পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿عَمَّ يَتَسَآءَلُونَ﴾
১। এরা কি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে?
﴿عَنِ ٱلنَّبَإِ ٱلْعَظِيمِ﴾
২। সেই বড় খবরটা সম্পর্কে কি,
﴿ٱلَّذِى هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ﴾
৩। যে ব্যাপারে এরা নানান ধরনের কথা বলে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরছে?১
১. বড় খবর বলতে কিয়ামত ও আখেরাতের কথা বুঝানো হয়েছে। মক্কাবাসীরা অবাক হয়ে কিয়ামত ও আখেরাতের কথা শুনতো। তারপর তাদের প্রত্যেকটি আলাপ আলোচনায়, বৈঠকে, মজলিসে এ সম্পর্কে নানান ধরনের কথা বলতো ও ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো। জিজ্ঞাসাবাঃদ বলতেও এ নানা ধরনের কথাবার্তা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের কথাই বোঝানো হয়েছে। লোকেরা পরস্পরের সাথে দেখা হলে বলতো, আরে ভাই, শুনেছো নাকি? মানুষ নাকি মরে যাবার পরে আবার জীবিত হবে? এমন কথা আগে কখনো শুনেছিলে? যে মানুষটি মরে পচে গেছে, যার শরীরের হাড়গুলো পর্যন্ত মাটিতে মিশে গেছে, তার মধ্যে নাকি আবার নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হবে, একথা কি মেনে নেয়া যায়? আগের পরের সব বংশধররা জেগে উঠে এক জায়গায় জমা হবে, একথা কি যুক্তিসম্মত? আকাশের বুকে মাথা উঁচু করে পৃথিবী পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা এসব বড় বড় পাহাড় নাকি পেঁজা তুলোর মতো বাতাসে উড়তে থাকবে? চাঁদ, সুরুজ আর তারাদের আলো কি নিভে যেতে পারে? দুনিয়ার এই জমজমাট ব্যবস্থাটা কি ওলটপালট হয়ে যেতে পারে? এই মানুষটি তো গতকাল পর্যন্তও বেশ জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ছিল, আজ তার কি হয়ে গেলো, আমাদের এমন সব অদ্ভূত অদ্ভূত খবর শুনিয়ে যাচ্ছে? এ জান্নাত ও জাহান্নাম এতদিন কোথায় ছিল? এর আগে কখনো আমরা তাঁর মুখে একথা শুনিনি কেন? এখন এরা হঠাৎ টপকে পড়লো কোথা থেকে? কোথা থেকে এদের অদ্ভূত ধরনের ছবি এঁকে এনে আমাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে?
هُم فِيهِ مُختَلِفُونَ আয়াতাংশটির একটি অর্থ তো হচ্ছেঃ “এ ব্যাপারে তারা নানান ধরনের কথা বলছে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরছে।” এর দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে, দুনিয়ার পরিণামসম্পর্কে তারা নিজেরাও কোন একটি অভিন্ন আকীদা পোষণ করে না বরং “তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়।” তাদের কেউ কেউ খৃস্টানদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল। কাজেই তারা মৃত্যুর পরের জীবন স্বীকার করতো। তবে এই সঙ্গে তারা একথাও মনে করতো যে, এই জীবনটি শারীরিক নয়, আত্মিক পর্যায়ের হবে। কেউ কেউ আবার আখেরাত পুরোপুরি অস্বীকার করতো না, তবে তা ঘটতে পারে কিনা, এ ব্যাপারে তাদের সন্দেহ ছিল। কুরআন মজীদে এ ধরনের লোকদের এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ اِن نَظُنُ اِلا ظَنَا وَمَا نَحنُ بِمُستَيقِنِينَ “আমরা তো মাত্র একটি ধারণাই পোষণ করি, আমাদের কোন নিশ্চিত বিশ্বাস নেই।” [আল জাসিয়াহঃ ৩১] আবার কেউ কেউ একদম পরিস্কার বলতোঃ اِن هِىَ اِلا حَيَا تُنَا وَمَا يَهلِكُنَا اِلا الدَهْرُ “আমাদের এ দুনিয়ার জীবনটিই সবকিছু এবং মরার পর আমাদের আর কখনো দ্বিতীয়বার উঠানো হবে না।” [আল আনআ’মঃ ২৯] তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ সবকিছুর জন্য সময়কে দায়ী করতো। তারা তারা বলতোঃ مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ “আমাদের এই দুনিয়ার জীবনটিই সব কিছু। এখানেই আমরা মরি, এখানেই আমরা জীবন লাভ করি এবং সময়ের চক্র ছাড়া আর কিছুই নেই যা আমাদের ধবংস করে।” [ আল জাসিয়াহঃ ২৪ ] আবার এমন কিছু লোকও ছিল, যারা সময়কে সবকিছুর জন্য দায়ী না করলেও মৃত্যুর পরের জীবনকে অসম্ভব মনে করতো। অর্থাৎ তাদের মতে, মরা মানুষদের আবার জীবিত করে তোলার ক্ষমতা আল্লাহর ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিলঃ مَن يُحْىِ ٱلْعِظَـٰمَ وَهِىَ رَمِيمٌۭ ‘এই হাড়গুলো পচে গলে নষ্ট হয়ে যাবার পর আবার এইগুলোকে জীবিত করবে কে?” [ ইয়াসীনঃ ৭৮] তাদের এসব বিভিন্ন বক্তব্য একথা প্রমাণ করে যে, এ বিষয়ে তাদের কোন সঠিক জ্ঞান ছিল না। বরং তারা নিছক আন্দাজ-অনুমান ও ধারণার বশবর্তী হয়ে অন্ধকারে তীর ছুঁড়ে যাচ্ছিল। নয়তো এ ব্যাপারে তাদের কাছে যদি কোন সঠিক জ্ঞান থাকতো তাহলে তারা সবাই একটি বক্তব্যের উপর একমত হতে পারতো ( আরো বেশী জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা আয্ যারিয়াতের ৬ টীকা দেখুন)।
