তরজমা ও তাফসীর
পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে
﴿قُلْ أُوحِىَ إِلَىَّ أَنَّهُ ٱسْتَمَعَ نَفَرٌۭ مِّنَ ٱلْجِنِّ فَقَالُوٓا۟ إِنَّا سَمِعْنَا قُرْءَانًا عَجَبًۭا﴾
১। হে নবী, বল, আমার কাছে অহী পাঠানো হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।১ তারপর (ফিরে গিয়ে নিজ জাতির লোকদেরকে) বলেছেঃ আমরা এক বিস্ময়কর ‘কুরআন’ শুনেছি২
১. এ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সা. সে সময় জিনদের দেখতে পাচ্ছিলেন না এবং তারা যে কুরআন শুনছে একথাও তাঁর জানা ছিল না। পরবর্তী সময়ে আল্লাহ তাআ’লা তাঁকে অহীর মাধ্যমে এ ঘটনা জানিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনাটির বর্ণনা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, সে সময় রাসূলুল্লাহ সা. জিনদের উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করেননি এবং তিনি তাদের দেখেনওনি।” (মুসলিম, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে জারীর)
২. মূল আয়াতে قُرْاَناً عَجَبًا (কুরআনান আজাবান) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘কুরআন’ মানে পড়ার মত জিনিস। জ্বীনেরা সম্ভবত শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহার করেছিল। কারণ তখন তারা প্রথম বারের মত এ বাণীর সাথে পরিচিত হয়েছিল। সে সময় হয়তো তাদের জানা ছিল না যে, যে জিনিস তারা শুনছে তার নামই কুরআন। عجب (আজাবা) আধিক্য অর্থনির্দেশক একটি শব্দ। আরবী ভাষায় শব্দটি ব্যবহৃত হয় অত্যধিক বিস্ময়কর ব্যাপার বুঝাতে। সুতরাং জিনদের উক্তির অর্থ হলো, আমরা এমন একটি বাণী শুনে এসেছি যা ভাষাগত উৎকর্ষতা ও বিষয়বস্তু হিসেবে অতুলনীয়।
এ থেকে জানা যায় যে, জিনরা শুধু মানুষের কথা শুনতে পারে তাই নয়, তারা মানুষের ভাষাও ভালভাবে বুঝতে পারে। তবে এটা জরুরী নয় যে, সব জিন মানুষের সব ভাষাই জানবে বা বুঝবে। সম্ভবত তাদের যে গোষ্ঠী পৃথিবীর যে এলাকায় বসবাস করে তারা সে এলাকার মানুষের ভাষা জানে। তবে কুরআনের এ বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐ সময় যেসব জিন কুরআন শুনেছিল তারা আরবী ভাষায় এত দক্ষ ছিল যে, তারা এ বাণীর অতুলনীয় ভাষাগত উৎকর্ষ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এর উচ্চমানের বিষয়বস্তুও ভালভাবে বুঝতে পেরেছিল।
﴿يَهْدِىٓ إِلَى ٱلرُّشْدِ فَـَٔامَنَّا بِهِۦ ۖ وَلَن نُّشْرِكَ بِرَبِّنَآ أَحَدًۭا﴾
২। যা সত্য ও সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা আর কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করবো না।”৩
৩. এ থেকে কয়েকটি বিষয় জানা গেল। একঃ জিনরা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর ‘রব’ হওয়াকে অস্বীকার করে না। দুইঃ তাদের মধ্যেও মুশরিক আছে যারা মুশরিক মানুষের মত অন্য জিনিসকে আল্লাহর উলুহিয়াতের মধ্যে শরীক করে। তাই জিনদের যে কওমের সদস্যরা কুরআন মজীদ শোনার পর কওমের কাছে ফিরে গিয়েছিল তারাও ছিল মুশরিক। তিনঃ নবুওয়াত এবং আসমানী কিতাবসমূহ নাযিল হওয়ার ধারা জিনদের মধ্যে প্রচলিত ছিল না। বরং তাদের মধ্যে যেসব জিন ঈমান আনে তারা মানুষের মধ্যে প্রেরিত নবী এবং তাদের আনীত কিতাবসমূহের ওপর-ই ঈমান আনে। একথাটি সূরা আল আহকাফের ২৯-৩১ আয়াত থেকেও জানা যায়। ঐ আয়াত গুলোতে বলা হয়েছে, সে সময় যেসব জিন কুরআন শুনেছিল তারা হযরত মূসার অনুসারী ছিল। তারা কুরআন শোনার পর নিজের কওমকে এ মর্মে দাওয়াত দিয়েছিল যে, এখন আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বানী এসেছে এবং পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রতিপন্ন করছে তার ওপর ঈমান আনো। সূরা আর রাহমানও এ বিষয়টিই প্রমাণ করে। কারণ তার পুরা বক্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় যে, মানুষ ও জিন শুধু এ দু’টি সৃষ্টিই রাসূলুল্লাহ সা. এর দাওয়াতের ক্ষেত্রে ছিল।
