আল লাহাব

নামকরণঃ

প্রথম আয়াতের লাহাব (لَهَبٍ)  শব্দকে এ সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কালঃ

এর মক্কী হবার ব্যাপারে তাফসীরকারদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। কিন্তু মক্কী যুগের কোন সময় এটি নাযিল হয়েছিল তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। তবে রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে আবু লাহাবের যে ভূমিকা এখানে দেখা গেছে তা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে, এ সূরাটি এমন যুগে নাযিল হয়ে থাকবে যখন রাসূলের সা. সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে সে সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল এবং তার দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি ইসলামের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধার সৃষ্টি করেছিল। সম্ভবত কুরাইশরা যখন রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর বংশের লোকদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করে তাদের শে’বে আবু তালেবে (আবু তালেব গিরিপথ) অন্তরীণ করেছিল এবং একমাত্র আবু লাহাবই তার বংশের লোকদেরকে পরিত্যাগ করে শত্রুদের সাথে অবস্থান করছিল, তখনই এ সূরাটি নাযিল হওয়া বিচিত্র নয়। আমাদের এ অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে, আবু লাহাব ছিল রাসূলুল্লাহ সা. এর চাচা। আর ভাতিজার মুখে চাচার প্রকাশ্যে নিন্দাবাদ ততক্ষণ সংগত হতে পারতো না যতক্ষণ চাচার সীমা অতিক্রমকারী অন্যায়, জুলম ও বাড়াবাড়ি উন্মুক্তভাবে সবার সামনে না এসে গিয়ে থাকে। এর আগে যদি শুরুতেই এ সূরাটি নাযিল করা হতো তাহলে লোকেরা নৈতিক দিক দিয়ে একে ত্রুটিপূর্ণ মনে করতো। কারণ ভাতিজার পক্ষে এভাবে চাচার নিন্দা করা শোভা পায় না।

পটভূমিঃ

কুরআনে মাত্র এ একটি জায়গাতেই ইসলামের শত্রুদের কারো নাম নিয়ে তার নিন্দা করা হয়েছে। অথচ মক্কায় এবং হিজরতের পরে মদীনায়ও এমন অনেক লোক ছিল যারা ইসলাম ও মুহাম্মাদ সা. এর শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যক্তিটির এমনকি বিশেষত্ব ছিল যে কারণে তার নাম নিয়ে নিন্দা করা হয়েছে? একথা বুঝার জন্য সমকালীন আরবের সামাজিক অবস্থা অনুধাবন এবং সেখানে আবু লাহাবের ভূমিকা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রাচীন যুগে যেহেতু সারা আরব দেশের সব জায়গায় অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, লুটতরাজ ও রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করছিল এবং শত শত বছর থেকে এমন অবস্থা চলছিল যার ফলে কোন ব্যক্তির জন্য তার নিজের বংশ ও রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়- পরিজনের সহায়তা ছাড়া নিজের ধন-প্রাণ ও ইজ্জত-আবরুর হেফাজত করা কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। এজন্য আরবীয় সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে মহাপাপ মনে করা হতো। রাসূলুল্লাহ সা. যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এলেন তখন আরবের ঐ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাবে কুরাইশ গোত্রের অন্যান্য পরিবার ও তাদের সরদাররা তাঁর কঠোর বিরোধিতা করলেও বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব (হাশেমের ভাই মুত্তালিবের সন্তানরা) কেবল তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেনি বরং প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। অথচ তাদের অধিকাংশই তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেনি। কুরাইশের অন্যান্য পরিবারের লোকেরাও রাসূলুল্লাহর সা. রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের এ সমর্থন-সহযোগিতাকে আরবের নৈতিক ঐতিহ্যের যথার্থ অনুসারী মনে করতো। তাই তারা কখনো বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে এই বলে ধিক্কার দেয়নি যে, তোমরা একটি ভিন্ন ধর্মের আহবায়কের প্রতি সমর্থন দিয়ে নিজেদের পৈতৃক ধর্ম থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছো। তারা একথা জানতো এবং স্বীকারও করতো যে, নিজেদের পরিবারের একজন সদ্যস্যকে তারা কোনক্রমেই শক্রর হাতে তুলে দিতে পারে না। কুরাইশ তথা সমগ্র আরবের অধিবাসীরাই নিজেদের আত্মীয়ের সাথে সহযোগিতা করাকে একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করতো।

জাহেলী যুগেও আরবের লোকেরা এ নৈতিক আদর্শকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখতো। অথচ শুধুমাত্র একজন লোক ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এ আদর্শ ও মূলনীতি লংঘন করে। সে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব। রাসূলুল্লাহ সা. এর চাচা। রাসূলের সা. পিতা এবং এ আবু লাহাব ছিল একই পিতার সন্তান। আরবে চাচাকে বাপের মতই মনে করা হতো। বিশেষ করে যখন ভাতিজার বাপের ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল তখন আরবীয় সমাজের রীতি অনুযায়ী চাচার কাছে আশা করা হয়েছিল, সে ভাতিজাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু এ ব্যক্তি ইসলাম বৈরিতা ও কুফরী প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে এ সমস্ত আরবীয় ঐতিহ্যকে পদদলিত করেছিল।

মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সূত্রে ইবনে আব্বাস থেকে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সা.কে সর্বসাধারণের কাছে দাওয়াত পেশ করার হুকুম দেয়া হলো এবং কুরআন মজীদে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হলোঃ “সবার আগে আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখান।” এ নির্দেশ পাওয়ার পর সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সা. সাফা পাহাড়ে উঠে বুলন্দ আওয়াজে চিৎকার করে বললেন يا صباحاه  (হায়, সকাল বেলার বিপদ!) আরবে এ ধরনের আওয়াজ এমন এক ব্যক্তি দিয়ে থাকে যে ভোর বেলার আলো আঁধারীর মধ্যে কোন শত্রুদলকে নিজেদের গোত্রের ওপর আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে থাকে। রাসূলুল্লাহর সা. এ আওয়াজ শুনে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, কে আওয়াজ দিচ্ছে? বলা হলো মুহা‌ম্মাদ (রাসূলুল্লাহ সা.) আওয়াজ দিচ্ছেন। একথা শুনে কুরাইশদের সমস্ত পরিবারের লোকেরা দৌঁড়ে গেলো তাঁর দিকে। যে নিজে আসতে পারতো সে নিজে এসে গেলো এবং সে নিজে আসতে পারতো না সে তার একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিল। সবাই পৌঁছে গেলে তিনি কুরাইশের প্রত্যেকটি পরিবারের নাম নিয়ে ডেকে ডেকে বললেনঃ হে বনী হাশেম! হে বনী আবদুল মুত্তালিব! হে বনী ফেহর! হে বনী উমুক! হে বনী উমুক! যদি আমি তোমাদের এ কথা বলি, এ পাহাড়ের পেছনে একটি সেনাবাহিনী প্রস্তুত হয়ে রয়েছে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য, তাহলে আমার কথা কি তোমরা সত্য বলে মেনে নেবে? লোকেরা জবাব দিল, হ্যাঁ, আমরা কখনো আপনার মুখে মিথ্যা কথা শুনিনি। একথা শুনে তিনি বললেনঃ তাহলে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আগামীতে কঠিন আযাব আসছে। একথায় অন্য কেউ বলার আগে তাঁর নিজের চাচা আবু লাহাব বললোঃ تَبًّا لَكَ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا “তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি কি এজন্য আমাদের ডেকেছিলে?” অন্য একটি হাদীসে একথাও বলা হয়েছে, সে রাসূলুল্লাহ সা. এর দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য একটি পাথর উঠিয়েছিল। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর ইত্যাদি)।

ইবনে যায়েদ বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ আবু লাহাব একদিন রাসূলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করলো, যদি আমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করি তাহলে এর বদলে আমি কি পাবো? তিনি জবাব দিলেন, অন্যান্য ঈমানদাররা যা পাবে আপনিও তাই পাবেন। আবু লাহাব বললোঃ আমার জন্য কিছু বাড়তি মর্যাদা নেই? জবাব দিলেনঃ আপনি আর কি চান? একথায় সে বললোঃ تَبَّا لَهَذَا الدِّيْنَ تَبَّا اَنْ اَكُوْنَ وَهَوْلَاءِ سَوَاءً  “সর্বনাশ হোক এ দ্বীনের যেখানে আমি ও অন্যান্য লোকেরা একই পর্যায়ভুক্ত হবে।” (ইবনে জারীর) মক্কায় আবু লাহাব ছিল রাসূলুল্লাহর সা. নিকটতম প্রতিবেশী। উভয়ের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর। এছাড়াও হাকাম ইবনে আস (মারওয়ানের বাপ), উকবা উবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা ও ইবনুল আসদায়েল হুযালীও তাঁর প্রতিবেশী ছিল। এরা বাড়িতেও রাসূলুল্লাহকে নিশ্চিন্তে থাকতে দিতো না। তিনি যখন নামায পড়তেন, এরা তখন ওপর থেকে ছাগলের নাড়িভূড়ি তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করতো। কখনো তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্না হতো এরা হাঁড়ির মধ্যে ময়লা ছুঁড়ে দিতো। রাসূলুল্লাহ সা. বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন, “হে বনী আবদে মান্নাফ! এ কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ?” আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (আবু সুফিয়ানের বোন) প্রতি রাতে নবী সা. এর ঘরের দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডালপালা ছড়িয়ে রেখে দিতো। এটা ছিল তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ। যাতে রাসূলুল্লাহ সা. বা তাঁর শিশু সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিঁধে যায়। (বায়হাকী, ইবন আবী হাতেম, ইবনে জারীর, ইবনে আসাকির ও ইবনে হিশাম)।

