আল আনকাবূত

নামকরণঃ

একচল্লিশের আয়াতের অংশবিশেষ مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنكَبُوتِ থেকে সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ যে সূরার মধ্যে আ’নকাবুত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এটি সে সূরা।

নাযিল হবার সময়কালঃ

৫৬ থেকে ৬০ আয়াতের মধ্যে যে বক্তব্য এসেছে তা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, এ সূরাটি হাবশায় হিজরাতের কিছু আগে নাযিল হয়েছিল। অধিকন্তু বিষয়বস্তু গুলোর অভ্যন্তরীন সাক্ষ্যও একথাই সমর্থন করে। কারণ, পশ্চাতপটে সে যুগের অবস্থার চিত্র ঝলকে উঠতে দেখা যায়। যেহেতু এর মধ্যে মুনাফিকদের আলোচনা এসেছে এবং মুনাফিকীর প্রথম দশটি আয়াত হচ্ছে মাদানী এবং বাকি সমস্ত সূরাটি মক্কী। অথচ এখানে যেসব লোকের মুনাফিকীর কথা বলা হয়েছে তারা কেবল কাফেরদের জুলুম, নির্যাতন ও কঠোর শারীরিক নিপীড়নের ভয়ে মুনাফিকী অবলম্বন করছিল। আর একথা সুস্পষ্ট, এ ধরনের মুনাফিকীর ঘটনা মক্কায় ঘটতে পারে, মদীনায় নয়। এভাবে এ সূরায় মুসলমানদেরকে হিজরাত করার উপদেশ দেয়া হয়েছে, এ বিষয়টি দেখেও কোন কোন মুফাসসির একে মক্কায় নাযিলকৃত শেষ সূরা গণ্য করেছেন। অথচ মদীনায় হিজরাতের আগে মুসলমানগণ হাবশায়ও হিজরাত করেছিলেন। এ ধারণাগুলো আসলে কোন হাদীসের ভিত্তিতে নয়। বরং শুধুমাত্র বিষয়বস্তুর অভ্যন্তরীন সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। আর সমগ্র সূরার বিষয়বস্তুর ওপর সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে এ অভ্যন্তরীন সাক্ষ্য মক্কার শেষ যুগের নয় বরং এমন এক যুগের অবস্থার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে যে যুগে মুসলমানদের হাবশায় হিজরাত সংঘটিত হয়েছিল।

বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় বক্তব্যঃ

সূরাটি পড়লে মনে হবে এটি যখন নাযিল হচ্ছিল তখন মক্কায় মুসলমানরা মহা বিপদ-মুসিবতের মধ্যে অবস্থান করছিল। কাফেরদের পক্ষ থেকে পূর্ণ শক্তিতে চলছিল ইসলামের বিরোধিতা এবং মু’মিনদের ওপর চালানো হচ্ছিল কঠোর জুলুম-নিপীড়ন। এহেন অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিকে সাচ্চা ঈমানদারদের লজ্জা দেবার জন্য এ সূরাটি নাযিল করেন। এই সাথে এর মধ্যে মক্কায় কাফেরদেরকেও এ মর্মে কঠোর ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, নিজেদের জন্য এমন পরিণতি ডেকে এনো না সত্যের সাথে শত্রুতা পোষণকারীরা প্রতি যুগে যার সম্মুখীন হয়ে এসেছে।

সে সময় কিছু কিছু যুবক যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন এ প্রসঙ্গে তারও জবাব দেয়া হয়েছে। যেমন তাদের পিতা-মাতারা তাদের ওপর মুহাম্মাদ সা. এর দ্বীন ত্যাগ করে তাদের দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করতো। তাদের পিতা-মাতারা বলতো, যে কুরআনের প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো তাতেও তো লেখা আছে যে, মা-বাপের হক সবচেয়ে বেশি। কাজেই আমরা যা কিছু বলছি তাই তোমরা মেনে নাও। নয়তো তোমরা নিজেদের ঈমান বিরোধী কাজে লিপ্ত হবে। ৮ আয়াতে এর জবাব দেয়া হয়েছে।

অনুরূপভাবে কোন কোন নওমুসলিমকে তাদের গোত্রের লোকেরা বলতো, তোমরা আমাদের কথা মেনে নাও এবং ঐ ব্যক্তি থেকে আলাদা হয়ে যাও, এ জন্য আযাব-সওয়াব যাই হোক, তার দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করছি। যদি এ জন্য আল্লাহ তোমাদের পাকড়াও করেন তাহলে আমরা অগ্রবর্তী হয়ে বলে দেবোঃ জনাব, এ বেচারাদের কোন দোষ নেই। আমরাই এদেরকে ঈমান ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলাম। কাজেই আমাদের পাকড়াও করুন। এর জবাব দেয়া হয়েছে ১২-১৩ আয়াতে।

এ সূরায় যে কাহিনীগুলো বর্ণনা করা হয়েছে সেখানেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ দিকটিই সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী নবীদেরকে দেখো, তারা কেমন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। কত দীর্ঘকাল ধরে তারা নির্যাতিত হয়েছেন। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের সাহায্য করা হয়েছে। কাজেই ভয় পেয়ো না। আল্লাহর সাহায্য নিশ্চয়ই আসবে কিন্তু পরীক্ষার একটি সময়কাল অতিবাহিত হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। মুসলমানদেরকে এ শিক্ষা দেবার সাথে সাথে মক্কার কাফেরদেরকেও এ কাহিনীগুলোতে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাকড়াও হতে দেরি হয়, তাহলে তাতে আর কোনদিন পাকড়াও হবেই না বলে মনে করে নিয়ো না। অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর চিহ্ন ও ধ্বংসাবশেষ তোমাদের সামনে রয়েছে। দেখে নাও, শেষ পর্যন্ত তাদের সর্বনাশ হয়েই গেছে এবং আল্লাহ তার নবীদেরকে সাহায্য করেছেন।

তারপর মুসলমানদেরকে এভাবে পথনির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, জুলুম নির্যাতন যদি তোমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে ঈমান পরিত্যাগ করার পরিবর্তে তোমরা ঘরবাড়ি ত্যাগ করে বের হয়ে যাও। আল্লাহর যমীন অনেক প্রশস্ত। যেখানে আল্লাহর বন্দেগী করার সুযোগ আছে সেখানে চলে যাও।

এসব কথার সাথে সাথে কাফেরদেরকে বুঝাবার দিকটিও বাদ দেয়া হয়নি। তাওহীদ ও আখেরাত উভয় সত্যকে যুক্তিসহকারে তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। শিরককে খণ্ডন করা হয়েছে। বিশ্ব-জাহানের নির্দশনাবলীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদেরকে জানানো হয়েছে যে, আমার নবী তোমাদের সামনে যে শিক্ষা পেশ করছেন এ নির্দশনাবলী তার সত্যতা প্রমাণ করছে।

পরম করুণাময় মেহেরবানী আল্লাহর নামে

﴿الم﴾

আলিম-লাম-মীম  

﴿أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ﴾

লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, “আমরা ঈমান এনেছি” কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না?  

১. যে অবস্থায একথা বলা হয় তা ছিল এই যে, মক্কা মুআ’যযমায় কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেই তার ওপর বিপদ আপদ ও জুলুম-নিপীড়নের পাহাড় ভেঙ্গে পড়তো কোন গোলাম বা গরীব মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ভীষণভাবে মারপিট এবং কঠোর নির্যাতন-নিপীড়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত করা হতো সে যদি কোন দোকানদার বা কারিগর হতো তাহলে তার রুজি-রোজগারের পথ বন্ধ করে দেয়া হতো সে যদি কোন প্রভাবশালী পরিবারের কোন ব্যক্তি হতো, তাহলে তার নিজের পরিবারের লোকেরা তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো ও কষ্ট দিতো এবং এভাবে তার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতো এ অবস্থা মক্কায় একটি মারাত্মক ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল কারণে লোকেরা নবী সা. এর সত্যতার স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও ঈমান আনতে ভয় করতো এবং কিছু লোক ঈমান আনার ভয়াবহ শাস্তিও সম্মুখীন হলে সাহস ও হিম্মতহারা হয়ে কাফেরদের সামনে নতজানু হয়ে যেতো এ পরিস্থিতি যদিও দৃঢ় ঈমানের অধিকারী সাহাবীগণের অবিচল নিষ্ঠার মধ্যে কোন প্রকার দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করেনি তবুও মানবিক প্রকৃতির তাগিদে অধিকাংশ সময় তাদের মধ্যেও একটা মারাত্মক ধরনের চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে যেতো এ ধরনের অবস্থার একটা চিত্র পেশ করে হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত বর্ণিত একটি হাদীস হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন বুখারী, আবু দাউদ ও নাসাঈ তাদের গ্রন্থে তিনি বলেন, যে সময় মুশরিকদের কঠোর নির্যাতনে আমরা ভীষণ দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিলাম সে সময় একদিন আমি দেখলাম নবী সা. কা’বাঘরের দেয়ালের ছায়ায় বসে রয়েছেন আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করেন না? একথা শুনে তার চেহারা আবেগে-উত্তেজনায় রক্তিমবর্ণ ধারণ করলো এবং তিনি বললেন, “তোমাদের পূর্বে যেসব মু’মিনদল অতিক্রান্ত হয়েছে তারা এর চাইতেও বেশি নিগৃহীত হয়েছে তাদের কাউকে মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে বসিয়ে দেয়া হতো এবং তারপর তার মাথার ওপর করাত চালিয়ে দুটুকরা করে দেয়া হতো কারো আংগ-প্রত্যংগের সন্ধিস্থলে লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ানো হতো, যাতে তারা ঈমান প্রত্যাহার করে আল্লাহর কসম, এ কাজ সম্পন্ন হবেই, এমনকি এক ব্যক্তি সানআ’ থেকে হাদ্বারামাউত পর্যন্ত নিশঙ্ক চিত্তে সফর করবে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় তার মনে থাকবে না

এ চিত্তচাঞ্চল্যকে অবিচল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় রূপান্তরিত করার জন্য মহান আল্লাহ মু’মিনদেরকে বুঝান, ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য অর্জনের জন্য আমার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি রয়েছে কোন ব্যক্তি নিছক মৌখিক ঈমানের দাবীর মাধ্যমে তার অধিকারী হতে পারে না বরং প্রত্যেক দাবীদারকে অনিবার্যভাবে পরীক্ষার চুল্লী অতিক্রম করতে হবেই তাকে এভাবে নিজের দাবির সত্যতা পেশ করতে হবে আমার জান্নাত এত সস্তা নয় এবং দুনিয়াতেও আমার বিশেষ অনুগ্রহ এত আয়াসলব্ধ নয় যে, তোমরা কেবলি মুখে আমার প্রতি ঈমান আনার কথা উচ্চারণ করবে আর অমনিই আমি তোমাদেরকে সেসব কিছুই দান করে দেবো এসবের জন্য তো পরীক্ষার শর্ত রয়েছে আমার জন্য কষ্ট বরদাশত করতে হবে বিভিন্ন ধরনের নিপীড়র-নির্যাতন সহ্য করতে হবে, বিপদ-মুসিবত ও সংকটের মুকাবিলা করতে হবে ভীতি ও আশঙ্কা দিয়ে পরীক্ষা করা হবে এবং লোভ-লালসা দিয়েও এমন প্রত্যেকটি জিনিস যা ভালোবাসো ও পছন্দ করো, আমার সন্তুষ্টির জন্য তাকে উৎসর্গ করতে হবে আর এমন প্রত্যেকটি কষ্ট যা তোমাদের অনভিপ্রেত এবং তোমরা অপছন্দ করে থাকো, আমার জন্য তা অবশ্যই বরদাশত করতে হবে তারপরেই তোমরা আমাকে মানার যে দাবি করেছিলে তার সত্য-মিথ্যা যাচাই হবে কুরআন মাজীদের এমন প্রত্যেকটি জায়গায় যেখানে বিপদ-মুসিবত ও নিগ্রহ-নিপীড়নের সর্বব্যাপী আক্রমণে মুসলমানদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের অবস্থা হয়ে গেছে সেখানেই একথা বলা হয়েছে হিজরাতের পরে মদিনায় মুসলমানদের জীবনের প্রথমাবস্থায় যখন অর্থনৈতিক সংকট, বাইরের বিপদ এবং ইহুদী ও মুনাফিকদের ভিতরের দুষ্কৃতি মু’মিনদেরকে ভীষণভাবে পেরেশান করে রেখেছিল তখন আল্লাহ বলেনঃ

﴿أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُم ۖ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللَّهِ ۗ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ﴾

তোমরা কি মনে করেছো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনো তোমরা সে অবস্থার সম্মুখীন হওনি, যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী (ঈমানদার) গণ? তারা সম্মুখীন হয়েছিল নির্মমতা ও দুঃখ-ক্লেশের এবং তাদেরকে অস্থির করে তোলা হয়েছিলএমনকি রাসূল ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? (তখনই তাদেরকে সুখবর দেয়া হয়েছিল এই মর্মে যে) জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই” (আল বাকারাহঃ ২১৪)

অনুরূপভাবে ওহোদ যুদ্ধেও পর যখন মুসলমানদের ওপর আবার বিপদ-মুসিবতের একটি দুর্যোগপূর্ণ যুগের অবতারণা হয় তখন বলা হয়ঃ

﴿أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ﴾

তোমরা কি মনে করে নিয়েছো, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি যে, তোমাদের মধ্য থেকে কে জিহাদে প্রাণ উৎসর্গকারী এবং কে সবরকারী?” (আলে ইমরানঃ ১৪২)

প্রায় একই বক্তব্য সূরা আলে ইমরানের ১৭৯, সূরা আত তাওবার ১৬ এবং সূরা মুহাম্মদের ৩১ আয়াতে বলা হয়েছে এসব বক্তব্যেও মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুসলমানদের মনে এ সত্যটি গেঁথে দিয়েছেন যে, পরীক্ষাই হচ্ছে এমন একটি মানদণ্ড যার মাধ্যমে ভেজাল ও নির্ভেজাল যাচাই করা যায় ভেজাল নিজে নিজেই আল্লাহর পথ থেকে সরে যায় এবং নির্ভেজালকে বাছাই করে নিয়ে নেয়া হয় এভাবে সে আল্লাহর এমনসব পুরস্কার লাভের যোগ্য হয়, যেগুলো কেবলমাত্র সাচ্চা ঈমানদারদের জন্য নির্ধারিত

﴿وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ﴾

অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক  

২. অর্থাৎ তোমাদের সাথে যা কিছু হচ্ছে, তা কোন নতুন ব্যাপার নয় ইতিহাসে হরহামেশা এমনটিই হয়ে এসেছে যে ব্যক্তিই ঈমানের দাবী করেছে তাকে অবশ্যই পরীক্ষার অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে দগ্ধ করা হয়েছে আর অন্যদেরকেও যখন পরীক্ষা না করে কিছু দেয়া হয়নি তখন তোমাদের এমন কি বিশেষত্ব আছে যে, কেবলমাত্র মৌখিক দাবীর ভিত্তিতেই তোমাদেরকে দেয়া হবে?

৩. মূল শব্দ হচ্ছে فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ  এর শাব্দিক অনুবাদ হবে, “আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন” একথায় কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আল্লাহ তো সত্যবাদীর সত্যবাদিতা এবং মিথ্যুকের মিথ্যাচার ভালোই জানেন, পরীক্ষা করে আবার তা জানার প্রয়োজন কেন? এর জবাব হচ্ছে, যতক্ষণ এক ব্যক্তির মধ্যে কোন জিনিসের কেবলমাত্র যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাই থাকে, কার্যত তার প্রকাশ হয় না ততক্ষণ ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দৃষ্টিতে সে কোন পুরস্কার বা শাস্তিও অধিকারী হতে পারে না যেমন এক ব্যক্তির মধ্যে আমানতদার হবার যোগ্যতা আছে এবং অন্যজনের মধ্যে যোগ্যতা আছে আত্মসাৎ করার এরা দু’জন যতক্ষণ না পরীক্ষার সম্মুখীন হয় এবং একজনের থেকে আমানতদারী এবং অন্যজনের থেকে আত্মসাতের কার্যত প্রকাশ না ঘটে ততক্ষণ নিছক নিজের অদৃশ্য জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ একজনকে আমানতদারীর পুরস্কার দিয়ে দেবেন এবং অন্যজনকে আত্মসাতের শাস্তি দিয়ে দেবেন, এটা তার ইনসাফের বিরোধী তাই মানুষের ভালো কাজ ও মন্দ কাজ করার আগে তাদের কর্মযোগ্যতা ও ভবিষ্যত কর্মনীতি সম্পর্কে আল্লাহর যে পূর্ব জ্ঞান আছে তা ইনসাফের দাবী পূরণ করার জন্য যথেষ্ঠ নয় অমুক ব্যক্তির মধ্যে চুরির প্রবণতা আছে, সে চুরি করবে অথবা করতে যাচ্ছে, এ ধরনের জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ বিচার করেন না বরং সে চুরি করেছে-এ জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি বিচার করেন এভাবে অমুক ব্যক্তি উন্নত পর্যায়ের মু’মিন ও মুজাহিদ হতে পারে অথবা হবে এ জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ তার ওপর অনুগ্রহ ও নিয়ামত বর্ষণ করেন না বরং অমুক ব্যক্তির নিজের কাজের মাধ্যমে তার সাচ্চা ঈমানদার হবার কথা প্রমাণ করে দিয়েছে এবং আল্লাহর পথে জীবন সংগ্রাম করে দেখিয়ে দিয়েছে-এরি ভিত্তিতে বর্ষণ করেন তাই আমি এ আয়াতের অনুবাদ করেছি “আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন

﴿أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ أَن يَسْبِقُونَا ۚ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ﴾

আর যারা খারাপ কাজ করছে তারা কি মনে করে বসেছে তারা আমার থেকে এগিয়ে চলে যাবে? বড়ই ভুল সিদ্ধান্ত তারা করছে  

৪. যদিও আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত সকলের উদ্দেশ্যে এখানে বলা হতে পারে তবুও বিশেষভাবে এখানে বক্তব্যেও লক্ষ হচ্ছে, কুরাইশদের সেই জালেম নেতৃবর্গ যারা ইসলামের বিরোধিতায় নেমে ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর নিগ্রহ চালাবার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ছিল,যেমন ওলীদ ইবনে মুগীরাহ, আবু জেহেল, উতবাহ, শাইবাহ, উকবাহ ইবনে আবু মুআ’ইত, হানযালা ইবনে ওয়াইল এবং আরো অনেকে এখানে পূর্বাপর বক্তব্যেও স্বতস্ফূর্ত দাবী এই যে, পরীক্ষা তথা বিপদ-মুসিবত ও জুলুম-নিপীড়নের মুকাবিলায় মুসলমানদেরকে সবর ও দৃঢ়তা অবলম্বন করার নির্দেশ দেবার পর এ সত্যপন্থীদের ওপর যারা জুলূম-নিপীড়ন চালাচ্ছিল তাদেরকে সম্বোধন করে ভীতি ও হুমকিমূলক কিছু কথাও বলা হোক

৫. এ অর্থও হতে পারে, “আমার পাকড়াও এড়িয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে পারবে” মূল শব্দ হচ্ছে يَسْبِقُونَا অর্থাৎ আমার থেকে এগিয়ে যাবে এর দু’টি অর্থ হতে পারে একটি অর্থ হচ্ছে, যা কিছু আমি করতে চাই (অর্থাৎ আমার রাসূলদের মিশনের সাফল্য) তা করতে আমার সফল না হওয়া এবং যা কিছু তারা করতে চায় (অর্থাৎ আমার রাসূলকে হেয় প্রতিপন্ন করা)তা করতে সফল হওয়া দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তাদের বাড়াবাড়ির জন্য আমি তাদেরকে পাকড়াও করতে চাই এবং তারা পালিয়ে আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়

﴿مَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللَّهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللَّهِ لَآتٍ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾

যে কেউ আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করার আশা করে (তার জানা উচিত), আল্লাহর নির্ধারিত সময় আসবেই আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন  

৬. অর্থাৎ যে ব্যক্তি পরকালীন জীবনে বিশ্বাসই করে না এবং মনে করে, কারো সামনে নিজের কাজের জবাবদিতি করতে হবে না এবং এমন কোন সময় আসবে না যখন নিজের জীবনের যাবতীয় কাজের কোন হিসেব-নিকেশ দিতে হবে, তার কথা আলাদা সে নিজের গাফলতির মধ্যে পড়ে থাকুক এবং নিশ্চিন্তে যা করতে চায় করে যাক নিজের আন্দাজ-অনুমানের বিপরীত নিজের পরিণাম সে নিজেই দেখে নেবে কিন্তু যারা আশা রাখে, এক সময় তাদেরকে তাদের মাবুদের সামনে হাজির হতে হবে এবং নিজের কর্ম অনুযায়ী পুরস্কার ও শাস্তি পেতে হবে, তাদের তো মনে করা উচিত, সে সময় অতি নিকটেই এসে গেছে এবং কাজের অবকাশ খতম হবারই পথে তাই নিজের শুভ পরিণামের জন্য তারা যা কিছু করতে চায় করে ফেলুক দীর্ঘ জীবন-কালের ভিত্তিহীন নির্ভরতার ওপর ভরসা করে নিজের সংশোধনে বিলম্ব করা উচিত নয়

৭. অর্থাৎ তাদের এ ভুল ধারণাও পোষণ করা উচিত নয় যে, এমন কোন বাদশাহর সাথে তাদের ব্যাপার জড়িত, যিনি বিভিন্ন ব্যাপারের কোন খোঁজ খবর রাখেন না যে আল্লাহর সামনে তাদের জবাবদিহি করার জন্য হাজির হতে হবে তিনি বেখবর নন বরং সবকিছু শোনেন ও জানেন তার কাছে তাদের কোন কথা গোপন নেই

﴿وَمَن جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ﴾

যে ব্যক্তিই প্রচেষ্টা-সংগ্রাম করবে সে নিজের ভালোর জন্যই করবে আল্লাহ অবশ্যই বিশ্ববাসীদের প্রতি মুখাপেক্ষিতাহীন  

৮. মুজাহাদা’ শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে, কোন বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, প্রচেষ্টা ও সাধনা করা আর যখন কোন বিশেষ বিরোধী শক্তি চিহ্নিত করা হয় না বরং সাধারণভাবে ‘মুজাহাদা’ শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন এর অর্থ হয় একটি সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব-সংঘাত মু’মিনকে এ দুনিয়ায় যে দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম করতে হয় তা হচ্ছে এ ধরনের তাকে শয়তানের সাথেও লড়াই করতে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ সৎকাজের ক্ষতির ভয় দেখায় এবং অসৎকাজের লাভ ও স্বাদ উপভোগের লোভ দেখিয়ে বেড়ায় তাকে নিজের নফসের বা কুপ্রবৃত্তির সাথেও লড়তে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ নিজের খারাপ ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার দাসে পরিণত করে রাখার জন্য জোর দিতে থাকে নিজের গৃহ থেকে নিয়ে বিশ্ব-সংসারের এমন সকল মানুষের সাথে তাকে লড়তে হয় যাদের আদর্শ, মতবাদ, মানসিক প্রবণতা, চারিত্রিক নীতি, রসম-রেওয়াজ, সাংস্কৃতিক ধারা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিধান সত্য দ্বীনের সাথে সংঘর্ষশীল তাকে এমন রাষ্ট্রের সাথেও লড়তে হয় যে আল্লাহর আনুগত্যমুক্ত থেকে নিজের ফরমান জারী করে এবং সততার পরিবর্তে অসততাকে বিকশিত করার জন্য শক্তি নিয়োগ করে এ প্রচেষ্টা-সংগ্রাম এক-দু’দিনের নয়, সারাজীবনের দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি মুহূর্তের কোন একটি ময়দানে নয় বরং জীবনের প্রত্যেকটি ময়দানের ও প্রতিটি দিকে এ সম্পর্কেই হযরত হাসান বাসরী (র) বলেনঃ

 إن الرجل ليجاهد وما ضرب يوماً من الدهر بسيف

মানুষ যুদ্ধ করে চলে, যদিও কখনো একবারও তাকে তলোয়ার চালাতে হয় না

৯. অর্থাৎ আল্লাহ এ জন্য তোমাদের কাছে এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের দাবী করছেন না যে, নিজের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার ও প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন এবং তোমাদের এ যুদ্ধ ছাড়া তার ইলাহী শাসন চলবে না, বরং এটিই তোমাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথ, তাই তিনি তোমাদের এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে লিপ্ত হবার নির্দেশ দিচ্ছেন এ পথেই তোমরা দুষ্কৃতি ও ভ্রষ্টতার ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের হয়ে সৎকর্মশীলতা ও সত্যতার পথে চলতে পারবে এ পথে অগ্রসর হয়ে তোমরা এমন শক্তির অধিকারী হতে পারো যার ফলে দুনিয়ায় তোমরা কল্যাণ ও সুকৃতির ধারক এবং পরকালে আল্লাহর জান্নাতের অধিকারী হবে এ সংগ্রাম ও যুদ্ধ চালিয়ে তোমরা আল্লাহর কোন উপকার করবে না বরং তোমরা নিজেরাই উপকৃত হবে

﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

আর যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদের দুষ্কৃতিগুলো আমি তাদের থেকে দূর করে দেবো এবং তাদেরকে তাদের সর্বোত্তম কাজগুলোর প্রতিদান দেবো১০  

