنَا مِن قَرْيَةٍ
إِلَّا وَلَهَا كِتَابٌ مَّعْلُومٌ﴾
৪। ইতিপূর্বে
আমি যে জনবসতিই ধ্বংস করেছি তার জন্য একটি বিশেষ কর্ম-অবকাশ লেখা হয়ে গিয়েছিল।২
২. এর মানে হচ্ছে, কুফরী করার সাথে সাথেই আমি কখনো কোন জাতিকে পাকড়াও করিনি। তাহলে এই নির্বোধরা কেন এ ভুল ধারণা
করছে যে, নবীকে তারা যেভাবে মিথ্যা বলছে এবং ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে, তাতে যেহেতু এখনো তাদেরকে
কোন শাস্তি দেয়া হয়নি, তাই এ নবী আসলে কোন নবীই নয়? আমার নিয়ম হচ্ছে, প্রত্যেক জাতিকে শুনবার, বুঝবার ও নিজেকে শুধরে নেবার
জন্য কি পরিমাণ অবকাশ দেয়া হবে এবং তার যাবতীয় দুষ্কৃতি ও অনাচার সত্বেও পূর্ণ
ধৈর্য সহকারে তাকে নিজের ইচ্ছামত কাজ করার কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে তা আমি
পূর্বাহ্নেই স্থির করে নিই। যথক্ষণ এ অবকাশ থাকে এবং আমার নির্ধারিত শেষ সীমা না আসে ততক্ষণ আমি ঢিল
দিতে থাকি। (কর্মের অবকাশ দেবার ব্যাপারটি সম্পর্কে
বিস্তারিত জানার জন্য সূরা ইবরাহীমের ১৮ টীকা দেখুন।)
﴿مَّا تَسْبِقُ مِنْ أُمَّةٍ
أَجَلَهَا وَمَا يَسْتَأْخِرُونَ﴾
৫। কোনো জাতি
তার নিজের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে যেমন ধ্বংস হতে পারে না, তেমনি সময় এসে যাওয়ার পরে অব্যাহতিও
পেতে পারে না।
﴿وَقَالُوا يَا أَيُّهَا الَّذِي
نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُونٌ﴾
৬। এরা বলে, “ওহে যার প্রতি বাণী৩ অবতীর্ণ হয়েছে,৪ তুমি নিশ্চয়ই উন্মাদ!
৩. “যিকির” বা বাণী শব্দটি পারিভাষিক অর্থে কুরআন মজীদে আল্লাহর বাণীর
জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আর এ
বাণী হচ্ছে আগাগোড়া উপদেশমালায় পরিপূর্ণ। পূর্ববর্তী নবীদের ওপর যেগুলো কিতাব
নাযিল হয়েছিল সেগুলো সবই “যিকির” ছিল এবং এ
কুরআন মজীদও যিকির। যিকিরের আসল মানে হচ্ছে স্মরণ করিয়ে দেয়া, সতর্ক করা এবং উপদেশ দেয়া।
৪. তারা ব্যংগ ও উপহাস করে একথা বলতো। এ বাণী যে, নবী সা. এর ওপর নাযিল হয়েছে
একথা তারা স্বীকারই করতো না। আর একথা স্বীকার করে নেয়ার পর তারা তাঁকে পাগল বলতে পারতো না। আসলে তাদের একথা বলার অর্থ
ছিল এই যে, “ওহে, এমন ব্যক্তি! যার দাবী হচ্ছে আমার ওপর যিকির তথা আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হয়েছে। “এটা ঠিক তেমনি ধরনের কথা যেমন ফেরাউন হযরত
মূসার আ. দাওয়াত শুনার পর তার সভাসদদের বলেছিলঃ
إِنَّ رَسُولَكُمُ
الَّذِي أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ لَمَجْنُونٌ
“এই যে পয়গম্বর সাহেবকে
তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছে, এর মাথা ঠিক নেই।”
﴿لَّوْ مَا تَأْتِينَا بِالْمَلَائِكَةِ
إِن كُنتَ مِنَ الصَّادِقِينَ﴾
৭। যদি তুমি
সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমাদের সামনে ফেরেশতাদেরকে আনছো না কেন?
﴿مَا نُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ
إِلَّا بِالْحَقِّ وَمَا كَانُوا إِذًا مُّنظَرِينَ﴾
৮। আমি
ফেরেশতাদেরকে এমনিই অবতীর্ণ করি না, তারা যখনই অবতীর্ণ হয় সত্য সহকারে অবতীর্ণ
হয়, তারপর
লোকদেরকে আর অবকাশ দেয়া হয় না।৫
৫. অর্থাৎ নিছক তামাশা দেখাবার জন্য ফেরেশতাদেরকে অবতরণ করানো
হয় না। কোন জাতি দাবী করলো, ডাকো ফেরেশতাদেরকে আর অমনি
ফেরেশতারা হাযির হয়ে গেলেন, এমনটি হয় না। কারণ ফেরেশতারা এ জন্য
আসেন না যে, তারা লোকদের সামনে সত্যকে উন্মুক্ত করে দেবেন এবং গায়েবের পর্দা চিরে এমন সব
জিনিস দেখিয়ে দেবেন যার প্রতি ঈমান আনার জন্য নবীগণ দাওয়াত দিয়েছেন। যখন কোন জাতির শেষ সময়
উপস্থিত হয় এবং তার ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা করার সংকল্প করে নেয়া হয়। তখনই ফেরেশতাদেরকে পাঠানো
হয়। তখন কেবলমাত্র ফায়সালা
অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করে ফেলা হয়। তখন আর একথা বলা হয় না যে, এখন ঈমান আনলে ছেড়ে দেয়া হবে। যথক্ষণ সর্ত আবরণ মুক্ত না
হয়ে যায়, কেবল ততক্ষণ পর্যন্তই ঈমান আনার অবকাশ থাকে। তার আবরণ মুক্ত হয়ে যাওয়ার পর আর ঈমান
আনার কি অর্থ থাকে?
“সত্য সহকারে অবতীর্ণ হওয়ার “মানে হচ্ছে সত্য
নিয়ে অবতীর্ণ হওয়া। অর্থাৎ তারা মিথ্যাকে
মিটিয়ে দিয়ে তার জায়গায় সত্যকে কায়েম করার জন্যই আসেন। অথবা অন্য কথায় বুঝে নিন, তারা আল্লাহর ফায়সালা নিয়ে
আসেন এবং তা প্রতিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত হন।
﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا
الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
৯। আর এ বাণী, একে তো আমিই অবতীর্ণ করেছি
এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।৬
৬. অর্থাৎ এই বাণী, যার বাহককে তোমরা পাগল বলছো, আমিই তা অবতীর্ণ করেছি, তিনি নিজে তা তৈরী করেননি। তাই এ গালি তাকে দেয়া হয়নি বরং আমাকে দেয়া হয়েছে। আর তোমরা যে এ বাণীর কিছু
ক্ষতি করতে পারবে তা ভেব না। এটি সরাসরি আমার হেফাজতে রয়েছে। তোমাদের চেষ্টায় একে বিলুপ্ত করা যাবে
না। তোমরা একে ধামাচাপা দিতে
চাইলেও দিতে পারবে না। তোমাদের আপত্তি ও নিন্দাবাদের ফলে এর মর্যাদাও কমে যাবে না। তোমরা ঠেকাতে চাইলেও এর
দাওয়াতকে ঠেকাতে পারবে না। একে বিকৃত বা এর মধ্যে পরিবর্তন সাধন করার সুযোগও তোমরা কেউ কোনদিন পাবে
না।
﴿وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِن
قَبْلِكَ فِي شِيَعِ الْأَوَّلِينَ﴾
১০। হে
মুহাম্মাদ! তোমার পূর্বে আমি অতীতের অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছিলাম।
﴿وَمَا يَأْتِيهِم مِّن رَّسُولٍ
إِلَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ﴾
১১। তাদের
কাছে কোনো রাসূল এসেছে এবং তারা তাকে বিদ্রূপ করেনি, এমনটি কখনো হয়নি।
﴿كَذَٰلِكَ نَسْلُكُهُ فِي
قُلُوبِ الْمُجْرِمِينَ﴾
১২। এ বাণীকে
অপরাধীদের অন্তরে আমি এভাবেই (লৌহ শলাকার মতো) প্রবেশ করাই।’
﴿لَا يُؤْمِنُونَ بِهِ ۖ وَقَدْ
خَلَتْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ﴾
১৩। তারা এর
প্রতি ঈমান আনে না।৭ এ ধরনের লোকদের এ রীতি
প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।
৭. সাধারণত অনুবাদক ও তাফসীরকারগণ نَسْلُكُهُ (আমি তাকে প্রবেশ করাই বা
চালাই) এর মধ্যকার সর্বনামটিকে استهزاء (বিদ্রূপ) এর সাথে এবং لَا يُؤْمِنُونَ بِهِ (তারা এর প্রতি ঈমান আনে না)
এর মধ্যকার সর্বনামটিকে ذكر এর সাথে সংযুক্ত করেছেন। তারা এর অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “আমি এভাবে এ বিদ্রূপকে অপরাধীদের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেই এবং তারা এ
বাণীর প্রতি ঈমান আনে না। “যদিও ব্যকরণের নিয়ম অনুযায়ী
এতে কোন ত্রুটি নেই, তবুও ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী উভয় সর্বনামই “যিকির “বা বাণির সাথে সংযুক্ত
হওয়াই আমার কাছে বেশী নির্ভুল বলে মনে হয়।
আরবী ভাষায় سَلَكَ শব্দের
অর্থ হচ্ছে কোন জিনিসকে অন্য জিনিসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া, অনুপ্রবেশ করানো, চালিয়ে দেয়া বা গলিয়ে দেয়া। যেমন সুঁইয়ের ছিদ্রে সূতো
গলিয়ে দেয়া হয়। কাজেই এ
আয়াতের অর্থ হচ্ছে, ঈমানদারদের মধ্যে তো এই “বাণী “হৃদয়ের শীতলতা ও আত্মার খাদ্য হয়ে প্রবেশ
করে। কিন্তু অপরাধীদের অন্তরে
তা বারুদের মত আঘাত করে এবং তা শুনে তাদের মনে এমন আগুন জ্বলে ওঠে যেন মনে হয় একটি
গরম শলাকা তাদের বুকে বিদ্ধ হয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।
﴿وَلَوْ فَتَحْنَا عَلَيْهِم
بَابًا مِّنَ السَّمَاءِ فَظَلُّوا فِيهِ يَعْرُجُونَ﴾
১৪। যদি আমি
তাদের সামনে আকাশের কোনো দরজা খুলে দিতাম এবং তারা দিন দুপুরে তাতে আরোহণও করতে
থাকতো।
﴿لَقَالُوا إِنَّمَا سُكِّرَتْ
أَبْصَارُنَا بَلْ نَحْنُ قَوْمٌ مَّسْحُورُونَ﴾
১৫। তবুও তারা
একথাই বলতো, আমাদের
দৃষ্টি বিভ্রম হচ্ছে বরং আমাদের ওপর যাদু করা হয়েছে।
﴿وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ
بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ﴾
১৬। আকাশে আমি
অনেক মজবুত দুর্গ নির্মাণ করেছি,৮ দর্শকদের জন্য সেগুলো সুসজ্জিত করেছি।৯
৮. আরবী ভাষায় দূর্গ, প্রাসাদ ও মজবুত ইমারতকে বুরুজ বলা হয়। প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যায় সূর্যের পরিভ্রমণ
পথকে যে বারটি স্তরে বা রাশিচক্রে বিভক্ত করা হয়েছিল ‘বুরুজ’ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে সেই বারটি স্তরের জন্য ব্যবহার করা হতো। এ কারণে কুরআন ঐ
বুরুজগুলোর দিকে ইংগিত করেছে বলে কোন কোন মুফাসসির মনে করেছেন। আবার কোন কোন মুফাসসির
এটিকে গ্রহ অর্থে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে মনে হবে, এর অর্থ সম্ভবত উর্ধ জগতের
এমন সব অংশ যার মধ্যকার প্রত্যেকটি অংশকে অত্যন্ত শক্তিশালী সীমান্ত অন্যান্য অংশ
থেকে আলাদা করে রেখেছে। যদিও এ
সীমান্তরেখা মহাশূন্যে অদৃশ্যভাবে অংকিত হয়ে আছে তবুও সেগুলো অতিক্রম করে কোন
জিনিসের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাওয়া খুবই কঠিন। এ অর্থের প্রেক্ষিতে আমি বুরুজ
শব্দটিকে সংরক্ষিত অঞ্চলসমূহ (Fortified) অর্থে গ্রহণ করা
অধিকতর নির্ভুল বলে মনে করি।
৯. অর্থাৎ প্রত্যেক অঞ্চলে কোন না কোন উজ্জ্বল গ্রহ বা তারকা
রেখে দিয়েছেন এবং এভাবে সমগ্র জগত ঝলমলিয়ে উঠেছে। অন্য কথায়, আমি দৃশ্যত কুলকিনারাহীন এ
বিশ্ব জগতকে একটি বিশাল পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়ি বানিয়ে রেখে দেইনি। বরং তাকে এমন একটি সুন্দর
সুসজ্জিত জগত বানিয়ে রেখেছি যার মধ্যে সর্বত্র সব দিকে নয়নাভিরাম দীপ্তি ছাড়িয়ে
