তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ فَاطِرِ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ جَاعِلِ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةِ رُسُلًا أُو۟لِىٓ أَجْنِحَةٍۢ مَّثْنَىٰ وَثُلَـٰثَ وَرُبَـٰعَ ۚ يَزِيدُ فِى ٱلْخَلْقِ مَا يَشَآءُ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرٌۭ﴾
১। প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা এবং ফেরেশতাদেরকে বাণীবাহক নিয়োগকারী১ (এমন সব ফেরেশতা) যাদের দুই দুই তিন তিন ও চার চারটি ডানা আছে।২ নিজের সৃষ্টির কাঠামোয় তিনি যেমনটি চান বৃদ্ধি করেন।৩ নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিমান।
১. এর অর্থ এও হতে পারে যে, ফেরেশতারা মহান আল্লাহ ও আম্বিয়া আ. এর মধ্যে বার্তা পৌঁছাবার কাজ করেন আবার এ অর্থও হতে পারে যে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানে মহাশক্তির অধিকারী আল্লাহর বিধান নিয়ে যাওয়া এবং সেগুলো প্রবর্তন করা এ ফেরেশতাদেরই কাজ। একথা উল্লেখ করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, এ ফেরেশতাদেরকে মুশরিকরা দেব-দেবীতে পরিণত করেছিল অথচ এদের মর্যাদা এক ও লা-শরীক আল্লাহর একান্ত অনুগত খাদেমের চেয়ে মোটেই বেশী কিছু নয়। একজন বাদশাহর খাদেমরা যেমন তাঁর হুকুম তামিল করার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে থাকে ঠিক তেমনি এ ফেরেশতারাও বিশ্ব-জাহানের প্রকৃত শাসনকর্তার হুকুম পালন করার জন্যও উড়ে চলতে থাকেন। এ খাদেমদের কোন ক্ষমতা নেই। সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে আসল শাসনকর্তার হাতে।
২. এ ফেরেশতাদের হাত ও ডানার অবস্থা ও ধরন জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে নেই। কিন্তু এ অবস্থা ও ধরন বর্ণনা করার জন্য আল্লাহ যখন এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা মানুষের ভাষায় পাখিদের হাত ও ডানার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে তখন অবশ্যই আমাদের ভাষার এ শব্দকেই আসল অবস্থা ও ধরন বর্ণনার নিকটতর বলে ধারণা করা যেতে পারে। দুই দুই, তিন তিন ও চার চার ডানার কথা বলা থেকে বুঝা যায় যে, বিভিন্ন ফেরেশতাকে আল্লাহ বিভিন্ন পর্যায়ের শক্তি দান করেছেন এবং যাকে দিয়ে যেমন কাজ করাতে চান তাকে ঠিক তেমনই দ্রুতগতি ও কর্মশক্তি দান করেছেন।
৩. এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ফেরেশতাদের ডানার সংখ্যা চারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং কোন কোন ফেরেশতাকে আল্লাহ এর চেয়েও বেশী ডানা দিয়েছেন। হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের রা. বর্ণনায় বলা হয়েছে নবী কারীম সা.একবার জিব্রাঈল আ. কে এমন অবস্থায় দেখেন যখন তাঁর ডানার সংখ্যা ছিল ছ’শো। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী) হযরত আয়েশা রা. বলেন, নবী কারীম সা.দু’বার জিব্রাঈলকে তাঁর আসল চেহারায় দেখেন। তখন তাঁর ছ’শো ডানা ছিল এবং তিনি সারা আকাশে ছেয়ে ছিলেন। (তিরমিযী)
﴿مَّا يَفْتَحِ ٱللَّهُ لِلنَّاسِ مِن رَّحْمَةٍۢ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا ۖ وَمَا يُمْسِكْ فَلَا مُرْسِلَ لَهُۥ مِنۢ بَعْدِهِۦ ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ﴾
২। আল্লাহ যে রহমতের দরজা মানুষের জন্য খুলে দেন তা রুদ্ধ করার কেউ নেই এবং যা তিনি রুদ্ধ করে দেন তা আল্লাহর পরে আর কেউ খোলার নেই।৪ তিনি পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।৫
৪. মুশরিকরা যে মনে করে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেউ তাদের রিযিকদাতা, কেউ সন্তানদাতা এবং কেউ রোগ নিরাময়কারী, তাদের এ ভুল ধারণা দূর করাও এর উদ্দেশ্য। শিরকের এ সমস্ত ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন এবং নির্ভেজাল সত্য শুধুমাত্র এতটুকু যে, বান্দাদের কাছে যে ধরনের রহমতই আসে নিছক মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহর অনুগ্রহেই আসে। অন্য কারো এ রহমত দান করার ক্ষমতাও নেই এবং একে রোধ করার শক্তিও কারো নেই। এ বিষয়টি কুরআন মজীদ ও হাদীসের বহু স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে মানুষ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াবার এবং সবার কাছে হাত পাতার গ্লানি থেকে রেহাই পাবে। এই সঙ্গে সে এ বিষয়টিও ভালোভাবে বুঝে নেবে যে, তার ভাগ্য ভাংগা গড়া এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইখতিয়ারে নেই।
৫. পরাক্রমশালী অর্থাৎ সবার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী ও পূর্ণ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তাঁর সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করার পথে কেউ বাঁধা দিতে পারে না। আবার এই সঙ্গে তিনি জ্ঞানীও। যে ফায়সালাই তিনি করেন পুরোপুরি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতেই করেন। কাউকে দিলে সেটিই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দাবী বলেই দেন এবং কাউকে না দিলে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দাবী বলেই দেন না।
﴿يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ ۚ هَلْ مِنْ خَـٰلِقٍ غَيْرُ ٱللَّهِ يَرْزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ ۚ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ فَأَنَّىٰ تُؤْفَكُونَ﴾
৩। হে লোকেরা! তোমাদের প্রতি আল্লাহর যেসব অনুগ্রহ রয়েছে সেগুলো স্মরণ করো। ৬ আল্লাহ ছাড়া কি আর কোন স্রষ্টা আছে, যে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তোমরা কোথা থেকে প্রতারিত হচ্ছো?৭
৬. অর্থাৎ অকৃতজ্ঞ ও নিমকহারাম হয়ো না। তোমরা যা কিছু লাভ করেছো তা আল্লাহরই দেয়া, এ সত্যটি ভুলে যেয়ো না। অন্য কথায় এ বাক্যটি এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছে যে, যে ব্যক্তিই আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী ও পূজা-উপাসনা করে অথবা কোন নিয়ামতকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তার দান মনে করে কিংবা কোন নিয়ামত লাভ করার জন্য আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অথবা কোন নিয়ামত চাওয়ার জন্য আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে দোয়া করে সে বড়ই অকৃতজ্ঞ।
৭. প্রথম বাক্যাংশ ও দ্বিতীয় বাক্যাংশের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ফাঁক রয়েছে। কথার স্থান ও কাল নিজেই এ ফাঁক ভরে দিচ্ছে। একথা অনুবাধন করার জন্য কল্পনার চোখের সামনে একটি চিত্র মেলে ধরুন। অর্থাৎ মুশরিকদের সামনে বক্তৃতা চলছে। বক্তা শ্রোতাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহ ছাড়া কি আর কোন স্রষ্টা আছে, যে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছে এবং পৃথিবী ও আকাশ থেকে তোমাদের জীবিকা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে? এ প্রশ্ন করে বক্তা কয়েক মুহূর্ত জবাবের অপেক্ষা করেন। কিন্তু দেখেন সমাবেশের সমগ্র জনতা নিরব। কেউ বলে না, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জীবিকা দানকারী ও স্রষ্টাও আছে। এ থেকে আপনা আপনিই এ ফল প্রকাশিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন স্রষ্টা ও রিযিকদাতা নেই, শ্রোতাগণও একথা পুরোপুরি স্বীকার করে। এরপরই বক্তা বলেন, তাহলে তিনি ছাড়া আর কেউ মাবুদও হতে পারে না। তোমরা কেমন করে এ প্রতারণার শিকার হলে যে, স্রষ্টা ও রিযিকদাতা হবেন তো একমাত্র আল্লাহ কিন্তু মাবুদ হবেন তিনি ছাড়া অন্য কেউ?
﴿وَإِن يُكَذِّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌۭ مِّن قَبْلِكَ ۚ وَإِلَى ٱللَّهِ تُرْجَعُ ٱلْأُمُورُ﴾
৪। এখন যদি (হে নবী!) এরা তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে থাকে৮ (তাহলে এটা কোন নতুন কথা নয়) তোমার পূর্বেও বহু রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপিত হয়েছে এবং সমস্ত বিষয় শেষ পর্যন্ত আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।৯
৮. অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইবাদাত লাভের অধিকারী নেই, তোমার একথা মানে না এবং তুমি নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করছো, এ অভিযোগ তোমার বিরুদ্ধে আনে।
৯. অর্থাৎ ফায়সালা লোকদের হাতে নেই। তারা যাকে মিথ্যুক বলবে সে যথার্থই মিথ্যাবাদী হয়ে যাবে না। ফায়সালা তো রয়েছে আল্লাহরই হাতে। মিথ্যুক কে ছিল তা তিনি শেষ পর্যন্ত জানিয়ে দেবেন এবং প্রকৃতই যে মিথ্যুক তার পরিণতিও দেখিয়ে দেবেন।
﴿يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّ وَعْدَ ٱللَّهِ حَقٌّۭ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَا ۖ وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِٱللَّهِ ٱلْغَرُورُ﴾
৫। হে লোকেরা! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি নিশ্চিতভাবেই সত্য,১০ কাজেই দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে ১১ এবং সেই বড় প্রতারক যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকা দিতে না পারে।১২
১০. প্রতিশ্রুতি বলতে আখেরাতের প্রতিশ্রুতি বুঝানো হয়েছে যেদিকে ওপরের এ বাক্য ইঙ্গিত করে বলা হয়েছিল যে, সমস্ত বিষয় শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সামনে উপস্থাপিত হবে।
১১. অর্থাৎ এ দুনিয়াই সবকিছু এবং এরপর আর কোন আখেরাত নেই যেখানে কৃতকর্মের হিসেব নেয়া হবে, এ প্রতারণা জালে আবদ্ধ না করে। অথবা এভাবে প্রতারিত না করে যে, যদি কোন আখেরাত থেকেও থাকে, তাহলে যে ব্যক্তি এ দুনিয়ায় আরাম আয়েশে জীবন যাপন করেছে সে সেখানেও আরাম আয়েশ করবে।
১২. “বড় প্রতারক” এখানে হচ্ছে শয়তান যেমন সামনের বাক্য বলছে। আর “আল্লাহর ব্যাপারে” ধোঁকা দেয়ার মানে হচ্ছে, শয়তান লোকদেরকে একথা বুঝায় যে, আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই এবং কিছু লোককে এ বিভ্রান্তির শিকার করে যে, আল্লাহ একবার দুনিয়াটা চালিয়ে দিয়ে তারপর বসে আরাম করছেন, এখন তাঁর সৃষ্ট এ বিশ্ব-জাহানের সাথে কার্যত তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। আবার কিছু লোককে সে এভাবে ধোঁকা দেয় যে আল্লাহ অবশ্যই এ বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা করে যাচ্ছেন কিন্তু তিনি মানুষকে পথ দেখাবার কোন দায়িত্ব নেননি। কাজেই এ অহী ও রিসালাত নিছক একটি ধোঁকাবাজী ছাড়া আর কিছুই নয়। সে কিছু লোককে এ মিথ্যা আশ্বাসও দিয়ে চলছে যে, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান, তোমরা যতই গোনাহ কর না কেন তিনি সব মাফ করে দেবেন এবং তাঁর এমন কিছু পিয়ারা বান্দা আছে যাদেরকে আঁকড়ে ধরলেই তোমরা কামিয়াব হয়ে যাবে।
