তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿إِنَّآ أَعْطَيْنَـٰكَ ٱلْكَوْثَرَ﴾
১। (হে নবী!) আমি তোমাকে কাউসার দান করেছি।১
১. কাউসার শব্দটি এখানে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাতে আমাদের ভাষায় তো দূরের কথা দুনিয়ার কোন ভাষায়ও এক শব্দে এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ শব্দটি মূলে কাসরাত كثرة থেকে বিপুল ও অত্যধিক পরিমাণ বুঝাবার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, সীমাহীন আধিক্য। কিন্তু যে অবস্থায় ও পরিবেশে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে শুধুমাত্র আধিক্য নয় বরং কল্যাণ ও নিয়ামতের আধিক্য এবং এমন ধরনের আধিক্যের ধারণা পাওয়া যায় যা বাহুল্য ও প্রাচুর্যের সীমান্তে পৌঁছে গেছে? আর এর অর্থ কোন একটি কল্যাণ বা নিয়ামত নয় বরং অসংখ্য কল্যাণ ও নিয়ামতের আধিক্য। ভূমিকায় আমি এ সূরার যে প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি তার ওপর আর একবার দৃষ্টি বুলানো প্রয়োজন। তখন এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। শত্রুরা মনে করছিল, মুহাম্মাদ সা. সবদিক দিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছেন। জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বন্ধু-বান্ধব ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন। ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গেছে। বংশে বাতি জ্বালাবার জন্য যে ছেলে সন্তান ছিল, সেও মারা গেছে। আবার তিনি এমন দাওয়াত নিয়ে ময়দানে নেমেছেন যার ফলে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া মক্কা তো দূরের কথা সারা আরব দেশের কোন একটি লোকও তাঁর কথায় কান দিতে প্রস্তুত নয়। কাজেই তাঁর ভাগ্যের লিখন হচ্ছে জীবিত অবস্থায় ব্যর্থতা এবং মারা যাবার পরে দুনিয়ায় তাঁর নাম উচ্চারণ করার মতো একজন লোকও থাকবে না। এ অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন বলা হলো, তোমাকে কাওসার দান করেছি তখন স্বাভাবিকভাবে এর মানে দাঁড়ালোঃ তোমার শত্রুপক্ষীয় নির্বোধরা মনে করছে তুমি ধ্বংস হয়ে গেছো এবং নবুওয়াত লাভের পূর্বে তুমি যে নিয়ামত অর্জন করেছিলে তা তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি তোমাকে সীমাহীন কল্যাণ ও অসংখ্য নিয়ামত দান করেছি। নবী সা.কে যে নজিরবিহীন উন্নত নৈতিক গুণাবলী দান করা হয়েছিল সেগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত। তাঁকে যে নবুওয়াত, কুরআন এবং জ্ঞান ও তা প্রয়োগ করার মতো বুদ্ধিবৃত্তির নিয়ামতদান করা হয়েছিল তাও এর মধ্যে শামিল। তাওহীদও এমন ধরনের একটি জীবন ব্যবস্থার নিয়ামত এর অন্তর্ভুক্ত যার সহজ, সরল, সহজবোধ্য বুদ্ধি ও প্রকৃতির অনুসারী এবং পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন মূলনীতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার এবং হামেশা ছড়িয়ে পড়তে থাকার ক্ষমতা রাখে। রাসূল সা. এর আলোচনা ব্যাপকতর করার নিয়ামতও এর অন্তর্ভুক্ত যার বদৌলতে তাঁর নাম চৌদ্দশো বছর থেকে দুনিয়ার সর্বত্র বুলন্দ হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বুলন্দ হতে থাকবে। তাঁর আহবানে অবশেষে এমন একটি বিশ্বব্যাপী উম্মাতের উম্ভব হয়েছে, যারা দুনিয়ায় চিরকালের জন্য আল্লাহর সত্য দ্বীনের ধারক হয়েছে, যাদের চাইতে বেশী সৎ নিষ্কলুষ ও উন্নত চরিত্রের মানুষ দুনিয়ার কোন উম্মাতের মধ্যে কখনো জন্ম লাভ করেনি এবং বিকৃতির অবস্থায় পৌঁছেও যারা নিজেদের মধ্যে দুনিয়ার সব জাতির চাইতেও বেশী কল্যাণ ও নেকীর গুণাবলী বহন করে চলছে। এ নিয়ামতটিও এর অন্তর্ভুক্ত।
রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর নিজের চোখে নিজের জীবদ্দশায় নিজের দাওয়াতকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উঠতে দেখেছেন এবং তাঁর হাতে এমন জামায়াত তৈরি হয়েছে যারা সারা দুনিয়ার ওপর ছেড়ে যাবার ক্ষমতা রাখতো, এ নিয়ামতটিও এর অন্তর্ভুক্ত। ছেলে সন্তান থেকে বঞ্চিত হবার পর শত্রুরা মনে করতো তাঁর নাম-নিশানা দুনিয়া থেকে মিটে যাবে। কিন্তু আল্লাহ শুধু মুসলমানদের আকারে তাঁকে এমন ধরনের আধ্যাত্মিক সন্তান দিয়েই ক্ষান্ত হননি যারা কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় তাঁর নাম বুলন্দ করতে থাকবে বরং তাঁকে শুধুমাত্র একটি কন্যা হযরত ফাতোমার মাধ্যমে এত বিপুল পরিমাণ রক্তমাংসের সন্তান দান করেছেন যারা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং মহান নবীর সাথে সম্পর্কই যাদের সবচেয়ে বড় অহংকার। এটিও এ নিয়ামতের অন্তর্ভুক্ত।
নিয়ামতগুলো আল্লাহ তাঁর নবীকে এ মরজগতেই দান করেছেন। কত বিপুল পরিমাণে দান করেছেন তা লোকেরা দেখেছে। এগুলো ছাড়াও কাউসার বলতে আরো দু’টো মহান ও বিশাল নিয়ামত বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ তাঁকে আখেরাতে দান করবেন। সেগুলো সম্পর্কে জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে ছিল না। তাই রাসূলল্লাহ সা. আমাদের সেগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ কাউসার বলতে দু’টি জিনিস বুঝানো হয়েছে। একটি হচ্ছে “হাউজে কাউসার” এটি কিয়ামতের ময়দানে তাঁকে দান করা হবে। আর দ্বিতীয়টি “কাউসার ঝরণাধারা” এটি জান্নাতে তাঁকে দান করা হবে। এ দু’টির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে এত বেশী হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এত বিপুল সংখ্যক রাবী এ হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন যার ফলে এগুলোর নির্ভুল হবার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহেরও অবকাশ নেই।
হাউজে কাউসার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. নিম্নরূপ তথ্য পরিবেশন করেছেনঃ
একঃ এ হাউজটি কিয়ামতের দিন তাঁকে দেয়া হবে। এমন এক কঠিন সময়ে এটি তাঁকে দেয়া হবে যখন সবাই “আল আতশ” ‘আল আতশ’ অর্থাৎ পিপাসা, পিপাসা বলে চিৎকার করতে থাকবে সে সময় তাঁর উম্মত তাঁর কাছে এ হাউজের চারদিকে সমবেত হবে এবং এর পানি পান করবে। তিনি সবার আগে সেখানে পৌঁছবেন এবং তার মাঝ বরাবর জায়গায় বসে থাকবেন। তাঁর উক্তিঃ
هو حوض ترد عليه امتى يوم القيامة
“সেটি একটি হাউজ। আমার উম্মাত কিয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে।” (মুসলিম, কিতাবুস সারাত এবং আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ)
انا فرطكم على الحوض “আমি তোমাদের সবার আগে সেখানে পৌঁছে যাবো।” (বুখারী, কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান, মুসলিম, কিতাবুল ফাযায়েল ও কিতাবুল তাহারাত, ইবনে মাজাহ, কিতাবুল মানাসিক ও কিতাবুয যুহদ এবং মুসনাদে আহমাদ, আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা., আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ)।
إِنِّى فَرَطٌ لَكُمْ ، وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ ، وَإِنِّى وَاللَّهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ
