তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ ۚ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ﴾
১। হে মানব জাতি! তোমাদের রবের গযব থেকে বাঁচো। আসলে কিয়ামতের প্রকম্পন বড়ই (ভয়ংকর) জিনিস।১
১. এ প্রকম্পন হবে কিয়ামতের প্রাথমিক অবস্থার প্রকাশ আর সম্ভবত এটা এমন সময় শুরু হবে যাখন যমীন অকস্মাৎ উল্টে পড়তে শুরু করবে এবং সূর্য পূর্ব দিকের পরিবর্তে পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। একথাই বর্ণনা করেছেন প্রাচীন তাফসীরকারদের মধ্য থেকে আলকামাহ ও শা’বী। তারা বলেছেনঃ يكون ذلك عند طلوع الشمس من مغربها ইবনে জারীর, তাবারানী, ইবনে আবী হাতেম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হযরত আবু হুরাইরারা.থেকে যে দীর্ঘ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তা থেকে একথাটিই জানা যায়। সেখানে নবী সা. বলেছেনঃ তিনবার সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। এক ফুঁক হবে “ফাযা” তথা ভীতি উৎপাদনকারী, দ্বিতীয় ফূঁক “সা‘আক” তথা সংজ্ঞা লোপকারী বিকট গর্জন এবং তৃতীয় ফুঁক হবে “কিয়াম লি-রাব্বিল আলামীন” অর্থাৎ রাব্বুল আলামীনের সামনে হাজির হবার ফূঁক। প্রথম ফুঁকটি সাধারণ বিভীষিকার সৃষ্টি করবে এবং মানুষ হতভম্ভ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ফুঁকে সবাই মরে পড়ে যাবে। তৃতীয় ফুঁকের পর সবাই জীবিত হয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। তারপর প্রথম ফুঁকের বিস্তারিত অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, সে সময় পৃথিবীর অবস্থা হবে এমন একটি নৌকার মতো যা ঢেউয়ের আঘাতে টলমল করছে অথবা এমন ঝুলন্ত প্রদীপের মতো যা বাতাসের ঝটকায় প্রচণ্ডভাবে দুলছে। সে সময় পৃথিবী পৃষ্ঠে বসতকারীরা যে অবস্থার সম্মুখীন হবে তার চিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে অংকন করা হয়েছে। যেমনঃ
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ، وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً، فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ
“যখন সিংগায় এক ফুঁক দেয়া হবে এবং যমীন ও পাহাড় তুলে এক আঘাতে ভেঙে দেয়া হবে তখন সে বিরাট ঘটনাটি ঘটে যাবে।” (আল হাক্কাহঃ ১৩-১৫)
إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا، وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا، وَقَالَ الْإِنسَانُ مَا لَهَا
“যখন পৃথিবীকে পুরোপুরি প্রকম্পিত করে দেয়া হবে এবং সে তার পেটের বোঝা বের করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে আর মানুষ বলবে, এর কি হলো?” (আয যিলযালঃ ১-৩)
يَوْمَ تَرْجُفُ الرَّاجِفَةُ، تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ، قُلُوبٌ يَوْمَئِذٍ وَاجِفَةٌ، أَبْصَارُهَا خَاشِعَةٌ
“যেদিন প্রকম্পনের একটি ঝটকা একেবারে নাড়িয়ে দেবে এবং এরপর আসবে দ্বিতীয় ঝটকা। সেদিন অন্তর কাঁপতে থাকবে এবং দৃষ্টি ভীতি বিহ্বল হবে।” (আন নাযিআ’তঃ ৫-৯)
إِذَا رُجَّتِ الْأَرْضُ رَجًّا، وَبُسَّتِ الْجِبَالُ بَسًّا، فَكَانَتْ هَبَاءً مُّنبَثًّا
“যে দিন পৃথিবীকে মারাত্মকভাবে ঝাঁকিয়ে দেয়া হবে এবং পাহাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধূলির মতো উড়তে থাকবে।” (আল ওয়াকিআ’হঃ ৪-৬)
فَكَيْفَ تَتَّقُونَ إِن كَفَرْتُمْ يَوْمًا يَجْعَلُ الْوِلْدَانَ شِيبًا، السَّمَاءُ مُنفَطِرٌ بِهِ
“যদি তোমরা নবীর কথা না মানো, তাহলে কেমন করে রক্ষা পাবে সেদিনের বিপদ থেকে, যা বাচ্চাদেরকে বুড়া করে দেবে এবং যার প্রচণ্ডতায় আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে যাবে?” (আল মুযযাম্মিলঃ ১৭-১৮)
যদিও কোন কোন মোফাসসিরের মতে এ কম্পনটি হবে এমন সময়ে যখন মৃতরা জীবিত হয়ে নিজেদের রবের সামনে হাজির হবে, এবং এর সমর্থনে তাঁরা একাধিক হাদীসও উদ্ধৃত করেছেন তবুও কুরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনা এব হাদীস গ্রহণ করার পথে বাধা। কুরআন এর যে সময় বর্ণনা করেছে তা হচ্ছে এমন এক সময় যখন মায়েরা শিশু সন্তানদের দুধ পান করাতে করাতে তাদেরকে ফেলে রেখে পালাতে থাকবে এবং গর্ভবতীদের গর্ভপাত হয়ে যাবে। এখন একথা সুষ্পষ্ট যে, আখেরাতের জীবনে কোন মাহিলা তার শিশুকে দুধ পান করাবে না এবং কোন গর্ভবতীর গর্ভপাত হবার কোন সুযোগও সেখানে থাকবে না। কারণ, কুরআনের সুষ্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী সেখানে সবরকমের সম্পর্ক খতম হয়ে যাবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত মর্যাদা নিয়ে আল্লাহর সামনে হিসেব দিতে দাঁড়াবে। কাজেই আমি পূর্বেই যে হাদীস উদ্ধৃত করেছি সেটিই অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য। যদিও তার বর্ণনা পরম্পরা দুর্বল কিন্তু কুরআনের সমর্থন তার দুর্বলতা দূর করে দেয়। অন্যদিকে অন্যান্য হাদীসগুলো বর্ণনা পরম্পরার দিক দিয়ে বেশী শক্তিশালী হলেও কুরআনের বর্ণনার সাথে গরমিল থাকায় এগুলোকে দুর্বল করে দেয়।
﴿يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَىٰ وَمَا هُم بِسُكَارَىٰ وَلَٰكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ﴾
২। যেদিন তোমরা তা দেখবে, অবস্থা এমন হবে যে, প্রত্যেক দুধদানকারিনী নিজের দুধের বাচ্চাকে ভুলে যাবে,২ প্রত্যেক গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে এবং মানুষকে তোমরা মাতাল দেখবে অথচ তারা নেশাগ্রস্ত হবে না। আসলে আল্লাহর আযাবই হবে এমনি কঠিন।৩
২. আয়াতে مُرْضِعْ এর পরিবর্তে مُرْضِعَةٍ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষার দিক দিয়ে উভয় শব্দের অর্থের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, مُرْضِعْ অর্থ হচ্ছে যে দুধ পান করায়। এবং مُرْضِعَةٍ এমন অবস্থাকে বলা হয় যখন কার্যত সে দুধ পান করাতে থাকে এবং শিশু তার স্তন মুখের মধ্যে নিয়ে থাকে। কাজেই এখানে যে চবিটি আঁকা হয়েছে সেটি হচ্ছে এই যে, যখন কিয়ামতের সে কম্পন শুরু হবে, মায়েরা নিজেদের শিশুসন্তানদেরকে দুধ পান করাতে করাতে ফেলে দিকে পালাতে থাকবে এবং নিজের কলিজার টুকরার কি হলো, একথা কোন মায়ের মনেও থাকবে না।
৩. একথা সুস্পষ্ট যে, এখানে কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করা বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য নয়। বরং আল্লাহর আযাবের ভয় দেখিয়ে তাঁর গযবের কারণ হয় এমন সব কাজ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেয়াই উদ্দেশ্য। এজন্য কিয়ামতের এ সংক্ষিপ্ত অবস্থা বর্ণনার পর সামনের দিকে আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয়েছে।
﴿وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيدٍ﴾
৩। কতক লোক এমন আছে যারা জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করে ৪ এবং প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের অনুসরণ করতে থাকে।
৪. সামনের দিকের ভাষণ থেকে জানা যায়, এখানে আল্লাহ সম্পর্কে তাদের যে বিতর্কের ওপর আলোচনা করা হচ্ছে তা আল্লাহর সত্তার ও তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কিত নয় বরং তাঁর অধিকার ও ক্ষমতা-ইখতিয়ার এবং তাঁর পাঠানো শিক্ষাবলী সম্পর্কিত ছিল। নবী সা. তাদের কাছ থেকে তাওহীদ ও আখেরাতের স্বীকৃতি চাচ্ছিলেন। এ বিষয়েই তিনি তাদের সাথে বিতর্ক করতেন। এ দু’টি বিশ্বাসের ওপর বিতর্ক শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে ঠেকতো তা এই ছিল যে, আল্লাহ কি করতে পারেন এবং কি করতে পারেন না, তাছাড়া এ বিশ্ব-জাহানের প্রভুত্বের কর্তৃত্ব কি শুধুমাত্র এক আল্লাহরই হাতে ন্যস্ত অথবা অন্য কতক সত্তারও এখানে প্রভুত্বের কর্তৃত্ব আছে।
﴿كُتِبَ عَلَيْهِ أَنَّهُ مَن تَوَلَّاهُ فَأَنَّهُ يُضِلُّهُ وَيَهْدِيهِ إِلَىٰ عَذَابِ السَّعِيرِ﴾
৪। অথচ তার ভাগ্যেই তো এটা লেখা আছে যে, যে ব্যক্তি তার সাথে বন্ধুত্ব করবে তাকে সে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে এবং জাহান্নামের আযাবের পথ দেখিয়ে দেবে।
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن تُرَابٍ ثُمَّ مِن نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِن مُّضْغَةٍ مُّخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِّنُبَيِّنَ لَكُمْ ۚ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ ۖ وَمِنكُم مَّن يُتَوَفَّىٰ وَمِنكُم مَّن يُرَدُّ إِلَىٰ أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِن بَعْدِ عِلْمٍ شَيْئًا ۚ وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَا أَنزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنبَتَتْ مِن كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ﴾
৫। হে লোকেরা! যদি তোমাদের মৃত্যু পরের জীবনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে তোমরা জেনে রাখো, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে,৫ তারপর রক্তপিণ্ড থেকে, তারপর গোশতের টুকরা থেকে, যা আকৃতি বিশিষ্টও হয় এবং আকৃতিহীনও।৬ (এ আমি বলছি) তোমাদের কাছে সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য। আমি যে শুক্রকে চাই একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত গর্ভাশয়ে স্থিত রাখি, তারপর একটি শিশুর আকারে তোমাদের বের করে আনি, (তারপর তোমাদের প্রতিপালন করি) যাতে তোমরা নিজেদের পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে যাও। আর তোমাদের কাউকে কাউকে তার পূর্বেই ডেকে ফিরিয়ে নেয়া হয় এবং কাউকে হীনতম বয়সের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, যাতে সবকিছু জানার পর আবার কিছুই না জানে।৭ আর তোমরা দেখছো যমীন বিশুষ্ক পড়ে আছে তারপর যখনই আমি তার ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেছি তখনই সে সবুজ শ্যামল হয়েছে, স্ফীত হয়ে উঠেছে এবং সব রকমের সুদৃশ্য উদ্ভিদ উদগত করতে শুরু করেছে।
৫. এর অর্থ হচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষ এমন একটি উপাদান থেকে তৈরি হয় যার সবটুকুই গৃহীত হয় মাটি থেকে এবং এ সৃজন প্রক্রিয়ার সূচনা হয় শুক্র থেকে। অথবা মানব প্রজাতির সূচনা হয়েছে আদম আ. থেকে। তাঁকে সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তারপর পরবর্তী পর্যায়ে শুক্র থেকেই মানব বংশের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। যেমন সূরা সিজদায় বলা হয়েছেঃ
وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنسَانِ مِن طِينٍ، ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِن سُلَالَةٍ مِّن مَّاءٍ مَّهِينٍ
“মানুষের সৃষ্টি শুরু করেন মাটি থেকে তারপর তার বংশ-ধারা চালান একটি নির্যাস থেকে যা বের হয় তুচ্ছ পানির আকারে।” (আস সাজদাহঃ ৭-৮)
৬. এখানে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ ও বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করতে থাকে সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। আজকাল শুধুমাত্র শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তাদের বিভিন্ন স্তরের যেসব বিস্তারিত বিষয়াবলী দৃষ্টিগোচর হতে পারে সেগুলো বর্ণনা করা হয়নি। বরং সেকালের সাধারণ বদ্দুরাও যেসব বড় বড় সুস্পষ্ট পরিবর্তনের কথা জানতো সেগুলো এখানে বলা হয়েছে। অর্থাৎ শুক্র গর্ভাশয়ে প্রবেশ করে স্থিতি লাভ করার পর প্রথমে জমাট রক্তের একটি পিণ্ড হয়। তারপর তা একটি গোশতের টুকরায় পরিবর্তিত হয়। এ অবস্থায় কোন আকৃতি সৃষ্টি হয় না। এরপর সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে মানবিক আকৃতি সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। গর্ভপাতের বিভিন্ন অবস্থায় যেহেতু মানব সৃষ্টির এসব পর্যায় লোকেরা প্রত্যক্ষ করতো তাই এদিকে ইংগিত করা হয়েছে। এটি বুঝার জন্য সেদিন ভ্রুণতত্বের বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন ছিল না, আজো নেই।
৭. অর্থাৎ এমন বৃদ্ধাবস্থা যখন মানুষের নিজের শরীরের ও অংগ-প্রত্যংগের কোন খোঁজ-খবর থাকে না। যে ব্যক্তি অন্যদেরকে জ্ঞান দিতো বুড়ো হয়ে সে এমন অবস্থায় পৌঁছে যায়, যাকে শিশুদের অবস্থার সাথে তুলনা করা যায়। যে জ্ঞান, জানা শোনা, অভিজ্ঞাতা ও দুরদর্শিতা ছিল তার গর্বের বস্তু তা এমনই অজ্ঞতায় পরিবর্তিত হয়ে যায় যে, একটি ছোট ছেলেও তার কথায় হাসতে থাকে।
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّهُ يُحْيِي الْمَوْتَىٰ وَأَنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
৬। এসব কিছু এজন্য যে, আল্লাহ সত্য,৮ তিনি মৃতদেরকে জীবিত করেন এবং তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।
৮. এ ধারাবাহিক বক্তব্যের মধ্যে এ বাক্যাংশটি তিনটি অর্থ হয়।
একঃ আল্লাহই সত্য এবং মৃত্যুর পর পুনরায় জীবনদানের কোন সম্ভাবনা নেই, —তোমাদের এ ধারণা ডাহা মিথ্যা।
দুইঃ আল্লাহর অস্তিত্ব নিছক কাল্পনিক নয়। কতিপয় বুদ্ধিবৃত্তিক জটিলতা দূর করার জন্য এ ধারণা গ্রহণ করা হয়নি। তিনি নিছক দার্শনিকদের চিন্তার আবিস্কার, অনিবার্য সত্তার ও সকল কার্যকারণের প্রথম কারণই (First Cause) নয় বরং তিনি প্রকৃত স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন কর্তা, যিনি প্রতি মুহূর্তে নিজের শক্তিমত্তা, সংকল্প, জ্ঞান ও কলা-কৌশলের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব-জাহান ও এর প্রতিটি বস্তু পরিচালনা করছেন।
তিনঃ তিনি কোন খেলোয়াড় নন যে, নিছক মন ভুলাবার জন্য খেলনা তৈরি করেন এবং তারপর অযথা তা ভেঙে চুরে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। বরং তিনি সত্য তাঁর যাবতীয় কাজ গুরুত্বপূর্ণ, উদ্দেশ্যমূলক ও বিজ্ঞানময়।
﴿وَأَنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ لَّا رَيْبَ فِيهَا وَأَنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ مَن فِي الْقُبُورِ﴾
৭। আর এ (একথার প্রমাণ) যে, কিয়ামতের সময় অবশ্যই আসবে, এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে উঠাবেন যারা কবরে চলে গেছে।৯
৯. এ আয়াত গুলোতে মানুষের জন্মের বিভিন্ন পর্যায়, মাটির ওপর বৃষ্টির প্রভাব এবং উদ্ধদ উৎপাদনকে পাঁচটি সত্য নির্ণয়ের প্রমাণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে সে সত্যগুলো হচ্ছেঃ
একঃ আল্লাহই সত্য।
দুইঃ তিনি মৃতকে জীবিত করেন।
তিনঃ তিনি সর্বশক্তিমান।
চারঃ কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবেই।
পাঁচঃ যারা মরে গেছে আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সবাইকে জীবিত করে উঠাবেন।
এখন দেখুন এ নিদর্শনগুলো এ পাঁচটি সত্যকে কিভাবে চিহ্নিত করে।
সমগ্র বিশ্ব-ব্যবস্থার কথা বাদ দিয়ে মানুষ যদি শুধুমাত্র নিজেরই জন্মের ওপর চিন্তা-ভাবনা করে, তাহলে জানতে পারবে যে, এক একটি মানুষের অস্তিত্বের মধ্যে আল্লাহর প্রকৃত ও বাস্তব ব্যবস্থাপনা ও কলা-কৌশল সর্বক্ষণ সক্রিয় রয়েছে। প্রত্যেকের অস্তিত্ব, বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ই তাঁর স্বেচ্ছামূলক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই স্থিরীকৃত হয়। একদল বলে, একটা অন্ধ, বধির এবং জ্ঞান ও সংকল্পহীন প্রকৃতি একটা ধরাবাঁধা আইনের ভিত্তিতে এসব কিছু চালাচ্ছে। কিন্তু তারা চোখ মেলে তাকালে দেখতে পাবে যে, এক একটি মানুষ যেভাবে অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপর যেভাবে অস্তিত্বের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে, তার মধ্যে একজন অতিশয় জ্ঞানী ও একচ্ছত্র শক্তিশালী সত্তার ইচ্ছামূলক সিদ্ধান্ত কেমন সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ যে খাদ্য খায়, তার মধ্যে কোথাও মানবিক বীজ লুকিয়ে থাকে না এবং তার মধ্যে এমন কোন জিনিস থাকে না যা মানবিক প্রাণের বৈশিষ্ট সৃষ্টি করে। এ খাদ্য শরীরে গিয়ে কোথাও চুল, কোথাও গোশত এবং কোথাও হাড়ে পরিণত হয়, আবার একটি বিশেষ স্থানে পৌঁছে এবং খাদ্যই এমন শুক্রে পরিণত হয়, যার মধ্যে মানুষে পরিণত হবার যোগ্যতার অধিকারী বীজ থাকে। এ বীজগুলোর সংখ্যা এত অগণিত যে, একজন পুরুষ থেকে একবারে যে শুক্র নির্গত হয় তার মধ্যে কয়েক কোটি শুক্রকীট পাওয়া যায় এবং এবং তাদের প্রত্যেকেই স্ত্রী-ডিম্বের সাথে মিলে মানুষের রূপ লাভ করার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু একজন জ্ঞানী, সর্বশক্তিমান ও একচ্ছত্র শাসকের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এ অসংখ্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে মাত্র একজনকে কোন বিশেষ সময় ছাটাই বাছাই করে এনে স্ত্রী-ডিম্বের সাথে মিলনের সুযোগ দেয়া হয় এবং এভাবে গর্ভধারণ প্রক্রিয়া চলে। তারপর গর্ভধারণের সময় পুরুষের শুক্রকীট ও স্ত্রীর ডিম্বকোষের (Egg cell) মিলনের ফলে প্রথমদিকে যে জিনিসটি তৈরি হয় তা এত ছোট হয যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা সম্ভব নয়। এ ক্ষুদ্র জিনিসটি নয় মাস ও কয়েক দিন গর্ভাশয়ে লালিত হয়ে যে অসংখ্য স্তর অতিক্রম করে একটি জ্বলজ্যান্ত মানুষের রূপ গ্রহণ করে তার মধ্য থেকে প্রতিটি স্তরের কথা চিন্তা করলে মানুষের মন নিজেই সাক্ষ্য দেবে যে, এখানে প্রতি মুহূর্তে একজন সদা তৎপর বিচক্ষণ জ্ঞানীর ইচ্ছামূলক সিদ্ধান্ত কাজ করে চলছে। তিনিই সিদ্ধান্ত দেন, কাকে পূর্ণতায় পৌঁছাবেন এবং কাকে রক্তপিণ্ডে অথবা গোশতের টুকরায় কিংবা অসম্পূর্ণ শিশুর আকারে খতম করে দেবেন। তিনিই সিদ্ধান্ত নেন, কাকে জীবিত বের করবেন এবং কাকে মৃত। কাকে সাধারণ মানবিক আকার আকৃতিতে বের করে আনবেন এবং কাকে অসংখ্য অস্বাভাবিক আকারের মধ্য থেকে কোন একটি আকার দান করবেন। কাকে পূর্ণাংগ মানবিক অবয়ব দান করবেন আবার কাকে অন্ধ, বোবা, বধির বা লুলা ও পংগু বানিয়ে বের করে আনবেন। কাকে সুন্দর করবেন এবং কাকে কুৎসিত। কাকে পুরুষ করবেন এবং কাকে নারী। কাকে উচ্চ পর্যায়ের শক্তি ও যোগ্যতা দিয়ে পাঠাবেন এবং কাকে নির্বোধ ও বেকুফ করে সৃষ্টি করবেন। সৃজন ও আকৃতিদানের এই কাজটি প্রতিদিন কোটি কোটি নারীর গর্ভাশয়ে চলছে। এর মাঝখানে কোন সময় কোন পর্যায়েও এক আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোন শক্তি সামান্যতমও প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। অথচ মানব সন্তানদের কমপক্ষে শতকারা ৯০ জনের ভাগ্যের ফায়সালা এই স্তরগুলোতেই হয়ে যায় এবং এখানেই কেবল ব্যক্তিদেরই নয় জাতিসমূহেরও, এমনকি সমগ্র মানব জাতির ভবিষ্যতের ভাঙাগড়া সম্পন্ন হয়। এরপর যেসব শিশু দুনিয়ায় আসে তাদের কাকে প্রথম শ্বাস নেবার পরই মরে যেতে হবে, কাকে বড় হয়ে যুবক হতে হবে এবং কার যৌবনের পর বার্ধক্যের পাট চুকাতে হবে? তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে কে এ সিদ্ধান্ত নেয়? এখানেও একটি প্রবল ইচ্ছা কার্যকর দেখা যায়। গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা করলে অনুভব করা যাবে তাঁর কর্মতৎপরতা কোন বিশ্বজনীন ব্যবস্থাপনা ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে এবং এরি ভিত্তিতে তিনি কেবল ব্যক্তিদেরই নয়, জাতির ও দেশের ভাগ্যের ফায়সালা করছেন। এসব কিছু দেখার পরও যদি আল্লাহ “সত্য” এবং একমাত্র আল্লাহই “সত্য” এ ব্যাপারে কেউ সন্দেহ পোষণ করে তাহলে নিসন্দেহে সে বুদ্ধিভ্রষ্ট।