﴿كَلَّا سَيَعْلَمُونَ﴾
৪। কখখনো না,২ শীঘ্রই এরা জানতে পারবে।
২. অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে যেসব কথা এরা বলে যাচ্ছে এগুলো সবই ভুল। এরা যা কিছু মনে করেছে ও বুঝেছে তা কোনক্রমেই সঠিক নয়।
﴿ثُمَّ كَلَّا سَيَعْلَمُونَ﴾
৫। হ্যাঁ, কখখনো না, শীঘ্রই এরা জানতে পারবে।৩
৩. অর্থাৎ যে বিষয়ে এরা নিজেরা নানা আজেবাজে কথা বলছে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরছে সেটি যথার্থ সত্য হয়ে এদের সামনে ফুটে ওঠার সময় মোটেই দূরে নয়। সে সময় এরা জানতে পারবে, রাসূল এদেরকে যে খবর দিয়েছিলেন তা ছিল সঠিক এবং আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে এরা যেসব কথা তৈরী করছিল তা ছিল ভিত্তিহীন অসার।
﴿أَلَمْ نَجْعَلِ ٱلْأَرْضَ مِهَـٰدًۭا﴾
৬। একথা কি সত্য নয়, আমি যমীনকে বিছানা বানিয়েছি?৪
৪. যমীনকে মানুষের জন্য বিছানা অর্থাৎ একটি শান্তিময় আবাস ভূমিতে পরিণত করার মধ্যে আল্লাহর যে নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান, ক্ষমতা ও কর্মকুশলতা সক্রিয় রয়েছে সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে তাফহীমুল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নীচের স্থানগুলো দেখুনঃ তাফহীমুল কুরআন, আন নামলঃ ৭৩, ৭৪ ও ৮১ টীকা, ইয়াসীনঃ ২৯ টীকা, আল মু’মিনঃ ৯০ ও ৯১ টীকা, আয যুখরুফঃ ৭ টীকা, আল জাসিয়াহ ৭ টীকা এবং কাফ ১৮ টীকা।
﴿وَٱلْجِبَالَ أَوْتَادًۭا﴾
৭। পাহাড়গুলোকে গেঁড়ে দিয়েছি পেরেকের মতো?৫
৫. পৃথিবীতে পাহাড় সৃষ্টির কারণ এবং এর পেছনে আল্লাহর যে কল্যাণ স্পর্শ রয়েছে তা জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা আন নাহলঃ ১২ টীকা, আন নামলঃ ৭৪ টীকা এবং আল মুরসালাত ১৫ টীকা দেখুন।
﴿وَخَلَقْنَـٰكُمْ أَزْوَٰجًۭا﴾
৮। তোমাদের (নারী ও পুরুষ) জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি?৬
৬. মানবজাতিকে নারী ও পুরুষের জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার যে মহান কল্যাণ ও উদ্দেশ্যে রয়েছে তা বিস্তারিতভাবে জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা আল ফুরকানঃ ৬৯ টীকা, আর রূমঃ ২৮ থেকে ৩০ টীকা, ইয়াসীনঃ ৩১ টীকা, আশ শূরা ৭৭ টীকা, আয যুখরুফঃ ১২ টীকা এবং আল কিয়ামাহঃ২৫ টীকা দেখুন।
﴿وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًۭا﴾
৯। তোমাদের ঘুমকে করেছি শান্তির বাহন,৭
৭. মানুষকে দুনিয়ায় কাজ করার যোগ্য করার জন্য মহান আল্লাহ অত্যন্ত কর্মকুশলতা সহকারে তার প্রকৃতিতে ঘুমের এক অভিলাষ বা চাহিদা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। প্রতি কয়েক ঘণ্টা পরিশ্রম করার পর এই চাহিদা আবার তাকে কয়েক ঘণ্টা ঘুমাতে বাধ্য করে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানার জন্য পড়ুন তাফহীমুল কুরআনের সূরা আর রূমঃ ৩৩ টীকা।
﴿وَجَعَلْنَا ٱلَّيْلَ لِبَاسًۭا﴾
১০। রাতকে করেছি আবরণ
﴿وَجَعَلْنَا ٱلنَّهَارَ مَعَاشًۭا﴾
১১। এবং দিনকে জীবিকা আহরণের সময়?৮