“আমি তোমাদের আগে পৌঁছে যাবো, তোমাদের জন্য সাক্ষ্য দেবো এবং আল্লাহর কসম, আমি এ মুহূর্তে আমার হাউজ দেখতে পাচ্ছি।” (বুখারীঃ কিতাবুল জানায়েয, কিতাবুল মাগাযী ও কিতাবুর রিকাক)।
আনসারদেরকে সম্বোধন করে একবার তিনি বলেনঃ
إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِى أَثَرَةً فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِى ، وَمَوْعِدُكُمُ الْحَوْضُ
“আমার পরে তোমরা স্বার্থবাদিতা ও স্বজনপ্রীতির পাল্লায় পড়বে। তখন তার ওপর সবর করবে, আমার সাথে হাউজে কাউসারে এসে মিলিত হওয়া পর্যন্ত।” (বুখারীঃ কিতাবু মানাকিবিল আনসার ও কিতাবুল মাগাযী, মুসলিমঃ কিতাবুল আমারাহ এবং তিরমিযীঃ কিতাবুল ফিতান।)
انا يوم القيمة عند عقر الحوض
“কিয়ামতের দিন হাউজের মাঝ বরাবর থাকবো।” (মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল) হযরত আবু বারযাহ আসলামীকে রা. জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কি হাউজ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে কিছু শুনেছেন। তিনি বলেন, “একবার নয়, দু’বার নয়, তিনবার নয়, চারবার নয়, পাঁচবার নয়, বারবার শুনেছি। যে ব্যক্তি একে মিথ্যা বলবে আল্লাহ তাকে যেন তার পানি পান না করান।” (আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ)। উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ হাউজ সম্পর্কিত রেওয়ায়াত মিথ্যা মনে করতো। এমন কি সে হযরত আবু বারযাহ আসলামী রা., বারাআ ইবনে আযেব রা. ও আয়েদ ইবনে আমর রা. বর্ণিত রেওয়ায়াতগুলো অস্বীকার করলো। শেষে আবু সাবরাহ একটি লিপি বের করে আনলেন। এ লিপিটি তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসের রা. মুখে শুনে লিখে রেখেছিলেন। তাতে রাসূল সা. এর এ বাণী লেখা ছিলঃ الا ان موعد كم حوضى “জেনে রাখো, আমার ও তোমাদের সাক্ষাতের স্থান হচ্ছে আমার হাউজ।” (মুসনাদে আহমাদ, আবদুল্লাহ ইবনে আমার ইবনুল আসের রেওয়ায়াতসমূহ)।
দুইঃ এ হাউজের আয়তন সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা এসেছে। তবে অধিকাংশ রেওয়ায়াতে বলা হয়েছেঃ এটি আইলা (ইসরাঈলের বর্তমান বন্দর আইলাত) থেকে ইয়ামনের সানআ’ পর্যন্ত অথবা আইল থেকে এডেন পর্যন্ত কিংবা আম্মান থেকে এডেন পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। আর এটি চওড়া হবে আইলা থেকে হুজকাহ (জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে একটি স্থান) পর্যন্ত জায়গার সমপরিমাণ। (বুখারীঃ কিতাবুর রিকাক, আবু দাউদ তায়ালাসী ৯৯৫ হাদীস, মুসনাদে আহমাদ, আবু বকর সিদ্দীক ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ, মুসলিম-কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল, তিরমিযী— আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ এবং ইবনে মাজাহ-কিতাবুয যুহূদঃ)। এ থেকে অনুমান করা যায়, বর্তমান লোহিত সাগরটিকেই কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে পরিবর্তিত করে দেয়া হবে। তবে আসল ব্যাপার একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে।
