আল মায়িদাহ

নামকরণঃ

এ সূরার ১৫ রুকূর هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَن يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِّنَ السَّمَاءِ আয়াতে উল্লেখিত মা-য়েদাহ শব্দ থেকে এ নামকরণ করা হয়েছে। কুরআনের অধিকাংশ সূরার নামের মতো এ সূরার নামের সাথেও এর আলোচ্য বিষয়বস্তুর তেমন কোন সম্পর্ক নেই। নিছক অন্যান্য সূরা থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্যই একে এ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কালঃ

হোদাইবিয়ার সন্ধির পর ৬ হিজরীর শেষের দিকে অথবা ৭ হিজরীর প্রথম দিকে এ সূরাটি নাযিল হয়। সূরায় আলোচ্য বিষয় থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় এবং হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনাও এর সত্যতা প্রমাণ করে। ষষ্ঠ হিজরীর যিলকদ মাসের ঘটনা। চৌদ্দশ, মুসলমানকে সাথে নিয়ে নবী সা. উমরাহ সম্পন্ন করার জন্য মক্কায় উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু কুরাইশ কাফেররা শক্রতার বশবর্তী হয়ে আরবের প্রাচীনতম ধর্মীঁয় ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করে তাঁকে উমরাহ করতে দিল না। অনেক তর্ক বিতর্ক ও বাদানুবাদের পর তারা এতটুকু মেনে নিল যে, আগামী বছর আপনারা আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার জন্য্য আসতে পারেন। এ সময় একদিকে মুসলমানদেরকে কাবাঘর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করার নিয়ম কানুন বাতলে দেবার প্রয়োজন ছিল, যাতে পরবর্তী বছর পূর্ণ ইসলামী শান শওকতের সাথে উমরাহর সফর করা যায় এবং অন্য দিকে তাদেরকে এ মর্মে ভালভাবে তাকীদ করারও প্রয়োজন ছিল যে, কাফের শক্র দল তাদের উমরাহ করতে না দিয়ে যে বাড়াবাড়ি করেছে তার জবাবে তারা নিজেরা অগ্রবর্তী হয়ে যেন আবার কাফেরদের ওপর কোন অন্যায় বাড়াবাড়ি ও জুলুম না করে বসে। কারণ অনেক কাফের গোত্রকে হজ্জ সফরের জন্য মুসলিম অধিকারভুক্ত এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া আসা করতে হতো। মুসলমানদেরকে যেভাবে কাবা যিয়ারত করতে দেয়া হয়নি সেভাবে তারাও এ ক্ষেত্রে জোর পূর্বক এসব কাফের গোত্রের কাবা যিয়ারতের পথ বন্ধ করে দিতে পারতো। এ সূরার শুরুতে ভূমিকাস্বরূপ যে ভাষণটির অবতারণা করা হয়েছে সেখানে এ প্রসংগই আলোচিত হয়েছে। সামনের দিকে তের রুকূতে আবার এ প্রসংগটি উত্থাপিত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, প্রথম রুকূ থেকে নিয়ে চৌদ্দ রুকূ পর্যন্ত একই ভাষণের ধারাবাহিকতা চলছে। এ ছাড়াও এ সূরার মধ্যে আর যে সমস্ত বিষয়বস্তু আমরা পাই তা সবই একই সময়কার বলে মনে হয়।

বর্ণনার ধারাবাহিকতা দেখে মনে হয় এ সমগ্র সূরাটি একটি মাত্র ভাষণের অন্তরভুক্ত এবং সম্ভবত এটি একই সংগে নাযিল হয়েছে। আবার এর কোন কোন আয়াত পরবর্তীকালে পৃথক পৃথকভাবে নাযিল হতেও পারে এবং বিষয়বস্তুর একাত্মতার কারণে সেগুলোকে এ সূরার বিভিন্ন স্থানে জায়গা মতো জুড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্ণনার ধারাবাহিকতার মধ্যে কোথাও সামান্যতম শূন্যতাও অনুভূত হয় না। ফলে একে দু’টি বা তিনটি ভাষণের সমষ্টি মনে করার কোন অবকাশ নেই।

নাযিলের উপলক্ষঃ

আলে ইমরান ও আন নিসা সূরা দু’টি যে যুগে নাযিল হয় সে যুগ থেকে এ সূরাটির নাযিলের যুগে পৌঁছতে বিরাজমান পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে অনেক বড় রকমের পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। ওহোদ যুদ্ধের বিপর্যয় যেখানে মদীনার নিকটতম পরিবেশও মুসলমানদের জন্য বিপদসংকুল করে তুলেছিল। সেখানে এখন সম্পূর্ণ ভিন্নতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আরবে ইসলাম এখন একটি অজেয় ও অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র একদিকে নজ্‌দ থেকে সিরিয়া সীমান্ত এবং অন্যদিকে লোহিত সাগর থেকে মক্কার নিকট এলাকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। ওহোদে মুসলমানরা যে আঘাত পেয়েছিল তা তাদের হিম্মত ও সাহসকে দমিত এবং মনোবলকে নিস্তেজ করার পরিবর্তে তাদের সংকল্প ও কর্মোন্মদনার জন্য চাবুকের কাজ করেছিল। তারা আহত সিংহের মতো গর্জে ওঠে এবং তিন বছরের মধ্যে সমগ্র পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। তাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও আত্মদানের ফলে মদীনার চারদিকে দেড়শ, দুশ, মাইলের মধ্যে সমস্ত বিরোধী গোত্রের শক্তির দর্প চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মদীনার ওপর সবসময় যে ইহুদী বিপদ শকুনির মতো ডানা বিস্তার করে রেখেছিল তার অশুভ পাঁয়তারার অবসান ঘটেছিল চিরকালের জন্য। আর হিজাযের অন্যান্য যেসব জায়গায় ইহুদী জনবসতি ছিল সেসব এলাকা মদীনার ইসলামী শাসনের অধীনে এসে গিয়েছিল। ইসলামের শক্তিকে দমন করার জন্য কুরাইশরা সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল খন্দকের যুদ্ধে। এতেও তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। এরপর আরববাসীদের মনে এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহই রইলো না যে, ইসলামের ও আন্দোলনকে খতম করার সাধ্য দুনিয়ার আর কোন শক্তির নেই। ইসলাম এখন আর নিছক একটি আকীদা-বিশ্বাস ও আদর্শের পর্যায় সীমিত নয়। নিছক মন ও মস্তিষ্কের ওপরই তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত নয়। বরং ইসলাম এখন একটি পরাক্রান্ত রাষ্ট্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের সীমানায় বসবাসকারী সমস্ত অধিবাসীর জীবনের ওপর তার কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত। এখন মুসলমানরা এতটা শক্তির অধিকারী যে, যে চিন্তা ও ভাবধারার ওপর তারা ঈমান এনেছিল সে অনুযায়ী স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলার এবং সে চিন্তা ও ভাবধারা ছাড়া অন্য কোন আকীদা-বিশ্বাস, ভাবধারা, কর্মনীতি অথবা আইন-বিধানকে নিজেদের জীবন ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করতে না দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার তারা লাভ করেছিল।

তাছাড়া এ কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামী মূলনীতি ও দৃষ্টিভংগী অনুযায়ী মুসলমানদের নিজস্ব একটি কৃষ্টি ও সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছিল। এ সংস্কৃতি জীবনের যাবতীয় বিস্তারিত বিষয়ে অন্যদের থেকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তির অধিকারী ছিল। নৈতিকতা, স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, জীবন যাপন প্রণালী, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি যাবতীয় ক্ষেত্রে মুসলমানরা এখন অমুসলিমদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামী রাষ্ট্রের সমস্ত মুসলিম অধ্যুসিত জনপদে মসজিদ ও জামায়াতে সাথে নামায পড়ার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক জনবসতিতে ও প্রত্যেক গোত্রে একজন ইমাম নিযুক্ত রয়েছে। ইসলামের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন-কানুন অনেকটা বিস্তারিত আকারে প্রণীত হয়ে গেছে এবং মুসলমানদের নিজস্ব আদালতের মাধ্যমে সর্বত্র গেগুলো প্রবর্তিত হচ্ছে। লেনদেন ও কেনা –বেচা ব্যবসায় বাণিজ্যের পুরাতন রীতি ও নিয়ম রহিত তৈরী হয়ে গেছে। বিয়ে ও তালাকের আইন, শরয়ী পরদা ও অনুমতি নিয়ে অন্যের গৃহে প্রবেশের বিধান এবং যিনা ও মিথ্যা অপবাদের শাস্তি বিধান জারি হয়ে গেছে। এর ফলে মুসলমানদের সমাজ জীবন একটি বিশেষ ছাঁচে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। মুসলমানদের ওঠা, বসা, কথাবার্তা, পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবন যাপন ও বসবাস করার পদ্ধতিও একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে সমুজ্জল হয়ে উঠেছে। এভাবে ইসলামী জীবন একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করার এবং মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও তামাদ্দুন গড়ে ওঠার পর, তারা যে আবার কোন দিন অমুসলিম সমাজের সাথে মিলে একাত্ম হয়ে যেতে পারে। তেমনটি আশা করা তৎকালীন অমুসলিম বিশ্বের পক্ষে আর সম্ভবপর ছিল না।

হোদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদিত হবার পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধক ছিল এই যে, কুরাইশ কাফেরদের সাথে তাদের ক্রমাগত যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও সংঘাত লেগেই ছিল। নিজেদের ইসলামী দাওয়াতে সীমানা বৃদ্ধি ও এর পরিসর প্রশস্ত করার জন্য অবকাশই তারা পাইনি। হোদাইবিয়ার বাহ্যিক পরাজয় ও প্রকৃত বিজয় এ বাধা দূর করে দিয়েছিল। এর ফলে কেবল নিজেদের রাষ্ট্রীয় সীমায়ই তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে পায়নি এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের দাওয়াত বিস্তৃত করার সুযোগ এবং অবকাশও লাভ করেছিল। নবী সা. এ কাজটিরই উদ্ধোধন করলেন ইরান, রোম মিসর ও আরবের বাদশাহ ও রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে পত্র লেখার মাধ্যমে। এ সাথে ইসলাম প্রচারকবৃন্দ মানুষকে আল্লাহর দীনের দিকে আহবান জানাবার জন্য বিভিন্ন গোত্র এ কওমের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেন।

আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

এ ছিল সূরা আল মায়িদাহ নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট। নিম্নলিখিত তিনটি বড় বড় বিষয় এ সূরাটির অন্তরভুক্তঃ

একঃ মুসলমানদের ধর্মীয়, তামাদ্দুনিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আরো কিছু বিধি নির্দেশ। এ প্রসংগে হজ্জ সফরের রীতি-পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। ইসলামী নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং কাবা যিয়ারতকারীদেরকে কোন প্রকার বাধা না দেবার হুকুম দেয়া হয়। পানাহার দ্রব্য সামগ্রীর মধ্যে হালাল ও হারামের চূড়ান্ত সীমা প্রবর্তিত হয়। জাহেলী যুগের মনগড়া বাধা নিষেধগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়। আহলী কিতাবদের সাথে পানাহার ও তাদের মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়। অযু, গোসল ও তায়াম্মুম করার রীতি পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। বিদ্রোহ ও অরাজকতা সৃষ্টি এবং চুরি-ডাকাতির শাস্তি প্রবর্তিত হয়। মদ ও জুয়াকে চূড়ান্তভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়। কসম ভাঙার কাফ্‌ফারা নির্ধারিত হয়। সাক্ষ্য প্রদান আইনের আরো কয়েকটি ধারা প্রবর্তন করা হয়।

দুইঃ মুসলমানদেরকে উপদেশ প্রদান। এখন মুসলমানরা একটি শাসক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে যাওয়ায় তাদের হাতে ছিল শাসন শক্তি। এর নেশায় বহু জাতি পথভ্রষ্ট হয়। মজলুমীর যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছিল এবং তার চাইতে অনেকে বেশী কঠিন পরীক্ষার যুগে মুসলমানরা পদার্পণ করেছিল। তাই তাদেরকে সম্বোধন করে বারবার উপদেশ দয়া হয়েছেঃ ন্যায়, ইনসাফ ও ভারসাম্যের নীতি অবলম্বন করো। তোমাদের পূর্ববর্তী আহ্‌লী কিতাবদের মনোভাব ও নীতি পরিহার করো। আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর হুকুম ও আইন কানুন মেনে চলার যে অংগীকার তোমরা করেছো তার ওপর অবিচল থাকো। ইহুদী ও খৃস্টানদের মতো তার সীমালংঘন করে তাদের মতো একই পরিণতির শিকার হয়ো না। নিজেদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালার জন্য কিতাবের অনুসরণ করো। মুনাফিকী নীতি পরিহার করো।

তিনঃ ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে উপদেশ প্রদান। এ সময় ইহুদীদের শক্তি খর্ব হয়ে গেছে। উত্তর আরবের প্রায় সমস্ত ইহুদী জনপদ মুসলমানদের পদানত। এ অবস্থায় তাদের অনুসৃত ভ্রান্ত নীতি সম্পর্কে তাদেরকে আর একবার সর্তক করে দেয়া হয়। তাদেরকে সত্য-সঠিক পথে আসার দাওয়াত দেয়া হয়। এ ছাড়া যেহেতু হোদায়বিয়ার চুক্তির কারণে সমগ্র আরবে ও আশপাশের দেশগুলোয় ইসলামের দাওয়াত প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তাই খৃস্টানদেরকেও ব্যাপকভাবে সম্বোধন করে তাদের বিশ্বাসের ভ্রান্তিগুলো জানিয়ে দেয়া হয় এবং শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনার জন্য তাদেরকে আহবান জানানো হয়। যেসব প্রতিবেশী দেশে মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসক জাতির বসবাস ছিল সেসব দেশের অধিবাসীদেরকে সরাসরি সম্বোধন করা হয়নি। কারণ ইতিপূর্বে তাদের সমমনা আরবের মুশরিকদেরকে সম্বোধন করে মক্কায় যে হেদায়াত নাযিল হয়েছিল তা-ই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ ۚ أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ ۗ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ﴾

হে ঈমানদারগণ! বন্ধনগুলো পরোপুরি মেনে চলো তোমাদের জন্য চতুষ্পদ গৃহপালিত পশু জাতীয় সব পশুই হালাল করা হয়েছে তবে সামনে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের জানানো হবে সেগুলো ছাড়া কিন্তু ইহ্‌রাম বাধাঁ অবস্থায় শিকার করা নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়ো না নিসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন 

১. অর্থাৎ এ সূরায় তোমাদের প্রতি যে সমস্ত নীতি-নিয়ম ও বিধি-বিধান আরোপ করা হচ্ছে এবং সাধারণভাবে আল্লাহর শরীয়াত যেগুলো তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি, সেগুলো মেনে চলো ভূমিকা স্বরূপ এ ছোট্ট একটি বাক্যের অবতারণা করার পর এবার সে বাঁধনগুলোর বর্ণনা শুরু হচ্ছে যেগুলো মেনে নেবার হুকুম দেয়া হয়েছে

২. মূল শব্দ হচ্ছে, বাহীমাতুল আনআন আনআ’মশব্দটি বললে আরবী ভাষায় উট, গরু, ছাগল ও ভেড়া বুঝায় আর ‍‍‍‍‍‍‌‌‌‌‍‍‍‍‍“বাহীমাবলতে প্রত্যেক বিচরণশীল চতুষ্পদ জন্তু বুঝানো হয় যদি আল্লাহ বলতেন, “আনআ’মতোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে, তাহলে এর ফলে কেবলমাত্র আরবীতে যে চারটি জন্তকে আনআ’ম বলা হয় সে চারটি জন্তুই হালাল হতো কিন্তু আল্লাহ বলেছেনঃ গৃহপালিত পশু পর্যায়ের বিচরণশীল চতুষ্পদ প্রাণী তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে এর ফলে নিদের্শটি ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং গৃহপালিত গবাদি পশু পর্যায়ের সমস্ত বিচরণশীল চতুষ্পদ প্রাণী এর আওতায় এসে গেছে অর্থাৎ যাদের শিকারী দাঁত নেই, যারা জান্তব খাদ্যের পরিবর্তে উদ্ভিজ্জ খাদ্য খায় এবং অন্যান্য প্রাণীগত বৈশিষ্টের ক্ষেত্রে আরবের আনআ’ম‘- এর সাথে সাদৃশ্য রাখে এ সংগে এখানে এ ইংগিতও পাওয়া যায় যে, গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুর বিপরীতধর্মী যে সমস্ত পশুর শিকারী দাঁত আছে এবং অন্য প্রাণী শিকার করে খায়, সেসব পশু হালাল হয় এ ইংগিতটিকে সুস্পষ্ট করে হাদীসে নবী সা. পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, শিকারী হিংস্র প্রাণী হারাম অনুরূপভাবে নবী সা. এমন সব পাখিকেও হারাম গণ্য করেছেন যাদের শিকারী পাঞ্জা আছে, অন্য প্রাণী শিকার করে খায় বা মৃত খায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেনঃ

نهَى رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم عن أكلِ كلِّ ذي نابٍ من السِّباعِ وعن كلِّ ذي مِخلَبٍ من الطَّيرِ

নবী সা. শিকারী দাঁত সম্পন্ন প্রত্যেকটি পশু এবং নখরধারী ও শিকারী পাঞ্জা সম্পন্ন প্রত্যেকটি পাখি আহার করতে নিষেধ করেছেনএর সমর্থনে অন্যান্য বহু সংখ্যক সাহাবীর হাদীসও বর্ণিত হয়েছে

. কাবাঘর যিয়ারত করার জন্য যে ফকিরী পোশাক করা হয় তাকে বলা হয় ইহরামকবার চারদিকে কয়েক মনযিল দূরত্বে একটি করে সীমানা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে কোন যিয়ারতকারীর নিজের সাধারণ পোশাক বদলে ইহরামের পোশাক পরিধান না করে এ সীমানাগুলো পার হয়ে এগিয়ে আসার অনুমতি নেই এ পোশাকের মধ্যে থাকে কেবল মাত্র একটি সেলাই বিহীন লুংগী ও একটি চাদর চাদরটি দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ ঢাকা হয় একে ইহরাম বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এ পোশাপ পরিধান করার সাথে সাথে মানুষের জন্য এমন অনেক কাজ হারাম হয়ে যায় যেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় তার জন্য হালাল ছিল যেমন ক্ষৌরকার্য করা, সুগন্ধি ব্যবহার, সবধরনের সাজসজ্জা, সৌন্দর্য চর্চা, যৌনাচার ইত্যাদি এ অবস্থায় কোন প্রাণী হত্যা করা যাবে না, শিকার করা যাবে না এবং শিকারের খোঁজও দেয়া যাবে না এগুলোও এ বিধিনিষেধের অন্তরভুক্ত

. অর্থাৎ আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক তিনি নিজের ইচ্ছেমতো যে কোন হুকুম দেবার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন তাঁর নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে কোন প্রকার উচ্চবাচ্য করার বা আপত্তি জানানোর কোন অধিকার মানুষের নেই তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়নীতি ও কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার মুসলিম যুক্তিসংগত, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর বলেই তার আনুগত্য করে না বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর হুকুম বলেই তার আনুগত্য করে যে জিনিসটি তিনি হারাম করে দিয়েছেন তা কেবল তাঁর হারাম করে দেবার কারণেই হারাম হিসেব গণ্য আর ঠিক তেমনিভাবে যে জিনিসটি তিনি হালাল করে দিয়েছেন সেটির হালাল হবার পেছনে অন্য কোন কারণ নেই বরং যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এসব জিনিসের মালিক তিনি নিজের দাসদের জন্য এ জিনিসটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলে এটি হালাল তাই কুরআন মজীদ সর্বোচ্চ বলিষ্ঠতা সহকারে এ মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কোন বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য সর্বশক্তিমান প্রভুব আল্লাহর অনুমোদন ও অননুমোদন ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ভিত্তির আদৌ কোন প্রয়োজন নেই অনুরূপভাবে আল্লাহ যে কাজটিকে বৈধ গণ্য করেছেন সেটি বৈধ এবং যেটিকে অবৈধ গণ্য করেছেন সেটি অবৈধ, এ ছাড়া মানুষের জন্য কোন কাজের বৈধ ও অবৈধ হবার দ্বিতীয় কোন মানদণ্ড নেই

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحِلُّوا شَعَائِرَ اللَّهِ وَلَا الشَّهْرَ الْحَرَامَ وَلَا الْهَدْيَ وَلَا الْقَلَائِدَ وَلَا آمِّينَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّن رَّبِّهِمْ وَرِضْوَانًا ۚ وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا ۚ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ أَن صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَن تَعْتَدُوا ۘ وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ﴾

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য ও ভক্তির নিদর্শনগুলোর অমর্যাদা করো না হারাম মাসগুলোর কোনটিকে হালাল করে নিয়ো না কুরবানীর পশুগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করো না যেসব পশুর গলাল আল্লাহর জন্য উৎর্গীত হবার আলামত স্বরূপ পট্টি বাঁধা থাকে তাদের ওপরও হস্তক্ষেপ করো না আর যারা নিজেদের রবের অনুগ্রহ ও তাঁর সন্তুষ্টির সন্ধানে সম্মানিত গৃহের (কাবা) দিকে যাচ্ছে তাদেরকেও উত্যক্ত করো না হাঁ, ইহরামের অবস্থা শেষ হয়ে গেলে আবশ্যি তোমরা শিকার করতে পারো আর দেখো, একটি দল তোমাদের জন্য মসজিদুল হারামের পথ বন্ধ করে দিয়েছে, এ জন্য তোমাদের ক্রোধ যেন তোমাদেরকে এতখানি উত্তেজিত না করে যে, তাদের বিরুদ্ধে তোমরা অবৈধ বাড়াবাড়ি করতে শুরু করো নেকী ও আল্লাহভীতির সমস্ত কাজে সবার সাথে সহযোগীতা করো এবং গুনাহ ও সীমালংঘনের কাজে কাউকে সহযোগীতা করো না আল্লাহকে ভয় করো তাঁর শাস্তি বড়ই কঠোর  

. যে জিনিসটি কোন আকীদা-বিশ্বাস, মতবাদ, চিন্তাধারা, চিন্তাধারা, কর্মনীতি বা কোন ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে তাকে তার শেআর বলা হয় কারণ সেটি তার আলামত, নিদর্শন বা চিহ্নের কাজ করে সরকারী পতাকা, সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রভৃতির ইউনিফরম, মুদ্রা, নোট ও ডাকটিকিট সরকারেরর শেআর” বা নিশানীর অন্তরভুক্ত সরকার নিজের বিভিন্ন বিভাগের কাছে বরং তার অধীনস্থ সকলের কাছে এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দাবী জানায় গীর্জা, ফাঁসির মঞ্চ ও ক্রুশ খৃস্টবাদের শেআর বা নিশানী টিকি, পৈতা ও মন্দির ব্রাহ্মণ্যবাদের নিশানী ঝুঁটি চুল, হাতের বালা ও কৃপাণ ইত্যাদি শিখ ধর্মের নিশানী হাতুড়ি ও কাস্তে সমাজতন্ত্রের নিশানী স্বস্তিকা আর্য বংশ-পূজার নিশানী এ ধর্ম বা মতবাদগুলো তাদের নিজেদের অনুসারীদের কাছে এ নিদর্শনগুলোর প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের দাবী করে যদি কোন ব্যক্তি কোন ব্যবস্থার নিশানীসমূহের মধ্য থেকে কোন একটি নিশানীর অবমাননা করে, তাহলে এটি মূলত তার ঐ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করার আলামত হিসেবে বিবেচিত হয় আর ঐ অবমাননাকারী নিজে যদি ঐ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত হয়, তাহলে তার এ কাজটি তার নিজের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তার থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার সমার্থক বলে গণ্য হয়

شَعَائِرَ “শাআইর” হচ্ছে  شَعَار “শেআর” শব্দের বহুবচন  شَعَائِرَ اللَّهِ “শাআইরুল্লাহ” বলতে এমন সব আলামত বা নিশানী বুঝায় যা শিরক, কুফরী ও নাস্তিক্যবাদের পরিবর্তে নির্ভেজাল আল্লাহ আনুগত্য সূচক মতবাদের প্রতিনিধিত্ব করে এ ধরনের আলামত ও চিহ্ন যেখানে যে মতবাদ ও ব্যবস্থার মধ্যে পাওয়া যাবে, প্রত্যেক মুসলমানকে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে তবে সেখানে শর্ত হচ্ছে তাদের মনস্তাত্বিক পটভূমিতে নির্ভেজাল আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের মানসিকতা বিরাজ করা চাই এবং সকল প্রকার মুশরিকী ও কুফরী চিন্তার মিশ্রণ থেকে তাদের মুক্ত হওয়া চাই কোন ব্যক্তি, সে কোন অমুসলিম হলেও, যদি তার নিজের বিশ্বাস ও কর্মের মধ্যে এক আল্লাহর আরাধনা ও ইবাদাতের কোন অংশ থেকে থাকে তাহলে অন্তত সেই অংশে মুসলমানদের উচিত তার সাথে একাত্ম হওয়া এবং সেই অধ্যায়ে তার যে সমস্ত শেআ’র” নির্ভাজাল আল্লাহর ইবাদাত উপসনার আলামত হিসেবে বিবেচিত হবে সেগুলোর প্রতিও পূর্ণ মর্যাদা প্রদর্শন করা এ বিষয়ে তার ও আমাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই বরং সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্য আছে সে আল্লাহর বন্দেগী করে কেন, এটা বিরোধের বিষয় নয় বরং বিরোধের বিষয় হচ্ছে এই যে আল্লাহর বন্দেগীর সাথে সে অন্য কিছুর বন্দেগীর মিশ্রণ ঘটাচ্ছে কেন?