দ্বিতীয় যে কথাটি এ নিদর্শনগুলো থেকে প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে এই যে, “আল্লাহ মৃতদেরকে জীবিত করেন,” আল্লাহ কখনো মৃতদেরকে জীবিত করবেন, একথা শুনে লোকেরা অবাক হয়ে যায়। কিন্তু তারা চোখ মেলে তাকালে দেখতে পাবে তিনি তো প্রতি মুহূর্তে মৃতকে জীবিত করছেন। যেসব উপদান থেকে মানুষের শরীর গঠিত হয়েছে এবং যেসব খাদ্যে সে প্রতিপালিত হচ্ছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর মধ্যে রয়েছে কয়লা, লোহা, চূন, কিছু লবনজাত উপাদন ও কিছু বায়ূ এবং এ ধরনের আরো কিছু জিনিস। এর মধ্যে কোন জিনিসেও জীবন ও মানবাত্মার বৈশিষ্টের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এসব মৃত, র্নিজীব উপাদনগুলোই একত্র করে তাকে একটি জীবিত ও প্রাণময় অস্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে। তারপর এসব উপাদান সম্বলিত খাদ্য মানুষের দেহে পরিবেশিত হয় এবং সেখানে এর সাহায্যে পুরুষের মধ্যে এমন শুক্রকীট এবং নারীর মধ্যে এমন ডিম্বকোষের সৃষ্টি হয় যাদের মিলনের ফলে প্রতিদিন জীবন্ত ও প্রাণময় মানুষ তৈরি হয়ে বের হয়ে আসছে। এরপর নিজের আশপাশের মাটির ওপরও একবার নজর বুলিয়ে নিন। পাখি ও বায়ূ অসংখ্য জিনিসের বীজ চারদিকে ছড়িয়ে রেখেছিল এবং অষংখ্য জিনিসের মূল এখানে সেখানে মাটির সাথে মিশে পড়েছিল। তাদের করো মধ্যেও উদ্ভিদ জীবনের সামান্যতম লক্ষণও ছিল না। মানুষের চারপাশের বিশুষ্ক জমি এ লাখো লাখো মৃতের কবরে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু যখনই এদের ওপর পড়লো পানির একটি ফোঁটা, অমনি চারদিকে জেগে উঠলো জীবনের বিপুল সমারোহ। প্রত্যেকটি মৃত বৃক্ষমূল তার কবর থেকে মাথা উঁচু করলো এবং প্রত্যেকটি নিষ্প্রাণ বীজ একটি জীবন্ত চারাগাছের রূপ ধারণ করলো। এ মৃতকে জীবিত করার মহড়া প্রত্যেক বর্ষা ঋতুতে মানুষের চোখের সামনে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এ নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ থেকে তৃতীয় যে জিনিসটি প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে এই যে, “আল্লাহ সর্বশক্তিমান।” সমগ্র বিশ্ব-জাহানের কথা বাদ দিন শুধুমাত্র আমাদের এই ক্ষুদ্র পৃথিবীটির কথাই ধরা যাক। আর পৃথিবীরও সমস্ত তত্ত্ব ও ঘটনাবলীর কথা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মানুষ ও উদ্ভিদেরই জীবনধারা বিশ্লষণ করা যাক। এখানে তাঁর শক্তিমত্তার যে অভাবনীয় কর্মকাণ্ড দেখা যায় সেগুলো দেখার পর কি কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তি একথা বলতে পারেন যে, আজ আমরা আল্লাহকে যাকিছু করতে দেখছি তিনি কেবল অতটুকুই করতে পারেন এবং কাল যদি তিনি কারো কিছু করতে চান তাহলে করতে পারবেন না? আল্লাহ তো তবুও অনেক বড় ও উন্নত সত্তা, মানুষের সম্পর্কেও বিগত শতক পর্যন্ত লোকেরা ধারণা ছিল যে, এরা শুধুমাত্র মাটির ওপর চলাচলকারী গাড়িই তৈরি করতে পারে বাতাসে উড়ে চলা গাড়ি তৈরী করার ক্ষমতা এর নেই। কিন্তু আজকের উড়োজাহাজগুলো জানিয়ে দিয়েছে যে, মানুষের “সম্ভাবনা”র সীমানা নির্ধারণ করার ব্যাপারে তাদের ধারণা কত ভুল ছিল। আজ যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর আজকের কাজগুলো দেখে তাঁর জন্য সম্ভাবনার কিছু সীমানা নির্ধারণ করে দিয়ে বলতে থাকে যে, তিনি যাকিছু করছেন এছাড়া আর কিছু করতে পারেন না, তাহলে সে শুধুমাত্র নিজেরই মনের সংকীর্ণতার প্রমাণ দেয়, আল্লাহর শক্তি তার বেঁধে দেয়া সীমানার মধ্যে আটকে থাকতে পারে না।
চতুর্থ ও পঞ্চম কথা অর্থাৎ “কিয়ামতের দিন আসবেই” এবং আল্লাহ অবশ্যই মৃত লোকদেরকে জীবিত করে উঠাবেন”-এ কথা দু’টি উপরে আলোচিত তিনটি কথার যৌক্তিক পরিণতি। আল্লাহর কাজগুলোকে তাঁর শক্তিমত্তার দিক দিয়ে দেখলে মন সাক্ষ্য দেবে যে, তিনি যখনই চাইবেন সকল মৃতকে আবার জীবিত করতে পারবেন, ইতিপূর্বে যাদের অস্তিত্ব ছিল না, তাদেরকে তিনি অস্তিত্ব দান করেছিলেন। আর যদি তাঁর কার্যাবলীকে তাঁর প্রজ্ঞার দিক দিয়ে দেখা যায় তাহলে বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষ্য দেবে যে, এ দু’টি কাজও তিনি অবশ্যই করবেন। কারণ, এগুলো ছাড়া যুক্তির দাবী পূর্ণ হয় না এবং একজন প্রাজ্ঞ সত্তা এ দাবী পূর্ণ করবেন না, এটা অসম্ভব ব্যাপার। মানুষ যে সীমিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করছে তার ফল আমরা দেখি যে, সে যখনই নিজের টাকাপয়সা, সম্পত্তি বা ব্যবসা-বাণিজ্য কারো হাতে সোপর্দ করে দেয় তার কাছ থেকে কোন না কোন পর্যায়ে হিসেব অবশ্যই নেয়। অর্থাৎ আমানত ও হিসেব-নিকেশের মধ্যে যেন একটি অনিবার্য যৌক্তিক সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের সীমিত প্রজ্ঞাও কোন অবস্থায় এ সম্পর্ককে উপেক্ষা করতে পারে না। তারপর এ প্রজ্ঞার ভিত্তিতে মানুষ ইচ্ছাকৃত কাজ ও অনিচ্ছাকৃত কাজের মধ্যে ফারাক করে থাকে। ইচ্ছাকৃত কাজের সাথে নৈতিক দায়িত্বের ধারণা সম্পৃক্ত করে। কাজের মধ্যে ভালো-মন্দের পার্থক্য করে। ভালো কাজের ফল হিসেবে প্রশংসা ও পুরস্কার পেতে চায় এবং মন্দ কাজের দরুন শাস্তি দাবী করে। এমনকি এ উদ্দেশ্যে নিজেরাই একটি বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলে। যে স্রষ্টা করেছেন তিনি নিজে এ প্রজ্ঞা হারিয়ে ফেলবেন একথা কি কল্পনা করা যেতে পারে? একথা কি মেনে নেয়া যায় যে, নিজের এত বড় দুনিয়াটা এত বিপুল সাজ-সরঞ্জাম ও ব্যাপক ক্ষমতা সহকারে মানুষের হাতে সোপর্দ করার পর তিনি ভুলে গেছেন এবং এর হিসেব কখনো নেবেন না? কোন সুস্থ বোধসম্পন্ন মানুষের বুদ্ধি কি সাক্ষ্য দিতে পারে যে, মানুষের যে সমস্ত খারাপ কাজ শাস্তির হাত থেকে বেঁচে যায় অথবা যেসব খারাপ কাজের উপযুক্ত শাস্তি তাকে দেয়া যেতে পারেনি, সেগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কখনো আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে না, এবং যেসব ভালো কাজ তাদের ন্যায়সংগত পুরস্কার থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে সেগুলো চিরকাল বঞ্চিতই থেকে যাবে? যদি এমনটি না হয়ে থাকে, তাহলে কিয়ামত ও মৃত্যু পরের জীবন জ্ঞানবান ও প্রাজ্ঞ আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার একটি অনিবার্য দাবী। এ দাবী পূরণ হওয়া নয় বরং পূরণ না হওয়াটাই সম্পূর্ণ বুদ্ধিবিরোধী ও অযৌক্তিক।
﴿وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُّنِيرٍ﴾
৮। আরো কিছু লোক এমন আছে যারা কোনো জ্ঞান১০ পথনির্দেশনা১১ ও আলো বিকিরণকারী কিতাব১২ ছাড়াই ঘাড় শক্ত করে১৩
১০. অর্থাৎ ব্যক্তিগত জ্ঞান, যা সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
১১. অর্থাৎ এমন জ্ঞান যা কোন যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত হয়, অথবা কোন জ্ঞানের অধিকারীর পথনির্দেশনা দানের মাধ্যমে লাভ করা যায়।
১২. অর্থাৎ এমন জ্ঞান, যা আল্লাহর নাযিল করা কিতাব থেকে লাভ করা যায়।
১৩. এর তিনটি অবস্থা রয়েছেঃ
একঃ মুর্খতাপ্রসূত জিদ ও হঠকারিতা।
দুইঃ অহংকার ও আত্মম্ভরিতা।
তিনঃ যে ব্যক্তি বুঝায় ও উপদেশ দান করে তার কথায় কর্ণপাত না করা।
﴿ثَانِيَ عِطْفِهِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۖ لَهُ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ ۖ وَنُذِيقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَذَابَ الْحَرِيقِ﴾
৯। আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করে, যাতে লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করা যায়।১৪ এমন ব্যক্তির জন্য রয়েছে দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে আগুনের আযাবের জ্বালা আস্বাদন করাবো।
১৪. প্রথমে ছিল তাদের কথা যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট ছিল। আর এ আয়াতে তাদের কথা বলা হয়েছে যারা শুধু নিজেরাই পথভ্রষ্ট নয় বরং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লাগে।
﴿ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ يَدَاكَ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾
১০। এ হচ্ছে তোমার ভবিষ্যত, যা তোমার হাত তোমার জন্য তৈরি করেছে, নয়তো আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি যুলুম করেন না।
﴿وَمِنَ النَّاسِ مَن يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَىٰ حَرْفٍ ۖ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ ۖ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انقَلَبَ عَلَىٰ وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ﴾
১১। আর মানুষের মধ্যে এমনও কেউ আছে, যে এক কিনারায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর বন্দেগী করে,১৫ যদি তাতে তার উপকার হয় তাহলে নিশ্চিন্ত হয়ে যায় আর যদি কোনো বিপদ আসে তাহলে পিছনের দিকে ফিরে যায়১৬ তার দুনিয়াও গেলো এবং আখেরাতও। এ হচ্ছে সুস্পষ্ট ক্ষতি।১৭
১৫. অর্থাৎ দীনী বৃত্তের মধ্যখানে নয় বরং তার এক প্রান্তে বা কিনারায় অথবা অন্য কথায় কুফর ও ইসলামের সীমান্তে দাঁড়িয়ে বন্দেগী করে। যেমন কোন দো-মনা ব্যক্তি কোন সেনাবাহিনীর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি দেখে সেনাদল বিজয়লাভ করছে তাহলে তাদের সাথে মিলে যায় আর যদি দেখে পরাজিত হচ্ছে তাহলে আস্তে আস্তে কেটে পড়ে।
১৬. এখানে এমন সব লোকের কথা বলা হয়েছে যাদের মানসিক গঠন অপরিপক্ক, আকীদা-বিশ্বাস নড়বড়ে এবং যারা প্রবৃত্তির পূজা করে। তারা ইসলাম গ্রহণ করে লাভের শর্তে। তাদের ঈমান এ শর্তের সাথে জড়িত হয় যে, তাদের আকাংখা পূর্ণ হতে হবে, সব ধরণের নিশ্চিন্ততা অর্জিত হতে হবে, আল্লাহর দীন তাদের কাছে কোন স্বার্থ ত্যাগ দাবী করতে পারবে না এবং দুনিয়াতে তাদের কোন ইচ্ছা ও আশা অপূর্ণ থাকতে পারবে না। এসব হলে তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তার দীন তাদের কাছে খুবই ভালো। কিন্তু যখনই কোন আপদ বলাই নেমে আসে অথবা আল্লাহর পথে কোন বিপদ, কষ্ট ও ক্ষতির শিকার হতে হয় কিংবা কোন আকাংখা পূর্ণ হয় না তখনই আর আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা, রাসূলের রিসালাত ও দীনের সত্যতা কোনটাই ওপরই তারা নিশ্চিন্ত থাকে না। এরপর তারা এমন প্রতিটি বেদীমূলে মাথা নোয়াতে উদ্যেগী হয় যেখানে তাদের লাভের আশা ও লোকসান থেকে বেঁচে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
১৭. এখানে একটি অনেক বড় সত্যকে কয়েকটি কথায় প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। আসলে দো-মনা মুসলমানের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়। কাফের যখন নিজের রবের মুখাপেক্ষী না হয়ে এবং পরকাল থেকে বেপরোয়া ও আল্লাহর আইনের অনুগত্য মুক্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে বস্তুগত স্বার্থের পেচনে দৌঁড়াতে থাকে তখন সে নিজের পরকাল হারালেও দুনিয়ার স্বার্থ কিছু না কিছু হাসিল করেই নেয়। আর মু’মিন যখন পূর্ণ ধৈর্য, অবিচলতা, দৃঢ় সংকল্প ও স্থৈর্য সহকারে আল্লাহর দীনের আনুগত্য করে তখন যদিও পার্থিব সাফল্য শেষ পর্যন্ত তার পদ-চুম্বন করেই থাকে, তবুও যদি দুনিয়া একেবারেই তার নাগালের বাইরে চলে যেতেই থাকে, আখেরাতে তার সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। কিন্তু এ দো-মনা মুসলমান নিজের দুনিয়ার স্বার্থ লাভ করতে পারে না এবং আখেরাতেও তার সাফল্যের কোন সম্ভবনা থাকে না। তার মন ও মস্তিষ্কের কোন এক প্রকোষ্ঠ আল্লাহ ও আখেরাতের অস্তিত্বের যে ধারণা রয়েছে এবং ইসলামের সাথে সম্পর্ক তার মধ্যে নৈতিক সীমারেখা কিছু না কিছু মেনে চলার যে প্রবণতা সৃষ্টি করেছে, দুনিয়ার দিকে দৌড়াতে থাকলে এগুলো তার হাত টেনে ধরে। ফলে নিছক দুনিয়াবী ও বৈষয়িক স্বার্থ অন্বেষার জন্য যে ধরনের দৃঢ়তা ও একনিষ্ঠতার প্রয়োজন তা একজন কাফেরের মতো তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। আখেরাতের কথা চিন্তা করলে দুনিয়ার লাভ ও স্বার্থের লোভ, ক্ষতির ভয় এবং প্রবৃত্তির কামনা বাসনাকে বিধিনিষেধের শৃংখলে বেঁধে রাখার ব্যাপারে মানসিক অস্বীকৃতি সেদিকে যেতে দেয় না বরং বৈষয়িক স্বার্থ পূজা তার বিশ্বাস ও কর্মকে এমনভাবে বিকৃত করে দেয় যে, আখেরাতে তার শাস্তি থেকে নিষ্কৃতিলাভের সম্ভাবনা থাকে না। এভাবে সে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই হারায়।
﴿يَدْعُو مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُ وَمَا لَا يَنفَعُهُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الضَّلَالُ الْبَعِيدُ﴾
১২। তারপর সে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদেরকে ডাকে যারা তার না ক্ষতি করতে পারে, না উপকার, এ হচ্ছে ভ্রষ্টতার চূড়ান্ত।
﴿يَدْعُو لَمَن ضَرُّهُ أَقْرَبُ مِن نَّفْعِهِ ۚ لَبِئْسَ الْمَوْلَىٰ وَلَبِئْسَ الْعَشِيرُ﴾
১৩। সে তাদেরকে ডাকে যাদের ক্ষতি তাদের উপকারের চাইতে নিকটতর১৮ নিকৃষ্ট তার অভিভাবক এবং নিকৃষ্ট তার সহযোগী।১৯
১৮. প্রথম আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য মাবুদদের উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ, মূলত ও যথার্থই তাদের উপকার ও ক্ষতি করার কোন ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয় আয়াতে তাদের ক্ষতিকে উপকারের চেয়ে নিকটতর বলা হয়েছে। কারণ, তাদের কাছে দোয়া চেয়ে এবং অভাব ও প্রয়োজন পূরণের জন্য তাদের সামনে হাত পাতার মাধ্যমে সে নিজের ঈমান সংগে সংগেই ও নিশ্চিতভাবেই হারিয়ে বসে। তবে যে লাভের আশায় সে তাদেরকে ডেকেছিল তা অর্জিত হবার ব্যাপারে বলা যায়, প্রকৃত সত্যের কথা বাদ দিলেও প্রকাশ্য অবস্থার দৃষ্টিতে সে নিজেও একথা স্বীকার করবে যে, তা অর্জিত হওয়াটা নিশ্চিত নয় এবং বাস্তবে তা সংঘটিত হবার নিকটতর সম্ভাবনাও নেই। হতে পারে, আল্লাহ তাতে আরো বেশী পরিক্ষার সম্মুখীন করার জন্য কোন আস্তানায় তার মনোবাঞ্চনা পূর্ণ করেছেন। আবার এও হতে পারে যে, সে আস্তানায় সে নিজের ঈমানও বিকিয়ে দিয়ে এসেছে এবং মনোবাঞ্চনা পূর্ণ হয়নি।
১৯. অর্থাৎ মানুষ বা শয়তান যে-ই হোক না কেন, যে তাকে এ পথে এনেছে সে নিকৃষ্টতম কর্মসম্পাদক ও অভিভাবক এবং নিকৃষ্টতম বন্ধু ও সাথী।
﴿إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾
১৪। (পক্ষান্তরে) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে২০ আল্লাহ তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত হবে; আল্লাহ যা চান তাই করেন।২১
২০. অর্থাৎ যাদের অবস্থা উল্লেখিত মতলবী, ধান্দাবাজ, দো-মনা ও দৃঢ় বিশ্বাসহীন মুসলমানের মতো নয় বরং যারা ঠান্ডা মাথায় খুব ভালোভাবে ভেবে চিন্তে আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতকে মেনে নেবার ফায়সালা করে তারপর ভালো মন্দ যে কোন অবস্থার সম্মুখীন হতে হোক এবং বিপদের পাহাড় মাথায় ভেঙে পড়ুক বা বৃষ্টিধারার মতো পুরস্কার ঝড়ে পড়ুক সবাবস্থায় দৃঢ়পদে সত্যের পথে এগিয়ে চলে।
২১. অর্থাৎ আল্লাহ ক্ষমতা অসীম। দুনিয়ায় বা আখেরাতে অথবা উভয় স্থানে তিনি যাকে যা চান দিয়ে দেন এবং যার থেকে যা চান চিনিয়ে নেন। তিনি দিতে চাইলে বাধা দেবার কেউ নেই। না দিতে চাইলে আদায় করার ও কেউ নেই।
﴿مَن كَانَ يَظُنُّ أَن لَّن يَنصُرَهُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ فَلْيَمْدُدْ بِسَبَبٍ إِلَى السَّمَاءِ ثُمَّ لْيَقْطَعْ فَلْيَنظُرْ هَلْ يُذْهِبَنَّ كَيْدُهُ مَا يَغِيظُ﴾
১৫। যে ব্যক্তি ধারণা করে, আল্লাহ দুনিয়ায় ও আখেরাতে তাকে কোনো সাহায্য করবেন না তার একটি রশির সাহায্যে আকাশে পৌঁছে গিয়ে ছিদ্র করা উচিত তারপর দেখা উচিত তার কৌশল এমন কোনো জিনিসকে রদ করতে পারে কিনা যা তার বিরক্তি ও ক্ষোভের কারণ।২২
২২. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বহু মত বিরোধ হয়েছে। বিভিন্ন তাফসীরকার এর ব্যাখ্যায় যা বলেছেন তার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ
একঃ যে মনে করে আল্লাহ তাকে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা.কে সাহায্য করবেন না সে ছাদের গায়ে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করুক।