﴿إِنَّ ٱلشَّيْطَـٰنَ لَكُمْ عَدُوٌّۭ فَٱتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُوا۟ حِزْبَهُۥ لِيَكُونُوا۟ مِنْ أَصْحَـٰبِ ٱلسَّعِيرِ﴾
৬। আসলে শয়তান তোমাদের শত্রু, তাই তোমরাও তাকে নিজেদের শত্রুই মনে করো। সে তো নিজের অনুসারীদেরকে নিজের পথে এজন্য ডাকছে যাতে তারা দোজখীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
﴿ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ لَهُمْ عَذَابٌۭ شَدِيدٌۭ ۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَهُم مَّغْفِرَةٌۭ وَأَجْرٌۭ كَبِيرٌ﴾
৭। যারা কুফরী করবে১৩ তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি আর যারা ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত ও বড় পুরস্কার।১৪
১৩. অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের এ দাওয়াত মেনে নিতে অস্বীকার করবে।
১৪. অর্থাৎ তাদের ভুল-ভ্রান্তি ও অপরাধ মাফ করে দেবেন এবং তারা যেসব সৎকাজ করবে সেগুলোর কেবল সমান সমান প্রতিদান দেবেন না বরং বড় ও বিপুল প্রতিদান দেবেন।
﴿أَفَمَن زُيِّنَ لَهُۥ سُوٓءُ عَمَلِهِۦ فَرَءَاهُ حَسَنًۭا ۖ فَإِنَّ ٱللَّهَ يُضِلُّ مَن يَشَآءُ وَيَهْدِى مَن يَشَآءُ ۖ فَلَا تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَٰتٍ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌۢ بِمَا يَصْنَعُونَ﴾
৮। (এমন১৫ ব্যক্তির বিভ্রান্তির কোন শেষ আছে কি) যার জন্য তার খারাপ কাজকে শোভন করে দেয়া হয়েছে এবং সে তাকে ভালো মনে করছে?১৬ আসলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্তিতে লিপ্ত করেন এবং যাকে চান সঠিক পথ দেখিয়ে দেন। কাজেই (হে নবী!) অযথা ওদের জন্য দুঃখে ও শোকে তুমি প্রাণপাত করো না।১৭ ওরা যা কিছু করছে আল্লাহ তা ভালোভাবে জানেন।১৮
১৫. ওপরের দু’টি প্যারাগ্রাফ সাধারণ জনগণকে সম্বোধন করে বলা হয়েছিল। এখন এ প্যারাগ্রাফে যেসব বিভ্রান্তির নায়করা নবী কারীম সা.এর দাওয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল তাদের কথা বলা হচ্ছে।
১৬. অর্থাৎ এমন এক ধরনের বিভ্রান্ত ও দুস্কৃতকারী লোক আছে যে খারাপ কাজ করে ঠিকই কিন্তু সে জানে এবং স্বীকার করে যে সে যা কিছু করছে খারাপই করছে। এ ধরনের লোককে বুঝালেও ঠিক হয়ে যেতে পারে এবং কখনো নিজের বিবেকের তাড়নায়ও সে সঠিক পথে চলে আসতে পারে। কারণ তার শুধুমাত্র অভ্যাসই বিগড়েছে, মন-মানসিকতা বিগড়ে যায়নি। কিন্তু আর এক ধরনের দুস্কৃতকারী আছে, যার মন-মানসিকতাই বিগড়ে গেছে। তার ভালো-মন্দের পার্থক্যবোধই খতম হয়ে গেছে। গোনাহের জীবন তার কাছে প্রিয় ও গৌরবময়। সৎকাজকে সে ঘৃনা করে এবং অসৎকাজকে যথার্থ সভ্যতা ও সংস্কৃতি মনে করে। সৎবৃত্তি ও তাকওয়াকে সে প্রাচীনত্ব এবং আল্লাহর হুকুম অমান্য করা ও অশ্লীল কাজ করাকে প্রগতিশীলতা মনে করে। তার দৃষ্টিতে হিদায়াত গোমরাহীতে এবং গোমরাহ হিদায়াতে পরিণত হয়। এ ধরনের লোকের ওপর কোন উপদেশ কার্যকর হয় না। সে নিজের নির্বুদ্ধিতার ওপর নিজেই সতর্ক হয় না এবং কেউ তাকে বোঝালেও বোঝে না। এ ধরনের লোকের পেছনে লেগে থাকা অর্থহীন। তাকে সৎপথে আনার চিন্তায় প্রাণপাত না করে সত্যের আহবায়ককে এমন সব লোকের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন যাদের বিবেক এখনো বেঁচে আছে এবং যারা সত্যের আহবানের জন্য নিজেদের মনের দুয়ার বন্ধ করে দেয়নি।
১৭. আগের বাক্য এবং এ বাক্যের মাঝখানে “আল্লাহ যাকে চান গোমরাহীতে লিপ্ত করেন এবং যাকে চান সঠিক পথ দেখান”–একথা বলা পরিষ্কারভাবে এ অর্থই প্রকাশ করছে যে, যারা এতদূর মানবিক বিকৃতির শিকার হয় আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন এবং পথহারা হয়ে এমন সব পথে ঘুরে বেড়াবার জন্য তাদেরকে ছেড়ে দেন যেসব ভুল পথে ঘুরে বেড়ানোর জন্য তারা নিজেরাই জিদ ধরে। এ সত্যটি বুঝিয়ে দেবার পর মহান আল্লাহ নবী কারীম সা.কে বলেন এ ধরনের লোকদেরকে সঠিক পথে আনার সামর্থ্য তোমার নেই কাজেই তাদের ব্যাপারে সবর করো এবং আল্লাহ যেমন তাদের পরোয়া করছেন না তেমনি তোমরাও তাদের অবস্থা দেখে দুঃখিত ও শোকাভিভূত হয়ো না।
এক্ষেত্রে দু’টি কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। একঃ এখানে যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা সাধারণ লোক ছিল না। তারা ছিল মক্কা মুআ’যযমার সরদার। তারা নবী কারীম সা.এর দাওয়াতকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য সব রকমের মিথ্যা প্রতারণা ও ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিয়ে চলছিল। তারা আসলে নবী কারীম সা.সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা করতো না। তিনি কিসের দিকে দাওয়াত দিচ্ছেন এবং তাঁর মোকাবিলায় তারা নিজেরা কোন ধরনের মূর্খতা ও নৈতিক দুষ্কৃতির প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট রয়েছে তা তারা ভালোভাবে জানতো। এসব কিছু জানার ও বুঝার পর ঠাণ্ডা মাথায় তাদের সিদ্ধান্ত এই ছিল যে, মুহাম্মাদ সা.এর কথা চলতে দেয়া যাবে না। এ উদ্দেশ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অস্ত্র এবং সবচেয়ে হীন হাতিয়ার ব্যবহার করতে তারা একটুও কুন্ঠিত ছিল না। এখন একথা সুস্পষ্ট, যারা জেনে বুঝে এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে প্রতিদিন একটি নতুন মিথ্যা রচনা করে এবং কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তা ছড়িয়ে বেড়ায় তারা সারা দুনিয়ার মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে কিন্তু নিজেকে তো তারা মিথ্যুক বলে জানে এবং তাদের নিজেদের কাছে একথা গোপন থাকে না যে, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে তারাএকটি অপবাদ দিয়েছে সে তা থেকে মুক্ত। তারপর যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ মিথ্যা হাতিয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে সে যদি এর জবাবে কখনো সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে সরে গিয়ে কোন কথা না বলে তাহলে এ জালেমদের কাছেও একথা কখনো গোপন থাকতে পারে না যে, তাদের মোকাবিলায় যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন সত্যবাদী ও নিখাদ পুরুষ। এরপরও নিজেদের কৃতকর্মের জন্য যারা এতটুকু লজ্জিত হয় না এবং অনবরত মিথ্যার মাধ্যমে সত্যের মোকাবিলা করে যেতে থাকে, তাদের এ নীতি নিজেই একথার সাক্ষ্য বহন করে যে, আল্লাহর লানত তাদের ওপর পড়েছে এবং ভালোমন্দের কোন পার্থক্য বোধ তাদের মধ্যে নেই।
দ্বিতীয় যে কথাটি এ প্রসঙ্গে বুঝে নিতে হবে সেটি হচ্ছে এই যে, নিছক স্বীয় রাসূল পাককে কাফেরদের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করানোই যদি আল্লাহর লক্ষ্য হতো, তাহলে তিনি গোপনে কেবলমাত্র তাঁকেই একথা বুঝাতে পারতেন। এ উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে সুস্পষ্ট অহীর মাধ্যমে তার উল্লেখের প্রয়োজন ছিল না। কুরআন মজীদে একথা বর্ণনা করবার এবং সারা দুনিয়ার মানুষকে তা শুনিয়ে দেবার উদ্দেশ্যই ছিল আসলে সাধারণ মানুষকে এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া যে, যেসব নেতার পেছনে তোমরা চোখ বন্ধ করে ছুটে চলছো তারা কতখানি বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোক এবং তাদের বেহুদা কাজকর্ম কেমন চিৎকার করে করে বলছে যে, তাদের ওপর আল্লাহর লানত পড়েছে।
১৮. আলোচ্য বাক্যটির মধ্যে এ স্বতস্ফূর্ত হুমকি প্রচ্ছন্ন রয়েছে যে, এমন একটি সময় আসবে যখন আল্লাহ তাদেরকে এসব কৃতকর্মের শাস্তি দেবেন। কোন শাসক যখন কোন অপরাধী সম্পর্কে বলেন, তার কাজ কর্মের আমি সব খবর রাখি তখন তার অর্থ কেবল এতটুকুই হয় না যে, শাসক তার কাজকর্ম সব জানেন বরং তার মধ্যে এ সতর্কবাণীও নিহিত থাকে যে, আমি তাকে শাস্তি দেবোই।
﴿وَٱللَّهُ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ ٱلرِّيَـٰحَ فَتُثِيرُ سَحَابًۭا فَسُقْنَـٰهُ إِلَىٰ بَلَدٍۢ مَّيِّتٍۢ فَأَحْيَيْنَا بِهِ ٱلْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ۚ كَذَٰلِكَ ٱلنُّشُورُ﴾
৯। আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করেন তারপর তা মেঘমালা উঠায় এরপর আমি তাকে নিয়ে যাই একটি জনমানবহীন এলাকার দিকে এবং মৃত পতিত যমীনকে সঞ্জীবিত করে তুলি। মৃত মানুষদের বেঁচে ওঠাও তেমনি ধরনের হবে।১৯
১৯. অর্থাৎ এ মূর্খের দল আখেরাতকে অসম্ভব মনে করছে। তাই তারা নিজস্বভাবে এ চিন্তায় নিমগ্ন হয়েছে যে, দুনিয়ায় তারা যাই কিছু করতে থাকুক না কেন, তাদের জবাবদিহি করার জন্য আল্লাহর সামনে হাজির হবার সময়টি কখনো আসবে না। কিন্তু তারা যার মধ্যে নিমগ্ন আছে সেটি নিছক একটি খামখেয়ালি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিয়ামতের দিন সামনের পেছনের সমস্ত মরা মানুষ মহান আল্লাহর একটিমাত্র ইশারায় সহসা ঠিক তেমনিভাবে জীবিত হয়ে উঠবে যেমন একবার বৃষ্টি হবার পর শুকনো জমি অকস্মাৎ সবুজ শ্যামল হয়ে ওঠে এবং দীর্ঘকালের মৃত শিকড়গুলো সবুজ চারাগাছে রূপান্তরিত হয়ে মাটির বুক থেকে মাথা উঁচু করতে থাকে।
﴿مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلْعِزَّةَ فَلِلَّهِ ٱلْعِزَّةُ جَمِيعًا ۚ إِلَيْهِ يَصْعَدُ ٱلْكَلِمُ ٱلطَّيِّبُ وَٱلْعَمَلُ ٱلصَّـٰلِحُ يَرْفَعُهُۥ ۚ وَٱلَّذِينَ يَمْكُرُونَ ٱلسَّيِّـَٔاتِ لَهُمْ عَذَابٌۭ شَدِيدٌۭ ۖ وَمَكْرُ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُوَ يَبُورُ﴾
১০। যে সম্মান চায় তার জানা উচিত সমস্ত সম্মান একমাত্র আল্লাহরই।২০ তাঁর কাছে শুধুমাত্র পবিত্র কথাই ওপরের দিকে আরোহণ করে এবং সৎকাজ তাকে ওপরে ওঠায়।২১ আর যারা অনর্থক চালবাজী করে২২ তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি এবং তাদের চালবাজী নিজেই ধ্বংস হবে।