﴿وَأَنَّهُۥ تَعَـٰلَىٰ جَدُّ رَبِّنَا مَا ٱتَّخَذَ صَـٰحِبَةًۭ وَلَا وَلَدًۭا﴾
৩। আর “আমাদের রবের মর্যাদা অতীব সমুচ্চ। তিনি কাউকে স্ত্রী কিংবা সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেননি।”৪
৪. এখান থেকে দু’টি বিষয় জানা গেল। এ জিনগুলো হয় ঈসায়ী বা খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিল অথবা অন্য এমন কোন ধর্মের অনুসারী ছিল যে ধর্মে মহান আল্লাহর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আছে বলে বিশ্বাস করা হতো। দুইঃ সে সময় রাসূলুল্লাহ সা. নামাযের মধ্যে পবিত্র কুরআনের এমন কোন অংশ তিলাওয়াত করছিলেন যা শুনে তাদের কাছে নিজেদের আকীদার ভ্রান্তি ধরা পড়েছিল এবং তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মহান আল্লাহর সমুন্নত ও অতি মর্যাদাবান সত্তার সাথে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সম্পর্কিত করা চরম অজ্ঞতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
﴿وَأَنَّهُۥ كَانَ يَقُولُ سَفِيهُنَا عَلَى ٱللَّهِ شَطَطًۭا﴾
৪। আর “আমাদের নির্বোধ লোকেরা৫ আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী অনেক কথাবার্তা বলে আসছে।”
৫. মূল আয়াতে سَفِيْهُنَا (ছাফিহুনা) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি এক ব্যক্তির জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে আবার অনেক লোক বা দলের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। যদি শব্দটি একজন অজ্ঞ বা মূর্খ লোক অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার মানে হবে ইবলীস। আর যদি অনেক লোক বা দলের অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে অর্থ হবে জিনদের মধ্য থেকে অনেক নির্বোধ ও বুদ্ধি-বিবেকহীন লোক এ রকম কথা বলতো।
﴿وَأَنَّا ظَنَنَّآ أَن لَّن تَقُولَ ٱلْإِنسُ وَٱلْجِنُّ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًۭا﴾
৫। আর “আমরা মনে করেছিলাম যে, মানুষ এবং জিন আল্লাহর সম্বন্ধে কখনো মিথ্যা বলতে পারে না।”৬
৬. অর্থাৎ তাদের ভ্রান্ত কথাবার্তা দ্বারা আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ হলো, আমরা কোন সময় চিন্তাও করতে পারিনি যে, মানুষ কিংবা জিন আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলার দুঃসাহসও করতে পারে কিন্তু এখন এ কুরআন শুনে আমরা জানতে পেরেছি যে, প্রকৃত পক্ষে তারা ছিল মিথ্যাবাদী।
﴿وَأَنَّهُۥ كَانَ رِجَالٌۭ مِّنَ ٱلْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍۢ مِّنَ ٱلْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًۭا﴾
৬। আর “মানুষের মধ্য থেকে কিছু লোক জ্বীনদের কিছু লোকের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতো। এভাবে তারা জ্বীনদের অহংকার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।”৭
৭. ইবনে আব্বাস বলেনঃ জাহেলী যুগে আরবরা যখন কোন জনহীন প্রান্তরে রাত্রি যাপন করতো তখন উচ্চস্বরে বলতো, “আমরা এ প্রান্তরের অধিপতি জ্বীনের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” জাহেলী যুগের অন্যান্য বর্ণনাতেও এ বিষয়টির বহুল উল্লেখ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কোন জায়গায় পানি এবং ঘাস ফুরিয়ে গেলে মুরুচারী যাযাবর বেদুঈনরা তাদের একজন লোককে এমন আরেকটি জায়গা খুঁজে বের করতে পাঠাতো যেখানে পানি এবং ঘাস পাওয়া যেতে পারে। অতঃপর উক্ত ব্যক্তির নির্দেশনা মুতাবিক এসব লোক নতুন জায়গায় পৌঁছলে সেখানে অবস্থান নেয়ার আগে চিৎকার করে বলতোঃ “আমরা এ প্রান্তরের মালিকের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যাতে