রয়েছে। এ শিল্পকর্মে শুধুমাত্র
একজন মহান কারিগরের অতুলনীয় শিল্প নৈপুণ্য এবং একজন মহাবিজ্ঞানীর অনুপম বৈজ্ঞানিক
কুশলতাই দৃষ্টিগোচর হয় না এই সংগে একজন অতীব পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রুচির অধিকারী
শিল্পীর শিল্পও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ বিষয়বস্তুটিই অন্য এক স্থানে এভাবে
বলা হয়েছেঃ الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ (আল্লাহ, যে জিনিসই বানিয়েছেন, চমৎকার বানিয়েছেন।) আস–সাজদাহঃ ৭
﴿وَحَفِظْنَاهَا مِن كُلِّ
شَيْطَانٍ رَّجِيمٍ﴾
১৭। এবং
প্রত্যেক অভিশপ্ত শয়তান থেকে সেগুলোকে সংরক্ষণ করেছি।১০ কোনো শয়তান সেখানে অনুপ্রবেশ
করতে পারে না।
১০. অর্থাৎ পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টি যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে
বন্দী হয়ে রয়েছে, ঠিক তেমনি জিন বংশোদ্ভূত শয়তানরাও এ অঞ্চলে বন্দী হয়ে রয়েছে। উর্ধ জগতে পৌঁছুবার ক্ষমতা
তাদের নেই। এর মাধ্যমে মূলত লোকদের
একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করাই উদ্দেশ্য। সাধারণ মানুষ এ বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিল
এবং আজো আছে। তারা
মনে করে, শয়তান ও তার সাংগপাংগদের জন্য সারা বিশ্ব জাহানের দরজা খোলা আছে, যত দূর ইচ্ছা তারা যেতে পারে। কুরআন এর জবাবে বলছে, শয়তানরা একটি বিশেষ সীমানা
পর্যন্তই যেতে পারে, তার ওপরে আর যেতে পারে না। তাদেরকে কখনোই সীমাহীন উড্ডয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
﴿إِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ
فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ مُّبِينٌ﴾
১৮। তবে আড়ি
পেতে বা চুরি করে কিছু শুনতে পারে।১১ আর যখন সে চুরি করে শোনার
চেষ্টা করে তখন একটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা তাকে ধাওয়া করে।১২
১১. অর্থাৎ যেসব শয়তান তাদের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোশকদেরকে গায়েবের
খবর এনে দেবার চেষ্টা করে থাকে, যাদের সাহায্যে অনেক জ্যোতিষী, গণক ও ফকির–বেশী বহুরূপী অদৃশ্য জ্ঞানের ভড়ং দেখিয়ে থাকে, গায়েবের খবর জানার কোন একটি
উপায়–উপকরণও আসলে তাদের আয়ত্বে নেই। তারা চুরি–চামারি করে কিছু শুনে
নেবার চেষ্টা অবশ্যি করে থাকে। কারণ তদের গঠনাকৃতি মানুষের তুলনায় ফেরেশতাদের কিছুটা কাছাকাছি কিন্তু
আসলে তাদের কপালে শিকে ছেঁড়ে না।
১২. شِهَابٌ مُّبِينٌ এর আভিধানিক অর্থ উজ্জ্বল
আগুনের শিখা। কুরআনের অন্য জায়গায় এজন্য شِهَابٌ ثاقب শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, অন্ধকার বিদীর্ণকারী অগ্নি-
স্ফুলিংগ। এর মানে যে, আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত জ্বলন্ত
নক্ষত্র হতে হবে, যাকে আমাদের পরিভাষায় “উলকা পিণ্ড “বলা হয়, তেমন কোন কথা নেই। এটা হয়তো অন্য কোন ধরনের
রশ্মি হতে পারে। যেমন
মহাজাগতিক রশ্মি (Cosmic Rays) অথবা এর চেয়েও তীব্র ধরনের
অন্য কিছু, যা এখনো আমাদের জ্ঞানের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। আবার এ উল্কা পিণ্ডও হতে পারে, যাকে আমরা মাঝে মধ্যে আকাশ
থেকে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে দেখি। বর্তমানকালের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে
মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর দিকে যেসব উলকা ছুটে আসতে দেখা যায় তার সংখ্যা হবে প্রতিদিন
এক লক্ষ কোটি। এর মধ্যে থেকে প্রায় ২
কোটি প্রতিদিন পৃথিবীর মধ্যাকার্ষণ এলাকার মধ্যে প্রবেশ করে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয়। তার মধ্য থেকে কোন রকমে
একটা ভু-পৃষ্ঠে পৌঁছে। মহাশূন্যে এদর গতি হয় কমবেশী প্রতি সেকেণ্ডে ২৬ মাইল এবং কখনো তা প্রতি
সেকেণ্ডে ৫০ মাইলেও পৌঁছে যায়। অনেক সময় খালি চোখেও অস্বাভাবিক উলকা বৃষ্টি দেখা যায়। পুরাতন রেকর্ড থেকে জানা
যায়, ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর উত্তর আমেরিকার পূর্ব এলাকায় শুধুমাত্র
একটিস্থানে মধ্য রাত্র থেকে প্রভাত পর্যন্ত ২ লক্ষ উলকা পিণ্ড নিক্ষিপ্ত হতে দেখা
গিয়েছিল। (ইনসাই–ক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ১৯৪৬, ১৫ খণ্ড, ৩৩৭–৩৯ পৃঃ) হয়তো এই উলকা বৃষ্টিই উর্ধ জগতের দিকে শয়তানদের উড্ডয়নের
পথে বাধার সৃষ্টি করে। কারণ
পৃথিবীর উর্ধ সীমানা পার হয়ে মহাশূন্যে প্রতিদিন এক লক্ষ কোটি উলকাপাত তাদের জন্য
মহাশূন্যের ঐ এলাকাকে সম্পূর্ণরূপে অনতিক্রম্য বানিয়ে দিয়ে থাকবে।
এখানে উপরে যে সংরক্ষিত দূর্গগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোর ধরন সম্পর্কে কিছুটা
অনুমান করা যেতে পারে। আপাত
দৃষ্টিতে মহাশূন্য একেবারে পরিস্কার। এর মধ্যে কোথাও কোন দেয়াল বা ছাদ দেখা
যায় না। কিন্তু আল্লাহ এ
মাহশূন্যের বিভিন্ন অংশকে এমন কিছু অদৃশ্য দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছেন যা এ অংশের
বিপদ ও ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অন্য অংশকে সংরক্ষিত করে রাখে। এ দেয়ালগুলোর বদৌলতেই
প্রতিদিন গড়ে যে এক লক্ষ কোটি উলকা পিণ্ড পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে তা সব পথেই জ্বলে
পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং মাত্র একটি এসে পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়তে সক্ষম হয়। পৃথিবীতে উলকা পিণ্ডের
যেসব নমুনা দুনিয়ার বিভিন্ন যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টির ওজন ৬৪৫
পাউণ্ড। এ পাথরটি ওপর থেকে পড়ে
মাটির মধ্যে ১১ ফুট গভীরে প্রেথিত হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়াও এক জায়গায় ৩৬ ১/২ টনের একটি
লোহার স্তূপ পাওয়া গেছে। বৈজ্ঞানিকদের মতে আকাশ থেকে এ লোহা নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে এর
স্তূপাকার অস্তিত্বের কোন কারণই তারা খুঁজে পাননি। চিন্তা করুন পৃথিবীর উর্ধ সীমানাকে যদি
মজবুত দেয়ালের মাধ্যমে সংরক্ষিত না করা হতো তাহলে এসব উলকাপাতে পৃথিবীর কী অবস্থা
হতো! এ দেয়ালগুলোকেই কুরআনে বুরুজ (সংরক্ষিত দূর্গ) বলা হয়েছে।
﴿وَالْأَرْضَ مَدَدْنَاهَا
وَأَلْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنبَتْنَا فِيهَا مِن كُلِّ شَيْءٍ مَّوْزُونٍ﴾
১৯। পৃথিবীকে
আমি বিস্তৃত করেছি, তার মধ্যে
পাহাড় স্থাপন করেছি, সকল
প্রজাতির উদ্ভিদ তার মধ্যে সুনির্দিষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন করেছি১৩
১৩. এর মাধ্যমে আল্লাহর কুদরত, শক্তিমত্তা ও জ্ঞানের আর
একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। উদ্ভিদের প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে
বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা এত বেশী যে, তার যদি শুধু একটি মাত্র তারাকে দুনিয়ায় বংশ বৃদ্ধির সুযোগ দেয়া হয় তাহলে কয়েক
বছরের মধ্যে পৃথিবীর চতুরদিকে শুধু তারই চারা দেখা যাবে, অন্যকোন উদ্ভিদের জন্য আর
কোন জায়গা খালি থাকবে না। কিন্তু
একজন মহাজ্ঞানী ও অসীম শক্তিধরের সূচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী অসংখ্য প্রজাতির
উদ্ভিদ এ বিশ্ব চরাচরে উৎপন্ন হচ্ছে। প্রত্যেক প্রজাতির উৎপাদন একটি বিশেষ
সীমায় পৌঁছে যাওয়ার পর থেমে যায়। এ পক্রিয়ায় আর একটি দিক হচ্ছে, প্রত্যেক প্রজাতির উদ্ভিদের
আয়তন, বিস্তৃতি, উচ্চতা ও বিকাশের একটি সীমা নির্ধারিত আছে। কোন উদ্ভিদ এ সীমা অকিক্রম করতে পারে
না। পরিস্কার জানা যায়, প্রতিটি বৃক্ষ, চারা ও লতাপাতার জন্য কেউ শরীর, উচ্চতা, আকৃতি, পাতা, ফুল, ফল ও উৎপাদনের একটি মাপাজোকা
পরিমাণ পুরোপুরি হিসেব ও গণনা করে নির্ধারিত করে দিয়েছে।
﴿وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا
مَعَايِشَ وَمَن لَّسْتُمْ لَهُ بِرَازِقِينَ﴾
২০। এবং তার
মধ্যে জীবিকার উপকরণাদি সরবরাহ করেছি তোমাদের জন্যও এবং এমন বহু সৃষ্টির জন্যও
যাদের আহারদাতা তোমরা নও।
﴿وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا
عِندَنَا خَزَائِنُهُ وَمَا نُنَزِّلُهُ إِلَّا بِقَدَرٍ مَّعْلُومٍ﴾
২১। এমন কোনো
জিনিস নেই যার ভাণ্ডার আমার কাছে নেই এবং আমি যে জিনিসই অবতীর্ণ করি একটি
নির্ধারিত পরিমাণেই করে থাকি।১৪
১৪. এখানে এ সর্তটি সম্পর্কে সজাগ করে দেয়া হয়েছে যে, সীমিত ও পরিকল্পিত প্রবৃদ্ধির এই নিয়ম কেবল উদ্ভিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়
বরং যাবতীয় সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বায়ূ, পানি, আলো, শীত, গ্রীষ্ম, জীব, জড়, উদ্ভিদ তথা প্রত্যেকটি জিনিস, প্রত্যেকটি প্রজাতি, প্রত্যেকটি শ্রেনী ও
প্রত্যেকটি শক্তির জন্য একটি সীমা নির্ধারিত রয়েছে। তার মধ্যে তারা অবস্থান করছে। তাদের জন্য একটি পরিমাণও
নির্ধারিত রয়েছে, তার চাইতে তারা কখনো বাড়েও না আবার কমেও না। এই নির্ধারিত অবস্থা এবং পরিপূর্ণ
প্রজ্ঞামূলক নির্ধারিত অবস্থার বদৌলতেই পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সমগ্র
বিশ্বব্যবস্থায় এই ভারসাম্য, সমন্বয় ও পারিপাট্য দেখা যাচ্ছে। এই বিশ্ব জাহানটি যদি একটি আকস্মিক ঘটনার ফসল হতো অথবা বহু খোদার
কর্মকুশলতা ও কর্মতৎপরতার ফল হতো, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অসংখ্য বস্তু ও শক্তির মধ্যে এই পর্যায়ের পূর্ণ
ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও অব্যাহতভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা কেমন করে সম্ভব হতো?