২০. মনে রাখতে হবে, কুরাইশ সরদাররা নবী কারীম সা.কে মোকাবিলায় যা কিছু করছিল সবই ছিল তাদের নিজেদের ইজ্জত ও মর্যাদার খাতিরে। তাদের ধারণা ছিল, যদি মুহাম্মাদ সা.এর কথা গৃহীত হয়ে যায় তাহলে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব তামাম আরব মুল্লুকে আমাদের যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত আছে তা মাটিতে মিশে যাবে। এরই প্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও কুফরী করে তোমরা নিজেদের যে মর্যাদা তৈরি করে রেখেছো এ তো একটি মিথ্যা ও ঠুনকো মর্যাদা। মাটিতে মিশে যাওয়াই এর ভাগ্যের লিখন। আসল ও চিরস্থায়ী মর্যাদা, দুনিয়া থেকে নিয়ে আখেরাত পর্যন্ত যা কখনো হীনতা ও লাঞ্ছনার শিকার হতে পারে না, তা বেবলমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। তুমি যদি তাঁর হয়ে যাও, তাহলে তাঁকে পেয়ে যাবে এবং যদি তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরয়ে নাও, তাহলে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে।
২১. এ হচ্ছে মর্যাদা লাভ করার আসল উপায়। আল্লাহর কাছে মিথ্যা, কলুষিত ও ক্ষতিকারক কথা কখনো উচ্চ মর্যাদা লাভ করে না। তাঁর কাছে একমাত্র এমন কথা উচ্চ মর্যাদা লাভ করে যা হয় সত্য, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন, বাস্তব ভিত্তিক, যার মধ্যে সদিচ্ছা সহকারে একটি ন্যয়নিষ্ঠ আকিদা-বিশ্বাস ও একটি সঠিক চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে। তারপর একটি পবিত্র কথাকে যে জিনিসটি উচ্চ মর্যাদার দিকে নিয়ে যায় সেটি হচ্ছে কথা অনুযায়ী কাজ। যেখানে কথা খুবই পবিত্র কিন্তু কাজ তার বিপরীত সেখানে কথার পবিত্রতা নিস্তেজ ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র মুখে কথার খই ফুটালে কোন কথা উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হয় না বরং এজন্য সৎকাজের শক্তিমত্তার প্রয়োজন হয়।
এখানে একথাও অনুধাবন করতে হবে যে, কুরআন মজীদ ভালো কথা ও ভালো কাজকে পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য বিষয় হিসেবে পেশ করে। কোন কাজ নিছক ভালো হতে পারে না যতক্ষন না তার পেছনে থাকে ভালো আকীদা-বিশ্বাস। আর কোন ভালো আকীদা-বিশ্বাস এমন অবস্থায় মোটেই নির্ভরযোগ্য হতে পারে না যতক্ষন না মানুষের কাজ তার প্রতি সমর্থন যোগায় এবং তার সত্যতা প্রমাণ করে। কোন ব্যক্তি যদি মুখে বলতে থাকে, আমি এক ও লা-শরীক আল্লাহকে মাবুদ বলে মানি কিন্তু কার্যত সে গাইরুল্লাহর ইবাদাত করে, তাহলে এ কাজ তার কথাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে। কোন ব্যক্তি যদি মুখে মদ হারাম বলতে থাকে এবং কার্যত মদ পান করে চলে, তাহলে শুধুমাত্র তার কথা মানুষের দৃষ্টিতেও গৃহীত হতে পারে না, আর আল্লাহর কাছেও তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
২২. অর্থাৎ বাতিল ও ক্ষতিকর কথা নিয়ে এগিয়ে আসে তারপর শঠতা, প্রতারণা ও মনোমুদ্ধকর যুক্তির মাধ্যমে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে দেবার চেষ্টা করে এবং তার মোকাবেলায় সত্য ও হক কথাকে ব্যর্থ করার জন্য সবচেয়ে খারাপ ব্যবস্থা আবলম্বন করতেও পিছপা হয় না।
﴿وَٱللَّهُ خَلَقَكُم مِّن تُرَابٍۢ ثُمَّ مِن نُّطْفَةٍۢ ثُمَّ جَعَلَكُمْ أَزْوَٰجًۭا ۚ وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنثَىٰ وَلَا تَضَعُ إِلَّا بِعِلْمِهِۦ ۚ وَمَا يُعَمَّرُ مِن مُّعَمَّرٍۢ وَلَا يُنقَصُ مِنْ عُمُرِهِۦٓ إِلَّا فِى كِتَـٰبٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٌ﴾
১১। আল্লাহ২৩ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে তারপর শুক্র থেকে২৪ এরপর তোমাদের জুটি বানিয়ে দিয়েছেন (অর্থাৎ পুরুষ ও নারী)। কোন নারী গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসব করলে কেবলমাত্র আল্লাহর জানা মতেই তা করে থাকে। কোন আয়ু লাভকারী আয়ু লাভ করলে এবং কার আয়ু কিছু কম করা হলে তা অবশ্যই একটি কিতাবে লেখা থাকে।২৫ আল্লাহর জন্য এসব একদম সহজ।২৬
﴿وَمَا يَسْتَوِى ٱلْبَحْرَانِ هَـٰذَا عَذْبٌۭ فُرَاتٌۭ سَآئِغٌۭ شَرَابُهُۥ وَهَـٰذَا مِلْحٌ أُجَاجٌۭ ۖ وَمِن كُلٍّۢ تَأْكُلُونَ لَحْمًۭا طَرِيًّۭا وَتَسْتَخْرِجُونَ حِلْيَةًۭ تَلْبَسُونَهَا ۖ وَتَرَى ٱلْفُلْكَ فِيهِ مَوَاخِرَ لِتَبْتَغُوا۟ مِن فَضْلِهِۦ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
১২। পানির দু’টি উৎস সমান নয়।২৭ একটি সুমিষ্ট ও পিপাসা নিবারণকারী সুস্বাদু পানীয় এবং অন্যটি ভীষণ লবণাক্ত যা গলা ছিলে দেয়, কিন্তু উভয়টি থেকে তোমরা তরতাজা গোশত লাভ করে থাকো,২৮ পরিধান করার জন্য সৌন্দর্যের সরঞ্জাম বের করো২৯ এবং এ পানির মধ্যে তোমরা দেখতে থাকো নৌযান তার বুক চিরে ভেসে চলছে, যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং তাঁর প্রতি কতৃজ্ঞ হও।
﴿يُولِجُ ٱلَّيْلَ فِى ٱلنَّهَارِ وَيُولِجُ ٱلنَّهَارَ فِى ٱلَّيْلِ وَسَخَّرَ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ كُلٌّۭ يَجْرِى لِأَجَلٍۢ مُّسَمًّۭى ۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمْ لَهُ ٱلْمُلْكُ ۚ وَٱلَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمْلِكُونَ مِن قِطْمِيرٍ﴾
১৩। তিনি দিনের মধ্যে রাতকে এবং রাতের মধ্যে দিনকে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে আসেন।৩০ চন্দ্র ও সূর্যকে তিনি অনুগত করে রেখেছেন।৩১ এসব কিছু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। এ আল্লাহই (এ সমস্তই যাঁর কাজ) তোমাদের রব, রাজত্ব তাঁরই। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য যাদেরকে তোমরা ডাকছো তারা তো একটি শুকনো ভূমির৩২ অধিকারীও নয়।
﴿إِن تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا۟ دُعَآءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا۟ مَا ٱسْتَجَابُوا۟ لَكُمْ ۖ وَيَوْمَ ٱلْقِيَـٰمَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ ۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ﴾
১৪। তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনতে পারে না এবং শুনে নিলেও তোমাদের কোন জবাব দিতে পারে না।৩৩ এবং কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে।৩৪ প্রকৃত অবস্থান এমন সঠিক খবর একজন সর্বজ্ঞ ছাড়া কেউ তোমাদের দিতে পারে না।৩৫
﴿يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ أَنتُمُ ٱلْفُقَرَآءُ إِلَى ٱللَّهِ ۖ وَٱللَّهُ هُوَ ٱلْغَنِىُّ ٱلْحَمِيدُ﴾
১৫। হে লোকেরা! তোমরাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী৩৬ এবং আল্লাহ তো অভাবমুক্ত ও প্রশংসার্হ।৩৭
২৩. এখান থেকে আবার কথার মোড় সাধারণ মানুষের দিকে ঘুরে যাচ্ছে।
২৪. অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি প্রথমে সরাসরি মাটি থেকে করা হয় তারপর তার বংশধারা চালান হয় তার বীর্য থেকে।
২৫. অর্থাৎ যে ব্যক্তিই দুনিয়ায় জন্মলাভ করে তার সম্পর্কে প্রথমেই লিখে দেয়া হয় সে দুনিয়ায় কত বছর বাঁচবে। কেউ দীর্ঘায়ু হলে তা হয় আল্লাহর হুকুমে এবং স্বল্পায়ু হলেও হয় আল্লাহর ফায়সালা অনুযায়ী। কতিপয় অজ্ঞ ও মূর্খ লোক এর জবাবে এ যুক্তি পেশ করে থাকে যে, পূর্বে নবজাত শিশুদের মৃত্যুহার ছিল বেশী এবং বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এ মৃত্যুহার কমিয়ে দিয়েছে। পূর্বে লোকদের গড় আয়ু ছিল কম, বর্তমানে চিকিৎসা উপকরণ বৃদ্ধির ফলে আয়ূ দীর্ঘায়িত হতে শুরু হয়েছে। কিন্তু এ যুক্তি কুরআন মজীদের এ বর্ণনার প্রতিবাদে কেবলমাত্র তখনই পেশ করা যেতে পারতো যখন কোন উপায়ে আমরা জানতে পারতাম, যেমন উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ অমুক ব্যক্তির আয়ু লিখেছিলেন দু’বছর এবং আমাদের চিকিৎসা উপকরণ তার মধ্যে একদিনের সময় বৃদ্ধি করে দিয়েছে। এ ধরনের কোন জ্ঞান যদি কারো কাছে না থেকে থাকে, তাহলে সে কোন সঙ্গত ভিত্তিতে কুরআনের এ উক্তির প্রতিবাদ করতে পারে না। সংখ্যাতত্ব ও গণনার দিক দিয়ে শিশু মৃত্যুর হার এখন কমে গেছে অথবা আগের তুলনায় লোকেরা বেশী আয়ুর অধিকারী হচ্ছে, নিছক এই তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা যায় না যে, মানুষ এবার আল্লাহর ফায়সালা বদলে দেবার শক্তি অর্জন করেছে। আল্লাহ বিভিন্ন যুগে জন্মলাভকারী মানুষের আয়ু বিভিন্নভাবে নির্ধারণ করেছেন এতে অযৌক্তিক কি আছে? এবং এটিও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ফায়সালা যে, অমুক যুগে মানুষকে অমুক রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা দান করা হবে এবং অমুক যুগে মানুষকে জীবনী শক্তি বৃদ্ধির অমুক উপায় দান করা হবে।
২৬. অর্থাৎ এত অসংখ্য সৃষ্টির ব্যাপারে এত বিস্তারিত জ্ঞান থাকা এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এত বিস্তারিত বিধান দেয়া ও ফায়সালা করা আল্লাহর জন্য মোটেই কোন কঠিন কাজ নয়।
২৭. অর্থাৎ পানির একটি উৎস যা সমুদ্রগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এবং পানির দ্বিতীয় উৎসটি গড়ে উঠেছে নদী, ঝরণা, হ্রদ ইত্যাদির সমন্বয়ে।
২৮. অর্থাৎ জলজ প্রাণীর গোশত।
২৯. অর্থাৎ মুক্তা, প্রবাল এবং কোন কোন নদী-সাগর থেকে হীরা ও সোনা।
৩০. অর্থাৎ দিনের আলো ধীরে ধীরে নিভে যেতে থাকে এবং রাতের আঁধার বেড়ে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি তাকে ঢেকে ফেলে। এভাবে রাতের শেষ দিকে দিগন্তে হালকা আলোর রেখা জেগে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে তা অগ্রসর হতে হতে আলোকোজ্জ্বল দিনে পরিণত হয়।
৩১. অর্থাৎ একটি নিয়ম ও বিধানের অধীন করে রেখেছেন।
৩২. মূলে “কিতমীর” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিতমীর বলা হয় খেজুরের আঁটির গায়ে জড়ানো পাতলা ঝিল্লি বা আবরণকে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বলা যে, মুশরিকদের মাবুদ ও উপাস্যরা কোন তুচ্ছ ও নগন্য জিনিসেরও মালিক নয়। তাই শাব্দিক তরজমা বাদ দিয়ে আমি এখানে ভাব-তরজমা করেছি।
৩৩. এর অর্থ এ নয় যে, তারা তোমাদের দোয়ার জবাবে তোমাদের দোয়া কবুল করা হয়েছে বা হয়নি একথা চিৎকার করে বলতে পারে না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তারা তোমাদের আবেদনের ভিত্তিতে কোন পদক্ষেপ নিতে পারে না। কোন ব্যক্তি নিজের আবেদন যদি এমন কোন ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেয় যে শাসনকর্তা নয়, তাহলে তার আবেদন ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ তা যার কাছে পাঠানো হয়েছে তার হাতে আদতে কোন ক্ষমতাই নেই। প্রত্যাখ্যান বা গ্রহণ করার কোন ইখতিয়ার তার নেই তবে এই একই আবেদন আবার যদি যথার্থ শাসনকর্তার কাছে পাঠানো হয়, তাহলে এর ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে কোন না কোন পদক্ষেপ গৃহীত হবেই। তা গৃহীতও হতে পারে আবার প্রত্যাখ্যাতও।