আমরা এখানে সব রকম বিপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারি।” তাদের বিশ্বাস ছিল, প্রত্যেক জনমানবহীন জায়গা কোন না কোন জ্বীনের দখলে আছে। তার আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়াই কেউ যদি সেখানে অবস্থান করে তাহলে সে জিন হয় নিজেই তাদের উত্যক্ত করে কিংবা অন্য জিনদের উত্যক্ত করার জন্য লেলিয়ে দেয়। ঈমান আনয়নকারী এ জিনরা এ বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করেছে। তাদের কথার অর্থ হলো এ পৃথিবীর খলিফা বা প্রতিনিধি মানুষ। তারাই যখন উল্টা আমাদের ভয় করতে শুরু করেছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের আশ্রয় প্রার্থনা করতে শুরু করেছে তখন আমাদের জাতির লোকদের মস্তিষ্ক বিকৃতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের গর্ব, অহংকার এবং কুফরী ও জুলুম অত্যাচারের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গিয়েছে এবং গোমরাহীর ক্ষেত্রে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে।
﴿وَأَنَّهُمْ ظَنُّوا۟ كَمَا ظَنَنتُمْ أَن لَّن يَبْعَثَ ٱللَّهُ أَحَدًۭا﴾
৭। আর “তোমরা যেমন ধারণা পোষণ করতে মানুষেরাও ঠিক তেমনি ধারণা পোষণ করেছিল যে, আল্লাহ কাউকে রাসূল বানিয়ে পাঠাবেন না।”৮
৮. মূল ভাষ্য হচ্ছে اَنْ لَّنْ يُّبْعَثَ اللهُ اَحَدًا এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি আমরা যা অনুবাদ করেছি। অপরটি হলো, “মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআ’লা কাউকে আর জীবিত করে উঠাবেন না।” যেহেতু কথাটি ব্যাপক অর্থবোধক তাই তার এ অর্থও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, মানুষের মত জিনদের মধ্যে একদল আখেরাতকে অস্বীকার করতো। কিন্তু পরবর্তী বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যের দিক থেকে প্রথম অর্থটিই অধিক অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। কারণ, পরবর্তী আয়াতসমূহে এ বিষয়টির উল্লেখ আছে যে, ঈমান আনয়নকারী এসব জিন তাদের কওমকে বলছে, আল্লাহ আর কোন রাসূল পাঠাবেন না। তোমাদের এ ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের জন্য আসমানের দরজা বন্ধ করার কারণ হলো আল্লাহ একজন রাসূল পাঠিয়েছেন।
﴿وَأَنَّا لَمَسْنَا ٱلسَّمَآءَ فَوَجَدْنَـٰهَا مُلِئَتْ حَرَسًۭا شَدِيدًۭا وَشُهُبًۭا﴾
৮। আর “আমরা আসমানে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি, তা কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা পরিপূর্ণ।”
﴿وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَـٰعِدَ لِلسَّمْعِ ۖ فَمَن يَسْتَمِعِ ٱلْـَٔانَ يَجِدْ لَهُۥ شِهَابًۭا رَّصَدًۭا﴾
৯। আর “ইতিপূর্বে আমরা ছিঁটেফোটা কিছু আড়ি পেতে শোনার জন্য আসমানে বসার জায়গা পেয়ে যেতাম। কিন্তু এখন কেউ গোপনে শোনার চেষ্টা করলে সে তার নিজের বিরুদ্ধে নিক্ষেপের জন্য একটি উল্কা নিয়োজিত দেখতে পায়।”৯
৯. এটাই সে কারণ যার ভিত্তিতে জিনরা এ বিষয়টি অনুসন্ধান করতে বেরিয়েছিল যে, পৃথিবীতে এমন কি ঘটনা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে যার খবরাখবর সুরক্ষিত করার জন্য এমন কঠোর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এখন আমরা ঊর্ধ্ব জগতের কোন খবর জানার সুযোগ পাই না এবং যেখানেই যাই আমাদের মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
﴿وَأَنَّا لَا نَدْرِىٓ أَشَرٌّ أُرِيدَ بِمَن فِى ٱلْأَرْضِ أَمْ أَرَادَ بِهِمْ رَبُّهُمْ رَشَدًۭا﴾
১০। আর আমাদের বোধগম্য হচ্ছিল না যে, পৃথিবীবাসীদের সাথে কোন খারাপ আচরণ করার সংকল্প করা হয়েছে, নাকি তাদের প্রভু, তাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে চান?১০