৮. অর্থাৎ রাতকে অন্ধকার করে দিয়েছি। ফলে আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তার মধ্যে তোমরা সহজেই ঘুমের প্রশান্তি লাভ করতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে দিনকে আলোকোজ্জ্বল করে দিয়েছি। ফলে তার মধ্যে তোমরা অতি সহজেই নিজেদের রুজি রোজগারের জন্য কাজ করতে পারবে। পৃথিবীতে রাত-দিনের নিয়মিত ও নিরবিছিন্ন আবর্তনের মধ্যে অসংখ্য কল্যাণ রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে থেকে মাত্র এই একটি কল্যাণের দিকে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ একথা বুঝাতে চান যে, এখানে যা কিছু ঘটছে এগুলো উদ্দেশ্যহিনভাবে ঘটছে না। বরং এর পেছনে একটি কল্যাণকর উদ্দেশ্য কাজ করছে। তোমাদের নিজেদের স্বার্থের সাথে এ উদ্দেশ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তোমাদের অস্তিত্বের গঠন প্রকৃতি নিজের আরাম ও প্রশান্তির জন্য যে অন্ধকারের অভিলাষী ছিল তার জন্য রাতকে এবং তার জীবিকার জন্য যে আলোর অভিলাষী ছিল তার জন্য দিনকে সরবরাহ করা হয়েছে। তোমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পাদিত এই ব্যবস্থাপনা নিজেই সাক্ষ্য দিয়ে চলছে যে, কোন জ্ঞানময় সত্তার কর্মকৌশল ছাড়া এটা সম্ভবপর হয়নি। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনুসঃ ৬৫ টীকা, ইয়াসীনঃ ৩২ টীকা, আল মু’মিনঃ ৮৫ টীকা এবং আয যুখরুফঃ ৪ টীকা)
﴿وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًۭا شِدَادًۭا﴾
১২। তোমাদের ওপর সাতটি মজবুত আকাশ স্থাপন করেছি৯
৯. মজবুত বলা হয়েছে এ অর্থে যে, আকাশের সীমান্ত অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সংঘবদ্ধ, তার মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তনও কখনো হয় না। এ সীমানা পেরিয়ে উর্ধ্বজগতের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্য থেকে কোন একটিও কখনো অন্যের সাথে সংঘর্ষ বাঁধায় না এবং কোনটি কক্ষচ্যুত হয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়েও পড়ে না। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য পড়ুন তাফহীমুল কুরআন আল বাকারাহঃ ৩৪ টীকা, আর রা’দঃ ২ টীকা, আল হিজরঃ ৮ ও ১২ টীকা, আল মু’মিনুনঃ ১৫ টীকা, লুকমানঃ ১৩ টীকা, ইয়াসীনঃ ৩৭ টীকা, আস সাফফাতঃ ৫ ও ৬ টীকা, আল মু’মিনঃ ৯০ টীকা এবং কাফ ৭ ও ৮ টীকা)।
﴿وَجَعَلْنَا سِرَاجًۭا وَهَّاجًۭا﴾
১৩। এবং একটি অতি উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত বাতি সৃষ্টি করেছি?১০
১০. এখানে সূর্যের কথা বলা হয়েছে। মূলে وَهَاجْ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে অতি উত্তপ্ত আবার অতি উজ্জ্বলও। তাই আয়াতের অনুবাদে আমি দু’টো অর্থই ব্যবহার করেছি। এ ছোট বাক্যটির মধ্যে মহান আল্লাহর শক্তি ও কর্মকুশলতার যে বিরাট নিদর্শনটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে সে নিদর্শনটির অর্থাৎ সূর্যের ব্যাস পৃথিবী থেকে ১০৯ গুণ বেশী এবং তার আয়তন পৃথিবী তুলনায় ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার গুণ বড়। তার তাপমাত্রা ১ কোটি ৪০ লক্ষ সেন্টিগ্রেড। পৃথিবী থেকে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও তার আলোর শক্তি এত বেশী যে, মানুষ খালি চোখে তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করলে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলবে। তার উত্তাপ এত বেশী যে পৃথিবীর কোথাও তার উত্তাপের ফলে তাপমাত্রা ১৪০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মহান আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞান ও সৃষ্টিকুশল তার মাধ্যমে পৃথিবীকে সূর্য থেকে এক ভারসাম্যপূর্ণ দূরত্বে স্থাপন করেছেন। পৃথিবী তার অবস্থানের চাইতে সূর্যের বেশী কাছাকাছি নয় বলে অস্বাভাবিক গরম নয়। আবার বেশী দূরে নয় বলে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডাও নয়। এ কারণে মানুষ, পশু-পাখি ও উদ্ভিদের জীবন ধারণ সম্ভবপর হয়েছে। সূর্য থেকে শক্তির অপরিমেয় ভাণ্ডার উৎসারিত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এ শক্তিই পৃথিবীর বুকে আমাদের জীবন ধারণের উৎস। তারই সাহায্যে আমাদের ক্ষেতে ফসল পাকছে এবং পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী তার আহার লাভ করছে। তারই উত্তাপে সাগরের পানি বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে যায়, তারপর বাতাসের সাহায্য দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে বারি বর্ষণ করে। এ সূর্যের বুকে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ এমন বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রেখেছেন যা কোটি কোটি বছর থেকে সমগ্র সৌরজগতে আলো, উত্তাপ ও বিভিন্ন প্রকার রশ্মি অব্যাহতভাবে ছড়িয়ে চলছে।
