তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ۖ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ﴾
১। আল্লাহরই তাসবীহ করছে আসমান ও যমীনের প্রতিটি জিনিস। তিনিই বিজয়ী এবং মহাজ্ঞানী।১
১. ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন সূরা আল হাদীদের তাফসীরের ১ও ২ নং টীকা। বনী নাযিরের বহিষ্কার সম্পর্কে বিশ্লেষণ শুরু করার আগে এই প্রারম্ভিক কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো মন-মগজকে এ সত্য উপলব্ধি করতে প্রস্তুত করা যে, এই শক্তিশালী ইহুদী গোত্রের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তা মুসলমানদের শক্তির কারণে নয়, বরং আল্লাহর অসীম শক্তির বিস্ময়কর কীর্তি মাত্র।
﴿هُوَ ٱلَّذِىٓ أَخْرَجَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ مِن دِيَـٰرِهِمْ لِأَوَّلِ ٱلْحَشْرِ ۚ مَا ظَنَنتُمْ أَن يَخْرُجُوا۟ ۖ وَظَنُّوٓا۟ أَنَّهُم مَّانِعَتُهُمْ حُصُونُهُم مِّنَ ٱللَّهِ فَأَتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِنْ حَيْثُ لَمْ يَحْتَسِبُوا۟ ۖ وَقَذَفَ فِى قُلُوبِهِمُ ٱلرُّعْبَ ۚ يُخْرِبُونَ بُيُوتَهُم بِأَيْدِيهِمْ وَأَيْدِى ٱلْمُؤْمِنِينَ فَٱعْتَبِرُوا۟ يَـٰٓأُو۟لِى ٱلْأَبْصَـٰرِ﴾
২। তিনিই আহলে কিতাব কাফেরদেরকে প্রথম আক্রমণেই২ তাদের ঘরবাড়ী থেকে বের করে দিয়েছেন।৩ তোমরা কখনো ধারণাও কর নাই যে, তারা বের হয়ে যাবে। তারাও মনে করে বসেছিলো যে, তাদের দুর্গসমূহ তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।৪ কিন্তু আল্লাহ এমন এক দিক থেকে তাদের ওপর চড়াও হয়েছেন, যে দিকের ধারণাও তারা করতে পারেনি।৫ তিনি তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফল হয়েছে এই যে, তারা নিজ হাতেও নিজেদের ঘর-বাড়ী ধ্বংস করছিলো এবং মু’মিনদের হাত দিয়েও ধ্বংস করেছিলো।৬ অতএব, হে দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা,৭ শিক্ষাগ্রহণ করো।
২. মূল শব্দ হলো لِأَوَّلِ الْحَشْرِ । হাশর ( (حشر) শব্দের অর্থ বিক্ষিপ্ত জনতাকে একত্র করা অথবা ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যক্তিদের একত্রিত করে বের হওয়া। আর لِأَوَّلِ الْحَشْرِ এর অর্থ হলো, প্রথমবার একত্রিত হওয়ার সাথে অথবা প্রথমবার একত্রিত হওয়ার সময়ে। এখন প্রশ্ন হলো, এখানে প্রথম হাশর বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। একদলের মতে এর অর্থ মদীনা থেকে বনী নাযীরের বহিষ্কার। একে প্রথম হাশর এই অর্থে বলা হয়েছে যে, তাদের দ্বিতীয় হাশর হয়েছিলো হযরত উমরের রা. সময়ে। এই সময় ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে আরব উপদ্বীপ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আর তাদের শেষ হাশর হবে কিয়ামতের দিন। দ্বিতীয় দলের মতে এর অর্থ হলো মুসলমানদের সৈন্য সমাবেশের ঘটনা যা বনী নাযীর গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য করা হয়েছিল সুতরাং لِأَوَّلِ الْحَشْرِ এর অর্থ হলো, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মুসলমানরা সবেমাত্র একত্রিত হয়েছিলো। লড়াই ও রক্তপাতের কোন অবকাশই সৃষ্টি হয়নি। ইতিমধ্যেই আল্লাহ তাআ’লার কুদরাতের তারা দেশান্তরিত হতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। অন্য কথায় এখানে এ বাক্যাংশটি আক্রমণের “প্রথম চোটে” বা “প্রথম আঘাতে” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এর অনুবাদ করেছেনঃ در اول جمع كردن لشكر । শাহ আবদুল কাদের সাহেবের অনুবাদ হলোঃ ( يهل هى بهير هوت ) আমাদের মতে এই দ্বিতীয় অর্থটিই এ আয়াতাংশের সঠিক ও বোধগম্য অর্থ।
৩. এখানে প্রথমেই একটি বিষয় বুঝে নেয়া উচিত, যাতে বনী নাযীরের বহিষ্কারের ব্যাপারে কোন মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি না হয়। নবী সা. এর সাথে বনী নাযীর গোত্রের যথারীতি একটি লিখিত চুক্তি ছিল। এ চুক্তিকে তারা বাতিলও করেছিলো না যে, তার কোন অস্তিত্ব নেই মনে করা চলে। তবে যে কারণে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছিল তা হলো, এই চুক্তি লংঘনের অনেকগুলো ছোট বড় কাজ করার পর তারা এমন একটি কাজ করে বসেছিল যা সুস্পষ্টভাবে চুক্তিভংগেরই নামান্তর। অর্থাৎ তারা চুক্তির অপর পক্ষ মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। আর তাও এমনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়লো যে, সেজন্য তাদেরকে চুক্তিভংগের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলে তারা তা অস্বীকার করতে পারেনি। এরপর রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে দশদিন সময় দিয়ে এই মর্মে চরমপত্র দিলেন যে, এই সময়ের মধ্যেই তোমরা মদীনা ছেড়ে চলে যাও। অন্যথায় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। এই চরম পত্র ছিল সম্পূর্ণরূপে কুরআন মজীদের নির্দেশ অনুসারে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ “যদি তোমরা কোন কওমের পক্ষ থেকে বিশ্বাসভংগের (চুক্তিলংঘনের)আশঙ্কা কর তাহলে সেই চুক্তি প্রকাশ্যে তাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।” (আল আনফালঃ ৫৮) এ কারণে তাদের বহিষ্কারকে আল্লাহ তাআ’লা তাঁর নিজের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। কারণ, তা ছিল আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক। যেন তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সা. ও মুসলমানগণ বহিষ্কার করেননি, বরং আল্লাহ তাআ’লা নিজে বহিষ্কার করেছেন। দ্বিতীয় যে কারণটির জন্য তাদের বহিষ্কারকে আল্লাহ তাআ’লা নিজের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন তা পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে।
৪. একথাটি বুঝার জন্য মনে রাখা দরকার যে, বনী নাযীর শত শত বছর ধরে এখানে প্রভাব প্রতিপত্তির সাথে বসবাস করে আসছিল। মদীনার বাইরে তাদের গোটা জনবসতি একই সাথে ছিল। নিজের গোত্রের লোকজন ছাড়া আর কোন গোত্রের লোকজন তাদের মধ্যে ছিল না। গোটা বসতি এলাকাকে তারা একটি দুর্গে রূপান্তিরিত করেছিল। সাধারণত বিশৃংখলাপূর্ণ ও নিরাপত্তাহীন উপজাতীয় এ এলাকায় ঘর-বাড়ী যেভাবে নির্মাণ করা হয়ে থাকে তাদের ঘর-বাড়ীও ঠিক তেমনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলো ছিল ছোট ছোট দুর্গের মত। তাছাড়া তাদের সংখ্যাও সেই সময়ের মুসলমানদের সংখ্যার চেয়ে কম ছিল না। এমনকি মদিনার অভ্যন্তরেও বহু সংখ্যক মুনাফিক তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। তাই মুসলমানরাও কখনো এ আশা করেনি যে, লড়াই ছাড়া শুধু আবরোধের কারণেই দিশেহারা হয়ে তারা নিজেদের বসতভিটা ছেড়ে চলে যাবে। বনু নাযীর গোত্রের লোকজন নিজেরাও একথা কল্পনা করেনি যে, কোন শক্তি মাত্র ছয় দিনের মধ্যেই তাদের হাত থেকে এ জায়গা ছিনিয়ে নেবে। তাদের পূর্বে যদিও বনু কায়নুকা গোত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো এবং নিজেদের বীরত্বের অহংকার তাদের কোন কাজেই আসেনি। কিন্তু তারা ছিল মদীনার অভ্যন্তরে এক মহল্লার অধিবাসী। তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র কোন দুর্গ-প্রাকার বেষ্টিত জনপদ ছিল না। তাই বনীনাযীর গোত্র মনে করতো যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের টিকে থাকতে না পারা অযৌক্তিক বা অসম্ভব কিছু ছিল না। পক্ষান্তরে তারা নিজেদের সুরক্ষিত জনপদ এবং মজবুত দুর্গসমূহ দেখে ধারণাও করতে পারতো না যে, এখান থেকে কেউ তাদের বহিষ্কার করতে পারে। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে দশ দিনের মধ্যে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার চরমপত্র দিলে তারা অত্যন্ত ধৃষ্টতার সাথে খোলাখুলি জবাব দিল, আমরা এখান থেকে চলে যাব না। আপনার কিছু করার থাকলে করে দেখতে পারেন।
এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রশ্নটি হলো, আল্লাহ তাআ’লা কিভাবে একথা বললেন যে, তারা মনে করে নিয়েছিলো তাদের ছোট ছোট দুর্গের মত বাড়ীঘর তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করবে? বনী নাযীর কি সত্যি সত্যিই জানতো যে, তাদের মোকাবিলা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর সা. সাথে নয়, বরং খোদ আল্লাহর সাথে? আর এটা জানার পরেও কি তারা একথা বিশ্বাস করেছিল যে, তাদের দুর্গসমূহ আল্লাহর হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে? যারা ইহুদী জাতির মানসিকতা এবং তাদের শত শত বছরের ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত নয় এরূপ প্রত্যেক ব্যক্তির মনে এ প্রশ্ন দ্বিধা ও সংশয়ের সৃষ্টি করবে। সাধারণ মানুষ সম্পর্কে কেউ ধারণাও করতে পারে না যে, আল্লাহর সাথে মোকাবিলা হচ্ছে সচেতনভাবে একথা জেনে শুনেও তারা এ ধরণের খোশ খেয়ালে মত্ত থাকবে এবং ভাববে যে, তাদের দুর্গ এবং অস্ত্রশস্ত্র তাদেরকে আল্লাহর থেকে রক্ষা করবে। এ কারণে একজন অনভিজ্ঞ লোক এখানে আল্লাহ তাআ’লার এ বাণীর অর্থ করবেন এই যে, বনী নাযীর বাহ্যত নিজেদের সুদৃঢ় দুর্গসমূহ দেখে ভুল ধারণা করে বসেছিল যে, তারা রাসূলুল্লাহ সা. এর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তাদের মোকাবিলা ছিল আল্লাহর সাথে। এ আক্রমণ থেকে তাদের দুর্গসমূহ তাদের রক্ষা করতে সক্ষম ছিল না। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, এই পৃথিবীতে ইহুদীরা একটি অদ্ভুত জাতি যারা জেনে বুঝেও আল্লাহর মোকাবিলা করে আসছে। তারা আল্লাহর রাসূলদেরকে আল্লাহর রাসূল জেনেও হত্যা করেছে এবং অহংকারে বুক ঠুকে বলেছে, আমরা আল্লাহ রাসূলকে হত্যা করেছি। এ জাতির লোকগাঁথায় রয়েছে যে “তাদের পূর্বপূরুষ হযরত ইয়া’কূবের আ. সাথে আল্লাহ তাআ’লার সারা রাত ধরে কুস্তি হয়েছে এবং ভোর পর্যন্ত লড়াই করেও আল্লাহ তাআ’লা তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। অতঃপর ভোর হয়ে গেলে আল্লাহ তাআ’লা তাকে বললেনঃ এখন আমাকে যেতে দাও। এতে ইয়া’কূব আ. বললেনঃ যতক্ষণ না তুমি আমাকে বরকত দেবে ততক্ষণ আমি তোমাকে যেতে দেব না। আল্লাহ তাআ’লা তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার নাম কি? তিনি বললেনঃ ইয়া’কূব। আল্লাহ তাআ’লা বললেনঃ ভবিষ্যতে তোমার নাম ইয়া’কূব হবে না বরং ‘ইসরাঈল’ হবে। কেননা তুমি খোদা ও মানুষের সাথে শক্তি পরীক্ষা করে বিজয়ী হয়েছো।” দেখুন ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থের (The Holy Scriptures) আধুনিকতম অনুবাদ, প্রকাশক, জুয়িশ পাবলীকেশন সোসাইটি অব আমেরিকা, ১৯৫৪, আদিপুস্তকঃ অধ্যায় ৩২, শ্লোক ২৫ থেকে ২৯। খৃস্টানদের অনুদিত বাইবেলেও এ বিষয়টি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইহুদীদের অনুবাদের ফুটনোটে ‘ইসরাঈল’ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছেঃ (He who Striveth with God) অর্থাৎ যিনি খোদার সাথে শক্তি পরীক্ষা করেন। ইনসাইক্লোপেডিয়া অব বাইবেলিকাল লিটারেচারে খৃস্টান পুরোহিতগণ ইসরাঈল শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ (Wreslter with God) “খোদার সাথে কুস্তি লড়নেওয়ালা।” হোশেয় পুস্তকে হযরত ইয়াকূবের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “তিনি তাঁর যৌবনে খোদার সাথে কুস্তি লড়েছেন। তিনি ফেরেশতার সাথে কুস্তি করে বিজয়ী হয়েছেন।” (অধ্যায় ১২, শ্লোক ৪) অতএব একথা স্পস্ট যে, বনী ইসরাঈলরা মহান সেই ইসরাঈলের বংশধর যার সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস হলো, তিনি খোদার সাথে শক্তি পরীক্ষা করেছিলেন এবং তাঁর সাথে কুস্তি লড়েছিলেন। তাই খোদার সাথে মোকাবিলা একথা জেনে বুঝেও খোদার বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হওয়া তাদের জন্য এমন কি আর কঠিন কাজ? এ কারণে তাদের নিজেদের স্বীকারোক্তি অনুসারে তারা আল্লাহর নবীদের হত্যা করেছে এবং একই কারণে তাদের নিজেদের স্বীকারোক্তি অনুসারে তারা আল্লাহর নবীদের হত্যা করেছে এবং একই কারণে তাদের নিজেদের ধারণা অনুসারে তারা হযরত ঈসাকে শূলে চড়িয়েছে এবং বুক ঠুকে বলেছেঃ (إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ –আমরা আল্লাহর রাসূল মাসীহ ঈ’সা ইবনে মারইয়ামকে হত্যা করেছি।) তাই মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল একথা জেনে বুঝেও তারা যদি তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকে তাহলে তা তাদের ঐতিহ্য বিরোধী কোন কাজ নয়। তাদের জনসাধারণ না জানলেও পণ্ডিত-পুরোহিত ও আলেম সমাজ ভাল করেই জানতো যে, তিনি আল্লাহর রাসূল। এ বিষয়ের কয়েকটি প্রমাণ কুরআন মজীদেই বর্তমান। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারাহঃ টিকা ৭৯-৯৫; আস সাফফাতঃ টীকা ৭০-৭৩।
৫. আল্লাহ তাআ’লার তাদের ওপর চড়াও হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তিনি অন্য কোন স্থানে ছিলেন সেখান থেকে তাদের ওপর চড়াও হয়েছেন। বরং এটি একটি রূপক বাক্য। এরূপ ধারণা দেয়াই মূলত উদ্দেশ্য যে, আল্লাহর বিরুদ্ধে মোকাবিলার সময় তাদের ধারণা ছিল, শুধু একটি পন্থায় আল্লাহ তাদের ওপর বিপদ আনতে পারেন। তাহলো সামনাসামনি কোন সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসা। আর তারা মনে করতো যে, দুর্গাভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে তারা সে বিপদ ঠেকাতে পারবে। কিন্তু এমন একটি পথে তিনি তাদের ওপর হামলা করেছেন, যে দিক থেকে কোন বিপদ আসার আদৌ কোনআশঙ্কা তারা করতো না। সে পথটি ছিল এই যে, ভিতর থেকেই তিনি তাদের মনোবল ও মোকাবিলার ক্ষমতা নিঃশেষ ও অন্তসারশূন্য করে দিলেন। এরপর তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং দুর্গ কোন কাজেই আসেনি।
৬. অর্থাৎ ধ্বংসসাধিত হয়েছে দু’ভাবে। যে দুর্গের মধ্যে তারা আশ্রয় নিয়েছিল। মুসলমানরা বাইরে থেকে অবরোধ করে তা ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করলো। আর ভেতর থেকে তারা নিজেরা প্রথমত মুসলমানদের প্রতিহত করার জন্য স্থানে স্থানে কাঠ ও পাথরের প্রতিবন্ধক বসালো এবং সেজন্য নিজেদের ঘর দড়জা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আবর্জনা জমা করলো। এরপর যখন তারা নিশ্চিত বুঝতে পারলো যে, এ জায়গা ছেড়ে তাদেরকে চলে যেতেই হবে তখন তারা নিজেদের হাতে নিজেদের ঘরবাড়ী ধ্বংস করতে শুরু করলো যাতে তা মুসলমানদের কোন কাজে না আসে। অথচ এক সময় বড় শখ করে তারা এসব বাড়ীঘর নির্মাণ করে সাজিয়ে গুছিয়েছিল। এরপর তারা যখন এই শর্তে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে সন্ধি করলো যে, তাদের প্রাণে বধ করা হবে না এবং অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর যাই তারা নিয়ে যেতে সক্ষম হবে নিয়ে যেতে পারবে তখন যাওয়ার বেলায় তারা ঘরের দরজা, জানালা এবং খুঁটি পর্যন্ত উপড়িয়ে নিয়ে গেল। এমনকি অনেকে ঘরের কড়িকাঠ এবং কাঠের চাল পর্যন্ত উঠের পিঠে তুলে দিল।
৭. এই ঘটনার মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের কয়েকটি দিক আছে। সংক্ষিপ্ত ও জ্ঞানগর্ভ এই আয়াতাংশে সে দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই ইহুদীরা মূলত অতীত নবীদেরই উম্মাত ছিল। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করতো, কিতাববিশ্বাস করতো, পূর্ববর্তী নবীদের বিশ্বাস করতো এবং আখেরাত বিশ্বাস করতো। এসব বিচারে তারা ছিল মূলত সাবেক মুসলমান। কিন্তু তারা যখন দ্বীন ও আখলাককে উপেক্ষা করে শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির লালসা এবং পার্থিব উদ্দেশ্য ও স্বার্থ উদ্ধারের জন্য স্পষ্ট ও খোলাখুলীভাবে ন্যায় ও সত্যের প্রতি শত্রুতা পোষণের নীতি অবলম্বন করলো এবং নিজেদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির কোন তোয়াক্কাই করলো না তখন আল্লাহ তাআ’লার অনুগ্রহ-দৃষ্টিও আর তাদের প্রতি রইলো না। তা না হলে একথা সবারই জানা যে, তাদের সাথে আল্লাহ তাআ’লার কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। তাই এই পরিণাম দেখিয়ে সর্বপ্রথম মুসলমানদের উপদেশ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে যেন ইহুদীদের মত তারাও নিজেদেরকে খোদার প্রিয়পাত্র ও আদরের সন্তান মনে করে না বসে এবং এই খামখেয়ালীতে মগ্ন না হয় যে, আল্লাহর শেষ নবীর উম্মত হওয়াটাই তাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য লাভের গ্যারান্টি। এর বাইরে দ্বীন ও আখলাকের কোন দাবী পূরণ তাদের জন্য জরুরী নয়। সাথে সাথে গোটা দুনিয়ার সেই সব লোককেও এ ঘটনা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে যারা জেনে বুঝে সত্যের বিরোধিতা করে এবং নিজেদের সম্পদ ও শক্তি এবং উপায়-উপকরণের উপর এতটা নির্ভর করে যে, মনে করে তা তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। মদীনার ইহুদীদের একথা অজানা ছিল না যে, মুহাম্মাদ সা. কোন কওম বা গোত্রের মান মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন না। বরং তিনি একটি আদর্শিক দাওয়াত পেশ করছেন। এ দাওয়াতের লক্ষ গোটা দুনিয়ার সব মানুষ। এ দাওয়াত গ্রহণ করে যে কোন জাতি, গোষ্ঠি ও দেশের মানুষ কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই তাঁর উম্মাত হিসেবে গণ্য হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা. এর নিজ খান্দানের লোকজনের মুসলিম সমাজে যে মর্যাদা ছিল হাবশার বেলাল রা., রোমের সুহাইব রা. এবং পরস্যের সালমানের রা. ও সেই একই মর্যাদা ছিল, এটা তারা নিজ চোখে দেখছিল। তাই কুরাইশ, খাযরাজ ও আওস গোত্রের লোকেরা তাদের ওপর আধিপত্য কায়েম করবে এআশঙ্কা তাদের সামনে ছিল না। নবী সা. যে আদর্শিক দাওয়াত পেশ করছিলেন তা যে অবিকল সেই দাওয়াত যা তাদের নবী-রাসূলগণ পেশ করে এসেছেন, এ বিষয়টিও তাদের অজানা ছিল না। এ দাবীও তো তিনি করেননি যে, তিনি নতুন একটি দ্বীন নিয়ে এসেছেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ আনেনি। এখন তোমরা নিজেদের দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা ছেড়ে আমার এই দ্বীন বা আদর্শ গ্রহণ করো। বরং তাঁর দাবী ছিল, এটা যে সেই একই দ্বীন, সৃষ্টির শুরু থেকে আল্লাহর নবী-রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন। প্রকৃতই এটা যে সেই দ্বীন তার সত্যতা তারা তাওরাত থেকে প্রমাণ করতে পারতো। এর মৌল নীতিমালার সাথে নবী-রাসূলের দ্বীনের মৌল নীতিমালার কোন পার্থক্য নেই। এ কারণেই কুরআন মজীদে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছেঃ (آمِنُوا بِمَا أَنْزَلْتُ مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُمْ وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍ بِهِ –তোমরা ঈমান আনো আমার নাযিলকৃত সেই শিক্ষার ওপরে যা তোমাদের কাছে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান শিক্ষার সত্যায়নকারী। সবার আগে তোমরাই তার অস্বীকারকারী হয়ো না) মুহাম্মাদ সা. কেমন চরিত্র ও আখলাকের লোক। তাঁর দাওয়াত কবুল করে মানুষের জীবনে কেমন সর্বত্মক বিপ্লব সাধিত হয়েছে তা তারা চাক্ষুষ দেখছিল। আনসারগণ দীর্ঘদিন থেকে তাদের নিটক প্রতিবেশী। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাদের অবস্থা যা ছিল তাও তারা দেখেছে। আর এখন ইসলাম গ্রহণের পর তাদের যে অবস্থা হয়েছে তাও তাদের সামনে বর্তমান। এভাবে দাওয়াত, দাওয়াতদাতা ও দাওয়াত গ্রহণকারীদের পরিণাম ও ফলাফল সবই তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। এসব দেখে এবং জেনে বুঝেও তারা শুধু নিজেদের বংশগত গোঁড়ামি এবং পার্থিব স্বার্থের খাতিরে এমন একটি জিনিসের সন্দেহ করার কোন অবকাশ অন্তত তাদের জন্য ছিল না। এই সজ্ঞান শত্রুতার পরেও তারা আশা করতো, তাদের দুর্গ তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। অথচ গোটা মানব ইতিহাস, একথার সাক্ষী যে, আল্লাহর শক্তি যার বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয় কোন অস্ত্রই তাকে রক্ষা করতে পারে না।