১০. ঈমান অর্থ এমন সব জিনিসকে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া, যেগুলো মেনে নেবার জন্য আল্লাহ, তার রাসূল ও তার কিতাব দাওয়াত দিয়েছে আর সৎকাজ হচ্ছে, আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা মানুষের চিন্তাধারা, ধারণা-কল্পনা ও ইচ্ছার পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতাই হচ্ছে মন ও মস্তিষ্কেও সৎকাজ খারাপ কথা না বলা এবং হক-ইনসাফ ও সত্য-সততা অনুযায়ী সব কথা বলাই হচ্ছে কণ্ঠের সৎকাজ আর মানুষের সমগ্র জীবন আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীর মধ্যে এবং তার বিধানসমূহ মেনে চলে অতিবাহিত করাই হচ্ছে অঙ্গ -প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়ের সৎকাজ এ ঈমান ও সৎকাজের দু’টি ফল বর্ণনা করা হয়েছে

একঃ মানুষের দুষ্কৃতি ও পাপগুলো তার থেকে দূর করে দেয়া হবে

দুইঃ তার সর্বোত্তম কাজসমূহের সর্বোত্তম পুরস্কার তাকে দেয়া হবে

পাপ ও দুষ্কৃতির কয়েকটি অর্থ হয় একটি অর্থ হচ্ছে ঈমান আনার আগে মানুষ যতই পাপ করে থাকুক না কেন ঈমান আনার সাথে সাথেই তা সব মাফ হয়ে যাবে দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, ঈমান আনার পর মানুষ বিদ্রোহ প্রবণতা সহকারে নয় বরং মানবিক দুর্বলতা বশত যেসব ভুল-ত্রুটি করে থাকে, তার সৎকাজের প্রতি নজর রেখে সেগুলো উপেক্ষা করা হবে তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, ঈমান ও সৎকর্মশীলতার জীবন অবলম্বন করার কারণে আপনা-আপনিই মানুষের নফসের সংশোধন হয়ে যাবে এবং তার অনেকগুলো দুর্বলতা দূর হয়ে যাবে ঈমান ও সৎকাজের প্রতিদান সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছেঃ

﴿لَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

এর দু’টি অর্থ হয় একটি হচ্ছেঃ মানুষের সৎকাজগুলোর মধ্যে যেটি হবে সবচেয়ে ভালো সৎকাজ, তাকে সামনে রেখে তার জন্য প্রতিদান ও পুরস্কার নির্ধারণ করা হবে দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মানুষ তার কার্যাবলীর দৃষ্টিতে যতটা পুরস্কারের অধিকারী হবে তার চেয়ে বেশি ভালো পুরস্কার তাকে দেয়া হবে একথাটি কুরআনের অন্যান্য স্থানেও বলা হয়েছেঃ

﴿مَن جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا﴾

যে ব্যক্তি সৎকাজ নিয়ে আসবে তাকে তার থেকে দশগুণ বেশি দেয়া হবে” (আল আনআ’মঃ ১৬০)

সূরা আল কাসাসে বলা হয়েছেঃ

﴿مَن جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِّنْهَا﴾

যে ব্যক্তি সৎকাজ নিয়ে আসবে তাকে তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দেয়া হবে

সূরা আন নিসায় বলা হয়েছেঃ

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ ۖ وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا﴾

“আল্লাহ তো কণামাত্র ও জুলুম করেন না এবং সৎকাজ হলে তাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন

﴿وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا ۖ وَإِن جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۚ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾

আমি মানুষকে নিজের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি কিন্তু যদি তারা তোমার ওপর চাপ দেয় যে, তুমি এমন কোন (মা’বুদকে) আমার সাথে শরীক করো যাকে তুমি (আমার শরীক হিসেবে)জানো না, তাহলে তাদের আনুগত্য করো না১১ আমার দিকেই তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদের জানাবো তোমরা কি করছিলে১২  

১১. এ আয়াতটি সম্পর্কে মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ, আবু দাউদ ও নাসাঈর বর্ণনা হচ্ছে, এটি হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াককাস এর ব্যাপারে নাযিল হয় তার বয়স যখন আঠারো উনিশ বছর তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তার মা হামনা বিনতে সুফিয়ান (আবু সুফিয়ানের ভাইঝি) যখন জানতে পারে যে. তার ছেলে মুসলমান হয়ে গেছে তখন সে বলে, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদকে অস্বীকার করবে ততক্ষণ আমি কিছুই পানাহার করবো না এবং ছায়াতেও বসবো না মায়ের হক আদায় করা তো আল্লাহর হুকুম কাজেই তুমি আমার কথা না মানলে আল্লাহরও নাফরমানী করবে একথায় হযরত সা’দ অত্যন্ত পেরেশান হয়ে পড়েন তিনি রাসূলুল্লাহ সা. এর দরবারে হাজির হয়ে নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন এ ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয় মক্কা মুআযযামার প্রথম যুগে যেসব যুবক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন হতে পারে তারাও একই ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন তাই সূরা লুকমানেও পূর্ণ শক্তিতে এ বক্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে  (দেখুন আয়াতঃ ১৫)

আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, সৃষ্ট জীবের মধ্যে মানুষের মধ্যে মানুষের ওপর মা-বাপের হক হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কিন্তু সেই মা-বাপই যদি মানুষকে শিরক করতে বাধ্য করে তাহলে তাদের কথা মেনে নেয়া উচিত নয় কাজেই এ ক্ষেত্রে অন্য কারো কথায় মানুষের এ ধরনের শিরক করার কোন প্রশ্নই ওঠে না তারপর শব্দগুলি হচ্ছেঃ وَإِن جَاهَدَاكَ অর্থাৎ যদি তারা দু’জন তোমাকে বাধ্য করার জন্য তাদের পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে এ থেকে জানা গেল, কম পর্যায়ের চাপ প্রয়োগ বা বাপ-মায়ের মধ্য থেকে কোন একজনের চাপ প্রয়োগ আরো সহজে প্রত্যাখান করার যোগ্য এই সঙ্গে مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ  “যাকে তুমি আমার শরীক হিসেবে জানো না” বাক্যাংশটিও অনুধাবনযোগ্য এর মধ্যে তাদের কথা না মানার সপক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি প্রদান করা হয়েছে অবশ্যই এটা পিতা-মাতার অধিকার যে, ছেলেমেয়েরা তাদের সেবা করবে, তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে এবং বৈধ বিষয়ে তাদের কথা মেনে চলবে কিন্তু তাদেরকে এ অধিকার দেয়া হয়নি যে, মানুষ নিজের জ্ঞানের বিরুদ্ধে তাদের অন্ধ অনুসরণ করবে শুধমাত্র বাপ-মায়ের ধর্ম বলেই তাদের ছেলে বা মেয়ের সেই ধর্ম মেনে চলার কোন কারণ নেই সন্তান যদি এ জ্ঞান লাভ করে যে, তার বাপ-মায়ের ধর্ম ভুল ও মিথ্যা তাহলে তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে তার সঠিক ধর্ম গ্রহণ করা উচিত এবং তাদের চাপ প্রয়োগের পরও যে পথের ভ্রান্তি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে সে পথ অবলম্বন করা তার উচিত নয় বাপ-মায়ের সাথে যখন এ ধরনের ব্যবহার করতে হবে তখন দুনিয়ার প্রত্যেক ব্যক্তির সাথেও এ ব্যবহার করা উচিত যতক্ষণ না কোন ব্যক্তির সত্য পথে থাকা সম্পর্কে জানা যাবে ততক্ষণ তার অনুসরণ করা বৈধ নয়

১২. অর্থাৎ এ দুনিয়ার আত্মীয়তা এবং আত্মীয়দের অধিকার কেবলমাত্র এ দুনিয়ার সীমা-ত্রিসীমা পর্যন্তই বিস্তৃত সবশেষে পিতা-মাতা ও সন্তান সবাইকে তাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে সেখানে তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহি হবে তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বেও ভিত্তিতে যদি পিতা-মাতা সন্তানকে পথভ্রষ্ট করে থাকে তাহলে তারা পাকড়াও হবে যদি সন্তান পিতা-মাতার জন্য পথ ভ্রষ্টতা গ্রহণ করে থাকে তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে আর সন্তান যদি সঠিক পথ অবলম্বন করে থাকে এবং পিতা-মাতার বৈধ অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার ত্রুটি না করে থাকে কিন্তু পিতা-মাতা কেবলমাত্র পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী না হবার কারণে তাকে নির্যাতন করে থাকে, তাহলে তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না

﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِي الصَّالِحِينَ﴾

আর যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করে থাকবে তাদেরকে আমি নিশ্চয়ই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবো  

﴿وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ وَلَئِن جَاءَ نَصْرٌ مِّن رَّبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ ۚ أَوَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ﴾

১০ লোকদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি১৩ কিন্তু যখন সে আল্লাহর ব্যাপারে নিগৃহীত হয়েছে তখন লোকদের চাপিয়ে দেয়া পরীক্ষাকে আল্লাহর আযাবের মতো মনে করে নিয়েছে১৪ এখন যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে বিজয় ও সাহায্য এসে যায়, তাহলে এ ব্যক্তিই বলবে, “আমরা তো তোমাদের সাথে ছিলাম”১৫ বিশ্ববাসীদের মনের অবস্থা কি আল্লাহ ভালোভাবে জানেন না?  

১৩. যদিও বক্তা এক ব্যক্তিমাত্র কিন্তু সে “আমি ঈমান এনেছি” বলার পরিবর্তে বলছে, “আমরা ঈমান এনেছি” ইমাম রাযী এর মধ্যে একটি সূক্ষ্ণ অর্থেও প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তিনি বলেন, মুনাফিক সবসময় নিজেকে মু’মিনদের মধ্যে শামিল করার চেষ্টা করে থাকে এবং নিজের ঈমানের উল্লেখ এমনভাবে করে থাকে যাতে মনে হয় সেও ঠিক অন্যদের মতই মু’মিন এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন কোন কাপুরুষ যদি কোন সেনাদলের সাথে গিয়ে থাকে এবং সেনাদলের অসম সাহসী সৈনিকেরা লড়াই করে শত্রুদলকে বিতাড়িত করে দিয়ে থাকে তাহলে কাপুরুষটি নিজে কোন কাজে অংশ গ্রহণ না করে থাকলেও সে এসে লোকদেরকে বলবে, আমরা গিয়েছি, আমরা ভীষণ যুদ্ধ করেছি এবং শত্রুকে পরাস্ত করেছি অর্থাৎ সেও যেন সেই অমিত সাহসী যোদ্ধাদের সাথে মিলে যুদ্ধ করেছিল

১৪. অর্থাৎ আল্লাহর আযাবের ভয়ে যেমন কুফরী ও গোনাহ থেকে বিরত থাকা উচিত এ ব্যক্তি ঠিক তেমনি বান্দা প্রদত্ত নির্যাতন-নিগ্রহের ভয়ে ঈমান ও সৎকাজ থেকে বিরত হয়েছে ঈমান আনার পর যখন সে কাফেরদের হুমকি, মারধর ও কারানির্যাতনের সম্মুখীন হয় তখন সে মনে করে মরে যাবার পর কুফরীর অপরাধে যে জাহান্নামের আযাব ভোগ করতে হবে আল্লাহর সেই জাহান্নামের আযাব কিছুটা এ ধরনেরই হবে তাই সে সিদ্ধান্ত করে, সে আযাব তো পরে ভোগ করবো কিন্তু এখন নগদ আযাব যা পাচ্ছি তার হাত থেকে নিস্তার লাভ করার জন্য আমাকে ঈমান ত্যাগ করে কুফরীর মধ্যে চলে যাওয়া উচিত এভাবে দুনিয়ার জীবনটাতো নিশ্চিন্তে আরামের মধ্য দিয়ে কেটে যাবে

১৫. অর্থাৎ আজ সে নিজেকে বাঁচাবার জন্য কাফেরদের সাথে যোগ দিয়েছে এবং মু’মিনদের পক্ষ ত্যাগ করেছে কারণ সত্য দ্বীনের সম্প্রসারণের জন্য নিজের গায়ে আঁচড়টি লাগাতেও প্রস্তুত নয় কিন্তু যখন এ দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদেরকে আল্লাহ সাফল্য ও বিজয়-দান করবেন তখন এ ব্যক্তি বিজয়ের ফল ভাগ করে নেবার জন্য এসে যাবে এবং মুসলমানদের বলবে, আমি তো মনে প্রাণে তোমাদেরই সাথে ছিলাম, তোমাদের সাফল্যেও জন্য দোয়া করেছিলাম এবং তোমাদের প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও কুরবানীকে আমি বিরাট মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেছি

এ প্রসঙ্গে আরো এতটুকু কথা জেনে রাখতে হবে যে, অসহনীয় নিপীড়ন, ক্ষতি বা মারাত্মক ভীতিজনক অবস্থায় কোন ব্যক্তির কুফরী কথা বলে নিজেকে রক্ষা করা শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েয তবে এ জন্য শর্ত হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আন্তরিকতা সহকারে ঈমানের ওপর অবিচল থাকতে হবে কিন্তু যে আন্তরিকতা সম্পন্ন মুসলমানটি অক্ষম অবস্থায় প্রাণ বাঁচাবার জন্য কুফরীর প্রকাশ করে এবং যে সুবিধাবাদী লোকটি আদর্শ ও মতবাদ হিসেবে ইসলামকে সত্য জানে এবং সে হিসেবে তাকে মানে কিন্তু ঈমানী জীবনধারার বিপদ ও বিঘ্ন-বিপত্তি দেখে কাফেরদের সাথে হাত মিলায় তাদের দু’জনের মধ্যে ফারাকটি অনেক বড় আপাত দৃষ্টিতে তাদের দু’জনের অবস্থা পরস্পর থেকে কিছু বেশি ভিন্ন মনে হবে না কিন্তু আসলে যে জিনিসটি তাদের মধ্যে আকাশ পাতালের ব্যবধান সৃষ্টি করে সেটি হচ্ছে এই যে, বাধ্য হয়ে কুফরীর প্রকাশকারী আন্তরিকতা সম্পন্ন মুসলমানটি কেবলমাত্র আকীদার দিক দিয়ে ইসলামের ভক্ত থাকে না বরং কার্যতও তার আন্তরিক সহানুভূতি ইসলাম ও মুসলমানদের সাথেই থাকে তাদের সাফল্যে সে খুশি হয় এবং তাদের ব্যর্থতা তাকে অস্থির করে তোলে অক্ষম অবস্থায়ও সে মুসলমানদের সাহায্য করার কয়েকটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তার ওপর ইসলামের শত্রুদের বাঁধন যখনই ঢিলে হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই সে মুসলমানদের সাথে যোগ দেয়, এ সুযোগের অপেক্ষাই সে থাকে পক্ষান্তরে সুযোগ সন্ধানী লোক যখনই দেখে ইসলামের পথ কঠিন হয়ে গেছে এবং খুব ভালভাবে মাপজোক করে দেখে নেয়, ইসলামের সহযোগী হবার ক্ষতি কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করার লাভের চেয়ে বেশি তখনই সে নিছক নিরাপত্তা ও লাভের খাতিরে ইসলাম ও মুসলমানদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষে তাদের জন্য এমন কোন কাজ করতে সে পিছপা ও হয় না যা ইসলামের মারাত্মক বিরোধী এবং মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কিন্তু এই সাথে হয়তো কোন সময় ইসলামের বিজয় সাধিত হতে পারে, এ সম্ভাবনার দিক থেকেও সে একেবারে চোখ বন্ধ করে রাখে না তাই যখনই মুসলমানদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় তখনই সে তাদের আদর্শকে সত্য বলে মেনে নেবার, তাদের সামনে নিজের ঈমানের অঙ্গীকার করে এবং সত্যেও পথে ত্যাগ ও কুরবানীর জন্য তাদেরকে বাহবা দেবার ব্যাপারে একটুও কার্পণ্য করেন না এ মৌখিক স্বীকৃতিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে প্রয়োজনের সময় সে তাকে কাজে লাগাতে চায় কুরআন মাজীদে অন্য এক জায়গায় মুনাফিকদের এ বেনিয়া মানসিকতাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

﴿الَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِن كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِّنَ اللَّهِ قَالُوا أَلَمْ نَكُن مَّعَكُمْ وَإِن كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوا أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُم مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾

এরা হচ্ছে এমন সব লোক যারা তোমাদের ব্যাপারে অপেক্ষা করছে (অর্থাৎ দেখছে, অবস্থা কোনদিকে মোড় নেয়) যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের বিজয় হয়, তাহলে এসে বলবে, আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? আর যদি কাফেরদের পাল্লা ভারী থাকে, তাহলে তাদেরকে বলবে, আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলাম না এবং এরপরও তোমাদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে বাঁচাইনি?” (আন নিসাঃ ১৪১)

﴿وَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْمُنَافِقِينَ﴾

১১ আর আল্লাহ তো অবশ্যই দেখবেন কারা ঈমান এনেছে এবং কারা মুনাফিক১৬  

১৬. অর্থাৎ মু’মিনদের ঈমান ও মুনাফিকদের মুনাফিকির অবস্থা যাতে উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং যার মধ্যে যা কিছু লূকিয়ে আছে সব সামনে এসে যায় সে জন্য আল্লাহ বারবার পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন একথাটিই সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছেঃ

﴿مَّا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَىٰ مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىٰ يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ﴾

আল্লাহ মু’মিনদেরকে কখনো এমন অবস্থায় থাকতে দেবেন না, যে অবস্থায় এখন তোমরা আছো (অর্থাৎ সাচ্চা ঈমানদার ও মুনাফিক সবাই মিশ্রিত হয়ে আছো) তিনি পবিত্র লোকদেরকে অপবিত্র লোকদের থেকে সুস্পষ্ট ভাবে আলাদা করে দেবেন” (আয়াতঃ ১৭৯)

﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آمَنُوا اتَّبِعُوا سَبِيلَنَا وَلْنَحْمِلْ خَطَايَاكُمْ وَمَا هُم بِحَامِلِينَ مِنْ خَطَايَاهُم مِّن شَيْءٍ ۖ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ﴾

১২ এ কাফেররা মু’মিনদেরকে বলে, তোমরা আমাদের পথ অনুসরণ করো এবং আমরা তোমাদের গুনাহখাতাগুলো নিজেদের ওপর চাপিয়ে নেবো,১৭ অথচ তাদের গুনাহখাতার কিছুই তারা নিজের ওপর চাপিয়ে নেবে না,১৮ তারা ডাহা মিথ্যা বলছে  

১৭. তাদের এ উক্তির অর্থ ছিল, প্রথমত মৃত্যু পরবর্তী জীবন, হাশর-নশর, হিসেব ও শাস্তি-পুরস্কারের এসব কথা একদম বাজে ও উদ্ভট কিন্তু ধরে নেয়া যাক যদি পরকালের কোন জীবন এবং সেখানে জবাবদিহির কোন বিষয় থেকেই থাকে, তাহলে তার তার দায়ভার আমরা গ্রহণ করছি আল্লাহর সামনে সমস্ত শাস্তি ও পুরস্কারের বোঝা আমরা মাথা পেতে নেবো আমাদের কথায় তোমরা এ নতুন ধর্ম পরিত্যাগ করো এবং নিজেদের পিতৃ পুরুষের ধর্মের দিকে ফিরে এসো হাদীসে বিভিন্ন কুরাইশ সরদার সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রথমদিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের সাক্ষাত করে এ সরদাররা এমনি ধরনের কথা বলতো তাই হযরত উমর রা. সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন তিনি ঈমান আনেন, আবু সুফিয়ান ও হারব ইবনে উমাইয়াহ ইবনে খালফও তার সাথে সাক্ষাত করে একথাই বলেছিল

১৮. অর্থাৎ প্রথমত এটা সম্ভব নয় কোন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অন্যের দায়-দায়িত্ব নিজের ওপর নিতে পারে না এবং কারো বলার কারণে গোনাহকারী নিজের গোনাহের শাস্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না কারণ সেখানে তো প্রত্যেক তার নিজের কৃতকর্মেও জন্য দায়ী ﴿وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ﴾ (কোন বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না) কিন্তু ধরে নেয়া যাক যদি এমনটি হয়ও, তাহলে যে সময় কুফরী ও শিরকের পরিণতি একটি প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামের আকারে সামনে এসে যাবে তখন কার এত বড় বুকের পাটা হবে যে, সে দুনিয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসে বলবে, জনাব!আমার কথায় যে ব্যক্তি ঈমান ত্যাগ করে মুরতাদ হয়েছিল আপনি তাকে মাফ করে জান্নাতে পাঠিয়ে দিন এবং আমি জাহান্নামের নিজের কুফরীর সাথে সাথে তার কুফরীর শাস্তিও ভোগ করতে প্রস্তুত আছি

﴿وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالًا مَّعَ أَثْقَالِهِمْ ۖ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ﴾

১৩ হ্যাঁ নিশ্চয়ই তারা নিজেদের বোঝাও বইবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে অন্য অনেক বোঝাও১৯ আর তারা যে মিথ্যাচার চালিয়ে এসেছে কিয়ামতের দিন নিশ্চয়ই তাদেরকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে২০  

১৯. অর্থাৎ আল্লাহর সামনে যদিও তারা নিজেদের বোঝার সাথে অন্যের বোঝা বইবে না কিন্তু দ্বিগুণ বোঝা উঠানোর হাত থেকে নিষ্কৃতিও পাবে না তাদের ওপর চাপবে তাদের নিজেদের গোমরাহ হবার একটি বোঝা আর দ্বিতীয় একটি বোঝাও তাদের ওপর চাপানো হবে অন্যদের গোমরাহ করার একথাটিকে এভাবে বলা যায়, এক ব্যক্তি নিজেও চুরি করে এবং অন্য ব্যক্তিকেও তার সাথে এ কাজে অংশ নিতে বলে এখন যদি এ দ্বিতীয় ব্যক্তি তার কথায় চুরি করায় অংশ নেয়, তাহলে অন্যের কথায় অপরাধ করেছে বলে কোন আদালত তাকে ক্ষমা করে দেবে না চুরির শাস্তি অবশ্যই সে পাবে ন্যায় বিচারের কোন নীতি অনুযায়ী তাকে রেহাই দিয়ে তার পরিবর্তে এ শাস্তি সেই প্রথম চোরটি যে তাকে ধোঁকা দিয়ে চৌর্যবৃত্তিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাকে দেয়া কোনক্রমেই ঠিক হবে না কিন্তু সেই প্রথম চোরটি তার নিজের অপরাধের সাথে সাথে অন্যজনকে চোরে পরিণত করার অপরাধের শাস্তিও পাবে কুরআন মাজীদের অন্য এক জায়গায় এ নিয়মটিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

﴿لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۙ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُم بِغَيْرِ عِلْمٍ ﴾

যাতে কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের বোঝাও পুরোপুরি বহন করে এবং এমনসব লোকদের বোঝার একটি অংশও বহন করে যাদেরকে তারা জ্ঞান ছাড়াই গোমরাহ করে” (আন নাহলঃ ২৫)

আর এ নিয়মটি নবী সা. নিম্নোক্ত হাদীসটিতে বর্ণনা করেছেনঃ

مَنْ دَعَا إلى هُدًى كان لهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أجورِ مَنْ تَبِعهُ لا يَنقُصُ ذلك مِنْ أجُورِهم شيئًا، ومَنْ دَعَا إِلَى ضَلالَةٍ كان عليه مِنَ الإثمِ مثلُ آثامِ مَنْ تَبِعهُ لا يَنْقُصُ ذلك مِنْ آثامِهم شَيئًا

যে ব্যক্তি সঠিক পথের দিকে আহ্বান জানায় সে তাদের সমান প্রতিদান পাবে যারা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করে, এ জন্য তাদের প্রাপ্য কোন কমতি করা হবে না আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর দিকে আহ্বান জানায় সে তাদের সবার সমান গোনাহের ভাগী হবে যারা তার অনুসরণ করে এবং এ জন্য তাদের গোনাহের মধ্যে কোন কমতি করা হবে না” (মুসলিম)

২০. মিথ্যাচার মানে এমনসব মিথ্যা কথা যা কাফেরদের নিম্নোক্ত উক্তির মধ্যে লুকিয়ে ছিলঃ “তোমরা আমাদের অনুসরণ করো এবং তোমাদের গোনাহখাতাগুলো আমরা নিজেদের ওপর চাপিয়ে নেবো” আসলে দু’টি বানোয়াট চিন্তার ভিত্তিতে তারা একথা বলতো একটি হচ্ছে, তারা যে শিরকীয় ধর্মেও অনুসরণ করে চলছে তা সত্য এবং মুহাম্মাদ সা. এর তাওহীদি ধর্ম মিথ্যা আর দ্বিতীয় বানোয়াট চিন্তা হচ্ছে, কোন কিয়ামত টিয়ামত হবে না এবং পরকালের জীবনের এ ধ্যান্-ধারণা যার কারণে একজন মুসলমান কুফরী করতে ভয় পায়, এটা একেবারেই অর্থহীন ও ভিত্তিহীন এ বানোয়াট চিন্তা নিজেদের মনে পোষণ করার পর তারা একজন মুসলমানকে বলতো, ঠিক আছে, তোমাদের মতে কুফরী করা যদি গোনাহই হয় এবং কোন কিয়ামতও যদি অনুষ্ঠিত হবার থাকে যেখানে এ গোনাহের কারণে তোমাদের জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে, তাহলে আমরা তোমাদের এ গোনাহ নিজেদের মাথায় নিয়ে নিচ্ছি, আমাদের দায়িত্বে তোমরা মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ করে তোমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে এসো এ ব্যাপারের সাথে আরো দু’টি মিথ্যা কথাও জড়িত ছিল তার একটি হচ্ছে, যে ব্যক্তি অন্যের কথায় কোন অপরাধ করে সে নিজের অপরাধের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে এবং যার কথায় সে এ অপরাধ করে সে এর পূর্ণ দায়ভার উঠাতে পারে দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তারা যথার্থই তাদের দায়ভার মাথায় তুলে নেবে, যারা তাদের কথায় ঈমান পরিত্যাগ করে কুফরীর দিকে ফিরে গিয়েছিল কারণ, যখন কিয়ামত সত্যি সত্যি কায়েম হয়ে যাবে এবং তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে জাহান্নাম তাদের চোখের সামনে বিরাজ করবে তখন তারা কখনোই নিজেদের কুফরীর শাস্তি পাওয়ার সাথে সাথে যাদেরকে তারা দুনিয়ায় ধোঁকা দিয়ে গোমরাহ করতো তাদের গোনাহের সমস্ত বোঝাও নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিতে রাজি হবে না