﴿وَأَنزَلْنَا مِنَ ٱلْمُعْصِرَٰتِ مَآءًۭ ثَجَّاجًۭا﴾
১৪। আর মেঘমালা থেকে বর্ষণ করেছি অবিরাম বৃষ্টিধারা,
﴿لِّنُخْرِجَ بِهِۦ حَبًّۭا وَنَبَاتًۭا﴾
১৫। যাতে তার সাহায্যে উৎপন্ন করতে পারি
﴿وَجَنَّـٰتٍ أَلْفَافًا﴾
১৬। শস্য, শাক সবজি ও নিবিড় বাগান?১১
১১. পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থাপনা এবং উদ্ভিদের তরতাজা হয়ে ওঠার মধ্যে প্রতিনিয়ত আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও সৃষ্টিকুশলতার যে বিস্ময়কর আত্মপ্রকাশ ঘটে চলছে সে সম্পর্কে তাফহীমুল কুরআনের নিম্নোক্ত স্থানসমূহে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছেঃ সূরা আন নাহলঃ ৫৩ টীকা, আল মু’মিনুনঃ ১৭ টীকা, আশ শূআ’রাঃ ৫ টীকা, আর রূমঃ ৩৫ টীকা, ফাতিরঃ ১৯ টীকা, ইয়াসীনঃ ২৯ টীকা, আল মু’মিনঃ ২০ টীকা, আয যুখরুফঃ ১০-১১ টীকা এবং আল ওয়াকিআ’হঃ ২৮ থেকে ৩০ টীকা।
এ আয়াত গুলোতে একের পর এক বহু প্রাকৃতিক নিদর্শন ও যুক্তি প্রমাণ পেশ করে কিয়ামত ও আখেরাত অস্বীকারকারীদেরকে একথা জানানো হয়েছে যে, যদি তোমরা চোখ মেলে একবার পৃথিবীর চারদিকে তাকাও, পাহাড়-পর্বত, তোমাদের নিজেদের জন্ম, নিদ্রা, জাগরণ এবং দিন-রাত্রির আবর্তনের এই ব্যবস্থাপনাটি গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করো তাহলে এসবের মধ্যে তোমরা দু’টি জিনিস সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবে। একঃ একটি জবরদস্ত শক্তির সহায়তা ছাড়া এসব কিছু অস্তিত্বশীল হতে পারে না এবং এ ধরনের নিয়ম-শৃংখলার আওতাধীনে জারীও থাকতে পারে না। দুইঃ এসব জিনিসের প্রত্যেকটির মধ্যে একটি বিরাট হিকমত তথা প্রজ্ঞা ও তীক্ষ্ণ কর্মকুশলতা সক্রিয় রয়েছে এবং উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোন একটি কাজও হচ্ছে না। যে মহাশক্তি এসব জিনিসকে অস্তিত্ব দান করতে পারে, এদেরকে ধ্বংস করে দেবার এবং ধ্বংস করার পর আবার নতুন করে অন্য আকৃতিতে সৃষ্টি করার তাঁর ক্ষমতা নেই, এ ধরনের কথা এখন কেবলমাত্র একজন মূর্খই বলতে পারে। আর একথাও কেবলমাত্র একজন নির্বোধই বলতে পারে যে, যে জ্ঞানময় সত্তা এই বিশ্ব-জাহানের কোন একটি কাজও বিনা উদ্দেশ্যে করেননি, তিনি নিজের এ জগতে মানুষকে জেনে বুঝে ভালো ও মন্দের পার্থক্য, আনুগত্য ও অবাধ্যতার স্বাধীনতা এবং নিজের অসংখ্য সৃষ্টিকে কাজে লাগাবার ও ইচ্ছা মতো ব্যবহার করার ক্ষমতা বিনা উদ্দেশ্যেই দান করেছেন। একথাও কেবলমাত্র একজন নির্বোধই বলতে পারে। মানুষ তাঁর সৃষ্ট এ জিনিসগুলোকে ভালোভাবে ব্যবহার করুক বা খারাপভাবে উভয় অবস্থায় পরিণাম সমান হবে, একজন ভালো কাজ করতে করতে মারা যাবে, সে মাটিতে মিশে খতম হয়ে যাবে আর একজন খারাপ কাজ করতে করতে মারা যাবে সেও মাটিতে মিশে খতম হয়ে যাবে, যে ভালো কাজ করবে সে তার ভালো কাজের কোন প্রতিদান পাবে না এবং যে খারাপ কাজ করবে সেও তার খারাপ কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে না এবং কোন প্রতিফল পাবে না, এ ধরনের কথা একজন জ্ঞানহীন মানুষই বিশ্বাস করতে পারে। মৃত্যুর পরের জীবন, কিয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কিত এসব যুক্তিই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তাফহীমুল কুরআনের নিম্নোক্ত স্থানগুলো দেখুনঃ আর রা’দঃ ৭ টীকা, আল হাজ্জঃ ৯ টীকা, আর রূমঃ ৬ টীকা, সাবাঃ ১০ ও ১২ টীকা এবং আস সাফফাতঃ ৮ ও ৯ টীকা।
﴿إِنَّ يَوْمَ ٱلْفَصْلِ كَانَ مِيقَـٰتًۭا﴾
১৭। নিঃসন্দেহে বিচারের দিনটি নির্ধারিত হয়েই আছে।
﴿يَوْمَ يُنفَخُ فِى ٱلصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًۭا﴾
১৮। যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তোমরা দলে দলে বের হয়ে আসবে।১২
