তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿ٱلْقَارِعَةُ﴾
১। মহাদুর্ঘটনা!১
১. কুরআনের মূল শব্দ হচ্ছে ‘কারিআ’হ’ اَلۡقَارِعَةُۙ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, “যে ঠোকে”। কারাআ’ (قرع) মানে কোন জিনিসকে কোন জিনিসের ওপর এমন জোরে মারা যার ফলে তা থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ হয়। এই শাব্দিক অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও বড় রকমের মারাত্মক বিপদের ক্ষেত্রে ‘কারিআ’হ’ শব্দ বলা হয়ে থাকে। যেমন আরবরা বলে, قَرَعَتهُمُ الْقَا رِعَةُ অর্থাৎ উমুক উমুক পরিবার ও গোত্রের লোকদের ওপর ভয়াবহ বিপদ নেমে এসেছে। কুরআন মজীদের এসব জায়গায়ও এই শব্দটি কোন জাতির ওপর বড় ধরনের মুসিবত নাযিল হবার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা রা’দে বলা হয়েছেঃ وَلاَيَزَ الُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْ اتُصِيْبُهُمْ بِمَا صَنَعُوا قَارِعَةٌ “যারা কুফরী করেছে তাদের ওপর তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে কোন না কোন বিপদ নাযিল হতে থাকে।” (৩১ আয়াত) কিন্তু এখানে “আল কারিআ’হ” শব্দটি কিয়ামতের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আবার সূরা আল হা-ক্কায় কিয়ামতকে এই শব্দটি দিয়েই চিহ্নিত করা হয়েছে। (আয়াতঃ ৪) এখানে একথাটিও সামনে রাখতে হবে যে, এখানে কিয়ামতের প্রথম পর্যায় থেকে নিয়ে শেষ পর্যায় পর্যন্ত পুরো আখেরাতের আলোচনা একসাথে করা হচ্ছে।
﴿مَا ٱلْقَارِعَةُ﴾
২। কী সেই মহাদুর্ঘটনা?
﴿وَمَآ أَدْرَىٰكَ مَا ٱلْقَارِعَةُ﴾
৩। তুমি কি জানো সেই মহাদুর্ঘটনাটি কি?
﴿يَوْمَ يَكُونُ ٱلنَّاسُ كَٱلْفَرَاشِ ٱلْمَبْثُوثِ﴾
৪। সেদিন যখন লোকেরা ছড়িয়ে থাকা পতঙ্গের মতো
﴿وَتَكُونُ ٱلْجِبَالُ كَٱلْعِهْنِ ٱلْمَنفُوشِ﴾
৫। এবং পাহাড়গুলো রং বেরঙের ধূনা পশমের মতো হবে।২
২. এ পর্যন্ত কিয়ামতের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা চলেছে। অর্থাৎ যখন মহাদুর্ঘটনা ঘটে যাবে। আর এর ফলে সারা দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, লোকেরা আতংকগ্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে যেমন আলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া পতঙ্গরা চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পাহাড়গুলো রং বেরঙের ধূনা পশমের মতো উড়তে থাকবে। পাহাড়গুলোর রং বিভিন্ন হওয়ার কারণে আসলে তাদেরকে রং বেরঙের পশমের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
﴿فَأَمَّا مَن ثَقُلَتْ مَوَٰزِينُهُۥ﴾
৬। তারপর৩ যার পাল্লা ভারী হবে
৩. এখান থেকে কেয়ামতের দ্বিতীয় পর্যায় আলোচনা শুরু হয়েছে। লোকেরা পুনর্বার জীবিত হয়ে আল্লাহর আদালতে হাযির হবার পর থেকে এই পর্যায়টি শুরু।
﴿فَهُوَ فِى عِيشَةٍۢ رَّاضِيَةٍۢ﴾
৭। সে মনের মতো সুখী জীবন লাভ করবে
﴿وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَٰزِينُهُۥ﴾
৮। আর যার পাল্লা হালকা হবে৪
৪. মূলে মাওয়াযীন (مَوَازِيۡن) ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি মাওযূন (مَوْزُوْنَ ) এর বহুবচন হতে পারে। আবার মীযান (مِيْزَانَ) এরও বহুবচন হতে পারে। যদি এটি মাওযুনের বহুবচন হয় তাহলে ‘মাওয়াযীন’ অর্থ হবে এমন ধরনের কর্মকাণ্ড, আল্লাহর দৃষ্টিতে যার কোন ওজন আছে এবং যা তাঁর কাছে কোন ধরনের মর্যাদা লাভের যোগ্যতা রাখে। আর যদি একে মীযানের বহুবচন গণ্য করা হয় তাহলে মাওয়াযীন অর্থ হবে দাঁড়িপাল্লার পাল্লা। প্রথম অবস্থায় মাওয়াযীনের ভারী বা হালকা হবার মানে হবে অসৎকর্মের মোকাবিলায় সৎকর্মের ভারী বা হালকা হওয়া। কারণ আল্লাহর দৃষ্টিতে কেবলমাত্র সৎকাজই