১০. এ থেকে জানা গেল যে, দু’টি পরিস্থিতিতে ঊর্ধ্ব জগতে এ ধরনের অসাধারণ ব্যবস্থাদি গৃহীত হয়ে থাকে। একঃ আল্লাহ যদি পৃথিবী বাসীদের ওপর কোন আযাব নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং চান যে, তা নাযিল হওয়ার আগে জিনরা তার পূর্বাভাস পেয়ে তাদের মানুষ বন্ধুদের সাবধান করে না দিক। দুইঃ আল্লাহ যদি পৃথিবীতে কোন রাসূল পাঠিয়ে থাকেন এবং তাঁর কাছে যেসব হিদায়াত ও বাণী পাঠানো হচ্ছে তাতে শয়তানরা যাতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং রাসূলের কাছে কি কি হিদায়াত বা বানী পাঠানো হচ্ছে তা আগেভাগেই জেনে নিতে না পারে তার নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ কাম্য হয় তখন এ ধরনের অসাধারণ ব্যবস্থাটি গ্রহীত হয়। সুতরাং জিনদের একথাটির অর্থ হলো, আমরা যখন আসমানে এরূপ কঠোর প্রহরা দেখলাম এবং অজস্র উল্কা বর্ষণ লক্ষ করলাম তখন এ দু’টি অবস্থার কোনটি সংঘটিত হচ্ছে আমাদের মধ্যে তা জানার উদ্বেগ সৃষ্টি হলো। আল্লাহ তাআ’লা কি হঠাৎ করে পৃথিবীর কোন জাতির ওপর আযাব নাযিল করেছেন না কোন এলাকায় কোন রাসূল পাঠিয়েছেন? এ বিষয়টি অনুসন্ধানেই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। এরই এক পর্যায়ে আমরা এ বিস্ময়কর বাণী শুনতে পেলাম যা সত্য ও সঠিক পথের সন্ধান দান করে। এভাবে আমরা জানতে পেরেছি, আল্লাহ কোন আযাব নাযিল করেননি। বরং তাঁর সৃষ্টিকে সত্য ও সঠিক পথ দেখানোর জন্য একজন রাসূল পাঠিয়েছেন। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হিজরঃ টীকা ৮ থেকে ১২; সূরা আস সাফফাতঃ টীকা ৭ এবং সূরা আল মুলকঃ টীকা ১১)
﴿وَأَنَّا مِنَّا ٱلصَّـٰلِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَٰلِكَ ۖ كُنَّا طَرَآئِقَ قِدَدًۭا﴾
১১। আর আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে নেককার আর কিছু লোক আছে তার চেয়ে নীচু পর্যায়ের। এভাবে আমরা বিভিন্ন মতে বিভক্ত১১ ছিলাম।
১১. অর্থাৎ আমাদের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের দিক থেকেও ভাল ও মন্দ দু’প্রকারের জিন আছে এবং আকীদা-বিশ্বাসের দিক থেকেও মত ও পথ একটি নয়। এক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একথা বলে ঈমান আনয়নকারী এসব জিন নিজ জাতির জিনদের বুঝাতে চাচ্ছিল যে, নিঃসন্দেহে আমরা সত্য ও সঠিক পথ খুঁজে বের করার মুখাপেক্ষী। এর প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
﴿وَأَنَّا ظَنَنَّآ أَن لَّن نُّعْجِزَ ٱللَّهَ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَن نُّعْجِزَهُۥ هَرَبًۭا﴾
১২। আর আমরা মনে করতাম যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে অক্ষম করে দিতে সক্ষম নই এবং পালিয়েও তাঁকে পরাভূত করতে পারবো না।১২
১২. অর্থাৎ আমাদের এ ধারণাই আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। আমরা যেহেতু আল্লাহ সম্পর্কে নির্ভয় বা বেপরোয়া ছিলাম না এবং এ ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, যদি আমরা তাঁর অবাধ্য হই তাহলে তাঁর পাকড়াও থেকে কোন অবস্থায়ই বাঁচতে পারবো না। তাই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্য ও সঠিক পথ প্রদর্শনকারী বাণী শুনে ন্যায় ও সত্যকে জানার পরও অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকদের প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত আকীদা-বিশ্বাসকেই আঁকড়ে থাকার দুঃসাহস আমরা দেখাইনি।
﴿وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا ٱلْهُدَىٰٓ ءَامَنَّا بِهِۦ ۖ فَمَن يُؤْمِنۢ بِرَبِّهِۦ فَلَا يَخَافُ بَخْسًۭا وَلَا رَهَقًۭا﴾
১৩। আর আমরা যখন হিদায়াতের বানী শুনলাম তখন তার প্রতি ঈমান আনলাম। যে ব্যক্তিই তার রবের ওপর ঈমান আনবে তার অধিকার বিনষ্ট হওয়ার কিংবা অত্যাচারিত হওয়ার ভয় থাকবে না।১৩
