তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿لَمْ يَكُنِ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ وَٱلْمُشْرِكِينَ مُنفَكِّينَ حَتَّىٰ تَأْتِيَهُمُ ٱلْبَيِّنَةُ﴾
১। আহলি কিতাব ও মুশরিকদের১ মধ্যে যারা কাফের ছিল২ তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত তারা (নিজেদের কুফরী থেকে) বিরত থাকতে প্রস্তুত ছিল না।৩
১. আহলি কিতাব ও মুশরিক উভয় দলই কুফরী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও দু’দলকে দু’টি পৃথক নাম দেয়া হয়েছে। যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলি কিতাব। আর যারা কোন নবীর অনুসারী ছিল না। কোন আসমানী কিতাবও মানতো না তারা মুশরিক। কুরআন মজীদের বহু স্থানে আহলি কিতাবদের শির্কের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন খৃস্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তারা বলে, আল্লাহ তিন খোদার একজন।” (আল মায়িদাহঃ ৭৩) “তারা মসীহকেও খোদা বলে।” (আল মায়িদাহঃ ১৭) “তারা মসীহকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করে।” (আত তাওবাহঃ ৩০) আবার ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তারা উযাইরকে আল্লাহর পুত্র বলে” (আত তাওবাহঃ ৩০) কিন্তু এসব সত্ত্বে কুরআনের কোথাও তাদের জন্য মুশরিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়নি। বরং তাদের উল্লেখ করা হয়েছে “আহলি কিতাব” বা “যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিল” শব্দের মাধ্যমে। অথবা ইয়াহূদঃ ও নাসারা শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে। কারণ তারা তাওহিদী ধর্ম মানতো, তারপর শিরক করতো। বিপরীত পক্ষে অ-আহলি কিতাবদের জন্য পারিভাষিক পর্যায়ে মুশরিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ তারা শিরককেই আসল ধর্ম গণ্য করতো। তাওহীদকে তারা পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করতো। এ দু’টি দলের মধ্যকার এ পার্থক্যটা শুধুমাত্র পরিভাষার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, শরীয়াতের বিধানের মধ্যেও এ পার্থক্য ছিল। আহলি কিতাবরা আল্লাহর নাম নিয়ে যদি কোন হালাল প্রাণীকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করে তাহলে তা মুসলমানের জন্য হালাল গণ্য করা হয়েছে। তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুশরিকদের যবেহ করা প্রাণীও হালাল নয় এবং তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়নি।
২. এখানে কুফরী শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার কুফরী দৃষ্টিভংগী এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কেউ এই অর্থে কাফের ছিল যে, সে আদৌ আল্লাহকে মানতো না। আবার কেউ আল্লাহকে মানতো ঠিকই কিন্তু তাঁকে একমাত্র মাবুদ বলে মানতো না। বরং আল্লাহর সত্ত্বা ও তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতায় কোন না কোনভাবে অন্যদেরকে শরীক করে তাদের বন্দেগীও করতো। কেউ আল্লাহর একত্ব স্বীকার করতো কিন্তু এ সত্ত্বেও আবার কোন না কোন ধরনের শিরকও করতো। কেউ আল্লাহকে মানতো কিন্তু তাঁর নবীদেরকে মানতো না এবং নবীদের মাধ্যমে যে হেদায়াত এসেছিল তাকে মানতে অস্বীকার করতো। কেউ এক নবীকে মানতো কিন্তু অন্য নবীকে অস্বীকার করতো। মোটকথা, বিভিন্ন ধরনের কুফরীতে লোকেরা লিপ্ত ছিল। এখানে ‘আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের ছিল’ একথা বলার অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে তাহলে কিছু লোক ছিল যারা কুফরীতে লিপ্ত ছিল না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, কুফরীতে লিপ্ত দু’টি দল ছিল, একটি আহলি কিতাব ও অন্যটি মুশরিক। এখানে মিন مِنْ শব্দটি কতক বা কিছু অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং ‘মিন’ এখানে বর্ণনামূলক। যেমন সূরা আল হাজ্জের ৩০ আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَاجۡتَنِبُوۡا الرِّجۡسَ مِنَ الۡاَوۡثَانِ অর্থাৎ মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। এর অর্থ এ নয় যে, মূর্তিদের মধ্যে যে অপবিত্রতা আছে তা থেকে দূরে থাকো। তেমনি اَلَّذِيْنَكَفَرُوْامِنْ اَهْلِ الْكِتَلبِ والْمُشْرِكِيْن এর অর্থও হচ্ছেঃ যারা কুফরী করে, যারা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের দলের অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ এ নয় যে, এই দু’টি দলের মধ্য থেকে যারা কুফরী করে।