নবুওয়াত লাভের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দুই মেয়েকে আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতাইবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। নবুওয়াতের পরে যখন তিনি ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখন আবু লাহাব তার দুই ছেলেকে বলে, তোমরা মুহাম্মাদের (রসুলূল্লাহ সা.) মেয়েদের তালাক না দিলে আমার পক্ষে তোমাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত হারাম হয়ে যাবে। কাজেই দু’জনেই তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়। উতাইবা জাহেলিয়াতের মধ্যে খুব বেশী অগ্রসর হয়ে যায়। সে একদিন রাসূলুল্লাহর সা. সামনে এসে বলেঃ আমি وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى এবং اَلَّذِى دَنَا فَتَدَلَّى  অস্বীকার করছি। একথা বলে তাঁর দিকে থুথু নিক্ষেপ করে। থুথু তাঁর গায়ে লাগেনি। তিনি বলেনঃ হে আল্লাহ! তোমার কুকুরদের মধ্য থেকে একটি কুকুর এর ওপর চাপিয়ে দাও। এরপর উতাইবা তার বাপের সাথে সিরিয়া সফরে রওয়ানা হয়। সফরকালে রাতে তাদের কাফেলা এক জায়গায় অবস্থান করে। স্থানীয় লোকেরা জানায়, সেখানে রাতে হিংস্র জানোয়ারদের আনাগোনা হয়। আবু লাহাব তার কুরাইশী সাথীদের বলে, আমার ছেলের হেফাজতের ভালো ব্যবস্থা করো। কারণ আমি মুহাম্মাদের সা. বদ দোয়ার ভয় করছি। একথায় কাফেলার লোকেরা উতাইবার চারদিকে নিজেদের উটগুলোকে বসিয়ে দেয় এবং তারা নিজেরা ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে একটি বাঘ আসে। উটদের বেষ্টনী ভেদ করে উতাইবাকে ধরে এবং সেখানেই তাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে খেয়ে ফেলে (আল ইসতিআব লি ইবনে আবদিল বার, আল ইসাবাঃ লি ইবনে হাজার, দালায়েলুন নুবুওয়া লি আবী নাঈম আল ইসফাহানী ও রওদুল উনুফ লিস সুহাইলী)। বর্ণনাগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কোন কোন বর্ণনাকারী তালাকের ব্যাপারটি নবুওয়াতের ঘোষণার পরের ঘটনা বলেন। আবার কোন কোন বর্ণনাকারীর মতে “তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাব” এর নাযিলের পরই তালাকের ঘটনাটি ঘটে। আবার আবু লাহাবের এ তালাক দানকারী ছেলেটি উতবা ছিল না উতাইবা— এ ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর উতবা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ সা. এর মুবারক হাতে বাইআ’ত গ্রহণ করেন, একথা প্রামাণিত সত্য। তাই আবু লাহাবের তালাকদানকারী ছেলেটি যে উতাইবা ছিল, এতে সন্দেহ নেই।

সে যে কেমন জঘন্য মানসিকতার অধিকারী ছিল তার পরিচয় একটি ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সা. এর ছেলে হযরত আবুল কাসেমের ইন্তিকালের পর তাঁর দ্বিতীয় ছেলে হযরত আবদুল্লাহরও ইন্তিকাল হয়। এ অবস্থায় আবু লাহাব তার ভাতিজার শোকে শরীক না হয়ে বরং আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌঁড়ে কুরাইশ সরদারদের কাছে পৌঁছে যায়। সে তাদেরকে জানায়ঃ শোনো, আজ মুহাম্মাদের (রাসূলুল্লাহ সা.) নাম নিশানা মুছে গেছে। তার এ ধরনের আচরণের কথা আমরা ইতিপূর্বে সূরা কাউসারের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করে এসেছি। রাসূলুল্লাহ সা. যেখানে যেখানে ইসলামের দাওয়াত দিতে যেতেন আবু লাহাবও তাঁর পেছনে পেছনে সেখানে গিয়ে পৌঁছতো এবং লোকদের তাঁর কথা শুনার কাজে বাধা দিতো। রাবীআ’হ ইবনে আব্বাদ আদদীলী রা. বর্ণনা করেন, আমি একদিন আমার আব্বার সাথে যুল-মাজাযের বাজারে যাই। তখন আমার বয়স ছিল কম। সেখানে রাসূলুল্লাহ সা. কে দেখি। তিনি বলছিলেনঃ “হে লোকেরা! বলো, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। একথা বললেই তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে।” এ সময় তাঁর পেছনে পেছনে এক ব্যক্তি বলে চলছিল, “এ ব্যক্তি মিথ্যুক, নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছে।” আমি জিজ্ঞেস করি, এ লোকটি কে? লোকেরা বললো ওঁর চাচা আবু লাহাব। (মুসনাদে আহমাদ ও বায়হাকী) এ একই বর্ণনাকারী হযরত রাবীআহ রা. থেকে আর একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে দেখলাম। তিনি প্রত্যেকটি গোত্রের শিবিরে যাচ্ছিলেন এবং বলছিলেনঃ “হে বনী অমুক! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছি, একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমরা আমাকে সত্য নবী বলে মেনে নাও এবং আমার সাথে সহযোগিতা করো। এভাবে আল্লাহ আমাকে যে কাজ করার জন্য পাঠিয়েছেন তা আমি পূর্ণ করতে পারবো।” তাঁর পিছে পিছে আর একটি লোক আসছিল এবং সে বলছিলঃ “হে বনী অমুক! এ ব্যক্তি নিজে যে নতুন ধর্ম ও ভ্রষ্টতা নিয়ে এসেছে লাত ও উযযার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমাদের সেদিকে নিয়ে যেতে চায়। এর কথা একদম মেনো না এবং এর পেছনেও চলো না।” আমি আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করলামঃ এ লোকটি কে? তিনি বললেনঃ এ লোকটি ওঁরই চাচা আবু লাহাব। (মুসনাদে আহমাদ ও তাবারানী) তারেক ইবনে আবদুল্লাহ আল মাহারেবীর রা. রেওয়ায়াতও প্রায় এ একই ধরনের। তিনি বর্ণনা করেছেনঃ যুল মাজাযের বাজারে দেখলাম, রাসূলুল্লাহ সা. লোকদের বলে যাচ্ছেন, “হে লোকেরা! তোমরা লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো, তাহলে সফলকাম হয়ে যাবে।” ওদিকে তাঁর পিছে পিছে একজন লোক তাঁকে পাথর মেরে চলছে। এভাবে তাঁর পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই সাথে সাথে ঐ ব্যক্তি বলে চলেছে, “এ মিথ্যুক, এর কথা শুনো না।” আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে? লোকেরা বললোঃ ওঁরই চাচা আবু লাহাব। (তিরমিযী)