ভারী ও মূল্যবান। দ্বিতীয় অবস্থায় মাওয়াযীনের ভারী হবার মানে হয় মহান আল্লাহর আদালতে নেকীর পাল্লা পাপের পাল্লার তুলনায় বেশী ভারী হওয়া। আর এর হালকা হবার মানে হয় নেকীর পাল্লা পাপের পাল্লার তুলনায় হালকা হওয়া। এছাড়া আরবী ভাষায় মীযান শব্দ ওজন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আর এই অর্থের দৃষ্টিতে ওজনের ভারী ও হালকা হবার মানে হয় নেকীর ওজন ভারী বা হালকা হওয়া। যাহোক মাওয়াযীন শব্দটি মাওযূন, মীযান বা ওজন যে কোন অর্থেই ব্যবহার করা হোক না কেন সব অবস্থায় প্রতিপাদ্য একই থাকে এবং সেটি হচ্ছেঃ মানুষ আমলের যে পুঁজি নিয়ে আল্লাহর আদালতে আসবে তা ভারী না হালকা অথবা মানুষের নেকী তার পাপের চেয়ে ওজনে বেশী না কম এরই ভিত্তিতে সেখানে ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয়টি কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। সেগুলো সব সামনে রাখলে এর অর্থ পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব হবে। সূরা আল আ’রাফে বলা হয়েছেঃ “আর ওজন হবে সেদিন সত্য। তারপর যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।” (৮-৯ আয়াত) সূরা আল কাহাফে বলা হয়েছেঃ “হে নবী! এই লোকদেরকে বলে দাও, আমি কি তোমাদের জানাবো নিজেদের আমলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী ব্যর্থ কারা? তারাই ব্যর্থ যাদের দুনিয়ার জীবনে সমস্ত কর্মকাণ্ড সত্য সঠিক পথ থেকে বিচ্যূত থেকেছে এবং যারা মনে করতে থেকেছে, তারা সবকিছু ঠিক করে যাচ্ছে। এই লোকেরাই তাদের রবের আয়াত মানতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর সামনে হাযির হওয়ার বিষয়টি বিশ্বাস করেনি। তাই তাদের সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে গেছে। কিয়ামতের দিন আমি তাদের কোন ওজন দেবো না।” (১০৪-১০৫ আয়াত) সূরা আম্বিয়ায় বলা হয়েছেঃ “কিয়ামতের দিন আমি যথাযথ ওজন করার দাঁড়িপাল্লা রেখে দেবো। তারপর কারো ওপর অণু পরিমাণও জুলুম হবে না। যার সরিষার দানার পরিমাণও কোন কাজ থাকবে তাও আমি সামনে আনবো এবং হিসেব করার জন্য আমি যথেষ্ট।” (৪৭ আয়াত) এই আয়াতগুলো থেকে জানা যায়, কুফরী করা এবং সত্যকে অস্বীকার করা বৃহত্তম অসৎকাজের অন্তর্ভুক্ত। গুনাহের পাল্লা তাতে অনিবার্যভাবে ভারী হয়ে যায়। আর কাফেরের এমন কোন নেকী হবে না নেকীর পাল্লায় যার কোন ওজন ধরা পড়ে এবং তার ফলে পাল্লা ঝুঁকে পড়তে পারে। তবে মু’মিনের পাল্লায় ঈমানের ওজনও হবে এবং এই সঙ্গে সে দুনিয়ায় যেসব নেকী করেছে সেগুলোর ওজনও হবে। অন্যদিকে তার সমস্ত গোনাহ গোনাহর পাল্লায় রেখে দেয়া হবে। তারপর নেকীর পাল্লা ঝুঁকে আছে না গোনাহর পাল্লা ঝুঁকে আছে, তা দেখা হবে।
﴿فَأُمُّهُۥ هَاوِيَةٌۭ﴾
৯। তার আবাস হবে গভীর খাদ।৫
৫. মূল শব্দ হচ্ছে اُمُّه هَاوِيَةٌ “তার মা হবে হাবিয়া।” হাবিয়া (هَاوِيَةٌ) শব্দটি এসেছে হাওয়া (هَاوىْ) থেকে। এর অর্থ হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে নীচুতে পড়ে যাওয়া। আর যে গভীর গর্তে কোন জিনিস পড়ে যায় তাকে হাবিয়া বলে। জাহান্নামকে হাবিয়া বলার কারণ হচ্ছে এই যে, জাহান্নাম হবে অত্যন্ত গভীর এবং জাহান্নামবাসীদেরকে তার মধ্যে ওপর থেকে নিক্ষেপ করা হবে। আর তার মা হবে জাহান্নাম একথা বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, মায়ের কোল যেমন শিশুর অবস্থান হয় তেমনি জাহান্নামবাসীদের জন্য জাহান্নাম ছাড়া আর কোন অবস্থান হবে না।
﴿وَمَآ أَدْرَىٰكَ مَا هِيَهْ﴾
১০। আর তুমি কি জানো সেটি কি?
﴿نَارٌ حَامِيَةٌۢ﴾
১১। (সেটি) জ্বলন্ত আগুন। ৬
৬. অর্থাৎ সেটি শুধুমাত্র একটি গভীর খাদ হবে না বরং জ্বলন্ত আগুনেও পরিপূর্ণ হবে।
— সমাপ্ত —
১০২. সূরা আত তাকাসুর