তিনঃ এ হাউজটি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জান্নাতের কাউসার ঝরণাধারা (সামনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে) থেকে পানি এনে এতে ঢালা হবে। একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ يشخب فيه ميزابان من الجنة এবং অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ يعت فيه ميزابان يمدانه من الجنة অর্থাৎ জান্নাত থেকে দু’টি খাল কেটে এনে তাতে ফেলা হবে এবং এর সাহায্যে থেকে তাতে পানি সরবরাহ হবে। (মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ يفتح نهر من الكوثر الى الحوض অর্থাৎ জান্নাতের কাওসার ঝরণাধারা থেকে একটি নহর এ হাউজের দিকে খুলে দেয়া হবে এবং তার সাহায্যে এতে পানি সরবরাহ জারী থাকবে (মুসনাদে আহমাদ, আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ)।
চারঃ হাউজে কাউসারের অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, তার পানি হবে দুধের চাইতে (কোন কোন রেওয়ায়াত অনুযায়ী রূপার চাইতে আবার কোন কোন রেয়ায়াত অনুযায়ী বরফের চাইতে) বেশী সাদা, বরফের চাইতে বেশী ঠাণ্ডা এবং মধুর চাইতে বেশী মিষ্টি। তার তলদেশের মাটি হবে মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত। আকাশে যত তারা আছে ততটি সোরাহী তার পাশে রাখা থাকবে। তার পানি একবার পান করার পর দ্বিতীয়বার কারো পিপাসা লাগবে না। আর তার পানি যে একবার পান করেনি তার পিপাসা কোনদিন মিটবে না। সামান্য শাব্দিক হেরফেরসহ একথাগুলোই অসংখ্য হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। (বুখারী কিতাবুর রিকাক, মুসলিম-কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল, মুসনাদে আহমাদ-ইবনে মাসউ’দ, ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ উবনে আমর ইবনুল আ’স বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ, তিরমিযী আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ, ইবনে মাজাহ-কিতাবুয যুহোদ এবং আবু দাউদ আত তায়ালাসীঃ ৯৯৫ ও ২১৩৫ হাদীস।
পাঁচঃ রাসূলুল্লাহ সা. বারবার তাঁর সময়ের লোকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আমার পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার তরিকা পদ্ধতি পরিবর্তন করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে হটিয়ে দেয়া হবে এবং এর পানির কাছে তাদের আসতে দেয়া হবে না। আমি বলবো, এরা আমার লোক। জবাবে আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না আপনার পরে এরা কি করেছে। তখন আমিও তাদেরকে তাড়িয়ে দেবো। আমি বলবো, দূর হয়ে যাও। এ বক্তব্যটি অসংখ্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। (বুখারী-কিতাবুল ফিতান ও কিতাবুর রিকাক, মুসলিম কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল, মুসনাদে আহমাদ-ইবনে মাসউ’দ ও আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীসসমূহ, ইবনে মাজাহ— কিতাবুল মানাসিক।) ইবনে মাজাহ এ ব্যাপারে যে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দগুলো বড়ই হৃদয়স্পর্শী। তাতে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ
أَلاَ وَإِنِّى فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ وَأُكَاثِرُ بِكُمُ الأُمَمَ فَلاَ تُسَوِّدُوا وَجْهِى أَلاَ وَإِنِّى مُسْتَنْقِذٌ أُنَاسًا وَمُسْتَنْقَذٌ أُنَاسٌ مِنِّى فَأَقُولُ يَا رَبِّ أُصَيْحَابِى. فَيَقُولُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِى مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ
“সাবধান হয়ে যাও! আমি তোমাদের আগে হাউজে উপস্থিত থাকবো। তোমাদের মাধ্যমে অন্য উম্মাতদের মোকাবিলায় আমি নিজের উম্মাতের বিপুল সংখ্যার জন্য গর্ব করতে থাকবো। সে সময় আমার মুখে কালিমা লেপন করো না। সাবধান হয়ে যাও! কিছু লোককে আমি ছাড়িয়ে নেবো আর কিছু লোককে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হবে।