মনে রাখতে হবে, আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এ নির্দেশ এমন এক সময় দেয়া হয়েছিল যখন আরবে মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল মক্কা ছিল মুশরিকদের দখলে আরবের প্রত্যক এলাকা থেকে মুশরি গোত্রের লোকেরা হজ্জ ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কাবাগৃহের দিকে আসতো এ জন্য অনেক গোত্রকে মুসলমানদের এলাকা অতিক্রম করতে হতো তখন মুসলমানদেরকে নিদের্শ দেয়া হয়েছিল, তারা মুশরিক হলেও এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও তারা যখন আল্লাহর ঘরের দিকে যাচ্ছে তখন তাদেরকে বাধা দিয়ো না হজ্জের মাসগুলোয় তাদের ওপর আক্রমণ করো না এবং আল্লাহর সমীপে নজরানা পেশ করার জন্য যে পশুগুলো তারা নিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করো না কারণ তাদের বিকৃত ধর্মে আল্লাহর আরাধনার যতটুকু অংশ বাকি রয়ে গেছে তা অবশ্যি সম্মন লাভের যোগ্য, অসম্মান লাভের নয়

. আল্লাহর নিশাণীসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সাধারণ নির্দেশ দেবার পর কয়েকটি নিশানীর নাম উল্লেখ করে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কারণ তৎকালীন যুদ্ধাবস্থার দরুন মুসলামনদের হাতে ঐগুলোর অবমাননা হবার আশংকা দেখা দিয়েছিল এ কয়েকটি নিশানীর নাম উল্লেখ করার অর্থ এ নয় যে, কেবল এ ক’টিই মর্যাদা যোগ্য

. ইহ্‌রামও আল্লাহর একটি অন্যতম নিশানী এ ব্যাপারে যে বিধিনষেধগুলো আরোপিত হয়েছে তার মধ্যে থেকে কোন একটি ভংগ করার অর্থই হচ্ছে ইহ্‌রামের অবমাননা করা তাই আল্লাহর নিশানী প্রসংগে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, যতক্ষণ তোমরা ইহ্‌রাম বাঁধা অবস্থায় থাকো ততক্ষণ শিকার করা আল্লাহর ইবাদাতের নিশানীগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি নিশানীল অবমাননা বুঝাবে তবে শরীয়াতের বিধি অনুযায়ী ইহ্‌রামের সীমা খতম হয়ে গেলে তোমাদের শিকার করার অনুমতি আছে

. যেহেতু কাফেররা সে সময় মুসলমানদেরকে কাবা ঘরের যিয়ারতের বাধা দিয়েছিল এবং আরবের প্রাচীন রীতির বিরুদ্ধাচরণ করে মুসলমানদেরকে হজ্জ থেকেও বঞ্চিত করেছিল, তাই মুসলমানদের মনে এ চিন্তার উদয় হলো যে, যেসব কাফের গোত্রকে কাবা যাবার জন্য মুসলিম অধ্যুসিত এলাকার কাছ দিয়ে যেতে হয়, তাদের হজ্জযাত্রার পথ তারা বন্ধ করে দেবে এবং হজ্জের মওসুমে তাদের কাফেলার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাবে কিন্তু এ আয়াত নাযিল করে আল্লাহর তাদেরকে এ সংকল্প থেকে বিরত রাখলেন

﴿حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ۚ ذَٰلِكُمْ فِسْقٌ ۗ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ ۚ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾

তোমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়াছে মৃতজীব, রক্ত, শূকরের গোশ্‌ত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নামে যবেহকৃত জীব১০ এবং কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে, আহত হয়ে, ওপর থেকে পড়ে গিয়ে বা ধাক্কা খেয়ে মরা অথবা কোন হিংস্র প্রাণী চিরে ফেলেছে এমন জীব, তোমরা জীবিত পেয়ে যাকে যবেহ করে দিয়েছো সেটি ছাড়া১১ আর যা কোন বেদীমূলে১২ যবেহ করা হয়েছে (তাও তোমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে)১৩ এ ছাড়াও শর নিক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নির্ণয় করাও তোমাদের জন্য জায়েয নয়১৪ এগুলো ফাসেকীর কাজ আজ তোমাদের দীনের ব্যাপারে কাফেররা পুরোপুরি নিরাশ হয়ে পড়েছে কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো১৫ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি (কাজেই তোমাদের ওপর হালাল ও হারামের যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা মেনে চলো)১৬ তবে যদি কোন ব্যক্তি ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য হয়ে ঐগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি জিনিস খেয়ে নেয় গুনাহের প্রতি কোন আকর্ষণ ছাড়াই, তাহলে নিসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী১৭ 

. অর্থাৎ যে পশুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে

১০. অর্থাৎ যাকে যবেহ করার সময় আল্লাহর ছাড়া আর কারোর নাম নেয়া হয় অথবা যাকে যবেহ করার আগে এ মর্মে নিয়ত করার হয় যে, অমুক মহাপুরুষ অথবা অমুক দেবী বা দেবতার নামে উৎসর্গীত (সূরা আল বাকারাহ-এর ১৭১ টীকা দেখুন)

১১. অর্থাৎ যে প্রাণীটি উপরোক্ত দুঘটনাগুলোর শিকার হবার পরও মরেনি বরং তার মধ্যে জীবনের কিছু আলামত পাওয়া যায় তাকে যবেহ করলে তার গোশ্‌ত খাওয়া যেতে পারে এ থেকে একথাও জানা যায় যে, হালাল প্রাণীর গোশ্‌ত একমাত্র যবেহর মাধ্যমে হালাল হয় একে হালাল করার আর দ্বিতীয় কোন সঠিক পথ নেই‌’যবেহযাকাতইসলামের একটি বিশেষ পরিভাষা এর অর্থ হচ্ছে, গলার এতখানি অংশ কেটে দেয়া যার ফলে শরীরের সমস্ত রক্ত ভালভাবে বের হয়ে যেতে পারে এক কোপে কেটে বা গলায় ফাঁস দিয়ে অথবা অন্য কোনভাবে প্রাণী হত্যা করলে যে ক্ষতিটা হয় তা হচ্ছে এই যে, এর ফলে রক্তের বেশীর ভাগ অংশ তার শরীরেরর মধ্যে আটকে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমে গিয়ে তা গোশ্‌তের সাথে মিশে যায় অন্য দিকে যবেহ করলে মস্তিকের সাথে শরীরের সম্পর্ক দীর্ঘ সময় বজায় থাকে এর ফলে প্রতিটি শিরা উপশিরা থেকে রক্ত নিংড়ে বেরিয়ে আসে এভাবে সারা দেহের গোশ্‌ত রক্তশূণ্য হয়ে যায় রক্ত হারাম একথা আগেই বলা হয়েছে কাজেই গোশ্‌তের পাক ও হালাল হবার জন্য অবশ্যি তার পুরোপুরি রক্তশূন্য হওয়া অপরিহার্য

১২. আসলে নুসুবশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এ থেকে এমন সব স্থান বুঝায় যেগুলোকে লোকেরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর উদ্দেশ্যে বলিদান ও নজরানা পেশ করার জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে সেখানে কোন পাথর বা কাঠের মুর্তি থাক বা না থাক তাতে কিছু আসে যায় না আমাদের ভাষায় এরি সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে বেদী বা আস্তানা কোন মহাপুরুষ, কোন দেবতা বা মুশরিকী আকীদার সাথে এ স্থানটি জড়িত থাকে

১৩. এখানে একথাটি ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, পানাহারযোগ্য দ্রব্যাদির মধ্যে শরীয়াত যেগুলোকে হালাল ও হারাম বলে দিয়েছে সেগুলোর হালাল ও হারাম হবার মূল ভিত্তি তাদের ভেষজ উপকারিতা ও অনুপকারিতা নয় বরং তাদের নৈতিক লাভ ও ক্ষতিই এর ভিত্তি প্রাকৃতিক বিষয়গুলোকে আল্লাহ মানুষের নিজের প্রচেষ্টা, সাধনা, অনুসন্ধান ও গবেষণার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন জীব ও জড় পদার্থগুলোর মধ্যে কোনটি মানুষের দেহে সুখাদ্যের যোগান দিতে পারে এবং কোনটি খাদ্য হিসেবে তার জন্য ক্ষতিকর ও অনুপকারীর তার উদ্ভাবন ও নির্ণয় করার দায়িত্ব মানুষের নিজের ওপর বর্তায় এসব বিষয়ে তাকে পথনির্দেশ দেবার দায়িত্ব শরীয়াত নিজের কাঁধে তুলে নেয় নি এ দায়িত্ব যদি শরীয়াত নিজের কাঁধে তুলে নিতো তাহলে সর্বপ্রথম বিষহারাম বলে ঘোষণা করতো কিন্তু আমরা দেখি কুরআন ও হাদীসের কোথাও এর অথবা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর অন্যান্য মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের আদৌ কোন উল্লেখই নেই শরীয়াত খাদ্যের ব্যাপারে যে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে তা হচ্ছে এই যে, কোন খাদ্যটি মানুষের নৈতিকতার ওপর কি প্রভাব বিস্তার করে, আত্মার পবিত্রতার জন্য কোন খাদ্যটি কোন পর্যায়ভুক্ত এবং খাদ্য সংগ্রহের পদ্ধতিগুলো মধ্য থেকে কোন পদ্ধতিটি বিশ্বাস ও প্রকৃতিগত দিক দিয়ে ভুল বা নির্ভুল? যেহেতু এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাবার সাধ্য মানুষের নেই এবং এ অনুসন্ধান চালাবার জন্য যে উপায় উপকরেণর প্রয়োজন তাও মানুষের আয়ত্বের বাইরে আর এ জন্য এসব ব্যাপারে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল করে বসেছে, তাই শরীয়াত কেবলমাত্র এসব বিষেয়ই তাকে পথনির্দেশ দেয় যেগুলোকে সে হারাম গণ্য করেছে, সেগুলোকে হারাম করার কারণ হচ্ছে এই যে, মানুষের নৈতিক বৃত্তির ওপর সেগুলোর খারাপ প্রভাব পড়ে বা সেগুলো তাহারাতও পবিত্রতা বিরোধী অথবা কোন খারাপ আকীদার সথে সেগুলোর সম্পর্ক রয়েছে পক্ষান্তরে যে জিনিসগুলোকে শরীয়াত হালাল গণ্য করেছে সেগুলোর হালাল হবার কারণ হচ্ছে এই যে, উপরোল্লিখিত দোষগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি দোষেও সেগুলো দুষ্ট নয়

প্রশ্ন করা যেতে পারে, এ জিনিসগুলোর হারাম হবার কারণ আল্লাহ আমাদের বুঝাননি কেন? কারণ বুঝিয়ে দিলে তো আমরা যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারতাম এর জবাব হচ্ছে, আমাদের পক্ষে ঐ কারণগুলো অনুধাবন করা সম্ভব নয় যেমন রক্ত, শূকরের গোশ্‌ত বা মৃত জীব খেলে আমাদের নৈতিক বৃত্তিতে কোন ধরনের দোষ, কতটুকু এবং কি পরিমাণে দেখা দেয়, সে সম্পর্কে কোন প্রকার অনুসন্ধান চালাবার কোন ক্ষমতাই আমাদের নেই কারণ নৈতিকতা পরিমাপ করার কোন উপকরণ আমাদের আয়ত্বাধীন নয় ধরুন যদি এদের খারাপ প্রভাব বর্ণনা করে দেয়াও হতো, তাহলেও সংশয় পোষণাকরীরা প্রায় সে একই জায়গায় থাকতেন যেখানে বর্তমানে অবস্থান করছেন কারণ এ বর্ণনা ভুল না নির্ভুল, তা সে পরিমাপ করবে কিসের সাহায্যে? তাই মহান আল্লাহ হালাল ও হারামের সীমানা মেনে চলাকে ঈমানের ওপর নির্ভরশীল করে দিয়েছেন যে ব্যক্তি মেনে নেবে যে, কুরআন আল্লহরই কিতাব, মুহাম্মাদ সা. আল্লারই রাসূল এবং আল্লাহকে সর্বজ্ঞ ও সবচেয়ে জ্ঞানী ও কুশলী বলের স্বীকার করবে সে তাঁর নির্ধারিত সীমানা অবশ্যই মেনে চলবে এর কারণ বোধগম্য হোক বা না হোক তার পরোয়া সে করবে না আর যে ব্যক্তি এ মৌলিক আকীদাটির ব্যাপারেই নিসংশয় নয় তার জন্য যেসব জিনিসের ক্ষতিকর বিষয় মানুষের জ্ঞানে ধরা পড়েছে কেবল মাত্র সেগুলো থেকে দূরে থাকা এবং যেগুলোর ক্ষতিকর বিষয় মানুষের জ্ঞানে ধরা পড়তে পারেনি সেগুলোর ক্ষতি দুর্ভোগ পোহাতে থাকা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই

১৪. এ আয়াতে যে জিনিসটি হারাম করা হয়েছে দুনিয়ায় তার তিনটি সংস্কারণ প্রচলিত আছে আয়াতে ঐ তিনটিকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে

একঃ মুশরিকদের মতো করে ‌‌‌’ফালগ্রহণ করা এতে কোন বিষয়ে দেব-দেবীর কাছে ভাগ্যের ফায়সালা জানার জন্য জিজ্ঞেস করা হয় অথবা গায়েবের-অজানার ও অদৃশ্যের খবর জিজ্ঞেস করা হয় বা পারস্পারিক বিবাদ মীমাংসা করে নেয়া হয় মক্কার মুশরিকরা কাবা ঘরে রক্ষিত হুবলদেবতার মূর্তিকে এ কাজের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিল তার দেবীমূলে সাতটি তীর রাখা হয়েছিল সেগুলোর গায়ে বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য খোদাই করা ছিল কোন কাজ করার বা না করার প্রশ্নে দোদুল্যমানতা দেখা দিলে, হারানো জিনিসের সন্ধান লাভ করতে চাইলে বা হত্যা মামলার ফায়সালা জানতে চাইলে, মোট কথা যেকোন কাজের জন্যই হুবল-এর তীর রক্ষকের কাছে যেতে হতো, সেখানে নজরানা পেশ করতে হতো এবং হুবল-এর কাছে এ মর্মে প্রার্থনা করা হতো, “আমাদের এ ব্যাপারটির ফায়সালা করে দিনএরপর তীর রক্ষক তার কাছে রক্ষিত তীলগুলোর সাহায্যে ফালবের করতো এতে যে তীরটিই বের হয়ে আসতো, তার গায়ে লিখিত শব্দকেই হুবল-এর ফায়সালা মনে করা হতো

দুইঃ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ফাল গ্রহণ এ ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা ও জ্ঞান-বুদ্ধির সাহায্যে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের মীমাংসার পরিবর্তে কোন প্রকার কুসংস্কার ও অমূলক ধারণা-কল্পনা বা কোন আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে কোন বিষয়ের মীমাংসা করা হয় অথবা এমন সব উপায়ে ভাগ্যের অবস্থা জানবার চেষ্টা করা হয়, যেগুলো গায়েব জানার উপায় হিসেবে কোন তাত্বিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত নয় হস্তরেখা গণনা, নক্ষত্র গণনা, রমল করা, বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার এবং নানা ধরনের ফাল বের করা এর অন্তরভুক্ত

তিনঃ জুয়া ধরনের যাবতীয় খেলা ও কাজ যেখানে অধিকার, কর্মমূলক অবদান ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফায়সালার মাধ্যমে বস্তু বন্টনের পদ্ধতি গ্রহণ না করে নিছক কোন ঘটনা-ক্রমিক কার্যক্রমের ভিত্তিতে বস্তু বন্টন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যেমন, লটারীতে ঘটনাক্রমে অমুক ব্যক্তির নাম উঠেছে, কাজেই হাজার হাজার ব্যক্তির পকেট থেকে বের হয়ে আসা টাকা তার একার পকেটে চলে যাবে অথবা তাত্বিক দিক দিয়ে কোন একটি ধাঁধার একাধিক উত্তর হতে পারে কিন্তু পুরস্কারটি পাবে একমাত্র সেই ব্যক্তি যার উত্তর কোন যুক্তিসংগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নয় বরং নিছক ঘটনাক্রমে ধাঁধাঁ প্রতিযোযিতা পরিচালকের সিন্ধুকে রক্ষিত উত্তরটির সাথে নিলে যাবে

এ তিন ধরনের ফাল গ্রহণ ও অনুমানভিত্তিক লটারী করাকে হারাম ঘোষণা করার পর ইসলাম কুরআনিক্ষেপ বা লটারী করার একমাত্র সহজ সরল পদ্ধতিটিকেই বৈধ গণ্য করেছে এ পদ্ধতিতে দু’টি সমান বৈধ কাজের বা দু’টি সমপর্যায়ের অধিকারের মধ্যে ফায়সালা করার প্রশ্ন দেখা দেয় যেমন, একটি জিনিসের ওপর দু’ব্যক্তির অধিকার সবদিক দিয়ে একদম সমান এবং ফায়সালাকারীর জন্য দু’জনের কাউকে অগ্রাধিকার দেবার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই আর তাদের দু’জনের মধ্য থেকে কোন একজন নিজের অধিকার প্রত্যাহার করতেও প্রস্তুত নয় এ অবস্থায় তাদের সম্মতিক্রমে লটারীর মাধ্যমে ফায়সালা করা যেতে পারে অথবা দু’টি একই ধরনের সঠিক ও জায়েয কাজ যুক্তির মাধ্যমে তাদের কোন একটিকে অগ্রাধিকার দেবার ব্যাপারে এক ব্যক্তি দোটানায় পেড়ে গেছে এ অবস্থায় প্রয়োজন হলে লটারী করা যেতে পারে নবী সা. এর সামনে যখন দু’জন সমান হকদারের মধ্যে একজনকে প্রাধান্য দেবার প্রশ্ন দেখা দিতো এবং তাঁর আশংকা হতো যে, তিনি একজনকে প্রাধান্য দিলে তা অন্যজনের মনোকষ্টের কারণ হবে তখন তিনি সাধারণত এ পদ্ধতিটি অবলম্বন করতেন

১৫. আজবলতে কোন বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তারিখ বুঝানো হয়নি বরং যে যুগে ও সময়ে এ আয়াত নাযিল হয় সেই সময়কালকে বুঝানো হয়েছে আমাদের ভাষায়ও আজশব্দটি একইভাবে সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়

তোমাদের দীনের ব্যাপারে কাফেররা পুরোপুরি নিরাশ হয়ে পড়েছে” – অর্থাৎ তোমাদের দীন এখন একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে এবং সে তার নিজস্ব শাসন ও কর্তৃত্ব ক্ষমতার জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে কাফেররা এতদিন তার পথে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল কিন্তু এখন তারা এ দীনকে ধ্বংস করার এবং তোমাদেরকে আবার জাহেলিয়াতের অন্ধকার গর্ভে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েছে কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করোঅর্থাৎ এ দীনের বিধান এবং এর হেদায়াত কার্যকর করার ব্যাপারে এখন তোমাদের আর কোন কাফের শক্তির প্রভাব, পরাক্রম, প্রতিবন্ধকতা, প্রাধান্য ও হস্তক্ষেপর সম্মুখীন হতে হবে না এখন আর মানুষকে ভয় করার কোন কারণ নেই তোমাদের এখন আল্লাহকে ভয় করা উচিত আল্লাহর বিধান কার্যকর করার ব্যাপারে এখন যদি তোমরা কোন ত্রুটি করো তাহলে এ জন্য তোমাদের কাছে এমন কোন ওজর থাকবে না যার ভিত্তিতে তোমাদের সাথে কোমল ব্যবহার করা যেতে পারে এখন আর শরীয়াতের বিরুদ্ধাচরণের অর্থ এ হবে না যে, এ ব্যাপারে তোমরা অন্যদের প্রভাবে বাধ্য হয়ে এমনটি করেছো বরং এর পরিস্কার অর্থ হবে, তোমরার আল্লাহর আনুগত্য করতে চাও না

১৬. দীনকে পরিপূর্ণ করে দেবার অর্থই হচ্ছে তাকে একটি স্বতন্ত্র চিন্তা ও কর্ম ব্যবস্থা এবং একটি পূর্নাঙ্গ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়েছে তার মধ্যে জীবনের সমস্ত প্রশ্নের নীতিগত বা বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায় হেদায়াত ও পথনির্দেশ লাভ করার জন্য এখন আর কোন অবস্থায়ই তার বাইরে যাবার প্রয়োজন নেই নিয়মিত সম্পূর্ণ করে দেবার অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমরা আমার আনুগত্য ও বন্দেগী করার যে অংগীকার করেছিল তাকে যেহেতু তোমরা নিজেদের প্রচেষ্টা ও কর্মের মাধ্যমে সত্য ও আন্তরিক অংগীকার হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছো, তাই আমি তাকে গ্রহণ করে নিয়েছি এবং তোমাদেরকে কার্যত এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছি যে, এখন তোমাদের গলায় প্রকৃত পক্ষে আমার ছাড়া আর কারোর আনুগত্য ও বন্দেগীর শৃংখল নেই এখন আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যেমন তোমরা আমার মুসলিম (আনুগত্যকারী) ঠিক তেমনি কর্মজীবনেও আমার ছাড়া আর কারোর মুসলিম (আনুগত্যকারী) হয়ে থাকতে তোমরা কোনত্রুমেই বাধ্য নও এ অনুগ্রহগুলোর কথা উচ্চারণ করার পর মহান আল্লাহ নীরবতা অবলম্বন করেছেন কিন্তু এ বাক পদ্ধতি থেকে একথা স্বতঃষ্ফূর্তভাবে ফুটে ওঠে, যেন এখানে আল্লাহ বলতে চাচ্ছেন, আমি যখন তোমাদের ওপর এ অনুগ্রহগুলো করেছি তখন এর দাবী হচ্ছে, এখন আমার আইনের সীমার মধ্যে অবস্থান করার ব্যাপারে তোমাদের পক্ষ থেকে যেন আর কোন ত্রুটি দেখা না দেয়

বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, এ আয়াতটি বিদায় হজ্জের সময় ১০ হিজরীতে নাযিল হয়েছিল কিন্তু যে বক্তব্যের ধারাবাহিকতার সাথে এর সম্পর্ক তা ৬ হিজরীতে হোদাইবিয়া চুক্তির সমসাময়িক কালের বর্ণনা রীতির কারণে বাক্য দু’টি পরস্পর এমনভাবে মিশে গেছে যার ফলে কোন ক্রমেই ধারণা করা যাবে না যে, শুরুতে এ বাক্যগুলো ছাড়াই এ ধারবাহিক বক্তব্যটি নাযিল হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এ বাক্যগুলো নাযিল হবার পর তা এখানে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে অবশ্য প্রকৃত ব্যাপার একমাত্র আল্লাহইই জানেন, তবে আমার অনুমান, প্রথম এ আয়াতটি এ একই প্রসংগে নাযিল হয়েছিল তাই বিজিত তখন এর আসল গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি পরে যখন সমগ্র মহান আল্লাহ পুনর্বার এ বাক্য তাঁর নবীর প্রতি নাযিল করেন এবং এটি ঘোষণা করে দেবার নির্দেশ জারি করেন

১৭. সূরা আল বাকারাহ-এর ১৭২ টীকা দেখুন

﴿يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ ۖ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ ۙ وَمَا عَلَّمْتُم مِّنَ الْجَوَارِحِ مُكَلِّبِينَ تُعَلِّمُونَهُنَّ مِمَّا عَلَّمَكُمُ اللَّهُ ۖ فَكُلُوا مِمَّا أَمْسَكْنَ عَلَيْكُمْ وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهِ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾

লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে, তাদের জন্য কি হালাল করা হয়েছে? বলে দাও, তোমাদের জন্য সমস্ত পাক-পবিত্র জিনিস হালাল করা হয়েছে১৮ আর যেসব শিকারী প্রাণীকে তোমরা শিক্ষিত করে তুলেছো, যাদেরকে আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে তোমরা শিকার করা শিখিয়েছো, তারা তোমাদের জন্য যেসব প্রাণী ধরে রাখে, তাও তোমরা খেতে পারো১৯ তবে তার ওপর আল্লাহর নাম নিতে হবে২০ আর আল্লাহর আইন ভাঙ্গার ব্যাপারে সাবধান! অবশ্যি হিসেব নিতে আল্লাহর মোটেই দেরী হয় না  

১৮. এ জবাবের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম তত্ব নিহিত রয়েছে ধর্মীয় ভাবাপন্ন লোকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন এক মানসিকতার শিকার হন যার ফলে তারা কোন জিনিসকে সুস্পষ্টভাবে হালাল গণ্য না করা পর্যন্ত দুনিয়ার সব জিনিসকেই হারাম গণ্য করে থাকেন এ মানসিকতার ফলে মানুষের ওপর সন্দেহ প্রবণতা ও আইনের গৎবাঁধা রীতি চেপে বসে জীবনের প্রত্যেকটি কাজে সে হালাল বস্তু ও জায়েজ কাজের তালিকা চেয়ে বেড়ায় এবং প্রত্যেকটি কাজ ও প্রত্যেকটি জিনিসকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে, যেন সব কিছুই নিষিদ্ধ এখানে কুরআন এ মানসিকতার সংশোধন করছে প্রশ্নকারীদের উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত হালাল জিনিসের বিস্তারিত বিবরণ তাদের জানিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা সেগুলো ছাড়া অন্য সব জিনিসকে হারাম মনে করতে পারে জবাবে কুরআন হারাম জিনিসগুলো বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছে এবং এরপর সমস্ত পাক পবিত্র জিনিস হালাল, এ সাধারণ নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে এভাবে পুরাতন ধর্মীয় মতাদর্শ সম্পূর্ণ রূপে উল্টে গেছে পুরাতন মতাদর্শ অনুযায়ী সবকিছুই ছিল হারাম কেবলমাত্র যেগুলোকে হালাল গণ্য করা হয়েছিল সেগুলো ছাড়া কুরআন এর বিপরীত পক্ষে এ নীতি নির্ধারণ করেছে যে, সবকিছুই হালাল কেবল মাত্র সেগুলো ছাড়া যেগুলোর হারাম হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে এটি ছিল একটি অনেক বড় সংশোধন মানুষের জীবনকে বাঁধন মুক্ত করে এ সংশোধন প্রশস্ত দুনিয়ার দুয়ারে তার জন্য খুলে দিয়েছে প্রথমে একটি গণ্ডীবদ্ধ ক্ষুদ্র পরিসরের কিছু জিনিস ছিল তার জন্য হালাল, বাকি সমস্ত দুনিয়া ছিল তার জন্য হারাম আর এখন একটি গণ্ডিবদ্ধ পরিসরের কিছু জিনিস তার জন্য হারাম বাদবাকী সমস্ত দুনিয়াটাই তার জন্য হালাল হয়ে গেছে