﴿وَلَوْلَآ أَن كَتَبَ ٱللَّهُ عَلَيْهِمُ ٱلْجَلَآءَ لَعَذَّبَهُمْ فِى ٱلدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابُ ٱلنَّارِ﴾
৩। আল্লাহ যদি তাদের জন্য দেশান্তর হওয়া নির্দিষ্ট না করতেন তাহলে তিনি দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি দিতেন।৮ আর আখেরাতে তো তাদের জন্য দোজখের শাস্তি রয়েছেই।
৮. দুনিয়ার আযাবের অর্থ তাদের নামনিশানা মুছে দেয়া। সন্ধি করে নিজেদের জীবন রক্ষা না করে যদি তারা লড়াই করতো তাহলে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। তাদের পুরুষরা নিহত হতো এবং নারী ও শিশুদের দাস-দাসী বানানো হতো। মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের উদ্ধার করারও কেউ থাকতো না।
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ شَآقُّوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ ۖ وَمَن يُشَآقِّ ٱللَّهَ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ﴾
৪। এ হওয়ার কারণ হলো, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চরম বিরোধিত করেছে। যে ব্যক্তিই আল্লাহর বিরোধিতা করে, তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর।
﴿مَا قَطَعْتُم مِّن لِّينَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا قَآئِمَةً عَلَىٰٓ أُصُولِهَا فَبِإِذْنِ ٱللَّهِ وَلِيُخْزِىَ ٱلْفَـٰسِقِينَ﴾
৫। খেজুরের যেসব গাছ তোমরা কেটেছো কিংবা যেসব গাছকে তার মূলের ওপর আগের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো তা সবই ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে।৯ (আল্লাহ এ অনুমতি দিয়েছিলেন এ জন্য) যাতে তিনি ফাসেকদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন।১০
৯. এখানে একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুসলমানরা অবরোধ শুরু করার পর তা সহজসাধ্য করার জন্য বনী নাযীরের বসতির চারদিকে যে খেজুর বাগান ছিল তার অনেক গাছ কেটে ফেলে কিংবা জ্বালিয়ে দেয়। আর যেসব গাছ সামরিক বাহিনীর চলাচলে প্রতিবন্ধক ছিল না সেগুলোকে যথাস্থানে অক্ষত রাখে। এতে মদীনার মুনাফিকরা ও বনী কুরায়যা এমনকি বনী নাযীর গোত্রের লোকও হৈ চৈ করতে শুরু করলো যে, মুহাম্মাদ সা. “ফাসাদ ফিল আরদ” বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেন; কিন্তু দেখো, তরুতাজাশ্যামল ফলবান গাছ কাটা হচ্ছে। এটি কি “ফাসাদ ফিল আরদ” নয়? এই সময় আল্লাহ তাআ’লা এই নির্দেশ নাযিল করলেনঃ “তোমরা যেসব গাছ কেটেছো এবং যা না কেটে অক্ষত রেখেছো এর কোন একটি কাজও নাজায়েয নয়। বরং এ উভয় কাজেই আল্লাহর সম্মতি রয়েছে।” এ থেকে শরীয়াতের এ বিধানটি পাওয়া যায় যে, সামরিক প্রয়োজনে যেসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর তৎপরতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা “ফাসাদ ফিল আরদ” বা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টির সংজ্ঞায় পড়ে না। “ফাসাদ ফিল আরদ” হলো কোন সেনাবাহিনীর মাথায় যদি যুদ্ধের ভূত চেপে বসে এবং তারা শত্রুর দেশে প্রবেশ করে শস্যক্ষেত, গবাদি পশু, বাগান, দালানকোঠা, প্রতিটি জিনিসই নির্বিচারে ধ্বংস ও বরবাদ করতে থাকে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে সেটিই সাধারণ বিধান। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেনঃ ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, ফসল ধ্বংস করবে না এবং জনবসতি বিরাণ করবে না। কুরআন মজীদে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মানুষদের নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে এ কাজের জন্য তাদের তিরষ্কার ও ভীতি প্রদর্শন করে বলা হয়েছেঃ “যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করে চলে।” (আল বাকারাহঃ ২০৫) হযরত আবু বকরের রা.এর এ নীতি ছিল কুরআনের এ শিক্ষারই হুবহু অনুসরণ। তবে সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে বিশেষ নির্দেশ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোন ধ্বংসাত্মক কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়লে তা করা যেতে পারে। তাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা. এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, قطعو منها ما كان موضعا للقتال “মুসলমানগণ বনী নাযীরের গাছপালার মধ্যে কেবল সেই সব গাছপালাই কেটেছিলেন যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবস্থিত ছিল।” (তাফসীরে নায়শাপুরী) ফকীহদের কেউ কেউ ব্যাপারটির এ দিকটার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে মত পেশ করেছেন যে, বনী নাযীরের বৃক্ষ কাটার বৈধতা শুধু এ ঘটনার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। এ থেকে এরূপ সাধারণ বৈধতা পাওয়া যায় না যে, সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলেই শত্রুর গাছপালা কেটে ফেলা এবং জ্বালিয়ে দেয়া যাবে। ইমাম আওযায়ী, লাইস ও আবু সাওর এ মতটিই গ্রহণ করেছেন। তবে অধিকাংশ ফকীহর মত হলো, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে এরূপ করা জায়েজ। তবে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য এরূপ করা জায়েজ নয়।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কুরআন মজীদের এ আয়াত মুসলমানদের হয়তো সন্তুষ্ট করে থাকতে পারে কিন্তু কুরআনকে আল্লাহর বাণী বলে স্বীকার করতো না নিজেদের প্রশ্নের এ জবাব শুনে তরা কি সান্ত্বনা লাভ করবে যে, এ দু’টি কাজই আল্লাহর অনুমতির ভিত্তিতে বৈধ? এর জবাব হলো শুধু মুসলমানদের সন্তুষ্ট করার জন্যই কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়েছে। কাফেরদের সন্তুষ্ট করা এর আদৌ কোন উদ্দেশ্য নয়। যেহেতু ইহুদী ও মুনাফিকদের প্রশ্ন সৃষ্টির কারণে কিংবা মুসলমানদের মনে স্বতস্ফূর্তভাবে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল আমরা “ফাসাদ ফীল আরদে” লিপ্ত হয়ে পড়ি নাই তো? তাই আল্লাহ তাআ’লা তাদেরকে সন্ত্বনা দিলেন যে, অবরোধের প্রয়োজনে কিছু সংখ্যক গাছপালা কেটে ফেলা এবং অবরোধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না এমন সব গাছপালা না কাটা এ দু’টি কাজই আল্লাহর বিধান অনুসারে বৈধ ছিল।
এসব গাছ কেটে ফেলা বা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ রাসূলুল্লাহ সা. নিজেই দিয়েছিলেন না মুসলমানরা নিজেরাই এ কাজ করে পরে এর শরয়ী বিধান নবী সা. এর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন সে বিষয়ে মুহাদ্দিসদের বর্ণিত হাদীসসমূহে মতানৈক্য দেখা যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের বর্ণনা হলো, নবী সা. নিজেই এর নির্দেশ দিয়েছিলেন (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে জারীর)। ইয়াযীদ ইবনে রূমানের বর্ণনাও তাই। (ইবনে জারীর) অন্যদিকে মুজাহিদ ও কাতাদার বর্ণনা হলো, এসব গাছপালা মুসলমানরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই কেটেছিলেন। তারপর এ বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় যে, কাজটি করা উচিত হয়েছে কিনা? কেউ কেউ তা বৈধ বলে মত প্রকাশ করলেন। আবার কেউ কেউ এরূপ করতে নিষেধ করলেন। অবশেষে আল্লাহ তাআ’লা এ আয়াত নাযিল করে উভয় দলের কাজই সঠিক বলে ঘোষণা করলেন। (ইবনে জারীর) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এ রেওয়ায়াত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেনঃ এ বিষয়ে মুসলমানদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয় যে, আমাদের মধ্য থেকে অনেকে গাছপালা কেটেছে আবার অনেকে কাটেনি। অতএব এখন রাসূলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করা উচিত, আমাদের কার কাজ পুরস্কার লাভের যোগ্য আর কার কাজ পাকড়াও হওয়ার যোগ্য? (নাসায়ী) ফকীহদের মধ্যে যারা প্রথম রেওয়ায়াতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তারা এ রেওয়ায়াত থেকে প্রমাণ করেন যে, এটি ছিল রাসূলুল্লাহ সা. এর ইজতিহাদ। পরবর্তী সময়ে আল্লাহ তাআ’লা স্পষ্ট অহী দ্বারা তা সমর্থন ও সত্যায়ন করেছেন। এটা এ বিষয়ের একটা প্রমাণ যে, যেসব ব্যাপারে আল্লাহর কোন নির্দেশ বর্তমান থাকতো না সে সব ব্যাপারে নবী সা. ইজতিহাদ করে কাজ করতেন। অপরপক্ষে যেসব ফকীহ দ্বিতীয় রেওয়ায়াতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তারা এ থেকে প্রমাণ পেশ করেন যে, মুসলমানদের দু’টি দল ইজতিহাদের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন দু’টি মত গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ তাআ’লা দু’টি মতই সমর্থন করেছেন। অতএব জ্ঞানী ও পণ্ডিতগণ যদি সৎনিয়তে ইজতিহাদ করে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন তবে তাদের মতসমূহ পরস্পর ভিন্ন হবে। কিন্তু আল্লাহর শরীয়াতে তারা সবাই হকের অনুসারী বলে গণ্য হবেন।
১০. অর্থাৎ আল্লাহ তাআ’লার ইচ্ছা ছিল এসব গাছ কাটার দ্বারাও তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হোক এবং না কাটা দ্বারাও অপমানিত ও লাঞ্ছিত হোক। কাটার মধ্যে তাদের অপমান ও লাঞ্ছনার দিকটা ছিল এই যে, যে বাগান তারা নিজ হাতে তৈরী করেছিল এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তারা যে বাগানের মালিক ছিল সেই সব বাগানের গাছপালা তাদের চোখের সামনেই কেটে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু তারা কোনভাবে কর্তনকারীদের বাধা দিতে পারছে না। একজন সাধারণ কৃষক বা মালিও তার ফসল বা বাগানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বরদাশত করতে পারে না। কেউ যদি তার সামনে তার ফসল বা বাগান ধ্বংস করতে থাকে তাহলে সে তার বিরুদ্ধে প্রাণপাত করবে। সে যদি নিজের সম্পদে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে না পারে তবে তা হবে তার চরম অপমান ও দুর্বলতার প্রমাণ। কিন্তু এখানে পুরা একটি গোত্র যারা শত শত বছর ধরে এ স্থানে বসবাস করে আসছিলো অসহায় হয়ে দেখছিলো যে, তাদের প্রতিবেশী তাদের বাগানের ওপর চড়াও হয়ে এর গাছপালা ধ্বংস করছে। কিন্তু তারা তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি। এ ঘটনার পর তারা মদীনায় থেকে গেলেও তাদের কোন মান-মর্যাদা অবশিষ্ট থাকতো না। এখন থাকলো গাছপালা না কাটার মধ্যে অপমান ও লাঞ্ছনার বিষয়টি। সেটি হলো, যখন তারা মদীনা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো তখন নিজ চোখে দেখছিল যে, শ্যামল-সবুজ যেসব বাগান কাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় ছিল আজ তা মুসলমানদের দখলে চলে যাচ্ছে। ক্ষমতায় কুলালে তারা ওগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে যেতো এবং অবিকৃত একটি গাছও মুসলমানদের দখলে যেতে দিতো না। কিন্তু তারা নিরূপায়ভাবে সবকিছু যেমন ছিল তেমন রেখে হতাশা ও দুঃখ ভরা মনে বেরিয়ে গেল।
﴿وَمَآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنْهُمْ فَمَآ أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍۢ وَلَا رِكَابٍۢ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ يُسَلِّطُ رُسُلَهُۥ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرٌۭ﴾
৬। আল্লাহ তাআ’লা যেসব সম্পদ তাদের দখলমুক্ত করে তাঁর রাসূলের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন১১ তা এমন সম্পদ নয়, যার জন্য তোমাদের ঘোড়া বা উট পরিচালনা করতে হয়েছে। বরং আল্লাহ সবকিছুই করতে সক্ষম।১২
১১. যেসব বিষয় সম্পত্তি বনী নাযীরের মালিকানায় ছিল এবং তাদের বহিষ্কারের পর তা ইসলামী সরকারের হস্তগত হয়েছিলো এখানে সেই সব বিষয় সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে। এসব সম্পদের ব্যবস্থাপনা কিভাবে করা যাবে এখান থেকে শুরু করে ১০নং আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ তাআ’লা সেই সব কথাই বলেছেন। কোন এলাকা বিজিত হয়ে ইসলামী সরকারের দখলভুক্ত হওয়ার ঘটনা যেহেতু এটাই প্রথম এবং পরে আরো এলাকা বিজিত হতে যাচ্ছিলো তাই এ জন্য বিজয়ের শুরুতেই বিজিত ভূমি সম্পর্কে বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভেবে দেখার মত বিষয় হলো, আল্লাহ তাআ’লা (وَمَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْهُمْ –যে সম্পদ তাদের দখলমুক্ত করে আল্লাহ তাআ’লা তাঁর রাসূলের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন) বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। এ বাক্য থেকে স্বতঃই এ অর্থ প্রকাশ পায় যে, এই পৃথিবী এবং যেসব জিনিস এখানে পাওয়া যায় তাতে সেই সব লোকদের মূলত কোন অধিকার নেই যারা মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। তারা যদি এর ওপরে দখলকারী ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেও থাকে তাহলেও তার অবস্থা হলো বিশ্বাসঘাতক ভৃত্য কর্তৃক মনিবের বিষয়-সম্পদ কুক্ষিগত করার মত। প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পদের হক হলো তা তার আসল মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মর্জি অনুসারে তাঁর আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করা। আর এভাবে ব্যবহার কেবল নেককার ঈমানদার বান্দারাই করতে পারে। তাই বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের পরিণতিতে যেসব সম্পদ কাফেরদের দখলমুক্ত হয়ে ঈমানদারদের করায়ত্ত হবে তার মর্যাদা হলো তার মালিক এ সম্পদ নিজের বিশ্বাসঘাতক ভৃত্যদের দখল থেকে উদ্ধার করে তাঁর আনুগত ভৃত্যদের দখলে দিয়েছেন। তাই ইসলামী আইনের পরিভাষায় এসব বিষয় সম্পদকে ‘ফাই’ (প্রত্যাবর্তিত বা ফিরিয়ে আনা সম্পদ) বলা হয়েছে।
১২. অর্থাৎ এসব সম্পদের অবস্থা ও প্রকৃতি এমন নয় যে, সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মুখোমুখি হয়ে লড়াই করে তা অর্জন করেছে। তাই এতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এ সম্পদ তাদের মধ্যেই বণ্টন করে দিতে হবে। বরং তার প্রকৃত অবস্থা হলো, আল্লাহ তাআ’লা অনুগ্রহ করে তাঁর রাসূলের এবং যে আদর্শের প্রতিনিধিত্ব এ রাসূল করছেন সেই আদর্শকে তাদের ওপর বিজয় দান করেছেন। অন্য কথায়, এসব সম্পদ মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হওয়া সরাসরি সেনাবাহীনির শক্তি প্রয়োগের ফল নয়। বরং এটা সেই সামগ্রিক শক্তির ফল যা আল্লাহ তাঁর রাসূল, রাসূলের উম্মাত এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত আদর্শকে দান করেছেন। তাই এসব সম্পদ গনীমতের সম্পদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মর্যাদা সম্পন্ন। এতে যুদ্ধরত সৈনিকদের এমন কোন অধিকার বর্তায় না যে, তা তাদের মধ্যে গনীমতের মত বণ্টন করে দিতে হবে। এভাবে শরীয়াতে ‘গনীমত’ ও ‘ফাই’-এর আলাদা আলাদা বিধান দেয়া হয়েছে। সূরা আল আনফালের ৪১ নং আয়াতে গনীমতের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। বিধানটি হলো, গনীমতের সম্পদ পাঁচটি অংশে ভাগ করা হবে। এর চারটি অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে এবং একটি অংশ বায়তুলমালে জমা দিয়ে উক্ত আয়াতে বর্ণিত খাতসমূহে খরচ করতে হবে। ফাইয়ের বিধান হলো, তা সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করা যাবে না। বরং এর সবটাই পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত খাতসমূহের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে। এই দুই ধরনের সম্পদের মধ্যে পার্থক্য প্রকাশ করা হয়েছেঃ (فَمَا أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍ وَلَا رِكَابٍ –তোমরা তার বিরুদ্ধে নিজেদের ঘোড়া বা উট পরিচালনা কর নাই) কথাটি দ্বারা ঘোড়া বা উট পরিচালনা করার অর্থ সামরিক তৎপরতা চালানো (Warlike Operations)। সুতরাং সরাসরি এ ধরনের তৎপরতার ফলে যেসব সম্পদ হস্তগত হয়ে থাকে তা গনীমতের সম্পদ। আর যেসব সম্পদ লাভের পেছনে এ ধরনের তৎপরতা নেই তা সবই ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য।