﴿وَأَرْسَلْنَا الرِّيَاحَ
لَوَاقِحَ فَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَسْقَيْنَاكُمُوهُ وَمَا أَنتُمْ
لَهُ بِخَازِنِينَ﴾
২২।
বৃষ্টিবাহী বায়ু আমিই পাঠাই। তারপর
আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি এবং এ পানি দিয়ে তোমাদের পিপাসা মিটাই। এ
সম্পদের ভাণ্ডার তোমাদের হাতে নেই।
﴿وَإِنَّا لَنَحْنُ نُحْيِي
وَنُمِيتُ وَنَحْنُ الْوَارِثُونَ﴾
২৩। জীবন ও
মৃত্যু আমিই দান করি এবং আমিই হবো সবার উত্তরাধিকারী।১৫
১৫. অর্থাৎ তোমাদের ধ্বংসের পরে একমাত্র আমিই টিকে থাকবো। তোমরা যা কিছু্ পেয়েছো, ওগুলো নিছক সাময়িকভাবে
ব্যবহার করার জন্য পেয়েছো। শেষ পর্যন্ত আমার দেয়া সব জিনিস ত্যাগ করে তোমরা এখান থেকে বিদায় নেবে
একেবারে খালি হাতে এবং এসব জিনিস যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটি আমার ভাণ্ডারে থেকে যাবে।
﴿وَلَقَدْ عَلِمْنَا الْمُسْتَقْدِمِينَ
مِنكُمْ وَلَقَدْ عَلِمْنَا الْمُسْتَأْخِرِينَ﴾
২৪। তোমাদের
পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদেরকে আমি দেখে রেখেছি এবং পরবর্তী আগমনকারীরাও আমার
দৃষ্টি সমক্ষে আছে।
﴿وَإِنَّ رَبَّكَ هُوَ يَحْشُرُهُمْ
ۚ إِنَّهُ حَكِيمٌ عَلِيمٌ﴾
২৫। অবশ্যি
তোমার রব তাদের সবাইকে একত্র করবেন। তিনি
জ্ঞানময় ও সবকিছু জানেন।১৬
১৬. অর্থাৎ তার অপার কর্মকুশলতা ও প্রজ্ঞার বলেই তিনি সবাইকে
একত্র করবেন। আবার তাঁর জ্ঞানের পরিধি
এত ব্যাপক ও বিস্তৃত যে তার নাগালের বাইরে কেউ নেই। বরং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কোন মানুষের
মাটি হয়ে যাওয়া দেহের একটি কণাও তাঁর কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারে না। তাই যে ব্যাক্তি পরকালিন
জীবনকে দূরবর্তী বা অবাস্তব মনে করে সে মূলত আল্লাহর প্রজ্ঞা ও কুশলতা সম্পর্কেই
বেখবর। আর যে ব্যক্তি অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করে “মরার পরে যখন আমাদের মৃত্তিকার বিভিন্ন অণু–কণিকা বিক্ষিপ্ত
হয়ে যাবে তখন আমাদের কিভাবে পূর্ণবার জীবিত করা হবে,” সে আসলে আল্লাহর জ্ঞান
সম্পর্কে অজ্ঞ।
﴿وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ
مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ﴾
২৬। আমি মানুষ
সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠন্ঠনে পচা মাটি থেকে।১৭
১৭. এখানে কুরআন পরিস্কার করে একথা বলে দিচ্ছে যে, মানুষ বির্বতন প্রক্রিয়ার
মাধ্যমে পশুত্বের পর্যায় অতিক্রম করে মানবতার পর্যায়ে অতিক্রম করে মানবতার পর্যায়ে
উন্নীত হয়নি। ডারউইনের ক্রমবিবর্তনবাদে
প্রভাবিত আধুনিক যুগের কুরআনের ব্যাখ্যাতাগণ একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। বরং কুরআন বলেছে, সরাসরি মৃত্তিকার উপাদান
থেকে তার সৃষ্টি কর্ম শুরু হয়।صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ (শুকনো ঠনঠনে পচা মাটি)
শব্দাবলীর মাধ্যমে একথা ব্যক্ত করা হয়েছে। حَمَإٍ م বলতে আরবী ভাষায় এমন ধরনের
কালো কাদা মাটিকে বুঝায় যার মধ্যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়ে গেছে, যাকে আমরা নিজেদের ভাষায় পংক
বা পাঁক বলে থাকি অথবা অন্য কথায় বলা যায়, যা মাটির গোলা বা মণ্ড হয়ে গেছে। مَّسْنُونٍ শব্দের দুই অর্থ হয়। একটি অর্থ, পরিবর্তিত, অর্থাৎ এমন পচা, যার মধ্যে পচন ধরার ফলে চকচকে ও তেলতেলে ভাব সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় অর্থ, চিত্রিত। অর্থাৎ যা একটা নির্দিষ্ট
আকৃতি ও কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। صَلْصَالٍ বলা হয় এমন পচা কাদাকে যা শুকিয়ে যাওয়ার পর ঠনঠনে করে বাজে। এ শব্দাবলী থেকে পরিস্কার
জানা যাচ্ছে যে, গাঁজানো কাদা মাটির গোলা বা মণ্ড থেকে প্রথমে একটি পুতুল বানানো হয় এবং
পুতুলটি তৈরী হবার পর যখন শুকিয়ে যায় তখন তার মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেয়া হয়।
﴿وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ
مِن قَبْلُ مِن نَّارِ السَّمُومِ﴾
২৭। আর এর আগে
জিনদের সৃষ্টি করেছি আগুনের শিখা থেকে।১৮
১৮. سَمُومِ বলা হয় গরম বাতাসকে। আর আগুনকে সামুমের সাথে সংযুক্ত করার
ফলে এর অর্থ আগুনের পরিবর্তে হয় প্রখর উত্তাপ। কুরআনের যেসব জায়গায় জিনকে আগুন থেকে
সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ আয়াত থেকে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হয়ে যায়। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা আর রাহমানঃ টীকা ১৪-১৬)
﴿وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ
إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِّن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ﴾
২৮। তারপর
তখনকার কথা স্মরণ করো যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি শুকনো ঠন্ঠনে পচা মাটি
থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করছি।
﴿فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ
فِيهِ مِن رُّوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ﴾
২৯। যখন আমি
তাকে পূর্ণ অবয়ব দান করবো এবং তার মধ্যে আমার রূহ থেকে কিছু ফুঁক দেবো।১৯ তখন তোমরা সবাই তার সামনে
সিজদাবনত হয়ো।
১৯. এ থেকে জানা যায়, মানুষের মধ্যে যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয় অর্থাৎ প্রাণ সঞ্চার করা হয় তা মূলত
আল্লাহর গুণাবলীর একটি প্রতিচ্ছায়া। জীবন, জ্ঞান, শক্তি, সামর্থ সংকল্প এবং অন্যান্য যতগুলো গুণ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়, যেগুলোর সমষ্টির নাম প্রাণ
—- সেসবই আসলে আল্লাহরই গুণাবলীর একটি প্রতিচ্ছায়া। মানুষের মাটির দেহ-কাঠামোটির ওপর এ
প্রতিচ্ছায়া ফেলা হয়। আর এ প্রতিচ্ছায়ার কারণেই মানুষ এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য
হয়েছে এবং ফেরেশতাগণসহ পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি তাকে সিজদা করেছে।
আসলে তো সৃষ্টির মধ্যে যেসব গুণের সন্ধান পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটিরই উৎস ও
উৎপত্তিস্থল আল্লাহরই কোন না কোন গুণ। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ
جعل الله الرحمة مائة
جزء، فأمسك عنده تسعة وتسعين، وأنزل في الأرض جزءًا واحدًا، فمن ذلك الجزء يتراحم
الخلائق، حتى ترفع الدابة حافرها عن ولدها خشية أن تصيبه
“মহান আল্লাহ রহমতকে একশো ভাগ বিভক্ত করেছেন। তারপর এর মধ্য থেকে ৯৯ টি
অংশ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন এবং মাত্র একটি অংশ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন। এই একটি মাত্র অংশের
বরকতেই সমুদয় সৃষ্টি পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহশীল হয়। এমনকি যদি একটি প্রাণী তার নিজের
সন্তান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ জন্য তার ওপর থেকে নিজের নখর উঠিয়ে নেয় তাহলে
এটিও আসলে এ রহমত গুণের প্রভাবেরই ফলশ্রুতি।”— (বুখারী ও মুসলিম)
কিন্তু আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিচ্ছায়া যে ধরনের পূর্ণতার সাথে মানুষের ওপর ফেলা
হয় অন্য কোন প্রাণীর ওপর তেমনভাবে ফেলা হয়নি। এ জন্যই অন্যান্য সৃষ্টির ওপর মানুষের
এ প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব।
এটি একটি সূক্ষ্ম বিষয়। এটি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সামান্যতম ভ্রান্তি মানুষকে এমন বিভ্রান্তির
মধ্যে ঠেলে দিতে পারে যার ফলে সে আল্লাহর গুণাবলীর একটি অংশ লাভ করাকে আল্লাহর
সার্বভৌম ক্ষমতার কোন অংশ লাভ করার সমার্থক মনে করতে পারে। অথচ আল্লাহর সার্বভৌম
ক্ষমতার সামন্যতম অংশ লাভ করার কথাও কোন সৃষ্টির জন্য কল্পনাই করা যায় না।
﴿فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ
كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ﴾
৩০। সেমতে সকল
ফেরেশতা একযোগে তাকে সিজদা করলো,
﴿إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ
أَن يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ﴾
৩১। ইবলীস
ছাড়া, কারণ সে
সিজদাকারীদের অন্তরভুক্ত হতে অস্বীকার করলো।২০
২০. তুলনামূলক পর্যালোচনার জন্য সূরা আল বাকারাহ-এর ৪ রুকূ, সূরা আন নিসার ১৮ রুকূ এবং সূরা আল আ’রাফের ২ রুকূ দেখুন। তাছাড়া এসব জায়গায় আমি যে টীকাগুলো
লিখেছি সেগুলোও একটু সামনে রাখলে ভাল হয়।
﴿قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا
لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ﴾
৩২। আল্লাহ
জিজ্ঞেস করলেন, “হে ইবলীস!