৩. অর্থাৎ একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে তাদেরকে কুফরীর প্রতিটি গলদ ও সত্য বিরোধী বিষয় বুঝাবে এবং যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে সত্য সঠিক পথ তাদের সামনে পেশ করবে, এছাড়া এই কুফরীর অবস্থা থেকে বের হবার আর কোন পথ তাদের সামনে ছিল না। এর মানে এ নয় যে, এ সুস্পষ্ট প্রমাণটি এসে যাবার পর তারা সবাই কুফরী পরিত্যাগ করবে। বরং এর মানে হচ্ছে এই প্রমাণটির অনুপস্থিতিতে তাদের এই অবস্থার মধ্য থেকে বের হয়ে আসা সম্ভবপরই ছিল না। তবে তার আসার পরও তাদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের কুফরীর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। এরপর তারা আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে পারবে না যে, আপনি আমাদের হোদায়াতের কোন ব্যবস্থা করেননি। এই ধরনের কথা কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। যেমন সূরা নাহলে বলা হয়েছেঃ وَعَلَى اللّٰهِ قَصۡدُ السَّبِيۡلِ “সোজা পথ দেখানো আল্লাহরই দায়িত্ব।” (আয়াতঃ ৯) সূরা আল লাইলে বলা হয়েছেঃ اِنَّ عَلَيۡنَا لَلۡهُدٰىۖ “পথ দেখাবার দায়িত্ব আমার।” (আয়াতঃ ১২)
اِنَّاۤ اَوۡحَيۡنَاۤ اِلَيۡكَ كَمَاۤ اَوۡحَيۡنَاۤ اِلٰى نُوۡحٍ وَّالنَّبِيّنَ مِنۡۢ بَعۡدِهۚ …… رُّسُلاً مُّبَشِّرِيۡنَ وَمُنۡذِرِيۡنَ لِئَلَّا يَكُوۡنَ لِلنَّاسِ عَلَى اللّٰهِ حُجَّةٌۢ بَعۡدَ الرُّسُلِ
“আমি তোমার প্রতি ঠিক তেমনিভাবে অহী পাঠিয়েছি যেভাবে নূহ ও তারপর নবীদের প্রতি পাঠিয়ে ছিলাম—-এই রাসূলদেরকে সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী করা হয়েছে যাতে রাসূলদের পর লোকদের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে।” (আন নিসাঃ ১৬৩-১৬৫)
يٰۤاَهۡلَ الۡكِتٰبِ قَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُوۡلُنَا يُبَيِّنُ لَكُمۡ عَلٰى فَتۡرَةٍ مِّنَ الرُّسُلِ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا مَا جَآءَنَا مِنۡۢ بَشِيۡرٍ وَّلَا نَذِيۡرٍ فَقَدۡ جَآءَكُمۡ بَشِيۡرٌ وَّنَذِيۡرٌ
“হে আহলি কিতাব! রাসূলদের সিলসিলা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য তোমাদের কাছে আমার রাসূল এসেছে। যাতে তোমরা বলতে না পারো আমাদের কাছে না কোন সুসংবাদ দানকারী এসেছিল, না এসেছিল কোন সতর্ককারী। কাজেই নাও, এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদানকারী এসে গেছে এবং সতর্ককারীও।” (আল মায়িদাহঃ ১৯)
﴿رَسُولٌۭ مِّنَ ٱللَّهِ يَتْلُوا۟ صُحُفًۭا مُّطَهَّرَةًۭ﴾
২। (অর্থাৎ) আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রাসূল৪ যিনি পবিত্র সহীফা পড়ে শুনাবেন,৫
৪. এখানে রাসূলুল্লাহ সা.কেই একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে। কারণ তাঁর নবুওয়াত লাভের আগের ওপরের জীবন, নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কুরআনের মতো কিতাব পেশ করা, তাঁর শিক্ষা ও সাহচর্যের প্রভাবে ঈমান গ্রহণকারীদের জীবনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন সূচিত হওয়া, তাঁর পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত আকীদা-বিশ্বাস, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ইবাদাত-বন্দেগী, চূড়ান্ত পর্যায়ের পবিত্র ও নিষ্কলুষ নৈতিক চরিত্র এবং মানব জীবন গঠনের জন্য সবচেয়ে ভালো মূলনীতি ও বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়া, তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে পুরোপুরি সামঞ্জস্য থাকা এবং সব ধরনের বিরোধিতা ও বাধা-বিপত্তির মোকাবেলায় সীমাহীন দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা সহকারে তাঁর নিজের দাওয়াতের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া—এসব বিষয়ই তিনি যে যথার্থই আল্লাহর রাসূল সে কথারই ছিল সুস্পষ্ট আলামত।