১৩. অধিকার বিনষ্ট হওয়ার অর্থ হলো, নেক কাজের জন্য যতটা পারিশ্রমিক বা পুরস্কার পাওয়ার কথা তার চাইতে কম দেয়া। আর জুলুম বা অত্যাচার হলো নেক কাজের জন্য আদৌ কোন পারিশ্রমিক বা পুরস্কার না দেয়া এবং তার দ্বারা যে ত্রুটি বা অপরাধ হয়েছে তার তুলনায় অধিক শাস্তি দেয়া, কিংবা অপরাধ ছাড়াই কাউকে শাস্তি দেয়া। আল্লাহ তাআ’লার দরবারে কোন ঈমানদারের প্রতি এ ধরনের কোন বে-ইনসাফী হওয়ারআশঙ্কা থাকবে না।
﴿وَأَنَّا مِنَّا ٱلْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا ٱلْقَـٰسِطُونَ ۖ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ تَحَرَّوْا۟ رَشَدًۭا﴾
১৪। আর আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে মুসলমান (আল্লাহর আনুগত্যকারী) আর কিছু সংখ্যক লোক আছে ন্যায় ও সত্য থেকে বিমুখ। তবে যারা ইসলাম (আনুগত্যের পথ) গ্রহণ করেছে তারা মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে।
﴿وَأَمَّا ٱلْقَـٰسِطُونَ فَكَانُوا۟ لِجَهَنَّمَ حَطَبًۭا﴾
১৫। আর যারা ন্যায় ও সত্য থেকে বিমুখ তারা হবে জাহান্নামের ইন্ধন।১৪
১৪. কুরআনের ভাষ্য অনুসারে জ্বীনেরা আগুন থেকে সৃষ্ট। তাই প্রশ্ন হতে পারে যে, জাহান্নামের আগুন দ্বারা তাদের আবার কি কষ্ট হবে? এর জবাব হলো, কুরআনের ভাষ্য অনুসারে মানুষও মাটি থেকে সৃষ্ট। তা সত্ত্বেও তাদের মাটির ঢিল ছুঁড়ে মারলে ব্যাথা পায় কেন? প্রকৃত সত্য হলো মানুষের গোটা দেহ মাটির উপাদান দ্বারা তৈরী হলেও এসব উপাদান থেকে যখন একজন রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ অস্তিত্ব লাভ করে তখন সে এসব উপাদান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিসে রূপান্তরিত হয় এবং একই উপাদান থেকে তৈরী অন্যান্য জিনিস তার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তেমনিভাবে গঠনাকৃতির দিক থেকে জিন যদিও আগুনের তৈরী। কিন্তু আগুন থেকে তৈরী একটি জীবন্ত ও চেতনা সম্পন্ন সৃষ্টি যখন অস্তিত্ব লাভ করে তখন সে আগুনই তার জন্যে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আর রাহমানঃ টীকা ১৫)
﴿وَأَلَّوِ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ عَلَى ٱلطَّرِيقَةِ لَأَسْقَيْنَـٰهُم مَّآءً غَدَقًۭا﴾
১৬। আর১৫ (হে বনী, বলে দাও, আমাকে অহীর মাধ্যমে এও জানানো হয়েছে যে,) লোকেরা যদি সঠিক পথের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে আমি তাদের প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণের মধ্যে সমৃদ্ধ করতাম।১৬
১৫. এর পূর্বে জিনদের কথা শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন এখান থেকে আল্লাহ তাআ’লা নিজের কথা শুরু হচ্ছে।
১৬. একথাটিই সূরা নূহে এভাবে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তোমাদের ওপর আসমান থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন।” (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূহঃ টীকা ২) প্রচুর পরিমাণ পানিকে নিয়ামতের প্রাচুর্য অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা, পানির ওপর নির্ভর করেই জনবসতি গড়ে ওঠে। পানি না থাকলে আদৌ কোন জনপদ গড়ে উঠতে পারে না। পানি না থাকলে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন যেমন পূর্ণ হয় না তেমনি মানুষের বিভিন্ন রকম শিল্পও গড়ে উঠতে পারে না।
﴿لِّنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَمَن يُعْرِضْ عَن ذِكْرِ رَبِّهِۦ يَسْلُكْهُ عَذَابًۭا صَعَدًۭا﴾
১৭। যাতে এ নিয়ামতের মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করতে পারি।১৭ আর যারা তাদের প্রভুর স্মরণ থেকে বিমুখ হবে১৮ তিনি তাদের কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করবেন।