আমি বলবো হে আমার রব! এরা তো আমার সাহাবী। তিনি বলবেন, তুমি জানো না তোমার পরে এরা কী অভিনব কাজ কারবার করেছে।” ইবনে মাজার বক্তব্য হচ্ছে, এ শব্দগুলো রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর আরাফাত ময়দানের ভাষণে বলেছিলেন।
ছয়ঃ এভাবে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর পর থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সময় কালের সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেনঃ তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য পথে চলবে এবং তার মধ্যে রদবদল করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। আমি বলবোঃ হে আমার রব! এরা তো আমার উম্মাতের লোক। জবাবে বলা হবেঃ আপনি জানেন না, আপনার পরে এরা কি কি পরিবর্তন করেছিল এবং আপনার পথের উল্টো দিকে চলে গিয়েছিল। তখন আমিও তাদেরকে দূর করে দেবো এবং তাদেরকে হাউজের ধারে কাছে ঘেঁসতে দেবো না। হাদীস গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অসংখ্য হাদীস উল্লেখিত হয়েছে। (বুখারী-কিতাবুল মূসাকাত, কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান, মুসলিম-কিতাবুত তাহারাত, কিতাবুস সালাত ও কিতাবুল ফাজায়েল, ইবনে মাজাহ-কিতাবুয যুহূদঃ, মুসনাদে আহামদ-আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসসমূহ)।
পঞ্চাশ জনেরও বেশী সাহাবী এ হাউজ সংক্রান্ত হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন। প্রথম যুগের আলেমগণ সাধারণভাবে এটিকে হাউজে কাউসার বলেছেন। ইমাম বুখারী কিতাবুর রিকাকের শেষ অনুচ্ছেদের শিরোনাম রাখেন নিম্নোক্তভাবেঃ باب فى الحوض وقول الله إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (হাউজ অনুচ্ছেদ, আর আল্লাহ বলেছেনঃ আমি তোমাকে কাউসার দিয়েছি)। অন্যদিকে হযরত আনাসের রেওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. কাউসার সম্পর্কে বলেছেনঃ
هو حوض ترد عليه امتى “সেটি একটি হাউজ। আমার উম্মাত সেখানে উপস্থিত হবে।”
জান্নাতে রাসূলুল্লাহ সা.কে কাউসার নামে যে নহরটি দেয়া হবে সেটির উল্লেখও অসংখ্য হাদীসে পাওয়া যায়। হযরত আনাস রা. থেকে এ সংক্রান্ত বহু হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলোতে তিনি বলেনঃ (আবার কোন কোনটিতে তিনি স্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ সা. এর উক্তি হিসেবেই বর্ণনা করেন) মি’রাজে রাসূলুল্লাহকে সা. জান্নাতে সফর করানো হয়। এ সময় তিনি একটি নহর দেখেন। এ নহরের তীরদেশে ভিতর থেকে হীরা বা মুক্তার কারুকার্য করা গোলাকৃতির মেহরাবসমূহ ছিল, তার তলদেশের মাটি ছিল খাঁটি মিশকের সুগন্ধিযুক্ত। রাসূলুল্লাহ সা. জিব্রাঈলকে বা যে ফেরেশতা তাঁকে ভ্রমণ করিয়েছিলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, এটা কি? ফেরেশতা জবাব দেন, এটা কাউসার নহর। আল্লাহ আপনাকে এ নহরটি দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ তায়ালাসী ও ইবেন জারীর)। হযরত আনাস এক রেওয়ায়াতে বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করা হল, অথবা এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেনঃ কাউসার কি? তিনি জবাব দিলেনঃ একটি নহর যা আল্লাহ আমাকে জান্নাতে দান করেছেন। এর মাটি মিশকের। এর পানি দুধের চাইতেও সাদা এবং মধুর চাইতে মিষ্টি। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে জারীর)। মুসনাদে আহমাদের অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. নহরে কাউসারের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ তার তলদেশে কাঁকরের পরিবর্তে মণিমুক্তা পড়ে আছে। ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ কাউসার জান্নাতের একটি নহর। এর তীরদেশ সোনার পরিবর্তে মূল্যবান পাথর বিছানো আছে।) এর মাটি মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত। পানি দুধের চাইতে বেশী সাদা। বরফের চেয়ে বেশী ঠাণ্ডা ও মধুর চেয়ে বেশী মিষ্টি। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, ইবনে আবী হাতেম, দারেমী, আবু দাউদ, ইবনুল মুনযির, ইবনে মারদুইয়া ও ইবনে আবী শাইবা)। উসামা ইবনে যায়েদ রা. রেওয়ায়াত করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. একবার হযরত হামাযার রা. বাড়িতে যান। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী নবী সা. এর মেহমানদারী করেন। আলাপ-আলোচনা করতে করতে এক সময় তিনি বলেন, আমার স্বামী আমাকে বলেছেন, আপনাকে জান্নাতে একটি নহর দেয়া হবে। তার নাম কাউসার। তিনি বলেনঃ “হ্যাঁ, তার যমীন ইয়াকুত, মারজান, যবরযদ ও মতির সমন্বেয় গঠিত”। (ইবনে জারীর ও ইবন মারদুইয়া। এ হাদীসটির সূত্র দুর্বল হলেও এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বিপুল সংখ্যক হাদীস পাওয়া যাওয়ার কারণে এর শক্তি বেড়ে গেছে)। নবী সা. এর এ উক্তি এবং সাহাবা ও তাবেঈগণের অসংখ্য বক্তব্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। এ সবগুলোতে কাউসার বলতে জান্নাতের এ নহরই বুঝানো হয়েছে। ওপরে এ নহরের যে সব বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে এ হাদীসগুলোতেই তাই বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা., হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হযরত আনাস ইবনে মালিক রা., হযরত আয়েশা রা., মুজাহিদ ও আবুল আলীয়ার উক্তিসমূহ মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মারদুইয়া, ইবনে জারীর ও ইবনে আবী শাইবা ইত্যাদি মুহাদ্দিসগণের কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে।
﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ﴾
২। কাজেই তুমি নিজের রবেরই জন্য নামায পড়ো ও কুরবানী করো।২
২. বিভিন্ন মনীষী এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ নামায বলতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামায ধরেছেন। কেউ ঈদুল আযহার নামায মনে করেছেন। আবার কেউ বলেছেন, এখানে নিছক নামাযের কথা বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘ওয়ানহার’ অর্থাৎ “নহর কর” শব্দেরও কোন কোন বিপুল মর্যাদার অধিকারী মনীষী অর্থ করেছেন, নামাযে বাম হাতের ওপর ডান হাত রেখে তা বুকে বাঁধা। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে, নামায শুরু করার সময় দুই হাত ওপরে উঠিয়ে তাকবীর বলা, কেউ কেউ বলেছেন, এর মাধ্যমে নামায শুরু করার সময় রুকূতে যাবার সময় এবং রুকূ থেকে উঠে রাফে ইয়াদায়েন করা বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে, ঈদুল আযহার নামায পড়া এবং কুরবানী করা। কিন্তু যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এ হুকুম দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে এর সুস্পষ্ট অর্থ এই মনে হয়ঃ “হে নবী! তোমার রব যখন তোমাকে এত বিপুল কল্যাণ দান করেছেন তখন তুমি তাঁরই জন্য নামায পড় এবং তাঁরই জন্য কুরবানী দাও।” এ হুকুমটি এমন এক পরিবেশে দেয়া হয়েছিল যখন কেবল কুরাইশ বংশীয় মুশরিকরাই নয় সমগ্র আরব দেশের মুশরিকবৃন্দ নিজেদের মনগড়া মাবুদদের পূজা করতো এবং তাদের আস্তানায় পশু বলী দিতো। কাজেই এখানে এ হুকুমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুশরিকদের বিপরীতে তোমরা নিজেদের কর্মনীতির ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো। অর্থাৎ তোমাদের নামায হবে আল্লাহরই জন্য, কুরবানীও হবে তাঁরই জন্য। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ
“হে নবী! বলে দাও, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহরই জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আমি সর্বপ্রথম আনুগত্যের শির নত করি।” (আল আনআ’মঃ ১৬২-১৬৩)
ইবনে আব্বাস আতা, মুজাহিদ, ইকরামা, হাসান বসরী, কাতাদাহ, মুহাম্মাদ ইবনে কাব আল কুয়াযী, যাহহাক, রাবী’ ইবনে আনাস, আতাউল খোরাসানী এবং আরো অন্যান্য অনেক নেতৃস্থানীয় মুফাস্সির এর এ অর্থই বর্ণনা করেছেন (ইবনে কাসীর)। তবে একথা যথাস্থানে পুরোপুরি সত্য যে, রাসূলুল্লাহ সা. যখন মদীনা তাইয়েবায় আল্লাহর হুকুমে ঈদুল আযহার নামায পড়েন ও কুরবানীর প্রচলন করেন তখন যেহেতু إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي আয়াতে এবং فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ আয়াতে নামাযকে প্রথমে ও কুরবানীকে পরে রাখা হয়েছে তাই তিনি নিজেও এভাবেই করেন এবং মুসলমানদের এভাবে করার হুকুম দেন। অর্থাৎ এদিন প্রথমে নামায পড়বে এবং তারপর কুরবানী দেবে। এটি এ আয়াতের ব্যাখ্যা বা এর শানে নুযুল নয়। বরং সংশ্লিষ্ট আয়াত গুলো থেকে রাসূলুল্লাহ সা. এ বিধানটি ইসতেমবাত তথা উদ্ভাবন করেছিলেন। আর রাসূলের সা. ইসতেমবাতও এক ধরনের ওহী।
﴿إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ ٱلْأَبْتَرُ﴾
৩। তোমার দুশমনই৩ শিকড় কাটা।৪
৩. এখানে شَانِئَكَ (শা-নিআকা) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মূল হচ্ছে شنء (শানউন)। এর মানে এমন ধরনের বিদ্বেষ ও শত্রুতা যে কারণে একজন অন্য জনের বিরুদ্ধে অসদ্ব্যবহার করতে থাকে। কুরআন মজীদের অন্য জায়গায় বলা হয়েছেঃ
وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا
“আর হে মুসলমানরা! কোন দলের প্রতি শত্রুতা তোমাদের যেন কোন বাড়াবাড়ি করতে উদ্বুদ্ধ না করে যার ফলে তোমরা ইনসাফ করতে সক্ষম না হও।”
কাজেই এখানে ‘শানিয়াকা’ বলে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. এর শত্রুতায় অন্ধ হওয়া তাঁর প্রতিও দোষারোপ করে, তাঁকে গালিগালাজ করে, তাঁকে অবমাননা করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানান ধরনের অপবাদ দিয়ে নিজের মনের ঝাল মেটায়।
৪. هُوَ الْأَبْتَرُ “সেই আবতার” বলা হয়েছে। অর্থাৎ সে তোমাকে আবতার বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই আবতার। আমি ইতিপূর্বে এ সূরার ভূমিকায় ‘আবতার’ শব্দের কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছি। এই শব্দের মূলে রয়েছে বাতারা (بتر) এর মানে কাটা। কিন্তু এর পরিভাষিক অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। হাদীসে নামাযের যে রাকাতের সাথে অন্য কোন রাকাত পড়া হয় না তাকে বুতাইরা (بتيراء) বলা হয়। অর্থাৎ একক রাকাত। অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ
كُلُّ أَمْرٍ ذِى بَالٍ لاَ يُبْدَأُ فِيهِ بِالْحَمْدِ الله فهو ابتر
“যেকোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আল্লাহর প্রসংশাবাণী উচ্চারণ না করে শুরু করাটা আবতার।”