তোমার কি হলো, তুমি
সিজদাকারীদের অন্তরভুক্ত হলে না?”
﴿قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ
لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ﴾
৩৩। সে জবাব
দিল, “এমন একটি
মানুষকে সিজদা করা আমার মনোপূত নয় যাকে তুমি শুকনো ঠন্ঠনে পচা মাটি থেকে সৃষ্টি
করেছো।”
﴿قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا
فَإِنَّكَ رَجِيمٌ﴾
৩৪। আল্লাহ
বললেন, “তবে তুমি
বের হয়ে যাও এখান থেকে, কেননা তুমি ধিকৃত।
﴿وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ
إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ﴾
৩৫। আর এখন
কর্মফল দিবস পর্যন্ত তোমার ওপর অভিসম্পাত!২১
২১. অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত তুমি অভিশপ্ত থাকবে। তারপর যখন প্রতিফল দিবস
কায়েম হবে তখন তোমাকে তোমার নাফরমানির শাস্তি দেয়া হবে।
﴿قَالَ رَبِّ فَأَنظِرْنِي
إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ﴾
৩৬। সে আরয
করলো, হে আমার
রব! যদি তাই হয়, তাহলে সেই
দিন পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও যেদিন সকল মানুষকে পুনর্বার উঠানো হবে।
﴿قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ﴾
৩৭। বললেন, “ঠিক আছে, তোমাকে অবকাশ দেয়া হলো।
﴿إِلَىٰ يَوْمِ الْوَقْتِ
الْمَعْلُومِ﴾
৩৮। সেদিন
পর্যন্ত যার সময় আমার জানা আছে।
﴿قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي
لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ﴾
৩৯। সে বললো, “হে আমার রব! তুমি যেমন আমাকে
বিপথগামী করলে ঠিক তেমনিভাবে আমি পৃথিবীতে এদের জন্য প্রলোভন সৃষ্টি করে এদের
সবাইকে বিপথগামী করবো,২২
২২. অর্থাৎ যেভাবে তুমি এ নগণ্য ও হীন সৃষ্টিকে সিজ্দা করার
হুকুম দিয়ে আমাকে তোমার হুকুম অমান্য করতে বাধ্য করেছো ঠিক তেমনিভাবে এ মানুষদের
জন্য আমি দুনিয়াকে এমন চিত্তাকর্ষকও মনোমুগ্ধকর জিনিসে পরিণত করে দেবো যার ফলে
তারা সবাই এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে তোমার নাফরমানী করতে থাকবে। অন্য কথায়, উবলীসের উদ্দেশ্য ছিল, সে পৃথিবীর জীবন এবং তার
সুখ- আনন্দ ও ক্ষণস্থায়ী আরাম–আয়েশ ও ভোগ -বিলাসকে মানুষের জন্য এমন
চমকপ্রদ ও সুদৃশ্য করে তুলবে যার ফলে সে খিলাফত ও তার দায়িত্বসমূহ এবং পরকালের
জবাবদিহির কথা ভুলে যাবে, এমনকি আল্লাহকেও ভুলে যাবে অথবা স্মরণ রাখা সত্ত্বেও তাঁর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ
করবে।
﴿إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ
الْمُخْلَصِينَ﴾
৪০। তবে এদের
মধ্য থেকে তোমার যেসব বান্দাকে তুমি নিজের জন্য নির্বাচিত করে নিয়েছো তাদের ছাড়া।
﴿قَالَ هَٰذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ
مُسْتَقِيمٌ﴾
৪১। বললেন, এটিই আমার নিকট পৌঁছুবার সোজা
পথ।২৩
২৩. هَٰذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ مُسْتَقِيمٌ বাক্যের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ আমি অনুবাদে অবলম্বন করেছি। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে
একথা ঠিক, আমি এটা মেনে চলবো।
﴿إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ
عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ﴾
৪২। অবশ্যি
যারা আমার প্রকৃত বান্দা হবে তাদের ওপর তোমার কোনো জোর খাটবে না। তোমার
জোর খাটবে শুধুমাত্র এমন বিপথগামীদের ওপর যারা তোমার অনুসরণ করবে২৪
২৪. এ বাক্যের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ আমি অনুবাদে অবলম্বন করেছি। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, আমার বান্দাদের (অর্থাৎ
সাধারণ মানুষদের) ওপর তোমার কোন কর্তৃত্ব থাকবে না। তুমি তাদেরকে জবরদস্তি নাফরমান বানাতে
পারবে না। তবে তারা নিজেরাই
বিভ্রান্ত হবে এবং নিজেরাই তোমার অনুসরণ করতে চাইবে তাদেরকে তোমার পথে চলার জন্য
ছেড়ে দেয়া হবে। তোমার
পথ থেকে তাদেরকে আমি জোর করে বিরত রাখার চেষ্টা করবো না।
প্রথম অর্থের দিক দিয়ে বক্তব্যের সার সংক্ষেপ হবেঃ বন্দেগীর পথই হচ্ছে
আল্লাহর কাছে পৌঁছুবার সোজা পথ। যারা এ পথ অবলম্বন করবে তাদের ওপর শয়তানের কোন কর্তৃত্ব চলবে না। আল্লাহ তাদেরকে নিজের জন্য
একান্তভাবে গ্রহণ করে নেবেন। আর শয়তান নিজেও স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, তারা তার ফাঁদে পা দেবে না। তবে যারা নিজেরাই বন্দেগীর
পথ থেকে সরে এসে নিজেদের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথ হারিয়ে ফেলবে তারা ইবলীসের শিকারে
পরিণত হবে এবং ইবলীস তাদেরকে প্রভাবিত করে যেদিক নিয়ে যেতে চাইবে তারা তার পেছনে
সেদিকেই বিভ্রান্তের মত ছুটে বেড়াতে বেড়াতে দূরে–বহু দূরে চলে যাবে।
দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে বক্তব্যের সার সংক্ষেপ হবেঃ মানুষকে বিভ্রান্ত করার
জন্য শয়তান তার যে কর্মপদ্ধতি বর্ণনা করেছে তা হচ্ছে এই যে, সে পৃথিবীর জীবনকে মানুষের
জন্য সুদৃশ্য ও সুশোভিত করে তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে গাফিল ও বন্দেগীর পথ থেকে
বিচ্যুত করে দেবে। আল্লাহ তার এই কর্মপদ্ধতির
স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, এ শর্ত আমি মেনে নিয়েছি এবং এর আরো ব্যাখ্যা করে একথা সুস্পষ্ট করে বলে
দিয়েছেন যে, তোমাকে কেবল মাত্র ধোঁকা দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে, তাদের হাত ধরে জোর করে নিজের
পথে টেনে নিয়ে যাবার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে না। আল্লাহ তাঁর যেসব বান্দাকে নিজের
একনিষ্ঠ বান্দা করে নিয়েছেন শয়তান তাদের নাম নিজের খাতায় রাখেনি। এ থেকে এ ভুল ধারণা সৃষ্টি
হচ্ছিল যে, সম্ভবত কোন যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই আল্লাহ ইচ্ছামতো যাকে চাইবেন নিজের একনিষ্ঠ
বান্দা করে নেবেন এবং সে শয়তানের হাত থেকে বেঁচে যাবে। আল্লাহ একথা বলে বিষয়টি পরিস্কার করে
দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি নিজেই বিভ্রান্ত হবে সে–ই তোমার অনুসারী হবে। অন্য কথায়, যে বিভ্রান্ত হবে না সে
তোমার অনুসরণ করবে না এবং সেই হবে আমার বিশেষ বান্দা, যাকে আমি একান্ত করে নেব।
﴿وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوْعِدُهُمْ
أَجْمَعِينَ﴾
৪৩। এবং তাদের
সবার জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তির অংগীকার।২৫
২৫. এখানে এ ঘটনাটি যে উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা হয়েছে তা অনুধাবন
করার জন্য পূর্বাপর আলোচনা পরিস্কারভাবে মনে রাখতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় রুকূর বিষয়বস্তু
সম্পর্কে চিন্ত–ভাবনা করলে একটি কথা পরিস্কার বুঝতে পারা যায়। সেটি হচ্ছেঃ এ বর্ণনা ধারায় আদম ও ইবলীসের এ কাহিনী বর্ণনা করার পেছনে একটি উদ্দেশ্য
যে, তোমরা নিজেদের আদি শত্রু শয়তানের ফাঁদে পড়ে গেছো এবং সে নিজের হিংসা চরিতার্থ
করার জন্য তোমাদের যে হীনতার গর্তে নামিয়ে দিতে চায় তোমরা তার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছো। পক্ষান্তরে এ নবী তোমাদের
এ ফাঁদ থেকে উদ্ধার করে উন্নতির সেই উচ্চ শিখরের দিকে নিয়ে যেতে চান যা আসলে
মানুষে হিসেবে তোমাদের স্বাভাবিক অবস্থান স্থল। কিন্তু তোমরা অদ্ভুত নির্বুদ্ধিতার পরিচয়
দিচ্ছো। নিজেদের শত্রুকে বন্ধু এবং
কল্যাণকামীকে তোমরা শত্রু মনে করছো।
এ সংগে এ সত্যটিও এ কাহিনীর মাধ্যমে তাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে
যে, তোমাদের জন্য একটি মাত্র
মুক্তির পথ রয়েছে এবং সেটি হচ্ছে আল্লাহর বন্দেগী করা। এ পথ পরিহার করে তোমরা যে পথেই চলবে তা
হবে শয়তানের পথ এবং সে পথটি চলে গেছে সোজা জাহান্নামের দিকে।
এ কাহিনীর মাধ্যমে তৃতীয় যে কথাটি বুঝানো হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তোমরা নিজেরাই নিজেদের এ
ভুলের জন্য দায়ী। শয়তানের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে
এর বেশী আর কিছু নয় যে, সে দুনিয়ার বাহ্যিক জীবনোপকরণের সাহায্যে ধোঁকা দিয়ে তোমাদের আল্লাহর বন্দেগীর
পথ তেক বিচ্যুত করার চেষ্টা করে। তার ধোঁকায় পড়ে যাওয়া তোমাদের নিজেদের ত্রুটি। এর কোন দায়–দায়িত্ব তোমাদের
নিজেদের ছাড়া আর কারোর ওপর বর্তায় না।
(এ ব্যাপারে আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য সূরা ইব্রাহীমঃ
২২ আয়াত ও ৩১ টীকা দেখুন)
﴿لَهَا سَبْعَةُ أَبْوَابٍ
لِّكُلِّ بَابٍ مِّنْهُمْ جُزْءٌ مَّقْسُومٌ﴾
৪৪। এ
জাহান্নাম (ইবলীসের অনুসারীদের জন্য যার শাস্তির অংগীকার করা হয়েছে) সাতটি দরজা