দুইঃ যে মনে করে আল্লাহ তাকে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা.কে) সাহায্য করবেন না সে কোন দড়ির সাহায্যে আকাশে যাবার ও সাহায্য বন্ধ করার চেষ্টা করে দেখুক।
তিনঃ যে মনে করে আল্লাহ তাকে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা.কে) সাহায্য করবেন না সে আকাশে গিয়ে অহীর সূত্র কেটে দেবার ব্যবস্থা করুক।
চারঃ যে মনে করে আল্লাহ তাকে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা.কে) সাহায্য করবেন না সে আকাশে গিয়ে তার রিযিক বন্ধ করার চেষ্টা করে দেখুক।
পাঁচঃ যে মনে করে আল্লাহ তাকে (অর্থাৎ যে নিজেই এ ধরনের চিন্তা করে তাকে) সাহায্য করবেন না সে নিজের গৃহের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করুক।
ছয়ঃ যে মনে করে আল্লাহ তাকে (অর্থাৎ যে নিজেই এ ধরনের চিন্তা করে তাকে) সাহায্য করবেন না সে আকাশে পৌঁছে সাহায্য আনার চেষ্টা করে দেখুক।
এর মধ্যে প্রথম চারটি ব্যাক্য তো পূর্বপর আলোচনার সাথে সম্পর্কহীন। আর শেষ দু’টি ব্যাখ্যা যদিও পূর্বপর আলোচনার বিষয় বস্তুর নিকটতর তবুও বক্তব্যের যথার্থ লক্ষে পৌঁছে না। ভাষণের ধারাবাহিকতার প্রতি দৃষ্টি রাখলে পরিষ্কার জানা যায় যে, কিনারায় দাঁড়িয়ে বন্দেগীকারী ব্যক্তিই একথা মনে করে। যতক্ষণ অবস্থা ভালো থাকে ততক্ষণ সে নিশ্চিন্ত থাকে এবং যখনই কোন আপদ-বিপদ বা বালা-মসিবদ আসে অথবা তাকে এমন কোন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় যা তার কাছে অপ্রীতিকর, তখনই সে আল্লাহর পথ থেকে সরে যায় এবং সব আস্তানার বেদীমূলে মাথা ঘসতে থাকে। এ ব্যক্তির এ অবস্থা কেন? এর কারণ সে আল্লাহ ইচ্ছা ও ফায়সালায় সন্তুষ্ট নয়। সে মনে করে ভাগ্য ভাংগা-গড়ার মূল সূত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো হাতেও আছে। তাই সে আল্লাহ থেকে নিরাশ হয়ে আশা-আকাংখার ডালি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ধর্না দেয়। তাই বলা হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ ধরনের চিন্তা করে সে নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দেখে নিতে পারে, এমন কি আকাশ চিরে ওপারে ঢুঁ মারতে পারলে তাও করে দেখে নিতে পারে, তার কোন কৌশল আল্লাহর তাকদীরর এমন কোন ফায়সালাকে বদলাতে পারে কি না যা তার কাছে অপ্রীতিকর ঠেকে। আকাশে পৌঁছে যাওয়া এবং ছিদ্র করা মানে হচ্ছে মানুষ যত বড় বড় প্রচেষ্টার কথা কল্পনা করতে পারে তার মধ্যে বৃহত্তম প্রচেষ্টা চালানো। এ শব্দগুলোর কোন শাব্দিক অর্থ এখানে উদ্দেশ্য নয়।
﴿وَكَذَٰلِكَ أَنزَلْنَاهُ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ وَأَنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يُرِيدُ﴾
১৬। –এ ধরনেরই সুস্পষ্ট কথা সহযোগে আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আল্লাহ যাকে চান তাকে সৎপথ দেখান।
﴿إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالصَّابِئِينَ وَالنَّصَارَىٰ وَالْمَجُوسَ وَالَّذِينَ أَشْرَكُوا إِنَّ اللَّهَ يَفْصِلُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ﴾
১৭। যারা ঈমান এনেছে২৩ ও যারা ইহুদী হয়েছে২৪ এবং সাবেয়ী,২৫ খৃস্টান২৬ ও অগ্নি পূজারীরা২৭ আর যারা শিরক করেছে২৮ তাদের সবার মধ্যে আল্লাহ কিয়ামতের দিন ফায়সালা করবেন।২৯ সব জিনিসই আল্লাহর দৃষ্টিতে আছে।
২৩. অর্থাৎ “মুসলমান”, যারা আপন আপন যুগে আল্লাহর সকল নবীকে ও তাঁর কিতাবসমূহকে মেনে নিয়েছে এবং মুহাম্মাদ সা. এর যুগে যারা পূর্ববর্তী নবীদের সাথে তাঁর প্রতিও ঈমান এনেছে। তাদের মধ্যে সাচ্চা ঈমানদাররাও ছিল এবং তারাও ছিল যারা ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়ে যেতো ঠিকই কিন্তু “কিনারায়” অবস্থান করে বন্দেগী করতো এবং কুফর ও ঈমানের মাঝখানে দোদুল্যমান ছিলো।
২৪. ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নিসাঃ ৭২ টীকা।
২৫. প্রাচীন যুগে সাবেয়ী নামে দু’টি সম্প্রদায় সর্বজন পরিচিত ছিল। এদের একটি ছিল হযরত ইয়াহ্ইয়া আ. এর অনুসারী। তারা ইরাকের উচ্চভূমিতে (অর্থাৎ আল জাযীরা) বিপুল সংখ্যায় বসবাস করতো। হযরত ইয়াহ্ইয়া আ. এর অনুগামী হিসেবে তারা মাথায় পানি ছিটিয়ে ধর্মান্তরিত হবার পদ্ধতি মেনে চলতো। তারকা পূজারী দ্বিতীয় দলের লোকেরা নিজেদের হযরত শীশ ও হযরত ইদরিস আ. এর অনুসারী বলে দাবী করতো। তারা মৌলিক পদার্থের ওপর গ্রহের এবং গ্রহের ওপর ফেরেশতাদের শাসনের প্রবক্তা চিল। হারান ছিল তাদের কেন্দ্র। ইরাকের বিভিন্ন এলাকায় তাদের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে ছিল। এ দ্বিতীয় দলটি নিজেদের দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শিতার কারণে বেশী খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু এখানে প্রথম দলটি কথা বলা হয়েছে। এ সম্ভাবনাই প্রবল। কারণ সম্ভবত কুরআন নাযিলের সময় দ্বিতীয় দলটি এ নামে অভিহিত ছিল না।
২৬. ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মায়িদাহঃ ৩৬ টীকা দেখুন।
২৭. অর্থাৎ ইরানের অগ্নি উপাসকগণ, যারা আলোক ও অনধারের দু’জন ইলাহর প্রবক্তা ছিল এবং নিজেদেরকে যরদ্শতের অনুসারী দাবী করতো। মায্দাকের ভ্রষ্টতা তাদের ধর্ম নৈতিক চরিত্রকে সাংঘাতিকভাবে বিকৃত করে দিয়েছিল। এমন কি তদের মধ্যে সহোদর বোনের সাথে বিয়ের প্রথাও প্রচলিত ছিল।
২৮. অর্থাৎ আরব ও অন্যান্য দেশের মুশরিকবৃন্দ, যারা ওপরের বিভিন্ন দলীয় নামের মতো কোন নামে আখ্যায়িত ছিল না। কুরআন মজীদ তাদেরকে অন্যান্য দল থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য “মুশরিক” ও “যারা শিরক করেছে” ধরনের পারিভাষিক নামে স্মরণ করেছে। অবশ্য মু’মিনদের দল ছাড়া বাকি সবার আকীদা ও কর্মধারায় শিরক অনুপ্রবেশ করেছিল।
২৯. অর্থাৎ মানুষদের বিভিন্ন দলের মধ্যে আল্লাহ সম্পর্কে যে মত বিরোধ ও বিবাদ রয়েছে এ দুনিয়ায় তার কোন ফায়সালা হবে না। তার ফায়সালা হবে কিয়ামতের দিন। সেখানে তাদের মধ্যে কারা সত্যপন্থী এবং কারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে তার চূড়ান্ত মীমাংসা করে দেয়া হবে। যদিও এক অর্থে দুনিয়ায় আল্লাহর কিতাবগুলোও এ ফায়সালা করে, কিন্তু এখানে ফায়সালা শব্দটি “বিবাদ মিটানো” এবং দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায় সংগত বিচার করার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে এক দলের পক্ষে এবং অন্য দলের বিপক্ষে যথারীতি ডিক্রি জারী করা হবে।
﴿أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَمَن فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِّنَ النَّاسِ ۖ وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ ۗ وَمَن يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّكْرِمٍ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ ﴾
১৮। তুমি কি দেখো না আল্লাহর সামনে সিজদানত৩০ সবকিছই যা আছে আকাশে৩১ ও পৃথিবীতে- সূর্য, চন্দ্র, তারকা, পাহাড়, গাছপালা, জীবজন্তু এবং বহু মানুষ৩২ ও এমন বহু লোক যাদের প্রতি আযাব অবধারিত হয়ে গেছে?৩৩ আর যাকে আল্লাহ লাঞ্ছিত ও হেয় করেন তার সম্মান দাতা কেউ নেই৩৪ আল্লাহ যাকিছু চান তাই করেন।৩৫
৩০. ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আর রা’দঃ ২৪ টীকা, সূরা আন্ নহল ৪১-৪২ টীকা।
৩১. অর্থাৎ ফেরেশতা, নক্ষত্রমন্ডলী এবং পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য জগতে মানুষের মতো বুদ্ধিমান জীব বা পশু, উদ্ভিদ, জড় পদার্থ, বায়ু ও আলো মতো অ-বুদ্ধিমান ও স্বাধীন ক্ষমতাহীন যাবতীয় সৃষ্টি।
৩২. অর্থাৎ যারা নিছক বাধ্য হয়েই নয় বরং ইচ্ছাকৃতভাবে, সানন্দে ও আনুগত্যশীলতা সহকারেও তাঁকে সিজদা করে। পরবর্তী বাক্যে তাদের মোকাবিলায় মানব সম্প্রদায়ের অন্য যে দলের কথা বলা হচ্ছে তারা স্বেচ্ছায় আল্লাহর সামনে নত হতে অস্বীকার করে। কিন্তু অন্যান্য স্বাধীন ক্ষমতাহীন সৃষ্টির মতো তারাও প্রাকৃতিক আইনের বাঁধান মুক্ত নয় এবং সবার সাথে বাধ্য হয়ে সিজদা করার মধ্যে তারাও রয়েছে। নিজেদের ক্ষমতার পরিসরে বিদ্রোহের নীতি অবলম্বনের কারণে তারা আযাবের অধিকারী হয়।
৩৩. এর অর্থ হচ্ছে, যদিও কিয়ামতের দিনে এসব বিভিন্ন দলের বিরোধের নিষ্পত্তি করে দেয়া হবে তবুও যথার্থ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হলে যে কেউ আজো দেখতে পারে কে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে এবং শেষ ফায়সালা কার পক্ষে হওয়া উচিত। পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সর্বত্র একই আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব পূর্ণ শক্তিতে ও সর্বব্যাপীভাবে চলছে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ব্যাবস্থা একথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্রতম ধূলিকণা থেকে শুরু করে আকাশের বড় বড় গ্রহ নক্ষত্র পর্যন্ত সবাই একটি আইনের শৃংখলে বাঁধা রয়েছে এবং তা থেকে এক চুল পরিমাণ এদকি ওদিক নড়ার ক্ষমতা কারোর নেই। মুমিন তো অন্তর থেকেই তাঁর কাছে মাথা নত করে কিন্তু যে নাস্তিকটি তাঁর অস্তিত্বই অস্বিকার করে এবং যে মুশরিকটি প্রতিটি ক্ষমতাহীন সত্তার সামনে মাথা নত করে সেও বাতাস ও পানির মতো সমানভাবে তার আনুগত্য করতে বাধ্য। কোন ফেরেশতা, জিন, নবী, অলী ও দেবদেবীর মধ্যে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতার সামান্যতম নামগন্ধও নেই। তাদেরকে আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্ব ক্ষমতা ও উপাস্য হবার মর্যাদা দান করা অথবা বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভুর সম জাতীয় ও সদৃশ গণ্য করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। কোন শাসকবিহীন আইন, স্রষ্টাবিহীন প্রকৃতি ও পরিচালকবিহীন ব্যবস্থার পক্ষে এত বড় বিশ্ব-জাহানের অস্তিত্ব দান করা, নিজেই তাকে সুষ্ঠ নিয়ম-শৃংখলার সাথে পরিচালনা করা এবং এ বিশ্ব-জাহানের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা ও প্রজ্ঞার বিস্ময়কর কর্মকুশলতা দেখানো কোনক্রমেই সম্ভব নয়। বিশ্ব-জাহানের এ উন্মুক্ত গ্রন্থটি সামনে থাকার পরও যে ব্যক্তি নবীদের কথা মানে না এবং বিভিন্ন মনগড়া বিশ্বাস অবলম্বন করে আল্লাহর ব্যাপারে বিরোধে প্রবৃত্ত হয় তার মিথ্যাশ্রয়ী হওয়া ঠিক তেমনিভাবে প্রমাণিত যেমন কিয়ামতের দিন প্রমাণিত হবে।
৩৪. এখানে লাঞ্ছনা ও সম্মান অর্থ সত্য অস্বীকার ও তার অনুসরণ। কারণ, লাঞ্ছনা ও সম্মানের আকরেই এর অনিবার্য ফল দেখা যায়। যে ব্যক্তি চোখ মেলে প্রকাশ্য ও উজ্জ্বল সত্য দেখে না এবং যে তাকে বুঝায় তার কথাও শোনে না সে নিজেই নিজের জন্য লাঞ্ছনা ও অবমাননার ডাক দেয়। সে নিজে যা প্রার্থনা করে আল্লাহ তার ভাগ্যে তাই লিখে দেন। তারপর আল্লাহই যখন তাকে সত্য অনুসরণ করার মর্যাদা দান করেননি তখন তাকে এ মর্যাদায় অভিষিক্ত করার ক্ষমতা আর কার আছে?
৩৫. এখানে তেলাওয়াতের সিজদা ওয়াজিব। সূরা আল হাজ্জের এ সিজদাটির ব্যাপারে সবাই একমত। তেলাওয়াতের সিজদার তত্বজ্ঞান, তাৎপর্য ও বিধান জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফঃ ১৫৭ টীকা।
﴿هَٰذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِمْ ۖ فَالَّذِينَ كَفَرُوا قُطِّعَتْ لَهُمْ ثِيَابٌ مِّن نَّارٍ يُصَبُّ مِن فَوْقِ رُءُوسِهِمُ الْحَمِيمُ﴾
১৯। এ দু’টি পক্ষ এদের মধ্যে রয়েছে এদের রবের ব্যাপারে বিরোধ।৩৬ এদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য আগুনের পোশাক কাটা হয়ে গেছে,৩৭
৩৬. এখানে আল্লাহ সম্পর্কে বিরোধকারী সমস্ত দলগুলোকে তাদের সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও দু’টি পক্ষে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি পক্ষ নবীদের কথা মেনে নিয়ে আল্লাহর সঠিক বন্দেগীর পথ অবলম্বন করে। দ্বিতীয় পক্ষ নবীদের কথা মানে না এবং তারা কুফরীর পথ অবলম্বন করে। তাদের মধ্যে বহু মতবিরোধ রয়েছে এবং তাদের কুফরী বিভিন্ন বিচিত্র রূপও পরিগ্রহ করেছে।
৩৭. ভবিষ্যতে যে বিষয়টির ঘটে যাওয়া একেবারে সুনিশ্চিত তার প্রতি জোর দেবার জন্য সেটি এমনভাবে বর্ণনা করা হয় যেন তা ঘটে গেছে। আগুনের পোশাক বলতে সম্ভবত এমন জিনিস বুঝানো হয়েছে যাকে সূরা ইবরাহীমের ৫০ আয়াতে سَرَابِيلُهُم مِّن قَطِرَانٍ বলা হয়েছে। ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইব্রাহীম ৫৮ টীকা।
﴿يُصْهَرُ بِهِ مَا فِي بُطُونِهِمْ وَالْجُلُودُ﴾
২০। তাদের মাথায় ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে, যার ফলে শুধু তাদের চামড়াই নয়, পেটের ভেতরের অংশও গলে যাবে।
﴿وَلَهُم مَّقَامِعُ مِنْ حَدِيدٍ﴾
২১। আর তাদের শাস্তি দেবার জন্য থাকবে লোহার মুগুর।
﴿كُلَّمَا أَرَادُوا أَن يَخْرُجُوا مِنْهَا مِنْ غَمٍّ أُعِيدُوا فِيهَا وَذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ﴾
২২। যখনই তারা কাতর হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হবার চেষ্টা করবে তখনই আবার তার মধ্যে তাদেরকে ঠেলে দেয়া হবে, বলা হবে, এবার দহন জ্বালার স্বাদ নাও।
﴿إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِن ذَهَبٍ وَلُؤْلُؤًا ۖ وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌ﴾
২৩। (অন্যদিকে) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে আল্লাহ তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত হতে থাকবে। সেখানে তাদেরকে সোনার কাঁকন ও মুক্তো দিয়ে সাজানো হবে৩৮ এবং তাদের পোশাক হবে রেশমের।
৩৮. তাদেরকে রাজকীয় ও ঝাঁকালো পোশাক পরানো হবে, এ ধারণা দেওয়াই এখানে উদ্দেশ্য। কুরাআন নাযিলের যুগে রাজা-বাদশাহ ও বড় বড় ধনীরা সোনা ও মনি-মক্তার অলংকার পরতেন। আমাদের যুগেও উপমহাদেশের রাজা-মহারাজা ও নওয়াবরাও এ ধরনের অলংকার পরতেন।
﴿وَهُدُوا إِلَى الطَّيِّبِ مِنَ الْقَوْلِ وَهُدُوا إِلَىٰ صِرَاطِ الْحَمِيدِ﴾
২৪। তাদেরকে পবিত্র কথা গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৩৯ এবং তাদেরকে দেখানো হয়েছে শ্রেষ্ঠ গুণাবলী সম্পন্ন আল্লাহর পথ।৪০
৩৯. যদিও পবিত্র কথা শব্দের অর্থ ব্যাপক কিন্তু এখানে এর অর্থ হচ্ছে সে কালেমায়ে তাইয়েবা ও সৎ আকীদ-বিশ্বাস যা গ্রহণ করে সে মু’মিন হয়েছে।
৪০. যেমন ইতিপূর্বে ভূমিকায় বলা হয়েছে, আমার মতে এখানে সূরার মক্কী যুগে অবতীর্ণ অংশ শেষ হয়ে যায়। এ অংশের বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভংগী মক্কী সূরাগুলোর মতো। এর মধ্যে এমন কোন আলামতও নেই যা থেকে সন্দেহ করা যেতে পারে যে, সম্ভবত এর পুরো অংশটি বা এর কোন একটি অংশ মাদানী যুগে নাযিল হয়। শুধুমাত্র এ هَٰذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِمْ (এ দু’টি দল যাদের মধ্যে তাদের রবের ব্যাপারে বিরোধ আছে) আয়াতটির ব্যাপারে কোন কোন তাফসীরকার একথা বলেন যে, এটি মাদানী আয়াত। কিন্তু তাদের এ বক্তব্যের ভিত্তি হচ্ছে শুধুমাত্র এই যে, তারা বদর যুদ্ধের দুই পক্ষকে এখানে দুই পক্ষ ধরেছেন। অথচ এটি কোন মজবুদ ভিত্তি নয়। কারণ এখানে যে দুই পক্ষের দিকে ইংগিত করা হয়েছে এর আগে ও পরে এমন কোন জিনিস নেই যা থেকে এ ইংগিতকে বদর যুদ্ধের দুই পক্ষের সাথে সংশ্লিষ্ট করা যায়। শব্দগুলোর অর্থ ব্যাপক এবং পরবর্তী ইবারত পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে, এখানে কুফর ও ঈমানের এমন বিরোধের কথা বলা হয়েছে যা শুরু থেকে চলে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। এর সম্পর্ক যদি বদর যুদ্ধের দুই পক্ষের সাথে থাকতো তাহলে এর জায়গা হতো সূরা আনফালে এ সূরায় নয় এবং এ বক্তব্য ধারার মধ্যেও নয়। এ তাফসীর পদ্ধতি যদি সঠিক বলে মেনে নেয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে, কুরআনের আয়াত গুলো একেবারে বিক্ষিপ্তভাবে নাযিল হয়েছে এবং তারপর সেগুলোকে কোন প্রকার সম্পর্ক সম্বন্ধ ছাড়াই এমনিই যেখানে ইচ্ছা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ কুরআনের বক্তব্য উপস্থাপনা ও শৃংখলা এ ধারণাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
﴿إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ الَّذِي جَعَلْنَاهُ لِلنَّاسِ سَوَاءً الْعَاكِفُ فِيهِ وَالْبَادِ ۚ وَمَن يُرِدْ فِيهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُّذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ﴾
২৫। যারা কুফরী করেছে৪১ এবং যারা (আজ) আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিচ্ছে আর সেই মসজিদে হারামের যিয়ারতে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে৪২ যাকে আমি তৈরি করেছি সব লোকের জন্য যাতে স্থানীয় বাসিন্দা ও বহিরাগতদের অধিকার সমান।৪৩ (তাদের নীতি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য) এখানে (মসজিদে হারামে) যে-ই সত্যতা থেকে সরে গিয়ে জুলুমের পথ অবলম্বন করবে৪৪ তাকেই আমি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের স্বাদ আস্বাদান করাবো।
৪১. অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. এর দাওয়াত মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। পরবর্তী বিষয়বস্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে যে, এখানে মক্কার কাফেরদের কথা বলা হচ্ছে।
৪২. অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর অনুসারীদেরকে হজ্জ ও উমরাহ করতে দেয় না।
৪৩. অর্থাৎ যা কোন ব্যক্তি, পরিবার বা গোত্রের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। বরং সর্বসাধারণের জন্য ওয়াকফকৃত, যার যিয়ারত থেকে বাধা দেবার অধিকার কারো নেই।
এখানে ফিকাহর দৃষ্টিতে দু’টি প্রশ্ন দেখা দেয়। ফকীহদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছেঃ
প্রথমত মসজিদে হারাম অর্থ কি? এটা কি শুধু মসজিদকে বুঝাচ্ছে না সমগ্র মক্কা নগরীকে?