হালালের জন্য পাক-পবিত্রতারশর্ত আরোপ করা হয়েছে, যাতে এ সাধারণ বৈধতার দলীলের মাধ্যমে নাপাক জিনিসগুলোকে হালাল গণ্য করার চেষ্টা না করা হয় এখন কোন জিনিসের পাক-পবিত্রহবার বিষয়টি কিভাবে নির্ধারিত হবে, এ প্রশ্নটি থেকে যায় এর জবাব হচ্ছে, যেসব জিনিস শরীয়াতের মূলনীতিগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি মূলনীতির আওতায় নাপাক গণ্য হয় অথবা ভারসাম্যপূর্ণ রুচিশীলতা যেবস জিনিস অপছন্দ করে বা ভদ্র ও সংস্কৃতিবান মানুষ সাধারণত যেসব জিনিসকে নিজের পরিচ্ছন্নতার অনুভূতির বিরোধী মনে করে থাকে সেগুলো ছাড়া বাকি সবকিছুই পাক

১৯. শিকারী প্রাণী বলতে বাঘ, সিংহ, বাজ পাখি, শিকরা ইত্যাদি এমনসব পশু-পাখি বুঝায় যাদেরকে মানুষ শিকার করার কাজে নিযুক্ত করে শিক্ষিত পশু-পাখির বৈশিষ্ট হচ্ছে এই যে, তারা যা কিছু শিকার করে সাধারণ পশু-পাখির মতো তাদেরকে ছিঁড়ে ফেড়ে খেয়ে ফেলে না বরং নিজের মালিকের জন্য রেখে দেয় তাই সাধারণ পশু-পাখির শিকার করা প্রাণী হারাম কিন্তু শিক্ষিত পশু-পাখির শিকার করা প্রাণী হালাল

এ বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ আছে এক দলের মতে, শিকারী পশু-পাখি তার শিকার করা প্রাণী থেকে যদি কিছুটা খেয়ে নেয় তাহলে তা হারাম হয়ে যাবে কারণ তার খাওয়া প্রমাণ করে যে, শিকারটিকে সে মালিকের জন্য নয়, নিজের জন্য ধরেছে ইমাম শাফেঈ এ মত অবলম্বন করেছেন দ্বিতীয় দলের মতে, সে যদি তার শিকার করা প্রাণীর কিছুটা খেয়ে নেয় তাহলেও তা হারাম হয়ে যায় না এমনকি এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খেয়ে নিলেও বাকি দু‘-তৃতীয়াংশ হালালই থেকে যাবে আর এ ব্যাপারে পশু ও পাখির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ইমাম মালেক এ মত অবলম্বন করেছেন তৃতীয় দলের মতে, শিকারী পশু যদি তার শিকার থেকে কিছু খেয়ে নেয় তাহলে তা হারাম হয়ে যাবে কিন্তু যদি শিকারী পাখি তার শিকার থেকে কিছু খেয়ে নেয় তাহলে তা হারাম হয়ে যাবে না কারণ শিকারী পশুকে এমন শিক্ষা দেয়া যেতে পারে যার ফলে সে শিকার থেকে কিছুই না খেয়ে তাকে মালিকের জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, শিকারী পাখিকে এ ধরনের শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয় ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর শাগরিদবৃন্দ এমত অবলম্বন করেছেন এর বিপরীত পক্ষে হযরত আলী রা.বলেন, শিকারী পাখির শিকার আদৌ জায়েয নয় কারণ শিকারকে নিজে না খেয়ে মালিকের জন্য রেখে দেবার ব্যাপারটি তাকে কোনক্রমেই শেখানো সম্ভব নয়

২০. অর্থাৎ শিকারী পশুকে শিকারের পেছনে লেলিয়ে দেবার সময় বিসমিল্লাহবলো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আদী ইবনে হাতেম রা.নবী সা.কে জিজ্ঞেস করেনঃ আমি কি কুকুরের সাহায্যে শিকার করতে পারি?’ জবাবে তিনি বলেনঃ যদি তাকে ছাড়ার সময় তুমি বিসমিল্লাহবলে থাকো, তাহলে তা খেয়ে নাও অন্যথায় খেয়ো না আর যদি সে শিকার থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে থাকে, তাহলে তা খেয়ো না কারণ সে শিকারকে আসলে তার নিজের জন্য ধরেছে,” তারপর তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ ‌‌’আমি যদি শিকারের ওপর নিজের কুকুর ছেড়ে দেবার পর দেখি সেখানে আর একটি কুকুর আছে তাহলে?’ তিনি জবাব দিলেনঃ এ অবস্থায় ঐ শিকারটি খেয়ো না কারণ আল্লাহর নাম তুমি নিজের কুকুরের ওপর নিয়েছিলে, অন্য কুকুরটির ওপর নয়?”

এ আয়াত থেকে জানা যায়, শিকারের ওপর শিকারী পশুকে ছাড়ার সময় আল্লাহর নাম নেয়া জরুরী এরপর যদি শিকারকে জীবিত পাওয়া যায় তাহলে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে তাকে যবেহ করতে হবে আর যদি জীবিত না পাওয়া যায় তাহলে যবেহ করা ছাড়াই তা হালাল কারণ শুরুতে শিকারী পশুকে তার উপর ছাড়ার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছিল তীর দিয়ে শিকার করার ব্যাপারেও এ একই কথা

﴿الْيَوْمَ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ ۖ وَطَعَامُ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حِلٌّ لَّكُمْ وَطَعَامُكُمْ حِلٌّ لَّهُمْ ۖ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ إِذَا آتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ وَلَا مُتَّخِذِي أَخْدَانٍ ۗ وَمَن يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

আজ তোমাদের জন্য সমস্ত পাক-পবিত্র বস্তু হালাল দেয়া হয়েছে আহ্‌লি কিতাবদের খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল২১ এবং তোমাদের খাদ্য তাদের জন্য হালাল আর সংরক্ষতি মেয়েরা তোমাদের জন্য হালাল, তারা ঈমানদারদের দল থেকে হোক বা এমন জাতিদের মধ্য থেকে হোক, যাদেরকে তোমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছিল২২ তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, তোমরা তাদের মোহরানা আদায় করে দিয়ে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে তাদের রক্ষক হবে তোমরা অবাধ যৌনচারে লিপ্ত হতে পারবে না অথবা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতেও পারবে না আর যে ব্যক্তি ঈমানের পথে চলতে অস্বীকার করবে, তার জীবনের সকল সৎ কার্যক্রম নষ্ট হয়ে যাবে এবং আখেরাতে সে হবে নিঃস্ব ও দেউলিয়া২৩ 

২১. আহ্‌লি কিতাবদের খাদ্যের মধ্যে তাদের যবেহকৃত প্রাণীও অন্তরভুক্ত আমাদের জন্য তাদের এবং তাদের জন্য আমাদের খাদ্য হালাল হবার মানে হচ্ছে এই যে, আমাদের ও তাদের মধ্যে পানাহারের ব্যাপারে কোন বাধ্য বা শুচি-অশুচির ব্যাপার নেই আমরা তাদের সাথে খেতে পারি এবং তারা আমাদের সাথে খেতে পারে কিন্তু এভাবে সাধারণ অনুমতি দেবার আগে এ বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যে, “তোমাদের জন্য সমস্ত পাক-পবিত্র জিনিস হালাল করে দেয়া হয়েছেএ থেকে জানা গেলো, আহলি কিতাব যদি পাক-পবিত্রতা ও তাহারাতের ব্যাপারে শরীয়াতের দৃষ্টিতে অপরিহার্য বিধানগুলো মেনে না চলে অথবা যদি তাদের খাদ্যে মধ্যে হারাম বস্তু অন্তরভুক্ত থাকে তাহলে তা থেকে দূরে থাকতে হবে যেমন, যদি তারা আল্লাহর নাম না নিয়েই কোন প্রাণী যবেহ করে অথবা তার ওপর আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নাম নেয়, তাহলে তা খাওয়া আমাদের জন্য জায়েয নয় অনুরূপভাবে যদি তাদের দস্তরখানে মদ, শূকরের গোশ্‌ত বা অন্য কিছু হারাম খাদ্য পরিবেশিত হয়, তাহলে আমরা তাদের সাথে আহারে শরীক হতে পারি না

আহ্‌লে কিতাবদের ছাড়া অন্যান্য অমুসলিমদের ব্যাপারেও একই কথা তবে সেখানে পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, আহলি কিতাবদের যবেহ করা প্রাণী জয়েয, যদি তারা যবেহ করার সময় তার ওপর আল্লাহর নাম নিয়ে থাকে কিন্তু আহলি কিতাব ছাড়া অন্যান্য অমুসলিমদের হত্যা করা প্রাণী আমরা খেতে পারি না

২২. এখানে ইহুদী ও খৃস্টানদের কথা বলা হয়েছে কেবলমাত্র তাদের মেয়েদেরকেই বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে আর এ সংগে শর্তও আরোপিত হয়েছে যে, তাদের মুহসানাত‘ (সংরক্ষিত মহিলা) হতে হবে এ নির্দেশটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিরূপণের ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে ইবনে আব্বাসের রা. মতে এখানে আহ্‌লি কিতাব বলতে সে সব আহ্‌লি কিতাবকে বুঝানো হয়েছে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা অন্যদিকে দারুল হার্‌ব ও কুফ্‌রের ইহুদী ও খৃস্টানদের মেয়েদের বিয়ে করা জায়েয নয় হানাফী ফকীহগণ এর থেকে সামান্য একটু ভিন্নমত পোষণ করেন তাদের মতে বহির্দেশের আহ্‌লি কিতাবদের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হারাম না হলেও মকরূহ, এতে কোন সন্দেহ নেই পক্ষান্তরে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব ও হাসান বসরীর মতে, আয়াতটির হুকুম সাধারণভাবে প্রযোজ্য কাজেই এখানে যিম্মী ও অযিম্মীর মধ্যে পার্থক্য করার কোন প্রয়োজন নেই তারপর মুহসানাতশব্দের ব্যাপারেও ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে হযরত উমরের রা. মতে, এর অর্থ পবিত্র ও নিষ্কলূষ চরিত্রের অধিকারী মেয়েরা মুহসানাত শব্দের এ অর্থ গ্রহণ করার কারণে তিনি আহ্‌লি কিতাবদের স্বেচ্ছাচারী মেয়েদের বিয়ে করাকে এ অনুমতির আওতার বাইরে রেখেছেন হাসান, শা’বী ও ইব্রাহীম নাখ্‌ঈ রা. এ একই মত পোষণ করেন হানাফী ফকীহগণও এ মত অবলম্বন করেছেন অন্যদিকে ইমাম শাফেঈর মতে, এখানে এ শব্দটি ক্রীতদাসীদের মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ এখানে এ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, আহলি কিতাবদের এমন সব মেয়ে যারা ক্রীতদাসী নয়

২৩. আহলি কিতাবদের মেয়েদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দেবার পর এখানে সতর্কবাণী হিসেবে এ বাক্যটি সন্নিবেশিত হয়েছে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ অনুমতি থেকে লাভবান হতে চাইবে সে যেন নিজের ঈমান ও চরিত্রের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে এমন যেন না হয়, কাফের স্ত্রীর প্রেমে আত্মহারা হয়ে অথবা তার আকীদা ও কর্মকাণ্ডে প্রভাবিত হয়ে তিনি নিজের ঈমানের মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে বসেন বা সামাজিক জীবন যাপন ও আচরণের ক্ষেত্রে ঈমান বিরোধী পথে এগিয়ে চলেন

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ ۚ وَإِن كُنتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا ۚ وَإِن كُنتُم مَّرْضَىٰ أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُم مِّنْهُ ۚ مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾

হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাযের জন্য তৈরী হও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত দু’টি কনুই পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো, মাথার ওপর হাত বুলাও এবং পা দু’টি গোড়ালী পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো২৪ যদি তোমরা ‘জানাবাত’ অবস্থায় থাকো, তাহলে গোসল করে পাক সাফ হয়ে যাও২৫ যদি তোমরা রোগগ্রস্ত হও বা সফরে থাকো অথবা তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি মলমূত্র ত্যাগ করে আসে বা তোমরা নারীদেরকে স্পর্শ করে থাকো এবং পানি না পাও, তাহলে পাক-পবিত্র মাটি দিয়ে কাজ সেরে নাও তার ওপর হাত রেখে নিজের চেহারা ও হাতের ওপর মসেহ করে নাও২৬ আল্লাহ তোমাদের জন্য জীবনকে সংকীর্ণ করে দিতে চান না কিন্তু তিনি চান তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করতে এবং তাঁর নিয়ামত তোমাদের ওপর সম্পূর্ণ করে দিতে,২৭ হয়তো তোমরা শোকর গুজার হবে  

২৪. নবী সা. এ হুকুমটির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা থেকে জানা যায়, কুল্লি করা ও নাক সাফ করাও মুখ ধোয়ার অন্তরভুক্ত এ ছাড়া মুখমণ্ডল ধোয়ার কাজটি কখনই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না আর কান যেহেতু মাথার একটি অংশ তাই মাথা মসেহ করার মধ্যে কানের ভেতরের ও বাইরের উভয় অংশও শামিল হযে যায় তাছাড়া অযু শুরু করার আগে দু’হাত ধুয়ে নেয়া উচিত কারণ যে হাত দিয়ে অযু করা হচ্ছে সে হাতেরই তো আগে পাক-পবিত্র হবার প্রয়োজন রয়েছে

২৫. স্ত্রী সহবাসের কারণে ‌’জানাবাত হোক বা স্বপ্নে বীর্য স্খলনের কারণে হোক উভয় অবস্থায়ই গোসল ওয়াজিব এ অবস্থায় গোসল ছাড়া নামায পড়া বা কুরআন স্পর্শ করা জায়েয নয় (আরো বিস্তারিত জানার জন্য সূরা আন নিসার ৬৭, ৬৮, ও ৬৯ টীকা দেখুন)

২৬. ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা আন নিসার ৬৯ ও ৭০ টীকা

২৭. আত্মার পবিত্রতা যেমন একটি নিয়ামত ঠিক তোমনি শরীরের পবিত্রতাও একটি নিয়ামত আর মানুষের ওপর আল্লাহর নিয়ামত তখনই সম্পূর্ণ হতে বা পূর্ণতা লাভ করতে পারবে যখন সে আত্মা ও শরীর উভয়ের তাহারাত ও পাক-পবিত্রতা অর্জনের জন্য পূর্ণ হেদায়াত লাভ করতে সক্ষম হবে

﴿وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمِيثَاقَهُ الَّذِي وَاثَقَكُم بِهِ إِذْ قُلْتُمْ سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ﴾

আল্লাহ তোমাদের যে নিয়ামত দান করেছেন২৮ তার কথা মনে রাখো এবং তিনি তোমাদের কাছ থেকে যে পাকাপোক্ত অংগীকার নিয়েছেন তা ভুল যেয়ো না অর্থাৎ তোমাদের একথা-আমরা শুনেছি ও আনুগত্য করেছি আর আল্লাহকে ভয় করো আল্লাহ মনের কথা জানেন  

২৮. অর্থাৎ আল্লাহর এ নিয়ামত যে, জীবনের সরল সঠিক রাজপথ তিনি তোমাদের জন্য আলোকোজ্জল করে দিয়েছেন এবং সারা দুনিয়ার মানুষের হেদায়াত ও নেতৃত্ব দানের আসনে সমাসীন করেছেন

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ ۖ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَىٰ أَلَّا تَعْدِلُوا ۚ اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ﴾

হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও২৯ কোন দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয় যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো এটি আল্লাহভীতির সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন  

২৯. সূরা আন নিসার ১৬৪ ও ১৬৫ টীকা দেখুন

﴿وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ۙ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ﴾

যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে আল্লাহ তাদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তাদের ভুল-ত্রুটি মাফ করে দেয়া হবে এবং তারা বিরাট প্রতিদান লাভ করবে

  ﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ﴾

১০ যারা কুফরী করবে এবং আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী 

 ﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ هَمَّ قَوْمٌ أَن يَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ فَكَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنكُمْ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ﴾

১১ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যা তিনি (এ সাম্প্রতিককালে) তোমাদের প্রতি করেছেন, যখন একটি দল তোমাদের ক্ষতি করার চক্রান্ত করেছিল কিন্তু আল্লাহ তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন৩০ আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো ঈমানদারদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত  

৩০. এখানে একটি বিশেষ ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এ সম্পর্কে রেওয়ায়াত করেছেনঃ ইহুদীদের একটি দল নবী কারীম সা. ও তাঁর বিশেষ বিশেষ সাহাবীদেরকে একটি ভোজ আমন্ত্রণ করেছিল এই সংগে তারা গোপনে চক্রান্ত করেছিল যে, নবী কারীম সা. ও সাহাবীগণ এসে গেলে একযোগে তাদের ওপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে শেষ করে দেবে এবং এভাবে তারা ইসলামের মূলোৎপাটনে সক্ষম হবে কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে ঠিক সময়ে নবী কারীম সা. এ ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারলেন তিনি দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করলেন না যেহেতু এখান থেকে বনী ইসরাঈলদেরকে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা শুরু হয়েছে, তাই ভূমিকা হিসেবে এ ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে

এখান থেকে যে ভাষণ শুরু হচ্ছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে দু’টো প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানদের পূর্বসূরী আহলী কিতাবরা যে পথে চলছিল সে পথে চলা থেকে তাদেরকে বিরত রাখা কাজেই তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেভাবে আজ তোমাদের থেকে অংগীকার নেয়া হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈল ও ঈসা আ. এর উম্মতদের থেকেও এ একই অংগীকার নেয়া হয়েছিল তারা যেভাবে নিজেদের অংগীকার ভংগ করে পথভ্রষ্ট হয়েছে তোমরাও যেন তেমনি অংগীকার ভংগ করে পথভ্রষ্ট হয়ে না যাও দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইহুদী ও খৃস্টান উভয় সম্প্রদায়কে তাদের ভুলের জন্য সতর্ক করে দেয়া এবং তাদেরকে সত্য দীন তথা ইসলামের দাওয়াত দেয়া

﴿وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًا ۖ وَقَالَ اللَّهُ إِنِّي مَعَكُمْ ۖ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلَاةَ وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَآمَنتُم بِرُسُلِي وَعَزَّرْتُمُوهُمْ وَأَقْرَضْتُمُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا لَّأُكَفِّرَنَّ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَلَأُدْخِلَنَّكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۚ فَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ مِنكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ﴾

১২ আল্লাহ বনী ইসরাঈলদের থেকে পাকাপোক্ত অংগীকার নিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে বারোজন ‘নকীব’৩১ নিযুক্ত করেছিলেন আর তিনি তাদেরকে বলেছিলেনঃ আমি তোমাদের সাথে আছি যদি তোমরা নামায কায়েম করো, যাকাত দাও, আমার রাসূলদেরকে মানো ও তাদেরকে সাহায্য করো৩২ এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে থাকো,৩৩ তাহলে নিশ্চিত বিশ্বাস করো আমি তোমাদের থেকে তোমাদের পাপগুলো মোচন করে দেবো৩৪ এবং তোমাদের এমন সব বাগানের মধ্যে প্রবেশ করাবো যার তলদেশ দিয়ে ঝরণাধারা প্রাবাহিত হবে কিন্তু এরপর তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কুফরী নীতি অবলম্বন করবে, সে আসলে সাওয়া-উস-সাবীল৩৫ তথা সরল সঠিক পথ হারিয়ে ফেলেছে 

৩১. নকীবঅর্থ পর্যবেক্ষক, রক্ষণাবেক্ষণকারী ও তদন্তকারী বনী ইসরাঈল ছিল বারোটি গোত্রে বিভক্ত আল্লাহ প্রত্যেক গোত্র থেকে একজনকে নিয়ে সে গোত্রের ওপরই তাকে নকীব নিযুক্ত করার হুকুম দিয়েছিলেন নকীবের কাজ ছিল তার গোত্রের লোকদের চালচলন ও অবস্থার প্রতি নজর রাখা এবং তাদেরকে বেদীনী ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা বাইবেলের গণনা পুস্তকে বারো জন সরদা‘-এ কথা বলা হয়েছে কিন্তু কুরআনে এ নকীবশব্দের মাধ্যমে তাদের যে পদমর্যাদা ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে বাইবেলের বর্ণনা থেকে তা প্রকাশ হয় না বাইবেল তাদেরকে নিছক সরদার ও প্রধান হিসেবে পেশ করেছে অন্যদিকে কুরআন তাদেরকে নৈতিক ও ধর্মীয় পর্যবেক্ষক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী বলে গণ্য করেছে

৩২. অর্থাৎ আমার পক্ষ থেকে যে রাসূলই আসবে যদি তোমরা তাঁর দাওয়াত কবুল করতে থাকো এবং তাকে সাহায্য করতে থাকো

৩৩. অর্থাৎ আল্লাহর পথে নিজের ধন সম্পদ ব্যয় করতে থাকো যেহেতু মানুষ আল্লাহর পথে যা ব্যয় করে আল্লাহ তার এক একটি পাইকেও কয়েকগুণ বাড়িয়ে ফেরত দেবার ওয়াদা করেন, তাই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর পথে অর্থ সম্পদ ব্যয় করাকে ঋণহিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে তবে এখানে শর্ত হচ্ছে, তা অবশ্যি উত্তম ঋণহতে হবে অর্থাৎ বৈধ উপায়ে সংহীত অর্থ আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে এবং আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও সৎ সংকল্প সহকারে ব্যয় করতে হবে

৩৪. কারোর পাপ মোচন করার দু’টি অর্থ হতে পারে

একঃ সত্য ও সঠিক পথ অবলম্বন করার এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চিন্তা ও কর্মের সঠিক পথে চলার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ মানুষের আত্মা বিভিন্ন প্রকার পাপের মলিনতা থেকে এবং তার জীবনধারা বহু প্রকার দোষ ও ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে যেতে থাকবে

দুইঃ এ পরিশুদ্ধি সত্ত্বেও যদি কোন ব্যক্তি সামগ্রিকভাবে পূর্ণতার পর্যায়ে না পৌঁছুতে পারে এবং তার মধ্যে কিছু ত্রুটি ও গুনাহ থেকে যায় তাহলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাকে জবাবদিহির সম্মুখীন করবেন না এবং সে গুনাহগুলো তার হিসেব থেকে বিলুপ্ত করে দেবেন কারণ যে ব্যক্তি মৌলিক হেদায়াত ও সংশোধন গ্রহণ করে নিয়েছে আল্লাহ তার ছোটখাট ও পরোক্ষ ত্রুটিগুলো পাকড়াও করার মতো কঠোর নীতি অবলম্বন করবেন না

৩৫. অর্থাৎ সে সাওয়া-উস-সাবীলপেয়ে আবার তা হারিয়ে ফেলেছে এবং ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়েছে ‌‌‌‌’সাওয়া-উস-সাবীলেরঅনুবাদ করা যেতে পারে ‌‌’সরল-সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পথকিন্তু এরপরও তার পুরোপুরি অর্থ প্রকাশিত হয় না তাই আয়াতের অনুবাদের সময় হুবুহু মূল শব্দটিই রাখা হয়েছে

এ শব্দটির গভীর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য প্রথমেই একথাটি হৃদয়ংগম করে নিতে হবে যে, মানুষের অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছ একটি ছোটখাটো জগত এ খুদে জগতটি অসংখ্য শক্তি ও যোগ্যতায় পরিপূর্ণ ইচ্ছা, আকাংখা, আবেগ, অনুভূতি ও বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা এখানে বাসা বেধেঁ আছে দেহ ও প্রবৃত্তির বিভিন্ন দাবী এবং আত্মা ও মানবিক প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকার চাহিদার ভীড় এখানে সর্বক্ষণ তারপর ব্যক্তি মানুষেরা একত্র হয়ে যে সমাজ কাঠামো নির্মাণ করে সেখানেও ঘটে অসংখ্য জটিল সম্পর্কের সমন্বয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশের সাথে সাথে এ জটিলতাও বেড়ে যেতে থাকে এরপর সারা দুনিয়ায় মানুষের চারদিকে জীবন ধারণের যেসব উপকরণ ছড়িয়ে আছে সেগুলো কাজে লাগাবার এবং মানবিক প্রয়োজনে ও মানব সভ্যতার বিনির্মাণে সেগুলো ব্যবহার করার প্রশ্নও ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে অসংখ্য ছোট বড় সমস্যার জন্ম দেয়