﴿وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِ فَلَبِثَ فِيهِمْ أَلْفَ سَنَةٍ إِلَّا خَمْسِينَ عَامًا فَأَخَذَهُمُ الطُّوفَانُ وَهُمْ ظَالِمُونَ﴾

১৪ আমি নূহকে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই২১ এবং সে তাদের মধ্যে থাকে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর২২ শেষ পর্যন্ত তুফান তাদেরকে ঘিরে ফেলে এমন অবস্থায় যখন তারা জালেম ছিল২৩  

২১. তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন সূরা আলে ইমরানঃ ৩৩-৩৪, আন নিসাঃ ১৬৩, আল আনআ’মঃ ৮৪, আল আ’রাফঃ ৫৯-৬৪, ইউনুসঃ ৭১ ও ৭৩, হূদঃ ২৫ ও ৪৮, আল আম্বিয়াঃ ৭৬-৭৭, আল মু’মিনুনঃ ২৩ ও ৩০, আল ফুরকানঃ ৩৭, আশ শুআ’রাঃ ১০৫-১২৩ আস সফ্‌ফাতঃ ৭৫ ও ৮২, আল ক্বামারঃ ৯০, আল হাককাহঃ ১১-১২ আয়াত এবং সূরা নূহ সম্পূর্ণ

যে পটভূমিতে এখানে এ কাহিনী বর্ণনা করা হচ্ছে তা অনুধাবন করতে হলে সূরার প্রথম দিকের আয়াত গুলোর সামনে রাখতে হবে সেখানে একদিকে মু’মিনদেরকে বলা হয়েছে, তোমাদের আগে যেসব মু’মিন অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে আমি পরীক্ষার সম্মুখীন করেছি অন্যদিকে জালেম কাফেরদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা আমাকে ছাড়িয়ে চলে যাবে এবং আমার পাকড়াও থেকে বেঁচে যাবে, এ ভুল ধারণা পোষণ করো না এ দু’টি কথা উপলব্ধি করার জন্য এ ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করা হচ্ছে

২২. এর অর্থ এই নয় যে, হযরত নূহের বয়স ছিল সাড়ে নশো বছর বরং এর অর্থ হচ্ছে নবুওয়াতের দায়িত্বলাভ করার পর থেকে মহাপ্লাবন পর্যন্ত সাড়ে নশো বছর হযরত নূহ এই জালেম ও গোমরাহ জাতির সংশোধনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন এবং এ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাদের জুলুম-নির্যাতন বরদাশত করার পরও তিনি হিম্মতহারা হননি এখানে এ জিনিসটি বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য যে, মু’মিনদেরকে বলা হচ্ছে, তোমরা তো মাত্র পাঁচ বছর থেকে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করছো এবং একটি গোমরাহ জাতির হঠকারিতা বরদাশত করে চলছো কিন্তু আমার এ বান্দা যে অনবরত সাড়ে নশো বছর ধরে এসবের মোকাবিলা করেছে তার সবর ও দৃঢ়তার কথা ভেবে দেখো

হযরত নূহের বয়সের ব্যাপারে কুরআন মাজীদ ও বাইবেলের বর্ণনায় পার্থক্য রয়েছে বাইবেল বলে তার বয়স ছিল সাড়ে নশো বছর তার বয়স যখন ছশো বছর তখন প্লাবন আসে এরপর তিনি আর সাড়ে তিনশো বছর জীবিত থাকেন (আদি পুস্তকঃ ৭:৬, ৯: ২৮-২৯) কিন্তু কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তার বয়স এক হাজার বছর হওয়া উচিত কারণ সাড়ে নশো বছর তো হচ্ছে শুধুমাত্র নবুওয়াতের দায়িত্বে আসীন হবার পর থেকে নিয়ে প্লাবন শুরু হওয়া পর্যন্তকার সময়টি এ সময়-কালটি তিনি ব্যয় করেন দ্বীনের দাওয়াত দেবার ও তার প্রচারের কাজে একথা সুস্পষ্ট, জ্ঞান ও বুদ্ধিও ক্ষেত্রে তিনি পরিপক্কতা অর্জন করেছেন এমন এক বয়সেই তিনি নবুওয়াত লাভ করেন এবং প্লাবনের পরও তিনি কিছুকাল জীবিত থেকে থাকবেন এত দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় কিন্তু আল্লাহর এ বিশ্বে বিস্ময়কর ঘটনাবলীর অভাব নেই যেদিকেই তাকানো যাবে তার অসীম ক্ষমতার নিদর্শনই অস্বাভাবিক ঘটনাবলীর আকারে দৃষ্টিগোচর হবে কিছু ঘটনা ও অবস্থার প্রথমত একটি বিশেষ আকারে আত্মপ্রকাশ করে যেতে থাকাটা এমন কোন যুক্তি পেশ করে না ফলে একথা মনে করা যেতে পারে যে, অন্য কোন অস্বাভাবিক অবস্থায় ভিন্নধর্মী কোন ঘটনা আত্মপ্রকাশ করতে পারে না এ পর্যায়ের ধারণাগুলোর ভিত ধসিয়ে দেবার জন্য বিশ্ব-জাহানের বিভিন্ন স্থানে এবং সৃষ্টির প্রত্যেকটি প্রজাতির মধ্যে অস্বাভাবিক অবস্থা ও ঘটনাবলীর একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে বিশেষ করে যে ব্যক্তির মনে আল্লাহর অসীম শক্তিশালী হবার সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে সে কখনো জীবন মৃত্যুও স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষে কোন মানুষকে এক হাজার বছর বা তার চেয়ে কম-বেশি বয়স দান করা সম্ভব নয়, এ ধরনের কোন ভুল ধারণা পোষণ করতে পারে না আসলে মানুষ নিজে চাইলেও এক মুহূর্তেও জন্যও জীবিত থাকতে পারে না কিন্তু আল্লাহ চাইলে যতদিন যত বছর চান তাকে জীবিত রাখতে পারেন

২৩. অর্থাৎ তারা নিজেদের জুলুম-নিপীড়ন চালিয়ে যেতে থাকা অবস্থায় মহাপ্লাবনের গ্রাসে পরিণত হয় অন্য কথায়,যদি মহাপ্লাবন আসার আগে তারা নিজেদের জুলুম-নিপীড়ন থেকে বিরত হতো তাহলে আল্লাহ তাদের ওপর এ আযাব পাঠাতেন না

﴿فَأَنجَيْنَاهُ وَأَصْحَابَ السَّفِينَةِ وَجَعَلْنَاهَا آيَةً لِّلْعَالَمِينَ﴾

১৫ তারপর আমি নূহকে ও নৌকা আরোহীদেরকে২৪ রক্ষা করি এবং একে বিশ্ববাসীর জন্য একটি শিক্ষণীয় নিদর্শন করে রাখি২৫  

২৪. অর্থাৎ যারা হযরত নূহের আ. প্রতি ঈমান এনেছিলেন এবং যাদেরকে আল্লাহ নৌকায় আরোহণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন সূরা হূদে এর সুস্পষ্ট বর্ণনা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ

﴿حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَمْرُنَا وَفَارَ التَّنُّورُ قُلْنَا احْمِلْ فِيهَا مِن كُلٍّ زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ وَأَهْلَكَ إِلَّا مَن سَبَقَ عَلَيْهِ الْقَوْلُ وَمَنْ آمَنَ ۚ وَمَا آمَنَ مَعَهُ إِلَّا قَلِيلٌ﴾

শেষ পর্যন্ত যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং চুলা উথলে উঠলো তখন আমি বললাম, (হে নূহ) এতে উঠিয়ে নাও প্রত্যেক শ্রেণীর (প্রাণীদের) এক এক জোড়া এবং নিজের পরিবার পরিজনদেরকে তবে যাদেরকে সঙ্গে না নেবার জন্য পূর্বেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের কথা আলাদা আর তার সাথে ঈমান এনেছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন” (আয়াতঃ ৪০)

২৫. এর অর্থ এও হতে পারে যে, এ ভয়াবহ শাস্তি অথবা এ যুগান্তকারী ঘটনাটিকে পরবর্তীকালের লোকদের জন্য শিক্ষণীয় করে দেয়া হয়েছে কিন্তু এখানে এবং সূরা আল ক্বামারে একথাটি যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে একথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, নৌকাটিই ছিল শিক্ষণীয় নিদর্শন শত শত বছর ধরে সেটি পর্বত শৃঙ্গে অবস্থান করছিল এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছিয়ে যেতে থেকেছে যে, এ ভূখণ্ডে এক সময় এমন ভয়াবহ প্লাবন এসেছিল যার ফলে এ নৌকাটি পাহাড়ের মাথায় উঠে যায় সূরা আল ক্বামারে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

﴿وَحَمَلْنَاهُ عَلَىٰ ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَدُسُرٍ﴾﴿تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِّمَن كَانَ كُفِرَ﴾﴿وَلَقَد تَّرَكْنَاهَا آيَةً فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ﴾

আর নূহকে আমি আরোহণ করালাম তখতা ও পেরেকের তৈরি নৌকায় তা চলছিল আমার তত্ত্বাবধানে সেই ব্যক্তির জন্য পুরস্কার স্বরূপ যাকে অস্বীকার করা হয়েছিল আর আমি তাকে ছেড়ে দিলাম একটি নিদর্শনে পরিণত করে; কাজেই আছে কি কেউ শিক্ষা গ্রহণকারী?

সূরা আল ক্বামারের এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জারীর কাতাদার এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেনঃ সাহাবীগণের আমলে মুসলমানরা যখন আল জাযীরায় যায় তখন তারা জুদী পাহাড়ের ওপর (অন্য একটি বর্ণনা মতে বাকেরওয়া নামক জনবসতির কাছে) এ নৌকাটি দেখে বর্তমানকালে মাঝে মাঝে এ ধরনের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখা গেছে যে, নূহের নৌকা অনুসন্ধান করার জন্য অভিযাত্রী দল পাঠানো হচ্ছে এর কারণ বর্ণনা করে বলা হয়, অনেক সময় বিমান আরারাতের পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করার সময় আরোহীরা একটি পর্বতশৃঙ্গে একটি নৌকার মতো জিনিস দেখেছে (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফঃ ৪৭ এবং হূদঃ৪৬ টীকা)

﴿وَإِبْرَاهِيمَ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ ۖ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾

১৬ আর ইব্রাহীমকে পাঠাই২৬ যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলে, “আল্লাহর বন্দেগী করো এবং তাঁকে ভয় করো২৭ এটা তোমাদের জন্য ভালো যদি তোমরা জানো  

২৬. তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন, সূরা আল বাকারাহঃ ১৫, ১৬ ও ৩৫; আলে ইমরানঃ ৭; আল আনআ’মঃ ০৯; হূদঃ ৭; ইব্রাহীমঃ ৬; আল হিজরঃ ৪; মারইয়ামঃ ৩; আল আম্বিয়াঃ ৫; আশ শুআ’রাঃ ৫ আস সাফ্ফাতঃ ৩; আয যুখরুফঃ ৩; এবং আয যারিয়াতঃ ২ রুকু সমূহ

২৭. অর্থাৎ তার সাথে কাউকে শরীক এবং তার নাফরমানী করতে ভয় করো

﴿إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا ۚ إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَابْتَغُوا عِندَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ ۖ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾

১৭ তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে পূজা করছো তারাতো নিছক মূর্তি আর তোমরা একটি মিথ্যা তৈরি করছো২৮ আসলে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তোমরা পূজা করো তারা তোমাদের কোন রিযিকও দেবার ক্ষমতা রাখে না, আল্লাহর কাছে রিযিক চাও, তাঁরই বন্দেগী করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তারই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে২৯  

২৮. অর্থাৎ তোমরা এ মূর্তি তৈরি করছো না বরং মিথ্যা তৈরি করছো এ মূর্তিগুলোর অস্তিত্ব নিজেই একটি মূর্তিমান মিথ্যা তার ওপর তোমাদের এ আকীদা-বিশ্বাস যে,এরা দেব-দেবী, আল্লাহর অবতার, তাঁর সন্তান, আল্লাহর সান্নিধ্যে অবস্থানকারী ও তাঁর কাছে শাফাআ’তকারী অথবা এদের মধ্য থেকে কেউ রোগ নিরাময়কারী আবার কেউ সন্তান-দাতা এবং কেউ রিযিকদাতা-এসবই মিথ্যা কথা তোমরা নিজেদের ধারণা ও কল্পনার মাধ্যমে এসব রচনা করেছো আসল সত্য এছাড়া আর কিছূই নয় যে, এগুলো নিছক হাতে গড়া নিষ্প্রাণ মূর্তি এবং এদের কোন ক্ষমতা ও প্রভাব নেই

২৯. এ কয়েকটি বাক্যেও মধ্যে হযরত ইব্রাহীম আ. মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সমস্ত যুক্তি একত্র করেছেন কাউকে মাবুদ বা আরাধ্য করতে হলে এ জন্য যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হবেএকটি যুক্তিসঙ্গত কারণ এ হতে পারে, তার নিজের সত্তার মধ্যে মাবুদ হবার কোন অধিকার থাকে দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, সে মানুষের স্রষ্টা এবং মানুষ নিজের অস্তিত্বেও জন্য তার কাছে অনুগৃহীত তৃতীয় কারণ হতে পারে, সে মানুষের লালন-পালনের ব্যবস্থা করে তাকে রিযিক তথা জীবন ধারণের উপকরণ সরবরাহ করে চতুর্থ কারণ হতে পারে, মানুষের ভবিষ্যত তার অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল এবং মানুষ আশঙ্কা করে তার অসন্তুষ্টি অর্জন করলে তার নিজের পরিণাম অশুভ হবে হযরত ইব্রাহীম বলেন, এ চারটি কারণের কোন একটিও মূর্তি পূজার পক্ষে নয় বরং এর প্রত্যেকটিই নির্ভেজাল আল্লাহর প্রতি আনুগত্যেও দাবী কর “এ নিছক মূর্তিপূজা” বলে তিনি প্রথম কারণটিকে বিলুপ্ত করে দেন কারণ নিছক মূর্তি মাবুদ হবার ব্যক্তিগত কি অধিকার বিলুপ্ত করেন তারপর “তোমরা তাদের স্রষ্টা” একথা বলে দ্বিতীয় কারণটিকে বিলুপ্ত করেন এরপর তারা তোমাদের কোন প্রকারের কোন রিযিক দান করতে পারে না, একথা বলে তৃতীয় কারণটিকে বিলুপ্ত করেন আর সবশেষে বলেন, তোমাদের তো আল্লাহর দিকে ফিরে যেতেই হবে, এ মূর্তিগুলোর দিকে ফিরে যেতে হবে না কাজেই তোমাদের পরিণাম ও পরকালকে সমৃদ্ধ বা ধ্বংস করার ক্ষমতাও এদের নেই এ ক্ষমতা আছে একমাত্র আল্লাহর হাতে এভাবে শিরককে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে তিনি তাদের ওপর একথা সুস্পষ্ট করে দেন যে, মানুষ যে সমস্ত কারণে কাউকে মাবুদ বা আরাধ্য গণ্য করতে পারে তার কোনটাই এক ও লা-শারীক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইবাদাত করার দাবী করে না

﴿وَإِن تُكَذِّبُوا فَقَدْ كَذَّبَ أُمَمٌ مِّن قَبْلِكُمْ ۖ وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ﴾

১৮ আর যদি তোমরা মিথ্যা আরোপ করো, তাহলে পূর্বে বহু জাতি মিথ্যা আরোপ করেছে৩০ এবং রাসূলের ওপর পরিষ্কারভাবে পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্ব নেই

৩০. অর্থাৎ যদি তোমরা আমার তাওহীদের দাওয়াতকে এবং তোমাদের নিজেদের রবের দিকে ফিরে যেতে হবে এবং নিজেদের সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে-এসব কথাকে মিথ্যা বলো, তাহলে এটা কোন নতুন কথা নয় ইতিহাসে এর পূর্বেও বহু নবী (যেমন নূহ, হূদ, সালেহ আ. প্রমুখগণ) এ একই দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদের জাতিরাও তাদেরকে এমনিভাবেই মিথ্যুক বলেছে এখন তারা এ নবীদেরকে মিথ্যুক বলে তাদের কোন ক্ষতি করতে পেরেছে, না নিজেদের পরিণাম ধ্বংস করেছে, এটা তোমরা নিজেরাই দেখে নাও

﴿أَوَلَمْ يَرَوْا كَيْفَ يُبْدِئُ اللَّهُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾

১৯ এরা৩১ কি কখনো লক্ষ করেনি আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন তারপর তার পুনরাবৃত্তি করেন? নিশ্চয়ই এ (পুনরাবৃত্তি) আল্লাহর জন্য সহজতর৩২  

৩১. এখান থেকে নিয়ে   لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি) পর্যন্ত আয়াত গুলো মূল আলোচনার মাঝখানে স্বতন্ত্র প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে আনা হয়েছে হযরত ইবরাহীমের কাহিনীর ধারা বর্ণনা ছিন্ন করে আল্লাহ মক্কার কাফেরদেরকে সম্বোধন করে একথাগুলো বলেছেন এ বিষয়ের সাথে এ প্রাসঙ্গিক ভাষণের সম্পর্ক হচ্ছে এই যে, মক্কার যে কাফেরদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য এ ভাষণ দেয়া হচ্ছে তারা দু’টি মৌলিক গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল একটি ছিল শিরক ও মূর্তিপূজা এবং অন্যটি ছিল আখেরাত অস্বীকৃতি এর মধ্য থেকে প্রথম গোমরাহীকে বাতিল করা হয়েছে হযরত ইবরাহীমের ওপর উদ্ধৃত ভাষণের মাধ্যমে এখন দ্বিতীয় গোমরাহীটিকে বাতিল করার জন্য আল্লাহ তার নিজের পক্ষ থেকে এ বাক্য কয়টি বলেছেনএভাবে একই বক্তব্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে দু’টি বিষয়কেই বাতিল করার ব্যবস্থা করা হয়েছে

৩২. অর্থাৎ একদিকে অসংখ্য বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করে এবং অন্যদিকে সকল শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গেও বিলুপ্তির সাথে সাথে আবার নতুন ব্যক্তিবর্গ অস্তিত্ব লাভ করতে থাকে মুশরিকরা এসব কিছুকে আল্লাহর সৃষ্টি হবার কথা অস্বীকার করে না তেমনি তারাও একথা অস্বীকার করতো না তাই তাদের স্বীকৃত কথার ওপর এ প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে, তোমাদের দৃষ্টিতে যে আল্লাহ বস্তুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেন এবং তারপর মাত্র একবার সৃষ্টি করে শেষ করেন না বরং তোমাদের চোখের সামনে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর জায়গায় আবার একই জিনিস অনবরত সৃষ্টি করে চলেন, তার সম্পর্কে তোমরা কেমন করে একথা ভাবতে পারলে যে, তোমাদের মরে যাবার পর তিনি আর পুনর্বার তোমাদের জীবিত করে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন না (আরো বেশি ব্যাখার জন্য দেখুন সূরা আন নামলঃ৮০ টীকা)

﴿قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ۚ ثُمَّ اللَّهُ يُنشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

২০ এদেরকে বলো, পৃথিবীর বুকে চলাফেরা করো এবং দেখো তিনি কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর আল্লাহ দ্বিতীয়বারও জীবন দান করবেন অবশ্যই আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী৩৩  

৩৩. অর্থাৎ যখন আল্লাহর শিল্পকারিতার বদৌলতে প্রথমবারের সৃষ্টি তোমরা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছো তখন তোমাদের বোঝা উচিত, একই আল্লাহর শিল্পকারিতার মাধ্যমে দ্বিতীয়বার ও সৃষ্টি হবে এ ধরনের কাজ করা তার ক্ষমতার আওতা বহির্ভূত নয় এবং আওতা বহির্ভূত হতেও পারে না

﴿يُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ وَيَرْحَمُ مَن يَشَاءُ ۖ وَإِلَيْهِ تُقْلَبُونَ﴾

২১ যাকে চান শাস্তি দেন এবং যার প্রতি চান করুণা বর্ষণ করেন, তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে  

﴿وَمَا أَنتُم بِمُعْجِزِينَ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ ۖ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ مِن وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ﴾

২২ তোমরা না পৃথিবীতে অক্ষমকারী, না আকাশে৩৪ এবং আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করার মতো কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী তোমাদের নেই৩৫  

৩৪. অর্থাৎ তোমরা পালিয়ে এমন কোন জায়গায় চলে যেতে পারো না যেখানে গিয়ে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারো তোমরা ভূগর্ভের তলদেশে কোথাও নেমে যাও অথবা আকাশের কোন উচ্চ মার্গে পৌঁছে যাও না কেন সব জায়গা থেকেই তোমাদেরকে ধরে আনা হবে এবং নিজেদের রবের সামনে হাজির করা হবে সূরা আর রাহমানের এ কথাটিই জ্বিন ও মানুষকে সম্বোধন করে চ্যালেঞ্জের সুরে এভাবে বলা হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর সার্বভৌম কতৃত্ব ও শাসন থেকে বের হয়ে যেতে পার তাহলে একটু বের হয়ে দেখিয়ে দাও তা থেকে বের হবার জন্য শক্তির প্রয়োজন এবং সে শক্তি তোমাদের নেই কাজেই তোমরা কোনক্রমেই বের হতে পারো না  (আর রাহমানঃ ৩৩)

﴿يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَن تَنفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانفُذُوا ۚ لَا تَنفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ﴾

৩৫. অর্থাৎ আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেদের শক্তির জোরে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা তোমাদের নেই এবং তোমাদের এমন কোন অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক বা সাহায্যকারীও নেই যে আল্লাহর মোকাবিলায় তোমাদের আশ্রয় দিতে পারে এবং তার কাছে জবাবদিহি থেকে তোমাদের বাঁচাতে পারে যারা শিরক ও কুফরী করেছে, আল্লাহর বিধানের সামনে মাথা নত হতে অস্বীকার করেছে এবং বুক ফুলিয়ে আল্লাহর নাফরমানী করেছে এবং তার যমীনে ব্যাপকভাবে জুলুম ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানে তাদের সাহায্য ও সহায়তা দানকারী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবার এবং আল্লাহর আযাবের ফায়সালাকে তাদের ওপর কার্যকর হওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা কারো নেই অথবা সমগ্র বিশ্ব-জগতে এমন একজনও নেই যে আল্লাহর আদালতে দাঁড়িয়ে একথা বলার সাহস রাখে যে, এরা আমার লোক কাজেই এরা যা কিছু করেছে তা মাফ করে দেয়া হোক

﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ وَلِقَائِهِ أُولَٰئِكَ يَئِسُوا مِن رَّحْمَتِي وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

২৩ যারা আল্লাহর আয়াত এবং তার সাথে সাক্ষাত অস্বীকার করে, তারা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে গেছে৩৬ এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি  

৩৬. অর্থাৎ আমার রহমতে তাদের কোন অংশ নেই আমার অনুগ্রহের অংশ লাভের আশা করার কোন অবকাশ তাদের জন্য নেই একথা সুস্পষ্ট যখন তারা আল্লাহর আয়াত মেনে নিতে অস্বীকার করলো তখন আল্লাহ ঈমানদারদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা থেকে স্বতষ্ফুর্তভাবে তাদের লাভবান হবার অধিকার প্রত্যাহার করে নিলেন তারপর যখন তারা আখেরাত অস্বীকার করলো এবং কখনো তাদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে একথা স্বীকারই করলো না তখন এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তারা আল্লাহর দান ও মাগফিরাতের সাথে কোন প্রকার আশার সম্পর্ক রাখেনি এরপর যখন নিজেদের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে তারা আখেরাতের জগতে চোখ খুলবে এবং আল্লাহর যেসব আয়াতকে তারা মিথ্যা বলেছিল সেগুলোকে ও সত্য হিসেবে স্বচক্ষে দেখে নেবে তখন সেখানে আল্লাহর রহমতের অংশ লাভের প্রার্থী হবার কোন কারণ তাদের থাকতে পারে না

﴿فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَن قَالُوا اقْتُلُوهُ أَوْ حَرِّقُوهُ فَأَنجَاهُ اللَّهُ مِنَ النَّارِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾

২৪ তারপর৩৭ সেই জাতির জবাব এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, তারা বললো, “একে হত্যা করো অথবা পুড়িয়ে ফেলো৩৮ শেষ পর্য্‌ন্ত আল্লাহ তাকে আগুন থেকে রক্ষা করেন৩৯ অবশ্যই এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে এমন লোকদের জন্য যারা ঈমান আনে৪০  