বিশিষ্ট। প্রত্যেকটি দরজার জন্য তাদের
মধ্য থেকে একটি অংশ নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে।২৬
২৬. যেসব গোমরাহী ও গোনাহের পথ পাড়ি দিয়ে মানুষ নিজের জন্য
জাহান্নামের পথের দরজা খুলে নেয় সেগুলোর প্রেক্ষিতে জাহান্নামের এ দরজাগুলো
নির্ধারিত হয়েছে। যেমন কেউ নাস্তিক্যবাদের
পথ পাড়ি দিয়ে জাহান্নামের দিকে যায়। কেউ যার শিরকের পথ পাড়ি দিয়ে, কেউ মুনাফিকীর পথ ধরে, কেউ প্রবৃত্তি পূজা, কেউ অশ্লীলতা ও ফাসেকী, কেউ জুলুম, নিপীড়ন ও নিগ্রহ, আবার কেউ ভ্রষ্টতার প্রচার ও কুফরীর প্রতিষ্ঠা এবং কেউ অশ্লীলতা ও নৈতিকতা
বিরোধী কার্যকলাপের প্রচারের পথ ধরে জাহান্নামের দিকে যায়।
﴿إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي
جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ﴾
৪৫। অন্যদিকে
মুত্তাকীরা২৭ থাকবে বাগানে ও নির্ঝরিণীসমূহে
২৭. অর্থাৎ যারা শয়তানের পদানুসরণ থেকে দূরে থেকেছে এবং
আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর বন্দেগী ও দাসত্বের জীবন যাপন করেছে।
﴿ادْخُلُوهَا بِسَلَامٍ آمِنِينَ﴾
৪৬। এবং
তাদেরকে বলা হবে, তোমরা
এগুলোতে প্রবেশ করো শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে।
﴿وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم
مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَىٰ سُرُرٍ مُّتَقَابِلِينَ﴾
৪৭। তাদের মনে
যে সামান্য কিছু মনোমালিন্য থাকবে তা আমি বের করে দেবো,২৮ তারা পরস্পর ভাই ভাইয়ে পরিণত
হয়ে মুখোমুখি আসনে বসবে।
২৮. অর্থাৎ সৎ লোকদের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝির কারণে
দনিয়ার জীবনে যদি কিছু মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করার সময়
তা দূর হয়ে যাবে এবং পরস্পরের পক্ষ থেকে তাদের মন একেবারে পরিস্কার করে দয়ো হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য সূরা আল আ’রাফের ৩২ টীকা
দেখুন)
﴿لَا يَمَسُّهُمْ فِيهَا نَصَبٌ
وَمَا هُم مِّنْهَا بِمُخْرَجِينَ﴾
৪৮। সেখানে
তাদের না কোনো পরিশ্রম করতে হবে আর না তারা সেখান থেকে বহিষ্কৃত হবে।২৯
২৯. নিম্নলিখিত হাদীস থেকে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এতে রাসূলুল্লাহ সা.
জানিয়েছেনঃ
يقال لأَهْلِ الجنَّةِ
إنَّ لَكُم أنْ تَصِحُّوا ولا تمرضوا أبدًا وإن لكم تعيشوا فلا تموتو أبدا، وإنَّ
لَكُمْ أنْ تَشِبُّوا فلا تَهْرَمُوا أبَدًا، وإنَّ لَكُمْ أنْ تَقِيْمُوا
فلا تَطْعُنُوا أبَدًا،
অর্থাৎ “জান্নাতবাসীদেরকে বলে দেয়া হবে, এখন তোমরা সবসময় সুস্থ থাকবে, কখনো রোগাক্রান্ত হবে না। এখন তোমরা চিরকাল জীবিত থাকবে, কখনো মরবে না। এখন তোমরা চির যুবক থাকবে, কখনো বৃদ্ধ হবে না। এখন তোমরা হবে চির
অবস্থানকারী, কখনো স্থান ত্যাগ করতে হবে না। “এর আরো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়
এমন সব আয়াত ও হাদীস থেকে যেগুলোতে বলা হয়েছে জান্নাতে নিজের খাদ্য ও প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্র সংগ্রহের জন্য মানুষকে কোন শ্রম করতে হবে না। বিনা প্রচষ্টায় ও পরিশ্রম ছাড়াই সে
সবকিছু পেয়ে যাবে।
﴿نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي
أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ﴾
৪৯। হে নবী!
আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আমি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।
﴿وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ
الْأَلِيمُ﴾
৫০। কিন্তু এ
সংগে আমার আযাবও ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক।
﴿وَنَبِّئْهُمْ عَن ضَيْفِ
إِبْرَاهِيمَ﴾
৫১। আর
তাদেরকে ইবরাহীমের মেহমানদের কাহিনী একটু শুনিয়ে দাও।৩০
৩০. এখানে যে উদ্দেশ্যে হযত ইব্রাহীম এবং তার সাথে সাথে লূতের
সম্প্রদায়ের কাহিনী শুনানো হচ্ছে তা অনুধাবন করার জন্য এ সূরার প্রথম দিকের আয়াত
গুলো সমানে থাকা প্রয়োজন। প্রথম
দিকে ৭ ও ৮ আয়াতে কাফেরদের এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, তারা নবী সা.কে বলতোঃ “যদি তুমি সাচ্চা নবী হয়ে
থাকো তাহলে ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে আনছো না কেন? “সেখানে এ প্রশ্নটির নিছক একটি সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিলঃ “ফেরেশতাদেরকে আমি এমনি অযথা পাঠাই না যখনই তাদেরক পাঠাই সত্য সহকারে
পাঠাই।” এখন এখানে এর বিস্তারিত জবাব
এ দু’টি কাহিনীর আকারে দেয়া হচ্ছে। এখানে তাদেরকে জানানো হচ্ছে যে, একটি “সত্য” নিয়ে ফেরেশতারা
ইবরাহীমের কাছে এসেছিল আবার অন্য একটি সত্য নিয়ে তারা এসেছিল লূতের সম্প্রদায়ের
কাছে। এখন তোমরা নিজেরাই দেখে
নাও, ঐ দু’টি সত্যের মধ্য থেকে কোনটি নিয়ে ফেরেশতারা তোমাদের কাছে আসতে পারে? একথা সুস্পষ্ট যে, ইবরাহীমের কাছে যে সত্য নিয়ে
তারা এসেছিল সেটি লাভ করার যোগ্যতা তোমাদের নেই। এখন কি যে সত্যটি নিয়ে তারা লূতের
সম্প্রদায়ের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল সেটি সহকারে তোমরা তাদেরকে আনতে চাও?
﴿إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا
سَلَامًا قَالَ إِنَّا مِنكُمْ وَجِلُونَ﴾
৫২। যখন তারা
এলো তার কাছে এবং বললো, সালাম তোমার প্রতি, সে বললো, “আমরা তোমাদের দেখে ভয় পাচ্ছি”।৩১
৩১. তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য সূরা হূদের ৭ রুকূ টীকা সহকারে দেখুন।
﴿قَالُوا لَا تَوْجَلْ إِنَّا
نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ﴾
৫৩। তারা জবাব
দিল, ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাকে এক পরিণত জ্ঞান
সম্পন্ন পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি।৩২
৩২. অর্থাৎ হযরত ইসহাকের আ. জন্মের সুসংবাদ। সূরা হূদে বিষয়টি
সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
﴿قَالَ أَبَشَّرْتُمُونِي
عَلَىٰ أَن مَّسَّنِيَ الْكِبَرُ فَبِمَ تُبَشِّرُونَ﴾
৫৪। ইব্রাহীম
বললো, তোমরা কি
বার্ধক্যবস্থায় আমাকে সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছো? একটু ভেবে দেখো তো এ কোন
ধরনের সুসংবাদ তোমরা আমাকে দিচ্ছো?
﴿قَالُوا بَشَّرْنَاكَ بِالْحَقِّ
فَلَا تَكُن مِّنَ الْقَانِطِينَ﴾
৫৫। তারা জবাব
দিল, আমরা
তোমাকে সত্য সংসংবাদ দিচ্ছি, তুমি নিরাশ হয়ো না।
﴿قَالَ وَمَن يَقْنَطُ مِن
رَّحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ﴾
৫৬। ইব্রাহীম
বললো, পথভ্রষ্ট
লোকেরাই তো তাদের রবের রহমত থেকে নিরাশ হয়।
﴿قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا
الْمُرْسَلُونَ﴾
৫৭। তারপর ইব্রাহীম
জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর
প্রেরিতরা! তোমরা কোন অভিযানে বের হয়েছো?৩৩
৩৩. হযরত ইবরাহীমের আ. এ প্রশ্নটি থেকে পরিস্কার প্রমাণ হয় যে, ফেরেশতারা সবসময় অস্বাভাবিক
অবস্থায়ই মানুষের আকৃতি ধরে আসেন এবং বড় বড় ও গুরুতর ধরনের অভিযানেই তাদেরকে
পাঠানো হয়।
﴿قَالُوا إِنَّا أُرْسِلْنَا
إِلَىٰ قَوْمٍ مُّجْرِمِينَ﴾
৫৮। তারা বললো, আমাদের একটি অপরাধী
সম্প্রদায়ের দিকে পাঠানো হয়েছে।৩৪
৩৪. এ ধরনের সংক্ষিপ্ত ইংগিত থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, লূতের সম্প্রদায়ের অপরাধের
পেয়ালা তখন কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। যার ফলে হযরত ইবরাহীমের আ. মত সজাগ ও অভিজ্ঞ লোকের সামনে তার নাম উচ্চারণ
করার আদৌ প্রয়োজনই হয়নি। কাজেই শুধুমাত্র “একটি অপরাধী সম্প্রদায়” বলাই যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে।
﴿إِلَّا آلَ لُوطٍ إِنَّا
لَمُنَجُّوهُمْ أَجْمَعِينَ﴾
৫৯। শুধুমাত্র
লূতের পরিবারবর্গ এর অন্তরভুক্ত নয়। তাদের
সবাইকে আমরা বাঁচিয়ে নেবো,
﴿إِلَّا امْرَأَتَهُ قَدَّرْنَا
ۙ إِنَّهَا لَمِنَ الْغَابِرِينَ﴾
৬০। তার
স্ত্রী ছাড়া, যার জন্য
(আল্লাহ বলেনঃ) আমি স্থির করেছি, সে পেছনে অবস্থানকারীদের সাথে থাকবে।
﴿فَلَمَّا جَاءَ آلَ لُوطٍ
الْمُرْسَلُونَ﴾
৬১। প্রেরিতরা
যখন লূতের পরিবারের কাছে পৌঁছুলো৩৫
৩৫. তুলনামূলক পার্যালোচনার জন্য সূরা আল আ’রাফের ১০ রুকূ এবং সূরা হূদের ৭ রুকূ দেখুন।
﴿قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ مُّنكَرُونَ﴾
৬২। তখন সে
বললো, আপনারা
অপরিচিত মনে হচ্ছে।৩৬
৩৬. এখানে বক্তব্য সংক্ষেপ করা হয়েছে। সূরা হূদে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা
করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের আগমনে হযতর লূত আ.