১৭. অর্থাৎ তিনি দেখতে চান তারা নিয়ামত লাভ করার পর কৃতজ্ঞ থাকে কিনা এবং আমার দেয়া নিয়ামতসমূহ সঠিক ভাবে কাজে লাগায়, না ভ্রান্ত পথে কাজে লাগায়।
১৮. স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার একটা অর্থ হলো, মানুষ আল্লাহর প্রেরিত উপদেশ গ্রহণ করবে না। আরেকটি অর্থ হলো, মানুষ আল্লাহর যিকরের কথা শোনা পছন্দই করবে না। এর আরেকটি অর্থ হলো, সে আল্লাহর ইবাদাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
﴿وَأَنَّ ٱلْمَسَـٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا۟ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدًۭا﴾
১৮। আর মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। তাই তোমরা আল্লাহর সাথে আর কাউকে ডেকো না।১৯
১৯. মুফাসসিরগণ مَسَاجِد (মাছাজিদ) শব্দটি সাধারণভাবে ইবাদাতখানা বা উপসানলায় অর্থে গ্রহণ করেছেনঃ ‘মাসাজিদ’ শব্দটি এ অর্থ গ্রহণ করলে আয়াতটির অর্থ হয় “উপাসনালয় সমূহে আল্লাহর ইবাদাতের সাথে সাথে আর কারো ইবাদাত যেন করা না হয়। হযরত হাসান বাসরী বলেনঃ সমস্ত পৃথিবীটাই ইবাদাতখানা বা উপাসনালয়। তাই আয়াতটির মূল বক্তব্য হলো আল্লাহর এ পৃথিবীতে কোথাও যেন শিরক করা না হয়। তিনি নবী সা. এর এ বাণী থেকে প্রমাণ পেশ করেছেন وَجُعِلَتْ لِىَ الاَرْضُ مَسْجِدًا وَطُهُوْرًا (আমার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে ইবাদতের স্থান এবং পবিত্রতা অর্জনের উপায় বানিয়ে দেয়া হয়েছে)। হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর মসজিদ বলতে যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ সিজদা করে সেগুলো অর্থাৎ হাত, হাঁটু, পা ও কপাল বুঝিয়েছেন। এ ব্যাখ্যানুসারে আয়াতটির অর্থ হলো, সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর তৈরী। এগুলোর সাহায্যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করা যাবে না।
﴿وَأَنَّهُۥ لَمَّا قَامَ عَبْدُ ٱللَّهِ يَدْعُوهُ كَادُوا۟ يَكُونُونَ عَلَيْهِ لِبَدًۭا﴾
১৯। আর আল্লাহর বান্দা২০ যখন তাঁকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন তারা সবাই তার ওপর হামলা করতে উদ্যত হলো।
২০. এখানে আল্লাহর বান্দা অর্থ রাসূলুল্লাহ সা.।
﴿قُلْ إِنَّمَآ أَدْعُوا۟ رَبِّى وَلَآ أُشْرِكُ بِهِۦٓ أَحَدًۭا﴾
২০। হে নবী, বলো “আমি শুধু আমার রবকেই ডাকি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না।২১
২১. অর্থাৎ আল্লাহকে ডাকা এমন কোন আপত্তিকর কাজ নয় যার জন্য মানুষ এতটা রাগান্বিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়বে। তবে কেউ যদি আল্লাহর সাথে তাঁর প্রভুত্ব ও উলুহিয়্যাতের ব্যাপারে কাউকে শরীক করে তাহলে তা নিঃসন্দেহে খারাপ। আর এ কাজ আমি করিনি। বরং যারা আল্লাহর নাম শুনে আমার ওপর হামলা করতে চায় তারাই এ কাজ করেছে।
﴿قُلْ إِنِّى لَآ أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّۭا وَلَا رَشَدًۭا﴾
২১। বলো, “আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করারও ক্ষমতা রাখি না, উপকার করারও না।
﴿قُلْ إِنِّى لَن يُجِيرَنِى مِنَ ٱللَّهِ أَحَدٌۭ وَلَنْ أَجِدَ مِن دُونِهِۦ مُلْتَحَدًا﴾
২২। বলো, আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউ আমাকে বাঁচাতে সক্ষম নয় এবং তাঁর কাছে কোন আশ্রয়ও আমি পাব না।
﴿إِلَّا بَلَـٰغًۭا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِسَـٰلَـٰتِهِۦ ۚ وَمَن يَعْصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ لَهُۥ نَارَ جَهَنَّمَ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًا﴾