৩৪. অর্থাৎ তারা পরিষ্কার বলে দেবে, আমরা কখনো এদেরকে বলিনি, আমরা আল্লাহর শরীক এবং তোমরা আমাদের ইবাদাত করো। বরং আমরা এও জানতাম না যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে শরীক করছে এবং আমাদের কাছে প্রার্থনা করছে। এদের কোন প্রার্থনা আমাদের কাছে আসেনি এবং এদের কোন নজরানা ও উৎসর্গ আমাদের হস্তগত হয়নি।
৩৫. সর্বজ্ঞ বলে আল্লাহকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ অন্য কোন ব্যক্তি বড় জোর বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি প্রমাণ পেশ করে শিরক খণ্ডন ও মুশরিকদের মাবুদদের শক্তিহীনতা বর্ণনা করবে। কিন্তু আমি সরাসরি প্রকৃত অবস্থা জানি। আমি নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তিতে তোমাদের জানাচ্ছি, লোকেরা যাদেরকেই আমার সার্বভৌম কর্তৃত্বের মধ্যে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন করে রেখেছে তারা সবাই ক্ষমতাহীন। তাদের কাছে এমন কোন শক্তি নেই যার মাধ্যমে তারা কারো কোন কাজ সফল বা ব্যর্থ করে দিতে পারে। আমি সরাসরি জানি, কিয়ামতের দিন মুশরিকদের এসব মাবুদরা নিজেরাই তাদের শিরকে প্রতিবাদ করবে।
৩৬. অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী, তোমরা তাঁকে আল্লাহ বলে মেনে না নিলে তাঁর সার্বভৌম ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চলবে না এবং তোমরা তাঁর ইবাদাত ও বন্দেগী না করলে তাঁর কোন ক্ষতি হয়ে যাবে, এ ভুল ধারণা পোষণ করো না। আসল ব্যাপার হচ্ছে, তোমরা তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি যদি তোমাদের জীবিত না রাখেন এবং যেসব উপকরণের সহায়তায় তোমরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকো এবং কাজ করতে পারো সেগুলো তোমাদের জন্য সরবরাহ না করেন, তাহলে তোমাদের জীবন এক মুহূর্তের জন্যও টিকে থাকতে পারে না। কাজেই তাঁর আনুগত্য ও ইবাদাতের পথ অবলম্বন করার জন্য তোমাদেরকে যে তাগিদ দেয়া হয় তা এজন্য নয় যে, আল্লাহর এর প্রয়োজন আছে বরং এজন্য যে, এরই ওপর নির্ভর করে তোমাদের দুনিয়ার ও আখেরাতের সাফল্য। এমনটি না করলে তোমরা নিজেদেরই সবকিছুর সর্বনাশ করে ফেলবে, আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
৩৭. মূলে বলা হয়েছে “গনী” ও “হামীদ” মানে হচ্ছে, তিনি সবকিছুর মালিক, প্রত্যেকটি জিনিসের অভাবমুক্ত ও অমুখাপেক্ষী। তিনি কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন। আর “হামীদ” মানে হচ্ছে, তিনি নিজে নিজেই প্রশংসিত, কেউ তাঁর প্রশংসা করুক বা না করুক প্রশংসা লাভ করার অধিকার একমাত্র তাঁরই আছে। এ দু’টি গুণকে একসাথে বর্ণনা করার কারণ হচ্ছে এই যে, নিছক “গনী” তো এমন ব্যক্তিও হতে পারে যে নিজের ধনাঢ্যতা দ্বারা কারো সাহায্য বা উপকার করে না। এ অবস্থায় সে গনী অবশ্যই হবে কিন্তু হামীদ বা প্রশংসিত হবে না। ‘হামীদ’ সে হতে পারে এমন অবস্থায় যখন সে কারো সাহায্যে নিজে লাভবান হবে না কিন্তু নিজের ধন-সম্পদ থেকে অন্যদেরকে সব ধরনের সহায়তা দান করবে। আল্লাহ যেহেতু এ দু’টি গুণের পূর্ণ আধার তাই বলা হয়েছে, তিনি নিছক ‘গনী’ নন বরং এমন ‘গনী’ যিনি সব রকমের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা লাভের অধিকারী। কারণ তিনি তোমাদের এবং বিশ্ব-জাহানের যাবতীয় জড় ও জীবের প্রয়োজন পূর্ণ করেন।
﴿إِن يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍۢ جَدِيدٍۢ﴾
১৬। তিনি চাইলে তোমাদের সরিয়ে কোন নতুন সৃষ্টি তোমাদের জায়গায় আনবেন।
﴿وَمَا ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ بِعَزِيزٍ﴾
১৭। এমনটি করা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন নয়।৩৮
﴿وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌۭ وِزْرَ أُخْرَىٰ ۚ وَإِن تَدْعُ مُثْقَلَةٌ إِلَىٰ حِمْلِهَا لَا يُحْمَلْ مِنْهُ شَىْءٌۭ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰٓ ۗ إِنَّمَا تُنذِرُ ٱلَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُم بِٱلْغَيْبِ وَأَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ ۚ وَمَن تَزَكَّىٰ فَإِنَّمَا يَتَزَكَّىٰ لِنَفْسِهِۦ ۚ وَإِلَى ٱللَّهِ ٱلْمَصِيرُ﴾
১৮। কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা উঠাবে না।৩৯ আর যদি ভারাক্রান্ত ব্যক্তি নিজের বোঝা উঠাবার জন্য ডাকে, তাহলে তার বোঝার সামান্য একটি অংশ উঠাবার জন্যও কেউ আসবে না, সে তার নিকটতম আত্মীয় স্বজন হলেও।৪০ (হে নবীঃ) তুমি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারো যারা না দেখে তাদের রবকে ভয় করে এবং নামায কায়েম করে।৪১ আর যে ব্যক্তিই পবিত্রতা অবলম্বন করে সে নিজেরই ভালোর জন্য করে এবং ফিরে আসতে হবে সবাইকে আল্লাহরই দিকে।
﴿وَمَا يَسْتَوِى ٱلْأَعْمَىٰ وَٱلْبَصِيرُ﴾
১৯। অন্ধ ও চক্ষুষ্মান সমান নয়,
﴿وَلَا ٱلظُّلُمَـٰتُ وَلَا ٱلنُّورُ﴾
২০। না অন্ধকার ও আলো সমান পর্যায়ভুক্ত,
৩৮. অর্থাৎ তোমরা নিজেদের শক্তিতে এ পৃথিবীর বুকে বিচরণ করছো না। তোমাদেরকে এখান থেকে বিদায় দেবার এবং তার জায়গায় অন্য কোন জাতিকে এনে বসাবার জন্য তাঁর একটি ইশারাই যথেষ্ট। কাজেই নিজের মর্যাদা অনুধাবন করো এবং এমন নীতি অবলম্বন করো না যার ফলে শেষ পর্যন্ত জাতিগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন কারো ধ্বংসের ফায়সালা এসে যায় তখন সমগ্র বিশ্ব-জাহানে এমন কোন শক্তি নেই যে তাঁর হাত টেনে ধরতে পারে এবং ফায়সালা কার্যকর হবার পথ রোধ করতে সক্ষম হয়।
৩৯. “বোঝা” মানে কৃতকর্মের দায়-দায়িত্বের বোঝা। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কাছে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই তার কাজের জন্য দায়ী এবং প্রত্যেকের ওপর কেবলমাত্র তার নিজের কাজের দায়-দায়িত্ব আরোপিত হয়। এক ব্যক্তির কাজের দায়-দায়িত্বের বোঝা আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্য ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার কোন সম্ভাবনা নেই। কোন ব্যক্তি অন্যের দায়-দায়িত্বের বোঝা নিজের ওপর চাপিয়ে নেবে এবং তাকে বাঁচাবার জন্য তার অপরাধে নিজেকে পাকড়াও করাবে– এরও কোন সম্ভাবনা নেই। একথা এখানে বলার কারণ হচ্ছে এই যে, মক্কা মুআ’যযমায় যারা ইসলাম গ্রহণ করছিল তাদেরকে তাদের মুশরিক আত্মীয় স্বজন ও গোত্রের লোকেরা বলছিল, আমাদের কথায় তোমরা এই নতুন ধর্ম ত্যাগ করো এবং নিজেদের বাপ-দাদার ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে যাও, এজন্য পাপ-পুণ্যের বোঝা আমরা বহন করব।
৪০. ওপরের বাক্যে আল্লাহর ন্যায়নীতির বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি একজনের পাপে অন্যকে পাকড়াও করবেন না। বরং প্রত্যেককে তার নিজের পাপের জন্য দায়ী করবেন। তাই এখানে এ বাক্যে বলা হয়েছে, আজ যারা বলছে, তোমরা আমাদের দায়িত্বে কুফরী ও গোনাহের কাজ করে যাও কিয়ামতের দিন তোমাদের গোনাহর বোঝা আমরা নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে নেব তারা আসলে নিছক একটি মিথ্যা ভরসা দিচ্ছে। যখন কিয়ামত আসবে এবং লোকেরা দেখে নেবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তারা কোন্ ধরনের পরিণামের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে তখন প্রত্যেকে নিজেকে বাঁচাবার ফিকিরে লেগে যাবে। ভাই ভাইয়ের থেকে এবং পিতা পুত্রের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কেউ কারো সামান্যতম বোঝা নিজের ওপর চাপিয়ে নিতে প্রস্তুত হবে না।
৪১. অন্য কথায় হঠকারী ও গোঁয়ারদের ওপর তোমার সতর্কবাণী কার্যকর হতে পারে না। তুমি বুঝালে এমন সব লোক সত্য সঠিক পথে আসতে পারে যাদের দিলে আল্লাহর ভয় আছে এবং যারা নিজের প্রকৃত মালিকের সামনে মাথা নোয়াতে প্রস্তুত।
﴿وَلَا ٱلظِّلُّ وَلَا ٱلْحَرُورُ﴾
২১। না শীতল ছায়া ও রোদের তাপ একই পর্যায়ের
﴿وَمَا يَسْتَوِى ٱلْأَحْيَآءُ وَلَا ٱلْأَمْوَٰتُ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُسْمِعُ مَن يَشَآءُ ۖ وَمَآ أَنتَ بِمُسْمِعٍۢ مَّن فِى ٱلْقُبُورِ﴾
২২। এবং না জীবিত ও মৃতরা সমান।৪২ আল্লাহ যাকে চান শুনান কিন্তু (হে নবী!) তুমি তাদেরকে শুনাতে পারো না যারা কবরে শায়িত রয়েছে।৪৩
৪২. উপমাগুলোতে মু’মিন ও কাফেরের বর্তমান ও ভবিষ্যতের পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। এক ব্যক্তি প্রকৃত সত্য থেকে চোখ বন্ধ করে আছে। সে একবারও দেখছে না বিশ্ব-জাহানের সমগ্র ব্যবস্থা এবং এমনকি তার নিজের অস্তিত্ব কোন্ সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে। অন্যদিকে আর এক ব্যক্তির চোখ খোলা আছে। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, তার ভেতরের ও বাইরের প্রত্যেকটি জিনিস আল্লাহর একত্ব এবং তাঁর সামনে মানুষের জবাবাদিহির ওপর সাক্ষ্য দিচ্ছে। একদিকে এক ব্যক্তি জাহেলী কল্পনা ও ভাববাদ এবং ধারণা, আন্দাজ-অনুমানের অন্ধকারে হাতড়ে মরছে এবং নবীর জ্বালানো প্রদীপের কাছাকাছি ঘেসতেও রাজি নয়। অন্যদিকে অপর ব্যক্তির চোখ একদম খোলা। নবীর জ্বালানো আলোর সামনে আসতেই তার কাছে একথা একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মুশরিক, কাফের ও নাস্তিক্যবাদীরা যেসব পথে চলছে সেগুলো ধ্বংসের দিকে চলে গেছে এবং সাফল্য ও মুক্তির পথ একমাত্র সেটিই যেটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দেখিয়েছন। এখন দুনিয়ায় এদের দু’জনের নীতি এক হবে এবং দু’জনে এক সাথে একই পথে চলতে পারবে, এটা কেমন করে সম্ভব? দু’জনের পরিণতি এক হবে, দু’জনই মরে খতম হয়ে যাবে, একজন তার কুপথগামিতার শাস্তি পাবে না এবং অন্যজন সৎপথে চলার জন্য কোন পুরস্কার পাবে না, এটাই বা কেমন করে সম্ভব? “শীতল ছায়া ও রোদের তাপ সমান নয়” —এর মধ্যে এ পরিণতির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, একজন আল্লাহর রহমতের ছায়া আশ্রয় লাভকারী এবং জাহান্নামের উত্তাপে ঝলসানো ব্যক্তি। তোমরা কোন্ উদ্ভট চিন্তায় মেতে আছো, এরা দু’জনা কি একই পরিণাম ভোগ করবে? শেষে মু’মিনকে জীবিতের সাথে এবং হঠকারী কাফেরদেরকে মৃতদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ মু’মিন হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার মধ্যে অনুভূতি, উপলব্ধি, বিবেচনা, জ্ঞান, বুঝ ও চেতনা আছে এবং তার বিবেক তাকে ভালো ও মন্দের মধ্যকার পার্থক্য থেকে সবসময় সজাগ করছে। এর বিপরীত যে ব্যক্তি কুফরীর অন্ধতায় পুরোপুরি ডুবে গেছে তার অবস্থা এমন অন্ধের চেয়েও খারাপ যে অন্ধকারে পথ হারিয়েছে। তার অবস্থা এমন মৃতের মতো যার মধ্যে কোন অনুভূতিই নেই।