দ্বিতীয়ত এখানে “আকিফ” (অবস্থানকারী) ও “বাদ”(বহিরাগত)-এর অধিকার সমান হবার অর্থ কি?
এক দলের মতে এর অর্থ শুধু মসজিদ, সমগ্র মক্কা নগরী নয়। কুরআনের শব্দাবলীর বাহ্যিক অর্থ থেকেই এটা সুস্পষ্ট হয়। এখানে অধিকার সমান হবার অর্থ ইবাদাত করার সমান অধিকার। যেমন নবী সা. এর নিম্নোক্ত উক্তি থেকে জানা যায়ঃ
يا بَنِي عَبْدِ مَنافٍ من ولى منكم من أمور الناس شيئا فلا يمْنَعُن أحدًا طَافَ بهِذا البيتِ أوصلَّى أَيَّةَ ساعَةٍ شاءَ من لَيْلٍ أوْ نَهارٍ
“হে আবদে মান্নাফের সন্তানগণ! তোমাদের যে কেউ জনগণের বিষয়াদির ওপর কোন প্রকার কর্তৃত্বের অধিকারী হবে তার পক্ষে রাতে ও দিনের কোন সময় কোন ব্যক্তির কাবাগৃহের তাওয়াফ করা অথবা নামায পড়ায় বাধা দেয়া উচিত নয়।”
এ অভিমতের সমর্থকরা বলেন, মসজিদে হারাম বলতে পুরা হারাম শরীফ মনে করা এবং তারপর সেখানে সবদিক দিয়ে স্থানীয় অধিবাসী ও বাইর থেকে আগতদের অধিকার সমান গণ্য করা ভুল। কারণ মক্কার ঘরবাড়ি ও জমি জমার ওপর লোকদের মালিকানা অধিকার, উত্তরাধিকার এবং কেনা-বেচা ও ইজারা দেবার অধিকার ইসলামপূর্ব যুগ থেকে প্রতিষ্ঠিত এবং ইসলামের আগমনের পরও প্রতিষ্ঠিত ছিল। এমন কি হযরত উমর রা. এর আমলে মক্কায় কারাগার নির্মাণের জন্য সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার গৃহ চার হাজার দিরহাম কিনে নেয়া হয়। কাজেই এ সাম্য শুধুমাত্র ইবাদাতের ব্যাপারে, অন্য কোন বিষয়ে নয়। এটি ইমাম শাফেঈ ও তাঁর সমমনা লোকদের উক্তি।
দ্বিতীয় দলটির মতে, মসজিদে হারাম বলতে মক্কার সমগ্র হারাম শরীফকে বুঝানো হয়েছে। এর প্রথম যুক্তি হচ্ছে, এ সংশ্লিষ্ট আয়াতটিতেই মক্কার মুশরিকদেরকে যে বিষয়ে তিরস্কার করা হয়েছে সেটি হচ্ছে মুসলমানদের হজ্জে বাধা হওয়া তাদের এ কাজকে এ বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যে, সেখানে সবার অধিকার সমান। এখন এ কথা সুষ্পষ্ট যে, হজ্জ কেবল সমজিদে হয় না বরং সাফা ও মারওয়া থেকে নিয়ে মিনা, মুযদালিফা, আরাফাত সবই হজ্জ অনুষ্ঠানের স্থানের অন্তরভুক্ত। তারপর কুরআনে শুধু এক জায়গায়ই নয় অসংখ্য জায়গায় সমজিদে হারাম বলে সমগ্র হারাম শরীফ ধরা হয়েছে যেমন বলা হয়েছেঃ
الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِندَ اللَّهِ
“মসজিদে হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং তার অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বের করে দেয়া আল্লাহর কাছে হারাম মাসে যুদ্ধ করার চাইতে বড় গুনাহ।” (আল বাকারাহঃ ২১৭)
বলাবাহুল্য, এখানে মসজিদে হারামে যারা নামায পড়ায় রত তাদেরকে বের করা নয় বরং মক্কা থেকে মুসলমান অধিবাসীদেরকে বের করা বুঝানো হয়েছে। অন্য জায়গায় বলা হয়েছেঃ
ذَٰلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ
“এ সুবিধা তার জন্য যার পরিবারবর্গ মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়।” (আল বাকারাহঃ ১৯৬)
এখানেও মসজিদে হারাম বলতে সমগ্র মক্কার হারাম শরীফ, নিছক মসজিদ নয়। কাজেই “মসজিদে হারামে” সাম্যকে শুধুমমাত্র মসজিদের মধ্যে সাম্য গণ্য করা যেতে পারে না বরং এটি হচ্ছে মক্কার হারমের মধ্যে সাম্য।
তারপর এ দলটি আরো বলে, সাম্য ও সমান অধিকার শুধুমাত্র ইবাদাত, সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে নয় বরং মক্কার হারমে সকল প্রকার অধিকারের ক্ষেত্রে রয়েছে। এ দেশটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বসাধারণের জন্য ওয়াকফকৃত। কাজেই এর এবং এর ইমারাতসমূহের ওপর কারো মালিকানা অধিকার নেই। প্রত্যেক ব্যক্তি প্রত্যেক জায়গায় অবস্থান করতে পারে। কেউ কাউকে বাধা দিকে পারে না এবং কোন উপবেশনকারীকে উঠিয়ে দিতেও পারে না। এর প্রমাণ স্বরূপ তারা অসংখ্য হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের বাণী ও কর্ম পেশ করে থাকেন। যেমন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেছেন, নবী সা. বলেনঃ
مَكَّةُ مُناخٌ، لا تُباعُ رِباعُها، ولا تُؤاجَرُ بُيُوتُها
“মক্কা মুসাফিরদের অবতরণস্থল, এর জমি বিক্রি করা যাবে না এবং এর গৃহসমূহের ভাড়া আদায় করাও যাবে না। ইব্রাহীম নাখঈ সাহাবীর নাম উল্লেখ ছাড়াই একটি (মুরসাল) হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ
مكة حرمها الله لا يحل بيع رباعها ولا اجارة بيوتها
“মক্কাকে আল্লাহ হারাম গণ্য করেছেন। এর জমি বিক্রি করা এবং এর গৃহসূহের ভাড়া আদায় করা হালাল নয়।
(উল্লেখ করা যেত পারে, ইব্রাহীম নাখঈর মুরসাল তথা সাহাবীর নাম উল্লেখ ছাড়া বর্ণিত হাদীস মারফু‘ তথা সাহাবীর নাম উল্লেখ সহ বর্ণিত হাদীসের পর্যায়ভুক্ত। কারণ, তাঁর সর্বজন পরিচিত নিয়ম হচ্ছে, যখন তিনি সাহাবীর নাম উল্লেখ ছাড়াই (মুরসাল) কোন হাদীস বর্ণনা করেন তখন আসলে আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদের রা. মাধ্যমেই বর্ণনা করেন। মুজাহিদও প্রায় এ একই শব্দাবলীর মাধ্যমে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। ‘আলকামাহ ইবনে ফাদলাহ বর্ণনা করেছেন, “নবী সা. এবং আবুবকর, উমর ও উসমান রা. এর আমলে মক্কার জমিকে পতিত জমি মনে করা হতো। যার প্রয়োজন হতো এখানে থাকতো এবং প্রয়োজন ফুরালে অন্য কাউকে বসিয়ে দিতো।”
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর রা. হুকুম দিয়েছিলেন যে, হজ্জের সময় মক্কার কোন লোক নিজের দরজা বন্ধ করতে পারবে না। বরং মুজাহিদ বর্ণনা করেন, হযরত উমর রা. মক্কাবাসীদেরকে নিজেদের বাড়ির আঙিনা খোলা রাখার হুকুম দিয়ে রেখেছিলেন এবং আগমণকারীদেরকে তাদের ইচ্ছামত স্থানে অবস্থান করতে দেয়ার জন্য আঙিনায় দরজা বসাতে নিষেধ করতেন। আতাও এ একই কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, হযরত উমর রা. একমাত্র সোহাইল ইবনে আমরকে আঙিনায় দরজা বসাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। কারণ, ব্যবসায় ব্যাপদেশে তাঁকে নিজের উট সেখানে আটকে রাখতে হতো।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, যে ব্যক্তি মক্কার গৃহের ভাড়া নেয় সে নিজের পেট আগুন দিয়ে ভরে।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসের রা. উক্তি হচ্ছে, আল্লাহ মক্কার সমগ্র হারমকে মসজিদ বানিয়ে দিয়েছেন। সেখানে সবার অধিকার সমান। বাইরের লোকদের থেকে ভাড়া আদায় করার কোন অধিকার মক্কার লোকদের নেই।
উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. মক্কার গভর্নরের নামে ফরমান জারি করেন যে, মক্কার গৃহের ভাড়া নেয়া যাবে না করণ, এটা হারাম এসব রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে বিপুল সংখ্যক তাবেঈ এমত পোষণ করেন এবং ফকীহগণের মধ্যে ইমাম মালেক রাহ., ইমাম আবু হানীফা রাহ., সুফিয়ান সওরী রাহ., আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. ও ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইয়াহও এ মতো অনুসারী হয়েছিলেন যে, মক্কার জমি বেচা-কেনা করা এবং কমপক্ষে হজ্জ মওসূমে মক্কার গৃহের ভাড়া আদায় করা জায়েয নয়। তবে অধিকাংশ ফকীহ মক্কার গৃহসমূহের ওপর জনগণের মালিকানা অধিকার স্বীকার করেছেন এবং জমি হিসেবে নয়, গৃহ হিসেবে সেগুলো বেচা-কেনা বৈধ গণ্য করেছেন।
এ অভিমতটিই আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের কাছাকাছি মনে হয়। কারণ, আল্লাহ দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানদের ওপর হজ্জ এজন্য ফরয করেননি যে, এটা মক্কার মুসলমানদের উপার্জনের একটা উপায় হবে এবং যেসব মুসলমান ফরয পালনের জন্য বাধ্য হয়ে সেখানে যাবে তাদের কাছ থেকে সেখানকার গৃহমালিক ও জমি মালিকগণ ভাড়া আদায় করে লুটের বাজার গরম করবেন। বরং সেগুলো সকল ঈমানদারের জন্য ব্যাপকভাবে ওয়াকফকৃত। তার জমির ওপর কারোর মালিকানা নেই। প্রত্যেক যিয়ারতকারী তার ইচ্ছামতো যে কোন জায়গায় অবস্থান করতে হবে।
৪৪. এখানে নিছক কোন বিশেষ কাজ নয় বরং এমন প্রত্যেক কাজই বুঝানো হয়েছে যা সত্য থেকে বিচ্যুত এবং জুলুমের সংজ্ঞায় আওতায় পড়ে। যদিও সকল অবস্থায় এ ধরণের কাজ করা পাপ কিন্তু হারাম শরীফে একাজ করা আরো অনেক বেশী মারাত্মক পাপ। মুফাসসিরগণ বিনা প্রয়োজনে কসম খাওয়াকে পর্যন্ত হারাম শরীফের মধ্যে বেদীনী গণ্য করেছেন এবং একে এ আয়াতের ক্ষেত্রে হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ সমস্ত সাধারণ গোনাহ ছাড়া হারাম শরীফের মর্যাদার সাথে জড়িত যে বিশেষ বিধানগুলো আছে সেগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করা সুস্পষ্টভাবে গোনাহের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। যেমনঃ
হারমের বাইরে যদি কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে অথবা এমন কোন অপরাধ করে যার ফলে তার ওপর শরীয়াত নির্ধারিত শাস্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং তারপর সে হারম শরীফে আশ্রয় নেয়, তাহলে যতক্ষণ সে সেখানে থাকে তার ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। হারমের এ মর্যাদা হযরত ইব্রাহীম আ. এর সময় থেকে চলে আসছে। মক্কা বিজয়ের দিন শুধুমাত্র কিছুক্ষণের জন্য এ হুরমত উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল তারপর আবার চিরকালের জন্য তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কুরআন বলেছেঃ وَمَن دَخَلَهُ كَانَ آمِنًا “যে এর মধ্যে প্রবেশ করলো সে নিরাপত্তাধীন হয়ে গেলো।” বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতে হযরত উমর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, যদি আমরা নিজেদের পিতৃহন্তাকেও সেখানে পাই তাহলে তার গায়েও হাত দেবো না। এ কারণে অধিকাংশ তাবেঈ, হানাফী, হাম্বলী ও আহলে হাদীস উলামা হারমের বাইরে অনুষ্ঠিত অপরাধের শাস্তি হারমের মধ্যে দেয়া যেতে পারে না বলে মত পোষণ করেন।
সেখানে যুদ্ধ ও রক্তপাত হারাম। মক্কা বিজয়ের পর দ্বিতীয় দিন নবী সা. যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “হে লোকেরা! আল্লাহ সৃষ্টির শুরু থেকেই মক্কাকে হারাম করেছেন এবং আল্লাহর মর্যাদাদানের কারণে কিয়ামত পর্যন্ত এটি মর্যাদাসম্পন্ন তথা হারাম। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তার জন্য এখানে রক্ত প্রবাহিত করা হালাল নয়।” তারপর তিনি বলেছিলেন, “যদি আমার এ যুদ্ধকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে কোন ব্যক্তি এখানে রক্তপাত বৈধ করে নেয় তাহলে তাকে বলে দাও, আল্লাহ তাঁর রাসূলের জন্য এটা বৈধ করেছিলেন, তোমার জন্য নয়। আর আমার জন্যও এটা মাত্র একটি দিনের একটি সময়ের জন্য হালাল করা হয়েছিল, আবার আজ গতকালের মতই তার হারাম হওয়ার হুকুম সেই একইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
সেখানকার প্রাকৃতিক গাছপালা কাটা যেতে পারে না। জমিতে স্বতঃ উৎপাদিত ঘাস তুলে ফেলা যেতে পারে না এবং পাখ-পাখালী ও অন্যান্য জন্তু জানোয়ার শিকার করাও যেতে পারে না। হারমের বাইরে শিকার করার জন্য সেখান থেকে প্রাণীদের তাড়িয়ে বাইরে আনাও যেতে পারে না। শুধুমাত্র সাপ, বিছা ইত্যাদি অনিষ্টকারী প্রাণীগুলো এর অন্তরভুক্ত নয়। আর ইযখির (এক ধরনের সুগন্ধি ঘাস) ও শুকনা ঘাসকে স্বতঃউৎপাদিত ঘাস থেকে আলাদা করা হয়েছে। এসব ব্যাপারে সহী হাদীসসমূহে পরিষ্কার বিধান রয়েছে।
সেখানকার পড়ে থাকা জিনিস উঠানো নিষেধ। যেমন আবু দাউদে বলা হয়েছেঃ
أَنَّ النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ لُقَطَةِ الْحَاجِّ
নবী সা. হাজীদের পড়ে থাকা জিনিস উঠাতে নিষেধ করে দিয়েছেন।”
যে ব্যক্তি হজ্জ বা উমরাহর নিয়তে আসে সে ইহরাম না বেঁধে সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। তবে অন্য কোন নিয়তে সেখানে প্রবেশ কারীর জন্য ইহরাম বাঁধা অপরিহার্য কিনা এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। ইবনে আব্বাসের মত হচ্ছে, কোন অবস্থায়ই ইহরাম না বেঁধে সেখানে প্রবেশ করা যেতে পারে না। ইমাম আহমদ ও ইমাম শাফেঈর একটি করে উক্তিও এ মতের সপক্ষে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে এই যে, একমাত্র তাদের এই ইহরাম বাঁধতে হবে না যাদের নিজেদের কাজের জন্য বারবার সেখানে যাওয়া-আসা করতে হয়। বাকি সবাইকে ইহরাম বাঁধতে হবে। এটি হচ্ছে ইমাম আহমদ ও ইমাম শাফেঈ‘র দ্বিতীয় উক্তি। তৃতীয় মতটি হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি মীকাতের (হারাম শরীফের মধ্যে প্রবেশের সময় সেখান থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়) সীমানার মধ্যে বাস করে সে ইহরাম না বেঁধে মক্কায় প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু মীকাতের সীমানার বাইরে অবস্থানকারীরা বিনা ইহরামে মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না। এটি ইমাম আবু হানীফার উক্তি।
﴿وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لَّا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ﴾
২৬। স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন আমি ইবরাহীমের জন্য এ ঘরের (কাবাঘর) জায়গা নির্ধারণ করেছিলাম (এ নির্দেশনা সহকারে) যে, আমার সাথে কোনো জিনিসকে শরীক করবে না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও রুকূ-সিজদা-কিয়ামকারীদের জন্য পবিত্র রাখো৪৫
৪৫. কোন কোন মুফাসসির হযরত ইব্রাহীমকে আ. যে ফরমান দেয়া হয়েছিল “পবিত্র রাখো” পর্যন্তই তা শেষ করে দিয়েছেন এবং “হজ্জের জন্য সাধারণ হুকুম দিয়ে দাও” নির্দেশটি নবী সা.কে সম্বোধন করে উচ্চারিত হয়েছে বলে মনে করেছেন। কিন্তু বক্তব্যের ধরন পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, এ সম্বোধনও হযরত ইবরাহীমের প্রতিই করা হয়েছে এবং তাঁকে কাবাঘর নির্মাণের সময় যে হুকুম দেয়া হয়েছিল এটি তারই একটি অংশ। এছাড়াও এখানে বক্তব্যের মূল লক্ষ হচ্ছে একথা বলা যে, প্রথম দিন থেকেই এ ঘরটি এক আল্লাহর বন্দেগী করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং আল্লাহর বন্দেগীকারী সকল মানুষের এখানে আসার সাধারণ অনুমতি ছিল।
﴿وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ﴾
২৭। এবং লোকদেরকে হজ্জের জন্য সাধারণ হুকুম দিয়ে দাও, তারা প্রত্যেকে দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে ও উটের পিঠে চড়ে৪৬
৪৬. মূলে ضَامِرٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এটি বিশেষ করে শীর্ণ ও ক্ষীণকায় উটের প্রতিশব্দ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য এমন সব মুসাফিরের ছবি তুলে ধরা যারা দূর দূরান্ত থেকে চলে আসছে এবং পথে তাদের উটগুলো খাদ্য ও পানীয় না পাওয়ার কারণে শীর্ণকায় হয়ে গেছে।
﴿لِّيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۖ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ﴾
২৮। তোমার কাছে আসবে,৪৭ যাতে এখানে তাদের জন্য যে কল্যাণ রাখা হয়েছে তা তারা দেখতে পায়৪৮ এবং তিনি তাদেরকে যেসব পশু দান করেছেন তার উপর কয়েকটি নির্ধারিত দিনে আল্লাহর নাম নেয়৪৯ নিজেরাও খাও এবং দুর্দশাগ্রস্ত অভাবীকেও খাওয়াও।৫০
৪৭. শুরুতে হযরত ইব্রাহীমকে যে হুকুম দেয়া হয়েছিল এখানে তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামনের দিকে যা বলা হয়েছে তা এর সাথে বাড়তি সংযোজন। অতিরিক্ত ব্যাখ্যা হিসেবে এ সংযোজন করা হয়েছে। আমাদের এ অভিমতের কারণ হচ্ছে এই যে, “এই প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে” পর্যন্তই এই বক্তব্য শেষ হয়ে গেছে। এটি কাবাঘর নির্মাণের কাজ শেষ হবার সময় বলা হয়ে থাকবে। (হযরত ইবরাহীমের কাবাঘর নির্মাণ সংক্রান্ত আরো বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য দেখুন সূরা আল বাকারাহঃ ১২৫-১২৯, আলে ইমরানঃ ৯৬-৯৭ এবং ইব্রাহীমঃ ৩৫-৪১)
৪৮. এখানে কেবলমাত্র দীনী কল্যাণের কথাই বলা হয়নি, এর সাথে পার্থিব কল্যাণও সংযুক্ত রয়েছে। এ কাবাঘর ও হজ্জের বরকতেই হযরত ইবরাহীমের আ. যুগ থেকে নিয়ে নবী সা. এর যুগ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছর ধরে আরবরা একটি ঐক্যকেন্দ্র লাভ করেছে। এটিই তাদের আরবীয় অস্তিত্বকে গোত্রবাদের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছে। কেন্দ্রের সাথে এর সংযুক্তি এবং হজ্জের জন্য প্রতি বছর দেশের সব এলাকা থেকে লোকদের এখানে আসা যাওয়ার কারণে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি এক থাকে, তাদের মধ্যে আরব হবার অনুভূতি জাগ্রত থাকে এবং তারা চিন্তা ও তথ্য সরবরাহ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতির প্রচার ও প্রসারের সুযোগ লাভ করে। তারপর এ হজ্জের বরকতেই আরবরে যাবতীয় সন্ত্রাস, বিশৃংখলা ও নিরাপত্তাহীনতা অন্তত চারমাসের জন্য স্থগিত হয়ে যেতো এবং সে সময় এমন ধরনের নিরাপত্তার লাভ করা যেতো যার মধ্যে দেশের সকল এলাকার লোকেরা সফর করতে পারতো এবং বাণিজ্য কাফেলাও নিরাপদে চলাফেরা করতে সক্ষম হতো। এজন্য আরবের অর্থনৈতিক জীবনের জন্যও হজ্জ একটি রহমত ছিল আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আলে ইমরানঃ ৮০-৮১ এবং আল মায়িদাহ ১১৩ টীকা।
ইসলামের আগমনের পরে হজ্জের দীনী কল্যাণের সাথে সাথে পার্থিব কল্যাণও কয়েকগুণ বেশী হয়ে গেছে। প্রথমে তা ছিল কেবলমাত্র আরবের জন্য রহমত, এখন হয়ে গেছে সারা দুনিয়ার তাওহীদবাদীদের জন্য রহমত।
৪৯. পশু বলতে এখানে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ উট, গরু, ছাগল, ভেড়া, যেমন সূরা আল আনআ’মের ১৪২-১৪৪ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাদের উপর আল্লাহর নাম নেবার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নামে এবং তাঁর নাম উচ্চারণ করে তাদেরকে যবেহ করা যেমন পরবর্তী বাক্য নিজেই বলে দিচ্ছে। কুরআন মজীদে কুরবানীর জন্য সাধারণভাবে “পশুর উপর আল্লাহর নাম নেয়া”র পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং সব জায়গায়ই এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নামে পশু যবেহ করা। এভাবে যেন এ সত্যটির ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নাম না নিয়ে অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে পশুযবেহ করা কাফের ও মুশরিকদের পদ্ধতি। মুসলমান যখনই পশু যবেহ করবে আল্লাহর নাম নিয়ে করবে এবং যখনই কুরবানী করবে আল্লাহর জন্য করবে।
কয়েকটি নির্ধারিত দিন বলতে কোন দিনের কথা বুঝনো হয়েছে? এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। একটি মত হচ্ছে, এর অর্থ, যিলহজ্জের প্রথম দশটি দিন। ইবনে আব্বাস রা. হাসান বসরী, ইব্রাহীম নখঈ, কাতাদাহ এবং অন্যান্য বহু সাহাবী ও তাবেঈনের এ মত উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফাও রাহ. এ মতের পক্ষে। ইমাম শাফেঈ রাহ. ও ইমাম আহমদেরও রাহ. একটি উক্তি এর সমর্থনে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে, এর অর্থ, ইয়াওমুন্ নাহর (অর্থাৎ ১০ যিলহজ্জ) এবং তার পরের তিন দিন। এর সমর্থনে ইবনে আব্বাস রা., ইবনে উমররা., ইব্রাহীম নখঈ, হাসান ও আতার উক্তি পেশ করা হয়। ইমাম শাফেঈ রাহ. ও ইমাম আহমদেরও রাহ. একটি উক্তি এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তৃতীয় মতটি হচ্ছে, এর অর্থ তিন দিন তথা ইয়াওমুন্ নাহর (কুরবানীর ঈদের দিন) এবং এর পরের দু’দিন। এর সমর্থনে হযরত উমর রা., আলী রা., ইবনে উমর রা. ইবনে আব্বাস রা., আনাস ইবনে মালিক রা., আবু হুরাইরাহ রা. সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব রা. ও সাঈদ ইবনে জুবায়েরের রা. উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। ফকীহগণের মধ্য থেকে সুফিয়ান সওরী রাহ., ইমাম মালেক রাহ., ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. ও ঈমাম মুহাম্মাদ রাহ. এ মত গ্রহণ করেছেন। হানাফী ও মালেকী মাযহাবে এ মতের ভিত্তিতেই ফতোয়া দেয়া হয়েছে। এছাড়া কিছু একক উক্তি আছে। যেমন কেউ কুরবানীর দিনগুলোকে পহেলা মহররমের দিন পর্যন্ত দীর্ঘ করেছেন। কেউ শুধুমাত্র ইয়াওমুন্ নাহরের মধ্যেই তাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। কেউ ইয়াওমুন নাহরের পরে মাত্র আর একদিন কুরবানীর দিন হিসেবে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এগুলো দুর্বল উক্তি। এসবের পেছনে শক্তিশালী যুক্তি প্রমাণ নেই।