২৩। আল্লাহর বাণী ও হুকুম-আহকাম পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আমার কাজ আর কিছুই নয়।২২ এরপর যারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা অমান্য করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। এ ধরনের লোকেরা চিরকাল সেখানে থাকবে।২৩
২২. অর্থাৎ আমি কখনো এ দাবী করি না যে, আল্লাহর প্রভুত্বে আমার কোন দখলদারী বা কর্তৃত্ব আছে। কিংবা মানুষের ভাগ্য ভাঙা বা গড়ার ব্যাপারে আমার কোন ক্ষমতা আছে। আমি তো আল্লাহর একজন রাসূল মাত্র। আমার ওপর যে কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা তোমাদের কাছে আল্লাহ তাআ’লার বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার অধিক আর কিছুই নয়। আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ব্যাপার তো পুরোপুরি আল্লাহরই করায়ত্ব। অন্য কারো কল্যাণ বা ক্ষতি সাধন তো দূরের কথা নিজের ক্ষতি ও কল্যাণের ব্যাপারটিও আমার নিজের ইচ্ছাধীন নয়। আমি যদি আল্লাহর নাফরমানী করি তাহলে তাঁর পাকড়াও থেকে আত্মরক্ষা করে কোথাও আশ্রয় লাভ করতে পারবো না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে ছাড়া আমার আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আশ্ শূরা, টীকা ৭)
২৩. এর অর্থ এই নয় যে, প্রতিটি গোনাহ ও অপরাধের শাস্তিই হচ্ছে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। বরং যে প্রসঙ্গে একথাটি বলা হয়েছে তার আলোকে আয়াতের অর্থ হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তাওহীদের যে আহবান জানানো হয়েছে তা যে ব্যক্তি মানবে না এবং শিরককেও বর্জন করবে না তার জন্য অবধারিত আছে জাহান্নামের চিরস্থায়ী শাস্তি।
﴿حَتَّىٰٓ إِذَا رَأَوْا۟ مَا يُوعَدُونَ فَسَيَعْلَمُونَ مَنْ أَضْعَفُ نَاصِرًۭا وَأَقَلُّ عَدَدًۭا﴾
২৪। (এসব লোক তাদের এ আচরণ থেকে বিরত হবে না) এমনকি অবশেষে যখন তারা সে জিনিসটি দেখবে যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেয়া হচ্ছে, তখন তারা জানতে পারবে যে, কার সাহায্যকারী দুর্বল এবং কার দল সংখ্যায় কম।২৪
২৪. এ আয়তটির পটভূমি হলো, সে যুগে যেসব লোক আল্লাহর পথের দিকে রাসূলুল্লাহ সা. এর আহবান শুনেই তাঁর ওপর মারমুখী হতো তারা এ খোশ খেয়ালে নিমগ্ন ছিল যে, তাদের দলবলই বড়। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে আছে আঙুলে গোণা কয়েকজন লোক। সুতরাং তারা অতি সহজেই তাকে পরাভূত করতে সক্ষম হবে। তাই বলা হচ্ছে, আজ এসব লোক রাসূলকে সা. অসহায় ও বন্ধুহীন এবং নিজেদের সংখ্যাধিক্য দেখে ন্যায় ও সত্যের কণ্ঠ স্তদ্ধ করে দিতে দুঃসাহস দেখাচ্ছে। কিন্তু যে সময় সম্পর্কে তাদের সাবধান করে দেয়া হচ্ছে সে দুঃসময়টি যখন আসবে, তখন তারা বুঝতে পারবে প্রকৃত পক্ষে অসহায় ও বন্ধুহীন কারা।
﴿قُلْ إِنْ أَدْرِىٓ أَقَرِيبٌۭ مَّا تُوعَدُونَ أَمْ يَجْعَلُ لَهُۥ رَبِّىٓ أَمَدًا﴾
২৫। বলো, আমি জানি না, যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা নিকটে, না তার জন্য আমার রব কোন দীর্ঘ মেয়াদ স্থির করছেন।২৫
২৫. বর্ণনাভঙ্গি থেকেই বুঝা যায়, এটি একটি প্রশ্নের জওয়াব। এখানে প্রশ্নটি উল্লেখ না করে শুধু তার জবাব দেয়া হয়েছে। সম্ভবত ওপরে উল্লেখিত কথা শুনে বিরোধীরা বিদ্রূপের ভঙ্গীতে প্রশ্ন করে থাকবে যে, যে সময়ের ভয় তিনি দেখাচ্ছেন সে সময়টি কখন আসবে? তার জবাবে রাসূলুল্লাহ সা.কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের বলো, সে সময়টি আগমন তো নিশ্চিত, তবে তার আগমনের দিনক্ষণ আমাকে জানানো হয়নি। সে সময়টি অতি আসন্ন, না তার জন্য দীর্ঘ সময় নির্দিষ্ট রয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ তাআ’লাই জানেন।
﴿عَـٰلِمُ ٱلْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَىٰ غَيْبِهِۦٓ أَحَدًا﴾
২৬। তিনি গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না।২৬