অত্যন্ত ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর মন ভীষণভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাদেরকে দেখার সাথে সাথেই তিনি মনে মনে
বলতে থাকেন আজ বড় কঠিন সময় এসেছে। তাঁর এ ভয়ের কারণ হিসেবে কুরআনের
বর্ণনা থেকে যে ইংগিত এবং হাদীস থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, এ ফেরেশতারা অত্যন্ত সুশ্রী
কিশোরদের আকৃতি ধরে হযরত লূতের কাছে এসেছিলেন। এদিকে হযরত লূত আ. তাঁর সম্প্রদায়ের
লোকদের চারিত্রিক দুষ্কৃতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি আগত মেহমানদেরকে ফিরিয়ে দিতে
পারছিলেন না আবার নিজের সম্প্রদায়ের বদমায়েশদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করাও তাঁর
পক্ষে কঠিন ছিল। তাই
তিনি বড়ই পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন।
﴿قَالُوا بَلْ جِئْنَاكَ بِمَا
كَانُوا فِيهِ يَمْتَرُونَ﴾
৬৩। তারা জবাব
দিল, না, বরং আমরা তাই এনেছি যার আসার
ব্যাপারে এরা সন্দেহ করছিলো।
﴿وَأَتَيْنَاكَ بِالْحَقِّ
وَإِنَّا لَصَادِقُونَ﴾
৬৪। আমরা
তোমাকে যথার্থই বলছি, আমরা সত্য সহকারে তোমার কাছে এসেছি।
﴿فَأَسْرِ بِأَهْلِكَ بِقِطْعٍ
مِّنَ اللَّيْلِ وَاتَّبِعْ أَدْبَارَهُمْ وَلَا يَلْتَفِتْ مِنكُمْ أَحَدٌ وَامْضُوا
حَيْثُ تُؤْمَرُونَ﴾
৬৫। কাজেই এখন
তুমি কিছু রাত থাকতে নিজের পরিবারবর্গকে নিয়ে বের হয়ে যাও এবং তুমি তাদের পেছনে
পেছনে চলো।৩৭ তোমাদের কেউ যেন পেছন ফিরে না তাকায়।৩৮ ব্যাস, সোজা চলে যাও যেদিকে যাবার
জন্য তোমাদের হুকুম দেয়া হচ্ছে।
৩৭. অর্থাৎ নিজের পরিবারবর্গের পেছনে পেছনে এ জন্য চলো যেন
তাদের কেউ থেকে যেতে না পারে।
৩৮. এর মানে এ নয় যে, পেছন ফিরে তাকালেই তোমরা পাথর হয়ে যাবে, যেমন বাইবেলে বলা হয়েছে। বরং এর মানে হচ্ছে, পেছনের আওয়াজ শোর গোল শুনে তামাশ দেখার জন্য থেমে যেয়ো না। এটা তামাশ দেখার সময় নয়
এবং অপরাধী জাতির ধ্বংসক্রিয়া দেখে অশ্রুপাত করার সময়ও নয়। এক মুহূর্ত যদি তোমরা আযাব
প্রাপ্ত জাতির এলাকায় থেমে যাও তাহলে ধবংস–বৃষ্টির কিছুটা তোমাদের ওপরও
বর্ষিত হতে পারে এবং তাতে তোমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারো।
﴿وَقَضَيْنَا إِلَيْهِ ذَٰلِكَ
الْأَمْرَ أَنَّ دَابِرَ هَٰؤُلَاءِ مَقْطُوعٌ مُّصْبِحِينَ﴾
৬৬। আর তাকে
আমি এ ফায়সালা পৌঁছিয়ে দিলাম যে, সকাল হতে হতেই এদেরকে সমূলে ধ্বংস করে
দেয়া হবে।
﴿وَجَاءَ أَهْلُ الْمَدِينَةِ
يَسْتَبْشِرُونَ﴾
৬৭। ইত্যবসরে
নগরবাসীরা মহা উল্লাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে লূতের বাড়ি চড়াও হলো।৩৯
৩৯. এ থেকে এ জাতির ব্যভিচারবৃত্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল
তা অনুমান করা যেতে পারে। জনপদের
এক ব্যক্তির বাড়িতে কয়েকজন সুশ্রী অতিথি এসেছেন। ব্যাস, আর যায় কোথায় অমনি তার
বাড়িতে বিপুল সংখ্যক দুর্বৃত্ত চড়াও হয় এবং তা অতিথিদের কাছে প্রকাশ্যে দাবী
জানাতে থাকে যে তার অতিথিদেরকে দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দিতে হবে, যাতে তারা তাদের সাথে
ব্যভিচার করতে পারে। তাদের
সারা জনপদে তাদের এসব কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মত কেউ ছিল না। তাদের জাতির নৈতিক চেতনাও
খতম হয়ে গিয়েছিল। ফলে
লোকেরা প্রকাশ্যে এ ধরনের বাড়াবাড়ি করতে লজ্জাবোধ করতো না। হযরত লূতের আ. মত
পবিত্রাত্মা ও নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের গৃহে যখন বদমায়েশদের এমন নির্লজ্জ হামলা
হতে পারে তখন এ থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে, এসব জনবসতিতে সাধারণ
মানুষদের সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করা হতো।
তালমূদে এ জাতির যে অবস্থা লিখিত হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র এখানে তুলে
ধরছি। এ থেকে এ জাতিটি নৈতিক
অধোপতনের কোন প্রান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল তার কিছুটা বিস্তারিত সংবাদ জানা যাবে। তুলমূদে বলা হয়েছেঃ একবার আইলাম এলাকার একজন মুসাফির এ জাতিটির এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। পথে রাত হয়ে গেল। ফলে তাকে বাধ্য হয়ে তাদের
সামুদ নগরীতে অবস্থান করতে হলো। তার সাথে ছিল তার নিজের পাথেয়। কারোর কাছে সে অতিথি হবার আবেদন জানালো
না। সে একটি গাছের নীচে বসে
পড়লো কিন্তু একজন সামুদবাসী পীড়াপীড়ি করে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল। রাত্রে তাকে নিজের কাছে
রাখলো এবং প্রভাত হবার আগেই তার গাধাটি তার জীন ও বাণিজ্যিক মালপত্রসহ লোপাট করে
দিল। বিদেশী লোকটি শোরগোল করলো। কিন্তু কেউ তার ফরিয়াদ
শুনলো না। বরং জনবসতির লোকেরা তার
অন্যান্য মালপত্রও লুট করে নিয়ে তাকে বাইরে বের করে দিল।
একবার হযরত সারা হযরত লূতের পরিবারের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য নিজে গোলাম
ইলিয়াযিরকে সাদুমে পাঠালেন। ইলিয়াযির নগরীতে প্রবেশ করে দেখলেন, একজন সাদুমী একজন বিদেশীকে
মারছে। ইলিয়াযির সাদুমীকে বললো, তোমার লজ্জা হয় না তুমি একজন
অসহায় মুসাফিরের সাথে এ ব্যবহার করছো? কিন্তু জবাবে সর্বসমক্ষে
ইলিয়াযিরের মাথা ফাটিয়ে দেয়া হলো।
একবার এক গরীব লোক কোথাও থেকে তাদের শহরে এলো। কেউ তাকে খাবার দাবারের জন্য কিছু দিল
না। সে ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে এক
জায়গায় মাটিতে পড়েছিল। এ অবস্থায় হযরত লূতের আ. মেয়ে তাকে দেখতে পেলেন। তিনি তার কাছে খাবার পৌঁছে
দিলেন। এ জন্য হযরত লূত আ. ও তাঁর
মেয়েকে কঠোরভঅবে নিন্দা করা হলো এবং তাদেরকে এই বলে হুমকি দেয়া হলো যে, এ ধরনের কাজ করতে থাকলে
তোমরা আমাদের জনবসতিতে থাকতে পারবে না।
এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা বর্ণনা করার পর তালমূদ রচয়িতা লিখছেন, নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে এ
লোকেরা ছিল বড়ই জালেম, ধোঁকাবাজ এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে অসৎ। কোন মুসাফির তাদের এলাকা নিরাপদে
অতিক্রম করতে পারতো না। তাদের লোকালয় থেকে কোন গরীব ব্যক্তি এক টুকরো রুটি সংগ্রহ করতে পারতো না। বহুবার এমন দেখা গেছে
বাইরের কোন লোক তাদের এলাকায় প্রবেশ করে অনাহারে মারা গেছে এবং তারা তার গায়ের
পোশাক খুলে নিয়ে গিয়ে তার লাশকে উলংগ অবস্থায় দাফন করে দিয়েছে। বাইরের ব্যবসায়ীরা
দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে পৌঁছে গেলে সর্বসমক্ষে তাদের মালামাল লুট করে নেয়া হতো এবং
তাদের ফরিয়াদের জবাবে ঠাট্টা–বিদ্রূপ করা হতো। নিজেদের উপত্যকাকে তারা একটি উদ্যান
বানিয়ে রেখেছিল। মাইলের
পর মাইল ব্যাপী ছিল এ উদ্যান। একমাত্র লূত আ. ছাড়া তাদের এসব কাজের প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। এ সমগ্র কাহিনীকে সংক্ষেপ
করে কুরআন মজীদে শুধুমাত্র দু’টি বাক্য প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
وَمِن قَبْلُ كَانُوا
يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ
“তারা আগে থেকেই অনেক খারাপ
কাজ করে আসছিল।” (হূদঃ ৭৮)
أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ
ٱلرِّجَالَ وَتَقْطَعُونَ ٱلسَّبِيلَ وَتَأْتُونَ فِى نَادِيكُمُ ٱلْمُنكَرَ
“তোমরা পুরুষদের দ্বারা যৌন
কামনা পূর্ণ করো, মুসাফিরদের মালপত্র লুটপাট করো এবং নিজেদের মজলিসমূহের প্রকাশ্যে দুষ্কর্ম করো।” (আল আনকাবুতঃ ২৯)
﴿قَالَ إِنَّ هَٰؤُلَاءِ ضَيْفِي
فَلَا تَفْضَحُونِ﴾
৬৮। লূত বললো, ভাইয়েরা আমার! এরা হচ্ছে আমার
মেহমান, আমাকে
বে-ইজ্জত করো না।
﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا
تُخْزُونِ﴾
৬৯। আল্লাহকে
ভয় করো, আমাকে
লাঞ্ছিত করো না।
﴿قَالُوا أَوَلَمْ نَنْهَكَ
عَنِ الْعَالَمِينَ﴾
৭০। তারা বললো, আমরা না তোমাকে বারবার মানা
করেছি, সারা
দুনিয়ার ঠিকেদারী নিয়ো না?