৫০. কেউ কেউ এ বক্তব্যের এ অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, খাওয়া ও খাওয়ানো উভয়টিই ওয়াজিব। কারণ, এখানে আদেশ সূচক ক্রিয়াপদের মাধ্যমে হুকুম দেয়া হয়েছে। অন্য একটি দলের মতে, খাওয়া হচ্ছে মুস্তাহাব এবং খাওয়ানো ওয়াজিব। ইমাম মালিক রাহ. ও ইমাম শাফেঈ রাহ. এমত প্রকাশ করেছেন। তৃতীয় দল বলেন, খাওয়া ও খাওয়ানো দু‘টোই মুস্তাহাব। খাওয়া মুস্তাহাব হবার কারণ হচ্ছে এই যে, জাহেলী যুগে লোকেরা নিজেদের কুরবানীর গোশত নিজেদের খাওয়া নিষেধ মনে করতো। আর খাওয়ানো এজন্য পছন্দনীয় যে, এর মাধ্যমে গরীবদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা হয়। এটি ইমাম আবু হানীফার রাহ. মত। হাসান বসরী, আত, মুজাহিদ ও ইব্রাহীম নাখঈ থেকে ইবনে জারীর এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, فَكُلُوا مِنْهَا এর মধ্যে আদেশসূচক ক্রিয়াপদ ব্যবহারের কারণে খাওয়া ওয়াজিব প্রমাণিত হয় না। এ হুকুমটি ঠিক তেমনি যেমন বলা হয়েছে وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا “যখন তোমরা ইহরামের অবস্থা থেকে বের হয়ে আসো তখন আবার শিকার করো।” (আল মায়িদাহঃ ২) এবং فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ “তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন আবার পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ো ওয়াজিব। বরং এর অর্থ হচ্ছেঃ এরপর এসনটি করার পথে কোন বাধা নেই। অনুরূপভাবে এখানেও যেহেতু লোকেরা কুরবানীর গোশত নিজেদের খাওয়া নিষিদ্ধ মনে করতো তাই বলা হয়েছেঃ না, তা খাও অর্থাৎ এটা মোটেই নিষিদ্ধ নয়।
দুর্দশাগ্রস্ত অভাবীকে আহার করানোর ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে, সচ্ছল বা ধনী ব্যক্তিকে আহার করানো যেতে পারে না। বন্ধু, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন অভাবী না হলেও তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেওয়া জায়েয। এ বিষয়টি সাহাবায়ে কেরামের কার্যাবলী থেকে প্রমাণিত। আলকামা বলেন, হযরত আবুদল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা. আমার হাতে কুরবানীর পশু পাঠান এবং নির্দেশ দেন, কুরবানীর দিন একে যবেহ করবে, নিজে খাবে, মিসকীনদেরকে দেবে এবং আমার ভাইয়ের ঘরে পাঠাবে। ইবনে উমরও রা. একই কথা বলেছেন অর্থাৎ একটি অংশ খাও, একটি অংশ প্রতিবেশীদেরকে দাও এবং একটি অংশ মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করো।
﴿ثُمَّ لْيَقْضُوا تَفَثَهُمْ وَلْيُوفُوا نُذُورَهُمْ وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ﴾
২৯। তারপর নিজেদের ময়লা দূর করে,৫১ নিজেদের মানত পূর্ণ করে৫২ এবং এ প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে।৫৩
৫১. অর্থাৎ ইয়াওমুন নাহরে (১০ যিলহজ্জ) কুরবানীর কাজ শেষ করার পর ইহরাম খুলে ফেলবে, ক্ষৌরকর্ম করবে, গোছল করবে, কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলবে এবং ইহরাম অবস্থায় যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল সেগুলো খতম করে দেবে। تَفَثَ এর আসল আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, সফরকালে যেসব ধূলো-ময়লা মানুষের গায়ে লেগে যায়। কিন্তু হজ্জ প্রসংগে যখন ধূলো-ময়লা দূর করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তখন এর সে একই অর্থ গ্রহণ করা হবে যা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, হাজী যতক্ষণ পর্যন্ত হজ্জের আনুষ্ঠানিক কার্যাবলী ও কুরবানীর কাজ শেষ না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি চুল ও নখ কাটতে পারবেন না এবং শরীরের অন্য কোন পরিচ্ছন্নতার কাজও করতে পারবেন না। (এ প্রসংগে এ কথা জেনে নেয়া উচিত যে, কুরবানীর কাজ শেষ করার পর অন্যান্য যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যায় কিন্তু স্ত্রীর কাছে যাওয়া ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ না যতক্ষণ না “তাওয়াফে ইফাদাহ” শেষ করা হয়।)
৫২. অর্থাৎ এ সময়ের জন্য যে ব্যক্তি কোন মানত করে।
৫৩. কাবাঘরের জন্য بَيْتِ الْعَتِيقِ শব্দ অত্যন্ত অর্থবহ। “আতীক” শব্দটি আরবী ভাষায় তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হচ্ছে প্রাচীন। দ্বিতীয় অর্থ স্বাধীন, যার ওপর কারোর মালিকানা নেই। তৃতীয় অর্থ সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ। এ তিনটি অর্থই এ পবিত্র ঘরটির বেলায় প্রযোজ্য।
তাওয়াফ বলতে “তাওয়াফে ইফাদাহ” অর্থাৎ তাওয়াফে যিয়ারত বুঝানো হয়েছে। ইয়াওমুন নাহরে (কুরবানীর দিন) কুরবানী করার ও ইহরাম খুলে ফেলার পর এ তাওয়াফ করা হয়। এটি হজ্জের রোকন তথা ফরযের অন্তরভুক্ত। আর যেহেতু ধূলা-ময়লা দূর করার হুকুমের সাথে সাথেই এর উল্লেখ করা হয়েছে তাই এ বক্তব্য একথা প্রকাশ করে যে, কুরবানী করার এবং ইহরাম খুলে গোসল করে নেবার পর এ তাওয়াফ করা উচিত।
﴿ذَٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِندَ رَبِّهِ ۗ وَأُحِلَّتْ لَكُمُ الْأَنْعَامُ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ ۖ فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ﴾
৩০। এ ছিল (কাবা নির্মাণের উদ্দেশ্য) এবং যে কেউ আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত পবিত্রত অনুষ্ঠানগুলোকে সম্মান করবে, তার রবের কাছে এ হবে তারই জন্য ভালো।৫৪ আর তোমাদের জন্য গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হালাল করে দেয়া হয়েছে৫৫ সেগুলো ছাড়া যেগুলো তোমাদের বলে দেয়া হয়েছে।৫৬ কাজেই মূর্তিসমূহের আবর্জনা থেকে বাঁচো৫৭ মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাকো,৫৮
৫৪. আপাতদৃষ্টিতে এটা একটা সাধারণ উপদেশ। আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত সকল মর্যাদাশালী জিনিসের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য একথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমজিদে হারাম, হজ্জ, উমরাহ ও মক্কার হরমের যেসব মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এ বক্তব্যে সেগুলোই প্রধানতম উদ্দেশ্য। তাছাড়া এর মধ্যে এ মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইংগিতও রয়েছে যে, কুরাইশরা হারম থেকে মুসলমানদেরকে বের করে দিয়ে, তাদের জন্য হজ্জের পথ বন্ধ করে দিয়ে, হজ্জের কার্যক্রমের মধ্যে জাহেলী ও মুশরিকী রীতিনীতি অন্তভূক্ত করে এবং আল্লাহর ঘরকে শিরকের আবর্জনায় দূষিত, কলুষিত করে এমন বহু মর্যাদাশালী জিনিসের মর্যাদা বিনষ্ট করে দিয়েছে যেগুলোর মর্যাদা হযরত ইব্রাহীম আ. এর সময় থেকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।
৫৫. এ প্রসংগে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুর হালাল হওয়ার কথা উল্লেখ করা উদ্দেশ্য হচ্ছে দু’টি ভুল ধারণা দূর করা। প্রথমত কুরাইশ ও আরবের মুশরিকরা “বাহীরা” “সায়েবা”, “অসীলা” ও “হাম”কেও আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত মর্যাদাসমূহের মধ্যে গণ্য করতো। তাই বলা হয়েছে, এগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত মর্যাদা নয়। বরং তিনি সমস্ত গৃহপালিত পশু হালাল করেছেন। দ্বিতীয়ত ইহরাম অবস্থায় যেভাবে শিকর করা হারাম তেমনিভাবে যেন একথা মনে না করা হয় যে, গৃহপালিত জন্তু যবেহ করা ও খাওয়াও হারাম। তাই বলা হয়েছে, এগুলো আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত মর্যাদাসমূহের মধ্যে গণ্য নয়।
৫৬. সূরা আল আনআ’ম ও সূরা আন নাহলে যে হুকুম দেয়া হয়েছে সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ যেসব জিনিস হারাম করেছেন সেগুলো হচ্ছেঃ মৃত, রক্ত, শুয়োরের মাংস এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নামে যবেহ করা পশু। (আল আনআ’মঃ ১৪৫ ও আন নাহলঃ ১১৫)
৫৭. অর্থাৎ মূর্তিপূজা থেকে এমনভাবে দূরে থাকো যেমন দুর্গন্ধময় ময়লা আবর্জনা থেকে মানুষ নাকে কাপড় দিয়ে দূরে সরে আসে। অন্য কথায় বলা যায়, তা যেন নাপাক ও ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ এবং কাছে যাবার সাথে সাথেই মানুষ তার সংস্পর্শ লাভ করে নাপাক ও নোংরা হয়ে যাবে।
৫৮. যদিও শব্দগুলো এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এ থেকে প্রত্যেকটি মিথ্যা, অপবাদ ও মিথ্যা সাক্ষের হারাম হওয়া প্রমাণ হয় তবুও এ আলোচনায় বিশেষভাবে এমনসব বাতিল আকিদা-বিশ্বাস বিধি-বিধান, রীতি-রেওয়াজ ও কল্পনা-কুসংস্কারের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যেগুলোর ওপর কুফরী ও শিরকের ভিত গড়ে উঠেছে। আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে শরীক করা এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে তাঁর বান্দাদেরকে অংশীদার করা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। এ থেকে এখানে নিষেধ করা হয়েছে। আবার আরবের মুশরিকরা যে মিথ্যার ভিত্তিতে “বাহীরা”, “সায়েবা” ও “হাম” ইত্যাদিকে হারাম গণ্য করতো তাও এ ফরমানের সরাসরি আওতাধীনে এসে যায়। যেমন সূরা আন্ নাহল-এ বলা হয়েছেঃ
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَٰذَا حَلَالٌ وَهَٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ
“আর তোমাদের কন্ঠ যে মিথ্যা বিধান দিয়ে থাকে যে, এটা হলাল এবং এটা হারাম, এ ধরনের বিধান দিয়ে আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করো না।” (আয়াতঃ ১১৬)
এ সংগে মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা কসমও একই বিধানের আওতায় আসে। যেমন বিভিন্ন সহীহ হাদীসে নবী সা. থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
عدلَت شَهادةُ الزُّورِ بالإشراكِ باللَّهِ
“মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াকে আল্লাহর সাথে শিরক করার সমান পর্যায়ে রাখা হয়েছে।”
এরপর তিনি প্রমাণ হিসেবে এ আয়াতটি পেশ করছেন। ইসলামী আইনে এ অপরাধটি শাস্তিযোগ্য। ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. ও ইমাম মুহাম্মাদের রাহ. ফতোয়া হচ্ছে, যে ব্যক্তি আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা প্রমাণিত হয়ে যাবে তার নাম চারদিকে প্রচার করে দিতে হবে এবং তাকে দীর্ঘ কাল অন্তরীণ রাখার শাস্তি দিতে হবে। হযরত উমর ও রা. একথাই বলেছেন এবং কার্যত এ পদক্ষেপই নিয়েছেন। মাকহূলের বর্ণনা হচ্ছে, হযরত উমর রা. বলেছেন এবং কার্যত এ পদক্ষেপই নিয়েছেন। মাকহূলের বর্ণনা হচ্ছে, হযরত উমর রা. বলেন,
يضرب ظهره ويلحق رأسه ويسخم وجهه ويطال حبسه
“তার পিঠে চাবুক মারতে হবে, মাথা ন্যাড়া করে দিতে হবে, মুখ কালো করে দিতে হবে এবং দীর্ঘকাল অন্তরীণ রাখার শাস্তি দিতে হবে।”
আবদুল্লাহ ইবনে আমের নিজের পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ হযরত উমরের রা. আদালতে এক ব্যক্তি সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ফলে তিনি তাকে একদিন প্রকাশ্য জনসমাগমের স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং ঘোষণা করে দেন যে, এ ব্যক্তি হচ্ছে ওমুকের ছেলে ওমুক এ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, একে চিনে রাখো। তারপর তাকে কারাগারে আটক করেন। বর্তমান কালে এ ধরনের লোকের নাম খবরের কাগজে ছেপে দিলেই ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে।
﴿حُنَفَاءَ لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِينَ بِهِ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ﴾
৩১। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেলো। এখন হয় তাকে পাখি ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে অথবা বাতাস তাকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে দেবে যেখানে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।৫৯
৫৯. এ উপমায় আকাশ বলতে বুঝানো হয়েছে মানুষের স্বভাবিক অবস্থাকে। এ অবস্থায় সে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো বান্দা হয় না এবং তার প্রকৃতি তাওহীদ ছাড়া অন্য কোন ধর্মকে চেনে না। মানুষ যদি নবী প্রদত্ত পথ-নির্দেশনা গ্রহণ করে তাহলে সে জ্ঞান ও অন্তরদৃষ্টি সহকারে এ প্রাকৃতিক অবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এবং পরবর্তী পর্যায়ে সে নিজের দিকে নয় বরং উপরের দিকে উঠতে থাকে। কিন্তু শিরক (এবং শুধুমাত্র শিরকই নয় বরং জড়বাদ ও নাস্তিক্যবাদও) গ্রহণ করার সাথে সাথেই সে নিজের প্রকৃতির আকাশ থেকে ধপাস করে নিচে পড়ে যায়। তখন সে অনিবার্যভাবে দু’টি অবস্থার যে কোনটির মুখোমুখি হয়। একটি অবস্থা হচ্ছে, শয়তান ও বিপথে পরিচালনাকারী মানুষ, যাদেরকে এ উপমায় শিকারী পাখির সাথে তুলনা করা হয়েছে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রত্যেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। আর দ্বিতীয় অবস্থাটি হচ্ছে, তার নিজের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা, তার আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তাধারা, যাদরকে বাতাসের সাথে তুলনা করা হয়েছে, তাকে উড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত কোন গভীর খাদে নিক্ষেপ করে।
মূলে “সহীক” শব্দ বলা হয়েছে এটি ‘সাহক‘ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। “সাহক” এর আসল মানে হচ্ছে পিষ্ট করা। কোন জায়গাকে এমন অবস্থায় “সাহীক” বলা হয় যখন তা এতবেশী গভীর হয় যে, তার মধ্যে কোন জিনিস গেলে তা টুকরো টুকরো বা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখানে চিন্তা ও নৈতিক চরিত্রের অধোপতনকে এমন গভীর খাদের সাথে তুলনা করা হয়েছে যার মধ্যে পড়ে গিয়ে মানুষের সমস্ত কলকব্জা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
﴿ذَٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ﴾
৩২। এ হচ্ছে আসল ব্যাপার (এটি বুঝে নাও), আর যে ব্যক্তি আল্লাহ নির্ধারিত রীতিনীতির৬০ প্রতি সম্মান দেখায়, তার সে কাজ তার অন্তরের আল্লাহভীতির পরিচায়ক।৬১
৬০. অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের চিহ্ন এটি কোন কাজ হতে পারে। যেমন, নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি অথবা কোন জিনিসও হতে পারে যেমন মসজিদ, কুরবানীর জন্য হাজীদের সংগে নেয়া উট ইত্যাদি। আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মায়িদাহ ৫ টীকা।
৬১. অর্থাৎ এ সম্মান প্রদর্শন হৃদয় অভ্যন্তরের তাকওয়ার ফল এবং মানুষের মনে যে কিছু না কিছু আল্লাহর ভয় আছে তা এরি চিহ্ন। তাইতো সে তাঁর নিদর্শনসমূহের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করছে। অন্য কথায় যদি কোন ব্যক্তি জেনে বুঝে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অমর্যাদা করে তাহলে এটা একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তার মনে আল্লাহর ভয় নেই। অথবা সে আল্লাহকে স্বীকারই করে না কিংবা স্বীকার করলেও তাঁর মোকাবিলায় বিদ্রোহাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছে।
﴿لَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ثُمَّ مَحِلُّهَا إِلَى الْبَيْتِ الْعَتِيقِ﴾
৩৩। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের ঐ সমস্ত (কুরবানীর পশু) থেকে উপকারলাভের অধিকার আছে।৬২ তারপর ওগুলোর (কুরবানী করার) জায়গা এ প্রাচীন ঘরের নিকটেই।৬৩
৬২. পূর্বের আয়াতে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এবং তাকে মনের তাকওয়ার আলামত হিসেবে চিহ্নিত করার পর এ বাক্যটি একটি বিভ্রান্তি দূর করার জন্য বলা হয়েছে। হাজীদের সাথে আনা কুরবানীর পশুও আল্লাহর নিদর্শনাবলী অন্তরভুক্ত। যেমন আরববাসীরা স্বীকার করতো এবং কুরআন নিজেই পরবর্তী পর্যায়ে বলছেঃ
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ
“এবং এ সমস্ত কুরবানীর উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তরভুক্ত করেছি।”
এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান দেখানোর যে হুকুম উপরে দেয়া হয়েছে তার দাবী কি এ যে, কুরবানীর পশুগুলোকে যখন আল্লাহর ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদেরকে কোনভাবে ব্যবহার করা যাবে না? তাদের পিঠে চড়া অথবা পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে দেয়া কিংবা তাদের দুধ পান করা কি আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান দেখাবার বিরোধী নয়? আরবের লোকেরা একথাই মনে করতো। তারা এ পশুগুলোকে একেবারেই আরোহীশূন্য অবস্থায় সুসজ্জিত করে নিয়ে যেতো। পথে তাদের থেকে কোন প্রকার লাভবান হওয়া তাদের দৃষ্টিতে ছিল পাপ। এ ভুল ধারণা দূর করার জন্য এখানে বলা হচ্ছে, কুরবানীর জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তোমরা এ পশুদের থেকে লাভবান হতে পারো। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিরোধী নয়। এ কথাটিই এ সম্পর্কিত হযরত আবু হুরাইরা রা. ও হযরত আনাস রা. বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, নবী সা. দেখলেন এক ব্যক্তি উটের লাগাম ধরে পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে এবং সে ভীষণ কষ্টের মধ্যে আছে। তিনি বললেন, “ওর পিঠে সওয়ার হয়ে যাও” সে বললো, এটা হজ্জের সময় কুরবানী করার জন্য নিয়ে যাওয়া উট। বললেন, “তাতে কি, সওয়ার হয়ে যাও।”
মুফাসসিরগণের মধ্যে ইবনে আব্বাস রা., কাতাদাহ, মুজাহিদ, দ্বাহহাক ও আতা খোরাসানী এ মত পোষণ করেছেন যে, এ আয়াতে “একটি নির্দিষ্ট সময়” মানে হচ্ছে, “যতক্ষণ পর্যন্ত পশুকে কুরবানীর জন্য নির্বাচিত ও কুরবানীর পশু নামে আখ্যায়িত না করা হয়।” এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানুষ এ পশুগুলো থেকে কেবলমাত্র ততক্ষণ পর্যন্ত লাভবান হতে পারে যতক্ষন তারা তাদেরকে কুরবানীর পশু নামে আখ্যায়িত করে না। যখনই তারা তাদেরকে কুরবানীর পশু বানিয়ে আল্লাহর ঘরে নিয়ে যাবার নিয়ত করে তখনই তাদের থেকে আর কোন প্রকার লাভবান হবার অধিকার তাদের থাকে না। কিন্তু এ ব্যাখ্যা মোটেই সঠিক বলে মনে হয় না। প্রথমত এ অবস্থায় ব্যবহার করার ও লাভবান হবার অনুমতি দেওয়াটাই অর্থহীন। কারণ কুরবানীর পশু ছাড়া অন্য পশুদের থেকে লাভবান হবার বা না হবার ব্যাপারে কবেই বা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল যে, সু্স্পষ্ট অনুমতির মাধ্যমে তা দূর করার প্রয়োজন দেখা দেয়? তারপর আয়াত পরিষ্কার বলছে, এমন সবপশু ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে যাদের ওপর “আল্লাহর নিদর্শন” শব্দ প্রযুক্ত হয়। আর একথা সুস্পষ্ট যে, এটি কেবলমাত্র তখনই হতে পারে যখন তাদেরকে কুরবানীর পশু গণ্য করা হয়।
অন্য তাফসীরকারগণ যেমন উরওয়া ইবনে যুবাইর ও আতা ইবনে আবি রিবাহ বলেন, “নির্দিষ্ট সময়” অর্থ হচ্ছে “কুরবানীর সময়।” কুরবানীর পূর্বে এ কুরবানীর পশুগুলো সওয়ারির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, এদের দুধও পান করা যায়, এদের বাচ্চাও গ্রহণ করা যেতে পারে এবং এদের পশম ও চুল ইত্যাদিও কাটা যেতে পারে। ইমাম শাফেঈ এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। হানাফীগণ যদিও প্রথম ব্যাখ্যাটির সমর্থক তবুও সেখানে এতটুকু অবকাশ বের করেছেন যে, প্রয়োজনের শর্তে লাভবান হওয়া জায়েয।
৬৩. যেমন অন্য জায়গায় هَدْيًا بَالِغَ الْكَعْبَةِ (আল মায়িদাহঃ ৯৫) এর অর্থ এই নয় যে, কাবাঘরে বা মসজিদে হারামে কুরবানী করতে হবে বরং সেখানে এর অর্থ হচ্ছে হারমের সীমানার মধ্যে কুরবানী করতে হবে। কুরআনে যে কা’বা, বায়তুল্লাহ বা মসজিদে হারাম শব্দ উচ্চারণ করে এ থেকে সাধারণত শুধুমাত্র কাবার ইমারত নয় বরং মক্কার হারম অর্থ গ্রহণ করে, এটি তার আর একটি প্রমাণ।
﴿وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ فَإِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا ۗ وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ﴾