১২. এখানে শিংগার শেষ ফুঁকের কথা বলা হয়েছে। এর আওয়াজ বুলন্দ হবার সাথে সাথেই সমস্ত মরা মানুষ অকস্মাৎ জেগে উঠবে। “তোমরা বলতে শুধুমাত্র যাদেরকে তখন সম্বোধন করা হয়েছিল তাদের কথা বলা হয়নি বরং সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যতগুলো লোক দুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছে ও করবে তাদের সবার কথা বলা হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইব্রাহীমঃ ৫৭ টীকা, আল হাজ্জঃ ১ টীকা, ইয়াসীনঃ ৪৬ ও ৪৭ টীকা এবং আয যুমারঃ ৭৯ টীকা)।
﴿وَفُتِحَتِ ٱلسَّمَآءُ فَكَانَتْ أَبْوَٰبًۭا﴾
১৯। আকাশ খুলে দেয়া হবে, ফলে তা কেবল দরজার পর দরজায় পরিণত হবে।
﴿وَسُيِّرَتِ ٱلْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا﴾
২০। আর পর্বতমালাকে চলমান করা হবে, ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে।১৩
১৩. এখানে মনে রাখতে হবে, কুরআনের অন্যান্য স্থানের মতো এখানেও একই সাথে কিয়ামতের বিভিন্ন পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে, প্রথম আয়াতটিতে শেষ দফায় শিংগায় ফুঁক দেবার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আর পরবর্তী দু’টি আয়াতে দ্বিতীয় দফায় শিংগায় ফুঁক দোবার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে তাফহীমুল কুরআনের সূরা আল হাক্কার ১০ টীকায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। “আকাশ খুলে দেয়া হবে” এর মানে হচ্ছে উর্ধজগতে কোন বাঁধা ও বন্ধন থাকবে না। সবদিক থেকে সব রকমের আসমানী বালা মুসিবতের এমন বন্যা নেমে আসতে থাকবে যেন মনে হবে তাদের আসার জন্য সমস্ত দরজা খুলে গেছে এবং তাদের বাঁধা দেবার জন্য কোন একটি দরজাও বন্ধ নেই। আর পাহাড়ের চলার ও মরীচিকায় পরিণত হবার মানে হচ্ছে, দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যে পর্বতমালা স্থানচ্যুত হয়ে শুন্যে উড়তে থাকবে। তারপর ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, যেখানে একটু আগে বিশাল পর্বত ছিল সেখানে দেখা যাবে বিশাল বালুর সমুদ্র। এ অবস্থাকে সূরা ত্বাহায় নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ “এরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, সেদিন এ পাহাড় কোথায় চলে যাবে? এদের বলে দাও, আমার রব তাদেরকে ধূলোয় পরিণত করে বাতাসে উড়িয়ে দেবেন এবং যমীনকে এমন একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন যে, তার মধ্যে কোথাও একটুও অসমতল ও উঁচুনীচু জায়গা এবং সামান্যতম ভাঁজও দেখতে পাবে না।” (১০৫-১০৭ আয়াত এবং ৮৩ টীকা)
﴿إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًۭا﴾
২১। আসলে জাহান্নাম একটি ফাঁদ।১৪
১৪. শিকার ধরার উপযোগী করে যে জায়গাটিকে গোপনে তৈরী করা হয় এবং নিজের অজ্ঞাতসারে শিকার যেখানে চলে এসে তার মধ্যে আটকে যায়, তাকেই বলে ফাঁদ। জাহান্নামের ক্ষেত্রে এ শব্দটি ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহাত্মক ভূমিকা অবলম্বন করে তারা জাহান্নামের ভয়ে ভীত না হয়ে দুনিয়ায় এ মনে করে লাফালাফি দাপাদাপি করে ফিরছে যে, আল্লাহর সার্বভৌমত কর্তৃত্ব তাদের জন্য একটি ঢালাও বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে তাদের পাকড়াও হবার কোন আশঙ্কা নেই। কিন্তু জাহান্নাম তাদের জন্য একটি গোপন ফাঁদ যেখানে তারা আকস্মিকভাবে আটকা পড়ে যায় এবং সেখানে থেকে বের হবার আর কোন উপায় থাকে না।
﴿لِّلطَّـٰغِينَ مَـَٔابًۭا﴾
২২। বিদ্রোহীদের আবাস।
﴿لَّـٰبِثِينَ فِيهَآ أَحْقَابًۭا﴾
২৩। সেখানে তারা যুগের পর যুগ পড়ে থাকবে।১৫