৪৩. অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপার তো ভিন্ন। তিনি চাইলে পাথরকেও শ্রবণশক্তি দান করেন। কিন্তু যাদের বক্ষদেশে বিবেকের কবর রচিত হয়েছে তাদের হৃদয়ে নিজের কথা বদ্ধমূল করে দিতে পারা এবং যারা কথা শুনতেই চায় না তাদের বধির কর্ণকূহরে সত্যের ধ্বনি পৌঁছিয়ে দেবার সাধ্য রাসূলের নেই। তিনি তো কেবলমাত্র তাদেরকেই শুনাতে পারেন যারা যুক্তিসঙ্গত কথা শুনতে চায়।
﴿إِنْ أَنتَ إِلَّا نَذِيرٌ﴾
২৩। তুমি তো একজন সতর্ককারী মাত্র।৪৪
৪৪. অর্থাৎ লোকদেরকে সতর্ক করে দেবার চেয়ে বেশী আর কোন দায়িত্ব তোমার নেই। এরপর যদি কেউ সচেতন না হয় এবং নিজের গোমরাহীর মধ্যে ছুটে চলতে থাকে তাহলে এর কোন দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর নেই। অন্ধদের দেখাবার এবং বধিরদের শুনাবার দায়িত্ব তোমার ওপর সোপর্দ করা হয়নি।
﴿إِنَّآ أَرْسَلْنَـٰكَ بِٱلْحَقِّ بَشِيرًۭا وَنَذِيرًۭا ۚ وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ﴾
২৪। আমি তোমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী বানিয়ে। আর এমন কোন সম্প্রদায় অতিক্রান্ত হয়নি যার মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি।৪৫
৪৫. একথাটি কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুনিয়ায় এমন কোন জাতি ও সম্প্রদায় অতিক্রান্ত হয়নি যাকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেবার জন্য আল্লাহ কোন নবী পাঠাননি। সূরা রা’দে বলা হয়েছেঃ
وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ (ايت: 7)
সূরা আল হিজরে বলা হয়েছেঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي شِيَعِ الْأَوَّلِينَ (ايت:10)
সূরা আন নাহলে বলা হয়েছেঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا (ايت:36)
সূরা আশ শূআ’রায় বলা হয়েছেঃ
وَمَا أَهْلَكْنَا مِنْ قَرْيَةٍ إِلَّا لَهَا مُنْذِرُونَ (ايت:208)
কিন্তু এ প্রসঙ্গে দু’টি কথা অনুধাবন করতে হবে। তাহলে আর ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না। প্রথমত হচ্ছে, একজন নবীর প্রচারণা যতদূর পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে ততদূর পর্যন্ত তিনিই যথেষ্ট। প্রত্যেকটি জনপদে ও প্রত্যেকটি জাতির মধ্যে পৃথক পৃথকভাবে নবী পাঠানো মোটেই জরুরী নয়। দ্বিতীয়ত, একজন নবীর দাওয়াত ও হিদায়াতের প্রভাব এবং তাঁর নেতৃত্বের পদাংক যতদিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত অন্য কোন নতুন নবীর প্রয়োজন নেই। প্রত্যেক বংশ ও প্রত্যেক প্রজন্মের (Generation) জন্য আলাদা নবী পাঠানো অপরিহার্য নয়।
﴿وَإِن يُكَذِّبُوكَ فَقَدْ كَذَّبَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ جَآءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِٱلْبَيِّنَـٰتِ وَبِٱلزُّبُرِ وَبِٱلْكِتَـٰبِ ٱلْمُنِيرِ﴾
২৫। এখন এরা যদি তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে থাকে তাহলে এদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকেরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল। তাদের কাছে এসেছিল তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণাদি৪৬ সহীফা ও দীপ্তোজ্জল হিদায়াত দানকারী কিতাব৪৭ নিয়ে।
৪৬. অর্থাৎ এমন প্রমাণপত্র যা পরিষ্কারভাবে একথার সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে, তাঁরা আল্লাহর রাসূল।
৪৭. সহীফা ও কিতাবের মধ্যে সম্ভবত একটি বড় পার্থক্য থেকে থাকবে। সেটি হচ্ছে এই যে, সহীফা প্রধানত ছিল উপদেশাবলী ও নৈতিক পথনিদের্শনার সমষ্টি। অন্যদিকে কিতাবে বিধৃত থাকতো একটি পূর্ণাংগ শরীয়াত ব্যবস্থা।
﴿ثُمَّ أَخَذْتُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ ۖ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ﴾
২৬। তারপর যারা মানেনি তাদেরকে আমি পাকড়াও করেছি এবং দেখে নাও আমার শাস্তি ছিল কেমন কঠোর।
﴿أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءًۭ فَأَخْرَجْنَا بِهِۦ ثَمَرَٰتٍۢ مُّخْتَلِفًا أَلْوَٰنُهَا ۚ وَمِنَ ٱلْجِبَالِ جُدَدٌۢ بِيضٌۭ وَحُمْرٌۭ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَٰنُهَا وَغَرَابِيبُ سُودٌ﴾
২৭। তুমি কি দেখো না আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তারপর তার মাধ্যমে আমি নানা ধরনের বিচিত্র বর্ণের ফল বের করে আনি? পাহাড়ের মধ্যেও রয়েছে বিচিত্র বর্ণের সাদা, লাল ও নিকষকালো রেখা।
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ وَٱلدَّوَآبِّ وَٱلْأَنْعَـٰمِ مُخْتَلِفٌ أَلْوَٰنُهُۥ كَذَٰلِكَ ۗ إِنَّمَا يَخْشَى ٱللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ ٱلْعُلَمَـٰٓؤُا۟ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ﴾
২৮। আর এভাবে মানুষ, জীব-জনোয়ার ও গৃহপালিত জন্তুও বিভিন্ন বর্ণের রয়েছে।৪৮ আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞান সম্পন্নরাই তাঁকে ভয় করে।৪৯ নিঃসন্দেহে আল্লাহ পরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল।৫০
৪৮. এ দ্বারা যে কথা বুঝতে চাওয়া হয়েছে তা এই আল্লাহর সৃষ্ট এ বিশ্ব-জাহানে কোথাও একঘেয়েমি ও বৈচিত্রহীনতা নেই। সর্বত্রই বৈচিত্র। একই মাটি ও একই পানি থেকে বিভিন্ন প্রকার গাছ উৎপন্ন হচ্ছে। একই গাছের দু’টি ফলেরও বর্ণ, দৈহিক কাঠামো ও স্বাদ এক নয়। একই পাহাড়ের দিকে তাকালে তার মধ্যে দেখা যাবে নানা রংগের বাহার। তার বিভিন্ন অংশের বস্তুগত গঠন প্রণালীতে বিরাট পার্থক্য পাওয়া যাবে। মানুষ ও পশুদের মধ্যে একই মা-বাপের দু’টি সন্তানও একই রকম পাওয়া যাবে না। এ বিশ্ব-জাহানে যদি কেউ মেজাজ, প্রকৃতি ও মানসিকতার একাত্মতা সন্ধান করে এবং বিভিন্নতা, বৈচিত্রতা ও বৈষম্য দেখে আতংকিত হয়ে পড়ে, যেদিকে ওপরের ১৯ থেকে ২২ আয়াতে ইশারা করা হয়েছে, তাহলে এটা হবে তার নিজের বোধশক্তি ও উপলব্ধির ত্রুটি। এই বৈচিত্র ও বিরোধই জানিয়ে দিচ্ছে এ বিশ্ব-জাহানকে কোন মহাপরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তা বহুবিধ জ্ঞান ও বিজ্ঞতা সহকারে সৃষ্টি করেছেন এবং এর নির্মাতা একজন নজীরবিহীন স্রষ্টা ও তুলনাবিহীন নির্মাণ কৌশলী। তিনি একই জিনিসের কেবল একটি মাত্র নমুনা নিয়ে বসে পড়েননি। বরং তাঁর কাছে প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য একের পর এক এবং অসংখ্য ও সীমাহীন ডিজাইন রয়েছে। তারপর বিশেষ করে মানবিক প্রকৃতি ও বুদ্ধি বৈচিত্র সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে যে কোন ব্যক্তি একথা বুঝতে পারে যে, এটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয় বরং প্রকৃতপক্ষে অতুলনীয় সৃষ্টি জ্ঞানের নিদর্শন। যদি জন্মগতভাবে সমস্ত মানুষকে তাদের নিজেদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, প্রবৃত্তি, কামনা, আবেগ অনুভূতি ঝোঁক প্রবণতা ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে এক করে দেয়া হতো এবং কোন প্রকার বৈষম্য বিভিন্নতার কোন অবকাশই না রাখা হতো তাহলে দুনিয়ায় মানুষের মতো একটি নতুন ধরনের সৃষ্টি তৈরি করাই হতো পুরাপুরি অর্থহীন। স্রষ্টা যখন এ পৃথিবীতে একটি দায়িত্বশীল ও স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী সৃষ্টিকে অস্তিত্বশীল করার ফায়সালা করেছেন তখন তার কাঠামোর মধ্যে সব রকমের বিচিত্রতা ও বিভিন্নতার অবকাশ রাখা ছিল সে ফায়সালার ধরনের অনিবার্য দাবী। মানুষ যে কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল নয় বরং একটা মহান বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার ফলশ্রুতি, এ জিনিসটি এর সবচেয় বড় সাক্ষ্য প্রদান করে। আর একথা সুস্পষ্ট যে, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই অনিবার্যভাবে তার পেছনে পাওয়া যাবে এক বিজ্ঞানময় সত্তার সক্রিয় সংযোগ। বিজ্ঞানী ছাড়া বিজ্ঞানের অস্তিত্ব কেবলমাত্র একজন নির্বোধই কল্পনা করতে পারে।
৪৯. অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলীর ব্যাপারে যতবেশী অজ্ঞ হবে সে তার ব্যাপারে তত বেশী নির্ভীক হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর শক্তিমত্তা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানময়তা, ক্রোধ, পরাক্রম সার্বভৌম কর্তৃত্ব-ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবালী সম্পর্কে যে ব্যক্তি যতবেশী জানবে সে ততবেশী তার নাফরমানী করতে ভয় পাবে। কাজেই আসলে এ আয়াতে জ্ঞান অর্থ দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অংক ইত্যাদি স্কুল কলেজে পঠিত বিষয়ের জ্ঞান নয়। বরং এখানে জ্ঞান বলতে আল্লাহর গুণাবলীর জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। এজন্য শিক্ষিত ও অশিক্ষিত হবার প্রশ্ন নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না সে যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হলেও এ জ্ঞানের দৃষ্টিতে সে নিছক একজন মূর্খ ছাড়া আর কিছু নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলী জানে এবং নিজের অন্তরে তাঁর ভীতি পোষণ করে সে অশিক্ষিত হলেও জ্ঞানী। এ প্রসঙ্গে একথাও জেনে রাখা উচিত যে, আয়াতে উল্লেখিত উলামা শব্দটির অর্থ এমন পারিভাষিক উলামাও নয় যারা কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও ইলমে কালামে জ্ঞান রাখার কারণে দ্বীনী আলেম বলে পরিচিত। তারা সঠিক তখনই এ আয়াতটির প্রয়োগ ক্ষেত্রে পরিণত হবে যখন তাদের মধ্যে আল্লাহভীতি থাকবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা. একথাই বলেছেনঃ
ليس العلم عن كثرة الحديث ولكن العلم عن كثرة الخشية
“বিপুল সংখ্যক হাদীস জানা জ্ঞানের পরিচায়ক নয় বরং বেশী পরিমাণ আল্লাহভীতিই জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।”
হযরত হাসান বাসরীও একথাই বলেছেনঃ
العالم من خشى الرحمن بالغيب ورغب فيما رغب الله فيه وزهد فيما سخط الله فيه
“আল্লাহকে না দেখে যে ভয় করে সেই হচ্ছে আলেম। আল্লাহ যা কিছু পছন্দ করেন সেদিকেই আকৃষ্ট হয় এবং যে বিষয়ে আল্লাহ নারাজ সে ব্যাপারে সে কোন আগ্রহ পোষণ করে না।”
৫০. অর্থাৎ তিনি এমন পরাক্রমশালী যে, নাফরমানদের যখনই চান পাকড়াও করতে পারেন। তাঁর পাকড়াও মুক্ত হবার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু তাঁর ক্ষমতাগুণের ফলেই জালেমরা অবকাশ পেয়ে চলছে।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُوا۟ مِمَّا رَزَقْنَـٰهُمْ سِرًّۭا وَعَلَانِيَةًۭ يَرْجُونَ تِجَـٰرَةًۭ لَّن تَبُورَ﴾