৩৭. এখান থেকে বর্ণনা আবার ইবরাহীমের কাহিনীর দিকে মোড় নিচ্ছে

৩৮. অর্থাৎ হযরত ইবরাহীমের ন্যায়সঙ্গত যুক্তির কোন জবাব তাদের কাছে ছিল না তাদের যদি কোন জবাব থেকে থাকে তাহলে তা এই ছিল যে, হক কথা বলছে যে কণ্ঠটি সেটি স্তব্ধ করে দাও এবং যে ব্যক্তি আমাদের ভুল আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরছে এবং তা থেকে আমাদের বিরত থাকতে বলছে তাকে জীবন্ত রেখো না “হত্যা করো ও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারো” শব্দাবলী থেকে একথা প্রকাশিত হচ্ছে যে, সমগ্র জনতা হযরত ইব্রাহীমকে মেরে ফেলার ব্যাপারে একমত ছিল তবে মেরে ফেলার পদ্ধতির ব্যাপারে ছিল বিভিন্ন মত কিছু লোকের মত ছিল, তাকে হত্যা করা হোক আবার কিছু লোকের মত ছিল, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হোক, এর ফলে ভবিষ্যতে যারা এ ভূখণ্ডে হক কথা বলার পাগলামী করতে চাইবে এটা তাদের জন্য একটা শিক্ষা হয়ে থাকবে

৩৯. এ থেকে স্বতষ্ফুর্তভাবে একথা প্রকাশ হয় যে, তারা শেষ পর্যন্ত হযরত ইব্রাহীমকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত করেছিল তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল এখানে শুধুমাত্র এতটুকু কথা বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ তাকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করেন কিন্তু সূরা আল আম্বিয়ায় পরিষ্কার করে বলা হয়েছেঃ আল্লাহর নির্দেশে আগুন হযরত ইবরাহীমের জন্য ঠাণ্ডা ও নিরাপদ বস্তু হয়ে যায়,  قُلْنَا يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَআমি বললাম, হে আগুন!ঠাণ্ডা হয়ে যাও এবং শান্তি ও নিরাপত্তা হয়ে যাও ইবরাহীমের প্রতি” (আয়াতঃ ৬৯)একথা বলা নিষ্প্রয়োজন, তাকে যদি আগুনের মধ্যে নিক্ষেপই না করা হয়ে থাকতো তাহলে আগুনকে ঠাণ্ডা হয়ে যাও এবং তার প্রতি শান্তি ও নিরাপত্তা হয়ে যাও এ হুকুম দেবার কোন অর্থই হয় না এ থেকে এ কথা পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত বস্তুও ধর্ম বা প্রকৃতি মহান আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি যখনই চান যে কোন বস্তুও ধর্ম ও বিশেষত্ব পরিবর্তন করতে পারেন সাধারণভাবে আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো এবং দগ্ধীভূত হবার মতো প্রত্যেকটি জিনিসকে পুড়িয়ে ফেলা কিন্তু আগুনের এ ধর্ম তার নিজের প্রতিষ্ঠিত নয় বরং আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত তার এ ধর্ম আল্লাহকে এমনভাবে বেঁধে ফেলেনি যে, তিনি এর বিরুদ্ধে কোন হুকুম দিতে পারেন না তিনি নিজের আগুনের মালিক যে কোন সময় তিনি তাকে জ্বালাবার কাজ পরিত্যাগ করার হুকুম দিতে পারেন কোন সময় নিজের এক ইঙ্গিতে তিনি অগ্নিকুণ্ডকে ফুল বাগানে পরিণত করতে পারেন এ অস্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় তার রাজ্যে প্রতিদিন হয় না কোন বড় রকমের তাৎপর্যবহ শিক্ষা ও প্রয়োজনের খাতিরেই হয়ে থাকে কিন্তু নিয়মমাফিক যেসব জিনিস প্রতিদিন দেখতে আমরা অভ্যস্ত সেগুলোকে কোনক্রমেই এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করা যেতে পারে না যে, সেগুলোর মধ্যে তার শক্তি আবদ্ধ হয়ে গেছে এবং নিয়ম বিরোধী কোন ঘটনা আল্লাহর হুকুমেও সংঘটিত হতে পারে না

৪০. এর মধ্যে ঈমানদারদের জন্য এ মর্মে নিদর্শন রয়েছে যে, হযরত ইব্রাহীম আ. পরিবার, বংশ, জাতি ও দেশের ধর্ম পরিত্যাগ করে যে সত্য জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি শিরকের অসারতা ও তাওহীদের সত্যতা জানতে পেরেছিলেন তারই অনুসরণ করেন আবার এ মর্মেও নিদর্শন রয়েছে যে, তিনি নিজ জাতির হঠকারিতা ও কঠোর জাতীয় স্বার্থ প্রীতি ও বিদ্বেষ অগ্রাহ্য করে তাকে মিথ্যার পথ থেকে সরিয়ে আনার ও সত্য গ্রহণ করার জন্য অনবরত প্রচার কার্য চালিয়ে যেতে থাকেন তাছাড়া এ ব্যাপারেও নিদর্শন রয়েছে যে, তিনি আগুনের ভয়াবহ শাস্তি মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যান এবং সত্য ও ন্যায়ের পথ পরিহার করতে প্রস্তুত হননি নিদর্শন এ ব্যাপারেও রয়েছে যে, মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহীম আ.কেও পরীক্ষার পুলসেরাত পার না করিয়ে ছাড়েননি আবার এ ব্যাপারেও যে, হযরত ইব্রাহীমকে আল্লাহ যে পরীক্ষার সম্মুখীন করেন তাতে তিনি সাফল্যেও সাথে উত্তীর্ণ হন, তবেই আল্লাহর সাহায্য তার জন্য আসে এবং এমন অলৌকিক পদ্ধতিতে আসে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড তার জন্য ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়

﴿وَقَالَ إِنَّمَا اتَّخَذْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا مَّوَدَّةَ بَيْنِكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ ثُمَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُ بَعْضُكُم بِبَعْضٍ وَيَلْعَنُ بَعْضُكُم بَعْضًا وَمَأْوَاكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّن نَّاصِرِينَ﴾

২৫ আর সে বললো,৪১ তোমরা দুনিয়ার জীবনের তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিগুলোকে নিজেদের মধ্যে প্রীতি-ভালোবাসার মাধ্যমে পরিণত করে নিয়েছো৪২ কিন্তু কিয়ামতের দিন তোমরা পরস্পরকে অস্বীকার এবং পরস্পরের প্রতি অভিসম্পাত করবে৪৩ আর আগুন তোমাদের আবাস হবে এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী হবে না

৪১. বক্তব্যের ধারাবাহিকতা থেকে বুঝা যায়, আগুনের মধ্য থেকে নিরাপদ বের হয়ে আসার পর হযরত ইব্রাহীম আ. লোকদেরকে একথা বলেন

৪২. অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে মূর্তিপূজার ভিত্তিতে নিজেদের সামাজিক জীবন গড়ে তুলেছো এ ব্যবস্থা দুনিয়ার জীবনের সীমানা পর্যন্ত তোমাদের জাতীয় সত্ত্বাকে একত্র করে রাখতে পারে কারণ এখানে সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে যে কোন আকীদার ভিত্তিতে লোকেরা একত্র হতে পারে আর যত বড় মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর আকীদার ভিত্তিতেই যে কোন ঐক্য ও সমাজ গড়ে উঠুক না কেন তা পারস্পরিক বন্ধত্ব, আত্মীয়তা, ভ্রাতৃত্ব ও অন্যান্য সকল ধর্মীয়, সামাজিক, তামাদ্দুনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হতে পারে

৪৩. অর্থাৎ মিথ্যা আকীদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তোমাদের এ সামাজিক কাঠামোর আখেরাতে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না সেখানে পারস্পরিক প্রীতি-ভালোবাসা, সহযোগিতা, আত্মীয়তা এবং আকীদা-বিশ্বাস ও কামনা-বাসনার কেবলমাত্র এমন ধরনের সম্পর্ক বজায় থাকতে পারে যা দুনিয়ায় এক আল্লাহর বন্দেগী এবং সৎকর্মশীলতা ও আল্লাহভীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় কুফরী ও শিরক এবং ভুল পথ ও কুপথের সাথে জড়িত যাবতীয় সম্পর্ক সেখানে ছিন্ন হয়ে যাবে সকল ভালোবাসা শত্রুতায় পরিণত হবে সমস্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি ঘৃণায় রুপান্তরিত হবে পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, পীর-মুরীদ পর্যন্ত একে অন্যেও ওপর লানত বর্ষণ করবে এবং প্রত্যেকে নিজের গোমরাহীর দায়-দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বলবে, এই জালেম আমাকে ধ্বংস করেছে, কাজেই একে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হোক একথা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যেমন সূরা আয যুখরুফে বলা হয়েছেঃ

﴿الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ﴾

বন্ধুরা সেদিন পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে, মুত্তাকীরা ছাড়া

সূরা আল আ’রাফে বলা হয়েছেঃ

﴿كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَّعَنَتْ أُخْتَهَا ۖ حَتَّىٰ إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَٰؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِّنَ النَّارِ﴾

প্রত্যেকটি দল যখন জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন তার কাছের দলের প্রতি লানত বর্ষণ করতে করতে প্রবেশ করবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত যখন সবাই সেখানে একত্র হয়ে যাবে তখন প্রত্যেক পরবর্তী দল পূর্ববর্তী দলের পক্ষে বলবেঃ হে আমাদের রব! এ লোকেরাই আমাদের পথভ্রষ্ট করে, কাজেই এদেরকে দ্বিগুণ আগুনের শাস্তি দিন” (আয়াতঃ ৩৮)

সূরা আল আহযাবে বলা হয়েছেঃ

﴿وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا﴾ ﴿رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا﴾

আর তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের সরদারদেরও বড়দের আনুগত্য করেছি এবং তারা আমাদের বিপথগামী করেছে হে আমাদের রব! তুমি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদের ওপর বড় রকমের লানত বর্ষণ করো

﴿فَآمَنَ لَهُ لُوطٌ ۘ وَقَالَ إِنِّي مُهَاجِرٌ إِلَىٰ رَبِّي ۖ إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾

২৬ সে সময় লূত তাকে মেনে নেয়৪৪ এবং ইব্রাহীমকে বলে, আমি আমার রবের দিকে হিজরাত করছি,৪৫ তিনি পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী৪৬  

৪৪. বক্তব্যের বিন্যাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যখন হযরত ইব্রাহীম আ. আগুন থেকে বের হয়ে আসেন এবং তিনি ওপরে উল্লেখিত কথাগুলো বলেন, তখন সমগ্র সমবেত জনতার মধ্য থেকে একমাত্র হযরত লূত আ. তার আনুগত্য গ্রহণ করার ঘোষণা করেন হতে পারে সে সময় আরো বহুলোক মনে মনে হযরত ইবরাহীমের সত্যতা স্বীকার করে থাকবে কিন্তু সমগ্র জাতি ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইবরাহীমের দ্বীনের বিরুদ্ধে যে ক্রোধ ও আক্রোশ প্রবণতার প্রকাশ সে সময় সবার চোখের সামনে হয়েছিল তা প্রত্যক্ষ করে কোন ব্যক্তি এ ধরনের ভয়ঙ্কর সত্য মেনে নেবার এবং তার সাথে সহযোগিতা করার সাহস করতে পারেনি এ সৌভাগ্য মাত্র এক ব্যক্তিরই হয়েছিল এবং তিনি হচ্ছেন হযরত ইবরাহীমেরই ভাতিজা হযরত লূত আ. শেষে তিনি হিজরাতকালেও নিজের চাচা ও চাচীর (হযরত সারাহ) সহযোগী হয়েছিলেন

এখানে একটি সন্দেহ দেখা দেয় এবং এ সন্দেহটি নিরসন করার প্রয়োজন রয়েছে অর্থাৎ এক ব্যক্তি প্রশ্ন করতে পারে যে, তাহলে এ ঘটনার পূর্বে কি হযরত লূত আ. কাফের ও মুশরিক ছিলেন এবং আগুন থেকে হযরত ইবরাহীমের নিরাপদে রেব হয়ে আসার অলৌকিক কাণ্ড দেখার পর তিনি ঈমানের নিয়ামত লাভ করেন? যদি একথা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে নবুওয়াতের আসনে কি এমন কোন ব্যক্তি সমাসীন হতে পারেন যিনি পূর্বে মুশরিক ছিলেন?এর জবাব হচ্ছে, কুরআন এখানে فَآمَنَ لَهُ لُوطٌ এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছে এ থেকে অনিবার্য হয়ে উঠে না যে, ইতিপূর্বে হযরত লুত বিশ্ব-জাহানের প্রভু আল্লাহকে না মেনে থাকবেন বা তার সাথে অন্য মাবুদদেরকেও শরীক করে থাকবেন বরং এ থেকে কেবলমাত্র এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, এ ঘটনার পর তিনি হযরত ইবরাহীমের রিসালাতের সত্যতা স্বীকার করেন এবং তার আনুগত্য গ্রহণ করেন ঈমানের সাথে لام শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন এর অর্থ হয় কোন ব্যক্তির কথা মেনে নেয়া এবং তার আনুগত্য করা হতে পারে হযরত লূত আ. তখন ছিলেন একজন উঠতি বয়সের তরুণ এবং সচেতনভাবে নিজের চাচার শিক্ষার সাথে তিনি এ প্রথমবার পরিচিত হবার এবং তার রিসালাত সম্পর্কে জানার সুযোগ লাভ করে থাকবেন

৪৫. অর্থাৎ তিনি আমার রবের জন্য হিজরত করছি এখন আমার রব আমাকে যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানে যাব

৪৬. অর্থাৎ তিনি আমাকে সহায়তা দান ও হেফাজত করার ক্ষমতা রাখেন এবং আমার পক্ষে তিনি যে ফায়সালা করবেন তা বিজ্ঞজনোচিত হবে

﴿وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ وَآتَيْنَاهُ أَجْرَهُ فِي الدُّنْيَا ۖ وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ﴾

২৭ আর আমি তাকে ইসহাক ও ইয়া’কুব (এর মতো সন্তান) দান করি৪৭ এবং তার বংশধরদের মধ্যে রেখে দিই নবুওয়াত ও কিতাব৪৮ এবং তাকে দুনিয়ায় এর প্রতিদান দিই আর আখেরাতে সে নিশ্চিতভাবেই সৎকর্মশালীদের অন্তর্ভুক্ত হবে৪৯  

৪৭. হযরত ইসহাক আ. ছিলেন তার পুত্র এবং হযরত ইয়া’কুব ছিলেন পৌত্র এখানে হযরত ইবরাহীমের আ. অন্যান্য পুত্রদের উল্লেখ না করার কারণ হচ্ছে এই যে, ইব্রাহীম সন্তানদের মাদয়ানী শাখায় কেবলমাত্র হযরত শোআ’ইব আ.ই নবুওয়াত লাভ করেন এবং ইসমাঈলী শাখায় মুহাম্মাদ সা. এর নবুওয়াত লাভ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরে আর কোন নবী আসেননি পক্ষান্তরে হযরত ইসহাক আ. থেকে যে শাখাটি চলে তার মধ্যে একের পর এক হযরত ঈসা আ. পর্যন্ত নবুওয়াত ও কিতাবের নিয়ামত প্রদত্ত হতে থাকে

৪৮. হযরত ইবরাহীমের আ. পরে যেসব নবীর আবির্ভাব হয় সবাই এর মধ্যে এসে গেছেন

৪৯. এখানে একথা বলাই উদ্দেশ্য যে, ব্যবিলনেরর যেসব শাসক, পণ্ডিত ও পুরোহিত হযরত ইব্রাহীম আ. এর দাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল এবং সেখানকার যেসকল মুশরিক অধিবাসী চোখ বন্ধ করে ঐ জালেমদের আনুগত্য করেছিল তারা সবাই দুনিয়ার বুক থেকে বিলূপ্ত হয়ে গেছে এবং এমনভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে, আজ দুনিয়ার কোথাও তাদের কোন নাম নিশানাও নেইকিন্তু যে ব্যক্তিকে আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার অপরাধে তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত যাকে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় স্বদেশভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে আল্লাহ এমন সফলতা দান করেন যে, চার হাজার বছর থেকে দুনিয়ার বুকে তার নাম সমুজ্জ্বল রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে দুনিয়ার সকল মুসলমান, খৃষ্টান ও ইহুদী রাব্বুল আলামীনের সেই খলিল তথা বন্ধুকে একযোগে নিজেদের নেতা বলে স্বীকার করে এ চল্লিশ শ’ বছরে দুনিয়া একমাত্র সেই পাক-পবিত্র ব্যক্তি এবং তার সন্তানদের থেকেই যা কিছু হিদায়াতের আলোক বর্তিকা লাভ করতে পেরেছে আখেরাতে তিনি যে মহাপুরস্কার লাভ করবেন তাতো তার জন্য নির্ধারিত হয়েই আছে কিন্তুএ দুনিয়ায়ও তিনি যে মর্যাদা লাভ করেছেন তা দুনিয়ার বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধার প্রচেষ্টায় জীবনপাতকারীদের একজনও লাভ করতে পারেনি

﴿وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُم بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ الْعَالَمِينَ﴾

২৮ আর আমি লূত কে পাঠাই৫০ যখন সে তার সম্প্রদায়কে বললো, “তোমরা তো এমন অশ্লীল কাজ করছো যা তোমাদের পূর্বে বিশ্ববাসীদের মধ্যে কেউ করেনি  

৫০. তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন সূরা আল আরাফ ১০; হূদঃ ৭; আল হিজরঃ ৪-৫; আল আম্বিয়াঃ ৫; আশ শুআ’রাঃ ৯; আন নামলঃ৪; আস সাফ্ফাতঃ ৪ ও আল ক্বামারঃ ২ রুকু

﴿أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ وَتَقْطَعُونَ السَّبِيلَ وَتَأْتُونَ فِي نَادِيكُمُ الْمُنكَرَ ۖ فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَن قَالُوا ائْتِنَا بِعَذَابِ اللَّهِ إِن كُنتَ مِنَ الصَّادِقِينَ﴾

২৯ তোমাদের অবস্থা কি এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তোমরা পুরুষদের কাছে যাচ্ছো,৫১ রাহাজানি করছো এবং নিজেদের মজলিসে খারাপ কাজ করছো?৫২ তারপর তার সম্প্রদায়ের কাছে এ ছাড়া আর কোন জবাব ছিল না যে, তারা বললো, “নিয়ে এসো আল্লাহর আযাব যদি তুমি সত্যবাদী হও”  

৫১. অর্থাৎ তাদের সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হচ্ছো, যেমন সূরা আল আ’রাফে বলা হয়েছেঃ

﴿إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِّن دُونِ النِّسَاءِ﴾

তোমরা যৌন কামনা পূর্ণ করার জন্য মহিলাদেরকে বাদ দিয়ে পুরুষদের কাছে গিয়ে থাকো

৫২. অর্থাৎ এ অশ্লীল কাজটি লুকিয়ে চাপিয়েও করো না বরং প্রকাশ্যে নিজেদের মজলিসে পরস্পরের সামনে বসে করে থাকো একথাটিই সূরা আন নামলে এভাবে বলা হয়েছেঃ

﴿أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ وَأَنتُمْ تُبْصِرُونَ﴾

তোমরা কি এমনই বিগড়ে গিয়েছো যে, প্রকাশ্যে দর্শকমণ্ডলীর সমক্ষেই অশ্লীল কাজ করে থাকো?”

﴿قَالَ رَبِّ انصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِينَ﴾

৩০ লূত বললো, “হে আমার রব! এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী লোকদের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করো

﴿وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا إِبْرَاهِيمَ بِالْبُشْرَىٰ قَالُوا إِنَّا مُهْلِكُو أَهْلِ هَٰذِهِ الْقَرْيَةِ ۖ إِنَّ أَهْلَهَا كَانُوا ظَالِمِينَ﴾

৩১ আর যখন আমার প্রেরিতগণ ইবরাহীমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে পৌঁছলো,৫৩ তারা তাকে বললো, “আমরা এ জনপদের লোকদেরকে ধ্বংস করে দেবো,৫৪ এর অধিবাসীরা বড়ই জালেম হয়ে গেছে

৫৩. সূরা হূদ ও সূরা আল হিজরে এর যে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে তা হচ্ছে এই যে, লূতের জাতির ওপর আযাব নাযিল করার জন্য যেসব ফেরেশতাকে পাঠানো হয়েছিল তারা প্রথমে হযরত ইবরাহীমের কাছে হাজির হন এবং তাকে হযরত ইসহাকের এবং তার পর হযরত ইয়াকূবের জন্মেও সুসংবাদ দেন তারপর বলেন, লূতের জাতিকে ধ্বংস করার জন্য আমাদের পাঠানো হয়েছে

৫৪. “এ জনপদ” বলে লূত জাতির সমগ্র এলাকাকে বুঝানো হয়েছে হযরত ইব্রাহীম আ. এ সময় ফিলিস্তিনের জাবরুন (বর্তমান আল খলীল) শহরে থাকতেন এ শহরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কয়েক মাইল দূরে মরুসাগরে (Dead Sea) অংশ রয়েছে সেখানে পূর্বে বাস করতো লূত জাতির লোকেরা এবং বর্তমানে এ সমগ্র এলাকা রয়েছে সাগরের পানির তলায় এ এলাকাটি নিম্নভূমির দিকে অবস্থিত এবং জাবরুনের উঁচু উঁচু পর্বতগুলো থেকে পরিষ্কার দেখা যায় তাই ফেরেশতারা সেদিকে ইঙ্গিত করে হযরত ইব্রাহীমকে বলেন, “আমরা এ জনপদটি ধ্বংস করে দেবো” (দেখুন সূরা আশ শুআ’রাঃ ১১৪ টীকা)

﴿قَالَ إِنَّ فِيهَا لُوطًا ۚ قَالُوا نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَن فِيهَا ۖ لَنُنَجِّيَنَّهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ﴾

৩২ ইব্রাহীম বললো, “সেখানে তো লূত আছে৫৫ তারা বললো, “আমরা ভালোভাবেই জানি সেখানে কে কে আছে, আমরা তাকে ও তার পরিবারবর্গকে রক্ষা করবো তার স্ত্রীকে ছাড়া;” সে ছিল পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত৫৬  

৫৫. সূরা হূদে এ কাহিনীর প্রারম্ভিক অংশ এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, প্রথমে হযরত ইব্রাহীম আ. ফেরেশতাদেরকে মানুষের আকৃতিতে দেখে ভয় পেয়ে যান কারণ এ আকৃতিতে ফেরেশতাদের আগমন কোন ভয়াবহ অভিযানের পূর্বাভাস দেয় তারপর যখন তারা তাকে সুসংবাদ দান করেন এবং তার ভীতি দূর হয়ে যায় তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, লূতের জাতি হচ্ছে এ অভিযানের লক্ষ তাই সে জাতির জন্য তিনি করুণার আবেদন জানাতে থাকেনঃ

فَلَمَّا ذَهَبَ عَنْ إِبْرَاهِيمَ الرَّوْعُ وَجَاءَتْهُ الْبُشْرَىٰ يُجَادِلُنَا فِي قَوْمِ لُوطٍ﴾﴿إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُّنِيبٌ

কিন্তু তার এ আবেদন গৃহীত হয়নি এবং বলা হয় এ ব্যাপারে এখন আর কিছু বলো না তোমার রবের ফায়সালা হয়ে গেছে এ আযাবকে এখন আর ফেরানো যাবে না

يَا إِبْرَاهِيمُ أَعْرِضْ عَنْ هَٰذَا ۖ إِنَّهُ قَدْ جَاءَ أَمْرُ رَبِّكَ ۖ وَإِنَّهُمْ آتِيهِمْ عَذَابٌ غَيْرُ مَرْدُودٍ

এ জবাবের মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম আ. যখন বুঝতে পারেন লূত জাতির জন্য আর কোন অবকাশের আশা নেই তখনই তার মনে জাগে হযরত লূতের চিন্তা তিনি যা বলেন তা এখানে উদ্ধৃত হয়েছে তিনি বলেন “সেখানে তো লূত রয়েছে” অর্থাৎ এ আযাব যদি লূতের উপস্থিতিতে নাযিল হয় তাহলে তিনি ও তার পরিবারবর্গ তা থেকে কেমন করে নিরাপদ থাকবেন

৫৬. এ মহিলা সম্পর্কে সূরা আত তাহরীমের ১০ আয়াতে বলা হয়েছেঃ হযরত লূতের এই স্ত্রী তার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল না এ জন্য তার ব্যাপারে এ ফায়সালা করা হয় যে, একজন নবীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাকে আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে

সম্ভবত হিজরাত করার পর হযরত লূত জর্দান এলাকায় বসতি স্থাপন করে থাকবেন এবং তখনই তিনি এ জাতির মধ্যে বিয়ে করে থাকবেন কিন্তু তার সাহচর্যে জীবনের একটি বিরাট অংশ পার করে দেবার পরও এ মহিলা ঈমান আনেনি এবং তার সকল সহানুভূতি ও আকর্ষণ নিজের জাতির ওপরই কেন্দ্রীভূত থাকে যেহেতু আল্লাহর কাছে আত্মীয়তা ও রক্ত সম্পর্কেও কোন গুরুত্ব নেই, প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যাপারে ফায়সালা হয় তার ঈমান ও চরিত্রের ভিত্তিতে, তাই নবীর স্ত্রী হওয়ায় তার কোন লাভ হয়নি তার পরিণাম তার স্বামীর অনুরূপ হয়নি বরং যে জাতির ধর্ম ও চরিত্র সে গ্রহণ করে রেখেছিল তার অনুরূপ হয়

﴿وَلَمَّا أَن جَاءَتْ رُسُلُنَا لُوطًا سِيءَ بِهِمْ وَضَاقَ بِهِمْ ذَرْعًا وَقَالُوا لَا تَخَفْ وَلَا تَحْزَنْ ۖ إِنَّا مُنَجُّوكَ وَأَهْلَكَ إِلَّا امْرَأَتَكَ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ﴾