‘গনীমত’ ও ‘ফাই’ এর মোটামুটি যে অর্থ এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে ইসলামের ফকীহগণ তা আরো স্পস্ট করে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ গণীমাত হলো সেই সব অস্থাবর সম্পদ যা সামরিক তৎপরতা চালানোর সময় শত্রু সেনাদের নিকট থেকে লাভ করা গিয়েছে। এসব ছাড়া শত্রু এলাকার ভূমি, ঘরবাড়ী এবং অন্যান্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ গনীমতের সংজ্ঞায় পড়ে না। এ ব্যাখ্যার উৎস হলো হযরত উমরের রা. সেই পত্র যা তিনি ইরাক বিজয়ের পর হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসকে লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছেনঃ
فَانْظُرْ مَا اَجْلَبُوْا بِهِ عَلَيْكَ فِى الْعَسْكَرِ مِنْ كَرَاعِ اَوْمَالِ فَاقْسِمْهُ بَيْنَ مَنْ حَضَرَ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ وَاتْرَكِ الْارْضِيْنَ وَالْانْهَارْ لِعُمَّالِهَا لِيَكُونَ ذَالِكَ فِى اَعْطِيَاتِ الْمُسْلِمِيْنَ
“সেনাবাহিনীর লোকজন যেসব ধন-সম্পদ তোমাদের কাছে কুড়িয়ে আনবে তা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দাও। আর ভূমি ও সেচ খালে যেসব লোক কাজ করে ভূমি ও সেচ খাল তাদের জন্য রেখে দাও যাতে তার আয় মুসলমানদের বেতন ভাতা ও বৃত্তি দেয়ার কাজে লাগে।” (কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসূফঃ পৃষ্ঠা ২৪; কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়েদঃ পৃষ্ঠা ৫৯; কিতাবুল খারাজ, ইয়াহইয়া ইবনে আদমঃ পৃষ্ঠা ২৭, ২৮৪৮)
এ কারণে হাসান বসরী বলেনঃ শত্রুর শিবির থেকে যা হস্তগত হবে তা সেই সব সৈন্যদের হক যারা তা দখল করেছে। কিন্তু ভূমি সব মুসলমানদের জন্য। (ইয়াহইয়া ইবনে আদমঃ ২৭) ইমাম আবু ইউসূফ বলেনঃ “শত্রুসেনাদের কাছ থেকে যেসব জিনিস মুসলমানদের হস্তগত হবে এবং যেসব দ্রব্য, অস্ত্রশস্ত্র ও জীবজন্তু তারা কুড়িয়ে ক্যাম্পে আনবে তাহলো গনীমত। এর মধ্য থেকে এক-পঞ্চমাংশ আলাদা করে রেখে অবশিষ্ট চার অংশ সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।” (কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ১৮) ইয়াহইয়া ইবনে আদমও এ মত পোষণ করেন এবং তা তিনি তাঁর গ্রন্থ কিতাবুল খারাজে বর্ণনা করেছেন। (পৃষ্ঠাঃ ২৭) যে জিনিসটি ‘গনীমতে’ ও ‘ফাই’ এ পার্থক্য আরো স্পষ্ট করে তুলে ধরে তা হলো, নাহাওয়ান্দের যুদ্ধ শেষে গনীমতের সম্পদ বণ্টন এবং বিজিত এলাকা যথারীতি ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সায়েব ইবনে আকরা, নামক এক ব্যক্তি দুর্গের অভ্যন্তরে দু’টি থলী ভর্তি মণি মুক্তা কুড়িয়ে পান। এতে তার মনে খটকা সৃষ্টি হয় যে, তা ‘গনীমত’ না ‘ফাই’? গনিমাত হলে তা সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর ‘ফাই’ হলে তা বায়তুলমালে জমা হওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত তিনি মদীনায় হাজির হলেন এবং বিষয়টি হযরত উমরের রা. সামনে পেশ করলেন। হযরত উমর রা. ফয়সালা করলেন যে, তা বিক্রি করে অর্থ বায়তুলমালে জমা দিতে হবে। এ থেকে জানা গেল যে, শুধু এমন সব অস্থাবর সম্পদ গনীমত হিসেবে গণ্য হবে যা যুদ্ধের সময় সৈন্যদের হস্তগত হবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ স্থাবর সম্পদের মতই ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য হয়। এ ঘটনাটি উল্লেখ করে ইমাম আবু উবায়েদ লিখছেনঃ
مَا نِيْلَ مِنْ اَهْلِ الشِّرِكْ عُنْوَةً قَسْرًا وَالْحَرْبُ قَائِمَةٌ فَهُوَ الْغَنِيْمَةُ- وَمَانِيْلَ مِنْهُمْ بَعْدَ مَا تَضَعُ الْحَرْبُ اَوْ زَارَهَا وَتَصِيْرُ الدَّارُ دَارَ الْاِسْلَامِ- فَهُوَ فِىءٌ يَكُوْنَ لِلنَّاسِ عَامَّا وَلَا خُمُسَ فِيْهِ
“যুদ্ধ চলাকালে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যেসব সম্পদ শত্রুর কাছ থেকে হস্তগত হবে তা গনীমত। আর যুদ্ধ শেষে দেশ দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হওয়ার পর যেসব সম্পদ হস্তগত হবে তা ‘ফাই’ হিসেবে পরিগণিত হবে। এ সম্পদ দারুল ইসলামের অধিবাসীদের কল্যাণ কাজে লাগা উচিত। তাতে এক-পঞ্চমাংশ নির্দিষ্ট হবে না।” (কিতাবুল আমওয়ালঃ পৃষ্ঠা ২৫৪)
গনীমতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত ও নির্দিষ্ট করার পর কাফেরদের কাছ থেকে মুসলমানদের হস্তগত হওয়া যেসব সম্পদ, বিষয়-সম্পত্তি ও জায়গা-জমি অবশিষ্ট থাকে তা প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একঃ লড়াই করে হস্তগত করা সম্পদ ইসলামী ফিকাহের পরিভাষায় যাকে শক্তি বলে দখলকৃত দেশ বা অঞ্চল বলা হয়। দুইঃ সন্ধির ফলে যা মুসলমানদের হস্তগত হবে। এ সন্ধি মুসলমানদের সামরিক শক্তির প্রভাব, দাপট কিংবা ভীতির কারণে হলেও। বাহুবলে হস্তগত না হয়ে অন্য কোনভাবে হস্তগত হওয়া সম্পদও এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম ফকীহদের মধ্যে যা কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা প্রথম প্রকারের সম্পদ সম্পর্কে হয়েছে। অর্থাৎ তার সঠিক শরয়ী মর্যাদা কি? কেননা, তা ( فما او خفتم عليه من خيل ولاركاب )-এর সংজ্ঞায় পড়ে না। এরপর থাকে দ্বিতীয় প্রকার সম্পদ। এ প্রকারের সম্পদ সম্পর্কে সর্বসম্মত মত হলো, তা ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য। কারণ এর বিধান কুরআন মজিদে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। পরে আমরা প্রথম প্রকারের সম্পদের শরয়ী মর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
﴿مَّآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنْ أَهْلِ ٱلْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِى ٱلْقُرْبَىٰ وَٱلْيَتَـٰمَىٰ وَٱلْمَسَـٰكِينِ وَٱبْنِ ٱلسَّبِيلِ كَىْ لَا يَكُونَ دُولَةًۢ بَيْنَ ٱلْأَغْنِيَآءِ مِنكُمْ ۚ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمْ عَنْهُ فَٱنتَهُوا۟ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ﴾
৭। এসব জনপদের দখলমুক্ত করে যে জিনিসই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে ফিরিয়ে দেন তা আল্লাহ, রাসূল, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন এবং মুসাফিরদের জন্য।১৩ যাতে তা তোমাদের সম্পদশালীদের মধ্যেই কেবল আবর্তিত হতে না থাকে।১৪ রাসূল যা কিছু তোমাদের দেন তা গ্রহণ করো এবং যে জিনিস থেকে তিনি তোমাদের বিরত রাখেন তা থেকে বিরত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।১৫
১৩. এসব সম্পদ আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর মধ্যে গনীমতের মত বণ্টন না করার কারণ কি এবং তার শরয়ী বিধান গনিমাতের সম্পর্কিত বিধান থেকে ভিন্ন কেন পূর্ববর্তী আয়াতে শুধু এতটুকু কথাই বলা হয়েছে। এখন এসব সম্পদের হকদার কারা এ আয়াতটিতে তা বলা হয়েছে।
এসব সম্পদের মধ্যে সর্বপ্রথম অংশ হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের। রাসূলুল্লাহ সা. এ নির্দেশ অনুসারে যেভাবে আমল করেছেন হযরত উমর রা. থেকে মালেক ইবনে আওস ইবনুল হাদাসান তা উদ্ধৃত করেছেন। হযরত উমর রা. বলেনঃ এ অংশ থেকে নবী সা. তাঁর নিজের ও পরিবার-পরিজনের খরচ নিয়ে নিতেন আর অবশিষ্ট অর্থ জিহাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং সাওয়ারী জন্তু সংগ্রহ করতে ব্যয় করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ইত্যাদি) নবীর সা. ইন্তিকালের পর এ অংশটি মুসলমানদের বায়তুলমালে জমা দেয়া হতো যাতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই কাজেই তা ব্যয়িত হয়। ইমাম শাফেয়ীর রাহি. মত হলো, যে অংশটি বিশেষভাবে রাসূলুল্লাহ সা. এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল তা তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর খলিফাদের জন্য নির্দিষ্ট হবে। কারণ ইমামত বা নেতৃত্বের পদমর্যাদার জন্য তিনি এর হকদার ছিলেন, রিসালাতের পদমর্যাদার জন্য নয়। তবে শাফেয়ী ফিকাহবিদগণের অধিকাংশ এ ব্যাপারে অন্যান্য অধিকাংশ ফিকাহবিদগণের অনুরূপ মতামত পোষণ করেন। অর্থাৎ এ অংশটি এখন আর কোন ব্যক্তিবিশেষের জন্য নির্দিষ্ট নয়, বরং তা মুসলমানদের দ্বীনি ও সামাজিক কল্যাণে ব্যয়িত হবে।
দ্বিতীয় অংশটি হলো আত্মীয়-স্বজনের জন্য। এর অর্থ রাসূলের আত্মীয়-স্বজনের জন্য। অর্থাৎ বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব। এ অংশটি নির্ধারিত করা হয়েছিল। এ জন্য যে, রাসূলুল্লাহ সা. যেন নিজের এবং নিজের পরিবার-পরিজনের হক আদায় করার সাথে সাথে নিজের সেই সব আত্মীয়-স্বজনের হকও আদায় করতে পারেন যারা তাঁর সাহায্যের মুখাপেক্ষী অথবা তিনি নিজে যাদের সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। নবী সা. এর ইন্তিকালের পর এ অংশেরও ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র মর্যাদা অবশিষ্ট নেই। বরং মুসলমানদের অন্য সব মিসকীন, ইয়াতীম এবং মুসাফিরদের মত বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবের অভাবী লোকদের অধিকারসমূহ ও বায়তুলমালের জিম্মাদারীতে চলে গিয়েছে। তবে যাকাতে তাদের অংশ না থাকার কারণে অন্যদের তুলনায় তাদের অধিকার অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু বকর, উমর ও উসমান রা.মের যুগে প্রথম দু’টি অংশ বাতিল করে শুধু অবশিষ্ট তিনটি অংশের (ইয়াতীম, মিসকীন ও ইবনুস সাবীল) হকদারদের জন্য ‘ফাই’ নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু তাঁর যুগে এ নীতি অনুসারে আমল করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইমাম মুহাম্মাদ বাকেরের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, যদিও হযরত আলীর রা. আহলে বায়তের রায়ই। [এ অংশ নবীর সা. আত্মীয়-স্বজনের পাওয়া উচিত] তাঁর ব্যক্তিগত রায় ছিল। তথাপি তিনি হযরত আবু বকর ও উমরের রা. সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করা পছন্দ করেননি। হাসান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া বলেনঃ নবীর সা. পরে ঐ দু’টি অংশ (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা. এর অংশ ও যাবিল কুরবার অংশ) সম্পর্কে মাতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু সংখ্যক লোকের মত ছিল, প্রথম অংশটি হুজুরের সা. খলীফার প্রাপ্য। কিছু সংখ্যক লোকের মত ছিল, দ্বিতীয় অংশ হুজুরের সা. আত্মীয়-স্বজনের পাওয়া উচিত। অপর কিছু সংখ্যক লোকের ধারণা ছিল, দ্বিতীয় অংশটি খলীফার আত্মীয়-স্বজনের দেয়া উচিত। অবশেষে এ মতে ‘ইজমা’ বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে, এ দু’টি অংশই জিহাদের প্রয়োজনে খরচ করা হবে। আতা ইবনে সায়েব বলেনঃ হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহি. তাঁর শাসনকালে হুজুর সা. এর অংশ এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজনের অংশ বনী হাশেমদের কাছে পাঠাতে শুরু করেছিলেন। ইমাম আবু হানীফা এবং অধিকাংশ হানাফী ফকীহদের সিদ্ধান্ত হলো, এক্ষেত্রে খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে অনুসৃত কর্মনীতিই সঠিক ও নির্ভুল (কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসূফঃ পৃষ্ঠা ১৯ থেকে ২১) ইমাম শাফেয়ীর রাহি. মত হলো, যারা হাশেম ও মুত্তালিব বংশের লোক বলে প্রমাণিত কিংবা সাধারণভাবে সবার কাছে পরিচিত তাদের সচ্ছল ও অভাবী উভয় শ্রেণীর লোককেই ‘ফাই’ এর সম্পদ থেকে দেয়া যেতে পারে। (মুগনিউল মুহতাজ) হানাফীদের মতে, এ অর্থ থেকে কেবল তাদের অভাবীদের সাহায্য করা যেতে পারে। অবশ্য অন্যদের তুলনায় তাদের অধিকার অগ্রগণ্য। (রূহুল মাআ’নী) ইমাম মালেকের মতে এ ব্যাপারে সরকারের ওপর কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা নেই। যে খাতে ইচ্ছা সরকার তা ব্যয় করতে পারেন। তবে রাসূলুল্লাহ সা. এর বংশধরদের অগ্রাধিকার দেয়া উত্তম। (হাশিয়াতুদ দুসুকী আলাশ্শারহিল কাবীর)
অবশিষ্ট তিনটি অংশ সম্পর্কে ফকীহদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই। তবে ইমাম শাফেয়ী এবং অন্য তিনজন ইমামের মধ্যে মতানৈক্য আছে। ইমাম শাফেয়ীররাহি. মতে ‘ফাই’ এর সমস্ত অর্থ-সম্পদ সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে তার এক ভাগ উপরোক্ত খাতসমূহে এমনভাবে খরচ করা উচিত যেন তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ সাধারণভাবে মুসলমানদের কল্যাণে, পাঁচ ভাগের এক ভাগ বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবের জন্য, পাঁচ ভাগের এক ভাগ ইয়াতিমের জন্য, পাঁচ ভাগের এক ভাগ মিসকীনদের জন্য এবং পাঁচ ভাগের এক ভাগ মুসাফিরদের জন্য ব্যয়িত হয়। অপরদিকে ইমাম মালেক, ইমাম আবু হানীফা এবং ইমাম আহমাদ এভাবে বন্টনের পক্ষপাতী নন। তাদের মতে, ‘ফাই’ এর সমস্ত অর্থ-সম্পদই সাধারণভাবে মুসলমানদের কল্যাণে ব্যয়িত হবে। (মুগনিউল মুহতাজ)
১৪. এটি কুরআন মজীদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক আয়াতসমূহের একটি। এতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পলিসির একটি মৌলিক নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গোটা সমাজে ব্যবপকভাবে সম্পদ আবর্তীত হতে থাকা উচিত। এমন যেন না হয় অর্থ-সম্পদ কেবল ধনবান ও বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকবে। কিংবা ধনী দিনে দিনে আরো ধনশালী হতে থাকবে আর গরীব দিনে দিনে আরো বেশী গরীব হতে থাকবে। কুরআন মজীদে এ নীতি শুধু বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়নি। বরং এ উদ্দেশ্যে সুদ হারাম করা হয়েছে, যাকাত ফরয করা হয়েছে, গনীমতের সম্পদ থেকে এক-পঞ্চমাংশ বের করে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন আয়াতে নফল সাদকা ও দান-খয়রাতের শিক্ষা দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের কাফ্ফারা আদায়ের এমন সব পন্থা নির্দেশ করা হয়েছে যার মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ সমাজের দরিদ্র মানুষের দিকে ফিরিয়ে দেয়া যেতে পারে। উত্তরাধিকারের জন্য এমন আইন রচনা করা হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ যেন ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, কার্পণ্য ও বখিলীকে নৈতিক বিচারে কঠোরভাবে নিন্দানীয় এবং দানশীলতাকে সর্বোত্তম গুণ বলে প্রশংসা করা হয়েছে আর সচ্ছল শ্রেণীকে বুঝানো হয়েছে যে, তাদের সম্পদে প্রার্থী এবং বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে যাকে খয়রাত মনে করে নয় বরং তাদের অধিকার মনে করে আদায় করা উচিত। তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের একটি বড় খাত অর্থাৎ ‘ফাই’ সম্পর্কে এমন একটি আইন রচনা করা হয়েছে যে, এর একটি অংশ যেন অনিবার্যরূপে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে সহায়তা দানের জন্য ব্যয়িত হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ খাত দু’টি একটি যাকাত এবং অন্যটি ‘ফাই’। মুসলমানদের নিসাবের অতিরিক্ত পূঁজি, গবাদি পশু, ব্যবসায় পন্য এবং কৃষি উৎপন্ন দ্রব্য থেকে আদায় করা হয়, আর এর বেশীর ভাগই গরীবদের জন্য নির্দিষ্ট। আর ‘ফাই’ এর মধ্যে জিযিয়া ও ভূমি রাজত্ব সহ সেই সব আয়ও অন্তর্ভুক্ত যা অমুসলিমদের নিকট থেকে আসে। এরও বেশীর ভাগ গরীবদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটা এ বিষয়েরই স্পষ্ট ইঙ্গিত যে, একটি ইসলামী রাষ্ট্রকে তার আয় ও ব্যয়ের ব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের গোটা আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা এমনভাবে পরিচালনা করা উচিত যেন ধন-সম্পদের উপায়-উপকরণের ওপর বিত্তবান এবং প্রভাবশালী লোকদের ইজারাদারী প্রতিষ্ঠিত না হয়ে সম্পদের প্রবাহ গরীবদের দিক থেকে ধনীদের দিকে ঘুরে না যায় আর বিত্তশালীদের মধ্যেই যেন আবর্তিত হতে না থাকে।