২৯। যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে খরচ করে, নিঃসন্দেহে তারা এমন একটি ব্যবসায়ের প্রত্যাশী যাতে কোনক্রমেই ক্ষতি হবে না।
﴿لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضْلِهِۦٓ ۚ إِنَّهُۥ غَفُورٌۭ شَكُورٌ﴾
৩০। (এ ব্যবসায়ে তাদের নিজেদের সবকিছু নিয়োগ করার কারণ হচ্ছে এই যে) যাতে তাদের প্রতিদান পুরোপুরি আল্লাহ তাদেরকে দিয়ে দেন এবং নিজের অনুগ্রহ থেকে আরো বেশী করে তাদেরকে দান করবেন।৫১ নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও গুণগ্রাহী।৫২
৫১. ঈমানদারদের এ কাজকে ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। কারণ মানুষ ব্যবসায়ে নিজের অর্থ, শ্রম ও মেধা নিয়োগ করে কেবলমাত্র আসল ফেরত পাবার এবং শ্রমের পারিশ্রমিক লাভ করার জন্য নয় বরং বাড়তি কিছু মুনাফা অর্জন করার জন্য। অনুরূপভাবে একজন মু’মিন ও আল্লাহর হুকুম পালন, তাঁর ইবাদাত-বন্দেগী এবং তাঁর দ্বীনের জন্য সংগ্রাম-সাধনায় নিজের ধন, সময়, শ্রম ও যোগ্যতা নিয়োগ করে শুধুমাত্র এসবের পুরোপুরি প্রতিদান লাভ করার জন্য নয় বরং এই সঙ্গে আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে বাড়তি অনেক কিছু দান করবেন এই আশায়। কিন্তু উভয় ব্যবসায়ের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ পার্থিব ব্যবসায়ে নিছক মুনাফা লাভেরই আশা থাকে না, লোকসান এবং দেউলিয়া হয়ে যাবার আশঙ্কাও থাকে। কিন্তু একজন আন্তরিকতা সম্পন্ন বান্দা আল্লাহর সাথে যে ব্যবসায় করে তাতে লোকসান ও ক্ষতির কোন আশঙ্কাই নেই।
৫২. অর্থাৎ নিজের আন্তরিকতা সম্পন্ন মু’মিনদের সাথে আল্লাহ এমন সংকীর্ণমনা প্রভুর মতো ব্যবহার করেন না, যে কথায় কথায় পাকড়াও করে এবং সামান্য একটি ভুলের দরুন নিজের কর্মচারীর সমস্ত সেবা ও বিশ্বস্ততা অস্বীকার করে। তিনি মহানুভব দানশীল প্রভু। তাঁর বিশ্বস্ত বান্দার ভুল ভ্রান্তি তিনি উপেক্ষা করে যান এবং তার পক্ষে যা কিছু সেবা করা সম্ভব হয়েছে তাকে যথার্থ মূল্য দান করেন।
﴿وَٱلَّذِىٓ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ مِنَ ٱلْكِتَـٰبِ هُوَ ٱلْحَقُّ مُصَدِّقًۭا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِعِبَادِهِۦ لَخَبِيرٌۢ بَصِيرٌۭ﴾
৩১। (হে নবী!) আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে যে কিতাব পাঠিয়েছি সেটিই সত্য, সত্যায়িত করে এসেছ তার পূর্বে আগত কিতাবগুলোকে।৫৩ অবশ্যই আল্লাহ নিজের বান্দাদের অবস্থা অবগত আছেন এবং সব জিনিসের প্রতি দৃষ্টি রাখেন।৫৪
৫৩. এর অর্থ হচ্ছে, পূর্বে আগত নবীগণ যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তিনি তার বিরোধী কোন নতুন কথা বলছেন না। বরং সকল নবী চিরকাল যে আদি ও চিরন্তন সত্য পেশ করে গেছেন তিনি তারই পুনরাবৃত্তি করছেন।
৫৪. বান্দার কল্যাণ কোন্ জিনিসের মধ্যে রয়েছে তার নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের উপযোগী নীতি কি এবং তার প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ নীতি নিয়ম কি কি এ সত্যগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়াই হচ্ছে এখানে আল্লাহর এ গুণাবলী বর্ণনা করার উদ্দেশ্য। এ বিষয়গুলো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। কারণ বান্দার প্রকৃতি ও চাহিদা একমাত্র তিনিই জানেন এবং তার প্রকৃত প্রয়োজন ও কল্যাণের প্রতি একমাত্র তিনিই দৃষ্টি রাখেন। বান্দা নিজেকে তত বেশী জানে না যত বেশী তার স্রষ্টা তাকে জানেন। তাই সত্য সেটিই এবং একমাত্র সেটিই হতে পারে যা তিনি অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন।
﴿ثُمَّ أَوْرَثْنَا ٱلْكِتَـٰبَ ٱلَّذِينَ ٱصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا ۖ فَمِنْهُمْ ظَالِمٌۭ لِّنَفْسِهِۦ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌۭ وَمِنْهُمْ سَابِقٌۢ بِٱلْخَيْرَٰتِ بِإِذْنِ ٱللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ ٱلْفَضْلُ ٱلْكَبِيرُ﴾
৩২। তারপর আমি এমন লোকদেরকে এ কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছি যাদেরকে আমি (এ উত্তরাধিকারের জন্য) নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে বাছাই করে নিয়েছি।৫৫ এখন তাদের মধ্য থেকে কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর হুকুমে সৎকাজে অগ্রবর্তী, এটিই অনেক বড় অনুগ্রহ।৫৬
৫৫. অর্থাৎ মুসলমানদেরকে। সমগ্র মানবজাতি থেকে ছাঁটাই বাছাই করে তাদেরকে বের করা হয়েছে। এভাবে তারা হবে আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং মুহাম্মাদ সা.এর পরে এ কিতাব নিয়ে তারা অগ্রসর হবে। যদিও কিতাব পেশ করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির সামনে কিন্তু যারা এগিয়ে এসে তা গ্রহণ করে নিয়েছে তাদেরকে এ মর্যাদা ও গৌরবের জন্য নির্ধারিত করে নেয়া হয়েছে যে, তারাই হবে কুরআনের ন্যায় মহিমান্বিত কিতাবের ওয়ারিস এবং মুহাম্মাদ সা.এর ন্যায় মহান রাসূলের শিক্ষা ও হিদায়াতের বিশ্বস্ত সংরক্ষক।
৫৬. অর্থাৎ এ মুসলমানরা সবাই একরকম নয়। বরং এরা তিন শ্রেনীতে বিভক্ত হয়ে গেছেঃ
একঃ নিজেদের প্রতি জুলুমকারী। এরা হচ্ছে এমন সব লোক যারা আন্তরিকতা সহকারে কুরআনকে আল্লাহর কিতাব এবং মুহাম্মাদ সা.কে আল্লাহর রাসূল বলে মানে কিন্তু কার্যত আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণের হক আদায় করে না। এরা মু’মিন কিন্তু গোনাহগার। অপরাধী কিন্তু বিদ্রোহী নয়। দুর্বল ঈমানদার, তবে মুনাফিক এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফের নয়। তাই এদেরকে আত্মনিপীড়ক হওয়া সত্ত্বেও কিতাবের ওয়ারিসদের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাদের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। নয়তো একথা সুস্পষ্ট, বিদ্রোহী, মুনাফিক এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফেরদের প্রতি এ গুণাবলী আরোপিত হতে পারে না। তিন শ্রেণীর মধ্য থেকে এ শ্রেণীর ঈমানদারদের কথা সবার আগে বলার কারণ হচ্ছে এই যে, উম্মাতের মধ্যে এদের সংখ্যাই বেশী।
দুইঃ মাঝামাঝি অবস্থানকারী। এরা হচ্ছে এমন লোক যারা এ উত্তরাধিকারের হক কমবেশী আদায় করে কিন্তু পুরোপুরি করে না। হুকুম পালন করে এবং অমান্যও করে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে পুরোপুরি লাগামহীন করে ছেড়ে দেয়নি বরং তাকে আল্লাহর অনুগত করার জন্য নিজেদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু কখনো তার বাগডোর ঢিলে করে দেয় এবং গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এভাবে এদের জীবনে ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের কাজের সমাবেশ ঘটে। এরা সংখ্যায় প্রথম দলের চাইতে কম এবং তৃতীয় দলের চেয়ে বেশী হয়। তাই এদেরকে দু’নম্বরে রাখা হয়েছে।
তিনঃ ভালো কাজে যারা অগ্রবর্তী। এরা হয় কিতাবের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রথম সারির লোক। এরাই আসলে এ উত্তরাধিকারের হক আদায়কারী। কুরআন ও সুন্নাতের অনুসরণের ক্ষেত্রেও এরা অগ্রগামী। আল্লাহর পয়গাম তাঁর বান্দাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার ক্ষেত্রেও এরা এগিয়ে থাকে। সত্যদ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকারেও এরাই এগিয়ে যায়। তাছাড়া সত্য, ন্যায়, সুকৃতি ও কল্যাণের যে কোন কাজেও এরাই হয় অগ্রবর্তী। এরা জেনে বুঝে গোনাহ করে না। আর অজান্তে কোন গোনাহর কাজ অনুষ্ঠিত হলেও সে সম্পর্কে জানার সাথে সাথেই এদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যায়। প্রথম দু’টি দলের তুলনায় উম্মাতের মধ্যে এদের সংখ্যা কম। তাই এদের কথা সবার শেষে বলা হয়েছে, যদিও উত্তরাধিকারের হক আদায় করার ক্ষেত্রে এরাই অগ্রগামী।
“এটিই অনেক বড় অনুগ্রহ” বাক্যটির সম্পর্ক যদি নিকটতম বাক্যের সাথে ধরে নেয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে, ভালো কাজে অগ্রগামী হওয়াই হচ্ছে বড় অনুগ্রহ এবং যারা এমনটি করে মুসলিম উম্মাতের মধ্যে তারাই সবার সেরা। আর এ বাক্যটির সম্পর্ক পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে মিল রেখে করা হলে এর অর্থ হবে, আল্লাহর কিতাবের হওয়া এবং এ উত্তরাধিকারের জন্য নির্বাচিত হওয়াই বড় অনুগ্রহ এবং আল্লাহর সকল বান্দাদের মধ্যে সেই বান্দাই সর্বশ্রেষ্ঠ যে কুরআন ও মুহাম্মাদ সা.এর প্রতি ঈমান এনে নির্বাচনে সফলকাম হয়েছে।
﴿جَنَّـٰتُ عَدْنٍۢ يَدْخُلُونَهَا يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِن ذَهَبٍۢ وَلُؤْلُؤًۭا ۖ وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌۭ﴾
৩৩। চিরস্থায়ী জান্নাতে তারা প্রবেশ করবে।৫৭ সেখানে তাদেরকে সোনার কংকন ও মুক্তা দিয়ে সাজানো হবে। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের
৫৭. মুফাসসিরগণের একটি দলের মতে এ বাক্যের সম্পর্ক নিকটবর্তী দু’টি বাক্যের সাথেই রয়েছে। অর্থাৎ সৎকাজে অগ্রগামীরাই বড় অনুগ্রহের অধিকারী এবং তারাই এ জান্নাতগুলোতে প্রবেশ করবে। অন্যদিকে প্রথম দু’টি দলের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের পরিণামের কথা চিন্তা করে এবং নিজেদের বর্তমান অবস্থা থেকে বের হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারে। আল্লামা যামাখ্ শারী এ অভিমতটি বলিষ্ঠভাবে বিবৃত করেছেন এবং ঈমাম রাযী একে সমর্থন দিয়েছেন।
কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসির বলেন, ওপরের সমগ্র আলোচনার সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। আর এর অর্থ হচ্ছে, এ তিনটি দলই শেষ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে, কোন প্রকার হিসেব-নিকেশ ছাড়াই বা হিসেব নিকেশের পর এবং সব রকমের জবাবাদিহি থেকে সংরক্ষিত থেকে অথবা কোন শাস্তি পাওয়ার পর যে কোন অবস্থাতেই হোক না কেন কুরআনের পূর্বাপর আলোচনা এ ব্যাখ্যার প্রতি সমর্থন দিচ্ছে। কারণ সামনের দিকে কিতাবের উত্তরাধিকারীদের মোকাবিলায় অন্যান্য দল সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন।” এ থেকে জানা যায়, যারা এ কিতাবকে মেনে নিয়েছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত এবং যারা এর প্রতি ঈমান আনতে অস্বীকার করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। আবার নবী সা.এর নিম্নোক্ত হাদীসও এর প্রতি সমর্থন জানায়। হযরত আবুদ দারদা এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং একে উদ্ধৃত করেছেন ইমাম আহমাদ, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম, তাবারানী, বায়হাকী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ। হাদীসে নবী কারীম সা.বলছেনঃ