মানুষ তার সহজাত দুর্বলতার কারণে জীবনের এ সমগ্র কর্মক্ষেত্রটির ওপর একই সময়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টি দিতে পারে না তাই মানুষ নিজেই নিজের জীবনের জন্য এমন কোন পথ তৈরী করতে পারে না যেখানে তার সমস্ত শক্তির সাথে পুরোপুরি ইনসাফ করা যেতে পারে, যেখানে তার সমস্ত ইচ্ছা ও আশা-আকাংখা যথাযথভাবে পূর্ণ করা যায়,তার সমস্ত আবেগ, অনুভূতি ও প্রবণতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, একটি ন্যায়ানুগ সমতা রক্ষা করে তার ভেতরের ও বাইরের সমস্ত চাহিদা ও দাবী পূরণ করা যায়, তার সমাজ জীবনের সমস্ত সমস্যার প্রতি যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ করে তাদের সুষ্ঠু সমাধান বের করা যায় এবং জড় বস্তুগুলোকেও, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ন্যায়, ইনসাফ, সমতা, ভারসাম্য ও সত্যনিষ্ঠা সহকারে ব্যবহার করা যায় মানুষ নিজেই যখন নিজের নেতা ও বিধাতায় পরিণত হয় তখন সত্যের বিভিন্ন দিকের মধ্য থেকে কোন একটি দিক, জীবনের প্রয়োজনের মধ্য থেকে কোন একটি প্রয়োজন, সমাধান প্রত্যাশী সমস্যাগুলোর কোন একটি সমস্যা তার মস্তিষ্ক ও চিন্তা জগতকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে, অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যাগুলোর সাথে সে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বে-ইনসাফী করতে থাকে তখন তার এ সিদ্ধান্তকে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠিত করার ফলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সে ভারসাম্যহীনতার কোন এক প্রান্তের দিকে বাঁকাভাবে চলতে থাকে তারপর এভাবে চলতে চলতে বক্রতার শেষ প্রান্তে পৌঁছার আগেই তা মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে ফলে যে সমস্ত দিক, প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে বেইনসাফী করা হয়েছিল তারা বিদ্রোহ শুরু করে দেয় এবং তাদের সাথে ইনসাফ করার জন্য তারা চাপ দিতে থাকে কিন্তু এরপরও ইনসাফ হয় না কারণ আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে অর্থাৎ আগের ভারসাম্যহীনতার কারণে যেগুলোকে সবচেয়ে বেশী দাবিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে কোন একটি মানুষের মস্তিষ্ক ও চিন্তা জগতকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফলে এবং একটি বিশেষ দাবী অনুযায়ী একটি বিশেষ দিকে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এখানে আবার অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে বেইনসাফী হতে থাকে এভাবে সরল সোজা পথে চলা মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব হয় না সবসময়ই সে ঢেউয়ের দোলায় দোদুল্যমান থাকে এবং ধ্বংসের এক কিনার থেকে আর এক কিনারে তাকে ঠেলে দেয়া হয় মানুষ নিজের জীবন ক্ষেত্রে চলার জন্য যতগুলো পথ তৈরী করেছে সবই বক্র রেখার মতো একটি ভুল প্রান্তে গিয়ে তার চলা শেষ হয় আবার সেখান থেকে যখন চলা শুরু করে তখন কোন ভুল দিকেই এগিয়ে চলে

সাওয়াউসসাবিল বা সরল পথ

এ অসংখ্য বক্র ও ভুল পথের মধ্য দিয়ে এমন একটি পথ চলে গেছে যার অবস্থান ঠিক মধ্যভাগে এ পথে মানুষের সমস্ত শক্তি সামর্থ, প্রবণতা, আশা-আকাংখা, আবেগ, অনুভূতি, তার দেহ ও আত্মার সমস্ত দাবী ও চাহিদা এবং তার জীবনের যাবতীয় সমস্যার সাথে পূর্ণ ইনসাফ করা হয়েছে এ পথে কোন প্রকার বক্রতার লেশ মাত্র নেই কোন দিকের প্রতি অযথা পক্ষপাতিত্ব ও তাকে সুযোগ-সুবিধা দান এবং কোন দিকের সাথে জুলুম ও বেইনসাফী করার প্রশ্নই এখানে নেই মানুষের জীবনের সঠিক উন্নয়ন, ক্রমবিকাশ এবং তার সাফল্য ও অগ্রগতির জন্য এ ধরনের একটি পথ একান্ত অপরিহার্য মানুষের মূল প্রকৃতি এ পথেরই সন্ধানে ফিরছে এ সোজা সরল রাজপথটির অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকার কারণেই তার বিভিন্ন বক্র পথের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে কিন্তু নিজের চেষ্টায় এ রাজপথের সন্ধান লাভ করার ক্ষমতা মানুষের নেই একমাত্র আল্লাহই তাকে এ পথের সন্ধান দিতে পারেন মানুষকে এ পথের সন্ধান দেবার জন্যই আল্লাহ তাঁর রাসূল পাঠিয়েছেন

কুরআন এ পথকেই সাওয়া-উস-সাবীলসিরাতুল মুস্তাকীমআখ্যা দিয়েছে দুনিয়ার এ জীবন থেকে নিয়ে আখেরাতের জীবন পর্যন্ত অসংখ্য বক্র পথের মধ্য দিয়ে এ সরল সোজা রাজপথটি চলে গেছে যে ব্যক্তি এ পথে অগ্রসর হয়েছে সে এ দুনিয়ায়ও সঠিক পথের যাত্রী এবং আখেরাতেও সফলকাম হয়েছে আর যে ব্যক্তি এ পথ হারিয়ে ফেলেছে সে এখানে বিভ্রান্ত হয়েছে, ভুল পথে চলেছে এবং আখেরাতেও অনিবার্যভাবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে কারণ, জীবনের সমস্ত বক্র পথ জাহান্নামের দিকেই চলে গেছে

আধুনিক যুগের কতিপয় অজ্ঞ দার্শনিক মানুষকে উপর্যুপরি এক প্রান্তিকতা থেকে আর এক প্রান্তিকতার দিকে ধেয়ে চলতে দেখে এ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া(Dialectic Process) মানব জীবনের উন্নতি, অগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক পথ নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে তারা এ ধারণা করে বসেছেন যে, প্রথমে একটি চরমপন্থী দাবী (Thesis) মানুষকে একদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তারপর এর প্রতিক্রিয়ায় একই পর্যায়ের আরেকটি চরম ভাবাপন্ন দাবী (Antithesis) তাকে আর এক প্রান্তে ঠেলে নিয়ে যায় আর এরপর তাদের উভয়ের মিশ্রণে (Synthesis) জীবনের অগ্রগতি ও বিকাশের পথ তৈরী হয় তাদের মতে এটিই হচ্ছে মানব জীবনের ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশের পথ অথচ এটি মোটেই ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির পথ নয় বরং এ হচ্ছে দুর্ভাগ্যের ধাক্কা, যা মানুষের জীবনের সঠিক পথে পরিচালিত করার এবং তার যথার্থ ক্রমবিকাশের পথে বারবার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে প্রত্যেকটি চরমপন্থী ও প্রান্তিকতাবাদী দাবী জীবনকে কোন একটি লক্ষের দিকে চালিত করে এবং তাকে টেনে নিয়ে চলে এভাবে চলতে চলতে যখন সে সাওয়া-উস-সাবীলথেকে অনেক দূরে সরে যায় তখন জীবনেরই অপর কতকগুলো উপেক্ষিত সত্য, যাদের সাথে বেইনসাফী করা হচ্ছিল, তারাই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে এ বিদ্রোহ একটি পাল্টা দাবীর আকারে আত্মপ্রকাশ করে তাকে উল্টো দিকে টানতে থাকে সাওয়া-উস-সাবীলযত কাছে আসতে থাকে ততই এ সংঘর্ষশীল দাবীগুলোর মধ্যে আপোস হতে থাকে এবং তাদের মিশ্রণে এমন কিছু জিনিস অস্তিত্ব লাভ করে যা মানুষের জীবনের জন্য উপকারী ও লাভজনক কিন্তু যখন সেখানে সাওয়া-উস-সাবীলেরসন্ধান দেয়ার মতো আলো থাকে না এবং তার ওপর অবিচল থাকার মতো ঈমানেরও অস্তিত্ব থাকে না তখন এ পাল্টা দাবী জীবনকে সেই স্থানে টিকে থাকতে দেয় না বরং নিজের শক্তির জোরে তাকে বিপরীত প্রান্তিকতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে এমনকি শেষ পর্যন্ত জীবনের অন্য কিছু সত্যকে অস্বীকার করার পর্ব শুরু হয়ে যায় এর ফলে আর একটা বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এসব সংকীর্ণ দৃষ্টির অধিকারী দার্শনিকদের মধ্যে যদি কুরআনের আলো পৌঁছে গিয়ে থাকতো এবং তারা সাওয়া-উস-সাবীলকি জিনিস তা দেখতে পেতেন তাহলে তারা জানতে পারতেন, সাওয়া-উস-সাবীলই মানুষের জন্য একমাত্র সঠিক ও নির্ভুল পথ বক্র রেখায় ক্রমাগত এক প্রান্তিকতা থেকে আর এক প্রান্তিকতায় ধাক্কা খেয়ে বেড়ানো মানব জীবনের ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশের কোন সঠিক ও নির্ভুল পথ নয়

﴿فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَاقَهُمْ لَعَنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً ۖ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ ۙ وَنَسُوا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوا بِهِ ۚ وَلَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلَىٰ خَائِنَةٍ مِّنْهُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِّنْهُمْ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاصْفَحْ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾

১৩ তারপর তাদের নিজেদের অংগীকার ভংগের কারণেই আমি তাদেরকে নিজের রহমত থেকে দূরে নিক্ষেপ করেছি এবং তাদের হৃদয় কঠিন করে দিয়েছি এখন তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা শব্দের হেরফের করে কথাকে একদিক থেকে আর একদিকে নিয়ে যায়, যে শিক্ষা তাদেরকে দেয়া হয়েছিল তার বড় অংশ তারা ভুলে গেছে এবং প্রায় প্রতিদিনই তাদের কোন না কোন বিশ্বাসঘাতকতার খবর তুমি লাভ করে থাকো, তাদের অতি অল্প সংখ্যক লোকই এ দোষমুক্ত আছে (কাজেই তারা যখন এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তখন তাদের যে কোন কুকর্ম মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়) তাই তাদেরকে মাফ করে দাও এবং তাদের কাজকর্মকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখো আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা সৎকর্মশীলতা ও পরোপকারের নীতি অবলম্বন করে 

﴿وَمِنَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَىٰ أَخَذْنَا مِيثَاقَهُمْ فَنَسُوا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوا بِهِ فَأَغْرَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ۚ وَسَوْفَ يُنَبِّئُهُمُ اللَّهُ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ﴾

১৪ এভাবে যারা বলেছিল আমরা “নাসারা”৩৬ তাদের থেকেও আমি পাকাপোক্ত অংগীকার নিয়েছিলাম কিন্তু তাদের স্মৃতিপটে যে শিক্ষা সংবদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল তারও বড় অংশ তারা ভুলে গেছে শেষ পর্যন্ত আমি তাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও পারস্পারিক হিংসা –বিদ্বেষের বীজ বপন করে দিয়েছি আর এমন এক সময় অবশ্যি আসবে যখন আল্লাহ তাদের জানিয়ে দেবেন তারা দুনিয়ায় কি করতো 

৩৬. অনেকে মনে করেন নাসার نصارى শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে হযরত ঈসার জন্মভূমির নাম নাসেরাناصرة থেকে কিন্তু এ ধারণা ভুল আসলে নাসারা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে নুসরাতنصرت  থেকে ঈসা আ. এর উক্তি من أنصاري إلى الله (আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে?) এর জবাবে তাঁর হাওয়ারীগণ نحن أنصار الله (আমরা হবো আল্লাহর কাজে সাহায্যকারী) বলে বক্তব্য পেশ করেছিলেন সেখান থেকেই এর উৎপত্তি খৃস্টান লেখকরা নিছক সাহ্যিক সাদৃশ্য দেখে এ বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন যে, খৃস্টবাদের ইতিহাসের প্রথম যুগে নাসেরীয়া (Nazarenes) নামে একটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল, তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সাথে নাসেরী ও ইবূনী বলা হতো এবং কুরআন দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করছে যে, তারা নিজেরাই বলেছিলঃ আমরা নাসার আর একথাও সুস্পষ্ট যে, খৃস্টানরা নিজেরা কখনো নিজেদেরকে নাসেরী বলে পরিচয় দেয়নি

এ প্রসংগে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত ঈসা আ. কখনো নিজের অনুসারীদেরকে ঈসায়ীবা মসীহীনামে আখ্যায়িত করেননি কারণ তিনি নিজের নামে কোন নতুন ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করতে আসেননি হযরত মূসা আ. এবং তাঁর আগের ও পরের নবীগণ যে দীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন তারই পুনরুজ্জীবন ছিল তাঁর দাওয়াতের লক্ষ তাই তিনি সাধারণ বনী ইসরাঈলদের এবং মূসার শরীয়াতের অনুসারীদের থেকে আলাদা কোন দল গঠন করেননি এবং তাদের কোন আলাদা নামও রাখেননি তাঁর প্রাথমিক যুগের অনুসারীরা নিজেদেরকে ইসরাঈলী মিল্লাত থেকে আলাদা মনে করতেন না এবং নিজেরা কোন স্বতন্ত্র দল হিসেবেও সংগঠিত হননি নিজেদের পরিচিতির জন্য তারা কোন বৈশিষ্টমূলক নাম ও চিহৃ গ্রহণ করেননি তারা ইহুদীদের সাথে বাইতুল মাকদিসের হাইকেলেই(ধর্মধাম) ইবাদাত করতে যেতেন এবং মূসার শরীয়াতের বিধিবিধান মেনে চলাকেই নিজেদের কর্তব্য মনে করতেন (দেখুন বাইবেল, প্রেরিতদের কার্য বিবরণ পুস্তকঃ ৩ : ১-১০, ৫:২১-২৫)

পরবর্তী সময়ে উভয় পক্ষ থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম শুরু হয়েছে একদিকে হযরত ঈসার আ. অনুসারীদের মধ্য থেকে সেন্টপল ঘোষণা করেন যে, শরীয়াতের বিধান অনুসরণের আর প্রয়োজন নেই কেবলমাত্র ঈসার ওপর ঈমান আনাই নাজাতের তথা পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট আবার অন্যদিকে ইহুদী আলেমগণও হযরত ঈসার অনুসারীদেরকে একটি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় বলে ঘোষণা করে তাদেরকে সাধারণ বনী ইসরাঈলদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেন কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও শুরুতে এ নতুন সম্প্রদায়ের কোন পৃথক নাম ছিল না হযরত ঈসার অনুসারীরা নিজেদেরকে কখনো শিষ্যবলে উল্লেখ করতেন, কখনো ভ্রাতৃগন’ (ইখওয়ান), ‘বিশ্বাসী’ (মুমিন), ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে’ (আল্‌লাযীন আমানূ) আবার কখনো পবিত্রগণবলেও উল্লেখ করেছেন (প্রেরিতদের কার্যবিবরণ পুস্তকঃ ২:৪৪, ৪:৩২, ৯:২৬, ১১:২৯, ১৩:৫২, ১৫:১ ও ২৩, রোমীয়ঃ ১৫:২৫, কলসীয় ১:১২) অন্যদিকে ইহুদীরা এদেরকে কখনো গালীলী’, কখনো নাসেরীবা নাসরতীআবার কখনো বেদাতী সম্প্রদায়বলে অভিহিত করতো (প্রেরিতদের কার্যবিবরণ ২৪:৫, লুকঃ ১৩:২) নিছক নিন্দা ও বিদ্রূপচ্ছলে হযরত ঈসার অনুসারীদেরকে এ নামে ডাকার কারণ ছিল এই যে, হযরত ঈসা আ. এর জন্মভূমি ছিল নাসেরা এবং তা ছিল ফিলিস্তিনের গালীল জেলার অন্তর্গত কিন্তু তাদের এ বিদ্রূপাত্মক শব্দগুলো খুব বেশী প্রচলিত হতে পারেনি ফলে এগুলো হযরত ঈসার অনুসরীদের নামে পরিণত হতে সক্ষম হয়নি

এ দলের বর্তমান নাম খৃস্টান’ (Christian) সর্বপ্রথম আন্তাকিয়াতে (انطاكية) প্রদত্ত হয় সেখানে ৪৩ বা ৪৪ খৃস্টাব্দে কতিপয় মুশরিক অধিবাসী হযরত ঈসার অনুসরীদেরকে এ নামে অভিহিত করে সে সময় সেন্টপল ও বার্নাবাস সেখানে পৌঁছে ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন (প্রেরিতদে কার্যঃ ১১:২৬) এ নামটিও মূলত বিরোধীদের পক্ষ থেকেই ঠাট্টা-বিদ্রূপচ্ছলেই রাখা হয়েছিল ঈসার অনুসরীরা নিজেরাও এটাকে তাদের নাম হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না কিন্তু তাদের শক্ররা যখন তাদেরকে ঐ নামে ডাকতে শুরু করলো তখন তাদের নেতারা বললেন, যদি তোমাদেরকে খৃস্টের সাথে যুক্ত করে খৃস্টান বলে ডাকা হয় তাহলে তাতে তোমাদের লজ্জা পাবার কি কারণ থাকতে পারে? (১-পিতর ৪:১৬) এভাবে তারা নিজেরাই ধীরে ধীরে শত্রুদের বিদ্রূপচ্ছলে দেয়া এ নাম নিজদেরকে আখ্যায়িত করতে থাকে অবশেষে তাদের মধ্যে এ অনুভূতিই খতম হয়ে যায় যে, এটি আসলে একটি খারাপ নাম এবং তাদেরকে শক্ররা বিদ্রূপচ্ছলে এ নাম দিয়েছিল

কুরআন এ কারণেই খৃস্টের অনুসারীদের ঈসায়ী, মসীহী বা খৃস্টান নাম আখ্যায়িত করেনি বরং তাদেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, তোমরা আসলে সেসব লোকদের অন্তর্গত যাদেরকে হযরত ঈসা আ. মান আনসারী ইলাল্লাহ’ (কে আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্য করবে?) বলে আহবান জানিয়েছিলেন এবং এর জবাবে সেই লোকেরা বলেছিল নাহ্‌নু আনসারুল্লাহ (আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী) তাই তোমরা নিজেদের প্রাথমিক ও মৌলিক তাৎপর্যের দিক দিয়ে নাসার বা আনসার কিন্তু আজকের খৃষ্টীয় মিশনারীরা এ বিস্মৃত বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেবার কারণে কুরআনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরিবর্তে উলটো অভিযোগ জানাচ্ছে যে, কুরআন তাদেরকে খৃস্টান না বলে নাসারা বলছে কেন?

﴿يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ ۚ قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ﴾

১৫ হে আহলি কিতাব! আমার রাসূল তোমাদের কাছে এসে গেছে সে আল্লাহর কিতাবের এমন অনেক কথা তোমাদের কাছে প্রকাশ করছে যেগুলো তোমরা গোপন করে রাখতে এবং অনেক ব্যাপারে ক্ষমার চোখেও দেখছে৩৭ তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে গেছে এক জ্যোতি এবং আমি একখানি সত্য দিশারী কিতাব

৩৭. অর্থাৎ তোমাদের অনেক চুরি ও খেয়ানত ফাঁস করে দিচ্ছেন, আল্লাহর সত্য দীন কায়েম করার জন্য যেগুলো ফাঁস করে দেয়া অপরিহার্য আর যেগুলো ফাঁস করে দেয়ার তেমন কোন যথার্থ প্রয়োজন নেই সেগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন

﴿يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ﴾

১৬ যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সন্তোষকামী লোকদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথপ্রদর্শন করেন এবং৩৮ নিজ ইচ্ছাক্রমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের দিকে নিয়ে আসেন এবং সরল-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন 

৩৮. শান্তি ও নিরাপত্তা মানে ভুল দেখা, ভুল আন্দাজ-অনুমান করা ও ভুল কাজ করা থেকে দূরে থাকা এবং এর ফলাফল থেকেও নিজেকে সংরক্ষিত রাখা যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের জীবন থেকে আলো সংগ্রহ করে, চিন্তা ও কর্মের প্রতিটি চৌমাথায় পৌঁছে সে কিতাবে এ ভুলগুলো থেকে সংরক্ষিত থেকেছে তা বুঝতে পারে

﴿لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ ۚ قُلْ فَمَن يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَن يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ۗ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۚ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

১৭ যারা বলে, মারইয়াম পুত্র মসীহই আল্লাহ, তারা অবশ্যি কুফরী করেছে৩৯ হে মুহাম্মাদ! ওদেরকে বলে দাও, আল্লাহ যদি মারইয়াম পুত্র মসীহকে, তার মাকে ও সারা দুনিয়াবাসীকে ধ্বংস করতে চান, তাহলে তাঁকে তাঁর এ সংকল্প থেকে বিরত রাখার ক্ষমতা কার আছে? আল্লাহ তো আকাশসমূহের এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক তিনি যা চান সৃষ্টি করেন৪০ তাঁর শক্তি সবকিছুর ওপর পরিব্যাপ্ত 

৩৯. খৃস্টবাদীরা শুরুতেই ঈসা আ. এর ব্যক্তিত্বকে মানবিক সত্তা ও ইলাহী সত্তার মিশ্রণ গণ্য করে যে ভুল করেছিল তার ফলে হযরত ঈসা যর্থার্থ রূপ গোলক ধাঁধায় পরিণত হয়েছে খৃস্টীয় আলেম সমাজ এ ধাঁধাঁর রহস্য উন্মোচনে যতই বাগাড়ম্বর ও কল্পনা-অনুমানের আশ্রয় নিয়েছেন ততই জটিলতা বেড়ে গেছে তাদের মধ্য থেকে যার চিন্তায় এ মিশ্র ব্যক্তিত্বের মানবিক সত্তার দিকটি বেশী প্রভাব বিস্তার করেছে তিনি ঈসাকে আল্লাহর পুত্র এবং তিনজন স্বতন্ত্র খোদার একজন হবার ওপর জোর দিয়েছেন আর যার চিন্তায় ইলাহী সত্তার দিকটি বেশী প্রভাব বিস্তার করেছে, তিনি ঈসাকে আল্লাহর দৈহিক প্রকাশ গণ্য করে তাঁকে ইবাদাত করেছেন আবার এ উভয় দলের মাঝামাঝি একটা পথ বের করতে যারা চেয়েছেন তারা নিজেদের সমস্ত শক্তি এমন সব শাব্দিক ব্যাখ্যা সংগ্রহে নিয়োগ করেছেন যাতে হযরত ঈসাকে মানুষও বলা যায় আবার এ সংগে তাঁকে আল্লাহ মনে করাও যেতে পারে আল্লাহ ও ঈসা পৃথক পৃথক থাকতে পারেন আবার একীভূতও হতে পারেন (দেখুন, সূরা আন নিসাঃ ২১২, ২১৩ ও ২১৫ টীকা)

৪০. এ বাক্যের মধ্যে এ মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইংগিত করা হয়েছে যে, নিছক ঈসার অলৌকিক জন্ম, তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং দৃষ্টি ও অনুভূতি গ্রাহ্য অলৌকিক কার্যকলাপে বিভ্রান্ত হয়ে যারা ঈসাকে আল্লাহমনে করেছে তারা আসলে একান্তই অজ্ঞ ঈসাতো আল্লাহর অসংখ্য অলৌকিক সৃষ্টির একটি নমুনা মাত্র এটি দেখেই এসব দুর্বল দৃষ্টির অধিকারী লোকদের চোখ ঝল্‌সে গেছে এদের দৃষ্টি যদি আর একটু প্রসারিত হতো তাহলে এরা দেখতে পেতো, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির এর চাইতে আরো অনেক বেশী বিস্ময়কর নমুনা পেশ করে যাচ্ছেন এবং তাঁর শক্তি কোন একটি বিশেষ সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নেই কাজেই সৃষ্টির কোন বিস্ময়কর ক্ষমতা দেখে তাকে স্রষ্টা মনে করা বিরাট অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক বরং সৃষ্টির কৃতিত্ব ও বিস্ময়কর কার্যাবলীর মধ্যে যে ব্যক্তি স্রষ্টার অসীম ক্ষমতার নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে এবং তা থেকে ঈমানে আলো সংগ্রহ করে সে-ই যথার্থ বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী

﴿وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَىٰ نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ ۚ قُلْ فَلِمَ يُعَذِّبُكُم بِذُنُوبِكُم ۖ بَلْ أَنتُم بَشَرٌ مِّمَّنْ خَلَقَ ۚ يَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ ۚ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۖ وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ﴾

১৮ ইহুদী ও খৃস্টানরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান এবং তাঁর প্রিয়পাত্র তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তাহলে তোমাদের গোনাহের জন্য তিনি তোমাদের শাস্তি দেন কেন? আসলে তোমরাও ঠিক তেমনি মানুষ যেমন আল্লাহ অন্যান্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন তিনি যাকে চান মাফ করে দেন এবং যাকে চান শাস্তি দেন পৃথিবী ও আকাশসমূহ এবং এ দুয়ের মধ্যকার যাবতীয় সৃষ্টি আল্লাহর মালিকানাধীন এবং তাঁরই দিকে সবাইকে যেতে হবে 

﴿يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ عَلَىٰ فَتْرَةٍ مِّنَ الرُّسُلِ أَن تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِن بَشِيرٍ وَلَا نَذِيرٍ ۖ فَقَدْ جَاءَكُم بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

১৯ হে আহ্‌লি কিতাব! আমার এ রাসূল এমন এক সময় তোমাদের কাছে এসেছেন এবং তোমাদেরকে দীনের সুস্পষ্ট শিক্ষা দিচ্ছেন যখন দীর্ঘকাল থেকে রাসূলদের আগমনের সিল্‌সিলা বন্ধ ছিল, তোমরা যেন একথা বলতে না পারো, আমাদের কাছে তো সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী আসেনি বেশ, এই দেখো, এখন সেই সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী এসে গেছেন এবং আল্লাহ সবকিছুর ওপর শক্তিশালী৪১ 