১৫. বর্ণনার ধারাবাহিকতার দিক থেকে এ আয়াতের অর্থ হলো, বনী নাযীর গোত্র থেকে লব্ধ সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং অনুরূপভাবে পরবর্তীকালে লব্ধ ‘ফাই’ এর সম্পদের বিলি-বন্টনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা কোন প্রকার আপত্তি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই মেনে নাও। তিনি যাকে যা দেবেন সে তা গ্রহণ করবে এবং যা কাউকে দেবেন না সেজন্য যেন আপত্তি বা দাবী উত্থাপন না করে। কিন্তু নির্দেশটির ভাষা যেহেতু ব্যাপকতাবোধক, তাই এ নির্দেশ শুধু ‘ফাই’ সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সীমবদ্ধ নয়। বরং এর অভিপ্রায় হলো, মুসলমান সব ব্যাপারেই রাসূলুল্লাহ সা. এর আনুগত্য করবে। এ অভিপ্রায়কে আরো স্পষ্ট করে দেয় এ বিষয়টি যে,“রাসূল তোমাদের যা কিছু দেন” কথাটির বিপরীতে “যা কিছু না দেন” বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে “যে জিনিস থেকে তিনি তোমাদের বিরত রাখেন(নিষেধ করেন) তা থেকে বিরত থাকো।” এ নির্দেশের লক্ষ যদি শুধু ‘ফাই’ এর সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে আনুগত্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হতো তা হলে ‘যা দেন’ কথাটির বিপরীতে ‘যা না দেন’ বলা হতো। এক্ষেত্রে নিষেধ করা বা বিরত রাখা কথাটির ব্যবহার দ্বারা আপনা থেকেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ নির্দেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নবীর সা. আদেশ ও নিষেধের আনুগত্য করা। রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও একথাটি বলেছেন। হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন যে, নবী সা. বলেছেনঃ
إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِامرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَمَا نَهَيْتُكُمْ عَنْه فَاجْتَنِبُوهُ
“আমি কোন বিষয়ে তোমাদের নির্দেশ দিলে তা যথাসাধ্য পালন করো। আর যে বিষয়ে বিরত থাকতে বলি তা থেকে দূরে থাকো।” (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার তিনি বক্তৃতাকালে বললেনঃ “আল্লাহ তাআ’লা অমুক অমুক ফ্যাশনকারীনী মহিলাকে লা’নত করেছেন।” এই বক্তৃতা শুনে এক মহিলা তাঁর কাছে এসে বললঃ একথা আপনি কোথায় পেয়েছেন? আল্লাহর কিতাবে তো এ বিষয়ে আমি কোথাও দেখি নাই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ বললেনঃ তুমি আল্লাহর কিতাব পড়ে থাকলে একথা অবশ্যই পেতে। তুমি কি এ আয়াত (مَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا) পড়েছো? সে বললো হাঁ, এ আয়াত তো আমি পড়েছি। হযরত আবদুল্লাহ বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, এরূপ কাজে লিপ্ত নারীদের ওপর আল্লাহ তাআ’লা লা’নত করেছেন। মহিলাটি বললোঃ এখন বুঝতে পারলাম। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে ইবনে আবী হাতেম।)
﴿لِلْفُقَرَآءِ ٱلْمُهَـٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخْرِجُوا۟ مِن دِيَـٰرِهِمْ وَأَمْوَٰلِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًۭا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضْوَٰنًۭا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ﴾
৮। (তাছাড়াও এ সম্পদ) সেই সব গরীব মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘর-বাড়ী ও বিষয়-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে।১৬ এসব লোক চায় আল্লাহর মেহেরবানী এবং সন্তুষ্টি। আর প্রস্তুত থাকে আল্লাহ ও তার রাসূলকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। এরাই হলো সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ লোক।
১৬. এ কথা দ্বারা সেই সব লোকদের বুঝানো হয়েছে যারা ঐ সময় মক্কা মুয়াযযামা ও আরবের অন্যান্য এলাকা থেকে ইসলাম গ্রহণের কারণে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বনী নাযীর গোত্রের এলাকা বিজিত হওয়া পর্যন্ত এসব মুহাজিরের জীবন যাপনের কোন স্থায়ী ব্যবস্থা ছিল না। এখানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেসব অর্থ-সম্পদ এখন হস্তগত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যেসব সম্পদ ‘ফাই’ হিসেবে হস্তগত হবে তাতে সাধারণ মিসকীন, ইয়াতীম এবং মুসাফিরদের সাথে সাথে এসব লোকেরও অধিকার আছে। উক্ত সম্পদ থেকে এমন সব লোকদের সহযোগিতা দেয়া উচিত যারা আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের জন্য হিজরত করতে বাধ্য হয়েছে এবং দারুল ইসলামে চলে এসেছে। এই নির্দেশের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সা. বনী নাযীরের সম্পদের একটি অংশ মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন এবং আনসারগণ যেসব খেজুর বাগান তাদের মুহাজির ভাইদের সাহায্যের জন্য দিয়ে রেখেছিলেন তা তাদের ফিরিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু এরূপ মনে করা ঠিক নয় যে, ‘ফাই’ এর সম্পদে মুহাজিরদের এ অংশ কেবল সেই যুগের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। প্রকৃতপক্ষে এ আয়াতের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, কিয়ামাত পর্যন্ত যত লোকই মুসলমান হওয়ার কারণে নির্বাসিত হয়ে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে তাদের পুনর্বাসিত করা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়া উক্ত রাষ্ট্রের ইসলামী সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই তার উচিত যাকাত ছাড়া ‘ফাই’ এর সম্পদও এ খাতে খরচ করা।
﴿وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلْإِيمَـٰنَ مِن قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِى صُدُورِهِمْ حَاجَةًۭ مِّمَّآ أُوتُوا۟ وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌۭ ۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِۦ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ﴾
৯। (আবার তা সেই সব লোকের জন্যও) যারা এসব মুহাজিরদের আগমনের পূর্বেই ঈমান এনে দারুল হিজরাতে বসবাস করছিলো।১৭ তারা ভালবাসে সেই সব লোকদের যারা হিজরত করে তাদের কাছে এসেছে। যা কিছুই তাদের দেয়া হোক না কেন এরা নিজেদের মনে তার কোন প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করে না এবং যত অভাবগ্রস্তই হোক না কেন নিজেদের চেয়ে অন্যদের অগ্রাধিকার দান করে।১৮ মূলত যেসব লোককে তার মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম।১৯
১৭. এখানে আনসারদের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ফাই’ অর্থ-সম্পদে শুধু মুহাজিরদের অধিকার নেই। বরং আগে থেকেই যেসব মুসলমানদের দারুল ইসলামে বসবাস করে আসছে তারাও এতে অংশ লাভের অধিকারী।
১৮. এটা মদীনা তাইয়্যেবার আনসারদের পরিচয় ও প্রশংসা। মুহাজিরগণ মক্কা ও অন্যান্য স্থান থেকে হিজরত করে তাঁদের শহরে আসলে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে প্রস্তাব দিলেন, আমাদের বাগ-বাগীচা ও খেজুর বাগান দিয়ে দিচ্ছি। আপনি ওগুলো আমাদের এবং এসব মুহাজির ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিন। নবী সা. বললেনঃ এসব লোক তো বাগনের কাজ জানে না। তারা এমন এলাকা থেকে এসেছে যেখানে বাগান নেই। এমনকি হতে পারে না, এসব বাগ-বাগিচা ও খেজুর বাগানে তোমরাই কাজ করো এবং উৎপন্ন দ্রব্যের অংশ এদের দাও। তারা বললোঃ سمعنا واطعنا আমরা মেনে নিলাম। (বুখারী, ইবনে জারীর) এতে মুহাজিরগণ বলে উঠলেনঃ এ রকম আত্মত্যাগী মানুষ তারা আর কখনো দেখেনি। এরা নিজেরা কাজ করবে অথচ আমাদেরকে অংশ দেবে। আমাদের তো মনে হচ্ছে, সমস্ত সওয়াব তারাই লুটে নিয়েছে। নবী সা. বললেনঃ তা নয়, যতক্ষণ তোমরা তাদের প্রশংসা করতে থাকবে এবং তাদের কল্যাণের জন্য দোয়া করবে ততক্ষণ তোমরাও সওয়াব পেতে থাকবে। (মুসনাদে আহমাদ) অতঃপর বনী নাযীরেরএলাকা বিজিত হলে রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ এখন একটা বন্দোবস্ত হতে পারে এভাবে যে, তোমাদের বিষয়-সম্পদ এবং ইহুদীদের পরিত্যক্ত ফল-ফলাদি ও খেজুর বাগান মিলিয়ে একত্রিত করে সবটা তোমাদের মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া যাক। আরেকটা বন্দোবস্ত হতে পারে এভাবে যে, তোমরা তোমাদের বিষয়-সম্পদ নিজেরাই ভোগ দখল করো আর পরিত্যক্ত এসব ভূমি মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া যাক। আনসারগণ বললেনঃ এসব বিষয়-সম্পদ আপনি তাদের মধ্যে বিলি-বন্টন করে দিন। আর আপনি চাইলে আমাদের বিষয়-সম্পদেরও যতটা ইচ্ছা তাদের দিয়ে দিতে পারেন। এতে হযরত আবু বকর চিৎকার করে উঠলেনঃ جزاكم الله يامعشر الانصار خيرا “হে আনসারগণ, আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিন।” (ইয়াহইয়াহ ইবনে আদম, বালাযুরী) এভাবে আনসারদের সম্মতির ভিত্তিতেই ইহুদীদের পরিত্যক্ত অর্থ-সম্পদ মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হলো। আনসারদের মধ্যে থেকে শুধু হযরত আবু দুজানা, হযরত সাহল ইবনে সা’দ এবং কারো কারো বর্ণনা অনুসারে হযরত হারেস ইবনুস সিমাকে অংশ দেয়া হলো। কারণ, তারা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। (বালযুরী, ইবনে হিশাম, রূহুল মাআ’নী) বাহরাইন এলাকা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলে সে সময়ও আনসারগণ এ ত্যাগের প্রমাণ দেন। রাসূলুল্লাহ সা. ঐ অঞ্চলের বিজিত ভূমি শুধু আনসারদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। কিন্তু আনাসারগণ বললেনঃ যতক্ষণ আমাদের সমপরিমাণ অংশ আমাদের ভাই মুহাজিরদের দেয়া না হবে ততক্ষণ আমরা এ সম্পদের কোন অংশ গ্রহণ করবো না। (ইয়াহইয়াহ ইবনে আদম) আনসারদের এ সব ত্যাগের কারণে আল্লাহ তাআ’লা তাদের প্রশংসা করেছেন।
১৯. ‘রক্ষা পেয়েছে’ না বলে বলা হয়েছে ‘রক্ষা করা হয়েছে’। কেননা আল্লাহ তাআ’লার তাওফীক ও সাহায্য ছাড়া কেউ নিজ বাহু বলে মনের ঔদার্য ও ঐশ্বর্য লাভ করতে পারে না। এটা আল্লাহর এমন এক নিয়ামত যা আল্লাহর দয়া ও করুণায়ই কেবল কারো ভাগ্যে জুটে থাকে। شح শব্দটি আরবী ভাষায় অতি কৃপণতা ও বখিলী বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শব্দটিকে যখন نفس শব্দের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করে شح النفس বলা হয় তখন তা দৃষ্টি ও মনের সংকীর্ণতা, পরশ্রীকাতরতা এবং মনের নীচতার সমার্থক হয়ে যায় যা বখলী বা কৃপণতার চেয়েও ব্যাপক অর্থ বহন করে। বরং কৃপণতার মূল উৎস এটাই। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ অন্যের অধিকার স্বীকার করা এবং তা পূরণ করা তো দূরের কথা তার গুণাবলী স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ করে। সে চায় দুনিয়ার সবকিছু সে-ই লাভ করুক। অন্য কেউ যেন কিছুই না পায়। নিজে অন্যদের কিছু দেয়া তো দূরের কথা, অপর কোন ব্যক্তি যদি কাউকে কিছু দেয় তাহলেও সে মনে কষ্ট পায়। তার লালসা শুধু নিজের অধিকার নিয়ে কখনো সন্তুষ্ট নয়, বরং অন্যদের অধিকারেও সে হস্তক্ষেপ করে, কিংবা অন্ততপক্ষে সে চায় তার চারদিকে ভাল বস্তু যা আছে তা সে নিজের জন্য দু’হাতে লুটে নেবে অন্য কারো জন্য কিছুই রাখবে না। এ কারণে এ জঘন্য স্বভাব থেকে রক্ষা পাওয়াকে কুরআন মজীদে সাফল্যের গ্যারান্টি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সা. ও এটিকে মানুষের নিকৃষ্টতম স্বভাব বলে গণ্য করেছেন যা বিপর্যয়ের উৎস। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, নবী সা. বলেছেনঃ
اتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ (مسلم – مسند احمد – بيهقى – بخارى فى الادب)
হযরত আ’বদুল্লাহ ইবনে আমরের বর্ণনার ভাষা হলোঃ
أَمَرَهُمْ بِالظُّلْمِ فَظَلَمُوا وَأَمَرَهُمْ بِالْفُجُورِ فَفَجَرُوا- وَأَمَرَهُمْ بِالْقَطِيعَةِ فَقَطَعُوا (مسند احمد – ابو داؤد – نسائى)
অর্থাৎ شح থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কারণ এটিই তোমাদের পূর্বের লোকদের ধ্বংস করেছে। এটিই তাদেরকে পরস্পরের রক্তপাত ঘটাতে এবং অপরের মর্যাদাহানি নিজের জন্য বৈধ মনে করে নিতে মানুষকে প্ররোচিত করেছে। এটিই তাদের জুলুম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাই তারা জুলুম করেছে। পাপের নির্দেশ দিয়েছে তাই পাপ করেছে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে বলেছে তাই তারা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন যে, নবী সা. বলেছেনঃ ঈমান ও মনের সংকীর্ণতা একই সাথে কারো মনে অবস্থান করতে পারে না। (ইবনে আবি শায়বা, নাসায়ী, বায়হাকী ফী শুআবিল ঈমান, হাকেম) হযরত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণনা করেন, নবী সা. বলেছেনঃ দুইটি স্বভাব এমন যা কোন মুসলমানের মধ্যে থাকতে পারে না। অর্থাৎ কৃপণতা ও দুশ্চরিত্রতা। (আবু দাউদ, তিরমিযী, বুখারী ফিল আদাব) কিছু সংখ্যক ব্যক্তির কথা বাদ দিলে পৃথিবীতে জাতি হিসেবে মুসলমানরা আজও সবচেয়ে বেশী দানশীল ও উদারমনা। সংকীর্ণমনতা ও কৃপণতার দিক দিয়ে যেসব জাতি পৃথিবীতে নজিরবিহীন সেই সব জাতির কোটি কোটি মুসলমান তাদের স্বগোত্রীয় অমুসলিমদের পাশাপাশি বসবাস করছে। হৃদয়-মনের ঔদার্য ও সংকীর্ণতার দিক দিয়ে তাদের উভয়ের মধ্যে যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায় তা ইসলামের নৈতিক শিক্ষার অবদান। এছাড়া তার অন্য কোন ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। এ শিক্ষাই মুসলমানদের হৃদয়-মনকে বড় করে দিয়েছে।
﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلْإِيمَـٰنِ وَلَا تَجْعَلْ فِى قُلُوبِنَا غِلًّۭا لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٌۭ رَّحِيمٌ﴾
১০। (তা সেই সব লোকের জন্যও) যারা এসব অগ্রবর্তী লোকদের পরে এসেছে।২০ যারা বলেঃ হে আমাদের রব, আমাদেরকে এবং আমাদের সেই সব ভাইকে মাফ করে দাও যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে। আর আমাদের মনে ঈমানদারদের জন্য কোন হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের রব, তুমি অত্যন্ত মেহেরবান ও দয়ালু।২১
২০. এ পর্যন্ত যেসব বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে তাতে চূড়ান্তভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, ‘ফাই’ এর সম্পদে আল্লাহ, রাসূল, রাসূলের আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফীর, মুহাজির, আনসার এবং কিয়ামত পর্যন্ত জন্মলাভকারী সমস্ত মুসলমানের অধিকার আছে। এটি কুরআন মজীদের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত সিদ্ধান্ত যার আলোকে হযরত উমর রা. ইরাক, শাম ও মিসরের বিজিত এলাকাসমূহের ভূমি ও অর্থ-সম্পদ এবং ঐ সব দেশের পূর্বতন সরকার ও তার শাসকদের বিষয়-সম্পদের নতুনভাবে বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব অঞ্চল বিজিত হলে হযরত যুবায়ের, হযরত বেলাল হযরত আবদুর রাহমান ইবনে আওফ এবং হযরত সালমান ফারসী সহ বিশিষ্ট কিছু সংখ্যক সাহাবী অত্যন্ত জোর দিয়ে বললেন যে, যেসব সৈন্য লড়াই করে এসব এলাকা জয় করেছে এসব তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হোক। তাদের ধারণা ছিল এসব সম্পদفَمَا أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍ وَلَا رِكَابٍ এর সংজ্ঞায় পড়ে না। বরং মুসলমানরা তাদের ঘোড়া এবং উটপরিচালনা করে এসব করায়ত্ত করেছে। তাই যেসব শহর ও অঞ্চল যুদ্ধ ছাড়াই বশ্যতা স্বীকার করেছে সেইগুলো ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত বিজিত অঞ্চল গনীমতের সংজ্ঞায় পড়ে। আর তার শরয়ী বিধান হলো, ঐ সব অঞ্চলের ভূমি ও অধিবাসীদের এক-পঞ্চমাংশ বায়তুলমালের অধীনে ন্যাস্ত করতে হবে এবং অবশিষ্ট চার অংশ সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে। কিন্তু এই মতটি সঠিক ছিল না। কারণ রাসূলুল্লাহ সা. এর পবিত্র যুগে যুদ্ধ করে যেসব এলাকা দখল করা হয়েছিলো তিনি তার কোনটিরই ভূমি ও বাসিন্দাদের থেকে গনীমতের মাল এক-পঞ্চমাংশ বের করে রেখে অবশিষ্টাংশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন না। তাঁর যুগের দু’টি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, মক্কা ও খায়বার বিজয়। এর মধ্যে পবিত্র মক্কাকে তিনি অবিকল তার বাসিন্দাদের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। এরপর থাকলো খায়বারের বিষয়টি। এ সম্পর্কে হযরত বুশাইর ইয়াসার বর্ণনা করেন যে, নবী সা. খায়বারকে ৩৬ টি অংশে ভাগ করলেন। তার মধ্যে থেকে ১৮ অংশ সামষ্টিক ও সামগ্রীক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখে অবশিষ্ট ১৮ অংশ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। (আবু দাউদ, বায়হাকী, কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়েদ; কিতাবুল খারাজ-ইয়াহইয়া ইবনে আদম; ফুতূহুল বুলদান-ফাতহূল কাদীর-ইবনে হুমাম) হুযুর সা. এর এ কাজ দ্বারা একথা স্পষ্ট হয়েছিলো যে, যুদ্ধ করে জয় করা হলেও বিজিত ভূমির বিধান গনীমতের বিধানের মত নয়। তা না হলে পবিত্র মক্কাকে পুরোপুরি তার অধিবাসীদের কাছে ফেরত দেয়া এবং খায়বারের এক-পঞ্চমাংশ বের করে নেয়ার পরিবর্তে তার পুরা অর্ধেকটা অংশ সামগ্রিক প্রয়োজন পূরণের জন্য বায়তুলমালে নিয়ে নেয়া কি করে সম্ভব হলো? অতএব, সুন্নাত তথা রাসূলের কাজকর্ম দ্বারা যা প্রমাণিত তাহলো, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিজিত অঞ্চলসমূহের ব্যাপারে পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ও এখতিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের আছে। তিনি তা বন্টনও করতে পারেন, আর পবিত্র মক্কার মত কোন অস্বাভাবিক প্রকৃতির এলাকা যদি হয় তাহলে তিনি সেখানকার অধিবাসীদের প্রতি ইহসানও করতে পারেন, নবী সা. যেমনটি মক্কাবাসীদের প্রতি করেছিলেন।
কিন্তু নবীর সা. যুগে যেহেতু ব্যাপক এলাকা বিজিত হয়নি এবং বিভিন্ন প্রকারের বিজিত অঞ্চলের আলাদা আলাদা বিধান সুস্পষ্টভাবে লোকের সামনে আসেনি। তাই হযরত উমরের রা. যুগে বড় বড় দেশ ও অঞ্চল বিজিত হলে সাহাবায়ে কিরামের সামনে এ সমস্যা দেখা দিলো যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিজিত এসব অঞ্চল গনীমতের মাল হিসেবে গণ্য হবে না ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য হবে? মিসর বিজয়ের পর হযরত যুবায়ের দাবী করলেন যে,