فَأَمَّا الَّذِينَ سَبَقُوا فَأُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَأَمَّا الَّذِينَ اقْتَصَدُوا فَأُولَئِكَ الذين يُحَاسَبُونَ حِسَاباً يَسِيراً وَأَمَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ يُحْبَسُونَ فِى طُولِ الْمَحْشَرِ ثُمَّ هُمُ الَّذِينَ تتلقاهم اللَّهُ بِرَحْمَتِهِ فَهُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَذْهَبَ عَنَّا الْحَزَنَ
“যারা সৎকাজে এগিয়ে গেছে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে কোনরকম হিসেব-নিকেশ ছাড়াই। আর যারা মাঝপথে থাকবে তাদের হিসেব-নিকেশ হবে, তবে তা হবে হালকা। অন্যদিকে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে তাদেরকে হাশরের দীর্ঘকালীন সময়ে আটকে রাখা হবে, তারপর তাদেরকে আল্লাহর রহমতের মধ্যে নিয়ে নেয়া হবে এবং এরাই হবে এমনসব লোক যারা বলবে, সেই আল্লাহর শোকর যিনি আমাদের থেকে দুঃখ দূর করে দিয়েছেন।”
এ হাদীসে নবী কারীম সা.নিজেই এ আয়াতটির পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। এখানে ঈমানদারদের তিনটি শ্রেণীর পরিণাম আলাদা আলাদাভাবে তুলে ধরেছেন। মাঝখানে অবস্থানকারীদের “হালকা জবাবদিহির” সম্মুখীন হবার অর্থ হচ্ছে, কাফেরদেরকে তো তাদের কুফরীর শাস্তি ছাড়াও তাদের প্রত্যেকটি অপরাধ ও গোনাহের পৃথক শাস্তিও দেয়া হবে। কিন্তু এর বিপরীতে ঈমানদারদের মধ্যে যারা ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের কাজ নিয়ে হাজির হবে তাদের সৎ ও অসৎ কাজগুলোর সম্মিলিত হিসেব-নিকেশ হবে। প্রত্যেক সৎকাজের জন্য আলাদা পুরস্কার ও প্রত্যেক অসৎ কাজের জন্য আলাদা শাস্তি দেয়া হবে না। আর ঈমানদারদের মধ্যে থেকে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করবে তাদেরকে হাশরের সমগ্র সময়-কালে আটকে রাখা হবে-একথার অর্থ হচ্ছে এই যে, তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে না বরং তাদেরকে আদালতের কার্যকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত আটকে রাখার শাস্তি দেয়া হবে। অর্থাৎ হাশরের সমগ্র সময়-কাল (না জানি তা কত শত বছরের সমান দীর্ঘ হবে) তার পূর্ণ কঠোরতা সহকারে তাদের ওপর দিয়ে অতিক্রান্ত হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করবেন এবং আদালতের কাজ শেষ হবার সময় হুকুম দেবেন, ঠিক আছে, এদেরকেও জান্নাতে দিয়ে দাও। এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বিভিন্ন উক্তি মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সাহাবী যেমন, হযরত উমর রা., হযরত উসমান রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হযরত আয়েশা রা., হযরত আবু সাঈদ ধুদরী রা. এবং হযরত বারাআ ইবনে আজেব রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন। আর একথা বলা নিস্প্রয়োজন যে, সাহাবীগণ এহেন ব্যাপারে কোন কথা ততক্ষণ পর্যন্ত বলতে পারেন না। যতক্ষণ না তাঁরা নবী সা. এর মুখে তা শুনে থাকবেন।
কিন্তু এ থেকে একথা মনে করা উচিত নয় যে, মুসলমানদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে তাদেরকে কেবলমাত্র “আদালত সমাপ্তিকালীন” সময় পর্যন্ত আটকে রাখারই শাস্তি দেয়া হবে এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ জাহান্নামে যাবেই না। কুরআন ও হাদীসে বহুবিধ অপরাধের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এসব অপরাধকারীদের ঈমানও তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারবে না। যেমন যে মু’মিন কোন মু’মিনকে জেনে বুঝে হত্যা করে আল্লাহ নিজেই তার জন্য জাহান্নামের শাস্তি ঘোষণা করেছেন। অনুরূপভাবে উত্তরাধিকার আইনের আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা ভংগকারীদের জন্যও কুরআন মজীদে জাহান্নামের শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। সূদ হারাম হবার হুকুম জারী হবার পর যারা সূদ খাবে তাদের জন্য পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে, তারা আগুনের সাথি। এছাড়াও আরো কোন কোন কবীরাহ গোনাহকারীদের জন্যও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, তারা জাহান্নামে যাবে।
﴿وَقَالُوا۟ ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ ٱلَّذِىٓ أَذْهَبَ عَنَّا ٱلْحَزَنَ ۖ إِنَّ رَبَّنَا لَغَفُورٌۭ شَكُورٌ﴾
৩৪। এবং তারা বলবেঃ আল্লাহর শোকর, যিনি আমাদের দঃখ মোচন করেছেন।৫৮ অবশ্যই আমাদের রব ক্ষমাশীল ও গুণের সমাদরকারী,৫৯
৫৮. সব ধরনের দুঃখ। দুনিয়ায় যেসব চিন্তা ও পেরেশানীতে আমরা লিপ্ত ছিলাম তার হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া গেছে। কিয়ামতে নিজের পরিণাম সম্পর্কে যে দুশ্চিন্তা ছিল তাও খতম হয়ে যাবে এবং এখন সামনের দিকে অখণ্ড নিশ্চিন্ততা, সেখানে কোন প্রকার দুঃখ কষ্টের প্রশ্নই থাকে না।
৫৯. অর্থাৎ আমাদের অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং কর্মের যে সামান্যতম পুঁজি আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম তাকে বিপুল মর্যাদা ও মূল্যদান করে তার বিনিময়ে তাঁর জান্নাত আমাদের দান করেছেন।
﴿ٱلَّذِىٓ أَحَلَّنَا دَارَ ٱلْمُقَامَةِ مِن فَضْلِهِۦ لَا يَمَسُّنَا فِيهَا نَصَبٌۭ وَلَا يَمَسُّنَا فِيهَا لُغُوبٌۭ﴾
৩৫। যিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে স্থায়ী আবাসস্থল দিয়েছেন।৬০ এখন এখানে আমাদের না কোন কষ্ট হয় এবং না আসে কোন ক্লান্তি।৬১
৬০. অর্থাৎ দুনিয়া আমাদের আখেরাতের সফরের একটি মনযিল ছিল। এ মনযিলটি আমরা অতিক্রম করে চলে এসেছি। হাশরের ময়দানও এ সফরের একটি পর্যায় ছিল। এ পর্যায়ও আমরা পার হয়েছি। এখন আমরা এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছি যেখান থেকে বের হয়ে আর কোথাও যেতে হবে না।
৬১. অন্যকথায় আমাদের সমস্ত পরিশ্রম ও কষ্টের অবসান ঘটেছে। এখন এখানে আমাদের এমন কোন কাজ করতে হবে না যা করতে আমাদের পরিশ্রম করতে হবে এবং যা শেষ করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বো।
﴿وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَىٰ عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا۟ وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُم مِّنْ عَذَابِهَا ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِى كُلَّ كَفُورٍۢ﴾
৩৬। আর যারা কুফরী করেছে৬২ তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। না তাদের অস্তিত্ব খতম করে দেয়া হবে যাতে তারা মরে যাবে এবং না তাদের জন্য জাহান্নামের আযাব কিছু কমানো হবে। এভাবে আমি প্রত্যেক কুফরীকারীকে প্রতিফল দিয়ে থাকি।
৬২. অর্থাৎ আল্লাহ মুহাম্মাদ সা.এর ওপর যে কিতাব নাযিল করেছেন তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছে।
﴿وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَآ أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَـٰلِحًا غَيْرَ ٱلَّذِى كُنَّا نَعْمَلُ ۚ أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُم مَّا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَن تَذَكَّرَ وَجَآءَكُمُ ٱلنَّذِيرُ ۖ فَذُوقُوا۟ فَمَا لِلظَّـٰلِمِينَ مِن نَّصِيرٍ﴾
৩৭। তারা সেখানে চিৎকার করে করে বলবে “হে আমাদের রব! আমাদের এখান থেকে বের করে নাও, আমরা সৎকাজ করবো, আগে যে কাজ করতাম তা থেকে আলাদা।” (তাদেরকে জবাব দেয়া হবে এই বলে,) “আমি কি তোমাদের এতটুকু আয়ুষ্কাল দান করিনি যে সময়ে কেউ শিক্ষাগ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারতো?৬৩ আর তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসে গিয়েছিল। এখন স্বাদ আস্বাদন করো, জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।”
৬৩. এখানে এমন প্রত্যেকটি আয়ুষ্কালের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে মানুষ সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দের মধ্যে ফারাক করতে চাইলে করতে পারে এবং গোমরাহী ত্যাগ করে হিদায়াতের পথে পাড়ি দিতে চাইলেও দিতে পারে। এ বয়সে পৌঁছে যাবার আগে যদি কোন ব্যক্তি মরে গিয়ে থাকে তাহলে এ আয়াতের দৃষ্টিতে তাকে কোন প্রকার জবাবদিহি করতে হবে না। তবে যে ব্যক্তি এ বয়সে পৌঁছে গেছে তাকে অবশ্যই তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আর তারপর এ বয়স শুরু হয়ে যাবার পর যতদিন সে বেঁচে থাকবে এবং সতর্কতার সাথে সহজ-সরল পথে চলার জন্য যতই সুযোগ সে পেয়ে যেতে থাকবে ততই তার দায়িত্ব কঠিন হয়ে যেতে থাকবে। এমনকি যে ব্যক্তি বার্ধক্যে পৌঁছেও সোজা হবে না তার জন্য কোন ওজরই থাকবে না। একথাটিই একটি হাদীসে হযরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী নবী সা. থেকে বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ যে ব্যক্তি কম বয়স পাবে তার জন্য তো ওজরের সুযোগ থাকে কিন্তু ৬০ বছর এবং এর বেশী বয়সের অধিকারীদের জন্য কোন ওজর নেই। (বাখারী, আহমাদ, নাসায়ী, ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতেম ইত্যাদি)
﴿إِنَّ ٱللَّهَ عَـٰلِمُ غَيْبِ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۚ إِنَّهُۥ عَلِيمٌۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ﴾
৩৮। নিঃসন্দেহে আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত গোপন বিষয় অবগত, তিনি তো অন্তরের গোপন রহস্যও জানেন।
﴿هُوَ ٱلَّذِى جَعَلَكُمْ خَلَـٰٓئِفَ فِى ٱلْأَرْضِ ۚ فَمَن كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُهُۥ ۖ وَلَا يَزِيدُ ٱلْكَـٰفِرِينَ كُفْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ إِلَّا مَقْتًۭا ۖ وَلَا يَزِيدُ ٱلْكَـٰفِرِينَ كُفْرُهُمْ إِلَّا خَسَارًۭا﴾
৩৯। তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন।৬৪ এখন যে কেউ কুফরী করবে তার কুফরীর দায়ভার তার ওপরই পড়বে৬৫ এবং কাফেরদের কুফরী তাদেরকে এছাড়া আর কোন উন্নতি দান করে না যে, তাদের রবের ক্রোধ তাদের ওপর বেশী বেশী করে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং কাফেরদের জন্য ক্ষতিবৃদ্ধি ছাড়া আর কোন উন্নতি নেই।