৫. আভিধানিক অর্থে ‘সহীফা’ বলা হয় “লিখিত পাতাকে।” কিন্তু কুরআন মজীদে এ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে নবীগণের ওপর নাযিলকৃত কিতাব হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর পবিত্র সহীফা মানে হচ্ছে এমন সব সহীফা যার মধ্যে কোনো প্রকার বাতিল কোন ধরনের গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা এবং কোন নৈতিক অপবিত্রতার মিশ্রণ নেই।কোন ব্যক্তি এই কথাগুলোর পুরোপুরি গুরুত্ব তখনই অনুধাবন করতে পারবেন যখন তিনি-কুরআনের পাশাপাশি বাইবেল (এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থগুলোও) অধ্যয়ন করবেন। সেখানে তিনি দেখবেন সঠিক কথার সাথে সাথে এমন কথাও লেখা আছে, যা সত্য ও ন্যায় এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী। আবার এই সঙ্গে নৈতিক দিক দিয়েও অত্যন্ত নিম্নমানের। এসব কথা পড়ার পর কুরআন পড়লে যেকোন ব্যক্তি তার অসাধারণ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রমাণ পেয়ে যাবেন।
﴿فِيهَا كُتُبٌۭ قَيِّمَةٌۭ﴾
৩। যাতে একেবারে সঠিক কথা লেখা আছে।
﴿وَمَا تَفَرَّقَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَـٰبَ إِلَّا مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَتْهُمُ ٱلْبَيِّنَةُ﴾
৪। প্রথমে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে তো বিভেদ সৃষ্টি হলো তাদের কাছে (সত্য পথের) সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে যাওয়ার পর।৬
৬. অর্থাৎ ইতিপূর্বে আহলি কিতাবরা বিভিন্ন ভুল পথে পাড়ি জমিয়ে যেসব বিভিন্ন দল ও উপদলের উদ্ভব ঘটিয়ে ছিল তার কারণ এ ছিল না যে, মহান আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে পথ দেখাবার জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণ পাঠাবার ব্যাপারে কোন ফাঁক রেখেছিলেন। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে পথনির্দেশনা আসার পর তারা নিজেরাই এ কর্মনীতি অবলম্বন করেছিল। কাজেই নিজেদের গোমরাহীর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী ছিল। কারণ তাদেরকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য পূর্ণাংগ ব্যবস্থা অবলম্বন করে প্রমাণ পূর্ণ করা হয়েছিল। অনুরূপভাবে এখন যেহেতু তাদের সহীফাগুলো পাক-পবিত্র ছিল না এবং তাদের কিতাব গুলো একেবারে সত্য সঠিক, শিক্ষা সম্বলিত ছিল না, তাই মহান আল্লাহ একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে নিজের একজন রাসূল পাঠিয়ে এবং তাঁর মাধ্যমে পুরোপুরি শর্ত-সঠিক শিক্ষা সম্বলিত পাক পবিত্র সহীফা পেশ করে আবার তাদের ওপর প্রমাণ পূর্ণ করে দিলেন। ফলে এর পরেও যদি তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় তাহলে এর দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে। আল্লাহর মোকাবেলায় তারা কোন প্রমাণ পেশ করতে পারবে না। কুরআন মজীদের বহু জায়গায় একথা বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা আল বাকারাহঃ ২১৩-২৫৩ আয়াত, আলে ইমরানঃ ১৯ আয়াত, আল মায়িদাহঃ ৪৪-৫০ আয়াত, ইউসুফঃ ৯৩ আয়াত, আশ শূরা ১৩-১৫ আয়াত, আল জাসিয়াহ ১৬-১৮ আয়াত। এই সাথে তাফহীমুল কুরআনে এসব আয়াতের আমি যে ব্যাখ্যাগুলো লিখেছি সেগুলোর ওপরও যদি একবার নজর বুলানো যায় তাহলে বক্তব্যটি অনুধাবন করা আরো সহজ হবে।
﴿وَمَآ أُمِرُوٓا۟ إِلَّا لِيَعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤْتُوا۟ ٱلزَّكَوٰةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلْقَيِّمَةِ﴾
৫। তাদেরকে তো এছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে, এটিই যথার্থ সত্য ও সঠিক দ্বীন।৭