৩৩ তারপর যখন আমার প্রেরিতগণ লূতের কাছে পৌঁছলো তাদের আগমনে সে অত্যন্ত বিব্রত ও সংকুচিত হৃদয় হয়ে পড়লো৫৭ তারা বললো, “ভয় করো না এবং দুঃখও করো না৫৮ আমরা তোমাকে ও তোমার পরিবারবর্গকে রক্ষা করবো, তোমার স্ত্রীকে ছাড়া, সে পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত  

৫৭. এ বিব্রতবোধ ও সংকুচিত হৃদয় হবার কারণ এই ছিল যে, ফেরেশতারা উঠতি বয়সের সুন্দর ও সুঠাম দেহের অধিকারী রূপ ধরে এসেছিলেন হযরত লূত নিজের জাতির চারিত্রিক ও নৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তাই তাদের আসা মাত্রই পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন এ জন্য যে, তিনি যদি এ মেহমানদেরকে অবস্থান করতে দেন তাহলে ঐ ব্যভিচারী জাতির হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে আর যদি অবস্থান করতে না দেন তাহলে সেটা হবে বড়ই অভদ্র আচরণ তাছাড়া এ আশংকাও আছে,তিনি যদি এ মুসাফিরদেরকে আশ্রয় না দেন তাহলে অন্য কোথাও তাদের রাত কাটাতে হবে এবং এর অর্থ হবে যেন তিনি নিজেই তাদেরকে নেকড়ের মুখে ঠেলে দিলেন এর পরের ঘটনা আর এখানে বর্ণনা করা হয়নি সূরা হূদ ও কামারে এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে সেখানে বলা হয়েছে, এ কিশোরদের আগমন সংবাদ শুনে শহরের বহু লোক হযরত লূতের গৃহে এসে ভীড় জমালো তারা ব্যভিচার কর্মে লিপ্ত হবার উদ্দেশ্যে মেহমানদেরকে তাদের হাতে সোপর্দ করার জন্য চাপ দিতে লাগলো

৫৮. অর্থাৎ আমাদের ব্যাপারে এরা আমাদের কোন ক্ষতি করবে এ ভয়ও করো না এবং এদের হাত থেকে কিভাবে আমাদের বাঁচাবে সে চিন্তাও করো না এ সময়ই ফেরেশতারা হযরত লূতের কাছে এ রহস্য ফাঁস করেন যে, তারা মানুষ নন বরং ফেরেশতা এবং এ জাতির ওপর আযাব নাযিল করার জন্য তাদেরকে পাঠানো হয়েছে সূরা হূদে এর বিস্তারিত বিবরণ এভাবে দেয়া হয়েছে, লোকেরা যখন একনাগাড়ে লূতের গৃহে প্রবেশ করে চলছিল এবং তিনি অনুভব করছিলেন এখন আর কোন ক্রমেই নিজের মেহমানদেরকে তাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন না তখন তিনি পেরেশান হয়ে চিৎকার করে বলেনঃ

﴿لَوْ أَنَّ لِي بِكُمْ قُوَّةً أَوْ آوِي إِلَىٰ رُكْنٍ شَدِيدٍ﴾

হায়! আমার যদি শক্তি থাকতো তোমাদের সোজা করে দেবার অথবা কোন শক্তিশালী সহায়তা আমি লাভ করতে পারতাম

এ সময় ফেরেশতারা বলেনঃ

﴿يَا لُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَن يَصِلُوا إِلَيْكَ﴾

হে লূত! আমরা তোমার রবের প্রেরিত ফেরেশতা এরা কখ্‌খনো তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না

﴿إِنَّا مُنزِلُونَ عَلَىٰ أَهْلِ هَٰذِهِ الْقَرْيَةِ رِجْزًا مِّنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ﴾

৩৪ আমরা এ জনপদের লোকদের ওপর আকাশ থেকে আযাব নাযিল করতে যাচ্ছি তারা যে পাপাচার করে আসছে তার কারণে

﴿وَلَقَد تَّرَكْنَا مِنْهَا آيَةً بَيِّنَةً لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ﴾

৩৫ আর আমি সে জনপদের একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন রেখে দিয়েছি৫৯ তাদের জন্য যারা বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে৬০  

৫৯. এই সুস্পষ্ট নিদর্শনটি হচ্ছে মরুসাগর একে লূত সাগরও বলা হয় কুরআন মাজীদেও বিভিন্ন স্থানে মক্কার কাফেরদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, এই জালেম জাতিটির ওপর তার কৃতকর্মের বদৌলতে যে আযাব নাযিল হয়েছিল তার একটি চিহ্ন আজো প্রকাশ্য রাজপথে বর্তমান রয়েছে তোমরা সিরিয়ার দিকে নিজেদের বাণিজ্য সফরে যাবার সময় দিনরাত এ চিহ্নটি দেখে থাকো

﴿وَإِنَّهَا لَبِسَبِيلٍ مُّقِيمٍ﴾ সেই এলাকাটি (যেখানে এটা ঘটেছিল) লোক চলাচলের পথের পাশে অবস্থিত। (আল হিজরঃ ৭৬)

﴿وَإِنَّكُمْ لَتَمُرُّونَ عَلَيْهِم مُّصْبِحِينَ﴾ এখন তোমরা দিনরাত তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা  (আস সাফফাতঃ ১৩৭)

বর্তমান যুগে একথাটি প্রায় নিশ্চয়তা সহকারেই স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে যে, মরুসাগরের দক্ষিণ অংশটি একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পনজনিত ভূমিধ্বংসের মাধ্যমে অস্তিত্বলাভ করেছে এবং এ ধ্বংস যাওয়া অংশেই অবস্থিত ছিল লূত জাতির কেন্দ্রীয় নগরী সাদোম (sodom) এ অংশে পানির মধ্যে কিছু ডুবন্ত জনপদের ধ্বংসাবশেষও দেখা যায় সাম্প্রতিককালে অত্যাধুনিক ডুবুরী সরঞ্জামের সহায়তায় কিছু লোকের নীচে নেমে ঐসব ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে কিন্তুএখনো এ প্রচেষ্টাগুলোর ফলাফল জানা যায়নি (আরো বেশি জানার জন্য দেখুন, সূরা আস শুআ’রাঃ ১১৪ টীক)

৬০. লূতের জাতির কর্মেও শরীয়াতবিহিত শাস্তিও জন্য দেখুন, সূরা আল আ’রাফঃ ৬৮ টীকা

﴿وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَارْجُوا الْيَوْمَ الْآخِرَ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ﴾

৩৬ আর মাদইয়ানের দিকে আমি পাঠালাম তাদের ভাই শুআ’ইবকে৬১ সে বললো, “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আল্লাহর বন্দেগী করো, শেষ দিনের প্রত্যাশী হও৬২ এবং যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে বাড়াবাড়ি করে বেড়িও না

৬১. তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন সূরা আল আ’রাফঃ ১১; হূদঃ ৮; এবং আশ শুআ’রাঃ ১০ রুকু

৬২. এর দু’টো অর্থ হতে পারে একটি হচ্ছে আখেরাতের আগমন কামনা করো একথা মনে করো না, যা কিছু আছে ব্যস এ দুনিয়ার জীবন পর্যন্তই এবং এরপর আর এমন কোন জীবন নেই যেখানে তোমাদের নিজেদের যাবতীয় কাজ-কর্মেও হিসেব দিতে হবে এবং তার পুরস্কার ও শাস্তি লাভ করতে হবে দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, এমন কাজ করো যার ফলে তোমরা আখেরাতে ভালো পরিণতি লাভের আশা করতে পারো

﴿فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ﴾

৩৭ কিন্তু তারা তার প্রতি মিথ্যা আরোপ করলো৬৩ শেষে একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করলো এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্যে৬৪ মরে পড়ে থাকলো  

৬৩. অর্থাৎ একথা স্বীকার করলো না যে, আল্লাহর রাসূল হযরত শুআ’ইব আ., যে শিক্ষা তিনি দিচ্ছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এবং একে না মানলে তাদেরকে আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হতে হবে

৬৪. ঘর বলতে এখানে এই জাতি যে এলাকায় বসবাস করতো সেই সমগ্র এলাকাকে বুঝানো হয়েছে একথা সুস্পষ্ট, যখন পুরোপুরি একটি জাতির কথা আলোচনা করা হচ্ছে তখন তার দেশই তার ঘর হতে পারে

﴿وَعَادًا وَثَمُودَ وَقَد تَّبَيَّنَ لَكُم مِّن مَّسَاكِنِهِمْ ۖ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَكَانُوا مُسْتَبْصِرِينَ﴾

৩৮ আর আদ ও সামূদ কে আমি ধ্বংস করেছি তারা যেখানে থাকতো সেসব জায়গা তোমরা দেখেছো৬৫ তাদের কার্যাবলীকে শয়তান তাদের জন্য সুদৃশ্য বানিয়ে দিল এবং তাদেরকে সোজা পথ থেকে বিচ্যুত করলো অথচ তারা ছিল বুদ্ধি সচেতন৬৬  

৬৫. আরবের যেসব এলাকায় এ দুটি জাতির বসতি ছিল আরবের প্রতিটি শিশুও তা জানতো দক্ষিণ আরবের যেসব এলাকা বর্তমানে আহকাফ, ইয়ামান ও হাদরা মাউত নামে পরিচিত প্রাচীনকালে সে এলাকাগুলোতে ছিল আদ জাতির বসবাস আরবের লোকেরা একথা জানতো হিজাযের দক্ষিণ অংশে রাবেগ থেকে আকাবাহ পর্যন্ত এবং মদিনা ও খাইবার থেকে তাইমা ও তাবুক পর্যন্ত সমগ্র এলাকা সামুদ জাতির ধ্বংসাবশেষে পরিপূর্ণ দেখা যায় কুরআন নাযিল হবার যুগে এ ধ্বংসাবশেষগুলোর অবস্থা বর্তমানের তুলনায় আরো বেশি সু্‌স্পষ্ট থেকে থাকবে

৬৬. অর্থাৎ অজ্ঞ ও মূর্খ ছিল না তারা ছিল তদানীন্তন যুগের শ্রেষ্ঠ সুসভ্য ও প্রগতিশীল লোক নিজেদের দুনিয়ার কার্যাবলী সম্পাদন করার ব্যাপারে তারা পূর্ণ জ্ঞান বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতোতাই একথা বলা যাবে না যে, শয়তান তাদের চোখের ঠুলি বেঁধে দিয়ে বুদ্ধি বিনষ্ট করে দিয়ে নিজের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বরঞ্চ তারা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে ও খোলা চোখে শয়তান যে পথে পাড়ি জমিয়েছিল এবং এমন পথ পরিহার করেছিল যা তাদের কাছে নীরস, বিস্বাদ এবং নৈতিক বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ হবার কারণে কষ্টকর মনে হচ্ছিল

﴿وَقَارُونَ وَفِرْعَوْنَ وَهَامَانَ ۖ وَلَقَدْ جَاءَهُم مُّوسَىٰ بِالْبَيِّنَاتِ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ وَمَا كَانُوا سَابِقِينَ﴾

৩৯ আর কারূন, ফেরাঊন ও হামানকে আমি ধ্বংস করি মূসা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে আসে কিন্তু তারা পৃথিবীতে অহংকার করে অথচ তারা অগ্রগমনকারী ছিল না৬৭  

৬৭. অর্থাৎ পালিয়ে আল্লাহর পাকড়াও থেকে আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা ছিল না আল্লাহর কৌশল ব্যর্থ করে দেবার ক্ষমতা তাদের ছিল না

﴿فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنبِهِ ۖ فَمِنْهُم مَّنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُم مَّنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُم مَّنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُم مَّنْ أَغْرَقْنَا ۚ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ﴾

৪০ শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককে আমি তার গুনাহের জন্য পাকড়াও করি তারপর তাদের মধ্যে থেকে কারোর ওপর আমি পাথর বর্ষণকারী বাতাস প্রবাহিত করি৬৮ এবং কাউকে একটি প্রচণ্ড বিষ্ফোরণ আঘাত হানে৬৯ আবার কাউকে আমি ভূগর্ভে প্রোথিত করি৭০ এবং কাউকে ডুবিয়ে দিই৭১ আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারী ছিলেন না কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করছিল৭২  

৬৮. অর্থাৎ আদ জাতি তাদের ওপর অবিরাম সাত রাত ও আটদিন পর্যন্ত ভয়াবহ তুফান চলতে থাকে(আল হাককাহঃ ৭)

৬৯. অর্থাৎ সামুদ

৭০. অর্থাৎ কারূন

৭১. ফেরাউন ও হামান

৭২. এ পর্যন্ত যেসব বক্তব্য শুনানো হলো সেগুলোর বক্তব্যের লক্ষ ছিল দুটি একদিকে এগুলো মু’মিনদেরকে শোনানো হয়েছে, যাতে তারা হিম্মতহারা, ভগ্ন হৃদয় ও হতাশ না হয়ে পড়ে এবং বিপদ ও সংকটের কঠিন আবর্তেও ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তা সহকারে সত্য ন্যায়ের ঝাণ্ডা উঁচু করে রাখে যে, শেষ পর্যন্ত তার সাহায্য অবশ্যই এসে যাবে, তিনি জালেমদেরকে লাঞ্চিত করবেন এবংসত্যেও ঝাণ্ডা উঁচু করে দেবেন অন্যদিকে এগুলো এমন জালেমদেরকে শুনানো হয়েছে যারা তাদের ধারণামতে ইসলামী আন্দোলকে সমূলে উচ্ছেদ করে দেবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিল তাদেরকে সতর্ক দেয়া হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর সংযম ও সহিষ্ণুতার ভুল অর্থ গ্রহণ করছো তোমরা আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব কে একটি অরাজক রাজত্ব মনে করছো তোমাদের যদি এখন পর্যন্ত বিদ্রোহ, সীমালংঘন, জুলুম, নিপীড়ন ও অসৎকাজের জন্য পাকড়াও না করা হয়ে থাকে এবং সংশোধিত হবার জন্য অনুগ্রহ করে দীর্ঘ অবকাশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তোমরা নিজে নিজেই একথা মনে করে বসো না যে, এখানে আদতে কোন ইনসাফকারী শক্তিই নেই এবং এ ভূখণ্ডে তোমাদেরকে এমন পরিণতির সম্মুখীন করবেই ইতিপূর্বে নূহের জাতি, লূতের জাতি ও শুআ’ইবের জাতি যার সম্মুখীন হয়েছিল, আদ ও সামুদ জাতিকে যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং কারুন ও ফেরাউন যে পরিণতির স্বচক্ষে দেখে নিয়েছিল

﴿مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا ۖ وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنكَبُوتِ ۖ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ﴾

৪১যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে নিয়েছে তাদের দৃষ্টান্ত হলো মাকড়সা সে নিজের একটি ঘর তৈরি করে এবং সব ঘরের চেয়ে বেশি দুর্বল হয় মাকড়সার ঘর হায় যদি এরা জানতো!৭৩  

৭৩. ওপরে যতগুলো জাতির কথা বলা হয়েছে তারা সবাই শিরকে লিপ্ত ছিল নিজেদের উপাস্যেও ব্যাপারে তাদের আকীদা ছিলঃ এরা আমাদের সহায়ক সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক এরা আমাদের ভাগ্য ভাঙ্গা গড়ার ক্ষমতা রাখে এদের পূজা করে এবং এদেরকে মানত ও নজরানা পেশ করে যখন আমরা এদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবো তখন এরা আমাদের কাজ করে দেবে এবং সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে আমাদের বাঁচাবে কিন্তু যেমন ওপরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে দেখানো হয়েছে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন তাদের ধ্বংসের ফায়সালা করা হয় তখন তাদের উপরোল্লিখিত সমস্ত আকীদা-বিশ্বাস ও ধারণা-কল্পনা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় সে সময় তারা যেসব দেব-দেবী, অবতার,অলী, আত্মা, জ্বিন বা ফেরেশতাদের পূজা করতো তাদের একজনও তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি এবং নিজেদের মিথ্যা আশার ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে তারা মাটির সাথে মিশে গেছে এসব ঘটনা বর্ণনা করার পর এখন মহান আল্লাহ মুশরিকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, বিশ্ব-জাহানের প্রকৃত মালিক ও শাসনকর্তাকে বাদ দিয়ে একেবারে অক্ষম বান্দা ও সম্পূর্ণ কাল্পনিক উপাস্যদের ওপর নির্ভর করে যে আশার আকাশ কুসুম তোমরা রচনা করেছো তার প্রকৃত অবস্থা মাকড়শার জালের চাইতে বেশি কিছু নয় মাকড়শার জাল যেমন আঙ্গুলের সামান্য একটি টোকাও বরদাশত করতে পারে না তেমনি তোমাদের আশার অট্টালিকাও আল্লাহর ব্যবস্থার সাথে প্রথম সংঘাতেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে তোমরা যে কল্পনা বিলাসের এমন এক চক্করের মধ্যে পড়ে আছো, এটা নিছক তোমাদের মূর্খতার কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়সত্যের যদি সামান্যতম জ্ঞানও তোমাদের থাকতো, তাহলে তোমরা এসব ভিত্তিহীন সহায় ও নির্ভরের ওপর কখনো জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না সত্য কেবলমাত্র এতটুকুই, এ বিশ্ব-জাহানে ক্ষমতার মালিক একমাত্র রাব্বুল আলামীন ছাড়া আর কেউ নেই এবং একমাত্র তারই ওপর নির্ভর করা যেতে পারে

﴿لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾

যে ব্যক্তি তাগুতকে (আল্লাহ বিরোধী শক্তিকে) অস্বীকার ও প্রত্যাখান করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে সে মজবুত নির্ভরকে আঁকড়ে ধরেছে যা কখনো ছিন্ন হবার নয় বস্তুত আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও জানেন” (আল বাকারাহঃ ২৫৬ আয়াত)

﴿إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ مِن شَيْءٍ ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾

৪২ এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে জিনিসকেই ডাকে আল্লাহ তাকে খুব ভালোভাবেই জানেন এবং তিনিই পরাক্রান্ত ও জ্ঞানী৭৪  

৭৪. অর্থাৎ যেসব জিনিসকে এরা মাবুদে পরিণত করেছে এবং যাদেরকে সাহায্যেও জন্য আহ্বান করে তাদের প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ ভালোভাবেই জানেন তাদের কোন ক্ষমতাই নেই একমাত্র আল্লাহই ক্ষমতার মালিক এবং তারই বিচক্ষণ কর্মকুশতলতা ও জ্ঞান এ বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থা পরিচালনা করছে

এ আয়াতের আর একটি অনুবাদ এও হতে পারে,আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন, তাকে বাদ দিয়ে এরা যাদেরকে ডাকে তারা কিছুই নয় (অর্থাৎ ভিত্তিহীন ও ক্ষমতাহীন)এবং একমাত্র তিনিই পরাক্রম ও জ্ঞানের অধিকারী।”

﴿وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ ۖ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ﴾

৪৩ মানুষকে উপদেশ দেবার জন্য আমি এ দৃষ্টান্তগুলো দিয়েছি কিন্তু এগুলো একমাত্র তারাই বুঝে যারা জ্ঞান সম্পন্ন  

﴿خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّلْمُؤْمِنِينَ﴾

৪৪ আল্লাহ আসমান ও যমীনকে সত্য-ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন,৭৫ প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে একটি নিদর্শন রয়েছে মু’মিনদের জন্য৭৬  

৭৫. অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, মিথ্যার ওপর নয় পরিষ্কার মন-মানসিকতা নিয়ে যে ব্যক্তিই এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে তার কাছে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ পৃথিবী ও আকাশ ধারণা কল্পনার ওপর নয় বরং প্রকৃত সত্য ও বাস্তব ঘটনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেক ব্যক্তি যা কিছু বুঝবে ও উপলব্ধি করবে এবং নিজের ধারণা ও কল্পনার ভিত্তিতে যে দর্শনই তৈরি করবে তা যে এখানে যথাযথভাবে খাপ খেয়ে যাবে, তার কোন সম্ভাবনা নেই এখানে তো একমাত্র এমন জিনিসই সফলকাম হতে এবং স্থিরতা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে, যা হয় প্রকৃত সত্য ও বাস্তব ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যশীল বাস্তব ঘটনা বিরোধী ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থা পরিষ্কার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এক আল্লাহ হচ্ছেন এর স্রষ্টা, এক আল্লাহই এর মালিক ও পরিচালক এ বাস্তব বিষয়টির বিরুদ্ধে যদি কোন ব্যক্তি এ ধারণা নিয়ে কাজ করতে থাকে যে, এ দুনিয়ার কোন আল্লাহ নেই অথবা এ ধারণা করে চলতে থাকে যে, এর বহু খোদা আছে, যারা মানত ও নজরানার জিনিস খেয়ে নিজেদের ভক্ত-অনুরক্তদের এখানে সবকিছু করার স্বাধীনতা এবং নিশ্চিন্তে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা দিয়ে দেয়, তাহলে তার এ ধারণার কারণে প্রকৃত সত্যের মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তন ঘটবে না বরং সে নিজেই যে কোন সময় একটি বিরাট আঘাতের সম্মুখীন হবে

৭৬. পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টির মধ্যে তাওহীদের সত্যতা এবং শিরক ও নাস্তিক্যবাদের মিথ্যা হবার ওপর একটি পরিষ্কার সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে কিন্তু এ সাক্ষ্য প্রমাণের সন্ধান একমাত্র তারাই পায় যারা নবীগণের শিক্ষা মেনে নেয় নবীগণের শিক্ষা অস্বীকারকারীরা সবকিছু দেখার পরও কিছুই দেখে না

﴿اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ ۖ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ ۗ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ﴾

৪৫ (হে নবী!) তোমার প্রতি অহির মাধ্যমে যে কিতাব পাঠানো হয়েছে তা তেলাওয়াত করো এবং নামায কায়েম করো,৭৭ নিশ্চিতভাবেই নামায অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে৭৮ আর আল্লাহর স্মরণ এর চাইতেও বড় জিনিস৭৯ আল্লাহ জানেন তোমরা যা কিছু করো  

৭৭. আপাত দৃষ্টিতে নবী সা. কে সম্বোধন করা হয়েছে কিন্তু আসলে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে উদ্দেশ্যে করেই বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তাদের ওপর সে সময় যেসব জুলুম-নিপীড়ন চালানো হচ্ছিল এবং ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য তাদের যেসব কঠিন সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল সে সবের মোকাবিলা করার জন্য পিছনের চার রুকুতে অনবরত সবর, দৃঢ়তা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার উপদেশ দেবার পর এখন তাদেরকে বাস্তব ব্যবস্থা হিসেবে কুরআন তেলাওয়াত ও নামায কায়েম করার কথা বলা হচ্ছে কারণ এ দুটি জিনিসই মু’মিনকে এমন সুগঠিত চরিত্র ও উন্নতর যোগ্যতার অধিকারী করে যার সাহায্যে সে বাতিলের প্রবল বন্যা এবং দুষ্কৃতির ভয়াবহ ঝনঝার মোকাবিলায় শুধু মাত্র টিকে থাকতে নয় বরং তার গতি ফিরিয়ে দিতে পারে কিন্তু কুরআন তেলাওয়াত ও নামাযের মাধ্যমে এ শক্তি মানুষ তখনই অর্জন করতে পারে যখন সে কুরআনের তেলাওয়াত শুধুমাত্র শব্দগুলো পাঠ করেই ক্ষান্ত হয় না বরং তার শিক্ষাগুলোও সঠিকভাবে অনুধাবন করে হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে সেগুলোকে সঞ্চারিত করে যেতে থাকে এবং তার নামায কেবলমাত্র শারীরিক কসরতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার অন্তরের প্রতিধ্বনি এবং চরিত্র ও কর্মেও সক্রিয় শক্তিতে পরিণত হয় সামনের দিকের বক্তব্যে কুরআন মাজীদ নিজেই নামাযের কাঙ্ক্ষিত গুণ বর্ণনা করছে আর কুরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে এতটুকু জানা দরকার যে, মানুষের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে তার হৃদয়তন্ত্রীতে যে তেলাওয়াত আঘাত হানতে পারে না তা তাকে কুফরীর বন্যা প্রবাহের মোকাবেলায় শক্তি তো দূরের কথা ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার শক্তিও দান করতে পারে না যেমন হাদীসে একটি দল সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

يقرأونَ القرآنَ لا يُجاوزُ جَنَاجِرَهُمْ، يمرقونَ من الدِّينِ مروقُ السهمُ من الرَّمِيَّةِ

তারা কুরআন পড়বে কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালীল নীচে নামনে না তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন শর ধনুক থেকে বের হয়ে যায়” (বুখারী, মুসলিম, মুয়াত্তা)