اقْسِمْهَا كَمَا قَسَمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْبَرَ
“রাসূলুল্লাহ সা. যেভাবে খায়বর এলাকা বণ্টন করে দিয়েছিলেন অনুরূপ এই গোটা অঞ্চল ভাগ করে দিন।” (আবু উবায়েদ)
শাম ও ইরাকের বিজিত অঞ্চলসমূহ সম্পর্কে হযরত বেলাল রা. জোর দিয়ে বললেন যে,
اَقْسِمِ الْاَرْضِيْنَ بَيْنَ اَّلذِيْنَ افْتَتَحُوهَا كَمَا تُقَسِّمُ غَنِيْمَةُ الْعَسْكَرِ
“যেভাবে গনীমতের সম্পদ ভাগ করা হয় ঠিক সেভাবে সমস্ত বিজিত ভূমি বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে ভাগ করে দিন।” (কিতাবুল খারাজ-আবু ইউসূফ)
অপর দিকে হযরত আলীর রা. মত ছিল এই যে, دعهم يكونوا مادة للمسلمين “এসব ভূমি এর চাষাবাদকারীদের কাছে থাকতে দিন যেন তা মুসলমানদের আয়ের একটা উৎস হয়ে থাকে।” (আবু ইউসুফ, আবু উবায়েদ)
অনুরূপ হযরত মুয়া’য ইবনে জাবালের মত ছিল এই যে, আপনি যদি এসব বণ্টন করে দেন তাহলে তার পরিণাম খুবই খারাপ হবে। এ বন্টনের ফলে বড় বড় সম্পদ ও সম্পত্তি মুষ্টিমেয় কিছু লোকের করায়ত্ত হয়ে পড়বে যারা এসব অঞ্চল জয় করেছে। পরে এসব লোক দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যাবে আর তাদের বিষয়-সম্পদ তাদের উত্তরাধিকারীদের কাছেই থেকে যাবে। অনেক সময় হয়তো একজন মাত্র নারী বা পুরুষ হবে এই উত্তরাধিকারী। কিন্তু পরবর্তী বংশধরদের প্রয়োজন পূরণের জন্য এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য কিছুই থাকবে না। তাই আপনি এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করুন যার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বার্থের সংরক্ষণ সমানভাবে হতে পারে (আবু উবায়েদঃ পৃষ্ঠা-৫৯; ফাতহুল বারীঃ ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ১৩৮) গোটা ইরাক বণ্টন করে দিলে মাথাপিছু কি পরিমাণ অংশ হয় হযরত উমর রা. তা হিসেব করে দেখলেন।
তিনি জানতে পারলেন, গড়ে মাথাপিছু দুই তিন ফাল্লাহ করে পড়ে, (আবু ইউসুফ, আবু উবায়েদ) অতঃপর তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, ঐ সব এলাকা বন্টিত না হওয়া উচিত। সুতরাং বন্টনের দাবীদার বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে তিনি যেসব জওয়াব দিয়েছিলেন তাহলোঃ تُرِيدُونَ اَنْ يَاْتِى آَخِرُ النَاسِ لَيْسَ لَهُمْ شَئٌ
“আপনি কি চান, পরবর্তী, লোকদের জন্য কিছুই না থাক?” (আবু উবাইদাহ)
فَكَيْفَ بِمَنْ يَأْتِي مِنْ الْمُسْلِمِينَ فَيَجِدُونَ الْأَرْضَ بِعُلُوجِهَا قَدْ اُقْتُسِمَتْ وَوُرِثَتْ عَنْ الْآبَاءِ وَحِيزَتْ, مَا هَذَا بِرَأْيٍ
“পরবর্তীকালের মুসলমানদের কি উপায় হবে? তারা এসে দেখবে ভূমি কৃষকসহ আগে থেকেই বন্টিত হয়ে আছে এবং মানুষ বাপ-দাদার নিকট থেকে উত্তারাধিকার সূত্রে তা ভোগ দখল করছে? তা কখনো হতে পারে না।” (আবু ইউসুফ)
فَمَا لِمَنْ جَاءَ بَعْدَكُمْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ؟ وَأَخَافَ إِنْ قَسَّمْتُهُ أِنْ تُفَاسِدُوْا بَيْنَكُمْ فِى الْمِيْاهَ
“তোমাদের পরে আগমনকারী মুসলমানদের জন্য কি থাকবে? তাছাড়া আমারআশঙ্কা হয় যদি আমি এসব বণ্টন করে দেই তাহলে পানি নিয়ে তোমরা পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হবে।” (আবু উবাইদাহ)
لَوْلاَ آخِرُ الناس مَا فَتَحْتُ قَرْيَةً إِلاَّ قَسَمْتُهَا كَمَا قَسَمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْبَرَ
“পরবর্তী লোকদের চিন্তা যদি না হতো তাহলে যে জনপদই আমি জয় করতাম তা ঠিক সেভাবে বণ্টন করতাম যেভাবে রাসূলুল্লাহ সা. খায়বার বণ্টন করেছিলেন।” (বুখারী, মুয়াত্তা, আবু উবাইদাহ)
لَاهَذَا عَيْنُ الْمَالِ وَلَاكِنِّى اَحِبْسُهُ فِيْمَا يَجْرِىْ عَلَيْهِمْ وَعَلَى الْمُسْلِمِيْنَ
“না, এটাই তো মূল সম্পদ (Real estate) আমি তা ধরে রাখবো যাতে তা দিয়ে বিজয়ী সৈনিক ও সাধারণভাবে মুসলমানদের সবার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে।” (আবু উবাইদাহ)
কিন্তু এসব জওয়াব শুনেও লোকজন সন্তুষ্ট হলো না। তারা বলতে শুরু করলো যে, আপনি জুলুম করেছেন। অবশেষে হযরত উমর রা. মজলিসে শুরার অধিবেশন ডাকলেন এবং তাদের সামনে এ বিষয়টি পেশ করলেন। এই সময় তিনি যে ভাষণ দান করেন তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত হলোঃ
“আমি আপনাদেরকে শুধু এ জন্য কষ্ট দিয়েছি যে, আপনাদের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনার যে দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে সেই আমানত রক্ষা করার ব্যাবস্থাপনায় আমার সাথে আপনারাও শরীক হবেন। আমি আপনাদেরই একজন। আর আপনারা সেই সব ব্যক্তি যারা আজ সত্যকে মেনে চলছেন। আপনাদের মধ্য থেকে যার ইচ্ছা আমার সাথে ঐকমত্য পোষণ করবেন। আর যার ইচ্ছা আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন। আমি চাই না, আপনারা আমার ইচ্ছার অনুসরণ করেন। আপনাদের কাছে ন্যায় ও সত্য বিধানদাতা আল্লাহর কিতাব রয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি যদি কোন কিছু করার জন্য কোন কথা বলে থাকি তাহলে সে ক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য আমার নেই……….। আপনারা তাদের কথা শুনছেন যাদের ধারণা হলো আমি তাদের প্রতি জুলুম করছি এবং তাদের হক নষ্ট করতে চাচ্ছি। অথচ কারো প্রতি জুলুম করা থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকি। যা তাদের জুলুম করে আমি যদি তা তাদের না দিয়ে অন্য কাউকে দেই তাহলে সত্যি সত্যিই আমি বড় হতভাগা। আমি দেখতে পাচ্ছি কিসরার দেশ ছাড়া বিজিত হওয়ার মত আর কোন অঞ্চল এখন নেই। আল্লাহ তাআ’লা ইরানীদের ধন-সম্পদ, তাদের ভূমি এবং কৃষক সবই আমাদের করায়ত্ত করে দিয়েছেন। আমাদের সৈনিকরা যেসব গনীমত লাভ করেছিল তার এক-পঞ্চমাংশ আলাদা করে আমি তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছি। আর গনীমতের মাল যেসব সম্পদ এখনো বন্টিত হয়নি আমি সেগুলোও বণ্টন করার চিন্তা-ভাবনা করছি। তবে ভূমি সম্পর্কে আমার মত হলো, ভূমি ও এর চাষাবাদকারীদের বণ্টন করবো না। বরং ভূমির ওপর খারাজ বা ভূমি-রাজস্ব এবং কৃষকদের ওপর জিযিয়া আরোপ করবো। তারা সবসময় এগুলো দিতে থাকবে। এই অর্থ বর্তমানকালের সব মুসলমান, যুদ্ধরত সৈনিক, মুসলমানদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এবং পরবর্তী বংশধরদের জন্য ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য হবে। আপনারা কি দেখছেন না আমাদের সীমান্তসমূহ রক্ষার জন্য লোকের অপরিহার্য প্রয়োজন? আপনারা কি দেখছেন না, এসব বড় বড় দেশ-সিরিয়া, আলজিরিয়া, কুফা, বসরা, মিসর, এসব স্থানে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকা দরকার এবং নিয়মিতভাবে তাদের বেতনও দেয়া দরকার? চাষাবাদকারী সহ এসব ভূমি যদি আমি বণ্টন করে দেই তাহলে এসব খাতে ব্যয়ের অর্থ কোথা থেকে আসবে?
দুই তিন দিন পর্যন্ত এ বিষয়ে আলোচনা ও যুক্তি-তর্ক চলতে থাকলো। হযরত উসমান, হযরত আলী হযরত তালহা, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর এবং আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হযরত উমরের রা. মত সমর্থন করলেন। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছা গেল না। অবশেষে হযরত উমর রা. দাঁড়িয়ে বললেনঃ আমি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি দলীল পেয়ে গিয়েছি যা এ সমস্যার সমাধান দেবে। এরপর তিনি সূরা আল হাশরের এই কয়টি অর্থাৎ مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْهُمْ থেকে رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ পর্যন্ত পড়লেন এবং তা থেকে এ দলীল পেশ করলেন যে, আল্লাহর দেয়া এসব সম্পদে শুধু এ যুগের লোকদেরই অংশ ও অধিকার বর্তায় না। বরং তাদের সাথে আল্লাহ পরবর্তীকালের লোকদেরও শরীক করেছেন। তাই ‘ফাই’য়ের যে সম্পদ সবার জন্য; পরবর্তীকালের লোকদের জন্য তার কিছুই না রেখে সবই কেবল এসব বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে আমি বণ্টন করে দেব তা কি করে সঠিক হতে পারে? তাছাড়া আল্লাহ তাআ’লা বলেছেনঃ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ “যাতে এ সব সম্পদ শুধু তোমাদের বিত্তবানদের মধ্যে আবর্তিত হতে না থাকে।” কিন্তু আমি যদি কেবল বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যেই তা বণ্টন করে দেই তাহলে তা তোমাদের বিত্তবানদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকবে, অন্যদের জন্য কিছুই থাকবে না। এই যুক্তি ও প্রমাণ সবাইকে সন্তুষ্ট করলো, আর এ বিষয়ে ‘ইজমা’ বা ঐকমত্য হয়ে গেল যে, বিজিত গোটা এলাকা সকল মুসলমানের স্বার্থে ‘ফাই’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। যেসব লোক এখানে কাজ করছে তাদের হাতেই এসব ভূমি থাকতে দেয়া হবে এবং তার ওপর ভূমি রাজস্ব ও জিযিয়া আরোপ করতে হবে। (কিতাবুল খারাজ-আবু ইউসুফঃ পৃষ্ঠা ২৩ থেকে ২৭ ও ৩৫; আহকামূল কুরআন-জাসসাস)।
এ সিদ্ধান্ত অনুসারে বিজিত ভূমির প্রকৃত যে মর্যাদা স্থিরিকৃত হলো তা হচ্ছে, সমষ্টিগতভাবে গোটা মুসলিম মিল্লাত হবে এর মালিক আগে থেকেই যারা এসব ভূমিতে কাজ করে আসছে মুসলিম মিল্লাত তার নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে চাষাবাদকারী হিসেবে বহাল রেখেছে, এসব ভূমি বাবদ তারা ইসলামী রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট একটা হারে খাজনা বা ভূমি রাজস্ব দিতে থাকবে, চাষাবাদদের এই অধিকার বংশানুক্রমিকভাবে তাদের উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তরিত হতে থাকবে এবং এ অধিকার তারা বিক্রি করতেও পারবে। কিন্তু তারা ভূমির প্রকৃত মালিক হবে না, এর প্রকৃত মালিক হবে মুসলিম মিল্লাত। ইমাম আবু উবায়েদ তাঁর আল আমওয়াল গ্রন্থে আইনগত এই মর্যাদা ও অবস্থানের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ
اَقَرَّ اَهْلَ السَّوَادِ فِى اَرْضِيْهِمْ وَضَرَبَ عَلَى رُؤُسِهِمْ الْجِزْيَةَ وَعَلَى اَرْضِيِهمِ الطَسَقَ
“হযরত উমর রা. ইরাকবাসীদের তাদের কৃষি ভূমিতে বহাল রাখলেন, তাদের সবার ওপর মাথা পিছু জিযিয়া আরোপ করলেন এবং ভূমির ওপর ট্যাক্স ধার্য করলেন।” ( ছোয়াদঃ ৫৭)
وَاِذَا اَقَرَّ الْاَمَامُ اَهْلَ الْعَنْوَةِ فِى اَرْضِهِمْ تَوَارَثُوْهَا وَتَبَا يَعُوْهَا
“ইমাম (অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্টপ্রধান) বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীদের যদি তাদের কৃষি ভূমিতে বহাল রাখেন তাহলে তারা ঐ সব ভূমি উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তর করতে এবং বিক্রি করতে পারবে।” (ছোয়াদঃ ৮৪)
উমর ইবনে আবদুল আযীযের আমলে শা’বীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইরাকের অধিবাসীদের সাথে কোন চুক্তি আছে কি? তিনি জবাব দিয়েছিলেন যে, চুক্তি নেই। তবে তাদের নিকট থেকে যখন ভূমি রাজস্ব গ্রহণ করা হয়েছে তখন তা চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। (আবু উবায়েদঃ পৃষ্ঠা ৪৯; আবু ইউসুফঃ পৃষ্ঠা ২৮)
হযরত উমরের রা. খিলাফতকালে উৎবা ইবনে ফারকাদ ফোরাত নদীর তীরে একখণ্ড জমি কিনলেন। হযরত উমর রা. তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি এ জমি কার নিকট থেকে কিনেছো? তিনি বললেনঃ জমির মালিকের নিকট থেকে। হযরত উমর রা. বললেনঃ তার মালিক তো এসব লোক (অর্থাৎ মুহাজির ও আনসার) رَأىَ عُمَرَ اَنَّ اَصْلَ الْاَرْضِ لِلْمُسْلِمِيْنَ হযরত উমরের রা. অভিমত ছিল এই যে, ঐ সব ভূমির প্রকৃত মালিক মুসলমানগণ-(আবু উবায়েদঃ পৃষ্ঠা ৭৪)
এ সিদ্ধান্ত অনুসারে বিজিত দেশসমূহের যেসব সম্পদ মুসলমানদের সমষ্টিগত মালিকানা বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো তা নীচে উল্লেখ করা হলোঃ
(১) কোন সন্ধিচুক্তির ফলে যেসব ভূমি ও অঞ্চল ইসলামী রাষ্ট্রের হস্তগত হবে।
(২) যুদ্ধ ছাড়াই কোন এলাকার লোক মুসলমানদের নিকট থেকে নিরাপত্তা লাভের উদ্দেশ্যে যে মুক্তিপণ فديه, ভূমি, রাজস্ব خراج এবং জিযিয়া প্রদান করতে সম্মত হবে।
(৩) যেসব জমি ও সম্পদের মালিক তা ফেলে পালিয়ে গিয়েছে।
(৪) যেসব সম্পদের মালিক মারা গেছে বা যেসব সম্পদের মালিক নেই।
(৫) যেসব ভূমি পূর্বে কারো অধিকারে ছিল না।
(৬) যে সব ভূমি আগে থেকে মানুষের অধিকারে ছিল। কিন্তু তার সাবেক মালিকদেরকেই বহাল রেখে তাদের ওপর জিযিয়া ও ভূমির ওপর খারাজ বা ভূমিকর ধার্য করা হয়েছে।
(৭) পূর্ববর্তী শাসক পরিবারসমূহের জায়গীরসমূহ।
(৮) পূর্ববর্তী সরকারসমূহের মালিকানভুক্ত বিষয়-সম্পত্তি।-বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, বাদায়েউস সানায়েঃ ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৬-১১৮; কিতাবুল খারাজ-ইয়াহইয়া ইবনে আদমঃ পৃষ্ঠা ২২-৬৪, মুগনিউল মুহতাজঃ ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ৯৩; হাশিয়াতুদ দুসূকী আলাশ শারহিল কাবীরঃ ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৯০; গায়তুল মুনতাহাঃ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৬৭-৪৭১)
এসব জিনিস যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ‘ফাই’ বলে ঘোষিত হয়েছিলো, তাই একে ‘ফাই’ বলে সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারে ও ইসলামের ফিকাহবিদদের মধ্যে নীতিগত ঐক্য বিদ্যমান। তবে কয়েকটি বিষয়ে মতানৈক্য আছে। আমরা ঐগুলো সংক্ষিপ্তাকারে নীচে বর্ণনা করলাম।
হানাফীগণ বলেনঃ বিজিত দেশ ও অঞ্চলসমূহের ভূমির ব্যাপারে ইসলামী সরকারের (ফিকাহবিদদের পরিভাষায় ইমাম) সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইখতিয়ার আছে। তিনি ইচ্ছা করলে এর মধ্যে থেকে এক-পঞ্চমাংশ আলাদা করে রেখে অবশিষ্ট সবটা বিজয়ী সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। কিংবা পূর্ববর্তী মালিকদের অধিকারে রেখে দেবেন, আর তার মালিকদের ওপরে জিযিয়া এবং ভূমির ওপরে খারাজ বা ভূমিকর ধার্য করবেন। এ অবস্থায় এসব সম্পদ মুসলমানদের জন্য স্থায়ী ওয়াকফ সম্পদ বলে গণ্য হবে। (বাদায়েউস সানায়ে, আহকামূল কুরআন, জাস্সাস, শারহুল এনায়া আলাল হিদায়া, ফাতহুল কাদীর) ইমাম সুফিয়ান সাওরী থেকে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারাক এ মতটিই উদ্ধৃত করেছেন। (ইয়াহইয়াহ ইবনে আদম; কিতাবুল আমওয়াল-আবু উবায়েদ)
মালিকীগণ বলেনঃ মুসলমানদের শুধু দখল করে নেয়ার কারণেই এসব ভূমি আপনা-আপনি মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ হয়ে যায়। তা ওয়াকফ করার জন্য ইমামের সিদ্ধান্ত বা মুজাহিদদের রাজি করার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া মালেকীগণের সর্বজন পরিজ্ঞাত মত হলো, বিজিত এলাকার শুধু ভূমিই নয়, বরং ঘরবাড়ী দালানকোঠাও প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ। তবে ইসলামী রাষ্ট্র বা সরকার ঐগুলোর জন্য ভাড়া ধার্য করবে না। (হাশিয়াতুদ দুসূকী)।
হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীগণ এতটুকু বিষয়ে হানাফীদের সাথে একমত যে, ভূমি বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করা কিংবা মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দেয়া ইমামের ইখতিয়ারাধীন। তারা মালেকীদের সঙ্গে এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, বিজিত অঞ্চলসমূহের ঘরবাড়ী ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হলেও তার ওপর ভাড়া দার্য করা হবে না। (গায়াতুল মুনতাহা-হাম্বলী মাযহাবের যেসব মত ও সিদ্ধান্তের সমর্থনের ফতোয়া দেয়া হয়েছে এ গ্রন্থখানি তারই সমষ্টি। দশম শতাব্দী থেকে এ মযহাবের সমস্ত ফতোয়া এ গ্রন্থ অনুসারেই দেয়া হয়ে থাকে।)।
শায়েফী মযহাবের মত হলোঃ বিজিত অঞ্চলের সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি গনীমত এবং সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি (ভূমি ও ঘরবাড়ী) ‘ফাই’ হিসেবে গণ্য করা হবে। (মুগনিউল মুহতাজ)।
কোন কোন ফিকাহবিদ বলেনঃ ইমাম যদি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিজিত দেশের বা অঞ্চলের ভূমি মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করতে চান তাহলে তাঁকে অবশ্যই বিজয়ী সৈনিকদের সম্মতি নিতে হবে। এর সপক্ষে তারা এ দলীল পেশ করেন, ইরাক জয়ের পূর্বে হযরত উমর রা. জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আলবাহালীকে এ মর্মে ওয়াদা করেছিলেন যে, বিজিত অঞ্চলের এক-চতুর্থাংশ তাঁকে দেয়া হবে। কাদেসিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর এক-চতুর্থাংশ লোক ছিল জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আলবাহারীর গোত্রের লোক। সুতরাং ২-৩ বছর পর্যন্ত এ অংশ তাঁর কাছেই ছিল। পরে হযরত উমররা. তাঁকে বললেনঃ
لَوْلَا أَنِّي قَاسِمٌ مَسْئُولٌ, لَكُنْتُمْ عَلَى مَا جُعِلَ لَكُمْ وَأَرَى النَّاسَ قَدْ كَثَرُوا فَاَرَى اَنْ تَرِدُّهُ عَلَيْهِمْ
“বণ্টনের ব্যাপারে আমি যদি দায়িত্বশীল না হতাম এবং আমাকে জবাবদিহি করতে না হতো তাহলে তোমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তা তোমাদের কাছেই থাকতে দেয়া হতো। কিন্তু এখন আমি দেখছি লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আমার মত হলো তোমরা সাধারণ মানুষের স্বার্থে তা ফিরিয়ে দাও।”