১৫. মূলে আহকাব (اَحْقاَبْ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, একের পর এক আগমনকারী দীর্ঘ সময়। এমন একটি ধারাবাহিক যুগ যে, একটি যুগ শেষ হবার পর আর একটি যুগ শুরু হয়ে যায়। এ থেকে লোকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, জান্নাতের জীবন হবে চিরন্তন কিন্তু জাহান্নাম চিরন্তন হবে না। কারণ এ যুগ যতই দীর্ঘ হোক না কেন, এখানে যখন যুগ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তখন এ থেকে একথাই বুঝা যাচ্ছে যে, এ সময় অশেষ ও অফুরন্ত হবে না। বরং একদিন তা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দু’টি কারণে এই যুক্তি ভুল। একঃ আরবীতে ‘হাকব’ শব্দের আভিধানিক অর্থের মধ্যেই এ ভাবধারা রয়েছে যে, একটি হাকবের পিছনে আর একটি হাকব রয়েছে। কাজেই আহকাব অপরিহার্যভাবে এমন যুগের জন্য বলা হবে যা একের পর এক আসতেই থাকবে এবং এমন কোন যুগ হবে না যার পর আর কোন যুগ আসবে না। দুইঃ কোন বিষয় সম্পর্কে কুরআন মজীদের কোন আয়াত থেকে এমন কোন অর্থ গ্রহণ করা নীতিগতভাবে ঠিক নয়, যা সেই একই বিষয় সম্পর্কিত কুরআনের অন্যান্য বর্ণনার সাথে সংঘর্ষশীল হয়। কুরআনের ৩৪ জায়গায় জাহান্নামবাসীদের জন্য ‘খুলুদ’ (চিরন্তন) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তিন জায়গায় কেবল ‘খুলুদ’ বলেই শেষ করা হয়নি বরং তার সাথে ‘আবাদান’ ‘আবাদান’ (চিরকাল) শব্দও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এক জায়গায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, “তারা চাইবে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু তারা কখনো সেখান থেকে বের হতে পারবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব।” (আল মায়িদাহঃ ৩৭) আর এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ “যতদিন পৃথিবী ও আকাশ প্রতিষ্ঠিত আছে ততদিন তারা এ অবস্থায় চিরকাল থাকবে, তবে তোমার রব যদি অন্য কিছু চান।” জান্নাতবাসীদের সম্পর্কেও এ একই কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “যতদিন পৃথিবী ও আকাশ প্রতিষ্ঠিত আছে ততদিন জান্নাতে তারা চিরকাল থাকবে, তবে তোমার রব যদি অন্য কিছু চান।” (হূদঃ ১০৭-১০৮) এই সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর ‘আহকাব’ শব্দের ভিত্তিতে একথা বলার অবকাশ আর কতটুকু থাকে যে, আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণকারীরা জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করবে না বরং কখনো না কখনো তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে?
﴿لَّا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًۭا وَلَا شَرَابًا﴾
২৪। সেখানে তারা গরম পানি ও ক্ষতঝরা ছাড়া১৬
১৬. মূলে গাসসাক (غَسَاق) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হয়ঃ পুঁজ, রক্ত, পুঁজ মেশানো রক্ত এবং চোখ ও গায়ের চামড়া থেকে বিভিন্ন ধরনের কঠোর দৈহিক নির্যাতনের ফলে যেসব রস বের হয়। এছাড়াও এ শব্দটি ভীষণ দুর্গন্ধ ও পঁচে গিয়ে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এমন জিনিসের জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
﴿إِلَّا حَمِيمًۭا وَغَسَّاقًۭا﴾
২৫। কোন রকম ঠাণ্ডা এবং পানযোগ্য কোন জিনিসের স্বাদই পাবে না।
﴿جَزَآءًۭ وِفَاقًا﴾
২৬। (তাদের কার্যকলাপের) পূর্ণ প্রতিফল।
﴿إِنَّهُمْ كَانُوا۟ لَا يَرْجُونَ حِسَابًۭا﴾
২৭। তারা কোন হিসেব-নিকেশের আশা করতো না।
﴿وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَا كِذَّابًۭا﴾
২৮। আমার আয়াত গুলোকে তারা একেবারেই মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।১৭
১৭. এ হচ্ছে তাদের জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব ভোগ করার কারণ। প্রথমত, দুনিয়ায় তারা এ মনে করে জীবন যাপন করতে থাকে যে, আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজেদের আসনের হিসেব পেশ করার সময় কখনো আসবে না। দ্বিতীয়, আল্লাহ নিজের নবীদের মাধ্যমে তাদের হিদায়াতের জন্য যেসব আয়াত পাঠিয়েছিলেন সেগুলো মেনে নিতে তারা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এবং সেগুলোকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করে।
﴿وَكُلَّ شَىْءٍ أَحْصَيْنَـٰهُ كِتَـٰبًۭا﴾
২৯। অথচ প্রত্যেকটি জিনিস আমি গুণে গুণে লিখে রেখেছিলাম।১৮
১৮. অর্থাৎ তাদের সমস্ত কথা ও কাজ, তাদের সব রকমের উঠাবসা-চলাফেরা এমনকি তাদের চিন্তা, মনোভাব, সংকল্প ও উদ্দেশ্যাবলীর পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড আমি তৈরি করে রাখছিলাম। সেই রেকর্ড থেকে কোন কিছুই বাদ যেতে পারেনি। অথচ সেই নির্বোধদের এসবের কোন খবর ছিল না। তারা নিজেদের জায়গায় বসে মনে করছিল, তারা কোন মগের মুল্লুকে বাস করছে, নিজেদের ইচ্ছে মতো তারা এখানে যাচ্ছেতাই করে যাবে এবং তাদের এসব স্বেচ্ছাচারের জন্যে কারোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।