৬৪. এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একঃ পূর্ববর্তী প্রজন্ম ও জাতিদের অতিবাহিত হওয়ার পর এই পৃথিবীর বুকে তিনি তোমাদেরকে তাদের জায়গায় স্থাপন করেছেন। দুইঃ তিনি পৃথিবীতে তোমাদেরকে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করার যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা তোমাদের এ জিনিসগুলোর মালিক হবার কারণে নয় বরং মূল মালিকের প্রতিনিধি হিসেবে তোমাদের এগুলো ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
৬৫. যদি পূর্বের বাক্যের এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে, তোমাদেরকে তিনি পূর্ববর্তী জাতিদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন তাহলে এ বাক্যটির অর্থ হবে, যারা অতীতের জাতিসমূহের পরিণাম থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং যে কুফরীর বদৌলতে জাতিসমূহ ধ্বংস হয়ে গেছে সেই একই কুফরী নীতি অবলম্বন করেছে তারা নিজেদের এ নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করবেই। আর যদি এ বাক্যটির এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে, আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করেছেন তাহলে এ বাক্যের অর্থ হবে, যারা নিজেদের প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা ভুলে গিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে বসেছে অথবা যারা আসল মালিককে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী করেছে তারা নিজেদের এ বিদ্রোহাত্মক কর্মনীতির অশুভ পরিণাম ভোগ করবে।
﴿قُلْ أَرَءَيْتُمْ شُرَكَآءَكُمُ ٱلَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَرُونِى مَاذَا خَلَقُوا۟ مِنَ ٱلْأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌۭ فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ أَمْ ءَاتَيْنَـٰهُمْ كِتَـٰبًۭا فَهُمْ عَلَىٰ بَيِّنَتٍۢ مِّنْهُ ۚ بَلْ إِن يَعِدُ ٱلظَّـٰلِمُونَ بَعْضُهُم بَعْضًا إِلَّا غُرُورًا﴾
৪০। (হে নবী!) তাদেরকে বলো, “তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের যেসব শরীককে ডাকো কখনো কি তোমরা তাদেরকে দেখেছো?৬৬ আমাকে বলো, তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে? অথবা আকাশসমূহে তাদের কি শরীকানা আছে?” (যদি একথা বলতে না পারো তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো) তাদেরকে কি আমি কোন কিতাব লিখে দিয়েছি যার ভিত্তিতে তারা (নিজেদের এ শিরকের জন্য) কোন সুস্পষ্ট প্রমাণপত্র লাভ করেছে?৬৭ না, বরং এ জালেমরা পরস্পরকে নিছক ধাপ্পা দিয়েই চলছে।৬৮
৬৬. “তোমাদের” শরীক শব্দ ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা তো আসলে আল্লাহর শরীক নয়, মুশরিকরা নিজেরাই তাদেরকে আল্লাহর শরীক বানিয়ে রেখেছে।
৬৭. অর্থাৎ আমার লেখা এমন কোন পরোয়ানা কি তাদের কাছে আছে যাতে আমি একথা লিখে দিয়েছি যে, অমুক অমুক ব্যক্তিকে আমি রোগ নিরাময় বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থান অথবা অভাবীদের অভাব পূরণ করার ক্ষমতা দিয়েছি কিংবা অমুক অমুক ব্যক্তিকে আমি আমার ভূপৃষ্ঠের অমুক অংশের কর্তৃত্ব দান করেছি এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকদের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার দায়িত্ব এখন তাদের হাতে কাজেই আমার বান্দাদের এখন তাদের কাছেই প্রার্থনা করা উচিত, তাদের কাছেই নজরানা ও মানত করা উচিত এবং যেসব নিয়ামতই তারা লাভ করে সেজন্য ঐ সব ছোট খোদাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। এ ধরনের কোন প্রমাণপত্র যদি তোমাদের কাছে থাকে তাহলে তা সামনে হাজির করো। আর যদি তা না থাকে তাহলে তোমরা নিজেরাই চিন্তা করো, এসব মুশরিকী আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মধারা তোমরা কিসের ভিত্তিতে উদ্ভাবন করেছো? তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, পৃথিবী ও আকাশে কোথাও তোমাদের এসব বানোয়াট উপাস্যদের আল্লাহর সাথে শরীক হবার কোন আলামত পাওয়া যায়? এর জবাবে তোমরা কোন আলামত চিহ্নিত করতে পারো না। তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আল্লাহ কি তাঁর কোন কিতাবে একথা বলেছেন অথবা তোমাদের কাছে বা ঐসব বানোয়াট উপাস্যদের কাছে আল্লাহর দেয়া এমন কোন পরোয়ানা আছে যা এ মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, তোমরা যেসব ক্ষমতা-ইখতিয়ার তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট করছো আল্লাহ নিজেই তাদেরকে সেগুলো দান করেছেন? তোমরা এটাও পেশ করতে পারো না। এখন যার ভিত্তিতে তোমরা এ আকীদা তৈরি করে নিয়েছো সেটি কি? তোমরা কি আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের মালিক, যার ফলে আল্লাহর ক্ষমতা ইখতিয়ার যাকে ইচ্ছা ভাগ বাটোয়ারা করে দিচ্ছো?
৬৮. অর্থাৎ এসব ধর্মীয় নেতা, পীর, পুরোহিত, গুরু, পণ্ডিত, মাশায়েখ ও দরগাহের খাদেম এবং এদের এজেন্টরা নিছক নিজেদের দোকানদারীর পসরা সাজিয়ে বসার জন্য জনসাধারণকে বোকা বানাচ্ছে এবং নানা গাল গল্প তৈরি করে লোকদেরকে মিথ্যা ভরসা দিয়ে চলছে যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে অমুক অমুক সত্তার শরণাপন্ন হলে তোমাদের দুনিয়ার সমস্ত কাজের সমাধা হয়ে যাবে এবং আখেরাতে তোমরা যতই গোনাহ নিয়ে হাজির হও না কেন তারা তা ক্ষমা করিয়ে নেবে।
﴿إِنَّ ٱللَّهَ يُمْسِكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ أَن تَزُولَا ۚ وَلَئِن زَالَتَآ إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍۢ مِّنۢ بَعْدِهِۦٓ ۚ إِنَّهُۥ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًۭا﴾
৪১। আসলে আল্লাহই আকাশ ও পৃথিবীকে অটল ও অনড় রেখেছেন এবং যদি তারা টলটলায়মান হয় তাহলে আল্লাহর পরে দ্বিতীয় আর কেউ তাদেরকে স্থির রাখার ক্ষমতা রাখে না।৬৯ নিঃসন্দেহে আল্লাহ বড়ই সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল।৭০
৬৯. অর্থাৎ আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত রাখার কারণেই এ সীমাহীন বিশ্ব-জাহান প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। কোন ফেরেশতা, জিন, নবী বা অলী একে ধরে রাখছে না। বিশ্ব-জাহানকে ধরে রাখা তো দূরের কথা এ অসহায় বান্দারা তো নিজেদেরকেই ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে না। প্রত্যেকেই নিজের জন্ম ও স্থায়িত্বের জন্য মহান সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাদের মধ্য থেকে কারো সম্পর্কে একথা মনে করা যে, আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারে তার কিছুটা অংশ আছে, নিছক বোকামী ও প্রতারণার শিকার হওয়া ছাড়া আর কি হতে পারে?
৭০. অর্থাৎ আল্লাহর সমীপে এত বড় গোস্তাখী করা হচ্ছে এবং এরপরও তিনি শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, এটা তাঁর নিছক সহনশীলতা ও ক্ষমাগুণের পরিচায়ক।
﴿وَأَقْسَمُوا۟ بِٱللَّهِ جَهْدَ أَيْمَـٰنِهِمْ لَئِن جَآءَهُمْ نَذِيرٌۭ لَّيَكُونُنَّ أَهْدَىٰ مِنْ إِحْدَى ٱلْأُمَمِ ۖ فَلَمَّا جَآءَهُمْ نَذِيرٌۭ مَّا زَادَهُمْ إِلَّا نُفُورًا﴾
৪২। তারা শক্ত কসম খেয়ে বলতো, যদি কোন সতর্ককারী তাদের কাছে আসতো তাহলে তারা দুনিয়ার প্রত্যেক জাতির তুলনায় বেশী সৎপথের অনুগামী হতো।৭১ কিন্তু যখন সতর্ককারী তাদের কাছে এলো তখন তার আগমন তাদের মধ্যে সত্য থেকে পলায়ন ছাড়া আর কোন জিনিষের বৃদ্ধি ঘটায়নি।
৭১. নবী সা.এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবের লোকেরা সাধারণভাবে এবং কুরাইশরা বিশেষভাবে ইহুদি ও খৃস্টানদের বিকৃত নৈতিক অবস্থা দেখে একথা বলতো। তাদের এ উক্তি ইতিপূর্বে সূরা আল আনআ’মেও (আয়াতঃ ১৫৬-১৫৭) উল্লেখিত হয়েছে এবং সামনে সূরা আস সাফফাতেও (আয়াতঃ ১৬৭-১৬৯) আসছে।
﴿ٱسْتِكْبَارًۭا فِى ٱلْأَرْضِ وَمَكْرَ ٱلسَّيِّئِ ۚ وَلَا يَحِيقُ ٱلْمَكْرُ ٱلسَّيِّئُ إِلَّا بِأَهْلِهِۦ ۚ فَهَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا سُنَّتَ ٱلْأَوَّلِينَ ۚ فَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ ٱللَّهِ تَبْدِيلًۭا ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ ٱللَّهِ تَحْوِيلًا﴾
৪৩। তারা পৃথিবীতে আরো বেশী অহংকার করতে থাকে এবং দুষ্ট চাল চালতে থাকে, অথচ দুষ্ট চাল তার উদ্যোক্তাদেরকেই ঘিরে ফেলে। এখন তারা কি পূর্বের জাতিদের সাথে আল্লাহ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তাদের সাথে অনুরূপ পদ্ধতিরই অপেক্ষা করছে?৭২ যদি একথাই হয়ে থাকে তাহলে তুমি আল্লাহর পদ্ধতিতে কখখনো কোন পরিবর্তন পাবে না এবং কখখনো আল্লাহর বিধানকে তার নির্ধারিত পথ থেকে হটে যেতেও তুমি দেখবে না।
৭২. অর্থাৎ আল্লাহর এ আইন এদের ওপরও জারি হয়ে যাবে। যে জাতি নিজের নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে তাকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দেয়া হবে।
﴿أَوَلَمْ يَسِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَيَنظُرُوا۟ كَيْفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَكَانُوٓا۟ أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةًۭ ۚ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُعْجِزَهُۥ مِن شَىْءٍۢ فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَلَا فِى ٱلْأَرْضِ ۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَلِيمًۭا قَدِيرًۭا﴾
৪৪। তারা কি পৃথিবীতে কখনো চলাফেরা করেনি, যার ফলে তারা তাদের পূর্বে যারা চলে গেছে এবং যারা তাদের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী ছিল তাদের পরিণাম দেখতে পেতো? আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে আল্লাহকে অক্ষম করে দেবার মতো কোন জিনিস নেই। তিনি সবকিছু জানেন এবং সব জিনিসের ওপর ক্ষমতাশালী।
﴿وَلَوْ يُؤَاخِذُ ٱللَّهُ ٱلنَّاسَ بِمَا كَسَبُوا۟ مَا تَرَكَ عَلَىٰ ظَهْرِهَا مِن دَآبَّةٍۢ وَلَـٰكِن يُؤَخِّرُهُمْ إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ مُّسَمًّۭى ۖ فَإِذَا جَآءَ أَجَلُهُمْ فَإِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِعِبَادِهِۦ بَصِيرًۢا﴾
৪৫। যদি কখনো তিনি লোকদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতেন তাহলে পৃথিবীতে কোন প্রাণসত্তাকে জীবিত ছাড়তেন না কিন্তু একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তিনি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছেন। তারপর যখন তাদের সময় পুরা হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে দেখে নেবেন।
— সমাপ্ত —