৪১. এ বাক্যটি গভীর অর্থব্যঞ্জক ও উচ্চাংগের সাহিত্যিক অংলকারে সমৃদ্ধ এখানে এর অর্থ হচ্ছে, যে আল্লাহ ইতিপূর্বে সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী পাঠাবার ক্ষমতা রাখতেন এখন তিনিই মুহাম্মাদ সা.কে সেই একই দায়িত্বে নিয়োগ করেছেন এবং এ ধরনের নিযুক্তির ক্ষমতাও তাঁর ছিল এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, যদি তোমরা এ সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারীর কথা না মানো, তাহলে মনে রেখো, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সবকিছু করতে সক্ষম তিনি তোমাদের যে শাস্তি দিতে চান তা কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁকে কোন বাধার সম্মূখীন হতে হয় না

﴿وَإِذْ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَعَلَ فِيكُمْ أَنبِيَاءَ وَجَعَلَكُم مُّلُوكًا وَآتَاكُم مَّا لَمْ يُؤْتِ أَحَدًا مِّنَ الْعَالَمِينَ﴾

২০ স্মরণ করো যখন মূসা তার জাতিকে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা আল্লাহর সেই নিয়ামতের কথা মনে করো, যা তিনি তোমাদের দান করেছিলেন তিনি তোমাদের মধ্যে বহু নবীর জন্ম দিয়েছেন, তোমাদেরকে শাসকে পরিণত করেছেন এবং তোমাদেরকে এমন সব জিনিস দিয়েছেন, যা দুনিয়ায় আর কাউকে দেননি৪২ 

৪২. এখানে বনী ইসরাঈলের অতীত গৌরবের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে হযরত মূসা আ. এর বহু পূর্বে কোন এক সময়ে তারা এ গৌরবের অধিকারী ছিল একদিকে তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন হযরত ইব্রাহীম, হযরত ইসহাক, হযরত ইয়া’কুব ও হযরত ইউসুফের মতো নবী ও রাসূলগণ এবং অন্যদিকে তারা হযরত ইউসুফ আ. এর আমলে ও তার পরবর্তী কালে মিসরে ব্যাপক শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েছিল দীর্ঘকাল পর্যন্ত তারাই ছিল তৎকালীন সভ্য জগতের সবচেয়ে প্রতাপশালী শাসক শক্তি এবং মিসর ও তার আশপাশের দেশে তাদেরই মুদ্রা প্রচলিত ছিল সাধারণত ঐতিহাসিকগণ বনী ইসরাঈলের উত্থানের ইতিহাস শুরু করেন হযরত মূসার আ. আমল থেকে কিন্তু কুরআন এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করছে যে, বনী ইসরাঈলের উত্থানের আসল যুগটি ছিল হযরত মূসার পূর্বে এবং হযরত মূসা নিজেই তার জাতির সামনে তাদের এ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন

﴿يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَىٰ أَدْبَارِكُمْ فَتَنقَلِبُوا خَاسِرِينَ﴾

২১ হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! সেই পবিত্র ভূখণ্ডে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন৪৩ পিছনে হটো না পিছনে হটলে তোমরা ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে৪৪ 

৪৩. এখানে ফিলিস্তিনের কথা বলা হয়েছে এ দেশটি হযরত –ইব্রাহীম, হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকুবের আবাসভূমি ছিল বনী ইসরাঈল মিসর থেকে বের হয়ে এলে আল্লাহ তাদের জন্য এ দেশটি নির্দিষ্ট করেন এবং সামনে অগ্রসর হয়ে এ দেশটি জয় করার নির্দেশ দেন

৪৪. হযরত মূসা তাঁর জাতিকে নিয়ে মিসর থেকে বের হবার প্রায় দু’বছর পর যখন তাদের সাথে ফারানের মরু অঞ্চলে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করছিলেন তখনই এ ভাষণটি দেন এ মরু অঞ্চলটি উত্তরে ও ফিলিস্তিনের দক্ষিণ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট সাইনা উপদ্বীপে অবস্থিত

﴿قَالُوا يَا مُوسَىٰ إِنَّ فِيهَا قَوْمًا جَبَّارِينَ وَإِنَّا لَن نَّدْخُلَهَا حَتَّىٰ يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِن يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنَّا دَاخِلُونَ﴾

২২ তারা জবাব দিল, হে মূসা! সেখানে একটা অতীব দুর্ধর্ষ জাতি বাস করে তারা সেখান থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা কখনই সেখানে যাবো না হাঁ, যদি তারা বের হয়ে যায় তাহলে আমরা সেখানে প্রবেশ করতে প্রস্তুত আছি  

﴿قَالَ رَجُلَانِ مِنَ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوا عَلَيْهِمُ الْبَابَ فَإِذَا دَخَلْتُمُوهُ فَإِنَّكُمْ غَالِبُونَ ۚ وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾

২৩ ঐ ভীরু লোকদের মধ্যে দুজন এমন লোকও ছিল৪৫ যাদের প্রতি আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলেন তারা বললো, এ শক্তিশালী লোকদের মোকাবিলা করে দরজার মধ্যে ঢুকে পড়ো ভেতরে প্রবেশ করলে তোমরাই জয়ী হবে আর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহর ওপর নির্ভর করো  

৪৫. ভীরু লোকদের মধ্য থেকে দু’জন বললো‘-এ বাক্যাংশটির দু’টি অর্থ হতে পারে একঃ যারা শক্তিশালীদেকে ভয় করছিল তাদের মধ্য থেকে দু’জন বলে উঠলো দুইঃ যারা আল্লাহকে ভয় করতো তাদের মধ্য থেকে দু’জন বলে উঠলো

﴿قَالُوا يَا مُوسَىٰ إِنَّا لَن نَّدْخُلَهَا أَبَدًا مَّا دَامُوا فِيهَا ۖ فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلَا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُونَ﴾

২৪ কিন্তু তারা আবার সেই একই কথা বললোঃ হে মূসা! যতক্ষণ তারা সেখানে অবস্থান করবে আমরা ততক্ষণ কোনক্রমেই সেখানে যাবো না কাজেই তুমি ও তোমার রব, তোমরা দুজনে সেখানে যাও এবং লড়াই করো, আমরা তো এখানে বসেই রইলাম 

﴿قَالَ رَبِّ إِنِّي لَا أَمْلِكُ إِلَّا نَفْسِي وَأَخِي ۖ فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ﴾

২৫ একথায় মূসা বললো, হে আমার রব! আমার ও আমার ভাই ছাড়া আর কারোর ওপর আমার কোন ইখতিয়ার নেই কাজেই তুমি এ নাফরমান লোকদের থেকে আমাকে আলাদা করে দাও 

﴿قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ ۛ أَرْبَعِينَ سَنَةً ۛ يَتِيهُونَ فِي الْأَرْضِ ۚ فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ﴾

২৬ আল্লাহ জবাব দিলেনঃ ঠিক আছে, তাহলে ঐ দেশটি চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য হারাম তারা পৃথিবীতে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াবে,৪৬ এ নাফরমানদের প্রতি কখনো সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করো না৪৭ 

৪৬. এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রাইবেলের গণনা পুস্তক, দ্বিতীয় বিবরণ ও যিহোশূয় পুস্তকে পাওয়া যাবে এর সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ হযরত মূসা ফিলিস্তিনের অবস্থা জানার জন্য ফারান থেকে বনী ইসরাঈলের ১২ জন সরদারকে ফিলিস্তিন সফরে পাঠান তারা ৪০ দিন সফর করার পর সেখান থেকে ফিরে আসেন জাতির এক সাধারণ সমাবেশে তারা জানান যে, ফিলিস্তিন তো খাদ্য ও অন্যান্য ভোগ্য সামগ্রীর প্রাচুর্যে ভরা এক সুখী সমৃদ্ধ দেশ, এতে সন্দেহ নেই কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা অত্যন্ত শক্তিশালী—–তাদের ওপর আক্রমণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই—–সেখানে আমরা যত লোক দেখেছি তারা সবাই বড়ই দীর্ঘদেহী সেখানে আমরা বনী ইনাককেও দেখেছি তারা মহাপরাত্রুমশালী ও দূর্ধর্ষ তরা বংশ পরস্পরায় পরাক্রমশালী আর আমরা তো নিজেদের দৃষ্টিতেই ফড়িংয়ের মতো ছিলাম এবং তাদের দৃষ্টিতেও”—- এ বর্ণনা শুনে সবাই সমস্বরে বলে উঠেঃ হায়, যদি আমরা মিসরেই মরে যেতাম! হায়, যদি এ মরুর বুকেই আমরা মরে যেতাম! আল্লাহ কেন আমাদের ঐ দেশে নিয়ে গিয়ে তরবারির সাহায্যে হত্যা করাতে চায়? এরপর আমাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তো লুটের মালে পরিণত হবে আমাদের জন্য মিসরে ফিরে যাওয়াই কি মংগলজনক হবে না?তারপর তারা পরস্পর বলাবলি করতে থাকে এসো আমরা কাউকে নিজেদের সরদার বানিয়ে নিই এবং মিসরে ফিরে যাই একথা শুনে ফিলিস্তিনে যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল সেই বারোজন সরদারদের মধ্য থেকে দু’জন-ইউশা ও কালেব উঠে দাঁড়ান তারা এ ভীরুতা ও কাপুরুষতার জন্য জাতিকে তিরস্কার করেন কালেব বলেন, “চলো, আমরা অতর্কিতে আক্রমণ করে সে দেশটি দখল করে নিই কারণ সে দেশটি পরিচালনা করার যোগ্যতা আমাদের আছে তারপর তারা দু’জন এক বাক্যে বলে ওঠেন, “যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে তিনি অবশ্যি আমাদের সে দেশে পৌঁছাবেন —-তবে তোমরা যেন আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করো এবং সে ভয় পেয়ো না কিন্তু জাতি ভীত না হও ‍‍‍‍‍‍”’আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন, কাজেই ওদের ভয় পেয়ো না কিন্তু জাতি তার জবাব দিল একথা বলে, “ওদেরকে পাথর মেরে হত্যা করো অবশেষে আল্লাহর ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং তিনি ফয়সালা করলেন, এখন ইউশা ও কালেব ছাড়া এ জাতির বয়স্ক পুরুষদের মধ্য থেকে আর কেউ সে ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারবে না এ জাতি চল্লিশ বছর পর্যন্ত গৃহহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে থাকবে অবশেষে যখন এদের মধ্যকার বিশ বছরের থেকে শুরু করে তার ওপরের বয়সের সমস্ত লোক মরে যাবে এবং নবীন বংশধররা যৌবনে প্রবেশ করবে তখনি এদেরকে ফিলিস্তিন জয় করার সুযোগ দেয়া হবে এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বনী ইসরাঈলের ফারান মরুভূমি থেকে পূর্ব জর্দানে পৌছাতে পৌছাতে ৩৮ বছর লেগে যায় যেসব লোক যুব বয়সে মিসর থেকে বের হয়েছিল তারা সবাই এ সময়ের মধ্যে মারা যায় পূর্ব জর্দান জয় করার পর হযরত মূসারও ইন্তিকাল হয় এরপর হযরত ইউশা ইবনে নূনের খিলাফত আমলে বনী ইসরাঈল ফিলিস্তিন জয় করতে সমর্থ হয়

বনী ইসরাঈলের মরু পরিক্রমা

ব্যাখ্যাঃ

হযরত মূসা আ. বনী ইসরাঈলদের মিসর হতে বের করে সীনা প্রান্তরের মারাহ, ঈলাম ও বীদাম-এর পথে সীন পর্বজ্ঞে দিকে আসেন এবং এক বছরের কিছু বেশী কাল পর্যন্ত এ স্থানে অবস্থান করতে থাকেন তাওরাতের বেশীর ভাগ বিধান এখানেই নাযিল হয় অতপর তাকে বনী ইসরাঈলদের নিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে যাওয়ার এবং উহা আয় করার নির্দেশ দেয়া হয় বলা হয়, ইহা তোমাদেরকে মীরাস হিসেবে দেয়া হয়েছে এ নির্দেশ অনুযায়ী হযরত মূসা আ. বনী ইসরাঈলদের সাথে নিয়ে তাবয়ীর ও হাচীরাত-এর পথেফারান প্রান্তরে উপস্থিত হন এখান হতে তিনি ফিলিস্তিনের অবস্থা জানার জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন ফিদিল নামক জায়গায় এ প্রতিনিধিদল ফিরে এসে রিপোর্ট পেশ করে হযরত ইউশা ও কালিব ছাড়া প্রতিনিধি দলের অন্যান্যের রিপোর্ট ছিল অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক বনী ইসরাঈলরা তা শুনে চীৎকার করে উঠে এবং তারা ফিলিস্তিন অভিযানে যেতে অস্বীকার করে তখন আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিলেন যে, এখন হতে চল্লিশ বছর কাল এরা এ অঞ্চলে ঘুরে ফিরবে এবং ইউশা ও কালিব ছাড়া বর্তমান লোকদের আর কেই ফিলিস্তিনের চেহারা দেখতে পাবে না এর পর বনী ইসরাঈলরা ফারান প্রান্তর, শুর প্রান্তর, চীন প্রান্তর-এর মাকে ইতস্তত দিশাহারা হয়ে ঘুরতে থাকে এবং আমালিকা, উমুরিয়া, আদুমীর, মাদিয়ানী এবং মুয়াব-এর লোকদের সাথে লড়াই করতে থাকে চল্লিশ বছর অতিবাহিত হবার উপক্রম হলে আদুম-এর সীমান্তের নিকট ‘হুর’ পর্বতে হযরত হারুন আ. ইন্তেকাল করেন পরে হযরত মূসা আ. বনী ইসরাঈলদের নিয়ে মুয়াব অঞ্চলে প্রবেশ করেন ও এ পূর্ণ অঞ্চলটিকে দখল করে নিলেন এভাবে হাসবুন ও শিত্তীম পর্যন্ত পৌঁছেন এবং আবারীম পর্বতে হযরত মূসা আ. প্রাণ ত্যাগ করেন তার পর তাঁর প্রথম খলীফা ইউশা পূর্বদিক হতে উর্দূন নদী পার হয়ে ইয়ারুহ (আরীহা) শহর জয় করেন ইহা ছিল ফিলিস্তিনের প্রথম শহর, যা বনী ইসরাঈলদের দখলে আসে এরপর অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র ফিলিস্তিন তারা দখল করে

এ মানচিত্রে উকৃতআয়লা (প্রাচীন নাম ঈলাত আর বর্তমান নাম আকাবা) সেই ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে সম্ভবত শনিবার ওয়ালাদের সূরা আল বাকারাহ (৮ম রুকু) ও সূরা আল আ’রাফ-এর (২১ রুকূ) উল্লেখিত সেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল

৪৭. বর্ণনার ধারাবাহিকতার প্রতি দৃষ্টি রেখে চিন্তা করলে এখানে এ ঘটনার বরাত দেবার উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় গল্পচ্ছলে একথা বর্ণনা করে বনী ইসরাঈলকে আসলে একথা বুঝানো হচ্ছে যে, মূসার সময় অবাধ্যতা, সত্য থেকে বিচ্যুতি ও কাপুরুষতার কাজ করে তোমরা যে শাস্তি পেয়েছিলে এখন মুহাম্মাদ সা. এর দাওয়াতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক নীতি অবলম্বন করলে তার চেয়ে অনেক বেশী শাস্তি ভোগ করবে

﴿وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ ۖ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ﴾

২৭ আর তাদেরকে আদমের দু-ছেলের সঠিক কাহিনী ও শুনিয়ে দাও তারা দুজন কুরবানী করলে তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না সে বললো, আমি তোমাকে মেরে ফেলবো সে জবাব দিল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকে৪৮ 

৪৮. অর্থাৎ তোমার কুরবানী কবুল না হয়ে থাকলে এতে আমার কোন দোষ নেই বরং তোমরা কুরবানী কবুল না হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, তোমার মধ্যে আল্লাহভীতি বা তাকওয়া নেই কাজেই আমাকে হত্যা না করে বরং তোমরা নিজের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টির চিন্তা করা উচিত

﴿لَئِن بَسَطتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ ۖ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ﴾

২৮ তুমি আমাকে মেরে ফেলার জন্য হাত উঠালেও আমি তোমাকে মেরে ফেলার জন্য হাত উঠাবো না৪৯ আমি বিশ্ব জাহানের প্রভু আল্লাহকে ভয় করি  

৪৯. এর অর্থ এ নয় যে, তুমি আমাকে হত্যা করতে এলে আমি হাত বেঁধে তোমার সামনে নিহত হবার জন্য তৈরী হয়ে যাবো এবং নিজের প্রতিরক্ষা করবো না বরং এর অর্থ হচ্ছে, তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও করো কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করতে চাইবো না তুমি আমাকে হত্যা করার জন্য কলা-কৌশল অবলম্বন ও ফন্দি ফিকির করতে চাও, তা করতে পারো, এ ব্যাপারে তোমরা পূর্ণ ইখতিয়ার আছে কিন্তু তুমি আমাকে হত্যা করার প্রস্তুতি চালাচ্ছো, একথা জানার পরও আমি তার আগেই তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবো না এখানে এতটুকু কথা অবশ্যি মনে রাখতে হবে, কোন ব্যক্তির নিজেকে অবলীলায় হত্যাকারীর সামনে পেশ করে দেয়া এবং জালেমের আক্রমণ প্রতিহত না করা কোন সওয়াবের কাজ নয় তবে যদি আমি জেনে থাকি, কোন ব্যক্তি আমাকে হত্যা করার ফিকিরে লেগে আছে এবং এ জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে আর এরপরও আমি তাকে হত্যা করার চিন্তা না করি এবং প্রথম অন্যায় আক্রমণ আমার পক্ষ থেকে না হয়ে বরং তার পক্ষ থেকে হোক, এটাকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে এতে অবশ্যি সওয়াব আছে এটিই ছিল আদম আ. এর সৎছেলেটির বক্তব্যের অর্থ ও মূল কথা

﴿إِنِّي أُرِيدُ أَن تَبُوءَ بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ فَتَكُونَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ۚ وَذَٰلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ﴾

২৯ আমি চাই, আমার ও তোমার পাপের ভার তুমি একাই বহন করো৫০ এবং তুমি জাহান্নামী হয়ে যাও জালেমদের জুলুমের এটিই সঠিক প্রতিফল  

৫০. অর্থাৎ আমাদের পরস্পরকে হত্যা করার প্রচেষ্টায় আমাদের দু’জনের গুনাহগার হবার পরিবর্তে আমি বরং ভাল মনে করছি আমাদের উভয়ের গুনাহ তোমার একার ভাগে পড়ুক তোমার নিজের পক্ষ থেকে হত্যার উদ্যোগের গুনাহ এবং তোমরা আক্রমণ থেকে আমার আত্মরক্ষার চেষ্টার কারণে তোমার যা ক্ষতি হয় তার গুণাহও

﴿فَطَوَّعَتْ لَهُ نَفْسُهُ قَتْلَ أَخِيهِ فَقَتَلَهُ فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

৩০ অবশেষে তার প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনা তার ভাইকে মেরে ফেলা তার জন্য সহজ করে দিল এবং তাকে মেরে ফেলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তরভুক্ত হয়ে গেলো

﴿فَبَعَثَ اللَّهُ غُرَابًا يَبْحَثُ فِي الْأَرْضِ لِيُرِيَهُ كَيْفَ يُوَارِي سَوْءَةَ أَخِيهِ ۚ قَالَ يَا وَيْلَتَا أَعَجَزْتُ أَنْ أَكُونَ مِثْلَ هَٰذَا الْغُرَابِ فَأُوَارِيَ سَوْءَةَ أَخِي ۖ فَأَصْبَحَ مِنَ النَّادِمِينَ﴾

৩১ তারপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন সে মাটি খুঁড়তে লাগলো, যাতে তাকে দেখিয়ে দেয় তার ভাইয়ের লাশ কিভাবে লুকিয়ে ফেলবে এ দৃশ্য দেখে সে বললো, হায় আফসোস! আমি এ কাকটির মতোও হতে পারলাম না যাতে নিজের ভাইয়ের লাশটিও লুকাতে পারি৫১ এরপর নিজের কৃতকর্মের জন্য সে খুবই অনুতপ্ত হলো৫২ 

৫১. এভাবে মহান আল্লাহ একটি কাকের মাধ্যমে আদমের বিভ্রান্ত ও অসৎ পুত্রটিকে তার মূর্খতা ও অজ্ঞতা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন আর একবার যখন সে নিজের মনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সুযোগ পেয়েছে তখন তার লজ্জা কেবলমাত্র এতটুকু বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি যে, সে লাশ লুকাবার কৌশল বের করার ব্যাপারে কাকের থেকে পেছনে থেকে গেলো কেন বরং তার মনে এ অনুভূতিও জন্ম নিয়েছে যে, নিজের ভাইকে হত্যা করে সে কত বড়ই না মূর্খতার পরিচয় দিয়েছে পরবর্তী বাক্য” সে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলো”-থেকে এ অর্থই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে

৫২. ইহুদীরা নবী সা. ও তাঁর কতিপয় মর্যাদাশালী সাহাবায়ে কেরামকে হত্যা করার জন্য যে চক্রান্ত করেছিল তার ব্যাপারে তাদেরকে সূক্ষ্মভাবে তিরস্কার করাই হচ্ছে এখানে এ ঘটনাটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য (এ জন্য এ সূরার ৩০ টীকাটি দেখে নিন) দু’টি ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট মহান আল্লাহ আরবের এ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে আরব ও বিশ্ববাসীর নেতৃত্ব দানের জন্য কবুল করে নিয়েছিলেন এবং এ পুরাতন আহ্‌লি কিতাবদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- এর ভিত্তি ছিল একমাত্র এই যে, একদিকে তাকওয়া ছিল এবং অন্যদিকে তাকওয়া ছিল না কিন্তু যাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল তারা নিজেদের প্রত্যাখ্যাত হবার কারণ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা এবং যেসব দোষ ও অপরাধের কারণে তারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সেগুলো সংশোধন ও দূর করতে উদ্বুদ্ধ হবার পরিবর্তে আদমের বিভ্রান্ত পুত্রটি যেমন মূর্খতার গর্তে নিমজ্জিত হয়েছিল, ঠিক তেমনি তারাও এমনসব লোককে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল যাদেরকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছিলেন অথচ একথা সুস্পষ্ট ছিল, এ ধরনের মূর্খতাপ্রসূত কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা কখনো আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হতে পারতো না বরং এসব কার্যকলাপ তাদেরকে আল্লাহর নিকট আরো বেশী অপ্রিয় করে তুলেছিল এবং তারা আরো বেশী প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল

﴿مِنْ أَجْلِ ذَٰلِكَ كَتَبْنَا عَلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ۚ وَلَقَدْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًا مِّنْهُم بَعْدَ ذَٰلِكَ فِي الْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ﴾

৩২ এ কারণেই বনী ইসরাঈলের জন্য আমি এ ফরমান লিখে দিয়েছিলাম,৫৩ নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোন কারণে যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলো সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করলো আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করলো সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষের জীবন রক্ষা করলো৫৪ কিন্তু তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, রাসূলগণ একের পর এক সুস্পষ্ট হেদায়াত নিয়ে তাদের কাছে এলো, তারপরও তাদের বিপুল সংখ্যক লোক পৃথিবীতে সীমালংঘনকারীই থেকে গেলো  

৫৩. অর্থাৎ যেহেতু আদমের এ জালেম সন্তানটি যেসব অসৎগুণের প্রকাশ ঘটিয়েছিল বনী ইসরাঈলের মধ্যেও সেইসব গুণের নিদর্শন পাওয়া যেতো, তাই মহান আল্লাহ তাদেরকে নরহত্যা থেকে বিরত থাকার ওপর ভীষণভাবে জোর দিয়েছিলেন এবং তাঁর ফরমানে একথা লিখে দিয়েছিলেন দুঃখের বিষয়, বর্তমান প্রচলিত বাইবেলে আল্লাহর ফরমানের এ মূল্যবান শব্দাবলীর ঠাঁই নেই তবে তালমূদে এ বিষয়বস্তুটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি ইসরাঈলের একটি প্রাণকে হত্যা করলো আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে সে যেন সারা দুনিয়ার মানুষকে হত্যা করলো আর যে ব্যক্তি ইসরাঈলের একটি প্রাণ রক্ষা করলো আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে সে যেন সারা দুনিয়ার মানুষকে রক্ষা করলো” এভাবে তালমূদে একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, হত্যা মামলায় বনী ইসরাঈরের বিচারপতিরা সাক্ষীদেরকে সম্বোধন করে বলতেনঃ “যে ব্যক্তি একজন মানুষকে হত্যা করে সে এমনভাবে জবাবদিহি করার যোগ্য যেন সে সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করেছে

৫৪. এর অর্থ হচ্ছে, দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে অন্য মানুষের প্রাণের প্রতি মর্যাদাবোধ যদি জাগ্রত থাকে এবং তাদের প্রত্যেকে অন্যের জীবনের স্থায়িত্বে ও সংরক্ষণে সাহায্যকারী হবার মনোভাব পোষণ করে তা হলেই কেবল মানব জাতির অস্তিত্ব নিশ্চিত ও নিরাপদ হতে পারে যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে সে কেবলমাত্র ঐ এক ব্যক্তির ওপর জুলুম করে না বরং সে একথাও প্রমাণ করে যে, তার অন্তরে মানুষের জীবনের প্রতি মর্যাদাবোধ ও সহানুভূতির কোন স্থান নেই কাজেই সে সমগ্র মানবতার শত্রু কারণ তার মধ্যে এমন একটা বৈশিষ্টের অস্তিত্ব বিরাজমান যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে পাওয়া গেলে সারা দুনিয়া থেকে মানব জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানুষের জীবন রক্ষায় সাহায্য করে সে আসলে মানবতার সাহায্যকারী ও সমর্থক কারণ তার মধ্যে এমন গুণ পাওয়া যায়, যার ওপর মানবতার অস্তিত্ব নির্ভরশীল

﴿إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَن يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم مِّنْ خِلَافٍ أَوْ يُنفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ۚ ذَٰلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾

৩৩ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়,৫৫ তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলিবিদ্ধ করা হবে বা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে৫৬ দুনিয়ায় তাদের জন্য এ অপমান ও লাঞ্ছনা নির্ধারিত রয়েছে আর আখেরাতের রয়েছে তাদের জন্য এর চাইতেও বড় শাস্তি  

৫৫. পৃথিবী বলতে এখানে পৃথিবীর সেই অংশ ও অঞ্চল বুঝাচ্ছে যেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কায়েম করার দায়িত্ব ইসলামী সরকার গ্রহণ করেছে আর আল্লাহ ও রাসূলের সাথে লড়াই করার অর্থ হচ্ছে, ইসলামী সরকার দেশে যে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন করেছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা পৃথিবীতে একটি সৎ ও সত্যনিষ্ঠ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আল্লাহর ইচ্ছা এবং এ জন্য তিনি নিজের রাসূল পাঠিয়েছিলেন সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে পৃথিবীতে অবস্থানকারী মানুষ, পশু, বৃক্ষ ইত্যাদি সমস্ত সৃষ্টি শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে, মানবতা তার প্রকৃতির কাংখিত পূর্ণতায় পৌঁছতে সক্ষম হবে এবং পৃথিবীর সমুদয় উপায় উপকরণ এমনভাবে ব্যবহৃত হবে যার ফলে সেগুলো মানবতার ধ্বংস ও বিলুপ্তির নয় বরং তার উন্নতির সহায়ক হবে এ ধরনের ব্যবস্থা কোন ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর তাকে নষ্ট করার প্রচেষ্টা চলানো, তা ক্ষুদ্র পরিসরে হত্যা, লুন্ঠন, রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদির পর্যায়ে চাপানো হোক অথবা আরো বড় আকারে, এ সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যবস্থাকে উৎখাত করে তার জায়গায় কোন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেই চালানো হোক না কেন, তা আসলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবেই বিবেচিত হবে এটা ঠিক তেমনি যেমন ভারতীয় দণ্ডবিধিতে কোন ব্যক্তির ভারতে বৃটিশ সরকারের ক্ষমতা উচ্ছেদের প্রচেষ্টাকে “সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” (Waging War Against the king) করার অপরাধে অভিযুক্ত গণ্য করা হয়েছে–সে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোন একজন মামুলি সিপাইয়ের বিরুদ্ধে কিছু করলেও এবং সম্রাট তার নাগালের বহু দূরে অবস্থান করলেও তার অপরাধের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় না

৫৬. এ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা এখানে সংক্ষেপে বলে দেয়া হয়েছে, যাতে করে কাযী বা সমকালীন ইসলামী শাসক নিজের ইজতিহাদের মাধ্যমে প্রত্যেক অপরাধীকে তার অপরাধের ধরণ ও মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারেন আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা প্রকাশ করা যে, ইসলামী হুকুমাতের আওয়তায় বাস করে কোন ব্যক্তির ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা চালানো নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ এবং এ জন্য তাকে উল্লেখিত চরম শাস্তিগুলোর মধ্য থেকে কোন শাস্তি দেয়া যেতে পারে

﴿إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِن قَبْلِ أَن تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ ۖ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾

৩৪ তবে যারা তোমাদের হাতে পড়ার আগেই তাওবা করে তাদের জন্য নয় তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী৫৭ 

৫৭. অর্থাৎ যদি তারা বিপর্যয় সৃষ্টির প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয়, সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন ও তাকে ছিন্নভিন্ন করার অপচেষ্টা পরিহার করে এবং তাদের পরবর্তী কর্মনীতি একথা প্রমাণ করে যে, তারা শান্তিপ্রিয়, আইনের অনুগত ও সদাচারী হয়ে গেছে আর তারপরই যদি তাদের আগের অপরাধের কথা জানা যায়, তাহলে ওপরে বর্ণিত শাস্তিগুলোর মধ্য থেকে কোন শাস্তি তাদেরকে দেয়া হবে না তবে যদি তারা মানুষের অধিকারের ওপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করে থাকে, তাহলে তার দায়িত্ব থেকে তাদেরকে মুক্ত করা যাবে না যেমন তারা কোন ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল অথবা কারোর সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত করেছিল বা অন্য কোন অপরাধ করেছিল, এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে ঐ বিশেষ অপরাধ সংক্রান্ত ফৌজদারী মামলা চালানো হবে কিন্তু বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা বা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা সম্পর্কিত কোন মামলা তাদের বিরুদ্ধে চালানো হবে না

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾

৩৫ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর দরবারে নৈকট্যলাভের উপায় অনুসন্ধান করো৫৮ এবং তাঁর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করো,৫৯ সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে  

৫৮. অর্থাৎ এমন প্রত্যেকটি উপায় অনুসন্ধান করতে থাকো যার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে পৌঁছতে পারো

৫৯. মূলে جاهدوا “জাহিদু” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে নিছক প্রচেষ্টা ও সাধনাশব্দ দু’টির মাধ্যমে এর অর্থের সবটুকু প্রকাশ হয় না আর مجاهده মুজাহাদাশব্দটির মধ্যে মুকাবিলার অর্থ পাওয়া যায় এর সঠিক অর্থ হচ্ছেঃ যেসব শক্তি আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা তোমাদের আল্লাহর মর্জি অনুসারে চলতে বাধা দেয় এবং তাঁর পথ থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে, যারা তোমাদের পুরোপুরি আল্লাহর বান্দা হিসেবে জীবন যাপন করতে দেয় না এবং নিজের বা আল্লাহর ছাড়া আর কারোর বান্দা হবার জন্য তোমাদের বাধ্য করে, তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের সম্ভাব্য সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাও এ প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ওপর তোমাদের সাফল্য এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ নির্ভর করছে

এভাবে এ আয়াতটি মুমিন বান্দাকে প্রতিটি ক্ষেত্রে চতুর্মুখী ও সর্বাত্মক লড়াই করার লড়াই করার নির্দেশ দেয় একদিকে আছে অভিশপ্ত ইবলীস এবং তার শয়তানী সেনাদল অন্যদিকে আছে মানুষের নিজের নফস ও তার বিদ্রোহী প্রবৃত্তি তৃতীয় দিকে আছে এমন এক আল্লাহ বিমুখ মানব গোষ্ঠী যাদের সাথে মানুষ সব ধরনের সামাজিক, তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সূত্রে বাঁধা চতুর্থ দিকে আছে এমন ভ্রান্ত ধর্মীয় তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার ভিত্তিভূমি গড়ে উঠেছে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ওপর এবং তা সত্যের আনুগত্য করার পরিবর্তে মিথ্যার আনুগত্য করতে মানুষকে বাধ্য করে এদের সবার কৌশল বিভিন্ন কিন্তু সবার চেষ্টা একমুখী এরা সবাই মানুষকে আল্লাহর পরিবর্তে নিজের অনুগত করতে চায় বিপরীত পক্ষে, মানুষের পুরোপুরি আল্লাহর অনুগত হওয়া এবং ভিতর থেকে বাইর পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহর নির্ভেজাল বান্দায় পরিণত হয়ে যাওয়ার ওপরই তার উন্নতি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মর্যাদার উন্নীত হওয়া নির্ভর করে কাজেই এ সমস্ত প্রতিবন্ধক ও সংঘর্ষশীল শক্তির বিরুদ্ধে একই সাথে সংগ্রামমুখর হয়ে, সবসময় ও সব অবস্থায় তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থেকে এবং এ সমস্ত প্রতিবন্ধককে বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত করে আল্লাহর পথে অগ্রসর না হলে নিজের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানো তার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়

﴿إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ أَنَّ لَهُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لِيَفْتَدُوا بِهِ مِنْ عَذَابِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

৩৬ ভালভাবে জেনে নাও, যারা কুফরীর নীতি অবলম্বন করেছে সারা দুনিয়ার ধন-দৌলত যদি তাদের অধিকারে থাকে এবং এর সাথে আরো সমপরিমাণও যুক্ত হয় আর তারা যদি কিয়ামতের দিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সেগুলো মুক্তিপণ হিসেবে দিতে চায়, তাহলেও তাদের কাছ থেকে তা গৃহীত হবে না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবেই

﴿يُرِيدُونَ أَن يَخْرُجُوا مِنَ النَّارِ وَمَا هُم بِخَارِجِينَ مِنْهَا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيمٌ﴾

৩৭ তারা জাহান্নামের আগুন থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে কিন্তু তা তারা পারবে না তাদেরকে স্থায়ী শাস্তি দেয়া হবে 

﴿وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾

৩৮ চোর-পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন, উভয়ের হাত কেটে দাও৬০ এটা তাদের কর্মফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আল্লাহর শক্তি সবার ওপর বিজয়ী এবং তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ  

৬০. দু’হাত নয় বরং এক হাত আর সমগ্র উম্মত এ ব্যাপারেও একমত যে, প্রথমবার চুরি করলে ডান হাত কাটতে হবে নবী সা. বলেছেনঃ لاقطع على خائن “খেয়ানতকারীর হাত কাটা হবে না,” এ থেকে জানা যায়, খেয়ানত বা আত্মসাৎ ইত্যাদি চুরির পর্যায়ভুক্ত নয় বরং চুরি বলতে এমন কাজ বুঝায় যার মাধ্যমে মানুষ একজনের ধন সম্পদ তার নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ থেকে বের করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে

নবী সা. এই সাথে এরূপ নির্দেশও দিয়েছেন যে, একটি ঢালের মূল্যের চেয়ে কম পরিমাণ চুরি করলে হাত কাটা যাবে না আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনা অনুযায়ী নবী সা. এর যুগে একটি ঢালের মূল্য ছিল দশ দিরহাম, ইবনে উমরের বর্ণনা অনুযায়ী তার মূল্য ছিল তিন দিরহাম, আনাস ইবনে মালিকের বর্ণনা অনুযায়ী পাঁচ দিরহাম এবং হযরত আয়েশার বর্ণনা অনুযায়ী ছিল অর্ধ দিনার সাহাবীদের এ মতবিরোধের কারণে চুরির সর্বনিম্ন নিসাব অর্থাৎ কমপক্ষে কি পরিমাণ চুরি করলে হাত কাটা হবে এবং ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে ইমাম আবু হানীফার মতে এর সর্বনিম্ন পরিমান দশ দিরহাম ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমদের মতে এক-চতুর্থাংশ দীনার (সে যুগের দিরহামে থাকতো ৩ মাসা ১.২০ রতি পরিমাণ রূপা এবং এক-চতুর্থাংশ দীনার হতো ৩ দিরহামের সমান)আবার এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো চুরি করলে হাত কাটার শাস্তি দেয়া যাবে না যেমন নবী সা. এর নির্দেশ لا قطع في ثمرة ولا كثر (অর্থাৎ ফল ও সবজী চুরি করলে হাত কাটা যাবে না) لاقطع في طعام (অর্থাৎ খাদ্যবস্তু চুরি করলে হাত কাটা যাবে না) হযরত আয়েমা রা. একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন তাতে বলা হয়েছেঃ

لم يكن قطع السارق على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم في الشئ التاقة

তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তু চুরির অপরাধে নবী সা. এর আমলে হাত কাটা হতো না

হযরত আলী ও হযরত উসমানের ফায়সালা ছিল لا قطع في الطير (অর্থাৎ পাখি চুরি করলে হাত কাটা যাবে না) এবং সাহাবীগণের মধ্য থেকে কেউ এ ব্যাপারে মতবিরোধ প্রকাশ করেননি তাছাড়া হযরত উমর ও আলী রা. বাইতুলমাল থেকে কেউ কোন বস্তু চুরি করলে তার হাত কাটেননি এ বাপারেও কোথাও সাহাবায়ে কেরামের কোন মতবিরোধের উল্লেখ নেই এসব মৌল উৎসের ভিত্তিতে ফিকাহর বিভিন্ন ইমাম কিছু নির্দিষ্ট বস্তু চুরি করার অপরাধে হাত কাটার দণ্ড না দেবার কথা ঘোষণা করেছেন ইমাম আবু হানীফার মতে শাক-শবজি, ফল, গোশত রান্না করা খাবার, যে শস্য এখনো স্তূপীকৃত করা হয়নি এবং খেলার সরঞ্জাম ও বাদ্যযন্ত্র চুরি করলে হাত কাটার শাস্তি দেয়া হবে না এ ছাড়াও তিনি বনে বিচরণকারী পশু ও বাইতুল-মালের জিনিস চুরি করলে তাতে হাত কাটার শাস্তি নেই বলে ঘোষণা করেছেন অনুরূপভাবে অন্যান্য ইমামগণও কোন কোন জিনিস চুরির ক্ষেত্রে এ শাস্তি কার্যকর নয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, এ চুরিগুলোর অপরাধে আদতে কোন শাস্তিই দেয়া হবে না বরং এর অর্থ হচ্ছে, এ অপরাধগুলোর কারণে হাত কাটা হবে না

﴿فَمَن تَابَ مِن بَعْدِ ظُلْمِهِ وَأَصْلَحَ فَإِنَّ اللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾

৩৯ তবে যে ব্যক্তি জুলুম করার পর তাওবা করবে এবং নিজের সংশোধন করে নেবে, আল্লাহর অনুগ্রহের দৃষ্টি আবার তার দিকে ফিরে আসবে৬১ আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু  

৬১. এর অর্থ এ নয় যে, তার হাত কাটা হবে না বরং এর অর্থ হচ্ছে, হাত কাটার পর যে ব্যক্তি তাওবা করবে এবং নিজেকে চুরি থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত রেখে আল্লাহর সৎ বান্দায় পরিণত হয়ে যাবে সে আল্লাহর গযব থেকে রক্ষা পাবে এ অবস্থায় তার গায়ে যে গুনাহের কালংক লেগেছিল তা ধুয়ে দেবেন কিন্তু কোন ব্যক্তি হাত কেটে যাবার পরও যদি নিজেকে অসৎ সংকল্প মুক্ত না করে এবং আগের দুষ্কৃতির মনোভাব লালন করতে থাকে, যার ভিত্তিতে সে চুরি করেছিল এবং তাকে হাত কাটার শাস্তি দেয়া হয়েছিল, তাহলে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে হাত তার দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু তার অন্তরে চুরির মনোভাব এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে তাই হাত কাটার আগে সে যেমন আল্লাহর গযবের অধিকারী ছিল হাত কাটার পরেও ঠিক তেমনিই থেকে যাবে তাই কোরআন মজীদ চোরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার এবং নিজের সংশোধন করার নির্দেশ দেয় কারণ হাত কাটা হয়েছে সামাজিক ও তামাদ্দুনিক ব্যবস্থাপনাকে বিশৃংখলামুক্ত করার জন্য এ শাস্তির কারণে আত্মা ও মন পবিত্র ও কলুষতা মুক্ত হতে পারে না আত্মা ও মন পবিত্র হতে পারে একমাত্র তাওবা ও আল্লাহর প্রতি সমর্পিত প্রাণ হবার মাধ্যমে হাদীসে নবী সা. সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছেঃ তাঁর হুকুম মোতাবিক এক চোরের হাত কাটার পর তিনি তাকে নিজের কাছে ডেকে আনেন তাকে বলেন, বলো-قل استغفر الله وأتوب إليه (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাঁর কাছে তাওবা করছি) সে তাঁর নির্দেশ অনুসারে ঐ বাক্যটি বলার পর তিনি তার জন্য দোয়া করেনঃ اللهم تب عليه (হে আল্লাহ! তাকে মাফ করো)

﴿أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ وَيَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

৪০ তুমি কি জানো না, আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশ রাজ্যের মালিক? তিনি যাকে চান শাস্তি দেন এবং যাকে চান ক্ষমা করে দেন, তিনি সব জিনিসের ওপর ইখতিয়ার রাখেন

﴿يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ لَا يَحْزُنكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْكُفْرِ مِنَ الَّذِينَ قَالُوا آمَنَّا بِأَفْوَاهِهِمْ وَلَمْ تُؤْمِن قُلُوبُهُمْ ۛ وَمِنَ الَّذِينَ هَادُوا ۛ سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ سَمَّاعُونَ لِقَوْمٍ آخَرِينَ لَمْ يَأْتُوكَ ۖ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ مِن بَعْدِ مَوَاضِعِهِ ۖ يَقُولُونَ إِنْ أُوتِيتُمْ هَٰذَا فَخُذُوهُ وَإِن لَّمْ تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوا ۚ وَمَن يُرِدِ اللَّهُ فِتْنَتَهُ فَلَن تَمْلِكَ لَهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ لَمْ يُرِدِ اللَّهُ أَن يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمْ ۚ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ ۖ وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾

৪১ হে রাসূল! কুফরীর পথে যারা দ্রুত পদচারণার পরাকাষ্ঠ দেখাচ্ছে তারা যেন তোমার মর্মপীড়ার কারণ না হয়,৬২ যদিও তারা এমন সব লোকের অন্তরভুক্ত হয় যারা মুখে বলে আমরা ঈমান এনেছি কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান আনেনি অথবা তারা এমন সব লোকের অন্তরভুক্ত হয় যারা ইহুদী হয়ে গেছে, যাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁচ্ছে গেছে যে, তারা মিথ্যা ভাষণ শোনার জন্য জান্য পেতে বসে থাকে,৬৩ এবং যারা কখনো তোমার কাছে আসেনি তাদের জন্য আড়ি পেতে থাকে,৬৪ আল্লাহর কিতাবের শব্দাবলীর সঠিক স্থান নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও যারা সেগুলোকে তাদের আসল অর্থ থেকে বিকৃত করে৬৫ এবং লোকদের বলে, যদি তোমাদের এ হুকুম দেয়া হয় তাহলে মেনে নাও অন্যথায় মেনো না৬৬ যাকে আল্লাহ নিজেই ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচাবার জন্য তোমরা কিছুই করতে পারবে না৬৭ এসব লোকের অন্তরকে আল্লাহ পবিত্র করতে চাননি৬৮ এদের জন্য দুনিয়াতে আছে লাঞ্ছানা এবং আখেরাতে কঠিন শাস্তি  

৬২. অর্থাৎ যারা জাহেলিয়াতের অবস্থা অপরিবর্তিত রাখার এবং ইসলামের এ সংস্কারমূলক দাওয়াত যাতে ঐ সমস্ত বিকৃতি ও গলদ দূর করতে সক্ষম না হয় সে জন্য নিজেদের সকল প্রকার বুদ্ধবৃত্তি ও কর্মতৎপরতা নিয়োজিত করে তারা সমস্ত নৈতিক বাঁধনমুক্ত হয়ে নবী সা. এর বিরুদ্ধে সব রকমের নিকৃষ্টতম চক্রান্ত চালাচ্ছিল তারা জেনে বুঝে সত্যকে বেমালুম হজম করে যাচ্ছিল অত্যন্ত নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা ও দুঃসাহসের সাথে ধোঁকা, প্রতারণা, জালিয়াতি ও মিথ্যার অস্ত্র ব্যবহার করে এমন এক পবিত্র ও নিষ্কলুষ ব্যক্তির কার্যক্রমকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল যিনি একান্ত নিস্বার্থভাবে পরোপকার ও নিছক কল্যাণাকাংখার ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের এবং তাদের নিজেদের মংগলের জন্য দিনরাত মেহনত করে যাচ্ছিলেন তাদের এ তৎপরতা দেখে নবী সা. মনে অত্যন্ত মর্মজ্বালা অনুভব করতেন তাঁর এ মর্মজ্বালা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক যখন কোন পবিত্র ও নিষ্কলুষ ব্যক্তি নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী লোকদের মুখোমুখি হন এবং তারা নিছক নিজেদের মূর্খতা, সংকীর্ণমনতা ও স্বার্থন্ধতার কারণে তাঁর কল্যাণকর ও শুভাকাংখামূলক প্রচেষ্টাবলীর পথ রোধ করার জন্য নিকৃষ্ট ধরনের চালবাজী ও কুটকৌশল অবলম্বন করতে থাকে তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি মনে ব্যাথা পান কাজেই এখানে আল্লাহর বক্তব্যের উদ্দেশ্য এ নয় যে, তাদের ঐসব কর্মতৎপরতার কারণে রাসূলের মনে স্বাভাবিকভাবে যে ব্যাথা ও মর্মবেদনার সৃষ্টি হয় তা না হওয়া উচিত বরং আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, তাঁর মন খারাপ করার কোন প্রয়োজন নেই তিনি যেন মনোবল না হারিয়ে ফেলেন এবং সবরের সাথে আল্লাহর বান্দাদের সংস্কার ও সংশোধনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন আর এসব লোকের ব্যাপারে বলা যায় যে, এরা যে ধরনের নিকৃষ্ট নৈতিক গুণাবলী নিজেদের মধ্যে লালন করেছে তাতে তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের ব্যবহারই আশা করা যেতে পারে এবং এ ব্যাপারে তাদের কোন ব্যবহারই অপ্রত্যাশিত নয়

৬৩. এর দু’টি অর্থ হতে পারে এরা যেহেতু প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়ে গেছে তাই সত্যের সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই এরা মিথ্যাই পছন্দ করে এবং মনোযোগ সহকারে মিথ্যাই শুনে থাকে কাজেই এতেই এদের মনের তৃষ্ণা মেটে আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, এরা নবী সা. ও মুসলমানদের মজলিসে এসে বসে মিথ্যাচারের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য এখানে এসে এরা যা কিছু দেখে ও শোনে সেগুলোকে বিপরীত অর্থে প্রয়োগ করে অথবা নিজেদের পক্ষ থেকে মিথ্যার মিশ্রণ দিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে নবী সা. ও মুসলমানদের দুর্নাম রটাবার জন্য লোকদের মধ্যে চড়াতে থাকে

৬৪. এরও দু’টি অর্থ হতে পারে একটি অর্থ হচ্ছে, এরা গোয়েন্দা হয়ে আসে এরা নবী সা. ও মুসলমানদের মজলিসে ঘোরাফেরা করে কোন গোপন কথা কানে পড়লে তা নিয়ে মুসলমানদের শত্রুদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয় দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, এরা মিথ্যা দোষারোপ ও নিন্দা করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করে বেড়ায় এবং যেসব লোক সরাসরি নবী সা. ও মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি তাদের মধ্যে ভুল ধারণা এবং নবী ও ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার কাজে লিপ্ত হয়

৬৫. অর্থাৎ তাওরাতের যেসব বিধান তদের মনমাফিক নয়, সেগুলোর মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে রদবদল করে এবং শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে সেখান থেকে নিজেদের ইচ্ছামাফিক বিধান তৈরী করে

৬৬. অর্থাৎ মূর্খ জনগণকে বলে, আমরা যে বিধান শুনাচ্ছি মুহাম্মাদ সা.ও যদি এই একই বিধান তোমাদের শোনায় তাহলেই তা গ্রহণ করো, অন্যথায় প্রত্যাখ্যান করো

৬৭. আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহ কোন খারাপ প্রবণতা লালিত হতে দেখেন তার সামনে একের পর এক এমন সব সুযোগ সৃষ্টি করে দেন যার ফলে সে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয় সে ব্যক্তি যদি এখনো অসৎকর্মের প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকে না পড়ে থাকে তাহলে এ পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে সে নিজেকে সামলে নেয় তার মধ্যে অসৎপ্রবৃত্তির মোকাবিলা করার জন্য সৎপ্রবৃত্তির যে শক্তিগুলো থাকে সেগুলো তীব্র হয়ে আত্মপ্রকাশ করে কিন্তু যদি সে অসৎকর্মের প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ে থাকে এবং তার সৎপ্রবণতা তার অসৎপ্রবণতার কাছে পরাজিত হয়ে থাকে তাহলে এ ধরনের প্রত্যেকটি পরীক্ষার সময় সে আরো বেশী অসৎপ্রবণতা ও অসৎকর্মের ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে থাকবে এটিই হচ্ছে আল্লাহর সেই ফিতনা বা পরীক্ষা যার হাত থেকে কোন বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন মানুষকে বাঁচানোর ক্ষমতা তার কোন কল্যাণাকাংখীর নেই আর এ ফিতানার মধ্যে কেবল ব্যক্তিরাই নয় জাতিরাও নিক্ষিপ্ত হয়

৬৮. কারণ তারা নিজেরাই পবিত্র হতে চায়নি যে নিজে পবিত্র হতে চায় এবং এ জন্য প্রচেষ্টা ও সাধানা করে তাতে পবিত্রতা থেকে বঞ্চিত করা আল্লাহর নীতি নয় যে নিজে পবিত্র হতে চায় না আল্লাহ তাকে পবিত্র করতে চান না

﴿سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّالُونَ لِلسُّحْتِ ۚ فَإِن جَاءُوكَ فَاحْكُم بَيْنَهُمْ أَوْ أَعْرِضْ عَنْهُمْ ۖ وَإِن تُعْرِضْ عَنْهُمْ فَلَن يَضُرُّوكَ شَيْئًا ۖ وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُم بَيْنَهُم بِالْقِسْطِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ﴾

৪২ এর মিথ্যা শ্রবণকারী ও হারাম আহারকারী৬৯ কাজেই এরা যদি তোমাদের কাছে (নিজেদের মামলা নিয়ে) আসে তাহলে তোমরা চাইলে তাদের মীমাংসা করে দিতে অথবা অস্বীকার করে দিতে পারো অস্বীকার করে দিলে এর তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না আর মীমাংসা করে দিলে যথার্থ ইনসাফ সহকারে মীমাংসা করো কারণ আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন  

৬৯. এখানে বিশেষ করে তাদের সে সব মুফতী ও বিচারপতিদের দিকে ইংগিত করা হয়েছে, যারা মিথ্যা সাক্ষ্য নিয়ে ও মিথ্যা বিবরণ শুনে এমন সব লোকদের পক্ষে ইনসাফ ও ন্যায়নীতি বিরোধী ফায়সালা করতো যাদের কাছ থেকে তারা ঘুষ নিতো অথবা যাদের সাথে তাদের অবৈধ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকতো

﴿وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ وَعِندَهُمُ التَّوْرَاةُ فِيهَا حُكْمُ اللَّهِ ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ ۚ وَمَا أُولَٰئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ﴾

৪৩ আর এরা৭০ তোমাকে কিভাবে বিচারক মানছে যখন এদের কাছে তাওরাত রয়ে গেছে, যাতে আল্লাহর হুকুম লিখিত আছে আর তারপরও এরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?৭১ আসলে এরা ঈমানই রাখে না  

৭০. ইহুদীরা তখনো পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়মিত প্রজা হিসেবে গণ্য হয়নি বরং সদ্ধি ও চুক্তির ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এ চুক্তিগুলোর প্রেক্ষিতে ইহুদীরা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহে স্বাধীনতা ভোগ করতো এবং তাদের মামলার ফায়সালা তাদের আইন অনুযায়ীই তাদের নিজেদের বিচারপতিরাই করতো নবী সা. বা তাঁর নিযুক্ত বিচারপতিদের কাছে নিজেদের মামলা-মোকদ্দমা আনার ব্যাপারে আইনের দিক দিয়ে তারা বাধ্য ছিল না কিন্তু যেসব ব্যাপারে তারা নিজেদের দর্শীয় আইন অনুযায়ী ফায়সালা করতে চাইতো না যেসব ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য তারা নবী সা. এর কাছে আসতো তারা আশা করতো, নবী সা. এর শরীয়াতে হয়তো তাদের জন্য অন্য কোন বিধান আছে এবং এভাবে নিজেদের ধর্মীয় আইনের আনুগত্য করা থেকে তারা নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে

এখানে বিশেষ করে যে মামলাটির দিকে ইশারা করা হয়েছে সেটি ছিল খয়বরের সম্ভ্রান্ত ইহুদী পরিবার সংক্রান্ত এ পরিবারগুলোর এক মহিলার সাথে এক পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল তাওরাতের বিদান অনুসারে তাদের শাস্তি ছিল রজমঅর্থাৎ উভয়কে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা (দ্বিতীয় বিবরণী পুস্তকঃ ২২: ২৩-২৪) কিন্তু ইহুদীরা এ শাস্তি প্রয়োগ করতে চাচ্ছিল না তাই তারা পারস্পরিক পরামর্শক্রমে মুহাম্মাদ সা.কে শালিস মানার সিদ্ধান্ত করলো এবং একথাও স্থির করলো যে, যদি তিনি রজম ছাড়া অন্য কোন হুকুম দেন তাহলে তা নেয়া হবে আর যদি রজমেরই হুকুম দেন তাহলে তা মানা হবে না কাজেই রাসূলের সামনে মামলা পেশ করা হলো তিনি রজমের হুকুম দিলেন তারা এ হুকুম মানতে অস্বীকার করলো তখন রাসূল সা. তাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের ধর্মে এর শাস্তির ব্যাপারে কি বিধান আছে? তারা জবাব দিলঃ বেত্রাঘাত করা এবং মুখে কালি মাখিয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে প্রদক্ষিণ করানো তিনি তাদের আলেমদেরকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীর ব্যাপারে তাওরাতে কি এ বিধানই আছে? তারা আবার সেই মিথ্যা জবাব দিলেন কিন্তু তাদের মধ্য থেকে একজন নীরব থাকলেন তার নাম ছিল ইবনে সূরিয়া ইহুদীদের বর্ণনা অনুযায়ী সে সময় তাওরাতের তার চেয়ে বড় আলেম দ্বিতীয় কেউ ছিল না নবী সা. তাকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমি তোমাকে সেই আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি যিনি তোমাদের বাঁচিয়েছিলেন ফেরাউনের কবল থেকে এবং তুর পাহাড়ে তোমাদের শরীয়াত দান করেছিলেন, সত্যিই কি তাওরাতে ব্যভিচারের জন্য এ শাস্তির বিধান আছে? ইবনে সূরিয়া জবাব দিলেনঃ “আপনি আমাকে এ ধরনের কঠিন কসম না দিলে আমি বলতাম না প্রকৃতপক্ষে রজমই ব্যভিচারের শাস্তি কিন্তু আমাদের এখানে যখন ব্যভিচার বেড়ে যেতে লাগলো তখন আমাদের শাসকরা এ রীতি অবলম্বন করলো যে, কোন বড় লোক ব্যভিচার করলে তাকে ছেড়ে দিতো এবং গরীবরা এ দুষ্কর্ম করলে তাদেরকে রজম করতো তারপর এতে যখন জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো তখন আমরা তাওরাতের আইনের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীকে বেত্রাঘাত করার এবং তাদের মুখে কালি দিয়ে উল্টো মুখে গাধার পিঠে চড়াবার শাস্তির বিধান দিলাম” এরপর ইহুদীদের আর কিছু বলার অবকাশ রইলো না নবী সা. এর নির্দেশে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীকে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা হলো

৭১. এ আয়াতে আল্লাহ ইহুদীদের দুর্নীতির মুখোস পুরোপুরি উন্মোচন করে দিয়েছেন এ “ধর্মীয় লোকেরা” সারা আরবে এরূপ প্রচারণার জাল বিস্তার করে রেখেছিল যে, ঐ সামজে দীনদারী ও “কিতাবী-জ্ঞানের” ব্যাপারে তদের কোন জুড়ি নেই এদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে, যে কিতাবকে তারা নিজেরা আল্লাহর কিতাব বলে মানতো এবং তারা যার প্রতি ঈমান রাখে বলে দাবী করতো, তার বিধান পরিহার করে নবী সা. এর কাছে নিজেদের মামলা নিয়ে এসেছিল অথচ তাঁকে নবী বলে মেনে নিতেও তারা কঠোরভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এ ইহুদীরা আসলে কোন জিনিসের ওপরই যথার্থ ঈমান রাখতো না আসলে তাদের ঈমান ছিল নিজেদের নফস ও প্রবৃত্তির ওপর আল্লাহর কিতাব বলে তারা যাকে মানে তার নির্দেশ তাদের নফস ও প্রবৃত্তির কাছে অপছন্দনীয় বলেই তারা তাকে মানতে অস্বীকার করে আর (নাউযুবিল্লাহ) যাকে তারা মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার বলে প্রচার করে বেড়ায় সেখান থেকে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কোন ফায়সালা লাভ করা যায় কিনা কেবলমাত্র এ আশায় তার কাছে ধর্ণা দেয়

﴿إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ ۚ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِن كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ ۚ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ﴾

৪৪ আমি তাওরাত নাযিল করেছি তাতে ছিল পথ নির্দেশ ও আলো সমস্ত নবী, যারা মুসলিম ছিল, সে অনুযায়ী এ ইহুদী হয়ে যাওয়া লোকদের৭২ যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করতো আর এভাবে রব্বানী ও আহবারও৭৩ (এরি ওপর তাদের ফায়সালার ভিত্তি স্থাপন করতো) কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং তারা ছিল এর ওপর সাক্ষী কাজেই (হে ইহুদী গোষ্ঠী!) তোমরা মানুষকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো এবং সামান্য তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াত বিক্রি করা পরিহার করো আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের  

৭২. এখানে প্রসংগক্রমে এ সত্যটিও প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে যে, সকল নবীই ছিলেন মুসলিম অন্যদিকে এ ইহুদীরা ইসলাম থেকে সরে এসে সাম্প্রদায়িক দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে কেবলমাত্র “ইহুদী” হিসেবেই থেকে গিয়েছিল

৭৩. রব্বানী মানে আলেম এবং আহবার মানে ফকীহ

﴿وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

৪৫ তাওরাতে আমি ইহুদীদের জন্য এ বিধান লিখে দিয়েছিলাম যে প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং সব রকমের যখমের জন্য সমপর্যায়ের বদলা৭৪ তারপর যে ব্যক্তি ঐ শাস্তি সাদকা করে দেবে তা তার জন্য কাফ্‌ফারায় পরিণত হবে৭৫ আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই জালেম  

৭৪. তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য তাওরাতের যাত্রাপুস্তকঃ ২১:২৩-২৫ দেখুন

৭৫. অর্থাৎ যে ব্যক্তি সাদকার নিয়তে কিসাস মাফ করে দেবে তার জন্য এ নেকীটি তার অনেক গোনাহর কাফফারায় পরিণত হবে নবী সা. এর নিম্নোক্ত বাণীটি এ অর্থেই উক্ত হয়েছেঃ

من جرح في جسده جراحة فتصدق بها كفر عنه ذنوبه بمثل ما تصدق به

যার শরীরে কোন আঘাত করা হয়েছে এবং সে তা মাফ করে দিয়েছে, এ ক্ষেত্রে যে পর্যায়ের ক্ষমা হবে ঠিক একই পর্যায়ের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে

﴿وَقَفَّيْنَا عَلَىٰ آثَارِهِم بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ ۖ وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ﴾

৪৬ তারপর ঐ নবীদের পরে মারইয়ামপুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছি তাওরাতের মধ্য থেকে যা কিছু তার সামনে ছিল সে তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল আর তাকে ইনজিল দিয়েছি তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো এবং তাও তাওরাতের মধ্যে থেকে যা কিছু সে সময় বর্তমান ছিল তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল৭৬ 

৭৬. অর্থাৎ ঈসা আ. কোন নতুন ধর্ম নিয়ে আসেননি বরং ইতিপূর্বেকার বিভিন্ন পয়গম্বরের দীনই ছিল তাঁর দীন এবং মানুষকে তিনি এ দীনেরই দাওয়াত দিতেন তাওরাতের আসল শিক্ষাবলীর যে অংশ তাঁর যুগে সংরক্ষিত ছিল তাকে তিনি নিজেরও মানতেন এবং ইনজীলও তার সত্যতা প্রমাণ করতো (মথিঃ ৫:১৭-১৮ দেখুন) কুরআন বারবার একথাটি ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় যত নবী এসেছেন তাদের একজনও পূর্ববর্তী নবীদের প্রতিবাদ করার এবং তাদের কার্যাবলীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিজের নতুন ধর্ম প্রবর্তন করার জন্য আসেননি বরং প্রত্যেক নবী তাঁর পূর্ববর্তী নবীদের সত্যতার সাক্ষ্য দিতেন এবং পূর্ববর্তী নবীগণ নিজেদের পবিত্র উত্তরাধিকার হিসেবে যেসব কাজ রেখে যেতেন সেগুলোর পরিবৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনের জন্য আসতেন অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোর প্রতিবাদ করার জন্য আল্লাহ কখনো নিজের কোন কিতাব পাঠাননি বরং তাঁর প্রত্যেকটি কিতাব ইতিপূর্বে প্রেরিত সমস্ত কিতাবের সমর্থক ও তার সত্যতা প্রমাণকারী হিসেবে উপস্থিত হয়েছে

﴿وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فِيهِ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾

৪৭ আর তা ছিল আল্লাহভীরুদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ আমার নিদের্শ ছিল, ইনজীলে আল্লাহ যে আইন নাযিল করেছেন ইনজীল অনুসারীরা যেন সে মোতাবেক ফায়সালা করে আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক৭৭ 

৭৭. যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এখানে তিনটি বিধান দিয়েছেন একঃ তারা কাফের দুইঃ তারা জালেম তিন,তারা ফাসেক এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম ও তার নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফায়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল কাজেই এটি কুফরী দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতির বিরোধী কারণ, আল্লাহ যথার্থ ইনসাফ ও ভারসম্যনীতি অনুযায়ীই হুকুম দিয়েছিলেন কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করলো তখন সে আসলে জুলুম করলো তৃতীয়ত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করলো তখনই সে আসলে বন্দেগী ও আনুগত্যের গণ্ডীর বাইরে পা রাখলো আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসেকী এ কুফরী, জুলুম ও ফাসেকী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিক দিয়ে অনিবার্যভাবেই পুরোপুরি আল্লাহর হুকুম অমান্যেরই বাস্তব রূপ যেখানে আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হবে সেখানে এ তিনটি বিষয় থাকবে না, এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয় তবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার যেমন পর্যায়ভেদ আছে তেমনি এ তিনটি বিষয়েরও পর্যায়েরও পর্যায়ভেদ আছে যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে ভুল এবং নিজের বা অন্য কোন মানুষের হুকুমকে সঠিক মনে করে আল্লাহর হুকুম বিরোধী ফায়সালা কের সে পুরোপুরি কাফের, জালেম ও ফাসেক আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, জুলুম ও ফাসেকীর সাথে মিশিয়ে ফেলছে অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সে সকল ব্যাপারেই কাফের, ফাসেক ও জালেম আর যে ব্যক্তি কিছু ব্যাপারে অনুগত এবং কিছু ব্যাপারে অবাধ্য তার জীবনে ঈমান ও ইসলাম এবং কুফরী, জুলুম ও ফাসেকীর মিশ্রণ ঠিক তেমনি হারে অবস্থান করছে যে হারে সে আনুগত্য ও অবাধ্যতাকে এক সাথে মিশিয়ে রেখেছে কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াত গুলোকে আহলি কিতাবদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত বলে গণ্য করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু আল্লাহর কালামের শব্দের মধ্যে এ ধরনের ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ নেই হযরত হুযাইফা রা. এর বক্তব্যই এ ধরনের ব্যাখ্যার সঠিক ও সর্বোত্তম জবাব তাঁকে একজন বলেছিল, এ আয়াত তিনটি তো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে সে বুঝাতে চাচ্ছিল যে, ইহুদীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা হুকুমের বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে-ই কাফের, জালেম ও ফাসেক একথা শুনে হযরত হুযাইফা বলে ওঠেনঃ

نعم الاخوة لكم بنو اسرائيل ان كانت لهم كل مرة ولكم كل حلوة كلا والله لتسلكن طربقهم قدر الشراك

এ বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী তোমাদের কেমন চমৎকার ভাই, তিতোগুলো সব তাদের জন্য আর মিঠাগুলো সব তোমাদের জন্য! কখনো নয়, আল্লাহর কসম তাদেরই পথে তোমরা কদম মিলিয়ে চলবে

﴿وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ ۖ فَاحْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ ۚ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ ۖ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ ۚ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ﴾

৪৮ তারপর হে মুহাম্মাদ! তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি, যা সত্য নিয়ে এসেছে এবং আল কিতাবের মধ্য থেকে তার সামনে যা কিছু বর্তমান আছে তার সত্যতা প্রমাণকারী৭৮ ও তার সংরক্ষক৭৯ কাজেই তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইনি অনুযায়ী লোকদের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা করো এবং যে সত্য তোমার কাছে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না –তোমাদের৮০ প্রত্যেকের জন্য একটি শরীয়াত ও একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে রেখেছি আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে একই উম্মতের অন্তরভুক্ত করতে পারতেন কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তার মধ্যে তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য এমনটি করেছেন কাজেই সৎকাজে একে অপরের চাইতে অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করো শেষ পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে তারপর তিনি সেই প্রকৃত সত্যটি তোমাদের জানিয়ে যে ব্যাপারে তোমরা মতবিরোধ করে আসছিলে৮১ 

৭৮. এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের দিকে ইংগিত করা হয়েছে এ বক্তব্যটিকে যদিও এভাবে বলা যেতো যে, “আগের কিতাবগুলোর মধ্য থেকে যা কিছু তার প্রকৃত ও সঠিক অবস্থায় বর্তমান আছে কুরআন তার সত্যতা প্রমাণ করে” কিন্তু আল্লাহ এখানে “আগের কিতাবগুলোর” পরিবর্তে  “আল কিতাব” শব্দ ব্যবহার করেছেন এ থেকে এ রহস্য উদঘাটিত হয় যে, কুরআন এবং বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন ভাষায় আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কিতাবগুলো নাযিল হয়েছে সবই মূলত একটি কিতাবের অন্তর্ভুক্ত তাদের রচয়িতাও একজন তাদের মূল বক্তব্য, উদ্দেশ্য-লক্ষও একই তাদের শিক্ষাও একই তাদের মাধ্যমে মানব জাতিকে একই জ্ঞান দান করা হয়েছে এ কিতাবগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলে তা আছে কেবল মাত্র ইবারাত অর্থাৎ বাক্য সংগঠন ও বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এ ক্ষেত্রে একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে কাজেই প্রকৃত সত্য কেবল এতটুকুই নয় যে, এ কিতাবগুলো পরস্পরের বিরোধী নয় বরং সমর্থক এবং পরস্পরের প্রতিবাদকারী নয় বরং সত্যতা প্রমাণকারী বরং প্রকৃত সত্য এর চাইতেও অনেক বেশী অর্থাৎ এরা সবাই একই” আল কিতাবের” বিভিন্ন সংস্করণ মাত্র

৭৯. মূলে “মুহাইমিন” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে আরবীতে হাইমানা, ইউহাইমিনু, হাইমানাতান (هيمن – يهيمن – هيمتة) মানে হচ্ছে দেখাশুনা, সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, সাক্ষ্য দান, আমানতদারী, সহায়তা দান ও সমর্থন করা যেমন বলা হয় هيمن الرجل الشيئ অর্থাৎ লোকটি অমুক জিনিসটি হেফাজত ও সংরক্ষণ করেছে আরো বলা হয়ঃ هيمن الطاشر على فراخه অর্থাৎ পাখিটি নিজের বাচ্চাকে নিজের ডানার মধ্যে নিয়ে সংরক্ষিত করে ফেলেছে হযরত উমর রা. একবার লোকদের বলেনঃ اني داع فهيمنوا অর্থাৎ আমি দোয়া করি, তোমরা সমর্থনে আম-মীন বলো অর্থাৎ কুরআনকে আল-কিতাব বলার পর “মুহাইমিন” বলার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোতে যেসব সত্য শিক্ষা ছিল কুরআন তার সবগুলোই নিজের মধ্যে সংরক্ষিত করে নিয়েছে সে সেগুলোর রক্ষাণাবেক্ষণকারী এই হিসেবে যে, এখন তাদের এ সত্য শিক্ষাগুলোর কোন অংশের নষ্ট হবার আর কোন সম্ভাবনাই নেই সে সেগুলোর সমর্থক এ অর্থে যে, ঐ কিতাবগুলোতে আল্লাহর কালাম যে অবস্থায় আছে কুরআন তার সত্যতা প্রমাণ করে সে সেগুলোর ওপর সাক্ষ্যদানকারী এ অর্থে যে, ঐ কিতাবগুলোতে আল্লাহর কালাম ও মানুষের বাণীর মধ্যে যে মিশ্রণ ঘটে গেছে কুরআনের সাক্ষের মাধ্যমে তাকে আবার ছেঁটে আলাদা করা যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে যেগুলো কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং তার অনুরূপ সেগুলো আল্লাহর কালাম আর যেগুলো কুরআন বিরোধী সেগুলো মানুষের বাণী

৮০. এটি একটি প্রসংগ কথা একটি প্রশ্নের বিশ্লেষণই এর উদ্দেশ্য ওপরের ধারাবাহিক ভাষণ শোনার পর শ্রোতার মনে এ প্রশ্নটি সংশয় ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে প্রশ্নটি হচ্ছে, সকল নবী ও সকল কিতাব যখন একই ধর্মের দিকে আহবান জানিয়েছে এবং তারা সবাই পরস্পরের সত্যতা প্রমাণ করে ও পরস্পরের সহযোগী তখন শরীয়াতের বিস্তারিত বিধানের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য কেন? ইবাদাত-বন্দেগীর বাহ্যিক অবয়ব ও আনুষ্ঠানিকতা, হালাল-হারামের বিধি-নিষেধ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আইন-কানুনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিভিন্ন নবী ও আসমানী কিতাবসমূহের শরীয়াতগুলোর মধ্যে কমবেশী পার্থক্য দেখা যায় কেন?

৮১. এটি হচ্ছে উপরোল্লিখিত প্রশ্নটির একটি পরিপূর্ণ জবাব এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ

একঃ নিছক শরীয়াতের বিভিন্নতা দেখে এ শরীয়াতগুলো বিভিন্ন মূল ও বিভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত হয়েছে বলে মনে করা ভুল হবে আসলে মহান আল্লাহ বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন অবস্থায় বিধি বিধান নির্ধারণ করে থাকেন

দুইঃ নিসন্দেহে প্রথম থেকেই সমগ্র মানব জাতির জন্য একটি বিধান নির্ধারিত করে সবাইকে এক উম্মতে পরিণত করা যেতো কিন্তু বিভিন্ন নবীর শরীযাতের মধ্যে আল্লাহ যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন তার পেছনে বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ এই ছিল যে, এভাবে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করতে চাচ্ছিলেন যারা প্রকৃত দীন,তার প্রাণসত্তা ও তাৎপর্য অনুধাবন করে, দীনের মধ্যে এ বিধানগুলোর যাথার্থ মর্যাদা জানে এবং কোন প্রকার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয় না তারা সত্যকে চিনে ফেলবে এবং গ্রহণ করে নেবে, যেভাবেই তা আসুক না কেন তারা আল্লাহ প্রেরিত আগের বিধানের জায়গায় পরবর্তী বিধান মেনে নেবার ব্যাপারে কোন প্রকার ইতস্তত করবে না পক্ষান্তরে যারা দীনের মূল প্রাণশক্তি থেকে দূরে অবস্থান করে, দীনের বিধান ও খুটিনাটি নিয়ম-কানুনকেই আসল দীন মনে করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত জিনিসের গায়ে নিজেরাই তকমা এঁটে দিয়ে সে ব্যাপারে স্থবিরতা ও বিদ্বেষে নিমজ্জিত হয়, তারা পরবর্তীকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রত্যেকটি আয়াত প্রত্যাখ্যান করতে থাকে এ দুই ধরনের লোককে পৃথক করার জন্য এ ধরনের পরীক্ষা অপরিহার্য ছিল তাই মহান আল্লাহ বিভিন্ন শরীয়াতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন

তিনঃ সমস্ত শরীয়াতের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে নেকী ও কল্যাণ অর্জন করা যে সময় আল্লাহ যে হুকুম দেন তা পালন করার মাধ্যমেই এগুলো অর্জিত হতে পারে কাজেই যারা আসল উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখে তাদের জন্য শরীয়াতের বিভিন্নতা ও পথের পার্থক্য নিয়ে বিরোধ করার পরিবর্তে আল্লাহর কাছে গৃহীত পথের মাধ্যমে মূল উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হওয়াই হচ্ছে সঠিক কর্মপদ্ধতি

চারঃ মানুষেরা নিজেদের স্থবিরতা, বিদ্বেষ, হঠকারিতা ও মানসিক অস্থিরতার কারণে নিজেরাই যে সমস্ত বিরোধ সৃষ্টি করেছে, কোন বিতর্ক সভায় বা যুদ্ধের ময়দানে সেগুলোর চূড়ান্ত ফায়সালা হবে না সেগুলোর চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন আল্লাহ নিজেই, যেদিন প্রকৃত সত্যকে সকল প্রকার আবরণমুক্ত করে দেয়া হবে সেদিন লোকেরা দেখবে, যেসব বিরোধের মধ্যে তারা নিজেদের সমগ্র জীবনকাল অতিবাহিত করে দুনিয়া থেকে চলে এসেছে তার মধ্যে “সত্য” কতটুকু ছিল এবং “মিথ্যা” মিশ্রণ কতটুকু

﴿وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَن بَعْضِ مَا أَنزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ﴾

৪৯ কাজেই৮২ হে মুহাম্মাদ! তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী তাদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করো এবং তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না সাবধান হয়ে যাও, এরা যেন তোমাকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করে সেই হেদায়াত থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত করতে না পারে, যা আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করছেন যদি এরা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ এদের কোন কোন গোনাহর কারণে এদেরকে বিপদে ফেলার সিদ্ধান্তই করে ফেলেছেন আর যথার্থই এদের অধিকাংশ ফাসেক  

৮২. ওপরে যে ধারাবাহিক ভাষণ চলছিল এখান থেকে আবার তা শুরু হচ্ছে

﴿أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ﴾

৫০ (যদি এরা আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়) তাহলে কি এরা আবার সেই জাহেলিয়াতের৮৩ ফায়সালা চায়? অথচ যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর চাইতে ভাল ফায়সালাকারী আর কেউ নেই  

৮৩. জাহেলিয়াত শব্দটি ইসলামের বিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে ইসলাম হচ্ছে পুরোপুরি জ্ঞানের পথ কারণ ইসলামের পথ দেখিয়েছেন আল্লাহ নিজেই আর আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন অপরদিকে ইসলাম থেকে ভিন্নধর্মী যে কোন পথই জাহেলিয়াতের পথ আরবের ইসলাম পূর্ব যুগকে জাহেলিয়াতের যুগ বলার কারণ হচ্ছে এই যে, সে যুগে জ্ঞান ছাড়াই নিছক ধারণা, কল্পনা, আন্দাজ, অনুমান বা মানসিক কামনা বাসনার ভিত্তিতে মানুষেরা নিজেদের জন্য জীবনের পথ তৈরী করে নিয়েছিল যেখানেই যে যুগেই মানুষেরা এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করবে তাকে অবশ্যি জাহেলিয়াতের কর্মপদ্ধতি বলা হবে মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কিছু পড়ানো হয় তা নিছক আংশিক জ্ঞান মানুষকে পথ দেখাবার জন্য এ জ্ঞান কোনক্রমেই যথেষ্ট নয় কাজেই আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানকে বাদ দিয়ে এ আংশিক জ্ঞানের মাধ্যমে আন্দাজ, অনুমান, কল্পনা ও লালসা-কামনার মিশ্রণে যে জীবন বিধান তৈরী করা হয়েছে তাও ঠিক প্রাচীন জাহেলী পদ্ধতির মতো জাহেলিয়াতের সংজ্ঞার আওতাভুক্ত হয়

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

৫১ হে ঈমানদারগণ! ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসেবে পরিগণিত করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে অব্যশ্যি আল্লাহ জালেমদেরকে নিজের পথনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত রাখেন