﴿قَالَ هَٰؤُلَاءِ بَنَاتِي
إِن كُنتُمْ فَاعِلِينَ﴾
৭১। লূত লাচার
হয়ে বললো, যদি
তোমাদের একান্তই কিছু করতেই হয় তাহলে এই যে আমার মেয়েরা রয়েছে।৪০
৪০. সূরা হূদের ৮৭ টীকায় এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে কেবল এতটুকুন
ইংগিতেই যতেষ্ট যে, একথাগুলো একজন ভদ্রলোকের মুখ থেকে এমন সময় বের হয়েছে যখন তিনি একবারেই লাচার
হয়ে গিয়েছিলেন এবং বদমায়েশরা তাঁর কোন ফরিয়াদ ও আবেদন নিবেদনে কান না দিয়ে তার
মেহমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল।
এ সুযোগে একটি কথা পরিস্কার করে দেয়া প্রয়োজন। সূরা হূদে ঘটনাটি যে ধারাবহিকতার সাথে
বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, বদমায়েশদের এ হামলার সময়
পর্যন্তও হযরত লূত আ. একথা জানাতেন না যে, তাঁর মেহমানরা আসলে আল্লাহর ফেরেশতা। তখনো পর্যন্ত তিনি মনে করছিলেন, এ ছেলে কয়টি মুসাফির এবং এরা
তাঁর বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বদমায়েশদের দল যখনই মেহমানদের অবস্থান স্থলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং হযরত
লূত আ. অস্থির হয়ে বলে উঠলেনঃ
لَوْ أَنَّ لِى بِكُمْ
قُوَّةً أَوْ ءَاوِىٓ إِلَىٰ رُكْنٍۢ شَدِيدٍۢ
(হায়, যদি আমার তোমাদের মোকবিলা
করার শক্তি থাকতো অথবা আমার সাহায্য–সহযোগিতা গ্রহণ করার মতো কোন সহায়
থাকতো!) তখনই মেহমানরা নিজেদের ফেরেশতা হবার কথা প্রকাশ করলো। এরপর ফেরেশতারা তাঁকে বললো, এখন আপনি নিজের পরিবারবর্গকে
নিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যান এবং এদের সাথে বোঝাপড়া করার জন্য আমাদের ছেড়ে দেন। ঘটনাবলীর এ ধারাবহিকতা
সামনে রাখার পর কোন সংকটপূর্ণ অবস্থায় একেবারে লাচার হয়ে হযরত লূত আ. একথা
বলেছিলেন তা পুরোপুরি অনুমান করা যেতে পারে। ঘটনাগুলো যে ধারাবহিকতায় সংঘটিত হয়েছিল
এ সূরায় সেগুলো বর্ণনা করার সময় যেহেতু সেই ধারাবহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়নি বরং যে
বিশেষ দিকটি শ্রোতাদের মনে বদ্ধমূল করার জন্য এ কাহিনীটি এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে
সেটিকে বিশেষভাবে সুস্পষ্ট করাই এখানে কাম্য। তাই একজন সাধারণ পাঠক এ ভুল ধারণা পোষণ
করতে পারে যে, ফেরেশতারা শুরুতেই হযরত লূতের কাছে নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল এবং এখন নিজের
মেহমানদের ইজ্জত- আব্রু বাঁচাবার জন্য তাঁর এ সমস্ত ফরিয়াদ ও আবেদন নিবেদন নিছক
নাটুকেপনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
﴿لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي
سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ﴾
৭২। তোমার
জীবনের কসম হে নবী! সে সময় তারা যেন একটি নেশায় বিভোর হয়ে মাতালের মতো আচরণ করে
চলছিল।
﴿فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ
مُشْرِقِينَ﴾
৭৩। অবশেষে
প্রভাত হতেই একটি বিকট আওয়াজ তাদেরকে আঘাত করলো
﴿فَجَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا
وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِّن سِجِّيلٍ﴾
৭৪। এবং আমি
সেই জনপদটি ওলট পালট করে রেখে দিলাম আর তাদের ওপর পোড়া মাটির পাথর বর্ষণ করলাম।৪১
৪১. এ পোড়া মাটির পাথর বৃষ্টি হতে পারে উলকাপাত ধরনের কিছু। আবার আগ্নেয়গিরির
অগ্নুৎপাতের ফলে তা মৃত্তিকা গর্ভ থেকে বের হয়ে তাদের ওপর চতুরদিক থেকে বৃষ্টির মত
বর্ষিত হয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া একটি মারাত্মক ধরনের ঘূর্ণি ঝড়ও তাদের ওপর এ পাথর বৃষ্টি করতে পারে।
﴿إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ
لِّلْمُتَوَسِّمِينَ﴾
৭৫।
প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ লোকদের জন্য এ ঘটনার মধ্যে বিরাট নিদর্শন রয়েছে।
﴿وَإِنَّهَا لَبِسَبِيلٍ مُّقِيمٍ﴾
৭৬। সেই
এলাকাটি (যেখানে এটা ঘটেছিল) লোক চলাচলের পথের পাশে অবস্থিত।৪২
৪২. অর্থাৎ হেজায থেকে সিরিয়া এবং ইরাক থেকে মিসর যাবার পথে এই
ধবংসপ্রাপ্ত এলাকটি পড়ে। সাধারণত
বাণিজ্য যাত্রীদল এ ধ্বংসের নিদর্শনগুলো দেখে থাকে। আজো সমগ্র এলাকা জুড়ে এ ধবংসাবশেষগুলো
ছড়িয়ে আছে। এ এলাকাটির অবস্থান লূত
সাগরের (Dead sea) পূর্বে ও দক্ষিণে। বিশেষ করে এর দক্ষিণ অংশ
সম্পর্কে ভূগোলবিদগণের বর্ণনা হচ্ছে, এ এলাকাটি এত বেশী বিধ্বস্ত যার নজীর দুনিয়ার আর কোথাও পাওয়া যায় না।
﴿إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً
لِّلْمُؤْمِنِينَ﴾
৭৭। ঈমানদার
লোকদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষার বিষয় রয়েছে।
﴿وَإِن كَانَ أَصْحَابُ الْأَيْكَةِ
لَظَالِمِينَ﴾
৭৮। আর
আইকাবাসীরা৪৩ জালেম ছিল।
৪৩. অর্থাৎ হযরত শোআ’য়েবের আ. সম্প্রদায়ের লোক। এ সম্প্রদায়টির নাম ছিল
বনী মাদইয়ান। তাদের
এলাকার কেন্দ্রীয় শহরেরও নাম ছিল মাদইয়ান এবং সমগ্র এলাকটিকেও মাদইয়ান বলা হতো। আর “আইকা” ছিল তাবুকের প্রাচীন নাম। এ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ঘন জংগল। বর্তমানে একটি পাহাড়ী
ঝরণার নাম আইকা। এটি
জাবালে নূরে উৎপন্ন হয়ে আফাল উপত্যকায় এসে পড়ছে। (ব্যাখ্যার জন্য সূরা আশ শূআ’রার ১১৫ টীকা দেখুন)
﴿فَانتَقَمْنَا مِنْهُمْ وَإِنَّهُمَا
لَبِإِمَامٍ مُّبِينٍ﴾
৭৯। কাজেই
দেখে নাও আমিও তাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছি। আর এ উভয়
সম্প্রদায়ের বিরাণ এলাকা প্রকাশ্য পথের ধারে অবস্থিত।৪৪
৪৪. মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের এলাকাও হেজায থেকে ফিলিস্তিন ও
সিরিয়া যাবার পথে পড়ে।
﴿وَلَقَدْ كَذَّبَ أَصْحَابُ
الْحِجْرِ الْمُرْسَلِينَ﴾
৮০। হিজ্রবাসীরাও৪৫ রাসূলদের প্রতি মিথ্যা আরোপ
করেছিল।
৪৫. এটি ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় শহর। মদীনার উত্তর পশ্চিমে বর্তমান আলউ’লা
শহরের কয়েক মাইল দূরে এ শহরটির ধবংসাবশেষ পাওয়া যায়। মদীনা থেকে তাবুক যাবার সময় প্রধান
সড়কের ওপরই এ জায়গাটি পড়ে। এ উপত্যকাটির মধ্য দিয়ে কাফেলা এগিয়ে যায়। কিন্তু নবী সা. এর নির্দেশ অনুযায়ী কেউ
এখানে অবস্থান করে না। হিজরী আট শতকে পর্যটক ইবনে বতুতা হজ্জে যাবার পথে এখানে এসে পৌঁছেন। তিনি লেখেনঃ “এখানে লাল রংয়ের পাহাড়গুলোতে সামুদ জাতির ইরামতগুলো রয়েছে। এগুলো তারা পাহাড় কেটে
কেটে তার মধ্যে নির্মাণ করেছিল। এ গৃহগুলোর কারুকাজ এখনো এমন উজ্জ্বল ও তরতাজা আছে যেন মনে হয় আজই এগুলো
খোদাই করা হয়েছে। পচাগলা
মানুষের হাড় এখনো এখানকার ঘরগুলো মধ্যে পাওয়া যায়। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য সূরা আল আ’রাফের ৫৭ টীকা দেখুন)।
﴿وَآتَيْنَاهُمْ آيَاتِنَا
فَكَانُوا عَنْهَا مُعْرِضِينَ﴾
৮১। আমি তাদের
কাছে আমার নিদর্শন পাঠাই, নিশানী দেখাই কিন্তু তারা সবকিছু উপেক্ষা করতে থাকে।
﴿وَكَانُوا يَنْحِتُونَ مِنَ
الْجِبَالِ بُيُوتًا آمِنِينَ﴾
৮২। তারা
পাহাড় কেটে কেটে গৃহ নির্মাণ করতো এবং নিজেদের বাসস্থানে একেবারেই নিরাপদ ও
নিশ্চিন্ত ছিল।
﴿فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ
مُصْبِحِينَ﴾
৮৩। শেষ
পর্যন্ত প্রভাত হতেই একটি প্রচণ্ড বিষ্ফোরণ তাদেরকে আঘাত হানলো
﴿فَمَا أَغْنَىٰ عَنْهُم مَّا
كَانُوا يَكْسِبُونَ﴾
৮৪। এবং তাদের
উপার্জন তাদের কোনো কাজে লাগলো না।৪৬
৪৬. অর্থাৎ তারা পাহাড় কেটে কেটে তার মধ্যে যেসব আলীশান ইমারত
নির্মাণ করেছিল সেগুলো তাদেরকে কোন প্রকারে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি।
﴿وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ
وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ ۗ وَإِنَّ السَّاعَةَ لَآتِيَةٌ ۖ
فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيلَ﴾
৮৫। আমি
পৃথিবী ও আকাশকে এবং তাদের মধ্যকার সকল জিনিসকে সত্য ছাড়া অন্য কিছুর ভিত্তিতে
সৃষ্টি করিনি৪৭ এবং ফায়সালার সময় নিশ্চিতভাবেই আসবে। কাজেই হে
মুহাম্মাদ! (এ লোকদের আজেবাজে আচরণগুলোকে) ভদ্রভাবে উপেক্ষা করে যাও।
৪৭. নবী সা.কে সান্তনা দেবার জন্য একথা বলা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, বর্তমানে বাতিলের যে আপাত
পরাক্রম ও বিজয় তুমি দেখতে পাচ্ছো এবং হকের পথে যেসব সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি
তোমাকে হতে হচ্ছে এতে ভয় পেলে চলবে না। এটি একটি সাময়িক অবস্থা মাত্র। এ অবস্থা সবসময় এবং চিরকাল থাকবে না। কারণ পৃথিবী ও আকশের সমগ্র
ব্যবস্থা হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাতিলের ওপর নয়। বিশ্ব জাহানের প্রকৃতি
হকের সাথে সামঞ্জস্যশীল, বাতিলের সাথে নয়। কাজেই
এখানে যদি অবস্থান ও স্থায়িত্বের অবকাশ থাকে তাহলে তা আছে হকের জন্য, বাতিলের জন্য নয়।
﴿إِنَّ رَبَّكَ هُوَ الْخَلَّاقُ
الْعَلِيمُ﴾
৮৬।
নিশ্চিতভাবে তোমার রব সবার স্রষ্টা এবং সবকিছু জানেন।৪৮
৪৮. অর্থাৎ স্রষ্টা হিসেবে তিনি নিজের সৃষ্টির ওপর পূর্ণ
প্রভাব ও প্রতিপত্তির অধিকারী। তাঁর পাকড়াও থেকে আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা কোন সৃষ্টির নেই। আবার এর সংগে তিনি