৭. অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. যে দ্বীনটি পেশ করছেন। আহলি কিতাবদের কাছে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল এবং তাদের কাছে যেসব নবী এসেছিলেন তারাও তাদেরকে সেই একই দ্বীনের তালীম দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যেসব বাতিল আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজ-কর্মের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তার কোনটিরও হুকুম তারা দেননি। সবসময় সত্য ও সঠিক দ্বীন একটিই ছিল। আর সেটি হচ্ছেঃ একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করতে হবে। তাঁর বন্দেগীর সাথে আর কারো বন্দেগীর মিশ্রণ ঘটানো যাবে না। সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে একমাত্র আল্লাহর পূজারী এবং তাঁর ফরমানের অনুগত হতে হবে। নামায কায়েম করতে হবে। যাকাত দিতে হবে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল আ’রাফঃ ১৯ টীকা, ইউনুসঃ ১০০-১০৯ টীকা, আর রূমঃ ৪৩-৪৭ টীকা এবং আয যুমারঃ ৩-৪টীকা। )
এই আয়াতে ‘দ্বীনুল কাইয়েমা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির একে دِيْنُ المِلَّتِ الْقَيِّمَتٍ অর্থাৎ “সত্য-সঠিক পথাশ্রয়ী মিল্লাতের দ্বীন” অর্থে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ একে বিশেষ্যের সাথে বিশেষণের সম্বন্ধ হিসেবে গণ্য করেছেন এবং قَيِّمَتٌ এর ه কে عَلَّامَهٌ ও فَهَّامَه এর মতো অত্যধিক বৃদ্ধি অর্থে গ্রহণ করেছেন। আমি এখানে অনুবাদে যে অর্থ গ্রহণ করেছি তাদের মতে এর অর্থও তাই।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَـٰبِ وَٱلْمُشْرِكِينَ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمْ شَرُّ ٱلْبَرِيَّةِ﴾
৬। আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে৮ তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। তারা সৃষ্টির অধম।৯
৮. এখানে কুফরী মানে মুহাম্মাদ সা.কে মেনে নিতে অস্বীকার করা। অর্থাৎ মুশরিক ও আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা এই রাসূলের নবুওয়াত লাভের পর তাঁকে মানেনি। অথচ তাঁর অস্তিত্বই একটি সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল প্রমাণ। তিনি সম্পূর্ণ ও নির্ভুল লিপি সম্বলিত মত পবিত্র সহীফা পাঠ করে তাদেরকে শুনাচ্ছেন। এ ধরনের লোকদের পরিণাম তাই হবে যা সামনের দিকে বর্ণনা করা হচ্ছে।
৯. অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি আর নেই। এমন কি তারা পশুরও অধম। কারণ পশুর বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি নেই। কিন্তু এরা বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি সত্ত্বেও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمْ خَيْرُ ٱلْبَرِيَّةِ﴾
৭। যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা নিশ্চিত ভাবে সৃষ্টির সেরা।১০
১০. অর্থাৎ তারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবার এমনকি ফেরেশতাদেরও সেরা। কারণ ফেরেশতারা আল্লাহর নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখে না। আর মানুষ এই নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে।
﴿جَزَآؤُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّـٰتُ عَدْنٍۢ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًۭا ۖ رَّضِىَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ خَشِىَ رَبَّهُۥ﴾
৮। তাদের পুরস্কার রয়েছে তাদের রবের কাছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এসব সে ব্যক্তির জন্য যে তার রবকে ভয় করে।১১
১১. অন্য কথায় যে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভীক এবং তাঁর মোকাবিলায় দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে জীবন যাপন করে না। বরং দুনিয়ায় প্রতি পদে পদে আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করে। প্রতি পদক্ষেপে যে ব্যক্তি মনে করে, কোথাও আমি এমন কোনো কাজ তো করে বসিনি যার ফলে আল্লাহ আমাকে পাকড়াও করে ফেলেন, তার জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে এই প্রতিদান ও পুরস্কার।
— সমাপ্ত —