হযরত জারীর রা. তাঁর এ কথা মেনে নিলেন। এ কারণে হযরত উমর রা. তাঁকে পুরস্কার হিসেবে ৮০ দিনার প্রদান করলেন। (কিতাবুল খারাজ-আবু ইউসুফ; কিতাবুল আমওয়াল-আবু উবায়েদ)। এ ঘটনা দ্বারা তারা প্রমাণ দেন যে, হযরত উমর বিজয়ী সৈন্যদের সম্মত করার পর বিজিত অঞ্চলসমূহ মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ফিকাহবিদদের অধিকাংশই এ যুক্তি মেনে নেননি। কারণ সকল বিজিত অঞ্চলের ক্ষেত্রে সমস্ত বিজয়ী সৈনিকদের নিকট থেকে এ ধরনের কোন সম্মতি নেয়া হয়নি। আর কেবল হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহর সাথে এ আচরণ করা হয়েছিল শুধু এ কারণে যে, বিজয়ের পূর্বে বিজিত ভূমি সম্পর্কে কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়ার পূর্বে হযরত উমর রা. তাঁর সাথে এ মর্মে একটি অঙ্গীকার করে ফেলেছিলেন। সেই অঙ্গীকার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্যই তাঁকে তার সম্মতি নিতে হয়েছিল। তাই এটাকে কোন ব্যাপকভিত্তিক আইন হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।
ফিকাহবিদদের আরেকটি গোষ্ঠী বলেনঃ ওয়াকফ ঘোষণা করার পরও বিজিত এ সব ভূমি বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে যে কোন সময় বণ্টন করে দেয়ার ইখতিয়ার সরকারের থেকে যায়। এর সপক্ষে তারা যে রেওয়ায়াত থেকে দলীল পেশ করেন তাহলো, একবার হযরত আলী রা. লোকদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বললেনঃ
لَوْلَا اَنْ يَّضْرِبَ بَعْضُكُمْ وُجُوهَ بَعْضٍ لَقَسَّمْتُ السَّوَادَ بَيْنَكُمْ
“যদি আমি এআশঙ্কা না করতাম যে, তোমরা পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হবে তাহলে এসব প্রত্যন্ত অঞ্চল আমি তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতাম।” (কিতাবুল খারাজ-আবু ইউসূফ; কিতাবুল আমওয়াল-আবু উবায়েদ)।
কিন্তু অধিকাংশ ফিকাহবিদ এমতটিও গ্রহণ করেননি। বরং তাদের সর্বসম্মত মত হলো, জিযিয়া ও খারাজ ধার্য করে বিজিত এলাকার ভূমি একবার যদি উক্ত এলাকার অধিবাসীদের অধিকারেই রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাহলে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা যায় না। এরপর থেকে হযরত আলীর রা. সাথে সম্পর্কিত কথাটি। এ সম্পর্কে আবু বকর জাসসাস আহকামূল কুরআন গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করে প্রমাণ করেছেন যে, ঐ রেওয়াত সঠিক নয়।
২১. ‘ফাই’-এর সম্পদ উপস্থিত ও বর্তমান কালের বিদ্যমান মুসলমানদেরই কেবল নয়, বরং অনাগত কালের মুসলমানদের এবং তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরও অংশ আছে। এ আয়াতের মূল বক্তব্য ও প্রতিপাদ্য এ বিষয়টি তুলে ধরা হলেও একই সাথে এর মধ্যে মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষাও দেয়া হয়েছে। তাহলো, কোন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃনা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা না থাকা উচিত। আর মুসলমানদের জন্য সঠিক জীবনাচার হলো, তারা তাদের পূর্ববর্তী মুসলমান ভাইদের লা’নত বা অভিশাপ দেবে না কিংবা তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার কথা বলবে না। বরং তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতে থাকবে। যে বন্ধন মুসলমানদের পরস্পর সম্পর্কিত করেছে তাহলো ঈমানের বন্ধন। কোন ব্যক্তির অন্তরে অন্য সব জিনিসের চেয়ে ঈমানের গুরুত্ব যদি অধিক হয় তাহলে যারা ঈমানের বন্ধনের ভিত্তিতে তার ভাই, সে অনিবার্যভাবেই তাদের কল্যাণকামী হবে। তাদের জন্য অকল্যাণ, হিংসা-বিদ্বেষ এবং ঘৃণা কেবল তখনই তার অন্তরে স্থান পেতে পারে যখন ঈমানের মূল্য ও মর্যাদা তার দৃষ্টিতে কমে যাবে এবং অন্য কোন জিনিসকে তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে শুরু করবে। তাই ঈমানের সরাসরি দাবী, একজন মু’মিনের অন্তরে অন্য কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। নাসায়ী কর্তৃক হযরত আনাস রা. বর্ণিত একটি হাদীস থেকে এক্ষেত্রে উত্তম শিক্ষা লাভ করা যায়। তিনি বর্ণনা করেছেন, এক সময় রাসূলুল্লাহ সা. এর মজলিসে একাধারে তিন দিন একটি ঘটনা ঘটতে থাকলো। রাসূলুল্লাহ সা. বলতেনঃ এখন তোমাদের সামনে এমন এক ব্যক্তির আগমন হবে যে জান্নাতের অধিবাসী। আর প্রত্যেকবারই আনসারদের কোন একজন হতেন সেই আগন্তুক। এতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আসের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিল যে, তিনি এমন কি কাজ করেন যার ভিত্তিতে নবী সা. তাঁর সম্পর্কে বারবার এই সুসংবাদ দান করলেন। সুতরাং তার ইবাদতের অবস্থা দেখার জন্য একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করে তিনি পরপর তিন দিন তাঁর বাড়ীতে গিয়ে রাত কাটাতে থাকলেন। কিন্তু রাতের বেলা তিনি কোন প্রকার অস্বাভাবিক কাজ-কর্ম দেখতে পেলেন না। বাধ্য হয়ে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ভাই, আপনি এমন কি কাজ করেন, যে কারণে আমরা নবীর সা. মুখে আপনার সম্পর্কে এই বিরাট সুসংবাদ শুনেছি। তিনি বললেনঃ আমার ইবাদাত-বন্দেগীর অবস্থা তো আপনি দেখেছেন। তবে একটি বিষয় হয়তো এর কারণ হতে পারে। আর তা হলো, ( لاَ أَجِدُ فِى نَفْسِى غِلاَّ لأَحَدٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَلاَ أَحْسُدُ عَلَى خَيْرٍ أَعْطَاهُ اللَّهُ تَعَالىَ إِيَّاهُ)
“আমি আমার মনের মধ্যে কোন মুসলমানদের জন্য বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং মহান আল্লাহ তাকে যে কল্যাণ দান করেছেন সেজন্য তাকে হিংসাও করি না।”
তবে এর মানে এ নয় যে, কোন মুসলমান অন্য কোন মুসলমানের কথা ও কাজে যদি কোন ত্রুটি দেখতে পান তাহলে তাকে তিনি ত্রুটি বলবেন না। কোন ঈমানদার ভুল করলেও সেটাকে ভুল না বলে শুদ্ধ বলতে হবে কিংবা তার ভ্রান্ত কথাকে ভ্রান্ত বলা যাবে না, ঈমানের দাবী কখনো তা নয়। কিন্তু কোন জিনিসকে প্রমাণের ভিত্তিতে ভুল বলা এবং ভদ্রতা রক্ষা করে তা প্রকাশ করা এক কথা আর শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা, নিন্দাবাদ ও কুৎসা রটনা করা এবং গালমন্দ করা আরেক কথা। সমসাময়িক জীবিত লোকদের বেলায়ও এরূপ আচরণ করা হলে তা একটি বড় অন্যায়। কিন্তু পূর্বের মৃত লোকদের সাথে এরূপ আচরণ করলে তা আরো বড় অন্যায়। কারণ, এরূপ মন ও মানসিকতা এমনই নোংরা যে, তা মৃতদেরও ক্ষমা করতে প্রস্তুত নয়। এর চেয়েও বড় অন্যায় হলো সেই সব মহান ব্যক্তি সম্পর্কে কটূক্তি করা যারা অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার সময়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর বন্ধুত্ব ও সাহচর্যের হক আদায় করেছিলেন এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে পৃথিবীতে ইসলামের আলোর বিস্তার ঘটিয়েছিলেন যার বদৌলতে আজ আমরা ঈমানের নিয়ামত লাভ করেছি। তাদের মাঝে যেসব মতানৈক্য হয়েছে সে ক্ষেত্রে কেউ যদি এক পক্ষকে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করে এবং অপর পক্ষের ভূমিকা তার মতে সঠিক না হয় তাহলে সে এরূপ মত পোষণ করতে পারে এবং যুক্তির সীমার মধ্যে থেকে তা প্রকাশ করতে বা বলতেও পারে। কিন্তু এক পক্ষের সমর্থনের এতটা বাড়াবাড়ি করা যে অপর পক্ষের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষে মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং কথা ও লেখনীর মাধ্যমে গালি দিতে ও নিন্দাবাদ ছড়াতে থাকার এটা এমন একটা আচরণ যা কোন আল্লাহভীরু মানুষের দ্বারা হতে পারে না। কুরআনের স্পষ্ট শিক্ষার পরিপন্থী এ আচরণ যারা করে তারা তাদের এ আচরণের সমর্থনে যুক্তি পেশ করে যে, কুরআন মু’মিনের প্রতি শত্রুতা ও ঘৃণা পোষণ করতে নিষেধ করে। কিন্তু আমরা যাদের প্রতি শত্রুতা ও ঘৃণা পোষণ করি তারা মু’মিন নয়, বরং মুনাফিক। কিন্তু যে গোনাহের সপক্ষে সাফাই ও ওযর হিসেবে এ অপবাদ পেশ করা হয়ে থাকে তা ঐ গোনাহের চেয়েও জঘন্য। কুরআন মজীদের এ আয়াত গুলোই তাদের এ অপবাদ খণ্ডন ও প্রত্যাখ্যানের জন্য যথেষ্ট। কারণ এ আয়াত গুলোর বর্ণনাধারার মধ্যেই আল্লাহ তাআ’লা পরবর্তীকালের মুসলমানদেরকে তাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের সাথে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ না রাখতে এবং তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন। এসব আয়াতে পর পর তিন শ্রেণীর লোককে ‘ফাই’-এর সম্পদ লাভের অধিকারী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম মুহাজির, দ্বিতীয় আনসার এবং তৃতীয় তাদের পরবর্তীকালের মুসলমান। তাদের পরবর্তী কালের মুসলমানদের বলা হয়েছে, তোমাদের পূর্বে যেসব লোক ঈমান আনার ব্যাপারে অগ্রগামী তোমরা তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো। একথা সবারই জানা যে, অগ্র-পশ্চাতে বিবেচনায় ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে অগ্রগামী বলতে এখানে মুহাজির ও আনসার ছাড়া আর কেউ-ই হতে পারে না। তাছাড়া মুনাফিক কারা সে সম্পর্কে এই সূরা আল হাশরের ১১ থেকে ১৭আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। এভাবে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুনাফিক তারাই যারা বনী নাযীর যুদ্ধের সময় ইহুদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে উৎসাহিত করেছিলো। আর মু’মিন তারা যারা এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে ছিল। যে মুসলমানের মনে এক বিন্দু আল্লাহভীতি আছে এরপরও কি সে ঐসব ব্যক্তির ঈমানকে অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাতে পারে, আল্লাহ নিজে যাদের ঈমানের সাক্ষ্য দিয়েছেন?
এ আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে ইমাম মালেক এবং ইমাম আহমাদ মত প্রকাশ করেছেন যে, যারা সম্মানিত সাহাবীদের গালমন্দ ও নিন্দাবাদ করে ‘ফাই’ সম্পদে তাদের কোন অংশ নেই। (আহকামূল কুরআন ইবনুল আরবী, গায়াতুল মুনতাহ) কিন্তু হানাফী ও শাফেয়ীগণ এ সিদ্ধান্তের সাথে একমত নন। এর কারণ হলো, আল্লাহ তাআ’লা তিন শ্রেণীর লোককে ফাই-এর সম্পদ লাভের অধিকারী ঘোষণা করেছেন এবং প্রত্যেক শ্রেণীর একটি বিশেষ গুণের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এসব গুণের কোনটিকেই পূর্বশর্ত হিসেবে পেশ করেননি যে, সেই শ্রেণীর মধ্যে ঐ বিশেষ শর্তটি বর্তমান থাকলেই কেবল তাদেরকে অংশ দেয়া যাবে, অন্যথায় দেয়া যাবে না। মুহাজিরদের সম্পর্কে বলেছেন যে, তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। তার অর্থ এ নয় যে, যে মুহাজিরদের মধ্যে এই গুণটি নেই সে ‘ফাই’ এর অংশ লাভের অধিকারী নয়। আনসারদের সম্পর্কে বলেছেনঃ “তারা মুহাজিরদের ভালবাসে। মুহাজিরদের যাই দেয়া হোক না কেন অভাবী হয়েও তারা সেজন্য মনের মধ্যে কোন চাহিদা অনুভব করে না।” এরও অর্থ এটা নয় যে, যেসব আনসার মুহাজিরদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে না এবং মুহাজিরদের যা কিছু দেয়া হয় তারা তা পেতে আগ্রহী ‘ফাই’ এর সম্পদে এমন মুহাজিরদের কোন অংশ নেই। অতএব তৃতীয় শ্রেণীর এই গুণটি অর্থাৎ তাদের পূর্বে ঈমান গ্রহণকারীদের মাগফিরাতের জন্য তারা দোয়া করে, আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যে, তাদের হৃদয়-মনে যেন কোন ঈমানদারদের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ না থাকে এটাও ‘ফাই’ এর হকদার হওয়ার কোন পূর্বশর্ত নয়। বরং এটা একটা ভাল গুণের বর্ণনা এবং অন্য সব ঈমানদার এ পূর্ববর্তী ঈমানদারদের সাথে তাদের আচরণ কিরূপ হওয়া উচিত সে বিষয়ে একটি শিক্ষাদান।
﴿أَلَمْ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ نَافَقُوا۟ يَقُولُونَ لِإِخْوَٰنِهِمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيعُ فِيكُمْ أَحَدًا أَبَدًۭا وَإِن قُوتِلْتُمْ لَنَنصُرَنَّكُمْ وَٱللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَـٰذِبُونَ﴾
১১। তোমরা২২ কি সেই সব লোকদের দেখনি যারা মুনাফিকীর আচরণ গ্রহণ করেছে? তারা তাদের কাফের আহলে কিতাব ভাইদের বলেঃ যদি তোমাদের বহিষ্কার করা হয়, তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাবো। তোমাদের ব্যাপারে কারো কথাই আমরা শুনবো না। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয় তাহলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো। কিন্তু আল্লাহ সাক্ষী, তারা পাকা মিথ্যাবাদী।
২২. পুরো এই রুকূর আয়াতসমূহের বাচনভঙ্গি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রাসূলুল্লাহ সা. যে সময় বনু নাযীরকে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য দশদিন সময় দিয়ে নোটিশ দিয়েছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু হতে এখনো কয়েকদিন দেরী ছিল সেই সময় এ রুকূর আয়াত গুলো নাযিল হয়েছিলো। আমরা পূর্বেই বর্ণনা করেছি, রাসূলুল্লাহ সা. বনু নাযীরকে এই নোটিশ দিলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং মদীনার অন্যান্য মুনাফিক নেতারা তাদের বলে পাঠালো যে, আমরা দুই হাজার লোক নিয়ে তোমাদের সাহায্য করার জন্য আসবো। আর বনী কুরায়যা এবং বনী গাতফানও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। অতএব তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও এবং কোন অবস্থায় তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো না। তারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো। আর তোমরা এখান থেকে বহিষ্কৃত হলে আমরাও চলে যাব। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআ’লা এ আয়াত গুলো নাযিল করেছেন। তাই নাযিল হওয়ার পরম্পরার দিক দিয়ে এ রুকূটা প্রথমে নাযিল হয়েছে। আর বনী নাযীরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করার পর প্রথম রুকূর আয়াত গুলো নাযিল হয়েছে। তবে কুরআন মজীদে সন্নিবেশ করার ক্ষেত্রে প্রথম রুকূর আগে এবং দ্বিতীয় রুকূ পরে রাখার কারণ হলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রথম রুকূতে বর্ণিত হয়েছে।
﴿لَئِنْ أُخْرِجُوا۟ لَا يَخْرُجُونَ مَعَهُمْ وَلَئِن قُوتِلُوا۟ لَا يَنصُرُونَهُمْ وَلَئِن نَّصَرُوهُمْ لَيُوَلُّنَّ ٱلْأَدْبَـٰرَ ثُمَّ لَا يُنصَرُونَ﴾
১২। যদি তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়, তাহলে এরা তাদের সাথে কখনো বেরিয়ে যাবে না। আর যদি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয় তাহলে তারা তাদেরকে সাহায্যও করবে না। আর যদি সাহায্য করেও তাহলে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। অতঃপর কোনখান থেকে কোন সাহায্য তারা পাবে না।
﴿لَأَنتُمْ أَشَدُّ رَهْبَةًۭ فِى صُدُورِهِم مِّنَ ٱللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌۭ لَّا يَفْقَهُونَ﴾
১৩। তাদের মনে আল্লাহর চেয়ে তোমাদের ভয়ই বেশী।২৩ কারণ, তারা এমন লোক যাদের কোন বিবেব-বুদ্ধি নেই।২৪
২৩. অর্থাৎ তারা যে তোমাদের মোকাবেলায় প্রকাশ্যে ময়দানে নামছে না তার কারণ এ নয় যে, তারা মুসলমান, তাদের মনে আল্লাহর ভয় আছে এবং এরূপ কোনআশঙ্কাও তাদের মনে আছে যে, ঈমানের দাবী করা সত্ত্বেও তারা যদি ঈমানদারদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাহায্য করে তাহলে আল্লাহ তাআ’লার কাছে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। বরং তোমাদের প্রকাশ্য মোকাবিলা করা থেকে যে জিনিস তাদের বিরত রাখে তা হলো, ইসলাম ও মুহাম্মাদ সা. এর জন্য তোমাদের ভালবাসা, প্রাণপণ সংকল্প এবং আত্মত্যাগের স্পৃহা আর তোমাদের পারস্পরিক দৃঢ় ঐক্য দেখে তারা সাহস হারিয়ে ফেলে। তারা ভাল করেই জানে যে, তোমরা নগণ্য সংখ্যক হলেও শাহাদাতের যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা তোমাদের প্রতিটি ব্যক্তিকে জান কবুল মুজাহিদ বানিয়ে রেখেছে এবং যে সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার কারণে তোমরা একটি ইস্পাত কঠিন দল ও সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছো তার সাথে সংঘর্ষ বাধলে ইহুদীদের সাথে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানে এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার যে, কারো অন্তরে আল্লাহর ভয়ের চেয়ে অন্য কারো ভয় অধিক থাকলে তা মূলত আল্লাহর ভয় না থাকারই নামান্তর। একথা সবারই জানা যে, যে ব্যক্তি দু’টি বিপদের একটিকে লঘু এবং অপরটিকে গুরুতর মনে করে সে প্রথমোক্ত বিপদটির পরোয়াই করে না। দ্বিতীয় বিপদটি থেকে রক্ষা পাওয়াই তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।
২৪. ছোট এই আয়াতাংশে একটি বড় সত্য তুলে ধরা হয়েছে। বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তি জানে, মানুষের শক্তি নয়, প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর শক্তিই ভয় করার মত। এ কারণে যেসব কাজে আল্লাহর সামনে তার জবাবদিহির ভয় থাকবে এ ধরনের সকল কাজ থেকে সে নিজেকে রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে জবাব চাওয়ার মত কোন মানবীয় শক্তি থাক বা না থাক তা দেখার প্রয়োজন সে মনে করবে না। আর আল্লাহ তাআ’লা যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য তার ওপর ন্যস্ত করেছেন তা সমাধা করার জন্য সে তৎপর হয়ে উঠবে। গোটা দুনিয়ার সমস্ত শক্তি এ পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও সে তার পরোয়া করবে না। কিন্তু একজন বুদ্ধি-বিবেকহীন মানুষের কাছে যেহেতু আল্লাহর শক্তি অনুভূত হয়না। কিন্তু মানুষের শক্তিসমূহ অনুভূত হয় তাই সমস্ত ব্যাপারে সে তার কর্মনীতি নির্ধারণ করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষের শক্তির প্রতি লক্ষ রেখে। কোন কিছু থেকে দূরে থাকলে এ জন্য থাকে না যে, সেজন্য আল্লাহর কাছে পাকড়াও হতে হবে। বরং এ জন্য দূরে থাকে যে, সামনেই কোন মানবীয় শক্তি তার খবর নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। আর কোন কাজ যদি সে করে তবে তাও এ জন্য করে না যে, আল্লাহ তাআ’লা তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন কিংবা সেজন্য সে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের প্রত্যাশী। বরং এ জন্য করে যে, কোন মানবীয় শক্তি তা করতে নির্দেশ দিচ্ছে কিংবা পছন্দ করছে এবং সে-ই এ জন্য পুরস্কৃত করবে। বুঝা ও না বুঝার এই পার্থক্যই প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার ও ঈমানদারের জীবন ও কর্মকে পরস্পর থেকে পৃথক করে দেয়।