পুরোপুরি সজাগ ও সচেতনও। তুমি এদের সংশোধনের জন্য যা কিছু করছো তাও তিনি জানেন এবং যেসব চক্রান্ত
দিয়ে এরা তোমার সংস্কার কার্যাবলীকে ধবংস করতে চাচ্ছে সেগুলো সম্পর্কেও তিনি অবগত। কাজেই তোমার ঘাবড়াবার এবং
অধৈর্য হাবার প্রয়োজন নেই। নিশ্চিন্ত থাকো। সময় হলে ন্যায্য ফায়সালা চুকিয়ে দেয়া হবে।
﴿وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا
مِّنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ﴾
৮৭। আমি
তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দিয়ে রেখেছি, যা বারবার আবৃত্তি করার মতো৪৯ এবং তোমাকে দান করেছি মহান
কুরআন।৫০
৪৯. অর্থাৎ সূরা আল ফাতিহার সাতটি আয়াত। যদিও কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন দু’শো
আয়াত বিশিষ্ট সাতটি বড় বড় সূরা। অর্থাৎ আল বাকারাহ, আলে ইমরান, আন নিসা, আল মায়িদাহ, আল আনআ’ম, আল আ’রাফ
ও ইউনুস অথবা আল আনফাল ও আত তাওবাহ। কিন্তু পূর্ববর্তী আলেমগণের অধিকাংশই এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে সূরা আল ফাতিহার কথাই
বলা হয়েছে। বরং খোদ নবী সা. সাতটি
বারবার আবৃত্তি করার মত সূরা বলে যে সূরা আল ফাতিহার দিকে ইংগিত করেছেন এর প্রামণ
স্বরূপ ইমাম বুখারী দু’টি “মরফূ” হাদীসও বর্ণনা
করেছেন।
৫০. একথাটিও নবী সা. এবং তাঁর সাথীদেরকে সান্তনা দেবার জন্য
বলা হয়েছে। তখন এমন একটা সময় ছিল যখন
নবী সা. এবং তাঁর সাথীরা সবাই চরম দুরবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছিলেন। নবুওয়াতের গুরু দায়িত্বভার
কাঁধে তুলে নিবার সাথে সাথেই নবী কারীমের সা. সব সম্পদও খরচ হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে কিছু
উঠতি যুবক ছিলেন। তাদেরকে
অভিভাবকরা ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। কতক ছিলেন ব্যবসায়ী ও কারিগর। অনবরত অর্থনৈতিক বয়কটের
আঘাতে তাদের কাজ কারবার একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর কতক দুর্ভাগ্য পীড়িত আগেই ছিলেন দাস
বা মুক্ত দাস শ্রেণীভুক্ত। তাদের কোন অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডই ছিল না। এরপর দুর্ভাগ্যের ওপর দুর্ভাগ্য হচ্ছে
এই যে, নবী সা. সহ সমস্ত মুসলমান মক্কা ও তার চারপাশের পল্লীগুলোতে চরম নির্যাতিতের
জীবন যাপন করছিলেন। তারা ছিলেন সবদিক থেকে
নিন্দিত ও ধিক্কৃত। সব জায়গায় তাঁরা লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও হাসি–তামাশার খোরাক হয়েছিলেন। এই সংগে মানসিক ও আত্মিক মর্মজ্বালার
সাথে সাথে তারা দৈহিক নিপীড়নের হাত থেকে ও রেহাই পাননি। অন্যদিকে কুরাইশ সরদাররা
পার্থিব অর্থ–সম্পদের ক্ষেত্রে সবরকমের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের অধিকারী ছল। এ অবস্থায় বলা হচ্ছে, তোমার মন হতাশাগ্রস্ত কেন? তোমাকে আমি এমন সম্পদ দান করেছি যার তুলনায় দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ তুচ্ছ। তোমার এ জ্ঞানগত ও নৈতিক
সম্পদ ঈর্ষার যোগ্য, ওদের বস্তুগত সম্পদ নয়। ওরা তো নানা হারাম উপায়ে এ সম্পদ আহরণ করছে এবং নানাবিধ হারাম পথে এ
উপার্জিত সম্পদ নষ্ট করছে। শেষ পর্যন্ত ওরা একদম কপর্দক শূন্য ও কাংগাল হয়ে নিজেদের রবের সামনে হাজির
হবে।
﴿لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ
إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ
جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ﴾
৮৮। আমি তাদের
মধ্য থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের দুনিয়ার যে সম্পদ দিয়েছি সেদিকে তুমি চোখ উঠিয়ে
দেখো না এবং তাদের অবস্থা দেখে মুনঃক্ষুন্নও হয়ো না।৫১ তাদেরকে বাদ দিয়ে মুমিনদের
প্রতি ঘনিষ্ঠ হও
৫১. অর্থাৎ তারা যে নিজেদের কল্যাণকামীকে নিজেদের শত্রু মনে
করছে, নিজেদের ভ্রষ্টতা ও নৈতিক ত্রুটিগুলোকে নিজেদের গুণাবলী মনে করছে, নিজেরা এমন পথে এগিয়ে চলছে
এবং নিজেদের সমগ্র জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যার নিশ্চিত পরিণাম ধবংস এবং যে
ব্যক্তি তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ দেখাচ্ছে তার সংস্কার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ
করার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম চালাচ্ছে, তাদের এ অবস্থা দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না।
﴿وَقُلْ إِنِّي أَنَا النَّذِيرُ
الْمُبِينُ﴾
৮৯। এবং
(অমান্যকারীদেরকে) বলে দাও-আমিতো প্রকাশ্য সতর্ককারী।
﴿كَمَا أَنزَلْنَا عَلَى الْمُقْتَسِمِينَ﴾
৯০। এটা ঠিক
তেমনি ধরনের সতর্কীকরণ যেমন সেই বিভক্তকারীদের দিকে আমি পাঠিয়েছিলাম
﴿الَّذِينَ جَعَلُوا الْقُرْآنَ
عِضِينَ﴾
৯১। যারা
নিজেদের কুরআনকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে।৫২
৫২. সেই বিভক্তকারী দল বলতে এখানে ইহুদীদেরকে বুঝানো হয়েছে। তাদেরকে বিভক্তকারী এ
অর্থে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর দীনকে বিভক্তকরে ফেলেছে। তার কিছু কথা মেনে নিয়েছে এবং কিছু কথা
মেনে নেয়নি। এ ছাড়া তার মধ্যে বিভিন্ন
প্রকার কাটছাঁট ও পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে অসংখ্য ফেরকার জন্ম দিয়েছে। তাদের ‘কুরআন’ বলতে তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। এ কিতাবটি তাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে দেওয়া
হয়েছিল যেমন উম্মতে মুহাম্মাদীয়াকে কুরআন দেয়া হয়। আর এ কুরআনকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলার
কথা বলে ঠিক এমন ধরনের একটি কর্মের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যেমন সূরা আল বাকারাহ-এর
৮৫ আয়াতে বলা হয়েছেঃ
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ
الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ
তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের কিছু কথা মেনে নেবে এবং কিছু কথা অস্বীকার করবে?
তারপর যে কথা বলা হয়েছে যে, তোমাদেরকে আজ এই যে সতর্ক করা হচ্ছে এটা ঠিক তেমনি ধরনের সতর্কীকরণ যেমন
ইতিপূর্বে ইহুদীদেরকে করা হয়েছিল, —– মূলত ইহুদীদের অবস্থা সংকেত থেকে গাফেল থাকার ফলে যে
পরিণামের সম্মুখীন হয়েছে তা তোমাদের চোখের সামনে রয়েছে। এখন ভেবে দেখো, তোমরাও কি এই একই পরিণাম
দেখতে চাও?
﴿فَوَرَبِّكَ لَنَسْأَلَنَّهُمْ
أَجْمَعِينَ﴾
৯২। তোমার
রবের কসম, আমি অবশ্যি
তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করবো,
﴿عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
৯৩। তোমরা কি
কাজে নিয়োজিত ছিলে?
﴿فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ
وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ﴾
৯৪। কাজেই হে
নবী! তোমাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হচ্ছে তা সরবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করো এবং
শিরককারীদের মোটেই পরোয়া করো না।
﴿إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ﴾
৯৫। যেসব
বিদ্রূপকারী আল্লাহর সাথে অন্য কাউকেও ইলাহ বলে গণ্য করে
﴿الَّذِينَ يَجْعَلُونَ مَعَ
اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۚ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ﴾
৯৬। তোমাদের
পক্ষ থেকে তাদের ব্যবস্থা করার জন্য আমিই যথেষ্ট। শীঘ্রই
তারা জানতে পারবে।
﴿وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ
يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ﴾
৯৭। আমি জানি, এরা তোমার সম্বন্ধে যেসব কথা
বানিয়ে বলে তাতে তুমি মনে ভীষণ ব্যথা পাও।
﴿فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ
وَكُن مِّنَ السَّاجِدِينَ﴾
৯৮। এর
প্রতিকার এই যে, তুমি নিজের
রবের প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করতে থাকো, তাঁর সকাশে সিজ্দাবনত হও
﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ
يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ﴾
৯৯। এবং যে
চূড়ান্ত সময়টি আসা অবধারিত সেই সময় পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগী করে যেতে থাকো।৫৩
৫৩. অর্থাৎ সত্যের বাণী প্রচার এবং সংস্কার প্রচেষ্টা চালাবার
ক্ষেত্রে তোমাকে অশেষ কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এগুলোর মোকাবিলা করার শক্তি তুমি
একমাত্র নামায ও আল্লাহর বন্দেগী করার ক্ষেত্রে অবিচল দৃঢ়তার পথ অবলম্বন করার
মাধ্যমেই অর্জন করতে পারো। এ জিনিসটি তোমার মনকে প্রশান্তিতে ভরে তুলবে, তোমার মধ্যে ধৈর্য ও
সহিষ্ণুতার জন্ম দেবে, তোমার সাহস ও হিম্মত বাড়িয়ে দেবে এবং তোমাকে এমন যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলবে
যার ফলে সারা দুনিয়ার মানুষের গালিগালাজ নিন্দাবাদ ও প্রতিরোধের মুখে তুমি দৃঢ়ভাবে
এমন দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকবে যার মধ্যে তোমার রবের রেজামন্দি রয়েছে।
— সমাপ্ত —