নবুওয়াতের সপ্তম বছরে কুরাইশদের সমস্ত পরিবার মিলে যখন বনি হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট করলো এবং এ পরিবার দু’টি রাসূলুল্লাহ সা. এর সমর্থনে অবিচল থেকে আবু তালেব গিরিপথে অন্তরীণ হয়ে গেলো তখন একমাত্র আবু লাহাবই নিজের পরিবার ও বংশের সহগামী না হয়ে কুরাইশ কাফেরদের সহযোগী হলো। এ বয়কট তিন বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে অনেক সময় অনাহারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আবু লাহাবের ভূমিকা ছিল মারমুখী। বাইর থেকে মক্কায় কোন বাণিজ্য কাফেলা এলে আবু তালেব গিরিপথে অন্তরীণদের মধ্য থেকে কেউ তাদের কাছ থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনতে যেতো। আবু লাহাব তখন চিৎকার করে বনিকদেরকে বলতোঃ ওদের কাছে এতো বেশী দাম চাও যাতে ওরা কিনতে না পারে। এজন্য তোমাদের যত টাকা ক্ষতি হয় তা আমি দেবো। কাজেই তারা বিরাট দাম হাঁকতো। ক্রেতা মহাসংকটে পড়তো। শেষে নিজের অনাহারের কষ্ট বুকে পুষে রেখে খালি হাতে পাহাড়ে ফিরে যেতে হতো ক্ষুধা কাতর সন্তানদের কাছে। তারপর আবু লাহাব সেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেই পণ্যগুলোই বাজার দরে কিনে নিতো। (ইবনে সা’দ ও ইবনে হিশাম)

এ সূরায় যে ব্যক্তিটির নাম নিয়ে নিন্দা করা হয়েছে এগুলো ছিল তারই কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে এর প্রয়োজন এজন্য দেখা দিয়েছিল যে, মক্কার বাইরের আরবের যেসব লোকেরা হজ্জের জন্য আসতো অথবা বিভিন্ন স্থানে যেসব বাজার বসতো সেখানে যারা জমায়েত হতো, তাদের সামনে যখন রাসূলুল্লাহ সা. এর নিজের চাচা তাঁর পিছনে ঘুরে ঘুরে তাঁর বিরোধিতা করতো তখন বাইরের লোকদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়তো। কারণ আরবের প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে কোন চাচা বিনা কারণে অন্যদের সামনে তার নিজের ভাতিজাকে গালিগালাজ করবে, তার গায়ে পাথর মারবে এবং তার প্রতি দোষারোপ করবে এটা কল্পনাতীত ছিল। তাই তারা আবু লাহাবের কথায় প্রভাবিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে পড়ে যেতো। কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হবার পর যখন আবু লাহাব রাগে অন্ধ হয়ে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো রাসূলুল্লাহ সা. এর বিরোধিতার ব্যাপারে তার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে নিজের ভাতিজার শত্রুতায় অন্ধ হয়ে গেছে।

তাছাড়া নাম নিয়ে নিজের চাচার নিন্দা করার পর মুহাম্মাদ সা. যে দ্বীনের ব্যাপারে কারো মুখ চেয়ে কোন প্রকার সমঝোতা বা নরম নীতি অবলম্বন করবেন, এ আশা চিরতরে নির্মূল হয়ে গেলো। যখন প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে রাসূলের চাচার নিন্দা করা হলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো, এখানে কোন কিছু রেখে ঢেকে করার অবকাশ নেই। এখানে ঈমান আনলে পরও আপন হয়ে যায় এবং ইসলামের বিরোধিতা ও কুফরী করলে আপনও হয়ে যায় পর। এ ব্যাপারে অমুকের ছেলে, অমুকের ভাই বা অমুকের বাপের কোন গুরুত্ব নেই।

তরজমা ও তাফসীর

পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে

﴿تَبَّتْ يَدَآ أَبِى لَهَبٍۢ وَتَبَّ﴾

ভেঙে গেছে আবু লাহাবের হাত এবং ব্যর্থ হয়েছে সে

১. আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উযযা তাকে আবু লাহাব বলে ডাকার কারণ, তার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল সাদা লালে মেশানো লাহাব বলা হয় আগুনের শিখাকে কাজেই আবু লাহাবের মানে হচ্ছে আগুনবরণ মুখ এখানে তার আসল নামের পরিবর্তে ডাক নামে উল্লেখ করার কয়েকটি কারণ রয়েছে এর একটি কারণ হচ্ছে এই যে, মূল নামের পরিবর্তে ডাক নামেই সে বেশী পরিচিত ছিল দ্বিতীয় কারণ, তার আবদুল উযযা (অর্থাৎ উযযার দাস) নামটি ছিল একটি মুশরিকী নাম কুরআনে তাকে এ নামে উল্লেখ করা পছন্দ করা হয়নি তৃতীয় কারণ, এ সূরায় তার যে পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে তার এ ডাক নামই বেশী সম্পর্কিত

تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ এর অর্থ কোন কোন তাফসীরকার করেছেন, “ভেঙে যাক আবু লাহাবের হাত” এবং وَتَبٌ  শব্দের মানে করেছেন, “সে ধ্বংস হয়ে যাক” অথবা “সে ধ্বংস হয়ে গেছে” কিন্তু আসলে এটা তার প্রতি কোন ধিক্কার নয় বরং এটা একটা ভবিষ্যদ্বাণী এখানে ভবিষ্যতে যে ঘটনাটি ঘটবে তাকে অতীতকালের অর্থ প্রকাশক শব্দের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে এর মানে, তার হওয়াটা যেন এত বেশী নিশ্চিত যেমন তা হয়ে গেছে আর আসলে শেষ পর্যন্ত তাই হলো যা এ সূরায় কয়েক বছর আগে বর্ণনা করা হয়েছিল হাত ভেঙে যাওয়ার মানে শরীরের একটি অংগ যে হাত সেটি ভেঙে যাওয়া নয় বরং কোন ব্যক্তি যে উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তাতে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যাওয়াই এখানে বুঝানো হয়েছে আর আবু লাহাব রাসূলুল্লাহ সা. এর দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা জন্য যথার্থই নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হবার মাত্র সাত আট বছর পরেই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এ যুদ্ধে কুরাইশদের অধিকাংশ বড় বড় সরদার নিহত হয় তারা সবাই ইসলাম বিরোধিতা ও ইসলামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের সহযোগী ছিল এ পরাজয়ের খবর মক্কায় পৌঁছার পর সে এত বেশী মর্মাহত হয় যে, এরপর সে সাত দিনের বেশী জীবিত থাকতে পারেনি তারপর তার মৃত্যুও ছিল বড়ই ভয়াবহ ও শিক্ষাপ্রদ তার শরীরে সাংঘাতিক ধরনের ফুসকুড়ি (Malignant pustule) দেখা দেয় রোগ সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায় মরার পরও তিন দিন পর্যন্ত তার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষেনি ফলে তার লাশে পচন ধরে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে শেষে লোকেরা তার ছেলেদেরকে ধিক্কার দিতে থাকে একটি বর্ণনা অনুসারে তখন তারা মজুরীর বিনিময়ে তার লাশ দাফন করার জন্য কয়েকজন হাবশীকে নিয়োগ করে এবং তারা তার লাশ দাফন করে অন্য এক বর্ণনা অনুসারে, তারা গর্ত খুঁড়ে লম্বা লাঠি দিয়ে তার লাশ তার মধ্যে ফেলে দেয় এবং ওপর থেকে তার ওপর মাটি চাপা দেয় যে দ্বীনের অগ্রগতির পথরোধ করার জন্য সে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল তার সন্তানদের সেই দ্বীন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তার আরো বেশী ও পূর্ণ পরাজয় সম্পন্ন হয় সর্বপ্রথম তার মেয়ে দাররা হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন আর মক্কা বিজয়ের পর তার দুই ছেলে উতবা ও মুআ’ত্তাব হযরত আব্বাসের রা. মধ্যস্থতায় রাসূলুল্লাহর সা. সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর হাতে বাইআত করেন

﴿مَآ أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُۥ وَمَا كَسَبَ﴾

তার ধন-সম্পদ এবং যা কিছু সে উপার্জন করেছে তা তার কোন কাজে লাগেনি

২. আবু লাহাব ছিল হাড়কৃপণ ও অর্থলোলুপ ইবনে আসীরর বর্ণনা মতে, জাহেলী যুগে একবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, সে কা’বা শরীফের কোষাগার থেকে দু’টি সোনার হরিণ চুরি করে নিয়েছে যদিও পরবর্তী পর্যায়ে সেই হরিণ দু’টি অন্য একজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় তবুও তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনার ফলে তার সম্পর্কে মক্কার লোকদের মনোভাব উপলব্ধি করা যায় তার ধনাঢ্যতা সম্পর্কে কাজী রশীদ ইবনে যুবাইর তাঁর “আয যাখায়ের ওয়াত তুহাফ” (الذَّخَايِّرَ وَالتَّحَفْ গ্রন্থে লিখেছেনঃ কুরাইশদের মধ্যে যে চারজন লোক এক কিনতার (এক কিনতার = দু’শো আওকিয়া আর এক আওকিয়া = সোয়া তিন তোলা, কাজেই এক কিনতার সমান ৮০ তোলার সেরের ওজনে ৮ সের ১০ তোলা) সোনার মালিক ছিল আবু লাহাব তাদের একজন তার অর্থলোলুপতা কি পরিমাণ ছিল বদর যুদ্ধের সময়ের ঘটনা থেকে তা আন্দাজ করা যেতে পারে এ যুদ্ধে তার ধর্মের ভাগ্যের ফায়সালা হতে যাচ্ছিল কুরাইশদের সব সরদার এ যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য রওয়ানা হয় কিন্তু আবু লাহাব নিজে না গিয়ে নিজের পক্ষ থেকে আস ইবনে হিশামকে পাঠায় তাকে বলে দেয়, তার কাছে সে যে চার হাজার দিরহাম পায় এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে এর বদলে তার সেই ঋণ পরিশোধ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে এভাবে সে নিজের ঋণ আদায় করার একটা কৌশল বের করে নেয় কারণ আস দেওলিয়া হয়ে গিয়েছিল ঋণ পরিশোধের কোন ক্ষমতাই তার ছিল না