﴿لَا يُقَـٰتِلُونَكُمْ جَمِيعًا إِلَّا فِى قُرًۭى مُّحَصَّنَةٍ أَوْ مِن وَرَآءِ جُدُرٍۭ ۚ بَأْسُهُم بَيْنَهُمْ شَدِيدٌۭ ۚ تَحْسَبُهُمْ جَمِيعًۭا وَقُلُوبُهُمْ شَتَّىٰ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌۭ لَّا يَعْقِلُونَ﴾
১৪। এরা একত্রিত হয়ে (খোলা ময়দানে) কখনো তোমাদের মোকাবিলা করবে না। লড়াই করলেও দুর্গাভ্যন্তরে অবস্থিত জনপদে বা প্রাচীরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে করবে। তাদের আভ্যন্তরীণ পারস্পরিক কোন্দল অত্যন্ত কঠিন। তুমি তাদের ঐক্যবদ্ধ মনে কর। কিন্তু তাদের মন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন।২৫ তাদের এ অবস্থার কারণ হলো তারা জ্ঞান ও বুদ্ধিহীন।
২৫. এখানে মুনাফিকদের দ্বিতীয় দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে। তাদের প্রথম দুর্বলতা হলো, তারা ছিল ভীরু-আল্লাহকে ভয় করার পরিবর্তে মানুষকে ভয় করতো। ঈমানদারদের মত তাদের সামনে এমন কোন উন্নত লক্ষ ও আদর্শ ছিল না যা অর্জনের জন্য তাদের মধ্যে প্রাণপণ সংগ্রামে ঝাপায়ে পড়ার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হতো। তাদের দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো মুনাফিকীর আচরণ ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোন বিষয়ে মিল ছিল না যা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মজবুত ও সুসংবদ্ধ দলে পরিণত করতে পারতো। যে বিষয়টি তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল তাহলো, নিজেদের শহরে বহিরাগত মুহাম্মাদ সা. এর নেতৃত্ব ও শাসন চলতে দেখে তাদের কলিজা দগ্ধ হচ্ছিলো আর স্বদেশবাসী আনসার কর্তৃক মুহাজিরদের সসম্মানে গ্রহণ করতে দেখে তাদের মন মুখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। এই হিংসার কারণে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এবং আশেপাশের ইসলাম বৈরীদের সাথে ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশ করে এই বহিরাগত প্রভাব-প্রতিপত্তিকে খতম করে দিতে চাইতো। তাদেরকে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এই নেতিবাচক উদ্দেশ্য ছাড়া কোন গঠনমূলক জিনিস ছিল না। তাদের প্রত্যেক নেতার আলাদা আলাদা দল ও উপদল ছিল। প্রত্যেকেই নিজের মাতবরী ফলাতে চাইতো। তারা কেউ কারো অকৃত্রিম বন্ধু ছিল না। প্রত্যেকের মনে অন্যদের জন্য এতটা হিংসা-বিদ্বেষ ছিল যে, নিজেদের সাধারণ শত্রুর মোকাবিলায়ও তারা নিজেদের পারস্পরিক শত্রুতা ভুলতে কিংবা একে অপরের মূলোৎপাটন থেকে বিরত থাকতে পারতো না।
আল্লাহ তাআ’লা এভাবে বনী নাযীর যুদ্ধের পূর্বেই মুনাফিকদের আভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যালোচনা করে মুসলমানদের জানিয়ে দিলেন যে, তাদের দিক থেকে বাস্তব কোন বিপদেরআশঙ্কা নেই। তাই বারবার এ খবর শুনে তোমাদের ঘাবড়ে যাওয়ার আদৌ কোন কারণ নেই যে, তোমরা বনী নাযীরকে অবরোধ করার জন্য যাত্রা করলেই এই মুনাফিক নেতা দুই হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে বসবে এবং একই সঙ্গে বনী কুরাইযা ও বনী গাতফান গোত্র দু’টিকেও তোমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণে উস্কে দেবে। এসবই লম্ফঝম্ফ মাত্র। চরম পরীক্ষা শুরু হতেই এর অন্তসারশূন্যতা প্রমাণিত হয়ে যাবে।
﴿كَمَثَلِ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ قَرِيبًۭا ۖ ذَاقُوا۟ وَبَالَ أَمْرِهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۭ﴾
১৫। এরা তাদের কিছুকাল পূর্বের সেই সব লোকের মত যারা তাদের কৃতকর্মের পরিণাম ভোগ করেছে।২৬ তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি।
২৬. এখানে কুরাইশ গোত্রের কাফের এবং বনী কায়নুকার ইহুদীদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা নিজেদের সংখ্যাধিক্য এবং সাজ-সরঞ্জামের প্রাচুর্য সত্ত্বেও এ সব দুর্বলতার কারণে মুসলমানদের সাজ-সরঞ্জামহীন মুষ্টিমেয় লোকের একটি দলের কাছে পরাজিত হয়েছিল।
﴿كَمَثَلِ ٱلشَّيْطَـٰنِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَـٰنِ ٱكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّى بَرِىٓءٌۭ مِّنكَ إِنِّىٓ أَخَافُ ٱللَّهَ رَبَّ ٱلْعَـٰلَمِينَ﴾
১৬। এদের উদাহরণ হলো শয়তান। সে প্রথমে মানুষকে বলে কুফরী কর। যখন মানুষ কুফরী করে বসে তখন সে বলে, আমি তোমার দায়িত্ব থেকে মুক্ত। আমি তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় পাই।২৭
২৭. অর্থাৎ এসব মুনাফিক বনী নাযীরের সাথে সেই একই আচরণ করছে, যে আচরণ শয়তান মানুষের সাথে করে থাকে। এখন এসব মুনাফিক তাদের বলছে, তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও প্রয়োজনে আমরাও তোমাদের সাথে থাকবো। কিন্তু তারা যখন সত্যি সত্যি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে তখন এরা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের সমস্ত প্রতিশ্রুতি থেকে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে এবং তাদের পরিণতি কি হলো তা দেখার জন্য ফিরেও তাকাবে না। শয়তান প্রত্যেক কাফেরের সাথে এ ধরনের আচরণই করে থাকে। বদর যুদ্ধে কুরাইশ গোত্রের কাফেরদের সাথেও সে এরূপ আচরণ করেছিল। সূরা আল আনফালের ৪৮ আয়াতে এর উল্লেখ আছে। প্রথমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সে তাদেরকে হিম্মত ও সাহস যুগিয়ে বদর প্রান্তরে এনে হাজির করেছে এবং বলেছেঃ (لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ ) (আজ কেউই তোমাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে না। আর আমি তো তোমাদের পৃষ্ঠপোষক ও সহযোগী হিসেবে আছিই)। কিন্তু যখন দুটো সেনাবাহীনি মুখোমুখি হয়েছে তখন সে একথা বলতে বলতে পালিয়েছেঃ
إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ
(আমি তোমাদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত। আমি যা দেখতে পাচ্ছি তোমরা তা দেখতে পাও না। আমি তো আল্লাহকে ভয় পাই।)
﴿فَكَانَ عَـٰقِبَتَهُمَآ أَنَّهُمَا فِى ٱلنَّارِ خَـٰلِدَيْنِ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ جَزَٰٓؤُا۟ ٱلظَّـٰلِمِينَ﴾
১৭। উভয়েরই পরিণাম হবে এই যে, তারা চিরদিনের জন্য জাহান্নামী হবে জালেমদের প্রতিফল এটাই।
﴿يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌۭ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۢ ۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ﴾
১৮। হে২৮ ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় করো। আর প্রত্যেকেই যেন লক্ষ রাখে, সে আগামীকালের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।২৯ আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই তোমাদের সেই সব কাজ সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করে থাক।
২৮. কুরআন মজীদের নিয়ম হলো, যখনই মুনাফিক মুসলমানদের মুনাফিকসুলভ আচরণের সমালোচনা করা হয় তখনই তাদেরকে নসীহতও করা হয়। যাতে তাদের যার যার মধ্যে এখনো কিছুটা বিবেক অবশিষ্ট আছে সে যেন তার এই আচরণে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহকে ভয় করে ধ্বংসের সেই গহবর থেকে উঠে আসার চিন্তা করে যার মধ্যে সে প্রকৃতির দাসত্বের কারণে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ রুকূ পুরোটাই এ ধরনের নসীহতে পরিপূর্ণ।
২৯. আগামীকাল অর্থ আখেরাত। দুনিয়ার এই গোটা জীবনকাল হলো, ‘আজ’ এবং কিয়ামতের দিন হলো আগামীকাল যার আগমণ ঘটবে আজকের এই দিনটির পরে। এ ধরনের বাচনভঙ্গির মাধ্যমে আল্লাহ তাআ’লা অত্যন্ত বিজ্ঞোচিতভাবে মানুষকে বুঝিয়েছেন যে, ক্ষণস্থায়ী আনন্দ উপভোগ করার জন্য যে ব্যক্তি তার সবকিছু ব্যয় করে ফেলে এবং কাল তার কাছে ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য আর মাথা গুঁজবার ঠাই থাকবে কিনা সে কথা চিন্তা করে না সেই ব্যক্তি এ পৃথিবীতে বড় নির্বোধ। ঠিক তেমনি ঐ ব্যক্তিও নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করছে যে তার পার্থিব জীবন নির্মাণের চিন্তায় এতই বিভোর যে আখেরাত সম্পর্কে একেবারেই গাফেল হয়ে গিয়েছে। অথচ আজকের দিনটির পরে কালকের দিনটি যেমন অবশ্যই আসবে তেমনি আখেরাতও আসবে। আর দুনিয়ার বর্তমান জীবনে যদি সে সেখানকার জন্য অগ্রিম কোন ব্যবস্থা না করে তাহলে সেখানে কিছুই পাবে না। এর সাথে দ্বিতীয় জ্ঞানগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এ আয়াতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের হিসেব পরীক্ষক বানানো হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তির মধ্যে ভাল এবং মন্দের পার্থক্যবোধ সৃষ্টি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আদৌ সে অনুভব করতে পারে না যে, সে যা কিছু করছে তা তার আখেরাতের জীবনকে সুন্দর ও সুসজ্জিত করছে, না ধ্বংস করছে। তার মধ্যে এই অনুভূতি যখন সজাগ ও সচেতন হয়ে ওঠে তখন তার নিজেকেই হিসেব-নিকেশ করে দেখতে হবে, সে তার সময়, সম্পদ, শ্রম, যোগ্যতা এবং প্রচেষ্টা যে পথে ব্যয় করছে তা তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করা তার নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন। অন্যথায় সে নিজের ভবিষ্যত নিজেই ধ্বংস করবে।
﴿وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ نَسُوا۟ ٱللَّهَ فَأَنسَىٰهُمْ أَنفُسَهُمْ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَـٰسِقُونَ﴾
১৯। তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন।৩০ তারাই ফাসেক।
৩০. অর্থাৎ আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার অনিবার্য ফল হলো নিজেকে ভুলে যাওয়া, সে কার বান্দা সে কথা যখন কেউ ভুলে যায়, তখন অনিবার্যরূপে সে দুনিয়ায় তার একটা ভুল অবস্থান ঠিক করে নেয়। এই মৌলিক ভ্রান্তির কারণে তার গোটা জীবনই ভ্রান্তিতে পর্যবসিত হয়। অনুরূপভাবে সে যখন একথা ভুলে যায় যে সে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো বান্দা নয় তখন আর সে শুধু সেই এদের বন্দেগী করে না। এমতাবস্থায় সে প্রকৃতই যার বান্দা তাকে বাদ দিয়ে যাদের সে বান্দা নয় এমন অনেকের বন্দেগী করতে থাকে। এটা আর একটি মারাত্মক ও সর্বাত্মক ভুল যা তার গোটা জীবনকেই ভুলে পরিণত করে। পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান হলো সে বান্দা বা দাস, স্বাধীন বা মুক্ত নয়। সে কেবল এক আল্লাহর বান্দা, তার ছাড়া আর কারো বান্দা সে নয়। একথাটি যে ব্যক্তি জানে না প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই নিজেকে জানে না। আর যে ব্যক্তি একথাটি জেনেও এক মুহূর্তের জন্যও তা ভুলে যায় সেই মুহূর্তে সে এমন কোন কাজ করে বসতে পারে যা কোন আল্লাহদ্রোহী বা মুশরিক অর্থাৎ আত্মবিস্মৃত মানুষই করতে পারে। সঠিক পথের ওপর মানুষের টিকে থাকা পুরোপুরি নির্ভর করে আল্লাহকে স্মরণ করার ওপর। আল্লাহ তাআ’লা সম্পর্কে গাফেল হওয়া মাত্রই সে নিজের সম্পর্কেও গাফেল হয়ে যায় আর এই গাফলতিই তাকে ফাসেক বানিয়ে দেয়।
﴿لَا يَسْتَوِىٓ أَصْحَـٰبُ ٱلنَّارِ وَأَصْحَـٰبُ ٱلْجَنَّةِ ۚ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَنَّةِ هُمُ ٱلْفَآئِزُونَ﴾
২০। যারা দোজখে যাবে এবং যারা জান্নাতে যাবে তারা পরস্পর সমান হতে পারে না। যারা জান্নাতে যাবে তারাই সফলকাম।
﴿لَوْ أَنزَلْنَا هَـٰذَا ٱلْقُرْءَانَ عَلَىٰ جَبَلٍۢ لَّرَأَيْتَهُۥ خَـٰشِعًۭا مُّتَصَدِّعًۭا مِّنْ خَشْيَةِ ٱللَّهِ ۚ وَتِلْكَ ٱلْأَمْثَـٰلُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ﴾
২১। আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে পেতে তা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।৩১ আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা (নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে) ভেবে দেখে।
৩১. এই উপমার তাৎপর্য হলো, কুরআন যেভাবে আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য এবং তাঁর কাছে বান্দার দায়িত্ব ও জবাবদিহির বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে পাহাড়ের মত বিশাল সৃষ্টিও যদি তার উপলব্ধি লাভ করতে পরতো এবং কেমন পরাক্রমশালী ও সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী প্রভুর সামনে নিজের সব কাজকর্মের জবাবদিহি করতে হবে তা যদি জানতো তাহলে সেও ভয়ে কেঁপে উঠতো। কিন্তু সে মানুষ কুরআনকে বুঝতে পারে এবং কুরআনের সাহায্যে সবকিছুর তাৎপর্য ও বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছে, কিন্তু এরপরও তার মনে কোন ভয়-ভীতি সৃষ্টি হয় না কিংবা যে কঠিন দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছে সে সম্পর্কে তার আল্লাহকে কি জবাব দেবে সে বিষয়ে আদৌ কোন চিন্তা তার মনে জাগে না। বরং কোরআন পড়ার বা শোনার পরও সে এমন নির্লিপ্তি ও নিষ্ক্রীয় থাকে যেন একটি নিষ্প্রাণ ও অনুভূতিহীন পাথর। শোনা, দেখা ও উলপব্দি করা আদৌ তার কাজ নয়। মানুষের এই চেতানাহীনতা ও নিরুদ্বিগ্নতা বিষ্মরকর বৈকি। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আহযাবঃ টীকা ১২০)
﴿هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِى لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَـٰلِمُ ٱلْغَيْبِ وَٱلشَّهَـٰدَةِ ۖ هُوَ ٱلرَّحْمَـٰنُ ٱلرَّحِيمُ﴾
২২। আল্লাহই সেই৩২ মহান সত্তা যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই।৩৩ অদৃশ্য ও প্রকাশ্য সবকিছুই তিনি জানেন।৩৪ তিনিই রাহমান ও রাহীম।৩৫
৩২. এ আয়াত গুলোতে বলা হয়েছে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার কাছে এই কুরআন পাঠানো হয়েছে যিনি তোমার ওপর এসব দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এবং যাঁর কাছে অবশেষে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে সেই আল্লাহ কেমন এবং তাঁর গুণাবলী কি? উপরোল্লেখিত বিষয়টি বর্ণনার পর পরই আল্লাহর গুণাবলীর বর্ণনা আপনা থেকেই মানুষের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি করে যে, তার লেনদেন ও বুঝা পড়া কোন সাধারণ সত্তার সাথে নয়, বরং এমন এক জবরদস্ত সত্তার সাথে যিনি এসব গুণাবলীর অধিকারী। এখানে এ বিষয়টি জেনে নেয়া দরকার যে, যদিও কোরআন মজীদে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর গুণাবলী এমন অনুপম ভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে যা থেকে আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণালাভ করা যায়। কিন্তু দু’টি স্থান বিশেষভাবে এমন যেখানে আল্লাহ তাআ’লার গুণাবলীর ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক বর্ণনা পাওয়া যায়। এর একটি হলো, সূরা আল বাকারাহ-এর আয়াতুল কুরসী (আয়াতঃ ২৫৫) অপরটি হলো সূরা আল হাশরের এই আয়াত গুলো।
৩৩. অর্থাৎ যিনি ছাড়া আর কারোই ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অবস্থান এমন নয় যে, তার বন্দেগী ও আরাধনা করা যেতে পারে। যিনি ছাড়া আর কেউ আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতার মালিকই নয় যে, সে উপাস্য হওয়ার অধিকার লাভ করতে পারে।
৩৪. অর্থাৎ সৃষ্টির কাছে যা গোপন ও অজানা তিনি তাও জানেন আর যা তাদের কাছে প্রকাশ্য ও জানা তাও তিনি জানেন। এই বিশ্ব-জাহানের কোন বস্তুই তার জ্ঞানের বাইরে নয়। যা অতীত হয়ে গিয়েছে, যা বর্তমানে আছে যা ভবিষ্যতে হবে তার সবকিছুই তিনি সরাসরি জানেন। এসব জানার জন্য তিনি কোন মাধ্যমের মুখাপেক্ষী নন।
৩৫. অর্থাৎ একমাত্র তিনিই এমন এক সত্তা যার রহমত অসীম ও অফুরন্ত সমগ্র বিশ্ব চরাচরব্যাপী পরিব্যাপ্ত এবং বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসই তার বদান্যতা ও অনুগ্রহই লাভ করে থাকে। গোটা বিশ্ব-জাহানে আর একজনও এই সর্বাত্মক ও অফুরন্ত রহমতের অধিকারী নেই। আর যেসব সত্তার মধ্যে দয়ামায়ার এই গুণটি দেখা যায় তা আংশিক ও সীমিত। তাও আবার তার নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। বরং স্রষ্টা কোন উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন সামনে রেখে তা তাকে দান করেছেন। তিনি কোন সৃষ্টির মধ্যে দয়ামায়ার আবেগ অনুভূতি সৃষ্টি করে থাকলে তা এ জন্য করেছেন যে, তিনি একটি সৃষ্টিকে দিয়ে আরেকটি সৃষ্টির প্রতিপালন ও সুখ-স্বচ্ছন্দের ব্যবস্থা করতে চান। এটাও তারই রহমতের প্রমাণ।
﴿هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِى لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْمَلِكُ ٱلْقُدُّوسُ ٱلسَّلَـٰمُ ٱلْمُؤْمِنُ ٱلْمُهَيْمِنُ ٱلْعَزِيزُ ٱلْجَبَّارُ ٱلْمُتَكَبِّرُ ۚ سُبْحَـٰنَ ٱللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