৩৪। প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদেরকে দিয়েছেন।৬৪ (এ বিভিন্ন নিয়মের উদ্দেশ্য একই) কাজেই তোমাদের ইলাহও সে একজনই এবং তোমরা তাঁরই ফরমানের অনুগত হয়ে যাও। আর হে নবী! সুসংবাদ দিয়ে দাও বিনয়ের নীতি অবলম্বন কারীদেরকে,৬৫
৬৪. এ আয়াত থেকে দু’টি কথা জানা গেছে।
একঃ কুরবানী ছিল আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত শরীয়াতের ইবাদাত ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশবিশেষ। মানুষ যেসব পদ্ধতিতে গায়রুল্লাহর বন্দেগী করেছে সেগুলো সবাই গায়রুল্লাহর জন্য নিষিদ্ধ করে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে দেয়াই হচ্ছে ইবাদাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদের অন্যতম মৌলিক দাবী। যেমন, মানুষ গায়রুল্লাহর সামনে রুকূ ও সিজদা করেছে। আল্লাহর শরীয়াত একে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। মানুষ গায়রুল্লাহর সামনে আর্থিক নযরানা পেশ করেছে। আল্লাহর শরীয়াত তাকে নিষিদ্ধ করে যাকাত ও সাদকাহ আল্লাহর জন্য ওয়াজিব ঘোষণা করেছে। মানুষ বাতিল উপাস্যদের উদ্দেশ্যে তীর্থযাত্রা করেছে। আল্লাহর শরীয়াত কোন একটি স্থানকে পবিত্র বা বায়তুল্লাহ গণ্য করে তার যিয়ারত ও তাওয়াফ করার হুকুম দিয়েছে। মানুষ গায়রুল্লাহর নামে রোযা রেখেছে। আল্লাহর শরীয়াত তাকেও আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ঠিক এমনিভাবে মানুষ তার নিজের মনগড়া উপাস্যদের জন্য পশু বলি করতে থেকেছে। আল্লাহর শরীয়াত পশু কুরবানীকেও গায়রুল্লাহর জন্য একেবারে হারাম এবং আল্লাহর জন্য ওয়াপাজিব করে দিয়েছে।
দুইঃ এ আয়াত থেকে জানা গেছে, আল্লাহর নামে কুরবানী করাই হচ্ছে আসল জিনিস। কুরবানী কখন করা হবে, কোথায় করা হবে, কিভাবে করা হবে-এ নিয়মটির এ বিস্তারিত নিয়মাবলী মোটেই কোন মৌলিক বিষয় নয়। বিভিন্ন যুগের, জাতির ও দেশের নবীদের শরীয়াতে অবস্তার প্রেক্ষিতে এ বিস্তারিত বিষয়াবলীতে পার্থক্য ছিল। কিন্তু সবার মূল প্রাণশক্তি ও উদ্দেশ্য একই রয়েছে।
৬৫. মূলে مُخْبِتِينَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোন একটি মাত্র শব্দের সাহায্যে এর অন্তরনিহিত অর্থ পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি অর্থঃ অহংকার ও আত্মম্ভরিতা পরিহার করে আল্লাহর সামনে অক্ষমতা ও বিনয়াবনত ভাব অবলম্বন করা। তাঁর বন্দেগী ও দাসত্বে একাগ্র ও একনিষ্ঠ হয়ে যাওয়া। তাঁর ফায়সালায় সন্তুষ্ট হওয়া।
﴿الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَالصَّابِرِينَ عَلَىٰ مَا أَصَابَهُمْ وَالْمُقِيمِي الصَّلَاةِ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ﴾
৩৫। যাদের অবস্থা এই যে, আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে, যে বিপদই তাদের ওপর আসে তার ওপর তারা সবর করে, নামায কায়েম করে এবং যাকিছু রিযিক তাদেরকে আমি দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।৬৬
৬৬. আল্লাহ কখনো হারাম ও নাপাক সম্পদকে নিজের রিযিক হিসেবে আখ্যায়িত করেননি, এর আগে আমরা একথা বলেছি। তাই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যে পাক-পবিত্র রিযিক ও যে হালাল উপার্জন আমি তাদেরকে দান করেছি তা থেকে তারা খরচ করে। আবার খরচ করা মানেও সব ধরনের যা-তা খরচ নয় বরং নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনদের বৈধ প্রয়োজন পূর্ণ করা,আত্মীয়, প্রতিবেশী ও অভাবীদেরকে সাহায্য করা, জন কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা এবং আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার জন্য আর্থিকত্যাগ স্বীকার করা। অযথা খরচ, ভোগ বিলাসিতার জন্য খরচ এবং লোক দেখানো খরচেকে কুরআন “খরচ” গণ্য করছে না। বরং কুরআনের পরিভাষায় এ খরচকে অমিতব্যয়িতা ও ফজুল খরচ বলা হয়। অনুরূপভাবে কার্পণ্য ও সংকীর্ণমনতা সহকারে যা খরচ করা হয়, তার ফলে মানুষ নিজের পরিবার পরিজনদেরকেও সংকীর্ণতার মধ্যে রাখে এবং নিজেও নিজের মর্যাদা অনুযায়ী প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে না আর এই সংগে নিজের সামর্থ অনুযায়ী অন্যদেরকে সাহায্য করতেও পিছপা হয়। এ অবস্থায় মানুষ যদিও কিছু না কিছু খরচ করে কিন্তু কুরআনের ভাষায় এ খরচের নাম “ইনফাক” নয়। কুরআন একে বলে “কৃপণতা” ও মানসিক সংকীর্ণতা।
﴿وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ ۖ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ ۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
৩৬। আর কুরবানীর উটকে৬৭ আমি করেছি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তরভুক্ত; তোমাদের জন্য রয়েছে তার মধ্যে কল্যাণ।৬৮ কাজেই তোমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে৬৯ তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও।৭০ আর যখন (কুরবানীর পরে) তাদের পিঠ মাটির সাথে লেগে যায়৭১ তখন তা থেকে নিজেরাও খাও এবং তাদেরকেও খাওয়াও যারা পরিতুষ্ট হয়ে বসে আছে এবং তাদেরকেও যারা নিজেদের অভাব পেশ করে। এ পশুগুলোকে আমি এভাবেই তোমাদের জন্য বশীভূত করেছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।৭২
৬৭. মূলে بُدْنَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি শুধুমাত্র উটের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নবী সা. কুরবানীর বিধানে গরুকেও উটের সাথে শামিল করেছেন। একটি উট কুরবানী করলে যেমন তা সাতজনের জন্য যথেষ্ট, ঠিক তেমনি সাত জন মিলে একটি গরু কুরবানী দিতে পারে। মুসলিমে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বর্ণিত একটি হাদীস রয়েছে। তাতে বলা হয়েছেঃ
أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نشترك في الأضاحي والبدنه عن سبعة والبقرة عن سبعة
“রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের হুকুম দিয়েছেন আমরা যেন কুরবানীতে উটের ক্ষেত্রে সাতজন এবং গরুর ক্ষেত্রে সাতজন শরীক হয়ে যাই।
৬৮. অর্থাৎ তোমরা তা থেকে ব্যাপক হারে কল্যাণ লাভ করে থাকো। তোমাদের সেগুলো কেন করতে হবে সেদিকে এখানে ইংগিত করা হয়েছে। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত যেসব জিনিস থেকে লাভবান হয় তার মধ্য থেকে প্রত্যেকটিই আল্লাহর নামে কুরবানী করা উচিত, শুধুমাত্র নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য নয় বরং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানার স্বীকৃতি দেবার জন্যও, যাতে মানুষ মনে মনে ও কার্যত একথা স্বীকার করে যে, আল্লাহ আমাকে যাকিছু দিয়েছেন এ সবই তাঁর। ঈমান ও ইসলাম হচ্ছে আত্মত্যাগের নাম। নামায ও রোযা হচ্ছে দেহ ও তার শক্তিসমূহের কুরবানীর নাম। যাকাত হচ্ছে আল্লাহ আমাদের বিভিন্নভাবে যেসব সম্পদ দিয়েছেন সেগুলোর কুরবানী। জিহাদ সময় এবং মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতাসমূহের কুরবানী। আল্লাহর পথে যুদ্ধ প্রাণের কুরবানী। এসব এক এক প্রকার নিয়ামত এবং এক একটি দানের জন্য কৃতজ্ঞতা। এভাবে পশু কুরবানী করার দায়িত্বও আমাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে, যাতে আমরা আল্লাহর এ বিরাট নিয়মাতের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেই। কারণ, তিনি তাঁর সৃষ্টি বহু প্রাণীকে আমাদের জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন। আমরা তাদের পিঠে চড়ি। তাদের সাহায্যে চাষাবাদ ও মাল পরিবহন করি। তাদের গোশত খাই, দুধ পান করি এবং তাদের চামড়া, লোম, পশম, রক্ত, হাড় ইত্যাদি প্রত্যেকটি জিনিস নানাভাবে ব্যবহার করি।
৬৯. উল্লেখ করা যেতে পারে, উটকে দাঁড় করিয়ে যবেহ করা হয়। তার একটি পা বেঁধে দেয়া হয় তারপর কণ্ঠনালীতে সজোরে বল্লম মারা হয়। সেখান থেকে রক্তের একটি ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। তারপর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গেলে উট মাটির ওপর পড়ে যায়।‘সাওয়াফ‘ বা দাঁড় করিয়ে রাখা বলতে এটিই বুঝানো হয়েছে। ইবনে আব্বাস রা. মুজাহিদ, দ্বাহহাক প্রমুখ ব্যাখ্যাতাগণ এর এ ব্যাখ্যাই করেছেন। বরং নবী সা. থেকেও একথাই উদ্ধৃত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী হাদীস বর্ণনা করেছেন, ইবনে উমর রা. এক ব্যক্তিকে তার উটকে বসিয়ে রেখে কুরবানী করতে দেখেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি বলেন,
ابعثهَا قيامًا مقيدة سُنةَ أبي القاسم صلى الله عليه وسلم
“পা বেঁধে তাকে দাঁড় করিয়ে দাও। এটা হচ্ছে আবুল কাসেম সা. এর সুন্নাত।”
আবু দাউদ জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, নবী সা. ও তাঁর সাহাবীগণ উটের বাম পা বেঁধে রেখে বাকি তিন পায়ের ওপর তাকে দাঁড় করিয়ে দিতেন। তারপর তার হলকুমে বর্শা নিক্ষেপ করতেন। কুরআন নিজেও এ অর্থের প্রতি ইংগিত করেছেঃ إِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا “যখন তাদের পিঠ জমিতে ঠেকে যায়।” একথা এমন অবস্থায় বলা হয় যখন পশু দাঁড়িয়ে থাকে এবং তারপর জমির ওপর পড়ে যায়। অন্যথায় শুইয়ে দিয়ে কুরবানী দিয়ে কুরবানী করা অবস্থায় পিঠ তো আগে থেকেই জমির সাথে লেগে থাকে।
৭০. এ বাক্যটি আবার একথা প্রমাণ করছে যে, আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করে যবেহ করলে কোন পশু হালাল হয় না। তাই আল্লাহ “তাদেরকে যবেহ করো” না বলে বলছেন “তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও” এবং এর অর্থ হচ্ছে, পশু যবেহ করো। এ থেকে একথা আপনা আপনিই বের হয়ে আসে যে, ইসলামী শরীয়াতে আল্লাহর নাম না নিয়ে পশু যবেহ করার কোন অবকাশ নেই।
যবেহ করার সময় بسم الله الله أكبر বলার পদ্ধতি এখান থেকেই গৃহীত হয়েছে। ৩৬ আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا “তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও।” আর ৩৭ আয়াতে বলা হয়েছেঃ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ “যাতে আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াতের ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করো।”
হাদীসে কুরবানী করার সময় নাম উচ্চারণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন
(১) بسم الله ، والله أكبر ، اللهم هذا منك ولك “আল্লাহর নামে এবং আল্লাহ সবচেয়ে বড়, হে আল্লাহ! তোমরাই সম্পদে এবং তোমারই জন্য হাজির।”
(২) الله أكبر لا اله الا الله اللهم منك ولك “আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, হে আল্লাহ! তোমারই সম্পদ এবং তোমারই জন্য হাজির।”
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا ۖ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ، اللهم منك ولك
(৩) “আমি একনিষ্ঠ হয়ে আমার চেহারা এমন সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই। অবশ্যই আমার নামায ও কুরবানী এবং আমার বাঁচা ও মরা সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আমি আনুগত্যের শির নতকারীদের অন্তরভুক্ত। হে আল্লাহ! তোমারই সম্পদ এবং তোমারই জন্য হাজির।”
৭১. লেগে যাওয়ার মানে শুধু এতটুকু নয় যে, তারা মাটিতে পড়ে যায় বরং এ অর্থও এর অন্তরবুক্ত যে, তারা পড়ে গিয়ে স্থির হয়ে যায় অর্থাৎ তড়পানো বন্ধ করে দেয় এবং প্রাণবায়ু পুরোপুরি বের হয়ে যায়। আবু দাউদ, তিরমিযী ও মুসনাদে আহমদে নবী সা. এর এ বাণী উদ্ধৃত হয়েছে যে,
ما قُطِع (أوما بان) من البَهِيمَة وهي حيَّة فهي ميْتَة
“এখনো জীবিত আছে এমন পশুর যে গোশত কেটে নেয়া হয় তা মৃত পশুর গোশত (এবং হারাম)।”
৭২. কুরবানীর হুকুম কেন দেয়া হয়েছে, এখানে আবার সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ চতুষ্পদ জন্তুগুলোকে তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে যে নিয়ামত দান করেছেন এ কুরবানী হচ্ছে সে বিরাট নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
﴿لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ ۗ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ﴾
৩৭। তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া।৭৩ তিনি তাদেরকে তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো।৭৪ আর হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও।
৭৩. জাহেলীয়াতের যুগে যেমন আরববাসীরা দেবদেবীর মূর্তিদের জন্য যেসব পশু কুরবানী দিতো সেগুলো নিয়ে গিয়ে আবার তাদেরই বেদীমূলে অর্ঘ দিতো, ঠিক তেমনি আল্লাহর নামে কুরবানী দেয়া জানোয়ারের গোশত কাবাঘরের সামনে এনে রাখতো এবং রক্ত তার দেয়ালে লেপটে দিতো। তাদের মতে, এ কুরবানী যেন আল্লাহর সামনে সংশ্লিষ্ট কুরবানীর গোশত ও রক্ত পেশ করার জন্য করা হতো। এ মূর্খতার পর্দা ছিন্ন করে বলা হয়েছেঃ আল্লাহর সামনে যে আসল জিনিস পেশ করা হয় তা পশুর গোশত ও রক্ত নয় বরং তোমাদের তাকওয়া। যদি তোমরা নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রবণতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে খালেস নিয়তে একমাত্র আল্লাহর জন্য কুরবানী করো, তাহলে এ প্রবণতা, নিয়ত ও আন্তরিকতার নযরানা তাঁর কাছে পৌঁছে যাবে অন্যথায় রক্ত ও গোশত এখানেই থেকে যাবে। একথাই হাদীসে নবী সা. থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
إِنَّ الله لا يَنْظُرُ إِلى صُوَرِكُمْ، وَلا إِلى أموالكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وأعمالكم
“আল্লাহ তোমাদের চেহারা-সুরাত ও তোমাদের রঙ দেখেন না বরং তিনি দেখন তোমাদের মন ও কার্যকলাপ।”
৭৪. অর্থাৎ অন্তরে তাঁর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নাও এবং কাজে তার প্রকাশ ঘটাও ও ঘোষণা দাও। এরপর কুরবানীর হুকুমের উদ্দেশ্য ও কারণের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। পশুদের ওপর আল্লাহ মানুষের কর্তৃত্ব দান করেছেন, শুধুমাত্র এ নিয়ামতের বিনিময়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্যই কুরবানী ওয়াজিব করা হয়নি। বরং এ জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে যে, এগুলো যাঁর পশু এবং যিনি এগুলোর ওপর আমাদের কর্তৃত্ব দান করছেন, আমরা অন্তরে ও কাজে-কর্মেও তাঁর মালিকানা অধিকারের স্বীকৃতি দেবো, যাতে আমরা কখনো ভুল করে একথা মনে করে না বসি যে, এগুলো সবই আমাদের নিজেদের সম্পদ। কুরবানী করার সময় যে বাক্যটি উচ্চারণ করা হয় তার মধ্য দিয়ে এ বিষয়বস্তুটিরই প্রকাশ ঘটে। যেমন সেখানে বলা হয় اللهم منك ولك হে আল্লাহ! তোমারই সম্পদ এবং তোমারই জন্য উপস্থিত।
এক্ষেত্রে একথা জেনে নেয়া উচিত যে, এ প্যারায় কুরবানীর যে হুকুম দেয়া হয়েছে তা কেবলমাত্র হাজীদের জন্য নয় এবং শুধুমাত্র মক্কায় হজ্জের সময় কুরবানী করার জন্য নয় বরং প্রত্যেক সমর্থ মুসলমান যেখানেই সে থাকুক না কেন তার জন্য ব্যাপকভাবে এ হুকুম দেয়া হয়েছে, যাতে সে পশুদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করার নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার দায়িত্ব পালন করতে এবং এই সংগে নিজেরস্থানে হাজীদের অবস্থার সাথে শরীক হয়ে যেতেও পারে। হজ্জ সম্পাদন করার সৌভাগ্য না হলেও কমপক্ষে হজ্জের দিনগুলোতে আল্লাহর ঘরের সাথে জড়িত হয়ে হাজীগণ যে সব কাজ করতে থাকেন সারা দুনিয়ার মুসলমানরা সেসব কাজ করতে থাকবে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এ বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।
এছাড়াও অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকেও একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী সা. মদীনা তাইয়েবায় অবস্থানের সমগ্র সময়ে নিজেই প্রত্যেক বছর বকরা ঈদের সময় কুরবানী করতেন এবং তাঁরই সুন্নাত থেকে মুসলমানদের মধ্যে এ পদ্ধতির প্রচলন হয় মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজায় হযরত আবু হুরাইরার রা. এ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছেঃ
مَنْ وَجَد سَعَةً فلم يُضَحِّ فلا يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنا
“যে ব্যক্তি সামর্থ রাখার পরও কুরবানী করে না তার আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছে না আসা উচিত।”
এ হাদীসটির সকল রাবীই সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য। মুহাদ্দিসগণ শুধুমাত্র রেওয়ায়াতটির মারফূ’ (অর্থাৎ যার বর্ণনার ধারাবাহিকতা সরাসরি নবী সা. পর্যন্ত পৌঁছে গেছে) অথবা মওকুফ (যার বর্ণনার ধারাবাহিকতা সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছে শেষ হয়ে গেছে) হবার ব্যাপারে দ্বিমত ব্যক্ত করেছেন। (হাদীসটির বিশুদ্ধতা নিয়ে কোন মতভেদ হয়নি) তিরমিযীতে ইবনে উমর রা. বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
أقام رسول الله صلى الله عليه وسلم بالمدينة عشر سنين يضحي
“নবী সা. মদীনায় দশ বছর থাকেন এবং পত্যেক বছর কুরবানী করতে থাকেন।”
বুখারীতে হযরত আনাস রা. বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ
مَنْ كان ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلَاةِ فليعد وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلَاةِ فَقَدْ تَمَّ نُسُكُهُ، وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ
“যে ব্যক্তি নামাযের আগে যবেহ করলো তার আবার কুরবানী করা উচিত। আর যে ব্যক্তি নামাযের পরে কুরবানী করে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে মুসলমানদের পথ পেয়ে গেছে।” আর একথা সবার জানা যে, কুরবানীর দিন মক্কায় এমন কোন নামায হতো না যার পূর্বে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের বিরোধী হতো এবং পরে করা হতো তার অনুকূল। কাজেই নিশ্চিতরূপেই এ উক্তি হজ্জের সময় মক্কায় নয় বরং মদীনায় করা হয়।
মুসলিমে জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রা. রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নবী সা. মদীনায় বকরা ঈদের নামায পড়ান এবং কোন কোন লোক তিনি কুরবানী করে ফেলেছেন মনে করে নিজেদের কুরবানী করে বসে। এ অবস্থা দেখে তিনি হুকুম দেন, যারা আমার পূর্বে কুরবানী করেছে তাদের আবার কুরবানী করতে হবে।
কাজেই একথা সকল প্রকার সংশয়-সন্দেহের উর্ধে যে, বকরা ঈদের দিন সাধারণ মুসলমানরা সারা দুনিয়ায় যে কুরবানী করে এটা নবী সা. প্রবর্তিত সুন্নাত। তবে এখানে এ কুরবানী ওয়াজিব অথবা শুধুমাত্র সুন্নাত নিছক এ বিষয়েই মতবিরোধ দেখা যায়। ইব্রাহীম নাখঈ, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম মুহাম্মাদ এবং এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আবু ইউসুফও একে ওয়াজিব মনে করতেন। কিন্তু শাফেঈ ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মতে এটা শুধুমাত্র মুসলমানদের সুন্নাত। সুফিয়ান সাওরীও বলতেন, কেউ কুরবানী না দিলে কোন ক্ষতি নেই। তবুও উম্মতে মুসলিমার কোন এজন আলেমও একথা বলেন না যে, মুসলমানরা একমত হয়ে যদি তা পরিহার করে তবুও কোন ক্ষতি নেই। এ নতুন কথা শুধু আমাদের যুগের কোন কোন লোকের উর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভাবন যাদের জন্য নিজের প্রবৃত্তিই কুরআন এবং প্রবৃত্তিই সুন্নাত।
﴿إِنَّ اللَّهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آمَنُوا ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُورٍ﴾
৩৮। নিশ্চয়ই৭৫ আল্লাহ ঈমানদারদের সংরক্ষণ করেন৭৬ নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বিশ্বাসঘাতক কৃতঘ্নকে পছন্দ করেন না।৭৭