﴿فَذُوقُوا۟ فَلَن نَّزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا﴾
৩০। এখন মজা বুঝ, আমি তোমাদের জন্য আযাব ছাড়া কোন জিনিসে আর কিছুই বাড়াবো না।
﴿إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا﴾
৩১। অবশ্যি মুত্তাকীদের১৯ জন্য সাফল্যের একটি স্থান রয়েছে।
১৯. এখানে মুত্তাকী শব্দটি এমন সব লোকের মোকাবিলায় ব্যবহার করা হয়েছে যারা কিয়ামতের দিন নিজেদের দুনিয়ার কার্যক্রমের হিসেব দেবার কোন ধারণা পোষণ করতো না। এবং যারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই নিশ্চিতভাবেই এ আয়াতে এমন সব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহর আয়াতকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল এবং একথা মনে করে দুনিয়ায় জীবন যাপন করেছিল যে, কিয়ামতের দিন তাদের দুনিয়ায় সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে।
﴿حَدَآئِقَ وَأَعْنَـٰبًۭا﴾
৩২। বাগ-বাগিচা, আঙুর,
﴿وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًۭا﴾
৩৩। নবযৌবনা সমবয়সী তরুণীবৃন্দ২০
২০. এর অর্থ এও হতে পারে যে, তারা পরস্পর সমবয়স্কা হবে। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, তাদেরকে যেসব পুরুষের স্ত্রী হিসেবে দেয়া হবে তারা সে সব স্বামীদের সমবয়স্কা হবে। ইতিপূর্বে সূরা ছোয়াদ-এর ৫২আয়াতে এবং সূরা আল ওয়াকিআ’র ৩৭ আয়াতেও এ বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে।
﴿وَكَأْسًۭا دِهَاقًۭا﴾
৩৪। এবং উচ্ছসিত পানপাত্র।
﴿لَّا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًۭا وَلَا كِذَّٰبًۭا﴾
৩৫। সেখানে তারা শুনবে না কোন বাজে ও মিথ্যা কথা।২১
২১. জান্নাতে মানুষ কোন বাজে, নোংরা, মিথ্যা ও অর্থহীন কথা শুনবে না। মানুষের কান এ থেকে সংরক্ষিত থাকবে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টিকে জান্নাতের বিরাট নিয়ামত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। জান্নাতে কোন কটূকথা ও আজেবাজে গপসপ হবে না। কেউ কারোর সাথে মিথ্যা কথা বলবে না এবং কারোর কথাকে মিথ্যাও বলবে না। দুনিয়ায় গালিগালাজ, মিথ্যা দোষারোপ, অভিযোগ, কুৎসা প্রচার ও অন্যের ওপর মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দেবার যে ব্যাপক প্রচেষ্টা মানুষের সমাজে চলছে তার ছিঁটে ফোটাও সেখানে থাকবে না। (আরো বেশী ব্যাখ্যা জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা মারইয়ামঃ ৩৮ টীকা এবং আল ওয়াকিআ’হঃ ১৩ ও ১৪ টীকা।)
﴿جَزَآءًۭ مِّن رَّبِّكَ عَطَآءً حِسَابًۭا﴾
৩৬। প্রতিদান ও যথেষ্ট পুরস্কার২২ তোমাদের রবের পক্ষ থেকে,
২২. প্রতিদান শব্দের পরে আবার যথেষ্ট পুরস্কার দেবার কথা বলার অর্থ এ দাঁড়াবে যে, তারা নিজেদের সৎকাজের বিনিময়ে যে প্রতিদান লাভের অধিকারী হবে কেবলমাত্র ততটুকুই তাদেরকে দেয়া হবো না বরং তার ওপর অতিরিক্ত পুরস্কার এবং অনেক বেশী পুরস্কার দেয়া হবে। বিপরীত পক্ষে জাহান্নামবাসীদের জন্য কেবলমাত্র এতটুকুই বলা হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। অর্থাৎ তাদের যে পরিমাণ অপরাধ তার চেয়ে বেশী শাস্তি দেয়া হবে না এবং কমও দেয়া হবে না। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সূরা ইউনুসঃ ২৬-২৭ আয়াত, আন নামলঃ ৮৯-৯০ আয়াত, আল কাসাসঃ ৮৪ আয়াত, সাবাঃ ৩৩ আয়াত এবং আল মু’মিনঃ ৪০ আয়াত।
﴿رَّبِّ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ٱلرَّحْمَـٰنِ ۖ لَا يَمْلِكُونَ مِنْهُ خِطَابًۭا﴾
৩৭। সেই পরম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি পৃথিবী ও আকাশসমূহের এবং তাদের মধ্যবর্তী প্রত্যেকটি জিনিসের মালিক, যার সামনে কারো কথা বলার শক্তি থাকবে না।২৩