কোন কোন তাফসীরকার مَا كَسَبَ  শব্দটিকে উপার্জন অর্থে নিয়েছেন অর্থাৎ নিজের অর্থ থেকে সে যে মুনাফা অর্জন করেছে তা তার উপার্জন আবার অন্য কয়েকজন তাফসীরকার এর অর্থ নিয়েছেন সন্তান-সন্ততি কারণ রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, সন্তানরা মানুষের উপার্জন (আবু দাউদ ও ইবনে আবী হাতেম) এ দু’টি অর্থই আবু লাহাবের পরিণতির সাথে সম্পর্কিত কারণ সে মারাত্মক ফুসকুড়ি রোগে আক্রান্ত হলে তার সম্পদ তার কোন কাজে লাগেনি এবং তার সন্তানরাও তাকে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করার জন্য ফেলে রেখে দিয়েছিল তার ছেলেরা তার লাশটি মর্যাদা সহকারে কাঁধে উঠাতেও চাইল না এভাবে এ সূরায় আবু লাহাব সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তা সত্য হতে দেখলো

﴿سَيَصْلَىٰ نَارًۭا ذَاتَ لَهَبٍۢ﴾

অবশ্যই সেই লেলিহান আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে 

﴿وَٱمْرَأَتُهُۥ حَمَّالَةَ ٱلْحَطَبِ﴾

এবং (তার সাথে) তার স্ত্রীও, লাগানো ভাঙানো চোগলখুরী করে বেড়ানো যার কাজ, 

৩. আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল ‘আরদায’ “উম্মে জামীল” ছিল তার ডাক নাম সে ছিল আবু সুফিয়ানের বোন রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে শত্রুতার ব্যাপারে সে তার স্বামী আবু লাহাবের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না হযরত আবু বকরের রা. মেয়ে হযরত আসমা রা. বর্ণনা করেছেনঃ এ সূরাটি নাযিল হবার পর উম্মে জামীল যখন এটি শুনলো, সে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর খোঁজে বের হলো তার হাতের মুঠোয় পাথর ভরা ছিল, রাসূলুল্লাহকে সা. গালাগালি করতে করতে নিজের রচিত কিছু কবিতা পড়ে চলছিল এ অবস্থায় সে কা’বা ঘরে পৌঁছে গেলো সেখানে রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আবু বকরের রা. সাথে বসেছিলেন হযরত আবু বকর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দেখুন সে আসছে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে আপনাকে দেখে কিছু অভদ্র আচরণ করবে তিনি বললেন, সে আমাকে দেখতে পাবে না বাস্তবে হলোও তাই তাঁর উপস্থিতি সত্ত্বেও সে তাঁকে দেখতে পেলো না সে আবু বকরকে রা. জিজ্ঞেস করলো, শুনলাম তোমার সাথী আমার নিন্দা করেছে হযরত আবু বকর রা. জবাব দিলেনঃ এ ঘরের রবের কসম, তিনি তো তোমার কোন নিন্দা করেননি একথা শুনে সে ফিরে গেলো— (ইবনে আবু হাতেম, সীরাতে ইবন হিশাম বাযযারও প্রায় একই ধরনের একটি রেওয়ায়াত হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন) হযরত আবু বকরের রা. এ জবাবের অর্থ ছিল, নিন্দা তো আল্লাহ‌ করেছেন রাসূলুল্লাহ সা. করেননি

৪. মূল শব্দ হচ্ছে حَمَّالَةَ الْحَطَبِ  এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, “কাঠ বহনকারিনী” মুফাসসিরগণ এর বহু বর্ণনা করেছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ইবনে যায়েদ, যাহহাক ও রাবী ইবনে আনাস বলেনঃ সে রাতের বেলা কাঁটা গাছের ডালপালা এনে রাসূলুল্লাহ সা. এর দরজায় ফেলে রাখতো তাই তাকে কাঠ বহনকারিনী বলা হয়েছে কাতাদাহ, ইকরামা, হাসান বসরী, মুজাহিদ ও সুফিয়ান সওরী বলেনঃ সে লোকদের মধ্যে ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য চোগলখুরী করে বেড়াতো তাই আরবী প্রবাদ অনুযায়ী তাকে কাঠ বহনকারিনী বলা হয়েছে কারণ যারা এর কথা ওর কাছে বলে এবং লাগানো ভাঙানোর কাজ করে ফিতনা-ফাসাদের আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করে আরবরা তাদেরকে কাঠ বহনকারিনী বলে থাকে এ প্রবাদ অনুযায়ী “হাম্মালাতাল হাতাব” শব্দের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে, “যে লাগানো ভাঙানোর কাজ করে” সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেনঃ যে ব্যক্তি নিজের পিঠে গোনাহের বোঝা বহন করে আরবী প্রবাদ অনুসারে তার সম্পর্কে বলা হয়فٌلَانٌ يُحْطَتِبُ عَلَى ظَهْرِهِ  (অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি নিজের পিঠে কাঠ বহন করছে) কাজেই হাম্মালাতাল হাতাব (حَمَّالَةَ الْحَطَبِ মানে হচ্ছে, “গোনাহের বোঝা বহনকারিনী” মুফাসসিরগণ এর আরো একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন সেটি হচ্ছে, আখেরাতে তার এ অবস্থা হবে অর্থাৎ সেখানে যে আগুনে আবু লাহাব পুড়তে থাকবে তাতে সে (উম্মে জামীল) কাঠ বহন করে এনে ফেলতে থাকবে