আসলে যে তেলাওয়াতের পরে মানুষের মন-মানস, চিন্তা-চেতনা ও চরিত্র কর্মনীতিতেও কোন পরিবর্তন আসে না বরং কুরআন পড়ার পরও কুরআন যা নিষেধ করে মানুষ তা সব করে যেতে থাকে তা একজন মু’মিনের কুরআন তেলাওয়াত হতেই পারে না এ সম্পর্কে তো নবী সা. পরিষ্কার বলেনঃ مَا آمَنَ بِالْقُرْآنِ مَنِ اسْتَحَلَّ مَحَارِمَهُ  “কুরআনের হারামকৃত জিনিসকে যে হালাল করে নিয়েছে সে কুরআনের প্রতি ঈমান আনেনি” (তিরমিযী) এ ধরনের তেলাওয়াত মানুষের আত্মিক সংশোধন এবং তার আত্মায় শক্তি সঞ্চার করার পরিবর্তে তাকে আল্লাহর মোকাবিলায় আরো বেশি বিদ্রোহী এবং নিজের বিবেকের মোকাবেলায় আরো বেশি নির্লজ্জ করে তোলে এ অবস্থায় তার মধ্যে চরিত্র বলে কোন জিনিসেরই আর অস্তিত্ব থাকে নাকারণ যে ব্যক্তি কুরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে মেনে নেয়, তা পাঠ করে তার মধ্যে আল্লাহ তাকে কি নির্দেশ দিয়েছেন তা জানতেও থাকে এবং তারপর তার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে যেতে থাকে, তার ব্যাপারটা তো দাঁড়ায় এমন একজন অপরাধীর মতো যে আইন না জানার কারণে নয় বরং আইন সম্পর্কে ভালোভাবে জানার পর অপরাধমূলক কাজ করে এ অবস্থাটিকে মহানবী সা. একটি ছোট্ট বাক্যেও মধ্য দিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সুস্পষ্ট করে তোলে ধরেছেনঃ  القرآنُ حُجَّةٌ لك أو عليك    “কুরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ” (মুসলিম) অর্থাৎ যদি কুরআনকে যথাযথভাবে অনুসরণ করে চলা হয় তাহলে তা তোমার জন্য সাক্ষ্য ও প্রমাণ হবে দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত যেখানেই তোমাকে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে সেখানেই তুমি নিজের সাফাই হিসেবে কুরআনকে পেশ করতে পারবে অর্থাৎ তুমি বলতে পারবে, আমি যা কিছু করেছি এ কিতাব অনুযায়ী করেছি যদি তোমার কাজ যথার্থই কুরআন অনুযায়ী হয়ে থাকে তাহলে দুনিয়ায় ইসলামের কোন বিচারক তোমাকে শাস্তি দিতে পারবেন না এবং আখেরাতে হাশরের ময়দানেও তোমাকে পাকড়াও করা হবে না কিন্তু যদি এ কিতাব তোমার কাছে পৌঁছে গিয়ে থাকে এবং তা পড়ে তুমি জেনে নিয়ে থাকো তোমার রব তোমাকে কি বলতে চান, তোমাকে কোন কাজের হুকুম দেন, কোন কাজ করতে নিষেধ করেন এবং আবার তুমি তার বিরোধী কর্মনীতি অবলম্বন করো, তাহলে এ কিতাব তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে আল্লাহর আদালতে এ কিতাব তোমার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলাকে আরো বেশি জোরদার করে দেবে এরপর না জানার ওজর পেশ করে শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া অথবা হালকা শাস্তি লাভ করা তোমার জন্য সম্ভব হবে না

৭৮. নামাযের বহু গুণের মধ্যে এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গুণ পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এটিকে সুস্পষ্ট করে এখানে পেশ করা হয়েছে মক্কার বিরুদ্ধ পরিবেশে মুসলমানরা যে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তার মোকাবিলা করার জন্য তাদের বস্তুগত শক্তির চাইতে বেশি প্রয়োজন ছিল নৈতিক শক্তির এ নৈতিক শক্তির উদ্ভব ও তার বিকাশ সাধনের জন্য প্রথমে দুটি ব্যবস্থা অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে একটি হচ্ছে কুরআন তেলাওয়াত করা এবং দ্বিতীয় নামায কায়েম করা এরপর এখানে বলা হচ্ছে, নামায কায়েম করা হচ্ছে এমন পদ্ধতি যার মাধ্যমে তোমরা এমনসব দুষ্কৃতি থেকে মুক্ত হতে পারো ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে যেগুলোতে তোমরা নিজেরাই লিপ্ত ছিলে এবং যেগুলোতে বর্তমানের লিপ্ত আছে তোমাদের চারপাশের আরবীয় ও অনারবীয় জাহেলী সমাজ

এ পর্যায়ে নামাযের এই বিশেষ উপকারিতার কথা বলা হয়েছে কেন, একটু চিন্তা করলে একথা অতি সহজে অনুধাবন করা যেতে পারে একথা সুস্পষ্ট যে, নৈতিক দুষ্কৃতিমুক্ত চরিত্রের অধিকারী লোকেরা এর মাধ্যমে কেবলমাত্র দুনিয়ায় ও আখেরাতেই লাভবান হয় না বরং এর ফলে তারা অনিবার্যভাবে এমন সব লোকদের ওপর ব্যাপক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে যারা নানান নৈতিক দুষ্কৃতির শিকার হয়ে গেছে এবং এসব দুষ‌কৃতির লালনকারী জাহেলিয়াতের পুতিগন্ধময় অপবিত্র ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে অশ্লীল ও অসৎকাজ বলতে যেসব দুষ্কৃতি বুঝায় মানুষের প্রকৃতি সেগুলোকে খারাপ বলে জানে এবং সবসময় সকল জাতি ও সকল সমাজের লোকেরা, কার্যত তারা যতই বিপথগামী হোক না কেন, নীতিগত ভাবে সেগুলোকে খারাপই মনে করে এসেছে কুরআন নাযিল হওয়ার সময় আরবের সমাজ মানসও এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না সে সমাজের লোকেরাও নৈতিকতার পরিচিত দোষ-গুণ সম্পর্কে সচেতন ছিল তারা অসৎকাজের মোকাবিলায় সৎকাজের মূল্য জানতো কদাচিত হয়তো এমন কোন লোকও তাদের মধ্যে থেকে থাকবে যে অসৎকাজকে ভালো মনে করে থাকবে এবং ভালো কাজকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে থাকবে এ অবস্থায় এ বিকৃত সমাজের মধ্যে যদি এমন কোন আন্দোলন সৃষ্টি হয় যার সাথে জড়িত হওয়ার সাথে সাথেই সংশ্লিষ্ট সমাজের ব্যক্তিবর্গ নিজেরাই নৈতিক দিক দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং নিজেদের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে নিজেদের সমকালীন লোকদের থেকে সুস্পষ্ট উন্নতি লাভ করে, তাহলে অবশ্যই সে তার প্রভাব বিস্তার না করে থাকতে পারে না এটা কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না যে, আরবের সাধারণ লোকেরা অসৎকাজ নির্মূলকারী এবং সৎ ও পবিত্র-পরিচ্ছন্ন মানুষ গঠনকারী এ আন্দোলনের নৈতিক প্রভাব মোটেই অনুভব করবে না এবং এর মোকাবিলায় নিছক জাহেলিয়াত প্রীতির অন্তসারশূন্য শ্লোগানের ভিত্তিতে এমনসব লোকদের সাথে সহযোগিতা করে যেতে থাকবে যারা নিজেরাই নৈতিক দুষ্কৃতিতে লিপ্ত ছিল এবং জাহেলিয়াতের যে ব্যবস্থা শত শত বছর থেকে সে দুষ্কৃতিগুলো লালন করে চলছিল তাকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল এ কারণেই কুরআন এ অবস্থায় মুসলমানদের বস্তুগত উপকরণাদি ও শক্তিমত্তা সংগ্রহ করার পরামর্শ দেবার পরিবর্তে নামায কায়েম করার নির্দেশ দিচ্ছে এর ফলে মুষ্টিমেয় মানুষের এ দলটি এমন চারিত্রিক শক্তির অধিকারী হবে যার ফলে তারা মানুষের মন জয় করে ফেলবে এবং তীর ও তরবারির সাহায্য ছাড়াই শত্রুকে পরাজিত করবে

এ আয়াতে নামাযের যে গুণ বর্ণনা করা হয়েছে তার দুটি দিক রয়েছে একটি তার অনিবার্য গুণ অর্থাৎ সে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে আর দ্বিতীয় তার কাঙ্ক্ষিত গুণ অর্থাৎ নামায আদায়কারী কার্যক্ষেত্রে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখুক বিরত রাখার ব্যাপারে বলা যায়, নামায অবশ্যই এ কাজ করে যে ব্যক্তিই নামাযের ধরনের ব্যাপারে সামান্য চিন্তা করবে সে-ই স্বীকার করবে, মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য যত ধরনের ব্রেক লাগানো সম্ভব তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ব্রেক নামাযই হতে পারে এরচেয়ে বড় প্রভাবশালী নিরোধক আর কী হতে পারে যে, মানুষকে প্রতিদিন পাঁচবার আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য আহ্বান করা হবে এবং তার মনে একথা জাগিয়ে দেয়া হবে যে, তুমি এ দুনিয়ায় স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী নও বরং এক আল্লাহর বান্দা এবং তোমার আল্লাহ হচ্ছেন তিনি যিনি তোমার প্রকাশ্য ও গোপন সকল কাজ এমনকি তোমার মনের ইচ্ছা ও সংকল্পও জানেন এবং এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন তোমাকে আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজের যাবতীয় কাজের জবাবদিহি করতে হবে তারপর কেবলমাত্র একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকলে চলবে না বরং কার্যত প্রত্যেক নামাযের সময় যাতে লুকিয়ে লূকিয়েও সে আল্লাহর কোন হুকুম অমান্য না করে তার অনুশীলনও করতে হবে নামাযের জন্য ওঠার পর থেকে শুরু করে নামায খতম হওয়া পর্যন্ত মানুষকে অনবরত এমনসব কাজ করতে হয় যেগুলো করার সময় সে আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে অথবা তার বিরুদ্ধাচরণ করছে এ কথা সে এবং তার আল্লাহ ছাড়া তৃতীয় কোন সত্তা জানতে পারে না যেমন, যদি কারো ওযু ভেঙ্গে গিয়ে থাকে এবং সে নামায পড়তে দাঁড়ায়, তাহলে তার যে অযু নেই একথা সে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কে-ই বা জানতে পারবে মানুষ যদি নামাযের নিয়তই না করে এবং বাহ্যত রুকু,সিজদা ও উঠা-বসা করে নামাজের সূরা-কেরাত, দোয়া-দরুদ ইত্যাদি পড়ার পরিবর্তে নিরবে গজল পড়তে থাকে তাহলে সে যে আসলে নামায পড়েনি সে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কে এ রহস্য উদঘাটন করতে পারবে? এ সত্ত্বেও যখন মানুষ শরীর ও পোশাকের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন থেকে শুরু করে নামাযের আরকান ও সূরা-কেরাত-দোয়া-দরুদ পর্যন্ত সবকিছু সম্পন্ন করে আল্লাহ নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী প্রতিদিন পাঁচবার নামায পড়ে তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এ নামাযের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েকবার তার বিবেক প্রাণ সঞ্চার করা হচ্ছে, তার মধ্যে দায়িত্বেও অনুভূতি সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাকে দায়িত্বশীল মানুষে পরিণত করা হচ্ছে এবং যে আইনের প্রতি সে ঈমান এনেছে তা মেনে চলার জন্য বাইরে কোন শক্তি থাক বা না থাক এবং বিশ্ববাসী তার কাজের অবস্থা জানুক বা না জানুক নিজের আনুগত্য প্রবণতার প্রভাবাধীনে গোপনে ও প্রকাশ্যে সকল অবস্থায় সে সেই আইন মেনে চলবে-কার্যত তাকে এরি অনুশীলন করানো হচ্ছে

এ দৃষ্টিতে বিচার করলে একথা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না যে, নামায কেবলমাত্র মানুষকে অশ্লীল ও অসৎকাজ থেকেই বিরত রাখে না বরং আসলে দুনিয়ার দ্বিতীয় এমন কোন অনুশীলন পদ্ধতি নেই যা মানুষকে দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে এত বেশি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে পারে এখন প্রশ্ন থেকে যায়, মানুষ নিয়মিত নামায পড়ার পর কার্যতও দুষ্কৃতি থেকে দূরে থাকে নি জবাবে বলা যায়, এটা নির্ভর করে যে ব্যক্তি আত্মিক সংশোধন ও পরিশুদ্ধিও অনুশীলন করছে তার ওপর সে যদি এ থেকে উপকৃত হবার সংকল্প করে এবং এ জন্য প্রচেষ্টা চালায়, তাহলে নামাযের সংশোধনমূলক প্রভাব তার ওপর পড়বে অন্যথায় দুনিয়ার কোন সংশোধন ব্যবস্থা এমন ব্যক্তির ওপর কার্যকর হতে পারে না যে তার প্রভাব গ্রহণ করতে প্রস্তুতই নয় অথবা জেনে বুঝে তার প্রভাবকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে এর দৃষ্টান্ত যেমন দেহের পরিপুষ্টি ও প্রবৃদ্ধি হচ্ছে খাদ্যের অনিবার্য বিশেষত্ব কিন্তু এ ফল তখনই লাভ করা সম্ভবপর হতে পারে যখন মানুষ তাকে শরীরের অংশে পরিণত হবার সুযোগ দেবে যদি কোন ব্যক্তি প্রত্যেক বারে খাবার পরে বমি করে সমস্ত খাবার বের করে দিতে থাকে তাহলে এ ধরনের আহার তার জন্য মোটেই উপকারী হতে পারে না এ ধরনের কোন ব্যক্তিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়ে যেমন একথা বলা চলে না যে, খাদ্য দ্বারা দেহের পরিপুষ্টি হয় না কারণ, দেখা যাচ্ছে অমুক ব্যক্তি আহার করার পরও শুকিয়ে যাচ্ছে এভাবে এমন একজন নামাযী যে অসৎকাজ করে যেতেই থাকে, তার দৃষ্টান্ত পেশ করেও একথা বলা যেতে পারে না যে, নামায অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে না কারণ, ওমুক ব্যক্তি নামায পড়ার পরও খারাপ কাজ করে এ ধরনের নামাযী সম্পর্কে তো একথা বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে যে, সে আসলে নামায পড়ে না যেমন যে ব্যক্তি আহার করে বমি করে তার সম্পর্কে একথা বলা বেশি যুক্তিযুক্ত যে, সে আসলে আহার করে না

ঠিক একথাই বিভিন্ন হাদীসে নবী সা. এবং অনেক নেতৃস্থানীয় সাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণনা করেন, নবী সা. বলেছেনঃ

من لم تَنْهَهُ صلاتُه عن الفحشاءِ والمنكَرِ فلا صلاةَ له

“যার নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি তার নামাযই হয়নি”(ইবনে আবী হাতেম)ইবনে আব্বাস রা. নবী সা. এর এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে,

مَن لم تنهَهُ صلاتُه وصيامُه عن الفحشاءِ والمنكرِ لم تزدْهُ من اللهِ إلا بُعدًا

যার নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি তাকে তার নামায আল্লাহ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছে

হাসান বসরী (র) একই বস্তু সম্বলিত হাদীস নবী সা.থেকে মুরসাল রেওয়ায়াতের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন (ইবনে জারীর ও বাইহাকী) ইবনে মাসউ’দ রা. থেকে নবী কারীমের সা. এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছেঃ

لا صلاة لمن لم يطع الصلاة، وطاعة الصلاة أن تنهى عن الفحشاء والمنكر

যে ব্যক্তি নামাযের আনুগত্য করেনি তার নামাযই হয়নি আর নামাযের আনুগত্য হচ্ছে, মানুষ অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে” (ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতেম)

একই বক্তব্য সম্বলিত একাধিক উক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হাসান বাসরী, কাতাদাহ, মাশ ও আরো অনেকের থেকে উদ্ধৃত হয়েছে ইমাম জাফর সাদেক বলেন, যে ব্যক্তি তার নামায কবুল হয়েছে কিনা জানতে চায় তার দেখা উচিত তার নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে কি পরিণাম বিরত রেখেছে যদি নামাযের বাধা দেবার পর সে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত হয়ে থাকে, তাহলে তার নামায কবুল হয়ে গেছে (রূহুল মাআ’নী)

৭৯. এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে একঃ আল্লাহর যিকির (অর্থাৎ নামায) এর চেয়ে বড় এর প্রভাব কেবল নেতিবাচকই নয় শুধুমাত্র অসৎকাজ থেকে বিরত রেখেই সে ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী হবার জন্য মানুষকে উদ্যোগী করে দ্বিতীয় অর্থঃ আল্লাহর স্মরণ নিজেই অনেক বড় জিনিস, সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ মানুষের কোন কাজ এর চেয়ে বেশি ভালো নয় এর তৃতীয় অর্থঃ তোমার আল্লাহকে স্মরণ করার চাইতে আল্লাহর তোমাকে স্মরণ করা অনেক বেশি বড় জিনিস কুরআনে মহান আল্লাহ বলেনঃ فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ “তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদের স্মরণ করবো” (আল বাকারাহঃ ১৫২) কাজেই বান্দা যখন নামাযে আল্লাহকে স্মরণ করার তুলনায় আল্লাহর বান্দাকে স্মরণ করা অনেক বেশি উচ্চমানের এ তিনটি অর্থ ছাড়া আরো একটি সূক্ষ্ণ অর্থও এখানে হয় হযরত আবু দারদা রা. এর সম্মানিতা স্ত্রী এ অর্থটি বর্ণনা করেছেন তিনি বলেছেনঃ আল্লাহর স্মরণ নামায পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় বরং তার সীমানা এর চাইতেও বহুদূর বিস্তৃত যখন মানুষ রোযা রাখে, যাকাত দেয় বা অন্য কোন সৎকাজ করে তখন অবশ্যই সে আল্লাহকে স্মরণই করে, তবেই তো তার দ্বারা ঐ কাজটি সম্পাদিত হয় অনুরূপভাবে যখন কোন ব্যক্তি কোন অসৎকাজ করার সুযোগ পাওয়ার পর তা থেকে দূরে থাকে তখন এটাও হয় আল্লাহর স্মরণেরই ফল এ জন্য আল্লাহর স্মরণ একজন মুমিনের সমগ্র জীবনে পরিব্যাপ্ত হয়

﴿وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ ۖ وَقُولُوا آمَنَّا بِالَّذِي أُنزِلَ إِلَيْنَا وَأُنزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَٰهُنَا وَإِلَٰهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ﴾

৪৬ আর৮০ উত্তম পদ্ধতিতে ছাড়া আহলে কিতাবের সাথে বিতর্ক করো না,৮১ তবে তাদের মধ্যে যারা জালেম৮২ তাদেরকে বলে, “আমরা ঈমান এনেছি আমাদের প্রতি যা পাঠানো হয়েছে তার প্রতি এবং তোমাদের প্রতি যা পাঠানো হয়েছিল তার প্রতিও, আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ একজনই এবং আমরা তারই আদেশ পালনকারী”৮৩  

৮০. উল্লেখ্য, সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে এ সূরায় হিজরাত করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে সে সময় হাবশাই ছিল মুসলমানদের পক্ষে হিজরাত করে যাবার জন্য একমাত্র নিরাপদ জায়গা আর হাবশায় সে সময় ছিল খৃষ্টানদের প্রাধান্য তাই আহলে কিতাবের মুখোমুখি হলে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের সাথে কোন ধরনের ও কিভাবে আলাপ আলোচনা করতে হবে আয়াত গুলোতে সেসব উপদেশ দেয়া হয়েছে

৮১. অর্থাৎ বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা উপযুক্ত যুক্তি-প্রমাণ সহকারে, ভদ্র ও শালীন ভাষায় এবং বুঝবার ও বুঝাবার ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে করতে হবে এর ফলে যার সাথে আলোচনা হয় তার চিন্তার সংশোধন হবে প্রচারকের চিন্তা করা উচিত, তিনি শ্রোতার হৃদয় দুয়ার উন্মুক্ত করে সত্যকথা তার মধ্যে বসিয়ে দেবেন এবং তাকে সঠিক পথে আনবেন একজন পাহলোয়ানের মতো তার লড়াই করা উচিত নয়, যার উদ্দেশ্যই হয় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়া বরং একজন ডাক্তারের মতো তাকে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকতে হবে, যিনি তার রোগীর চিকিৎসা করার সময় একথাকে গুরুত্ব দেন যে, তার নিজের কোন ভূলের দরুন রোগীর রোগ যেন আরো বেশি বেড়ে না যায় এবং সর্বাধিক কম কষ্ট সহ্য করে যাতে তার রোগীর রোগ নিরাময় হওয়া সম্ভব হয় এ জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান পরিস্থিতি র সাথে সামঞ্জস্য রেখে আহলি কিতাবের সাথে বিতর্ক-আলোচনা করার ব্যাপারে এ নির্দেশ দেয়া হয় কিন্তু এটা কেবলমাত্র বিশেষভাবে আহলি কিতাবদের জন্য নয় বরং দ্বীনের প্রচারের ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ নির্দেশ কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে এর উল্লেখ রয়েছে যেমনঃ

﴿ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ﴾

আহ্বান করো নিজের রবের পথের দিকে প্রজ্ঞা ও উৎকৃষ্ট উপদেশের মাধ্যমে এবং লোকদের সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক-আলোচনা করো” (আন নাহলঃ -১২৫)

﴿وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ۚ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ﴾

সুকৃতি ও দুষ্কৃতি সমান নয় (বিরোধীদের আক্রমণ) প্রতিরোধ করো উৎকৃষ্ট পদ্ধতিতে তুমি দেখবে এমন এক ব্যক্তি যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে এমন হয়ে গেছে যেমন তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু” (হা-মীম আস সাজদাহঃ ৩৪)

﴿ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ ۚ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ﴾

তুমি উত্তম পদ্ধতিতে দুষ্কৃতি নির্মুল করো আমি জানি (তোমার বিরুদ্ধে) তারা যেসব কিছু তৈরি করে” (আল মু’মিনুনঃ ৯৬)

﴿خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ﴾﴿وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ﴾

ক্ষমার পথ অবলম্বন করো, ভালো কাজ করার নির্দেশ দাও এবং মূর্খদেরকে এড়িয়ে চলো আর যদি (মুখে মুখে জবাব দেবার জন্য) শয়তান তোমাকে উসকানী দেয় তাহলে আল্লাহর আশ্রয় চাও” (আল আ’রাফঃ ১৯৯-২০০)

৮২. অর্থাৎ যারা জুলুমের নীতি অবলম্বন করে তাদের সাথে তাদের জুলুমের প্রকৃতি বিবেচনা করে ভিন্ন নীতিও অবলম্বন করা যেতে পারে এর অর্থ হচ্ছে, সবসময় সব অবস্থায় সব ধরনের লোকদের মোকাবিলায় নরম ও সুমিষ্ট স্বভাবের হয়ে থাকলে চলবে না যেন মানুষ সত্যেও আহ্বায়কের ভদ্রতাকে দুর্বলতা ও অসহায়তা মনে না করে বসে ইসলাম তার অনুসারীদেরকে অবশ্যই ভদ্রতা, বিনয়, শালীনতা যুক্তিবাদিতার শিক্ষা দেয় কিন্তুহীনতা ও দীনতার শিক্ষা দেয় না তাদেরকে প্রত্যেক জালেমের জুলূমের সহজ শিকারে পরিণত হবার শিক্ষা দেয় না

৮৩. এ বাক্যগুলোতে মহান আল্লাহ নিজেই উৎকৃষ্ট পদ্ধতিতে বিতর্ক-আলোচনার পথ-নির্দেশ দিয়েছেন সত্য প্রচারের দায়িত্ব যারা গ্রহণ করেছেন তাদের এ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত এখানে শেখানো হয়েছে, যে ব্যক্তির সাথে তোমাকে বিতর্ক করতে হবে তার ভ্রষ্টতাকে আলোচনার সূচনা বিন্দুতে পরিণত করো না বরং সত্য ও ন্যায়-নীতির যে অংশগুলো তোমার ও তার মধ্যে সমভাবে বিরাজ করছে সেগুলোর থেকে আলোচনা শুরু করো অর্থাৎ বিরোধীয় বিন্দু থেকে আলোচনা শুরু না করে ঐক্যেও বিন্দু থেকে শুরু করতে হবে তারপর সেই সর্বসম্মত বিষয়াবলী থেকে যুক্তি পেশ করে শ্রোতাকে একথা বুঝাবার চেষ্টা করতে হবে যে, তোমার ও তার মধ্যে যেসব বিষয়ে বিরোধ রয়েছে সেগুলোতে তোমার অভিমত সর্বসম্মত ভিত্তিগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রাখে এবং তার অভিমত হচ্ছে তার বিপরীতধর্মী

এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, আহলি কিতাব আরবের মুশরিকদের মতো অহী, রিসালাত ও তাওহীদ অস্বীকারকারী ছিল না বরং তারা মুসলমানদের মতো এ সত্যগুলো স্বীকার করতো এ মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐক্যমত্য পোষণ করার পর যদি তাদের মধ্যে মতবিরোধের বড় কোন ভিত্তি হতে পারতো তাহলে তা হতো এই যে, তাদের কাছে যেসব আসমানী কিতাব এসেছে মুসলমানরা সেগুলো মানছে না এবং মুসলমানদের নিজেদের কাছে যে আসমানী কিতাব এসেছে তাদেরকে তার প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিচ্ছে আর তা গ্রহণ না করলে তাদেরকে কাফের বলে গণ্য করছে বিরোধের জন্য এটি খুবই শক্তিশালী ভিত্তি হতে পারতো কিন্তু মুসলমানদের অবস্থান ছিল এ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আহলি কিতাবের কাছে যেসব কিতাব ছিল সেসবকেই তারা সত্য বলে মানতো এবং এ সঙ্গে মুহাম্মাদ সা. এর প্রতি যে অহী নাযিল হয়েছিল তার প্রতি তারা ঈমান এনেছিলএরপর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে আহলি কিতাব এক আল্লাহরই নাযিল করা একটি কিতাব মানে এবং অন্যটি মানে না একথা বলার দায়িত্ব ছিল তাদের নিজেদেরই এ জন্য আল্লাহ এখানে মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন, যখনই আহলি কিতাবদের মুখোমুখি হবে সবার আগে তাদের কাছে ইতিবাচকভাবে নিজেদের এ অবস্থানটি তুলে ধরো তাদেরকে বলো, তোমরা যে আল্লাহকে মানো আমরাও তাকেই মানি এবং আমরা তার হুকুম পালন করি তার পক্ষ থেকে যে বিধান, নির্দেশ ও শিক্ষাবলীই এসেছে, তা তোমাদের ওখানে বা আমাদের এখানে যেখানেই আসুক না কেন, সেসবের সামনে আমরা মাথা নত করে দেই আমরা তো হুকুমের দাস দেশ, জাতি ও বংশের দাস নই আল্লাহর হুকুম এক জায়গায় এলে আমরা মেনে নেবো এবং এই একই আল্লাহর হুকুম অন্য জায়গায় এলে আমরা তা মানবো না, এটা আমাদের রীতি নয় একথা কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে বার বার বলা হয়েছে বিশেষ করে আহলি কিতাবের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে তো জোর দিয়ে এ বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে যেমন দেখুন, সূরা আল বাকারাহ-এর ৪, ১৩৬, ১৭৭; আলে ইমরানের ৮৪; আন নিসার ১৩৬, ১৫০-১৫২,১৬২-১৬৪ এবং আশ শুআ’রার ১৩ আয়াত