৭৫. এখান থেকে অন্য একটি বিষয়বস্তুর দিকে ভাষণটির মোড় ফিরে গেছে। প্রাসংগিক বক্তব্য অনুধাবন করার জন্য একথা স্মরণ করা দরকার যে, একটি এমন এক সময়ের ভাষণ যখন হিজরাতের পর প্রথমবার হজ্জের মওসুম এসেছিল। সে সময় এক দিকে মুহাজির ও মদীনার আনসারদের কাছে এ বিষয়টি বড়ই কঠিন মনে হচ্ছিল যে, তাদেরকে হজ্জের নিয়মাত থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং হারম শরীফের যিয়ারতের পথ জোরপূর্বক তাদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মক্কায় মুসলমানদের ওপর যেসব জুলুম করা হয়েছিল শুধুমাত্র সেগুলোর আঘাতই তাদের মনে দগদগ করছিল তাই নয় বরং এ ব্যাপারেও তারা অত্যন্ত শোকাহত ছিল যে, ঘরবাড়ী ছেড়ে তারা মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছে এরপর এখন মদীনাতেও তাদেরকে নিশ্চিন্তে বাস করতে দেয়া হচ্ছে না। এ সময় যে ভাষণ দেয়া হয় তার প্রথম অংশে কাবাগৃহ নির্মাণ, হজ্জ পালন ও কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে একথা বলা হয় যে, এসব বিষয়ের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল এবং জাহেলীয়াত এগুলোকে বিকৃত করে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে। এভাবে মুসলমানদের মধ্যে প্রতিশোধ নেবার সংকল্প নিয়ে নয় বরং সংষ্কারের সংকল্প নিয়ে এ অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য এগিয়ে আসার প্রেরণা সৃষ্টি করা হয়। তাছাড়া এ সংগে মদীনায় কুরবানীর পদ্ধতি জারি করে মুসলমানদেরকে এ সুযোগ দেয়া হয় যে, হজ্জের সময় নিজ নিজ গৃহেই কুরবানী করে শত্রুরা তাদেরকে যে সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে তাতে তারা অংশ গ্রহণ করতে পারবে। আবার হজ্জ থেকে আলাদাভাবে কুরবানীকে একটি স্বতন্ত্র সুন্নাত হিসেবে জারী করে। এর ফলে যারা হজ্জ করার সুযোগ পাবে না তারাও আল্লাহর এ নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞাত প্রকাশ এবং তাঁর শেষ্ঠত্ব ঘোষণার হক আদায় করতে পারবে। এরপর এখন দ্বিতীয় অংশে মুসলমানদেরকে তাদের ওপর যে জুলুম করা হয়েছিল এবং যে জুলুমের ধারা অব্যাহত ছিল তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
৭৬. মূলে مدافعت শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর উৎপত্তি হয়েছে دفع থেকে। এ শব্দটির আসল মানে হচ্ছে, কোন জিসিকে হটিয়ে দেয়া ও সরিয়ে দেয়া। কিন্তু যখন “দফা” করার পরিবের্ত “মুদাফা‘আত” করার কথা বলা হবে তখন এর মধ্যে আরো দু’টি অর্থ শামিল হয়ে যাবে।
একঃ কোন শত্রুশক্তি আক্রমণ চালাচ্ছে এবং প্রতিরক্ষাকারীতার মোকাবিলা করছে।
দুইঃ এ মোকাবিলা শুধুমাত্র একবারেই শেষ হয়ে যায়নি বরং যখনই আক্রমণকারী আক্রমণ করে তখনই এ প্রতিরক্ষাকারী তার মোকাবিলা করে। এ দু’টি অর্থ সামনে রেখে বিচার করলে মু’মিনদের পক্ষ থেকে আল্লাহর ‘মুদাফা‘আত‘ করার অর্থ এই বুঝা যায় যে, কুফর ও ঈমানে সংঘাতে মু’মিনরা একা ও নিসংগ হয় না বরং আল্লাহ নিজেই তাদের সাথে এক পক্ষ হয়ে দাঁড়ান। তিনি তাদেরকে সমর্থন দান করেন। তাদের বিরুদ্ধে শত্রুদের কৌশল ব্যর্থ করে দেন। অনিষ্টকারকদের অনিষ্টকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকেন। কাজেই এ আয়াতটি আসলে হক পন্থীদের জন্য একটি বড় রকমের সুসংবাদ। তাদের মনকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য এর চেয়ে বড় আর কোন জিনিস হতে পারে না।
৭৭. এ সংঘাতে আল্লাহ কেন হকপন্থীদের সাথে একটি পক্ষ হন এটি হচ্ছে তার কারণ। এর কারণ হচ্ছে, হকের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত দ্বিতীয় পক্ষটি বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ এবং নিয়মাত অস্বীকারকারী। আল্লাহ তার কাছে যেসব আমানত সোপর্দ করেছেন তার প্রত্যেকটিতে সে খেয়ানত করেছে এবং তাকে যেসব নিয়মাত দান করেছেন অকৃতজ্ঞতা, অস্বীকৃতি ও নেমকহারামির মাধ্যমে তার প্রত্যেকটির জবাব দিয়ে চলছে।কাজেই আল্লাহ তাকে অপছন্দ করেন এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত হক-পন্থীদেরকে সাহায্য-সহায়তা দান করেন।
﴿أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ﴾
৩৯। অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, কেননা তারা মজলুম৭৮ এবং আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন।৭৯
৭৮. যেমন ইতিপূর্বে ভূমিকায় বলা হয়েছে, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা সম্পর্কে অবতীর্ণ এটিই প্রথম আয়াত। এ আয়াতে কেবলমাত্র অনুমতি দেয়া হয়েছিল। পরে সূরা আল বাকারায় যুদ্ধের আদেশ প্রদান সম্পর্কিত আয়াতটি নাযিল হয়।অর্থাৎ
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ
আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। (আয়াতঃ ১৯০)
وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ
তাদের সাথে যেখানেই তোমাদের মোকাবিলা হয় তোমরা যুদ্ধ করো এবং তাদের উৎখাত করো সেখান থেকে যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে উৎখাত করেছে। (আয়াতঃ ১৯১)
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ
তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নিদিষ্ট হয়ে যায়। (আয়াতঃ ১৯৩)
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ
তোমাদের যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং তা তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর। (আয়াতঃ ২১৬)
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
হে মুসলমানরা! আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো এবং ভালোভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ শ্রবণকারী ও সর্বজ্ঞ। (আয়াতঃ ২৪৪)
অনুমতি ও হুকুম দেয়ার মধ্যে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান। আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী অনুমতি নাযিল হয় হিজরীর প্রথম বছরের যিলহজ্জ মাসে এবং হুকুম নাযিল হয় বদর যুদ্ধের কিছু পূর্বে দ্বিতীয় হিজরীর রজব অথবা শাবান মাসে।
৭৯. অর্থাৎ এরা মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক, এ সত্ত্বেও আল্লাহ এদেরকে আরবের সমগ্র মুশরিক সমাজের ওপর বিজয়ী করতে পারেন। একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যখন এ অস্ত্রধারণ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছিল তখন মুসলমানদের সমস্ত শক্তি কেবলমাত্র মদীনার একটি মামূলী ছোট শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় মুহাজির ও আনসারদের মিলিত শক্তি সর্বসাকুল্যে এক হাজারও ছিল না। এ অবস্থায় কুরাইশদেরকে চ্যালেঞ্জ দেয়া হচ্ছিল। আর কুরাইশরা একা ছিল না বরং আরবের অন্যান্য মুশরিক গোত্রগুলোও তাদের পেছনে ছিল। পরে ইহুদীরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। এসময় “আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে” একথা বলা অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। এর ফলে এমনসব মুসলমানদের মনেও সাহসের সঞ্চার হয়েছে যাদেরকে সমগ্র আরব শক্তির বিরুদ্ধে তলোয়ার হাতে মোকাবিলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং কাফেরদেরকেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই মর্মে যে, তোমাদের মোকবিলা আসলে আল্লাহর সাথে, ঐ মুষ্টিমেয় মুসলমানদের সাথে নয়। কাজেই যদি আল্লাহর মোকাবিলা করার সাহস থাকে তহলে সামনে এসো।
﴿الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ ۗ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ﴾
৪০। তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে৮০ শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা বলেছিল, “আল্লাহ আমাদের রব।”৮১ যদি আল্লাহ লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী করে উচ্চারণ করা হয় সেসব আশ্রম, গীর্জা, ইবাদাতখানা৮২ ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হতো।৮৩ আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করবে।৮৪ আল্লাহ বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত।
৮০. এ আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, সূরা আল হাজ্জের এ অংশটি অবশ্যই হিজরতের পরে নাযিল হয়েছে।
৮১. এদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার করে বের করে দেয়া হয় তা অনুমান করার জন্য নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা সামনে রাখতে হবেঃ
হযরত সোহাইব রুমী রা. যখন হিজরত করতে থাকেন তখন কুরাইশ বংশীয় কাফেররা তাঁকে বলে, তুমি এখানে এসেছিলে খালি হাতে। এখন অনেক ধনী হয়ে গেছো।
যেতে চাইলে তুমি খালি হাতে যেতে পারো। নিজের ধন-সম্পদ নিয়ে যেতে পারবে না। অথচ তিনি নিজে পরিশ্রম করেই এ ধন-সম্পদ উপার্জন করেছিলেন। কারো দান তিনি খেতেন না। ফলে বেচারা হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং সবকিছু ঐ জালেমদের হাওয়ালা করে দিয়ে এমন অবস্থায় মদীনায় পৌঁছেন যে, নিজের পরণের কাপড়গুলো ছাড়া তাঁর কাছে আর কিছুই ছিল না।
হযরত উম্মে সালামাহ রা. ও তাঁর স্বামী আবু সালামাহ রা. নিজেদের দুধের বাচ্চাটিকে নিয়ে হিজরত করার জন্য বের হয়ে পড়েন। বনী মুগীরাহ (উম্মে সালামাহর পরিবারের লোকেরা) তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তারা আবু সালামাহকে বলে, তোমার যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো কিন্তু আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারো না। বাধ্য হয়ে তিনি স্ত্রীকে রেখে দিয়ে চলে যান। এরপর বনী আবদুল আসাদ (আবু সালামাহর বংশের লোকেরা) এগিয়ে আসে এবং তারা বলে, শিশুটি আমাদের গোত্রের। তাকে আমাদের কাছে দিয়ে দাও। এভাবে মা ও বাপ উভয়ের কাছ থেকে শিশু সন্তানকেও ছিনিয়ে নেয়া হয়। প্রায় এক বছর পর্যন্ত হযরত উম্মে সলামাহ রা. স্বামী ও সন্তাদের শোকে ছটফট করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত বড়ই কঠিন বিপদের মধ্যদিয়ে নিজের শিশু সন্তানটি পুনরুদ্ধার করে মক্কা থেকে এমন অবস্থায় বের হয়ে পড়েন যে, একজন নিসংগ স্ত্রীলোক কোলে একটি ছোট বাচ্চা নিয়ে উটের পিঠে বসে আছেন। এমন পথ দিয়ে তিনি চলছেন যেখান দিয়ে সশস্ত্র কাফেলা যেতে ভয় পেতো।
আইয়াশ ইবনে রাবীআহ আবু জেহেলের বৈপিত্রেয় ভাই ছিলেন। হযরত উমরের রা. সাথে হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে যান। পিছে পিছে আবু জেহেল নিজের এক ভাইকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছে যায়। সে মায়ের নামে মিথ্যা বানিয়ে বলে, আম্মাজান কসম খেয়েছেন আইয়াশের চেহারা না দেখা পর্যন্ত রোদ থেকে ছায়ায় যাবেন না এবং মাথায় চিরুনীও লাগাবেন না। কাজেই তুমি গিয়ে একবার শুধু তাঁকে চেহারা দেখিয়ে দাও তারপর চলে এসো। তিনি মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও মাতৃভক্তির আতিশয্যে তাদের সংগ নেন। পথে দুই ভাই মিলে তাকে বন্দী করে এবং তাকে নিয়ে মক্কায় এমন অবস্থায় প্রবেশ করে যখন তার আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং দুই ভাই চিৎকার করে যাচ্ছিল, “হে মক্কাবাসীরা! নিজেদের নালায়েক ছেলেদেরকে এমনিভাবে শায়েস্থা করো যেমন আমরা করেছি।” দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি বন্দী থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত একজন দুঃসাহসী মুসলমান তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মক্কা থেকে মদীনায় যারাই হিজরত করেন তাদের প্রায় সবাইকেই এ ধরনের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়ও জালেমরা তাদেরকে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে বের হয়ে আসতে দেয়নি।
৮২. মূলে صَوَامِعُ, بِيَعٌ ও صَلَوَاتٌ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। صومعة এমন জায়গাকে বলা হয় যেখানে খৃষ্টান রাহেব যোগী, সন্ন্যাসী, সংসার বিরাগী সাধুরা থাকেন। بيعة শব্দটি আরবী ভাষায় খৃষ্টানদের ইবাদাতগাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। صَلَوَاتٌ শব্দের অর্থ হচ্ছে ইহুদীদের নামায পড়ার জায়গা। ইহুদীরা নিজেদের ভাষায় একে বলে صَلَوَتا “সালওয়াতা”। এটি আরামীয় ভাষার শব্দ। বিচিত্র নয় যে, ইংরেজী ভাষার (Salute ও Salutation) শব্দ এর থেকে বের হয়ে প্রথম ল্যাটিন ও পরে ইংরেজী ভাষায় পৌঁছে গেছে।
৮৩. অর্থাৎ আল্লাহ কোন একটি গোত্র বা জাতিকে স্থায়ী কর্তৃত্ব দান কেরননি, এটি তাঁর বিরাট অনুগ্রহ। বরং বিভিন্ন সময় দুনিয়ায় একটি দলকে দিয়ে তিনি অন্য একটি দলকে প্রতিহত করতে থেকেছেন। নয়তো কোন এটি নির্দিষ্ট দল যদি কোথাও স্থায়ী কর্তৃত্ব লাভ করতো তাহলে শুধু দূর্গ, প্রাসাদ এবং রাজনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস করে দেয়া হতো না বরং ইবাদাতগাহগুলোও বিধ্বস্ত হওয়ার হাত থেকে রেহাই পেতো না। সূরা আল বাকারায় এ বিষয়বস্তুকে এভাবে বলা হয়েছেঃ
وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ
“যদি আল্লাহ লোকদেরকে একজনের সাহায্যে অন্যজনকে প্রতিহত না করতে থাকতেন তাহলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি বড়ই করুণাময়।” (আয়াতঃ ২৫১)
৮৪. এ বক্তব্যটি কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় উপস্থাপিত হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করে এবং সত্য দীন কায়েম ও মন্দের জায়গায় ভালোকে বিকশিত করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালায় তারা আসলে আল্লাহর সাহায্যকারী। কারণ এটি আল্লাহর কাজ। এ কাজটি করার জন্য তারা আল্লাহর সাথে সহযোগিতা করে। আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আলে ইমরানঃ ৫০ টীকা।
﴿الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ﴾
৪১। এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজ নিষেধ করবে।৮৫ আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।৮৬
৮৫. অর্থাৎ আল্লাহকে সাহায্যকারী এবং তাঁর সাহায্য ও সহায়তালাভের অধিকরী লোকদের গুণাবলী হচ্ছে এই যে, যদি দুনিয়ায় তাদেরকে রাষ্ট্র ও শাসন ক্ষমতা দান করা হয় তাহলে তারা ব্যক্তিগত জীবনে ফাসেকী, দুষ্কৃতি, অহংকার ও আত্মম্ভরিতার শিকার হবার পরিবর্তে নামায কায়েম করবে। তাদের ধন-সম্পদ বিলাসিতা ও প্রবৃত্তি পূজার পরিবর্তে যাকাত দানে ব্যয়িত হবে। তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র সৎকাজকে দাবিয়ে দেবার পরিবর্তে তাকে বিকশিত ও সম্প্রসারিত করার দায়িত্ব সম্পন্ন করবে। তাদের শক্তি অসৎকাজকে ছড়াবার পরিবর্তে দমন করার কাছে ব্যবহৃত হবে। এ একটি বাক্যের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ এবং তার কর্মী ও কর্মকর্তাদের বৈশিষ্টের নির্যাস বের করে দেয়া হয়েছে। কেউ যদি বুঝতে চায় ইসলামী রাষ্ট আসলে কোন জিনিসের নাম তাহলে এ একটি বাক্য থেকেই তা বুঝে নিতে পারে।
৮৬. অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা কোন সময় কার হাতে সোপর্দ করতে হবে এ ব্যাপারটির সিদ্ধান্ত আল্লাহ নিজেই নেন। অহংকারী বান্দারা এ ভুল ধারণা করে যে, পৃথিবীতে বসবাসকারীদের ভাগ্যের ফায়সালা তারা নিজেরাই করে। কিন্তু যে শক্তি একটি ছোট্ট বীজকে বিশাল বৃক্ষে এবং একটি বিশাল বৃক্ষকে শুষ্ক কাষ্ঠখন্ডে পরিণত করে তার মধ্যেই এমন ক্ষমতা রয়েছে যে, যাদের প্রতাপ ও প্রতিপত্তি দেখে লোকেরা মনে করে এদেরকে নাড়াবার সাধ্য কারো নেই, তাদেরকে তিনি এমনিভাবে ভূপাতিত করেন যে, সারা দুনিয়াবাসীর জন্য শিক্ষাণীয় হয় এবং যাদেরকে দেখে কেউ কোনদিন ধারণাই করতে পারে না যে, এরাও কোন দিন উঠে দাঁড়াবে তাদের মাথা তিনি এমনভাবে উঁচু করে দেন যে, দুনিয়ায় তাদের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ডংকা বাজতে থাকে।
﴿وَإِن يُكَذِّبُوكَ فَقَدْ كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوحٍ وَعَادٌ وَثَمُودُ﴾
৪২। হে নবী! যদি তারা তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে,৮৭ তাহলে ইতিপূর্বে নূহের জাতি, আদ, সামূদ, ইবরাহীমের জাতি, লূতের জাতি ও মাদয়ানবাসীরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল
৮৭. অর্থাৎ মক্কার কাফেররা।
﴿وَقَوْمُ إِبْرَاهِيمَ وَقَوْمُ لُوطٍ﴾
৪৩। এবং মূসার প্রতিও মিথ্যা আরোপ করা হয়েছিল। এসব সত্য অস্বীকারকারীকে আমি প্রথমে অবকাশ দিয়েছি তারপর পাকড়াও করেছি।৮৮
৮৮. অর্থাৎ তাদের মধ্যে কোন জাতিকেও নবীকে অস্বীকার করার সাথে সাথেই পাকড়াও করা হয়নি। বরং প্রত্যেককে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়। তাদেরকে তখনই পাকড়াও করা হয় যখন ইনসাফের দাবী পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় কাফেররা যেন তাদের দুর্ভাগ্য আসতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে নবীর সতর্কবাণীগুলোকে নিছক অন্তসারশূন্য হুমকি না করে। মূলত এভাবে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য আল্লাহ তাঁর রীতি অনুযায়ী তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছেন। এ অবকাশের সুযোগ যদি তারা যথাযথভাবে ব্যবহার না করে তাহলে তাদের পরিণামও তাই হবে যা তাদের পূর্ববর্তীদের হয়েছে।
﴿وَأَصْحَابُ مَدْيَنَ ۖ وَكُذِّبَ مُوسَىٰ فَأَمْلَيْتُ لِلْكَافِرِينَ ثُمَّ أَخَذْتُهُمْ ۖ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ﴾
৪৪। এখন দেখে নাও আমার শাস্তি কেমন ছিল।৮৯
৮৯. মূলে نكير শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শাস্তি বা অন্য কোন শব্দের মাধ্যমে এর পুরোপুরি অর্থ প্রকাশ পায় না। এ শব্দের দু’টি অর্থ হয়।
একঃ কোন ব্যক্তির খারাপ মনোভাব ও মন্দ নীতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করা।
দুইঃ তাকে এমন শাস্তি দেয়া যার ফলে তার অবস্থা ওলটপালট হয়ে যায়, চেহারা এমনভাবে বিকৃত হয়ে যায় যেন কেউ দেখে তাকে চিনতে না পারে। এ দু’টি অর্থের দৃষ্টিতে এ বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায়, “এখন দেখে নাও, তাদের এ নীতির কারণে যখন আমার ক্রোধ উদ্দীপিত হলো তখন আমি তাদের অবস্থা পরিবর্তিত করে দিলাম।”
﴿فَكَأَيِّن مِّن قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ فَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا وَبِئْرٍ مُّعَطَّلَةٍ وَقَصْرٍ مَّشِيدٍ﴾
৪৫। কত দুষ্কৃতকারী জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি এবং আজ তারা নিজেদের ছাদের ওপর উলটে পড়ে আছে, কত কূয়া৯০ অচল এবং কত প্রাসাদ ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে।
৯০. আরবে কূয়া ও জনবসতি প্রায় সমার্থক শব্দ। কোন গোত্রর জনবসতির নাম নিতে হলে বলা হয় ما بني فلان অর্থাৎ অমুক গোত্রের কূয়া। একজন আরবের সামনে যখন বলা হবে কূয়াগুলো অকেজো পড়ে আছে তখন সে এর অর্থ এ বুঝবে যে জনবসতিগুলো জনশূন্য ও পরিত্যক্ত।
﴿أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا أَوْ آذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا ۖ فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَٰكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ﴾
৪৬। তারা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করেনি, যার ফলে তারা উপলব্ধিকারী হৃদয় ও শ্রবণকারী কানের অধিকারী হতো? আসল ব্যাপার হচ্ছে, চোখ অন্ধ হয় না বরং হৃদয় অন্ধ হয়ে যায়, যা বুকের মধ্যে আছে।৯১
৯১. মনে রাখতে হবে, কুরআন বিজ্ঞানের বই নয় বরং সাহিত্যের ভাষায় কথা বলে। এখানে অযথা এ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই যে, বক্ষস্থিত হৃদয় আবার চিন্তা করে কবে থেকে? সাহিত্যের ভাষায় আবেগ; অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা বরং প্রায় সব রকমের কাজকেই মস্তিষ্ক, বক্ষদেশ ও হৃদয়ের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। এমনকি কোন কথা মনে থাকার ব্যাপারটিও এভাবে বলা হয়, “সেটা তো আমার বুকে সংরক্ষিত আছে।”
﴿وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِالْعَذَابِ وَلَن يُخْلِفَ اللَّهُ وَعْدَهُ ۚ وَإِنَّ يَوْمًا عِندَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ﴾
৪৭। তারা আযাবের জন্য তাড়াহুড়ো করছে৯২ আল্লাহ কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভংগ করবেন না। কিন্তু তোমার রবের কাছের একটি দিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান হয়।৯৩
৯২. অর্থাৎ বারবার চ্যালেঞ্জ করছে! তারা বলছে যদি তুমি সাচ্চা নবী হয়ে থাকো, তাহলে আল্লারহ সত্য নবীকে অস্বীকার করার ফলে যে আযাব আসা উচিত এবং যার ব্যাপারে তুমি বারবার হুমকি দিয়েছো তা আসছে না কেন?