﴿فِى جِيدِهَا حَبْلٌۭ مِّن مَّسَدٍۭ﴾

তার গলায় থাকবে খেজুর ডালের আঁশের পাকানো শক্ত রশি

৫. তার গলার জন্য জীদ (جيد শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আরবী ভাষায় যে গলায় অলংকার পরানো হয়েছে তাকে জীদ বলা হয় সাঈদ ইবনুল মূসাইয়েব, হাসান বসরী ও কাতাদা বলেনঃ এ হার বিক্রি করে আমি এর মূল্য বাবদ পাওয়া সমস্ত অর্থ মুহাম্মাদের সা. বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কাজ করার জন্য ব্যয় করবো এ কারণে জীদ শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যঙ্গার্থে অর্থাৎ এ অলংকার পরিহিত সুসজ্জিত গলায়, যেখানে পরিহিত হার নিয়ে সে গর্ব করে বেড়ায়, কিয়ামতের দিন সেখানে রশি বাঁধা হবে এটা ঠিক সমপর্যায়েরই ব্যাঙ্গাত্মক বক্তব্য যেমন কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছেঃ بَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ  তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও

তার গলায় বাঁধা রশিটির জন্য حَبْلٌ مِنْ مَسَدٍ  শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাৎ সে রশিটি হবে ‘মাসাদ’ ধরনের অভিধানবিদ ও মুফাসসিরগণ এ শব্দটির বহু অর্থ বর্ণনা করেছেন এ সম্পর্কিত একটি বক্তব্য হচ্ছে, খুব মজবুত করে পাকানো রশিকে মাসাদ বলা হয় দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, খেজুর গাছের (ডালের) ছাল থেকে তৈরি রশি মাসাদ নামে পরিচিত এ সম্পর্কে তৃতীয় বক্তব্য হচ্ছে, এর মানে খেজুরের ডালের গোড়ার দিকের মোটা অংশ থেঁতলে যে সরু আঁশ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাকানো রশি অথবা উটের চামড়া বা পশম দিয়ে তৈরি রশি আর একটি বক্তব্য হচ্ছে, এর অর্থ লোহার তারের পাকানো রশি