﴿وَكَذَٰلِكَ أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ ۚ فَالَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يُؤْمِنُونَ بِهِ ۖ وَمِنْ هَٰؤُلَاءِ مَن يُؤْمِنُ بِهِ ۚ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلَّا الْكَافِرُونَ﴾

৪৭ (হে নবী) আমি এভাবেই তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি,৮৪ এ জন্য যাদেরকে আমি প্রথমে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এতে বিশ্বাস করে৮৫  এবং এদের অনেকেও এতে বিশ্বাস করছে,৮৬ আর আমার আয়াত একমাত্র কাফেররাই অস্বীকার করে৮৭  

৮৪. এর দু’টি অর্থ হতে পারে একঃযেভাবে পূববর্তী নবীগণের প্রতি আমি কিতাব নাযিল করেছিলাম ঠিক তেমনিভাবে এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি দুইঃ আমি এই শিক্ষা সহকারেই একে নাযিল করেছি যে, আমার পূর্ববর্তী কিতাবগুলো অস্বীকার করে নয় বরং সেগুলো সব স্বীকার করে নিয়েই একে মানতে হবে

৮৫. পূর্বাপর বিষয়বস্তু নিজেই একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, এখানে সমস্ত আহলি কিতাবেরর কথা বলা হয়নি বরং এমনসব আহলি কিতাবেরর কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহর কিতাবের সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যারা কেবলমাত্র এ কিতাব বহনকারী চতুষ্টদ জীবের মতো নিছক বিতারের বোঝা বহন করে বেড়াতেন না বরং প্রকৃত অর্থেই ছিলেন কিতাবধারী তাদের সামনে যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ববর্তী কিতাবগুলোকে সত্যায়িত করে এ শেষ কিতাবটি এলো তখন তারা কোন প্রকার জিদ, হঠকারিতা ও সংকীর্ণ স্বার্থ প্রীতির আশ্রয় নিলেন না এবং তাকেও ঠিক তেমনি আন্তরিকতা সহকারে স্বীকার করে নিলেন যেমন পূর্ববর্তী কিতাবগুলোকে স্বীকার করতেন

৮৬. ‘এদের’ শব্দের মাধ্যমে আরববাসীদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এর অর্থ হচ্ছে, সত্যপ্রিয় লোকেরা, তারা আহলি কিতাব বা অ-আহলি কিতাব যারাই হোক না কেন, সর্বত্রই এর প্রতি ঈমান আনছে

৮৭. এখানে তাদেরকে কাফের বলা হয়েছে যারা নিজেদের সংকীর্ণ স্বাথ প্রীতি ত্যাগ করে সত্য কথা মেনে নিতে প্রস্তুত নয় অথবা যারা নিজেদের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও অবাধ স্বাধীনতার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করার ব্যাপারে পিছটান দেয় এবং এরি ভিত্তিতে সত্য অস্বীকার করে

﴿وَمَا كُنتَ تَتْلُو مِن قَبْلِهِ مِن كِتَابٍ وَلَا تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ ۖ إِذًا لَّارْتَابَ الْمُبْطِلُونَ﴾

৪৮ (হে নবী) ইতিপূর্বে তুমি কোন কিতাব পড়তে না এবং স্বহস্তে লিখতেও না, যদি এমনটি হতো, তাহলে মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করতে পারতো৮৮  

৮৮. এটি নবী সা. এর নবুওয়াতের স্বপক্ষে একটি যুক্তি ইতিপূর্বে সূরা ইউনুস ও সূরা আল কাসাসে এ যুক্তি আলোচিত হয়েছে (দেখুন তাফহিমুল কুরআন, সূরা ইউনুসঃ ২১ টীকা এবং সূরা আল কাসাসঃ ৬৪ ও ১০৯ টীকা এ বিষয়বস্তুর আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য তাফহিমুল কুরআন, সূরা আন নাহলঃ ১০৭; সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১০৫; আল মু’মিনুনঃ ৬৬; আল ফুরকানঃ ১২; আশ শূরাঃ ৮৪; টীকাগুলো অধ্যয়ন সহায়ক হবে)

এ আয়াতে যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে, নবী সা. ছিলেন নিরক্ষর তার স্বদেশবাসী ও আত্মীয়-বান্ধবগণ, যাদের মধ্যে তিনি শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত জীবনকাল অতিবাহিত করেছিলেন, সবাই ভালোভাবে জানতো তিনি সারা জীবন কখনো কোন বই পড়েননি এবং কলম হাতে ধরেননি এ সত্য ঘটনাটি পেশ করে মহান আল্লাহ বলেছেন, এটি একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, আসমানী কিতাবসমূহের শিক্ষাবলী, পূর্ববর্তী নবীগণের অবস্থা, বিভিন্ন ধর্ম ও দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাস, প্রাচীন জাতিসমূহের ইতিহাস এবং সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিক জীবন যাপনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী সম্পর্কে যে গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের প্রকাশ ও নিরক্ষর নবীর কণ্ঠ থেকে হচ্ছে তা তিনি অহী ছাড়া অন্য কোন উপায়ে অর্জন করতে পারতেন না যদি তিনি লেখাপড়া জেনে থাকতেন এবং লোকেরা তাকে বই পড়তে এবং অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে দেখতো তাহলে তো অবশ্যই বাতিলপন্থীদের জন্য এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করার কোন ভিত্তি থাকতো যে, এসব জ্ঞান অহীর মাধ্যমে নয় বরং জাগতিক মেধা, প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে কিন্তু তার নিরক্ষরতা তো তার সম্পর্কে নামমাত্র কোন সন্দেহ পোষণ করার সুযোগ ও ভিত্তিও অবশিষ্ট রাখেনি এখন নিছক হঠকারিতা ছাড়া তার নবুওয়াত অস্বীকার করার আর এমন কোন কারণই নেই যাকে কোন পর্যায়েও যুক্তিসঙ্গত বলা যেতে পারে

﴿بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ ۚ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلَّا الظَّالِمُونَ﴾

৪৯ আসলে এগুলো হচ্ছে উজ্জ্বল নিদর্শন এমন লোকদের মনের মধ্যে যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে৮৯ এবং জালেমরা ছাড়া আর কেউ আমার আয়াত অস্বীকার করে না  

৮৯. অর্থাৎ একজন নিরক্ষরের পক্ষে কুরআনের মতো একটি কিতাব পেশ করা এবং সহসা এমনসব অসাধারণ বিস্ময়কর ঘটনাবলীর প্রকাশ যেগুলোর জন্য পূর্বাহ্নে প্রস্তুতি গ্রহণ করার কোন উদ্যোগ আয়োজন কখনো কারো চোখে পড়েনি, এগুলোই বুদ্ধিমান বিচক্ষণ লোকদের দৃষ্টিতে তার নবুওয়াতের প্রমাণ পেশকারী উজ্জ্বলতম নিদর্শন দুনিয়ার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের মধ্য থেকে যারই অবস্থা পর্যালোচনা করা যাবে, তারই নিজস্ব পরিবেশে মানুষ এমনসব উপাদানের সন্ধান লাভ করতে পারবে যেগুলো তার ব্যক্তিত্ব গঠনে এবং তার অসাধারণ কৃতিত্ব প্রকাশের জন্য তাকে প্রস্তুতকরার ব্যাপারে সক্রিয় ছিল তার পরিবেশ ও তার ব্যক্তিত্ব গঠনের উপাদানের মধ্যে একটা পরিষ্কার সম্পর্ক পাওয়া যায় কিন্তু মুহাম্মাদ সা. এর ব্যক্তিত্বে যেসব বিস্ময়কর গুনাবলী ও কৃতিত্বের প্রকাশ ঘটেছিল তার কোন উৎস তার পরিবেশে খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর ছিল না এখানে মুহাম্মাদ সা. এর ব্যক্তিত্ব গঠনের উপাদানের সাথে কোন প্রকার দূরবর্তী সম্পর্ক রাখে এমনসব উপাদান সেকালে আরবীয় সমাজের এবং আশপাশে যেসব দেশের সাথে আরবদের সম্পর্ক ছিল তাদের সমাজের কোথাও থেকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয় এ বাস্তবতার ভিত্তিতেই এখানে বলা হয়েছে, মুহাম্মাদ সা. এর সত্তা একটি নিদর্শনের নয় বরং বহু নিদর্শনের সমষ্টি মূর্খ এর মধ্যে কোন নিদর্শন দেখতে পায় না, এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় কিন্তু জ্ঞানীরা এ নিদর্শনগুলো দেখে মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কেবলমাত্র একজন নবীই এ কৃতিত্বেও অধিকারী হতে পারে

﴿وَقَالُوا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ آيَاتٌ مِّن رَّبِّهِ ۖ قُلْ إِنَّمَا الْآيَاتُ عِندَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُّبِينٌ﴾

৫০ এরা বলে “কেনই বা এই ব্যক্তির ওপর নিদর্শনাবলী অবর্তীর্ণ করা হয়নি৯০ এর রবের পক্ষ থেকে?” বলো, “নিদর্শনাবলী তো রয়েছে আল্লাহর কাছে এবং আমি কেবলমাত্র পরিষ্কারভাবে সতর্ককারী

৯০. অর্থাৎ মু’জিযা, যেগুলো দেখে বিশ্বাস করা যায় সত্যই মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর নবী

﴿أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَرَحْمَةً وَذِكْرَىٰ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾

৫১আর এদের জন্য কি এ (নিদর্শন) যথেষ্ঠ নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদেরকে পড়ে শুনানো হয়?৯১ আসলে যারা ঈমান আনে তাদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে রহমত ও নসিহত৯২  

৯১. অর্থাৎ নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের প্রতি কুরআনের মতো একটি কিতাব নাযিল হওয়া, এটি তোমাদের রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য যথেষ্ঠ হবার মতো বড় মু’জিযা নয় কি? এর পরও কি আর কোন মু’জিযা থাকে? অন্য মু’জিযাগুলোতো যারা দেখেছে তাদের জন্য মু’জিযা ছিল কিন্তু এ মু’জিযাটি তো সর্বক্ষণ তোমাদের সামনে রয়েছে, প্রতিদিন তোমাদের পড়ে শুনানো হচ্ছে তোমরা সবসময় তা দেখতে পারো

কুরআন মাজীদের এ যুক্তি প্রমাণ পেশ করার পরও যারা নবী সা.এক সাক্ষ্যও প্রমাণ করার চেষ্টা করে তাদের দুঃসাহস দেখে অবাক হতে হয় অথচ এখানে কুরআন পরিষ্কার ভাষায় নবী কারীমের সা. নিরক্ষর হবার বিষয়টিকে তার নবুওয়াতের স্বপক্ষে একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে পেশ করছে যে সব হাদীসের ভিত্তিতে নবী কারীম সা. সাক্ষর ছিলেন অথবা পরে লেখাপড়া শিখেছিলেন দাবী করা হয়, সেগুলো তো প্রথম দৃষ্টিতেই প্রত্যাখ্যান করার যোগ্য কারণ কুরআন বিরোধী কোন হাদীসই গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না তারপর এগুলো নিজেই এত দুর্বল যে, এগুলোর ওপর কোন যুক্তির ভিত খাড়া করা যেতে পারে না এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বুখারীর একটি হাদীস তাতে বলা হয়েছেঃ হুদায়বিয়া সংঘটিত হওয়ার সময় যখন চুক্তিনামা লেখা হচ্ছিল তখন মক্কার কাফেরদের প্রতিনিধিরা রাসূলে কারীমের সা. নামের সাথে রাসূলুল্লাহ লেখার ওপর আপত্তি জানায় তখন নবী সা. চুক্তি লেখককে (অর্থাৎ হযরত আলী) নির্দেশ দেন, ঠিক আছে রাসূলুল্লাহশব্দটি কেটে দিয়ে তার জায়গায় লেখো “মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ” হযরত আলী রাসূলুল্লাহশব্দটি কেটে দিতে অস্বীকার করেন নবী কারীম সা. তার হাত থেকে কলম নিয়ে নিজেই শব্দটি কেটে দেন এবং মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহলিখে দেন

কিন্তু হাদীসটি বারাআ ইবনে আযিব থেকে বুখারীতে চার জায়গায় এবং মুসলিমে দু’জায়গায় উদ্ধৃত হয়েছে প্রত্যেক জায়গায় এর শব্দাবলি বিভিন্ন

একঃ বুখারী চুক্তি অধ্যায়ে এর শব্দগুলো হচ্ছে নিম্নরূপঃ

قَالَ لِعَلِيٍّ امْحُهُ، فَقَالَ عَلِيٌّ ما أنَا بالَّذِي أمْحَاهُ، فَمَحَاهُ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ بيَدِهِ

নবী কারীম সা. আলীকে বললেন এ শব্দগুলো কেটে দাও আলী বললেন, আমি তো কেটে দিতে পারি না শেষে নবী কারীম সা. নিজ হাতে তা কেটে দেন

দুইঃ এ কিতাবে অন্য একটি হাদীসের শব্দাবলি হচ্ছেঃ

ثُمَّ قالَ لِعَلِيِّ امْحُ رَسولَ اللَّهِ قالَ لا واللَّهِ لا أمْحُوكَ أبَدًا، فأخَذَ رَسولُ اللَّهِ الكِتابَ فَكَتَبَ  هذا ما قاضَى عليه مُحَمَّدُ بنُ عبدِ اللَّهِ،

তারপর আলীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ শব্দ কেটে দাও তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো আপনার নাম কাটবো না শেষে নবী কারীম সা. দলীলটি নিয়ে লিখলেন, “এটি সেই চুক্তি যা আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ সম্পাদন করেছেন

তিনঃ তৃতীয় হাদীসও বারাআ ইবনে আযিব থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম বুখারী এটি জিযিয়া অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেনঃ

وكانَ لا يَكْتُبُ فَقالَ لِعَلِيٍّ امْحَ رَسولَ اللَّهِ فَقالَ عَلِيٌّ واللَّهِ لا أَمْحَاهُ أَبَدًا، قالَ فأرِنِيهِ، قالَ فأرَاهُ إيَّاهُ فَمَحَاهُ النبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ بيَدِهِ

নবী কারীম সা. নিজে লিখতে পারতেন না তিনি হযরত আলীকে বললেন, রাসূলুল্লাহটা কেটে দাও আলী বললেন, আল্লাহর কসম, আমি এ শব্দগুলো কখনোই কাটবো না একথায় নবী কারীম সা. বলেন, যেখানে এ শব্দগুলো লেখা আছে সে জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে দাও তিনি তাকে জায়গাটি দেখিয়ে দিলেন এবং নবী সা. নিজের হাতে সে শব্দগুলো কেটে দিলেন

চারঃ চতুর্থ হাদীসটি বুখারীর যুদ্ধবিগ্রহ অধ্যায়ে এভাবে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

فَأَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الكِتَابَ، وَلَيْسَ يُحْسِنُ يَكْتُبُ ، فَكَتَبَ: هَذَا مَا قَاضَى عَلَيْهِ مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ

কাজেই নবী কারীম সা. সে দলীলটি নিয়ে নিলেন অথচ তিনি লিখতে জানতেন না এবং তিনি লিখলেন এটি সেই চুক্তি যেটি স্থির করেছেন মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ

পাঁচঃ একই বর্ণনাকারী বারাআ ইবনে আযিব থেকে মুসলিমের কিতাবুল জিহাদে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেটি হচ্ছে, নবী কারীম সা. আলীর অস্বীকৃতির কারণে নিজের হাতে “আল্লাহর রাসূল” শব্দ কেটে দেন

ছয়ঃ এ কিতাবে অন্য একটি হাদীস একই বর্ণনাকারী থেকেই বর্ণিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আলীকে বলেন, রাসূলুল্লাহ শব্দ কোথায় লেখা আছে আমাকে দেখিয়ে দাও হযরত আলী তাকে জায়গাটি দেখিয়ে দিলেন এবং তিনি সেটি বিলুপ্ত করে আবদুল্লাহর পুত্র লিখে দেন

উল্লেখিত হাদীসগুলোর বর্ণনার মধ্যে যে অস্থিরতা ফুটে উঠেছে তা পরিষ্কারভাবে একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, মাঝখানের বর্ণনাকারীরা হযরত বারাআ ইবনে আযিব রা. এর শব্দগুলো হুবহু উদ্ধৃত করেননি তাই তাদের কারো একজনের বর্ণনার ওপর নির্ভর করে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে একথা বলা যেতে পারে না যে, নবী কারীম সা. “মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ” শব্দগুলো নিজ হাতেই লেখেন হতে পারে, সঠিক ঘটনা হয়তো এ রকম ছিলঃ যখন হযরত আলী ‘রাসূলূল্লাহ’ শব্দ কেটে দিতে অস্বীকার করেন তখন তিনি তার কাছে থেকে সে জায়গাটি জিজ্ঞেস করে নিয়ে নিজের হাতে সেটি কেটে দেন এবং তারপর তার সাহায্যে বা অন্য কোন লেখকের সহায়তায় মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ শব্দ লিখে দিয়ে থাকবেন অন্যান্য হাদীস থেকে জানা যায়, এ সময় দু’জন লেখক চুক্তিনামা লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, এদের একজন ছিলেন হযরত আলী রা. এবং অন্যজন ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ (ফাতহুল বারি, ৫ খণ্ড, ২১৭ পৃষ্ঠা) কাজেই একজন লেখক যে কাজ করেননি দ্বিতীয়জন যে তা করেছেন, এটা মোটেই অসম্ভব নয় তবুও যদি বাস্তবেই এটা ঘটে থাকে যে, নবী কারীম সা.নিজের নাম নিজের পবিত্র হাতে লিখে দিয়েছেন, তাহলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই দুনিয়ায় এ ধরণের বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যে, একজন নিরক্ষর লোক শুধুমাত্র নিজের নামটি লেখা শিখে নিয়েছে, এ ছাড়া আর কিছুই লিখতে পড়তে পারে না

অন্য যে হাদীসটির ভিত্তিতে নবী সা. কে সাক্ষর দাবী করা হয়ে থাকে সেটি মুজাহিদ থেকে ইবনে আবী শাইবা এবং আমর ইবনে শূবাহ উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দাবলি হচ্ছেঃ

ما مات رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى كتب وقرأ

ইন্তিকালের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সা. লিখতে ও পড়তে শিখেছিলেন

কিন্তু প্রথমত সনদের দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত দুর্বল রেওয়ায়েত, যেমন হাফেয ইবনে কাসীর বলেন, فضعيت لا اصل له

(অর্থাৎ এটি দুর্বল রেওয়ায়েত, এর কোন ভিত্তি নেই) দ্বিতীয়ত এর দুর্বলতা ও সুস্পষ্ট অর্থাৎ যদি নবী কারীম সা. পরবর্তী পর্যায়ে লেখাপড়া শিখে থাকেন, তাহলে এটা সাধারণ্যে প্রচারিত হবার কথা বহু সংখ্যক সাহাবী এ বিষয়টি বর্ণনা করতেন এই সঙ্গে নবী কারীম সা. কার কাছে বা কার কার কাছে লেখাপড়া শিখেছেন তাও জানা যেতো কিন্তু একমাত্র মুজাহিদ যার কাছ থেকে একথা শুনেন সেই আওন ইবনে আবদুল্লাহ ছাড়া আর কেউ একথা বর্ণনা করেননি আর এই আওন ও সাহাবী নন বরং তিনি একজন তাবেঈ কোন সাহাবী বা কোন কোন সাহাবী থেকে তিনি একথা শুনেছেন তাও তিনি ঘুণাক্ষরেও বলেননি একথা সুস্পষ্ট, এ ধরনের দুর্বল রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে এমন কোন কথা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যা অত্যন্ত সুপরিচিত ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত ঘটনার বিরোধিতা করে

৯২. অর্থাৎ নিসন্দেহে এ কিতাব অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহর মহা অনুগ্রহ স্বরূপ এর মধ্যে রয়েছে বান্দার জন্য বিপুল পরিমাণ উপদেশ ও নসিহত কিন্তুএ থেকে একমাত্র তারাই উপকৃত হতে পারে যারা এর প্রতি ঈমান আনে

﴿قُلْ كَفَىٰ بِاللَّهِ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ شَهِيدًا ۖ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَالَّذِينَ آمَنُوا بِالْبَاطِلِ وَكَفَرُوا بِاللَّهِ أُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ﴾

৫২ (হে নবী!) বলো, “আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষ্যের জন্য আল্লাহই যথেষ্ঠ তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর মধ্যে সবকিছু জানেন যারা বাতিলকে মানে ও আল্লাহকে অমান্য করে তারাই ক্ষতিগুস্ত

﴿وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِالْعَذَابِ ۚ وَلَوْلَا أَجَلٌ مُّسَمًّى لَّجَاءَهُمُ الْعَذَابُ وَلَيَأْتِيَنَّهُم بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾

৫৩ এরা তোমার কাছে দাবী করছে আযাব দ্রুত আনার জন্য৯৩ যদি একটি সময় নির্ধারিত না করে দেয়া হতো, তাহলে তাদের ওপর আযাব এসেই যেতো এবং নিশ্চিতভাবেই (ঠিক সময় মতো) তা অকস্মাৎ এমন অবস্থায় এসে যাবেই যখন তারা জানতেও পারবে না  

৯৩. অর্থাৎ বারবার চ্যালেঞ্জের কণ্ঠে দাবী জানাচ্ছে, যদি তুমি রাসূল হয়ে থাকো এবং আমরা যথার্থই সত্যের প্রতি মিথ্যা আরোপ করে থাকি, তাহলে তুমি যে আযাবের ভয় আমাদের দেখিয়ে থাকো তা নিয়ে আসছো না কেন?

﴿يَسْتَعْجِلُونَكَ بِالْعَذَابِ وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةٌ بِالْكَافِرِينَ﴾

৫৪ এরা তোমার কাছে আযাব দ্রুত আনার দাবী করছে অথচ জাহান্নাম এ কাফেরদেরকে ঘেরাও করে নিয়েছে  

﴿يَوْمَ يَغْشَاهُمُ الْعَذَابُ مِن فَوْقِهِمْ وَمِن تَحْتِ أَرْجُلِهِمْ وَيَقُولُ ذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾

৫৫ (এবং এরা জানতে পারবে) সেদিন যখন আযাব এদেরকে ওপর থেকে ঢেকে ফেলবে এবং পায়ের নীচে থেকেও আর বলবে, যেসব কাজ তোমরা করতে এবার তার মজা বোঝো  

﴿يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ أَرْضِي وَاسِعَةٌ فَإِيَّايَ فَاعْبُدُونِ﴾

৫৬ হে আমার বান্দারা, যারা ঈমান এনেছো! আমার যমীন প্রশস্ত, কাজেই তোমরা আমারই বন্দেগী করো৯৪  

৯৪. এখানে হিজরতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে এর অর্থ হচ্ছে, যদি মক্কায় আল্লাহর বন্দেগী করা কঠিন হয়ে থাকে, তাহলে দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও আল্লাহর পৃথিবী সংকীর্ণ নয় যেখানেই তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে বসবাস করতে পারো সেখানে চলে যাও তোমাদের জাতি ও দেশের নয় বরং আল্লাহর বন্দেগী করা উচিত এ থেকে জানা যায়, আসল জিনিস জাতি ও দেশ নয় বরং আল্লাহর বন্দেগী যদি কখনো জাতি ও দেশ প্রেমের দাবী এবং আল্লাহর বন্দেগীর দাবীর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে তাহলে সেটিই হয় মু’মিনের ঈমানের পরীক্ষার সময় যে সাচ্চা মু’মিন হবে, সে আল্লাহর বন্দেগী করবে এবং দেশ ও জাতিকে পরিত্যাগ করবে আর যে মিথ্যা ঈমানের দাবীদার হবে, সে ঈমান পরিত্যাগ করবে এবং নিজের দেশ ও জাতিকে আঁকড়ে ধরবে এ আয়াতটি এ ব্যাপারে একেবারে সুস্পষ্ট যে, একজন সত্যিকার আল্লাহর অনুগত ব্যক্তি দেশ ও জাতি প্রেমিক হতে পারে কিন্তু দেশ ও জাতি পূজারী হতে পারে না তার কাছে আল্লাহর বন্দেগী হয় সব জিনিসের চেয়ে প্রিয় এবং দুনিয়ার সমস্ত জিনিসকে সে এর কাছে বিকিয়ে দেয় কিন্তু দুনিয়ার কোন জিনিসের কাছে একে বিকিয়ে দেয় না

﴿كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۖ ثُمَّ إِلَيْنَا تُرْجَعُونَ﴾

৫৭ প্রত্যেক জীবকেই মৃত্যুও স্বাদ পেতে হবে তারপর তোমাদের সবাইকে আমার দিকে ফিরিয়ে আনা হবে৯৫  

৯৫. অর্থাৎ প্রাণের কথা ভেবো না এ তো কখনো না কখনো চলে যাবেই চিরকাল থাকার জন্য কেউই দুনিয়ায় আসেনি কাজেই এ দুনিয়ায় কিভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে চলতে হবে এটা তোমাদের জন্য কোন চিন্তাযোগ্য বিষয় নয় বরং আসল চিন্তাযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ঈমান কেমন করে বাঁচানো যাবে এবং আল্লাহর আনুগত্যের দাবী কিভাবে পূরণ করা যাবে শেষ পর্যন্ত তোমাদের ফিরে আমার দিকে আসতে হবে যদি দুনিয়ায় প্রাণ বাঁচাবার জন্য ঈমান হারিয়ে চলে আসো তাহলে এর ফল হবে ভিন্ন কিছু আর ঈমান বাঁচাবার জন্য যদি প্রাণ হারিয়ে চলে আসো তাহলে এর পরিণাম হবে অন্য রকম কাজেই আমার কাছে যখন ফিরে আসবে তখন কি নিয়ে ফিরে আসবে, কেবল একথাটিই চিন্তা করো প্রাণের জন্য উৎসর্গীত ঈমান, না ঈমানের জন্য উৎসর্গীত প্রাণ নিয়ে?

﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُبَوِّئَنَّهُم مِّنَ الْجَنَّةِ غُرَفًا تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ نِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ﴾

৫৮ যারা ঈমান এনেছে এবং যারা সৎকাজ করেছে তাদেরকে আমি জান্নাতের উঁচু ও উন্নত ইমারতের মধ্যে রাখবো, যেগুলোর নিচে দিয়ে নদী বয়ে যেতে থাকবে সেখানে তারা থাকবে চিরকাল কতই না উত্তম প্রতিদান কর্মশীলদের জন্য৯৬  

৯৬. অর্থাৎ ধরে নেয়া যাক যদি ঈমান ও নেকীর পথে চলে তোমরা দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত থেকে বঞ্চিত ও হয়ে যাও এবং পার্থিব দৃষ্টিকোন থেকে পুরোপুরি ব্যর্থতার মুত্যু বরণও করে থাকো তাহলে বিশ্বাস করো অবশ্যই এ ক্ষতিপূরণ হবে এবং নিছক ক্ষতিপূরণই হবে না বরং সর্বোত্তম প্রতিদানও পাওয়া যাবে

﴿الَّذِينَ صَبَرُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾

৫৯-তাদের জন্য যারা সবর করেছে৯৭ এবং যারা নিজেদের রবের প্রতি আস্থা রাখে৯৮  

৯৭. অর্থাৎ যারা সব রকমের সমস্যা, সংকট, বিপদ-আপদ, ক্ষতি ও কষ্টের মোকাবিলায় ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে যারা ঈমান আনার বিপদ নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়নি ঈমান ত্যাগ করা, উপকারিতা ও মুনাফা যারা নিজের চোখে দেখেছে এবং এরপরও তার প্রতি সামান্যতমও ঝুঁকে পড়েনি যারা কাফের ও ফাসেকদেরকে নিজেদের সামনে ফুলে ফেঁপে উঠতে দেখেছে এবং তাদের ধন্-দৌলত ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তির দিকে ভুলেও নজর দেয়নি

৯৮. অর্থাৎ যারা নিজেদের সহায়-সম্পত্তি, কাজ-কারবার ও বংশ-পরিবারের ওপর ভরসা করেনি বরং নিজেদের রবের ওপর ভরসা করেছে যারা দুনিয়াবী উপায়-উপাদানের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নিছক নিজেদের রবের ভরসায় ঈমানের খাতিরে প্রত্যেকটি বিপদ সহ্য করার এবং প্রয়োজনে প্রত্যেকটি শক্তির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার জন্য তৈরি হয়ে যায় এবং সময় এলে বাড়িঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়ে যারা নিজেদের রবের প্রতি এতটুকু আস্থা রাখে যে, ঈমান ও নেকীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রতিদান তার কাছে কখনো নষ্ট হবে না এবং বিশ্বাস রাখে যে, তিনি নিজের মু’মিন ও সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে এ দুনিয়ায় সহায়তা দান করবেন এবং আখেরাতেও তাদের কার্যক্রমের সর্বোত্তম প্রতিদান দেবেন

﴿وَكَأَيِّن مِّن دَابَّةٍ لَّا تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللَّهُ يَرْزُقُهَا وَإِيَّاكُمْ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾

৬০ কত জীব-জানোয়ার আছে যারা নিজেদের জীবিকা বহন করে না আল্লাহই তাদেরকে জীবিকা দেন এবং তোমাদের জীবিকাদাতাও তিনিই, তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন৯৯  

৯৯. অর্থাৎ হিজরাত করার ব্যাপারে তোমাদের প্রাণের চিন্তার মতো জীবিকার চিন্তায়ও পেরেশান হওয়া উচিত নয় তোমাদের চোখের সামনে এই যে অসংখ্য পশুপাখি ও জলজপ্রাণী জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, এদের মধ্য থেকে কে তার জীবিকা বহন করে ফিরছে? আল্লাহই তো এদের সবাইকে প্রতিপালন করছেন যেখানেই যায় আল্লাহর অনুগ্রহে এরা কোন না কোন প্রকারে জীবিকা লাভ করেই থাকে কাজেই তোমরা একথা ভেবে সাহস হারিয়ে বসো না যে, যদি ঈমান রক্ষার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়ি তাহলে খাবো কি? আল্লাহ যেখান থেকে তার অসংখ্য সৃষ্টিকে রিযিক দিচ্ছেন সেখান থেকে তোমাদেরও দেবেন ঠিক একথা সাইয়্যিদিনা মসীহ আ. তার সাথীদেরকে বলেছিলেন তিনি বলেছিলেনঃ “কেহই দুই কর্তার দাসত্ব করিতে পারে না, কেননা সে হয়ত একজনকে দ্বেষ করিবে, আর একজনকে প্রেম করিবে, নয়ত একজনের অনুরক্ত হইবে, আর একজনকে তুচ্ছ করিবে; তোমরা ঈশ্বর এবং ধন উভয়ের দাসত্ব করিতে পার না এইজন্য আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, “কি ভোজন করিব, কি পান করিববলিয়া প্রাণের বিষয়ে, কিম্বা কি পরিববলে শরীরের বিষযে ভাবিত হইও না; ভক্ষ্য হতে প্রাণ ও বস্ত্র হতে শরীর কি বড় বিষয় নয়? আকাশের পক্ষীদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর? তাহারা বুনেওনা, কাটেওনা, গোলাঘরে সঞ্চয়ও করো না, তথাপি তোমাদের স্বর্গীয় পিতা তাহাদিগকে আহার দিয়া থাকেন; তোমরা কি তাহাদের চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ নও? আর তোমাদের মধ্যে কে ভাবিত হয়ে আপন বয়স এক হস্ত মাত্র বৃদ্ধি করিতে পারে? আর বস্ত্রের নিমিত্ত কেন ভাবিত হও? ক্ষেত্রের কানুড় পুষ্পের বিষয়ে বিবেচনা কর, সেগুলি কেমন বাড়ে; সে সকল শ্রম করে না, সূতাও কাটেনা; তথাপি আমি তোমাদিগকে বলতেছি শলোমনও আপনার সমস্ত প্রতাপে ইহার একটির ন্যায় সুসজ্জিত ছিলেন না ভাল ক্ষেত্রের যে তৃণ আজ আছে ও কাল চুলায় ফেলিয়া দেওয়া যাইবে, তা যদি ঈশ্বর এরূপ বিভূষিত করেন, তবে হে অল্প বিশ্বাসীরা, তোমাদিগকে কি আরও অধিক নিশ্চয় বিভূষিত করিবেন না? অতএব ইহা বলিয়া ভাবিত হইও না যে, “কি ভোজন করিব?বা “কি পান করিব”? বা “কি পরিব?কেননা পরজাতীয়েরাই এ সকল বিষয় চেষ্টা করিয়া থাকে; তোমাদের স্বর্গীয় পিতা-ত জানেন যে, এই সকল দ্রব্যে তোমাদের প্রয়োজন আছে কিন্তু তোমরা প্রথমে তাহার রাজ্য ও তার ধার্মিকতার বিষয়ে চেষ্টা কর, তাহলে ঐ সকল দ্রব্যও তোমাদের দেওয়া হইবে অতএব কল্যকার নিমিত্ত ভাবিত হইও না, কেননা কল্য আপনার বিষয় ভাবিত হইবে; দিনের কষ্ট দিনের জন্যই যথেষ্ঠ” (মথিঃ ৬ : ২৪-৩৪)

কুরআন ও বাইবেলের এ উক্তিগুলোর পটভূমি অভিন্ন সত্যের দাওয়াতের পথে এমন একটি পর্যায়ে এসে যায় যখন একজন সত্যপ্রিয় মানুষের জন্য উপকরণের জগতের সমস্ত সহায় ও নির্ভরতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিছক আল্লাহর ওপর ভরসা করে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না এ অবস্থায় যারা অংক কষে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিচার করে এবং পা বাড়াবার আগে প্রাণরক্ষা ও জীবিকা উপার্জনের নিশ্চয়তা খুঁজে বেড়ায় তারা কিছুই করতে পারে না আসলে এ ধরনের অবস্থা পরিবর্তিত হয় এমন সব লোকের শক্তির জোরে যারা প্রতিমুহূর্তে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সব ধরনের বিপদ মাথা পেতে নেবার জন্য নির্দ্ধিধায় এগিয়ে যায় তাদেরই ত্যাগ ও কুরবানীর ফলে শেষ পর্যন্ত এমন সময় আসে যখন আল্লাহর কালেমা বুলন্দ হয়ে যায় এবং তার মোকাবিলায় অন্য সমস্ত মত পথ অবনমিত হয়

﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ۖ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾

৬১ যদি১০০ তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো পৃথিবী ও আকাশসমূহ কে সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র ও সূর্যকে কে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন তাহলে অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ, এরপর এরা প্রতারিত হচ্ছে কোন দিক থেকে?  

১০০. এখান থেকে আবার মক্কায় কাফেরদের প্রতি বক্তব্যের মোড় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে

﴿اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾

৬২ আল্লাহই তার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা রিযিক প্রসারিত করে দেন এবং যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণ করে দেন নিশ্চিতভাবে আল্লাহ সব জিনিস জানেন 

﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّن نَّزَّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ مِن بَعْدِ مَوْتِهَا لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ۚ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ ۚ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ﴾

৬৩ আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত পতিত ভূমিকে সঞ্জীবিত করেছেন, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য১০১ কিন্তু অধিকাংশ লোক বোঝে না  

১০১. এখানে “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য” শব্দগুলোর দু’টি অর্থ প্রকাশিত হচ্ছে একটি অর্থ হচ্ছে, এসব যখন আল্লাহরই কাজ তখন একমাত্র তিনিই প্রশংসার অধিকারী অন্যেরা প্রশংসালাভের অধিকার অর্জন করলো কোথায় থেকে? দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, আল্লাহর শোকর, তোমরা নিজেরাও একথা স্বীকার করছো

﴿وَمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ ۚ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ﴾

৬৪ আর এ দুনিয়ার জীবন একটি খেলা ও মন ভুলানোর সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়১০২  

১০২. অর্থাৎ এর বাস্তবতা শুধুমাত্র এতটুকুই যেমন ছোট ছেলেরা কিছুক্ষণের জন্য নেচে গেয়ে আমোদ করে এবং তারপর যার যার ঘরে চলে যায় এখানে যে রাজা হয়ে গেছে সে আসলে রাজা হয়ে যায়নি বরং শুধুমাত্র রাজার অভিনয় করছে এক সময় তার এ খেলা শেষ হয়ে যায় তখন সে ঠিক তেমনি দীনহীন অবস্থায় রাজ সিংহাসন থেকে বিদায় নেয় যেভাবে এ দুনিয়ার বুকে এসেছিল অনুরূপভাবে জীবনের কোন একটি আকৃতিও এখানে স্থায়ী ও চিরন্তন নয় যে যে অবস্থায়ই আছে সাময়িকভাবেএকটি সীমিত সময়কালের জন্যই আছে মাত্র কয়েকদিনের জীবনের সাফল্যের জন্য যারা প্রাণপাত করে এবং এবং এরি জন্য বিবেক ও ঈমান বিকিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু আয়েশ আরামের উপকরণ ও শক্তি-প্রতিপত্তির জৌলুস করায়ত্ত করে নেয়, তাদের এ সমস্ত কাজ মন ভুলানো ছাড়া আর কিছুই নয় এসব খেলনার সাহায্যে তারা যদি দশ, বিশ বা ষাট সত্তর বছর মন ভুলানোর কাজ করে থাকে এবং তারপর শূন্য হাতে মৃত্যুর দরোজা অতিক্রম করে ভ্রমন জগতে পৌঁছে যায় সেখানকার স্থায়ী ও চিরন্তন জীবনে তাদের এ খেলা এক প্রতিপত্তিহীন রোগে পরিণত হয়, তাহলে এ ছেলে ভুলানোর লাভ কি?

﴿فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ﴾

৬৫ আসল জীবনের গৃহতো হচ্ছে পরকালীন গৃহ, হায়! যদি তারা জানতো১০৩ যখন তারা নৌযানে আরোহণ করে তখন নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নিয়ে তার কাছে প্রার্থনা করে তারপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে ভিড়িয়ে দেন তখন সহসা তারা শিরক করতে থাকে,  

১০৩. অর্থাৎ যদি তারা একথা জানতো, এ দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষার অবকাশ মাত্র এবং মানুষের জন্য আসল জীবন, যা চিরকাল স্থায়ী হবে, তা হচ্ছে আখেরাতের জীবন, তাহলে তারা এখানে পরীক্ষার সময় কালকে খেলা তামাশায় নষ্ট না করে এর প্রতিটি মুহূর্ত এমনসব কাজে ব্যবহার করতো যা সেই চিরন্তন জীবনের জন্য উৎকৃষ্ট ফলদায়ক হতো

﴿لِيَكْفُرُوا بِمَا آتَيْنَاهُمْ وَلِيَتَمَتَّعُوا ۖ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ﴾

৬৬ যাতে আল্লাহ প্রদত্ত নাজাতের ওপর তার অনুগ্রহ অস্বীকার করতে এবং দুনিয়ার জীবনের মজা ভোগ করতে পারে১০৪ বেশ, শিগগীর তারা জেনে যাবে  

১০৪. ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল করআন, সূরা আল আনআ’মঃ ২৯ ও ৪১ ; সূরা ইউসুফ ২৯ ও ৩১ এবং সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮৪ টীকা

﴿أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَمًا آمِنًا وَيُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنْ حَوْلِهِمْ ۚ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَةِ اللَّهِ يَكْفُرُونَ﴾

৬৭ তারা কি দেখে না, আমি একটি নিরাপদ হারম বানিয়ে দিয়েছি, অথচ তাদের আশেপাশে লোকদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়?১০৫ এরপরও কি তারা বাতিলকে মেনে নেবে এবং আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করবে?  

১০৫. অর্থাৎ তারা যে মক্কা শহরে বাস করে, যে শহরে তারা পূর্ণ নিরাপদ জীবন যাপন করছে, কোন লাত বা হুবল কি একে হারম তথা নিরাপদ স্থানে পরিণত করেছে? আরবের আড়াই হাজার বছরের চরম অশান্তি ও নৈরাজ্যের পরিবেশ এ স্থানটিকে সকল প্রকার বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় মুক্ত রাখার কি কোন দেবতা বা দেবীর সাধ্যায়াত্ত ছিল? আমি ছাড়া আর কে এর মর্যাদা রক্ষাকারী ছিল?

﴿وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْكَافِرِينَ﴾

৬৮ তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা সত্যকে মিথ্যা বলে,যখন তা তার সামনে এসে গেছে?১০৬ জাহান্নামই কি এ ধরনের কাফেরদের আবাস নয়?  

১০৬. অর্থাৎ নবী রিসালাতের দাবী করেছেন এবং তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছো এখন বিষয়টি দু’টি অবস্থা থেকে মুক্ত নয় নবী যদি আল্লাহর নাম নিয়ে মিথ্যা দাবী করে থাকেন, তাহলে তার চেয়ে বড় জালেম আর কেউ নেই আর যদি তোমরা সত্য নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে থাকো, তাহলে তোমাদের চেয়ে বড় জালেম আর কেউ নেই

﴿وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ﴾

৬৯ যারা আমার জন্য সংগ্রাম-সাধনা করবে তাদেরকে আমি আমার পথ দেখাবো১০৭   আর অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশালীদেরই সাথে আছেন  

১০৭. “সংগ্রাম-সাধনার” ব্যাখ্যা এ সূরা আল আনকাবুতের ৮ টীকায় করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সংগ্রাম-সাধনা করবে সে নিজের ভালোর জন্য করবে (আয়াতঃ ৬) এখানে এ নিশ্চিন্ততা দান করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর পথে আন্তরিকতা সহকারে সারা দুনিয়ার সাথে সংঘর্ষের বিপদ মাথা পেতে নেয় তাদেরকে পথ দেখান এবং তার দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন তারা তার সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন পথের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাদেরকে আলো দেখান যার ফলে কোনটা সঠিক পথ ও কোনটা ভুল পথ তা তারা দেখতে চায় তাদের নিয়ত যতই সৎ ও সদিচ্ছা প্রসূত হয় ততই আল্লাহর সাহায্য, সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও হিদায়াতও তাদের সহযোগি হয়

— সমাপ্ত —

শেয়ারঃ

সম্পাদকের ব্লগ

অনলাইন পাঠাগার

অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থ

সকল সূরা

০০১

আল ফাতিহা

মাক্কী

৭ আয়াত

০০২

আল বাকারাহ

মাদানী

২৮৬ আয়াত

০০৩

আলে ইমরান

মাদানী

২০০ আয়াত

০০৪

আন নিসা

মাদানী

১৭৬ আয়াত

০০৫

আল মায়িদাহ

মাদানী

১২০ আয়াত

০০৬

আল আনআ’ম

মাক্কী

১৬৫ আয়াত

০০৭

আল আ’রাফ

মাক্কী

২০৬ আয়াত

০০৮

আল আনফাল

মাদানী

৭৫ আয়াত

০০৯

আত তাওবা

মাদানী

১২৯ আয়াত

০১০

ইউনুস

মাক্কী

১০৯ আয়াত

০১১

হূদ

মাক্কী

১২৩ আয়াত

০১২

ইউসুফ

মাক্কী

১১১ আয়াত

০১৩

আর রা’দ

মাক্কী

৪৩ আয়াত

০১৪

ইব্রাহীম

মাক্কী

৫২ আয়াত

০১৫

আল হিজর

মাক্কী

৯৯ আয়াত

০১৬

আন নাহল

মাক্কী

১২৮ আয়াত

০১৭

বনী ইসরাঈল

মাক্কী

১১১ আয়াত

০১৮

আল কাহফ

মাক্কী

১১০ আয়াত

মারইয়াম

০২০

ত্বা-হা

মাক্কী

১৩৫ আয়াত

০২১

আল আম্বিয়া

মাক্কী

১১২ আয়াত

০২২

আল হাজ্জ

মাদানী

৭৮ আয়াত

০২৩

আল মু’মিনূন

মাক্কী

১১৮ আয়াত

০২৪

আন নূর

মাক্কী

১১৮ আয়াত

০২৫

আল ফুরকান

মাক্কী

৭৭ আয়াত

০২৬

আশ শুআ’রা

মাক্কী

২২৭ আয়াত

০২৭

আন নামল

মাক্কী

৯৩ আয়াত

০২৮

আল কাসাস

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০২৯

আল আনকাবূত

মাক্কী

৬৯ আয়াত

০৩০

আর রূম

মাক্কী

৬০ আয়াত

০৩১

লুকমান

মাক্কী

৩৪ আয়াত

০৩২

আস সাজদাহ

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৩৩

আল আহযাব

মাদানী

৭৩ আয়াত

০৩৪

আস সাবা

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৩৫

ফাতির

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৩৬

ইয়াসিন

মাক্কী

৮৩ আয়াত

০৩৭

আস সাফফাত

মাক্কী

১৮২ আয়াত

০৩৮

ছোয়াদ

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০৩৯

আয যুমার

মাক্কী

৮৮ আয়াত

০৪০

আল মু’মিন

মাক্কী

৮৫ আয়াত

০৪১

হা-মীম আস সাজদাহ

মাক্কী

৫৪ আয়াত

০৪২

আশ শূরা

মাক্কী

৫৩ আয়াত

০৪৩

আয যুখরুফ

মাক্কী

৮৯ আয়াত

০৪৪

আদ দুখান

মাক্কী

৫৯ আয়াত

০৪৫

আল জাসিয়াহ

মাক্কী

৩৭ আয়াত

০৪৬

আল আহক্বাফ

মাক্কী

৫৯ আয়াত

০৪৭

মুহাম্মাদ

মাদানী

৩৮ আয়াত

০৪৮

আল ফাতহ

মাদানী

২৯ আয়াত

০৪৯

আল হুজুরাত

মাদানী

১৮ আয়াত

০৫০

ক্বাফ

মাদানী

৪৫ আয়াত

০৫১

আয যারিয়াত

মাক্কী

৬০ আয়াত

০৫২

আত তূর

মাক্কী

৪৯ আয়াত

০৫৩

আন নাজম

মাক্কী

৬২ আয়াত

০৫৪

আল ক্বামার

মাক্কী

৫৫ আয়াত

০৫৫

আর রাহমান

মাদানী

৭৮ আয়াত

০৫৬

আল ওয়াকিআ’

মাক্কী

৯৬ আয়াত

০৫৭

আল হাদীদ

মাদানী

২৯ আয়াত

০৫৮

আল মুজাদালাহ

মাদানী

২২ আয়াত

০৫৯

আল হাশর

মাদানী

২২ আয়াত

০৬০

আল মুমতাহিনাহ

মাদানী

১৩৫ আয়াত

০৬১

আস সাফ

মাদানী

১৪ আয়াত

০৬২

আল জুমুআ’

মাদানী

১১ আয়াত

০৬৩

আল মুনাফিকুন

মাদানী

১১ আয়াত

০৬৪

আত তাগাবুন

মাদানী

১৮ আয়াত

০৬৫

আত তালাক্ব

মাদানী

১২ আয়াত

০৬৬

আত তাহরীম

মাদানী

১২ আয়াত

০৬৭

আল মুলক

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৬৮

আল কালাম

মাক্কী

৫২ আয়াত

০৬৯

আল হাককাহ

মাক্কী

৫২ আয়াত

০৭০

আল মাআ’রিজ

মাক্কী

৪৪ আয়াত

০৭১

নূহ

মাক্কী

২৮ আয়াত

০৭২

আল জিন

মাক্কী

২৮ আয়াত

০৭৩

আল মুযযাম্মিল

মাক্কী

২০ আয়াত

০৭৪

আল মুদ্দাসসির

মাক্কী

২০ আয়াত

০৭৫

আল কিয়ামাহ

মাক্কী

৪০ আয়াত

০৭৬

আদ দাহর

মাদানী

৩১ আয়াত

০৭৭

আল মুরসালাত

মাক্কী

৫০ আয়াত

০৭৮

আন নাবা

মাক্কী

৫০ আয়াত

০৭৯

আন নাযিআ’ত

মাক্কী

৪৬ আয়াত

০৮০

আবাসা

মাক্কী

৪২ আয়াত

০৮১

আত তাকবীর

মাক্কী

২৯ আয়াত

০৮২

আল ইনফিতার

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৮৩

আল মুতাফফিফীন

মাক্কী

৩৬ আয়াত

০৮৪

আল ইনশিকাক

মাক্কী

২৫ আয়াত

০৮৫

আল বুরূজ

মাক্কী

২২ আয়াত

০৮৬

আত তারিক

মাক্কী

১৭ আয়াত

০৮৭

আল আ’লা

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৮৮

আল গাশিয়াহ

মাক্কী

২৬ আয়াত

০৮৯

আল ফাজর

মাক্কী

৩০ আয়াত

০৯০

আল বালাদ

মাক্কী

২০ আয়াত

০৯১

আশ শামস

মাক্কী

১৫ আয়াত

০৯২

আল লাইল

মাক্কী

২১ আয়াত

০৯৩

আদ দুহা

মাক্কী

১১ আয়াত

০৯৪

আলাম নাশরাহ

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৫

আত তীন

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৬

আল আলাক

মাক্কী

১৯ আয়াত

০৯৭

আল কাদর

মাক্কী

৫ আয়াত

০৯৮

আল বাইয়্যিনাহ

মাক্কী

৮ আয়াত

০৯৯

আল যিলযাল

মাদানী

৮ আয়াত

১০০

আল আ’দিয়াত

মাক্কী

১১ আয়াত

১০১

আল কারিআ’হ

মাক্কী

১১ আয়াত

১০২

আত তাকাসুর

মাক্কী

৮ আয়াত

১০৩

আল আসর

মাদানী

৮ আয়াত

১০৪

আল হুমাযাহ

মাক্কী

৯ আয়াত

১০৫

আল ফীল

মাক্কী

৫ আয়াত

১০৬

কুরাইশ

মাক্কী

৪ আয়াত

১০৭

আল মাউন

মাক্কী

৭ আয়াত

১০৮

আল কাউসার

মাক্কী

৩ আয়াত

১০৯

আল কাফিরূন

মাক্কী

৬ আয়াত

১১০

আন নাসর

মাদানী

৩ আয়াত

১১১

আল লাহাব

মাক্কী

৫ আয়াত

১১২

আল ইখলাস

মাক্কী

৪ আয়াত

১১৩

আল ফালাক

মাক্কী

৫ আয়াত

১১৪

আন নাস

মাক্কী

৬ আয়াত