২৩. অর্থাৎ হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারের শান-শওকত, প্রভাব ও প্রতিপত্তি এমন পর্যায়ের হবে যার ফলে পৃথিবী বা আকাশের আধিবাসী কারোর আল্লাহর সামনে কথা বলার অথবা তাঁর আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার সাহস হবে না।
﴿يَوْمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ صَفًّۭا ۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحْمَـٰنُ وَقَالَ صَوَابًۭا﴾
৩৮। যেদিন রূহ২৪ ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। পরম করুণাময় যাকে অনুমতি দেবেন এবং যে ঠিক কথা বলবে, সে ছাড়া আর কেউ কথা বলবে না।২৫
২৪. অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে এখানে জিব্রাঈল আ. এর কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর দরবারে তিনি উন্নত মর্যাদার অধিকারী হবার কারণে এখানে অন্যান্য ফেরেশতাদের থেকে আলাদাভাবে তাঁর কথা বলা হয়েছে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আল মাআ’রিজঃ ৩ টীকা)
২৫. এখানে কথা বলা মানে শাফায়াত করা বলা হয়েছে, কেবলমাত্র দু’টি শর্ত সাপেক্ষে সেদিন এ শাফায়াত সম্ভব হবে। একঃ যে ব্যক্তিকে যে গুনাহগারের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফায়াত করার অনুমতি দেয়া হবে একমাত্র সে-ই তার জন্য শাফায়াত করতে পারবে। দুইঃ শাফায়াতকারীকে সঠিক ও যথার্থ সত্য কথা বলতে হবে। অন্যায় সুপারিশ করতে পারবে না। দুনিয়ায় কমপক্ষে সত্যের কালেমার সমর্থক অর্থাৎ নিছক গুনাহগার ছিল, কাফের ছিল না, এমন ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করতে হবে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল বাকারাহঃ ২৮১ টীকা, ইউনুসঃ ৫ টীকা, হূদঃ ১০৬ টীকা, মারইয়ামঃ ৫২ টীকা, ত্বা-হাঃ ৮৫-৮৬ টীকা, আল আম্বিয়াঃ ২৭ টীকা, সাবাঃ ৪০-৪১ আল মু’মিনঃ ৩২ টীকা, আয যুখরুফঃ ৬৮ টীকা, আন নাজমঃ ২১ টীকা এবং আল মুদদাসসিরঃ ৩৬ টীকা)
﴿ذَٰلِكَ ٱلْيَوْمُ ٱلْحَقُّ ۖ فَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مَـَٔابًا﴾
৩৯। সেদিনটি নিশ্চিতভাবেই আসবে। এখন যার ইচ্ছা নিজের রবের দিকে ফেরার পথ ধরুক।
﴿إِنَّآ أَنذَرْنَـٰكُمْ عَذَابًۭا قَرِيبًۭا يَوْمَ يَنظُرُ ٱلْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُولُ ٱلْكَافِرُ يَـٰلَيْتَنِى كُنتُ تُرَٰبًۢا﴾
৪০। যে আযাবটি কাছে এসে গেছে সে সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম।২৬ যেদিন মানুষ সেসব কিছুই দেখবে যা তার দু’টি হাত আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে এবং কাফের বলে উঠবে, হায়! আমি যদি মাটি হতাম।২৭
২৬. আপাতদৃষ্টিতে এক ব্যক্তি এখানে একথা চিন্তা করতে পারে যে যাদেরকে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছিল তারা চৌদ্দ শ’ বছর আগে দুনিয়া থেকে চলে গেছে এবং এখনো বলা যেতে পারে না, কিয়ামত আগামী কত শত, হাজার বা লক্ষ বছর পরে আসবে, তাহলে একথাটি কোন অর্থে বলা হয়েছে যে, যে আযাবটি কাছে এসে গেছে সে সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম? তাছাড়া সূরার সূচনায় কেমন করে একথা বলা হলো যে, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে? এর জবাব এই যে মানুষ যতক্ষণ এ দুনিয়ার স্থান ও কালের সীমানায় রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে অবস্থান করে কেবল ততক্ষণই তার মধ্যে সময়ের অনুভূতি থাকে। মরণের পরে যখন শুধুমাত্র রূহই বাকি থেকে যাবে তখন আর সময়ের চেতনা ও অনুভূতি থাকবে না। আর কিয়ামতের দিন মানুষ যখন পুনর্বার জীবিত হয়ে উঠবে তখন তার মনে হবে যেন এখনি ঘুমের মধ্যে কেউ তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার বছর পরে তাকে আবার জীবিত করা হয়েছে, এ অনুভূতির লেশমাত্রও তখন তার মধ্যে থাকবে না। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নামলঃ ২৬ টীকা, বনি ইসরাঈলঃ ৫৬ টীকা, ত্বা-হাঃ ৮০ টীকা এবং ইয়াসীনঃ ৪৮ টীকা)
২৭. অর্থাৎ দুনিয়ায় জন্মই না হতো অথবা মরে গিয়ে মাটিতে মিশে যেতাম এবং আবার জীবিত হয়ে ওঠার সুযোগ না হতো।
— সমাপ্ত —