অর্থাৎ তার শিকড় কাটা গেছে। সে কোন প্রতিষ্ঠা ও শক্তিমত্তা লাভ করতে পারে না। অথবা তার পরিণাম ভালো নয়। ব্যর্থ কাম ব্যক্তিকেও আবতার বলা হয়। যে ব্যক্তির কোন উপকার ও কল্যাণের আশা নেই এবং যার সাফল্যের সব আশা নির্মূল হয়ে গেছে তাকেও আবতার বলে। যার কোন ছেলে সন্তান নেই অথবা হয়ে মারা গেছে তার ব্যাপারেও আবতার শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কারণ তার অবর্তমানে তার নাম নেবার মতো কেউ থাকে না এবং মারা যাবার পর তার নাম নিশানা মুছে যার। প্রায় সমস্ত অর্থেই কুরাইশ কাফেররা মুহাম্মাদ সা.কে আবতার বলতো। তার জবাবে আল্লাহ বলেন, হে নবী! তুমি আবতার নও বরং তোমার এ শত্রুই আবতার। এটা নিছক কোন জবাবী আক্রমণ ছিল না। বরং এটা ছিল আসলে কুরআনের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্য থেকে একটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী। এটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়। যখন এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তখন লোকেরা নবী সা.কে আবতার মনে করতো। তখন কেউ ধরণা করতে পারতো না যে, কুরাইশদের এ বড় বড় সরদাররা আবার কেমন করে আবতার হয়ে যাবে? তারা কেবল মক্কায়ই নয় সমগ্র দেশে খ্যাতিমান ছিল। তারা সফলকাম ছিল। তারা কেবল ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির অধিকারী ছিল না বরং সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় ছিল তাদের সহযোগী ও সাহায্যকারী দল। ব্যবসার ইজারাদার ও হজ্জের ব্যবস্থাপক হবার কারণে আরবের সকল গোত্রের সাথে ছিল তাদের সম্পর্ক। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেলো। হিজরী ৫ সনে আহযাব যুদ্ধের সময় কুরাইশরা বহু আরব ও ইহুদি গোত্র নিয়ে মদীনা আক্রমণ করলো এবং রাসূলুল্লাহ সা.কে অবরুদ্ধ অবস্থায় শহরের চারদিক পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হলো। কিন্তু এর মাত্র তিন বছর পরে ৮ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সা. যখন মক্কা আক্রমণ করলেন তখন কুরাইশদের কোন সাহায্য-সহযোগিতা দানকারী ছিল না। নিতান্ত অসহায়ের মতো তাদেরকে অস্ত্র সংবরণ করতে হলো। এরপর এক বছরের মধ্যে সমগ্র আরব দেশ ছিল রাসূলুল্লাহ সা. এর করতলগত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিদল এসে তাঁর হাতে বাইআ’ত হচ্ছিল। ওদিকে তাঁর শত্রুরা সম্পূর্ণরূপে বন্ধু-বান্ধব ও সাহায্য-সহায়হীন হয়ে পড়েছিল। তারপর তাদের নাম-নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে এমনভাবে মুছে গেলো যে, তাদের সন্তানদের কেউ আজ বেঁচে থাকলেও তাদের কেউই আজ জানে না সে আবু জেহেল আর আবু লাহাব, আস ইবনে ওয়ায়েল বা উকবা ইবনে আবীমুআ’ইত ইত্যাদি ইসলামের শত্রুদের সন্তান। আর কেউ জানলেও সে নিজেকে এদের সন্তান বলে পরিচয় দিতে প্রস্তুত নয়। বিপরীতপক্ষে রাসূলুল্লাহ সা. এর পরিবারবর্গের ওপর আজ সারা দুনিয়ায় দরূদ পড়া হচ্ছে। কোটি কোটি মুসলমান তাঁর সাথে সম্পর্কিত হবার কারণে গর্ব করে। লাখো লাখো লোক তাঁর সাথেই নয় বরং তাঁর পরিবার-পরিজন এমন কি তাঁর সাথীদের পরিবার-পরিজনের সাথেও সম্পর্কিত হওয়াকে গৌরবজনক মনে করে। এখানে কেউ সাইয়েদ, কেউ উলুব্বী, কেউ আব্বাসী, কেউ হাশেমী, কেউ সিদ্দিকী, কেউ ফারুকী, কেউ উসমানী, কেউ যুবাইরী এবং কেউ আনসারী। কিন্তু নামমাত্রও কোন আবু জেহেলী বা আবু লাহাবী পাওয়া যায় না। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, রাসূলুল্লাহ সা. আবতার নন বরং তাঁর শত্রুরাই আবতার।
— সমাপ্ত —