— সমাপ্ত —

শেয়ারঃ

সম্পাদকের ব্লগ

অনলাইন পাঠাগার

অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থ

সকল সূরা

০০১

আল ফাতিহা

মাক্কী

৭ আয়াত

০০২

আল বাকারাহ

মাদানী

২৮৬ আয়াত

০০৩

আলে ইমরান

মাদানী

২০০ আয়াত

০০৪

আন নিসা

মাদানী

১৭৬ আয়াত

০০৫

আল মায়িদাহ

মাদানী

১২০ আয়াত

০০৬

আল আনআ’ম

মাক্কী

১৬৫ আয়াত

০০৭

আল আ’রাফ

মাক্কী

২০৬ আয়াত

০০৮

আল আনফাল

মাদানী

৭৫ আয়াত

০০৯

আত তাওবা

মাদানী

১২৯ আয়াত

০১০

ইউনুস

মাক্কী

১০৯ আয়াত

০১১

হূদ

মাক্কী

১২৩ আয়াত

০১২

ইউসুফ

মাক্কী

১১১ আয়াত

০১৩

আর রা’দ

মাক্কী

৪৩ আয়াত

০১৪

ইব্রাহীম

মাক্কী

৫২ আয়াত

০১৫

আল হিজর

মাক্কী

৯৯ আয়াত

০১৬

আন নাহল

মাক্কী

১২৮ আয়াত

০১৭

বনী ইসরাঈল

মাক্কী

১১১ আয়াত

০১৮

আল কাহফ

মাক্কী

১১০ আয়াত

মারইয়াম

০২০

ত্বা-হা

মাক্কী

১৩৫ আয়াত

০২১

আল আম্বিয়া

মাক্কী

১১২ আয়াত

০২২

আল হাজ্জ

মাদানী

৭৮ আয়াত

০২৩

আল মু’মিনূন

মাক্কী

১১৮ আয়াত

০২৪

আন নূর

মাক্কী

১১৮ আয়াত

০২৫

আল ফুরকান

মাক্কী

৭৭ আয়াত

০২৬

আশ শুআ’রা

মাক্কী

২২৭ আয়াত

০২৭

আন নামল

মাক্কী

৯৩ আয়াত

০২৮

আল কাসাস

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০২৯

আল আনকাবূত

মাক্কী

৬৯ আয়াত

০৩০

আর রূম

মাক্কী

৬০ আয়াত

০৩১

লুকমান

মাক্কী

৩৪ আয়াত

০৩২

আস সাজদাহ

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৩৩

আল আহযাব

মাদানী

৭৩ আয়াত

০৩৪

আস সাবা

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৩৫

ফাতির

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৩৬

ইয়াসিন

মাক্কী

৮৩ আয়াত

০৩৭

আস সাফফাত

মাক্কী

১৮২ আয়াত

০৩৮

ছোয়াদ

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০৩৯

আয যুমার

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০৪০

আল মু’মিন

মাক্কী

৮৫ আয়াত

০৪১

হা-মীম আস সাজদাহ

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৪২

আশ শূরা

মাক্কী

৫৩ আয়াত

০৪৩

আয যুখরুফ

মাক্কী

৮৯ আয়াত

০৪৪

আদ দুখান

মাক্কী

৫৯ আয়াত

০৪৫

আল জাসিয়াহ

মাক্কী

৩৭ আয়াত

০৪৬

আল আহক্বাফ

মাক্কী

৫৯ আয়াত

০৪৭

মুহাম্মাদ

মাদানী

৩৮ আয়াত

০৪৮

আল ফাতহ

মাদানী

২৯ আয়াত

০৪৯

আল হুজুরাত

মাদানী

১৮ আয়াত

০৫০

ক্বাফ

মাদানী

৪৫ আয়াত

০৫১

আয যারিয়াত

মাক্কী

৬০ আয়াত

০৫২

আত তূর

মাক্কী

৪৯ আয়াত

০৫৩

আন নাজম

মাক্কী

৬২ আয়াত

০৫৪

আল ক্বামার

মাক্কী

৫৫ আয়াত

০৫৫

আর রাহমান

মাদানী

৭৮ আয়াত

০৫৬

আল ওয়াকিআ’

মাক্কী

৯৬ আয়াত

০৫৭

আল হাদীদ

মাদানী

২৯ আয়াত

০৫৮

আল মুজাদালাহ

মাদানী

২২ আয়াত

০৫৯

আল হাশর

মাদানী

২২ আয়াত

০৬০

আল মুমতাহিনাহ

মাদানী

১৩৫ আয়াত

০৬১

আস সাফ

মাদানী

১৪ আয়াত

০৬২

আল জুমুআ’

মাদানী

১১ আয়াত

০৬৩

আল মুনাফিকুন

মাদানী

১১ আয়াত

০৬৪

আত তাগাবুন

মাদানী

১৮ আয়াত

০৬৫

আত তালাক্ব

মাদানী

১২ আয়াত

০৬৬

আত তাহরীম

মাদানী

১২ আয়াত

০৬৭

আল মুলক

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৬৮

আল কালাম

মাক্কী

৫২ আয়াত

০৬৯

আল হাককাহ

মাক্কী

৫২ আয়াত

০৭০

আল মাআ’রিজ

মাক্কী

৪৪ আয়াত

০৭১

নূহ

মাক্কী

২৮ আয়াত

০৭২

আল জিন

মাক্কী

২৮ আয়াত

০৭৩

আল মুযযাম্মিল

মাক্কী

২০ আয়াত

০৭৪

আল মুদ্দাসসির

মাক্কী

২০ আয়াত

০৭৫

আল কিয়ামাহ

মাক্কী

৪০ আয়াত

০৭৬

আদ দাহর

মাদানী

৩১ আয়াত

০৭৭

আল মুরসালাত

মাক্কী

৫০ আয়াত

০৭৮

আন নাবা

মাক্কী

৫০ আয়াত

০৭৯

আন নাযিআ’ত

মাক্কী

৪৬ আয়াত

০৮০

আবাসা

মাক্কী

৪২ আয়াত

০৮১

আত তাকবীর

মাক্কী

২৯ আয়াত

০৮২

আল ইনফিতার

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৮৩

আল মুতাফফিফীন

মাক্কী

৩৬ আয়াত

০৮৪

আল ইনশিকাক

মাক্কী

২৫ আয়াত

০৮৫

আল বুরূজ

মাক্কী

২২ আয়াত

০৮৬

আত তারিক

মাক্কী

১৭ আয়াত

০৮৭

আল আ’লা

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৮৮

আল গাশিয়াহ

মাক্কী

২৬ আয়াত

০৮৯

আল ফাজর

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৯০

আল বালাদ

মাক্কী

২০ আয়াত

০৯১

আশ শামস

মাক্কী

১৫ আয়াত

০৯২

আল লাইল

মাক্কী

২১ আয়াত

০৯৩

আদ দুহা

মাক্কী

১১ আয়াত

০৯৪

আলাম নাশরাহ

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৫

আত তীন

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৬

আল আলাক

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৯৭

আল কাদর

মাক্কী

৫ আয়াত

০৯৮

আল বাইয়্যিনাহ

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৯

আল যিলযাল

মাদানী

৮ আয়াত

১০০

আল আ’দিয়াত

মাক্কী

১১ আয়াত

১০১

আল কারিআ’হ

মাক্কী

১১ আয়াত

১০২

আত তাকাসুর

মাক্কী

৮ আয়াত

১০৩

আল আসর

মাদানী

৮ আয়াত

১০৪

আল হুমাযাহ

মাক্কী

৯ আয়াত

১০৫

আল ফীল

মাক্কী

৫ আয়াত

১০৬

কুরাইশ

মাক্কী

৪ আয়াত

১০৭

আল মাউন

মাক্কী

৭ আয়াত

১০৮

আল কাউসার

মাক্কী

৩ আয়াত

১০৯

আল কাফিরূন

মাক্কী

৬ আয়াত

১১০

আন নাসর

মাদানী

৩ আয়াত

১১১

আল লাহাব

মাক্কী

৫ আয়াত

১১২

আল ইখলাস

মাক্কী

৪ আয়াত

১১৩

আল ফালাক

মাক্কী

৫ আয়াত

১১৪

আন নাস

মাক্কী

৬ আয়াত