৯৩. অর্থাৎ মানুষের ইতিহাসে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের সময় নির্ধারক ও পঞ্জিকার হিসেব অনুযায়ী হয় না। যেমন আজকে একটি ভুল বা সঠিক নীতি অবলম্বন করা হলো এবং কালই তার মন্দ বা ভালো ফলাফল প্রকাশ হয়ে গেলো, এমন নয়। কোন জাতিকে বলা হয়, অমুক কর্মপদ্ধতি অবলম্বনের ফল দাঁড়াবে তোমাদের ধ্বংস। এর জবাবে তারা যদি এ যুক্তি পেশ করে যে, এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করার পর আমাদের দশ বিশ-পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, এখনো তো আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি, তাহলে তারা হবে বড়ই নির্বোধ। ঐতিহাসিক ফলাফলের জন্য দিন, মাস ও বছর তো সামান্য ব্যাপার শতাব্দীও কোন বিরাট ব্যাপার নয়।
﴿وَكَأَيِّن مِّن قَرْيَةٍ أَمْلَيْتُ لَهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ ثُمَّ أَخَذْتُهَا وَإِلَيَّ الْمَصِيرُ﴾
৪৮। কতই জনপদ ছিল দুরাচার, আমি প্রথমে তাদেরকে অবকাশ দিয়েছি তারপর পাকড়াও করেছি। আর সবাইকে তো ফিরে আমারই কাছে আসতে হবে।
﴿قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَنَا لَكُمْ نَذِيرٌ مُّبِينٌ﴾
৪৯। হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, “ওহে লোকেরা, আমি তো তোমাদের জন্য শুধুমাত্র (খারাপ সময় আসার আগেই) একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী।৯৪
৯৪. আমি তোমাদের ভাগ্য নির্ণায়ক নই বরং একজন সতর্ককারী মাত্র। সর্বনাশ ঘটার আগে তোমাদের সতর্ক করে দেয়াই আমার কাজ, এর বেশী কোন দায়িত্ব আমার ওপর নেই। পরবর্তী ফায়সালা করা আল্লাহর কাজ। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে কতদিন পর্যন্ত অবকাশ দেবেন এবং কবে কোন অবস্থায় শাস্তি দেবেন।
﴿فَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ﴾
৫০। কাজেই যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদের জন্য রয়েছে মাগফেরাত ও সম্মানজনক জীবিকা।৯৫
৯৫. “মাগফেরাত” বলতে বুঝানো হয়েছে অপরাধ, পাপ, ভুল-ভ্রান্তি ও দুর্বলাত উপেক্ষা করা ও এড়িয়ে চলা। আর “সম্মানজনক জীবিকা”র দু’টি অর্থ হয়। প্রথমত উত্তম জীবিক দেয়া এবং দ্বিতীয়ত মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে জীবিকা দেয়া।
﴿وَالَّذِينَ سَعَوْا فِي آيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ﴾
৫১। আর যারা আমার আয়াতকে খাটো করার চেষ্টা করবে তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী।
﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا إِذَا تَمَنَّىٰ أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنسَخُ اللَّهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللَّهُ آيَاتِهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
৫২। আর হে মুহাম্মাদ! তোমার পূর্বে আমি এমন কোনো রাসূল ও নবী পাঠাইনি৯৬ (যার সাথে এমন ঘটনা ঘটেনি যে) যখন সে তামান্না করেছে।৯৭ শয়তান তার তামান্নায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।৯৮ এভাবে শয়তান যাকিছু বিঘ্ন সৃষ্টি করে আল্লাহ তা দূর করে দেন এবং নিজের আয়াত সমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন,৯৯ আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।১০০
৯৬. রাসূল ও নবীর মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারটির ব্যাখ্যা সূরা মারইয়ামের ৩০ টীকায় আলোচিত হয়েছে।
৯৭. মূল শব্দটি হচ্ছে تَمَنَّىٰ (তামান্না)। আরবী ভাষায় এ শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হচ্ছে কোন জিনিসের আশা-আকাংখা করা। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে তেলাওয়াত অর্থাৎ কিছু পাঠ করা।
৯৮. “তামান্না” শব্দটি যদি প্রথম অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে এর অর্থ হবে, শয়তান ও তার আকাংখা পূর্ণ হবার পথে বাধার সৃষ্টি করে। আর দ্বিতীয় অর্থে গ্রহণ করলে এর অর্থ হবে, যখনই তিনি লোকদেরকে আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন তখনই শয়তান সে সম্পর্কে লোকদের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় ও আপত্তি সৃষ্টি করে দিয়েছে, সেগুলোর অদ্ভুত অদ্ভুত অর্থ তাদের সামনে তুলে ধরেছে এবং একমাত্র সঠিক অর্থটি ছাড়া বাকি সব ধরনের উলটা-পালটা অর্থ লোকদেরকে বুঝিয়েছে।
৯৯. প্রথম অর্থটির দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হবে এই যে, আল্লাহর শয়তানের বিঘ্ন সৃষ্টি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নবীর তামান্না তথা আশা আকাংখা (আর নবীর আশা-আকাংখা এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, তাঁর প্রচেষ্টা ফলবতী এবং মিশন বাস্তবায়িত হবে) পূর্ণ করেন এবং নিজের আয়াতকে (অর্থাৎ নবীর সাথে অংগীকার করেছিলেন) পাকাপোক্ত ও মজবুত অংগীকারে পরিণত করেন। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর তৎপর্য হবে, শয়তানের ঢুকানো সন্দেহ-সংশয় ও আপত্তি আল্লাহ দূর করে দেন এবং এক একটি আয়াত সম্পর্কের সে লোকদের মনে যেসব জটিলতা সৃষ্টি করে পরবর্তী কোন অধিকতর সুষ্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে সেগুলো পরিষ্কার করে দেয়া হয়।
১০০. অর্থাৎ তিনি জানেন শয়তান কোথায় কি বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন এবং তার কি প্রভাব পড়েছে। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শয়তানী ফিতনার প্রতিবিধান করে।
﴿لِّيَجْعَلَ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِّلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ وَالْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ ۗ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَفِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ﴾
৫৩। (তিনি এজন্য এমনটি হতে দেন) যাতে শয়তানের নিক্ষিপ্ত অনিষ্টকে পরীক্ষায় পরিণত করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে (মুনাফিকীর) রোগ রয়েছে এবং যাদের হৃদয়বৃত্তি মিথ্যা-কলূষিত-আসলে এ জালেমরা শত্রুতায় অনেক দূরে পৌঁছে গেছে
﴿وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَيُؤْمِنُوا بِهِ فَتُخْبِتَ لَهُ قُلُوبُهُمْ ۗ وَإِنَّ اللَّهَ لَهَادِ الَّذِينَ آمَنُوا إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ﴾
৫৪। –এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা জেনে নেয় যে, তোমার রবের পক্ষ থেকে এটা সত্য এবং তারা এর প্রতি ঈমান আনে এবং এর সামনে তাদের অন্তর ঝুঁকে পড়ে; যারা ঈমান আনে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ চিরকাল সত্য-সরল পথ দেখিয়ে থাকেন।১০১
১০১. অর্থাৎ শয়তানের ফিতনাবাজীকে আল্লাহ লোকদের জন্য পরীক্ষা এবং নকল থেকে আসলকে আলাদ করার একটা মাধ্যমে পরিণত করেছেন। বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরা এসব জিনিস থেকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এগুলো তাদের জন্য ভ্রষ্টতর উপকরণে পরিণত হয়। অন্যদিকে স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী লোকেরা এসব কথা থেকে নবী ও আল্লাহর কিতাবের সত্য হবার দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করে এবং তারা অনুভব করতে থাকে যে, এগুলো শয়তানের অনিষ্টকর কার্যকলাপ। এ জিনিসটি তাদেরকে একদম নিশ্চিন্ত করে দেয় যে, এটি নির্ঘাত কল্যাণ ও সত্যের দাওয়াত, নয়তো শয়তান এতে এতো বেশী অস্থির হয়ে পড়তো না।
বক্তব্য পরম্পরা সামনে রাখলে এ আয়াত গুলোর অর্থ পরিষ্কার বুঝা যায়। নবী সা. এর দাওয়াত এ সময় যে পর্যায়ে ছিল তা দেখে বাহ্যজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা মনে করছিল তিনি নিজের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। সাধারণ দর্শকরা এটাই দেখছিল যে, এক ব্যক্তির বিপুল আকাংখা ছিল। তিনি আশা করছিলেন তাঁর জাতি তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। তের বছর ধরে নাউযুবিল্লাহ অনেক মাথা খোড়ার পর তিনি শেষমেষ নিজের মুষ্টিমেয় কয়েকজন সংগী সাথী নিয়ে প্রিয় স্বদেশভূমি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হলেন। এ অবস্থায় লোকেরা যখন তাঁর এ বক্তব্য দেখতো যেখানে তিনি বলছেন, আমি আল্লাহর নবী এবং তিনি আমাকে সাহায্য-সহায়তা দান করছেন আর এ সংগে কুরআনের এ ঘোষণাবলীও দেখতো, যাতে বলা হয়েছে, নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী জাতি আল্লাহর আযাবের সুম্মখীন হয় তখন তাদের কাছে তাঁর ও কুরআনের সত্যতা সংশয়িত হয়ে যেতো। তাঁর বিরোধীরা এর ফলে গায়ে পড়ে নানা কথা বলতো। তারা বলতো, কোথায় গেলো সে আল্লাহর সাহায্য সহায়তা? কি হলো সে শাস্তির ভয় দেখাবার? আমাদের যে আযাবের ভয় দেখানো হতো তা এখন আসে না কেন? এর আগের আয়াত গুলোতে এসব কথার জবাব দেয়া হয়েছিল এবং এরি জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। আগের আয়াত গুলোতে জবাবের লক্ষ ছিল কাফেররা এবং এ আয়াত গুলোতে এর লক্ষ হচ্ছে এমন সব লোক যারা কফেরদের প্রচারণায় প্রভাবিত হচ্ছিল। সমগ্র জবাবের সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ
“কোন জাতি কর্তৃক তার নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার ব্যাপারটি ইতিহাসে কোন নতুন ঘটনা নয়। ইতিপূর্বেও এমনটিই হয়েছে। তারপর এ মিথ্যা আরোপের পরিণামও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের আকারে তোমাদের সামনে রযেছে। শিক্ষা নিতে চাইলে এ থেকে নিতে পারো। তবে মিথ্যা আরোপ এবং নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার সাথে সাথেই কুরআনের অসংখ্য আয়াতে যে আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে তা শুরু হয়ে যায়নি কেন, এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, প্রত্যেকটি প্রত্যাখ্যান সংগে সংগেই আযাব নিয়ে আসে একথা কবে বলা হয়েছিল? আর আযাব নিয়ে আসা নবীর নিজের কাজ এ কথাইবা তিনি কবে বলেছিলেন? এর ফায়সালা তো আল্লাহ নিজেই করেন এবং তিনি তাড়াহুড়া করে কাজ করেন না। ইতিপূর্বেও তিনি আযাব নাযিল করার আগে জাতিগুলোকে অবকাশ দিয়ে এসেছেন এবং এখনো দিচ্ছেন। এ অবকাশকাল যদি শত শত বছর পর্যন্তও দীর্ঘ হয় তাহলে এ থেকে নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি আযাব নাযিলের হুমকি দেয়া হয়েছিল তা অন্তসারশূন্য প্রমাণিত হয় না।
তারপর নবীর আশা-আকাংখা পূর্ণ হবার পথে বাধার সৃষ্টি হওয়া বা তাঁর দাওয়াতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ এবং বিভিন্ন প্রকার সন্দেহ-সংশয়-আপত্তির প্রবল ঝড় সৃষ্টি হওয়াও কোন নতুন কথা নয়। পূর্বের সকল নবীর দাওয়াতের মোকাবিলায় এসব কিছুই হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ এসব শয়তানী ফিতনার মুলোচ্ছেদ করেছেন। বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সত্যের দাওয়াত সম্প্রসারিত হয়েছে। সুষ্পষ্ট ও বিস্তারিত আয়াতের মাধ্যমে সন্দেহ-সংশয়ের বিঘ্ন দূরীভূত হয়েছে। শয়তান ও তার সাংগ পাংগরা এসব কৌশল অবলম্বন করে আল্লাহর আয়াতকে মর্যাদাহীন করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ সেগুলোকেই মানুষের মধ্যে আসল ও নকলের পার্থক্য করার মাধ্যমে পরিণত করেছেন। এ পথেই আসল ও নির্ভেজাল মানুষেরা সত্যের দাওয়াতের দিকে এগিয়ে আসে এবং ভেজাল ও মেকী লোকেরা ছাঁটাই হয়ে আলাদা হয়ে যায়।”
পূর্বাপর বক্তব্যের আলোকে এ হচ্ছে এ আয়াত গুলোর পরিষ্কার ও সহজ সরল অর্থ। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটি রেওয়ায়াত এ আয়াত গুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে এমন জটিলতা সৃষ্টি করে দিয়েছে যার ফলে কেবল এদের অর্থেরই আমূল পরিবর্তন ঘটেনি বরং সমগ্র দীনের বুনিয়াদই বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এখানে আমি এর আলোচনা এজন্য করছি যে, কুআনেরর জ্ঞানানুশীলনকারীকে অবশ্যি কুরআনেরর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে রেওয়ায়াতের সাহায্য গ্রহণ করার সঠিক ও বেঠিক পদ্ধতিগুলোর পার্থক্য ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং তাদের জানতে হবে রেওয়ায়াতের প্রতি মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে অবৈধ বাড়াবাড়ির ফল কি হয় এবং কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদানকারী রেওয়ায়াত যাচাই করার সঠিক পদ্ধতি কি।
ঘটনা এভাবে বর্ণনা করা হয় যে, নবী সা. এর মনে আকাংখা জাগে, আহা, যদি কুআনে এমন কোন আয়াত নাযিল হতো যার ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের ঘৃণা দূর হয়ে যেতো এবং তারা কিছুটা কাছাকাছি এসে যেতো! অথবা কমপক্ষে তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে এমন কড়া সমালোচনা না হতো যা তাদেরকে উত্তেজিত করে। এ আকাংখা তাঁর মনের মধ্যেই ছিল এমন সময় একদিন কুরাইশদের একটি বড় মজলিসে বসে থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর সূরা আন নাজম নাযিল হয় এবং তিনি তা পড়তে শুরু করেন। যখন তিনি أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّىٰ، وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَىٰ আয়াতে পৌঁছেন তখন হঠাৎ তাঁর মুখ থেকে নাকি বের হয়ে যায়ঃ تلك الغرانقة العلى، وان شفاعتين لترجى (এরা মহিয়সী দেবী, এদের সুপারিশ অবশ্যই কাংখিত) এরপর তিনি সামনের দিকে সূরা নজমের আয়াত গুলো পড়ে যেতে থাকেন। এমনকি সূরা শেষে যখন তিনি সিজদা করেন তখন মুশরিক মুসলিম নির্বিশেষে সবাই সিজদা করে। কুরাইশ সংশীয় কাফেররা বলতে থাকে, এখন আর মুহাম্মাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরাও তো এ কথাই বলতাম, আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা আর আমাদের এ দেবদেবীরা তাঁর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশকারী। সন্ধ্যায় জিব্রাঈল আসেন। তিনি বলেন,