২৩। আল্লাহ-ই সেই মহান সত্তা যিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি বাদশাহ,৩৬ অতীব পবিত্র,৩৭ পূর্ণাঙ্গ শান্তি,৩৮ নিরাপত্তাদানকারী,৩৯ হিফাযতকারী,৪০ সবার ওপর বিজয়ী,৪১ শক্তি বলে নিজের নির্দেশ কার্যকরী করতে সক্ষম।৪২ এবং সবার চেয়ে বড় হয়েই বিরাজমান থাকতে সক্ষম।৪৩ আল্লাহ সেই সব শিরক থেকে পবিত্র যা লোকেরা করে থাকে।৪৪
৩৬. মূল আয়াতে الملك শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ প্রকৃত বাদশাহ তিনিই। তাছাড়া শুধু الملك শব্দ ব্যবহার করায় তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি কোন বিশেষ এলাকা বা নির্দিষ্ট কোন রাজ্যের বাদশাহ নন, বরং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ। তার ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্ব সমস্ত সৃষ্টিজগত জুড়ে পরিব্যাপ্ত। প্রতিটি বস্তুর তিনিই মালিক। প্রতিটি বস্তু তার ইখতিয়ার ক্ষমতা এবং হুকুমের অধীন। তার কর্তৃত্ব তথা সার্বভৌম ক্ষমতাকে (Soverignty) সীমিত করার মত কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআ’লার বাদশাহীর এ দিকগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছেঃ
وَلَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَهُ قَانِتُونَ
“আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তা সব তারই মালিকানাধীন। সবাই তার নির্দেরশের অনুগত।” (আর রূমঃ ২৬)
يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ
“আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সব কাজের ব্যবস্থাপনা তিনিই পরিচালনা করে থাকেন।” (আস সিজদাহঃ ৫)
لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ
“আসমান ও যমীনের বাদশাহী তাঁরই। সব বিষয় আল্লাহর দিকেই রুজু করা হবে।” (আল হাদীদঃ ৫)
وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ
“বাদশাহী ও সার্বভৌমত্বে কেউ তাঁর অংশীদার নয়।” (আল ফুরকানঃ ২)
بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ
“সবকিছুর কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা তাঁরই হাতে।” (ইয়াসীনঃ ৮২)
فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ
“যা ইচ্ছা তাই করতে সক্ষম” (আল বুরুজঃ ১৬)
لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ
“তিনি যা করেন তার জন্য তাকে কারো জবাবদিহি করতে হয় না। তবে অন্য সবাইকে জবাবদিহি করতে হয়।” (আল রা’দঃ ২৩)
اللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ
“আল্লাহ ফয়সালা করেন। তাঁর ফয়সালা পুনর্বিবেচনাকারী কেউ নেই।” (আল রা’দঃ ৪১)
وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ
“তিনিই আশ্রয় দান করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ আশ্রয় দিতে পারে না।” (আল মু’মিনূনঃ ৮৮)
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“বলো, হে আল্লাহ, বিশ্ব-জাহানের মালিক! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর এবং যার নিকট থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও। তুমি যাকে ইচ্ছা মর্যাদা দান করো আবার যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত কর। সমস্ত কল্যাণ তোমার আয়ত্বে। নিঃসন্দেহে তুমি সব বিষয়ে শক্তিমান।” (আলে ইমরানঃ ২৬)
এসব স্পষ্ট ঘোষণা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহ তাআ’লার বাদশাহী সার্বভৌমত্ব কোন সীমিত বা রূপক অর্থের বাদশাহী নয়, সত্যিকার বাদশাহী যা সার্বভৌমত্বের পূর্ণাংগ অর্থ ও পূর্ণাংগ ধারণার মূর্তপ্রতীক। সার্বভৌম ক্ষমতা বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বুঝায় তার অস্তিত্ব তার বাস্তবে কোথাও থাকলে কেবলমাত্র আল্লাহ তাআ’লার বাদশাহীতেই আছে। তাঁকে ছাড়া আর যেখানেই সার্বভৌম ক্ষমতা থাকার দাবী করা হয় তা কোন বাদশাহী বা ডিক্টেটরের ব্যক্তিসত্তা, কিংবা কোন শ্রেণী বা গোষ্ঠী অথবা কোন বংশ বা জাতি যাই হোক না কেন প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। কেননা যে ক্ষমতা অন্য কারো দান, যা কোন সময় পাওয়া যায় এবং আবার এক সময় হাতছাড়া হয়ে যায়, অন্য কোন শক্তির পক্ষ থেকে যা বিপদেরআশঙ্কা করে, যার প্রতিষ্ঠা ও টিকে থাকা সাময়িক এবং অন্য বহু প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের গণ্ডি সীমিত করে দেয় এমন সরকার বা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে আদৌ সার্বভৌম ক্ষমতা বলা হয় না।
কিন্তু কুরআন মজীদ শুধু একথা বলেই ক্ষান্ত হয় না যে, আল্লাহ তাআ’লা গোটা বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ। এর সাথে পরবর্তী আয়াতাংশগুলোতে স্পষ্ট করে বলেছে, তিনি এমন বাদশাহ যিনি, ‘কুদ্দুস’, ‘সালাম’, ‘মু’মিন’, ‘মুহাইমিন’, ‘আযীয’, ‘জাব্বার’, ‘মুতাকাব্বির’, ‘খালেক’, ‘বারী’এবং ‘মুছাওবির’।
৩৭. মূল ইবারতে قدوس শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা আধিক্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এর মূল ধাতু قدس । قدس অর্থ সবরকম মন্দ বৈশিষ্ট্য মুক্ত ও পবিত্র হওয়া। قدوس অর্থ হলো, আল্লাহ তাআ’লার পবিত্র সত্তা কোন প্রকার দোষ-ত্রুটি অথবা অপূর্ণতা কিংবা কোন মন্দ বৈশিষ্ট্যের অনেক উর্ধ্বে। বরং তা এক অতি পবিত্র সত্তা যার মন্দ হওয়ার ধারণাও করা যায় না। এখানে একথাটি ভালভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, চরম পবিত্রতা প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্বের প্রাথমিক অপরিহার্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত যে সত্তা দুষ্ট, দুশ্চরিত্র এবং বদনিয়াত পোষণকারী, যার মধ্যে মানব চরিত্রের মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান এবং যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের অধিনস্তরা কল্যাণ লাভের প্রত্যাশী হওয়ার পরিবর্তে অকল্যাণের ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে এমন সত্তা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে এটা মানুষের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি ও স্বাভাব-প্রকৃতি মেনে নিতে অস্বীকার করে। এ কারণে মানুষ যাকেই সার্বভৌম ক্ষমতার আধার বলে স্বীকৃতি দেয় তার মধ্যে পবিত্রতা না থাকলেও তা আছে বলে ধরে নেয়। কারণ পবিত্রতা ছাড়া নিরংকুশ ক্ষমতা অকল্পনীয়। কিন্তু এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, আল্লাহ ছাড়া কোন চূড়ান্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি পবিত্র নয় এবং তা হতেও পারে না। ব্যক্তিগত বাদশাহী, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি, অন্য কোন পদ্ধতির মানবীয় সরকার যাই হোক না কেন কোন অবস্থায়ই তার সম্পর্কে চরম পবিত্রতার ধারণা করা যেতে পারে না।
৩৮. মূল আয়াতে السلام শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ শান্তি। কাউকে ‘সুস্থ’ ও ‘নিরাপদ’ না বলে ‘নিরাপত্তা’ বললে আপনা থেকেই তার মধ্যে আধিক্য অর্থ সৃষ্টি হয়ে যায়। যেমন কাউকে সুন্দর না বলে যদি সৌন্দর্য বলা হয় তাহলে তার অর্থ হবে সে আপাদমস্তক সৌন্দর্যমণ্ডিত। সুতরাং আল্লাহ তাআ’লাকে السلام বলার অর্থ তার গোটা সত্তাই পুরোপুরি শান্তি। কোন বিপদ, কোন দুর্বলতা কিংবা অপূর্ণতা স্পর্শ করা অথবা তাঁর পূর্ণতায় কোন সময় ভাটা পড়া থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।
৩৯. মূল আয়াতে المؤمن শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটির মূল ধাতু হলো امن । امن অর্থ ভয়ভীতি থেকে নিরাপদ হওয়া। তিনিই মু’মিন যিনি অন্যকে নিরাপত্তা দান করেন। আল্লাহ তাআ’লা তাঁর সৃষ্টিকে নিরাপত্তা দান করেন তাই তাঁকে মু’মিন বলা হয়েছে। তিনি কোন সময় তাঁর সৃষ্টির ওপর জুলুম করবেন, কিংবা তার অধিকার নাস্যাত করবেন কিংবা তার পুরস্কার নষ্ট করবেন অথবা তার কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করবেন এ ভয় থেকে তার সৃষ্টি পুরোপুরি নিরাপদ। আর কর্তার কোন কর্ম অর্থাৎ তিনি কাকে নিরাপত্তা দেবেন তা যেহেতু উল্লেখিত হয়নি বরং শুধু المؤمن বা নিরাপত্তা দানকারী বলা হয়েছে তাই আপনা থেকে এর অর্থ দাঁড়ায় গোটা বিশ্ব-জাহান ও তার সমস্ত জিনিসের জন্য তাঁর নিরাপত্তা।
৪০. মূল আয়াতে اَلْمُهَيْمِنَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটির তিনটি অর্থ হয়। একঃ তত্ত্বাবধান ও হিফাজতকারী। দুইঃ পর্যবেক্ষণকারী, কে কি করছে তা যিনি দেখছেন। তিনঃ সৃষ্টির যাবতীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপক, যিনি মানুষের সমস্ত প্রয়োজন ও অভাব পূরণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এখানেও যেহেতু শুধু المهيمن শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই কর্তার কোন কর্ম নির্দেশ করা হয়নি। অর্থাৎ তিনি কার তত্বাবধানকারী ও সংরক্ষক, কার পর্যবেক্ষক এবং কার দেখা শোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তা বলা হয়নি। তাই শব্দের এ ধরনের প্রয়োগ থেকে স্বতঃই যা অর্থ দাঁড়ায় তা হলো তিনি সমস্ত সৃষ্টির তত্বাবধান ও সংরক্ষণ করছেন, সবার কাজকর্ম দেখছেন এবং বিশ্ব-জাহানের সমন্ত সৃষ্টির দেখাশোনা, লালন-পালন এবং অভাব ও প্রয়োজন পুরণের দায়িত্ব গ্রহণ করছেন।
৪১. মূল ইবারতে العزيز শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ এমন এক পরাক্রমশালী সত্তা যার মোকাবিলায় অন্য কেউ মাথা তুলতে পারে না, যার সিদ্ধান্তসমূহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সাধ্য করো নেই এবং যার মোকাবিলায় সবাই অসহায় ও শক্তিহীন।
৪. মূল আয়াতে الجبار শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর শব্দমূল বা ধাতু হলো جبر । جبر শব্দের অর্থ কোন বস্তুকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঠিক করা, কোন জিনিসকে শক্তি দ্বারা সংশোধন করা। যদিও আরবী ভাষায় جبر শব্দটির কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু সংশোধন অর্থে এবং কোন কোন সময় শুধু জবরদস্তি বা বল প্রয়োগ অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হলো, সংস্কার ও সংশোধনের জন্য শক্তি প্রয়োগ করা। সুতরাং আল্লাহ তাআ’লাকে جبار বলার অর্থ হলো বল প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি সৃষ্ট বিশ্ব-জাহানের শৃংখলা রক্ষাকারী এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নকারী, যদিও তাঁর ইচ্ছা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান ও যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়াও جبار শব্দটির মধ্যে বড়ত্ব ও মহত্ববোধক অর্থও বিদ্যমান। খেজুরের যে গাছ অত্যন্ত উঁচু হওয়ার কারণে তার ফল সংগ্রহ করা কারো জন্য সহজসাধ্য নয় আরবী ভাষায় তাকে জাব্বার বলে। অনুরূপ যে কাজ অত্যন্ত গুরুত্ব বা জাকজমকপূর্ণ তাকে জাব্বার বা অতি বড় কাজ বলা হয়।
৪৩. মূল আয়াতে اَلْمُتَكَبِّرُ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটির দু’টি অর্থ। একঃ যে প্রকৃতপক্ষে বড় নয়, কিন্তু খামাখা বড়ত্ব জাহির করে। দুইঃ যে প্রকৃতপক্ষেই বড় এবং বড় হয়েই থাকে। মানুষ হোক, শয়তান হোক, বা অন্য কোন মাখলুক হোক, যেহেতু প্রকৃতপক্ষে তার কোন বড়ত্ব মহত্ব নেই, তাই নিজেকে নিজে বড় মনে করা এবং অন্যদের কাছে নিজের বড়ত্ব ও মহত্ব জাহির করা একটা মিথ্যা দাবী ও জঘন্য দোষ। অপর দিকে আল্লাহ তাআ’লা প্রকৃতই বড়, বড়ত্ব বাস্তবে তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট এবং বিশ্ব-জাহানের সব বস্তু তাঁর সামনে ক্ষুদ্র ও নগণ্য। তাই তাঁর বড় হওয়ার এবং বড় হয়ে থাকা নিছক কোন দাবী বা ভান নয়। বরং একটি বাস্তবতা। এটি কোন খারাপ বা মন্দ বৈশিষ্ট্য নয়, বরং একটি গুণ ও সৌন্দর্য যা তাঁর ছাড়া আর কারো মধ্যে নেই।
৪৪. অর্থাৎ যারাই তাঁর ক্ষমতা, ইখতিয়ার ও গুণাবলীতে কিংবা তাঁর সত্তায় অন্য কোন সৃষ্টিকে অংশীদার বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তারা অতিবড় এক মিথ্যা বলেছে। কোন অর্থেই কেউ আল্লাহ তাআ’লার শরীক বা অংশীদার নয়। তিনি তা থেকে পবিত্র।
﴿هُوَ ٱللَّهُ ٱلْخَـٰلِقُ ٱلْبَارِئُ ٱلْمُصَوِّرُ ۖ لَهُ ٱلْأَسْمَآءُ ٱلْحُسْنَىٰ ۚ يُسَبِّحُ لَهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۖ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ﴾
২৪। সেই পরম সত্তা তো আল্লাহ-ই যিনি সৃষ্টির পরিকল্পনাকারী, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের র্নিদেশ দানকারী এবং সেই অনুপাতে রূপদানকারী।৪৫ উত্তম নামসমূহ তাঁর-ই।৪৬ আসমান ও যমীনের সবকিছু তাঁর তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করে চলেছে।৪৭ তিনি পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।৪৮
৪৫. অর্থাৎ সারা দুনিয়ার এবং দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু সৃষ্টির প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তার নির্দিষ্ট আকার আকৃতিতে অস্তিত্ব লাভ করা পর্যন্ত পুরোপুরি তাঁরই তৈরী ও লালিতপালিত। কোন কিছুই আপনা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেনি কিংবা আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়ে যায়নি অথবা তার নির্মাণ ও পরিপাটি করণে অন্য কারো সামান্যতম অবদান ও নেই। এখানে আল্লাহ তাআ’লার সৃষ্টিকর্মকে তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায় বা স্তরে বর্ণনা করা হয়েছে। যা ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়টি হলো সৃষ্টি অর্থাৎ পরিকল্পনা করা। এর উদাহরণ হলো, কোন ইঞ্জিনিয়ার কোন ইমারত নির্মাণের পূর্বে যেমন মনে মনে স্থির করে যে, অমুক বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে এরূপ ও এরূপ একটি ইমরাত নির্মাণ করতে হবে। সে তখন মনে মনে তার নমুনা বা ডিজাইন চিন্তা করতে থাকে। এ উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত ইমারতের বিস্তারিত ও সামগ্রিক কাঠামো কি হবে এ পর্যায়ে সে তা ঠিক করে নেয়। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, برء । এ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো, পৃথক করা চিরে ফেলা, ফেড়ে ফেলা আলাদা করা। স্রষ্টার জন্য ‘বারী’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা হচ্ছে, তিনি তার পরিকল্পিত কাঠামোকে বাস্তবে রূপ দেন। অর্থাৎ যে নকশা তিনি নিজে চিন্তা করে রেখেছেন তাকে কল্পনা বা অস্তিত্বহীনতার জগত থেকে এনে অস্তিত্ব দান করেন। এর উদাহরণ হলো, ইঞ্জিনায়ার ইমারতের যে কাঠামো ও আকৃতি তাঁর চিন্তার জগতে অংকন করেছিলেন সে অনুযায়ী ঠিকমত মাপজোঁক করে মাটিতে দাগ টানেন, ভিত খনন করেন, প্রাচীর গেঁথে তোলেন এবং নির্মাণের সকল বাস্তব স্তর অতিক্রম করেন। তৃতীয় পর্যায় হলো, ‘তাসবীর’ এর অর্থ রূপদান করা। এখানে এর অর্থ হলো, কোন বস্তুকে চূড়ান্ত, পূর্ণাঙ্গ আকৃতি ও রূপ দান করা। এখানে এর অর্থ হলো, কোন বস্তুকে চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ আকৃতি ও রূপ দান করা। এই তিনটি পর্যায়ে আল্লাহ তাআ’লার কাজ ও মানুষের কাজের মধ্যে আদৌ কোন মিল বা তুলনা হয় না। মানুষের কোন পরিকল্পনাই এমন নয় যা পূর্বের কোন নমুনা থেকে গৃহীত নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআ’লার প্রতিটি পরিকল্পনাই অনুপম এবং তাঁর নিজের আবিষ্কার। মানুষ যা তৈরী করে তা আল্লাহ তাআ’লার সৃষ্ট উপাদানসমূহের একটিকে আরেকটির সাথে জুড়ে করে। অস্তিত্ব নেই এমন কোন জিনিসকে সে অস্তিত্ব দান করে না, বরং যা আছে তাকেই বিভিন্ন পন্থায় জোড়া দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআ’লা সমস্ত বস্তুকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন এবং যে উপাদান দিয়ে তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সে উপাদানও তাঁর নিজের সৃষ্টি। অনুরূপ আকার-আকৃতি দানের ব্যাপারেও মানুষ আবিষ্কর্তা নয়, বরং প্রকৃত আকার-আকৃতি দানকারী ও চিত্র অংকনকারী মহান আল্লাহ। তিনি প্রতিটি জাতি, প্রজাতি এবং প্রতিটি ব্যক্তির অনুপম ও নজীরহীন আকার-আকৃতি বানিয়েছেন এবং কোন সময় একই আকার-আকৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটাননি।
৪৬. নামসমূহ অর্থ গুণবাচক নাম। তাঁর উত্তম নাম থাকার অর্থ হলো, যেমন গুণবাচাক নাম দ্বারা তার কোন প্রকার অপূর্ণতা প্রকাশ পায় যেসব গুণবাচক নাম তাঁর উপযুক্ত নয়। যেসব নাম তাঁর পূর্ণাংগ গুণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে সেই সব নামে তাকে স্মরণ করা উচিত। কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ তাআ’লার এসব উত্তম নামের উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসে তাঁর পবিত্র সত্তার ৯৯টি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে তিরমিযী ও ইবনে মাজা এসব নাম বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। কেউ যদি কুরআন ও হাদীস থেকে এসব নাম গভীর মনোনিবেশ সহকারে পড়ে তাহলে সে অতি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে, পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় যদি আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করতে হয় তাহলে সেজন্য কি ধরনের শব্দ উপযুক্ত হবে।
৪৭. অর্থাৎ মুখের ভাষায় ও অবস্থার ভাষায় বর্ণনা করছে যে, তারা স্রষ্টা সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি, অপূর্ণতা, দুর্বলতা এবং ভুল-ভ্রান্তি থেকে পবিত্র।
৪৮. ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন সূরা আল হাদীদের ২ নং টীকা।
— সমাপ্ত —