﴿فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰ أَن تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ ۚ فَعَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِّنْ عِندِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا أَسَرُّوا فِي أَنفُسِهِمْ نَادِمِينَ﴾

৫২ তুমি দেখতে পাচ্ছো, যাদের অন্তরে মোনাফেকীর রোগ আছে তারা তাদের মধ্যেই তৎপর থাকে তারা বলে, আমাদের ভয় হয়, আমরা কোন বিপদের কবলে না পড়ে যাই৮৪ কিন্তু অচিরেই আল্লাহ যখন তোমাদের চূড়ান্ত বিজয় দান করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন কথা প্রকাশ করবেন৮৫ তখন তারা নিজেদের অন্তরে লুকিয়ে রাখা এ মোনাফেকীর জন্য লজ্জিত হবে  

৮৪. তখনো পর্যন্ত আরবে কুফর ও ইসলামের দ্বন্দ্বের কোন মীমাংসা হয়নি যদিও নিজের অনসারীদের কর্মতৎপরতা সাধনা ও আত্মত্যাগের কারণে ইসলাম একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল তবুও বিরুদ্ধ শক্তিগুলোও ছিল প্রবল পরাক্রান্ত ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা যেমন ছিল তেমনি কুফরের বিজয়ের সম্ভাবনাও ছিল তাই মুসলমানদের মধ্যে যেসব মোনাফেক বিদ্যমান ছিল তারা ইসলামী দলের মধ্যে থেকেও ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে চাইতো তারা ভাবতো, ইসলাম ও কুফরের এ দ্বন্দ্বে যদি ইসলামের পরাজয় ঘটে যায় তাহলে তাদের জন্য যেন কোন একটা আশ্রয় স্থল অবশিষ্ট থাকে এ ছাড়াও সে সময় আরবে খৃষ্টান ও ইহুদীদের অর্থবল ছিল সবচেয়ে বেশী মহাজনী ব্যবসায়ের বেশীর ভাগ ছিল তাদের হাতে আরবের সবচেয়ে উর্বর ও শস্যশ্যামল ভূখণ্ড ছিল তাদের অধিকারে তাদের সুদখোরীর জাল চারদিকে ছড়িয়ে ছিল কাজেই অর্থনৈতিক কারণেও এ মোনাফেকরা তাদের সাথে নিজেদের আগের সম্পর্ক অটুট রাখতে চাইতো তদের ধারণা ছিল, ইসলাম ও কুফরের এ সংঘর্ষে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে আমরা যদি ইসলামের সাথে বর্তমানে বিরোধে ও যুদ্ধে লিপ্ত সম্প্রদায়গুলোর সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করি, তাহলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়েই এটা হবে আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক

৮৫. অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয়ের চাইতে কম পর্যায়ের এমন কোন জিনিস যার মাধ্যমে লোকদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে, জয় পরাজয়ের চূড়ান্ত ফায়সালা ইসলামের পক্ষেই হবে

﴿وَيَقُولُ الَّذِينَ آمَنُوا أَهَٰؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ ۙ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ ۚ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِينَ﴾

৫৩ আর সে সময় ঈমানদাররা বলবে, এরা কি সে সব লোক যারা আল্লাহর নামে শক্ত কসম খেয়ে আমরা তোমাদের সাথে আছি বলে আশ্বাস দিতো? এদের সমস্ত কর্মকাণ্ড নষ্ট হয়ে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত এরা ব্যর্থ মনোরথ হয়েছেন৮৬ 

৮৬. অর্থাৎ ইসলামের বিধান মেনে চলতে গিয়ে তারা যা কিছু করলোঃ নামায পড়লো, রোযা রাখলো, যাকাত দিল, জিহাদে শরীক হলো, ইসলামী আইরে আনুগত্য করলো–এসব কিছুই এ জন্য নষ্ট হয়ে গেলো যে, ইসলামের ব্যাপারে তাদের মনে আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা ছিল না এবং তারা সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে একমাত্র তারই অনুগত বান্দায় পরিণত হয়ে যায়নি বরং নিজেদের পার্থিব স্বার্থের কারণে তারা আল্লাহ ও তাঁর বিদ্রোহীদের মধ্যে নিজেদেরকে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে রেখেছিল

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ﴾

৫৪ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি দীন থেকে ফিরে যায়, (তাহলে ফিরে যাক), আল্লাহ এমনিতর আরো বহু লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন এবং তারা আল্লাহকে ভালবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হবে,৮৭ যারা আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করে যাবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবেনা৮৮ এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে চান তাকে দান করেন আল্লাহ ব্যাপক উপায় উপকরণের অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জানেন  

৮৭. মুমিনদের ব্যাপারে কোমলহবার মানে হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি ঈমানদারদের মোকাবিলায় কখনো শক্তি প্রয়োগ করবে না তর বুদ্ধি, মেধা, যোগ্যতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ-সম্পদ, শারীরিক ক্ষমতা কোনটিই মুসলমানদরেকে দাবিয়ে রাখার, কষ্ট দেবার বা ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করবে না মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে তাকে সবসময় একজন দয়ার্দ্র হৃদয়, কোমল স্বভাবের, দরদী ও ধৈর্যশীল মানুষ হিসেবেই দেখতে পায়

কাফেরদের ব্যাপারে কঠোরহবার মানে হচ্ছে, নিজের মজবুদ ঈমান, নিস্বার্থ ও একনিষ্ঠ দীনদারী, অনমনীয় নীতিবাদিতা, চারিত্রিক শক্তি ও ঈমানী দূরদৃষ্টির কারণে একজন মুমিন ইসলাম বিরোধীদের মোকাবিলায় পাহাড়ের মতো অটল হবে নিজের স্থান থেকে তাকে এক চূলও নড়ানো যাবে না ইসলাম বিরোধীরা কখনো তাকে নমনীয়, দোদ্যুল্যমান এবং অক্লেশে গলধঃকরণ কারার মতো খাদ্য মনে করতে পারবে না যখনই তারা তর মুখোমুখি হয় তখনই টের পেয়ে যায় যে, এ আল্লাহর বান্দা মরে যেতে পারে কিন্তু কখনো কোন মূল্যে বিক্রি হতে পারে না এবং কোন চাপের সামনে নতি স্বীকারও করতে পারে না

৮৮. অর্থাৎ আল্লাহর দীনের অনুসরণ করার ব্যাপারে তাঁর বিধানসমূহ কার্যকর করার ব্যাপারে এবং এ দীনের দৃষ্টিতে যা সত্য তাকে সত্য এবং যা মিথ্যা তাকে মিথ্যা বলার ব্যপারে সে আপোষহীন ও নির্ভীক কারোর বিরোধিতা, নিন্দা, তিরস্কার, আপত্তি ও বিদ্রূপবানের সে পরোয়া করবে না সাধারণ জনমত যদি ইসলামের প্রতিকূল হয় এবং ইসলামের পথে চলার অর্থ যদি সারা দুনিয়ার সামনে নিজেকে অপাংক্তেয় বানানো হয়ে থাকে তাহলেও সে সাচ্চাদিলে সে পথকে সত্য মনে করেছে সে পথেই চলতে থাকবে

﴿إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ﴾

৫৫ আসলে তোমাদের বন্ধু হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই ঈমানদাররা যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহর সামনে বিনত হয়

﴿وَمَن يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ﴾

৫৬ আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে, তাঁর রাসূলকে ও মুমিনদেরকে নিজের বন্ধু রূপে গ্রহণ করে তার জেনে রাখা দরকার, আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِّنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾

৫৭ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যেসব লোক তোমাদের দীনকে বিদ্রুপ ও হাসি –তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছে তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধ হিসেবে গ্রহণ করো না আল্লাহকে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো

﴿وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ اتَّخَذُوهَا هُزُوًا وَلَعِبًا ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَعْقِلُونَ﴾

৫৮ যখন তোমরা নামাযের জন্য ডাক দাও তখন তারা এর প্রতি বিদ্রূপবান নিক্ষেপ করে এবং এ নিয়ে টিটকারী ও তামাশা করে৮৯ এর কারণ হচ্ছে তাদের জ্ঞান নেই৯০ 

৮৯. অর্থাৎ আযানের আওয়াজ শুনে তা নকল করতে থাকে ঠাট্টা-তামাশা ও বিদ্রূপ করার জন্য তার শব্দ বদল ও বিকৃত করে এবং তা নিয়ে টিটকারী দেয় ও ভেংচি কাটে

৯০. অর্থাৎ তাদের এ কাজগুলো নিছক মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার ফল যদি তারা মূর্খতা ও অজ্ঞতায় নিমজ্জিত না হতো হালে মুসলমনাদের সাথে ধর্মীয় বিরোধ রাখা সত্ত্বেও এ ধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ তারা করতে পারতো না আল্লাহ ইবাদাতের জন্য আহবান জানানো হলে তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করাকে কোন বিবেকবান ব্যক্তি পছন্দ করতে পারেন না

﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ هَلْ تَنقِمُونَ مِنَّا إِلَّا أَنْ آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلُ وَأَنَّ أَكْثَرَكُمْ فَاسِقُونَ﴾

৫৯ তাদেরকে বলে দাও, হে আহলি কিতাব! তোমরা আমাদের প্রতি তোমাদের ক্রোধের একমাত্র কারণ তো এই যে, আমরা আল্লাহর ওপর এবং দীনের সে শিক্ষার ওপর ঈমান এনেছি যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং আমাদের আগেও নাযিল হয়েছিল আর তোমাদের বেশীরভাগ লোকইতো অবাধ্য

﴿قُلْ هَلْ أُنَبِّئُكُم بِشَرٍّ مِّن ذَٰلِكَ مَثُوبَةً عِندَ اللَّهِ ۚ مَن لَّعَنَهُ اللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْهِ وَجَعَلَ مِنْهُمُ الْقِرَدَةَ وَالْخَنَازِيرَ وَعَبَدَ الطَّاغُوتَ ۚ أُولَٰئِكَ شَرٌّ مَّكَانًا وَأَضَلُّ عَن سَوَاءِ السَّبِيلِ﴾

৬০ তাহলে বলো, আমি কি তাদেরকে চিহ্নিত করবো যাদের পরিণাম আল্লাহর কাছে এ ফাসেকের চাইতেও খারাপ? বস্তুত যাদের ওপর আল্লাহ লানত বর্ষণ করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধান্বিত, যাদের মধ্য থেকে কতককে বানর ও শুয়োর বানানো হয়েছে এবং যারা তাগুতের বন্দীগী করেছে, তারা আরো নিকৃষ্ট এবং তারা সাওয়া-উস-সাবীল- (সরল সঠিক পথ) থেকে বিচ্যুত হয়ে অনেক দূরে সরে গেছে৯১ 

৯১. এখানে স্বয়ং ইহুদীদের দিকে সূক্ষ্ম ইংগিত করা হযেছে তাদের ইতিহাস বলছে, বারবার আল্লাহর গযব ও লানতের শিকার হয়েছে শনিবারের আইন ভাঙার কারণে তাদের কওমের বহু লোকের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে এমনকি তারা অধপতনের এমন নিম্নতম পর্যায়ে নেমে গেছে যে, তাদেরকে তাগুত তথা আল্লাহর বিদ্রোহী শক্তির দাসত্ব পর্যন্ত করতে হয়েছে সার কথা হচ্ছে এই যে, তোমাদের নির্লজ্জতা ও অপরাধমূলক কার্যক্রমের কি কোন শেষ আছে? তোমরা নিজেরা ফাসেকী, শরীয়াত বিরোধী কার্যকলাপ ও চরম নৈতিক অধপতনের মধ্যে নিমজ্জিত আছো আর যদি অন্য কোন দল আল্লাহর ওপর ঈমান এনে সাচ্চা দীনদারীর পথ অবলম্বন করে তাহলে তোমরা তার বিরোধিতায় উঠে পড়ে লেগে যাও

﴿وَإِذَا جَاءُوكُمْ قَالُوا آمَنَّا وَقَد دَّخَلُوا بِالْكُفْرِ وَهُمْ قَدْ خَرَجُوا بِهِ ۚ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا كَانُوا يَكْتُمُونَ﴾

৬১ যখন তারা তোমাদের কাছে আসে, তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি অথচ তারা কুফর নিয়ে এসেছিল, কুফর নিয়েই ফিরে গেছে এবং আল্লাহ খুব ভাল করেই জানেন তারা তাদের মনের মধ্যে কি জিনিস লুকিয়ে রেখেছে 

﴿وَتَرَىٰ كَثِيرًا مِّنْهُمْ يُسَارِعُونَ فِي الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ ۚ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

৬২ তুমি দেখতে পাচ্ছো, এদের বেশীর ভাগ লোক গোনাহ, জুলুম ও সীমালংঘনের কাজে তৎপর এবং এরা হারাম খায় এরা অত্যন্ত খারাপ কাজ করে যাচ্ছে

﴿لَوْلَا يَنْهَاهُمُ الرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ عَن قَوْلِهِمُ الْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ ۚ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَصْنَعُونَ﴾

৬৩ এদের উলামা ও মাশায়েখগণ কেন এদেরকে পাপ কথা বলতে ও হারাম খেতে বাধা দেয় না? অবশ্যি এরা যা করে যাচ্ছে তা অত্যন্ত জঘন্য কার্যক্রম

﴿وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ ۚ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا ۘ بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ ۚ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرًا مِّنْهُم مَّا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا ۚ وَأَلْقَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ۚ كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِّلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ ۚ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا ۚ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ﴾

৬৪ ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত বাঁধা,৯২ আসলে তো বাঁধা হয়েছে ওদেরই হাত৯৩ এবং তারা যে বাজে কথা বলছে সে জন্য তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে৯৪ —আল্লাহর হাত তো দরাজ, যেভাবে চান তিনি খরচ করে যান আসলে তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার ওপর যে কালাম নাযিল করা হয়েছে তা উল্টা তাদের অধিকাংশের বিদ্রোহ ও বাতিলের পূজা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৯৫ আর (এ অপরাধে) আমি তাদের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী শক্রতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করে দিয়েছি যতবার তারা যুদ্ধের আগুন জ্বালায় ততবারই আল্লাহ তা নিভিয়ে দেন তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কখনোই পছন্দ করেন না  

৯২. আরবী প্রবাদ অনুযায়ী কারোর হাত বাঁধা থাকার অর্থ হচ্ছে সে কৃপণ দান-খয়রাত করার ব্যাপারে তার হাত নিষ্ক্রীয় কাজেই ইহুদীদের একথার অর্থ এ নয় যে, সত্যিই আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে বরং এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ কৃপণ যেহেতু শত শত বছর থেকে ইহুদী জাতি ঘোর লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও পতিত দশায় নিমজ্জিত ছিল, তাদের অতীতের গৌরব ও কৃতিত্ব নিছক পুরাতন কাহিনীতে পরিণত হয়েছিল এবং সে গৌরবের যুগ ফিরিয়ে আনার আর কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না, তাই সাধারণত নিজেদের অব্যাহত জাতীয় দুর্যোগ ও দৈন্যদশার জন্য আক্ষেপ ও হাহুতাশ করতে গিয়ে ঐ অজ্ঞ ও নাদান লোকেরা (নাউযুবিল্লাহ)” আল্লাহ তো কৃপণ হয়ে গেছেন, তার ধনাগারের মুখ বন্ধ এবং আমাদের দেবার জন্য তাঁর কাছে আপদ-বিপদ ছাড়া আর কিছুই নেই”–এ বেহুদা কথা বলে বেড়াতো কেবল যে ইহুদীরাই একথা বলতো, তা নয় বরং অন্যান্য জাতির মূর্খ ও অজ্ঞ গোষ্ঠীরও এ একই অবস্থা ছিল তাদের ওপর কোন কঠিন সময় এলে তারা আল্লাহর কাছে নত হওয়ার পরিবর্তে অত্যন্ত ক্রোধের সাথে এ ধরনের বেআদবীমূলক কথা বলতো

৯৩. অর্থাৎ এরা নিজেরাই কৃপণতায় নিমজ্জিত নিজেদের কৃপণতা ও সংকীর্ণমনতার জন্য তারা সারা দুনিয়ায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে

৯৪. অর্থাৎ এ ধরনের গোস্তাখী ও বিদ্রূপাত্মক কথা বলে এরা যদি মনে করে থাকে যে, আল্লাহ এদের প্রতি করুণাশীল হবেন এবং এদের ওপর তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করতে থাকবেন, তাহলে এদের জেনে রাখা দরকার, এটা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয় বরং এদের এ কথাগুলোর ফলে এরা আল্লাহর অনুগ্রহের দৃষ্টি থেকে আরো বেশী বঞ্চিত হয়েছে এবং তাঁর করুণা ও রহমত থেকে আরো দূরে সরে গেছে

৯৫. অর্থাৎ এ কালাম শুনে তারা কোন ভাল ও সুফলদায়ক শিক্ষা গ্রহণ এবং নিজেদের ভুল ও ভ্রান্তি কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক হয়ে তার ক্ষতিপূরণ করার ও নিজেদের অধপতিত অবস্থার কারণ জেনে তার সংশোধন করার দিকে নজর দেবার পরিবর্তে উল্টো তাদের ওপর এর এরূপ প্রভাব পড়েছে যে, জিদের বশবর্তী হয়ে তারা সত্যের বিরোধিতা করতে শুরু করে দিয়েছে সৎকর্ম ও আত্মশুদ্ধির বিস্মৃত শিক্ষার কথা শুনে তাদের নিজেদের সত্য পথে ফিরে আসা তো দূরের কথা, উল্টো তারা এ শিক্ষাকে স্মরণ করিয়ে দেবার আহবান যাতে অন্যেরাও শুনতে না পারে এ জন্য তাকে দাবিয়ে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে

﴿وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَكَفَّرْنَا عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأَدْخَلْنَاهُمْ جَنَّاتِ النَّعِيمِ﴾

৬৫ যদি (বিদ্রোহের পরিবর্তে) এ আহলি কিতাব গোষ্ঠী ঈমান আনতো এবং আল্লাহ ভীতর পথ অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের থেকে তাদের দুষ্কৃতিগুলো মোচন করে দিতাম এবং তাদেরকে পৌঁছিয়ে দিতাম নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে  

﴿وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِم مِّن رَّبِّهِمْ لَأَكَلُوا مِن فَوْقِهِمْ وَمِن تَحْتِ أَرْجُلِهِم ۚ مِّنْهُمْ أُمَّةٌ مُّقْتَصِدَةٌ ۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ سَاءَ مَا يَعْمَلُونَ﴾

৬৬ হায়, যদি তারা তাওরাত, ইনজিল ও অন্যান্য কিতাবগুলো প্রতিষ্ঠিত করতো, যা তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল! তাহলে তাদের জন্য রিযিক ওপর থেকেও বর্ষিত হতো এবং নীচে থেকেও উত্থিত হতো৯৬ তাদের মধ্যে কিছু লোক সত্যপন্থী হলেও অধিকাংশই অত্যন্ত খারাপ কাজে লিপ্ত  

৯৬. বাইবেলের বেলীয় পুস্তক (২৬ অনুচ্ছেদ) ও দ্বিতীয় বিবরণে (২৮ অনুচ্ছেদ) হযরত মূসা আ. এর একটি ভাষণ উদ্বৃত হয়েছে এ ভাষনে তিনি বিস্তারিতভাবে বনী ইসলাঈল জাতিকে একথা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা পুরোপুরি ও যথাযথভাবে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে চললে আল্লাহর রহমত ও বরকত কিভাবে তোমাদের ওপর বর্ষিত হবে এবং আল্লাহর কিতাবকে পেছনে ফেলে দিয়ে তাঁর নাফরমানী করতে থাকলে কিভাবে বালা-মুসিবত, আপদ-বিপদ ও ধ্বংস চতুরদিক থেকে তোমাদেরকে ঘিরে ফেলবে হযরত মূসার ভাষণটি কুরআনের এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটির চমৎকার ব্যাখ্যা

﴿يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ۖ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ ۚ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ﴾

৬৭ হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার কাছে যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছাও যদি তুমি এমনটি না করো তাহলে তোমার দ্বারা তার রিসালাতের হক আদায় হবে না মানুষের অনিষ্টকারিতা থেকে তোমাকে আল্লাহ রক্ষা করবেন নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, তিনি কখনো কাফেরদেরকে (তোমার মোকাবিলায়) সফলতার পথ দেখাবেন না

﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَىٰ شَيْءٍ حَتَّىٰ تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ ۗ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرًا مِّنْهُم مَّا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا ۖ فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ﴾

৬৮ পরিষ্কার বলে দাও, হে আহ্‌লি কিতাব! তোমরা কখনোই কোন মূল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে না যতক্ষণ না তোমরা তাওরাত, ইনজিল ও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে নাযিল করা অন্যান্য কিতাবগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করবে৯৭ তোমার ওপর এই যে ফরমান নাযিল করা হয়েছে এটা অবশ্যি তাদের অনেকের গোয়ার্তুমী ও অবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দেবে৯৮ কিন্তু অস্বীকারকারীদের অবস্থার জন্য কোন দুঃখ করো না  

৯৭. তাওরাত ও ইনজীলকে প্রতিষ্ঠিত করার মানে হচ্ছে, সততা ও নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করা এবং তাদেরকে নিজের জীবন বিধানে পরিণত করা এ প্রসংগে একথাটি ভালভাবে হৃদয়ংগম করে নিতে হবে যে, বাইবেলের পবিত্র পুস্তক সমষ্টিতে এক ধরনের বাণী আছে, যেগুলো ইহুদী ও খৃষ্টান লেখকরা নিজেরাই রচনা করে লিখে দিয়েছেন আর এক ধরনের বাণী সেখানে আছে, যেগুলো আল্লাহর বাণী বা হযরত ঈসা আ. ও অন্যান্য পয়গম্বরের বাণী হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে এবং যেগুলোতে একথা সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ একথা বলেছেন বা অমুক নবী একথা বলেছেন বাইবেলের এ বচনগুলোর মধ্য থেকে প্রথম ধরনের বচনগুলোকে আলাদা করে যদি কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র দ্বিতীয় ধরনের বাণীগুলোর মধ্যে অনুসন্ধান চালান, তাহলে তিনি সহজেই দেখতে পাবেন সেগুলোর শিক্ষা ও কুরআরনের শিক্ষার মধ্যে কোন উল্লখযোগ্য পার্থক্য নেই অনুবাদক অনুলেখক ও ব্যাখ্যাতাগণের হস্তক্ষেপ এবং কোথাও কোথাও ঐশী বর্ণনাকারীদের ভুলের কারণে এ দ্বিতীয় ধরনের বাণীগুলোও পুরোপুরি অবিকৃত নেই তবু প্রত্যেক ব্যক্তি নিসন্দেহে একথা অনুভব করবেন যে, কুরআন যে নির্ভেজাল তাওহীদের তাওয়াত দিয়ে চলেছে এগুলো মধ্যেও ঠিক সেই একই নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে কুরআন যে আকীদা বিশ্বাসের কথা উপস্থাপন করেছে এখানেও সেই একই আকীদা বিশ্বাস উপস্থাপিত হয়েছে কুরআন যে জীবন পদ্ধতির দিকে পথনির্দেশ করেছে এখানেও সেই একই জীবন পদ্ধতির নির্দেশ দেয়া হয়েছে কাজেই ইহুদী ও খৃষ্টানরা যদি তাদের ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ ও নবীদের পক্ষ থেকে উদ্ধৃত প্রকৃত শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে নিসন্দেহে নবী সা. এর আবির্ভাবকালে তাদেরকে একটি ন্যায়বাদী ও সত্যপন্থী দল হিসেবে পাওয়া যেতো এ ক্ষেত্রে তারা কুরআনের মধ্যে সেই একই আলো দেখতে পেতো, যা পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর মধ্যে পাওয়া যেতো এ অবস্থায় নবী সা. এর আনুগত্য করার জন্য তাদের ধর্ম পরিবর্তন করার আদতে কোন প্রশ্নই দেখা দিতো না বরং যে পথে তারা চলে আসছিল সে পথের ধারাবাহিক পরিণতি হিসেবেই তারা মুহাম্মাদ সা. এর অনুসারী হয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারতো

৯৮. অর্থাৎ একথা শোনার পর তারা স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করার ও যথার্থ সত্য হৃদয়ংগম করার পরিবর্তে একগুঁয়েমী ও হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে আরো বেশী কঠোরভাবে বিরোধিতা শুরু করে দেবে

﴿إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالصَّابِئُونَ وَالنَّصَارَىٰ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾

৬৯ (নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো এখানে কারোর ইজারাদারী নেই) মুসলমান হোক বা ইহুদী, সাবী হোক বা খৃস্টান যে-ই আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে নিসন্দেহে তার কোন ভয় বা মর্ম বেদনার কারণ নেই৯৯ 

৯৯. সূরা আল বাকারাহ-এর ৮ রুকূর ৮০ টীকা দেখুন

﴿لَقَدْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَأَرْسَلْنَا إِلَيْهِمْ رُسُلًا ۖ كُلَّمَا جَاءَهُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَىٰ أَنفُسُهُمْ فَرِيقًا كَذَّبُوا وَفَرِيقًا يَقْتُلُونَ﴾

৭০ বনী ইসরাঈলের থেকে পাকাপোক্ত অংগীকার নিয়েছিলাম এবং তাদের কাছে অনেক রাসূল পাঠিয়েছিলাম কিন্তু যখনই তাদের কাছে কোন রাসূল তাদের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা বিরোধী কিছু নিয়ে হাযির হয়েছেন তখনই কাউকে তারা মিথ্যুক বলেছে এবং কাউকে হত্যা করেছে

﴿وَحَسِبُوا أَلَّا تَكُونَ فِتْنَةٌ فَعَمُوا وَصَمُّوا ثُمَّ تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ثُمَّ عَمُوا وَصَمُّوا كَثِيرٌ مِّنْهُمْ ۚ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ﴾