২৬. অর্থাৎ গায়েবী বিষয়ের সবটুকু জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। গায়েবী বিষয়ের এ পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তিনি কাউকেই দেন না।
﴿إِلَّا مَنِ ٱرْتَضَىٰ مِن رَّسُولٍۢ فَإِنَّهُۥ يَسْلُكُ مِنۢ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِۦ رَصَدًۭا﴾
২৭। তবে যে রাসূলকে (গায়েবী বিষয়ের কোন জ্ঞান দেয়ার জন্য) মনোনীত করেছেন২৭ তাকে ছাড়া। তিনি তার সামনে ও পেছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।২৮
২৭. অর্থাৎ রাসূল নিজে “আলেমুল গায়েব” বা গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী নন। বরং আল্লাহ তাআ’লা যখন তাকে রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য মনোনীত করেন তখন তিনি ইচ্ছামত তাঁকে অদৃশ্য বস্তুসমূহের জ্ঞান দান করেন।
২৮. প্রহরী মানে ফেরেশতা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআ’লা যখন অহীর মাধ্যমে গায়েবী বিষয়ের গভীর জ্ঞান ও তাৎপর্য তাঁর রাসূলের কাছে পাঠান তখন তার রক্ষণাবেক্ষণ ও পাহারাদারীর জন্য সবখানে ফেরেশতা মোতায়েন করেন। যাতে সে জ্ঞানটি অত্যন্ত সুরক্ষিত পন্থায় রাসূলের কাছে পৌঁছতে পারে এবং তার মধ্যে বাইরের কোন কিছু সংমিশ্রত হতে না পারে। ওপরে ৮ও ৯ নং আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জ্বীনরা দেখলো তাদের ঊর্ধ্ব জগতে প্রবেশের সব পথ বন্ধ। তারা দেখলো সব জায়গায় কঠোর প্রহরা বসানো হয়েছে যার কারণে ছিটে ফোঁটা কিছু আভাস লাভের সুযোগও তাদের নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
﴿لِّيَعْلَمَ أَن قَدْ أَبْلَغُوا۟ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّهِمْ وَأَحَاطَ بِمَا لَدَيْهِمْ وَأَحْصَىٰ كُلَّ شَىْءٍ عَدَدًۢا﴾
২৮। যাতে তিনি নিশ্চিতরূপে জানতে পারেন যে, রাসূলগণ তাদের রবের বাণীসমূহ পৌঁছিয়ে দিয়েছেন২৯ তিনি তাদের গোটা পরিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। আর তিনি প্রতিটি জিনিস গুণে গুণে হিসেব করে রেখেছেন।৩০
২৯. এর তিনটি অর্থ হতে পারে। একঃ রাসূল নিশ্চিতভাবে জানবেন যে, ফেরেশতারা তাঁর কাছে আল্লাহ তাআ’লার বাণীসমূহ ঠিক ঠিক পৌঁছিয়ে দিয়েছে। দুইঃ আল্লাহ তাআ’লা জানবেন যে, ফেরেশতারা তাদের রবের বাণীসমূহ তাঁর রাসূলের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তিনঃ আল্লাহ তাআ’লা জানবেন যে রাসূলগণ তাঁদের রবের বাণীসমূহ তাঁর বান্দাদের কাছে ঠিকমত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আয়াতটির শব্দমালা এ তিনটি অর্থেরই ধারক। অসম্ভব নয় যে, এখানে যুগপৎ এ তিনটি অর্থই বুঝানো হয়েছে। এছাড়াও আয়াতটির আরো দু’টি অর্থ হয়। প্রথমটি হলো রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য রাসূলকে যতটুকু “ইলমে গায়েব” বা অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান দান করা জরুরী ততটুকু জ্ঞান দান করা। দ্বিতীয়টি হলো, যেসব ফেরেশতাকে প্রহরা কাজে নিয়োজিত করা হয় তারা রাসূল পর্যন্ত সুরক্ষিত পন্থায় অহী পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারটুকুই শুধু তত্ত্বাবধান করেন না বরং রাসূল তাঁর রবের বাণীসমূহ তাঁর বান্দাদের কাছে যাতে পুরোপুরি পৌঁছিয়ে দিতে পারেন তার তত্ত্বাবধানও করে থাকেন।
৩০. অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা রাসূল ও ফেরেশতা উভয়কে এমনভাবে পরিব্যাপ্ত করে আছে যে, তারা যদি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চুল পরিমাণ কাজও করেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও হবেন। আর যে বাণীসমূহ আল্লাহ পাঠান তার প্রতিটি বর্ণ গোণা ও হিসেব করা। তার একটি বর্ণের হ্রাস-বৃদ্ধি করার ক্ষমতাও রাসূল বা ফেরেশতা করো নেই।
— সমাপ্ত —